৬. যুগান্তকারী পর্বের পরবর্তী সময়
(খ্রি: পূ: ২০০০-১৫০০)
আমাদের ইতিহাস পর্যবেক্ষণে এখন পর্যন্ত প্রধান প্রধান সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক আর আধ্যাত্মিক বিপ্লবের প্রতি আমরা আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ রেখেছি যা মানুষকে তাদের পৌরাণিক তত্ত্ব সংশোধনে বাধ্য করেছে। যুগান্তকারী অ্যাক্সিয়াল যুগের পরের হাজার বছরে তুলনা করার মতো কোনো পরিবর্তন হয়নি। আধ্যাত্মিক আর ধর্মীয় ব্যাপারে আমরা এখনও যুগান্তকারী সময়ের ঋষি আর দার্শনিকদের অন্তর্জানের উপর নির্ভর করি এবং ষোড়শ শতকের পূর্ব পর্যন্ত পুরাণের পরিস্থিতি মূলত অপরিবর্তিত থাকে। এই ইতিহাসের বাকী অংশে আমরা পশ্চিমে মনোযোগ নিবদ্ধ করবো, নবমার্গের পরবর্তী পর্যায় এখান থেকে শুরু হয়েছে বলেই কেবল না, কিন্তু একই সাথে পশ্চিমের মানুষ এই সময় পুরাণ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়তেও শুরু করেছে। পশ্চিমের ধর্মও আমরা খুটিয়ে দেখবো, কারণ একেশ্বরবাদের তিনটি মতবাদের দাবী, কিছুটা হলেও, ইতিহাসের চেয়ে পুরাণের উপরে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। অন্যান্য প্রধান মতবাদে পুরাণের প্রতি এমন যুগপৎ মতবাদের প্রভাব কম। হিন্দু মতবাদে, ইতিহাসকে ক্ষণস্থায়ী আর অলীক হিসাবে দেখা হয় আর সে কারণে আধ্যাত্মিক বিবেচনায় গুরুত্বহীন। পুরাণের আদি মৌলিক পৃথিবীতে হিন্দুরা অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বৌদ্ধ মতবাদ গভীর মনোবৈজ্ঞানিক ধর্ম, এবং পুরাণকে মনোবিদ্যার প্রাচীন ধারা বলে মনে করে, দুটো বেশ সদৃশ। কনফুসিয়াসের মতবাদে, পুরাণের ভাষ্যের চেয়ে আচার অনুষ্ঠানের গুরুত্ব সবসময় বেশি। কিন্তু খ্রিস্টান, ইহুদি আর মুসলমানেরা বিশ্বাস করে ইতিহাসে তাদের ঈশ্বরের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে এবং এই পৃথিবীর বাস্তব ঘটনায় তাকে অনুভব করা সম্ভব। এসব ঘটনা কি আদতেই ঘটেছিল নাকি এগুলো সবই ‘পুরাণে’র অংশ? পুরাণের প্রতি এই অস্বস্তিকর মনোভাবের কারণে প্লাটো আর এ্যারিস্টোটলের হাত ধরে যা পশ্চিমা মননে প্রবেশ করেছে, একেশ্বরবাদীরা কিছু সময় পর পর দর্শনের যুক্তিপাতের সাথে ধর্মকে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে চেষ্টা করাটা ভুল হয়েছে।
অন্য পুরাণের প্রতি ইহুদি মতবাদের মনোভাব অনেক স্ববিরোধিতায় ক্লিষ্ট। অন্য জাতির পুরাণের প্রতি একে শত্রুভাবাপন্ন বলে মনে হয়, কিন্তু কখনও কখনও ইহুদি ভাবধারা প্রকাশ করতে তারা এসব বিদেশী গল্পের সাহায্য অকাতরে নিয়ে থাকে। আর তাছাড়া ইহুদি মতবাদ আরো পুরাণের সৃষ্টিকে প্রবুদ্ধ করা অব্যাহত রেখেছে। তার মধ্যে একটা হলো খ্রিস্টানধর্ম। যীশু আর তার প্রথম দিকের শিষ্যরা সবাই ছিল ইহুদি আর ইহুদি আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী, যেমন সেন্ট. পল, যিনি যীশুকে বলা যায় প্রায় পৌরাণিক চরিত্রে রপান্তরিত করেছেন। যদিও মর্যাদাহানিকর কোনো ইচ্ছা থেকে না। যীশু ছিলেন একজন সত্যিকারের ঐতিহাসিক চরিত্র, ৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রোমানরা তাকে হত্যা করেছিল এবং তার প্রথম শিষ্যরা নিশ্চিতভাবে ভেবেছিল যে তিনি– কোনো একটা অর্থে মৃত্যু থেকে জাগ্রত হয়েছেন। একটা ঐতিহাসিক ঘটনাকে যতই পৌরাণিকায়ন করা হোক এটা কখনও ধর্মীয় উৎসাহের উৎস হতে পারে না। পুরাণ হলো একটা ঘটনা যাকে স্মরণ করা হবে যা– কোনো এক অর্থে- একদা সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু যা একই সাথে সব সময়ে ঘটছে। একটা ঘটনাকে মুক্ত হতে হবে, যেভাবে ঘটেছিল, একটা নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডি থেকে এবং সমসাময়িক উপাসকদের জীবনে আনয়ন করতে হবে নতুবা এটা একটা অনন্য, পুনরাবৃত্তিহীন ঘটনা হিসাবে রয়ে যাবে বা একটা ঐতিহাসিক খেয়াল যা সত্যিকারের অর্থে কারো জীবন স্পর্শ করতে অপারগ। আমরা জানি না মিশর থেকে পালাবার সময়ে এবং সি অব রীড অতিক্রমকালে ইসরাইলের মানুষের ভাগ্যে কি ঘটেছিল কারণ গল্পটা একটা পুরাণের মতো করে লেখা হয়েছে। পাসওভারের আচার আনুষ্ঠানিকতা বহু শতাব্দী ধরে এই কাহিনীকে ইহুদিদের আধ্যাত্মিক জীবনের কেন্দ্রে পরিণত করেছে যা তাদের বলেছে যে তারা নিজেদের প্রত্যেককে মিশর থেকে পালিয়ে আসা বংশধর বলে মনে করবে। একটা পুরাণকে রূপান্তরকারী আচার অনুষ্ঠান ব্যতীত সঠিকভাবে অনুধাবন করা যায় না, যা বংশ পরম্পরায় উপাসকদের হৃদয়ে এবং জীবনে একে বাঁচিয়ে রেখেছে। পুরাণ যজ্ঞ দাবী করে : যাত্রা পুস্তকের পুরাণ দাবী করে যে ইহুদিরা স্বাধীনতাকে পবিত্র বলে সম্মান করবে এবং অপরের নিপীড়ন আর তাদেরকে দাসে পরিণত করার প্রয়াসে বাধা দেবে। আচার অনুষ্ঠান এবং নৈতিক স্বীকৃতি দ্বারা, গল্পটা অতীতের কোনো ঘটনা হিসাবে বিদ্যমান না থেকে একটা জীবন্ত বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে।
যীশুর সাথে সেন্ট পলও একই কাজ করেছেন। যীশুর শিক্ষা সম্বন্ধে তার খুব একটা উৎসাহ ছিল না, যা তিনি সামান্যই উদ্ধৃত করতেন, তার পার্থিব জীবন সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। ‘আমরা যদি কখনও রক্ত মাংসের যীশুকে জেনেও থাকি,’ কোরিন্থিয়ানের ধর্মান্তরিতদের উদ্দেশে তিনি লেখেন, ‘এখন তাকে আর আমরা সেভাবে জানি না’।[৯৪] গুরুত্বপূর্ণ হলো তার মৃত্যু আর পুনরুত্থান সংক্রান্ত ‘রহস্য’ (গ্রীক মিথোস আর এই শব্দটা একই উৎস থেকে আগত)। পল যীশুকে রূপান্তরিত করে, অনন্ত পৌরাণিক বীরে পরিণত করেন, মারা গিয়ে নতুন জীবনে যার উত্থান হয়েছে। তাকে ক্রুশবিদ্ধকরণের পরে, যীশু ঈশ্বর কর্তৃক একটা অনন্য উচ্চতর মাত্রা লাভ করেন, অস্তিত্বের ঊর্ধ্বতর মার্গে ‘আরোহণ’ তিনি অর্জন করেন।[৯৫] কিন্তু সবাই যারা আঙ্গুদীক্ষার আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেয় (পানিতে অবগাহন করিয়ে সনাতন রূপান্তরিতকরণ) যীশুর মৃত্যুতে প্রবেশ করে তার নতুন জীবন ভাগ করে নেয়।[৯৬] যীশু এখন আর কেবলই একটা ঐতিহাসিক চরিত্র না কিন্তু খ্রিস্টানদের জীবনে একটা আধ্যাত্মিক বাস্তবতা, আচার অনুষ্ঠান আর নৈতিক অনুশাসন দ্বারা জীবনযাপন করে তারা তার মতো নিঃস্বার্থ জীবন পেতে চায়।[৯৭] ‘রক্তমাংসের’ যীশুকে খ্রিস্টানরা আর চেনে না কিন্তু আগমন বার্তা আর অন্যান্য শ্লোক পাঠ করে অন্য মানুষের মাঝে তারা তাকে খুঁজে পায়।[৯৮] তারা জানে এই পুরাণটা সত্যি, ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকার কারণেই কেবল না, তাদের নিজেদেরও রূপান্তরের অভিজ্ঞতা হয়েছে বলেও। এভাবে যীশুর মৃত্যু আর ‘জেগে ওঠা’ একটা পুরাণ, এটা একদা যীশুর জীবনে ঘটেছিল এবং এখন সব সময়ে ঘটে চলেছে।
খ্রিস্টানধর্ম অ্যাক্সিয়াল যুগের একেশ্বরবাদের পরবর্তী সময়ের পুনরুক্তি; আরেকটা হলো ইসলাম ধর্ম। মুসলমানেরা মহানবী (স:) (৫৭০-৬৫২)কে যীশু এবং বাইবেলীয় দৈবজ্ঞদের উত্তরসূরী বলে মনে করে। পবিত্র কুরআন শরীফ, আরবদের মাঝে নাযিল হওয়া পবিত্র গ্রন্থ, তার সাথে পুরাণের কোনো সমস্যা নেই। এর প্রতিটা শ্লোককে আয়াত বলা হয়, নীতিগর্ভ রূপকের আকারে রচিত। দৈবজ্ঞদের সম্বন্ধে সব কাহিনী– নূহ (আঃ), ইব্রাহিম (আঃ) বা ঈসা (আঃ)- সব আয়াত, ‘নীতিগত রূপকের উপমা,’ কারণ ঐশ্বরিক সম্বন্ধে আমরা কেবল প্রতীক আর স্মারকের সাহায্যে কথা বলতে পারি। আরবী শব্দ কুরআনের মানে ‘আবৃত্তি’। অন্যান্য লোকায়ত গ্রন্থের ন্যায়, তথ্যের জন্য নিভৃতে এই গ্রন্থ অধ্যয়ন করা ঠিক না, মসজিদের পবিত্র পরিবেশে এর পাঠ আবশ্যক এবং যতক্ষণ না একজন মুসলমান এর নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জীবনযাপন না করবে কুরআনের সম্পূর্ণ তাৎপর্য তার কাছে প্রতিভাত হবে না।
ঐতিহাসিক ধর্মের এই পৌরাণিক মাত্রার কারণে, ইহুদি, খ্রিস্টান আর মুসলমানেরা তাদের অন্তজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে বা কোনো সংকটের সমাধান খুঁজে পেতে আজও পুরাণের দ্বারস্থ হয়। তাদের সব মরমীবাদীরাই পুরাণের স্মরণাপন্ন হয়েছেন। মরমীবাদ পুরাণ এবং রহস্যময়তা সবই গ্রীক শব্দ Musteion-এর সাথে সম্পর্কিত : ‘মুখ বা চোখ বন্ধ করে’। সবই সেইসব অভিজ্ঞতার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষিত করে যা অস্পষ্ট আর অবর্ণনীয়, কারণ তারা বাক্যালাপের অতীত এবং বাইরের জগতের চেয়ে অন্তর্জগতের সাথে বেশি সম্পর্কযুক্ত। অন্তরাত্মার গভীরে মরমীবাদী ঋষিরা অবগাহন করেন মনঃসংযোগের বিধিবদ্ধ নিয়ম পালন করে যা সব ধর্মীয় মতবাদেই বিকশিত হয়েছে এবং বীরের পৌরাণিক অভিযানের একটা ভাষ্যে পরিণত হয়েছে। পৌরাণিকতা যেহেতু এই গোপন, গুহ্য প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অনুসন্ধান করে মরমীবাদী ঋষিরা তাই স্বাভাবিক কারণে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে পৌরাণিক আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করেন যা প্ৰথম দর্শনে মনে হবে তাদের সনাতন প্রথার অনুমোদিত ধারার বৈরী। এটা কাবালাহ্, ইহুদিদের মরমী সাধনার ধারায় বিশেষভাবে স্পষ্ট। আমরা দেখেছি বাইবেলীয় লেখকরা ব্যাবিলনীয় আর সিরিয়ান পুরাণের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করতেন। কিন্তু কাবালীয়রা ঐশ্বরিক বিপ্লবের এমন একটা পদ্ধতির কল্পনা করতো যা এনুমা এলিশে বর্ণিত দেবতাদের উৎপত্তির ক্রমিকতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। দুর্বোধ এবং অজ্ঞাত স্বৰ্গীয় প্রকৃতি (godhead) থেকে, মরমীবাদীরা যাকে বলতেন এন ‘সফ’ (যার কোনো শেষ নেই), দশ সেফ্রিয়টের উৎপত্তি হয়েছে দশটা প্রবাহ যার দ্বারা এন ‘সফ’-এর প্রক্রিয়া বোঝানো হয়েছে, নিজের নিঃসঙ্গ একাকিত্ব থেকে অবতরণ করে মানুষের কাছে নিজেকে প্রকাশ করেছে।[৯৯] প্রতিটা সেফিরাহ ক্রমশ প্রকাশিত এই প্রক্রিয়ার একেকটা মঞ্চ এবং প্রত্যেকের নিজের প্রতীকী নাম রয়েছে। প্রত্যেকে স্বর্গীয় প্রকৃতির রহস্য সীমিত মানব মনে বেশি করে প্রবেশে সাহায্য করে। প্রতিটাই ঈশ্বরের শব্দ এবং একই সাথে অনুষঙ্গ যার দ্বারা ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছে। শেষ সেফিরাকে বলা হয় সেকিনাহ্ (shekhinah), পৃথিবীতে ঈশ্বরের দিব্য উপস্থিতি। সেকিনাকে প্রায়শই একজন নারী হিসাবে কল্পনা করা হয়, ঈশ্বরের মানবী প্রকৃতি। কোনো কোনো কাবালীয়রা ঐশ্বরিকতার মানব এবং মানবী অনুষঙ্গের মাঝে যৌন মিলন কল্পনা করে, সম্পূর্ণতা আর পুনরায় অঙ্গীভূতকরণ। কাবালাহ্র কিছু কিছু তরিকায় সেকিনাহ্ পৃথিবীতে একা একা ঘুরে বেড়ায়, বধূ বেশে যে হারিয়ে গেছে এবং স্বর্গীয় প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, দিব্য রাজ্য থেকে নির্বাসিত এবং নিজের উৎসে ফিরতে আকুল। সুমায়ী আইন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে, কাবালীয়রা সেকিনাহ্ নির্বাসন শেষ করতে এবং ঈশ্বরের পৃথিবী আবার স্থাপন করতে পারে। বাইবেলীয় সময়ে, আনাট নামে এক ঈশ্বরের স্থানীয় প্রার্থনাকারী দলকে ইহুদিরা ঘৃণা করতো, সে পৃথিবীময় নিজের দিব্য সঙ্গীর খোঁজে ঘুরে বেড়িয়েছে এবং শেষে বাআলের সাথে নিজের যৌন পুনর্মিলন উদযাপন করেছে। কিন্তু ইহুদিরা যখন দিব্য সম্পর্কে নিজেদের মরমী উপলব্ধি প্রকাশ করার একটা পথ খুঁজতে চেষ্টা করে, তখন এই গালাগালির বদলে, পৌত্তলিক পুরাণ ইহুদিদের নিরব সম্মতি লাভ করে।
কাবালাহ্র সম্ভবত কোনো বাইবেলীয় ন্যায্যতা নেই, কিন্তু আধুনিক যুগের আগে সাধারণত এটা ধরে নেয়া হতো যে পুরাণের কোনো “সর্বজন স্বীকৃত” রূপ নেই। নতুন পুরাণ নির্মাণ ব্যাপারে কারো উপরে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না এবং যে কেউ চাইলেই পুরাতন পৌরাণিক ভাষ্যের মৌলিক ব্যাখ্যা করতে পারত। কাবালীয়রা আক্ষরিক অর্থে বাইবেল পাঠ করতো না, তারা একটা ব্যাখ্যা তৈরি করেছিল যা বাইবেলীয় ভাষ্যের প্রতিটা শব্দকে কোনো না কোনো সেফ্রয়িটে অর্পণ করতো। যেমন সৃষ্টি পুস্তকের প্রথম অধ্যায়ের প্রতিটা শ্লোক একেকটা ঘটনার বর্ণনা করে যার প্রতিটার প্রতি ঘটনা ঈশ্বরের গোপন জীবনে আছে। কাবালীয়রা এমনকি একটা নতুন সৃষ্টি পুরাণও তৈরি করে যার সাথে জেনেসিসের কোনো ধরনের মিল নেই। ১৪৯২ সালে ক্যাথলিক সম্রাট ফার্দিনাণ্ড আর রানী ইসাবেলা স্পেন থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করার পরে, অনেকেই জেনেসিস I এর শান্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ সৃষ্টি পুরাণের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারতো না, তাই কাবালীয় ইসহাক লুরিয়া (১৫৩৪-৭২) একটা সম্পূর্ণ আলাদা সৃষ্টির গল্প ফাঁদেন, মিথ্যা সূত্রপাত, দিব্য ভ্রান্তি, আকস্মিক বৃদ্ধি, প্রচণ্ড বিপর্যয় এবং বিপর্যয়ের কারণে ক্রাটযুক্ত সৃষ্টির জন্ম হয় যেখানে সবকিছুই ভুল স্থানে রয়েছে। বাইবেলীয় গল্প থেকে ব্যত্যয়ী বিচ্যুতি ইহুদিদের ভিতরে কোনো ঘাতপ্রতিঘাত সৃষ্টির বদলে, লুরিয়ানিক কাবালাহ্ একটা ইহুদি গণআন্দোলনে পরিণত হয়। ষোড়শ শতকে ইহুদিদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা এতে ফুটে উঠেছে কিন্তু পুরাণটা কেবল একটা ভাষ্য না। লুরিয়া এর জন্য বিশেষ আচার অনুষ্ঠান, ধ্যানের পদ্ধতি আর নৈতিক শৃঙ্খলার পরিকল্পনা করেছেন যা পুরাণটির মাঝে প্রাণের সঞ্চার করে এবং সারা পৃথিবীর ইহুদিদের জীবনে এটা একটা আধ্যাত্মিক বাস্তবতায় পরিণত হয়।
খ্রিস্টান আর মুসলমান ইতিহাসেও অনুরূপ উদাহরণ রয়েছে। পশ্চিমে রোমান সাম্রাজ্যের যখন পতন হয়, সেন্ট অগাষ্টিন (৩৫৪-৪৩০) উত্তর আফ্রিকার হিপ্পোর বিশপ, আদম আর ঈভের পুরাণের নতুন ব্যাখ্যা করেন এবং আদিপাপের পুরাণের সৃষ্টি করেন। আদমের অবাধ্যতার কারণে, ঈশ্বর সমগ্র মানব জাতিকে অনন্ত নরকদণ্ড দেন (আরেকটা ধারণা যার কোনো বাইবেলীয় ভিত্তি নেই)। যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে আদমের উত্তরপুরুষদের মাঝে এই পাপ উত্তরাধিকারসূত্রে আরোপিত হতে থাকে, যা ‘কামপ্রবৃত্তি’ দ্বারা দূষিত, ঈশ্বরের চেঁয়ে মামুলি প্রাণীর মাঝে আনন্দ আহ্বানের অযৌক্তিক কামনা, প্রথম পাপের স্থায়ী ফল। কামপ্রবৃত্তি যৌনক্রিয়ায় সবচেয়ে পরিপূর্ণভাবে প্রতিভাত হয়, যখন ঈশ্বরের কথা মনে থাকে না এবং মানুষ নির্লজ্জভাবে একে অন্যের সাথে আনন্দে মাতে। যুক্তির এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুভূতির বিশৃঙ্খলা দ্বারা অধঃপতিত হয়েছে রোমের চাকচিক্যের সাথে যার বিশ্রী রকমের মিল, যা ছিল পশ্চিমের যৌক্তিকতা আইন আর শৃঙ্খলার উৎস, বর্বর সম্প্রদায়ের হাতে নাজেহাল হয়েছে। আদি পাপের পুরাণকে পশ্চিমা খ্রিস্টানরা তাদের বিশ্বাসের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচনা করে কিন্তু বাইজেনটাইনের গ্রীক অর্থোডক্সেরা, যেখানে রোমের পতন হয়নি, এই মতবাদকে কখন পুরোপরি স্বীকৃতি দেয়নি, তারা বিশ্বাস করে না যে যীশু আদি পাপের শাস্তি থেকে আমাদের বাঁচাতে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে যে আদম যদি পাপ নাও করতো ঈশ্বর হয়তো মানুষে পরিণত হতেন।
ইসলামে মরমীবাদীরা বিচ্ছিন্নতার এবং ঈশ্বরের কাছে ফিরে যাবার পুরাণ বিকশিত করেছে। তারা বলে যে জেরুজালেমের মসজিদ থেকে হযরত মহম্মদ (স:) আল্লাহর আরশে এক অতীন্দ্রিয় আরোহণ করেছিলেন। মুসলমান আধ্যাত্মিকতার আদিরূপে পরিণত হয়েছে এই পুরাণ এবং সুফীরা হযরতের নিখুঁত ইসলামী আচরণ বা ঈশ্বরের কাছে ‘সমর্পণ’কে প্রতীকীরূপ দিতে এই অতীন্দ্রিয় ভ্রমণের সাহায্য নেয়। শিয়া মুসলমানেরা মহানবীর পুরুষ বংশধরদের ব্যাপারে একটা পৌরাণিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটিয়েছে, যারা তাদের ইমাম (নেতা)। প্রত্যেক ইমাম দিব্য ইলম এর প্রতিমূর্তি। যখন এই ধারা শেষ হয় তারা বলে যে শেষ ইমাম ‘Occultation’-এর পর্যায়ে গিয়েছেন এবং একদিন তিনি ফিরে এসে শান্তি আর ন্যায়বিচারের যুগের সূচনা করবেন। এইখানে, শিয়া মতবাদ প্রাথমিকভাবে মরমী আন্দোলন এবং ধ্যানের বিশেষ পদ্ধতি এবং আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা ছাড়া এই পুরাণের কোনো ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। শিয়ারা নিশ্চিতভাবেই চায় না আক্ষরিক অর্থে তাদের পুরাণের ব্যাখ্যা করতে। ইমামতির এই পুরাণ, মুসলমান গোড়ামিকে যা অবজ্ঞা করে, ঐশ্বরিক উপস্থিতির বোধ প্রকাশে মরমীদের একটা প্রতীকী প্রয়াস, বিপজ্জনক পৃথিবীতে অন্তর্নিহিত এবং গ্রহণযোগ্য। লুক্কায়িত ইমাম একটা মিথে পরিণত হয়েছেন, সাধারণ ইতিহাস থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে তাকে সময় আর স্থানের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে এবং আপাতবিরোধী মনে হলেও সত্যি যে এভাবেই তিনি শিয়াদের জীবনে আরো প্রবলভাবে বর্তমান আছেন, আব্বাসীয় খলিফার আদেশে গৃহবন্দি থাকাকালীন সময়ের চাইতে। গল্পটা বিস্মৃতিপ্রবণ হিসাবে ঐশ্বরিকতা সম্বন্ধে আমাদের বোধকে প্রকাশ করে এবং এই পৃথিবীতে লোভনীয়তার রেশ জাগিয়ে অনুপস্থিত কিন্তু এর শেষ নেই।
মিথোস আর লোগোসের মাঝে গ্রীকরা ইহুদিদের কিছু অংশ, খ্রিস্টান এবং মুসলমানেরা বিভক্তি অনুভব করার কারণে তাদের সংস্কৃতিতে পৌরাণিকতার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য সত্ত্বেও এ বিষয়ে অস্বস্তিবোধ করে। অষ্টম আর নবম শতকে প্লাটো আর এরিস্টোটলের লেখা যখন আরবীতে অনূদিত হয় কিছু মুসলমান চেষ্টা করেছিল কোরআনের ধর্মের বদলে একে লোগোসের ধর্মে পরিণত করতে। তারা ‘আল্লাহ’র অস্তিত্বের ‘প্রমাণ’ বিকশিত করে, এরিস্টোটলের প্রথম কারণ প্রতিপাদনের উপর ভিত্তি করে। তাদের ফালয়াসুফ (faylasuf) বলা হতো, তারা আদিম পৌরাণিক বলে বিবেচিত সবকিছু থেকে ইসলামকে মুক্ত করতে চেয়েছিল। তাদের কাজটা ছিল কঠিন। কারণ দার্শনিকদের ঈশ্বরের আটপৌরে ঘটনা সম্পর্কে কোনো আগ্রহ নেই ইতিহাসে নিজেকে প্রকাশ করেননি, পৃথিবী সৃষ্টি করেননি এবং মানুষের অস্তিত্বের কথাই জানেন না। এসব ছাড়া ফালয়াসুফরা একটা চমকপ্রদ কাজ করেছিল, মুসলিম সাম্রাজ্যে বসবাসকারী ইহুদিদের সাথে মিলে বাইবেলের ধর্মকে যুক্তিপাতে ফেলতে চেষ্টা করেছিল। এসব সত্ত্বেও ফালয়াসুফরা সংখ্যালঘু রয়ে যায়, ক্ষুদ্র অভিজাত বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠীতে নিজেদের আবদ্ধ রাখে। বাইবেলের আর কোরআনের ঈশ্বরের চেয়ে প্রথম কারণ অনেক বেশি যৌক্তিক কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের কাছে এমন দেবতা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া মুশকিল যিনি তাদের প্রতি এত উদাসীন।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, গ্রীক অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা এই যৌক্তিক প্রকল্প অপছন্দ করতো। তারা নিজেদের আপন হেলেনীয় প্রথা সম্বন্ধে জানতো এবং আরো ভালো করে জানতো যে, প্লাটো যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, তেমন লোগোস আর মিথোস ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারবে না। তাদের দৃষ্টিতে ধর্মতত্ত্বের অধ্যয়ন যৌক্তিক অনুশীলন হতে পারে না। কাটা চামচ দিয়ে স্যুপ খাবার মতো অর্থহীন ব্যাপার হবে যুক্তি দিয়ে দিব্যকে নিয়ে আলোচনা করা। বিধিবদ্ধ প্রথা আর প্রার্থনার মাধ্যমে অগ্রসর হলেই কেবল ধর্মতত্ত্বের নির্যাস পাওয়া সম্ভব। মুসলমান এবং ইহুদিরা একটা সময়ে একই সিদ্ধান্তে পৌঁছে। একাদশ শতক নাগাদ, মুসলমানেরা সিদ্ধান্ত নেয় দর্শনকে অবশ্যই আধ্যাত্মিকতার কৃত্যানুষ্ঠান এবং প্রার্থনার সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে এবং সুফীদের পৌরাণিক মরমী ধর্ম উনিশ শতক নাগাদ ইসলামে নিয়মাত্মক রূপ লাভ করে। একইভাবে ইহুদিরা আবিষ্কার করে যে, স্পেন থেকে বিতাড়নের মতো বিয়োগাত্মক ঘটনা দ্বারা যখন তারা পীড়িত হয় তাদের দার্শনিকদের যৌক্তিক ধর্ম তাদের কেনো সাহায্যে আসে না এবং তাদের কাবালাহ্র পুরাণের দ্বারস্থ হতে হয় যা মনের স্নায়বিক স্তরের মধ্যে চালিত হয়ে তাদের কষ্ট আর আকুতির অন্তর্নিহিত উৎস স্পর্শ করে। পুরাণ আর যুক্তির পুরাতন পরিপূরক দৃষ্টিভঙ্গির শরণ নেয় তারা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান গণিত আর চিকিৎসাবিদ্যার মতো ক্ষেত্রে লোগোস অপরিহার্য- মুসলমানদের যাতে বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু তারা যখন পরমার্থ এবং তাদের জীবনের মানে খুঁজতে চায়, যখন তারা তাদের হতাশা হ্রাস করতে চেষ্টা করে বা নিজের ব্যক্তিত্বের অন্তর্নিহিত অঞ্চলের অনুসন্ধান করতে চায়, তারা পুরাণের রাজত্বে প্রবেশ করে।
কিন্তু একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপের খ্রিস্টানরা রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর অন্ধকার যুগে প্লাটো আর এরিস্টটলের হারিয়ে যাওয়া কাজ পুনরাবিষ্কার করে। ঠিক সেই সময়ে যখন ইহুদি আর মুসলমানেরা তাদের পুরাণকে যুক্তিপাতে ফেলার প্রয়াস থেকে সরে আসতে শুরু করেছে, পশ্চিমা খ্রিস্টানরা এই কাজে লাফিয়ে পড়ে এমন একটা উৎসাহ নিয়ে যা তারা কখনও সম্পূর্ণ হারাবে না। পুরাণের অর্থ তারা হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। অবাক হবার তাই কিছু থাকে না যখন মানব ইতিহাসের পরবর্তী মহান রূপান্তর শুরু হয়, যা পৌরাণিক আঙ্গিকে চিন্তা করাটা মানুষের জন্য দুরূহ করে তুলবে।