বিংশ অধ্যায় – একদলীয় নিষ্পেষনের জাতাকলে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা এবং সেনা পরিষদ
- জাতিকে শ্বাসরূদ্ধকর পরিবেশ থেকে মুক্ত করার জন্য বৈপ্লবিক পদক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে উঠে।
- শেখ মুজিবকে আজীবন রাষ্ট্রপতি বানাবার পরিকল্পনা।
- সেনা পরিষদের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটানোর সিদ্ধান্ত।
- লেঃ কর্নেল রশিদ ও লেঃ কর্নেল ফারুকের সেনা পরিষদের সাথে যোগাযোগ।
- মিলিত প্রচেষ্টায় অভ্যুত্থান ঘটানোর সিদ্ধান্ত সাফল্যের সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তুলল।
- খন্দোকার মোশতাক আহমদ সম্পর্কে সেনা পরিষদের মূল্যায়ন।
বাকশাল গঠন করার আগে জোর প্রচারণা চালানো হল- শেখ মুজিব তার দল ও দলীয় কর্মীদের ক্ষমতার লোভ, লালসা ও দুর্নীতি সর্ম্পকে উদাসীন নন। তিনি বুঝতে পেরেছেন তার পার্টির চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এ পার্টি দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধন করা আর সম্ভব নয়। তাই তিনি পার্টির বিলুপ্তি ঘোষণা করে একদলীয় সরকার কায়েম করে দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করতে যাচ্ছেন। লোকজন ভাবল, তার এই পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে কলুশিত লোকজন ক্ষমতাচ্যুত হবে এবং সে জায়গায় নিয়োগ করা হবে ভালো লোকজনদের। কিন্তু সে আশা অল্প সময়েই কর্পূরের মত বিলীন হয়ে গেল : দেখা গেল পার্টির বিলুপ্তি ঘোষণা করে তিনি যে বাকশাল গঠন করলেন সেখানে ক্ষমতাবলয়ে স্থান পেলো ধিকৃত গাজী গোলাম মোস্তফা, মনসুর আলী এবং শেখ মনি এন্ড গংরাই। তারাই হয়ে উঠল মুখ্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। যাদের অপকর্মের বদৌলতে আওয়ামী লীগ সংগঠন হিসাবে জনগণের আস্থা হারিয়েছিল; তাদের নিয়েই ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ যাত্রা শুরু করলেন শেখ মুজিব। জনগণ হতাশ হয়ে পড়ল। পার্টি বিলুপ্ত করলেও চাটার দলকে বাদ দিতে পারলেন না শেখ মুজিব। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে আর একটি জিনিস পরিষ্কার হয়ে উঠল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাবলয়ে পাকাপোক্তভাবে অধিষ্ঠিত করা হল তার পরিবারবর্গকে। ব্যাপারটা এমনই যেন- পুরো দেশটাই শেখ পরিবারের ব্যক্তিগত জমিদারী।
বাকশাল গঠন করে একনায়কত্ব কায়েমের সাথে সাথে প্রকাশ্য রাজনীতি ও সমস্ত রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে গেল। সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ড আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যেতে বাধ্য হল। আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে দেশের নতুন পরিস্থিতি নিয়ে মত বিনিময় করতে লাগলাম। জাতীয় অবস্থার পর্যালোচনা করে সবাই একমত হলাম, একদলীয় নিষ্পেষনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে অবিলম্বে। পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে গণতন্ত্রিক এবং মানবিক অধিকার। বাকশালের শিকড় বাংলার মাটিতে প্রথিত হবার আগেই উপড়ে ফেলতে হবে। একনায়কত্বের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে জনগণকে মুক্ত করার সাথে সাথে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু এই রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করার ন্যায়সঙ্গত অধিকার যাদের সে সমস্ত দেশপ্রেমিক এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি ও সামর্থ্য অত্যন্ত কম। স্বৈরশাসনের ষ্টিমরোলারের পেষণে তাদের আরো দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে দিন দিন। এ ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে সরকার বদল করার কোন বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। শিকড় গেড়ে বসার আগেই একনায়কত্বের অবসান ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক মহল থেকে অনেকেই ঈঙ্গিত দিলেন, সেনা বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে অগ্রণীর ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে ইচ্ছুক হলেই সম্ভব হবে এই একনায়কত্ব ও স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে জাতিকে মুক্ত করা। তাদের এ ধরণের ঈঙ্গিতের যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছিলাম আমরা। যেখানে সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একনায়কত্বের অবসান ঘটানো সম্ভব নয় সেখানে স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করার জন্য বৈপ্লবিক পদক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বৈপ্লবিক পদক্ষেপের মাধ্যমেই উৎখাত করতে হয় স্বৈরাচারী সরকার। এর কোন বিকল্প থাকে না বলেই জনগণ স্বাগত জানায় ঐ ধরণের যে কোন বৈপ্লবিক পদক্ষেপকে। স্বতঃস্ফুর্ত জনসমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্লব অর্জন করে তার নৈতিক ও আইনগত বৈধতা। খন্দোকার মোশতাক আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রীমনা নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে একই প্রকার মনোভাব প্রকাশ করে বলেছিলেন যে, জাতির বৃহত্তর
স্বার্থে যে কোন বৈপ্লবিক উদ্যোগকে অভিনন্দন জানিয়ে সর্বোতভাবে সক্রিয় সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছেন তিনি এবং আরো অনেকেই। মোশতাক সাহেবের এ ধরণের উক্তির পেছনে আওয়ামী লীগের একটা বড় অংশের সমর্থন ছিল। ইস্তফা দেবার পর জেনারেল ওসমানীর সাথে দেখা করতে গেলে বাকশাল সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপের সময় তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “মুজিব খানকে সরাতে হবে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?”
