আমার পশ্চিমী বন্ধুদের প্রায় অর্ধেকই সমকামী। সে কারণে ইওরোপ আমেরিকার সমকামী বারে রেস্তোরাঁয় নৃত্যমজ্ঞে আমার প্রচুর যাওয়া আসা। নিউইয়র্কে সমকামীদের যে বিশাল গে প্রাইড প্যারেড হয় প্রতিবছর, সেটিতেও সমকামী-সমর্থক হিসেবে নেমে গেছি মহানন্দে। সমকামীরা তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করছে বহু বছর। অনেক অধিকারই অর্জন হয়েছে, অনেক বাকি রয়ে গেছে। উত্তর ইওরোপের দেশগুলোয় সমকামীরা সবচেয়ে বেশি অধিকার পায়। ওখানে বিয়ে তো বটেই, দণ্ডক সন্তানের উত্তরাধিকারের ব্যাপারে যে প্রশ্ন ছিল, সেটিরও ফয়সালা হয়ে গেছে। ওসব দেশে সমকামীরাও আজ রাষ্ট্রপ্রধান, আজ প্রধানমন্ত্রী।
সমকামীদের অধিকারকে সমর্থন যে করে না, সে মানবাধিকারকে সমর্থন করে না। প্রতিটি মানুষেরই অধিকার আছে নিজের যৌনইচ্ছের প্রকার এবং প্রকৃতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া, সেই মতো সঙ্গেী খুঁজে নেওয়া, এবং একত্রবাস করা। একত্রবাস করছে আমার অনেক সমকামী বন্ধু। দুএকজন শখ করে বিয়ে করেছে। দণ্ডক নিয়েছে কিছু সমকামী পুরুষ-বন্ধুজুটি। সেদিন প্যারিসে আমার দুই সমকামী মেয়ে-বন্ধুর সাজানো সংসারে গিয়ে দেখলাম একজন সবে মা হয়েছে। কী ব্যাপার, স্পার্ম পেলে কোজ্ঞেকে? কোন পুরুষের সঙ্গে শুয়েছো? না, শুয়ে নয়। স্পার্ম নেওয়া হয়েছে তাদেরই এক সমকামী পুরুষ বন্ধু থেকে। সমকামী মেয়ে-বন্ধু দুজনই নবজাতক শিশুটিকে একইরকম আদরে লালন পালন করছে। পুরুষ এবং নারী যখন শিশুর বাবা মা, তখন কিন্তু শিশুর লালন পালন একা নারীকেই করতে হয়, বাচ্চাকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো, বাচ্চার কাঁথা কাপড় পাল্টানো ইত্যাদি হাজার রকম কাজের ক’টি পুরুষ করে?
পেরেন্টস যদি দুজনই নারী হয়, তবে শিশুর যত্ন যেমন বেশি হয়, তেমনি শিশুও বড় হয় বৈষম্যহীন একটি পারিবারিক পরিবেশে। শিশুর লালন পালনের ভার একজনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় না। সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হল, দুই নারীর সংসারে উঁচুলিঙ্গ উচুঁনাক আর মানকচু মাচোঘেঁচুর ঝামেলা নেই।
সেদিন এই কলকাতায়, যে কলকাতাকে বিরাট এক প্রগতিশীল শহর আর ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলে বেশিরভাগ লোক বিশ্বাস করে, সেখানে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখা এক সমকামী মেয়ে আমার কাছে বললো এসে তার যন্ত্রণার কথা। কোনও পুরুষকে সে বিয়ে করেনি। বাবা মা ক্ষুব্ধ। মেয়েটির পছন্দ মেয়ে। মেয়ে নিয়ে সে ঘরে গেলে লোকে নিন্দে করে। পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে গেছে। এই মেয়ে নাকি ‘খারাপ’। একত্রবাস চায় সে তার প্রেমিকাটির সঙ্গে। সম্ভব নয় এই কলকাতা শহরে। বলতে বলতে মেয়ে কাঁদছিল। বললাম, ‘লোকে যা ইচ্ছে তাই বলুক, তোমার যেটা ভালো লাগে সেটা করবে।’ বললাম বটে, কিন্তু মেয়ে কী করে টিকে থাকবে শহরে! একে তো বাঁচতে দেবে না। সমকামী হওয়ার অপরাধে এখন চাকরি চলে যাচ্ছে মানুষের। মেয়েটি চাকরি যাবার ভয়ে, পাড়া থেকে তার অপসারণের ভয়ে নীল হয়ে থাকে। আমার খুব কষ্ট হয় মেয়েটির জন্য, তার দুর্ভোগের জন্য। কষ্ট হয় পচা পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক প্রথায় পড়ে থাকা রক্ষণশীল হোমোফোবিকদের জন্য। তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য।
যেখানে মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়াটাই একটা অভিশাপ, সেখানে সমকামী হওয়া যে ঠিক কী রকম, তা অধিকাংশ মানুষের বোঝার ক্ষমতা নেই। সমকামের বিরুদ্ধে আইন আছে, ধরা পড়লে দশ বছরের কারাদণ্ড, হ্যাঁ, এই গণতন্ত্রের দেশে। অবিশ্বাস্য বটে। গণতন্ত্রের এই দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আর মানবাধিকারের লঙ্ঘন কী অবলীলায় করা হয়! ক’জন প্রতিবাদ করে?
সরকারি হিসেবে এ দেশে প্রতি ঘণ্টায় একটি করে মেয়ে ধর্ষিতা হচ্ছে, প্রতি ছ ঘণ্টায় একটি করে মেয়েকে পণ না দেওয়ার অপরাধে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, এবং অবৈধ গর্ভপাতের শতকরা আশি ভাগ শিশুই মেয়ে। হ্যাঁ, ধর্ষিতা হওয়ার, নির্যাতিত হওয়ার, মরে যাওয়ার অধিকার মেয়েদের আছে, কিন্তু অন্য একটি মেয়েকে ভালোবাসার অধিকার নেই। ভালোবাসতে হবে পুরুষকে, প্রেম দিতে হবে পুরুষকে, পুরুষকে উৎসর্গ করতে হবে জীবন। তা না হলে এই পুরুষতন্ত্রে এক তিল ঠাঁই নেই তোমার।
আমার এক ইওরোপীয় সমকামী মেয়ে-বন্ধু এসেছিল দুবছর আগে কলকাতায়। একটা এনজিওর কাজে সে শহরে তো বটেই গ্রামে গঞ্জেও ঘুরে বেড়ালো দু’মাস। ইওরোপে ফিরে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা তার। বললো কী কী করেছে, বললো অন্তত বারোটি মেয়ের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্কের হয়েছে।
‘বল কী?’ আমি চমকে উঠি। ‘ওরা রাজি হল?’
মেয়েটি বললো, ‘নিশ্চয়ই রাজি।’
‘বিবাহিত?’
‘হ্যাঁ বিবাহিত। কিছু আবার অবিবাহিতও।’
‘আড়ষ্ট নয়?’
‘মোটেও না।’
‘খুব কষ্ট হয়নি বিছানায় নিতে?’
‘মোটেও না। ঠোঁটে চুমু খেতে খেতে বুকে আলতো করে আদর করে দিতেই দেখি গলে পড়লো।’
‘আর বিছানায়..? জানে কিছু?’
‘একটু গাইড করলেই পারফেক্ট।’
‘আর অরগাজম?’
‘তীব্র অরগাজম পেল। মনে হয় পুরুষদের কাছ থেকে পায়নি কখনও।’
আমার বন্ধুটির কাছে অসমকামী বা হেটারোসেক্সুয়াল বলে পরিচিত মেয়েদের আচরণ খুব স্বাভাবিক বলে মনে হলেও আমি একটু ভাবনায় পড়লাম। মেয়েরা নিজেদের যৌনতার অবদমন করে চলেছে বছরের পর বছর! একটু কেবল স্পর্শের অপেক্ষায়। দুফোঁটা জলের অপেক্ষায় আগুন!
পুরুষের কাছ থেকে সুখ না পেয়ে পেয়েই যে মেয়েরা সমকামী হয়, তা নয়। মেয়েদের ভালোবেসেই মেয়েরা সমকামী হয়। ভালোবেসে স্পর্শ করতে জানে ক’টা পুরুষ! পুরুষ যেটা খুব ভালো জানে, তা হল ধর্ষণ। পিতৃতন্ত্রের মন্ত্র যদি মেয়েদের মস্তিষ্কে কৃঙ্গিমভাবে ঢোকানো না হত, মেয়েদের যদি অসভ্য তন্ত্রে মন্ত্রে অন্ধ করা না হত, বেশির ভাগ মেয়েই হয়তো সমকামী হত। সমকামীতার অভিজ্ঞতা আমারও আছে এবং আমি হলফ করতে বলতে পারি ওই দিনগুলোয় আমি খুব সুখে এবং স্বস্তিতে ছিলাম, নির্ভাবনায় ছিলাম, ভেতরে বাইরে তৃপ্ত ছিলাম।
যেই না পুরুষে ফিরেছি অমনি দুশ্চিন্তা, দুর্ভোগ, অমনি অশান্তি আর অসন্তোষ। দুর্ভাগ্যক্তমে শরীর আমার পুরুষকামী, তা না হলে সমকামী হয়ে সমাজকে দেখিয়ে দিতাম কী করে ভালোবাসতে হয়, একত্রবাস করতে হয়, এবং লক্ষ লোকের সামনে চেঁচিয়ে বলতে হয় যে ‘সমকামী হওয়ার সবরকম অধিকার আমার আছে, আমি সমকামী, আমি আমাকে নিয়ে লঙ্গিত নই, গর্বিত।’
তাদের জন্য আমার লজ্জা হয় যারা অন্যের যৌন ইচ্ছের লাগাম টেনে জীবন পার করে। এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই সংখ্যাটিই সমাজে বেশি।
কলকাতার যে সমকামী মেয়েটি আমাকে বলতে এসেছিল তার কষ্টের কথা, বলেছিল, সমাজ যেদিন, যদি কোনওদিন, স্বীকার করে সমকামীদের, সেই সুদিনের জন্য সে অপেক্ষা করছে। আমি বলেছি, ‘সমাজ কোনওদিন এই কাজটি করবে না।’ তাকে বলেছি ‘কিছুকে পরোয়া করো না। বরং মুখ ফুটে নিজের দাবি জানাও। জোর গলায় জানাও। পৃথিবীতে সমকামীরা আন্দোলন করেছে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য, তাদের অধিকার কেউ তাদের হাতে দিয়ে বলেনি যে এই নাও, দিলাম। কোনও সমাজই এত মানবিক কোনওকালেই ছিল না।’
সমকামীদের বেরিয়ে আসতে হবে গর্ত থেকে। যতদিন তারা গর্তের মধ্যে থাকবে ততদিন লোকের সুবিধে হবে তাদের ঘৃণা করতে, এবং ভয় পেতে। বেরিয়ে এলেই লোকে টের পাবে যে তারা তাদেরই মতো মানুষ, তারা তাদেরই ভাই বোন। তাদেরই স্বজন।
লেসবিয়ান শব্দটি এসেছে গ্রীসের লেসবো নামের একটি দ্বীপ থেকে, যে দ্বীপে খ্রিস্টের জন্মের সাড়ে তিনশ বছর আগে জন্মেছিলেন স্যাফো নামের এক কবি। যে কবি নিজে নারী এবং অন্য নারীর প্রতি তার প্রেম এবং যৌনআকর্ষণের কথা প্রকাশ করেছেন। বাংলায় আমরা লেসবিয়ানদের সমকামী বলি। শব্দটি সুন্দর। কিন্তু শব্দটিতে শুধু কামের উল্লেখ আছে, ভালোবাসার নেই। সমকামী জুটিরা কিন্তু পরস্পরকে ভালোবাসে। কাম তাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে না, টিকিয়ে রাখে প্রেম। অনেকসময় দেখেছি সমকামীরা যত মূল্য দেয় প্রেমের, অসমকামীরা তত দেয় না।
টেনিস খেলোয়াড় মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার প্রাক্তন প্রেমিকা আমেরিকান লেখক রিতা মে ব্রাউন সমকামীদের প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মেয়েরা যারা মেয়েদের ভালোবাসে তারা লেসবিয়ান। পুরুষ, যেহেতু তারা মেয়েদেরকে যৌনসামগ্রী বলে ভাবে, লেসবিয়ানের সংত্তা দেয় ভিন্নভাবে, তাদের মতে লেসবিয়ান মানে হচ্ছে দুই নারীর মধ্যে যৌনসম্পর্ক। আরও বলেছেন—No government has the right to tell its citizens when or whom to love. The only queer people are those who don’t love anybody.
সরকারের যেমন অধিকার থাকা উচিত নয় জনগণের প্রেমজীবনে নাক গলাবার, আমাদের তেমন দায়িত্ব আছে জনগণের অধিকারের জন্য লড়ার। আমরা যারা মানবাধিকারে বিশ্বাস করি, কেন অসমকামী আর সমকামী সবার জন্য এই গণতন্ত্রের দেশে সমানাধিকারের ভিত্তিতে সভ্য আইন প্রণয়নের জন্য আন্দোলন করছি না! আমরা আর কতকাল ঘৃণায়, হিংসেয়, যুদ্ধে, রক্তপাতে বিশ্বাস করবো, আর কতকাল ভালোবাসায় বিশ্বাস না করবো ! আর কতকাল প্রেমকে ছিছি করবো, চুম্বনকে সেন্সর করবো, যৌনতাকে নিষিদ্ধ করবো! আর কতকাল আমরা সভ্যতার নামে অসভ্যতা করে যাবো?