নারীনিগ্রহ ছিল সকালে ঘুম থেকে ওঠার মতো, উঠে পেচ্ছাব করার মতো, দাঁত মাজার মতো, চা খাওয়ার মতো। নারীনিগ্রহ ছিল পাড়ার দোকান থেকে হাফ প্যাক সিগারেট কেনার মতো, প্রতিদিনকার বাসে চড়ার মতো, আপিস যাওয়ার মতো। ছিল লাঞ্চের পর একটু ঝিমিয়ে নেওয়ার মতো। ছিল রকের আত্তার মতো, তালুতে খৈনি ডলে দু চিমটি মুখে দেওয়ার মতো। ছিল সন্ধ্যের দু পেগের মতো। টিভিতে ক্তিকেট দেখার মতো। রাতে খেয়ে দেয়ে ঢেঁকুর তুলে কুঁচকি চুলকোতে চুলকোতে বিছানায় যাওয়ার মতো। নারীনিগ্রহ ছিল এমনই নিরীহ, এমনই নগণ্য। এমনই নিত্যনৈমিঙ্গিক, এমনই নরমাল।
হঠাৎ করে কিসের মধ্যে কী? কী আবার, পান্তা ভাতে ঘি!
কী, গজ্ঞে আইনবাবু এয়েচেন। আইনবাবু এখন চোখ রাঙিয়ে মানুষকে শাসাচ্ছেন, দুষ্টুমি করবি তো মরবি। এই দুষ্টের দেশে বলা নেই কওয়া নেই লালচক্ষুর ছড়ি ঘোরানো! আইনবাবুকে দেখে পুং-জনতা ত্রিশূল হাতে বেরিয়ে পড়েছে, লিঙ্গের আগায় লাল পতাকা ঝুলিয়ে যৌন-অনশনে নেমে গেছে। আইনবাবুকে গঞ্জ থেকে না খেদিয়ে কেউ অন্ন মুখে দেবে না। হিংসের হিশহিশ শব্দ চারদিকে। সভ্যভব্য দেখতে লোকেরা তো নাক কুঁচকে বলেই যাচ্ছে, ‘আইন করে কিসসু হবে না, যে আইনের প্রয়োগ কস্মিন কালেও হবে না, সেই আইন প্রণয়ন করে আইনকেই হাসির বস্তু বানানো হলো।’ কোনও কোনও পুরুষ আবার দাঁত খিঁচিয়ে বলছে, ‘আইন তো নয়, যেন ফতোয়া।’ কেউ বলছে,আধুনিক সমাজে যত কম বাধানিষেধ জারি করা যায়, ততই মঙ্গল। সমাজ চলবে তার অভ্যন্তরীণ সংশোধনের তাগিদে। বাইরের হুকুমে নয়।
এই পচা পুরোনো সংস্কারে ঠাসা সমাজকে আধুনিক সমাজ বলে দাবি করার এবং এ নিয়ে গর্ব করার লোকের অভাব নেই এ শহরে। তাজ্জব হয়ে যাই ভাবলে, যে, ধর্মান্ধ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কী করে কবে আধুনিক হল! মেয়েদের এখনও ‘দেখতে আসে’ পুরুষেরা। বিয়ে করে পুরুষের বাড়িতে নিয়ে যায় মেয়েকে। বিয়ের পর মেয়েদের পরতে হয় শাঁখা সিঁদুর, পাল্টাতে হয় পদবী, কারও সম্পত্তি তারা, তা বোঝানোর জন্য। পুরুষকে কিন্তু কোনও বিবাহের চিহ্ন বহন করতে হয় না!
এই ‘আধুনিক’ সমাজেই স্ত্রীর ওপর শারীরিক মানসিক অর্থনৈতিক সব রকম অত্যাচারই চলে। কন্যাভ্রূণ হত্যা করা হয়, পুত্র-প্রসব না করলে গঞ্জনা সইতে হয়, এই তথাকথিত আধুনিক সমাজেই স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবা স্ত্রীকে দুঃসহ জীবন যাপন করতে হয়, কিন্তু বিপত্নীক পুরুষকে কোনও গ্লানি ভোগ করতে হয় না। এই আধুনিক সমাজে স্বামী স্ত্রী দুজনই ঘরের বাইরে যাচ্ছে চাকরি করতে বা ব্যবসা করতে, কিন্তু ঘরে ফিরে দাসীর কাজটা করতে হয় স্ত্রীকেই, স্বামী তখন স্বামীর মতোই, প্রভু। যত আধুনিক হচ্ছে সমাজ, তত পণ্য হচ্ছে মেয়েরা। পুরুষের শরীর এবং মন তৃপ্ত করার জন্য মাপ মতো শরীর তৈরি করতে হচ্ছে, সাজপোশাক পরতে হচ্ছে। এই আধুনিক সমাজেই তো ধর্ষণ, বধূহত্যা ও বধূনির্যাতন বহাল তবিয়তে বিরাজ করে। এই আধুনিক সমাজেই তো রং কালো বলে উপেক্ষা অবত্তা পেতে পেতে গভীর হতাশায় ডুবে আত্মহত্যা করে মেয়েরা!
এই যদি হয় আধুনিকতার সংত্তা! তবে বছর পেরোতে পেরোতে সূর্য তার জ্যোতি হারালেও, গ্রহগুলো এক এক করে কক্ষচ্যূত হলেও এই সমাজকে সত্যিকার আধুনিক করা দুরূহ হবে।
মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় কিছু ডিগ্রি নিলে, ছোট ছোট আঁটো পোশাক পরে বাইরে বেরোলে, ডিসকোথেকে গিয়ে নাচলে, আর মদ সিগারেট খেলে সমাজ আধুনিক হয় না। আধুনিকতার সংত্তা এত সংকীর্ণ নয়।
না। এ সমাজ আধুনিক নয়। সমাজে অসাম্যের দুর্গন্ধ। সংসারে আপোস। এই আপোসের নীতি রীতির নাম আর যা কিছুই হোক, ‘আধুনিকতা’ নয়। এ নিতান্তই প্রভু এবং দাসীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
স্বামী দিনের পর দিন ধর্ষণ করছে স্ত্রীকে। এখন সেই ধর্ষণকে যদি ধর্ষণ বলে গণ্য করা হয়, কার তাতে আপত্রি থাকে? থাকে অগুনতি ধর্ষকদের। তারা এখন ফুঁসছে। ‘কী হল কী, বউকেও কি করতে দেবে না নাকি? জোর করছি, হ্যাঁ নিজের বউকেই জোর করছি। রাস্তার মেয়েছেলেকে তো জোর করে কিছু করছি না। এ আমার বউ। আমার জিনিস। আমার মাল। আমার প্রপার্টি। আমার প্রপার্টিকে আমি যা ইচ্ছে তাই করবো। কার তাতে কী বলার আছে! সংসারের শান্তি নষ্ট করার আইন এনেছেন তেনারা!’
স্ত্রীরা পুরুষদের সম্পত্তি, এ কথা পুরুষ যেমন বিশ্বাস করে, পুরুষের সম্পত্তি নামক স্ত্রীরাও করে বা করতে বাধ্য হয়। বাধ্য হয় বলেই কোনও রকম যুক্তি ছাড়াই, কারণ ছাড়াই ঘরে ঘরে বিয়ে নামক জিনিসগুলো টিকে আছে। এখন সম্পত্তির আমি মালিক হলে যা ইচ্ছে তাই করবো, আর আমাকে নাকি যা ইচ্ছে তাই করতে দেবে না আইনবাবুরা। ভারতের সম্পত্তি আইন কী বলে? সেই আইন কি বলে না আমার সম্পত্তিতে আমার একচ্ছত্র অধিকার?
নারী যে পুরুষের সম্পত্তি নয়, সামাজিক সম্পর্ক থাকলেও—তা ক’জন জানে। যারা জানে, তারা ক’জন মানে? সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক। একথা আমাদের ভুললে চলবে না যে সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক। সমাজের হর্তাকর্তা পুরুষ। এই সমাজে দুএকটা মেয়ে ‘পৌরুষ’ দেখালো, পৌরুষ দেখিয়ে পুরুষের ক্ষমতা ছটাকখানিক খর্ব করলো তার মানে এই নয় যে ভাইস ভার্সা, পুরুষরাও নারীর সম্পত্তিস্বরূপ!
‘আইনের প্রয়োগ হবে না’—এই বলে আইনকে কটাক্ষ করা উচিত নয়। ঘোর অন্ধকার সমাজে আইনের সত্যিকার প্রয়োগ হতে হতে সময় লাগতে পারে। প্রথম প্রথম আড়ষ্টতা থাকবে আইনটিকে ব্যবহারের ব্যাপারে। লোকে ঘেন্না দেবে বলে মেয়েরা এগোবে না। মেয়েদের শাসানো হবে। মেয়েরা গুণ্ডাদের ভয় পাবে। কিন্তু কোনও একদিন তো প্রয়োগ হবে, কোনও একদিন তো কিছু মেয়ে মাথা উঁচু করে বিচার চাইবে এই আইনের আওতায়। দেয়ালে পিঠ লেগে যাওয়া মেয়েরা তো পুরুষের রক্তচক্ষু তুচ্ছ করে সামনে এগিয়ে যাবে। এবং এই সাহসী মেয়েদের দেখে আরও মেয়ের সাহস হবে আইনের আশ্রয় নেওয়ার। শয়তানি করে বদ পুরুষেরা পার পেয়ে যাবে , তা হবে না, ওদের ছাই দিয়ে ধরতে হবে। ওই ছাই-টিই হল আইনটি। আইন দিয়ে না ধরলে পিছলে যাওয়ার আশংকা বেশি। এতকাল তো বদএর পক্ষে এবং তাদের পিছলে যাওয়ার পক্ষেই ছিল যাবতীয় আইন।
‘আইন আইনের মতো পুস্তকে পড়ে থাকবে, প্রয়োগের নামগন্ধ থাকবে না’ — এরকম যারা বলতে শুরু করেছিল, তাদের নস্যাৎ করে কিন্তু আইন প্রণয়নের পরদিনই তামিলনাড়ুর জোসেফ নামের এক লোক তার স্ত্রীকে পেটানোর দায়ে গ্রেফতার হয়েছে। কুড়িহাজার টাকা জরিমানা দিয়ে তবে তার মুক্তি। জোসেফরা এতকাল যে ভাবতো স্ত্রীকে যেমন ইচ্ছে মারবে পোড়াবে, তা আর হচ্ছে না। ভালোবাসা যদি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সৃষ্টি করতো তবে সেটিই হত আদর্শ সহাবস্থান। কিন্তু সেটি যদি না থাকে, তবে ভয়ই ভরসা। ভয় দেখিয়েই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ জাতি ধার্মিক জাতি, নরকের ভয় আছে বলেই নরম থাকে, যতটাই থাকে। ক্ষিধে পেলে, হিংসে পেলে, ক্রোধ জাগলে, রাগ উঠলে অন্যকে কামড়ানোর খামচানোর খুন করার উদ্রেক মানুষ নামক দ্বিপদী জীবের না হওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু নৈতিকতার শিক্ষা, ন্যায়-অন্যায়-বোধ জন্মের পর থেকে মানুষ অর্জন করতে থাকে বলে অনেক ইচ্ছেকে দমন করে। মেয়েদের বিরুদ্ধে করা কোনও অন্যায়কে অন্যায় বলে মনে না করার শিক্ষা পেয়ে যদি এই সমাজের পুরুষেরা বড় হয়ে থাকে, তবে তাদের নতুন করে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা তো এভাবেই করতে হবে। এভাবে, আইন করে।
অন্যকে আঘাত দিও না, অন্যের ক্ষতি করো না, অন্যকে মেরো না — অন্যের নিরাপত্তার জন্য তো একশ একটা আইন আছে। সেই অন্যের মধ্যে নারীকে যুক্ত করার অভ্যেস কারওর নেই। মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য, মেয়েদের বাঁচাবার জন্য আইন থাকবে না কেন? বিশেষ করে সেই মেয়েদের, যে মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে স্তে্রী, প্রেমিকা, মা, বোন, কন্যা ইত্যাদি সম্পর্কের দাবিতে বাস করতে বাধ্য হয়।
লিভ টুগেদার করা জুটি এবং বিয়ে করা জুটির জন্য একই আইন — এটিই বলে দেয় যে সভ্যতার পথে গুটিগুটি করে হাঁটছে সমাজ। কিন্তু প্রশ্ন হল, সব ধর্মাবলম্বীদের জন্যও তো আইনটি! আইনটির কোথাও লেখা নেই, এটি শুধু হিন্দুদের জন্য বা খ্রিস্টানদের জন্য বা সাঁওতালদের জন্য। এর অর্থ, আইনটি সব ধর্মের, সব জাতের মানুষের জন্য। মুসলিমদের জন্যও। কিন্তু, মুসলিম পারসোনাল ল-র সঙ্গে এই আইনের যখন পদে পদে বিরোধ হবে, তখন কী হবে? কোন আইনকে তখন প্রাধান্য দেওয়া হবে? নারীকে নিগ্রহ করা যখন মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে অন্যায় নয়, কিন্তু পারিবারিক নিগ্রহ আইনে অন্যায় — তখন? জনতার আদালত কোন পক্ষে যাবে, অন্যায়ের পক্ষে নাকি অন্যায়ের বিপক্ষে?
পুরুষেরা খেপে উঠেছে, তবে গঞ্জ থেকে যত সহজে তারা তাড়াবে ভেবেছে আইনবাবুকে, তত সহজে তাড়ানোটা বুঝি হচ্ছে না। আইনের প্রয়োজনীয়তা শহর বন্দর গ্রামের সর্বত্র আনাচ কানাচ থেকে অনুভূত হচ্ছে। কেউ কেউ বলছে বাড়ির কর্তার বিরুদ্ধে এই আইন খাটালে পরিবারে ঝগড়াঝাঁটি, অশান্তি, ভুলবোঝাবোঝি, হিংসেহিংসি সব বাড়বে। ভাবটা এমন, এখন কোনও ঝগড়াঝাঁটি হিংসেহিংসি বলতে নেই। এখন বেশ ভালোবাসায় ভরে আছে সংসার।
এই নিগ্রহ আইনেই কিন্তু মেয়েদের সব সমস্যার সমাধান লেখা হয়ে যায়নি। বিয়ে-বিচ্ছেদের পর মেয়েকে খালি হাতে বেরিয়ে যেতে হয়, বড় জোর সঙ্গে পায় স্ত্রীধন। কিন্তু পত্তাশ পত্তাশ হিসেবে দাম্পত্যজীবনে অর্জিত সহায় সম্পদগুলোর ভাগবাটোয়ারা হয় না। ভাগ করে দেবার জন্য আইনবাবু কবে আসবেন? আইনবাবুর কিন্তু আরও কাজ বাকি, আরও অনেক কিছু সমান ভাগে ভাগ করার কাজ। উনি গঞ্জে যখন এসে বসেছেন, তখন যেন পুরুষগুলোর গালিগালাজে আর ত্রিশূলের গুঁতোয় বিদেয় হয়ে আবার মানবতার সব্বনাশ ডেকে না আনেন।