‘নিঃশব্দ’ দেখে এসে আমার মনে হচ্ছিল, ‘এর উল্টোটি কি হতে পারতো? ষাট বছরের একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে আঠারো বছর বয়সী একটি ছেলে, এই গল্প নিয়ে সিনেমা?’ না, হতে পারতো না। পুরুষ সে যত বৃদ্ধই হোক, যত কুৎসিত হোক, সে পুরুষ। সে বিরাট সে মহান। তাই বিরাটের প্রেমে পড়া সহজ। ষাট বছরের নারী সে যা কিছুই হোক, যত ত্তানী হোক, যত গুণী হোক, যত আকর্ষণীয় ব্যক্ততি্বের অধিকারী সে হোক না কেন, তার একটিই পরিচয় সে বৃদ্ধা, লোলচর্মসর্বস্ব বৃদ্ধা। নারীকে বিচার করা হয় তার শরীর দিয়ে। শরীর গেল তো নারী গেল। পুরুষ যায় না। অমিতাভ তাঁর বলিরেখা নিয়েও কিশোরীর প্রেমিক হতে পারেন, মেগাস্টার হিসেবে ভূভারতে চুটিয়ে রাজত্ব করতে পারেন। মাধবী কিন্তু তাঁর বলিরেখা নিয়ে আর যাই হোন, তারকা হতে পারেন না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর লোলচর্ম নিয়েও তারকা হয়ে শহর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সুচিত্তা সেনকে বছরের পর বছর ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে। রেখাকে টিকে থাকতে হয় বলিরেখা নির্মূল করে, অমিতাভর তার দরকার পড়ে না।
এ কেবল উদাহরণ মাত্র। সমস্যা সিনেমা জগতে নয়। সমস্যা সমাজে। মেয়েদের সৌন্দর্যই মেয়েদের সম্পদ, এই ধারণা বা বিশ্বাসটি সম্পূর্ণই রাজনৈতিক। রাজনৈতিক, কারণ এটি পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখছে। মেয়েদের সৌন্দর্যকে মেয়েদের সম্পদ বলে বিবেচনা করা না হলে মেয়েদের শিক্ষা সচেতনতা, বোধ বুদ্ধি, দক্ষতা বিচক্ষণতা ইত্যাদি গৌণ না হয়ে মুখ্য হয়ে উঠবে। উঠলেই বিপদ পুরুষতন্ত্রের। নারীকে আর খেলনা পুতুল বানিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
কোনও একটি ব্যবস্থাকে যদি দীর্ঘ-দীর্ঘকাল সমাজে টিকিয়ে রাখতে হয়, তবে সেটির পেছনে তুখোড় রাজনীতি কাজ করে। শিশুকে জন্মের পর থেকে লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্যে লালন করা, এবং মস্তিষ্কে পুরুষ সামনে, নারী পেছনে, পুরুষ বুদ্ধিমান, নারী বোকা, পুরুষ প্রভু, নারী দাসী-র শিক্ষাটি ঢুকিয়ে দেওয়া সামাজিক নয়, রাজনৈতিক। পুরুষতন্ত্রের বা পুরুষবাদের রাজনীতিটি এত শক্তপোক্ত যে জগতে পুঁজিবাদে চিড় ধরে, সমাজতন্ত্র ভেঙে যায়, কিন্তু পুরুষতন্ত্র যেমন ছিল তেমনই দাঁড়িয়ে থাকে, আগের চেয়ে আরও মজবুত হয়ে।
নারীর কিছুই নারীর নিজের নয়। নিজের যে জীবন, সে জীবনটিও নারীর নয়। নারী পুরুষের সম্পত্তি, শুধু পুরুষেরই নয়, পুরুষ শাসিত এই ‘সমাজের সম্পত্তি’। সমাজ কড়া নজর রাখে নারীর যৌনাঙ্গ অক্ষত আছে কি না, নারীর পোশাক আশাক চাল চলন ‘সঠিক’ কি না, বয়স থাকতেই বিয়ে হল কি না, স্বামীসেবা ঠিকঠাক সে করছে কি না, পুত্রসন্তান জন্ম দিচ্ছে কি না, সতীলক্ষ্মী হিসেবে জীবন পার করছে কি না। সমাজকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে সমাজ নারীর শাস্তির ব্যবস্থা করে। কঠিন শাস্তি।
নারীর সতীত্বের দিকে লোকের যে কড়া নজর ছিল, সেটি এখন, বিশেষ করে পশ্চিমের দেশগুলোতে, সরে এসেছে নারীর শরীরের আকার আকৃতির দিকে। পুবের দেশে এখনও কড়া নজর সতীত্বের দিকে যেমন ছিল, তেমন আছেই, বরং নতুন একটি নজর তৈরি হয়েছে, সেটি মেয়েদের শরীরের দিকে। গলা, ঘাড়, বুক, পেট, তলপেট, উরু, পা ইত্যাদির আকৃতি কেমন হবে, তা বলে দেওয়া আছে, সেই মতো না হলে মেয়েদের ওপর হুমকি আসে, ধিত্তার আসে, ছিছি আর চুকচুক চলে। অল্প বয়সী মেয়েরা মেয়ে-পছন্দের বাজারে টিকে থাকার জন্য খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বুলেমিয়া, অ্যানোরেঙ্গিয়া রোগে ভুগছে। শরীরের কোন আনাচে কোন কানাচে কী খাঁজ কী ভাঁজ থাকলে লোকের চোখ জুড়োবে, তার পেছনে মেয়েরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাচ্ছে। জায়গা মতো ভাঁজ চাই, বেজায়গায় ভাঁজ পড়ে গেলে মাখতে হচ্ছে ভাঁজ দূর করার দামি ওষুধ, তাতেও কাজ না হলে দৌড়োতে হচ্ছে কসমেটিক সার্জারির জন্য।
আহা, উনবিংশ শতাব্দীতে মেয়েদের মডেল করে যত বিখ্যাত রংচিত্র আর ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে, আজ দেখলে কি মনে হবে না, সব মেয়েই বুঝি ন’ মাসের গর্ভবতী ছিল! মেয়েদের যে শরীরটিকে কিছুকাল আগেও স্বাভাবিক বলে ভাবা হত, আজ সেটিকে অস্বাভাবিক বলা হচ্ছে। মেয়েদের শরীর কী হবে কেমন হবে তার সিদ্ধান্ত মেয়েরা কোনওদিনই নিতে পারেনি। যে মেয়েরা পুরুষতন্ত্রের কোলাবরেটর হিসেবে নাম করছে, সেই আধুনিক মেয়েরা এখন মেয়েদের সাজাবার দায়িত্ব নিয়েছে। পণ্যকে আরও আকর্ষণীয় পণ্য হিসেবে পুরুষের সামনে পরিবেশন করার দায়িত্ব।
‘মেয়েরা সুন্দর’, — নারী-প্রগতির বিরুদ্ধে এটি একটি ধারালো রাজনৈতিক অস্ত্র। মেয়েদের এই সৌন্দর্য যেন টিকে থাকে, তারা যেন অসুন্দর হিসেবে চিহ্নিত না হয়—এই চাপটি মেয়েদের ওপর প্রচণ্ড। তাদের এখন দিনরাত গাধার খাটনি খাটতে হচ্ছে, অঢেল খরচা করতে হচ্ছে প্রসাধনের পেছনে। দিনে কত কোটি টাকার প্রসাধন সামগ্রী মেয়েরা ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে! মুখে, গালে, নাকে, চোখে, ভুরুতে, চুলে, চিবুকে মাখবার জন্য কত রং, কত কেমিক্যাল, কত আঠা, কত কালির এখন রমরমা বাজার! কেন? মুখ যা আছে তার, তা যথেষ্ট নয়? গাল চোখ ভুরু পারফেক্ট নয়? মেয়েরা তবে কি জন্মায় ‘ইমপারফেক্ট’ হয়ে? অ্যাবনরমাল হয়ে? পঙ্গু হয়ে? তাই কি তাদের এটা ঝরিয়ে, ওটা বাড়িয়ে, এটা মাখিয়ে, ওটা তাড়িয়ে পারফেক্ট হতে হবে! তাদের পঙ্গুত্ব দূর করতে হবে? নিজেদের পারফেক্ট বানানোর দায়িত্ব যে মেয়েরা নিচ্ছে, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করে যে এছাড়া তারা ঠিক ‘সঠিক’ বা ‘সম্পূর্ণ’ নয়। এই মিথ্যেটি তারা ত্তানে বা অত্তানে স্বীকার করে বা মেনে নেয়। এই মিথ্যেটি মেনে নেওয়া মানে মেয়েদের মানুষ বলে মোটেও মূল্য না দেওয়া। এই মিথ্যেটি মেনে নেওয়া মানে মেয়েদের ঘৃণা করা, জঘন্যভাবে তাদের অপমান করা, এবং তাদের পণ্য করার রাজনীতিতে সক্তিয় অংশগ্রহণ করা।
মেয়েরা দেখতে কেমন হবে, তার বিত্তাপন সবখানে। সিনেমায়, টিভিতে, বিলবোর্ডে, পত্রিকায়, পুতুলে। নিস্তার নেই। সৌন্দর্যের গ্যাঁড়াকলে মেয়েদের এমন আটকে দেওয়া হয়েছে যে সৌন্দর্যচর্চার পেছনেই ব্যয় করতে হবে জীবন, জীবনের সব উপার্জন। নিজের অধিকার-অনধিকার বিষয়ে ভাবনার কোনও অবকাশ পাবে না। গাঁটের টাকা এমন ফুরোবে চর্চায়, যে, শেষ সম্বল বলেও কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না। ধূর্ত জালে আটকা পড়েছে আমাদের চারাপোনারা। জরিপ করলে দেখা যাবে শতকরা নব্বই ভাগ মেয়ে মনে করছে তারা যথেষ্ট সুন্দর নয়, বুকগুলো ছোট, ঠ্যাংগুলো চিকন, কোমরটা মোটা, পাছাটা বেঢপ, চুলগুলো পাতলা, রংটা ময়লা, নাকটা বোঁচা, চোখদুটো ছোট, চামড়াটা কোঁচকানো — নিজের শরীরের কিছু না কিছু নিয়ে মেয়েদের অসন্তোষ আর গ্লানি দিন দিন বাড়ছে। মেয়েদের নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেওয়ার রাজনীতিটি ভয়ংকর। আত্মবিশ্বাস না থাকলে, নিজেকে নিয়ে ভয়ভাবনা দূর না হলে পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস এবং শক্তি দুটোই কর্পূরের মতো উবে তো যায়ই, নিজের স্বাধীনতার প্রশ্নে জরুরি সচেতনতাও মরে পচে নষ্ট হয়।
সবচেয়ে দুঃখজনক এই যে, শিক্ষা স্বনির্ভরতা মেয়েদের সামনে এগিয়ে নিচ্ছে এক পা, পিছিয়ে নিচ্ছে দুই পা। শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর মেয়েদের মধ্যে নিজের শরীর নিয়ে হতাশা হুহু করে বাড়ছে, বাড়ছে বলেই সমস্ত মেধা খরচ হচ্ছে শরীরের পেছনে। মৌলিকতা বিদেয় করে কৃঙ্গিমতা দিয়ে তারা এমন মুড়ে রাখার চেষ্টা করে শরীর, যেন এ শরীর প্রসাধন বাণিজ্য, প্রচার মাধ্যম আর পুরুষতন্ত্রের যোগসাজসে প্রস্তাবিত নারীর শরীরের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায়। মিলে গেলেই জয়। নারীকে এভাবেই জয়ী হতে শিখিয়েছে সমাজ। নারীর বোধ বুদ্ধি বিসর্জন দিতে এভাবেই নারী শিখেছে।
আজকালকার মেয়েদের থেকে শুধু তাদের দিদিমারা নয়, দিদিমাদের মা- দিদিমারাও এ ব্যাপারে অনেক বেশি স্বাধীন ছিল। সুন্দর হওয়ার চাপ তাদের ওপর ছিল না। দাসী হওয়ার গুণ থাকলেই চলতো তখন। এখন শুধু দাসী হলেই চলবে না, ‘রূপসী দাসী’ হতে হবে। সঠিক মাপের বুক কোমর ঠ্যাং নিতম্ব না হলে পাশ হবে না। ত্বক টানটান না হলে, ত্বকে সঠিক রং না হলে পাশ নেই। জগত পুরুষের, সমাজ সংসার পুরুষের, এখানে নারী আসলে গোটাটাই ‘শরীর’, আর কিছু নয়।
পুরুষতন্ত্রের নিয়মই হল, মানুষ হিসেবে মেয়েদের প্রাপ্য অধিকার দুমড়ে মুচড়ে নষ্ট করা, মেয়েদের পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার না করা, নিজেদের স্বার্থে মেয়েদের ব্যবহার করা। মেয়েদের মূল্য না দেওয়া। নারী-অধিকার আন্দোলনের ফলে যখনই মেয়েদের মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা চলে, তখনই তা যে করেই হোক কমিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা পুরুষতন্ত্রের পবিত্ত কর্তব্য।
মেয়েদের মূল্য যখন কমতে থাকে, শরীরই মেয়েদের একমাত্র পরিচয়পত্র হয়ে দাঁড়ায়, যেটি দেখিয়ে তার জীবন চলে। মূল্য কমলে মেয়েদের সাজগোজ বাড়ে, বিউটি পার্লারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মূল্য কমলে পণের টাকা বাড়ে। গৃহবধূত্ব বাড়ে। বেশ্যাবৃঙ্গি বাড়ে। কন্যাভ্রুণহত্যা বাড়ে। গৃহনিগ্রহ বাড়ে। ধর্ষণ বাড়ে। নারীহত্যা বাড়ে। সমাজে মেয়েদের মূল্য কম বলেই নারীবিরোধী সব ক্তিয়াকাণ্ড এত নির্বিঘ্নে এবং নিশ্চিন্তে চলতে পারছে।
পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রের চাহিদা অনুযায়ী মেয়েরা যখন এক শরীর ড়বতসন আর থনতয়ঢ়ঁ বনে থাকে, নিজের জীবনটি তখন তুচ্ছাতিতুচ্ছ কিছুতে পরিণত হয়। সমানাধিকারের জন্য চেঁচানোর কগুটি তখন আপনাতেই বুজে আসে। টোপ গিললে কি আর গালি দেওয়া যায় কাউকে? আপস করলে কি আর রুখে ওঠা যায়?
পুরুষতন্ত্র সম্ভবত আর অন্য ষড়যন্ত্রে তত সফল নয়, যত সফল মেয়েদের বিরুদ্ধেই মেয়েদের লেলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে।