৪৪. লিঙ্গ-নিরপেক্ষ বাংলা ভাষার প্রয়োজন

বাংলা ভাষাকে দারিদ্র্যমুক্ত এবং বৈষম্যমুক্ত করে একে আরও সমৃদ্ধ করা যাঁদের দায়িত্ব তাঁরা নিশ্চয়ই খুব বিত্ত, অভিজ্ঞ, ত্তানী এবং গুণী মানুষ। আমি অনুমান করতে পারি, তাঁরা অধিকাংশই পুরুষ। পুরুষ হলেই যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বহন করবেন, তা আমি মনে করি না। তাঁদের এবং সাধারণ জনগণের কাছে লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভাষার উদ্ভাবন এবং প্রচার শুরু করার অনুরোধ করছি। বিশ্বের সভ্য দেশগুলোয় যেখানে নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, সেসব দেশে ভাষাকেও করা হচ্ছে লিঙ্গ নিরপেক্ষ। এই বাংলায় যদি সেটির কোনও উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে বুঝতে হবে, বাঙালি নারী যেভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে আদিকাল থেকে, আচার আচরণে আইনে ঐতিহ্যে ধর্মে সংস্কৃতিতে ভাবে ভাষায়, তেমন খেয়েই যাবে। ইংরেজি ভাষাকে লিঙ্গনিরপেক্ষ করার জন্য যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে বা হচ্ছে, সেসবের সামান্য কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।

যা ছিল–যা হয়েছে/হচ্ছে
ম্যান — হিউম্যান বিং
ম্যানকাইন্ড — হিউম্যানকাইন্ড, হিউম্যানিটি
ম্যান্‌স অ্যাচিভমেন্ট — হিউম্যান অ্যাচিভমেন্ট
ম্যানফুলি — ভ্যালেন্টলি
ম্যানপাওয়ার — ওয়ার্কফোর্স, হিউম্যান এনার্জি,
হিউম্যান — রিসোর্সেস
ম্যান মেইড — হিউম্যান ইনডিউজড
ব্রাদারহুড অব ম্যান — হিউম্যান ফেলোশিপ, হিউম্যান কিনশিপ
ব্রাদারলি — ফ্রেঞ্চলি
ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ — হাজবেন্ড অ্যান্ড ওয়াইফ
বিজনেসম্যান — বিজনেস ম্যানেজার
ক্যামেরাম্যান — ফটোগ্রাফার, ক্যামেরা অপারেটর, ক্যামেরা ক্তু
ক্রাফটসম্যান — ক্রাফটওয়ার্কার, আর্টিসেন
ক্রাফটম্যানশিপ — ক্রাফট, ক্রাফট স্কিল্‌স
ফেলো কান্ট্রিম্যান — কমপ্যাট্রিয়ট
ফোরম্যান — সুপারভাইজার
জেন্টেলম্যানস অ্যাগ্রিমেন্ট — অনারেবল অ্যাগ্রিমেন্ট
ল্যান্ডলর্ড — ওউনার, প্রোপ্রাইটর
লেম্যান — লেপারসন, নন প্রফেশনাল
অমবুডসম্যান — মেডিয়েটর
পুলিসম্যান — পুলিস, পুলিস অফিসার
সেল্‌সম্যান — সেল্‌স অ্যাসিসটেন্ট
স্পোর্টম্যান — স্পোর্টপারসন
স্পোর্টসম্যান — অ্যাথলেট, স্পোর্টসউওম্যান (প্রয়োজনে)
ওয়ার্কম্যান লাইক — ওয়েল একজেকিউটেড
জন অ্যান্ড মেরি হ্যাভ ফুল — জন অ্যান্ড মেরি হ্যাভ ফুল
টাইম জব্‌স, হি হেল্পস হার — টাইম জব্‌স, দে
উইদ দ্য হাউজওয়ার্ক — শেয়ার হাউজওয়ার্ক
ট্রান্সপোর্ট উইল বি প্রোভাইডেড — ট্রান্সপোর্ট উইল বি প্রোভাইডেড ফর
ফর ডেলেগেট্‌স এণ্ড দেয়ার — ডেলেগেট্‌স অ্যান্ড ফর দেয়ার
ওয়াইভস — স্পাউসেস অর পারসন্স, অ্যাকোমপ্যানিং দেম
দ্য ডকটর .. হি — ডকটরস… দে
দ্য নার্স.. শি — নার্সেস… দে
উওম্যান ডক্টর, মেইল নার্স — ডক্টর, নার্স
মাদারিং — প্যারেন্টিং, নার্চারিং, চাইল্ড রিয়ারিং
হাউজওয়াইফ — হোমমেকার
ফোরফাদার্‌স — অ্যানসেসটর্‌স
ফাউনিডং ফাদার্স — ফাউন্ডার্স
উওম্যান ড্রাইভার — ড্রাইভার
গানম্যান — শুটার
দ্য কমন ম্যান — দ্য অ্যাভারেজ পারসন, অরডিনারি পিপল

বাংলা ভাষাটিকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ (এবং প্রয়োজনে লিঙ্গ-নির্দিষ্ট) করা হলে ভাষা একটি সভ্য ভাষা হবে, নয়তো এটি পুরুষতান্ত্রিকই রয়ে যাবে, যেমন আছে। অভিধান সংশোধন করতে হবে সবার আগে।

শারীরিক যে পার্থক্য পুরুষ নারীতে আছে, তা তো আছেই। তার বদলের কথা হচ্ছে না। নারী আর পুরুষের ভূমিকা এক এক সমাজে এক এক সময়ে এক একরকম ছিল। নারী ও পুরুষ হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সুযোগ সুবিধে হেরফের করা হয়। নারী এবং পুরুষদের কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এই ভাগটি করেছে পুরুষেরা। নারীকে দেশের লোকনীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ, সিদ্ধান্ত-নির্মাণ — এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিতে বাধা দেওয়া হয়। লৈঙ্গিক সাম্যের কথা বললে অনেকে ভাবে পুরুষ ও নারীকে বুঝি এক করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তা নয়, পুরুষ হোক নারী হোক, সুযোগ সুবিধে যা পাবে, সমান পাবে — এই হল দাবি।

‘অবলা’ যে অর্থে ব্যবহার হয়, সেই অর্থে ‘অবল’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে হবে। পুরুষ যদি বলহীন এবং দুর্বল হয় তবে তাদের অবল বলে ডাকতে হবে, যেমন ডাকা হয় নারীদের অবলা। কুমারী, সতী, রক্ষিতা, পতিতা, বারাঙ্গণা, বারবণিতা, গণিকা, বেশ্যা, ডাকিনী, কলঙ্গিনী, কুলটা, উপপত্নী, মাগ, মাগী, অসতী, দ্বিচারিণী, রূপোপজীবিনী, দেহোপজীবিনী, ছিনাল, খানকি ইত্যাদির পুং প্রতিশব্দ প্রস্তুত করা হোক, নয় এই শব্দগুলোর ব্যবহার বন্ধ করা হোক।

যে অর্থে কুমারী এবং সতী শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হয়, সেই একই অর্থে কুমার আর সৎ ব্যবহৃত হয় না। শব্দে নতুন অর্থ স্থাপন করারও খুব প্রয়োজন। সতী/অসতী শব্দদ্বয়ের পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ তৈরি করতে হলে সত/অসত-এর কথা ভাবা যায়। সৎ-অসৎ যেমন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে, তেমনই হবে। জানি জোর করে কোনও নতুন শব্দ ভাষায় ঢোকানো যায় না। কিন্তু মানুষের মধ্যে সচেতনতা এলেই নতুন শব্দ এবং বাক্যের ব্যবহার হয়, এবং এর প্রচলন শুরু হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বাংলা ভাষাটিকে অত্যন্ত নারী বিরোধী ভাষায় পরিণত করেছে। গালিগালাজ আর যৌন রসাত্মক কৌতুক বাজারে যা চিরকালই চলছে, প্রায় সবই নারী-বিরোধী। নারীকে ভয়ংকরভাবে অপমান করেই হো হো করে তুমুল হেসে ওঠে সমাজ।

যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশে নারীরা বাস করছে, কোনওদিনই সেখানে নারী তার সমানাধিকার পাবে না, যদি এই পরিবেশটি নারীকে বর্জন করে কোনওভাবে।

চলতে ফিরতে আমি পুরুষতান্ত্রিক বাক্যের সম্মুখীন হই প্রতিদিন। ধরা যাক সুব্রত আমাকে নেমন্তন্ন করলো, আমি যাবো, সিদ্ধান্ত নিলাম সঙ্গে আমার এক বন্ধু অমিতকে নেব আমি, যেই না বললাম অমনি সুব্রত অমিতের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চাইবে, বলে দেবে অমিত যেন আমাকে অমুক ঠিকানায় সুব্রতর বাড়িতে নিয়ে যায়। অমুক ঠিকানা অমিত তার বাপের জন্মে চেনে না। যদি চেনে কেউ, সে আমার গাড়ির ড্রাইভার, আর গাড়িতে যে ম্যাপ আছে, সেই ম্যাপ দেখে ঠিকানা খুঁজে বার করতে পারি আমি, যেটি অমিতের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। আমার গাড়িতে আরাম করে বসে অমিত গান শোনে। আর, হয় ড্রাইভার নয় আমি ঠিকানা খুঁজে বার করি। সুব্রতর বাড়িতে যাওয়ার পর সুব্রত এবং তার বাড়ির সকলে আর তার বন্ধুরা এই খবরটি জানে এবং লোককে জানায় যে অমিত নামের একটা ছেলে আমাকে তার বাড়ি নিয়ে গেছে।

কোথাও নেমন্তন্নে গেলে যেখানে প্রচুর লোক লক্ষ্য করেছি একলা মেয়েদের জিজ্ঞেস করে, ‘কার সঙ্গে এলে বা কে নিয়ে এলো তোমাকে?’ একলা ছেলেদের এ কথাটা জিজ্ঞেস করে না কে নিয়ে এলো। মেয়েরা একা কোথাও যেতে পারে না এই বিশ্বাস থেকে ভাষার এই ব্যবহার।

দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিনই পুরুষকে প্রধান করে যেসব বাক্য ব্যবহার হচ্ছে, কারও কানে বা মনে কোনো খটকা লাগে না শুনে। ‘সুব্রত এই মাত্র তার বউকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।’ এর বদলে বলা তো যায় ‘সুব্রত আর ঋতুপর্ণা এই মাত্র বেরিয়ে গেল!’ ‘দে আর মেকিং লাভ’ বাংলা কথ্যভাষায় এমন শব্দ প্রচলিত নয়, যা প্রচলিত তা হল ‘ছেলেটা মেয়েটাকে করছে।’ এতে দুজনকে দিয়ে কোনও কাজ করানো হচ্ছে না। তাতে দুজনের ইনভলভমেন্ট নেই। একজনকে অ্যাকটিভ, আরেকজনকে প্যাসিভ ধরা হচ্ছে।

কবি আর মহিলা-কবি, এরকম বলা হচ্ছে অনেক যুগ। নারী পুরুষ উভয়ের জন্য ‘কবি’ শব্দটি ব্যবহার করা জরুরি, কিন্তু তা না করে মেয়েদের যদি ‘মহিলা-কবি’ বলা হয়, তবে পুরুষদের শুধু কবি না বলে ‘পুরুষ কবি’ বলা উচিত। একই রকম সাংবাদিক আর মহিলা সাংবাদিক। হয় দুজনের জন্য সাংবাদিক। নয় একজন পুরুষ-সাংবাদিক, আরেকজন মহিলা-সাংবাদিক।

তোমরা ক-পুরুষ বাস করছো এখানে?’ না বলে, ‘তোমরা ক-প্রজন্ম বাস করছো এখানে?’ ‘তোমার পূর্ব পুরুষ কোথায় বাস করতো?’ র বদলে ‘তোমার আগের প্রজন্ম কোথায় বাস করতো?’

‘আমার কর্তা কলকাতায় নেই’ না বলে ‘আমার স্বামী’, বা যদি নাম হয় কল্যাণ তবে ‘কল্যাণ কলকাতায় নেই।’ স্বামীকে ‘অ্যাই, অ্যাই শুনছো, কই গো, পিংকির বাবা কোথায় গেলে’ এভাবে না ডেকে সোজা নাম ধরে, যদি নাম হয় অভীক, ডাকতে হবে অভীক।

বাংলাকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভাষা করার ক্ষেত্রে একটা বড় সুবিধে আছে। সুবিধেটি হল ইংরেজির হি এবং শি বাংলায় ‘সে’। হিম/হার/হিজ/ সবই তার/তাকে। নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে এই একই শব্দের ব্যবহার ভাষাটিকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ হওয়ার পক্ষে ব্যাপক সম্ভাবনা দিচ্ছে।

সব সময় স্বামী-স্ত্রী ব্যবহার করা কেন? স্ত্রী-স্বামীও তো ব্যবহার করা যায়। উত্তমস ুচিত্তার জায়গায় সুচিত্তা-উত্তমও বলা চলে বিকল্প হিসেবে।

ভাষাকে শুদ্ধ করার কথা এই কারণেই বলা হচ্ছে, যে, ভাষা শুধু যে আমাদের মানসিকতার প্রতিফলন তাই নয়, ভাষা আমাদের মানসিকতাকে গঠন করেও বটে। এমন ভাষা যদি সারাক্ষণ ব্যবহার করা হয়, যে ভাষা নারীকে দুর্বল, পরনির্ভর, নিচুশ্রেণীর জীব হিসেবে চিহ্নিত করে, তাহলে এই ধারণাটি মানুষের মানসিকতার মধ্যে অজান্তেই ঢুকে বসে থাকে নারীরা বুঝি সত্যিই দুর্বল, পরনির্ভর, নিচুশ্রেণীর জীব।

আধুনিক হচ্ছে জগত। সাম্যের আর সমানাধিকারের বোধ বাড়ছে মানুষের মধ্যে। নারী শেকল ছিড়ে বাইরে বেরোচ্ছে। আমাদের চিন্তাভাবনা ধ্যান ধারণার বিবর্তন হচ্ছে, তবে ব্যবহৃত ভাষাটির বিবর্তন নয় কেন?

ভাষা খুব শক্তিশালী জিনিস। সাহিত্যিকেরা জানেন, বৈষম্যের শিকার যে নারীরা, তাঁরাও জানেন ভাষার শক্তি কী ভয়ংকর। যে সমাজে যত বেশি মানুষ ভাষার শুদ্ধতা আনার চেষ্টা করবে, সে সমাজ তত সভ্য হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *