৪. সভ্যতার সূচনাপর্ব

৪. সভ্যতার সূচনাপর্ব

(খ্রি : পূ: ৪০০০ থেকে খ্রি: পূ: ৮০০ সাল) :

খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালের দিকে মানুষ সামনের দিকে আরেকটা বড় পদক্ষেপ নেয়, এসময়ে তারা বিভিন্ন নগরীর পত্তন করতে শুরু করে, প্রথমে পারস্যে এবং মিসরে প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালে এবং পরবর্তীকালে চীন, ভারত এবং ক্রীটে। এসব প্রাচীন সভ্যতার কিছু কোনো স্মারক ব্যতীত পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে কিন্তু উর্বর চন্দ্রাকৃতি ভূখণ্ড, এখন যেখানে ইরাক অবস্থিত, আমরা পুরাণে নগরায়নের ফলে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের একটা প্রাথমিক প্রয়াস দেখতে পাই যা শহুরে জীবন উদযাপন করে। এ সময়ে মানুষ অনেক বেশি আত্মসচেতন হয়ে উঠে। উন্নত মার্জিত চিত্রকলায় মানুষ এখন তার আকাঙ্ক্ষার স্থায়ী ছাপ আঁকতে সক্ষম এবং অক্ষর আবিষ্কারের মানে দাঁড়ায় নিজেদের পৌরাণিকতত্ত্বের স্থায়ী সাহিত্যিক ব্যঞ্জনা এখন তারা দিতে পারবে। তারা ঐতিহাসিক যুগে প্রবেশ করে : শহরগুলোতে, পরিবর্তনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং কার্যকরণের পরম্পরা সম্পর্কে মানুষ অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠে। নতুন নতুন প্রযুক্তি শহরের অধিবাসীদের প্রকৃতির উপরে অধিকমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ কায়েমে সাহায্য করে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ ধীরে ধীরে তাদের সাথে ব্যবধান বাড়াতে থাকে। উত্তেজনা, স্বাধীনতা আর গর্বের একটা সময় ছিল সেটা।

কিন্তু এই মাত্রার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ব্যাপক ভয়েরও জন্ম দিয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, ইতিহাস পূর্ণ বিলয়ের একটা প্রক্রিয়া, কারণ প্রতিটি নতুন পরিবর্তনের জন্য পূর্ববর্তী সবকিছুর ধ্বংসের প্রয়োজন।[৪৪] পারস্যের শহরগুলোর ক্ষেত্রে পরিষ্কারভাবে এটাই ঘটেছিল, সেখানকার মাটির তৈরি দেয়ালগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ আর মাঝে মাঝেই পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন হতো। তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমিতে বিলীন হয়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষের উপরে নতুন কাঠামো নির্মিত হয়েছিল এবং ক্ষয় আর নবায়নের এই প্রক্রিয়া শহর পরিকল্পনার নতুন বিদ্যার জন্ম দিয়েছিল।[৪৫] সভ্যতার অভিজ্ঞতা ছিল জাঁকজমকপূর্ণ কিন্তু ভঙ্গুর, একটা শহর নাটকীয়ভাবে কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে ততোধিক দ্রুততায় বিলুপ্তির গর্ভে তলিয়ে যেত। যখন একটা নগর-রাষ্ট্র সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপরে সে প্রভাব বিস্তার করে। তার ইতিহাস যুদ্ধ, গণহত্যা, বিদ্রোহ আর নির্বাসনের ইতিহাস। ধ্বংসযজ্ঞের মানে হলো তিল তিল করে বহু শ্রমে গড়ে তোলা সংস্কৃতিকে পুনর্নির্মাণ আর প্রতিষ্ঠা করতে হবে বার বার। জীবন আবার পুরাতন বর্বরতায় ফিরে যাবে এই ভয় সবসময়ে কাজ করতো। ভয় আর আশার জট পাকানো পরিস্থিতিতে, নিয়ম আর অনিয়মের মাঝে অনন্ত সংগ্রামকে, নতুন শহুরে পুরাণ মধ্যস্থতার চেষ্টা করে।

নতুন সভ্যতাকে কেউ কেউ যখন বিপর্যয়ের চোখে দেখে তখন অবাক হবার কিছু থাকে না। বাইবেলের লেখকরা একে ঈশ্বর থেকে বিচ্যুতির একটা স্মারক হিসাবে দেখেন, ইডেন থেকে নির্বাসনের পরে থেকে যা তাদের অনুসরণ করছে। শহুরে জীবনের বৈশিষ্ট্যই যেন হিংসা, মারামারি আর স্বার্থসিদ্ধির বোঝাপরা। কেইন ছিল প্রথম শহরটার নির্মাতা আবার প্রথম হত্যাকারীও বটে।[৪৬] তারই বংশধরেরা সভ্যতার আবিষ্কারক : জুবাল ছিল ‘বীনা এবং বংশীবাদক সবার পূর্বপুরুষ,’ এবং টুবালকেইন ছিল ‘সব ধরনের ব্রোঞ্জ আর লোহার হাতিয়ারের নির্মাতা’।[৪৭] ব্যাবিলনের বিখ্যাত মন্দিরের তোরণ বা ziggurat প্রাচীন ইসরালাইটসদের উপরে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। পৌত্তলিক প্রগলভ অহংকার, যার মূল প্রেষণা কেবলমাত্র আত্ম-সংবর্ধনার আকাঙ্ক্ষা এটা তারই প্রতিনিধিত্বকারী বলে তাদের কাছে মনে হয়েছিল। তারা একে টাওয়ার অভ ব্যাভেল বা ব্যাবেল বলে অভিহিত করতো কারণ এর নির্মাতাদের শাস্তি দেবার জন্য ঈশ্বর ‘পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠীর ভাষায় একটা বিশৃঙ্খলা আনয়ন করেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে তাদের ছড়িয়ে দেন’।[৪৮]

পারস্যের লোকেরা কিন্তু শহরকে এমন একটা স্থান হিসাবে বিবেচনা করতে থাকে যেখান থেকে তারা দিব্যের মোকাবেলা করতে পারবে। এটা ছিল- প্রায়- হারিয়ে যাওয়া স্বর্গের পুনর্নির্মাণ। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পাহাড়কে মন্দির তোরণ বা ziggurat প্রতিস্থাপন করে, যা প্রাচীন মানুষদের দেবতাদের রাজত্বে বেয়ে উঠতে সাহায্য করতো। দেবতারা শহরে বাস করেন, মানুষের পাশাপাশি দিব্য জগতে তাদের প্রাসাদের অনুকরণে নির্মিত মন্দিরে তাদের অধিষ্ঠান। প্রাচীন পৃথিবীর সব শহরই ছিল পবিত্র শহর। তাদের পূর্বপুরুষেরা যেমন শিকার আর চাষাবাদকে পবিত্র এবং সাংস্কারিক হিসাবে বিবেচনা করতো, গোড়ার দিকের এসব শহরবাসীরা তাদের সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকেও তেমনি পবিত্র হিসাবে বিবেচনা করতো। পারস্যে, দেবতারা মানুষকে শিখিয়েছিল কিভাবে উঁচু তোরণযুক্ত মন্দির নির্মাণ করতে হয় এবং জ্ঞানের দেবতা এনকি ছিল চামার, কামার, নাপিত, কুমার, রাজমিস্ত্রী, সেচ, কবিরাজ, সঙ্গীতশিল্পী এবং লেখকদের পৃষ্ঠপোষক।[৪৯] তারা জানত যে তারা একটা চমকপ্রদ কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে যা মানুষের জীবন চিরতরে বদলে দেবে; তাদের নগরগুলো ছিল সর্বব্যাপী কারণ তারা পূর্বেকার জ্ঞাত সবকিছুকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দেবতাদের দিব্য সৃষ্টিশীলতায় তারা অংশ নিয়েছিল, যারা বিশৃঙ্খলার বিভ্রান্তিতে সামান্য পরিমাণে হলেও শৃঙ্খলা আনতে সক্ষম হয়েছিল।

কিন্তু পারস্যের লোকদের অহংকারী হিসাবে কল্পনা করাটা ইসরালাইটসদের ভুল হয়েছিল। তারা জানত যে মানবজীবন, দেবতাদের জগতের তুলনায়- এমনকি তাদের অতিকায় নগরগুলোতেও- ত্রুটিপূর্ণ এবং স্বল্পস্থায়ী যা এখনও তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রেক্ষাপট জুড়ে রয়েছে। তাদের নগরগুলো হারিয়ে যাওয়া স্বর্গ ডিলমানের জেলো প্রতিচ্ছবি, যেখানে এখন কেবল দেবতারা এবং কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ বাস করে। তারা খুব ভালো করেই জানত যে, মানব জীবনের মতো, সভ্যতাও নশ্বর এবং অস্থায়ী। ঘনবিন্যস্ত, বিচ্ছিন্ন এবং পাহাড় দ্বারা বিরুদ্ধ শক্তির হাত থেকে সুরক্ষিত এবং নীল নদের নিয়মিত বন্যার কারণে উর্বরা মিশরে মানুষের এইসব পার্থিব অর্জনের প্রতি যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল। কিন্তু পারস্যে, যেখানে টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিসের বন্যা ছিল অতর্কিত এবং প্রায়শই বিধ্বংসী, যেখানে মৌসুমী বৃষ্টি মাটিকে চোরাকাদায় পরিণত করতো বা লু হাওয়া তাকে করতো ধুলোয় মলিন, যেখানে বহিরাগত শত্রুর হামলার হুমকি লাগাতার বিব্রত করত মানুষকে, সেখানে জীবন ছিল অনেক বেশি অরক্ষিত। প্রকৃতির বিধ্বংসী আর খেয়ালী শক্তির হাত থেকে সভ্যতাকে বাঁচাতে বীরোচিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বন্যা পুরাণে এসব ভয়ের কথা বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। কোনো প্রাকৃতিক বাধা না থাকার কারণে পারস্যের নদীসমূহের সহসা গতিমুখ পরিবর্তন করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল আর সে কারণে ঘন ঘন বন্যা হতো এবং প্রায়শই তার মাত্রা হতো প্রলয়ংকর। মিশরের মতো, বন্যাকে এখানে আশীর্বাদ হিসাবে দেখা হতো না, বরং তা রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিনাশের রূপকে পরিণত হয়।

যখনই ইতিহাসের নতুন পর্বে মানুষ প্রবেশ করেছে, মানবতা এবং ঐশ্বরিকতা সম্পর্কে তাদের ধারণা পাল্টে গেছে। এসব প্রাচীন সভ্যতাসমূহে, নারী ও পুরুষ আধুনিক আমাদের মতো, আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠে যে নিজের নিয়তির কারিগর তারা নিজেরাই। একইসাথে, দেবতাদের সম্পর্কে তাদের পূর্বপুরুষদের লালিত বিশ্বাস তাদের মাঝে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়। মানুষের কর্ম মূল উপলক্ষ্য হবার কারণে, দেবতাদের অনেক দূরবর্তী বলে মনে হয়; নাগালের সামান্য বাইরে স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা হিসাবে তারা তাদের যোগ্যতা হারায়। নতুন শহুরে পুরাণ বন্যাকে মানব-দিব্য সম্পর্কের মাঝে একটা সংকট হিসাবে বর্ণনা করে। Atrahasis-এ, পারস্যের সবচেয়ে দীর্ঘ বন্যা কাব্য, দেখা যায় দেবতারাও মানুষের মতো নগর পরিকল্পক। গ্রামাঞ্চলকে বসবাসযোগ্য করার উদ্দেশ্যে সেচ খাল খননের সীমাহীন পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দেবতারা ধর্মঘট করলে, ধরিত্রী দেবী মানুষ সৃষ্টি করেন তাদের দিয়ে এসব ভৃত্যের কাজ করাবেন বলে। কিন্তু অচিরেই তাদের সংখ্যা মাত্রা ছাড়ায় এবং হট্টগোলের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে ঝড়ের দেবতা এনলিল এই চিৎকার চেঁচামেচিতে জেগে উঠতে বাধ্য হলে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটা নিষ্ঠুর পদ্ধতির সাহায্য নেন, তিনি পৃথিবীকে প্লাবিত করেন। কিন্তু এনকি শুরুপ্পাক শহরের ‘চূড়ান্ত জ্ঞানী মানুষ’ আথরাহসিসকে[৫০] বাঁচাতে চান। দু’জনের ভিতরে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকায়, এনকি আথরাসিসকে একটা নৌকা বানাতে বলেন, পানিরোধী করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি তিনিই তাকে বলে দেন এবং এই ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের কারণে আথরাহসিস, নূহ (আঃ) এর ন্যায় তার পরিবারকে এবং সমস্ত গাছগাছালির বীজ রক্ষা করতে সমর্থ হয়। কিন্তু পানি নেমে যাবার পরে, ধ্বংসযজ্ঞ দেখে দেবতারাই ভীত হয়ে উঠেন। পারস্য পুরাণে, পৃথিবী থেকে দেবতাদের প্রস্থানের সূচনা এই বন্যার পর থেকেই শুরু হয়। এনকি আথরাহসিস আর তার স্ত্রীকে ডিলমানে নিয়ে যান। মানুষের ভিতরে কেবল তারাই অমরত্বের বরাভয় লাভ করেন এবং দেবতাদের সাথে পুরাতন সখ্য বজায় রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু গল্পটা একই সাথে মানবজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে যে দিব্য প্রযুক্তি উজ্জীবিত হয়েছিল সেটারও জয়গান গায়। আমাদের আধুনিক সমাজের মতো, পারস্যে এই সময় থেকেই সভ্যতা এবং সংস্কৃতি পুরান এবং প্রেরণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

পারস্যবাসীরা কিন্তু পুরোপুরি আমাদের ন্যায় ছিল না। দেবতারা হয়তো বিদায় নিয়েছিল কিন্তু মানুষ তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপে সর্বব্যাপী উপাদান সম্পর্কে অধিকমাত্রায় সচেতন রয়ে যায়। একেকজনে দেবতার পার্থিব জায়গীর হিসাবে একেকটা শহরকে অভিহিত করা হয় এবং প্রতিটি নাগরিক- শাসক থেকে শুরু করে নগণ্য শ্রমিক সবাই– পৃষ্ঠপোষক দেবতা- এনলিল, ইনানা বা এনকির- অধীনতা মেনে নেয়।[৫১] মানুষ তখনও বর্ষব্যাপী দর্শন আঁকড়ে ছিল, যা পৃথিবীর সবকিছুই দিব্য বাস্তবতার প্রতিরূপ হিসাবে দেখত। নগর রাষ্ট্রগুলো বয়স্কদের একটা সংঘ শাসন করত, পারস্যবাসীরা তাই বিশ্বাস করতো যে শীর্ষস্থানীয় দেবতাদের ঐশ্বরিক একটা সংঘও দেবতাদের শাসন করে। তারা আরও মনে করতো যে, ক্ষুদ্র কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী থেকে যেমন তাদের শহুরে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, গ্রামাঞ্চলের প্রাকৃতিক উত্থানপতনের সাথে যা সম্পৃক্ত, দেবতাদের মাঝেও একই ধরনের বিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল।

ব্যাবিলোনিয়ান মহাকাব্যে যে সৃষ্টি পুরাণ টিকে আছে শুরুর শব্দ দিয়েই যা পরিচিত Enuma Elish . আমাদের এই ভাষ্য খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম অর্ধের কিন্তু অনেক পুরাতন বিষয়বস্তুও এর অন্তর্ভুক্ত।[৫২] দেবতাদের সৃষ্টি রহস্য দিয়ে কাব্যটার সূচনা যেখানে দেখানো হয়েছে কিভাবে প্রথমে দেবতাদের সৃষ্টি হয়েছিল। শূন্য থেকে সৃষ্টির (ex nihilo) কোনো কথা সেখানে নেই, কেবল একটা বিবর্তনের প্রক্রিয়া। সেখানে পবিত্র আদি বস্তু থেকে, যা এক প্রকার পিচ্ছিল, অনির্ধারিত পদার্থ, যেখানে কোনো কিছুরই কোনো পরিচয় নেই, প্রথম পর্যায়ের দেবতাদের সৃষ্টি হয়। লবণ আর তিক্ত পানি এক সাথে মথিত হয়, আকাশ, পৃথিবী বা সমুদ্রের কোনো আলাদা অস্তিত্ব ছিল না; এবং দেবতারাও তখন ছিলেন ‘নামহীন, পরিচয়হীন এবং আকৃতিহীন’।[৫৩] এই নোংরা থেকে সৃষ্ট এই দেবতারা উপাদান থেকে ছিল অচ্ছেদ্য। আপসু ছিল মিষ্টি পানির নদী, তিয়ামাত ছিল লবণাক্ত সমুদ্র আর মুম্মু ছিল ধোঁয়াটে মেঘ। তাদের নামগুলোকে আমরা ভাষান্তরিত করতে পারি যথাক্রমে ‘অতল গহ্বর,’ ‘শূন্যতা’ এবং ‘তলাবিহীন খাদ’ হিসাবে।

এসব আদি দেবতারা তখনও ছিল আকৃতিহীন এবং নিষ্ক্রিয়। কিন্তু তাদের ভিতর থেকে অন্যান্য দেবতারা জোড়া জোড়ায় আবির্ভূত হন, প্রতিটি জোড়া পূর্ববর্তী জোড়া অপেক্ষা স্পষ্টভাবে নির্দেশিত। এসব দিব্য উপাদান পরস্পর থেকে পৃথক হলে একটা সুবিন্যস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অস্তিত্ব লাভ করে। প্রথমে সৃষ্টি হলো পলিমাটি (কাদা ও পানি সহযোগে), যথাক্রমে লাহমু আর লাহামু দ্বারা। তারপরে আনশের এবং কিশর (আকাশ এবং সমুদ্রের দিগন্ত) এবং সবশেষে আকাশ দেবতা, অনু এবং ধরিত্রী আ। কিন্তু দেবতাদের সৃষ্টির এই পুরাণ সম্পূর্ণভাবে ঐশ্বরিক বিবর্তনের অধিবিদ্যামূলক অনুমান নির্ভর না; গভীর চিন্তার একটা ছাপ আমরা পারস্যের মাঝে অনুভব করি পলিমাটি জমে সৃষ্টি হওয়া পাললিক অঞ্চল। অন্যদিকে মানব জগতের একটা দিক হলো ঐশ্বরিকতা। ভূ-প্রকৃতি থেকে দেবতারা অচ্ছেদ্য এবং পারস্যের অন্যতম প্রাচীন শহর এরিডুতে অগভীর লবণাক্ত উপহ্রদ যা বসতিকে টিকে থাকতে সাহায্য করেছিল এবং যা প্রার্থনা কেন্দ্র ঘিরে রেখেছে, তাকে আপসু বলা হয়। পুরাণে প্রকৃতি থেকে ক্রমিক বিচ্যুতির কথা বলা হয়েছে যা নতুন শহরের বাসিন্দারা নিজেদের ভিতরে অনুভব করেন।

নতুন দেবতারা অনেক বেশি সক্রিয় এবং তাদের পিতামাতাকে অতিক্রম করতে সক্ষম : আপসু ভূগর্ভের অতলে দেবে যায় এবং আ আর অনু তার জীর্ণ খোলসের উপর নিজেদের প্রাসাদ তৈরি করে প্রার্থনা আর মন্ত্রণাকক্ষ সম্বলিত। শহুরে দালানসমূহ সব সময়ে পারস্যের সৃষ্টিতত্ত্বের গৌরবময় মুহূর্ত চিহ্নিত করতো। কিন্তু তিয়ামাত এখনও পরাস্ত হয়নি এবং আপসুর বদলা নিতে সে ভয়ংকর দানবদের একটা বাহিনী তৈরি করে। আর যোগ্য সন্তান মারডুক একমাত্র দেবতা যে, তাকে যুদ্ধে হারাতে সক্ষম। এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর মারডুক, তিয়ামাতের বিশাল শবের উপর দাঁড়িয়ে এক বিশাল খোলসি মাছের মতো তাকে দু’টুকরো করে স্বর্গ আর মর্ত্যের সৃষ্টি করে যেখানে এখন থেকে কেবল মানব সন্তানেরা বাস করবে। সে আইন প্রণয়ন করে এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নতুন শৃঙ্খলা সুসংবদ্ধ করার জন্য একটা দিব্য সংঘ প্রতিষ্ঠা করে। শেষে, অনেকটা পরবর্তীকালীন অনুধ্যানের ন্যায়, মারডুক তার হাতে পরাস্ত এক দেবতার রক্তের সাথে একমুঠো ধুলো মিশিয়ে প্রথম মানুষ তৈরি করেন, তিনি দেখাতে চান দেবতারা কেবল তাদের অতিপ্রাকৃতিক এবং প্রাকৃতিক জগতে একলা, আলাদা নেই, বরং মানব সম্প্রদায় এবং প্রাকৃতিক জগৎ সবই একই দিব্য বস্তু থেকে তৈরি হয়েছে।

মানুষের পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে পুরাণ যা দেবতাদের পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পারস্যের নগর-রাষ্ট্রের বিবর্তন এতে প্রতিফলিত হয়, প্রাচীন কৃষিজীবী সমাজ থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে (সেটাকে এখন অনুন্নত এবং স্থবির আখ্যা দেয়া হয়েছে) এবং সামরিক শক্তির দ্বারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিজয় সমাপ্ত হবার পরে মারডুক ব্যাবিলনের পত্তন করে। শহরের কেন্দ্রে ইসাগলিয়ার সুউচ্চ মিনারযুক্ত মন্দির, দিব্য জগতে মারডুকের প্রার্থনালয়ের প্রতিরূপ। ‘অনন্ত স্বর্গের স্মারক’ হিসাবে শহরের সব ভবনের মধ্যে উঁচু মন্দির পরবর্তীকালে দেবতাদের পার্থিব বাসগৃহের মর্যাদা পায়। শহরের নাম ‘বাব-ইলানি’ (দেবতাদের তোরণ) রাখা হয় কারণ এখানেই ঐশ্বরিকতা মানুষের পৃথিবীতে প্রবেশ করে। ইসাগিলার, পবিত্র বিধান উদ্‌যাপন করতে দেবতারা একত্রিত হন যা থেকে ব্রহ্মাণ্ড তার কাঠামো লাভ করেছে, গোপন পৃথিবী হয়েছে স্পষ্ট এবং ব্রহ্মাণ্ডে দেবতাদের স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে।[৫৪]

নতুন শহরটা axis mundiকে এবার প্রতিস্থাপন করতে পারে। যা স্বর্ণযুগে স্বৰ্গ আর মর্ত্যের মাঝে যোগসূত্র হিসাবে বিদ্যমান ছিল।

বাইবেলও সৃষ্টি পুরাণ সংরক্ষণ করেছে যাতে আমরা দেখি তিয়ামাতের ন্যায় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সমুদ্রের একটা দানবকে হত্যা করে পৃথিবীকে অস্তিত্ব প্রদান করেন।[৫৫]

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির এধরনের আখ্যান মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের ভিতরে বেশ জনপ্রিয়। এটা তাদের বিশ্বাসকেই সমর্থন করে যে সভ্যতা একটা চলমান সংগ্রাম, পশ্চাদপসরণ করে আকৃতিহীন বর্বরতায় পতন থেকে রক্ষা পেতে অভিভূত করার মতো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। নববর্ষের উৎসবের চতুর্থ দিনে এনুমা এলিশ সুর করে গাওয়া হয়। যে কোনো পৌরাণিক আখ্যানের ন্যায়, সময় নিরপেক্ষ পবিত্র ক্ষণে রহস্যময় এবং অশিষ্ট ঘটনা যা সংঘটিত হয়েছিল, তারই একটা বর্ণনা। সাধারণ ঐতিহাসিক ঘটনার মতো না যা শেষ হয়ে হেজেমজে গেছে। পৃথিবীর সৃষ্টি একটা চলমান প্রক্রিয়া; বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে ঐশ্বরিক যুদ্ধ আজও ঘটমান এবং বিশৃঙ্খলা এবং বিপর্যয় রুখতে মানুষের দিব্য শক্তির বরাভয় প্রয়োজন।

প্রাচীন পৃথিবীতে, অপ্রেক্ষিত বস্তু বা ঘটনা থেকে তার প্রতীক অচ্ছেদ্য হয়ে উঠে। কারণ সাদৃশ্যতা এক ধরনের পরিচয়ের জন্ম দেয়, অদৃশ্য বাস্তবতাকে বর্তমান করে তুলে। নববর্ষের উৎসবের প্রতীকী কৃত্যানুষ্ঠান একটা নাটক, যা, যে কোনো ভালো নাটকের ন্যায়, স্থানকালের বেড়াজাল ছিন্ন করে, দর্শক এবং কুশীলবদের তাদের পার্থিব চিন্তাবিষ্টতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। পবিত্রতার ভান করা পুরো ব্যাপারটাই একটা খেলা। প্রার্থনাকারীরা অনুভব করে যে তাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রেক্ষাপট সৃষ্টিকারী যে অনন্ত ঐশ্বরিক জগৎ তারা সেখানে ব্যস্ত হয়ে উঠছে। শেষ হয়ে আসা বছরের জীর্ণতা কাটাতে ছাগল বলি দেয়া হয়; তিয়ামাতের বিরুদ্ধে মারডুকের সংঘর্ষ উপস্থাপিত করতে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার আয়োজন করা হয়; খেলাচ্ছলে রাজাকে লাঞ্ছিত করে উৎসবের মধ্যে থেকে একজনকে সিংহাসনে বসিয়ে বিশৃঙ্খলার শক্তিগুলোকে আবার সৃষ্টি করা হয়। আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই অবলুপ্তি আধ্যাত্মিক বৈকল্যকে স্মরণ করে শামানরা তাদের দীক্ষার সময়ে, যা অনুভব করত, এবং অতিক্রমণের যজ্ঞের প্রত্যাবৃত্তি সতর্কতার সাথে বিন্যস্ত করা হতো। প্রাচীন আধ্যাত্মিকতায়, যে কোনো নতুন সৃষ্টির ক্ষেত্রে আদ্যকালীন বিশৃঙ্খলায় প্রতীকী প্রত্যাবর্তন ছিল অপরিহার্য।[৫৬]

আমরা যেমন জানি, সৃষ্টির গল্প কখনও মানুষকে জীবনের উৎস সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহ করে না। প্রাচীন কালে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির গল্প সাধারণত নির্দিষ্ট বিধিমতে আবৃত্তি করা হতো এবং চরম মুহূর্তে : নতুন অভিযানের শুরুতে তারা অজানার দিকে তাকিয়ে আছে– নববর্ষে, বিয়েতে বা রাজাভিষেকের সময়ে, যখন মানুষ দিব্য শক্তির আশীর্বাদ কামনা করে। কিছু জানানো এর উদ্দেশ্য না, এর উদ্দেশ্য মূলত নিরাময় সংক্রান্ত। মানুষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পুরাণের আবৃত্তি তখনই শ্রবণ করে যখন তারা কোনো আসন্ন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়, যখন তারা কোনো সংঘাতের সমাপ্তি চায় বা কোনো অসুস্থকে আরোগ্য লাভ করাতে চায়। মূল ধারণাটা হলো অনন্ত শক্তির বরাভয় লাভ যা মানুষের অস্তিত্বকে ধারণ করে আছে। পুরাণ এবং এর আনুষঙ্গিক আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এটাই স্মরণ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় যে ভালো হবার আগে পরিস্থিতি প্রায়ই অনেক সময় খারাপের দিকে যায়, এবং বেঁচে থাকা আর সৃষ্টিশীলতা উভয়েরই জন্য প্রয়োজন নিবেদিত শ্ৰম নিষ্ঠা।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির অন্যান্য গল্পে সত্যিকারের সৃষ্টিশীলতা আত্মোৎসর্গ দাবী করে এমনটা বলা হয়েছে। ভারতীয় বৈদিক পুরাণে, আত্মাহুতির ফলেই সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। পুরুষ, এক মহাজাগতিক দৈত্য, নিজেকে দেবতাদের কাছে উৎসর্গ করলে, তারা তাকে বলি দিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করেন; বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এবং সামাজিক শ্রেণী যা মানব সমাজ গঠন করেছে তার ধড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এবং সেজন্য এটা পবিত্র এবং প্রশ্নাতীত। চীনে, আরেকটা দৈত্য পানগু, তাকে নিয়ে একটা জনপ্রিয় পুরাণ রয়েছে, সে ৩৬০০০ বছর পরিশ্রম করেছে চলনসই বিশ্ব সৃষ্টি করতে এবং তারপরে এই পরিশ্রমের কারণে ক্লান্ত হয়ে সে মারা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পুরাণে একই ছক আমরা দেখতে পাই। তিয়ামাত, মট, এবং লেভিয়াথান কেউই খল না তারা কেবল তাদের মহাজাগতিক ভূমিকা পালন করেছে। মরতে তাদের হবে আর মৃত্যুর পর অঙ্গহানি সহ্য করার পরেই কেবল বিশৃঙ্খলা থেকে সুশৃঙ্খল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আবির্ভাব ঘটতে পারে। টিকে থাকতে, সভ্য সমাজ অন্যের মৃত্যু আর ধ্বংসের উপরে নির্ভর করে এবং দেবতা এবং মানুষ কেউই সত্যিকারের সৃষ্টিশীল হবে না যতক্ষণ না তারা নিজেদের উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হবে।

এখন পর্যন্ত পৌরাণিক তত্ত্ব প্রায় সম্পূর্ণরূপেই আদ্যকালীন বৈশিষ্ট্যকেন্দ্রিক এবং দেবতাদের সংগ্রাম বা আদ্যকালীন সময়ের পূর্বপুরুষদের আদি রূপের উপর কেন্দ্রীভূত। কিন্তু এখন থেকে শহুরে পুরাণ ঐতিহাসিক জগতের উপরে অভিঘাত সৃষ্টি করবে। কারণ মানুষ এখন পূর্বেকার চাইতে অনেক বেশি নিজের উদ্ভাবন কুশলতার উপরে নির্ভরশীল, মানুষ ক্রমশ নিজেকে স্বাধীন সত্তা হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ড এখন প্রধান হয়ে উঠেছে এবং সেইসাথে পাল্লা দিয়ে দেবতারাও দূরে সরে যেতে শুরু করেছে। পুরাতন গল্প কবিরা নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করছে। এই বিষয়টা আমরা ব্যাবিলনীয় মহাকাব্য যা গিলগামেশের মহাকাব্য নামে পরিচিত সেখানে এই পরিবর্তন লক্ষ্য করি। গিলগামেশ সম্ভবত কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র, খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে সম্ভবত তিনি জীবিত ছিলেন : দক্ষিণ পারস্যে উর্কের পঞ্চম রাজা হিসাবে তার নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং পরবর্তীকালে তিনি লোককথার নায়কে পরিণত হন। তার ভৃত্য এনকিছুর সাথে তার অভিযান প্রাচীন কিংবদন্তীর বিষয়বস্তু। সেখানে আমরা বীরোচিত এবং শামানিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করি যেমন দানবের সাথে যুদ্ধ, পাতাল ভ্রমণ, এবং দেবীদের সাথে মিলন। পরবর্তীকালে এসব কাহিনীতে গূঢ় মানে আরোপিত হয়েছে এবং অনন্ত জীবনের অভিযানে পরিণত হয়েছে। খ্রীস্টপূর্ব ১৩০০ সালে লিখিত, এই মহাকাব্যের সর্বশেষ নমুনায়, আমরা দেখি মানুষের সংস্কৃতির স্বরূপ এবং সীমা নিয়ে পুরাণ অনুসন্ধান করতে চাইছে।

মহাকাব্যের শুরুতে, আমরা দেখি মানুষ গিলগামেশ পথ হারিয়েছে। তার হৃদয় বিক্ষুব্ধ এবং নিজের লোককেই সে ভয় দেখাতে শুরু করলে, তারা দেবতার কাছে গিয়ে প্রতিকার চায়। কিন্তু, লক্ষণীয় বিষয় হলো, দেবতারা এখন আর সরাসরি মানুষের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে রাজি না এবং তারা একজন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। গিলগামেশকে বশে আনতে তারা এনকিছুকে সৃষ্টি করেন, বন্য আদিম এক মানুষ গ্রামাঞ্চলে যে মনের ফুর্তিতে ঘুরে বেড়ায়। তার দেহ রুক্ষ চামড়া দ্বারা আচ্ছাদিত, অপরিপাটি চুল, উলঙ্গ, ঘাস খায় আর পুকুরের পানি পান করে, এনকিডু হলো ‘মানুষ-শুরুতে-যা-ছিল,’[৫৭] মানুষের চাইতে পশুর সাথে থাকতেই সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এনকিডুকে বশ মানাতে, গিলগামেশ বেশ্যা সামহাতকে পাঠায় তাকে সভ্য আদব কায়দা শিখাতে। সামহাতের সাথে ছয় রাত কাটাবার পরে, এনকিছু বুঝতে পারে প্রকৃতি এবং পশু জগতের সাথে তার যে বন্ধন ছিল সেটা ভেঙে গেছে। সে ক্রমশ সভ্য হয় কিন্তু এতে লাভ আর ক্ষতি দুটোই হয়। এনকিছুর পশুসত্তা ‘লোপ’ পেয়েছে বটে কিন্তু একইসাথে সে হয়ে উঠেছে ‘দেবতার ন্যায়’ এবং ‘দুয়ে’।[৫৮] উর্কের পরিশীলিত জীবনযাত্রা উপভোগ করার মতো জ্ঞান এবং শিষ্টাচার তার ভিতরে এসেছে কিন্তু সেটা মানবিকতার স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে এতদূর বিস্তৃত যে একে ঐশ্বরিক বলে মনে হয়।

গিলগামেশ আর এনকিডু পরস্পরের বন্ধুতে পরিণত হয়, এবং তাদের অভিযান শুরু করে। এক সাথে ঘুরে বেড়াবার সময়ে তাদের দেখা হয় ইশতারের সাথে। প্রাচীন পুরাণে ধরিত্রী দেবীর সাথে বিয়ে প্রায়শই সর্বোচ্চ জ্ঞানার্জনের বিষয়টা বোঝাত এবং সেটা হতো বীরের অভিযানের চরম পরিণতি, কিন্তু গিলগামেশ ইশতারকে ফিরিয়ে দেয়। প্রচলিত পুরাণের এটা একটা কঠোর সমালোচনা, যা শহুরে নারী পুরুষের সাথে আর তাল রাখতে পারে না। গিলগামেশ সভ্যতাকে ঐশ্বরিক প্রচেষ্টা বলে মনে করতেন না। এশতার সংস্কৃতি ধ্বংসকারী : সে অনেকটা পানির আবরণের মতো যা এর বহনকারীকে শুষে নেয়, একটা জুতো যা পরিধানকারীকেই খোঁচায় এবং একটা দরজা যা বায়ু প্রবাহ রোধ করতে পারে না।[৫৯] তার কোনো সম্পর্কই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; সে তার প্রতিটা প্রেমিকের সর্বনাশ করেছে।[৬০] দায়িত্বজ্ঞানহীন দেবতাদের সাথে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক যোগাযোগ ছাড়াই মরণশীলেরা ভালো থাকবে। গিলগামেশ, সভ্য মানুষ, দিব্যর কাছ থেকে নিজের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এবার সময় হয়েছে দেবতা আর মানুষের পৃথক পথ অবলম্বন করার।

ইশতার প্রতিশোধ নেয়, এবং এনকিছু অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়। গিলগামেশ বিহ্বল হয়ে পড়ে। তাকেও মরতে হবে এই উপলব্ধির ফলে যখন সে ভারাক্রান্ত, তখন তার মনে পড়ে বন্যার কবল থেকে যে বেঁচে গেছে– এই মহাকাব্যে উথনাপিসতিম বলে অভিহিত করা হয়েছে- তাঁকে অনন্ত জীবন দান করা হয়েছে, সে তখন তার সাথে দেখা করার জন্য ডিলমান রওয়ানা হয়। কিন্তু মানুষ প্রাচীন আধ্যাত্মিকতায় ফিরতে পারবে না এবং দেবতাদের রাজ্যের খোঁজে এই অভিযান সাংস্কৃতিক প্রত্যাবৃত্তির পরিচায়ক; তৃণভূমির মাঝে গিলগামেশ ঘুরে বেড়ায়, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল, চুল বড় বড়, লজ্জাস্থান সিংহের চামড়া দিয়ে ঢাকা একজন শামানের ন্যায়, জনবসতিহীন প্রান্তরের মাঝ দিয়ে সে সূর্যের গতিপথ অনুসরণ করে, মনশ্চক্ষে পাতাল অবলোকন করে এবং ‘দেবতাদের গোপন জ্ঞান’ খুঁজে বেড়ায়।[৬১] শেষ পর্যন্ত সে যখন ডিলমানে পৌঁছায়, উথনাপিসতিম তাকে বোঝায় যে দেবতারা তাদের প্রিয় মানুষের জন্য আর প্রাকৃতিক নিয়ম স্থগিত করবে না। মানুষের আকাঙ্ক্ষার পথপ্রদর্শক হিসাবে পুরাতন পুরাণ আর কোনো কাজে আসবে না। ডিলমান ভ্রমণ পুরাতন পৌরাণিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে।[৬২] আথরাসিসে, বন্যার গল্প দেবতাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণনা করা হয়েছে কিন্তু এখানে উথনাপিসতিম তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে, নৌকা তৈরি করে পানিতে ভাসাতে গিয়ে সে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল এবং বন্যার দ্বারা সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের প্রতি তার নিজের মানবিক প্রতিক্রিয়া। পুরাতন পুরাণগুলো পবিত্র পৃথিবীকেন্দ্রিক ছিল ক্ষণস্থায়ী ঘটনা বা চরিত্রের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না তাদের, আর এখানে ঐতিহাসিক গিলগামেশ পৌরাণিক উথনাপিসতিমের সাথে দেখা করে। ইতিহাস পুরাণকে আঘাত করতে শুরু করেছে, একই সাথে দেবতারাও মানুষের পৃথিবী ছেড়ে প্রস্থান আরম্ভ করেছেন।[৬৩]

দেবতাদের কাছ থেকে প্রাধিকার বলে সংবাদ পাবার বদলে, গিলগমেশ মানুষের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে কষ্টদায়ক শিক্ষা লাভ করে। সে সভ্যতার কাছেই ফিরে আসে : গোসল করে, সিংহের চামড়া বর্জন করে, চুল পরিপাটি করে বিন্যস্ত করে পরিষ্কার পোশাক পরিচ্ছেদ পরিধান করে। এরপরে উর্কের সীমানা প্রাচীর নির্মাণে সে মনোনিবেশ করে এবং সভ্য শিল্পকলার চর্চা শুরু করে। ব্যক্তি গিলগামেশ মারা যাবে, কিন্তু এসব সৌধচূড়ায় সে অমরত্ব লাভ করবে, বিশেষ করে লেখনীর আবিষ্কারের কারণে, যা তার অর্জনকে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করবে।[৬৪] উথনাপিসতিম দেবতাদের সাথে কথা বলে যেখানে জ্ঞানী হয়েছিল, সেখানে গিলগমেশ ঐশ্বরিক সহায়তা ছাড়াই নিজের অভিজ্ঞতা বলতে শিখে নেয়। তার কিছু স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে কিন্তু তার বদলে সে ‘পরিপূর্ণ’ জ্ঞান লাভ করেছে, ‘ক্লান্ত কিন্তু আত্মসমর্পিত চিত্তে’ ফিরে এসেছে।[৬৫] প্রাচীন পৌরাণিক অন্তজ্ঞান থেকে সে দূরে সরে গিয়েছে কিন্তু ইতিহাসের নিজস্ব সান্ত্বনা রয়েছে।

গ্রীসেও প্রাচীন পৌরাণিক আদর্শের একই ধরনের পূর্ণ মূল্যায়ন হয়েছে। এডোনিসের পুরাণে, যেমন, ডুমুনিস আর ইশতারের গল্প নতুন করে লেখা হয়েছে এবং একে একটা রাজনৈতিক পুরাণের রূপ দেয়া হয়েছে।[৬৬] এডোনিস নাগরিকত্ব লাভের যোগ্য না। এক হতাশ শিকারী, সে নিশ্চয়ই দীক্ষাদানের অনুষ্ঠান পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিল যা সদ্যযুবা গ্রীকদের নাগরিকে পরিণত করে, বা প্রায়শই যা শিকারের অভিজ্ঞতার উপর আধারিত হতো। দুই দেবীর বন্ধনে আবদ্ধ, সে কখনও মেয়েদের আকর্ষণ কাটাতে পারেনি। প্রাচীন গ্রীক নগর রাষ্ট্র Polis–এ পরিবারের মাধ্যমে গ্রীক নাগরিকেরা একতাবদ্ধ হতো কিন্তু এডোনিস ব্যভিচারের ফলে জন্ম নেয়া সন্তান, এমন একটা কাজ যা পারিবারিক আদর্শকে নস্যাৎ করে এবং নিজের আপন পরিবার খুঁজে পেতে সে ব্যর্থ হয়। তার দায়িত্বজ্ঞানহীন জীবনযাপন স্বেচ্ছাচারেরই নামান্তর, এমন এক ধরনের প্রশাসন যা আইনের ঊর্ধ্বে রাজাকে স্থান দেয় এবং এথেন্সবাসীরা যা বর্জন করেছে। এডোনিসের উৎসবের, বৈশিষ্ট্যই হলো মেয়েদের মাত্রা ছাড়া বিলাপ, পুরুষরা যাকে বিতৃষ্ণার সাথে দেখে। সংক্ষেপে, সে ছিল রাজনৈতিকভাবে প্রতিবন্ধী, এবং এথেন্সবাসীদের হয়তো সাহায্যই করেছিল সংযমের বিপরীত সব কিছুকে মানবিক গুণাবলী দ্বারা প্রকাশ করে নিজেদের সীমা নির্ধারণে, Polis এর পুরুষদের মূল্যবোধ।

শহুরে জীবন পুরাণকে বদলে দিয়েছে। দেবতারা দূরবর্তী হতে শুরু করেছেন। দিব্য জগতে নারী ও পুরুষকে পৌঁছে দিতে পুরাতন আচার অনুষ্ঠান আর গল্পজ্ঞানের প্রতি মানুষের মোহভঙ্গ হচ্ছে যা তাদের পূর্বপুরুষদের এক সময় মানসিক পুষ্টি জুগিয়েছে। শহরগুলো আরো সংগঠিত হলে, পাহারাদারীর দক্ষতা বাড়লে এবং চোর ও ডাকাতদের শাস্তি দেয়ার হার বেড়ে গেলে, দেবতারা যেন ক্রমশ মানবতার দুর্দশা সম্পর্কে উদাসীন বেখেয়াল হয়ে উঠেন। একটা আধ্যাত্মিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। সভ্য পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে, পুরাতন আধ্যাত্মিকতা হ্রাস পায় এবং এর স্থান নিতে নতুন কিছু সামনে এগিয়ে আসে না। শেষ পর্যন্ত এই অস্থিরতা আরেকটা মহান রূপান্তরের জন্ম দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *