২. প্যালিওলিথিক যুগ : শিকারীদের পুরাণতত্ত্ব

২. প্যালিওলিথিক যুগ : শিকারীদের পুরাণতত্ত্ব

(প্রায় ২০,০০০ বছর পূর্ব থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০ সাল)

মানুষ তাদের ইতিহাসের এই পর্বে দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে গঠনমূলক জীববিজ্ঞান-সংক্রান্ত বিবর্তন ক্রিয়া সম্পূর্ণ করে। নানা দিক থেকে বিবেচনা করলে এটা একটা ভীতিকর এবং উদ্বেগাকুল সময়। এইসব প্রাচীন মানুষের দল তখনও কৃষিকাজ আয়ত্ত করেনি। তারা নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপন্ন করতে জানত না, জীবনধারণের জন্য তারা পুরোপুরি শিকার এবং খাদ্য সংগ্রহের উপরে নির্ভরশীল ছিল। শিকারের কৌশল আর আয়ুধের মতোই পুরাণও তাদের উত্তরজীবিতার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ছিল যা তারা, তাদের শিকার হত্যা করতে এবং তাদের পারিপার্শ্বিকের উপর এক প্রকারের নিয়ন্ত্রণ অর্জনের জন্য স্বাভাবিকভাবে বিকশিত করেছিল। নিয়ানডারথালদের মতোই প্যালিওলিথিক নারী ও পুরুষ তাদের পুরাণের কোনো লিখিত বর্ণনা আমাদের জন্য রেখে যায়নি, কিন্তু এসব গল্প মানুষের নিজেদের বুঝতে, তাদের দুর্দশা অনুধাবন করতে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে যে খণ্ডিতভাবে পরবর্তীকালের শিক্ষিত সংস্কৃতির পুরাণের অংশ হিসাবে এসব গল্প লিপিবদ্ধ হয়েছে। এইসব আদিম মানুষের অভিজ্ঞতা আর চিন্তাধারা, আমরা আফ্রিকার পিগমী বা অস্ট্রেলিয়ার অ্যাপেরিজিনদের মতো দেশজ বা মাটির কাছের মানুষদের কাছ থেকে যারা প্যালিওলিথিক মানুষদের মতো শিকারী সমাজে বাস করে এবং কৃষিবিপ্লবের অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি, তাদের কাছ থেকে অনেকাংশে জানতে পারি।

প্রতীক ও পুরাণের আঙ্গিকে এসব দেশজ মানুষের চিন্তা করাটা স্বাভাবিক কারণ, নৃতত্ত্ববিদ ও নৃবিজ্ঞানীদের কল্যাণে আমরা জানতে পারি তারা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে দৈবের মাত্রা সম্বন্ধে খুব বেশিমাত্রায় সচেতন। শিল্পায়িত শহুরে সমাজের নারী পুরুষের জীবনে আমরা যাকে দিব্য অভিজ্ঞতা বলি সেটা এখন কল্পনায় পরিণত হয়েছে কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নিকট এটা যে কেবল স্বতঃসিদ্ধ তাই না বস্তুজগতের চাইতে সেটা অনেক বেশি বাস্তব। ‘স্বপ্নসময়’ (dreamtime)– ঘুমের ভিতরে অস্ট্রেলিয়ানরা যা অনুভব করে এবং স্বপ্নাবির্ভাবের মুহূর্ত– সময়নিরপেক্ষ এবং ‘সতত’। আটপৌরে জীবনে এটা স্থায়ী প্রেক্ষাপটের সৃষ্টি করে, মৃত্যু, দুর্দশাসহ অন্তহীন ঘটনার আনাগোনায় এবং ঋতুর পটপরিবর্তনে যা জর্জরিত। স্বপ্নসময়ে পূর্ব-পুরুষদের আনাগোনা–শক্তিশালী, অস্তিত্বের আদিরূপ যারা মানুষকে বেঁচে থাকবার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে যেমন শিকারের কৌশল, যুদ্ধের নীতি, বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া, কাপড় বয়ন এবং ঝুড়ি তৈরি। এসব কাজ, সেই কারণে, লৌকিক না বরং পবিত্র কর্মকাণ্ড যা নশ্বর নারী পুরুষকে স্বপ্নসময়ের সংস্পর্শে নিয়ে আসে। যেমন ধরা যাক, কোনো অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী যখন শিকার করতে যায়, প্রথম শিকারীর আচরণ সে এমনভাবে অনুসরণ করে তার প্রতিরূপ তৈরি করে যে সে নিজের মাঝে তাকে সম্পূর্ণভাবে অনুভব করে, পৃথিবীর শক্তিশালী আদিরূপের মাঝে সে যেন দ্রবীভূত হয়ে যায়। স্বপ্নসময়ের সাথে যখন সে এই প্রকার অতীন্দ্রিয় একাত্মতা অনুভব করে কেবল তখনই তার জীবনও যে অর্থবহ সেটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এর পরেই আদি বিশুদ্ধতা থেকে তার পতন ঘটে এবং সে তার বর্তমান সময়ে ফিরে আসে যা তাকে গ্রাস করে তার সমস্ত অর্জন নিমেষে বিনাশ করবে এই ভয়ে সে তখন অস্থির হয়ে উঠে।[৩]

আধ্যাত্মিক জগৎ এমন উপস্থায়ী আর তীব্র যে আদিবাসী মানুষেরা বিশ্বাস করে, এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষের অভিগম্যতা ছিল অনেক বেশি। প্রতিটি সংস্কৃতিতে আমরা হারিয়ে যাওয়া স্বর্গ সম্বন্ধিত একটা পুরাণ দেখতে পাই, সেখানে মানুষ দিব্য সত্তার সাথে অনেক ঘনিষ্ঠ আটপৌরে, জীবনযাপন করত। তারা ছিল অমর এবং প্রকৃতি আর তার পশুপাখির সাথে মিলেমিশে তারা শান্তিতে বসবাস করতো। পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটা গাছ, পাহাড় বা খুঁটি, স্বর্গ আর মর্ত্যকে একসাথে জুড়ে রেখেছিল, যা বেয়ে মানুষ সহজেই দেবতার সন্নিকটে পৌঁছাতে পারত। তারপরে আসে এক ঘোর দুর্যোগ : পাহাড় বিচূর্ণ হয়, গাছ উপড়ে যায় এবং স্বর্গে পৌঁছানো তখন কঠিন হয়ে পড়ে। স্বর্ণযুগের গল্প, খুব প্রাচীন এবং বিশ্বজনীন এক পুরাণ যার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। পবিত্রতার তীব্র অনুভূতি থেকে এর উৎপত্তি যা মানুষের সহজাত এবং বাস্তবতার অনুভূতি সম্পর্কে তাদের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে যা প্রায় বাস্তব এবং আয়ত্তের সামান্য বাইরে। বেশির ভাগ প্রাচীন সমাজের ধর্ম এবং পুরাণ হারানো স্বর্গ ফিরে পাবার বাসনায় সিক্ত।[৪] যদিও পুরাণ নষ্টালজিয়ার সাধারণ কোনো কসরত না। পুরাণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো কিভাবে আদর্শ পৃথিবীতে আবার ফিরে যাওয়া যায় মানুষকে সেই পথ দেখানো, দিব্যদৃষ্টির মগ্নতার মাধ্যমে না বরং তাদের প্রাত্যহিক জীবনের নৈমিত্তিক দায়িত্ব পালনের ভিতর দিয়ে।

আমরা বর্তমানে ধর্মকে লোকায়ত থেকে আলাদা করে ফেলেছি। প্যালিওলিথিক শিকারীদের কাছে বিষয়টা অকল্পনীয় ছিল, যাদের কাছে লোকায়ত বা ইহজাগতিক বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। তারা যা দেখতো বা অনুভব করতো সবই ছিল দিব্যজগতের স্বচ্ছ প্রতিমূর্তি। কোনোকিছু, তা সে যতই ইতর বা হীন হোক না কেন, পবিত্রতাকে ধারণ করতে পারতো। তাদের আচরিত সব কাজই ছিল অপসুদীক্ষার মতো যা তাদের দেবতাদের সান্নিধ্যে নিয়ে যাবে। বেশির ভাগ সাধারণ কর্মকাণ্ড ছিল আনুষ্ঠানিক যা নশ্বর আত্মাকে চিরন্তন পৃথিবীর সাথে একাত্ম হতে সাহায্য করতো।[৫] আমাদের মতো আধুনিকদের কাছে, কোনো প্রতীক বিমূর্ত বাস্তবতা থেকে স্বভাবতই আলাদা, যার প্রতি সেই প্রতীক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিন্তু গ্রীক symballein শব্দের মানে ‘একসাথে নিক্ষেপ করা’ : এখানে দুটো অসম বস্তুর অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠা বোঝানো হয়েছে– ঠিক যেমন ডিসপ্রিন পানিতে দ্রবীভূত হয়। তুমি যখন কোনো পার্থিব বস্তুর কথা গভীরভাবে চিন্তা করো, এর ঐশ্বরিক প্রতিরূপের উপস্থিতিতে তুমি সেটা করো। দিব্যতার সন্নিবেশের এই বোধটা পুরাণের বিশ্ব-বীক্ষার ক্ষেত্রে জরুরী : আধ্যাত্মিক মাত্রা সম্বন্ধে মানুষকে বেশি করে সজাগ করে তোলাটাই পুরাণের উদ্দেশ্য যে তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে এবং জীবনের একটা স্বাভাবিক অংশ।

একেবারে প্রথমদিকের পুরাণগুলো মানুষকে পার্থিব জগতের মাঝ দিয়ে এমন একটা বাস্তবতা দেখাতে চাইতো যাতে মনে হবে অন্যকিছু একটা[৬] এর মধ্যে আরোপিত রয়েছে– কিন্তু এটা করতে বিশ্বাসের জোর দরকার হতো না কারণ এই পর্বে পবিত্র আর লোকায়তের মাঝে কোনো বিমূর্ত দূরত্ব বিরাজমান ছিল না। এসব প্রাচীন মানুষ যখন কোনো পাথরের দিকে দেখত, তারা সেটাকে কেবল অচেতন কোনো জড় পদার্থ বলে ভাবতো না। শক্তি, স্থায়িত্ব, একতা আর অস্তিত্বের একটা পরম মাত্রা হিসাবে পাথরটা প্রতিভাত হতো যা মানুষের ঘাতোপযোগী পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পাথরের এই স্বতন্ত্রতাই তার পবিত্র বলে পরিগণিত হবার কারণ। পাথর কৃত্যানুষ্ঠানের একটা সাধারণ ধারক- পবিত্রতার বিস্ময়কর প্রকাশ প্রাচীন পৃথিবীর সর্বত্র। অথবা, একটা গাছ, যার অনায়াসে নিজেকে নবীন, পুনরুত্থিত করার শক্তি রয়েছে এবং দৃশ্যমান এই ক্ষমতা এক অলৌকিক প্রাণশক্তি মরণশীল নারী পুরুষের যাতে কোনো অধিকার নেই। চাঁদের ক্ষয় হওয়া যখন তারা দেখে, তখন পুনর্জন্মের পবিত্র উদাহরণ হিসাবে একে বিবেচনা করে,[৭] নিয়মের অলঙ্ঘনীয় নজির যা একাধারে কঠোর আবার করুণাময় এবং ভীতিকর আবার সেই সাথে প্রশান্তিদায়ক। গাছ, পাথর, কিংবা দিব্য সত্তা কখনও তাদের উপাসনার বস্তু ছিল না কিন্তু তাদের শ্রদ্ধা করা হতো কারণ তারা ছিল একটা গোপন শক্তির প্রকাশবার্তা যা সব প্রাকৃতিক বস্তুর ভিতর প্রচণ্ডভাবে প্রতিভাত হয়ে মানুষকে আরেকটা প্রভবিষ্ণু বাস্তবতার ইঙ্গিত প্রদান করতো।

সভ্যতার একেবারে শুরুর দিকের কিছু পুরাণ, যা সম্ভবত প্যালিওলিথিক যুগের চেয়েও প্রাচীন, আকাশের সাথে সম্বন্ধিত, যা মানুষকে সম্ভবত পবিত্রতার প্রথম ধারণা দিয়েছিল। তারা যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো- তাদের ক্ষুদ্ৰ প্ৰাণ থেকে বহুদূরে অনন্ত অসীমে বিরাজমান– তাদের মনের ভিতরে একটা ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত হতো।[৮] তাদের মাথার উপরে বিরাজমান প্রবল আকাশ, যার বিশালতা তাদের বোধগম্যতার অতীত এবং অনন্ত। সর্বব্যাপী আর স্বতন্ত্রতাইএর মূল নির্যাস। মানুষের পক্ষে এ দুটো জিনিসকে প্রভাবিত করা অসম্ভব। ঝড়, ঝঞ্ঝা, বজ্রপাত, গ্রহণ, সূর্যাস্ত, রঙধনু এবং উল্কাপাতের শেষ না হওয়া নাটকই অন্য আরেকটা অনন্ত সক্রিয় যাত্রার কথা বলে যার নিজস্ব একটা গতিশীল জীবন রয়েছে। আকাশের কথা চিন্তা করে মানুষ কখনও হত ভীত কখনও আনন্দিত আবার কখনওবা আতঙ্কিত কখনওবা উদ্বিগ্ন। আকাশ কখনও তাদের আকর্ষণ করতো কখনও বীতস্পৃহা জন্মাত। রুডলক ওট্টো, ধর্মতত্ত্বের মহান ঐতিহাসিক বলেছেন, এর প্রকৃতিই ভয় ও শক্তির উদ্রেককারী। কোনো কল্পিত দেবীর অধিষ্ঠান ব্যতীত আকাশ নিজেই হলো mysterium tremendum terribile et fascinans?[৯]

পৌরাণিক ও ধর্মীয় চেতনা উভয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের সাথে এভাবেই আমরা ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠি। আমাদের সন্দেহপ্রবণ বয়েসে, আমরা প্রায়শই ভেবে নিতাম মানুষ ধার্মিক কারণ তারা যে দেবতার আরাধনা করে তার কাছ থেকে তারা প্রতিদানে কিছু চায়। তারা চেষ্টা করে শক্তির বরাভয় যেন তাদের উপরেই বর্ষিত হয়। তারা চায় দীর্ঘ জীবন, রোগমুক্তি আর অমরত্ব এবং চিন্তা করে যে দেবতাকে তারা রাজি করাতে পারবে তাদের এসব বর প্রদানে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে এইসব অতি প্রাচীন পৌরাণিক ব্যাখ্যায় আমরা দেখতে পাই উপাসনায় সব সময়ে নিজের বরাভয়ের উপলক্ষটা জরুরী না। মানুষ আকাশের কাছ থেকে কিছু চায় না এবং স্পষ্টতই জানতো কোনোভাবেই আকাশকে তারা প্রভাবিত করতে পারবে না। সুপ্রাচীন কাল থেকেই, আমরা পৃথিবীকে ভীষণ রহস্যময় হিসাবে দেখতেই অভ্যস্ত; ত্রাস আর বিস্ময়ের যুগলবন্দির সাহায্যে সে আমাদের আটকে রাখে যা কিনা আবার উপাসনার মূলসুর পরবর্তীকালে ইসরায়েলের জনগোষ্ঠী ঐশ্বরিক কিছু বোঝাতে qaddosh শব্দটা ব্যবহার করেছে। এর মানে ‘পৃথক, আলাদা’। শুদ্ধ ভাবোন্মাদনা নিজেই একটা সন্তুষ্টিকর অভিজ্ঞতা যা এমন কিছু সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে, যা তাদের আপন সত্তাকে পুরোপুরি ছাপিয়ে যেতে পারে, এবং তাদের নিজস্ব সীমাবদ্ধ পরিসর থেকে অনুভূতি আর কল্পনার রাশ আলগা করে দিয়ে মানুষকে পরমানন্দের অভিজ্ঞতা এনে দেয়। এটা অচিন্তনীয় যে দুস্থ দুর্বল মানুষের ইচ্ছাকে আকাশ প্ররোচিত করতে পারবে।

প্যালিওলিথিক যুগের পরেও বহুকাল আকাশ পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সুপ্রাচীন কালেই একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠে যে পুরাণ যদি এমন কোনো বাস্তবতার কথা বলে যা নিজেই বড্ড সর্বব্যাপী তবে সেই পুরাণ ব্যর্থ হতে বাধ্য। পুরাণ যদি মানুষকে ঐশ্বরিকতার সাথে কোনোভাবে শরিক করতে না পারে তবে তা তাদের চেতনা থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে যেতে একটা পর্যায়ে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। কোনো একটা পর্যায়ে- আমরা জানি না ঠিক কখন ব্যাপারটা ঘটেছিল– পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জনগোষ্ঠী আকাশের মাঝে মানবিক গুণাবলী আরোপ করতে শুরু করেছিল। তারা ‘আকাশ দেবতা’ বা ‘ঊর্ধ্বদেব’ এদের নিয়ে গল্প বলতে শুরু করে, যিনি একাকী শূন্য থেকে স্বর্গ আর মর্ত্য সৃষ্টি করেছেন। এই প্রাচীন একেশ্বরবাদ প্রায় নিশ্চিতরূপেই প্যালিওলিথিক পর্বের। অসংখ্য দেবদেবীর উপাসনা শুরু করার আগে, পৃথিবীর নানা অঞ্চলের মানুষ, কেবল একজন মহান ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছিল যিনি বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং দূর থেকে মানুষের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন।

প্রায় প্রতিটি সর্বদেবতার মন্দিরের নিজস্ব আকাশ দেবতা রয়েছে। নৃতত্ত্ববিদেরা ফুজির আদিবাসী, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী এবং পিগমীদের মতো জনগোষ্ঠীর মাঝে তাঁর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন।[১০] সব বস্তুর তিনিই মূল / প্রথম কারণ এবং স্বর্গ ও মর্ত্যের শাসক। কোনো প্রতিমূর্তি বা প্রতিমা দ্বারা তাঁকে কখনও উপস্থাপন করা হয়নি এবং তাঁর কোনো পুরোহিত বা মন্দির নেই কারণ মানুষের প্রথাগত প্রার্থনায় তার প্রশংসা করা সম্ভব না। মানুষ ঊর্ধ্ব ঈশ্বরের প্রার্থনার সময় তাঁর প্রতি আকুল আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে, বিশ্বাস করে যে তিনি উপর থেকে তাদের দেখছেন এবং খারাপ কাজ করলে শাস্তি দেবেন। কিন্তু তারপরেও তাদের প্রাত্যহিক জীবনে তিনি অনুপস্থিত। আদিবাসী মানুষদের ভাষায় তাঁকে প্রকাশ করা অসম্ভব এবং পৃথিবীর মানুষের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে তিনি ব্যগ্র নন। দুর্যোগের সময়ে তাঁরা তার স্মরণাপন্ন হতে পারে কিন্তু অন্য সময়ে তিনি অনুপস্থিত থাকেন এবং প্রায়শই বলা হয় ‘চলে গেছেন’ বা ‘অদৃশ্য হয়েছেন’।

প্রাচীন পারস্য, বৈদিক ভারত এবং গ্রীক ও ক্যানানাইটদের আকাশ ঈশ্বর এভাবেই বিলীন হয়ে গেছেন। এসব জনগোষ্ঠীর পুরাণ, ঊর্ধ্বঈশ্বর, বড়জোর একটা আবছায়া, শক্তিহীন দেবতা, সর্বদেবতার দিব্য উপস্থিতির মাঝে তাঁর অবস্থান খুব সাধারণ এবং ইন্দ্র, অনীল, বাআল এদের মতো প্রাণবন্ত, আকর্ষণীয় আর অভিগম্যরাই সেখানে প্রাধান্য লাভ করেছে। ঊর্ধ্ব ঈশ্বর কিভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন সেটা ব্যাখ্যা করে গল্প প্রচলিত আছে : যেমন, গ্রীকদের, আকাশ দেবতা ওরানস তার ক্ষমতা হরণ করে তারই ছেলে ক্রোনস, পুরাণে এসব নপুংসক স্রষ্টাদের খুব ভয়াবহভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, যে তারা মানুষের প্রাত্যহিক জীবন থেকে দূরে এতটাই দূরে সরে গিয়েছে যে একটা সময়ে প্রান্তিক অবস্থার শিকার হয়েছেন। প্রতিবার বৃষ্টিপাতের সময়ে মানুষ বাআলের দিব্য ক্ষমতা অনুভব করে; যুদ্ধের সর্বব্যাপী চণ্ডতা তাদের যতবার আচ্ছন্ন করে ফেলে ততবারই ইন্দ্রের ক্ষমতা তাদের গোচরীভূত হয়। কিন্তু বুড়ো আকাশ দেবতা আর মানুষের জীবনকে সেভাবে ছুঁয়ে যায় না। এসব প্রাচীন লোককথা একটা বিষয় পরিষ্কার করে দেয় যে পুরাণ যদি খুব বেশিমাত্রায় আধিদৈবিক নির্ভর হয় তবে সেটা সফল হতে পারে না; মানবতার সাথে সম্পৃক্ত পুরাণই কেবল গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

আকাশদেবতার নিয়তি আমাদের আরেকটা ভ্রান্ত কিন্তু লোকপ্রিয় ধারণার কথা মনে করিয়ে দেয়। এটা প্রায়ই ধরে নেয়া হয় যে, প্রাচীন পুরাণসমূহ প্রাক বিজ্ঞান যুগে মানুষকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সূচনা সম্পর্কে অবহিত করতো। আকাশদেবতার গল্প ঠিক এধরনেরই অনুমানের কথা উপস্থাপন করে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এটা একটা ব্যর্থ পুরাণ, মানুষের প্রকৃতি সম্বন্ধে বা তাদের দৈনন্দিন জীবনের কোনো সমস্যার সমাধানে এটা সাহায্য করতে অপারগ। আকাশ দেবতার দুর্দশাই আমাদের জন্য ব্যাখ্যা করাটা সহজ করে দেয় কেন মুসলমান, খ্রিস্টান আর ইহুদিদের উপাস্য স্রষ্টা ঈশ্বর, কেন পশ্চিমের বহু মানুষের জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পুরাণ কখনও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দেয় না বরং এটা আচরণের একটা প্রাথমিক বিধিবিধান। আচরিত হলেই কেবল এর অন্তর্নিহিত সত্যটা প্রতিভাত হবে, তা সে নীতিগতভাবেই হোক বা প্রথাগতভাবেই হোক। এটাকে যদি কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো উপপ্রমেয় হিসাবে বিবেচনা করা হয় তবে এটা বিরল, আর অবিশ্বাসী হয়ে উঠবে।

ঊর্ধ্বদেবতা হতে পারে মর্যাদা হারিয়েছে কিন্তু আকাশ আজও মানুষকে ঈশ্বরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পবিত্রতার পৌরাণিক প্রতীক হিসাবে উচ্চতা টিকে আছে– প্যালিওলিথিক আধ্যাত্মিকতার স্মারক হিসাবে। পুরাণ এবং মরমীবাদে নারী এবং পুরুষ উভয়েই আকাশকে ছুঁতে চেষ্টা করেছে এবং স্বপ্নযান এবং একাগ্রতার নানা তরিকা এবং পদ্ধতির জন্ম দিয়েছেন যাতে আরোহণের এই সমস্ত গল্পকে আচরিত পর্যায়ে নিয়ে এসে চেতনার উন্নততর ‘স্তরে’ ‘আরোহণ’ করা যায়। সাধুসন্তরা দাবী করেন যে দিব্য মণ্ডলে আরোহণের পূর্বে তারা দিব্য পৃথিবীর নানা স্তরের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করেছেন। বলা হয়ে থাকে যোগীরা শূন্যে ভেসে বেড়াতে পারে। মরমীবাদীরা দেহকে শূন্যে উত্থিত করতে পারে, নবীরা পাহাড় ডিঙিয়েছেন এবং অস্তিত্বের আরো মহত্তর মাত্রায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন।[১১] মানুষ যখন আকাশের সর্বব্যাপী বিস্তারের কারণে তার পানে ধাবিত হয়, তারা অনুভব করে যে মানুষেরা নশ্বরতা অতিক্রম করে ঊর্ধ্বে উঠতে পারবে। সেই কারণে প্রায়শই পুরাণে পাহাড়কে পবিত্র জ্ঞান করা হয়েছে : স্বর্গ আর মর্ত্যের মধ্যবর্তী একটা স্থান, যেখানে মূসা (আঃ)-এঁর মতো লোকেরা তাদের ঈশ্বরের দেখা পান। সব সংস্কৃতিতেই আরোহণ সম্পর্কীয় পুরাণ লক্ষ্য করা যায়, সব কিছুকে অতিক্রম করার, ছাপিয়ে যাবার একটা বিশ্বজনীন আকাঙ্ক্ষা এবং মানব জন্মের নানা বন্ধন থেকে মুক্তি। পুরাণকে কখনও আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া উচিত না। আমরা যখন পড়ি যে যীশু খ্রিস্ট স্বর্গে আরোহণ করেছেন তখন বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে তিনি উঠে যাচ্ছেন কল্পনা করাটা আমাদের উচিত হবে না। মহানবী (সঃ) যখন মক্কা থেকে জেরুজালেমে উড়ে আসেন এবং তারপরে একটা সিঁড়ি বেয়ে আল্লাহ্র আরশে পৌঁছান, আমাদের বুঝতে হবে যে আধ্যাত্মিকতার একটা ভিন্ন উচ্চতর মাত্রায় তিনি আরোহণ করেছেন। নবী এলিজাহ্ (রা:) যখন আগুনের রথে চড়ে স্বর্গে আরোহণ করেন, তিনি মানুষের নশ্বরতা পিছনে ফেলে যান এবং পার্থিব অভিজ্ঞতার ঊর্ধ্বে যে পবিত্র দিব্য অঞ্চল সেখানে পৌঁছান।

পণ্ডিতেরা মনে করেন যে আরোহণ সম্পর্কিত প্রথম পুরাণটার জন্ম প্যালিওলিথিক পর্বে এবং তা শামান নামে একজনের সাথে সম্পর্কিত, শিকারী সমাজের প্রধান ধর্মীয় আচার্য্য। তিনি ছিলেন পরমানন্দ আর স্বপ্নপ্রয়াণের গুরু, যার স্বপ্ন আর দূরদৃষ্টি শিকারের মূল্যবোধগুলোকে একটা ভিত্তি দিয়েছে এবং এর প্রতি একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা আরোপ করেছে। শিকার ছিল মারাত্মক বিপদসঙ্কুল। শিকারের প্রয়োজনে শিকারীদের অনেকদিন বাইরে কাটাতে হয়, গুহার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত করে এবং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা তাঁদের লোকদের জন্য খাবার সংগ্রহ করে আনতো। কিন্তু, আমরা এখন দেখবো যে, এটা কেবল একটা প্রয়োগবাদী অভিযান না, তাদের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মতো এরও একটা সৰ্বব্যাপী মাত্রা রয়েছে। গুরু শামানও একটা অভিযানে নেমেছেন, কিন্তু তার এ অভিযান আধ্যাত্মিকতার। এটা অনুমান করা হয় যে নিজের দেহ ত্যাগ করার ক্ষমতা তার ছিল এবং তার আত্মা স্বর্গীয় পরিমণ্ডলে ঘুরে বেড়াত। তিনি যখন স্বপ্নপ্রয়াণ অবস্থায় থাকতেন তখন বাতাসে ভেসে যেতে পারতেন এবং নিজের লোকদের ভালোমন্দ নিয়ে দেবতাদের সাথে অন্তরঙ্গ আলাপ করতেন।

স্পেনের আলতামিরা এবং ফ্রান্সের লাসাউক্সে অবস্থিত প্যালিওলিথিক গুহা মন্দিরে, আমরা শিকারের চিত্র অঙ্কিত দেখতে পাই; বন্য পশু আর শিকারী পাশাপাশি, মানুষগুলোর মুখে পাখির মুখোশ উড্ডয়নের ইঙ্গিতবহ, সম্ভবত তারাই শামান। এমনকি আজও, সাইবেরিয়া থেকে টিয়েরা ডেল ফুয়েগোর শিকারী গোষ্ঠীর, শামানরা বিশ্বাস করে যে তারা যখন স্বপ্নপ্রয়াণে থাকে তখন তারা স্বর্গে আরোহণ করে এবং দেবতাদের সাথে কথা বলে, বহুকাল আগে স্বর্ণযুগে মানুষেরা যেমন করে থাকত। পরমানন্দ অর্জনের ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতির ব্যাপারে শামানদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। বয়ঃসন্ধিক্ষণে সে কখনও চিত্তবৈকল্যে আক্রান্ত হতো যা তার পুরাণ লোকায়ত চেতনার প্রতি প্রবল বৈরাগ্য এবং প্রাচীন মানুষদের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, কিন্তু যা আজ আমরা হারিয়ে ফেলেছি, তার পুনরুদ্ধার। ঢাকঢোল সহযোগে শামান স্বপ্নপ্রয়াণ দশাপ্রাপ্ত হতো বিশেষ আচারানুষ্ঠান পর্বে। কখনও সে একটা গাছ বা লম্বা খুটি বেয়ে উপরে উঠে যা একসময় স্বর্গ ও মর্ত্য সংযোগকারী পাহাড়, গাছ বা সিঁড়ির প্রতীকী আরোপণ।[১২] পৃথিবীর গভীরতার ভিতর দিয়ে স্বর্গে যাবার ঘটনা বর্ণনা করেছে আধুনিককালের এক শামান :

মানুষ যখন গান গায়, আমি নাচি। আমি পৃথিবীর উদরে প্রবেশ করি। আমি একটা জায়গায় যাই, মানুষ বসে পানি পান করে অনেকটা সেরকম জায়গাটা। আমি বহুদূর ভ্রমণ করি, অনেক দূর… যখন আমি আবির্ভূত হই, তখনই আমি উঠতে শুরু করেছি। দক্ষিণে ঝুলে থাকা সুতো, সেই সুতো বেয়ে আমি উঠছি… এবং তুমি অবশেষে যখন ঈশ্বরের সান্নিধ্যে পৌঁছাও, তুমি নিজেকে খুব দীন করে তোলো। তারপরে সেখানে কর্ম সমাধা করে তুমি অন্যেরা যেখানে রয়েছে সেখানে ফিরে আসো।[১৩]

শিকারীদের বিপদসঙ্কুল অভিযানের মতো, শামানও মৃত্যুর মোকাবেলা করে। সে যখন তার লোকদের কাছে ফিরে আসে এবং তার সঙ্গীসাথীরা তাকে সুস্থ করে তোলে তারা তোমার মাথা তুলে ধরে এবং মুখের এক পাশে ফুঁ দেয়। এভাবেই তুমি আবারও বেঁচে উঠো। বন্ধুরা যদি তোমাকে ফুঁ না দিত তবে তুমি মারা পড়তে… তুমি নিশ্চিত মারা যেতে, এবং মৃত বলে ঘোষণা করা হতো তোমাকে।[১৪]

আধ্যাত্মিক ঊর্ধ্বচর্চা শারীরিক ভ্রমণের সাথে জড়িত না, কিন্তু একটা পরমানন্দের অনুভূতি যখন মনে হবে আত্মা দেহচ্যুত হয়েছে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে অবরোহণ ব্যতীত স্বর্গের গৌরবে আরোহণ করা যায় না। পৃথিবীর সব সংস্কৃতির মরমীবাদী সাধু আর যোগীদের আত্মিক অনুসন্ধানে এই একই প্রাচীন আধ্যাত্মিকতার সুর ঘুরে ঘুরে এসেছে। মানুষের ইতিহাসের সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত এসব পুরাণ এবং আরোহণের আচারঅনুষ্ঠানের এই উপস্থিতি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে মানবতার অন্যতম আকুতি হলো মানবিক অবস্থার ঊর্ধ্বে উঠার আকাঙ্ক্ষা। মানুষ বিবর্তনের প্রক্রিয়া শেষ করার সাথে সাথে, তারা দেখতে পায় ছাপিয়ে যাবার ছড়িয়ে পড়ার একটা আকাঙ্ক্ষা তাদের অস্তিত্বের সাথে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে।

শিকারী সবগোষ্ঠীতেই আমরা কেবল শামানদের উপস্থিতি খুঁজে পাই এবং তাদের আধ্যাত্মিকতায় পশু একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে। প্রশিক্ষণের সময়, আধুনিককালের শামানকে একটা পর্যায়ে কখনও বনে জন্তুদের সাথে কাটাতে হয়। আশা করা হয় এ পর্যায়ে কোনো একটা জন্তুর সাথে তার দেখা হবে যে তাকে পরমানন্দের গূঢ় তত্ত্বের বিষয়ে অবহিত করবে, পশুদের ভাষা শেখাবে এবং তার সব সময়ের সহচরে পরিণত হবে। এটাকে কোনো মতেই প্রত্যাবৃত্তি বলা যাবে না। শিকারী সমাজে, পশুকে কখনও নিকৃষ্ট জীব হিসাবে দেখা হয় না বরং তাদের প্রাজ্ঞতার অধিকারী হিসাবে দেখা হয়। অমরত্ব আর দীর্ঘায়ুর রহস্য তারা জানে, এবং তাদের সাথে নিবিড়ভাবে মিশে শামান একটা উন্নত জীবনের অধিকারী হয়। স্বর্ণ যুগে, মর্যাদাচ্যুত হবার আগে, ভাবা হতো যে মানুষ জীবজন্তুর সাথে কথা বলতে পারতো এবং যতক্ষণ না সে এই বিস্মৃতবিদ্যায় পুনরায় দক্ষ না হয়ে উঠবে ততক্ষণ একজন শামান দিব্য জগতে অবতীর্ণ হতে পারবে না।[১৫] কিন্তু তার এই অভিযানের আরেকটা ব্যবহারিক উদ্দেশ্যও রয়েছে। শিকারীদের মতো, সেও তার লোকদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করে। যেমন, গ্রীনল্যাণ্ডের কথাই ধরা যাক, এস্কিমোরা বিশ্বাস করে এক বিশেষ দেবীর রক্ষিতা হলো সীল আর তাই তাকে জীবজগতের দয়িতা বলা হয়। যখনই শিকারের অভাব দেখা দেয় তখনই শামানকে পাঠানো হয় তাকে সন্তুষ্ট করতে যাতে মন্দাভাব কেটে যায়।[১৬]

প্যালিওলিথিক পর্বের মানুষদের এমন পুরাণ আর রীতিনীতি ছিল এমনটা হতেই পারে। হোমো স্যাপিয়েন্সরাই যে আবার ‘শিকারী বনমানুষ এই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, যারা অন্য জন্তুদের শিকার করে, তাদের হত্যা করে ভক্ষণ করে।[১৭] প্যালিওলিথিক পুরাণে জন্তুদের প্রতি বিশেষ সম্মান দেখানো হয়েছে তাই মানুষ এখন তাদের হত্যা করতে বিব্রত বোধ করে। শিকার করার জন্য মানুষের অস্ত্র বাড়ন্ত, কারণ তারা তাদের শিকারের চেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতি এবং দুর্বল। এটা কাটাতে তাদের নতুন আয়ুধ আর তরিকার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই সাথে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো বেশ সমস্যাবহুল বলে প্রতীয়মান হয়। নৃতত্ত্ববিদেরা লক্ষ্য করেছেন যে আজকের আদিবাসী মানুষেরা পশু পাখিকে হরহামেশাই নিজেদের সমগোত্রীয় ‘মানুষ’ বলে অভিহিত করে। তারা মানুষের পশুতে পরিণত হবার বা বিপরীতটা সংঘটিত হবার গল্প বলে ও তাদের কাছে পশু হত্যা একজন বন্ধুকে হত্যা করার মতোই, তাই আদিবাসী শিকারীর দল সফল শিকার অভিযান শেষে মনঃকষ্টে ভুগে থাকে। পবিত্র কর্মকাণ্ড হিসাবে বিবেচিত হবার কারণে এবং উচ্চকোটির উদ্বেগ জড়িয়ে থাকার কারণে শিকারকে ভাবগম্ভীর আনুষ্ঠানিকতায় ভূষিত করা হয়েছে এবং একে কেন্দ্ৰ করে নানা রীতিনীতি ও টাবু গড়ে উঠেছে। শিকারের আগে, শিকারীকে অবশ্যই যৌন সংসর্গ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্রথাগত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজের অর্জিত শুদ্ধতা বজায় রাখবে; শিকার শেষে, হাড় থেকে মাংস নিকিয়ে নেয়া হবে এবং তারপরে চামড়ার উপরে খুলি ও পুরো কঙ্কাল যত্নের সাথে বিছানো হবে তাকে পুনরায় সৃষ্টির অভিপ্রায়ে এবং তাকে নতুন জীবন দান করবে।[১৮]

ধারণা করা হয়, সভ্যতার ঊষালগ্নের প্রথম শিকারীদের অনুরূপ বোধ কাজ করতো। অনেক চাপানউতোর পার হতে হয়েছে তাদের। কৃষিপূর্ব যুগে, তারা নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপন্ন করতে জানত না, তাই নিজের জীবন বাঁচাতে যাদের তারা নিজেদের সমগোত্রীয় মনে করতো তাদের বিনাশ করতে হয়েছে। তাদের প্রধান শিকার ছিল অতিকায় আকৃতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, যাদের শরীর আর মুখের অভিব্যক্তি তাদের সাথে মিলে। তাদের ভয় শিকারীর দল দেখতে পেত এবং তাদের আতঙ্কিত চিৎকারের সাথে একাত্মতা বোধ করতো। মানুষের মতো প্রবাহিত হয় তাদের রক্তধারা। এই অসহ্য অবস্থার মুখোমুখি হয়ে তারা পুরাণ আর আচার অনুষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে যাতে সমগোত্রীয় প্রাণী হত্যা করার সাথে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে, যার কিছু কিছু পরবর্তীকালের পুরাণে টিকে আছে। প্যালিওলিথিক যুগের পরেও মানুষ বন্যপ্রাণী হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করাটা সহজভাবে নিতে পারেনি। প্রাচীনকালে প্রায় সব ধর্মীয় ব্যবস্থায় পশু বলি দেয়াটা ছিল প্রধান রীতি যা প্রাচীনকালের শিকারের আনুষ্ঠানিকতার স্মারক এবং মানুষের জীবন বাঁচাতে যেসব প্রাণী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের প্রতি সম্মান জানানো।

পুরাণের প্রথম মহান বিকাশ তাই এমন একটা সময়ে যখন হোমো স্যাপিয়েন্সরা পরিণত হয় homo necans এ ‘খুনী মানুষ,’ এবং বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে অস্তিত্বের পরিবেশ মেনে নেয়াটা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আক্ষরিক অর্থে ব্যবহারিক সমস্যাজনিত প্ৰচণ্ড উদ্বেগ থেকে অনেক সময় পুরাণের জন্ম হতে পারে, যা কেবল যুক্তিতর্ক দ্বারা মীমাংসা করা অসম্ভব। শারীরিকভাবে পিছিয়ে থাকার বিষয়টা মানুষ পুষিয়ে নিতে সক্ষম, তাদের অস্বাভাবিক রকমের বড় মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যখন তারা তাদের নিজস্ব শিকারের কৌশল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়।

তারা অস্ত্র উদ্ভাবন করে এবং শিখে নেয় কিভাবে দক্ষতার সাথে নিজের সমাজকে সংগঠিত করতে হয় এবং দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হয়। শুরুর এই পর্বেও homo sapiens এর দল, পরবর্তীকালে গ্রীকরা যাকে লোগোস বলে অভিহিত করবে, তার যৌক্তিক বিবর্তন শুরু করেছে, প্রয়োগবাদী এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা যা সাফল্যের সাথে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে তাকে সাহায্য করবে।

পৌরাণিক চিন্তাভাবনা থেকে লোগোস সম্পূর্ণ আলাদা একটা ব্যাপার। পুরাণের মতোই, যুক্তিকেও বস্তুগত ঘটনার সাথে ঠিকঠিক সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। বাইরের পরিবেশে আমরা যদি কিছু ঘটনা ঘটাতে চাই তখন আমরা আমাদের মানসিক শক্তি ব্যবহার করি : যখন আমরা প্রযুক্তি উদ্ভাবন বা সমাজকে সংগঠিত করতে চাই। পুরাণের মতো, এটাও প্রয়োগবাদী। পার্থক্য একটাই, পুরাণ যেখানে হারানো স্বর্গ বা পবিত্র আদিরূপের কল্পিত পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, সেখানে লোগোস সামনে এগিয়ে যায়, সব সময় নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টায় মগ্ন, সেটা হতে পারে যুগান্তকারী কোনো উদ্ভাবন বা পুরাণ পরিজ্ঞান শানিয়ে নেয়া এবং পরিবেশের উপরে আরো বেশি করে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। যদিও পুরাণ এবং লোগোস উভয়েরই নিজ নিজ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রাক আধুনিক যুগে বেশির ভাগ মানুষ উপলব্ধি করে যে পুরাণ এবং যুক্তি একটা অন্যটার পরিপূরক; প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা মণ্ডল রয়েছে, প্রত্যেকের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যোগ্যতা রয়েছে এবং এই দু’ধরনের চিন্তা পদ্ধতির মানুষের প্রয়োজন আছে। পুরাণ কখনও শিকারীকে বলবে না কিভাবে শিকারকে বধ করতে হবে বা কিভাবে কোনো অভিযান দক্ষতার সাথে সংগঠিত করতে হবে কিন্তু পশু হত্যার জটিল আবেগ শমিত করতে নিজেকে ধাতস্থ হতে সে তাকে সাহায্যে করবে। পক্ষান্তরে লোগোস দক্ষ, বাস্তবসম্মত এবং যুক্তিনির্ভর কিন্তু মানুষের শেষ পরিণতি সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নের সে উত্তর দিতে অপারগ বা মানুষের দুঃখকষ্টও সে লাঘব করতে পারে না।[১৯] শুরু থেকেই তাই homo sapiens-এর দল সহজাত প্রবৃত্তির বলেই বুঝে গিয়েছিল যে পুরাণ আর লোগোসের প্রয়োগ ক্ষেত্র ভিন্ন। নতুন আয়ুধের উদ্ভাবনের নিমিত্তে সে লোগোস প্রয়োগ করে, এবং পুরাণ- এর সাথে আচরিত কৃত্যানুষ্ঠানের প্রয়োগ করে জীবনের নানা দুঃখজনক ঘটনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যা তাকে পুরোপুরি আপ্লুত করে ফেলার মতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং যা তাকে সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে ভূমিকা রাখতে বাধা দিচ্ছে।

আলতামিরা আর লাসাউক্স-এর ভূগর্ভস্থ গুহাসমূহ অসাধারণ প্যালিওলিথিক আধ্যাত্মিকতার একটা ঝলক আজও আমাদের জন্য ধারণ করে রেখেছে।[২০] হরিণ, বাইসন আর লোমঅলা ঘোড়া, পশুর ছদ্মবেশ নেয়া শামানের দল আর বর্শা হাতে শিকারীদের ভক্তি উদ্রেককারী চিত্রগুলো নিখুঁত চমৎকারিত্বপূর্ণ যত্ন আর দক্ষতায় আন্তর্ভৌম সুড়ঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে যেখানে পৌঁছানো খুবই কষ্টসাধ্য। ভূগর্ভস্থ এসব স্থানই সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম মন্দির আর গির্জা, এসব গুহার মানে জানতে অজস্র পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা হয়েছে; চিত্রগুলোয় সম্ভবত স্থানীয় লোককাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা আমরা কখনও জানতে পারবো না। কিন্তু তারা নিশ্চিতভাবে মানুষ আর ঈশ্বরদৃশ্য, আদিরূপ প্রাণীর মাঝে পরম সম্মিলনের একটা দৃশ্যকল্প যা গুহার দেয়াল আর ছাদকে অলংকৃত করেছে। তীর্থযাত্রীকে স্যাঁতসেঁতে এবং বিপজ্জনক সেইসব গুহায় হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে তবেই তারা কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতে পারবে। অন্ধকারের গর্ভে মুখ লুকিয়ে থাকা চিত্রিত পশুর দল তবেই দৃষ্টিপটে ধরা দেবে। আমরা এখানেও সেই একই জটিল রূপ এবং ধারণার প্রতিফলন দেখি যা আমাদের শামানের অভিযানের খবর জানিয়েছিল। শামানিক পর্বের মতোই, গুহাতেও বাদ্যবাজনা, নাচ, গান অনুষ্ঠিত হয়েছে, অন্য পৃথিবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুই হয় পৃথিবীর গর্ভে অবতরণের মাধ্যমে; এবং সেখানে মায়াবী পরিবেশে জীবজন্তুর সাথে তাদের যোগাযোগ হয়, পতিত, নিরানন্দ জগৎ থেকে যা আলাদা।

নবাগতদের জন্য অভিজ্ঞতাটা হয়তো একটু বেশিই জোরালো বিশেষভাবে আগে কখনও যে গুহায় প্রবেশ করেনি এবং মনে হয় যে এই গুহাগুলো গোষ্ঠীর যুবকদের শিকারীতে রূপান্তরিত করতে দীক্ষাদানের স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হত। প্রাচীনকালে দীক্ষাদানের অনুষ্ঠানই ছিল ধর্মের মূল বিষয় এবং আজকের প্রথাবদ্ধ সমাজেও এর গুরুত্ব যথেষ্ট রয়েছে।[২১] আজও আদিবাসী সমাজে, সদ্যযুবকদের তাদের মায়ের কাছ থেকে জোর করে বিচ্ছিন্ন করে বাধ্য করা হয় সহিষ্ণুতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে যাতে তারা মানুষে গোত্রান্তরিত হতে পারে। শামানদের যাত্রার মতো, এটাও মৃত্যু আর পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া : বালককে তার শৈশব হত্যা করে প্রাপ্তবয়স্কের দায়িত্বপূৰ্ণ পৃথিবীতে প্রবেশ করতে হবে। উপনয়নের স্মারকসমূহ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয় বা সমাধি দেয়া হয়; তাদের বলা হয় এখন একটা দানব তাদের গ্রাস করবে বা একটা আত্মা তাদের হত্যা করবে। তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা আর অন্ধকারে তাদের রাখা হয়, এসময় সাধারণত তাদের লিঙ্গাগ্রের ত্বকচ্ছেদ বা গায়ে উল্কি আঁকা হয়। অভিজ্ঞতাটা এতটাই তীব্র আর স্মরণীয় যে একবারের দীক্ষায় সবকিছু চিরতরে বদলে যায়। মনোবিদরা আমাদের বলেন যে এ ধরনের একাকিত্ব আর বঞ্চনা ব্যক্তিত্বের ভিতরে যে কেবল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাই না ব্যক্তির মাঝে সুপ্ত সৃষ্টিশীলতাও জাগ্রত হতে পারে। সহিষ্ণুতার পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে কিশোরকে জানানো হয় যে মৃত্যু মানে একটা নতুন সূচনা। পুরুষের দেহ আর সত্তা নিয়ে সে তার লোকদের মাঝে ফিরে আসে। মৃত্যুর সমূহ সম্ভাবনার সম্মুখীন হয়ে এবং অস্তিত্বের নতুন মাত্রায় আরোহণের এটা কেবলমাত্র একটা প্রক্রিয়া এটা জানার পরে, শিকারী বা যোদ্ধায় পরিণত হয়ে সে তার গোষ্ঠীর লোকদের রক্ষার জন্য তখন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হয়ে উঠবে।

দীক্ষাদান পর্বের কোনো একটা সময়ে নবদীক্ষিত প্রথমবারের মতো নিজের গোত্রের সবচেয়ে পবিত্র পুরাণ শ্রবণ করে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। পুরাণ কোনো গল্প না যেকোনো লোকায়ত বা অকিঞ্চিৎকর পরিবেশে তা উচ্চারিত হবে। এর সাথে যেহেতু পবিত্র জ্ঞানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে তাই সবসময়ে কৃত্যানুষ্ঠানের আবহে এটাকে পুনরায় স্মরণ করা হয়, যা তাকে সাধারণ লৌকিক অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা মাত্রা দেয় এবং আত্মিক আর মানসিক রূপান্তরের পবিত্র প্রেক্ষাপটেই যা কেবল অনুধাবন করা সম্ভব।[২২] পুরাণ হলো সেই উপদেশ যা আমাদের চরম মাত্রায় প্রয়োজন। একটা পুরাণ আমাদের চিরতরে বদলে দেবে এটার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কৃত্যানুষ্ঠানের সাথে মিলিত হয়ে যা গল্প আর শ্রোতার মধ্যবর্তী অন্তরায় দূর করে এবং নিজের করে নিতে যা তাকে সাহায্য করে, পৌরাণিক আখ্যানসমূহ এমনভাবে বিন্যাস করা হয় যা আমাদের পরিচিত জগতের নিরাপদ নিশ্চয়তা থেকে অজ্ঞাত জগতে ঠেলে দেবে। রূপান্তরের কৃত্যানুষ্ঠান সমূহ পালন না করে পুরাণ পাঠ অনেকটা বাজনা ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার মতো অসম্পূর্ণ। মৃত্যু এবং নবজন্ম, পুনরুত্থানের প্রক্রিয়ার একটা অংশ হিসাবে না দেখলে, পুরাণের কোনো মানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। লাসাউক্সের মন্দিরের কৃত্যানুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা থেকে, এবং শিকার এবং শামানদের অভিজ্ঞতা থেকে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যে নায়কদের জন্যেই পুরাণের সৃষ্টি হয়েছে। শিকারী, শামান আর নবদীক্ষিতের দল সবাইকে পরিচিত পরিবেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভীতিকর অভিজ্ঞতা আত্মস্থ করতে হয়েছে। নিজের যূথবদ্ধ সমাজকে সমৃদ্ধ করার অঙ্গীকার নিয়ে ফিরে আসবার আগে তাদের নৃশংস মৃত্যুর সম্ভাবনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বীরোচিত অভিযান সম্পর্কে সব সংস্কৃতিতেই প্রায় একই ধরনের পুরাণ রয়েছে। নায়ক তার নিজের জীবনে বা সমাজে কোনো একটা উপাদানের ঘাটতি অনুভব করেন। পুরাতন যে মূল্যবোধ বংশপরম্পরায় তাঁর লোকদের আত্মিক উন্নতি সাধন করেছে সেসব তাঁর কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। তাই সে ঘর ছাড়ে এবং বিপদসঙ্কুল অভিজ্ঞতা সহ্য করে। সে দানবদের সাথে লড়াই করে। দূরতিক্রম্য পাহাড় টপকে যায়, নিকষ অন্ধকার জঙ্গল অতিক্রম করে এবং এই প্রক্রিয়ার মাঝে তার পুরাতন সত্তার বিলুপ্তি ঘটে এবং নতুন অন্তজ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করে সে তার জনগোষ্ঠীর কাছে ফিরে আসে। মানবতার জন্য প্রমিথিউস দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলো, এবং সে কারণে বহু শতাব্দী যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে; এনিয়াস বাধ্য হয়েছিল তার পুরাতন জীবন ত্যাগ করতে, প্রজ্বলিত অগ্নিকাণ্ডে মাতৃভূমির ঝলসে যাওয়া দেখতে এবং নতুন শহর রোম খুঁজে পাবার আগে তাকে নিম্নতলে অবতরণ করতে হয়েছিল। নায়কের পুরাণ এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত যে ঐতিহাসিক চরিত্রদের জীবনকথা যেমন, বুদ্ধ, মুহাম্মদ (সা:), বা যীশু খ্রিস্ট, যেভাবেই বলা হোক না কেন এই আদি ছকের সাথে মিলে যাবেই আর এই কাহিনী প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল সম্ভবত প্যালিওলিথিক যুগে।

আবার, মানুষ যখন তাদের গোত্রের বীরদের এসব গল্প অন্যদের বলে, শ্রোতার মনোরঞ্জনই কেবল তারা আশা করে না। পুরাণ আমাদের বলে দেয় পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হতে চাইলে আমাদের কি করতে হবে। আমাদের প্রত্যেককেই জীবনের কোনো না কোনো একটা পর্যায়ে নায়কের ভূমিকা নিতে হবেই। জরায়ুর সংকীর্ণ গলিপথ দিয়ে প্রতিটা শিশুকেই জোর করে ঠেলে দেয়া হয়, লাসাউক্সের জটপাকানো সুড়ঙ্গপথের সাথে তার কি গভীর সখ্য, তাকে বাধ্য করা হয় মাতৃজঠরের নিরাপদ নিভৃত আশ্রয় ত্যাগ করতে এবং অপরিচিত পৃথিবীর ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। প্রতিটা মা যে সন্তান জন্ম দেয় এবং নিজের সন্তানের মৃত্যুর ঝুঁকি নেয়, সেটাও বীরোচিত।[২৩] সবকিছু ত্যাগ করার জন্য তৈরি না থাকলে কেউ বীর হতে পারে না; অন্ধকারের গর্ভে অবক্রান্তি ব্যতীত আলোর উচ্চতায় উঠা সম্ভব না, মৃত্যুর স্পর্শ ব্যতীত নতুন প্রাণের আবাহন অসম্ভব। আমাদের জীবনে সবসময়েই আমরা অপরিচিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হই এবং বীরের পুরাণ বলে দেয় আমাদের আচরণ কি ধরনের হওয়া উচিত।

আমাদের অবশ্যই যাত্রা পথে শেষকৃত্যের মুখোমুখি হতেই হবে, যা মৃত্যুর মোহরখচিত।

পরবর্তীকালের পৌরাণিক সাহিত্যে প্যালিওলিথিক যুগের কিছু বীর স্থান পেয়েছে। গ্রীক দেবতা হেরাক্লিস, যেমন নিশ্চিতরূপেই শিকারী পর্বের টিকে থাকা স্মারক।[২৪] গুহামানবের মতো তার পরনে পশুর চামড়া এবং হাতে লাঠি। হেরাক্লিস একজন শামান, পশুপাখির ব্যাপারে, তার জ্ঞান সুবিদিত; তিনি পাতালে যান, অমরত্বের সন্ধানে এবং অলিম্পাস পাহাড়ে দেবতাদের রাজ্যে পৌঁছান।[২৫] আবার গ্রীক দেবী আর্টেমিসকে বলা হয় ‘পশুর কর্ত্রী’ একজন শিকারী এবং প্রকৃতিকে বশে রাখতে সাহায্যকারী, তিনিও প্যালিওলিথিক পর্বের একজন হতে পারেন।[২৬]

শিকার একান্তভাবে পুরুষদের কাজ এবং তারপরেও প্যালিওলিথিক পর্বের অন্যতম শক্তিশালী শিকারী একজন নারী। গর্ভবতী মহিলাকে বর্ণনা করে খোদিত অতিপ্রাচীন ক্ষুদ্রাকৃতি প্রস্তরমূর্তি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ আর আফ্রিকা জুড়ে যা পাওয়া গেছে, সবই এই পর্বের। আর্টেমিসকে গ্রীক দেবীরূপে কেবল আত্মস্থ করা হয়েছে, ভীতিকর দেবী যে পশুদের কর্ত্রীই কেবল না সেই সাথে প্রাণের উৎসও বটে। প্রতিপালনকারী মমতাময়ী মা না বরং নিষ্করুণ, প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং স্বার্থপর। শিকারের পূর্বে আচরিত কৃত্য পালনে ভুল হলে, রক্তপাত আর বলি আদায়ের কারণে কুখ্যাত। এই পরাক্রমশালী দেবী প্যালিওলিথিক পর্ব ভালো করেই উতরে এসেছেন। তুরস্কের কাটাল হুইউক শহরে, সপ্তম কি অষ্টম সহস্রাব্দের, জন্মদানের প্রক্রিয়ায় রত দেবীদের চিত্র খোদাই করা বিশাল বিশাল পাথরের চাই প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁজে পেয়েছেন। তাকে বেষ্টন করে থাকে কখনও পশুর দল, মহিষের শিং বা শূকরের করোটি– সফল শিকারের স্মারক বা কখনও পুরুষের প্রতিকৃতি।

প্রবলভাবে পুরুষ শাসিত সমাজে একজন দেবী কিভাবে এতটা পরাক্রমশালী হয়ে উঠেন? হয়তো নারীর প্রতি অবচেতন বিরক্তিই এর কারণ। কাটাল হুইউকের দেবী অনন্তকাল ধরে জন্ম দিয়ে যান কিন্তু তার সঙ্গী ষাড়কে নিশ্চিত মৃতুবরণ করতে হবে। নারী এবং শিশুদের বাঁচাতে শিকারীরা নিজের প্রাণ বিপন্ন করে। শিকারের কারণে উদ্ভূত দুশ্চিন্তা আর অপরাধবোধ সাথে পালনীয় কৌমার্য থেকে উৎপন্ন হতাশা একজন শক্তিশালী নারীর চিত্র প্রক্ষেপ করতে পারে, যে, নিরন্তর রক্তপাত দাবী করে।[২৭] শিকারীদের কাছে সেই মহিলাটা নতুন প্রাণের উৎস- তাদের কারণে– খরচযোগ্য পুরুষরা না– গোত্রের অস্তিত্ব নিশ্চিত হয়। নারী এভাবেই জীবনের সম্ভ্রম উদ্রেককারী প্রতাঁকে পরিণত হয়– একটা জীবন যা পুরুষ আর পশুর বিরামহীন বলি দাবী করে।

আমাদের প্যালিওলিথিক অতীতের এসব খণ্ডিত অংশ দেখায় যে, পুরাণতত্ত্ব সর্বরোগ নিরাময়কারী, কোনো উপায় না। জীবন আর মৃত্যুর নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে এটা মানুষকে সাহায্য করে। মানুষের একটা বিয়োগান্তক অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে। স্বর্গের উচ্চতায় পৌঁছাবার জন্য তারা ব্যগ্র যদিও বুঝতে পারে যে নিজেদের নশ্বরতার মুখোমুখি হলেই কেবল সেটা সম্ভব। নিরাপদ পৃথিবী ত্যাগ করে, পাতালে অবতরণ করতে হবে এবং নিজের পুরাতন সত্তার মৃত্যু ঘটাতে হবে। পুরাণতত্ত্ব আর এর সাথে আচরিত কৃত্যানুষ্ঠান প্যালিওলিথিক পর্বের মানুষকে জীবনের একটা স্তর থেকে অন্য স্তরে নিতে সাহায্য করেছে এমনভাবে যখন মৃত্যু এসে উপস্থিত হয় তখন সেটাকে সম্পূর্ণ অজানা সত্তায় চূড়ান্ত এবং শেষ অভিমন্ত্রণ হিসাবে দেখা যায়। এই সব প্রাচীন অন্তজ্ঞান কখনও লুপ্ত হয়নি যখনই মানব ইতিহাসের পরবর্তী মহান বিবর্তনের পর্যায় শুরু হয়েছে সে তাদের পথ দেখিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *