১. পুরাণ কাকে বলবো?

১. পুরাণ কাকে বলবো?

মানব সম্প্রদায় বরাবরই মিথ (পুরাণ) নির্মাতা। প্রত্নতত্ত্ববিদের দল নিয়ানডারথাল কবর খুঁড়ে পেয়েছেন অস্ত্র, যন্ত্রপাতি আর উৎসর্গীকৃত পশুর হাড়, যা তাদের নিজেদের জগতের মতোই ভবিষ্যৎ জগতের প্রতি এক ধরনের বিশ্বাসের কথা বলে। নিয়ানডারথাল মানুষেরা হয়তো তাদের মৃত পূর্ব পুরুষেরা এখন উপভোগ করছে এমন জীবনের কথা গল্পের ছলে একে অন্যকে বলত। মৃত্যুকে নিশ্চিতরূপেই তারা এমনভাবে অভিব্যক্ত করত যা তাদের সমসাময়িক অন্যান্য প্রাণীরা সেরকমভাবে দেখত না। জীবজন্তু একে অন্যকে মারা যেতে দেখে, আমরা যতদূর জানতে পারি, ব্যাপারটা নিয়ে তারা খুব একটা ভাবিত হয় না। কিন্তু নিয়ানডারথাল কবরগুলো থেকে আমরা একটা বিষয় বুঝতে পারি যে এসব প্রাচীন মানুষ যখন তাদের নশ্বরতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে তখন তারা এক ধরনের পাল্টা আখ্যান তৈরি করে যা তাদের এই নশ্বরতার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। নিয়ানডারথাল লোকেরা যারা তাদের সঙ্গীদের এহেন যত্নের সাথে সমাধিস্থ করেছে বোঝাই যায় দৃশ্যমান বস্তুগত জগৎই যে একমাত্র বাস্তবতা না সেটা তারা কল্পনা করতে সক্ষম হয়েছিল। বহু প্রাচীন কাল থেকেই, সেজন্য এটা প্রতীয়মান হয় যে মানুষ তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার অতীত, কল্পনা করার শক্তির কারণে স্বতন্ত্র।

আমরা কার্য-কারণ সন্ধানী প্রাণী। কুকুর, আমরা যতদূর জানতে পারি, তাদের সারমেয় জন্ম নিয়ে যন্ত্রণা অনুভব করে না, বিশ্বের অন্য প্রান্তের কুকুরের দুর্দশা নিয়ে কোনো প্রকার দুশ্চিন্তায় ভোগে না বা নিজেদের জীবন কোনো ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে দেখার চেষ্টা করে না। কিন্তু মানুষ খুব সহজেই হতাশায় আক্রান্ত হয় এবং সভ্যতার শুরু থেকে আমরা গল্প তৈরি করেছি, আমাদের জীবনকে একটা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে স্থাপিত করে যা একটা মূলগত ছক উন্মোচিত করে এবং হতাশাজনক আর বিশৃঙ্খলতার প্রমাণের বিপরীতে, জীবনের মানে আর মূল্য সম্পর্কে আমাদের মাঝে একটা বোধের জন্ম দেয়।

মানুষের মনের আরেকটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো আমাদের যুক্তিগতভাবে ব্যাখ্যার অতীত ধারণা এবং অভিজ্ঞতা অনুভব করার ক্ষমতা। আমাদের কল্পনা শক্তি, এমন একটা ক্ষমতা যা তাৎক্ষণিকভাবে বর্তমান/উপস্থিত না এমন কিছু ভাবতে আমাদের সাহায্য করে এবং আমরা প্রথম যখন সেটা কল্পনা করি তা তখন বাস্তবিক অস্তিত্বহীন। এই কল্পনাশক্তিই মিথ/পুরাণ এবং ধর্মের সৃষ্টিকারী। আজকাল পৌরাণিক চিন্তা খ্যাতিহীনতার গর্ভে পতিত হয়েছে; আমরা প্রায়শই একে অযৌক্তিক এবং আত্ম-প্রশ্রয়ী অভিধা দিয়ে বাতিল করে দেই। কিন্তু কল্পনাশক্তিই আবার বিজ্ঞানীদের নতুন জ্ঞান আহরণে সাহায্য করে এবং তাদের এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়তা করে যা আমাদের দক্ষতা পক্ষান্তরে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। বিজ্ঞানীদের কল্পনাশক্তির বরাভয়ে আমরা মহাশূন্যে ভ্রমণ করে চাঁদের বুকে হাঁটতে সক্ষম হয়েছি, যা একটা সময়ে কেবল পৌরাণিক আখ্যানের অংশ ছিল। বিজ্ঞান এবং পুরাণ উভয়েই মানুষের সম্ভাবনার সীমা বৃদ্ধি করেছে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ন্যায় আমরা পরবর্তীকালে দেখব যে পুরাণও, এই পৃথিবীকে বাদ দিয়ে চিন্তা করেনি বরং এখানেই আরও সক্রিয় আরও প্রাণবন্তভাবে বাঁচতে আমাদের সহায়তা করেছে।

নিয়ানডারথাল সমাধিক্ষেত্র পুরাণের পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে। প্রথমত, বিলুপ্তির ভয় এবং মৃত্যুর অভিজ্ঞতার ভিতরেই প্রায় সবসময়েই এর মূল নিহিত থাকে। দ্বিতীয়ত, পশুর অস্থি সাক্ষ্য দেয় যে সমাধিস্থ করবার সময় পশু উৎসর্গ করা হয়েছিল। পুরাণতত্ত্বকে সাধারণত প্রথাগত অনুষ্ঠান থেকে আলাদা করা যায় না। অনেক মিথ মূলত গণপ্রার্থনা অনুষ্ঠান, যা ছাড়া তাদের প্রাণবন্ত করে তোলা সম্ভব না এবং ইহজাগতিক প্রেক্ষাপটে তাদের অর্থ অনুধাবন করা অসম্ভব। তৃতীয়ত, নিয়ানডারথাল পুরাণ সমাধি ছাড়া অন্যভাবে মানব জীবনের স্বল্পতার, তার সীমিত আয়ুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সব শক্তিশালী পুরাণই মানবিক অনুভূতির চরম মাত্রা নিয়ে; আমাদের অভিজ্ঞতার সীমা অতিক্রম করতে তারা আমাদের বাধ্য করে। একটা সময় আসে যখন আমাদের সবাইকে একভাবে না একভাবে এমন একটা স্থানে যেতে হবে যা আমরা আগে কখনও দেখিনি এবং এমন কাজ করতে হবে যা আমরা আগে কখনও করিনি। অজ্ঞাতকে নিয়েই পুরাণ; এটা এমন একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় প্রাথমিকভাবে যা বর্ণনা করবার মতো শব্দ আমাদের সঞ্চয়ে ছিল না। পুরাণ তাই চূড়ান্ত নীরবতার গভীরে উঁকি দেবার একটা প্রয়াস। চতুর্থত, পুরাণ কেবল তার খাতিরে কোনো গল্প বলা না। সে আমাদের শেখায় আমাদের আচরণ কি ধরনের হওয়া উচিত। নিয়ানডারথাল সমাধিতে, কিছু কিছু মৃতদেহ ভ্রূণের অবস্থানে সমাধিস্থ দেখা যায় যেন পূনর্জন্মের প্রতীক্ষায় রয়েছে : পরবর্তী পদক্ষেপ মৃত ব্যক্তিকে নিজে উদ্যোগী হয়ে নিতে হবে। সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলে, পুরাণতত্ত্ব, এই পৃথিবীতে বা পরবর্তী কোনো জগতে, সঠিক কাজের জন্য উপযুক্ত আত্মিক বা মানসিক মনোভাব আমাদের মাঝে আরোপ করে।

সর্বশেষ, প্রতিটি পুরাণই আমাদের নিজস্ব জগতের পাশাপাশি অবস্থিত আরেকটা প্রেক্ষাপটের কথা বলে এবং যা এক অর্থে আমাদের জগৎকে সমর্থন করে। এই অদৃশ্য কিন্তু অনেক বেশি শক্তিশালী বাস্তবতায় বিশ্বাস স্থাপন, যাকে কখনও কখনও দেবতাদের পৃথিবী বলে অভিহিত করা হয়, পুরাণতত্ত্বের মূল আঙ্গিক। অনেক সময়ে একে বারোমেসে দর্শন হিসাবে অভিহিত করা হয় কারণ আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিকতার আগমনের পূর্বে সব সমাজব্যবস্থার সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং কৃত্যানুষ্ঠান, পুরাণতত্ত্বকে অবহিত করত এবং বর্তমানেও অনেক সনাতন সমাজকে প্রভাবিত করে চলেছে। বারোমেসে দর্শন অনুসারে, এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে, সবকিছু যা আমরা এখানে দর্শন বা শ্রবণ করে থাকি, তার একটা প্রতিরূপ রয়েছে দিব্যলোকে যা আমাদের এখানের চাইতে অনেক বেশি সমৃদ্ধ, শক্তিশালী এবং অনেক বেশি স্থায়ী।[১] এবং প্রতিটি পার্থিব বাস্তবতা এর আদিরূপ, মূল ছাঁচের, জেলো সংস্করণ, ত্রুটিযুক্ত প্রতিরূপ। এই দিব্য জগতের অঙ্গীভূত হয়েই কেবল নশ্বর ভঙ্গুর মানুষ তাদের সম্ভাবনা সার্থক করে তুলতে পারে। মানুষ অন্তজ্ঞানে যা অনুভব করে পুরাণ তাকেই পরিপূর্ণ সুনির্দিষ্ট আকৃতি এবং রূপ দান করে। পুরাণ তাদের কাছে দেবতাদের আচরণ ব্যাখ্যা করে, অলস অনুসন্ধিৎসা থেকে না বা এসব আকর্ষণীয় শোনায় বলে না, যাতে এসব শক্তিশালী সত্তাকে মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে অনুকরণ করতে সক্ষম হয় এবং নিজেদের মাঝে দিব্যসত্তাকে অনুভব করতে পারে।

আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক সংস্কৃতিতে, আমরা প্রায়শই দৈবকে সাধারণ ভঙ্গিতে প্রকাশ করে থাকি। প্রাচীনকালে, ‘দেবতা’দের খুব কম সময়েই অসংলগ্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী সম্পূর্ণ ভিন্ন বিমূর্ত অস্তিত্বে বসবাসকারী অতিপ্রাকৃতিক সত্তা হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। আধুনিক মতে পুরাণতত্ত্ব ধর্মতত্ত্বের সাথে না বরং মানুষের অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত। মানুষ মনে করে যে দেবতা, মানুষ, জীবজন্তু এবং প্রকৃতি অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ, একই নিয়মের অধীন এবং একই দিব্যসত্তা থেকে উদ্ভূত। শুরুতে দেবতাদের জগৎ আর মানুষের জগতের ভিতরে কোনো ধরনের অস্তিত্বের ফারাক বিদ্যমান ছিল না। মানুষ যখন দৈবের কথা বলতো তখন যেন তারা জাগতিক পৃথিবীর একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপট নিয়েই আলোচনা করছে বলে মনে করতো। দেবতাদের অস্তিত্ব কোনো ঝড়, সাগর নদী থেকে বা মানুষের প্রচণ্ড অনভূতি- ভালোবাসা, ক্রোধ বা যৌন অনুভূতি থেকে অচ্ছেদ্য ছিল যা ক্ষণিকের জন্য যেন নারী পুরুষকে অস্তিত্বের একটা ভিন্ন স্তরে উন্নীত করতো যাতে করে জগৎকে তারা একটা ভিন্ন আঙ্গিকে দেখতে সক্ষম হয়।

পুরাণতত্ত্ব আমাদের তাই মানবজীবনের সমস্যাসঙ্কুল দশার সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো করে প্রণীত হয়েছে। মানুষকে জগতে নিজের স্থান এবং তার যথাযথ পরিচিতি খুঁজে নিতে এটা সাহায্য করে। কোথা থেকে আমরা এসেছি এটা সবাই জানতে চায় কিন্তু আমাদের শুরুটা যেহেতু প্রাকইতিহাসের কুয়াশায় হারিয়ে গেছে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে পুরাণের জন্ম দিয়েছি যা ইতিহাসনির্ভর নয় কিন্তু পরিবেশ, প্রতিবেশী এবং প্রথা সম্পর্কে আমাদের বর্তমান অভিব্যক্তি ব্যাখ্যা করে। আমরা আরও আমাদের পরিণতি সম্পর্কে জানতে চাই, তাই আমরা গল্পের অবতারণা করেছি যা মৃত্যুপরবর্তী অস্তিত্বের কথা বলে- যদিও পরবর্তীকালে আমরা দেখব, খুব বেশি পুরাণে মানুষের জন্য অমরত্বের কথা বলা হয়নি। এবং আমরা সেইসব মহিমান্বিত মুহূর্ত ব্যাখ্যা করতে চাই যখন আমরা আপাতভাবে আমাদের সাধারণ সত্তার ঊর্ধ্বে উন্নীত হই। দেবতারা মানুষের এই অভিজ্ঞতার সীমানা অতিক্রম করাকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করেন। আমাদের সহজাত অনুভূতি বারোমেসে দর্শন ব্যাখ্যা করে যে চর্মচক্ষুতে আমরা নিজেদের যে পার্থিব জগতে দেখি তার অতিরিক্ত কিছু একটা রয়েছে।

আজকাল ‘পুরাণ’ দ্বারা এমন কিছু ব্যাখ্যা করা হয় যা সত্যি হতে পারে না। পাপাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত রাজনীতিবিদ ‘মিথ’ বলে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেবেন, মানে, তেমনটা কখনও ঘটেনি। পৃথিবীর বুকে দেবতাদের হেঁটে বেড়াবার, সমাধি থেকে মৃতদের বের হয়ে আসবার বা শত্রুর হাত থেকে বাঁচবার জন্য সমুদ্র দু’ভাগ হয়ে পছন্দের লোকদের পালাবার সুযোগ করে দেয়ার কথা আমরা যখন শুনতে পাই, সাথে সাথে এসব গল্পকে অবিশ্বাস্য প্রতিপাদন করা সম্ভব না বিধায় অসত্য বলে, তাদের আমরা নাকচ করে দেই। অষ্টাদশ শতক থেকে ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের একটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে; আসলে কি ঘটেছিল সে বিষয় আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রাক-আধুনিক যুগে, মানুষ যখন অতীত সম্পর্কে কিছু লিপিবদ্ধ করত তখন তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কোনো ঘটনার আসল তাৎপর্য। পুরাণ তেমনই কোনো ঘটনা, আপাতদৃষ্টিতে যা একদা সংঘটিত হয়েছিল, কিন্তু একই সাথে যা সবসময়েই ঘটে চলেছে। ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের কঠোর কালানুক্রমিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, এ ধরনের পুনরাবৃত্তি বর্ণনা করার মতো কোনো শব্দ আমাদের সঞ্চয়ে নেই, কিন্তু পুরাণতত্ত্ব এক ধরনের শিল্পমাধ্যম, মানবঅস্তিত্বে যা কিছু ধ্রুপদী সময়ের সীমা অতিক্রম করে তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, এলোমেলো ঘটনার বিশৃঙ্খল প্রবাহের ঊর্ধ্বে উঠতে সাহায্য করে এবং বাস্তবতার মূল অংশবিশেষ আমাদের সামনে তুলে ধরে।

বোধবুদ্ধির সীমানা অতিক্রম করাটা সব সময়ে মানুষের অভিজ্ঞতার একটা অংশ। আমরা পরমানন্দের মুহূর্ত অনুসন্ধান করি যখন আমাদের অনুভূতিগুলো তীব্রভাবে আলোড়িত হয় এবং ক্ষণিকের তরে আমরা আমাদের সত্তার ঊর্ধ্বে আরোহণ করি। সেইসব মুহূর্তে, মনে হয় যেন আমরা ভীষণভাবে বেঁচে আছি এবং আমাদের মানবতার পুরোটাই যেন জেগে উঠেছে। পরমানন্দ লাভের সবচেয়ে সনাতন উপায়ের মধ্যে একটা হলো ধর্ম কিন্তু মানুষ যখন মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায় কিংবা সিনাগগে তাকে খুঁজে না পায় তারা তাকে অন্যত্র খোঁজার চেষ্টা করে : শিল্পকলা, সঙ্গীত, কবিতা, নৃত্য, মাদক, যৌনতা বা অন্য কিছু। সঙ্গীত বা কবিতার মতো, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এবং বিলুপ্তির সম্ভাবনায় আমাদের মাঝে জন্ম নেয়া হতাশা উড়িয়ে দিয়ে, পুরাণতত্ত্ব তুরীয় আনন্দ আমাদের মাঝে জাগ্রত করবে। কোনো পুরাণ যদি তা করা বন্ধ করে তবে বুঝতে হবে যে এর প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়েছে এবং পুরাণটির মৃত্যু ঘটেছে।

পুরাণকে সেজন্য চিন্তার অনুন্নত ধরন, যাকে মানুষের বিচারবুদ্ধির উন্মেষের সাথে সাথে দ্বিতীয় কাতারে সরিয়ে দেয়া যাবে এমনটা ভাবা আমাদের ভুল হবে। পুরাণতত্ত্ব ইতিহাস রচনার কোনো প্রাথমিক প্রয়াস না এবং সে এটাও দাবী করে না যে এর সমস্ত গল্পই বস্তুনিষ্ঠ ঘটনা। উপন্যাস বা নাটকের মতো পুরাণও মনগড়া; এটা একটা খেলা যা ‘যদি এমন হতো?’ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে আমাদের শোকাবহ অসম্পূর্ণ পৃথিবীকে মহিমান্বিত করে তোলে এবং নতুন সম্ভাবনার আশা জোগায় — এই একই প্রশ্ন দর্শন এবং বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের সূচনা করেছে। নিয়ানডারথাল মানুষেরা যারা তাদের মৃত সঙ্গীদের নতুন জীবনের জন্য প্রস্তুত করেছে তারাও সম্ভবত এই একই ধরনের মন-গড়া আধ্যাত্মিক খেলায় মেতেছিল, যা সব পুরাণ নির্মাতাদের মাঝে দেখতে পাওয়া যায় : “যদি এমন হয় যে এই পৃথিবীই সবকিছু না? আমাদের জীবনকে এটা কিভাবে প্রভাবিত করে- সামাজিক বাস্তবিক বা মানসিকভাবে? আমরা অন্য কিছুতে পরিণত হই? আরো সম্পূর্ণ? এবং যদি আমরা খুঁজে পাই যে আমরা আসলেই পরিবর্তিত হয়েছি তাহলে কি এটাই বোঝা যায় না যে আমাদের পৌরাণিক বিশ্বাস কোনো না কোনো ভাবে সত্যি, যে আমাদের মানবতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সে আমাদের বলতে চায়, যা যৌক্তিকভাবে আমরা হয়তোবা প্রমাণ করতে অপারগ?”

আনন্দ করার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারার কারণেই মানুষ অনন্য।[২] বন্দিত্বের কৃত্রিম পরিবেশে বসবাস করা ছাড়া, অন্যান্য প্রাণী যখন প্রকৃতির মাঝে জীবনের কঠোর বাস্তবতার সম্মুখীন হয় তখন তারা তাদের প্রাথমিক আনন্দের বোধটাই হারিয়ে ফেলে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ অবশ্য নানা সম্ভাবনা বাজিয়ে দেখা অব্যাহত রাখে এবং শিশুদের মতো আমরা আমাদের জন্য কল্পনার একটা জগৎ তৈরি করে নেই। চিত্রকলায়, যুক্তি আর কারণের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে আমরা নতুন আঙ্গিকের ধারণার জন্ম দেই যা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে এবং আমরা বিশ্বাস করি যা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ এবং চরমভাবে ‘সত্যি’ কিছু একটার কথা বলে। পুরাণ তত্ত্বেও, তেমনি, কৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে, আচরণের সাথে সংশ্লিষ্ট করে, আমাদের জীবনে এর প্রভাব বিবেচনা করে আমরা কোনো উপপ্রমেয়কে গুরুত্ব দিয়ে থাকি এবং আবিষ্কার করি যে আমাদের পৃথিবীর বিভ্রান্তিকর সব প্রশ্নের নতুন পরিজ্ঞান আমরা লাভ করেছি।

বস্তুগত তথ্য সরবরাহ করার কারণে না, কার্যকর এ কারণেই, পুরাণ সত্যি। জীবনের গভীর মানের ব্যাপারে সে যদি আমাদের নতুন পরিজ্ঞান দিতে না পারে তবে বলতে হবে পুরাণ ব্যর্থ হয়েছে। যদি এটা কাজ করে, মানে, যদি এটা আমাদের মনমানসিকতা পরিবর্তনে বাধ্য করে, আমাদের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করে এবং আমাদের আরো পূর্ণাঙ্গভাবে বাঁচতে বাধ্য করে তবে এটা একটা বৈধ পুরাণ। পুরাণতত্ত্ব আমাদের তখনই পরিবর্তিত করবে যদি আমরা এর অনুশাসন অনুসরণ করি। পুরাণ কার্যত একটা নির্দেশিকা; কি করে আরো ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায় সে কথাই সে আমাদের বলে। আমরা যদি এই অনুশাসন আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করি, একে আমাদের নিজেদের জীবনে বাস্তবতা দিতে ব্যর্থ হই তবে বোর্ড গেমের নিয়মের মতো যা অনেক সময় বিভ্রান্তিকর এবং বিরক্তিকর, সেরকম দুর্বোধ্য এবং অব্যবহৃত থেকে যাবে যতক্ষণ আমরা খেলা শুরু না করি।

পুরাণ থেকে আমাদের আধুনিকতার বিচ্যুতি অভূতপূর্ব। প্রাক-আধুনিক যুগের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল পুরাণ। মানুষকে জীবনের মানে বুঝতেই এটা কেবল তাদের সাহায্য করেনি, সেই সাথে মানব মনের এমন সব ক্ষেত্রকে উদ্ভাসিত করেছে যা হয়তো অন্যথায় অগম্যই রয়ে যেত। মনোবিদ্যার এটা একটা প্রাথমিক রূপ। দেবতা এবং বীরদের পাতালে অবতরণের গল্প, গোলকধাঁধাঁর মাঝে পথ খুঁজতে খুঁজতে অসুরের সাথে যুদ্ধ, আত্মার রহস্যময় আচরণের উপরে আলো নিক্ষেপ করে মানুষকে দেখিয়েছে কিভাবে নিজেদের মানসিক টানাপোড়েনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। ফ্রয়েড এবং জুঙ আত্মার নবীন অভিযানের রেখচিত্র প্রণয়ন আরম্ভ করার সময়ে, তারা তাদের পরিজ্ঞান ব্যাখ্যা করার জন্য সহজাতভাবেই ধ্রুপদী পুরাণতত্ত্বের দ্বারস্থ হন এবং পুরাতন পুরাণের নতুন ব্যাখ্যা দেন।

এটা নতুন কিছু না। কোনো পুরাণের একটা অনুমোদিত বা স্বীকৃত ব্যাখ্যা কখনওই থাকে না। আমাদের পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে, আমাদের গল্পগুলোও ভিন্নভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাদের মাঝে বিদ্যমান অনন্ত সত্যিকে অনুধাবনের খাতিরে। পুরাণতত্ত্বের এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে, আমরা দেখব যে সামনের দিকে মানুষ যখনই বিশাল কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে তারা তাদের পুরাণতত্ত্ব পর্যালোচনা করেছে এবং নতুন পরিস্থিতির ব্যাখ্যা তার কাছে খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সেই সাথে আমরা আরও দেখব যে মানুষের প্রকৃতি আসলে খুব একটা বদলায় নাই এবং এসব পুরাণের অনেকগুলিই, সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে কল্পিত যা আমাদের নিজেদের সমাজ থেকে খুব একটা আলাদা না, এখনও আমাদের সবচেয়ে অপরিহার্য চাহিদা আর ভয়ের কথাই বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *