প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে নারী পুরুষের আনুপাতিক হার সাধারণত এমনই থাকে, নারী বেশি, পুরুষ কম। একহাজার পুরুষে একহাজার পাঁচ-এর মতো নারী। সুস্থ সমাজ হলে তাই থাকে। কিন্তু অসুস্থ হলে হেরফের হয়। অসুস্থতা ভারতে আগেই ছিল কিছু কিছু সম্প্রদায়ে, এখন সেটি মহামারির আকার ধারণ করেছে। বিশ্বাস কারও হোক বা না হোক, এটি সত্য।
উনিশশ বিরানব্বই সালে জয়ললিতা মুখ্যমন্ত্রী থাকা কালীন তামিলনাড়ুর সরকার একটি দোলনা-ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। অনাকাঙ্ক্ষিত মেয়েশিশুদের ওই দোলনায় রেখে যাবে লোকেরা। কিন্তু সাতাত্তরটি শিশু সে বছর দোলনায় জোটে বটে, দত্তক দেওয়ার আগে বেঁচে থাকে মাত্র কুড়িটি। এই ব্যবস্থার প্রতি কারও আর আস্থা থাকেনি। উনিশশ তিরানব্বই সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর অবধি দেখা গেছে তামিলনাড়ুর ওই অঞ্চলে এগারোশ চুরানব্বইটি মেয়ে শিশু জন্ম নেয়, একশ ছাপ্পান্নটি মেয়েশিশুকে হত্যা করা হয়েছে, ২৪৩টি মেয়েহত্যা রোধ করা হয়েছে, আর দোলনায় জুটেছে মাত্র সাতটি শিশু। দোলনা প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।
ভারতের উত্তরাঞ্চলের চেয়ে দক্ষিণাঞ্চলে চিরকালই মেয়েদের মর্যাদা তুলনায় বেশি ছিল। কেরালায় এমনকী মাতৃকুলভিত্তিক সমাজ ছিল এক সময়। মায়ের সম্পত্তি মেয়ে পেত। বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর বাড়ি ঘর করতে যেত না। নিজের বাড়িতে দাপট নিয়ে থাকতো, স্বামী এসে মাঝে মাঝে কিছুদিন কাটিয়ে যেত। ওই মাতৃকুলভিত্তিক সমাজ ভেঙে গেলেও কেরালায় মেয়েদের মান মর্যাদা ভারতের অন্য যে কোনও রাজ্য থেকেই বেশি ছিল। ছেলের অনুপাতে মেয়ে বেশি ছিল। মেয়েরা শিক্ষিতও বেশি, স্বনির্ভরও বেশি। মেয়েদের এমন স্বর্গরাজ্য কেরালাতেও এখন মেয়েহত্যা চলছে। তামিলনাডু, অন্ধপ্রদেশ, কর্নাটকও বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে তামিলনাড়ু। এই রাজ্যের কিছু গ্রামে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হচ্ছে মেয়েদের, সম্ভব হলে জন্মানোর আগে, সম্ভব না হলে পরে। উসিলামপত্রি, সালেম, ধরমপুর, উত্তর আরকট, পেরিয়ার, দিন্দিজ্ঞুল, মাদুরাই অঞ্চলগুলো মেয়েশিশুহত্নঅঞ্চল বলে চিহ্নিত। তামিলনাড়ুর কিছু অঞ্চলে মেয়েশিশুকে হত্যা করার একটি নাকি ঐতিহ্যই আছে। মা ঠাকুরমারা সদ্যজাত কন্যার মুখে দুধের ফোঁটা দেয়, যে দুধে মিশিয়ে দেয় হলুদ করবীর গুঁড়ো। যারা খুব বিত্তানী বিশ্বাসী, তারা দুধের সঙ্গে কিছু ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে মিশিয়ে দেয়, নয়তো সামান্য কীটনাশক। মেয়েশিশু হত্যা কেবল ওই কিছু অঞ্চলেই নয়। ঐতিহ্যটি যেন দেশ জুড়েই। তবে হত্যার পদ্ধতিটি একেক জায়গায় একেকরকম। গুজরাটে মায়েরা তাদের কন্যাদের দুধের মধ্যে ডুবিয়ে মারে, আর পাত্তাবে মাটির হাঁড়িতে কন্যাকে পুরে সেই হাঁড়ির ঢাকনা ভালো করে বন্ধ করে হাঁড়ি মাটির তলায় পুতে রাখে। অনেকে জানে না যে মেয়েশিশু হত্যা কোনও অপরাধ। এটিকে খুব স্বাভাবিক কাজ বলেই অনেক সম্প্রদায়ের ধারণা।
শিশুহত্যা নৃশংস। আজকাল আবার থানা পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। তাই সবচেয়ে নিরাপদ মেয়েভ্রুণ হত্যা। যেহেতু দেখতে নৃশংস নয়, অপরাধবোধের প্রশ্ন ওঠে না। স্ক্যানিং এখন সস্তায় করা যাচ্ছে। গহন গ্রামের ভেতরেও ঢুকে গেছে লিঙ্গ নির্ণয় আর গর্ভপাতের সব রকমের আধুনিক ব্যবস্থা। আগে মানুষ মন্দিরে মন্দিরে দৌড়োতো ভগবানের কাছে ছেলে চাইতে, সাধু সন্ন্যাসীর পেছনে টাকা ঢালতে হত, এখন আর তুকতাকের দরকার নেই, ভগবানের চেয়েও শক্তিশালি মাধ্যম এসে গেছে ভারতে, বিজ্ঞান। স্ক্যান মেশিন, অ্যামনিওসেনথেসিস, এবং আরও কিছু বৈত্তানিক পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুর ভ্রূণের লিঙ্গ দেখে, ‘ঠিক লিঙ্গ’ না হলেই জরায়ু থেকেই বিদায়। ঠিক লিঙ্গ পুং, বেঠিক লিঙ্গ স্ত্রী। সুস্থ লিঙ্গ পুং, পঙ্গু লিঙ্গ স্ত্রী।
তামিলনাড়ুর মেয়েরা স্বীকার করছে তারা তাদের কন্যাদের হত্যা করছে, মোটেও তারা দুঃখিত নয় এ কাজে। একটুও অনুশোচনা কেউ করছে না। ক্রোধী ক্রোন্দসীরা বলছে, ‘তোমরা কী চাও? কী করবো আমাদের মেয়েদের? কেন তাদের আমরা বাঁচতে দেব? যেন নির্যাতিত হয়, যেমন আমরা হচ্ছি? যেন যন্ত্রণায় ভোগে জীবনভর, যেমন আমরা ভুগছি?’
সমাজে মেয়েরা এই শিক্ষা পেতে পেতে বড় হয় যে মেয়েদের জীবনের আদৌ কোনও মূল্য নেই, পুরুষকে সুখী এবং তৃপ্ত করতে না পারলে মেয়েরা অক্ষম অথর্ব এবং অর্থহীন জীব হিসেবে সামাজিক নিন্দা ঘৃণার শিকার হবে। এ তো সত্যিই যে, মেয়েদের বোধ বুদ্ধি বিচক্ষণতার, দক্ষতা পারদর্শিতার কোনও মূল্য দেওয়া হয় না, মেয়েদের যৌনতাকে পণ্য করা হয়, চরিত্রকে দুর্বল বলে ভাবা হয়, মেয়েদের জাতটাকেই ‘নিচু জাত’ বলে বিশ্বাস করা হয়। মেয়ে হয়ে জন্মালে কীরকম দুর্বিষহ হয়ে ওঠে জীবন, তা জেনে বুঝে মেয়েরা কেবল পুত্রসন্তান চাইছে, কোনও কন্যা সন্তান চাইছে না। পারিবারিক এবং সামাজিক চাপই মেয়েদের বাধ্য করছে কন্যাহত্যা বা কন্যাভ্রুণহত্যা করতে। মেয়েরা এই হত্যাযজ্ঞে অংশ গ্রহণ করছে ঠিকই, কিন্তু দোষ কেন তাদের দেব! তারা এই খেলায় ঘুঁটি মাত্র। আইনে এই হত্যা অপরাধ। সত্যিকার অপরাধিকে শাস্তি না দিয়ে আজকাল শাস্তি দেওয়া হয় মেয়েদের। এই কুৎসিত লিঙ্গ বৈষম্যের সমাজে ভ্রুণহত্যা বা শিশুহত্যার দায়ে মেয়েদের শাস্তি দিলে মেয়েরা কিন্তু দুবার শাস্তি পায়। এক মেয়ে হয়ে জন্মানোয়, দুই মেয়ে হয়ে অন্য কাউকে জন্মাতে বাধা দেওয়ায়। মেয়েরা হত্যা কেন করে, কন্যা জন্ম দিলে লাঙ্গি খেতে হয়, বেশি কন্যা জন্ম দিলে স্বামী তাড়িয়ে দেয়, বাপের বাড়িতেও তার জায়গা হয় না। তাই কন্যাহত্যা করে তারা নিজের কন্যাকে তো বাঁচায়, নিজেকেও বাঁচায়।
আইনত নিষিদ্ধ হলেও বহাল তবিয়তে চলছে ভ্রুণহত্যা, শিশুহত্যা। নারীনির্যাতনও তো আইনত নিষিদ্ধ। চলছে না? চার দেওয়ালের ঘরের মধ্যে কার আইন চলে? ওখানে চলে পুরুষ কর্তার আইন। পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে পুরুষ শাসিত এই সমাজে পার পাবে কোন মেয়ে? কে তাকে বাঁচতে দেবে বাকি জীবন?
বিরানব্বই সালে তামিল নাডুর মেয়েশিশুদের নিরাপত্তা দেওয়ার একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়, ২০০০ সালের মধ্যে শিশুহত্যা নির্মূল করার জন্য। এক বা দুই মেয়ে যাদের আছে, কোনও পুত্র নেই, তাদের টাকা দেওয়া হবে যদি বাবা মার একজন বন্ধ্যাকরণ করেন। মেয়ের নামে টাকা জমা হবে ফিক্সড ডিপোজিটে, যতদিন না মেয়ের ২১ বছর বয়স হয়। মেয়ের ইস্কুলের খরচপাতি বাবা মার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। স্কিমে প্রতিবছর ২০,০০০ পরিবারকে নেওয়া হচ্ছিল। বিরানব্বই সালে সালেম ডিস্ট্রিজ্ঞে ৬১৪ টি মেয়ে টাকা পেল, পেল দেড় বছর পর্যন্ত। স্কিমটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হল। নানারকম বাধা বিপত্রি। মাস্তান পুলিশ সুদখোর ঘুসখোর ঢুকে সব্বনাশ করলো প্রকল্পটির । ২১ বছর বয়সে যখন মেয়ের নামে জমা হওয়া টাকাটা তোলা হবে সেই টাকা এক পণ দেওয়া কাজে ছাড়া অন্য কিছুতে ব্যবহার হবে না। কোনও স্কিমই বুঝি সত্যিই মেয়েদের অবস্থা বদলাবে না।
৬ বছর বয়স অবধি ছেলে মেয়ের সংখ্যার আনুপাতিক হার হওয়া উচিত খুব কম করে হলেও ছেলে ১০০০, মেয়ে ৯৫০। বয়স বাড়লে এটি পাল্টে যায়, মেয়ের সংখ্যা বাড়ে, ছেলের সংখ্যা কমে। কারণ ছেলেদের চেয়ে বাঁচার ক্ষমতা মেয়েদের বেশি। যত্নআঙ্গি পেলে মেয়ের সংখ্যা ১০০৫ হয়। সমানাধিকার পেলে মেয়ের সংখ্যা ছেলের অনুপাতে অনেক ওপরে ওঠে। কিন্তু ছ বছর অবধি মেয়ে-শিশুর সংখ্যা যদি ৯৫০এর কম হয়, বুঝে নিতে হবে নির্ঘাত হত্যা করা হচ্ছে মেয়েদের।
অমর্ত্য সেনএর এক গবেষণায় দেখা যায় যে, তিন কোটি সাত লক্ষ মেয়ে এই ভারতে, ১৯৮৬ সালে, ‘মিসিং’। এই যে মেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, এ কিন্তু হঠাৎ করে ঘটছে না। এ বহুকালের পুত্রপিপাসার ইতিহাস। বহু কাল ধরেই অন্যান্য যে কোনও দেশের চেয়ে কম মেয়ে সংখ্যা এই ভারতে। ১৯০১ সালের আদমসুমারিতে দেখা যায় প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সংখ্যা ছিল ১০০০ ছেলেয় মাত্র ৯৭২ মেয়ে। সেই থেকে বছর যত যাচ্ছে মেয়ের সংখ্যা আরও কমছে। ২০০১ সালে ৯৩৩। ১০০০ ছেলেয় ৭০ জন মেয়ে কম। হিসেব তা হলে এই, একশ কোটির দেশে সে বছর ৭ কোটি মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে। এত বিশাল দেশ ভারত, এই ভারতের একটি রাজ্য নেই যেখানে মেয়েশিশু সংখ্যা হ্রাস পায়নি। কিছু কিছু রাজ্যে মেয়েশিশু সংখ্যা ৮০০র নিচে চলে গেছে। পাত্তাব হরিয়ানা হিমাচল প্রদেশ গুজরাট মহারাষ্ট্র। পাঞ্জাবের গুরদাসপুরে তো ১০০০ ছেলেয় ৭২৯ মেয়ে। গুজরাটের মেহসানায় ৭৫২। তামিলনাড়ুর সালেমে যেখানে ৭৬৩, হরিয়ানার আমবালায় ৭৭২। উত্তর প্রদেশের সাহজাহানপুরে ৬৭৮। এসব অঞ্চলে ১০০০এ ২০০ করে মেয়ে বেপাত্তা। পাত্তাব হরিয়ানায় ১৯৯১ সালের পরেই বাজার কথা বিপদঘন্টি। কিন্তু কেউ হয়তো অনুমান করেনি দশ বছরে আরও কত নেমে যেতে পারে সংখ্যা। ১৯৯১ সালে কোনও রাজ্যেই ৮০০র কম মেয়ে ছিল না, কিন্তু দশ বছরের মধ্যেই মোট চারটে রাজ্যে মেয়ের সংখ্যা ৮০০র চেয়ে কম।
এনজিওগুলো বলে যে, নারী শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম হলে মেয়েশিশু বা মেয়েভ্রুণ হত্যা বন্ধ হবে। বেশির ভাগ মানুষের বিশ্বাস পরিকল্পিত মেয়েহত্যা বুঝি গরিব এবং অশিক্ষিতদের মধ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু ঘটনা তার উল্টো। ভারতে সবচেয়ে বেশি ছেলের অনুপাতে মেয়ে কম এখন দক্ষিণ দিল্লিতে, যেখানে শিক্ষিত এবং ধনীদের বাস। সবচেয়ে বেশি বিলুপ্তি ঘটেছে সেখানে। বড় বড় রাজনীতিবিদদের নাকের ডগায় ঘটছে হত্যাযজ্ঞ। ৯০৪ থেকে দশ বছরে ৮৪৫। ২৪,০০০ মেয়েশিশুকে এই দক্ষিণ দিল্লি থেকে প্রতিবছর উধাও করা হচ্ছে। গুজরাটের প্যাটেল বংশে বিস্ময়। ধনী কৃষক ওরা। অথচ মেয়ের চিহ্ন নেই ওদের গ্রামগুলোয়। চঙ্গিগড়ে ৮৫৩ মেয়ে। চঙ্গিগড় শহরে হার আরও কম, ৮৪৪। ভারতে দরিদ্র এবং অশিক্ষিত এলাকার চেয়ে ধনী এবং শিক্ষিত মানুষের এলাকায় মেয়েশিশুর হার কম। হত্যা বেশি হচ্ছে ওখানেই। মেয়েদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে চলছে হলোকস্ট। গণহত্যা। পশ্চিমবঙ্গে অন্য যে কোনও অংশের চেয়ে কলকাতায় মেয়েশিশুর বিলুপ্তি বেশি।
১ কোটি মেয়েভ্রুণের গর্ভপাত হয়েছে ভারতে, গত দু দশকে। ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতার পত্তাশ বছর পূর্তির বছরে পাঁচ লক্ষ মেয়ে ভারতের মাটিতে জন্মানোর স্বাধীনতা পায়নি, যে ভারত কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে গর্ব করে।
এ দেশে মেয়েরা খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে লালন করা নারী বিরোধী কুসংস্কার। বেশ কিছু সম্প্রদায়ে পুত্রদেরই সন্তান বলে মনে করা হয়, কন্যাদের নয়। ১৯৮০ সালের আগ অবধি মেয়েশিশুদের জন্মানোর পর হত্যা করা হত। তখন জরায়ুর ভেতরে থাকা অবস্থায় মারার চল শুরু হয়নি। ভ্রুণহত্যা যে হারে বাড়ছে, এটি নিষিদ্ধ করার পরও, এতে আশংকা হয় যে সমাজে মেয়েদের অবস্থার উন্নতি না হওয়াতক এই হত্যাকাণ্ড, এই রক্তপাত রোধ করার কোনও উপায় নেই। উত্তর ভারত এমন ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যে, আশংকা করা হচ্ছে ২০২১ সালে বোধহয় মেয়ে বলতে কিছুই থাকবে না।
হত্যার মাধ্যমে মেয়েদের নানা ঝামেলা উপদ্রব নির্যাতন নিষ্পেষণ থেকে নিরাপত্তা দেওয়া, সেটা আজকের ঐতিহ্য নয়, বহু বছর ধরেই ছিল। দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে মেয়েরা শিখে আসছে বেঁচে না থাকাটাই এই সমাজে তাদের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। ব্রিটিশরা মেয়েহত্যা এলাকা চিহ্নিত করেছিল তাদের রাজত্বেই। ১৮০৫ সালে সৌরাষ্ট্রের জাদেজা রাজপুতদের মধ্যে মেয়েশিশুহত্যার চল ছিল, ওরা বার করেছিল। পূর্ব উত্তর প্রদেশে একটা গ্রাম ছিল তখন, কোনও মেয়েশিশু ছিল না গোটা গ্রামে। ১৮০৮ সালে বরোদার শাসক আলেকজান্ডার ওয়াকার সমন পাঠিয়েছিল সব সম্প্রদায়ের প্রধানদের কাছে, সবাইকে বলেছিল মুচলেকা লিখে যাও যে মেয়েশিশু হত্যা আর করবে না। ১৮৭০ সালে মেয়েশিশুহত্যা রোধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ১৮৯৮ সালে সরকার মেয়েশিশুহত্যাকে অপরাধ বলে রায় দেয়। মেয়েশিশু হত্যা রোধ আইনও প্রণয়ন করা হয়েছিল, একসময় রাজনৈতিক কারণেই ওটি উঠে যায়।
নৃতত্ত্ববিদরা বলেন, সভ্যতার শুরু থেকে দেখা গেছে যখন খাদ্যের অভাব হয়েছে, মেয়ে আর শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। ডারউইন বলেছেন, মেয়েদের হত্যা করা হত জন্মের সময়, এর কারণ কিন্তু তাদের মৃত্যুটা সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার ছিল বলে নয়। কারণ পুরুষ শাসিত সমাজ মেয়েদেরকে বোঝা বলে মনে করতো। ভারতে সেই উনবিংশ শতাব্দীতে মেয়েশিশুহীন বেশ কয়েকটি গ্রামের কথা নথিপত্র উেল্লেখ আছে। কিছু এলাকায় ছিল ৩৪৩টি ছেলে, ৫৪টি মেয়ে। বোম্বেতে ১৮৩৮টি ছেলে, আর মেয়ের সংখ্যা ৬০৩। আরও পেছনে গিয়ে যদি খুঁজতে যাই, কী পাবো? মেয়েশিশুহত্যার চল হয়তো বৈদিক যুগ থেকেই ছিল। অথর্ব বেদের কথা, ‘মেয়েশিশুকে অন্য কোথাও জন্মাতে দাও, এখানে জন্মাতে দাও ছেলেশিশুকে। পুত্র হল সম্পদ। পুত্র আশীর্বাদ। বৃদ্ধ বয়সে পিতাকে শক্তি দেবে পুত্র। পুত্র মুখাগ্নি করবে পিতার, তাই পিতা স্বর্গে যাবে। পুত্রই পিতাকে নরক থেকে মুক্ত করবে।’ নারীর ভূমিকা কী! নারী পুত্র সন্তান জন্ম দেবে। নারী হচ্ছে জমি, যে জমিতে পুরুষ তার বীর্য নিক্ষেপ করবে পুত্র উৎপন্ন হওয়ার জন্য। মনু বলেছেন, ‘দিন রাত মেয়েদের নির্ভর করতে হবে পুরুষের ওপর।’ বলেছেন, ‘তার পিতা তাকে রক্ষা করে যখন সে শিশু, স্বামী যখন সে যুবতী, পুত্র যখন সে বৃদ্ধা। স্বাধীনতা নারীর জন্য নয়। নারী এর যোগ্য নয়।’ প্রথম মেয়েদেরকে ‘পরনির্ভর’ থাকতে বলা হচ্ছে, তারপর তাদের বলা হচ্ছে, তারা একরকম ‘বোঝা’। তবে সত্য এই, মেয়েদের সেই আদিকাল থেকে এই এখন অবধি পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে রাখা হয়েছে।
দীর্ঘ দীর্ঘ কাল ধরে মেয়েশিশু হত্যা করে এসে এখন মেয়েশিশুর গর্ভপাত ঘটানো ঐতিহ্যের বাইরের কোনও কাজ নয়। এ অনেকটা আগাছা তোলার মতো পুত্রউৎপাদনের জন্য রাখা জরায়ুর মাটি থেকে মেয়ে তুলে ফেলে দেওয়া। এমন পুত্রপিপাসু জাতির জন্য কন্যাহত্যা তো আশ্চর্যের কিছু নয়।
রামচন্দ্রের পিতা রাজা দশরথ পায়েশ খাওয়ালো তিন স্ত্রীকে, অমনি স্ত্রীরা জন্ম দিয়ে দিল চারটে পুত্রসন্তান। পুরাণের সেই জাদুর পায়েশ ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের কোথাও কোথাও এখনও স্ত্রীদের খাওয়ানো হয়, যেন পুত্র জন্ম দেয়।
কারও কারও মতে, সীতা এই সমাজের মেয়েশিশুহত্যাযজ্ঞের শিকার, পরে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। রাজা জনক সীতাকে মাটির তলায় পুঁতে রাখা একটা হাঁড়িতে পেয়েছিল। যেখানে পাওয়া গিয়েছিল, সেখানকার ঐতিহ্য হল—হাঁড়িতে জীবন্ত মেয়েশিশুকে পুরে, এক টুকরো গুড় আর একটু সুতো সঙ্গে দিয়ে হাঁড়ির ঢাকনা শক্ত করে লাগিয়ে মাটির তলায় পুঁতে চেঁচিয়ে লোকে বলতো, ‘গুড় খা, ওখানেই থাক, কখনও ফিরে আসিস না, তোর ভাইকে পাঠিয়ে দে।’ সম্ভবত, ‘রাম এবং সীতা দুজনই সেক্স সিলেকসানের প্রাচীন ফর্মের প্রডাক্ট।’
পুত্র পিপাসায় ধর্মে জাতিতে কোনও ভেদ নেই। বাদশা আকবর পুত্র চেয়ে শেখ সেলিম চিশতির আশীর্বাদ নিল। পুত্র হল। পুজ্ঞের নাম রাখা হল সেলিম আর ফতেপুর সিক্তি নামের চমৎকার একটি শহর তৈরি করা হল পুজ্ঞের জন্ম উৎসব করার জন্য। এ দেশের আনাচে কানাচে গলি ঘুপচিতে আছে ধর্মশালা, যেখানে গিয়ে পুত্র কামনা করা যায়। হিন্দু, শিখ, মুসলিম, বৌদ্ধ সবারই প্রয়োজন পুজ্ঞের। ভারত ছেয়ে যাচ্ছে বাবায়। বাবাদের দ্বারে ধর্না দেওয়া হয়েছে, ফকির কোবরেজ অনেক হয়েছে। ভগবান, বাবা এরা এখন কেউই আর এত পারফেক্ট নয়। বিজ্ঞান পারফেক্ট। বিজ্ঞান এখন মানুষকে ঝাঁড় ফুক তুকতাক ভগবান বাবা থেকে উদ্ধার করতে এসেছে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেও, নানা পুজো আর্চা করেও এত ভালো ফল কোনওদিন পাওয়া যায়নি, বিজ্ঞান যে ফলটি তাদের দিচ্ছে। বিজ্ঞান আসাতে এখন দেখে নেওয়া যাচ্ছে পেটের ভেতর বাচ্চাটির লিঙ্গ, লিঙ্গ পছন্দ না হলেই লিঙ্গসহ বাচ্চাকে হাওয়া করে দেওয়া হচ্ছে। ট্রেডিশান আর টেকনোলজির এমন সমন্বয় পৃথিবীর অন্য কোথাও এত বীভৎস ভাবে নেই।
‘অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভ বিদেয় করা যায় বিজ্ঞানের মাধ্যমে’, বিজ্ঞানের লোকেরা এমন দাবিও করেছিল শুরুতে। স্ক্যান তো আছেই, এলো অ্যামনিওসেনথেসিস। ভ্রুণে কোনও অস্বাভাবিকতা বা ডিফরমিটি বা পঙ্গুত্ব আছে কি না দেখার জন্য। কিন্তু সে উজ্ঞেশে ভারতে এই পরীক্ষাটি করা হয় না। করা হয় লিঙ্গ দেখার জন্য। যেই না স্ত্রীলিঙ্গ, অমনি গুডবাই। এদেশি মানসিকতায় তবে ভ্রুণের অস্বাভাবিকতা লিঙ্গেই লুকিয়ে আছে, পঙ্গুত্ব লিঙ্গেই। স্ত্রীলিঙ্গেই।
দুরকম গর্ভপাত আছে। বৈধ এবং অবৈধ। বৈধ এবং অবৈধের মধ্যে সূক্ষ্ম সুতোর ব্যবধান। গর্ভপাত করা বৈধ, কিন্তু লিঙ্গ নির্ণয়ের পর গর্ভপাত অবৈধ। একজন মেয়ে তার গর্ভপাত বৈধভাবে ঘটাতে পারে যদি ভ্রুণে কোনও অস্বাভাবিকতা পায়। কিন্তু স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিকের মধ্যে পার্থক্যটা কী? ডাক্তারি বিত্তানে যে ভ্রুণকে অস্বাভাবিক ভ্রুণ বলে সেটি আর সুস্থ স্বাভাবিক মেয়েভ্রুণ — এ দুটো এক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। সামাজিকভাবে দু ভ্রুণই অনাকাঙ্ক্ষিত।
অস্বাভাবিক বা পঙ্গু ভ্রুণ এবং মেয়ে ভ্রুণ এ দুটোকে জন্মাতে দিলে অনেক খরচ। মানসিক সুস্থতা আর থাকবে না, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। তার চেয়ে এদের না জন্মাতে দেওয়াই ভালো। এই হল মেয়েভ্রুণহত্যায় বিশ্বাসীদের মত।
গর্ভপাতের ক্লিনিকগুলো একটা বিত্তাপন দেয়। ‘পাঁচশ টাকা খরচা কর, ৫০,০০০ টাকা বাঁচবে।’ অর্থাৎ ‘একে মার। এ বেঁচে থাকলে তোর পত্তাশ হাজার টাকা যাবে পণে।’ এক ২০০৫ সালেই আলট্রাসাউন্ডএর কারখানাই গড়া হয় ৫০০ কোটি টাকার। পুত্রপিপাসুদের জন্য লিঙ্গনির্ণায়ক ক্লিনিকগুলো হল আধুনিক মন্দির।
গর্ভপাতের অধিকারের জন্য ইওরোপ আমেরিকায় দীর্ঘ বছর সংগ্রাম করতে হয়েছে মেয়েদের। গর্ভপাতের অধিকার পাওয়া নারীস্বাধীনতার পক্ষে বিরাট ঘটনা। কিন্তু ভারতবর্ষে একটি বিশেষ লিঙ্গের কারণে যখন গর্ভপাত ঘটানো হয়, এবং সে লিঙ্গটি স্ত্রীলিঙ্গ, তার সঙ্গে তখন আর নারীস্বাধীনতার সম্পর্ক তো থাকেই না, বরং অঙ্গাঙ্গী যুক্ত থাকে নারীর পরাধীনতার করুণ কাহিনী।
ভারতীয়রা যে দেশেই বাস করতে যায়, এক টুকরো ভারতকে সঙ্গে নিয়ে যায়। ইওরোপ আমেরিকায় যেখানেই বাস করুক, পুত্রলিপ্সা তাদের মরে না। ওখান থেকে খরচ কম বলে ভারতে চলে এসে গর্ভপাত ঘটায়। আরও নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার হদিস পাওয়া গেছে, ভ্রুণের অসুখ দেখার আধুনিক পদ্ধতিগুলোর আশ্রয় নিয়ে গোপনে লিঙ্গ দেখছে তারা। ভ্রুণ যদি ভুল লিঙ্গের হয়, চোখ বুজে হত্যা। নিউ জার্সির ভারতীয় পরিবারে মেয়েশিশুর সংখ্যা পাত্তাব হরিয়ানার চেয়ে কিছু বেশি নয়। ভারতীয় মেয়েরা অনেকটা এখন বিলুপ্ত হতে যাওয়া প্রাণী। এনডেনজারড, বাঘের চেয়েও।
আইন দেখাতে গিয়েছিল কেউ কেউ। যে মেয়েরা মেরে ফেলছে নিজের সন্তান, তারা চেঁচিয়ে বললো, ‘আইন? আইন আবার কী? আইন কি আমাকে সাহায্য করতে আসবে যখন আমি আরেকটি কন্যা জন্ম দিলে আমার স্বামী আমাকে তাড়িয়ে দেবে! আইন কি আমাকে সাহায্য করবে যখন আমার স্বামী আরেকটি বিয়ে করবে পুত্রসন্তানের আশায়? আইন কি সমাজের সেই চোখকে বদলাতে পারবে যে চোখ আমাকে মূল্য দেবে না যেহেতু আমার পুত্রসন্তান নেই!’
পুরোনো মেয়েশিশুহত্যার জায়গায় এখন আধুনিক সঙ্গে সিলেকটিভ অ্যাবরশান এসেছে। ডিএনএ টেস্ট, প্রি-জেনেটিক ডায়াগনোসিস টেস্ট। আরও হাই টেক। মেয়েবর্জিত সমাজ চাই, চাইই চাই। সমাজ তো প্রস্তুত নয় মেয়েসন্তানকে মর্যাদা দিতে। কিন্তু আইন বলছে মেয়েসন্তানকে হত্যা করা যাবে না। এদিকে মেয়েরা কারণ দেখিয়ে যাচ্ছে কেন তারা হত্যা করছে তাদের নিজের সন্তানকে। কারণ সমাজ পুত্র চায়, পরিবার পুত্র চায়। পুত্র না জন্ম দিলে জীবনে অশান্তি হচ্ছে। সোজা কথা, সমাজ যেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে, যেটা মানুষের অন্তরে, মুখে অন্য যা কিছু বলুক না কেন, যে, ‘তোমার যদি দুটো পুত্র থাকে, তোমার দুটো চোখ আছে। যদি একটা পুত্র থাকে, এক চোখ অন্ধ। আর যদি তোমার দুটো কন্যা থাকে, তুমি সম্পূর্ণই অন্ধ।’ আইন ভাঙা হচ্ছে। সবাই ভাঙছে। ডাক্তার, নার্স, ধাই, ল্যাবরেটরি, হাসপাতাল সবাই। ৯৪ সালে লিঙ্গ-দেখা পরীক্ষা সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হলেও কারও যেন কিছু যায় আসে না। মানুষের মানসিকতা না পাল্টালে আইন প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার মানসিকতাও পাল্টাবে না যতক্ষণ না আইন প্রণয়ন হবে। কিন্তু এই মানসিকতা, এই নারীবিরোধী মানসিকতা নিয়ে কি মানুষ জন্মায়? তা তো নয়, এ তৈরি করা।
সমাজে অপরাধ যখন বাড়তে থাকে, মেয়ের মূল্যও হু হু করে কমতে থাকে। স্ক্যান মেশিনগুলো যে হয়ে উঠবে এক একটি মানুষ মারার অস্ত্র, তা কে জানতো! পাত্তাব হরিয়ানায় মেয়েশিশুহত্যা ইদানীং ফিরে আসছে। যেহেতু মেয়েভ্রুণহত্যা এখন দিনকে দিন কঠিন হচ্ছে। বেআইনি, তার ওপর এনজিওগুলো ওত পেতে আছে অপরাধী ধরার জন্য। যে সব গ্রামে মেয়েশিশুর সংখ্যা কম, সেসব গ্রামে নার্স বা ধাই মানেই কিন্তু ভয়ংকর। বুঝে নিতে হবে, এই জীবনের দূতগুলোই আসলে মৃত্যুর দূত।
কেন তারা গর্ভপাত ঘটাচ্ছে, কেন মেয়েশিশুকে বাঁচতে দিচ্ছে না। মেয়েরা বলেছে, ‘কেন আমরা বাঁচতে দেব? আমরা কোনও মেয়ে চাই না। কেন আমরা মেয়েদের জন্মাতে দেবো আমরা যে কষ্ট পাচ্ছি তা পাওয়ার জন্য?’ তারা বলে, ‘বেঁচে থেকে আমাদের কী লাভ হচ্ছে? দুঃসহ জীবন শুরু হওয়ার আগেই মরে যাওয়া ভালো। দুনিয়ায় লাত্থি গুতো খেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে সোজা স্বর্গে যাওয়াই ভালো।’ তারা কি ভুল বলে?
পাঞ্জাব হরিয়ানায় এখন ব্যাকল্যাশ শুরু হয়েছে। পাঁচ ভাই-এর এক বউ। বউ কোথায় পাবে, গ্রামে কোনও মেয়ে নেই। বড় ভাইয়ের বউকে বাকি ভাইয়েরা ব্যবহার করছে। এ ছাড়া উপায় নেই। ‘দ্রৌপদী সিনড্রোম’ যাকে বলে। ঙ্গিপালা কুমারি নামে ঝাড়খজ্ঞের এক উপজাতি মেয়েকে এক লোক চাকরি দেবে বলে হরিয়ানায় নিয়ে যায়। সেখানে আজমের সিং নামের এক লোক তাকে বিয়ে করে এবং বলে তার আর ভাইয়ের সঙ্গে শুতে। মেয়ে রাজি হয়নি বলে তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল।
গুজরাটের প্যাটেল বংশে আর মেয়ে নেই। বিহার আর ওড়িষ্যা থেকে গরিব মেয়েদের কিনে নিয়ে আসা হচ্ছে এখন। এই মেয়েরা ক্রীতদাসী আর যৌনদাসী হিসেবে আর পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়ার যন্ত্র হিসেবে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
মেয়েদের মেরে ফেলে এখন মেয়ের অভাব এত তীব্র যে ‘সাতা পাধ্যাতি’ বলে একটি বিনিময়-নিয়ম চালু হয়েছে, ‘আমার মেয়ে বিয়ে দেব ছেলের কাছে একটি শর্তে, বিনিময়ে ছেলের বোনকে চাই, আমার ছেলে যেন বিয়ে করতে পারে।’
নতুন প্রজনন প্রযুক্তি এসে গেছে। মেয়েভ্রুণহত্যা এখন হাই টেক ক্তাইম সবখানে। ‘ভগবানের নিজের দেশ’ কেরালাতেও। মেয়েরা কোথাও নিরাপদ নয়। রাষ্ট্রে, সমাজে পরিবারে কোথাও না। ভাবা হত মায়ের গর্ভ সবচেয়ে নিরাপদ। এখন, মায়ের গর্ভই মেয়েদের জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওখানে মেয়েশিশুর ভ্রুণ আছে, খবর পেলেই মেয়েদের নিরাপত্তা নষ্ট হচ্ছে।
ভারতের দক্ষিণও উত্তরের পথে হাঁটছে।
মেয়েরা শিক্ষিত হলে মেয়েভ্রুণহত্যা রোধ করা যাবে না। শিক্ষিত মেয়েরা অশিক্ষিত মেয়েদের চেয়েও তাদের গর্ভের ভ্রুণকে হত্যা করার পরিকল্পনা খুব ভালো নিতে পারে। শিক্ষিত মেয়েরা যারা দিব্যি আছে, তারাও কেন এ কাজ করছে! এর পেছনে কারণটি হল, ‘আত্মবিশ্বাসের অভাব’। বহু শতাব্দী ধরে হীনমন্যতার চর্চা চলেছে মেয়েদের মধ্যে, ফলে মেয়েদের রক্তে মাংসে মত্তায় জিনে ঢুকে গেছে এটি। প্রচলিত শিক্ষা দিয়ে এটি নির্মূল করা যায় না। মেয়েরা যদি রাজনৈতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতাবান না হতে পারে, ওইসব তথাকথিত শিক্ষা মেয়েদের ক্ষতে আরও নুন ছিটোবে, আর কিছু নয়।
পুরুষেরা শিক্ষিত স্ত্রী চায় আজকাল। তাই মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, বিয়ের বাজারে ভালো বিকোবার জন্য। শিক্ষিত স্ত্রী হলে দোকানপাট করা, বিল মেটানো, বাচ্চাদের পড়াশোনা, ইস্কুলসমস্যা নিজে মেটাতে পারে। এক লোকতো এভাবেই বললো, ‘আমার স্ত্রীর পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি আছে অংকে, ভালো যে সে বাচ্চাদের এখন হোমওয়ার্কে সাহায্য করতে পারে। টিউটর রাখার দরকার পড়ে না তাই। আর স্ত্রী কেন বাইরে চাকরি করবে? সংসারে আমাদের তো বাড়তি টাকার দরকার নেই। তার প্রচুর কাজ পড়ে আছে ঘরে।’
শিক্ষিত নারীদের হাল এই হয় অবশেষে। তাদের উপার্জিত টাকার নাম ‘বাড়তি টাকা’। বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় ডিগ্রি নিজের বাচ্চাদের হোমওয়ার্কে সাহায্য করার কাজে আসে, আর কিছুতে নয়। মধ্যবিত্ত মেয়েরা বিয়ের পর চাকরি করবে না, এরকমই চল। মেয়েদের কাজ হল ঘর সংসার করা। শুধু সেই মেয়েরা বাইরে কাজ করার অনুমতি পায়, যাদের বেঁচে থাকার জন্য টাকার ভীষণ প্রয়োজন হয়। হায় শিক্ষা! শিক্ষিত মেয়েদেরই পণ বেশি দিতে হয়। বেশি শিক্ষিত মেয়েরা বেশি শিক্ষিত স্বামী দাবি করে। শিক্ষিত স্বামী পেতে হলে পণের পরিমাণও যায় বেড়ে। পণ বেশি দিলে অনেকে ভাবে যে বুঝি মেয়েদের মান বাড়লো। পণ দিলে মেয়েদের মর্যাদা কখনও শ্বশুরবাড়িতে বাড়ে না, বরং কমে। যত বেশি পণ দেবে, তত বেশি কমবে। বরের পণ দেওয়ার নিয়ম নেই, যতই শিক্ষিত হোক, যত বড় চাকরিই মেয়ে করুক না কেন। এদেশি পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনই বুঝিয়ে দেয় মেয়েরা এই সংসারে কী মূল্য নিয়ে আছে। ফর্সা, দেখতে সুন্দর, শিক্ষিত, ভদ্র পরিবারের ঘরোয়া মেয়ে চাই। ঘরোয়া মেয়ে মানে যে চব্বিশ ঘণ্টা ঘরসংসার করবে শুধু, বাইরে চাকরি বাকরি করতে যাবে না। ভদ্র পরিবারের মেয়ে মানে যে পরিবার ভালো পণ দেবে। বর সমৃদ্ধ পরিবারের হলে পণ কম দিলেও চলবে তা নয়, বরং আরও বেশি দিতে হয়। এই যদি হয় অবস্থা কেন তবে মানুষের বিশ্বাস হবে না যে মেয়ে জন্মালে খরচ বেশি? মেয়েরা নিচুজাত, এই বিশ্বাস ভারতের নারী পুরুষ সবার মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে। নিচুজাত বলে দূর করতে বা পার করতে পণের প্রয়োজন হয়।
পুরুষও যখন কোনও মেয়েকে টাকা দিয়ে বিয়ে করে, তখন সংসারের জন্য একটি ক্রীতদাসী কেনে সে। আর, কোনও মেয়ে যদি টাকা দিয়ে পুরুষকে বিয়ে করে, মেয়ে নিজের মানমর্যাদাহীন একটি হীন অবস্থান কেনে। মেয়েদের মুক্তি নেই কিছুতে। পণ প্রথা আইন করে নির্মূল হয়নি। ততদিন পর্যন্ত এটি নির্মূল হবে না, যতদিন পর্যন্ত পরিবারের সবাই বিশ্বাস করবে যে একটি মেয়ে কখনও একটি ছেলের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয় না।
সমাজের অনেক বদল দরকার। মেয়েরা যে পরিবারের খুব মূল্যবান সদস্য, কেবল পণের বোঝা নয়, পুত্র উৎপাদনের যন্ত্র নয়—তা সমাজকে বুঝতে হবে। মেয়েদের আত্মবিশ্বাস সবচেয়ে বেশি জরুরি। নারী পুরুষ উভয়ে মিলে সমাজ বদলের চেষ্টা না করলে মেয়ে ভ্রুণ হত্যা চলতেই থাকবে সমাজে।
‘সমাজটা মেয়েদের জন্য মন্দ, তাই মেয়েদের জন্ম দেওয়াই ঠিক নয়।’ এই যুক্তিটা অনেকটা, ‘খুব চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে, নয়েজ পলুশান হচ্ছে, তাই মাথা ধরছে, সুতরাং মাথাটা কেটে ফেলা’র মতো। অনেকে বলে মেয়েরা নিজেরা লিঙ্গ পছন্দ করে শিশুর জন্ম দিলে অনেকগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভ থেকে বাঁচবে। মেয়েরা কিন্তু এতে শেষ পর্যন্ত বাঁচে না, বরং মরে। কতটুকু অসহায় হলে নিজের জরায়ুর ভেতর বাড়তে থাকা ভ্রুণটির ওপর নিজের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না! সামাজিক এবং পারিবারিক চাপের কাছে মেয়েদের বাধ্য হতে হয় গর্ভপাত ঘটাতে। অনেকগুলো অনাকাঙ্খিত গর্ভ কী আর ভয়ংকর, তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর মেয়েদের নিতান্তই এই নিঃস্ব, নিরীহ, নিরুপায়, এই মানমর্যাদাহীন অবস্থা।
এভাবে চললে, যেভাবে চলছে এখন দেশ, খুব বেশি দশকের দরকার হবে না, যখন দেখতে হবে দেশে একটিও মেয়ে নেই, কেবল পুরুষ। ভালো, যে, নির্যাতনের জন্য, নিষ্পেষণের জন্য, ধর্ষণের জন্য, হত্যা করার জন্য পুরুষ আর মেয়ে পাবে না। তখনও সম্ভবত বোধোদয় হবে না পুরুষের।
এ লজ্জা ভারতের, আর কারও নয়। যতদিন না ভারতের নারীরা এ রাষ্ট্রে নির্বিঘ্নে জন্ম নেওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার না পাবে, ততদিন ভুল হবে এ রাষ্ট্রকে গণতন্ত্র বলে মানা।
সূত্র: ডিসঅ্যাপিয়ারিং ডটারস, গীতা আরাভামুদান