ষষ্ঠ অধ্যায় – ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এবং গ্রেন্ড কনফারেন্স
- বিএলএফ এর সাথে না জড়িয়ে মুক্তি বাহিনীর সাথে কাজ করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা তিনজনেই।
- লেঃ মতি এবং আমাকে গেরিলা এ্যাডভাইজার করে সেক্টরগুলোতে পাঠাবার এবং লেঃ নূরকে তার PSO/ADC হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত I
- বালিগঞ্জ থেকে ৮ নং থিয়েটার রোডে।
- মতি চলে গেল উত্তর পশ্চিম সীমান্তের সেক্টরগুলোর দায়িত্ব নিয়ে।
- কর্নেল ওসমানী আমাকে নিয়ে গেলেন ৮ নং এবং ৯ নং সেক্টরে।
- রনাঙ্গনের ব্যস্ততা ও অভিজ্ঞতা।
- শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারী আর যুব ক্যাম্পের যুবকদের চিন্তা- চেতনায় ছিল আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
- বয়রা সেক্টরে প্রথমবারের মত আহত হলাম।
- ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বীর জোয়ানরা ৮ নং সেক্টরে যোগদান করেছিল।
- গ্রেন্ড কনফারেন্সের ঠিক আগে নীতির প্রশ্নে আপোষহীন কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ করলেন।
- অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কমান্ডার ইন চীফ কর্নেল ওসমানীকে বাদ দিয়েই গ্রেড কনফারেন্স শুরু হল।
- উদ্বোধনী ভাষণে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানালেন কমান্ডারদের একাংশের অনাস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই কর্নেল ওসমানী সেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।
- তার ঐ বক্তব্য উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে চরম অসন্তোষ এবং উত্তেজনার সৃষ্টি করে ফলে কনফারেন্স স্থগিত হয়ে যায়।
- মুক্তিযোদ্ধাদের চাপের মুখে প্রবাসী সরকার কর্নেল ওসমানীর পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নেবার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়।
- চানক্যদের চক্রান্ত ব্যর্থ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মপ্রত্যয় বেড়ে যায়।
- সেক্টরসমূহের সীমানা নির্ধারন, রনকৌশল এবং সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল কনফারেন্সে।
- সফলভাবে কনফারেন্স শেষ হল।
আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত কর্নেল ওসমানীকে জানিয়ে দিলাম। ভারতীয় নীল নকশার সঙ্গে সরাসরিভাবে জড়িয়ে পরতে চাই না আমরা। রাজনৈতিক একটি দলের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য গঠিত ঠেঙ্গারে বাহিনীর নেতা হওয়ার খায়েশ নেই আমাদের তিনজনের একজনেরও। আমরা এতদূর থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসেছি অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই যুদ্ধ করব আমরা। কর্নেল ওসমানীর সাজেশান অনুযায়ী গেরিলা অ্যাডভাইজার হয়ে সেক্টর কমান্ডারদের সাহায্য করে মুক্তিফৌজ (অনিয়মিত বাহিনী) গঠন করার দায়িত্ব নিয়ে তখনই কাজে যোগদানের সিদ্ধান্ত জানালাম আমরা। কর্নেল ওসমানী আমাদের জবাবে খুশি হলেন। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিল ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে কি বলা যায়। তারা যদি জানতে পারে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের ইচ্ছার বিরোধিতা করেছি তবে অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠবে। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কর্নেল ওসমানী ঠিক করলেন, যদি প্রশ্ন উঠে তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তিনি বলবেন, BLF কিংবা মুজিব বাহিনীর মত রাজনৈতিক একটি বাহিনী তৈরি করার দায়িত্ব সার্বিকভাবেই থাকা উচিত রাজনৈতিকভাবে সচেতন পরীক্ষিত ব্যক্তিবর্গের হাতে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মতে আমাদের তিনজনের একজনেরও সে ধরণের রাজনৈতিক ওরিয়েন্টেশন অথবা কমিটমেন্ট কোনটাই নেই। Therefore we are not fit for such as
as important assignment. Some more politically conscious persons have to be found out to lead such a highly politisized force. সময় মত তাদের এ যুক্তি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিলেন। ফলে ‘চার খলিফা’কেই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় BLF তথা মুজিব বাহিনী গড়ার। আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম রাহুগ্রাস থেকে। আমাকে গেরিলা অ্যাডভাইজার টু দ্যা সেক্টর কমান্ডার হিসাবে ৮নং এবং ৯নং সেক্টরে পোষ্টিং অর্ডার ইস্যু করে দেন কর্নেল ওসমানী। মতিকেও একই দায়িত্ব দেয়া হল ১০ এবং ১১ নং সেক্টরে। নূরের সব যুক্তিকে খন্ডন করে প্রায় জোর করেই তাকে কর্নেল ওসমানী পার্সোনাল ষ্টাফ অফিসার হিসেবে নিয়োজিত করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন কলকে কেন্দ্র করে বহুমূখী চক্রান্তের সূচনা ঘটে।
জনাব ওসমানীর ঘরে এক রাত কাটানোর পর পার্ক সার্কাস ময়দানের কাছেই একটি খালি স্কুল ঘরে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে যেতাম ৫৮নং বালিগঞ্জের হেডকোয়াটার্সে। ফিরতাম অনেক রাতে। খাবারের ব্যবস্থা ছিল ৫৮ নং বালিগঞ্জে। একদিন কর্নেল ওসমানী বললেন, “অস্থায়ী সরকার ও মুক্তিফৌজ হেডকোয়টার্স এর জন্য একটি জায়গা ভারত সরকার নির্ধারন করেছে। চল জায়গাটা দেখে আসা যাক উপযুক্ত কিনা।” বালিগঞ্জের বাড়িটা নেহায়েতই ছোট। সবসময় অসংখ্য লোকজন ভীড় করে থাকে। নিরাপত্তা রক্ষা করা দুঃস্কর, কথাটা অতি সত্য। সর্বক্ষণ অগুনিত লোক মাছির মত ভনভন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক কামরা ছেড়ে অন্য কামরায়, কেউবা এমপি, কেউবা জাদরেল আমলা, কেউবা নেতাদের বিশেষ পরিচিত এবং আস্থাভাজন চামচা। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য নেতা পাতি-নেতার ভীড়। গায়ে মানেনা সকলেই আপনে মোড়ল। যার যার হাতে প্রত্যেকেই সাড়ে তিন হাত। গেটে প্রহরীরা কিছু জিজ্ঞাসা করলেই লংকাকান্ড বেধে যায়। সবাই যারা আসছেন তাদের ভাবসাব হচ্ছে, ‘আমরা কি হনুরে’। সবার পরিধানে নতুন নতুন কাপড়-চোপড়। হাল ফ্যাশনের অন্ত নেই। দিব্যি হেলেদুলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দেখা হলে দাত বের করে নিজের পরিচয় দিয়ে খাজুড়ে আলাপ জমিয়ে তুলতে চেষ্টা করছেন। ঢালাওভাবে ভাত, গোস্ত আর ডাল রান্না হচ্ছে কিচেনে। যে আসছেন সেই খাচ্ছেন নির্দ্বিধায়। কেউ কাউকে কিছু বলছেন না। ভুড়ি ভোজনের পর বিভিন্ন ঘরে চেয়ারের উপর, বসার বেঞ্চে এমনকি টেবিলের উপরও সটান হয়ে শুয়ে পড়ে দিবা নিদ্রা কিংবা রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করে নিতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করছেন না এ সমস্ত ভিআইপি ব্যক্তিদের দল। প্রত্যেকের হাতে একটা নতুন ব্রিফকেস কিংবা ছোট এট্যাচী। কোন কোন নেতার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। তারা যা কিছুই করছেন এ সমস্ত জিনিসগুলোও থাকছে তাদের সাথে সাথে। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাবার সময়ও সেগুলো সাথে নেয়া হচ্ছে, পাছে হারিয়ে যায়। ব্যাপার কি? এ সমস্ত ব্রিফকেস, এট্যাচী এবং ঝোলায় কি এমন দুর্লভ জিনিষ রয়েছে ভেবেই পাচ্ছিলাম না। রহস্যটা মতিই উৎঘাটন করল কিছুদিন পর। ও জানাল,
—স্যার, সমস্ত ডিস্ট্রিক্ট ও সাব-ডিভিশন থেকে মুক্তিফৌজের সাথে বর্ডার ক্রস করে আসার সময় ব্যাংক ট্রেজারীগুলো সব উজাড় করে নিয়ে এসেছেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। যার ভাগ্যে যতটুকু পরেছে সেগুলো রাখা আছে এ সমস্ত ব্রিফকেসে, এট্যাচীতে এবং ঝোলায়। তাই এগুলোকে এভাবে হেফাজত করা হচ্ছে।
—বল কি?
— বিশ্বাস না হয় পরীক্ষা করে দেখেন? বলল মতি
একদিন কোন এক অজানা মহারথী তার মাথার নিচে ব্রিফকেসটা রেখে খাবার পর সুখনিদ্রা দিচ্ছিলেন। ঘুমের ঘোরে ব্রিফকেসটা মাথার নিচ থেকে সরে গিয়েছিল। আশেপাশে কাউকে না দেখে মতি সেটা চট করে তুলে নিয়ে খুলে ফেলল। ভদ্রলোকের ব্রিফকেসে তালা ছিল না। খুলতেই মতি ও আমার চোখ চড়কগাছ। একি। থরে থরে সাজানো পাকিস্তানী পাচঁশত টাকার নোটের বান্ডিলে ব্রিফকেসটা বোঝাই। ব্রিফকেসটা নিয়ে আমরা চুপিসারে কেটে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর ঘুম থেকে উঠে ভদ্রলোক তার ব্রিফকেসের হদিস না পেয়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলে হায় হায় করতে লাগলেন। আরদালীকে পাঠিয়ে ভদ্রলোককে ডেকে পাঠালাম। তিনি এলেন।
জিজ্ঞেস করলাম,
—কি ব্যাপার? এতো হৈ চৈ করছেন কেন?
—আমার ব্রিফকেস চুরি হয়ে গেছে। তিনি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন।
—কি ছিল তাতে?
—আমার কিছু কাপড় ও প্রয়োজনীয় জরুরী কিছু কাগজপত্র ছিল।
টাকা সম্পর্কে সবটাই গোপন করলেন ভদ্রলোক। ইতিমধ্যে নূর উঠে গিয়ে পাশের ঘরে কর্নেল ওসমানীকে সবকিছু খুলে বলেছে। সব শুনে কর্নেল ওসমানী আমরা যে ঘরে বসেছিলাম সেখানে আসেন। তিনি ভদ্রলোককে অনেকভাবে জেরা করেন। ভদ্রলোক টাকার কথা সম্পূর্ণ চেপে গিয়ে ঝোলাতে শুধু কিছু কাপড় ও জরুরী কাগজপত্র ছিল সে কথাই কর্নেল ওসমানীকে জানান। সব শুনে কর্নেল ওসামানী নূরকে আদেশ করেন ব্রিফকেসটি ভদ্রলোককে ফিরিয়ে দিতে। ইতিমধ্যেই ব্রিফকেস থেকে প্রায় ১২ লাখ টাকা আলাদা করে রেখে দেওয়া হয়েছিল। কাপড়-চোপড় ও কিছু কাগজপত্রসহ ব্রিফকেসটি ভদ্রলোককে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তিনি তাড়াতাড়ি ব্রিফকেস খুলে দেখেন টাকা ছাড়া অন্য সবকিছুই ঠিক আছে। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিন্তু অবস্থা বেগতিক বুঝে ব্রিফকেস বন্ধ করে নিয়ে আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে সুর সুর করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এরপর সেই ভদ্রলোককে আর কখনও দেখিনি পুরো ৯ মাস সংগ্রামকালে। উদ্ধারকৃত টাকাটা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে জমা করে দেয়া হয়। এ ঘটনার অবতারনা এখানে এজন্য করলাম, তখন তথাকথিত মুজিবনগর সরকারের কার্যালয় দেখে বোঝা কষ্ট হত যে একটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম চলছে বাংলাদেশে। আর সে সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন প্রবাসী বালিগঞ্জস্থ লোকজন। যে সমস্ত লোকজন তখন অকারণে বালিগঞ্জের বাড়িতে ভীড় করে সর্বদা ঘুর ঘুর করতেন তাদের হাবভাব দেখে মনে হত সবাই যেন বরযাত্রী হয়ে এসেছেন কোন দূরদেশ থেকে। কোন ভাবনা নেই, কোন চিন্তা নেই। নির্বিঘ্নে হেসে খেলে সময় কাটিয়ে আনন্দেই আবার ফিরে যাবেন তারা।
৮নং থিয়েটার রোডের বাড়িটা দেখতে গেলাম কর্নেল ওসমানী, আমি, মতি, নূর ও ব্রিগেডিয়ার গুপ্তা এবং কর্নেল ভোরা। বালিগঞ্জের বাড়িটা থেকে এটা অনেক বড়। চারদিক উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা। ভেতরটা বিশাল জমিদার বাড়ির মত। বাড়িটি পুরনো কায়দায় গড়া। একপাশে বড় বড় দু’টো ব্যারাক রয়েছে। তাছাড়া পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে তাবু অথবা টেম্পোরারী সেল্টার গড়ে তোলার জন্য। বড় বড় গাছপালায় ছায়া সুনিবিড় একটা শান্ত পরিবেশ। বাইরে থেকে ভেতরের কিছুই দেখা যায় না। বাড়িটা সবদিক দিয়েই বালিগঞ্জের বাড়িটা থেকে অনেক ভাল। সবাই একবাক্যে এটা গ্রহণীয় বলে মত দিলেন। আমরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে বালিগঞ্জ ছেড়ে উঠে এলাম ৮নং থিয়েটার রোডে। নতুন জায়গায় এসেই কর্নেল ওসমানী নূরকে আদেশ দিলেন নিরাপত্তা রক্ষার জন্য লোকজনের আসা-যাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা কড়াকড়ি করতে হবে। ঠিক হল পারমানেন্ট রেসিডেন্টদের জন্য স্থায়ী আইডি কার্ড এবং অনুমতি সাপেক্ষে টেম্পোরারী ভিজিটারদের জন্য পাশ ইস্যু করবে লেফটেন্যান্ট নূর। এভাবে অপ্রয়োজনীয় লোকদের ভীড় কমানো সম্ভব হবে। বিএসএফ এর সেন্ট্রিদের কড়া নির্দেশ দেয়া হল এ ব্যাপারে। আমরা আমাদের অস্থায়ী বাসস্থান স্কুল ছেড়ে চলে এলাম থিয়েটার রোডের হেডকোয়াটার্সে। প্রধান বিল্ডিং এর একটি ঘরে থাকবেন কর্নেল ওসমানী এবং নূর। প্রধানমন্ত্রীর জন্যও একটি ঘর বরাদ্দ করা হল। ব্যারাকের ঘরগুলোতে আমি, ক্যাপ্টেন চৌধুরী, গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার এবং চীফ অব ষ্টাফ কর্নেল রব এর থাকার বন্দোবস্ত হল। অন্যান্য ঘরগুলোকে বিভিন্ন পরিদপ্তরের অফিস বানানো হল। কর্মচারীদের জন্যও থাকার বন্দোবস্ত হল। সি-ইন-সির দপ্তর থেকে সার্কুলার জারি করল নূর, “পারমানেন্ট ষ্টাফ ছাড়া অন্য সবার জন্য হেডকোয়াটার্সে ঢুকবার, থাকবার এবং খাবার জন্য লিখিত অনুমতি আগেই সি-ইন-সির সেক্রেটারীয়েট মানে লেফটেন্যান্ট নূর এর কাছ থেকে নিতে হবে।” এ ধরণের নিয়ম প্রবর্তনে সবাই প্রথমে বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে পড়লেন। কিন্তু নিয়মের কোন ব্যতিক্রম করা হল না। অসন্তোষ আস্তে আস্তে কমে এল। সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে হল। অন্যদিকে ১৯ নং সার্কাস এ্যাভেনিউ মানে বাংলাদেশ মিশন হয়ে উঠেছিল একটা বাজার। জনাব হোসেন আলী এবং তার প্রশাসন তেমন কোন নিয়ম প্রবর্তন করে কার্যকর করতে ব্যর্থ হন। ফলে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা সেখানে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে লোকের ভীড় লেগেই থাকল। ব্যাপারটা হাস্যকর এবং coincidental হলেও নিয়তির হেরফের বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রধান দু’টো কর্মস্থলই প্রতিষ্ঠিত হল থিয়েটার রোড এবং সার্কাস এ্যাভিনিউতে। আমরা সবাই যেন হয়ে উঠলাম থিয়েটার এবং সার্কাসের খেলোয়াড়। থিয়েটার রোড থেকে কর্নেল ওসমানী একদিন আমাকে নিয়ে চললেন ৮নং সেক্টর হেডকোয়টার্স বনগাঁয়, সাথে নূর। শহর থেকে প্রায় ৯০-৯৫ মাইল দূরে যশোর বর্ডারের গা ঘেসে বনগাঁ। ওখানে পৌঁছে কর্নেল ওসমানী আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর ওসমান এবং ৯নং সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জলিলের সাথে। তাদের বিস্তারিত ব্রিফিং দিলেন তিনি। সেখানে পরিচয় হল বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাফিজ, লেফটেন্যান্ট হালিম, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিন, পুলিশের এসডিপিও মাহবুব, সিএসপি কামাল সিদ্দিকী এবং তৌফিক এলাহী চৌধুরী ও লেফটেন্যান্ট মাহবুবের সাথে। ওরা সবাই আমাকে সাদর অভিনন্দন জানালেন। দুপুরের খাওয়ার পর কর্নেল ওসমানী নূরকে নিয়ে ফিরে গেলেন। যাবার আগে জানিয়ে গেলেন শীঘ্রই তিনি সেক্টর কমান্ডারদের একটি গুরত্বপূর্ণ কনফারেন্স ডাকবেন কোলকাতায়। সে কনফারেন্সে মুক্তিযুদ্ধের বর্তমান স্তর এবং ভবিষ্যত রনকৌশল ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে কর্মপদ্ধতি ঠিক করা হবে। থিয়েটার রোড ছেড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে পৌঁছে ভীষণ ভালো লাগছিল। মতিও আমি চলে আসার পরপরই উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের সেক্টরগুলোর দায়িত্ব নিয়ে চলে যায়। শুরু হল নতুন কর্মজীবন। খুলনা, যশোরের ছিন্নমূল ও বিক্ষিপ্ত অনেক ইপিআর, কিছুসংখ্যক নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদদের নিয়ে মেজর ওসমানের অধিনে শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। তার সাথে যোগ দেয় স্থানীয় ছাত্র-জনতা। নড়াইলের তরুণ এসডিও জনাব কামাল সিদ্দিকী, মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরী এবং মাগুরার এসডিও ওয়ালীউর রহমানও প্রতিরোধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মেজর ওসমান তার অধিনস্ত সমস্ত নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের ৭টি কোম্পানীতে বিভক্ত করে সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের নিয়োগ করেন।
১) প্রথম কোম্পানী উত্তরে মহেশকুন্ড বিওপি এলাকায় লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীরের অধিনে।
২) দ্বিতীয় কোম্পানী তার দক্ষিনে ইছাখালী বিওপি এলাকায়। কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী।
৩) তৃতীয় কোম্পানী আরো দক্ষিনে জীবননগর বিওপি এলাকায়। নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মোস্তাফিজুর রহমান।
৪) চতুর্থ কোম্পানী কাশিমপুর-মুকুন্দপুর-বয়ড়া এলাকায় ক্যাপ্টেন খন্দোকার নাজমুল হুদার অধিনে।
৫) পঞ্চম কোম্পানী বেনাপোল কাস্টমস্ চেকপোষ্ট এলাকায় লেফটেন্যান্ট আবদুল হালিমের অধিনে। এ কোম্পানী পরবর্তী পর্যায়ে ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী সিএসপির অধিনে দেওয়া হয়।
৬) ষষ্ঠ কোম্পানী আরও দক্ষিনে বকশা-কাকডাঙ্গা-বেনাপোল থানার এলাকায় ক্যাপ্টেন শফিকউল্লার অধিনে।
৭) সপ্তম কোম্পানী ভোমরা এলাকার গোজভাঙ্গায় ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিনের অধিনে।
মে মাসের শেষে ক্যাপ্টেন সালাহ্উদ্দিনকে হেডকোয়ার্টারসে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব নেয়ার জন্য চলে যেতে হয় মুজিবনগর তথা ৮নং থিয়েটার রোডে। তখন ঐ সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিনকে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রাক্তন ফ্ল্যাইট লেফটেন্যান্ট জামালউদ্দিন এমপি, ক্যাপ্টেন ওয়াহাব এবং লেফটেন্যান্ট এনামুল হক ৮নং সেক্টরে যোগদান করেন। ফ্ল্যাইট লেফটেন্যান্ট জামালউদ্দিনকে সেক্টর হেডকোয়াটার্স এ ষ্টাফ অফিসার হিসাবে নিয়োজিত করা হয়।
যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক বাহিনীর ব্যূহ ভেদ করে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে যুদ্ধ করতে করতে বর্ডার পেরিয়ে ৮নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দেন ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অকুতোভয় সেনারা। বেনাপোল বর্ডার পর্যন্ত মাত্র ১৮৮ জন সৈনিককে জীবিত অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল হাফিজ। পুরো রেজিমেন্টের বাকি সবাই যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। বেনাপোল পৌঁছে সেক্টর হেডকোয়াটার্স এর কাছেই সে তার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। বনগাঁ বিওপির বিপরীতে মুক্ত এলাকায় বাংলাদেশের পতাকা সমুন্নত রাখার পবিত্র দায়িত্ব যথাযথ বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গলের বীর জোয়ানরা শেষদিন পর্যন্ত পালন করেছিলেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ আমার বিশেষ বন্ধু বিধায় ওর সাথেই আমার থাকার বন্দোবস্ত করি।
বরিশাল ও খুলনায় একইভাবে ২৫শে মার্চ রাতের পর থেকে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন জলিল। তিনি ছিলেন আর্মড কোরের একজন সৈনিক এবং পরে মেধাবলে অফিসার হয়েছিলেন তিনি। পুলিশ বাহিনীর অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেই তিনি শুরু করেন প্রতিরোধ সংগ্রাম। তার সাথে যোগ দেন লেঃ মেহেদী, লেঃ জিয়া এবং লেঃ নাসের। এছাড়াও তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, লেঃ খুরশীদ প্রমুখ। লেফটেন্যান্ট খুরশীদ তথাকথিত আগরতলা মামলার একজন আসামীও ছিলেন। এরপর এমএ বেগ নামে একজন যুবক এসে নবম সেক্টরে যোগ দেয়। তিনি পাকিস্তান সেনা বাহিনীর একজন দক্ষ প্যারাস্যুট জাম্পার ও ফ্রগম্যান হিসেবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিক বিধায় পরে তাকে নৌবাহিনীতে শীপম্যান হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। ৯নং সেক্টরকে গঠন করা হয় খুলনার কিছু অংশ, ফরিদপুরের কিছু অংশ এবং পুরো বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন ক্যাপ্টেন জলিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথমার্ধে বরিশাল, পটুয়াখালীতে ক্যাপ্টেন মেহেদী, খুলনার সুন্দরবন এলাকায় লেঃ জিয়া এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ক্যাপ্টেন হুদা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। জুলাই মাসে ৯নং সেক্টরকে পুনর্গঠিত করা হয়। বরিশাল জেলার দায়িত্ব দেয়া হয় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরকে। পটুয়াখালীর দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন মেহেদীকে। সুন্দরবন ও খুলনার দায়িত্ব দেয়া হয় লেঃ জিয়াকে। পিরোজপুর, বাগেরহাট এলাকা দেয়া হয় সুবেদার তাজুল ইসলামকে। ক্যাপ্টেন হুদাকে দেয়া হয় সীমান্তবর্তী এলাকা। সেক্টর হেডকোয়টার্স প্রথম স্থাপন করা হয় হাসনাবাদে। পরে সরিয়ে নেয়া হয় টাকীতে। সেক্টর হেডকোয়াটার্সে থাকতেন ক্যাপ্টেন জলিল, এডজ্যুটেন্ট এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ফ্ল্যাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক ও মফিজ। এদের সাথে ষ্টাফ অফিসার হিসেবে ছিল ক্যাপ্টেন আরিফিন। সেক্টরের প্রধান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল তকিপুর। ইনচার্জ ছিলেন সুবেদার গোলাম আজম। ৯নং সেক্টরের নৌবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন চীফ পেটি অফিসার এম ইউ আলম। সুন্দরবনে লেঃ জিয়ার অধিনে ছিলেন ফুল মিয়া ও মধু। প্রথম পর্যায়ে টাকী, হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ এবং শমসের নগরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হল। এরপর হিঙ্গলগঞ্জের ক্যাম্প উক্শা পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়। এরপর বরিশাল, খুলনা অঞ্চলে ক্রমে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। সীমিত পরিমাণের অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে ক্যাপ্টেন জলিল ও তার সহযোদ্ধারা অবস্থার মোকাবেলা করতে পারছিলেন না। প্রয়োজন অস্ত্রের। অস্ত্রের অন্বেষনে জনাব মঞ্জুর এমপি ২৪শে এপ্রিল সুন্দরবন হয়ে ভারত এসে তার পরিচিত বিএসএফ এর কয়েকজন কর্মকর্তার সহযোগিতায় অল্প কিছু হাতিয়ার নিয়ে ফিরে এসে ক্যাপ্টেন জলিলকে জানালেন যে তিনি ভারতে গেলে আরো অস্ত্র পেতে পারেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন হুদা ও মঞ্জুরকে নিয়ে ক্যাপ্টেন জলিল ভারতের পথে রওনা হলেন। ভারত সীমান্তের ওপারে ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ইনসপেক্টর মি পি কে ঘোষ তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। সেখান থেকে বিএসএফ এর নিরাপত্তার অধিনে তারা এসে পৌঁছলেন হিঙ্গলগঞ্জে। এখানে তাদের পরিচয় হল অধিনায়ক পান্ডের সাথে। সেখান থেকে হাসনাবাদ হয়ে ব্যারাকপুর। বিএসএফ এর প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী তাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। হাসনাবাদে গণপরিষদের সদস্য মিঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর পূর্ব পরিচিত বন্ধু ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং এর সাথেও পরিচয় হয়েছিল তাদের। ব্যারাকপুরে ৭২নং বিএসএফ এর অফিসার্স মেসেই তাদের থাকার বন্দোবস্ত করে দেয় এডজ্যুটেন্ট ক্যাপ্টেন সরকার। মিঃ মুখার্জী তাদের কোলকাতায় নিয়ে গিয়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বর্ডার নিরাপত্তা বাহিনীর ডেপুটি ইনসপেক্টর জেনারেল মিঃ মজুমদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাকে মেজর জলিল জানালেন অধিনায়ক হিসেবে মুক্তি সংগ্রাম এবং দেশের জন্য তিনি অনেক কিছুই করতে পারেন অস্ত্র সাহায্য পেলে। কি অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োজন তা মিঃ মজুমদারকে জানানো হল। ওই দিন সন্ধ্যায় কেলকাতা আসাম হাউজে বর্ডার নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিঃ রুস্তমজীর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হল। তার সাথে আলাপের পর মিঃ মুখার্জী তাদের নিয়ে গেলেন ফোর্ট উইলিয়ামে। পূর্বাঞ্চলের সামরিক বাহিনীর সদর দফতর ফোর্ট উইলিয়াম। সেখানে তাদের জেরা করেন বিশেষ গোয়েন্দা বিভাগের কর্নেল খেরা। খেরার সাথে তাদের বিশদ আলাপ-আলোচনা হল। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন কোথায় কোথায় তারা থেকেছেন, কি কি করেছেন তা পুংখানুপুংখভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি। সব প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হয়েছিল মেজর জলিল এবং দলের সবাইকে। সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সাথেও সাক্ষাৎ হল তাদের। তাকে সবকিছু খুলে বলেছিলেন ক্যাপ্টেন জলিল। মানচিত্রে বাংলাদেশের কোথায় কোথায় তার গেরিলা ঘাটি রয়েছে তাকে বিস্তারিত দেখান হয়েছিল। ফলে জেনারেল অরোরা তাকে অস্ত্রাদি দিতে সম্মত হন। ৫ই মে পর্যন্ত তাকে কোলকাতায় থাকতে হয়।
ইতিমধ্যে বরিশালের পতন হওয়ায় মিঃ মঞ্জুর, নাসের, ক্যাপ্টেন হুদা পরিবার-পরিজন নিয়ে হাসনাবাদে পৌঁছলে ওদের ক্যাম্পে রেখে ক্যাপ্টেন জলিল প্রায় চল্লিশজন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে দু’টো লঞ্চে ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করে বরিশালের দিকে রওনা হলেন। কিন্তু ভুল ট্যাকটিক্যাল মুভের জন্য সুন্দরবন এলাকায় তার লঞ্চ দু’টো পাকিস্তান নৌবাহিনী অ্যামবুশ করে। দু’তিনজন সাথীকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাপ্টেন জলিল অতি কষ্টে প্রাণে বেচে হাসনাবাদ ফিরে আসেন। ক্যাপ্টেন জলিলের এভাবে ভারতে আসা এবং মুজিবনগর সরকার এবং কর্নেল ওসমানীর হেডকোয়াটার্সকে বাইপাস করে সরাসরি ভারতীয় ইষ্টার্ন কমান্ডের সাথে যোগাযোগ করে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে যাবার সিদ্ধান্তে কর্নেল ওসমানী ও মুজিবনগর অস্থায়ী সরকার ভীষণভাবে চটে যান। তার অদূরদর্শিতা ও হঠকারী প্ল্যানিং এর ফলে এতগুলো হাতিয়ার হারানোর জন্যও তার প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন কর্নেল ওসমানী। তার এ ধরণের নিয়মবর্হিভূত কাজের জন্য তাকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে অপসারনের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পরে আমাদের সবার অনুরোধে কর্নেল ওসমানী তার সিদ্ধান্ত কার্যকরী করা থেকে বিরত হন। তবে কর্নেল ওসমানী তাকে ডেকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন এ ধরণের গাফিলতি ভবিষ্যতে দ্বিতীয়বার বরদাস্ত করা হবে না।
ইতিমধ্যে ঝড়ের বেগে আমার কাজ এগিয়ে চলেছে। কৃষ্ণনগর থেকে তকীপুর, সমস্ত সেক্টর আমি ঝাটিকা সফর করে বেড়াচ্ছি। আমার মূল দায়িত্ব যুবশিবির ও শরনার্থী শিবির থেকে গেরিলাদের রিক্রুট করে তাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা। সাথে সাথে সেক্টর ট্রুপসদের প্রশিক্ষন ও অপারেশনে সাব সেক্টর কমান্ডারদের সাহায্য করা। এরই ফাকে ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে পুনর্গঠিত করার কাজেও ক্যাপ্টেন হাফিজকে সাহায্য করছিলাম যতটুকু সম্ভব। রাতদিন পরিশ্রম করে জুন মাসের মধ্যেই প্রায় হাজার দশেক গেরিলা রিক্রুট করে ফেলেছিলাম। তাদেরকে ২০০ থেকে ৫০০ এর একটি ব্যাচে বিহারের চাকুলিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের ট্রেনিং এ পাঠানো হচ্ছিল। একই সাথে যুব শিবির এবং সাব সেক্টরগুলোতেও আমরা কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। সেক্টরের নিয়মিত বাহিনীর অভিজ্ঞ সৈনিকরা গেরিলাদের হালকা অস্ত্র, গ্রেনেড, ডেমোলিশন, রেইড, অ্যামবুশ, আনআর্মড কাম্বেট, ম্যাপ রিডিং, আরবান এবং জঙ্গল ওয়ারফেয়ার, অবসট্যাকলস প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষন দিচ্ছিলেন। লাইভ ফায়ারিং এর বন্দোবস্তও করা হয়েছিল টেম্পোরারী রেঞ্জ তৈরি করে। একই সাথে চলছিল মটিভেশন ক্লাশ।
এখানে রিক্রুটিং এর কাজে নিয়োজিত থাকাকালে একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। যুদ্ধকালে প্রায় এক লাখের মত মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নেয়। কিন্তু এর মধ্যে শতকরা একভাগও শরনার্থী শিবিরের লোক ছিল না। শরনার্থী শিবিরের আশ্রয় গ্রহণকারী বেশিরভাগ লোকই ছিলেন হিন্দু। তাদের মধ্যে খুব কম লোকের মাঝেই ট্রেনিং গ্রহণ করে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ দেখা যেত। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে শরনার্থী শিবিরে যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারা পরিবারের সব সদস্য নিয়েই সেখানে থাকত। জীবন বাচাঁনোর জন্য দু’বেলা দু’মুঠো আহারের নিশ্চয়তাও শিবিরে তাদের ছিল। বাংলাদেশ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার মত তাদের খুব বেশি কেউই ছিল না। শিবিরে তাদের জীবনের নিরাপত্তাও ছিল। তাদেরকে নিরাপদে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা কারা করছে, কিভাবে করছে, এ নিয়ে তাদের তেমন কোন মাথাৰ্য্যাথা ছিল না। মনে মনে হয়তো বা তারা চাইত কষ্টের কাজটুকু অন্যে করুক, তারা একদিন ধীরে সুস্থে ফিরতে পারলেই হয়। শরনার্থী শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকেরই আবার পশ্চিমবঙ্গে আত্মীয়-স্বজন বিভিন্ন শহর গ্রামে পার্টিশনের সময় এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার চাপ এড়াতে বয়স্করা যুবকদের বর্ডার থেকে দূরে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দিত। ওরা সেখানে কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করে জীবন চালাত। শরনার্থীদের মধ্যে এবং নিছক প্রাণের ভয়ে যারা দেশত্যাগ করেছিল তাদের মধ্যে সুবিধাবাদী মনোবৃত্তিই লক্ষ্য করা গেছে। যুদ্ধে তাদের বিশেষ কোন অবদান ছিল না। কিছু থাকলে তা ছিল পরিস্থিতি সাপেক্ষে, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নয়। অনেক ক্ষেত্রে শরনার্থী শিবিরগুলোতে খুঁজেও সমর্থ লোক পেতাম না। পাওয়া যেত শুধু বুড়ো মানুষ, শিশু ও মহিলাদের।
এরই বিপরীত অবস্থা ছিল যুব শিবিরগুলোতে। হাজার হাজার তরুণ, যুবক, ছাত্র/ছাত্রী, সমাজের অন্যান্য পেশাজীবি, সমর্থ ছেলেদের ভীড়ে প্রতিটি যুব শিবিরই ভরে থাকত সবসময়। বাসস্থানের সংকুলানের অভাবে অনেককে ফিরিয়েও দেয়া হত বাধ্য হয়ে। তারা তাদের আত্মীয়-পরিজনদের বাংলাদেশে ফেলে রেখে ছুটে আসত সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে ট্রেনিং গ্রহণ করে হাতিয়ার নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে খান সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। তারা অতি কষ্টকর পরিবেশে যুব শিবিরে দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে অনেকক্ষেত্রে অভূক্ত থেকে উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করত কবে তাদের রিক্রুট করে ট্রেনিং এ পাঠানো হবে। শতকষ্টে ও তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। প্রত্যেকের মধ্যে দেখেছি প্রতিশোধের স্পৃহা এবং দেশকে স্বাধীন করার অঙ্গীকার। আজ একটি কথা স্পষ্ট করে স্বীকার করছি, শরনার্থী শিবিরে পালিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে যারা নিরাপদ জীবন-যাপন করেছিল তাদের তুলনায় হাজার রকমের ভয়ভীতি, অজানা আশংকা ও সমূহ বিপদের মোকাবেলা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙ্গালী যারা দেশেই থেকে গিয়েছিল, স্বাধীনতার জন্য তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অবদানের মূল্য কোন অংশে কম নয়। তাদের অনেককেই দিতে হয়েছে চরম আহুতি।
ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সহায়তায় ক্যাপ্টেন জলিলের ফোর্ট উইলিয়ামের পূর্বাঞ্চলীয় হেডকোয়াটার্সের কর্মকর্তাদের সাথে গোপন যোগাযোগ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠল। ভারতীয় সরকার শুধুমাত্র প্রবাসী সরকার এবং মুক্তি বাহিনীর সদর দপ্তরের মাধ্যমেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল তা নয়, তারা ক্ষমতাধর কমান্ডারদের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল। অত্যন্ত চতুরতার সাথে তারা তাজুদ্দিনের প্রবাসী সরকারের মধ্যে অর্ন্ত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে তাকেও দুর্বল করে চাপের মুখে রাখছিল যাতে তিনি তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে বাধ্য হন। অপরদিকে মুজিবনগর সরকার ও মুক্তিযোদ্ধের সর্বাধিনায়ক জনাব ওসমানীর মধ্যেও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে কর্নেল ওসমানীর ক্ষমতা সীমিত করে রাখা হচিছল একইভাবে। কর্নেল ওসমানীকে সাইড ট্র্যাক করে প্রবাসী সরকার ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের এ ধরণের কার্যকলাপে কর্নেল ওসমানী অতি যুক্তিসঙ্গত কারণেই ভীষণভাবে অপমানিত বোধ করছিলেন। তার বক্তব্য ছিল পরিষ্কার। ভারত বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের বক্তব্য অনুযায়ী মানবিক কারণে সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছে সেটার জন্য বাঙ্গালী জাতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামটা পূর্ব বাংলার ৮ কোটি বাঙ্গালীর নিজস্ব সংগ্রাম। এ সংগ্রাম তাদেরই সংগঠিত করতে হবে। যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে তাদেরকেই অর্জন করতে হবে জাতীয় স্বাধীনতা, সংগ্রামের নেতৃত্ব ও সব দায়িত্বও থাকতে হবে মুক্তিফৌজ কমান্ড ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধিন। জনাব ওসমানী নীতির এ প্রশ্নে কখনোই আপোষ করেননি। এ বিষয় নিয়ে তৎকালীন প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বের সাথে অনেক বিতর্ক হয়েছে তার। কিন্তু তার এ নীতির প্রতি সমর্থন দেননি আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ নেতৃত্ব ও গণপরিষদ সদস্যরা। তারা তখন নিজ নিজ ক্ষমতার বলয় তৈরি করতে ব্যস্ত। তাদের প্রায় সবার মাঝেই এক ধরণের উদ্ভট চিন্তা কাজ করছিল। শুধু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দই নয় অনেক আমলা এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধাবাদী নেতৃত্বের মাঝেও সেই একই চিন্তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল। তাদের ধারণা ছিল মুক্তিযুদ্ধ যে কারণেই হোক শুরু হয়ে গেছে। প্রতিরোধ সংগ্রামকালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব অঞ্চল থেকে কোটি কোটি টাকা ও সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে হিজরত করে চলে আসা হয়েছে নিরাপদ আশ্রয় ভারতে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বলতে লজ্জা লাগলেও বলতে হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা অনেক বুদ্ধিজীবি ও হোমরা-চোমরা পদস্থ ব্যক্তিরাও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ মুক্তি সংগ্রামকে দেখতেন অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিতে। তারা মনে করতেন বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারা কখনই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশ স্বাধীন করতে সক্ষম হবে না। পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করতে সরাসরি ভারতীয় সেনা বাহিনীর হস্তক্ষেপ অবশ্যই অতি প্রয়োজনীয়। রক্তক্ষয়ী দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা অথবা যোগ্যতা তাদের অনেকেরই ছিল না। যুদ্ধের ঝুঁকি এবং কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতেও তারা ছিলেন নারাজ। এতে করেই তাড়াতাড়ি ‘হজ্জ’ শেষ করে প্রবাসী জীবনের কষ্ট থেকে রেহাই পেয়ে দেশে ফিরে লুটপাটের কালো টাকার আয়েশী জীবন খুব তাড়াতাড়ি আবার শুরু করতে পারা যাবে একমাত্র ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমেই : ভারতে হজ্জ্ব করার স্ট্যাম্প যখন একবার নিতে সক্ষম হয়েছেন তারা তখন দেশে ফেরার পর তাদের রাজ কায়েম করার পথে বাধা কোথায়? তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশটাকে স্বাধীন করে দেবার জন্য তাদের একাংশ গোড়া থেকেই ভারত সরকারের বিভিন্ন মহলে জোর লবিং শুরু করে দিয়েছিলেন। সমস্ত প্রবাসী সরকারের মধ্যে শুধুমাত্র দু’জন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ ধরণের উদ্যোগের বিরোধিতা দৃঢ়তার সাথে করে গিয়েছিলেন। তাদের একজন হলেন কর্নেল ওসমানী এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ। এই দুইজন ছাড়া সিনিয়র রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রায় সবাই এবং আমলাদের উচ্চপদস্থ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনেকেই ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পক্ষপাতিত্ত্ব করছিলেন। পরবর্তিকালে Scissorian Operation এর মাধ্যমে বাংলাদেশের Premature birth এর জন্য মূলতঃ এরাও দায়ী ছিলেন অনেকাংশে। কিন্তু বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা, আমলাতন্ত্রের তরুণ সদস্যরা এভাবে অপরের কৃপায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার উদ্যোগের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এ নিয়ে প্রবীণদের সাথে তরুণদের দ্বন্দ্ব ক্রমশঃই বেড়ে উঠছিল প্রতিদিন ।
ইতিমধ্যেই ৮ই জুলাই কোলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন ডাকা হয় কর্নেল ওসামানীর নির্দেশে। কিন্তু সম্মেলনের কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই একদিন ঘটল এক ঘটনা। ক্যাবিনেট মিটিং এ কর্নেল ওসমানী প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিনকে পরিষ্কার ভাষায় হুশিয়ারী দিয়ে বললেন, “ভারতের গোয়েন্দা ও সেনা বাহিনীর কর্তৃপক্ষ যদি মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালাতে থাকেন তবে শুধুমাত্র শিখন্ডী কমান্ডার ইন চীফ হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব থেকে আমি স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেব।” তিনি মিটিং এ
তিনি মিটিং এ জনাব তাজুদ্দিনকে প্রশ্ন করেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামটা কাদের সংগ্রাম? এটা যদি ভারতের সংগ্রাম হয়ে থাকে তবে আমরা সবাই কি তাদের হাতে ক্রিয়াণক হয়ে ইসলামাবাদ থেকে দিল্লীতে তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী স্থানান্তরের প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি?” ঐ বক্তব্যের পর তিনি একটি পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সকলকে স্তম্ভিত করে সভা কক্ষ ত্যাগ করেন। কথাটা মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত থিয়েটার রোড হেডকোয়াটার্সে ছড়িয়ে পড়ল। আমরা ইয়াং অফিসার যারা সেখানে উপস্থিত ছিলাম তাদের মাঝে ভীষণ উত্তেজনা সৃষ্টি হল। আমাদের হাবভাব দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে থিয়েটার রোড ছেড়ে সংসদ সদস্যদের দল, মন্ত্রীবর্গ সবাই কেটে পড়লেন। আমরা সোজা প্রধানমন্ত্রীকে গিয়ে অনুরোধ জানালাম, “যে করেই হোক কর্নেল ওসমানীকে আপনার আশ্বাস দিতে হবে যাতে তাকে বাইপাস করে ভারতীয়রা কোন কিছু না করে। আপনি যদি এ আশ্বাস তাকে দিতে পারেন তবে আমরা তাকে তার পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ জানাব এবং যে করেই হোক তাকে রাজি করাব। এটা যদি আপনি করতে ব্যর্থ হন তবে দু’দিন পর সেক্টর কমান্ডারদের যে মিটিং এখানে হবে তার পরিণতি কি হবে সেটা আপনি নিশ্চয়ই ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছেন। আপনাকে শুধু এতটুকুই বলছি, আমাদের মুক্তি বাহিনীর একজন সৈনিক বেঁচে থাকতে কর্নেল ওসমানীর গায়ে এতটুকু আচড় কেউ দিতে পারবে না। আমরা কেউ তার এতটুকু অপমানও বরদাস্ত করব না। তাছাড়া তার বক্তব্যে যুক্তি রয়েছে। আগে আপনি বলেছেন বিএলএফ-মুজিব বাহিনী গঠনের ব্যাপারে আপনি কিছুই জানতেন না। এ খবর আপনি জানতে পেরে নাকি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার অ্যাডভাইজারদের সাথে এর প্রতিবিধান করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেহায়েত অপারগ হয়েই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আপনাদের এ ধরণের অপারগতার সুযোগে তারা তাদের নীল নকশার জাল বিস্তার করে চলেছে। তাদের জালে আটকে পড়ে থাকা নির্জীব বাংলাদেশ আমাদের কাম্য নয়। পরনির্ভরশীল পঙ্গু বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য হাজার হাজার বাঙ্গালী রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিচ্ছেনা বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে। আমরা তথা আপমর জনসাধারণ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পৃথিবীর অন্যান্য জাতি যদি ১২ বছর, ১৫ বছর, ২০ বছর রক্তক্ষরণের ত্যাগ স্বীকার করে নিজেদের শক্তির বলে তাদের দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করে থাকতে পারেন তবে আমরাই বা পারব না কেন আমাদের নিজ শক্তিতে স্বাধীনতার সূর্যকে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে ছিনিয়ে নিতে? পৃথিবীর অনেক জাতি তাদের মুক্তি সংগ্রামে মিত্র দেশের সহযোগিতা গ্রহণ করেছে সংগ্রামকালে কিন্তু তাই বলে তারা নিজেদের সত্ত্বাকে তো বিকিয়ে দেয়নি। আপনি প্রধানমন্ত্রী। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে সব কিছু দেখে বুঝে শুনে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দৃঢ়তার সাথে সমস্যার মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়া। আপনি যদি সততা ও আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে চলেন তবে আপনি আপনার যাত্রা পথে নিঃসঙ্গ হবেন না। আমরা সবাই থাকব আপনার সাথে।”
প্রধানমন্ত্রী আমাদের বক্তব্য শুনে বললেন তিনি কিছু একটা করবেন। কর্নেল ওসমানীকে passify করার দায়িত্ব নিয়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। বাইরে এসে শুনলাম গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, তাজুদ্দিন এবং প্রবাণী সরকারের সাথে কর্নেল ওসমানীর মতানৈক্য ঘটায় তিনি নাকি কমান্ডার ইন চীফ হিসেবে হুকুম দিয়েছেন সমস্ত আওয়ামী লীগ সরকারকে অ্যারেষ্ট করতে। প্রধানমন্ত্রীকে ইতিমধ্যেই নাকি অ্যারেষ্ট করে রাখা হয়েছে থিয়েটার রোডেই। বাকিরা পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। গুজবটা শুনে হাসব কি কাঁদব ভেবে পেলাম না। ভাবলাম, গুজবটা ছড়িয়ে আওয়ামী লীগাররা তাদের দুর্বলতাটাকেই প্রকাশ করে দিলেন তাদের অজান্তে।
এদিকে কনফারেন্সের দিন ক্রমশঃ ঘনিয়ে আসছে। বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডাররাও ইতিমধ্যে কোলকাতায় এসে উপস্থিত হচ্ছেন। কর্নেল ওসমানীকে আমরা একনাগাড়ে বুঝিয়ে চলেছি। অনুরোধ করে চলেছি তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নিতে। ভীষণ একরখা মানুষ কর্নেল ওসমানী। যারা তার সান্নিধ্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন তারা সবাই সেটা জানেন। অত্যন্ত আত্মসম্মানবোধী এবং অভিমানী তিনি। নীতির প্রশ্নে জীবনে কেউই তাকে আপোষ করাতে সক্ষম হয়নি। নূর ও আমাকে তিনি ভীষণভাবে স্নেহ করতেন। বকাও খেয়েছি অনেক। কোন সময় অযৌক্তিকভাবেও বটে। তবুও তার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তার যে আন্তরিক ভালোবাসা আমি পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সেটা এক অমূল্য অনুভূতি। একান্ত নিভৃতে শ্রদ্ধার সাথে তাকে ও তার স্মৃতিগুলো আমি স্মরন করে যাব সারাজীবন। চাকুরিতে থাকাকালীন এবং চাকুরিচ্যুত অবস্থায় আমরা নিজেদের মাঝে অনেক মতামত বিনিময় করেছি নির্দ্বিধায়। এমনকি অনেক ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সমস্যা সম্পর্কেও তার পিতৃসুলভ আচরণ ও উপদেশাবলীর কথা আজও মনে হলে হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। যাক সে কথা। বাইরের ওসমানীর চেয়ে তার অন্তরের কিছুটা জানতে পারার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল বলে নিজেকে আমি ধন্য মনে করি। আমাদের আকুতি- মিনতির জবাবে তিনি কিছুই বলছেন না; এমন একটা অনিশ্চিতয়তার মাঝেই শুরু হল সম্মেলন ১১ই জুলাই ১৯৭১-এ। অধিবেশনের আগে যখন এ সমস্ত ঘটনা ঘটছিল তখনই মে মাসের শেষ দিকে একদিন বয়রা সেক্টর এর একটি অপারেশনে আমি প্রথমবারের মত গুলিবিদ্ধ হই। ইনজ্যুরিটা বিশেষ সিরিয়াস ছিল না। ডান হাতের মাঝের আঙ্গুলটা ভেঙ্গে গিয়েছিল গুলি লেগে। আল্লাহর অসীম কৃপায় প্রাণে বেঁচে যাই। ক্ষত নিয়েই আমার দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হাতের ব্যান্ডেজ নিয়েই সেক্টরে সেক্টরে ঘুরে ফিরেছি। ফলে ঠিকমত ঔষধ এবং কেয়ার না নেয়ায় ক্ষতে একটা খারাপ ধরণের ইনফেকশান দেখা দেয়। ফলে হেডকোয়াটার্সের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আমি রক্ষা করতে পারিনি। অবশ্য নূরের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে খবরা-খবর যতটুকু সম্ভব জানার চেষ্টা করেছি। সেক্টর থেকে যোগাযোগের ব্যবস্থাও ছিল খুবই সীমিত। সম্মেলনে সব সেক্টর থেকে কমান্ডাররা এসেছিলেন। সম্মেলনের দিন সকালে নূর এসে বলল, কর্নেল ওসমানী কনফারেন্স অ্যাটেন্ড করবেন না। কারণ প্রধানমন্ত্রী ও মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে তিনি তার পদত্যাগের ব্যাপারে সন্তোষজনক কোন জবাব পাননি। সেক্ষেত্রে তার পক্ষে সম্মেলনে উপস্থিত হওয়াটা হবে অসম্মানজনক। তাছাড়া সম্মেলনে সবাই তাকে পদত্যাগের কারণও জিজ্ঞাসা করতে পারেন। পদত্যাগের সঠিক কারণ এই মুহূর্তে সবাইকে জানানোটা সমীচীন মনে করছেন না কর্নেল ওসমানী। নূর এ খবরটা আমাকে জানিয়ে অনুরোধ করল সমস্ত ব্যাপারটা গোপন রাখতে। মুজিবনগর সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে কর্নেল ওসমানী তার পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন আভাস পেলাম।
থিয়েটার রোডেই কনফারেন্স শুরু হল। সবাই উপস্থিত। জনাব তাজুদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে হাজির হলেন। বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর সেনা প্রধান হিসাবে ওসমানী অনুপস্থিত। তিনি জানিয়েছেন বিশেষ কারণবশতঃ তার পক্ষে সম্মেলনে উপস্থিত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী কর্নেল ওসমানীর উপস্থিতি সেখানে ছিল অপরিহার্য। কিন্তু তিনি নেই দেখে সবার কাছে ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক মনে হল। যাই হোক জনাব তাজুদ্দিন লম্বা-চওড়া ভাষণ শুরু করলেন। তার ভাষণে তিনি সবাইকে জানালেন, “সেক্টর কমান্ডারদের অনাস্থাবশতঃ কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ পত্র দাখিল করেছেন।” উপস্থিত সবাই প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কথাটা এতই আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত ছিল যে, কমান্ডারদের মধ্যে ভীষণ উত্তেজনার সৃষ্টি হল। কর্নেল ওসমানীর উপর কমান্ডারদের আস্থা নেই এ কথা প্রধানমন্ত্রী কি করে জানলেন সে বিষয়ে অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার কোন জবাব দিতে পারলেন না। বাক-বিতন্ডার মাঝে অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে কনফারেন্স হল ত্যাগ করে চলে যেতে হল। সম্মেলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডাররা। কর্নেল ওসমানী সবার কাছে বিশেষ করে বাঙ্গালী বীর যোদ্ধাদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তার উপর অনাস্থা এনেছেন কারা সে রহস্য উদঘাটন না হওয়া পর্যন্ত কোন কনফারেন্স হবে না বলে সিদ্ধান্ত গৃহিত হল প্রধানমন্ত্রীর অবর্তমানেই। এ অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে আমি ও নূর মেজর জিয়া, মেজর খালেদ মোশাররফ এবং উইং কমান্ডার বাশারকে একান্তভাবে কর্নেল ওসমানীর পদত্যাগের আসল কারণ খুলে বললাম। আমরা এটাও তাদের বুঝিয়ে বললাম কর্নেল ওসমানীর এ ধরণের ষ্ট্যান্ড এ অস্থায়ী সরকার ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নীল নকশা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয়েছে। তাই তারা অতি কৌশলে কমান্ডার ইন চীফের পদ থেকে তাকে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা আটছে তার পদত্যাগের সুযোগ গ্রহণ করে। তাদের এ পরিকল্পনার পেছনে মুক্তিযুদ্ধের কয়েকজন কমান্ডারও পরোক্ষভাবে সমর্থন জানাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা তাদের আমাদের দিল্লীর অভিজ্ঞতা এবং বিএলএফ- মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার নীল নকশার কথাও খুলে বললাম। সব কিছু বিস্তারিত জানিয়ে তাদের অনুরোধ করলাম, যে করেই হোক কর্নেল ওসমানীকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে রাখতে হবে। তাকে সম্মুখে রাখতে না পারলে নীল নকশার মোকাবেলা করতে আমরা সবাই ব্যর্থ হব। আর তাতে জাতীয় স্বার্থ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের সাথে তারা একমত হলেন। ঠিক হল উপস্থিত সবার তরফ থেকে তারা কর্নেল ওসমানীর সাথে দেখা করে তাকে তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে অনুরোধ জানাবেন। একইসাথে তাকে আশ্বাসও দেয়া হবে তিনি যাতে সসম্মানে তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নিতে পারেন সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অস্থায়ী সরকারকে বাধ্য করা হবে সমগ্র মুক্তিযোদ্ধাদের তরফ থেকে। কর্নেল ওসমানীর সাথে গোপন বৈঠক হল। আমরা যা বলেছিলাম তার পুনরাবৃত্তিই তিনি করলেন তাদের কাছে। সবাই তার পদত্যাগ করার পেছনের যুক্তি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন। সব বুঝে তারা তাকে অনুরোধ জানালেন জাতীয় স্বার্থ বিরোধী সব ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করার জন্য তার নেতৃত্ব বিশেষভাবে প্রয়োজন : একমাত্র তিনিই মুক্তি বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেন। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া কোন ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। তাদের দেয়া Assurance এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্নেল ওসমানী তার পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করবেন বলে আমাদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। তার সাথে আলাপের পর আমরা গেলাম অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জনাব নজরুল ইসলাম ও অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিনের কাছে। আমাদের দেখে দু’জনই বেশ কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিলেন। সকালের মিটিং-এর অবস্থা বুঝে জনাব তাজুদ্দিন ইতিমধ্যেই শংকিত হয়ে পড়েছিলেন। সরাসরিভাবে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হল,
—আপনি কোন যুক্তির ভিত্তিতে সকালে আপনার বক্তব্যে বললেন সেক্টর কমান্ডারদের অনাস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কর্নেল ওসমানী পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? জবাবে কিছুটা বিব্রত হয়ে তাজুদ্দিন সাহেব বললেন,
—তার কাছে খবর রয়েছে যে বেশ কিছু কমান্ডার জনাব ওসমানীর উপর অনাস্থা পোষণ করছেন।
—মহামান্য প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, শুধুমাত্র কমান্ডারদের তরফ থেকেই নয়, সমগ্র মুক্তি ফৌজের তরফ থেকে আমাদের পূর্ণ আস্থাই যে রয়েছে কর্নেল ওসমানীর উপর মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে তা নয় তিনি আমাদের অতি শ্রদ্ধার পাত্রও বটে। তার পরিবর্তে অন্য কাউকে যদি কমান্ডার ইন চীফ বানাবার চিন্তা-ভাবনা করে থাকেন তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমাদের বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার কাছে তিনি গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারেন। প্রবাসী সরকারের হয়তো বা ক্ষমতা থাকতে পারে, সরকার ইচ্ছামত একজন সর্বাধিনায়কও নিয়োগ করতে পারে কিন্তু তার পরিণতি কি হবে সেটাও একটু ভেবে দেখবেন। মেজর জিয়াই প্রধানমন্ত্রীর কথার জবাব দিলেন।
জনাব নজরুল ইসলাম ও তাজুদ্দিন দু’জনই মেজর জিয়ার কথা শুনে ভীষণভাবে চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ ভেবে তাজুদ্দিন সাহেব বললেন,
—ওসমানী সাহেব স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন। তিনি সেটা প্রত্যাহার করলে সরকার তার পুননিয়োগ সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা করতে পারে।
—তিনি স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিয়েছেন সেটা ঠিক। কিন্তু সম্মেলনে আপনি যে কারণে তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন সেটা সত্য নয়। কি কারণে তিনি পদত্যাগ পত্র সরকারকে স্বেচ্ছায় দিয়েছেন সেটা আমরা অবশ্যই শুনব তার কাছ থেকেই : আমাদের অনুরোধ কাল সম্মেলনে আপনি বলবেন, আপনার কাছে যে খবর এসেছিল কিছু কমান্ডারের অনাস্থার ব্যাপারে সেটা তদন্তে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাই নয় আপনি আরও বলবেন উপস্থিত সব কমান্ডার এবং সমগ্র মুক্তিফৌজের দাবি একমাত্র কর্নেল ওসমানীই থাকবেন কমান্ডার ইন চীফ হিসেবে। অন্য কেউ নয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে সবার তরফ থেকে আপনি স্বয়ং তাকে তার ইস্তফা প্রত্যাহার করে নেবার জন্য অনুরোধ জানাবেন এবং একমাত্র সে ক্ষেত্রেই তিনি তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করবেন। কথার ধরণ থেকে বুদ্ধিমান জনাব তাজুদ্দিন আহমদ বুঝে নিলেন মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডাররা ইতিমধ্যে অনেক কিছুই জেনে গেছেন। পর্দার অন্তরালে পাশা খেলার চালগুলো সম্পর্কেও হয়তো বা অনেকেই অবগত হয়ে পড়েছেন। তাই কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে না পড়ার জন্য মেজর জিয়ার অনুরোধ মেনে নিতে রাজি হলেন প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন। পুরো মিটিং এ নির্বাক নিরব সাক্ষী হয়ে নিশ্চুপ বসে ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব নজরুল ইসলাম। মিটিং এর বিস্তারিত বিবরণ নূরের মাধ্যমে জানানো হল কর্নেল ওসমানীকে। পরদিন কথামত কাজ করলেন প্রধানমন্ত্রী। তার অনুরোধে কর্নেল ওসমানী তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে সম্মেলনের নেতৃত্ব দেবার স্বীকৃতি জানালে করতালির মাধ্যমে উপস্থিত সবাই কর্নেল ওসমানীর সিদ্ধান্তকে আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন। কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে সম্মেলন শুরু হল। চানক্য বুদ্ধির দূরভিসন্ধি নস্যাৎ করে কর্নেল ওসমানীকে কমান্ডার ইন চীফ পদে বহাল রাখতে পেরে আমরা তার উপযুক্ত মর্যাদা দিতে পেরেছিলাম বলে নিজেদের আত্মপ্রত্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের এই বিজয় থেকে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলেন যে, জানবাজ মুক্তিসেনারা অন্যায় ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কোন কিছুই মুখ বুজে সহ্য করবেন না। এ সম্মেলনে যুদ্ধের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সমস্যা এবং ভবিষ্যতে কর্মপন্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে কর্নেল ওসমানীর মনোভাব আমাদের আগেই জানা ছিল, সে আলোকেই আলোচনা পরিচালিত হয়। ঐ বৈঠকে লেঃ কর্নেল এম এ রব বাংলাদেশ মুক্তি ফৌজের চীফ অফ ষ্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দোকার ডেপুটি চীফ অফ ষ্টাফ নিযুক্ত হন। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যেসব নেয়া হয়েছিল তা হচ্ছে :- ১) বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা নির্ধারন।
২) মুক্তিযুদ্ধের কৌশল পদ্ধতির সারসংক্ষেপ এবং বর্ণনা।
(ক) নির্ধারিত এলাকায় নির্দিষ্ট দায়িত্বে পাঁচ অথবা দশজনকে নিয়ে গঠিত ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা দলগুলোকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো হবে।
(খ) গেরিলাদের শ্রেণী বিভক্তি :-
এ্যাকশন গ্রুপ : এ গ্রুপের সদস্যরা শত্রুর বিরুদ্ধে সরাসরি তবে গেরিলা হামলা চালাবে। তারা শতকরা ৫০ থেকে ১০০ ভাগ হাতিয়ার বহন করবে।
গোয়েন্দা সেনা : এই গ্রুপের গেরিলারা হেডকোয়াটার্সের অধিনে প্রতিষ্ঠিত গোয়েন্দা বিভাগের নির্দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এরা সাধারণত সম্মুখ সংঘর্ষে জড়িত হবে না। এদের মূল দায়িত্ব হবে খবরা-খবর সংগ্রহ করা। এদের কাছে শতকরা ৩০ থেকে ৫০ ভাগের বেশি অস্ত্র থাকবে না।
গেরিলা ঘাটি : প্রতিটি গেরিলা ঘাটি সেক্টর ট্রুপস এর দ্বারা রক্ষিত হবে। প্রতিটি ঘাটিতে গেরিলাদের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা এবং ট্রেনিং এর ব্যবস্থা থাকবে। প্রত্যেক ঘাটিতে একটি করে মেডিকেল টিম থাকবে প্রয়োজনে গেরিলাদের চিকিৎসার জন্য। প্রত্যেক ঘাটিতে গেরিলাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলার জন্য একজন রাজনৈতিক নেতা থাকবেন। তার দায়িত্ব হবে বিভিন্ন কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে পাকিস্তানীদের মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়া এবং একই সঙ্গে বাঙ্গালীরা যেন মানসিক সাহস ও শক্তি হারিয়ে না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। শত্রুর বিরুদ্ধে বড় ধরণের আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশ্যে আরো বেশি সংখ্যক গেরিলা কিংবা নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদের সংকুলানের জন্য প্রতিটি ঘাটিকে তৈরি রাখাও এদের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু বাস্তবে পরবর্তিকালে এই রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য মুজিবনগর সরকার থেকে কোন প্রতিনিধিই আসেনি। সেক্টর এবং সাব-সেক্টর কমান্ডারদেরকেই নিজেদের উদ্যোগে এ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল।
৩) নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের অবিলম্বে ব্যাটালিয়ন ফোর্স এবং সেক্টর ট্রুপস এ সংগঠিত করতে হবে।
৪) যুদ্ধ পরিকল্পনার পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপ : –
(ক) প্রতিটি সুবিধাজনক স্থানে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানার জন্য বিপুল সংখ্যক গেরিলাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর বন্দোবস্ত করতে হবে।
(খ) কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখতে দেয়া হবে না। বিদ্যুতের খুঁটি, সাবস্টেশন প্রভৃতি ধ্বংস করে বিদ্যুৎ সরবরাহ অচল করে দিতে হবে।
(গ) কোন কাঁচামাল কিংবা উৎপাদিত পণ্য রফতানি করতে দেয়া হবে না। এ সমস্ত জিনিস যে সমস্ত গুদামে থাকবে সেগুলো ধ্বংস করে দিতে হবে।
(ঘ) শত্রুপক্ষের সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম, রসদপত্র আনা নেয়ার জন্য ব্যবহারযোগ্য যানবাহন, রেলপথ, নৌযান, রাস্তা, পুল প্রভৃতি পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করতে হবে।
(ঙ) রণকৌশলগত পরিকল্পনা এভাবে করতে হবে যাতে শত্রুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
(চ) শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করার পর তাদের বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলোর উপর গেরিলারা মরণপন আঘাত হানবে।
এ সম্মেলনে বাংলাদেশকে নিম্নোক্ত এগারোটি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় :-
১নং সেক্টর : চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী জেলার অংশ বিশেষ মুহুরী নদীর পূর্ব এলাকা নিয়ে এই সেক্টর গঠিত হয়। সমগ্র সেক্টরকে ৫টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। মেজর জিয়া সেক্টর কমান্ডার নিয়োজিত হন। (পরে জিয়া জেড ফোর্স কমান্ডার নিযুক্ত হওয়ার পর ক্যাপ্টেন রফিক ১নং সেক্টর কমান্ডার নিয়োজিত হন।) এ সেক্টরের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ২১ শত। এর মধ্যে ১৫ শত ইপিআর, ২’শ পুলিশ, ৩’শ সামরিক বাহিনী এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ১’শ। এখানে গেরিলাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার। এদের মধ্যে ৮ হাজারকে এ্যাকশন গ্রুপ হিসাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শতকরা ৩৫ ভাগ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দেয়া হয় এই সেক্টরকে।
২নং সেক্টর : কুমিল্লা, ফরিদপুর জেলা, নোয়াখালী ও ঢাকার অংশ বিশেষ নিয়ে এ সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর খালেদ মোশাররফ। সেক্টরটিকে ৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সমগ্র সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার। গেরিলা ছিল ৩০ হাজার। (মেজর খালেদ মোশাররফ ফোর্স কমান্ডার হিসেবে গুরুতরভাবে আহত হওয়ার পর ক্যাপ্টেন হায়দার সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।)
৩নং সেক্টর : মৌলভীবাজার, ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ নিয়ে এই সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টরটিকে ১০টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। গেরিলাদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর শফিউল্লাহ। (এস’ ফোর্স গঠনের পর মেজর শফিউল্লাহর জায়গায় মেজর নূরুজ্জামানকে ৩নং সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়।)
৪নং সেক্টর : উত্তরে সিলেট সদর এবং দক্ষিনে হবিগঞ্জ থানার মধ্যবর্তী সমস্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ৪নং সেক্টর। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। সেক্টরটিকে ৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ হাজার। গেরিলা ছিল প্রায় ১২ হাজার।
৫নং সেক্টর : সিলেট জেলার উত্তরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় এই সেক্টর। কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর মীর শওকত আলী। নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮’শ, গেরিলা ছিল প্রায় ৫ হাজার। সেক্টরটিকে ৬টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।
৬ নং সেক্টর : এই সেক্টর রংপুর এবং দিনাজপুর নিয়ে গঠিত হয়। উইং কমান্ডার এম কে বাশার নিযুক্ত হন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। সাব-সেক্টর ৫টি। নিয়মিত বাহিনী সংখ্যা প্রায় ১২’শ। গেরিলা ছিল প্রায় ৬ হাজার।
৭নং সেক্টর : রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া জেলা এবং দিনাজপুর জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত হয় এ সেক্টর। সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর নাজমুল হক। (যুদ্ধকালীন সময় এক মটর দুর্ঘটনায় তিনি শহীদ হলে তার স্থলে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর এম হাসান।) সাব-সেক্টরের সংখ্যা ৮টি। সৈন্য সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। গেরিলা প্রায় ৮ হাজার।
৮নং সেক্টর : কুষ্টিয়া, যশোর এবং খুলনার অংশ বিশেষ নিয়ে এ সেক্টর গঠন করা হয়। ১৫ই জুলাই পর্যন্ত সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ ওসমান চৌধুরী। পরবর্তিকালে মেজর ওসমানকে হেডকোয়াটার্সে বদলি করে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্ত ান থেকে পালিয়ে আসার পর মেজর মঞ্জুর ৮ নং সেক্টরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ হাজার। গেরিলা প্রায় ৮ হাজার। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ৭টি।
৯নং সেক্টর : বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনার অংশ বিশেষ, ফরিদপুরের একাংশ নিয়ে এ সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। সাব-সেক্টরের সংখ্যা ৮টি। নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫’শ। গেরিলা প্রায় ১৫ হাজার।
১০নং সেক্টর : এ সেক্টরের কোন আঞ্চলিক সীমানা ছিল না। নৌ কমান্ডোরাই এ সেক্টরের অধিনে ছিল। শত্রুপক্ষের টার্গেট ধ্বংস করার জন্য প্রয়োজন মত বিভিন্ন সেক্টরে গ্রুপ গঠন করে তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্বে পাঠানো হবে সেই সিদ্ধান্তই নেয়া হয়। তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করার নির্দেশ দেয়া হয় সেক্টর কমান্ডারদের। দায়িত্ব সম্পন্ন করার পর নৌ কমান্ডোরা সব আবার তাদের মূল আস্তানা ১০নং সেক্টরে ফিরে আসবে ঠিক করা হয়।
১১নং সেক্টর : এ সেক্টর ছিল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল এবং তুরা ও গারো অঞ্চল নিয়ে। কমান্ডার নিযুক্ত হন মেজর তাহের। (১৫ই নভেম্বর এক অভিযানে তিনি গুরুতরভাবে আহত হয়ে একটি পা হারান।) সাব-সেক্টর ছিল ৮টি। গেরিলা সংখ্যা ২৫ হাজার।
এ সম্মেলনে সেক্টরসমূহ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার পর মুক্তি ফৌজের সৈনিকদেরকেও নিম্নলিখিত ক্যাটাগরিতে পুর্নগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়:-
নিয়মিত বাহিনী : ২৫শে মার্চ রাতের শ্বেত সন্ত্রাসের পর ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ কোর এবং অন্যান্য সামরিক ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যদের নামকরণ করা হয় নিয়মিত বাহিনী।
আর্মি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে তিনটি ব্রিগেড গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তখনকার ৫টি ব্যাটালিয়নকে কেন্দ্র করেই নিয়মিত বাহিনীর পুনর্গঠনের কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এইসব ব্যাটালিয়নের জনশক্তি ছিল খুবই কম। প্রত্যেক সেক্টর থেকে উপযুক্ত লোক সংগ্রহ করে এদের শক্তি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ক্রমান্বয়ে নতুন আরও ব্যাটালিয়ন দাড় করানোর সিদ্ধান্ত হয়। এগুলোকে পরে ব্রিগেড গ্রুপে সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এদের দ্বারা গঠিত তিনটি ব্রিগেড গ্রুপই পরে জেড’ ফোর্স, এস’ ফোর্স এবং কে’ ফোর্স নামে পরিচিত হয়।
সেক্টর ট্রপস্ : উপরোক্ত ব্যাটালিয়নগুলোতে যেসব ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের অর্ন্তভূক্ত করা সম্ভব হবে না তাদেরকে সেক্টর ট্রুপস হিসাবে যুদ্ধ করার জন্য ইউনিট এবং সাব-ইউনিটে সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন ধারনের জন্য নগন্য সম্মানী দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের তরফ থেকে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের বেশিরভাগই ঐ অর্থ গ্রহণ না করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন।
অনিয়মিত বাহিনী অথবা ফ্রিডম ফাইটার্স (এফ এফ) : গেরিলা হিসেবে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যাদের ট্রেনিং দেয়া হত তাদের বলা হত অনিয়মিত বাহিনী, গণবাহিনী, অথবা ফ্রিডম ফাইটার্স। প্রথম পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে নিয়ম- শৃঙ্খলার অভাব ছিল। সঠিক রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ এবং কঠোর সংগ্রামী জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে তাদের সুশৃঙ্খল গেরিলা হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গণবাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিংকালে সামান্য পকেট খরচা এবং বাংলাদেশের ভেতরে পাঠাবার সময় প্রথমবার তাদের কিছু রাহা খরচ দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এরপর তাদের বিশাল জনসমুদ্রে মিশে গিয়ে তাদেরই একজন হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার প্রশিক্ষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমাকে, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন, লেঃ মতি ও লেঃ নূরকে আগের দায়িত্বেই বহাল রাখা হয়।
কনফারেন্সে কমান্ডারদের নিয়মিত এবং অনিয়মিত বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামো এবং সদস্য সংখ্যা হিসাব করে তাদের জন্য কাপড়-চোপড়, রেশন, অস্ত্র, গোলা-বারুদ, ওয়্যারলেস সেট, টেলিফোন, অতি আবশ্যকীয় রসদপত্রের তালিকা তৈরি করে মুজিবনগর সরকারের কাছে পেশ করতে বলা হয়। অস্থায়ী সরকার চাহিদা অনুযায়ী ভারত সরকারের কাছ থেকে জিনিসগুলো সংগ্রহ করবে সেই কথাই জানানো হয়েছিল মিটিং-এ। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কয়েকটি ফিল্ড হাসপাতাল গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এছাড়া সেক্টর এবং সাব-সেক্টরগুলোতেও চিকিৎসা কেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্তও গৃহিত হয়। কনফারেন্সে কর্নেল ওসমানী সবাইকে জানালেন ইতিমধ্যে পাকিস্তান থেকেও বাঙ্গালী সামরিক বাহিনীর অফিসাররা পালিয়ে আসার চেষ্টা এবং উদ্যোগ নিচ্ছে। এপ্রিল মাসে তিনজনের সর্বপ্রথম দলটির মাঝে রয়েছি আমি, লেঃ মতি ও লেঃ নূর। আমাদের কাছ থেকে জানা তথ্যের ভিত্তিতে তিনি আরও বলেছিলেন অনেক বাঙ্গালী অফিসারই স্বাধীনতা যুদ্ধ যোগ দেবার জন্য পালিয়ে আসার সুযোগ খুঁজছে কিন্তু সীমান্ত পার হয়ে ভারতে পালিয়ে এসে তারপর যুদ্ধে যোগ দেয়ার কাজটি খুবই বিপদজনক; বিশেষ করে পাকিস্তানে পরিবার-পরিজন নিয়ে যারা বসবাস করছে তাদের জন্য তো বটেই। তাছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ভারত সরকারের মনোভাব কি সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে না পারায় অনেকেই পালিয়ে ভারতে আসতে ভরসা পাচ্ছে না। তাদের এ ব্যাপারে প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করার আহ্বান জানানো হয়েছে বিশেষ যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে। পাকিস্তান থেকে অফিসাররা চলে আসছে জানতে পেরে সকলেই খুশি হলেন। আমাদের উষ্ণ অভিনন্দন জানানো হল।