ষষ্ঠদশ অধ্যায় – বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস এবং বৈশিষ্ট্য
- বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সৃষ্টি ইতিহাস এবং চরিত্র ব্যতিক্রমধর্মী ছিল।
- পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সাথে করা হয় অবিচার।
- মুক্তিযোদ্ধাদের ২ বছরের সিনিয়রিটি দিয়ে সেনা বাহিনী এবং আমলাতন্ত্রের মত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ‘ডিভাইড এ্যন্ড রুল’ নীতির প্রবর্তন করা হয় জাতির মেরুদন্ড দুর্বল করে রাখার অভিপ্রায়ে।
- শেখ মুজিবের ভগ্নিপতি জনাব সাইদ হোসেনকে বানানো হল বেসামরিক প্রশাসনের একচ্ছত্র অধিপতি।
- সেনা বাহিনীর বিকল্প হিসাবেই গড়ে তোলা হয়েছিল রক্ষীবাহিনী।
- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত সবাইকে সামরিক বাহিনীতে পুননিয়োগ করা হয়।
- জিয়াকে ডিঙ্গিয়ে শফিউল্লাকে বানানো হল আর্মি চীফ অফ ষ্টাফ।
- সরকারের এই সিদ্ধান্ত সেনা বাহিনীতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
- শেখ মুজিব আমাকে ডেকে পাঠালেন
- কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে নিজেদের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এলাকাধীন উদ্বাস্ত জনগণের পূর্ণবাসনে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি আমরা।
- শেখ মুজিব জেনারেল শফিউল্লার মাধ্যমে এক আদেশ জারি করে আমাদের গণমুখী সব তৎপরতা বন্ধ করে দেন।
কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সৃষ্টি, ইতিহাস ও চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। পাকিস্তান স্বাধীন করার সংগ্রামে পূর্ব বাংলার জনগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটিশ সৃষ্ট শাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন-শোষণের যাতাকলে পিষতে থাকে। এরই ফলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে স্বৈরতন্ত্র বিরোধী জাতীয়তাবাদী এ সংগ্রামে গণতান্ত্রিক চেতনাও গড়ে উঠতে থাকে। সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল দেশ স্বাধীন করে গণতান্ত্রিক, জনগণের মৌলিক এবং মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে স্বনির্ভর সুষম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠিদের নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল তৎকালীন সেনা বাহিনী এবং প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বাঙ্গালী সদস্যদেরও। তাদের উপরও করা হয়েছিল অন্যায়-অবিচার। ফলে গোড়া থেকেই তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছেন জাতীয় সংগ্রামে। জাতীয় মুক্তির রাজনৈতিক সংগ্রামের চরম স্তরই ছিল ‘৭১ এর স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম। হানাদার বাহিনীর আচমকা হামলার মুখে যখন রাজনৈতিক নেতারা জাতিকে লক্ষ্যহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রেখে পালিয়ে যান তখন ঔপনিবেশিক ছাঁচে গড়া সেনা বাহিনীরই এক জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেনা বাহিনী, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যরাই প্রথম বিদ্রোহ করেন এবং কৃষক, শ্রমিক, যুবক, ছাত্র, প্রশাসনিক আমলাদের একাংশ এবং জনগণের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় দেশব্যাপী প্রতিরোধ সংগ্রাম। জনগণের সাথে সৈনিকদের চেতনা, আশা-আকাংখা এক হয়ে মিলে গিয়েছিল বলেই গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। পরবর্তিকালে নয় মাস জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন তারা। শ্রেণী বিন্যাসের সব বাধা ভেঙ্গে তারা নিজেদের পরিচয় কায়েম করেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন জনগণের সাথে এক হয়ে গিয়ে যুদ্ধ সংগঠিত করছিলেন তখন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বেশিরভাগ সদস্য ভারতে পালিয়ে গিয়ে ভারতীয় সরকারের সহায়তায় তথাকথিত মুজিবনগর প্রবাসী সরকার গঠন করে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের একক নেতৃত্বের দাবিদার হয়ে বসেন। যুদ্ধক্ষেত্রে না যেয়ে অবস্থান নেন কোলকাতার ৫৮নং বালিগঞ্জ, ৮নং থিয়েটার রোড এবং ১৯নং সার্কাস এ্যাভেনিউতে এভাবেই তারা নিজেদের ভারতীয় চক্রান্তের ক্রীড়ানকে পরিণত করেন। মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছিলেন তাদের আত্মত্যাগ, তিতিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তাদের সংগ্রাম আর তারই ফলে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে পরীক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব; যারা পরিচালিত করবে মুক্তি সংগ্রাম। স্বাধীনতার পর তারা গড়ে তুলবে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতীয় সেনা বাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে মুক্তিযুদ্ধ সেই স্বাভাবিক পরিণতি লাভ করতে পারেনি। ফলে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন তাদের বদলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চলে গেল আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে। কিন্তু কোলকাতা নিবাসী প্রবাসী সরকার ভারতীয় ছত্রছায়ায় নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সোলএজেন্ট বলে ঘোষণা করলেও তাদের চিন্তা-চেতনার সাথে মুক্তিযোদ্ধা এবং আপামর মুক্তিপাগল জনগণের চিন্তা-ভাবনার সাথে কোন মিল ছিল না। তাদের মূল এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল যে কোন উপায়ে বাংলাদেশের ভৌগলিক স্বাধীনতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রিয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। এভাবেই গণবিচ্ছিন্ন এই সুযোগ সন্ধানী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের এবং জনগণের মাঝে একটি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় সংগ্রামের প্রথমলগ্ন থেকেই। পরগাছা, স্বর্ণলতার মত অন্যের উপর নির্ভরশীল এ নেতৃত্বের দেউলিয়াপনার সুযোগ গ্রহণ করে দেশী-বিদেশী স্বার্থান্বেষী মহল নানাভাবে ইন্ধন যুগিয়ে এই দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করে তুলে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রবাসী আওয়ামী সরকারের মাঝে সন্দেহ এবং ব্যবধান সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। এ সম্পর্কে মেজর রফিকুল ইসলাম তার বই ‘বাংলাদেশঃ সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংকট’ – এ লিখেছেন, “এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথিতযশা রাজনীতিকরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শিক পটভূমি, চেতনা ও সংকল্প মুক্তিযুদ্ধকে অবধারিত করে তুলেছিল সেই চেতনাকে সংগ্রামী জনতার মধ্যে সঞ্চারের কোন প্রচেষ্টা ছিল না। এমনকি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষে কোন প্রচারণাও ছিল না। এসব কারণেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরাজয় হয়তো আজকে ইতিহাস সম্মত বলে প্রমাণিত হতে চলেছে।” তিনি আরো লেখেন, “একাত্তরের সর্বকালের সর্ববৃহৎ জনগণের মহান সংগ্রাম প্রলম্বিত হলে নেতৃত্ব প্রগতিশীল মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে; যারা সচেতন মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে যুদ্ধ শেষে তাদের ক্ষমতাবলে স্বাধীন বাংলাদেশের পরীক্ষিত জাতীয় নেতৃত্ব হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারে; এই ভেবে প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার আতংকিত হয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙ্গালী সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র সংগ্রামের বিকাশের পথে প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক কাঠামোর ভিত্তিতে গণমুখী সেনা বাহিনী গড়ে তোলার বদলে তারা ভারতীয় নীল নকশায় সমর্থন দান করে, ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্বাভাবিক পরিণতি বাধাগ্রস্থ হয়।”
ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে চলে যাবার পর আমাদের তরফ থেকে জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের জোর দাবি জানানো হয়েছিল সরকারের কাছে। এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সরকারি মহল থেকে জোর প্রচারণা চালানো হয়, “বাংলাদেশের মত শান্তিপ্রিয় দরিদ্র একটি দেশের জন্য সেনা বাহিনীর কি প্রয়োজন? বাংলাদেশের তিন দিক ঘিরে রয়েছে ভারত। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সাথে রয়েছে মৈত্রী চুক্তি। সেখানে যুদ্ধ হবে কার সাথে? অন্য কোন তৃতীয় শক্তির পক্ষ থেকে আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের উপর কোন হুমকি এলে চুক্তি অনুযায়ী বন্ধুরাষ্ট্রই আমাদের রক্ষা করবে।” কি উদ্ভট যুক্তি।। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী মিত্র বা শত্রু বলে কিছু নেই। সব সম্পর্কই পরিবর্তনশীল। তাছাড়া জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী যে কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সুস্পষ্ট জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির অধিনে সম্পদের সংকুলান অনুযায়ী ধাপে ধাপে একটি সুসংগঠিত সামরিক বাহিনী আমাদের গড়ে তুলতে হবে নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই। সেই বাহিনীর দায়িত্ব হবে সমর্থ ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তোলা। অনেক দর কষাকষির পর সরকার অনুমতি দিল সেনা বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল- মুক্তি বাহিনীর নিয়মিত বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমম্বয়ে গড়ে তোলা হবে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রংপুর এবং যশোর সেনা নিবাসের পাচঁটি ব্রিগেড। এই ব্রিগেডগুলোকে পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা হবে পূর্ণাঙ্গ ডিভিশন রূপে। একই সাথে নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনীর অবকাঠামোও গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
যেসব বাঙ্গালী সৈনিকরা ঔপনিবেশিক ধাচেঁ গড়া সেনা বাহিনীর কাঠামো ভেঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের আবার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হল। গড়ে তোলা হল পুরনো ধাচেঁর সশস্ত্র বাহিনী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনা বাহিনীর সদস্যদের বেশিরভাগই তখন হয়ে উঠেছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন। এই সচেনতার বিকাশ ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাই বিশ্বের অন্যান্য গতানুগতিকভাবে সৃষ্ট সেনা বাহিনীগুলোর ধাঁচে তাদের আবার সংগঠিত করলেও চারিত্রিকভাবে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহৎ অংশই ছিলেন নিঃস্বার্থ অকুতোভয়, দেশপ্রেমিক কর্তব্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, স্পষ্ট বক্তা মুক্তিযোদ্ধারা কোন অন্যায়কে মেনে নেননি যুদ্ধের সময় থেকেই। সীমিত গন্ডির ভেতরে থেকেও তারা সব অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন: সুযোগ মত অন্যায়কে প্রতিহত করার চেষ্টাও করেছেন সাধ্যমত। তাই ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণায় এ ধরণের চরিত্রের সেনা বাহিনীকে জাতির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ব্যারাকে আবদ্ধ রাখার চিন্তা-ভাবনা ছিল নেহায়েতই অবাস্তব। সেনা বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সমাজ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। দেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের প্রতি জনগণের মত তারাও স্বাভাবিকভাবে ছিলেন সদা সচেতন। সেই কারণেই ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারণায় সেনা সদস্যদের জাতির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ব্যারাকে আবদ্ধ করে রাখার সরকারি প্রচেষ্টা ফলদায়ক হয়নি বাংলাদেশের সেনা বাহিনীর ক্ষেত্রে। জনগণ ও সেনা সদস্যদের মাঝে গড়ে উঠা দেশপ্রেমের অটুট বন্ধনের গভীরতা অনুধাবন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন আওয়ামী-বাকশালী শাসকগোষ্ঠি। সৈনিকদের ব্যারাকে আবদ্ধ করে রাখলেও তাদের সিংহভাগই দেশের রাজনৈতিক গতিধারার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে চলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কারণেই। শুধু বাইরেই তার প্রকাশ ছিল না। এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে পুরনো ধাঁচের রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে পশ্চিমা শাসকদের স্থলাভিষিক্ত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ শাসন করতে গিয়েও চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সেনা বাহিনীর মধ্যেও বিক্ষোভ ধূমায়িত হয়ে উঠতে থাকে।
প্রশ্ন দেখা দিল পাকিস্তানে আটক অবস্থায় থাকা ৩০,০০০ বাঙ্গালী সৈনিকদের কি করা হবে। যদিও তারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি তবুও তাদের বেশিরভাগই ছিলেন দেশপ্রেমিক এবং বাংলাদেশের প্রতি অনুগত এবং সমর্থক। তাই তাদের দেশে ফিরে আসার পর পূর্ণমর্যাদায় নিয়োগ করাই যুক্তিসঙ্গত হবে ফলে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেন। কেউ কেউ বললেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের সেনা বাহিনীতে থাকবে শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই। যুদ্ধবন্দীরা দেশে ফিরে এলে সামরিক বাহিনীর বিধান অনুযায়ী তাদের সামরিক বাহিনী থেকে অব্যাহতি দিয়ে বেসামরিক ক্ষেত্রে নিয়োগ করা উচিত।” সরকার সিদ্ধান্ত নিল, “পাকিস্তান প্রত্যাগতদের সামরিক বাহিনীতেই নিয়োগ করা হবে।” একই সাথে সরকারি সিদ্ধান্তে বলা হল, “মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেয়া হবে পাকিস্তান প্রত্যাগতদের উপর।’ এভাবেই সেনা বাহিনীর মধ্যে সুস্পষ্ট ফাটল সৃষ্টি করল আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের এ সুদূরপ্রসারী চক্রান্তে সমর্থন জানিয়েছিলেন মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক উচ্চাভিলাষী এবং সুযোগ সন্ধানী সিনিয়র অফিসার। বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতির প্রয়োগ করে যে চরম সর্বনাশা খেলা শুরু করেছিলেন শেখ মুজিবর রহমান তার খেসারত জাতি এবং সেনা বাহিনীকে চরমভাবে দিতে হয়েছে পরবর্তিকালে।
এছাড়া অন্যায়ভাবে কোন কারণ ছাড়াই মেজর জিয়াউর রহমানকে সুপারসিড করে মেজর শফিউল্লাহকে সেনা বাহিনীর প্রধান নিয়োগ করে শেখ মুজিব সেনা বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেন। এভাবেই সেনা বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে জাতির মেরুদন্ড সেনা বাহিনীকে দুর্বল করে রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন শেখ মুজিব। সামরিক বাহিনীতে বিভেদ নীতি প্রণয়ন করার সাথে সাথে বিএলএফ পরবর্তিকালে মুজিব বাহিনী এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সেনা বাহিনীর মোকাবেলায় তৈরি করা হয় জাতীয় রক্ষীবাহিনী। সেনা বাহিনী গঠন করার অনুমতি সরকার দিলেও সেনা বাহিনীকে গড়ে তোলার তেমন কোন উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা সরকারিভাবে নেয়া হয়নি মুজিব আমলে। পক্ষান্তরে রক্ষীবাহিনীকে সামরিক বাহিনীর চেয়ে বেশি শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ভারতীয় সহযোগিতায়। রক্ষীবাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছিল ভারতীয় সেনা বাহিনীর উপর। তাদের পোষাকও ছিল ভারতীয় সেনা বাহিনীর পোষাকের মতো। ভারত সরবরাহ করে তাদের গাড়ি, অস্ত্র-শস্ত্র, সাজ-সরঞ্জাম, রসদপত্র এবং আনুসাঙ্গিক সমস্ত কিছু। এদের অফিসারদের প্রশিক্ষণ হত দেড়াদুনের ভারতীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সৈনিকদের ভারতীয় বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ দিত ঢাকার অদূরে সাভারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সম্পাদক জনাব তোফায়েল আহমদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হত রক্ষীবাহিনী। সামরিক অধিনায়ক ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত প্রাক্তন পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সদস্য কর্নেল নূরুজ্জামান। রক্ষীবাহিনী সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য অত্যাচার করত। জনসাধারণ ক্রমশঃ রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি বিরূপ হয়ে পড়ে। রক্ষীবাহিনীর সস্যদের যে কাউকে বিনা বিচারে বন্দী এবং হত্যা করার ক্ষমতা প্রদান; অপরাধীদের দেশের প্রচলিত আইনে বিচার না করে গোপনে হত্যা করার প্রচলন এবং আওয়ামী লীগ বিরোধীদের নির্বিচারে অত্যাচার নিপীড়নের ফলে আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবের ভাবমুর্তি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। তাছাড়া ভারতীয় বাহিনীর অনূরূপ জলপাই রং-এর পোষাক জনগণের মনে অবিশ্বাস ও সন্দেহের সৃষ্টি করে। তাদের মনে ধারণা জন্মে, প্রয়োজনে মৈত্রী চুক্তির আওতায় আওয়ামী সরকার মতলব হাসিল করার জন্য যে কোন সময় রক্ষীবাহিনীর আবরণে ভারতীয় বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরেও ডেকে নিয়ে আসতে পারে। উপযুক্ত কোন এক সময় বাংলাদেশ সেনা বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে সরকার রক্ষীবাহিনীকেই সেনা বাহিনী হিসেবে অধিষ্ঠিত করবে; এ ধরণের কথাও শোনা যাচ্ছিল সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এ ধরণের বৈরী মনোভাবে এবং অবহেলায় সেনা বাহিনীর সদস্যরা মনঃক্ষুন্ন হন।
একইভাবে দেশের বেসামরিক প্রশাসনিক অবকাঠামোকে দুর্বল করে তোলার জন্য সেখানেও বিভেদ নীতির প্রবর্তন করা হয়। তাজুদ্দিন সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল সদ্যমুক্ত বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো ভারতীয় আমলাদের সাহায্যে ঢেলে সাজাতে। কিন্তু তার সে প্রচেষ্টা বাঙ্গালী আমলাদের তীব্র বিরোধিতার ফলে কার্যকরী করা সম্ভব হয়নি। পরিণামে বাংলাদেশের বেসামরিক আমলারাও মুজিব সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাননি। সেনা বাহিনীর সদস্যদের মত তাদেরও সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে মুজিব সরকার। এভাবে জাতীয় জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় দু’টো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের দেশপ্রেমের যথার্থ মূল্যায়ন না করে তাদের প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। বেসামরিক প্রশাসনকে সম্পূর্নরূপে দলীয় নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য আওয়ামী সরকার অভিজ্ঞ আমলাদের বাদ দিয়ে সে সমস্ত পদে দলীয় লোক নিয়োগের এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের দলীয় সমর্থকদের মাঝ থেকে প্রায় ৩০০ তরুণ যুবককে পাঠানো হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার পর তাদের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ করা হয়। এদের বলা হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস (আইএমস) ক্যাডার। এছাড়া পুরো বেসামরিক প্রশাসনের সর্বময় কর্তা হয়ে উঠেন শেখ মুজিবের বোনের জামাই জনাব সাইদ হোসেন। জনাব হোসেন ছিলেন একজন সেকশন অফিসার। রাতারাতি পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসন পরিচালনার সব ক্ষমতাই অলিখিতভাবে তার হাতে সঁপে দেন শেখ মুজিব। শেখ মুজিবের সমর্থনপুষ্ট জনাব সাইদ হোসেন সমস্ত বেসমারিক প্রশাসন চালাতে থাকেন অঙ্গুলী হেলনে। ফলে আমলাতন্ত্রের মধ্যেও অবক্ষয় শুরু হয়ে যায়। এটাও ছিল নীল নকশা বাস্তবায়নেরই একটি সূক্ষ্ম চাল।
বাংলাদেশ সেনা বাহিনী গঠন পর্বের শুরুতে আমি কুমিল্লাতে পোষ্টেড হই। কর্নেল জিয়াউর রহমান ছিলেন আমাদের প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার। কুমিল্লাতে থাকাকালীন অবস্থায় তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নতি লাভ করেন। জেনারেল ওসমানী তখনও আমাদের কমান্ডার-ইন-চীফ। তার হেডকোয়টার্স তখন ২৭নং মিন্টু রোডে। অল্প কিছুদিন পর সেনা বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি মন্ত্রীসভায় যোগদান করেন। সাধারণ নিয়মে জেনারেল ওসমানীর পর ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকেই আর্মির সিনিয়র মোষ্ট অফিসার হিসেবে চীফ অফ আর্মি ষ্টাফ বানানো উচিত ছিল। কিন্তু অত্যান্ত অন্যায়ভাবে জিয়াউর রহমানকে তার ন্যায্য পদ থেকে বঞ্চিত করা হল। স্বাধীনতার ঘোষক হওয়ার ফলেই আওয়ামী লীগ সরকার তার প্রতি এ ধরণের অবমাননাকর আচরণ করে তার জুনিয়র ব্রিগেডিয়ার শফিউল্লাহকে আর্মি চীফ অফ ষ্টাফ পদে নিযুক্ত করে। অস্বাভাবিক এ পদোন্নতির ফলে শফিউল্লাহ শেখ মুজিব ও তার সরকারের একান্ত বিশ্বস্ত এবং অনুগত তাবেদার হয়ে তাদের খেদমত করতে শুরু করে। আর্মির স্বার্থ ও নিয়ম জলাঞ্জলী দিয়ে শফিউল্লাহ শেখ মুজিব ও তার সরকারের ইচ্ছা ও স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতে থাকে। এর ফলেই মুজিব ভক্ত কয়েকজন অফিসারকে উত্তরোত্তর পদোন্নতি দিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণ করা হল নিয়ম বর্হিভূতভাবে। মুজিব সরকারের এ সমস্ত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আর্মির তরুণ দেশপ্রেমিক অংশ সোচ্চার হয়ে উঠেন। আর্মির মধ্যে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে জানতে পেরে শেখ মুজিবর রহমান একদিন আমাকে ডেকে পাঠান 1
পারিবারিক সূত্রে ঘনিষ্টতার কারণে তিনি খবরা-খবর নেয়ার জন্য প্রায়ই আমাকে ডেকে পাঠাতেন। বিশেষ প্রয়োজনে আমিও অবাধে ৩২নং ধানমন্ডিতে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারতাম। যখনই আমি ও বাড়িতে গিয়েছি, সবসময় দেখেছি লোকের ভীড়; সবাই তাকে ঘিরে রাখছে। কিন্তু কম লোকজনকেই দেখেছি তার সামনে কোন প্রশ্নের সঠিক এবং সত্য জবাব দিতে। বেশিরভাগ লোকই তোষামোদ করে যা বললে তিনি খুশি হন সেটাই বলত। আশ্চর্য হতাম তাদের চাটুকারিতা এবং মোশায়েবীপনায়। দর্শনার্থীরা একথা সেকথার পর সুবিধামত নিজের ব্যক্তিগত কাজটি বাগিয়ে নিয়ে কেটে পড়তেন। এটাই ছিল নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। তিনি আমাকে বিশেষভাবে স্নেহ করতেন। মুজিব পরিবারের অন্য সবাইও আমাকে এবং আমার স্ত্রী নিম্মীকে খুবই ভালোবাসতো। পাকিস্তান থেকে ফেরার পর ১৯৭২ সালে আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে তিনি স্বপরিবারে উপস্থিত হয়ে আমাদের আশীর্বাদ করেছিলেন। সে অনুষ্ঠানই ছিল তার বাংলাদেশে আসার পর প্রথম কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিতি। পুরো মন্ত্রী পরিষদও উপস্থিত ছিলেন সে অনুষ্ঠানে। আমি ও আমার পরিবারবর্গ রাজনৈতিকভাবে তার দল ও রাষ্ট্র পরিচালনা করার নীতিকে সমর্থন না করলেও তাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। নিজের কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য আমি তার কাছে কখনোই যাইনি। যেতাম সত্যকে তার কাছে তুলে ধরার জন্য ভাবতাম, সবাই যেখানে চাচাগিরী করছে সেখানে সাহস করে সত্যকে তার সামনে তুলে ধরলে তিনি নিশ্চয়ই তা অনুধাবন করতে পারবেন এবং এতে করে তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে তার সুবিধা হবে। তার রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটবে।
৩২নং ধানমন্ডিতে গিয়েই তার সাথে দেখা করলাম। তিনি জানতে চাইলেন শফিউল্লাহকে সেনা প্রধান বানানোর সিদ্ধান্তের ফলে সেনা বাহিনীতে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছে? আমি পরিষ্কারভাবে তাকে জানালাম- তার এ সিদ্ধান্ত সেনা বাহিনীতে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। আমি তাকে বলেছিলাম অন্যায়ভাবে ব্রিগেডিয়ার জিয়াকে তার ন্যায্য পদে নিয়োগ না করে শেখ মুজিব অত্যন্ত ভুল করেছেন। কারণ এ সিদ্ধান্তে শুধু যে প্রচন্ড বিক্ষোভই সেনা বাহিনীতে সৃষ্টি হয়েছে তা নয়; সরকার এবং সেনা বাহিনীর মাঝে ভুল বুঝাবুঝিরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সবাই তাকেই একান্তভাবে দায়ী করেছে জিয়াউর রহমানের প্রতি এ অবিচার করার জন্য। ফলে তারই ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে সেনা বাহিনীর সর্বস্তরের সদস্যদের কাছে। অবিলম্বে এ ভুলের সংশোধন হওয়া উচিত। আমার বক্তব্য শুনে শেখ মুজিব সেদিন বলেছিলেন, কর্নেল ওসমানীর পরামর্শ অনুযায়ীই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তিনি। সিদ্ধান্ত বদলিয়ে এই মূহুর্তে শফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে চীফ বানানো তার জন্য বিব্রতকর হয়ে দাড়াবে। তিনি এ জবাব দিয়েছিলেন তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে। তবে তিনি কথা দিয়েছিলেন কিছুদিন পর জিয়াউর রহমানকে চীফ-অফ-ষ্টাফ বানানোর কথা তিনি পুনর্বিবেচনা করবেন। তার এ বক্তব্য অনেক কারণেই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তবুও আমি তার প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম যতদিন শফিউল্লাহ চীফ থাকেন ততদিন ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে সাধারণ ব্রিগেড কমান্ডার কিংবা চীফ-অফ-ষ্টাফের পিএসও হিসাবে না রেখে উপপ্রধান হিসাবে নিয়োগ করলে সেনা বাহিনীতে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে সেটা অনেকাংশে কমে যাবে। জনাব মুজিব আমাকে কথা দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে তিনি চিন্তা-ভাবনা করে দেখবেন। তিনি আমাকে একইসাথে অনুরোধ করেছিলেন, তার এই অভিমত ব্যক্তিগতভাবে ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে জানাতে এবং সেনা বাহিনীর মধ্যে প্রচার করতে। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবের নির্দেশে আর্মিতে DCOS (ডেপুটি চীফ-অফ-ষ্টাফ) পদ সৃষ্টি করা হয় এবং মেজর জেনারেল হিসাবে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াউর রহমানকে সে পদে নিয়োগ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, যোগ্য চীফ- অফ-ষ্টাফ হিসাবে জনাব শফিউল্লাহর পদমর্যাদাও ছিল মেজর জেনারেল। আমাদের সবার প্রিয় জেনারেল জিয়াউর রহমানের চীফ-অফ-ষ্টাফ পদে উন্নতির যে প্রতিশ্রুতি প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন তার বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রইলাম আমরা। জিয়াউর রহমানের জায়গায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে পোষ্টেড হলেন আমার পূর্ব পরিচিত এবং সুহৃদ কর্নেল তাহের।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত সেনা বাহিনীতে অবকাঠামো গড়ে তোলা ছিল অত্যন্ত দূরূহ কাজ : আমাদের প্রয়োজনীয় প্রায় কিছুই নেই তখন। নেই পর্যাপ্ত হাতিয়ার, ইকুইপ্টমেন্ট, পোশাক-পরিচ্ছদ, নেই টুপি, বুট, প্রয়োজনীয় রশদপত্র এবং প্রশিক্ষণের সরঞ্জাম। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে কুমিল্লায় সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ক্যান্টনমেন্টকে বাসপযোগী করে গড়ে তোলার সাথে সাথে আমাদের অপারেশন এরিয়াতে গিয়ে পুর্নঃগঠন কাজে জনগণকে আমরা সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করব। রাস্তাঘাট মেরামত, ব্রিজ কালভার্ট ঠিক করা, বাড়ি-ঘর তৈরির কাজে সাহায্য করা হবে। হেলথ সার্ভিস, ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুল কলেজগুলোকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি কাজে আমরা স্থানীয় জনগণের প্রচেষ্টায় সাহায্য করব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের উদ্ধুদ্ধ করেছিল এ ধরণের উদ্যোগ নিতে। আমাদের এ উদ্যোগকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানিয়েছিল জনগণ। এই ধরণের কর্মতৎপরতায় আমরা জনগণের মনে এই ধারণা জন্মাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, শোষণমূলক পাক বাহিনী এবং বাংলাদেশের সেনা বাহিনীর মধ্যে মূল্যবোধ ও চারিত্রিক ব্যাতিক্রম রয়েছে। বাংলাদেশের সেনা বাহিনী জনগণের সেবায় নিবেদিত প্রাণ এবং দেশপ্রেমিক। জনগণকে শোষণ এবং নির্যাতন করার জন্য এ সেনা বাহিনীকে ব্যবহার করা যাবে না। সেনা বাহিনীর জনপ্রিয়তাই শুধু যে বেড়ে গিয়েছিল আমাদের তৎপরতায় তাই নয়; আমাদের সম্পর্কে জনগণের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্ভরশীলতা। আমাদের এ ধরণের গঠনমূলক তৎপরতার সাফল্যের কথা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের সর্বত্র। আমাদের সাফল্য এবং ইতিবাচক দিকগুলো অন্যান্য ফরমেশনের দেশপ্রেমিক সচেতন অংশের মাঝে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল। যার ফলে অন্যান্য জায়গায় বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরাও এ ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এ ধরণের গণমুখী ভূমিকা পালনের জন্য অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শাসকমহল এমনকি সেনা বাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠিও আতংকিত হয়ে উঠে। জনগণের সাথে সেনা বাহিনীর এ ধরণের সুসম্পর্ক এবং বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে উঠাকে তারা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশ জুড়ে তখন ব্যাপক রিলিফ তৎপরতা চলছিল। রিলিফ বিতরণের ক্ষেত্রে স্থানীয় এবং কেন্দ্রিয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অসাধুতার কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনেরা রিলিফ পাচ্ছিলেন না। আমরা আমাদের অধিনস্ত এলাকায় রিলিফ বিতরণের ব্যাপারে সবরকম দুর্নীতির বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা ঠিকমত রিলিফ সামগ্রী পান। এতে বিশেষভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের স্বার্থে আঘাত লাগে ফলে তারা আমাদের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে চটে যান। এরই ফলে পার্টি প্রধান শেখ মুজিব জেনারেল শফিউল্লাহর মাধ্যমে এক আদেশ জারি করে আমাদের গণমুখী সমস্ত তৎপরতা বন্ধ করে দেন। আদেশের স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে প্রচার চালানো হয়- সেনা বাহিনী সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নয়।