আমার এই এক দোষ। প্রেমে পড়া। প্রেমে পড়লেই আমি পুরুষের প্রতি খুব আন্তরিক হয়ে উঠি। পুরুষের সাতখুন মাফ করে দিই। নিজেকে আমি অনেকবার শাসন করেছি। বলেছি, ‘আর যাই করিস, প্রেম যেন করিস না।’ আমার হৃদয়, শরীর কোনওটিই এই শাসন মানে না। হৃদয়ের দুয়ার আমি খোলা রাখি বলে যে কোনও সুদর্শনই আচমকা ঢুকে যেতে পারে । দেখে সব্বাইকেই প্রথম প্রথম মনে হয়, ‘এ পুরুষটি পুরুষতন্ত্র মানে না, ধর্ম কুসংস্কার রক্ষণশীলতা ইত্যাদি থেকে লক্ষ মাইল দূরে। এ পুরুষটি অসাধারণ প্রেমিক না হয়েই যায় না।’ প্রেম আমাকে কল্পনার সাত সাগরে ডুবিয়ে রাখে। সেই ডুবে থাকা আমি পুরুষকে ভেবে নিই নারীর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, নারী-স্বাধীনতায় একশ ভাগ বিশ্বাসী, নারীর অধিকারের জন্য নিজেই বুঝি লড়বে। কিন্তু দিন যত যায় তত ডুবে থাকা আমি ভেসে উঠতে থাকি, অবশেষে ডাঙায় উঠি। আমাকে হতাশ করে প্রেমিক বুঝিয়ে দেয় যে আর দশটা লোকের মতো সেও নারীবিদ্বেষী, সেও সুযোগ পেলে নারীর সর্বনাশ করতে ছাড়ে না।
‘পুরুষেরা নারীর প্রেম পাবার যোগ্য নয়’, এ কথা বিশ্বাস করেও আমি প্রেম করি, করি পুরুষের সঙ্গেই। এর কারণ, আমি চেষ্টা করেও সমকামী হতে পারিনি, আর আমার প্রকৃতিতে পুরুষ-কাম প্রচণ্ড। সুদর্শন সুঠাম মেদহীন ধারালো পুরুষ-শরীর ভোগ করে আমি বড় আনন্দ পাই। পুরুষের পণ্য হওয়া আমার কম্ম নয়। আমিও কি চাই পুরুষ আমার পণ্য হোক! চাই না। এই নারী বিদ্বেষী সমাজে নারীই যেখানে ঘরে ঘরে পুরুষের পণ্য হয়ে বেঁচে থাকছে, সেখানে পুরুষকে পণ্য করা অসম্ভব। সম্ভব হলে প্রতিশোধ নিতে আমিই একবার ওদের পণ্য করে দেখতাম। আমি যে জিনিস চাই, সে জিনিস এখানে মেলে না। তার নাম সমানাধিকার। সমানাধিকার কী জিনিস, এখানকার পুরুষের তার ধারণা নেই। সমানাধিকারের গল্প যারা শুনেছে, তারা শুনেছেই কেবল, বোঝেনি কিছু।
পুরুষ আসলে সব এক। পুবের পশ্চিমের দক্ষিণের উত্তরের পুরুষে খুব একটা তফাত নেই। তফাত যা আছে বাইরে। ভেতরে এক এবং অভিন্ন। স্বনির্ভর পরনির্ভর, উঁচুশ্রেণী নিচুশ্রেণী সব এক। নিচুশ্রেণীর এক পরনির্ভর আমার পেছন পেছন সামান্য অনুকম্পা পেতে অনেকদিন চলেছিল। অনুকম্পা দেব কী! ঢেলে প্রেম দিয়েছিলাম একবার, যেই না প্রেম পেয়েছে, অমনি সে মাথায় উঠেছে। মাথায় উঠেই আমাকে আর চেনে না সে, গায়ে টোকা দিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই তুই কে রে? কে তুই?’ পুরুষকে লাই দেওয়া আর প্রেম দেওয়া একই কথা। প্রেম তারা নিতে জানে, প্রেম কোনওদিন দিতে শেখেনি। কী করে শিখবে, শেখাবে কে তাদের! জন্মের পর প্রথম পাঠ নিয়ে নেয় অন্দরমহলে, বাবা আর মায়ের ভিন্ন ভূমিকা তাদের নজরে পড়ছে। দেখছে মা প্রেম দিচ্ছে, শ্রদ্ধা দিচ্ছে, সেবা দিচ্ছে, আর বাবা নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় ভোগ করছে সব। পাঠের কী আর শেষ আছে! ঘর থেকে বেরোলেই দ্বিতীয় পাঠ, তৃতীয় পাঠ।
ঘরে বাইরে পুরুষের জয় জয়কার। পুরুষ প্রভুর ভুমিকায়, সমাজের রাজনীতির অর্থনীতির মাতব্বর তারা। এই আরামের তিলার্ধও কোনও পুরুষ ছাড়ছে না। এ না হয় ভারতবর্ষের চিত্র। পশ্চিমের যেসব দেশে মেয়েদের দাপট অনেকটাই বেড়েছে, ওখানেও একই চিত্র। সাদা প্রেমিক-পুরুষও দেখেছি হীনমন্য, ঈর্ষাকাতর, দুষ্ট, দাম্ভিক। আসলে পুরুষ জাতটাই ভীষণরকম নারীবিদ্বেষী। জাতের দোষ দেওয়া হয়তো ঠিক নয়। পুরুষদের বানানো হয়েছে নারীবিদ্বেষী করে। বহু শতাব্দী ধরে পুরুষ এই শিক্ষাই পেয়েছে যে তারা বেশি বোঝে, বেশি জানে, তাদের শরীরটা শক্তি ধরে বেশি, তাদের মাথাটা বুদ্ধি ধরে বেশি, তারা উন্নত জাতের মানুষ। সুতরাং এ খুব স্বাভাবিক কম বোঝা কম জানা দুর্বল বুদ্ধিহীন নারীজাতকে পুরুষ পুছবে না, কেবল ব্যবহার করবে নিজের স্বার্থে।
নিজের ওপর বড় রাগ হয় আমার। এত মাথা উঁচু করে চলা মানুষ আমি, এত স্বাধীন, স্বনির্ভর, এত দৃঢ়, এত সবল, শক্তিমান, আর এই আমি প্রেমে পড়লেই দুর্বল একটি দ্বিপদী জীব হয়ে উঠি। প্রেমে পড়লে বুদ্ধিদীপ্ত আমিটিও কোথায় কোন দমকা হাওয়ায় উবে যায়। বোকা একটি জবুথবু আমি পড়ে থাকি প্রেমিকের নাগালের মধ্যে। আমি আমার পেটের মেদ নিয়ে বিব্রত হই, আমার ডাবল চিন নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। আমার নাক চোখ মুখের গড়ন কিম্ভূত লাগে। পাকা চুল সহ্য হয় না, চুলের বিন্যাস জঘন্য লাগে। আমার তখন রেখার মতো চেহারা চাই, সুস্মিতা সেনের মতো ফিগার চাই। নিজের কোনওকিছু আমার আর পছন্দ হয় না। প্রেমিকের চোখ দিয়ে নিজের দিকে তাকাই আমি, কারণ তখন আমার নিজস্ব কোনও চোখ থাকে না। প্রেমিকের চোখে আমি ঢুকিয়ে দিই অসন্তোষ। সেই অসন্তোষ নিয়ে নিজেকে দেখি আমি। বারবার দেখি। সহস্রবার দেখি। যত দেখি তত নিস্তেজ হই। যত দেখি তত আমি ব্যস্ত হয়ে উঠি প্রেমিককে মুগ্ধ করার নানারকম আয়োজনে। ভোঁতা মাথা থেকে ছিটকে বেরোতে থাকে মূর্খতা, হীনমন্যতা, অসহায়তা। প্রেমের আগুন আমার আত্মবিশ্বাসকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। আমাকে আমি আর চিনতে পারি না। ন্যূব্জ, নিথর, নম্র। আমার রূপ দেখে প্রেমিক যেন আহ্লাদিত হয়, গুণ দেখে আমোদিত হয়, মরিয়া হয়ে তার চেষ্টা করি। আমার নিজস্ব কোনও বোধ থাকে না। আমার ইন্দ্রিয়গুলো ক্তমে অকেজো হয়ে উঠতে থাকে। মাথার খুলি পড়ে থাকে, ভেতরে মস্তিষ্ক বলে কিছু আর থাকে না। আমার আমিকে আমি হারিয়ে ফেলতে থাকি। আমার নিজস্বতা, আমার অহংকার, আমার দৃঢ়তা, আমার বলিষ্ঠতা, আমার শক্তি সাহস প্রেমের তুফানে টুকরো টুকরো হয়ে উড়তে থাকে। যত উড়তে থাকে, যত আমি একটি দীনহীন জড় বস্তু হয়ে উঠি, তত আমার প্রেমিক দেখি শক্তিধর পুরুষ হয়ে উঠছে। যত আমি নত, তত সে আনন্দিত, তত সে ফুলে ফেঁপে ঢোল হচ্ছে, তত সে মেগালোম্যানিয়াক, তত সে ইনক্রেডিবল হাল্ক, তত সে ‘মুই যেন কী হনুরে…’।
কে আমাকে শিখিয়েছে প্রেমিকের মন ভরাতে? পুরোনো কোনও শিক্ষা কি এখনও ঘাপটি মেরে কোথাও লুকিয়ে আছে ভেতরে? কর্কট রোগের মতো এই শিক্ষা, জীবনবিনাসী শিক্ষা, ধ্বংস করে ছাড়ে। হামুখো মৃত্যুকে টেনে এনে আস্ত জীবনটাই মুখে পুরে দেয়। আর প্রচণ্ড প্রাণশক্তি নিয়ে বেঁচে থাকা, পৃথিবীর সব ধর্ম আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে, কুৎসিত পুরুষতন্ত্র, যুদ্ধ আর রক্তপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েও, মানবতার জন্য বিশ্বজুড়ে লড়াই করা অনমনীয় আপোসহীন আমিই কিনা নত হই অমানবিক পুরুষের কাছে। পুরুষতন্ত্রের সুবিধে ভোগ করা, যুগ যুগ ধরে নারীকে দলে পিষে আরাম করা পুরুষের কাছে।
কী যুক্তি দেব আমি এর! এই ভুলের, এই অধঃপাতের! একটিই সান্ত্বনা যে আমার ঘোর কেটে যায় যখনই চাবুক পড়ে পিঠে। পুরুষ মাথায় উঠলেই মাথা বনবন করে ঘোরে আমার। একটিই সান্ত্বনা যে তাকে না নামিয়ে আমার আর চলে না তখন। পুরুষকে মাথা থেকে নামানোর সময়, মাকড়শার মতো জীবন আঁকড়ে পড়ে থাকা পুরুষকে ঠেলে সরানোর সময় অসম্ভব শক্তি পেয়ে যাই মনে আর শরীরে। প্রেমের শেকল ছিঁড়ে, প্রেমিকের কালিধুলো ঝেড়ে উঠে আবার দাঁড়িয়ে পড়তে পারি। দাঁড়ানো আমিটি কোনও বৈষম্যের সঙ্গে আপোস করে না। দাঁড়ানো আমিটি পেছন ফিরে তাকায় না। দাঁড়ানো আমিটি পুরুষ পোছে না। দাঁড়ানো মানুষটি একজনের সঙ্গেই প্রেম করতে পারে, একজনের সঙ্গেই তার বন্ধুত্ব হতে পারে, সে হল মানুষ। এ সমাজের পুরুষ এখনও পুরুষ, এখনও মানুষ নয়। যতদিন ‘মানুষ’ না হয়, ততদিন প্রেম নৈব নৈব চ।
পুরুষ কি আদৌ কোনওদিন মানুষ হবে! ঘোর পিতৃতন্ত্রের মধ্যে ডুবে থেকে আর যা কিছুই হওয়া যায়, ‘মানুষ’ হওয়া যায় না। মানুষ বলতে আমি বুঝি যার মনুষ্যত্ব আছে, মানবিক গুণ আছে, যে মানববাদে বিশ্বাসী। মানুষ বলতে বুঝি মানুষের প্রতি অন্যায় যে করে না, মানুষে মানুষে অসাম্য যে মানে না, কেবল লিঙ্গগুণে নিজেকে উন্নততর জীব বলে বিচার করে না। তারাই মানুষ, যারা নারী ও পুরুষের মধ্যে ক্ষুদ্রতম কোনও বৈষম্যও মেনে নেয় না, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, যুদ্ধ করে, এবং নিজের জীবনে বৈষম্যের ছিঁটেফোঁটারও চর্চা করে না নারীকে অসম্মান করা, নারী বলে নারীকে অবত্তা করা পুরুষের চরিত্রের অন্তর্গত। পুরুষ কি চাইবে ‘চরিত্রহীন’ হতে? প্রেমিকের ভেতর থেকে যখন বেরিয়ে আসে পুরুষ, সে আর প্রেমিক থাকে না। এ আমার জীবনে আমি বারবারই দেখেছি। প্রেমিককে পুরুষ নয়, মানুষ বলে বারবারই আমি ভুল করেছি।
যে নারীরা আমার মতোই প্রেমে বিশ্বাসী, যারা ভোগে, যারা মরে, তারাও যদি আমার মতো উঠে দাঁড়াতে পারতো, পুরুষের ধুলোময়লা ঝেড়ে পুরুষহীন মানবিক জীবন কাটাতে পারতো, পৃথিবীটা সুন্দর হত খুব। পুরুষতন্ত্রের বাইরে না বেরোলে কোনও পুরুষই, আমি সত্য বলছি, যে, নারীর একবিন্দু প্রেম পাবারও যোগ্য নয়।