এদিকে বাকশালী একনায়কত্ব স্থাপন করেও শেখ মুজিব তার ক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। সিদ্ধান্ত হল- তাকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা দেবে বাকশাল। ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এক সমাবেশে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেয়ার কথা প্রচার করা হয়। উল্লেখ্য, ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তাকে পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করা হয়েছিল। সেটাতে শেখ মুজিব সম্ভ্রষ্ট হতে পারেননি বলেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তাকে আজীবন রাষ্ট্রপতি বানাবার। আরো খবর পাওয়া গেল সমস্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত এবং বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের মাঝ থেকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় সরকার বিরোধী মনোভাবাপন্ন দুই লক্ষ লোকের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলা গভর্ণর ও তাদের অধিনস্থ রক্ষীবাহিনীর সাহায্যে ঐ তালিকাভুক্ত লোকদের মেরে ফেলা হবে। এই নীল নকশা বাস্তবায়িত করে শেখ মুজিব চেয়েছিলেন বাংলাদেশের জনগণের প্রতিবাদী কণ্ঠকে আগামী কয়েক দশকের জন্য স্তব্ধ করে দিতে। এভাবে রাজনৈতিক বিপক্ষ শক্তিকে সমূলে উৎপাটন করার এক হীন চক্রান্ত করা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশেই।
বাংলাদেশের একটি চিহ্নিত মহল স্বীয় স্বার্থে শেখ মুজিবর রহমানেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘জাতির পিতা’ বলে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা পর থেকেই। বাংলাদেশ কায়েম হয়েছে ‘৭১ এর মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে। জনগণের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আজকের বাংলাদেশ। তাই স্বাধীনতার জনগণের সব ত্যাগকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র মুজিবর রহমানকে এককভাবে স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন বানাবার প্রচেষ্টা ছিল এক চরম ধৃষ্টতা। শেখ মুজিবর রহমানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে আরো অনেক নেতাদের মতই ব্যক্তিগত অবদান থাকলেও এ সত্যকে কিছুতেই মুছে ফেলা যাবে না যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ, বিকাশ এবং সেই আন্দোলনকে চরম পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে ‘৭১ এর সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার মূল কৃতিত্ব বাংলাদেশের জনগণের। সংগ্রামের চরম পর্যায়- সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিব অংশগ্রহণ করেননি। পাক হানাদার বাহিনীর শ্বেত সন্ত্রাসের মুখে জনগণকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে আওয়ামী লীগ নেতারাও নিজ নিজ জান বাঁচাতে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। সেই ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতায় হতাশ হলেও জনগণ তাদের সিদ্ধান্তে ভুল করেননি। এক অখ্যাত মেজরের ডাকে সাড়া দিয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন প্রতিরোধ সংগ্রামে। গড়ে তুলেছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। এ সত্যকে মিথ্যা বলে প্রমাণিত করা কখনোই সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যত প্রজন্ম কখনও মেনে নেবে না মিথ্যা প্রচারণাকে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার অভাব ছিল শেখ মুজিবের। তারই ফলে জাতি যখন হয়ে উঠেছিল মুক্তি পাগল তখন শেখ মুজিব চরম সুবিধাবাদীর মত আপোষরফায় ব্যস্ত ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়ার সাথে। জনগণের সব আশাকে নস্যাৎ করে দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণের পাশে না থেকে কারাবরণ করে সাচ্ছন্দে পাড়ি জমিয়েছিলেন পাকিস্তানে। দেশ স্বাধীন হবার পর সেই শেখ মুজিবকেই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বানানো হয় অতি সহজেই। রাষ্ট্র প্রধান হয়ে নিজ ও দলীয় স্বার্থে তিনি জাতীয়তাবাদের মূল চেতনা গণতন্ত্র, স্বাধীকার, মানবিক অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, আইনের শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করলেন না শেখ মুজিব। সন্ত্রাস ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন তিনি স্থাপন করলেন একনায়কত্বের স্বৈরশাসন। তার শাসনকাল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় এবং এক ব্যর্থতার ইতিহাস। চরম জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার পরও যারাই তাকে অযৌক্তিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ কিংবা ‘জাতির পিতা’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তারা সবাই একদিন হবে জনধিকৃত। ইতিহাসের আস্তাকুড়ে হবে তাদের ঠাঁই। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে মিথ্যাকে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা কোন শক্তির পক্ষেই সম্ভব হয়নি কখনো। সত্যই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে ঐতিহাসিক ধারা প্রবাহে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না।
আমরা ঠিক করলাম, জাতিকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে মুক্ত করতে হবে যে কোন ত্যাগের বিনিময়েই। পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে মানবিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক অধিকার। শুরু হল আমাদের নিজস্ব পরিকল্পনা। সেনা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে সেনা পরিষদ গড়ে তোলার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। দেশের প্রতিটি সেনানিবাসের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ও রেজিমেন্টে সমমনা অফিসার ও সৈনিকদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা। হচ্ছে গোপন সংগঠন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, শেখ মুজিবকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আগেই বিপ্লব ঘটিয়ে শেখ মুজিবের একনায়কত্ব ও বাকশালের পতন ঘটাতে হবে। বিপ্লবকে সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও সাংগঠনিক তৎপরতা তরিৎ গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলে কেন্দ্রিয় কমিটি I
প্ল্যানিং ষ্টেজের এক পর্যায়ে একদিন লেঃ কর্নেল আব্দুর রশিদ খন্দোকার সেনা পরিষদের কেন্দ্রিয় নেতৃবৃন্দের কয়েকজনের সাথে সাক্ষাৎ করে। মিটি-এ দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবকে আজীবন রাষ্ট্রপতি বানাবার সরকারি সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে লেঃ কর্নেল রশিদ অভিমত প্রকাশ করে যে, শেখ মুজিব যদি একবার পাকাপোক্তভাবে ক্ষমতায় আসন গেড়ে বসে তবে তার স্বৈরাচারী সরকারের জোয়াল থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করা খুবই দূরূহ হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দুর্বলতার কারণে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটানো তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। এ অবস্থায় সে ও লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খন্দোকার মোশতাকের নেতৃত্বে একটি বিকল্প সরকারের কথা চিন্তা-ভাবনা করেছেন। এ ব্যাপারে সেনা পরিষদের নেতাদের অভিমত কি তা জানতে চায় লেঃ কর্নেল রশিদ। লেঃ কর্নেল রশিদ ও লেঃ কর্নেল ফারুক দু’জনেই মুক্তিযোদ্ধা। সেই সময় লেঃ কর্নেল রশিদ ও লেঃ কর্নেল ফারুক যথাক্রমে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ও ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারস এর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছিল। দু’টো ইউনিটই তখন ঢাকায়। দু’জনই সেনা পরিষদের নেতৃবৃন্দের কাছে সুপরিচিত। তাদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রশ্নে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তাই লেঃ কর্নেল রশিদকে সেনা পরিষদের সিদ্ধান্তের কথা খুলে বলা হল। সব শুনে লেঃ কর্নেল রশিদ প্রস্তাব রাখলো যৌথ উদ্যোগে অভ্যুত্থান সংগঠিত করার। তার প্রস্তাবে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। তার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বলা হল, অভ্যুত্থানের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত রয়েছে সেনা পরিষদের। আলোচনা সাপেক্ষে সেগুলোতে ঐক্যমত্য হলেই সেনা পরিষদ তার প্রস্তাবের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। লেঃ কর্নেল রশিদ আলোচনা করতে রাজি হওয়ায় পরবর্তিকালে ঐ সকল বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়। সেনা পরিষদের তরফ থেকে লেঃ কর্নেল রশিদকে জানানো হয় বিপ্লবের পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানই হবেন চীফ অফ আর্মি ষ্টাফ। এই পরিপ্রেক্ষিতে লেঃ কর্নেল রশিদ প্রস্তাব রাখে এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দোকারকে অব্যাহতি দিয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এমজি তোয়াবকে বিমান বাহিনী প্রধান হিসাবে নিয়োগ করার। তার এই প্রস্তাব সেনা পরিষদ মেনে নেয়। ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় যৌথ বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেনা পরিষদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্যাবলী ও নূন্যতম প্রোগ্রাম সম্পর্কে খন্দোকার মোশতাক সম্মতি প্রদান করেন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় খবরা-খবর আদান-প্রদান ও যৌথভাবে বিপ্লবের কার্যকরী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হবে। এভাবেই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ফলে অভ্যুত্থানের সফলতার সম্ভবনা স্বাভাবিক কারণেই আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল I
আওয়ামী লীগের খন্দোকার মোশতাক এবং বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতা ও কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন অনেক প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এ সমস্ত তথ্যগুলো ছিল আমাদের পরিকল্পনার জন্য অপরিহার্য। আমরা জানতে পেরেছিলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখরাই ছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে কট্টর রুশ-ভারতপন্থী। বাকশালী একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার মূল উদ্দ্যোক্তা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, নজরুল ইসলাম, আব্দুস সামাদ আজাদ, আব্দুর রাজ্জাক, মনসুর আলী, সেরনিয়াবাত, সৈয়দ হোসেন, মনি সিং এবং প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং নিজের অবস্থানকে সুসংহত করার জন্যই শেখ মুজিব এ সমস্ত উচ্চাভিলাসী নেতাদের প্রভাব ও পরামর্শ মেনে নিয়ে গণতন্ত্রের বলি দিয়ে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার এই হঠকারী সিদ্ধান্তকে আওয়ামী লীগের বৃহৎ অংশই মেনে নিতে পারেনি। শেখ মুজিবের ক্ষমতার প্রতাপের মুখে নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে সেদিন এরা প্রকাশ্য বিরোধিতা না করে নিরব থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবের এ সিদ্ধান্তের ফলে সংসদে সেদিন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল গণতন্ত্রীমনা নেতৃবৃন্দ ও সংসদ সদস্যেদের মাঝে। এদের অনেকেই বর্ষীয়ান নেতা খন্দোকার মোশতাকের সাথে আলোচনা করে এ ব্যবস্থার প্রতিকারের রাস্তা খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছিলেন। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার কোন পদক্ষেপ নিলে আওয়ামী লীগের এই বৃহৎ অংশের সমর্থন পাওয়া যাবে অতি সহজেই। তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে অভিনন্দন জানিয়ে সমর্থন করবেন এ ধরণের যে কোন পরিবর্তনকে। আর একটি বিষয়ও আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠে সেটা হল আওয়ামী লীগের মধ্যে খন্দোকার মোশতাকের সমর্থন রয়েছে অনেক। তার ব্যক্তিগত প্রভাব ও জনপ্রিয়তা পার্টির নেতা ও কর্মীদের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট। আমরা খন্দোকার মোশতাককে ‘৭১ এর সংগ্রামকাল থেকে দেখে আসছি। তিনি ছিলেন ঘোর রুশ-ভারত বিরোধী। ধর্মপ্রাণ প্রবীণ নেতা খন্দোকার মোশতাক ছিলেন নীতির প্রশ্নে আপোষহীন। একজন সাচ্চা গণতান্ত্রিক এবং উদারপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি দেশে-বিদেশে পরিচিত ছিলেন। আলাপ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেকেই খন্দোকার মোশতাকের ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করে অভিমত পর্যন্ত ব্যক্ত করেছেন যে. নেতৃত্বের যোগ্যতার বিচারে খন্দোকার মোশতাকের স্থান শেখ মুজিবর রহমানেরও উপরে। তাদের এ ধরণের মনোভাব থেকে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, খন্দোকার মোশতাকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করা হলে তারা অতি সহজেই তার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে বিপ্লবের পক্ষে স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন জানাবেন। ফলে আওয়ামী বাকশালীদের বৃহৎ অংশকে শুধু যে নিউট্রালাইজ করাই সম্ভব হবে তা নয়; এতে করে বাকশালী যোগসাজসে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনাও অনেকাংশে কমে যাবে : আওয়ামী-বাকশালী নেতাদের সমর্থন পেলে রক্ষীবাহিনীকে নিরস্ত্র করার কাজটিও সহজ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামিক রাষ্ট্রসমূহের ক্ষমতাবলয়ে একজন ধর্মপ্রাণ, উদারপন্থী, গণতন্ত্রীমন। রাজনীতিবিদ হিসেবে খন্দোকার মোশতাকের একটা ইতিবাচক গ্রহণযোগ্যতাও ছিল। এ সমস্ত দেশের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের অনেকের সাথেই তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এই অবস্থায় খন্দোকার মোশতাক আহমদকে সরকারের রাষ্ট্রপতি বানালে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ এবং মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর স্বীকৃতি ও সমর্থন আমরা সহজেই পেতে পারব। তাছাড়া রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধিনে বেসামরিক সরকার গঠন করলে আমরা দেশে-বিদেশে এটাও প্রমাণ করতে পারব যে, বাংলাদেশের বৈপ্লবিক অভ্যূত্থান ঘটেছে দেশপ্রেমিক সেনা বাহিনীর নেতৃত্বে। স্বৈরশাসন ও রুশ-ভারতের নাগপাশ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার জন্য, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বিস্তারিত বিশ্লেষনের পরই খন্দোকার মোশতাক আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় :