৫. যুগান্তকারী পর্ব

৫. যুগান্তকারী পর্ব

(খ্রি: পূ: ৮০০ থেকে খ্রি: পূ: ২০০ )

খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতক নাগাদ, অস্থিরতা আরও ছড়িয়ে পড়ে, এবং চারটি আলাদা অঞ্চলে দৈবজ্ঞ আর ঋষিদের একটা চিত্তাকর্ষক বিন্যাস নতুন সমাধান খুঁজতে শুরু করে। জার্মান দার্শনিক জ্যাসপার এই সময়কে ‘Axial Age’ বলে অভিহিত করেছেন কারণ মানবতার আধ্যাত্মিক উন্নতিতে এই সময় নিরতিশয় গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে; এই সময়ে অর্জিত অন্তজ্ঞান আজও নারী পুরুষের আত্মিক পুষ্টি সাধন করছে।[৬৭] আমরা আজ ধর্ম বলতে যা বুঝি এসব ছিল তারই সূচনাপর্ব। মানুষ নিজেদের প্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠে এবং নিজেদের পরিস্থিতি আর সীমাবদ্ধতা নজিরবিহীন স্পষ্টতায় বুঝতে পারে। নতুন ধর্মীয় আর দার্শনিক পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটে : চীনে কুনফুসিয়ানিজম আর তাওবাদ; ভারতবর্ষে বৌদ্ধ আর হিন্দু ধর্ম; মধ্যপ্রাচ্যে একেশ্বরবাদ এবং ইউরোপে গ্রীক যুক্তিবাদ। সপ্তম, অষ্টম আর ষষ্ঠ শতকের মহান হিব্রু দৈবজ্ঞদের মতো মানুষ এসব যুগান্তকারী প্রথার সাথে যুক্ত ছিলেন; উপনিষদের ঋষিমণ্ডলী আর বুদ্ধদেব (খ্রি: পূ: ৫৬৩-৪৮৩) ভারতবর্ষে; চীনের কনফুসিয়াস এবং ডাও ডে জিঙের;[৬৮] এবং গ্রীসের সক্রেটিস (খ্রি: পূ: ৪৬৯-৩৯৯), প্লাটো (খ্রি: পূ: ৪২৭- ৩৪৭) এবং এরিস্টটলের (খ্রি: পূ: ৩৮৪-৩২২) মতো পঞ্চম শতকের ট্র্যাজেডি লেখকবর্গের কথাও উল্লেখযোগ্য।

যুগান্তকারী এই সময়ের অনেক কিছুই এখনও রহস্যাবৃত। আমরা জানি না ভারতীয়, চৈনিক, গ্রীক আর ইহুদিরাই কেন এর সাথে সংযুক্ত হয়েছিল এবং কেনইবা এর সাথে তুলনীয় কোনো কিছুর পারস্য বা মিশরে উদ্ভব ঘটেনি। একটা বিষয় অবশ্যই সত্যি যে এসব অ্যাক্সিয়াল অঞ্চলসমূহ রাজনৈতিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের ভিতরে পতিত হয়েছিল। যুদ্ধ, নির্বাসন, গণহত্যা আর শহরের বিনাশ ঘটেছিল এখানে। একটা নতুন বাজার অর্থনীতিও ক্রমশ গড়ে উঠছিলো; রাজা আর পুরোহিতদের কাছ থেকে ক্ষমতা ক্রমশ বণিকদের হাতে কুক্ষিগত হচ্ছিল আর এর ফলে পুরাতন সামাজিক কাঠামোতে একটা টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল। প্রত্যন্ত মরুভূমি বা পাহাড়ের নিরালা গুহায় এসব নতুন বিশ্বাসের জন্ম হয়নি, বরং পুঁজিবাদ আর স্বচ্ছলতার বাতাবরণে তাদের আত্মপ্রকাশ। কিন্তু এসব অভ্যুত্থান যুগান্তকারী অ্যাক্সিয়াল বিপ্লবকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারে না, যা মানুষ পরস্পরের সাথে, নিজের সাথে এবং তার চারপাশের পৃথিবীর সাথে যেভাবে জড়িত, তাতে একটা অনপনেয় ছাপ ফেলেছে।

সব যুগান্তকারী অ্যাক্সিয়াল আন্দোলনের অপরিহার্য উপাদানগুলো একই ধরনের। তারা মানুষের দুর্ভোগ যাকে মানুষের পরিস্থিতির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করা হতো সে সম্পর্কে ভীষণমাত্রায় সচেতন এবং সবাই আরো বেশি মাত্রায় আধ্যাত্মিক ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন যা কেবল বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান এবং পূজা অর্চনার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ব্যক্তিগত চেতনা আর নৈতিকতা সম্পর্কে তাদের একটা নতুন ভাবনা ছিল। তাছাড়া প্রথাগত কৃত্যানুষ্ঠান যথাযথভাবে পালন করাটাই যথেষ্ট না; ভক্ত অনুরাগী ব্যক্তিকে অবশ্যই তাদের সাথে বসবাসরত অন্য মানুষদের সাথে ভক্তিসহকারে আচরণ করতে হবে। তাদের সময়ের হিংস্র আচরণ সব ঋষিরাই বর্জন করেছিলেন এবং ন্যায়বিচার আর করুণাময় নীতিকথা প্রচার করেছেন। তারা তাদের শিষ্যদের শিখিয়েছেন সত্যের জন্য নিজের ভিতরে অনুসন্ধান করতে এবং পুরোহিত আর অন্যান্য ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের শিক্ষার উপর নির্ভর না করার জন্য। বিশ্বাস করে কোনো কিছু গ্রহণ করলে চলবে না, সবকিছুকে প্রশ্ন করতে হবে এবং পুরাতন মূল্যবোধ যাকে মেনে নেয়া হয়েছে তাকে সমালোচকের দৃষ্টিতে নিরীক্ষা করতে হবে। আর একটা ক্ষেত্র যার পূর্ণ মূল্যায়ন প্রয়োজন সেটা হলো অবশ্যই পুরাণতত্ত্ব।

প্রাচীন পুরাণ বিবেচনাকালে, প্রতিটা যুগান্তকারী আন্দোলন সামান্য ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে। কেউ আবার নির্দিষ্ট পৌরাণিক ধারার প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করে; অন্যেরা Laissez-faire হস্তক্ষেপ না করার রীতি গ্রহণ করে। সবাই নিজ নিজ পুরাণের নৈতিক ব্যাখ্যা আর ভিতরের বিন্যাস নতুন করে সাজায়। শহুরে জীবনের অভ্যাগমের মানে একটাই পুরাণগুলোকে কেউ আর কোনো প্রশ্ন না করে মেনে নেবে না। মানুষ সমালোচকের দৃষ্টিতে এগুলোকে বিশ্লেষণ করা অব্যাহত রাখে কিন্তু তারা যখন আত্মার রহস্যের সম্মুখীন হয়, তারা দেখে যে সহজাত প্রবৃত্তির বলে তারা পুরাতন পুরাণেরই দ্বারস্থ হচ্ছে। গল্পগুলোকে হয়তো নতুন করে লিখতে হবে, কিন্তু এখনও তাদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায়। যদি কোনো পুরাণ কোনো কঠোর সংস্কারকের দ্বারা উদ্‌বাসিত হয়, কখনও কখনও সামান্য ভিন্ন আঙ্গিকে পরবর্তী সময়ে সে আবার মূল ধারায় ফিরে এসেছে। এমনকি এই পরিশীলিত ধর্মীয় ব্যবস্থায়, মানুষ দেখে যে পুরাণ ব্যতীত কোনো কিছু করতে তারা অপারগ।

কিন্তু পূর্বপুরুষের ন্যায় মানুষ এখন আর সহজেই দিব্য অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে না। প্রাচীন কিছু কিছু শহুরে-বাসিন্দাদের চেতনা থেকে দেবতারা ইতিমধ্যেই বিদায় নিতে শুরু করেছে। অ্যাক্সিয়াল রাষ্ট্রে বসবাসকারীরা এখনও সর্বব্যাপী অভিজ্ঞতা লাভের জন্য আকুল, কিন্তু দিব্য এখন যেন বহুদূরের বস্তু এবং কখনও হয়তোবা ভিনগ্রহের বাসিন্দা। মরণশীল মানুষ আর তাদের দেবতাদের মাঝে এক যোজন ব্যবধান। সেই একই প্রকৃতিতে তারা আর সহাবস্থান করে না; এটা এখন বিশ্বাস করা কঠিন যে দেবতা আর মানুষ একই ঐশ্বরিক উপাদান থেকে সৃষ্ট। প্রাচীন হিব্রু পুরাণে এমন একজন দেবতার কথা কল্পনা করা হয়েছিল যিনি খেতে পারেন এবং বন্ধুর ন্যায় আব্রাহামের সাথে কথোপকথন চালিয়ে যেতে সক্ষম।[৬৯] কিন্তু অ্যাক্সিয়াল যুগের পয়গম্বরের দল যখন এই একই দেবতার মুখোমুখি হন, তার কারণে একটা ভীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় তারা, যা তাদের জীবনকে বিপর্যস্ত করে বা বিস্মিত বিপর্যস্ত অনুভূতি তাদের মাঝে রেখে যায়।[৭০] পরম বাস্তবতার মাঝে লীন হওয়াটা এখন অসম্ভব রকমের কঠিন মনে হয়। ভারতবর্ষে, বৌদ্ধরা অনুভব করে যে নির্বাণের দিব্য শান্তির জগতে তারা প্রবেশ করতে পারবে কেবল তাদের সাধারণ চেতনার প্রতি যোগাসনের মাধ্যমে ব্যাপক আক্রমণ শাণিত করে যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে, আবার জৈনরা এমন কঠিন তপশ্চর‍্যা করে যে কেউ কেউ অনাহারের কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। চীনে, কনফুসিয়াস বিশ্বাস করতেন যে, ডাও, পরম বাস্তবতা, মানুষের পৃথিবী থেকে এতটাই আলাদা যে সে সম্পর্কে কথা না বলাই ভালো।[৭১] মৌলিকভাবে পৃথক এসব ধর্মীয় অভিজ্ঞতার মানে এই যে পুরাণ তার সেই প্রাচীন দেবতাদের সাথে তুলনীয় anthropomorphic উপায়ে দিব্য সম্পর্কে আলোচনা করতে পারছে না।

আমাদের আলোচনায় আমরা চীনকে খুব বেশি প্রাধান্য দেইনি কারণ চীনারা তাদের উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতিতে দেবতাদের সম্পর্কে কোনো গল্প বয়ান করে না। ঐশ্বরিক যুদ্ধের কোনো গল্প সেখানে নেই, নেই মৃতাপন্ন দেবতা বা পবিত্র বন্ধন বা বিয়ে; কোনো স্বীকৃত দেবতামণ্ডলী নেই, নেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির গল্প বা মানুষের সাথে তুলনীয় দেবতার দল। তাদের শহরগুলোর কোনো পৃষ্ঠপোষক দেবতা থাকত না বা কোনো প্রকার শহুরে প্রার্থনার প্রথা। তার মানে এই না যে চৈনিক সমাজের কোনো পৌরাণিক ভিত্তি নেই। পূর্বপুরুষরা আরাধনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা এমন একটা পৃথিবীর দিকে ইশারা করে যা মানুষের পৃথিবীর চাইতে অনেক পুরাতন। মৃত আত্মীয়স্বজনের আচারঅনুষ্ঠান চাইনিজদের সামাজিক শৃঙ্খলার আদর্শায়িত প্রতিরূপ সরবরাহ করত যা পরিবার হিসাবে কল্পনা করা হয় এবং শিষ্টতার নীতি দ্বারা পরিচালিত হতো। নদী, তারা, বাতাস, আর শস্যাদি সবার মাঝেই আত্মা রয়েছে যা আকাশ দেবতা, ডি (পরবর্তীকালে তিয়েন। ‘স্বর্গ’ বলা হয়) এর অধীনে একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। অন্যান্য আকাশ দেবতাদের ন্যায় চৈনিক আকাশ দেবতা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়নি। শান্ রাজবংশের সময়ে সে আরও জোরালো হয়ে উঠে (খ্রি: পূ: ১৭৬৬-খ্রি: পূ: ১১২২)। রাজার বৈধতা নির্ণয় করতে গিয়ে বলা হতো যে কেবল রাজা একাই ডি / তিয়েন এর সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং বারোমেসে দর্শনের নীতি অনুসারে সে ঈশ্বরের পার্থিব প্রতিরূপ- ১৯১১ সালের বিপ্লবের আগ পর্যন্ত চীনা সংস্কৃতিতে এই পুরাণ টিকে ছিল। পার্থিব প্রশাসন স্বর্গীয় ব্যবস্থার অনুরূপ; রাজাকে তার মন্ত্রীরা সাহায্য করে ঠিক যেমন তিয়েনকে ব্রহ্মাণ্ড পরিচালনায় অনুষঙ্গের দেবতারা সাহায্য করে থাকে।

চাইনিজরা বোধহয় অন্যান্য সংস্কৃতির চেয়ে আগে অ্যাক্সিয়াল মূল্যবোধের দিকে হাতড়ে হাতড়ে পথ চিনে এগিয়ে গিয়েছে। খ্রি: পূ: ১১২৬ সালে উই নদীর অববাহিকার লোকেরা বর্তমানে চীনের সেনসি প্রদেশ, শান বংশকে উৎখাত করে জোউ বংশের অভিষেক ঘটায়। জোউ দাবী করে যে শান বংশের শেষ রাজা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল এবং মানুষের দুর্দশার কথা বিবেচনা করে তিয়েন তার ম্যাণ্ডেট জোউকে দিয়েছে– এ পুরাণে তিয়েন নীতিবাদী চরিত্রে অভিষিক্ত। ব্যাপক উৎসব আর শ্রুতিমধুর বাদ্যের সহযোগে স্বর্গের এই আদেশ জোউ উদ্‌যাপিত করে। এই বিধানকে সামাজিক সম্প্রীতির আগমনী হিসাবে দেখা হয় যা কিনা নিজেই ঐশ্বরিক। সব অংশগ্রহণকারীকে জীবিত বা মৃত, এসব অনুষ্ঠান মেনে চলতে হবে। সব অস্তিত্ব– সত্তা, পূর্বপুরুষ, এবং মানুষ– তাদের বিশেষ স্থান রয়েছে, সবাইকে নিজ নিজ পছন্দ অপছন্দকে এবং আচার অনুষ্ঠানের প্রতি ব্যক্তিগত প্রবণতা দমন করতে হবে যা বিশ্বের আদর্শ বিন্যাসকে মানুষের ত্রুটিযুক্ত পৃথিবীতে একটা বাস্তবতার রূপ দিয়েছে। আচার অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ এতে অংশগ্রহণকারীরা নয়; ব্যক্তি মানুষ অনুভব করে পবিত্র জগতের সাথে তারা লীন হয়ে পড়ছে যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আর তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি।

কনফুসিয়াসের সময় নাগাদ অবশ্য, জোউ রাজত্ব ভঙ্গুর হয়ে এসেছিল এবং পুরাতন প্রথা ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। আচার অনুষ্ঠানের প্রতি অনীহাই এর কারণ বলে প্রচার করেন কনফুসিয়াস এবং আচরণের (লি) বিধিবদ্ধ নিয়ম গ্রহণ করেন যা মানুষকে শিখাবে তাদের একে অন্যের প্রতি আচরণ কি ধরনের হওয়া উচিত। এখন মানুষ ভব্যতা জলাঞ্জলি দিয়ে স্বার্থপরের মতো কেবল নিজের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছে। কিছু কিছু পুরান পুরাণে উল্লেখ ছিল যে ব্যাক্তিগত আত্মোৎসর্গের উপরে সৃষ্টিশীলতা নির্ভরশীল কিন্তু যুগান্তকারী পর্বের ঋষিরা নৈতিক বোধের এই অন্তজ্ঞানকে সুনির্দিষ্ট করে তোলেন। প্রত্যেককে প্রাত্যহিক জীবনে এই আত্মাহুতির অনুশীলন করতে হবে যারা নিজের মানবতাকে নিখুঁত করার ইচ্ছা রাখে।[৭২] কনফুসিয়াস পুরাতন চৈনিক মূল্যবোধের সাথে এই যুগান্তকারী করুণানিধির সংমিশ্রণ ঘটান। তিনি রেন (সহৃদয়তা) এর আদর্শ প্রচার করেন যা দাবী করে মানুষ ‘অপর মানুষ’কে ভালোবাসবে।[৭৩] সোনালী আইনের তিনিই প্রথম প্রচারক : ‘তুমি যেমন নিজের ক্ষতি করবে না তেমনি অপরের ক্ষতি করতে যেও না’।[৭৪] আত্মনিরীক্ষা আর মনের অভিব্যক্তি অ্যাক্সিয়াল সত্তা দাবী করে নিজের গোপন লুকানো মানসিকতার ইচ্ছাকৃত বিশ্লেষণের জন্য। নিজের চাহিদা প্রথমে বিশ্লেষণ না করে অন্যের সাথে ন্যায্য আচরণ কেউ করতে পারবে না; অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন হলো শু (নিজেকে পছন্দ করা)র একটা প্রক্রিয়া।[৭৫]

কিন্তু কনফুসিয়াস বুঝতে পেরেছিলেন কেবল যৌক্তিক অভিব্যক্তি বা সদিচ্ছা দ্বারা এটা সম্ভব না। সঙ্গীত আর আচারঅনুষ্ঠানের মিলিত রসায়নের মাধ্যমে স্বার্থপরতার চরম বিলুপ্তি অর্জন করা সম্ভব যা অন্যসব মহান কলার ন্যায় মানুষকে এমন একটা পর্যায়ে উন্নীত করে যা অনুভূতির চাইতে গভীর।[৭৬] অবশ্য কেবল আচারঅনুষ্ঠানে যোগ দেয়াটাই যথেষ্ট না : এর পেছনের উদ্দেশ্যটা বোঝা জরুরী যা অপরের প্রতি ‘আনত’ (রাঙ) অভিব্যক্তি হৃদয়ে প্রোথিত করবে অহংকার ঈর্ষা এবং ক্ষোভকে অতিক্রম করতে সহায়তা করে।[৭৭] অন্যান্য সদস্যদের প্রতি মাথা নত করে, কৃত্যানুষ্ঠানের দাবী মেনে নিয়ে এবং যখন প্রয়োজন তখন অন্যকে নেতৃত্বের সুযোগ দান করে ভক্তের দল- এসবই হবে মহিমাময় সঙ্গীতের সঙ্গতে- তাদের প্রতিবেশী অন্য মানুষের সাথে কি ধরনের আচরণ ও সম্পর্ক সাধারণ পরিস্থিতিতে বজায় রাখতে হবে সেটার শিক্ষা নেয়। অতীতের আদর্শ ব্যবস্থার দিকে কনফুসিয়াস ফিরে তাকান। দেবতাদের সম্পর্কে কোনো গল্প চীনাদের ভিতরে প্রচলিত নেই কিন্তু বীরদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের, যারা বস্তুতপক্ষে পৌরাণিক চরিত্র কিন্তু তাদের ঐতিহাসিক বলে মনে করা হতো, প্রথা চীনাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল। সুদূর অতীতকালের পাঁচ ঋষি রাজার মাঝ থেকে দুজন ছিল কনফুসিয়াসের বিশেষ বীর চরিত্র। প্রথম জনের নাম ইয়াও যে চীনাদের সঙ্গীত আর আচার অনুষ্ঠানের যথাযথ ব্যবহারই কেবল শেখাননি সেই সাথে রাঙের গুণাবলী তাদের সামনে প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু তিনি নিজের পাঁচ ছেলের কাউকেই যোগ্য না মনে করায় সৎ চাষী শানকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে পছন্দ করেন। শানও অসাধারণ নিঃস্বার্থতার পরিচয় দেয়, তার আপন ভাইয়েরা আর বাবা তাকে হত্যার চেষ্টা করলেও তাদের প্রতি তার ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ থাকে এবং তাদের প্রাপ্য সম্মান থেকে তাদের বঞ্চিত করে না।

কিন্তু কনফুসিয়াসের কাছে, আচার অনুষ্ঠানের গুরুত্ব যথাযথভাবে অনুধাবন করাটা এসব পৌরাণিক গল্পের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বৈদিক ভারতে একই অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়, সেখানে দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গিত বলীর আচার অনুষ্ঠান মূল উদ্দেশ্যকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল। ধর্মীয় চেতনা থেকে ধীরে ধীরে দেবতারা সরে যায় এবং খ্রিঃ পূঃ অষ্টম শতকের আচার অনুষ্ঠান সংস্কারকের দল নতুন প্রথা প্রবর্তন করে যেখানে ব্যক্তি একককে প্রাধান্য দেয়া হয়। সে কারণে মানুষ সাহায্যের জন্য দেবতাদের উপরে নির্ভর করতে পারে না, আচারের ক্ষেত্রে তাদের একটা আদর্শায়িত পৃথিবী সৃষ্টি করতে হবে নিজেদের জন্য। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অর্জিত ক্ষমতার যাকে ব্রাহ্মণ বলা হয়, অভিজ্ঞতা এতটাই ব্যাপক যে মনে করা হতে থাকে যে দেবতার পরে পরম বাস্তবতার অবস্থান এবং সেটাই জগতের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। আজও, ধর্মীয় উৎসব তুরীয় আনন্দ সৃষ্টি করতে সক্ষম তারা যাকে বলে অন্য মানস যা সাধারণ লোকায়ত চেতনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিধিবদ্ধ প্রথার প্রতি চীন আর ভারতবর্ষের গুরুত্ব আরোপ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে পুরাণকে তার প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা করে দেখাটা ঠিক না। পুরাণ এবং আচরিত অনুষ্ঠান সমান সমান অংশীদার, উভয়েই পবিত্রতার একটা অনুভূতি ছড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে এবং সাধারণত একই সাথে সেটা করে থাকে তবে কখনও কখনও অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যকে অতিক্রম করে যায়।

যুগান্তকারী ঋষিরা সবাই অবশ্য তৃতীয় আরেকটা উপাদানের কথা বলেছেন। পুরাণের আসল মানে বুঝতে হলে, কেবল আচারগুলো পালন করলেই চলবে না বা একে একটা আবেগঘন অনুরণন দান করে লাভ হবে না, সেইসাথে সঠিক নৈতিক আচরণও জরুরী। কনফুসিয়াস যাকে রেন, রাঙ আর শু বলেছেন সেটা যতক্ষণ পর্যন্ত কারো প্রাত্যহিক জীবনে আচরিত না হবে ইয়াও বা শানের মতো পুরাণ ততক্ষণ পর্যন্ত বিমূর্ত অধরা রয়ে যাবে। বৈদিক ভারতে, আচার অনুষ্ঠানকে বলা হতো ‘কর্ম’।[৭৮] বুদ্ধের অবশ্য এধরনের উৎসর্গমূলক আচারে কোনো বিশ্বাস ছিল না। তিনি কর্মের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন আমাদের সাধারণ প্রতিক্রিয়াকে প্রেরণা দান করে যে ইচ্ছা সেটাই কর্ম। আমাদের প্রেষণা হলো অন্তরের কর্ম, মানসিক কর্ম আচারানুষ্ঠান পালনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বাহ্যিক কর্মের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাক্সিয়াল পর্বের এই সময়কাল বিশেষভাবে বৈপ্লবিক, যা নৈতিকতা এবং পুরাণ উভয়ের বোঝাপড়া আত্তীকরণে সাহায্য করে। পুরাণ সবসময়ে কর্ম দাবী করে। বৈপ্লবিক যুগের ঋষিরা বোঝাতে চেয়েছেন যে পুরাণের মূল অর্থ আমাদের সামনে প্রতিভাত হবে না যতক্ষণ না প্রাত্যহিক জীবনে ন্যায়বিচার এবং অপরের প্রতি সমবেদনা প্রকাশের চর্চা আয়ত্তে না আসবে।

ডাও ডে জিঙের খ্রি: পূ: তৃতীয় শতকের লেখক, সনাতনভাবে তাকে লাওজি বলা হয়, প্রথাগত আচারঅনুষ্ঠানকে তিনিও বিরূপ দৃষ্টিতেই দেখছেন। লি’র পরিবর্তে তিনি মনঃসংযোগের অভ্যাসের উপর জোর দিয়েছেন যা অনেকটা ভারতীয় যোগব্যায়ামের মতো। তার স্থির বিশ্বাস ছিল, সভ্যতা একটা বিরাট ভুল, যা মানুষকে সত্যের পথ (ডাও) থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কৃষিজীবী সরলতার সোনালী দিনের দিকে পেছন ফিরে তাকান লাওজি, যখন মানুষ ছোট ছোট গ্রামে বাস করত, কোনো প্রযুক্তি ছিল না, ছিল না শিল্পকলা বা সংস্কৃতি, যুদ্ধও ছিল না।[৭৯] শেননঙ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর সাথে সাথে এই সোনালী দিনের যুগ শেষ হয়েছে বলে চীনারা বিশ্বাস করত, যিনি, নিজে অমানবিক পরিশ্রম করে মানুষকে কৃষিকাজ শিখিয়েছিল। শেননঙ সব উদ্ভিদ খেয়ে দেখেছে কেবল জানতে যে কোনটা সহজপাচ্য এবং সেটা করতে গিয়ে একবার একদিনে সত্তর বার বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছিল। খ্রিঃ পূঃ তৃতীয় শতক নাগাদ, যখন শক্তিশালী রাজারা ছোট ছোট রাজ্য আর গ্রাম একের পর এক বিধ্বংসী যুদ্ধে জয় করে নিচ্ছে তখন শেননঙের পুরাণ ভাষ্য বদলে যায়। তখন তাকে আদর্শ শাসক হিসাবে অভিহিত করা শুরু হয়। বলা হতে থাকে, একটা সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্য তিনি শাসন করেছেন, যেখানে প্রজাদের পাশে মাঠে লাঙল চষেছেন, এবং কোনো মন্ত্রী বা আইন আর শাস্তির ভয় ব্যতীত তিনি শাসন কাজ পরিচালনা করেছেন। আদর্শবাদী তপস্বীর দল শেন নঙের আদর্শ পুনরায় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সামাজিক জীবন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় এবং ডাও ডে জিঙ যা ছোটখাটো রাজ্যের নৃপতির উদ্দেশে লিখিত সেখানেও একই উপদেশ দেখা যায়। পিছু হটে আসাই উত্তম, অনাড়ম্বর জীবনযাপন কর এবং কুটোটিও নাড়িও না যতক্ষণ না মহান শক্তিগুলো উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে নিজেদের ধ্বংস না করছে।

কিন্তু অন্য সব যুগান্তকারী শিক্ষকের ন্যায়, লাওজি কেবল বেঁচে থাকার বাস্তবতা নিয়ে উদগ্রীব ছিলেন না, কিন্তু পৃথিবীর উত্থানপতনের মাঝে একটা সর্বব্যাপী শান্তির উৎস খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন। পরম বাস্তবতার অভিকাঙ্ক্ষী হন তিনি, ডাও, যার ব্যাপ্তি দেবতাদেরও ছাড়িয়ে যায় এবং যা সব অস্তিত্বের অবর্ণনীয় ভিত্তি। আমরা যা কিছু ধারণা করতে পারি এটা তার সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় এবং তারপরেও যদি আমরা আমাদের ভিতরে একটা শূন্যতার চাষ করি, কোনো ধরনের স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা এবং লোভ ছাড়া সমবেদী জীবনযাপন করি তাহলে আমরা ডাও আত্মস্থ করতে পারব এবং এভাবেই রূপান্তর ঘটবে। আমরা যখন সভ্যতার লক্ষ্য কেন্দ্রিক মূল্যবোধ পরিত্যাগ করবো কেবল তখনই আমরা জীবন যেমন হওয়া উচিত তার সাথে খাপ খাওয়াতে পারবো।[৮০] আবার লাওজি যেমন শেননঙের পৌরাণিক সোনালী দিন কামনা করছেন আদর্শ রাষ্ট্র ব্যবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে, তিনি সনাতন পুরাণের কাছেও আবেদন জানান (যা হয়তো এখনও বর্তমান সংস্কৃতিতে জনপ্রিয়) ডাওকে জাগ্রত করতে। ডাও হলো জীবনের উৎস, নিখুঁত পূর্বপুরুষ এবং একই সাথে মা। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ মহান মাতাকে দেখতো চণ্ড এবং রুদ্ররূপে কিন্তু নতুন যুগান্তকারী সত্তা, লাওজি তার চরিত্রে করুণার গুণাবলী আরোপ করেন। তাকে নিঃস্বার্থপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয় যা সত্যিকারের সৃষ্টিশীলতা থেকে অচ্ছেদ্য।[৮১] প্রাগৈতিহাসিক নারী ও পুরুষ ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে মাতৃজঠরে ফিরে যাবার অভিনয় করেছে কখনও কখনও, সভ্য মানুষ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়মের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে সেই একই ফিরে যাওয়া মূর্ত করে তুলতে চেয়েছে।

লাওজি আর বুদ্ধদেব দুজনেই পুরাতন পুরাণগুলো লোকদের নতুন ধারণা বোঝাবার কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। পশু উৎসর্গ করা কেবল অর্থহীনই না নিষ্ঠুর বলেও বিশ্বাস করতেন এবং বুদ্ধ সনাতন বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের নির্মম সমালোচনা করেছেন যদিও সনাতন পুরাণের ব্যাপারে তিনি সহনশীল ছিলেন। দেবতাদের উপযোগিতা অবশিষ্ট আছে বলে তিনি মোটেই বিশ্বাস করতেন না এবং নিরবে তাদের একপাশে সরিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি দেবতাদের একটা নতুন প্রতীকী গুরুত্ব দান করেছেন। তার জীবনের কিছু কিছু গল্পে, দেবতাদের রাজা ব্রহ্মা বা মৃত্যুর দেবতা মরা, তার নিজের মনের অবস্থার প্রতিফলন ঘটিয়েছে বলে মনে হয় বা মানসিক শক্তির টানাপোড়েনে ব্যক্তিরূপ আরোপিত হয়েছে।[৮২]

কিন্তু ইসরাইলের পয়গম্বরেরা এমন নমনীয় মনোভাব দেখাননি। যুগান্তকারী সংস্কারের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ যা কিছুই তারা দেখেছেন পুরান পুরাণে তাকে নাকচ করতে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। কয়েক শতাব্দী যাবৎ ইসরালাইটসরা, নিকট প্রাচ্যের আচার অনুষ্ঠান আর পৌরাণিক জীবনযাপন করছিল আশেরাহ্ রাআল, এবং ইশতার সাথে সাথে নিজস্ব দেবতা ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌-এর অর্চনা করে। কিন্তু এখন ইয়াওয়েকে দূরাগত স্মৃতি মনে হতে থাকলে, হোসা, জেরেমিয়াহ্ এবং এজিকিয়েলের ন্যায় পয়গম্বরের দল, দেবতাদের লক্ষণযুক্ত পুরাতন পুরাণসমূহের মৌলিক সংশোধনের কাজ হাতে নেন। পুরাতন কাহিনীগুলোকে মূল্যহীন মনে হওয়ায় তারা এসবকে মিথ্যে বলে ঘোষণা করেন। তাদের দেবতা ইয়াওয়ে যার মহান ব্যাপ্তির কাছে এসব পুরাতন গল্পের অসারত্ব প্রমাণিত হয়েছে বিধায় সেই একমাত্র দেবতা। পুরাতন ধর্মের বিরুদ্ধে তারা বিপ্রতিপত্তিক অবস্থান গ্রহণ করেন। ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌কে, দিব্য সঙ্ঘের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য মরিয়া এমনভাবে চিত্রিত করা হয়, কারণ দেখানো হয় তার সমকক্ষ অন্য দেবতারা করুণা এবং ন্যায়বিচারের অ্যাক্সিয়াল গুণাবলী অবহেলা করেছে এবং সে কারণে তাদের মরণশীল মানুষের ন্যায় মৃত্যু হবে।[৮৩] স্থানীয় পৌত্তলিক দলগুলোকে জওয়া, ডেভিড এবং রাজা জোশিয়ার ন্যায় সাংস্কৃতিক বীরের দল প্রবলভাবে দমন করেন,[৮৪] এবং বাআল আর মারডুকের মূর্তিগুলোকে মানুষের তৈরি বলে উপহাস করা হয় যা ছিল পুরো সোনা আর রূপা নির্মিত এবং কয়েক ঘণ্টার ভিতরে শ্রমিকের দল তাদের গুঁড়িয়ে দেয়।[৮৫]

এটা অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের পৌত্তলিকতার একটা সরল উপস্থাপনা। কিন্তু ধর্মের ইতিহাস থেকে আমরা দেখি যে, একবার যদি কোনো পুরাণ মানুষের মাঝে ব্যাপ্তির অনুভূতি আরোপ করতে ব্যর্থ হয়, সেটা তখন ঘৃণিত বলে বিবেচিত হতে থাকে। একেশ্বরবাদ, কেবল একমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস, এর শুরুটা ছিল সংগ্রামমুখর। ইসরালাইটসদের অনেকে এখনও পুরাতন পুরাণসমূহের প্রতি টান অনুভব করেন এবং এটা কাটাতে তাদের রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় নিজের সাথে। তারা মনে করে প্রতিবেশীদের পৌরাণিক জগৎ থেকে তাদের জোর করে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এবং তারা বহিরাগতে পরিণত হয়েছেন। জেরেমিয়া দুর্দশার সময় আমরা এর রেশ বেশ অনুভব করতে পারি, যিনি ঈশ্বরকে ব্যথার মতো অনুভব করেছিল যা তার পুরা দেহকে কাঁপিয়ে ছেড়েছে, বা এজিকিয়েলের অদ্ভুত পেশা, যার জীবন ধারাবাহিকতা হীনতার মৌলিক স্মারকে পরিণত হয়েছে। ঈশ্বর এজিকিয়েলকে আদেশ করেছিলেন পশুবিষ্ঠা ভক্ষণ করতে; মৃত স্ত্রীর জন্য শোক প্রকাশ করতে তাকে বাধা দেয়া হয়েছিল। ভয়ংকর অনিয়ন্ত্রিত কাঁপুনি সে অতিক্রম করেছে। যুগান্তকারী পয়গম্বরের দল অনুভব করেছিলেন যে, তারা মানুষকে একটা অজানা জগতে নিয়ে চলেছে যেখানে কোনো কিছুই নিশ্চিত না এবং স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কোনো অবকাশ নেই।

কিন্তু একটা সময় পরে এই দুর্দশা প্রশান্ত আত্মবিশ্বাসে পরিণত হয় এবং আমরা এখন যাকে ইহুদি ধর্ম বলি সেটার জন্ম হয়। বিড়ম্বনা হলো এক বিশাল দুর্যোগের পরেই কেবল এই নতুন আত্ম-প্রত্যয়ের জন্ম হয়। ৫৮৬ সালে ব্যাবিলনের রাজা নেবুকাডনেজার জেরুজালেম শহর দখল করেন, এবং ইয়াওয়ের মন্দির গুঁড়িয়ে দেন, অধিকাংশ ইসরালাইটসকে ব্যাবিলোনিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হয়, নির্বাসিতেরা সেখানে বিশালাকার মিনারযুক্ত মন্দিরের মুখোমুখি হয় এবং শহরের সমৃদ্ধ বিধিবদ্ধ জীবন প্রথমবারের মতো দেখে আর দেখে ইসাগলিয়ার বিশাল মন্দির। কিন্তু পৌত্তলিকতা এখানেই তার আকর্ষণ হারায়। জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ে আমরা এই নতুন সত্তাকে দেখি, সম্ভবত তথাকথিত ঋষিদের কোনো সদস্যের লেখা, যা পুরাতন যুধ্যমান সৃষ্টি এবং বিবর্তন তত্ত্বের বিপরীতে একটা শান্ত, সমাহিত বিসংবাদ। সুস্থির শ্রেণীবদ্ধ গদ্যে, এই নতুন সৃষ্টি পুরাণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ব্যাবিলোনীয় সৃষ্টি তত্ত্বকে প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করায়। মারডুকের ন্যায়, ইসরাইলের ঈশ্বরকে পৃথিবী সৃষ্টির জন্য বেপরোয়াভাবে লড়াই করতে হয়নি; অনায়াসে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন কেবল একটা আদেশের মাধ্যমে। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা কেউই আর ইয়াওয়ে প্রতি বিরূপ মনোভাবপূর্ণ দেবতা নন। তারা তার অধীন এবং কেবলমাত্র ব্যবহারিক কারণে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তিয়ামাত কোনো সমুদ্রদানব না কিন্তু ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং তার আজ্ঞাধীন। মারডুকের তুলনায় ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌র সৃষ্টি এতটাই মহিমান্বিত যে তাকে আর দ্বিতীয়বার কিছু করতে হয়নি বা কোনো পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন পড়েনি। বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে ব্যাবিলনের দেবতারা যখন যুদ্ধে রত এবং নবান্নের আচার অনুষ্ঠান জরুরী হয়ে পড়েছে তাদের শক্তি উজ্জীবিত করতে সেখানে ইয়াহ্‌ওয়েহ্‌ তার কাজ শেষ করে সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিতে পারেন।

ইসরালইটসরা অবশ্য সুবিধামতো স্থানে মধ্যপ্রাচ্যের পুরাতন পুরাণ ব্যবহার করতে পারলে খুশীই হয়। যাত্রা পুস্তকে, আগাছাপূর্ণ সমুদ্র অতিক্রমের বর্ণনা দেয়া হয়েছে একটা পুরাণের আঙ্গিকে।[৮৬] অতিক্রমের আচার হিসাবে অপুদীক্ষা সনাতনভাবে প্রচলিত ছিল; অন্য দেবতারা পৃথিবী সৃষ্টির সময়ে সমুদ্রকে দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন- যাত্রা পুরাণে অবশ্য পৃথিবীর বদলে মানুষকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আমরা যাকে দ্বিতীয় ইশায়াহ্ বলি, ষষ্ঠশতকের মাঝামাঝি নাগাদ যিনি ব্যাবিলনে সক্রিয় ছিলেন, তিনি পরিষ্কার দ্ব্যর্থহীনভাবে একেশ্বরবাদের কথা প্রচার করেছেন। মাত্রাতিরিক্ত কর্কশ কিছু না; তার মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে ইয়াওয়েই একমাত্র ঈশ্বর; তার বিরুদ্ধ মনোভাব তিরোহিত হয়েছে। অবশ্য তার পরেও তিনি পুরাতন সৃষ্টি পুরাণের দ্বারস্থ হন যেখানে পৃথিবী সৃষ্টির জন্য ইয়াওয়ে এই বিজয়কে নিষ্ক্রমণের সময় আগাছাপূর্ণ সমুদ্রকে দু’ভাগ করার সাথে মিলিয়ে দেখা হয়েছে। ইসরালাইটসরা এখন দিব্যশক্তির এমনই একটা প্রদর্শনী আশা করে যেখানে ঈশ্বর নির্বাসন রদ করে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। গিলগামেশের মহাকাব্যের ব্যাবিলনীয় লেখক প্রাচীন ইতিহাস আর পুরাণ এক করেছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় ইশায়াহ্ আরো এগিয়ে যায়। তিনি তার ঈশ্বরের আদিকালিক কর্মকাণ্ডকে বর্তমান ঘটনার সাথে জুড়ে দেন।[৮৭]

গ্রীসে, যুগান্তকারী সময়টা লোগোস (যুক্তি) দ্বারা তাড়িত, পুরাণ থেকে মনের বিভিন্ন স্তরে যা কাজ করে। আবেগ বা কোনো প্রকার আচার অনুষ্ঠানের সহযোগিতা যেখানে প্রয়োজন হয় পুরাণের মানে বুঝতে সেখানে লোগোস সতর্কতার সাথে যাচাই করে সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যার আবেদন কেবল সমালোচক বুদ্ধিবৃত্তির কাছেই আছে। গ্রীক উপনিবেশ ইওনিয়ায় যা বর্তমান তুরস্ক, প্রথম পদার্থবিদ পুরাতন বিশ্ব পুরাণের যৌক্তিক ভিত্তি খুঁজে দেখার প্রয়াস নেন। অবশ্য এই বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা পুরাতন পৌরাণিক আর আদিরূপ কাঠামোর ভিতরেই আটকে থাকে। একদিক থেকে দেখতে গেলে এনুমা এলিশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যারা বিশ্বাস করত পৃথিবী কোনো আদিকালিক পদার্থ থেকে উদ্ভূত হয়েছে কোনো দিব্য প্রচেষ্টা দ্বারা না, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের স্বাভাবিক নিয়মের কারণে এই রূপান্তর ঘটেছে। অ্যানাক্সিমানদারের কাছে (খ্রি: পূ: ৬১১-৫৪৭) মূল আর্চে (নীতি) আমাদের মানবিক অভিজ্ঞতার মতো কোনো ঘটনা না। তিনি এর নাম দেন অনন্ত, উষ্ণতা শীতলতার পর্যায়ক্রমিক পারস্পরিক ক্রিয়ায় আমাদের পরিচিত উপাদানগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। এ্যানাক্সিমেনেস (খ্রি: পূ: ৫০০) বিশ্বাস করতেন আর্চে হলো অনন্ত বাতাস; হেরাক্লিটাস (খ্রি: পূ: ৫০০) মনে করতেন আগুন। পুরাতন পুরাণের ন্যায় এসব প্রাথমিক ধারণার পুরোটাই কাল্পনিক, কারণ যাচাই করার কোনো উপায় ছিল না। কবি জেনোফেনেসও (খ্রি: পূ: ৫৪০-৫০০) এটা উপলব্ধি করেন এবং মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতার কথা বলেন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন একটা যৌক্তিক ধর্মশাস্ত্র প্রণয়নের, দেবতাদের সম্বন্ধে প্রচলিত লোকায়ত পুরাণ নাকচ করে এবং phusikoi এর বিজ্ঞানের সাথে খাপ খায় এমন দেবতার অধিষ্ঠান করতে তিনি চেয়েছিলেন : বিমূর্ত, ছদ্মবেশী শক্তি, নৈতিক কিন্তু স্থির, সর্বজ্ঞ এবং শক্তিমান।

ইওনিয়ান পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে খুব কম লোকই আগ্রহ প্রকাশ করেছে যা ছিল গ্রীসের প্রথম যুগান্তকারী সত্তার প্রদর্শন। চতুর্থ শতকে দর্শনের প্রতি আগ্রহ জোরালো হবার আগে, এথেন্সবাসীরা একটা নতুন ধরনের কৃত্যানুষ্ঠানের প্রচলন করে, বিয়োগান্তক নাট্যকল্প, ধর্মীয় উৎসবের আবহে প্রাচীন পুরাণের ভাবগম্ভীর উপস্থাপন কিন্তু একই সাথে গভীরভাবে তাকে খুটিয়ে দেখার প্রয়াস। একিলাস (খ্রি: পূ: ৫২৫-৪৫৬) সফোক্লিস (খ্রি: পূ: ৪৯৬-৪০৫) এবং ইউরেপিডিস (৪৮০- ৪০৬) সবাই ঈশ্বরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, আর দর্শকেরা বিচারের ভূমিকায় আসীন। পুরাণ নিজেকে প্রশ্ন করে না, সে একপ্রকার আত্মপরিচয় দাবী করে। ট্রাজেডি অবশ্য সনাতন পুরাণ আর নিজের ভিতরে এক ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি করে এবং কয়েকটা মৌলিক গ্রীক মূল্যবোধের বিষয় খতিয়ে দেখে। দেবতারা কেনো ন্যায়পরায়ণ আর ঠিক? বীরত্ব, গ্রীকনেস বা গণতন্ত্রের মূল্য কি? নগর রাষ্ট্রের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে পুরাণ যখন পরাজয় মেনে নিচ্ছে ঠিক সেই সময়ে ট্রাজেডির আগমন ঘটেছে। অডিপাসের মতো বীর তখনও সনাতন পৌরাণিক মূল্যবোধের প্রতি অবিচল কিন্তু তারা তাকে তার সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে না। পৌরাণিক বীরেরা যেমন যুদ্ধ করে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায় বা ন্যূনতম মাত্রায় হলেও দৃঢ়তা দেখাতে পারেন, ট্রাজিক বীরের ক্ষেত্রে সে ধরনের সমাধান প্রযোজ্য না। ব্যথা আর বিভ্রান্তির সাথে দোদুল্যমান অবস্থায়, নায়ককে সচেতনভাবে পছন্দ বেছে নিয়ে তার পরিণতি ভোগ করতে হবে।

প্রতিমা প্রথার বিরোধী হলেও, সনাতন রীতিতেই ট্রাজেডি লেখা হয়। কোনো ধর্মীয় আচারের ন্যায়, বিচ্ছিন্ন দুঃখকে ভাগ করে নেয়ার প্রয়াস এতে উপস্থাপিত কিন্তু প্রথমবারের মতো শহরের ধর্মীয় জীবনে অন্তরের ভাব সংযুক্ত হলো। ডিওনিসিসের উৎসবের সময় নাটক মঞ্চস্থ হতো এবং এথেন্সের যুবকদের উদ্দীপ্ত করতে আর তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। পরিচিত দীক্ষা অনুষ্ঠানের ন্যায়, ট্রাজেডি দর্শকদের অবর্ণনীয় আর চরম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করতো। উৎসর্গের আদর্শের ন্যায় অনেকটা যেহেতু এটা Katharsis-এর দিকে নিয়ে যেত, করুণা আর ভয়ের অনুভূতির দ্বারা হৃদয় ও মনকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করে আত্মিক পরিশোধনে যার সমাপ্তি। কিন্তু উৎসর্গের এই নতুন রূপ অ্যাক্সিয়াল সমবেদনার সাথে সম্পৃক্তকরণ দর্শককে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট বলে অনুভব করতে শিখাতো, আর এভাবে তাদের মানবতা আর সহানুভূতির পরিধির বিস্তার ঘটতো।

প্লাটো ট্রাজেডি অপছন্দ করতেন এর আবেগপ্রবণতার কারণে, তিনি বিশ্বাস করতেন আত্মার অযৌক্তিক অংশকে এটা পরিপূর্ণ করে এবং লোগোসের মাধ্যমেই মানুষ কেবল নিজের সম্পূর্ণ সম্ভাবনার উন্মেষ ঘটাতে পারবে।[৮৮] পুরাণকে তিনি পুরাতন স্ত্রীর গল্পের সাথে তুলনা করেছেন। কেবল যৌক্তিক আলোচনাই সত্যিকারের বোঝাপড়ার জন্ম দিতে পারে।[৮৯] প্লাটোর চিরন্তন ধারণার সূত্রকে প্রাচীন দিব্য আদিরূপ পুরাণের দার্শনিক সংস্করণ ধরা যেতে পারে, পার্থিব বস্তু যার ন্যূনতম রূপ। কিন্তু প্লাটো মনে করতেন পুরাণ বা আচার অনুষ্ঠানের অন্তজ্ঞান দ্বারা প্রেম, সৌন্দর্য্য, ন্যায়বিচার বা ভালোকে অনুধাবন বা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব না সেটা কেবল মনের যুক্তিপাতের শক্তি দ্বারা সম্ভব। এরিস্টোটলও প্লাটোর মতবাদ মানতেন। পুরাতন পুরাণ তার কাছে দুর্বোধ্য মনে হতো : ‘কারণ তারা দেবতাদের বা তাদের থেকে সঞ্জাতকে প্রথম নীতি বলে মেনে নিয়েছিল এবং বলেছিল যে অমৃত আর অমৃতের স্বাদ যে লাভ করেনি সে মরণশীল… কিন্তু এসব কারণের সত্যিকারের প্রয়োগ বিবেচনা করলে, এসব উদ্ধৃতি আমাদের বোধগম্যতার বাইরে’। দার্শনিক ভাষ্য মনে করে এরিস্টোটল পুরাণ পাঠ করতেন। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব পুরাণ গাঁজাখুরির নামান্তর এবং সত্যের একনিষ্ঠ সন্ধানীর উচিত ‘প্রয়োগ দ্বারা যুক্তি অবতারণা করে সেদিকে মনোযোগ দেয়া’।[৯০] আপাতদৃষ্টিতে এখন মনে হয় লোগোস আর মিথোসের ভিতরে দর্শন পাঠ একটা টানাপোড়েনের জন্ম দিয়েছে, যা এযাবৎ কাল পর্যন্ত পরিপূরক ছিল।

কিন্তু এটাও পুরো সম্পূর্ণ না। পুরাণের উপর যতই বিরক্ত থাকুক, ধারণার অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে প্লাটো একে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়েছিলেন যা দার্শনিক ভাষার পরিধির বাইরে অবস্থিত। লোগোসের ভাষা ব্যবহার করে আমরা শুভ সম্বন্ধে কিছু বলতে অপারগ কারণ এটা কোনো সত্তা না, কিন্তু একইসাথে সত্তা আর জ্ঞানের উৎস। আরো ব্যাপার আছে যেমন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি বা দেবতাদের জন্ম যা আপাতদৃষ্টিতে অন্ধ বিশ্বাসের বিষয় এবং অযৌক্তিকতা দ্বারা এতটাই জারিত যে সামঞ্জস্যপূর্ণ তর্কে তাদের প্রকাশ করা অসম্ভব ব্যাপার। তাই বিষয়বস্তু দার্শনিক গণ্ডির বাইরে চলে গেলে, গ্রহণযোগ্য রূপকথা দ্বারা আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে।[৯১] প্রাচ্যের পুরাতন পুনরুত্থানের ও পুরাণের দ্বারস্থ হন প্লাটো।[৯২] এরিস্টোটল স্বীকার করেন যে, দেবতা সম্পর্কিত কিছু কিছু পুরাণ পরিষ্কার বানোয়াট হলেও, এই প্রথার ভিত্তি ‘যে প্রথম সব উপাদানই ছিল দেবতা’- এটা ‘সত্যিই ঐশ্বরিক’।[৯৩]

পশ্চিমা চিন্তায় তাই একটা অসঙ্গতি রয়েছে। গ্রীক লোগোস পুরাণ বিরোধী বলে মনে হয়, কিন্তু দার্শনিকেরা পুরাণ ব্যবহার অব্যাহত রাখেন, হয় যৌক্তিক চিন্তার প্রাচীন প্রতিনিধি হিসাবে বা ধর্মীয় আলোচনায় তাকে অচ্ছেদ্য আখ্যা দিয়ে। গ্রীক যুক্তিপাতের বিপুল অর্জন সত্ত্বেও অ্যাক্সিয়াল সময়ে গ্রীক ধর্মের উপর এর কোনো প্রভাব ছিল না। গ্রীকরা দেবতাদের উদ্দেশে উৎসর্গ করা অব্যাহত রাখে, এ্যলুসিনিয়ান রহস্যময়তায় অংশ নেয়, তাদের উৎসব ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বজায় রাখে যতক্ষণ পর্যন্ত এই পৌত্তলিক ধর্ম জোরপূর্বক সম্রাট জাস্টিনিয়ান দমন করে খ্রিস্টান মতবাদের মিথোস আরোপ না করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *