বাংলাদেশে দুই রাজনৈতিক নেত্রী বহুকাল থেকে দেশ শাসন করছেন। হাসিনা আর খালেদা। খালেদা নিশ্চিতভাবেই ধর্মীয় মৌলবাদীদের বন্ধু। আর হাসিনাকে ভাবা হত সেকুলার, অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদের বিপক্ষ শক্তি। হাসিনার দল আওয়ামি লীগ এবার জিতে যাবে, এরকমই অনেকে ভেবেছিল। কারণ ধর্মীয় মৌলবাদীদের দাপটে, সন্ত্রাসে জনজীবন জর্জরিত। আশা ছিল দেশটিতে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা আনা, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার বন্ধ করা, ফতোয়াবাজদের ফতোয়া বন্ধ করা, মৌলবাদীদের দাপট বন্ধ করার বিরুদ্ধে হাসিনাই একমাত্র নেত্রী যিনি রুখে দাঁড়াতে পারেন। প্রতিক্তিয়াশীল মৌলবাদী শক্তি যখন দেশটিকে ধ্বংস করে ফেলছে, তখন হাসিনার দিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাকিয়ে ছিল দেশের শুভানুধ্যায়ী মানুষ। সবাইকে স্তম্ভিত করে, স্থবির করে হাসিনা জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি ফতোয়াবাজদের অধিকার দেবেন ফতোয়া দেবার। বললেন, তিনি মাদ্রাসাগুলোকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেবেন, ব্লাসফেমি আইন আনবেন, এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি নির্ভেজাল ইসলামী রাষ্ট্র বানিয়ে তবে ছাড়বেন। ১৯৯৩ সালে হাবিবুর রহমান নামের যে সিলেটি মৌলবাদী লোকটি আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া ঘোষণা করেছিলো, মাথার দাম ঘোষণা করেছিল, সে আগামী নির্বাচনে আওয়ামি লীগের একজন প্রার্থী। হাসিনা অবলীলায় হাত মিলিয়েছেন ইসলামী মৌলবাদী দলের নেতা শায়খুল হাদিসের সঙ্গে, দেশ জুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাস ছড়াতে যার জুড়ি নেই। কারও কি বিশ্বাস হয় এমন কথা! বিশ্বাস না হলেও এসব সত্য। বিশ্বাস না হলেও সত্য যে বাংলাদেশ নামের দেশটির আর কোনও সম্ভাবনা নেই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে ফিরে যাবার।
আওয়ামি লীগ নামের দলটিকে মানুষ চিনতো প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে। এখন আওয়ামি লীগ আর মৌলবাদী দলে কোনও কি পার্থক্য আছে? জামাতে ইসলামি, ইসলামি ঐক্যজোট, বিএনপি, আওয়ামি লীগ — এইসব দলের মধ্যে নীতি ও আদর্শগতভাবে সত্যি কথা বলতে কী, এখন সত্যিকার কোনও পার্থক্য নেই। এই মুহূর্তে কী হতে পারে তবে দেশটির ভবিষ্যত! না। ও দেশ নিয়ে কোনও সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে আমি এখন অপারগ। দেশটি উগ্রপন্থী জঙ্গি মুসলমানদের একটি ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। বাকি যারা আছে, যারা বলছে যে তারা উগ্রপন্থী নয়, তারা মৌলবাদবিরোধী, তারা গোপনে গোপনে মৌলবাদের শেকড় আঁকড়ে বসে আছে। মৌলবাদের শেকড় যে ধর্ম — তা সবলে অস্বীকার করতে চাইবে অনেকে। কিন্তু ধর্মে বিশ্বাস আছে বলেই মৌলবাদের বিরুদ্ধে অত শক্ত করে লড়তে আজ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষও পারছে না। মৌলবাদ তো আকাশ থেকে পড়েনি! মৌলবাদ ধর্ম থেকে উদ্ভূত। আল্লাহ বা ঈশ্বর বা ভগবান সকলেই মৌলবাদী, তাদের বান্দাগণ মৌলবাদী, ধর্মের গুরুজনেরা, প্রেরিত পুরুষেরা সকলেই সন্দেহাতীতভাবে মৌলবাদী। ধর্মের মূলনীতিতে যারা বিশ্বাস করে তারাই তো মৌলবাদী। ধর্মের মূলনীতিতে বিশ্বাস তো তাঁরা করেনই, তাঁরা চান অগুনতি মানুষও সেই নীতিতে যেন বিশ্বাস করে। বাংলাদেশে যারা দাবি করছেন যে তাঁরা মৌলবাদী নন, তাঁরা কি ধর্মের মূলনীতিতে বিশ্বাস করেন না? গোপনে গোপনে অনেকে করেন। যাঁরা করেন না তাঁদের বেশির ভাগেরই সাহস নেই বলার যে তাঁরা করেন না।
বাংলাদেশ ছিল সুফিদের দেশ। ছোটবেলায় দেখেছি খুব বুড়োরা যাদের কিছু করার নেই, লাঠি ভর দিয়ে টুক টুক করে হেঁটে মসজিদে যেতেন, যতনা নামাজের জন্য, তার চেয়ে বেশি অন্য বুড়োদের সঙ্গে আত্তা দেবার জন্য। সব মিলিয়ে দশ বারোজন লোক হত মসজিদে। আর এখন? তরুণদের ভিড়ে মসজিদ উপচে পড়ছে। রাস্তা বন্ধ করে তারা নামাজ পড়ে। এ কী রূপ দেখি বাংলাদেশের! ধর্মের এই উন্মাদনা কে সৃষ্টি করলো? আমি দোষ দেব রাজনীতিকদের। দোষ দেব ধনী আরবদেশগুলোকে যারা ধর্মপ্রচার করতে দরিদ্র দেশগুলোকে প্রায় কিনে নিয়েছে, দোষ দেব সমাজতন্ত্রবিরোধী পুঁজিবাদী নিও-কনদের রক্তচক্ষুকে। বাংলাদেশ সোনার বাংলা নয়। কোনওকালে ছিল কী! বাহান্নোতে, উনসঙ্গেরে আর একাণ্ডরে একটি কেবল সম্ভাবনা ছিল। সেই অফুরান সম্ভাবনা কিন্তু মাত্র কবছরেই হাওয়া।
এই যে ধর্মান্ধতায় থিকথিক করছে দেশ, এই যে রাজনৈতিক নেতারা এক এক করে নিজেরা মৌলবাদীতে পরিণত হচ্ছেন এবং নিজেদের মধ্যে কে কতটা ধার্মিক বা মৌলবাদী তার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছেন তাতে কী হাল হবে দেশের, ভেবেছেন কেউ? রাজনীতিকরা না হয় গদিতে বসার আরাম কিছুদিন ভোগ করলেন। কিন্তু দুরবস্থা কাদের দিকে ধেয়ে আসছে? মেয়েদের দিকে আসছে, সকলেই জানে। ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে মেয়েদের জীবনভর ভুগতে হয়। রাষ্ট্রে সমাজে, আইনে পরিবারে ধর্মকে ডেকে আনা মানে নারীনির্যাতনকে সাদরে ডেকে আনা, নারীপুরুষে বৈষম্য ডেকে আনা, মেয়েদের বাল্যবিবাহকে, পুরুষের বহুবিবাহকে, তথাকথিত ব্যাভিচারের নামে মেয়েদের পাথর ছুড়ে হত্যা করার আইন ডেকে আনা, বোরখা না পরলে, স্বামীর অবাধ্য হলে, পিটিয়ে মারা ডেকে আনা, তালাক তালাক তিন তালাকের বীভৎসতা ডেকে আনা, মেয়েদের জন্য বন্দিত্ব, বেকারত্ব, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, দাসীত্ব আর দুর্ভোগ ডেকে আনা।
নারীকে ছোবল দেবার জন্য ফণা তুলে আছে মৌলবাদ। বিষাক্ত সাপে ছেয়ে যাওয়া আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য আশংকায় আমি আজ বাকরুদ্ধ। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে নাকি প্রতিবাদ করবে মৌলবাদ বিরোধী শক্তি। কিন্তু পুরুষরা কি প্রতিবাদ করবে? পুরুষ কি সত্যি করে করবে কোনও প্রতিবাদ? ধর্মের যাবতীয় আরাম তো ভোগ করছে পুরুষ। নারীর ঘাড়ের ওপর বসে, নারীকে পায়ের তলায় পিষে, দলবদ্ধভাবে দলে, যত রকম আরাম আয়েশ করা যায়, করছে পুরুষ নামক প্রভুরা। ধর্মের কারণে বা মৌলবাদের কারণে পুরুষকে কখনও দুর্ভোগ পোহাতে হয় না, হবে না। পোহাতে হয় এক মেয়েদেরই। দেয়ালে যদি পিঠ ঠেকে কারওর, ঠেকবে মেয়েদের পিঠই। যদিও আরও বহু বছর আগেই দেয়ালে পিঠ ঠেকার কথা, কেন ঠেকছে না, সে এক রহস্য। অথবা ঠেকেছে পিঠ, কিন্তু তাদের এত বেশি অনুভূতিহীন করে রাখা হয়েছে যে তারা আজ বুঝতেও পারে না কোথাও কিছু ঠেকলে। মেয়েদের মস্তিষ্ক এত ভোঁতা করে রাখা হয়েছে যে বুঝতে পারে না পুরুষেরা মৌলবাদী হোক যৌগবাদী হোক, সব এক। সবাই মেয়েদের ভোগাবে। সবাই মেয়েদের লাথি দেবে, গুঁতো দেবে। মেয়েদের অধিকার টেনে ছিঁড়ে নর্দমায় ফেলবে। মেয়েদের স্বাধীনতাকে গণধর্ষণ করে খুন করবে ঠাত্তা মাথায়। মৌলবাদী যৌগবাদী দু জাতের পুরুষই করবে, করবে এবং করবেই। তারা করেছে অতীতে, এখনও করছে, এবং ভবিষ্যতেও করবে। ততদিন অবধি করবে যতদিন না পুরুষদের পায়ের তলায় পিষে মারা না হয়। যতদিন না তাদের দম্ভকে গুঁড়া করা না হয়। তাদের পৌরুষকে ছিঁড়ে টুকরো করে ঘৃণায় এবং অবত্তায় ছুড়ে ফেলা না হয় দুর্গন্ধ ডোবায়।
হাসিনা নারী। যে কেউ এখন বলবে। হাসিনা নারী, কিন্তু তিনি পুরুষের প্রতিনিধি। তিনি মৌলবাদের দোসর। তিনি ধর্মের দোসর। পুরুষতন্ত্রের দোসর। হাসিনার মতো পুরুষ বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই। হাসিনা এখন পুরুষের মতো পুরুষ। নারীরা পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক, এ কথা জানি। কিন্তু কোনও নারী যে এত জঘন্যভাবে এমন ভয়াবহ নারীবিরোধী পুরুষ হয়ে উঠতে পারে, তা এত তীব্র করে আমার জানা ছিল না।
নারী হয়ে নারীর ক্ষতি অনেকে করে। না বুঝেই করে। কিন্তু হাসিনা, আমি মানি যে জেনে বুঝেই নারীর এই ক্ষতি করছেন। তিনি ভালো করেই জানেন মৌলবাদীরা আজ ক্ষমতার চুড়োয় উঠে নারীর সর্বনাশ সবার আগে করবে। তিনি জানেন শরিয়তি আইনের আগুন, ফতোয়ার আগুন, ধর্মীয় আইনের বর্বরতা, অসভ্যতা সবই নারীকে গিলে খাবে, তারপরও তিনি এই ভয়ংকর সিদ্ধান্তটি নিলেন। অনেকে হাসিনার এই সিদ্ধান্তকে কৌশল বলে ব্যাখ্যা করবে। কিন্তু আমি একে বলবো আগুন নিয়ে খেলা। এর পরিণাম কখনও ভালো হয় না। হবে না।
আজ যেদিকে তাকাই, দেখি নারীদের চরিত্রহীনতা। পুরুষের সুখের জন্য ভোগের জন্য নিজের অধিকার বিসর্জন দেওয়া, পুরুষের দাসীত্ব করা, পুরুষের প্রতিনিধি হওয়া কি নারীর চরিত্রহীনতা নয়? এর চেয়ে বেশি চরিত্রহীন নারী আর অন্য কোনও কারণে হতে পারে না। হাসিনার চরিত্রহীনতা থেকে যেন কোনও নারী শিক্ষা না নেয়। যেন সকল নারী একযোগে ধিক বলতে পারে হাসিনার মতো চরিত্রহীনকে। ধিক বলতে পারার সাহস এবং শক্তি এবং সততা অর্জন করুক সকল নারী।