৪৫. শাঁখা সিঁদুরের গল্প

ইস্কুলে বিবাহিত মেয়েরা যেন শাঁখা সিঁদুর পরে না আসে, অবিবাহিত মেয়েদের কাছে নিজেদের দাম্পত্য জীবনের গল্প না করে, কিছুদিন আগে মুর্শিদাবাদের একটি ইস্কুল কর্তৃপক্ষ এমন আদেশই জারি করেছে। জারি করা মাত্র ভীষণভাবে ক্ষেপে উঠলো মিডিয়া, মানুষ। কী? হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে ফতোয়া! কর্তৃপক্ষ বোঝাতে চাইছেন, দাম্পত্য জীবনের সরস বর্ণনা অবিবাহিত মেয়েদের যদি আগ্রহী করে তোলে বিবাহিত জীবনের প্রতি, তবে তারা পড়াশোনায় আগ্রহী না হয়ে বরং যত শীঘ্র পারে বিয়ে করার জন্য আগ্রহী হবে। কতৃপক্ষের যুক্তি কারও পছন্দ হয়নি, হুমকির মুখে ইস্কুলের শাঁখা সিঁদুর না পরার আদেশ তুলে নিতে বাধ্য হলেন কর্তৃপক্ষ।

আর ওদিকে উত্তর চব্বিশ পরগণার গুমা গ্রামের রীনা বৌদ্ধকে গ্রামবাসীরা প্রচণ্ড মেরে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তার অপরাধ, বিবাহিত হয়েও শাঁখা সিঁদুর না পরা। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার কারণে রীনা শাঁখা সিঁদুর পরেননি, কিন্তু গ্রামবাসীর ফতোয়া, শাঁখা সিঁদুর পরতেই হবে, তা না হলে গ্রামে থাকা চলবে না। রীনা বৌদ্ধ অগত্যা তার স্বামী বীরেন্দ্র বৌদ্ধকে নিয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তিনি তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিরাপদে বাস করতে চান কিন্তু সেই নিশ্চয়তা এখনও তিনি প্রশাসনের কাছ থেকে পাননি।

শাঁখা সিঁদুরের গল্প অনেক। আমার বাড়িতে প্রায়ই গল্প করতে আসে সোনারপুরের সপ্তমী। জন্ম তার সুন্দরবনে। বন্যায় বাড়ি ঘর ভেসে গেল যে বছর, সে বছর তার বাবা মা তার এগারোটা ভাইবোনকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছিলো সোনারপুরে। সপ্তমী তখন সাত মাসের শিশু। সপ্তমীকে মেঝেয় বসিয়ে রেখে লোকের বাড়িতে কাজ করতো তার মা। সপ্তমীও অল্প বয়স থেকেই লোকের বাড়িতে কাজ করছে। বারো তেরো বছর বয়সেই তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। স্বামী কোনওদিন ভালোবাসেনি। শ্বশুরবাড়িতে দাসীর কাজ করতো, তারপরও প্রতিদিন তাকে স্বামী সহ শ্বশুরবাড়ির লোকেরা প্রচণ্ড মারতো। এত অত্যাচার সয়েও স্বামীর বাড়ি বলেই রয়ে গিয়েছিল সে। দুটো মেয়ে-বাচ্চা জন্মেছে, বাচ্চাগুলো তখনও কোলে, স্বামী তাকে মেরে প্রায় আধমরা করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। সেও পনেরো বছর হয়ে গেল। এই পনেরো বছর স্বামী তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেনি, বাচ্চাদুটো বেঁচে আছে কী মরে গেছে তা জানতেও কোনওদিন চেষ্টা করেনি। কোনওদিন কোনও খরচপাতি দেয়নি। অসম্ভব আর্থিক কষ্টে দিনের পর দিন কাটিয়েছে। না খেয়ে বা আধপেট খেয়ে বেঁচেছে সপ্তমী, বাঁচিয়েছে দু বাচ্চাকে। তার স্বামী আরেকটা বিয়ে করে নিয়েছে সেও অনেক বছর। কিন্তু সপ্তমী এখনও পরে আছে শাঁখা সিঁদুর, এখনও পরে আছে হাতে লোহা। দেখে সপ্তমীকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘যে লোক তোমাকে এত কষ্ট দিলো, এত মারলো, তাড়িয়ে দিল, তোমার সঙ্গে পনেরো বছর কোনও সম্পর্ক নেই। তুমিও কোনওদিন তার কাছে ফিরবে না। সেও তোমাকে নেবে না। তবে কেন পরে আছো শাঁখা সিঁদুর?’

সপ্তমী বলে, ‘আমাদের মধ্যে একবার শাঁখা সিঁদুর পরলে তা আমরা ফেলতে পারি না।’

আমি বললাম, ‘তুমি ডিভোর্স দিচ্ছ না কেন?’

বললো, ‘আমাদের মধ্যে মেয়েরা ডিভোর্স করতে পারে না।’

বললাম, ‘কে বলেছে পারে না? খুব পারে। তোমার স্বামীর সঙ্গে তোমার তো ডিভোর্স হয়নি, স্বামী তো আরেকটা বিয়ে করে বসে আছে। তোমাদের মধ্যে তো ডিভোর্স না হলে ফের বিয়ে করাও আইনত নিষিদ্ধ, সেটা জানো?’

সপ্তমী আমার কথা ঠিক বুঝতে পারলো না। আমাকে আবার বুঝিয়ে বলতে হল যে এখনকার হিন্দু আইনে ডিভোর্স দেওয়ার অধিকার মেয়েদের আছে এবং কোনও পুরুষ বা নারীর একাধিক স্ত্রী বা স্বামী রাখার অধিকার নেই। না, সপ্তমী এসব আইনের কথা জানে না। সে গড়গড় করে অনেক চেনা পুরুষের নাম বলে গেল, যারা দুটো তিনটে স্ত্রী নিয়ে এক বাড়িতে বাস করছে।

‘কোথায়?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

বললো, ‘সোনারপুর, সুভাষগ্রাম, সুন্দরবন।’

সপ্তমীকে আমি দেখেছি কিছু একটা কথা যখন সে আমাকে বিশ্বাস করাতে চায়, তাড়াতাড়ি তার এক হাতের শাঁখাকে আরেক হাতে চিমটি মেরে ধরে বলে, ‘আমার স্বামীর দিব্যি খেয়ে বলছি দিদি….’

সপ্তমীর কাছে বড় পবিত্র জিনিস এই শাঁখা। এটি সে যে করেই হোক পরতে চায়। এটি ফেলতে যেদিন হবে, সেদিন তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন।

আমি হেসে বলি, ‘তোমার স্বামী তোমার কোনও খবরই নেয়নি। তোমার দুরবস্থায় কোনও রকম সাহায্য কোনওদিনই করেনি। তোমার দু বাচ্চা জানেই না বাবা কাকে বলে। ওই লোক বেঁচে থাকলেই কী, না থাকলেই কী।’

সপ্তমী বললো, ‘আমার স্বামী যেভাবেই থাকুক, আমি চাই বেঁচে থাকুক।’

‘কেন?’ আমার প্রশ্ন।

সপ্তমীর উত্তর, ‘আমি শাঁখা সিঁদুর নিয়েই মরতে চাই।’

শাঁখা সিঁদুর নিয়ে মরলে সপ্তমী স্বর্গে যাবে। সপ্তমীর মতো মেয়ে প্রচুর চারদিকে। আমি সেই মেয়েদের কথা জানি, যাদের স্বামী আরেকটা বিয়ে করে অন্যত্র সংসার করছে, ফিরেও তাকায় না, জানি সেই মেয়েদের কথা স্বামীরা যাদের মেরে হাড় গোড় ভেঙে ফেলে রাখে, জানি সেই মেয়েদের কথা, যে মেয়েরা অমানুষিক পরিশ্রম করে সারাদিন যা উপার্জন করে, তার পুরো টাকাই মদ্যপ জুয়ারী স্বামী সন্ধেবেলা এসে কেড়ে নেয়, জানি সেই মেয়েরা কী পরম যত্নে সিঁদুর পরে, কী আহলাদে শাঁখা পরে।

‘শাঁখা সিঁদুর না পরলে তো নানারকম সম্ভাবনা আছে। কারও সঙ্গে তোমার প্রেম হতে পারে, তাকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করতে পারো। কোনও ভালো লোকের দেখা তো পেতে পারো।’

আমার কথা শুনে সপ্তমী জোরে হেসে ফেললো। বললো, ‘না, না, বিয়ে আমাদের একবারই হয়। স্বামী আমাদের একজনই থাকে। ভালো লোকের কথা বলছেন? না, দিদি। কাউকে বিশ্বাস নেই। প্রথম প্রথম ভালো হলেও শেষে গিয়ে সব লোকই আমার স্বামীর মতোই।’

সপ্তমী একদিন বললো, ‘বদ লোকের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য শাঁখা সিঁদুর আমাদের পরতেই হয়। এগুলো পরা দেখলে লোকেরা বুঝে যাবে আমরা কোনও বেওয়ারিশ মাল নই।’

আমার বোঝা হল, শাঁখা সিঁদুর মেয়েদের জীবনে বিরাট এক নিরাপত্তা। স্বামীর কোনও অস্তিত্ব না থাকলেও বেওয়ারিশ মাল ভেবে শিয়াল শকুনেরা যেন তাদের খুবলে না খেতে পারে, সে কারণে শাঁখা সিঁদুরের আশ্রয় তাদের নিতেই হয়।

কিন্তু শাঁখা সিঁদুর মেয়েদের সত্যিকার কোনও নিরাপত্তা দিতে পারে বলে আমি মনে করি না। যে পুরুষ ছিঁড়ে খেতে আসে, ধর্ষণের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে আসে, বদ উদ্দেশে বদমাইশি করতে আসে, শাঁখা সিঁদুর তাদের জন্য কোনও বাধা নয়।

সপ্তমীর জন্য, সপ্তমীর মতো আরও লক্ষ মেয়ের জন্য আমার খুব কষ্ট হতে থাকে। মেয়েটি একা থাকে, একা একটি বেড়ার ঘরে। খেতে পাক বা না পাক, কোথায় কোন সুদূরে আমোদ ফুর্তি করা স্বামীর মঙ্গলের জন্য যত পুজো আচ্চা আছে, সবই অভাবী মেয়েটি সাধ্যের বাইরের খরচাপাতি দিয়ে হলেও করে। কী নিরাপত্তা দেয় তাকে শাঁখা সিঁদুর। জিজ্ঞেস করেছিলাম তাকে কেউ কি চেষ্টা করেনি অসম্মান করতে?

‘খুব করেছে।’ সপ্তমীর কথা। ‘দিন রাত লোকে করেই যাচ্ছে।’

‘তবে আর কী লাভ!’ বলতে চেয়েও বলিনি। নিজেই বললো, ‘রাতে রাতে ঘুম হয় না। বালিশের কাছে একটা দা নিয়ে শুই। দরজায় যখনই খুট খুট শব্দ হয়, দা নিয়ে দরজার কাছে যাই। আয় কে ঢুকবি ঢোক, আজ তোর একদিন কী আমার একদিন।’

‘এত সাহস তোমার সপ্তমী!’ মুগ্ধ বিস্ময়ে বলি।

‘সাহস না থাকলে লোকে কেটে ফেলতো গো দিদি। কেউ দু পয়সা দিয়ে আমাকে সাহায্য করার নেই। সোনারপুর থেকে সাত সকালে উঠে পান্তা খেয়ে ভিড়ের ট্রেন ধরি। সাত লোকের বাড়িতে কাজ করে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফিরি। সাহস আছে বলে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে একটা জায়গা কিনেছি, জায়গার ওপর হোক না দরমার, ঘর তো একটা করেছি। লোকে কত বড় ছোট কথা বলেছে, বলেছে কলকাতায় গিয়ে গিয়ে লাঙ ধরি। কারও কথায় আমি কান দিইনি। কান দিলে চলবে? আমাকে কি একবেলা খেতে দেবে নাকি ওরা?

জিজ্ঞেস করি, ‘তবে শাঁখা সিঁদুর না পরলে লোকে কী ভাববে কী বলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো কেন? যা ইচ্ছে তাই বলুক, ভাবুক। বেওয়ারিশ মাল ভাবলে তোমার কী যায় আসে? যদি বলো, তোমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে কেউ স্পর্শ করবে, তোমাকে কেউ বিরক্ত করবে, তোমার ওপর কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে, তাতে কী? তোমার দা তো আছেই। ভয় কিসের?’

সপ্তমীর চোখে অন্য ভয় খেলা করে। সেই ভয়টা দীর্ঘ দীর্ঘকাল ধরে মহা দাপট নিয়ে বিরাজ করা সংস্কারকে ভাঙার ভয়। এই ভয়টা সপ্তমীর মতো আরও সহস্র সপ্তমীর আছে।

নিম্নবিত্ত মেয়েরা কী কী সব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে, উচ্চ-শ্রেণীর, উচ্চ-শিক্ষিত উচ্চ- বিত্ত মেয়েদের পক্ষে সেসব কল্পনা করাও অসম্ভব। সপ্তমীরা আইন জানে না তাই মানে না। মুখের অন্ন জোগাতে বাধা দেয়, এমন যা কিছুই দেখে সজোরে উপড়ে ফেলে, পাছে লোকে কিছু বলের ধার কখনও ধারে না। ভীষণ সাহস আর শক্তি নিয়ে এরা একা একা বেঁচে থাকে। এদের দু পয়সা দিয়ে সাহায্য করার, একবেলা খাবার দিয়ে সহযোগিতা করার কেউ নেই। এরা যুদ্ধ করে প্রতিদিন, ভাতের একটি দানার জন্যও যুদ্ধ করতে হয়। এরা কোনওদিন ইস্কুলে যায়নি, স্বরে অ স্বরে আ জানে না। কিন্তু লাফিয়ে কী করে ট্রেনটা ধরতে হয় জানে। কেউ কাঁধ খামচে ধরলে কী করে গুষ্ঠি তুলে গালি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে হয় জানে। নিজের পয়সার দিকে কেউ হাত বাড়ালে সেই হাত কি করে মুচড়ে দিতে হয় জানে। রাতের অন্ধকারে ঘরের দরজা ভেঙে কেউ ঢুকে পড়লে মাথায় কী করে কোপ দিতে হয় জানে। শুধু জানে না কী করে ফেলে দিতে হয় হাতের শাঁখা, কী করে মুছতে হয় সিঁদুর। সংস্কারের শেকলে বন্দি এখনও বেশির ভাগ মেয়ে, এমনকী দুর্দান্ত সাহসী মেয়েও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *