৭. পাশ্চাত্যের মহান রূপান্তর

৭. পাশ্চাত্যের মহান রূপান্তর

(পনের শতক থেকে বিংশ শতক)

ষোড়শ শতকে ভুল শোধরানো না হওয়া পর্যন্ত পরীক্ষা চালিয়ে যাবার পদ্ধতি ব্যবহার করে, ইউরোপের মানুষ এবং পরে, পরবর্তীকালে যা আমেরিকা বলে অভিহিত হবে, সেখানকার মানুষ এমন একটা সভ্যতার নির্মাণ শুরু করে যার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই এবং ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী নাগাদ মানচিত্রের অন্যান্য অংশে এই কর্মযজ্ঞ ছড়িয়ে পড়বে। এটা মানুষের অভিজ্ঞতার শেষ মহান বিবর্তন। কৃষিকাজের উদ্ভব বা নগর পত্তনের মতো, এটারও একটা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, যার ফলাফল আমরা কেবলমাত্র উপভোগ করতে শুরু করেছি। জীবন আর কখনও আগের মতো হবে না, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভবত– এবং সম্ভাব্য দুর্যোগআকীর্ণ– এই নতুন পরীক্ষার ফলাফল পুরাণের মৃত্যু।

লোগোসের মানসপুত্র পাশ্চাত্য সভ্যতা। একটা ভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ভিত্তির উপরে এটা প্রতিষ্ঠিত। কৃষিপণ্যের উদ্বৃত্তের উপরে নির্ভর করার বদলে, যা সব প্ৰাক- আধুনিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য, নতুন পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পদের প্রযুক্তিগত পুনরাবৃত্তি আর পুঁজির পূর্ণ বিনিয়োগের উপর প্রতিষ্ঠিত। সনাতন সংস্কৃতির, যার কৃষিভিত্তি অনিবার্য কারণেই ছিল অনিশ্চিত। অনেক বিধিনিষেধ থেকে আধুনিক সমাজকে এটা মুক্তি দিয়েছে। আজকের আগে পর্যন্ত কোনো আবিষ্কার বা ধারণা যা বাস্তবায়ন করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন সমূহ সম্ভাবনা ছিল তা স্থগিত রাখার কারণ আমাদের আগে কোনো সমাজই আজ যা আমরা সম্ভব বলে প্রথমেই ধরে নেই, সেই বিরামহীনভাবে কাঠামোর পুনরাবৃত্তির হ্যাপা সামলাতে পারতো না। জমির উর্বরতা আর ফসলের ফলনের জন্য নানা প্রভাবকের উপর নির্ভর করতে হতো বলে কৃষিজীবী সমাজ ছিল ঘাতোপযোগী। সাম্রাজ্য কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে নিজের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করতো এবং অনিবার্যভাবে নিজের অর্থনৈতিক শক্তি নিঃশেষ করে ফেলতো। কিন্তু পশ্চিমে এমন একটা অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে আপাতদৃষ্টিতে যা অনন্তকালব্যাপী পুনর্নবায়নের সম্ভাবনাযুক্ত। অতীতের দিকে তাকিয়ে যা অর্জিত হয়েছে তা রক্ষা করা, যা ছিল প্রাক-আধুনিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য, এই মনোভাব পরিত্যাগ করে পশ্চিমের মানুষ সামনের দিকে তাকাতে শুরু করেছে। আধুনিকায়নের দীর্ঘ প্রক্রিয়া : যা সম্পন্ন করতে ইউরোপের প্রায় তিন শতাব্দী প্রয়োজন হয়েছে, ব্যাপক পরিবর্তনের একটা ধারাবাহিক সমাবেশ : শিল্পায়ন, কৃষির রূপান্তর, নতুন শর্ত পূরণ সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের স্বীকৃতি, এবং একটা বুদ্ধিবৃত্তিক ‘বিকাশ’ যা মিথ্যা, অদরকারী আর বাতিল, অচল বলে পুরাণের মানহানি ঘটিয়েছে।

বৈজ্ঞানিক, প্রয়োগকারী সত্তার উপর নির্ভর করেই এসেছে পশ্চিমাদের অর্জন। দক্ষতা আজ নতুন মন্ত্রশব্দ। সবকিছুকে কাজ করতে হবে। একটা নতুন আবিষ্কার বা ধারণার যুক্তিপাতের সামর্থ্য থাকতে হবে এবং দেখতে হবে সেটা বহির্জগতের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। পুরাণের মতো নয়, লোগোসকে অবশ্যই ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে; এটা মূলত প্রায়োগিক, আমরা যখন কিছু করতে চাই তখন চিন্তার এই পদ্ধতি আমরা ব্যবহার করি; আমাদের পরিবেশের উপর আরো অধিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে বা নতুন কিছু আবিষ্কারের তাগিদে এটা সবসময় সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। পশ্চিমা সমাজের নতুন নায়ক তাই এখন থেকে বিজ্ঞানী বা উদ্ভাবক যিনি তার সমাজের জন্য অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্রে অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। তাকে প্রায়ই পুরাতন পবিত্র অনুভূতি ছুঁড়ে ফেলতে হয়– যুগান্তকারী পর্বের ঋষিরা যেমনটি করেছিলেন। পশ্চিমা আধুনিকতার এই নায়করা কিন্তু লোগোসের প্রযুক্তিগত বা বৈজ্ঞানিক প্রতিভা মিথোস দ্বারা অনুপ্রাণিত আধ্যাত্মিক প্রতিভা নন। তার মানে দাঁড়ায় যে ভাবনার অন্তজ্ঞানলব্ধ পৌরাণিক পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতার প্রায়োগিক যুক্তিবাদী সত্তার কাছে অবহেলিত হবে। কারণ পাশ্চাত্যের অধিকাংশ লোকই পুরাণ ব্যবহার করে না, এটা কি সে জ্ঞানও অনেক খুইয়ে বসেছে।

পশ্চিমে আজ নতুন আশাবাদী মানুষ অনুভব করে যে প্রকৃতির উপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ বেশি। পবিত্র, অপরিবর্তনীয় আইন বলে আর কিছু নেই। বেঁচে থাক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আজ তারা প্রকৃতিকে পরিচালিত করে নিজেদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে। আধুনিক ঔষুধের আবিষ্কার স্বাস্থ্যবিধি, শ্রমিকের উপরে নির্ভরতা কমিয়ে আনা প্রযুক্তি আর উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা পশ্চিমা মানুষের জীবনযাত্রায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। কিন্তু লোগোস মানুষকে কখনও গুরুত্বের সেই বোধটা দিতে পারবে না যেটার প্রয়োজন তাদের আছে। জীবনকে মানে দিয়েছে আর ছাঁচে ফেলেছে পুরাণ। কিন্তু আধুনিকতার অগ্রসর হবার সাথে এবং লোগোসের চমকপ্রদ অর্জনের ফলে পৌরাণিক তত্ত্বের সুনাম ক্রমেই খর্ব হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ, আমরা, অসাড় হতাশার আরো নজির, ক্রমবর্ধমান মানসিক জড়তা এবং একটা অক্ষমতাবোধ আর তদজনিত ক্ষোভ, পুরাতন পৌরাণিক চিন্তাধারা ভেঙে পড়লে এবং তার স্থানে নতুন কিছুর আবির্ভাব না হলে, লক্ষ্য করি। উন্নতশীল দেশগুলোতে একই ধরনের সামাজিক মূল্যবোধহীনতাজনিত পরিস্থিতি লক্ষ্য করি যারা আধুনিকায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে এখনও রয়েছে।

ষোড়শ শতকে, সংস্কারকদের মাঝে এই বিচ্ছিন্নতাবোধ স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যারা ইউরোপের ধর্মকে আরো পরিশীলিত পরিমার্জিত এবং আধুনিক করার প্রয়াস নিয়েছেন। মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৩৬) যন্ত্রণাদায়ক হতাশা আর ক্রোধের আকস্মিক বহিঃপ্রকাশের শিকার হয়েছেন। উলরিখ জিংলী (১৪৮৪-১৫৩১), এবং জন ক্যালভিন (১৫০৯-৬৪) লুথারের বিবশ করা অসহায়ত্ব তারাও মানুষের অস্তিত্বের পরীক্ষার সামনে অনুভব করতেন– একটা ব্যাধি যা তাদের সমাধান খুঁজতে বাধ্য করেছে। তাদের পরিমার্জিত খ্রিস্টানধর্ম দেখায় যে বিকাশমান আধুনিক সত্তা পৌরাণিক চেতনাবোধ থেকে কতটা বিপরীত। প্রাক আধুনিক ধর্মে, সাদৃশতাকে পরিচয় হিসাবে দেখা হতো, তাই প্রতীক ছিল যে বাস্তবতা উপস্থাপন করে তার সাথে সম্পর্কিত। এখন, সংস্কারকদের মতামত অনুসারে, ইউক্যাবিষ্টের মতো কোনো কৃত্য ‘কেবল’ একটা প্রতীক- যা অপরিহার্যভাবে আলাদা। কোনো প্রাক আধুনিক কৃত্যর ন্যায়, খ্রিস্টের বলিসদৃশ মৃত্যু খ্রিস্টের নৈশভোজের পর্ব উদ্‌যাপনে পুনরায় বিধিবদ্ধ হয়েছে, যা পৌরাণিক হবার কারণে সময়নিরপেক্ষ এবং একে বর্তমান বাস্তবতায় পরিণত করেছে। সংস্কারকদের কাছে, এটা কেবল বিগত দিনের অনুষ্ঠানের একটা স্মারক মাত্র। বাইবেল সম্বন্ধে নতুন গুরুত্ব আরোপিত হয়, কিন্তু ছাপাখানার আবিষ্কার এবং শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি পবিত্র ভাষ্যের ব্যাপারে মানুষের ধারণা দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে। নিরব নিভৃত পাঠের স্থান নিয়েছে গণ-প্রার্থনা। মানুষ এখন অনেক বিশদভাবে বাইবেলকে জানতে পারে এবং তাদের নিজস্ব ধারণা থেকে, কিন্তু এখন আর একে ধর্মীয় আচারের অংশ হিসাবে পাঠ করা হয় না, অন্যান্য আধুনিক গ্রন্থের ন্যায়, বস্তুনিষ্ঠ উপাত্তের জন্য লোকায়ত ভঙ্গিতে সহজেই এটার পাঠ করা সম্ভব।

জীবনের প্রায় সব জিনিসের ন্যায়, অনেক আধুনিক আবিষ্কারও ঝামেলা সৃষ্টিকারী। নতুন জ্যোতির্বিদ্যা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের মুগ্ধ করা দৃশ্য অবারিত করেছে। নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) তার নতুন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন যা তার মাঝে ভয় আর শ্রদ্ধামিশ্রিত সম্মানবোধের উদ্রেক ঘটিয়েছিল। কিন্তু তার প্রাপ্ত ফলাফল ছিল বিভ্রান্তকারী। পুরাণ মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল যে বিশ্বের নির্যাসের সাথে তারা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত কিন্তু এখন এটা প্রতীয়মান হয় যে একটা ক্ষুদ্র নক্ষত্রের চারপাশে ঘূর্ণায়মান স্বতন্ত্রতাহীন গ্রহে কেবল প্রান্তিক অবস্থান তাদের রয়েছে। তারা আর নিজেদের উপলব্ধিকে বিশ্বাস করতে পারে না, কারণ আপাত স্থির পৃথিবী আসলে প্রবল গতিশীল। নিজেদের নিজস্ব ধারণা সৃষ্টির ব্যাপারে তারা ক্রমশ উৎসাহী হয়ে উঠে কিন্তু তারা আরও বেশি বেশি করে আধুনিক ‘বিশেষজ্ঞ’দের অধীন হয়ে পড়ে, যারাই কেবল বস্তুর প্রকৃতির গোপনীয়তা উদ্ঘাটন করতে সক্ষম।

বৃটেনে, ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) স্বাধীনতার একটা ঘোষণা দেন, বিজ্ঞানকে পুরাণের বন্ধন থেকে স্বাধীন করতে। Advancement of Learning-এ (১৬০৫) তিনি একটি নতুন গৌরবময় যুগের ঘোষণা করেন। মানুষের দুর্দশা বিনাশ করে বিজ্ঞান পৃথিবীকে রক্ষা করবে। কোনো কিছুই এই পরিবর্তনের গতি রোধ করতে পারবে না। সব ধর্মীয় পুরাণকে কঠোর সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করতে হবে এবং তারা যদি প্রমাণিত ঘটনার বিরোধিতা করে তবে তাদের একপাশে বাতিল বলে সরিয়ে রাখতে হবে। এই সত্যের সন্ধান কেবলমাত্র যুক্তি দিতে পারে। স্যার আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) সম্ভবত প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এই প্রায়োগিক মূল্যবোধ পুরোপুরি আত্মস্থ করেছিলেন, পরীক্ষা এবং বিশ্লেষণের বিকাশমান বৈজ্ঞানিক ধারা কঠোরভাবে ব্যবহার করে তিনি তার পূর্ববর্তীদের প্রাপ্ত তথ্যের সংশ্লেষণ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে তিনি মানুষের জন্য পৃথিবী সম্বন্ধে নজীরবিহীন এবং নির্দিষ্ট তথ্য হাজির করছেন, তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে ব্যবস্থা আবিষ্কার করেছেন তা পুরোপুরি প্রকৃত ঘটনার সাথে মিলে যায় এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, মহান ‘মেকানিক’ যিনি দুর্বোধ্য বিশ্ব ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছেন।

কিন্তু লোগোস এই সম্পূর্ণ অবগাহন উপলব্ধির অন্তজ্ঞানের রূপ আরো বেশি মূল্যায়ন করা নিউটনের জন্য অসম্ভব করে তোলে। তার কাছে পৌরাণিক তত্ত্ব আর মরমীবাদ ছিল চিন্তাধারার আদিম পদ্ধতি। তিনি অনুভব করেন খ্রিস্টান ধর্মকে ট্রিনিটির মতো মতবাদ থেকে মুক্ত করা তার কর্তব্য, যা যুক্তির নীতিসমূহ অমান্য করে। তিনি এটা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন যে চতুর্থ শতকের গ্রীক ধর্মবেত্তার দল এই মতবাদ কেবল একটা পুরাণ হিসাবে কল্পনা করেছিলেন, যা অনেকটা ইহুদি কাবালিস্টদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। নিসসার বিশপ (৩৩৫-৩৯৫) গ্রেগরী যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, পিতাপুত্র আর পবিত্র সত্তা, মোটেই অস্তিত্বের স্বরূপ বিষয়ক বাস্তবতা না কিন্তু আমরা এই পদগুলো ব্যবহার করি; আমাদের মানবমনের সীমাবদ্ধতা সাপেক্ষে ‘নামহীন অব্যক্ত’ দিব্যসত্তা কিভাবে নিজেকে অভিযোজিত করে, সেটা প্রকাশ করতে।[১০০] যুক্তিপাতের দ্বারা আমরা ট্রিনিটির অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারব না। কবিতা বা সঙ্গীতে বিস্মৃতিপ্রবণ অর্থের চেয়ে বেশি কিছু এটা দ্বারা বোঝানো হয় না। কিন্তু নিউটন কেবল যৌক্তিকভাবেই ট্রিনিটির নিকটবর্তী হতে পারতেন। কোনো কিছু যদি যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা না যায়, তবে সেটা মিথ্যা। ‘ধর্মের ক্ষেত্রে মানব জাতির কুসংস্কারাচ্ছন্ন অংশের আর উগ্রতার মাত্রা এটা,’ তিনি বিরক্ত হয়ে লেখেন, ‘সবসময়েই রহস্যের ভক্ত আর সে কারণে যেটা সবচেয়ে কম বোঝে সেটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে’[১০১] বর্তমানের কসমোলজিষ্টরা নিউটনের যৌক্তিক ঈশ্বরে আর বিশ্বাস রাখেন না কিন্তু পশ্চিমের অনেক লোকই তার যুক্তিকে প্রাধান্য দেয়া আর পুরাণ সম্বন্ধে অস্বস্তিবোধে ভোগে এমনকি ধর্মীয় ব্যাপারেও। নিউটনের মতো, তারাও মনে করে যে ঈশ্বরের প্রকাশযোগ্য আর বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা থাকা উচিত। যাই হোক বহুসংখ্যক পশ্চিমা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী ট্রিনিটিকে নিয়ে প্রায়ই সমস্যায় পড়ে। নিউটনের মতো তারাও অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয় যে ট্রিনিটি সম্বন্ধীয় পুরাণের সৃষ্টি হয়েছিল খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের এটা স্মরণ করিয়ে দিতে যে তারা যেন দৈবকে ব্যক্তিত্বের মামুলি আঙ্গিকে চিন্তা করার চেষ্টা না করে।[১০২]

বৈজ্ঞানিক লোগোস আর পুরাণ ক্রমশ পরস্পরবিরোধী হয়ে উঠছে। এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান পুরাণের বিভিন্ন অংশের মাঝে পরিচালিত হয়েছে যা এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে। ফরাসী গণিতবিদ রেইসী প্যাসকেল (১৬২৩-৬২) ছিলেন পরম ধার্মিক একজন মানুষ, যখন তিনি অনন্ত বিশ্বের ‘চিরন্তন নিরবতা, আধুনিক বিজ্ঞান যা উন্মুক্ত করেছে, বিবেচনা করেন তার মন আতঙ্কিত হয়ে উঠে।

মানুষের অন্ধ দুর্দশাময় অবস্থা আমি যখন দেখি, সমগ্র বিশ্বকে আমি যখন এর নিরবতার মাঝে পর্যবেক্ষণ করি, এবং আলো ছাড়া মানুষ একাকী পড়ে রয়েছে যেন বিশ্বের এই কোণে সে হারিয়ে গেছে জানেও না কে তাকে এখানে স্থাপন করেছে, কি তার করণীয়, বা মারা গেলে তার কি হবে, কোনো কিছু জানতে অক্ষম, আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠি, সেই মানুষের মতো ঘুমের মাঝে যাকে কোনো ভয়ংকর নিঃসঙ্গ দ্বীপে স্থানান্তরিত করা হয়েছে, পালাবার পথ বিচ্ছিন্ন এই একটা অনুভূতি নিয়ে যে জেগে উঠেছে। তারপরে আমি বিস্মিত হই, এত দুর্দশাপূর্ণ অবস্থাতেও মানুষকে হতাশ না হতে দেখে।[১০৩]

এই ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ আধুনিক অভিজ্ঞতারও অংশ।

অষ্টাদশ শতকের যুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশের কালে এই মেঘ কিছুটা দূর হয়েছিল বলে মনে হয়। জন লক (১৬৩২-১৭০৪) অনুধাবন করেন যে দিব্যের অস্তিত্ব প্রমাণ করা অসম্ভব, কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না, এবং বিশ্বাস করতেন মানবতা একটা গঠনমূলক যুগে প্রবেশ করেছে। আলোকপ্রাপ্ত ফরাসী আর জার্মান দার্শনিকের দল পুরাতন মরমীবাদ আর পৌরাণিক ধর্মকে বাতিল হিসাবে দেখতেন। বৃটিশ ধর্মবেত্তা জন টোল্যান্ড (১৬৭০-১৭২২) আর ম্যাথিউ টিনডালও (১৬৫৫-১৭৩৩) একই মত পোষণ করতেন। সত্যের সন্ধান কেবল লোগোস দিতে পারে এবং মরমীতত্ত্ব আর পৌরাণিকতার নিগড় থেকে খ্রিস্টান ধর্মকে মুক্ত হতে হবে। পুরাতন পুরাণগুলোকে, সেগুলো যেন লোগোই (Logoi) এভাবে ব্যাখ্যা করা শুরু হয়, একটা সম্পূর্ণ নতুন ধারা ব্যর্থতা তার নিয়তি, কারণ এসব গল্প কখনও বস্তুনিষ্ঠ ছিল না।

যদিও, স্ববিরোধী হলেও, Age of Reason অযৌক্তিকতার উৎপাত প্রত্যক্ষ করে। ষোড়শ আর সপ্তদশ শতকের ব্যাপক ডাইনী ভীতি যা ইউরোপের ক্যাথলিক আর প্রোটেষ্ট্যান্ট অনেক দেশকে ছারখার করে দিয়েছে, প্রমাণ করেছে যে মনের অশুভ শক্তিগুলোকে বৈজ্ঞানিক যুক্তিপাত দমিয়ে রাখতে অপারগ। ডাইনী ভীতি ছিল একটা সমন্বিত অশুভ কল্পনার ফসল যা হাজার হাজার নারী ও পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড আর নির্যাতন নিপীড়নের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। মানুষ তখন বিশ্বাস করত ডাইনীদের শয়তানের সাথে যৌন সম্পর্ক রয়েছে এবং বাতাসে ভেসে শয়তানের বন্য আনন্দোৎসবে তারা যোগ দিতে যায়। মানুষের অবচেতন মনের ভয় ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো শক্তিশালী পুরাণের অনুপস্থিতির কারণে তারা তাদের ভয়কে যুক্তির মোড়কে সিদ্ধ করতে চেয়েছে। ভীতিকর আর বিধ্বংসী কু-যুক্তি সবসময়ে মানুষের অভিজ্ঞতার অংশ হিসাবে বিরাজ করেছে এবং এখনও করছে। নতুন খ্রিস্টান আন্দোলনে খুব জোরালোভাবে এর উন্মেষ ঘটেছে যা আলোকিত যুগের ধারণাসমূহকে ধর্মীয় আঙ্গিকে ভাষান্তরের চেষ্টা করেছে। বন্ধুসভার সদস্যদের (Quaker) এই বিশেষ নামে ডাকা হয় কারণ তাদের সমাবেশের সময়ে তারা শিহরিত হয়, নেকড়ের মতো হুঙ্কার করে আর তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠে পিউরিটানদের অনেকে সফল পুঁজিপতি এবং খ্যাতিমান বিজ্ঞানী হলেও অব্যবস্থিত আধ্যাত্মিকতা এবং স্নায়বিক রূপান্তরের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন অনেকেরই তা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। ব্যাপকসংখ্যক হতাশার শিকার হন এবং কেউ কেউ এমনকি আত্মহত্যাও করে।[১০৪] নিউ ইংল্যাণ্ডের (১৭৩৪-৪০) প্রথম মহান জাগরণের সময়ও একই লক্ষণ আবার দেখা যায়। সকলেই মরমীবাদে দক্ষতা লাভের চেষ্টা করে। কিন্তু মরমীবাদের উচ্চতর মার্গ সকলের জন্য না। বিশেষ প্রতিভা, মানসিকতা আর গুরু শিষ্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন এর জন্য। অদক্ষ লোকের সমন্বয়ে গঠিত দলের অভিজ্ঞতা গণ উন্মত্ততা এমনকি মানসিক অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে।

উনিশ শতক নাগাদ, ইউরোপের মানুষ ধর্মকে ক্ষতিকর হিসাবে ভাবতে শুরু করে। লুডউইগ ফয়েরবাখ (১৮০৪-৭২) যুক্তি উপস্থাপন করেন যে এটা মানুষকে মানবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং কার্ল মার্কস (১৮১৮-৮৩) ধর্মকে অসুস্থ সমাজের উপসর্গ হিসাবে বিবেচনা করেন। আর সত্যিই সেই সময়ের পৌরাণিক ধর্ম একটা অস্বাস্থ্যকর বিরোধ সৃষ্টির ক্ষমতা রাখতো। এটা ছিল বিজ্ঞানের যুগ এবং মানুষ বিশ্বাস করতে চাইতো যে তাদের সনাতন আচার অনুষ্ঠান নুতন যুগের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, কিন্তু পুরাণগুলোকে সাহিত্যের আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করতে গেলে সেটা অসম্ভব একটা প্রকল্পে পরিণত হয়। চার্লস ডারউইন (১৮০৯-৮২) The Origin of Species (১৮৫৮) প্রকাশ করলে উন্মাদনায় যেন ঢাকের বোল পড়ে। ধর্মকে আঘাত করার কোনো উদ্দেশ্য বইটার ছিল না, এটা ছিল, বৈজ্ঞানিক উপপ্রমেয়র একটা সংযমী অনুসন্ধান। কিন্তু সে সময়ে মানুষ সৃষ্টিতত্ত্বের বিবর্তন তত্ত্ব এমন ভঙ্গিতে পাঠ করতো যেন সেটা প্রকৃত ঘটনা, অনেক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অনুভব করেন- এবং আজও অনুভব করেন যে বিশ্বাসের সৌধ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। সৃষ্টির গল্পগুলোকে কখনও ঐতিহাসিকভাবে নির্ভুল বিবেচনা করা হয়নি; উপশম আনয়নকারী হিসাবেই এগুলোকে দেখা হতো। কিন্তু কেউ যদি সৃষ্টিতত্ত্বকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্ভুল মনে করে পাঠ শুরু করে তাহলে সেটা হবে অপবিজ্ঞান আর অধর্মের নামান্তর।

নতুন Higher Criticism, আধুনিক বৈজ্ঞানিক নিয়মসংক্রান্ত বিজ্ঞানের পদ্ধতি স্বয়ং বাইবেলের উপর আরোপ করে দেখিয়েছে যে অক্ষরে অক্ষরে বাইবেল পাঠ করা একটা অসম্ভব ব্যাপার। এর কিছু কিছু দাবী প্রত্যক্ষ প্রমাণজনিত কারণে অসত্য। Pentateuch মোটেই মূসা (আঃ) রচনা করেন নাই, অনেক পরে একাধিক লেখকের দ্বারা এটা লিখিত; স্তুতিগানগুলো কিং ডেভিডের রচনা না; অলৌকিক গল্পগুলোর বেশির ভাগই সাহিত্যের আলঙ্কারিক প্রয়োগ। বাইবেলীয় ভাষ্যগুলো ‘পুরাণ’ এবং প্রচলিত বাচনভঙ্গিতে রচিত যার মানে সেগুলো সত্য না। প্রটেষ্ট্যান্ট মৌলবাদীরা Higher Criticism-কে এখনও জুজুর মতো ভয় করে, তারা দাবী করে যে বাইবেলের প্রতিটা অক্ষর সাহিত্যের দৃষ্টিতে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আর ঐতিহাসিকভাবে সত্য- সমর্থনের অযোগ্য একটা অবস্থান যা ব্যপনয়ন / অপহ্নব আর রক্ষণাত্মক তর্কের সূচনা করে।

উনিশ শতকের শেষ নাগাদ, লোগোস আর মিথোসের মাঝে বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হয়। টমাস এইচ. হাক্সলির (১৮২৫-৯৫) মতো ধর্মযোদ্ধারা বিশ্বাস করতেন এটা তাদেরই দায়িত্ব। পুরাণ আর যুক্তিবাদী বিজ্ঞানের মধ্যে থেকে একটা বেছে নিতে হবে এবং এতে কোনো আপোস চলবে না। যুক্তিই কেবল সত্যি আর ধর্মীয় পুরাণ সত্যরহিত। কিন্তু সত্যের মানে এখন ‘প্রদর্শিত আর প্রদর্শনযোগ্য’[১০৫] এর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে, ধর্মকে পাশে রেখে, যা সঙ্গীত আর চিত্রকলা দ্বারা কথিত সত্যকে বর্জন করবে। পুরাণকে যৌক্তিক ভেবে নিয়ে, আধুনিক বিজ্ঞানী আর দার্শনিকের দল একে অবিশ্বাস্য করে তুলেছেন। ১৮৮২ সালে, ফ্রেডারিক নিশে (১৮৪৪-১৯০০) ঘোষণা করেন যে ঈশ্বর মৃত। এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে তার কথাই ঠিক। পুরাণ, কৃত্যানুষ্ঠান, প্রার্থনার প্রথা, নৈতিক জীবনযাপন ব্যতীত, দিব্যচেতনা মারা যাবে। “ঈশ্বর’কে পুরোপুরি নিদর্শনমূলক সত্যে পরিণত করে, যা কেবল সমালোচনামূলক বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা বোঝা যায়, আধুনিক নারী ও পুরুষ তাদের জন্য একে হত্যা করেছে। নিটশের রূপক কাহিনী The Gay Science-এর পাগল লোকটা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বরের মৃত্যুতে মানবতা তার মূল থেকে বিচ্যুত হয়েছে। ‘উপর বা নিচ বলে কিছু কি এখনও আছে?’ সে জানতে চায়। “অনন্ত অসারতার মধ্যে দিয়ে আমরা কি পথভ্রষ্ট হইনি?”

পৌরাণিক চিন্তা আর আচরণ মানুষকে অসারতা আর বিলুপ্তির সম্ভাবনা মোকাবেলা করতে সাহায্য করতো এবং এর মধ্যে দিয়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতো। এই ধারাটা ছাড়া অনেকের পক্ষেই হতাশার থাবা এড়ানো অসম্ভব ছিল। বিংশ শতাব্দী আমাদের একের পর এক নাস্তিবাদী স্মারক উপহার দিয়েছে এবং আধুনিকতার অনেক অসংযত আশা মিথ্যা হিসাব প্রকাশ পেয়েছে। ১৯১২ সালে টাইটানিকের সলিল সমাধি হওয়াটা প্রযুক্তির নশ্বরতা আমাদের সামনে তুলে ধরে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখা যায় যে, আমাদের বন্ধু, বিজ্ঞানকে, আয়ুধের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে নিয়োগ করা সম্ভব, অসউইচ, গুলাগ আর বসনিয়ায় আমরা দেখি ঐশ্বরিকতার সব বোধ নষ্ট হলে কি ঘটতে পারে। আমরা জেনেছি যে যৌক্তিক শিক্ষা মানবতাকে বর্বরতা থেকে মুক্তি দেবে না, এবং বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের অস্তিত্ব নাকচ করা যাবে না। হিরোশিমা নাগাসাকির উপরে প্রথম আণবিক বোমার বিস্ফোরণ আধুনিক সংস্কৃতির মূলে আত্মনাশী নাস্তিবাদী জীবাণু উন্মোচিত করেছে; ২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা দেখিয়েছে যে আধুনিকতার সুবিধাসমূহ– প্রযুক্তি, অনায়াস ভ্রমণ আর বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থা–আতঙ্কের অনুষঙ্গে পরিণত হতে পারে।

লোগোস অনেকভাবে আমাদের জীবন পরিবর্তিত করে তাকে উন্নত করেছে, কিন্তু এটা কোনো নিরঙ্কুশ অর্জন না। আমাদের পৌরাণিকতারহিত পৃথিবী আমাদের অনেকের জন্য আরামপ্রদ, আমরা যারা প্রথম বিশ্বে বাস করার মতো ভাগ্যবান কিন্তু বেকন আর লক যে পার্থিব স্বর্গের কল্পনা করেছিলেন সেটা আর যাই হোক এটা না। আমরা বিংশ শতাব্দীর নানা অশুভ আগমন বার্তা যখন বিবেচনা করি, তখন দেখি যে আধুনিক দুশ্চিন্তা কেবল আত্মপ্রশ্রয়ী খেপাটে স্বভাবের মামুলি ফলাফল না। নজিরবিহীন কিছু একটার প্রথমবারের মতো আমরা মুখোমুখি হয়েছি। অন্যান্য সমাজে মৃত্যুকে অস্তিত্বের একটা ধরন থেকে অন্য একটা ধরনে রূপান্তর হিসাবে দেখা হয়। পরকাল সম্বন্ধে কোনো ধরনের অবিমিশ্র, স্থূল ধারণা তারা লালন করে না, কিন্তু পরিকল্পিত কৃত্য আর পুরাণ মানুষকে অবর্ণনীয়ের মুখোমুখি হতে সাহায্য করে। অন্য কোনো সংস্কৃতিতে কেউ অতিক্রমণের বা দীক্ষাদানের মাঝপথে আতঙ্কের শেষ না দেখে থামবে না। কিন্তু টেকসই পুরাণের অনুপস্থিতিতে আমরা ঠিক সেটাই করছি। পুরাণের বর্তমান বর্জনের মাঝে একটা মর্মস্পর্শী ও বীরোচিত সন্ন্যাস রয়েছে। কিন্তু একেবারে যৌক্তিক, রৈখিক আর ঐতিহাসিক চিন্তার ধরন আমাদের অনেককেই উপশম আর মাধ্যমের সাহায্য থেকে বঞ্চিত করছে যা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে তাদের মানবতার পূর্ণ সম্পদের উপর নির্ভর করে অগ্রহণযোগ্যতার সাথে বাস করতে সাহায্য করে।

আমরা হয়তো বৈষয়িক দিকে অনেক বেশি পরিশীলিত হয়েছি, কিন্তু আধ্যাত্মিকভাবে আমরা এখনও অ্যাক্সিয়াল যুগের ঊর্ধ্বে যেতে পারিনিঃ মিথোসের অবদমনের ফলে হয়তো আমাদের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। আমাদের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতের ‘ঊর্ধ্বে’ উঠতে এবং ‘পুরোপুরি’ আরও প্রবল, পরিপূর্ণ অস্তিত্বে প্রবেশ করতে দেরি আছে। চিত্রকলা, মাদকদ্রব্য, রক সঙ্গীত বা চলচ্চিত্রের জীবনের চেয়ে বড় দৃষ্টরূপে প্রবেশ করে আমরা এই মাত্রায় বিলীন হতে চাই। আমরা আজও বীরের পূজারী। প্রিন্সেস ডায়ানা আর এলভিস প্রিসলী তাই সাথে সাথে পৌরাণিক সত্তায় পরিণত হয় এমনকি ধর্মীয় প্রার্থনাসভার কাল্টের বিষয়ে পরিণত হয়। বীরের পুরাণ আমাদের শ্রদ্ধার স্মারক সরবরাহ করবে সেটা অভিপ্রেত না কিন্তু বীরত্বের শোণিত ধারা আমাদের মাঝে সঞ্চারিত করবে সে লক্ষ্যে পরিকল্পিত। অপ্রতিরোধী বিবেচনা না অংশগ্রহণ বা সীমিতকরণের দিকে পুরাণকে অবশ্যই পথ দেখাতে হবে। আমরা আজ জানি না কিভাবে আমাদের পৌরাণিক জীবনকে বশে আনতে পারি এমনভাবে যা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং রূপান্তরযোগ্য।

পুরাণ মিথ্যা বা চিন্তাধারার নিকৃষ্টতম ধরনের উপস্থাপক ঊনবিংশ শতকের ভ্রান্তির এই মায়াজাল থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। আমরা আমাদের পুরোপুরি পুনর্গঠন করতে পারব না, আমাদের শিক্ষার যৌক্তিক দুর্বলতা নাকচ করে প্রাক আধুনিক সুকুমার আবেগ, সংবেদনশীলতায় ফিরে যাওয়া আমাদের পক্ষে আর সম্ভব না। কিন্তু পৌরাণিক তত্ত্বের প্রতি আমরা অনেক পরিশীলিত মনোভাব অর্জন করতে পারি। আমরা পুরাণ সৃষ্টিকারী প্রাণী এবং বিংশ শতাব্দী জুড়ে আমরা কিছু অতীব ধ্বংসাত্মক আধুনিক পুরাণ দেখেছি, যার শেষ হয়েছে রক্তপাত আর গণহত্যার ভিতর দিয়ে। অ্যাক্সিয়াল যুগের বৈশিষ্ট্য অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় এসব পুরাণ ব্যর্থ হয়েছে। সহানুভূতিশীলতা, সব জীবনই মূল্যবান বা কনফুসিয়াস যাকে বলেছিলেন ‘Leaning’ তার প্রতি কোনো প্রকার ভক্তি এসব গুণাবলী আধুনিক পুরাণে সঞ্চারিত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এসব ধ্বংসাত্মক পুরাণ সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতের বিভক্তি দ্বারা অভিযুক্ত আর অন্যদের আসুরিকভাবে দমন করে নিজের আত্মপ্রচারের একটা স্বার্থপর প্রচেষ্টা। এমনসব পুরাণের কারণেই আধুনিকতা ব্যর্থ হয়েছে, যা একটা বিশ্ব বসতি তৈরি করেছে যেখানে প্রতিটা মানুষ আজ নিজেদের একই ধরনের বিপাকে দেখতে পাচ্ছে। কেবল যুক্তির দ্বারা এসব পুরাণকে পরাস্ত করা সম্ভব না কারণ এ ধরনের সুদূরপ্রসারিত, মন্ত্রপূত ভয়, আকাঙ্ক্ষা এবং স্নায়বিক বৈকল্যকে কেবলমাত্র আনাড়ি লোগোসের দ্বারা দূর করা সম্ভব না। আধ্যাত্মিক আর নৈতিকভাবে পুষ্ট পুরাণের কাজ সেটা।

আজ আমাদের এমন পুরাণ প্রয়োজন যা অন্য সব মানুষের সাথে নিজেদের চিহ্নিত করতে আমাদের সহায়তা করবে, যারা আমাদের জাতীয়, আদর্শগত বা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত না। করুণার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে এমন পুরাণ আজ আমাদের প্রয়োজন যাকে আমাদের যৌক্তিক প্রয়োগবাদী পৃথিবীতে দক্ষ বা যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদনশীল হিসাবে গণ্য করা হয় না। আমাদের আশু প্রয়োজনকে ছাপিয়ে দেখতে সাহায্য করে এমন আধ্যাত্মিক মনোভাব গড়ে তুলবে আমাদের আজ সেই পুরাণ দরকার এবং আমাদের পরিশীলিত স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে প্রশ্নের আঙ্গুল তুলবে যা আমাদের একটা সর্বব্যাপী বোধ অনুভবে সাহায্য করবে। কেবল তার ‘সম্পদ’ ব্যবহার না করে, পৃথিবীকে ঐশ্বরিক হিসাবে আমাদের আরো একবার সম্মান করতে শেখাবে, এমন পুরাণ আজ প্রয়োজন। এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ কোনো ধরনের আধ্যাত্মিক বিপ্লব, যা আমাদের প্রযুক্তিগত প্রতিভার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম, না হলে, আমরা আমাদের পৃথিবীকে বাঁচাতে পারব না।

১৯২২ সালে, টি.এস. এলিয়ট তার বিখ্যাত কবিতা The Waste Land-এ পশ্চিমা সংস্কৃতির এই আধ্যাত্মিক বিখণ্ডায়ন চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। Holy Grail- এর পুরাণে, ওয়েস্টল্যাণ্ডের লোকেরা কৃত্রিম জীবনযাপন করে, কোনোপ্রকার বিশ্বাস ছাড়া অন্ধভাবে সমাজের রীতিনীতি অনুসরণ করে গভীর অনুকম্পা থেকে যার উৎপত্তি। নিজের সংস্কৃতির পৌরাণিক ভিত্তির পরশ যেখানে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে সেখানে কি আধুনিকতার ‘পাথুরে জঞ্জালে’ সৃষ্টিশীলতার মূল প্রোথিত করা সম্ভব? নিজেদের রীতিনীতির অন্তর্নিহিত প্রাঞ্জলতা অনুধাবনের পরিবর্তে তারা জানে কেবল ‘ভাঙ্গা প্রতিমার এক ঢেলা’। অতীতের পুরাণের মর্মভেদী যথাযথ উল্লেখের সাহায্যে- ইউরোপীয়, সংস্কৃত, বৌদ্ধ, বাইবেলীয়, গ্রীক আর রোমান পুরাণ- আধুনিক জীবনের বন্ধ্যাত্বকে প্রকাশ করেন এলিয়ট; এর বিচ্ছিন্নতাবোধ, অবসাদ, বিষণ্ণতা, নাস্তিবাদী, কুসংস্কার, হতাশা আর আত্মপ্রচার। পশ্চিমা সভ্যতার আশু বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তার কথক উপসংহার টানে : ‘আমার ধ্বংসের মাঝে এসব টুকরো আমি বিলিয়ে দিলাম।’ অতীতের অন্তর্দৃষ্টির এই খণ্ডিতাংশ যা এই কবিতায় তিনি একত্রিত করেছেন আমাদের বাঁচিয়ে দিতে পারে। এই টুকরোগুলোকে একত্রিত করে আমরা তাদের সাধারণ নির্যাসটুকু যদি অনুধাবন করতে পারি, আমরা আমাদের ওয়েস্টল্যাণ্ড যেখানে আমরা বাস করতাম পুনরুদ্ধার করতে পারব।

ইলিয়টের কবিতাটা ছিল ভাবীসূচক। ধর্মীয় নেতাদের চাইতে লেখক আর শিল্পীর দলই শূন্যতায় অবগাহন করে আমাদের অতীতের পৌরাণিক প্রজ্ঞার সাথে পুনরায় পরিচয় করাতে চেষ্টা করেছে। তাদের আধুনিকতার হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতা আর বন্ধ্যাত্বের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক খুঁজে পাবার প্রচেষ্টায় অনেকেই যেমন চিত্রশিল্পীদের কথাই ধরা যাক, পৌরাণিক ভাবধারায় মনোনিবেশ করেছেন। ১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল, স্পেনের গৃহযুদ্ধ যখন তুমুল আকার ধারণ করেছে, নাজী যুদ্ধবিমান, জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সরাসরি নির্দেশে বাসক রাজধানী গুয়েরনিকায় হাটবারে আক্রমণ করে, এর ৭০০০ অধিবাসীর ১৬৫৪ জনকে হত্যা করে। কয়েক মাস পরে, প্যারিসে এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পাবলো পিকাসো তার গুয়েরনিকা চিত্রকর্মটি প্রদর্শিত করেন। এই আধুনিক লোকায়ত ক্রুশবিদ্ধকরণ তার সমসাময়িকদের চমকে দেয় এবং The waste Land-এর মতো এটাও ছিল ভাবীসূচক একটা বক্তব্য এবং নতুন বিশ্বের কাছে এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে নব জাগরণের প্রয়াস।

চিত্রকর্মটা ছিল করুণাঋদ্ধ, অন্যের যন্ত্রণা অনুভব করার ক্ষমতাযুক্ত। প্রাচীন পৌরাণিক নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেক সময় উৎসর্গ একটা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। প্যালিওলিথিক সময়ে মানুষ যেসব পশু শিকার এবং হত্যা করতো তারা তাদের প্রতি এক ধরনের যন্ত্রণাদায়ক স্বভাবগত সাযুজ্য অনুভব করতো। উৎসবের আচার অনুষ্ঠানে তারা তাদের এই অপরিণত দুর্দশা ব্যক্ত করতো যা মানবতার খাতিরে হত হওয়া সেই জন্তুকে সম্মান জানাত। গুয়েরনিকায়, মানুষ আর পশু উভয়েই এলোপাথাড়ি বাছবিচারহীন হত্যাযজ্ঞের শিকার, তালগোল পাকিয়ে একটা স্তূপের ন্যায় পড়ে আছে, যন্ত্রণায় অস্থির ঘোড়া অনিস্তার্যভাবে কবন্ধ শবের সাথে জড়িয়ে যায়। যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার অগণিত চিত্রে ক্রুশের পায়ের কাছের রমণীদের কথা মনে করিয়ে দেয়, দুই মহিলার চোখে আহত ঘোড়ার যন্ত্রণার সাথে বিষাদঘন একাত্মতা। প্রাগৈতিহাসিক সমাজে মহান মাতা একজন অপ্রশম্য শিকারী, কিন্তু পিকাসোর চিত্রকর্মে, মা তার মৃত সন্তানের নিস্তেজ শরীর জড়িয়ে আছে, নিজেই উপদ্রুত হয়ে নির্বাক আর্তনাদে মুখরিত। তার পেছনেই একটা মোষ, যা পিকাসো বলেন, নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক। বুলফাইটের দর্শনীয় আচারঅনুষ্ঠান সবসময়েই পিকাসোকে মুগ্ধ করেছে, স্পেনের এই জাতীয় খেলার যোগ আছে অতীতের উৎসর্গের আনুষ্ঠানিকতার সাথে। পিকাসোর মোষ দেখতে নির্মম না; অন্যান্য উপদ্রুতদের সাথে সে দাঁড়িয়ে, লেজ আছড়ায় আর দৃশ্যপট জরিপ করে। হয়তো এটাই বোঝাতে চায় সে বুলফাইটের সেই মুহূর্তে সে পৌঁছে গেছে যখন সে আক্রমণ বাদ দিয়ে দাঁড়িয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ চিন্তা করছে। কিন্তু নিজেই বলির শিকার হবার কারণে, নিষ্ঠুরতার প্রতীক, মোষের ধ্বংস অনিবার্য। আর তাই- পিকাসোও হয়তো বলতে চান– আধুনিক মানবতাও তাই যা– যদিও পিকাসোর পক্ষে সেটা জানা সম্ভব না- যৌক্তিকভাবে নিরূপিত হিংসা আর আত্মনাশী প্রবণতার পূর্ণ সম্ভাবনা সবেমাত্রই খোঁজ করতে শুরু করেছে।

উপন্যাস লিখিয়ের দলও আধুনিকতার দুর্দশা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে পুরাণের দ্বারস্থ হয়েছেন। The Waste Land-এর সাথে একই বছর প্রকাশিত জেমস জয়েসের ইউলিসিসের কথা আমাদের ভাবা উচিত, যেখানে রয়েছে হোমারের ওডেসির বিভিন্ন অধ্যায়ের সাথে জয়েসের সমসাময়িক মুখ্য চরিত্রদের অভিজ্ঞতার একটা সঙ্গতিপূর্ণ বর্ণনা। মায়াবী বাস্তববাদীর দল- হোর্হে লুইস বোর্হেস, গুন্টার গ্রাস, ইটালো ক্যালভিনো, অ্যানজেলা কার্টার, সালমান রুশদী- লোগোসের আধিপত্যের প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন অব্যক্তের সাথে বাস্তবতাকে জুড়ে দিয়ে এবং রূপকথা আর স্বপ্নের পৌরাণিক যুক্তির দ্বারা আটপৌরে যুক্তির বিন্যাসকে একত্রিত করে। অন্য লেখকরা ভবিষ্যতের দিকে চোখ মেলেছেন। জর্জ অরওয়েলের Nineteen Eighty Four (১৯৪৯) পুলিশী রাষ্ট্রের বিপদ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দেয় যেখানে জোর যার মুল্লুক তার আর বর্তমানের সাথে খাপ খাওয়াবার জন্য অতীতকে ক্রমাগত বদলানো হয়। অরওয়েলের বক্তব্যের যথাযথ ব্যঞ্জনা নিয়ে প্রচুর তর্ক হয়েছে কিন্তু অতীতের মহান পুরাণের ন্যায়, এটা লৌকিক চেতনার প্রকাশ করেছে। উপন্যাসটার অনেক বাক্য আর দৃশ্যকল্প আমাদের দৈনন্দিন কথাবার্তায় প্রবেশ করেছে : বিগ ব্রাদার, ডবলথিঙ্ক, নিউজস্পেক, এবং রুম ১০১ এখনও ব্যবহৃত হয় ধারা চিহ্নিত করতে এবং আধুনিক জীবনের বৈশিষ্ট্যাবলী বোঝাতে, উপন্যাসটা যারা পড়েনি এমনকি তারাও এগুলো ব্যবহার করে।

কিন্তু লোকায়ত একটা উপন্যাস কি সত্যিই সনাতন পুরাণের পুনরাবৃত্তি করতে পারে, যেখানে দেবতা আর দেবীরা থাকবে? প্রাক আধুনিক পৃথিবীতে আমরা দেখেছি যে, পশ্চিমা লোগোসের দ্বারা আরোপিত অধিবিদ্যামূলক ধারণার শব্দ দ্বারা খুব কমই ঐশ্বরিকতাকে বোঝানো হতো কিন্তু মানুষকে তাদের মানবতা বোঝাতে যা সাধারণত সাহায্য করে। মানুষের অবস্থা বদলাবার সাথে সাথে, দেবতারা অনেক সময় অপসৃত হয়ে পুরাণে এবং ধর্মে একটা প্রান্তিক স্থান নেয়; কখনও অবশ্য একেবারেই হারিয়ে যায়। সমসাময়িক উপন্যাসের দেবতাহীন পুরাণে নতুন কিছু নেই যা প্রাচীন পুরাণের ন্যায় মানুষের অবস্থার একই ধরনের বিস্মৃতিপ্রবণ আর দুর্দম সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করে এবং আমাদের উপলব্ধি করায় যে- কেবল দেহটা নিয়েই মানুষের অস্তিত্ব না এবং সবারই দিব্য ঐশ্বরিক মূল্য রয়েছে।

পুরাণ নির্মাতাদের মতো লেখক আর শিল্পী দলের মাঝে একই মাত্রার বোধ কাজ করায়, সহজাতভাবেই তারা একই ধরনের ভাবধারার সহায়তা নেয়। জোসেফ কনরাডের Heart of Darkness কে একটা বীরোচিত অভিযাত্রা আর দীক্ষা হিসাবে দেখা যেতে পারে যা ব্যর্থ হয়েছে। ১৯০২ সালে প্রকাশিত, পশ্চিমের মোহভঙ্গ শুরু হবার ঠিক আগে, উপন্যাসটা আফ্রিকার গহীন বনে অতি-সভ্য মি. কার্টজের কিছুকাল অবস্থানের বর্ণনা। সনাতন পুরাণে, সামাজিক পৃথিবীর নিরাপত্তা পেছনে রেখে নায়ক এগিয়ে যায়। কখনও তাকে পাতালে নামতে হলে, সেখানে তার সাথে হয়তো নিজের অশঙ্কিত সত্তার দেখা হয়। বিচ্ছিন্নতা আর বঞ্চনার অভিজ্ঞতা থেকে স্নায়বিক বৈকল্য দেখা দিতে পারে, যা জীবনীয় অন্তর্জানের পথে নিয়ে যাবে। সে সফল হলে, নায়ক নতুন আর মূল্যবান কিছু একটা নিয়ে নিজের লোকের কাছে ফিরে আসে। কনরাডের উপন্যাসের সর্পিল অপকারী আফ্রিকার নদী আমাদের লাসাক্সের ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের কথা মনে করিয়ে দেয়, যার মাঝে হামাগুড়ি দিয়ে সম্ভাব্য সদস্য পৃথিবীর জঠরে ফিরে যায়। পাতালপুরীর আদিমতম জঙ্গলে, কার্টজ সত্যিই নিজের হৃদয়ের কলুষতায় উঁকি দেয়, কিন্তু নিজের প্রত্যাবৃত্তি অব্যাহত রাখে এবং আধ্যাত্মিকতায় অবগাহন করেই মারা যায়। সে একজন শামান, মানব-এ পরিণত হয় যার হৃদয়ে আফ্রিকার জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই কেবল ক্ষোভ রয়েছে যাদের উপরে সে অত্যাচার করে। পৌরাণিক নায়ক জানতে পারে যে, সে যদি নিজের সত্তাকে হত্যা করে, নতুন জীবনে তার পুনর্জন্ম হবে; কিন্তু কার্টজ বন্ধ্যা আত্মপ্রচারের ফাঁদে আটকে যায়, উপন্যাসে যখন সে শেষ পর্যন্ত এই ফাঁদ থেকে বের হয়, সে তখন সজীব শবদেহের অশ্লীলতায় পরিণত হয়েছে। নিজের খ্যাতির মোহে অন্ধ, কার্টজ বীরত্বের বদলে বন্ধ্যা খ্যাতি বেছে নেয়। জীবনের বীরোচিত প্রত্যয় ব্যক্ত করতে সে ব্যর্থ হয় : তার অন্তিম কথা ‘বিভীষিকা! কি বিভীষিকা!” কার্টজের অন্তিম বাক্যকে টি.এস. এলিয়ট The waste Land-এর এপিগ্রাফ করেছেন। কনরাড, সত্যিকারের এক দৈবজ্ঞ, বিংশ শতাব্দীর স্বার্থপরতা, লোভ, নাস্তিবাদ, হতাশা আর অকিঞ্চিৎকরতা সম্বন্ধে আমাদের জানিয়ে রেখেছেন।

টমাস মান তার The Magic Mountain উপন্যাসেও দীক্ষাদানের এই মোটিফ ব্যবহার করেছেন (১৯২৪), পশ্চিমা ইতিহাসের আরেক সন্ধিক্ষণে যা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি স্বীকার করেছেন যে তার আসল উদ্দেশ্য এটা ছিল না, কিন্তু হার্ভাডের এক তরুণ ছাত্র যখন তাকে বলে যে “The Quester Hero’ এর আধুনিক উদাহরণ এটা, সে সাথে সাথে অনুধাবন করে যে আসলেও তাই ঘটেছে। বীরোচিত অভিযানের পুরাণ তার অবচেতনে প্রোথিত ছিল এবং না বুঝেই তিনি এর উপরে নির্মাণ শুরু করেন যা তিনি করেছেন। মানের উপন্যাসের ডাভোস আরোগ্য নিকেতন পরিণত হয় ‘দীক্ষাদানের আচার অনুষ্ঠানের মন্দিরে, জীবনের রহস্যময়তা সম্বন্ধে রোমাঞ্চভিলাষী অনুসন্ধানের স্থান’। হানস কাস্ট্রপ, তার নায়ক, হলি গ্রেইলের সন্ধানী, ‘জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর পবিত্রতার’ স্মারক জীবনকে যা অর্থবহ করে তোলে। কাস্ট্রপ ‘স্বেচ্ছায় রোগ আর মৃত্যুকে বরণ করেন কারণ তাদের সাথে তার প্রথম যোগাযোগেই তারা তাকে অসাধারণ অগ্রগতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অবশ্য এর সাথে বিশাল ঝুঁকিও রয়েছে’। আর তারপরেও, এই আধুনিক দীক্ষাদান একই সাথে বিংশ শতাব্দীর ক্রমবর্ধমান তুচ্ছতাকে ধারণ করে। আরোগ্য নিকেতনের রোগীদের মাঝে মানব ‘বিচ্ছিন্নতা আর ব্যক্তিবাদের একটা মনোহর চক্র’ তৈরি হতে দেখেন সনাতনের সন্ধানীরা যেখানে নিজের সমাজের মঙ্গল সাধন করতে চায় সেখানে কাস্ট্রপ মগ্ন থাকে এক আত্মকেন্দ্রিক, পরজীবী আর চূড়ান্তভাবে লক্ষ্যহীন সাধনায়।[১০৭] তার মায়াবী পাহাড়ে সে সাত বছর কাটায়, মানবতার জন্য নিজের মহান স্বপ্নগুলোর কথা ভাবে, কেবল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যাবার জন্য, যাকে ইউরোপের সম্মিলিত আত্মহনন বলে অভিহিত করা চলে।

ম্যালকম লোউরির Under the Volcan (১৯৪৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে মেক্সিকোর প্রেক্ষাপটে রচিত। কনসাল, এক পাড় মদ্যপের, জীবনের শেষ দিনটার সন্ধান করে, যে কিনা লোউরিরই কেবল না কিন্তু- সেটা পরিষ্কার বোঝানো হয়- আমাদের সবার আত্মস্বরূপ। বইটার শুরু ক্যান্টিনা ডেল বসকে, দান্তের ইনফার্নোর ‘গহীন অরণ্যের কথা স্মরণ করায়, ডে অব দ্য ডেডে, যখন মৃতেরা বিশ্বাস করা হয় যে, জীবিতদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। পুরো উপন্যাসে, লোউরি প্রাচীন পৌরাণিক অন্তজ্ঞান যা বলে জীবন আর মৃত্যু অচ্ছেদ্য তার অনুসন্ধান করেছেন। উপন্যাসে মেক্সিকোর ভূ-প্রকৃতির সৌন্দর্য্যের আর প্রাণবন্ত জীবনের- যেন একটা স্বর্গোদ্যান- বর্ণনার পাশাপাশি মৃত্যু আর অন্ধকারের নারকীয় চিত্রকল্পের অবতারণা করা হয়েছে। আপাত তুচ্ছ বর্ণনা বিশ্বজনীন দ্যোতনা লাভ করেছে।

যুদ্ধ উপদ্রুতদের মতো যারা বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষাকারী বাঙ্কারে আত্মগোপন করে, তাদের মতো মানুষ ঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে আশ্রয় নেয়; সিনেমা হলের আলো নিভে যায় ঠিক যেমন ইউরোপে আধার নেমে এসেছিল সেভাবে। চলচ্চিত্রটার জন্য নির্মিত বিজ্ঞাপন Las Manos de Orlac, সাথে রক্ত রঞ্জিত হাড়, মানবতায় সম্মিলিত অপরাধবোধের কথাই মনে পড়িয়ে দেয়; একটা নাগরদোলা সময়ের বহমানতা প্রকাশ করে; রাস্তার পাশে মৃতাপন্ন কৃষক মনে করিয়ে দেয় পৃথিবী জুড়ে মানুষ অযত্ন অবহেলায় মারা যাচ্ছে। কনসাল ক্রমশ উন্মাদ হয়ে উঠলে, তার চারপাশ একটা ভ্রমোৎপাদক তীব্রতা লাভ করে যেখানে বস্তু আর ঘটনার অস্তিত্ব একে অপরকে ছাপিয়ে যায়। প্রাচীন পুরাণে সবকিছুরই ঐশ্বরিক গুরুত্ব ছিল এবং কোনো একটা বস্তু বা কর্মকাণ্ড লৌকিক ছিল না। লোউরির উপন্যাসের ডে অব দ্য ডেডের সময় গড়িয়ে চললে, কিছুই নিরপেক্ষ থাকে না : সবকিছুতেই নিয়তি নির্ধারিত গুরুত্ব আরোপিত হয়।

১৯৩৯ সালের পূর্বের পৃথিবীর মাতাল অবস্থা উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কনসালের গ্রহণ করা প্রতি পাত্র মদ তাকে অনিবার্য মৃত্যুর দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেয়। কনসালের ন্যায়, মানবতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে এবং বিপদের দিকে ধেয়ে চলেছে। শেষ ইচ্ছার কাছে নত হয়ে জীবন আর অভিব্যক্তির ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলছে। কাবালাকে মরমী সাধকের সাথে তুলনা করা হয় যে মদ্যপের সাথে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। উপন্যাসের এটাই কেন্দ্ৰীয় ধারণা : ক্ষমতা হারানো জাদুকরের ন্যায় মানুষও এমন শক্তির অধিকারী হয়েছে যা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীকে ধ্বংস করে তবে থামবে। লোউরি আমাদের বোঝাতে চান তিনি এখানে পারমাণবিক বোমার কথা ভাবছেন। কিন্তু তারপরেও উপন্যাসটা নাস্তিবাদী না, মানবতার প্রেমময় উদ্ভটত্ব এবং সৌন্দর্য্য আর করুণরসের স্মৃতিচারণের মাঝে একটা গভীর সহমর্মিতার রেশ পাওয়া যায়।

আমরা দেখেছি যে পুরোপুরি লৌকিক প্রেক্ষাপটে কোনো পুরাণকে অনুধাবন করা সম্ভব না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে ভিন্ন বিধিবদ্ধ ছকেই কেবল একে বোঝা সম্ভব; নিজস্ব রূপান্তরের প্রক্রিয়ার একটা অংশ হিসাবে একে অনুভব করতে হবে। অবশ্য এর কিছুই উপন্যাসের প্রতি আরোপ করা যায় না, কোনো প্রকার আচার অনুষ্ঠানের বিধিবিধান ছাড়াই যে কোনো স্থানে এটা পাঠ করা যায় এবং অবশ্যই, যদি এতে কোনো লাভ হয়, প্রত্যক্ষ শিক্ষাদান থেকে বিরত থাকে। তবু উপন্যাস পাঠের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা আমাদের পুরাণের সনাতন চেতনার কথা মনে করিয়ে দেয়। ধ্যানের একটা রূপ হিসাবে একে দেখা যেতে পারে। কয়েকদিন বা সপ্তাহ পাঠক একটা উপন্যাসের সাথে বাস করে। এটা তাদের সমান্তরাল কিন্তু সাধারণ আটপৌরে জীবন থেকে আলাদা একটা জগতে নিয়ে যায়। তারা ভালোমতোই জানে এই কল্পিত জগৎ‍ ‘সত্যি’ না কিন্তু পাঠ করার সময় সত্যি ভাবতে বাধ্য হয় তারা। শক্তিশালী কোনো উপন্যাস পাঠ শেষ করার অনেক পরেও সেটা আমাদের জীবনের প্রেক্ষাপটের একটা অংশে পরিণত হয়। এটা ভান করার একটা খেলা যা, যোগ ব্যায়াম বা ধর্মীয় উৎসবের ন্যায়, সময় এবং স্থানের বন্ধনী ভেঙে আমাদের সহানুভূতি উজ্জীবিত করে যার ফলে অন্যের জীবন তাদের দুঃখ আমরা অনুভব করতে পারি। এটা করুণা করতে শেখায়, অন্যের ‘সাথে অনুভব’ করার ক্ষমতা আমাদের শেখায়। এবং পুরাণের মতো, একটা ভালো উপন্যাসও রূপান্তর করার ক্ষমতা রাখে। আমরা যদি সুযোগ দেই তাহলে চিরতরে সে আমাদের বদলে দিতে পারে।

পৌরাণিক তত্ত্ব, আমরা দেখেছি, শিল্পকলার একটা মাধ্যম। যে কোনো শক্তিশালী শিল্পকর্ম আমাদের সত্তাকে জারিত করে এবং চিরতরে বদলে দেয়। বৃটিশ সমালোচক জর্জ স্টেইনার দাবী করেন যে চিত্রকলা, নির্দিষ্ট ধর্মীয় আর অধিবিদ্যামূলক অভিজ্ঞতার ন্যায়, সবচেয়ে “প্রবেশক্ষম,” রূপান্তরক্ষম মানুষের অভিজ্ঞতা যার শরণ নিতে পারে’। এটা উদ্বেধী, অধিক্রামক, অবিচারণা যা ‘আমাদের অস্তিত্বের শেষ নিভৃত স্থানের অনুসন্ধানে রত; একটা ঘোষণা যা আমাদের সতর্ক সত্তাকে ভেঙে ছোট ছোট ঘরে পরিণত করে,’ যাতে করে ‘পূর্বের ন্যায় একইভাবে এটা আর বাসযোগ্য না থাকে’। এটা একটা সর্বব্যাপী যোগাযোগ যা আমাদের বলে, আক্ষরিক অর্থে : ‘তোমার জীবনকে বদলে নাও’।[১০৮]

যদি গভীর মনোযোগ সহকারে এটা লেখা আর পড়া হয়, একটা উপন্যাস, পুরাণের ন্যায় বা শিল্পকলার অন্য যে কোনো মহান স্মারকের ন্যায়, প্রত্যুপক্রমে পরিণত হয় যা আমাদের সাহায্য করে জীবনের এক পর্যায় থেকে, মনের এক অবস্থা থেকে, যন্ত্রণাময় কৃত্যের দ্বারা অন্য স্তরে যেতে। উপন্যাস পুরাণের ন্যায়, পৃথিবীকে ভিন্ন চোখে দেখতে আমাদের শেখায়; এটা আমাদের শেখায় কিভাবে নিজের হৃদয়ে উঁকি দিতে হয় এবং এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পৃথিবীকে দেখতে শেখায় যা আমাদের ব্যক্তিস্বার্থকে ছাপিয়ে যায়। যদি পেশাদার ধর্মীয় নেতারা পৌরাণিক বিদ্যায় আমাদের অবহিত করতে না পারে, তাহলে আমাদের লেখক আর চিত্রকরের দল হয়তো এই যাজকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত পথ হারানো পৃথিবীতে নতুন অন্তর্জ্জান নিয়ে আসতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *