৩৫. মা, মোহানার আরও কাছে

৩৫

মা, মোহানার আরও কাছে চলে এসেছি, তার সান্নিধ্য, তার শব্দ নিরন্তর কোনও নিশ্বাসের মতো, সুদূর, গভীর, ঈষৎ তপ্ত-ও। এ কোন মোহানা? অনেক বাঁকে বাঁকে পাকে-পাকে ঘোরা যে-নদীর নাম ইহকাল—তার পিছন ফিরে চাইছি—ছড়ানো, গড়ানো অনেকগুলো ধারা। তার একটি কি তোমার আমার সম্পর্ক, তার একটি কি তুমি? তুমি এত দূরে এসেছিলে নাকি? মনে তো হয় না। অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছ কোন সমতলে, ঘিঞ্জি গঞ্জে অথবা মাছিতে ছেয়ে ফেলা বাজারে, জীবনের আদিতম সম্পর্কের স্রোতটি সেখানে আর দেখা যায় না।

কিংবা চেনা যায় না তাকে। আরও বহু সম্পর্কের, অভ্যাসের, পাপের উপনদী তাতে এসে মিশেছে। তার কোনওখানে এক আঁজলা জল হাতে তুলে নিয়ে বলব, ‘এই জলটুকু

আমার মা?’ মিশে গেছে। তা-ছাড়া ভাটির জল ঘোলাও বটে, যত ভাটি, তত ঘোলা। পরিশুদ্ধ সম্পর্ককে পাওয়া যায় খালি উজানে, অথবা একেবারে উৎসে ফিরে।

সেই দিকে চেয়ে আছি, কিন্তু জল নাড়া দিচ্ছি এখানে, যেখানে সব ঘোলা। নাড়তে গিয়ে কি তলার ময়লা আরও তুলে আনছি।

মা, তাই হয়তো বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল, তুমি আসছ না। একি শাস্তি, একি তিরস্কার, এই শেষ প্রণামটাও অকিঞ্চিৎকরতায় ভরে তুলছি বলে,অকিঞ্চিৎকরতায়, বিকৃতিতে আর নানা তুচ্ছতায়—তাই? তা হলে কিন্তু প্রতিবাদ করব, মা, ভীষণ চেঁচিয়ে উঠব, তোমাকে বলে রাখছি, এই শেষবার। মাঝে মাঝে যাকে বলে গল্প বলা; তার ধাঁচ এসে গেছে, এই কি আমার অপরাধ? সে তো শুধু গলা ভেজাতে, শক্ত শক্ত এক-একটা গ্রাস সহজে নামিয়ে দিতে ঢকঢক করে খানিকটা জল মাঝে মাঝে খেয়ে নিতে হয় না?—তাই। নইলে, রঙ যদি কিছু-বা লাগিয়েও থাকি, তা শুধু বাইরে, মর্মবস্তুও কি স্পর্শ করেছি? না।

তবে কি তোমার রোষ সেই মর্মবস্তুরই ব্যবসায়িক ব্যবহারে? তা যদি হয়, অভিযোগটা মাথা পেতে নেব। মা, তুমি জানো না মাঝখানে কঠিন জ্বরে পড়েছিলাম যে-কয়দিন, তোমার বাঁধানো ছবিটার দিকে তাকাতে পারতাম না। মনে হত, ছবিটার চোখ যেদিকে যাই সেদিকেই ঘোরে, আমাকে বিঁধিয়ে মারে। তুমি বকছ, ঠোঁট একটুও না নেড়ে আমাকে ধমকে দিচ্ছ—কী করছিস, কী করছিস তুই–একে তো চেঁচিয়ে বলছিস যা বলার নয় সেই সব কথা, যা নিভৃত; তার উপরে, লোভে পড়ে তাকেও করছিস বিকৃত? ছিঃ।

ছিঃ বললেও আর শুনছি না। এই অসুখ থেকে ওঠার পরে আর ভয় না। কলমটাকে মুঠো করে ধরেছি, তাকাচ্ছি তোমার ছবির চোখে-চোখে; মুখ ফিরিয়ে নাও তো এবারে দেখি কেমন পারো।

এখনও যখন খুব জ্বরে পড়ি, তোমার কথা সব চেয়ে বেশি মনে পড়ে। তোমার কথা, আর তখনকার সকলের। কিংবা যখন ঝড় ওঠে। জ্বর আর ঝড়, বার বার দেখেছি, পুরনো কালকে তোলপাড় করে তুলে আনে। এই শক্তি আছে দেখেছি বিকালের শান্ত নদীরও, আর আছে কোনও-কোনও সুদূর মেঘের। মেঘ আর নদী, নিজে ওরা চঞ্চল, অস্থির, কিন্তু অপরূপভাবে বিশ্বস্তও। নদী তার তলায় আমাদের সব স্মৃতি গচ্ছিত রেখেছে, মেঘ তার নানা রঙের ভাঁজে ভাঁজে। চাইলেই জমানো জিনিসের যতটা চাই ততটাই ফিরিয়ে দেবে।

সেবারের গ্রীষ্মে আমার জ্বরটা তোমার খুব কাছে আমাকে নিয়ে গেল। জ্বর—জ্বর, সে-রকম জ্বর একালে আর হয় না। এখনকার সব অসুখই জটিল, কঠিন, প্রায়শ শরীরের সঙ্গে মনটাও মেলানো। তখনকার জীবনের মতো তখনকার অসুখও ছিল সরল, সোজা রাস্তায় উঠে যেত, বাঁকা-চোরা রাস্তা চিনত না।

এমন-কী এক-একটা বৎসরও নিজেই কয়েকটা স্পষ্ট ভাগে ভাগ হয়ে থাকত। গ্রীষ্মে সময়টা নিজেই পড়ত জ্বরে, সারা দুপুর বিকারের ঘোর, রক্তাভ চোখ। বর্ষায় সর্বদাই তার চোখ টলটল; শরতে সে ডুরে ফ্রক-পরা খুকি, অথচ কার্তিক পড়লেই ছানি-পড়া বুড়ি, শীতে আরও জড়োসড়ো, কিন্তু যেই ফাল্গুন এল অমনই সব জোব্বা বালাপোষে সে তরুণ, নতুন উদ্দাম হয়ে গেল।

সময়ের এই এক-একটা ভাগের ছাপ আমাদের উপরেও পড়ত। সেই গ্রীষ্মে, তাই, সব গ্রীষ্মের মতোই, আমার জ্বর হল। হবেই, অবধারিত। তবু সেই জ্বরেরও অব্যবহিত একটা হেতু ছিল।

হেঁটে হেঁটে হাওড়া থেকে ফিরছিলাম। রজনীগন্ধা—কিশমিশ—চলে যাচ্ছিল। জানালায় বসে সে কী বলেছিল মনে নেই কিংবা মন ছিল না শোনবার মতো; সে সব কথা বলছিল বাঁশিকে,—তার দাদাকে? আমাকে কিছুই না?—”ছুটি হলে আবার আসব” রজনী কাকে বলল এ-কথা বাঁশিকে? নাকি বাঁশিকে সাক্ষী রেখে আমাকে?—”তখন হয়তো আরও কম দেখব।” কী কম দেখবে, রজনী, কী—কী? যা দেখা উচিত নয় তা-ই আরও কম দেখবে, নিরর্থক দৃশ্যে নিরাসক্ত হয়ে যাবে, তাই বলল কি? আমি ভালো বুঝছিলাম না। রজনী চলে যাচ্ছে, এটুকু বুঝেছিলাম ঠিক, আর নীচের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম নিরাসক্ত আর একটি বস্তুকে : প্লাটফর্মটা বাঁধানো, কঠিন। গাড়ি যখন চলে যাবে, এই প্লাটফর্ম তখন কাঁপবে, যতবার যত গাড়ি যায় ততবারই কাঁপে, কাঁপাটা ওর অভ্যাস হয়ে গেছে, কিন্তু বেশিক্ষণ না। নিজেকে ও শক্ত, হৃদয়হীন করে রাখতেও শিখেছে। তা ছাড়া সবাইকে ছেড়ে দিতেও; কোনও গাড়িকেই শেষ পর্যন্ত তো আটকায় না।

শেষ সময়ে ঝুঁকে পড়ে রজনী বলল, “সেই জিনিসটা দাদা? ওটা সাবধানে রেখো। বেশি নাড়াচাড়া কোরো না। তুমি সাবধানে থেকো।”

বাঁশি একটা রিভলভার কোথা থেকে জোগাড় করে এনেছিল। ক’দিন থেকে সেটা নিয়ে তার সময় কাটত। হেসে বলত, “প্রাণবাতিকা, কিন্তু বিশ্বস্ত। কিন্তু আমি যা চাই তাতে রিভলভারে তো কুলোবে না। মনে হয় গুলি ছুঁড়ে-ছুঁড়ে সব গর্ত করে দিই, যত আসবাব আর চারপাশের দেওয়াল। কিন্তু তাতে তো হবে না। রিভলভারের গুলিতে বড় জোর গর্ত ই শুধু হবে, কিছু ধসে পড়বে না। আমি সব ধসিয়ে দিতেও চাই যে।” ওর গলার শিরা আরও নীল হত। বলতাম “বাঁশি, নাটক? কোনও পুরুষের পার্ট মুখস্থ করছ?” অদ্ভুত চোখে তাকাত সে। দৃষ্টির রঙও নীল—ঘৃণার।

সেদিন বাইরে এসে গাড়িতে আর উঠলাম না। বাঁশিকে বললাম, “তুমি যাও, আমি একটু পরে যাব।”

দুপুরবেলাটা তখন জ্বরের বিকারে চিৎকার করছিল। আমি হাঁটলাম, হাঁটলাম; হাঁটতে থাকলাম।

.

তুমি ভয় পেলে, চেঁচিয়ে উঠলে।—”এ কী? তোর চোখ টকটকে লাল যে? জ্বর হয়নি তো, দেখি?”

আমি টলে পড়ে যাচ্ছি, তুমি ধরে ফেললে, টেনে নিলে—কাছে, কত কাছে, কত দিন পরে বলো তো। দুটি তাপ, আমার শরীরের আর তোমার স্নেহের, মিশে গেল। টেনে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলে। নীচের ঘরে, তোমার বিছানায়। কত দিন পরে বলো তো?

কপালে জলপটি, মা, তোমার হাতেও জলপটি, আমি চোখ বুজে শুয়ে তোমাকে পাচ্ছি। আমার বয়সও কি কম হয়ে গেল? বলতে পারব না। অসুস্থ, দুর্বল শরীর শুধু লুব্ধ হয়ে উঠতে জানে, স্পর্শের জন্যে, একটু সারার মুখে কুপথ্যের জন্যেও, তা-ছাড়া তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে এক স্নায়বিক বিকার, কিছুই সে ছাড়তে চায় না, সব কিছু মুঠোর মধ্যে আটকে রাখার একটা ছেলেমানুষি তাকে পেয়ে বসে, আমি যেমন যতক্ষণ জেগে, ততক্ষণ জোর করে পাশে ধরে রেখেছি তোমাকে। যখন ঘুমে, তখনও তোমার আঁচলের শেষভাগ আমার হাতে; জড়ানো থাকত আমার আঙুলের গিঁটে গিঁটে।

আর ঘরে বালতি এনে যখন আমার মাথায় জল ঢালছ, জল, নির্মল, নির্মল, তার শতধারা কি ধুইয়ে দিত আমার বয়সকে, এই বছরগুলোকে, জমে-ওঠা সব ময়লাকে?

কখনও রগ-ছেঁড়া যন্ত্রণায়, কখনও চোখ-বোজা, গভীর আরামে আর অবসাদে তাই মনে হত বটে। এই ছোঁয়া, এই স্নেহ, উৎকণ্ঠা, প্রগাঢ় গন্ধ, সব চেনা এ-সবই কি ছাড়াতে যাই, ছাড়াতে চাই? ঠান্ডা জলের মতো তৃষ্ণা আর কিছুতে কি মেটে? তবু উৎসে গিয়ে সেই ধারা করপুটে গ্রহণ করতে কৃতাঞ্জলি হয়ে লোকে দাঁড়ায় না কেন। শোক আর আঘাত, ভয়ংকর কোনও রোগ, মৃত্যুভয়—এইসব নইলে মানুষ ফেরে না, ফিরতে চায় না, কদাচ তাকায় না ভিতর দিকে—কিন্তু কেন। আর সেই ফেরা, সেই তাকানোও একান্তই ক্ষণিক, তার পরেই ভিতরেরই কোনও ফুসলানি তাকে ঠেলতে থাকে, ছুটিয়ে মারে—কিন্তু কেন?

তুমি কি ভয় পেয়েছিলে, আমার খুব শক্ত অসুখ ধরে নিয়ে? মানত করেছিলে?

৩৬

দিনের শেষ নৌকোটিও যখন ছেড়ে যায় পারঘাটা তখন কোন্ চোখে চেয়ে দ্যাখে? সেই দৃষ্টি কি দেখেছিলাম তোমার মুখে? দেখেছি। দেখিনি। দেখলেও তার মানে পড়তে পারিনি।

জ্বরে জিভ, ত্বক, সব শুকনো ঠেকত। একটু স্পর্শের জন্যে মন তৃষিত হয়ে থাকত। বারবার যে চোখ, মা, এদিক ওদিক চাইতাম, থেকে থেকেই যে চাইতাম জল, আরও একটু জল, সেই জলের নাম কী? সে কি শুধুই বর্ণহীন একটি পেয়? বোধ হয় না। বোধ হয় তার চেয়ে কিছু বেশি। আমার সন্ধানী দৃষ্টিকে ঘুরতে দেখলেই তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসতে।—”কী রে, কী দেব, কী চাই?” কী যে চাই তোমাকে বোঝানো যেত না। চেয়ে দেখতাম—নেই। কেউ নেই। কিচ্ছু নেই। সব যেন পুরনো, ফুরনো হয়ে গেছে।

কপালে একটি হাত। ঠান্ডা, নরম। চমকে উঠতাম। বলতাম, “কে?” সব সময় তুমি উত্তর দাওনি, শুধু আঙুলগুলো বুলিয়ে গিয়েছ। অলস নয়নে তোমাকে দেখে বলতাম, “ওঃ, তুমি!” সেই ভঙ্গিতে যে হতাশা, তুমি কি তা ধরতে পারতে? নইলে বলতে কেন “তুই ভেবেছিলি কে?”

“কে আবার? কেউ না।” বলে চোখ ফের বুজে ফেলেছি। টের পেয়েছি, একটি হাত আমার একটা কবজির যেন একটা রগ টিপে ধরেছে। হাতটা টেনে নিয়ে বিরক্ত গলায় বলেছি “কী দেখছ?”

লজ্জিত, ধরা-পড়া গলায় বলেছ “দেখছিলাম কেমন আছিস?”

“তুমি বুঝি নাড়ি দেখতে পারো?” আমার গলা তেতো-তেতো।

“এই একটু একটু।”

আমি কিন্তু তোমার মিথ্যেটা ধরে ফেলেছি। আমি কেমন আছি তুমি দেখতে না, দেখতে আমি তোমার কতটা আছি। তোমারই তো?

না, মা, না। শুনে নাও, পৃথিবীর সব কালের সব মা শুনে নিক, আমি তোমার ছিলাম না! দুনিয়ার কোনও ছেলে বা মেয়ে থাকে না। কোন্ নৌকো কবে পারঘাটায় বরাবর বাঁধা পড়ে থাকে? কাছি খুলে তারা বেরিয়ে পড়বেই, মাঝ দরিয়ায় হাবুডুবু খাবে, হয়তো ডুববেও। তবু ভেসে পড়বে।

আমিও ভেসেছি। বিছানায় যখন পড়ে আছি, তখনও ভেসেছি স্বপ্নে।

এই স্বপ্ন ব্যাপারটা মা বড় অদ্ভুত। মানুষ ছাড়া এ জিনিস আর কে দেখে থাকে, জানিনে। মানুষ দ্যাখে বটে, কিন্তু তাকে ধরে রাখতে পারে না। প্রত্যেকটা স্বপ্ন আক্ষরিক অর্থে এক-একটা মানস সরোবর। তার থেকে আঁজলা ভরে কতটুকু আর জল তুলে আনতে পারি? প্রায় সবই আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে যায়। তবু যা বাঁচে, তাই লেগে থাকে স্মৃতির ঠোঁটে। আধো-জাগরণের ক্ষণেও তার স্বাদটুকু নিয়ে বাঁচতে চাই। চাইলেই কি সাধ মেটে? ঝরা স্বপ্ন মরা স্নেহ-প্রেম ইত্যাদির মতো। সহস্রাক্ষ কামনাতেও আরও অটুট ফেরে না।

কিংবা, মানস-সরোবর নয়, কখনও বা মনে হয়, স্বপ্ন আসলে হল চোর কুঠরি। আমরা সকলের চোখ এড়িয়ে সন্তর্পণে সেখানে প্রবেশ করি। খুঁজি, খুঁজি, অচরিতার্থ বাসনা যা-কিছু আছে, সব পেতে চাই, অন্ধের মতো হাতড়াই।

কিন্তু স্বপ্নের কথা থাক। আমাদের কথা বলছিলাম। সেই জ্বরের দিনগুলোরই একটিতে কি বিশ্রী একটা কাণ্ড করেছি, মনে আছে?

বার্লির বাটিটা আগেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। তার পরেই তোমার হাত থেকে কেড়ে নিলাম জ্বর-মাপা থার্মোমিটার। এক ঝলক দেখে নিয়েই কী দেখলাম কী দেখলাম না, পুট করে ভেঙে ফেললাম সেটাকে। একই সঙ্গে অবাক হয়ে আর ভয় পেয়ে তুমি বললে, “কী করলি, কী করলি তুই?”

“বেশ করেছি।”—আমি ফুঁসছিলাম। আমার ফাটা ঠোঁট চড়চড় করছিল, আমার ভাঙা গলা কুৎসিত হয়ে গিয়েছিল।

“জ্বরটা বোধ হয় বেড়েছে”, তুমি বললে শান্ত গলায়, “যাই ওষুধটা নিয়ে আসি।”

চিৎকার করে বললাম, “ওষুধ? ওষুধ আর খাব না আমি। ভেবেছ তোমার ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পারিনি?”

“ষড়যন্ত্র?” নীল হয়ে যাওয়া গলায় তুমি বলেছ, “কিসের ষড়যন্ত্র?”

“আমার জ্বরটা পুষে রাখার”, বিকারের ঘোরে আমি বলে গেছি, “আমাকে যদ্দিন সম্ভব ভোগাবার।”

এতক্ষণে স্থির গলায় তুমি বলেছ, “তাতে আমার লাভ?”

“লাভ? তুমিই ভালো জানো। আমি যাতে নাগালের বাইরে না চলে যাই, তোমার আঁচলের তলায় পড়ে থাকি তাই।”

আশ্চর্য, একটুও রাগ করলে না, গলা কাঁপল না তোমার, নিষ্পলক নিষ্কম্প, বললে, “তুই একথা বলছিস? কই, কাউকে তো তবুও রাখতে পারিনি।”

আমি তখনই যেন দেখতে পেলাম, তোমার নিপাড় সাদা শাড়ি, যার প্রান্ত শুধু একটু একটু কাঁপছে, যেন ভয় পেলাম, সেই ভয় কাটাতেই তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ঠিক সেইভাবে যেভাবে, বার্লির বাটি ছুঁড়ে দিয়েছিলাম, “পারোইনি তো দাদাকে না, বাবাকে না। তার শোধ বুঝি আমাকে দিয়ে তুলতে চাইছ? ছিঃ মা, ছিঃ!

‘পাগল! এইভাবে কাউকে কি রাখা যায়?” শেষবারের মতো আমার কপালে একটুখানি ঠান্ডা হাতের ছাপ রেখে উঠে যাচ্ছিলে, সেই ছোঁয়া, সেই হিমশীতল ক্ষমা আমার গায়ে যেন ছ্যাঁকা দিল, তোমার হাত ধরে টেনে রাখলাম আমি—”যেতে পারবে না, বাকিটাও তবে শুনে যাও। আমাকেও ধরে রাখতে পারবে না তুমি। আমিও যাব।”

“জানি। চলে তো গেছিসই। আমি কি জানি না, বুঝতে পারি না?”

“আরও দূরে যাব। এই অসুখটা একবার সারে যদি, দেখবে, আমি আরও ছড়িয়ে পড়েছি, ছিটকে গেছি, সে এক অন্য জগৎ, আলাদা জীবন, সেখানে তুমি আমার নাগালও পাবে না।”

“না পাই তো না-ই পাব। তুই এখন তো ঘুমো” বলে তুমি উঠে গেছ। দুটি মোটে বাক্য। কিন্তু এত কম কথায় এত কঠোর রায় অদ্যাবধি উচ্চারিত হয়নি।

শেষ রায়? না। হত তো মিটে যেত। কিন্তু ফিরে এসেছ আবার, আধ ঘণ্টাটাক পরেই।

সেই দৃষ্টি, সেই স্পর্শ। সেই শান্ত, শীতল উচ্চারণ—”চোখ ফোলাফোলা কেন রে? কই, জ্বর তো নেই, আর বাড়েনি। তবে?”

উত্তর দিলাম না, তখন তাই তুমি আবার—”কাঁদছিলি?”

বোকা, বোকা, কী ভীষণ বোকা তুমি বলো তো, মেয়েরা যা হয়। তুমি এতক্ষণ আড়ালে কেঁদেছ, তার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তাই ভাবলে ‘কাঁদছিলাম আমিও? ছেলেদের তুমি জানো না, ছেলেরা সহজে তো কাঁদে না। তা ছাড়া দু’জন মিলে কাঁদছে এমন ঘটনা ঘটে কদাচিৎ। টেলিপ্যাথি? ও মানুষের শুধু এক ইচ্ছাময়ী কোমল কল্পনা। দু’জনে আলাদা স্থানে সত্যিই যদি কাঁদত, তা হলে জগতের অনেক সম্পর্কের জ্বালা আর ভুল বোঝার কাঁটা জল হয়ে জলেই ধুয়ে যেত। সেদিন সত্যিই যদি কাঁদতাম, তা হলে আজ এই লেখালেখির কান্নাকাটি কি দরকার হত? মা, তুমি কিচ্ছু বোঝনি, বোঝ না।

ওই একটা কথা বোঝাতে আজ এক গাদা কথা লিখতে হল, অথচ সেদিন কিন্তু “কাঁদছিলি?” এই প্রশ্নটার জবাবে বলেছিলাম, “কই? না।”

“তবে মুখ ভার কেন?” তুমি তবুও বলেছ “একেবারে ছেলেমানুষ। বাইরে কাঠ, নীচে কাদা। তোর বাবাও ওই রকম ছিল। দূর, মন খারাপ করে না, করলে অসুখ সারে না। কথা কাটাকাটি? ও তো হয়েই থাকে। ঝোঁকের মাথায় না-হয় যা খুশি বলেছিস।”

“কী বলেছি তোমার মনে আছে?”

“আমাকে যা-তা; আবার কী। তোরা সবাই যা পারিস।”

ইস্ তোমাকে কী-না-কী সব কথা ছুঁড়ে মেরেছি বলে মন ভার করে বসে আছি, তারই জের টানছি আর জাবর কাটছি শুয়ে শুয়ে–মা, এত ঘা খেয়েও তুমি তখন কী ছেলেমানুষই না ছিলে। তখনও জানো না আমি কোন্ পাষাণে তৈরি।

আজ যদি বলি, তোমাকে যা-ই বলে থাকি না কেন, আমার মনে তা নিয়ে কোনও ঘূর্ণি চলছিল না, তুমি হিংস্রতম আঘাতে দীর্ণ হয়ে যখন চলে গেছ, তখন—তখনও আমি ভাবছিলাম অন্য কারও কথা—কার, কার? হয়তো বুলা, কিংবা কিশমিশই হবে হয় তো। অথবা অপরা যে-কোনও নারী! সরল ধারণা বা বিশ্বাসের বশবর্তিনী জননী বা জায়াকে নিয়ে প্রতারক পুরুষ মাত্রেই যা করি। যে একাগ্র, সমর্পিত, তাকে উপেক্ষা করে অপরায় আত্মহারা। মাকে দিয়ে যে বিদ্যায় হাতে খড়ি, পরবর্তী কালে ঘরণীর ক্ষেত্রেও তারই প্রয়োগ, এই তো রীতি! অবশেষে স্বীকার করছি।

সেদিন আমি উতলা হয়ে ছিলাম অন্য কোনও সঙ্গ বা সান্নিধ্যের জন্যে, তারা নেই কেন, তারা আসে না কেন, ওই জ্বরশয্যায় যে-স্পর্শ নেই তার জন্যে ব্যাকুল হয়েছি, নিঃশ্বাস বন্ধ করে তপ্ত কোনও নিঃশ্বাস ঘনিষ্ঠ হয়ে এল কিনা অনুভব করতে চেয়েছি। বয়সের ধর্ম। ওই বয়স অবুঝ, শুধু সময়ের সাহচর্য খোঁজে। বাকি সব মিথ্যা, বাজে।

সেদিন এ সব বলতে পারলাম না বলেই বিছানার পাশে-রাখা একটা পত্রিকায় মুখ আড়াল করলাম। আমার আরও দু’চারটে লেখা ছাপা হয়েছিল। ঝুঁকে পড়ে একনজর দেখে নিলে।—”তোর লেখা?”

“তুমি বুঝবে না।”

“কবেকার?”

উত্তর–”তুমি যাও।”

“নতুন কিছু লিখিসনি আর?”

“কী বোঝো এসবের! তুমি যাও।”

যাওনি। তুমিও কি সেদিন মরিয়া, তাই বিছানার এক পাশে বসেছ? বলেছ আস্তে আস্তে “তখন অন্য জগৎ, অন্য জীবনের কথা কী যেন বলছিলি? সে কি এই লেখার?”

“তুমি বুঝবে না।”

‘জানি।” ছোট্ট একটু শ্বাস ফেলে বলেছ, “তুই সেদিন মিছে কথা বলেছিলি। প্রথম লেখাটা যেদিন ছাপা হল। কাকে নিয়ে লেখা জিজ্ঞেস করতে ফস্ করে বলে দিলি “তুমি!” অথচ এ সবের কিছুতে আমি নেই। তা কি জানি না? জানি। উঠছিস কেন, ভয় পেলি? আমি জানি বলে? আমি বুঝি বলে? কিন্তু একটু আগেই না বললি, কিছু জানি না, বুঝতে পারিনা আমি! পাগল একটা, আস্ত পাগল। তা হলে এ-ও জেনে রাখ, আমি নেই বটে, আবার আছিও। না থেকেও থাকব। তোর সব কিছুতে আমি আছি।”

মা, এক জন্মে জন্মের মূলকে অস্বীকার করা যায় না, সেদিন তুমি কি তাই বলতে চেয়েছিলে? তা হলে শুনে রাখো, তুমিও সম্পূর্ণ অভ্রান্ত ছিলে না। সেদিন সত্যিই তুমি ছিলে না, বলছি তো, মায়েরা থাকে না। থাকে না, কিন্তু ফিরে আসে। যেমন তুমি এসেছ। কবে থেকে আশীর্বাদ, স্নেহ, কৃপা আর করুণা ধারায় ধারায় এই লেখাটার উপরে বর্ষিত হয়ে চলেছে।

.

জ্বর আসে, জ্বর যায়। আমারও গিয়েছিল। আবার কবে পা টিপে টিপে উঠলাম আমি বাঁশির ঘরে। উঠলাম, না নামলাম? সেটা কোন্ কাল? গ্রীষ্ম তখন ভিতরে ভিতরে তরল হয়ে কি বর্ষায় রুদ্ধ সব রোষ ধুয়ে ফেলে নির্মল হতে চাইছিল? এই এক অক্লান্ত আবর্তন প্রকৃতির। জ্যৈষ্ঠের পর আষাঢ়, প্রতিবারই যেন তাপিত কারও অনুতাপিতে রূপান্তর—সম্মোহিত হয়ে প্রত্যক্ষ করি। কঠোর যে, সে রাতারাতি কোমল, চরিত্র-বৈচিত্র্যের বৈপরীত্য মানুষের মধ্যে আর কতটা আছে! নদীতে, মেঘে, আকাশে, সাগরে নিয়ত তার প্রচুর সন্নিবেশ দেখে দিশাহারা হয়ে পড়ি।

জ্বর আসে, জ্বর যায়। আমারও গেল। গেল, তাই আবার ছাদে উঠলাম, সেই চিলেকুঠিতে। আবার নামলাম, পা টিপে টিপে, বাঁশির পিছু পিছু, অথবা তাকে সঙ্গে নিয়ে। যেতেই হবে জানতাম। অন্যায়, গর্হিত অপকর্ম, দেখেছি জীবনের নানা বাঁকে আততায়ীর মতো আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে, হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকে। ভীতু তো, তাই মনে মনে আমি একটু কুঁকড়ে যাই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাড়া না দিয়ে পারি না।

আমাকে দেখে বাঁশি পাউডারের পাফ নামিয়ে রাখল। বললাম, “কোথায় যাবে বাঁশি, যে ফিটফাট হচ্ছ?”

সে বলল, “কোথাও তো না। এমনি নিজে নিজে—কী করি। সময় তো কাটাতে হবে, তাই একাই—”

বাঁশির নিঃসঙ্গতা আমাকে দ্রবীভূত করছিল। ফিসফিস করে বলাম, “বাঁশি, চলো না যাই!” ও বলল, “কোথায়?” মন ভোলানো গলায় বললাম, “ওখানে আর যাও না?” বাঁশি বুঝল, বলল “যাই। কিন্তু গিয়ে লাভ নেই। বুলাদের ওখানে যাওয়ার কথা বলছ তো? এখন সেই ঘাটে খেয়া দেয় ঈশ্বরী পাটনী।”

“তার মানে লীলামাসি? তিনি তো আছেনই। ছিলেন।”

“এখন একা নন। নতুন একজন জুটেছেন—অরিন্দম।”

অরিন্দম? মনে মনে নামটা নিয়ে আমি নাড়াচাড়া করলাম। একটু ঘষতেই চেনাটা চিকচিক করে উঠল—”অরিন্দম? আমি চিনি। নতুন তো নন। পুরনো। লীলামাসির সঙ্গে—’

বাঁশি বলে উঠল—”তিনিই। আদি এবং অকৃত্রিম অরিন্দম। উত্তরাধিকার সূত্রে বুলা তাঁকেই অর্জন করেছে।”

মানে বুঝতে পারছিলাম না। বাঁশি বলল, “উত্তরাধিকার জানো না? যে সূত্রে এক পুরুষের জিনিস পরের পুরুষে বর্তায়। যে নিয়মে আমি এই বাড়ি ঘর, টাকা-কড়ি সব পাব বা পেয়েছি। সেই নিয়মে বুলাও তার মার—”

কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, “প্রেমিককে? কিন্তু অরিন্দম তো; মানে…”

“বুড়ো, তাই বলবে তো? কিন্তু ভাই, বুলারা তো বয়স দ্যাখে না, অন্য কিছু দ্যাখে। যেমন আমার কাছে এক দিন দেখেছিল–টাকা।” বলতে বলতে বাঁশি হিংস্র হয়ে উঠল, “আমিও অবশ্য দেখিয়েছি, দেখাচ্ছি। টাকা দেখিয়ে যাব। আমার পার্টটা আমি আঁকড়ে রেখেছি।

.

সেই ছাদ, যে ছাদে বুলা বলছিল ফুল ফোটে না, ওখানে শুধু গরমের কালে ক্যাকটাস আর বর্ষায় ক্যানা।

চমৎকার একটা শীতলপাটি বিছিয়ে তার সবটাই যেন জুড়ে বসেছিল বুলা। কোনও চটকানো মালার অকাতর সৌরভ বিলিয়ে যাচ্ছিল ম্রিয়মাণ ফুলগুলো যেন শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ছিল।

আমাদের দেখে বুলা কী যেন ঢারুল, ওর ফাঁপানো, ছড়ানো আঁচলের তলায়। অরিন্দম একটা সহর্ষ হ্রেষাধ্বনি করে উঠলেন—”আরে! এসো, এসো!” যেন সব সাজানো, যেন সব আমাদের প্রতীক্ষাতেই ছিল। অনেক দূরের আকাশে অবধারিত সেই চাঁদটাকেও ফুটতে দেখলাম, মেঘে আর নীলে আঁকা, যেন বানানো। মনে হল একটা বাঁধা মঞ্চ, এখুনি এক নির্ধারিত নাটকের মহলা শুরু হয়ে যাবে, অথবা পুরো অভিনয়টাই নাকি?

চোখের ইশারায় অরিন্দম বললেন, “ওদের জন্যেও তবে আরও গোটা কতক আনতে দিই?”

অস্বচ্ছন্দ গলায় বলে উঠলাম, “বুলা আজ এখানে কী?”

অরিন্দম দরাজ গলায় বলে উঠলেন, “কিছু না, কিছু না, এই একটু সেলিব্রেট করব আর কি।”

তবু ছাড়লাম না, কারণ আমার অস্বস্তি যাচ্ছিল না, কেবলই যেহেতু বলতে থাকলাম, “কিসের সেলিব্রেশন”, তাই অগত্যা বুলা ইশারায় আমাকে উঠতে বলে আড়ালে ডেকে নিয়ে এল। বললাম, “আজ কী?”

“আজ?” গালে একটা আঙুল রেখে ঘাড় একটু হেলিয়ে বুলা ভাবনার ভান করল। প্রায় তখনই খিলখিল হেসে উঠে বলল, “আজ আমার পাকা দেখা যদি বলি?”

“বুলা, ইয়ার্কি রাখো। “

“ইয়ার্কি রাখব? বলছিস? তবে থাকবে কী? এখানে তবে তোরা কেন এসেছিস? গীতাপাঠ শুনতে? গীতা-টীতা আমি তো জানিনে ভাই, তবে বলিস তো খান দুই গীত গেয়ে দিতে পারি।” বলে সত্যিই ও বিশ্রী ধরনের একটা গানের সুর ভাঁজতে বুঝি শুরু করেছিল, থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম, “আজ তোমার পাকা দেখা সত্যিই তো নয়।”

সে বলল, “হতে দোষ কী। হয়ে যাক, যখন এসে পড়েছিস। কেন, আমার পাকা দেখা হবে না কেন? আমার মতো মেয়ের বুঝি কখনো বিয়ে হবে না তাই ধরে রেখেছিস? নাকি তোরা চাস না যে হোক। তাই, না রে, তাই?”

বুলার চোখ নাচছিল, সেই চোখে সঙ্কোচের সুতোটুকুও ছিল না। বুলা আলগোছে আমাকে একটা ঠেলা দিল। তখন বোকার মতো বলে উঠলাম, “বেশ। পাকা দেখা বলছ, কিন্তু বুলা বর কে?”

একটা চোখ বুজে, আর-একটাকে টেরচা করে বুলা যেন আমাকে যাচাই করল। বলল, “যদি বলি তুই?”

“যাঃ!”

ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে বুলা, বলল, “তবে তোর ওই বাঁশি। হতে পারত, মুশকিল এই যে, তা হলে বোঝা যাবে না কে বর আর বউ কে। তার চেয়ে–“

হট করে বলে ফেললাম, “বুলা, তোমার বর ওই বুড়োটা, ওই অরিন্দম নয় তো?”

“হিংসে?” বলে বুলা সেখান থেকে আমাকে আবার ওই শীতলপাটির আসরে টেনে নিয়ে এল।

চাঁদটা সেখানে আরও প্রকাণ্ড হয়ে নানা কাণ্ড ঘটাতে শুরু করেছিল। দলিত ফুলগুলির সুবাসের লেশমাত্রও ছিল না। মুখ বেঁকিয়ে বুলা বলল, “বিচ্ছিরি! এই জ্যোচ্ছনা একটুও ভালো লাগে না। সব কেমন ফটফট করে, ঢাকাঢাকি থাকে না কিছু।”

সায় দিয়ে অরিন্দম বললেন, “চাঁদ নয় তো, যেন চীনেমাটির বাসনের দোকানে ঢুকে-পড়া একটা ষণ্ড। হাজার তারা মিলে যা পারে না, ও একাই তার চেয়ে বেশি পারে, সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়।”

এ সব কথার অর্থ কী, বুঝতে পারছিলাম না। উসখুস করলাম খানিক। বাঁশি তখন থেকে ঠায় বসে একটা ফুলের কুঁড়ি তুলে কানে সুড়সুড়ির সুখটুকু নিচ্ছিল। বললাম, “বুলা, লীলামাসি কোথায়?”

“মা? আছে নীচের ঘরে। ওকে মাংসের শিঙাড়া তৈরি করতে বসিয়ে দিয়ে এসেছি। মাংসের শিঙাড়া আর ঘুগনি। তোরা খেয়ে যাবি তো?”

থাকতে রুচি ছিল না, আবার যাবার মতো জোরও নেই। অরিন্দম উঠলেন। পকেট থেকে চাবি বের করে রিংটা ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, “কী হে, যাবে নাকি?”

‘কোথায়?”

“একটা সওদা করে আসি। যাব আর আসব। গাড়িতে দু’মিনিট। আসবে?” প্রতিরোধের ক্ষমতা ছিল না বলেই তাঁর পিছু নিলাম।

সেদিন নীচে নামতে নামতে, পরে গাড়িতে, কী বলেছিলাম অরিন্দমকে? “আপনাকে অনেক দিন পরে দেখলাম”, “আপনি খুব রোগা হয়ে গেছেন।” এই সব?

“কত দিন পরে, বলো তো?” গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে অরিন্দম বললেন, “আগে যখন দেখেছিলে তখন কেমন ছিলাম আমি? তেজি ঘোড়ার মতো, বলবে তো? কিন্তু দ্যাখো, এখন আমি কী। গালের হাড় বসে গেছে, চুল পাতলা; তাতে কলপ দিয়ে রাখি। জানি, সব জানি! “

“অনেকগুলো বছর তো?”

“কত আর? তবু দ্যাখো এই হাল। শরীরটা ভাঙা গাড়ির মতো। নিজে থেকে স্টার্ট নিতে চায় না। ঠেলে ঠুলে চালাতে হয়।”

“আর বুলারা? তারাও তো বদলে গেছে।“

অরিন্দম সংক্ষেপে বললেন, “গেছে।” কাঁপা কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরালেন। আমি বললাম, “আপনি এখানে প্রায়ই আসেন তাই না?”

“আসি।” বলেই অরিন্দম বললেন, “তুমি?”

“অসুখ করেছিল মাঝখানে। এবার এলাম অনেক দিন পরে। আরও যেন সব বদলে গেছে। বুলা যেন আরও কেমন–“

আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে অরিন্দম বললেন, “ইয়ং ম্যান; ঝেড়ে কাশতে পারছ না কেন। বুলা প্রায় বেশ্যার মতো হয়ে গেছে, তাই বলতে চাইছ তো?”

চুপ করে রইলাম

গাড়ি সদর রাস্তায় পড়েছিল। অরিন্দম, প্রৌঢ় পাকা অরিন্দম একটা ঝাঁকুনি সামলে বললেন, “কিন্তু তুমি ঠিক কথা বলছ না। বেশ্যা হয়ে গিয়েছি বরং আমি।”

আমার মুখে কথা ছিল না।

অরিন্দম হাসলেন। সেই হাসি কোনও একটা বেদনায় কেমন হলদে হয়ে গেল। বাঁধানো দাঁতে ওঁর প্রত্যেকটা কথাই শোনাচ্ছিল অনিশ্চিত।

“হ্যাঁ, পুরুষেরাও বেশ্যা হয়, একটা বয়সে। যখন তাদের বন্ধু থাকে না। সঙ্গী, সাঙাত, কেউ না। তারা যখন বিপুষ্পিত হয়। হ্যাঁ, পুরুষেরাও বিপুষ্পিত হয়— মেয়েদেরই মতো। তখন তাদের জৌলুস নেবে, ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ মুছে যায়, শুধু বিকর্ষণের পালা। তখন সেই গত-বয়স পুরুষেরা ডেকে ডেকে লোক বসায়, খারাপ মেয়েদেরই মতো। বলে, আসবি? একটু আমার কাছে বসবি? আমি তোদের বিনে পয়সার মদ খাওয়াব, যত চাস, তোদের নিয়ে মোটরে চক্কর দেব। আসবি? একটুখানি আমার সঙ্গে কাটাবি শুধু। আর কিছু না। আমার এখন সেই পালা চলেছে। আমি সেই পুরুষ বেশ্যা এখন, প্রগাঢ়, প্রৌঢ়।”

একটু থেমে অরিন্দমই শুরু করলেন আবার। “তাই মদ খাই। অরুচি ত জানি তবু। অনুচিত আর অস্বাস্থ্যকর। তবু। উপায় নেই। শরীরকে কষ্ট দিয়ে মনটাকে খানিক তাজা রাখা, এইমাত্র। বুঝেছ, এই হল ড্রিংকিং-এর একমাত্র ফিলজফি।”

“কিন্তু” তিনি বলে গেলেন, “শেষ কথা এই নয়, এটা সর্বশেষ দর্শন হতে পারে না কখনও। এর পরেও, তরলিত চেতনা দিয়ে সকলকে সহনীয় করার, সকলের কাছে গ্রহণীয় হবার, পরেও নিশ্চয় কিছু আছে। জীবনের অন্য কোনও মানে আছে। আছে কিনা, আমি তাই খুঁজছি।”

বলেই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে অরিন্দম একটা দোকানের সামনে গাড়িটা থামিয়ে দিলেন। নিয়ন-জ্বালা অক্ষরে সেই দোকানের পরিচয় পড়ে আমি তখন কাঁপছি।

৩৭

তিরতির করে উড়ে যায় পাখি। গাছ বেয়ে তরতর করে উঠে যায় কাঠ-বিড়ালি কতবার দেখেছি, আজও দেখি। যখনই সুযোগ ঘটে। কী দেখি? ওদের স্বাচ্ছন্দ্য? ওরা কত লঘুভার, নিজ নিজ শরীরের ওপর ওদের সম্পূর্ণ অধিকার—দেখি এই সবই তো? মানুষের যা নেই, মানুষ যা পারে না। পারে না অবলীলায় লাফিয়ে উঠতে, ‘ইচ্ছেমতো আপন দেহকে আপনারই আজ্ঞাবহ করতে। এই যে পাখিটা যেমন খুশি খুঁটে খুঁটে কী খেল, আবার অহেতুক চক্রাকারে নাচতে থাকল, তারপর সহসা গতির একটি তির হয়ে ছুটে গিয়ে বসল কোনও ডালে, হয়তো একেবারে অগ্রভাগে পাতা পল্লবের মাঝখানে, সেখানে শরীরের ভার সঁপে দিয়ে দোল খেতে শুরু করল—আমরা কি তা পারি? পারি না। যেহেতু মানুষ অভিকর্ষের অভিশাপে আষ্টেপিষ্টে বাঁধা, দেহের কাছে দাসখত লিখে দিয়ে জাগতিক যাবতীয় নিয়মবিধি তামিল করে চলেছে।

মানুষের তবে মুক্তি কোথায়? অতীতে। সেখানে তার স্বচ্ছন্দ বিহার—ওই পাখি আর কাঠবিড়ালিরই মতো। ইচ্ছেমতো সব খুঁটে তুলতে পারে সে, আগডালে মগডালে গিয়ে বসে। শরীর যা পারে না, মন দিয়ে তা উশুল করে। এই মন নিজ খেয়ালেই টেনে বের করে ছবির পর ছবি, যেমন আমি দেখছি, দেখাচ্ছিও, সম্মোহিত, মুগ্ধ। কখনও বা চকিত, কখনও অনুতপ্তও। দেখছি।

অথবা আমি খুঁজছি নাকি? যেন কোথাও এখনও একটি বালক সবুজ কয়েক গাছি দূর্বা হাতে নিয়ে বসে আছে কোনও ব্রতকথার আসরে, সরল বিশ্বাসে, ভক্তিতে বা শুধুই কৌতূহলে, মুগ্ধ হয়ে শুনছে প্রত্যয়াদিষ্ট, মেলানো পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তি, সুর করে ছড়া পড়া! কোথায় পাব আজ তাকে? ব্রতপাঠের আসর থেকে সে কবে উঠে গেছে। বাঘবন্দি খেলার ছকটাতেও ঘুঁটি ছড়ানো, সেখানেই বা সে বসে রইল কই! চলে এসেছে। আজ অতীত তাকে ছোবল মারে শুধু, সে-ও তাই পাল্টা ছুটে ছুটে গিয়ে ছোবল মেরে আসতে চায় তার অতীতকে। এ লেখাটা কি তাই? সেই অতীতের একটা ভাগের সার্বিক প্রতীক তুমি, কিন্তু ভাগীদার, দাবিদার আরও কত জনে, বুলা প্রভৃতি আরও অনেকে।

আজ হাত বোলাচ্ছি সেইখানে, চুরি করে বুঝি ঠোঁটও রাখছি একবারটি, বুলা যেখানটায় ছোবল মেরেছিল, যেখানটায় বিষের ব্যথা আর নেই, নেই, যেহেতু কিছুই থাকে না, আনন্দ বেদনা সবই মিলিয়ে যায়, একই পরিমণ্ডলে সুরভি আর পূতিগন্ধ মিশে থাকে অনায়াসে, সহবাস জীবন মানে আগাগোড়া অশেষ বিপরীতের শুধু প্রেম, আক্রোশ, বাসনা, ক্ষমা আর বিদ্বেষ, একই ইন্দ্ৰধনুতে দ্যাখো, দ্যাখো কত বিবিধ বর্ণের সমাবেশ, জীবন কী তবে এই ইন্দ্রধনু, বেগুনি থেকে নীল, নীল থেকে হরিৎ, হরিৎই, পরে ঈষৎ শুকিয়ে হবে পিঙ্গল বা হরিদ্রা, তার পরে? কমলা। অবশেষে সত্যের মুখ, সূর্যের মুখের মতো রক্তাক্ত।

আঃ, রক্ত, যা ছুপিয়ে যায় সকালে জবায়, হৃদয়ের সহস্রার কমলেও যা অনর্গল বিগলিত, কিন্তু ফের কেন সেই রঙের প্রসঙ্গে ফিরে এলাম, এলামই যদি আর একটু থাকি না কেন, অন্তত এইকথাটা লিখতে যে, বর্ণের মধ্যে রক্তই সবচেয়ে বয়স্ক, পরিণত।

তবু শেষ পরিণতি, বুঝি রক্তও নয়, সে কি তবে শুভ্র? শুভ্রতায় হয়তো পাই শুচিতাকে, কিন্তু শেষ কথা শুচিতাও নয়। একেবারে শুরুতেও সে ছিল না। আলোকে সব শুভ্র হয়, তবু সেই আলোকও অনাদি হতে পারে না, কখনও-না-কখনও সে সৃষ্ট হয়েছিল নিশ্চয়ই। তবে? আলোকেরও আগে কী, এই সন্ধানে রত হয়ে তখন অন্ধকারকে দেখি। নিরাকার, ভয়ঙ্কর, কিন্তু তাকে সৃষ্টি করতে হয় না, সে ছিল। আছে! থাকে। সব রঙ যখন মিলিয়ে যায়, শুভ্রতাও যায় নিঃশেষে মুছে, তখনও কী থাকে? যা অন্ধকার, যা কালো। আদিতে যে, সে-ই অন্তেও। কেউ যখন নেই, কোনও রকমারি রঙ না, তখনও কালো অন্ধকার বলে “আমি আছি।” রজতগিরি-সন্নিভ শুভ্রতাকেও তাই অপরিমেয়, বিশাল অন্ধকারের পদতলে শয়ান দেখি!

কিন্তু মা, এসব কথা তো এখনকার। তখনকার আমাকে তো সেই কখন থেকে বুলাদের ছাদে বসিয়ে রেখে এসেছি। শ্বেতীগ্রস্ত সেই চন্দ্রকান্ত জ্যোৎস্নার সন্ধ্যাটিকে, চলো যাই, ফিরে গিয়ে দেখি।

সুডৌল একটি বোতল নেড়ে নেড়ে বুলা বলছিল, “কী বল্ তো? তরল অনল—একটা পদ্যে পড়েছি। একটু চাখবি?” প্লেটে রাখা পাঁঠার ভাজা কলিজা থেকে ধোঁয়া উঠে সেই প্রেতকায় মিহি জ্যোৎস্নায় মিশে যাচ্ছিল। নখ-তীক্ষ্ণ আঙুল দিয়ে একটি খণ্ড বিঁধে তুলে নিয়ে বুলা বলছিল, “কেমন যেন গা শিরশির করে। কজেগুলো হঠাৎ যদি নড়াচড়া করে ওঠে?”

অরিন্দম প্রজ্ঞাপারমিত কণ্ঠে বললেন, “মরা কলজে কিনা বুলা! একে মরা, তায় ভাজা ভাজা তাই কখনও নড়াচড়া করে না।” তিনিও একটা পিস্ তুলে দাঁত বসালেন। বাঁশি একটা শুকনো মালা গলায় পরে ঘট হয়ে বসেছিল। তার চোখ ঢুলুঢুলু, তার মুখে কথা ছিল না।

আমার ঠোটে কষ, রস গড়িয়ে পড়েছিল আমার জামায়, আমিও কি ভাজা কলজেগুলো একটার পর একটা তুলে মুখে পুরতে শুরু করে দিয়েছিলাম?

বুলা ওর আঁচলের একটা কোনা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আমার বুকে লাগা রস মুছে মুছে দিচ্ছিল, কখন একটা গ্লাসও সে ধরল আমার মুখের সামনে, “একটুখানি খেয়ে নে, দেখবি ঠোটের কষ ধুয়ে যাবে”, আমি মুখ সরিয়ে নিলাম, বললাম, “বড্ড তেতো, তা তা ছাড়া ফেনা।”

ফেনা? ও গোড়ায় একটু থাকে, পরে দেখবি সব ফেনা মরে যায়, মানুষের মতো। এর নাম সাকুরা যে। একটু পরে দেখবি, ফুরিয়েও যায়। তখন দেখবি, এই ফরাসে কাত হয়ে পড়ে আছে। যে ফুরলো সেই বোতল আর যারা ফুরিয়ে দিল সেই মানুষ—বোতল আর মানুষ ফরাসে একই সঙ্গে গড়াগড়ি যায়।”

বলছিল বুলা, আর পায়ের রঞ্জিত নখ অলখ্যে আমার পায়ের পাতায় বিধিয়ে দিচ্ছিল। তার একটা হাত বাঁশির গলায় জড়ানো, একটা কনুইয়ের ভর সমাধিস্থপ্রায় অরিন্দমের উরুতে, তার মুখখানি ঈষৎ তোলা, যেন বোতলের কাছে যা পাবার সব আদায় করে বুলা এখন চাতকিনী, আকাশের কাছে বাকিটা প্রার্থনা করছে, হিম বা জ্যোৎস্না যাই হোক না কেন, ওর আলগা দুই ঠোঁটের ফাঁকে ঝরে পড়ুক।

ওর নখরাঘাতের যন্ত্রণা ভুলতে, মা, আমিও তখন, একটা গ্লাস তুলে মুখে ঠেকালাম।

কতক্ষণ, কতক্ষণ? এক-একটা সেকেন্ডে যেন এক-একটা পিপীলিকা, ধীর পায়ে উঠে আসছে আমার মজ্জা-মেরু বেয়ে; সেই এক-একটা সেকেন্ডই আবার যেন এক-একটা বেগবান ঘোড়া হয়ে, টগবগ ক্ষুরের ঘায়ে আমার অস্থি-পঞ্জর সমেত সত্তাকে চূর্ণ-চূর্ণ করে গুঁড়িয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে।

আঙুল দিয়ে বুলা দেখিয়ে দিল—কত পরে?—অরিন্দমের নেত্র নিমীলিত। কানের কাছে মুখ এনে বলল, “শিবকে ত্রিনেত্র কেন বলে এবার বুঝেছিস? ওই দ্যাখ্, ওর চোখ উঠে গেছে কপালে।”

ইশারায় ওকে চুপ করতে বললাম, বুলা শুনল না, আরও ঘেঁষে এসে বলল, “ধ্যানাসনে যোগী কিছু শুনতে পাবে না। ও এখন এখানে থেকেও নেই। যেটুকু-বা আছে, একটু পরে তা-ও থাকবে না।”

সত্যিই একটু পরে অরিন্দম সেখানে আর ছিলেনও না। হাই তুললেন একবার, নিঃশব্দে, তুড়ি দিলেন, মানে দিতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু আঙুলে আঙুলে ঠেকে শব্দ হল না, বিপন্নের মতো তাকালেন এদিকে ওদিকে।

(দ্যাখো, আমার সব গেছে এখন আর চকমকিও জ্বলে না, অতএব দয়া করো আমাকে, ঘৃণা কোরো না )

শেষে, যত থেঁতলানো ফুল ছিল ছড়িয়ে, অন্তঃসারহীন যত বোতল আর চুষে-ফেলা সব, আর মরা কজের প্লেটগুলোর দিকে উপেক্ষার দৃষ্টি হেনে তিনি অরিন্দম, দেখি, হঠাৎ নিরুদ্দেশ। ভোলানাথের মতো টলমল পদপাত—আঃ! চলে যাওয়ার এমন সুন্দর নিস্পৃহ রূপ জীবনে বেশি দেখিনি।

“বুলা”, ফিসফিস করে বললাম, “উনি কোথায় গেলেন?”

“ভয় নেই, বেশি দূরে নয়—নীচে। মার—তোর লীলামাসির কাছে। এখানকার যা পাওয়া ওর শেষ হল, যতটুকু নিতে পারে ও নিয়ে নিল, এবার তাই চলে গেছে নীচে।”

“সেখানে কী হবে বুলা, কী হবে?”

বুলা বলল, “কী আবার! বিশেষ কিছু হবে না, ওদের বয়সিরা বিশেষ কিছু পারেও না। বুড়োবুড়ি দু’জনাতে মনের সুখে—কী আর?—মা ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দেবে, সেই সুখটুকু পেতে পেতে ও আরামে ঘুমিয়ে পড়বে, এই পর্যন্ত। …আর মা, মানে তোর লীলামাসি কী পাবে ভাবছিস? পাবে। সে-ও পাবে। গায়ে হাত বুলোনো, ওতেই ওর পাওয়া হয়ে গেল। সারা সন্ধে ভাজাভুজি যা করেছেন খাটাখাটুনি সব কিছু দাম ওতেই হয়ে গেল।”

পর পর হাতের সব ক’টা আঙুল মটকে বুলা প্রথম হাই তুলে আলস্যের ভঙ্গি করল, পরে তুড়ি দিয়ে আলস্য কাটাল। বলল, “আমরা চারজন ছিলাম, এখানে, এখন হলাম তিন হারাধনের তিনটি ছেলে নাচে ধিনধিন।” হাওয়া উঠে রাতটা ক্রমশ উতলা হয়ে উঠেছিল, আমার কপালে তবু ফোঁটা ফোঁটা ঘাম। মুছে নিয়ে মনে মনে বুঝি প্রার্থনা করতে থাকলাম, “ছড়ায় যাই লিখুক, তাই বলে, বুলা, তুমি যেন এখন ধিন ধিন নাচ শুরু করে দিও না।”

তখন আমাকে চমৎকৃত এবং পরিবেশকে চকিত করে বুলা একটা তালি দিল। বলল, “আয় একটা মজা করি!”

মজা, আরও মজা? নিজে মজে গিয়েছি, তবু ঘোলাটে বোধ দিয়েই ভাবতে শুরু করেছি, আজকের সন্ধ্যার জন্যে বুলা বাঁচিয়ে রেখেছে আরও কত মজা?

বাঁশি ঢুলছিল, শুকনো কতকগুলো পাতা কোথা থেকে উড়ে এসে ওর মাথার উপরে পড়ল, বুলা উঠে গিয়ে বাঁশির লম্বা লম্বা বাবরি চুলে ঝাঁকুনি দিয়ে পাতাগুলো ঝেড়ে দিয়ে এল। বাঁশি তবু নড়ছিল না। বুলা কনুইয়ে মুখ রেখে একটা হাসি চাপার ভাব করল।—”দেখলি, ওর হুঁশ নেই। আরও একজন গেল। রইল বাকি দুই। এবার তোতে আমাতে।”

বিবর্ণ মুখে বলে উঠলাম, “কী, বুলা, কী।”

“একটা খেলা। খেলব আমরা দু’জনে। কেউ দেখবে না, টের পাবে না আয়।”

বুলার চোখের মণি সবুজ কাচে ছোট্ট দুটি দুষ্টুমির গুলি হয়ে যেন জ্বলছিল। “আয়”; দুটো মোটে অক্ষরের শব্দ, টেনে টেনে বুলা বলছিল, “আয় খেলবি আয়।” আয় শব্দটা যেন কোনও টুকটুকে পাখির মতো হাওয়ায় ভর করে উড়ে উড়ে এসে আমাকে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছিল।

উপর দিকে চেয়ে বললাম, আকাশের রঙ আর নীল নয়, পাঁশুটে, নীল নেই দেখে যেন ভয় পেলাম, তাই বললাম, “বুলা, এ কি সেই খেলা যা কিশমিশকে লুকিয়ে আমরা সেই পিকনিকের দিনে খেলেছিলাম?”

“সেই খেলা”–আমার গালে টোকা দিয়ে বলল, ঠিক বুঝেছিস।”

আকাশের চাঁদটার গায়ে তখন গুঁড়ি গুঁড়ি পিঁপড়ে বসেছে, ছোপ ছোপ আলোর সঙ্গে মিশে গেছে ছোপ ছোপ অন্ধকার। রাতটার গায়ে যেন রোঁয়া উঠেছে। শেষ বোতলটা তখন খোলা হল, খুলল সেই—সেই চতুরিকা আর নিপুণিকা যে-নায়িকা সেখানে ছিল। খোলার চাবিটা হাতড়ে হাতড়েও পাওয়া যায়নি, তাই বুলা ছিপিটায় একবার দাঁত বসিয়ে দিয়ে টেনে খুলতে চেষ্টা করল, হল না, বরং ঠোঁটের কোণ কী করে কেটে কষ-কষ রক্ত চুঁইয়ে পড়তে শুরু করেছিল, আমি দু’হাতে চোখ ঢেকেছি। বরাবরের আনাড়ি তা ছাড়া ওই পটভূমিতে ম্রিয়মাণ বর্ণে অঙ্কিত আমি আর কী করতে পারি, ওরই ফাঁকে পিটপিটে চোখে দেখে নিয়েছি বুলা দমেনি, উঠে গেছে দরজার আড়ালে আংটায় আটকে এক হ্যাঁচকা টানে বুঝি বোতলটাকে খুলেও ফেলেছে, সেই ছাদে বিবিধ নৈসর্গিক দৃশ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল এই সব।

ফিরে এল বুলা, ঢকঢক করে ঢালল বোতলের ভিতরকার পদার্থ, একটা বড় গ্লাসে! আমি কী দেখছিলাম, বুলাকে, যে চুল আঁচল সব আলগা করে দিয়ে তখন পা ছড়িয়ে বসেছে শীতলপাটিতে, বাঁশির কানের কাছে মুখ নিয়ে আর মুখের কাছে গ্লাস ধরে বলছে, খাবি আর একটু? খা।”

অথবা আমি কি দেখছিলাম বাঁশিকে যে-বাঁশি তখন তদ্‌গত, দারুভূত, অবিচল, —অক্লেশে, নিঃশেষে যথা নিযুক্ত তথা চুমুকের পর চুমুক দিয়ে চলেছিল?

না, আসলে হয়তো আমি দেখছিলাম বোতলটাকে, যার তলা থেকে উঠে আসছে বুড়বুড়ি, যেমন বোবার অনেক কথা উঠে আসে মনের তলা থেকে, ক্রমাগত ওঠে কিন্তু ফোটে না, অবশেষে স্থির হয়ে থাকে!

.

তারপর? সেই খোলাখুলি খেলাটা শুরু করেছিল কতক্ষণ পরে? যত অকপটতারই না ভান করে থাকি এই চিঠিটাতে, মা খেলাটার সব কথা তোমাকে খোলাখুলি লেখা যায় না। কতকগুলি নিয়ম সংস্কার আর শিক্ষা আমাদের কালের মানুষদের অনুসরণ করে এসেছে, আজও আমাদের সঙ্গে আছে। তাই শালীনতার সীমান্ত যদি বা লঙ্ঘন করি কখনো-সখনো, বেড়াটা গুঁড়িয়ে দিই না।

.

মানুষ একটু আগে কী লিখলাম, মানুষ? আমি ওই প্রজাতির দাবিদার, কিন্তু এই দাবি কতটা সঙ্গত, আমি আজও জানি না। মানুষ নামধেয় জীবের কতটা মনুষ্যত্ব, পশুত্বও বা কতটা তার কোনও প্রামাণিক অনুপাত অদ্যাবধি নিরূপিত হয়নি। স্থান কাল বুঝে, বিশেষ-বিশেষ বয়সে আর পরিবেশে সেই অনুপাতের হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। কখনও কখনও আকৃতি ছাড়া মনুষ্যত্বকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষ মাত্রেই প্রাণী, আর প্রাণী মাত্রেই মূলত পশু, এইটেই তখন শেষ সমীকরণের অঙ্ক বলে বোধ হয়।

বুলা কি ছলাকলা করছিল? বুলা কি হঠাৎ এক-একবার খিলখিল করে হেসে বলছিল—বলছিল যখন আমার হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত, আমি আর আমাতে ছিলাম না—”এই! না, না, ঠোঁটে না। দেখছিস না আমার ঠোঁটে রক্ত?”

রক্ত আমি দেখিনি, দেখতে পাচ্ছিলাম না কেননা বুলার লিপিস্টিক-মাখা ঠোঁটও দেখেছি একই রকম টকটকে থাকে।

এইটুকু বলা যায়, বুলা মাঝে মাঝে হাত ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল, কার্নিসের উপর ঝুঁকে পড়ছিল উপুড় হয়ে, কখনও কাছে এসে, ঘনতপ্ত নিঃশ্বাসে–নিঃশ্বাসেরও দাহ থাকে, তার ফুলকিতে আমার চোখে মুখে নাকে ফোসকা পড়ছিল। আমি তখন শুধু মাঝে মাঝে জান্তব কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারছিলাম।

একবার, বুলা যেই পালিয়ে যাবে, তখন কি খপ করে ওর আঁচল মুঠো করে ধরেছিলাম? আঁচলটা সামলে টেনে নিতে গিয়ে বুলা কি আরও খুলে গিয়েছিল, যদিও মুখে বলছিল, “এই দুষ্টু, এসব কী, এখন না”, বলছিল “এত দূর না”, আর আমি ভূতাবিষ্ট বলছি “না কেন বুলা, না কেন। এই খেলাটাই আমরা খেলব, একজন সঙ্গীকে মাতাল করে দিয়ে, তাকে মৃতবৎ জ্ঞান করে তার চোখের সামনে, অন্ধপ্রায় রজনীগন্ধাকেও ফাঁকি দিয়ে সেদিন যেমন—বুলা, সেই খেলারই তো আজ আর-এক রাউন্ড, তাই না?”

রজনীগন্ধা। এই একটি নামে হঠাৎ যেন স্থির হয়ে গেল বুলা, সেই বুলা, কাকে কখন কতটুকু দিতে হবে, কিসের বিনিময়ে কত, বড় হোটেলে যেমন ব্রেকফাস্ট পাঁচ টাকা, লাঞ্চ আট, ঘরভাড়া ইত্যাদির, বাঁধা হিসাব লেখা থাকে, সেই রকম একটা হিসাব মেপে রেখেছে যে-বুলা, সেই বুলা হঠাৎ যেন খাতাপত্তর বন্ধ করে ঠান্ডা হয়ে গেল। হিসহিস করে উঠল, “সেই পেত্নীটা বুঝি নামেনি ঘাড় থেকে?”

“ছি বুলা, পেত্নী বোলো না। যে চলে গেছে, তাকে নিয়ে—”

আমার বুকে একটা আঙুল-রেখে বুলা বলল, “লাগছে বুঝি! আহা, কোথায় রে? এখানে?”

“বুলা, সে বড় দুঃখী।”

একটু সরে গিয়ে বুলা মণি স্থির করে তাকাল আমার চোখে চোখে।—”আর আমি? আমার? আমার বুঝি সবটাই সুখ?” তার চোখে তখন আর ফুর্তির লেশ ছিল না।

একটা উগ্র গন্ধে আমার গা গুলিয়ে যাচ্ছিল, সেই গন্ধ ওর চুলের, না চটকানো কিন্তু তখনও ওর গ্রীবামূলে সেঁটে-থাকা কোনও ফুলের, আমি বুঝতে পারছিলাম না। চৌকিদার চাঁদটা মাথার উপরে উঠে এসে তখন আরও লালচে হয়ে গিয়েছিল, তাই নীচের কোনও স্তরে হিম কিংবা কুয়াশা জমে জমে পৃথিবী তখন সত্যিই যেন ধূমাবতী।

শুকনো গলায় বললাম, “আমাকে এখন ছেড়ে দাও বুলা, আমি এখন যাব।”

“যাবি? যাবি বই কি, এখানে থেকে যেতে কে আর আসে।” এই পর্যন্ত বুলা বলেছিল স্বাভাবিক গলায়, দীর্ঘশ্বাস চাপার ধরনে, তার পরেই পলকে সে আবার তরল হয়ে গেল, আমার দুটো হাত মুঠো করে ধরে সে নিয়ে গেল তার কণ্ঠতটে, হাতদুটিকে এক লহমা সেখানে থাকতে দিয়েই দূরে ছুঁড়ে দিল, নিমেষে নিমেষে এইসব ঘটছিল, হঠাৎ দেখি বুলা ওর হাত বাড়িয়েছে আমার গলায়, কাঁধে নাক ঘষে ঘষে বলছে, “এই, আমাকে বিয়ে করবি?”

এই প্রলাপের উত্তর দিতে নেই আমি জানতাম। বুলা তখন আরও ঘন হয়ে আরও ঘন করে জ্বাল-দেওয়া গলায় বলল, “আমার সত্যিই খুব বিপদ—বিপদে পড়েছি। তুই কিন্তু মানিক ইচ্ছে করলে আমাকে উদ্ধার করতে পারিস।”

“কিসের বিপদ বলছ বুলা, বুঝতে পারছি না।”

“সত্যিই খুব বিপদ, মাইরি। এই তোকে ছুঁয়ে বলছি।”

“তুমি যদি থিয়েটারে কখনও না নামতে বুলা, তবে হয়তো বিশ্বাস করতাম। কিন্তু তুমি প্লে-ও করো কিনা, তাই সব সময় ধরতে পারি না, কোন্‌টা অভিনয় তোমার, আর কোন্টা ঠিক বলছ। যাক, বলো না কী বিপদ।”

“বিপদ মেয়েদের তো একটাই হতে পারে”, কেমন ঢঙে বুলা কথাটা যে বলল! — “বুঝলি না? বিয়ে না করিস, আমার উদ্ধারের উপায়টা অন্তত বাতলে দিতে তো পারিস?”

তবু চুপ করে আছি দেখে বুলা হঠাৎ যেন হিংস্র হয়ে গেল, একটা বিড়ালির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপরে, কাঁধে থাবা বসিয়ে, যেন মাংস খুবলে নেবে, সেইভাবে বসিয়ে, বলতে থাকল, “এখনও বলতে চাস যে বুঝিসনি? তিলে খচ্চর কোথাকার। তোর ওই কিশমিশ নামে মেয়েটার তবে কী হয়েছিল? বলতে চাস তুই তাকে বিপদে ফেলিসনি? ফেলিসনি তো নেকী-খুকী মেয়েটা ডুব দিয়েছে কেন? তোর হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি, পুরো বদমায়েশি তোর পেটে পেটে। বলতে চাস, তোর কিশমিশকে তোর দেওয়া কাঁটা থেকে মুক্ত হয়ে আসবার জন্যে ষড় করে পাঠাসনি?”

“কী যা-তা বকছ”, বলে আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গেলাম, কিন্তু বুলা দিল না, সাঁড়াশির মতো শক্ত করে ধরেছে আমাকে, আমি চেপটে যাব, বুলা পাগলের মতো শ্বাস ছাড়ছে, হা-হা করে বলছে, “জানিস তুই সব জানিস—এ-বিদ্যে তোদের ফ্যামিলিতে আছে। তোর মা নষ্ট করেছিল একটাকে, তুই নিজেই বলেছিস একদিন। বলিসনি?”

এবার ওর হাত মুচড়ে মুচড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার পালা আমার। যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাচ্ছে বুলা, মার-খাওয়া সাপের মতো ওর শরীরটা বেঁকে গেছে তবু থামছে না। ওর কণ্ঠ তখন যেন আর ওর বশে নেই, স্বরনালি একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বুলা তখনও দম নিয়ে, ফুলে ফুলে বলছে, “তোর বাবা সন্দেহ করত, তোর মা তাই ওটাকে নষ্ট করেছিল। আমি জানি—”

বাকিটা ওকে আমি আর শেষ করতে দিইনি, শরীরে যত শক্তি ছিল সব সংহত করে ওকে আমি প্রচণ্ড একটা চড় মারলাম। লাট্টুর মতো ঘুরে বুলা পড়ে গেল, সেদিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, “বেশ্যা! হারামজাদী! ‘

হ্যাঁ মা, আমি পুরুষ হয়েও একটি মেয়েকে মারলাম। আমি সংস্কৃতি-অভিমানী; আমি রুচিমান, তবু অনায়াসে “হারামজাদী” কথাটা উচ্চারণ করতে পারলাম। পায়ের কাছে পড়ে থাকা সাপিনীটাকে পা দিয়ে থেঁতলে দিতেও বুঝি তখন আমার আটকাত না।

কিন্তু বাঁশি গোলমালে কখন উঠে পড়েছিল, হঠাৎ চমকে দেখি সে আমাকে পিছন থেকে জামা ধরে টানচে।

.

বাঁশিই এক রকম টানতে টানতে আমাকে নীচে নিয়ে এল।

বাঁশি আমার পাশে, অন্ধকারে। ওদের বিরাট জুড়ি গাড়িটার ভিতরে আমরা বসে আছি। ঠক-ঠক, ঠক-ঠক–ঘোড়ার ক্ষুর ঘা দিয়ে দিয়ে পাথরে বাঁধানো রাস্তায় শব্দ তুলছে। টগবগ, টগবগ—ওই ঠক-ঠক আওয়াজটা চলার লয় যে-ই দ্রুততর, অমনই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। ঠকঠক আর টগবগ—হয় হাতুড়ির শব্দ, নয়তো ভিতরে অনবরত কিছু ফুটতে থাকা, এ ছাড়া চারপাশে তখন প্রাণের চিহ্নমাত্র ছিল না। রাত তখন খুব বেশি নয়, তবু শহরতলি তখনকার দিনে ওরই মধ্যে কেমন ঝিমিয়ে পড়ত।

বাঁশির মুখ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। ফাঁকে ফাঁকে এক-একটা গ্যাসের বাতি ঝলসে যাচ্ছিল বটে, প্রেতবৎ পীত একটা উপস্থিতিকে প্রকট করে তুলছিল।

“স্টেজে আগুন ধরে গিয়েছিল, তাই না রে? বাঁশি সহসা বলে উঠল, “আর তাই আমরা পালিয়ে এলাম?”

বাঁশি প্রথম বাক্যটি সাজানো ছিল জিজ্ঞাসার আকারে, কিন্তু উত্তরের জন্য সে অপেক্ষা করল না, পরবর্তী সংলাপ নিজেই বলে গেল—”পালিয়ে এল দু’জন অভিনেতা, তার মধ্যে একজন অবশ্য কাটা সৈনিক, যে শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য দ্যাখো, কাটা সৈনিক যে, সেই কিনা জ্যান্ত নায়ককে টানতে টানতে নিয়ে এল।”

ভাবলেশহীন নিস্তর কণ্ঠস্বর বাঁশির, মা, আমি তখনও বুঝিনি, সেই সন্ধ্যার নাটকটা তখনও শেষ হয়নি, আরও একটু বাকি আছে। মঞ্চে আগুন লেগেছে, তাই ছোট্ট একটি দৃশ্য এখন অভিনীত হবে গাড়ির অভ্যন্তরে।

আমার গা ছমছম করছিল, যেহেতু একটা অপরাধবোধে আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম। —”বাঁশি”, আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “আমি তোমার প্রতি একটা অন্যায় করেছি।”

সেই স্বীকারোক্তিতে কান না দিয়ে বাঁশি বলে গেল “পালাটা কিন্তু বেশ জমেছিল। নেহাত . স্টেজে আগুন ধরে গেল, তাই—”

বলতে গেলাম, “বাঁশি, তুমি জানো না—“

তেমনই নিরুত্তাপ স্বরে বাঁশি ধীরে ধীরে বলে গেল, “আমি সবই জানি।” ওর পাশে বসেই আধো অন্ধকারে টের পেলাম একটা ছোট ধাতব বস্তু ও হাতে করে নাচাচ্ছিল।

“সবই জানো?” আমি যেন দীর্ণ হয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “জানো যে, বুলা ইচ্ছে করে তোমাকে অত অত মদ গিলিয়েছিল, যাতে তুমি বেহুঁশ হয়ে পড়ো, কিছু টের না পাও, তোমারই চোখের সামনে আমরা যাতে বিনে বাধায় মজা করতে পারি—”

.

আরও কত কী হয়তো অনর্গল বলে যেতাম, বাঁশি আবার আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “জানি। আমি বেহুঁশ হইনি তো, ঘুমিয়ে পড়িনি। সটান হয়ে পড়েছিলাম খালি। ভুলে যাও কেন যে আমিও একজন অভিনেতা, যদিও কাটা সৈনিক ছাড়া কোনও পার্ট পাইনি।” একটু থেমে সে বলল, “আমি সব দেখেছি, সব জানি।”

সেই ধাতব পদার্থটা তখনও সে হালকা হাতে লুফে লুফে ধরছিল। রাস্তার আলো এক-একবার উঁকি দিয়েই পিছিয়ে পড়ছে, বস্তুটাকে আমি চিনেও যেন চিনতে পারছিলাম না, ফলে অস্পষ্ট একটা ভয়ে অবশ হয়ে বললাম, “বাঁশি ওটা কী?”

সে নিশ্চিন্ত, অলস গলায় বলল, “রিভলভার।“

তাড়াতাড়ি তার হাত চেপে ধরে বললাম, “বাঁশি তুমি, কি—” হাত ছাড়িয়ে সে বলল, “এ ছাড়া আমার উপায়ই বা কী? জীবনে আর কিচ্ছু হল না, হবেও না, গোটা দুনিয়া যাকে নিয়ে শুধু ঠাট্টা করল, সবাই মিলে ঠকাল, এমন কি আশ্রিত, রাস্তার যে-কুকুরটাকে তুলে এনে ঘরে ঠাঁই দিলাম, ঠকাল সে-ও–কোন্ সুখে সে বেঁচে থাকবে বলতে পার?”

ওর চরম আঘাতটাও গায়ে মাখার মতো মনের জোর তখন আমার ছিল না, আরও একবার ওর হাত চেপে বললাম, “বাঁশি আমাকে ক্ষমা করো। আত্মঘাতী হতে তুমি পারবে না, কিছুতেই পারবে না।” মনের জোর ছিল না তাই গায়ের জোর খাটিয়ে আমি ওই ধাতব হাতিয়ারটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করলাম।

আর তখনই বোমা-ফাটার মতো হাসি হেসে—বাঁশির গলায় এত যে জোরালো আওয়াজ আছে আমি জানতাম না—সে আমার কাঁধে থাবড়া মেরে বলে উঠল, “বিলকুল বুদ্ধু, তোকে কেমন ঘাবড়ে দিলাম? আরে, এটা সত্যিকারের জিনিস নাকি, দেখেও বুঝিসনি, এটা একটা খেলনা—থিয়েটারে যা দুমদাম ফাটে সেই টয় রিভলভার?” বলতে বলতে অকস্মাৎ সে আবার তার পরিচিত রুগ্ন বিষণ্নতায় ফিরে এল। জড়িত গলায় তাকে বলতে শুনলাম, “সত্যিকারের জিনিস পাব কোথায়, পেলেও তাকে ব্যবহারের সাহস কি আমার হবে? জানিস, আমার অদৃষ্ট আমি পড়ে নিয়েছি—মিথ্যে একটা জীবনে বেঁচে আছি, কিন্তু সত্যিকার মরার সাধ্য আমার হবে না।”

বলতে বলতে এবার বাঁশিই আমার হাত চেপে ধরল, “কিন্তু কী করব, কোথায় যাব বলতে পারিস? যুদ্ধটা জমে উঠেছে, মাঝে মাঝে ভাবি নাম লেখাব। তবে এই চেহারায় লড়াইতে তো আমাকে নেবে না, এমন-কি সিভিল গার্ডও করবে না। নিত্য যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি, তবু ওদের চোখে আমার মধ্যে সৈনিকের কোনও গুণ নেই। কখনও ভাবি, একটু-আধটু অ্যাকটিং তো জানি, তবে কেন ‘এসা-’য় ভর্তি হই না! যাকে বলে ফৌজি দিলখুশ, নেচে গেয়ে যারা পলটনদের মন ভোলায়। কিন্তু সেই দলেই কি আমাকে নেবে? দেহচিহ্নে আমি যে আবার পুরুষ! সুতরাং রাস্তা একদম বন্ধ— সে কৃত্রিম অথচ করুণ গলায় প্রবল বেগে বলে উঠল, তারপর হঠাৎ—”রোখকে, জেনানা হ্যায়!” বাঁশি নিজেকেই তাক-করা গলায় যেন গুলি ছুঁড়ল, ওদের বাড়ির বন্ধ ফটকের সামনে গাড়ি থেমেছিল, বাঁশি রিভলভারটা লুকিয়ে ফেলল জামার তলায়, তার মুখে তখন আর সুখ-দুঃখের লেশমাত্র ছিল না।

মা, আমি আজও জানি না, ওই রিভলভারটা মিথ্যে ছিল, না সত্যি।

.

গাড়ি দাঁড়াতেই বাঁশি টলতে টলতে উপরে চলে গিয়েছিল। আমিও নেমেই টের পেলাম আমার পাও টলছে। এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে কেটেছে, তাই বুঝতে পারিনি। হঠাৎ যেন কম্প দিয়ে জ্বর আসার মতো ভয়ের ধস ভেঙে পড়েছে মাথার উপরে—ঠান্ডা, কঠিন, চাপ-চাপ ভয়, তারই কুচো-কুচো গুঁড়ো আবার ছড়িয়ে যাচ্ছে রক্তের ভিতরে, পথ কই, কোন্ দিকে যাব, নাকি ফিরব, কিন্তু ফেরার রাস্তাটাও খোলা পাব তো, তদুপরি কানের কাছে একটা ভোমরা, একটা নয়, দুটো; দুটো নয় তো, তিন—না না চারটে,; কে জানে ক’টা—আমি আর জানতে পারছি না, হে ঈশ্বর, রাতেও ভোমরা বেরিয়ে পড়ে, কই কোনওদিন শুনিনি, ভোমরা, বোলতা, মৌমাছি এ-সবের গুঞ্জন, আক্রমণ ইত্যাদি তো জানতাম শুধু দিনে–তবে? এত জোনাকিই বা ফুটছে কোথা থেকে, নাকি জোনাকি নয়, তারা—আকাশটা হঠাৎ মাটিতে ঝরে গেছে? দূর দূর, প্রফুল্ল হতে চেষ্টা করে একবার ভাবলাম কিসের জোনাকি কিসের তারা, এ-সব তো সর্ষেফুল, তবু ভয় করছিল, এই নিশুতি-রাতে কে আমাকে একটা সর্ষেখেতে নামিয়ে দিয়ে গেছে? থই পাচ্ছিলাম না যেহেতু টলছিলাম, অথবা আমি নই, পায়ের নীচের মাটিই টলছিল। জোরে মাটিতে লাথি মেরে তাকে স্থির হতে বলতে কিন্তু মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। পড়ে গেলাম, কিংবা যাচ্ছিলাম, আর তখনই একটা হাত আমাকে চেপে ধরল। সেই হাতও কঠিন, ঠান্ডা, যেন বরফের মতোই।

.

আমার ভয়, আমার মৃত্যু, আমার ভক্তি, আমার প্রীতি, এই তো আমি তোমার কাছে ফিরে এসেছি, মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি তোমার, এবার কী বলবে বলো।

কী বলছ, স্পষ্ট করে বলো, অমন জড়ানো গলায় কথা বলছ কেন, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। তুমি যখন জড়ানো গলায় কথা বলো, মা, আমার কেমন কান্না পেয়ে যায়। সত্যি বলছি, ছেলেবেলায় খাওয়া তোমার বুকের সব দুধ যেন দই হয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। টক-টক গন্ধ—বিশ্রী। তার চেয়ে তুমি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলো, শুনি। তোমার জপতপ, স্তব, মন্ত্র এক সময়ে পাশে বসে চুপ করে শুনতাম, হাতে দূর্বা নিয়ে, মনে আছে? সেই যে আমাদের ফেলে-আসা বাড়িতে, বাসী হয়ে যাওয়া দিনগুলোতে—বাসী, বাসী, বাসী, হোক না, তবু সেই বয়সের মতো আর কিছু না। তখন তুমি আর আমি, আর রোজ সকালে সুধীরমামা…

আরে, তোমার পাশে সুধীরমামাই দাঁড়ানো না? সুধীরমামা আবার কেন, ওকে চলে যেতে বলো। খালি ‘তুমি আর আমি থাকি, আমার মৃত্যু আমার প্রীতি, মুখোমুখি। তুমি আর আমি আর তুমি…

“কোথায় ছিলি, কোথায় গিয়েছিলি?” কে জিজ্ঞাসা করছে, জানতে চাইছি এ কার কণ্ঠস্বর। এই সুদূর জলপ্রপাতের মতো প্রবল অথচ গভীর, নিশ্চিত এবং তীব্র ধ্বনি সে পেল কোথা থেকে?

“কোথায় গিয়েছিলি?” সেই একই জিজ্ঞাসা, জিজ্ঞাসা না জেরা? —আবারও? সরো। কোথা থেকে আসছি, কী করে ফিরছি, তা বলা যায় না। সব কথা জানা উচিতও না, দুঃখ পাবে। সরো। পথ দাও। ওপরে যাব। ফের যদি জেরা করো, তা হলে বলে দেব। দেব কিন্তু যদি বলে দিই আজকের সন্ধ্যার সব কাহিনি, আমার মনুষ্যত্বকে আমি বিকিয়ে দিয়ে এসেছি, বলি দিয়ে এসেছি আমার নিষ্পাপতাকে, সইতে পারবে? আমার আর কী, আমার তো সবে শুরু, কিন্তু মা, তোমার সব যাবে। শেষ পিদিমটাকে ফুঁ দিয়ে নেবাতে নেই।

তা ছাড়া পাপ করে এসেছে যে, সে মরিয়া হয়ে গেছে, তাকে আর ঘাঁটাতে নেই। সে আরও পাপ করতে পারে। আসল খুন হল জীবনের প্রথমটা—বাকিগুলো সব পরম্পরা নাও, এবার রাস্তা দাও, পথ ছাড়ো।

“আগে বল কোথা থেকে এলি। তুই নীচে নামছিস টের পেয়েছিলাম, যখন এ-বাড়ির ওই মেয়েটার সঙ্গে যাচ্ছেতাই মেলামেশা শুরু করলি। তারপর কত নীচে নেমেছিস আজ জানতে চাই আমি।”

“টের পেয়েছিলে?” টিটকারি দিয়ে বলে উঠলাম, “আমি।—”তবে মা তখন কেন কিছু বলোনি?” একটু অবকাশ দিয়ে ফের বললাম, “আমি জানি কেন। তুমি দোটানায় পড়েছিলে।”

“কিসের দোটানা?”

“একদিকে আমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছি, তোমার ভালো লাগত না। অন্যদিকে লোভ মালিকদের মেয়ের সঙ্গে তোমার ছেলে ভাব করছে, মন্দ কী। একবার কব্‌জা করতে পারে যদি, তা হলে তো তোফা—এ-বাড়ির হেড ঝি থেকে একেবারে শাশুড়ি; তুমিও লোভে পড়েছিলে মা, লোভে পড়ে আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলে। আমি শুধু তার সুযোগ নিয়েছি

তুমি থরথর কাঁপছ, এইবার তুমি টলছ—কেন? তুমিও একটি মৃত্যু দেখছ নাকি, আমি কি সেই মুহূর্তে মরে গেলাম তোমার চোখে, তাই কাঁপছ, যেমন কাঁপছিলে দাদার মৃত্যুর দিনে, ছেলে আর ছেলে রইল না বলে? আর তাই সুধীরমামা তাঁর লাঠি ছাড়াই এগিয়ে এসে শক্ত করে ধরেছেন তোমাকে, “আনু চুপ করো, স্থির হও”, ঠিক যেমনটি বলেছিলেন দাদার মৃত্যু রাত্রিটিতে? ইতিহাস থেকে আমি পুরনো ছবিটাকে যেন উঠে আসতে দেখলাম।

তুমি সেই তেমনই পাগলের মতো মাথা নাড়ছ অবিরত, অস্ফুট গলায় বলছ, “ছেড়ে দাও সুধীরদা, ছেড়ে দাও”, কী শক্তি তোমার, আর অদ্ভুত ধৈর্য তখনও ধপ করে মাটিতে বসে পড়োনি, নিজেকে যেন আরও কঠিন করে বেঁধে একেবারে সরাসরি বলছ, “তোর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, চোখ টকটকে, তোর মুখে গন্ধ। কিসের গন্ধ?”

বেশ, তবে তৈরি হও। আড়াল তুমি যখন রাখলে না, তখন রাখব না আমিও। সঙ্কোচের পর্দা ফালাফালা করে ছিঁড়ব। এই দ্যাখো, টানটান হয়ে দাঁড়িয়েছি তোমার সামনাসামনি, আমার বাঁকানো শিং দুটো, তেরিয়া আর মরিয়া–দেখতে পাচ্ছ না? “কিসের গন্ধ”, কথাটা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেছি, “সাবালক ছেলের মুখে কিসের গন্ধ থাকে? দুধের গন্ধ নয়, তোমাকে দিব্যি গেলে বলতে পারি।”

“তবে?”

“এ গন্ধ তোমার তো একেবারে না-চেনা হবার কথা নয়, মা। বাবার মুখে কখনো পাওনি?”—জোর দিয়ে বলে উঠলাম, ‘অনেক দিন পেয়েছ।”

আর বেশি নেবার ক্ষমতা নেই তোমার, ফুরিয়ে আসছ, দেখতে পাচ্ছি। চোখ দুটি একবার প্রজ্বলন্ত হয়েই নিবে গেল, সে কী কারণে? তোমাকে অপমান, না বাবাকে, কোন্‌টা বেশি বাজল?

“যে চলে গেছে, তোকে আশীর্বাদ করতে করতে, তাকে তুই এত বড় আঘাত করলি?”

কাপুরুষ আর পিশাচ, এই দ্বৈত কণ্ঠ নকল করে অনায়াসে বলেছি “করলাম।”

তখন যদি থেমে যেতে মা, বেঁচে যেতে। কিন্তু কত জন্মের পাপ তোমারও বুঝি জমা ছিল তাই প্রাপ্য শাস্তি পুরো করে নেবে বলেই মাথাটা আরও এগিয়ে দিলে। “চলে যা, চলে যা তুই, দূর হয়ে যা। যে নরকে ছিলি, যেখানে গিয়েছিলি, আরও খারাপ সেই মেয়েটার ওখানে তো? ফিরে যা।”

আর আমি, তৎক্ষণাৎ বললাম, “যাব, যাবই তো। যার বাবা মদ খেত, খারাপ পাড়ায় যেত—সেই নলিনীর কথা মনে নেই?—সে আর কতদূর হবে, যাবে কোথায়?”

“বললি, তুই বললি?”

বিকৃত, তেতো গলায় বললাম, “তুমি যদি আর কিছু না বলো, মা, তাহলেই সব থেকে মানায়। নইলে কী বলতে কী বলে ফেলব—”

“বাকি রেখেছিস কী?“

“অনেকখানি। এখনও বলিনি যে, বাবাকে আমি আঘাত দিয়েছি, বড় গলায় একথা বলা তোমার মুখে মানায় না। আঘাত আমি আর কতটুকু দিয়েছি? তুমি দাওনি? আরও বেশি দিয়েছ, তুমি আর উনি দু’জনে মিলে—”

আঙুল তুলে সুধীরমামাকে দেখিয়ে দিলাম।

ফ্যাকাশে গলায় বলেছ, “আমরা দু’জনে?”

“নয়?” যতটুকু বিষ ছিল তার সব ঢেলে দিয়ে তখনও বলছি, “না হলে উনি এখনও এখানে আছেন কেন! ছি, মা, ছি, ওঁকে চলে যেতে বলো। এত রাত্রে ভালো দেখায় না।

তুমি যদি বুলাদের মতো হতে, সেইক্ষণে হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতে। কিন্তু তুমি নিথর হয়ে যাচ্ছ, দেখতে পাচ্ছি। তাই তোমার হয়ে জবাব দিলেন সুধীরমামা। শান্ত গলায় বললেন, “যাচ্ছি। তুমি এতক্ষণ আসোনি, আনু ভেবে ভেবে সারা, তাই অপেক্ষা করছিলাম।”

“আর ভাবতে হবে না। এবার যান। “

লাঠিটা পড়ে রইল, দু’হাত বাড়িয়ে আর্ত, আহত, কোনও বৃদ্ধ পাখির মতো যেন ডানা মেলে, হাওয়া হাতড়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন, এখনও দেখতে পাই।

কুয়াশার আস্তরের মধ্যে তাঁর দীর্ঘ শরীরটা মিলিয়ে যেতে তোমার দিকে ফিরে বললাম, “আর কেন। এবার যেতে দাও। মানে মানে তুমিও যাও।”

মাথা নিচু করে, স্তিমিত, ধীর, নিচু, তুমি বললে, “হ্যাঁ, এবার যাব।“

.

মা, অতি নির্লজ্জ, তাই এখনও ডাকছি “মা”, তারপরেও কিন্তু সকাল এল। সকালগুলো আসে, নেহাত অভ্যাসবশতই আসে। সকালের আর একটা নাম কি প্রসন্নতা, স্নিগ্ধতা? কই তেমন প্রত্যয় সর্বদা তো বোধ করি না। সব সকালই আমার কাছে যেন তেতো-তেতো, সারা মুখে তেতো স্বাদ জড়ানো, আবশ্যিক কয়েকটি প্রাতঃকৃত্য—কদর্য। পাখির রব? আরে দূর! পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ি, পাখির ডাকে জাগি—এ সব একেবারে বানানো। আমরা প্রকৃতপক্ষে কিন্তু প্যাঁচার ডাক শুনতে শুনতে শুয়ে পড়ি, ঘুম ভাঙে কাকের ডাকে। রাত্রিদিনের বৃত্তান্ত এই তো।

পরদিন সকালে—তুমি নেই। তুমি ছিলে না।

চমকে উঠে সুধীরমামা বললেন, “কই সে তো এখানে নেই। আসেনি। আয়, তুই ভেতরে আয়।’ শান্ত কণ্ঠ, এতটুকু উত্তাপ, অভিমান বা অভিযোগ নেই।

“নেই? এখানেও নেই?” চিৎকার করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু গোঙানির চেয়ে স্পষ্ট কোনও স্বর পরিস্ফুট হল না।

আর সুধীরমামা? দেখতে পাচ্ছি তিনি কাছে এসেছেন, একটু নত হয়ে হাত রেখেছেন আমার পিঠে, বলছেন, “পাগল, তুই কি ভেবেছিলি সে এখানে এসে উঠবে। না রে, তুই ভুল করেছিস, আবার ভুল করছিস আনু এখানে কী আসবে? কখনও আসেনি, আসবে না। “

কী বলতে যাচ্ছিলাম, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আস্তে। ও-ঘরে ভামতী— একটু ইতস্তত করে যোগ করলেন “মানে, তোর মামি, অসুস্থ, ঘুমোচ্ছে। ওকে ডিসটার্ব করা ঠিক হবে না।”

আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সুধীরমামা বলে গেলেন ধীরে ধীরে,”তোকে কোনও দিন বলিনি, আজ বলতে বাধা নেই, তাই বলি। ওকে, মানে ভামতীকে নিয়ে ভুল বুঝেছে তোর মা-ও। আনু বলত, ‘তোমার কী সুধীরদা, তুমি তো সুখ, তৃপ্তি এই সব নিয়ে আছ। কিন্তু আমার কী আছে বলো তো।’ কিন্তু দ্যাখ, মানুষের কী যে আছে, কী থাকে, মানুষ নিজেই জানে না। যা আছে তা দেখতে না পেয়ে, আরও নেই কেন সেই নালিশ করে খালি হাহাকার করে। সুখ, আর দুঃখ এই দুটোকে আলাদা ছকে বসিয়ে কষ্ট পায়। যেন দুঃখ হল শীত, আর সুখ হল লেপ, সেই লেপখানার নীচে ঢুকে যেতে চায়। কিন্তু লেপে তো শুধু চাপা পড়ে, কিন্তু শীত যায় কি? শীতের হাত থেকে মুক্তি যদি চাস তবে ডুব দিস। একবার ডুব দিলে দেখবি, শীত আর নেই।”

সুধীরমামা থামলেন। লজ্জিত মুখে বললেন, “কিন্তু এসব কী বকবক করছি। আনু কোথায়?”

“মাকে কোথায় খুঁজব সুধীরমামা, কোথায় পাব?”

“কোথায় পাবি জানি না, তবে খুঁজতে হবে।” সুধীরমামা গভীর প্রত্যাদেশের স্বরে বললেন।

.

মা, আজও যখন ভাবি, মনে হয়, কোনও মোহানায় দাঁড়িয়ে আছি, আমি আর সুধীরমামা, আর তিনি প্রবল কোন প্রত্যয়ের সঙ্গে, মন্ত্রপাঠের মতো একটার পর একটা কথা উচ্চারণ করে চলেছেন।

সেই মোহানা যেখানে একটি সম্পর্কের সংহারকারী কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান। আশীর্বাদের মতো আশ্বাস ঝরে পড়ছে তার শিরে, “ভাবছিস কেন, ভাবিস না। সব মানবিক সম্পর্কই নদী কিংবা উপনদী, বিলীন হয় শেষ এক মহাসঙ্গমে। তাঁর সঙ্গে সেই সম্পর্কটা একবার স্থাপিত হয়ে গেলে দেখবি, পাপ পুণ্য, অনুসন্ধান, সব, অর্থহীন কিছু না।”

হঠাৎ চুপ করে সুধীরমামা বললেন, “তুই ভুল করেছিস, আনু ভুল করেছে, আমরা সবাই করি। জাগতিক সম্পর্ককে বড়ো করে দেখে। আমি ভুল করেছি সেদিন প্রতিশোধ নিতে গিয়ে। ভোগের মধ্যেই আমি বাঁচার রসদ পেতে গিয়েছিলাম আনু ভুল করেছে আমাকে সুখী ভেবে। কিন্তু কী সুখ পেয়েছি, দেখবি, একবার দেখবি।”

সুধীরমামা ভিতরে ডেকে নিয়ে সেদিন দেখিয়েছিলেন। করুণ, কৃশ, শয্যালীন একটি মূর্তি—ভামতী। বড় বড় চোখ মেলে চেয়ে আছে। আমাকে দেখল কি দেখল না, চিনল কি চিনল না, কিন্তু তার চোখে পলক পড়তে দেখিনি।

আবার বাইরে ডেকে নিয়ে এসে সুধীরমামা বললেন, “এই সুখ এই ভামতী। পক্ষাঘাতগ্রস্ত, এখন চোখে দেখতে পায় শুধু, আর কানে শুনতে পায়। ওকে আমি আগলে রেখেছি, কীভাবে জানিস? ওকে সব উত্তেজনা থেকে বাঁচিয়ে রাখি। জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে ও, অনেক অশুভ দেখেছে। নতুন করে আর কোনও অশুভ ওকে যেন দেখতে না হয়, কোনও কষ্টের কাহিনি যেন আর না শোনে। তাই তো তোকে বাইরে ডেকে এনেছি। আমি যা পারি ওর জন্যে আজকাল তাই করি। শাস্ত্র-টাস্ত্র কিছু তো জানি না; ওকে শুধু নামকীর্তন করে শোনাই।”

সুধীরমামা এর পর গুন গুন করে কয়েক কলি কীর্তনও গেয়েছিলেন কি না মনে নেই। তিনি একবার বাবার কথাও তুলেছিলেন মনে আছে।—”তুই কাল সবচেয়ে অন্যায় করেছিস প্রণববাবুকে নিয়ে। অথচ তিনি যে কী ছিলেন, তুই জানিস না। ওঁর মৃত্যুর পর ওঁর কিছু কিছু ডায়েরি দেখেছি। একটাতে কী ছিল জানিস? লিখেছেন, ‘একটা ক্ষোভ রহিয়া গেল, দেশকে স্বাধীন দেখিয়া যাইতে পারিলাম না, অথচ এই স্বাধীনতার জন্য একদিন সব উৎসর্গ করিয়াছি। আর একটা? ক্ষোভ নহে তৃপ্তি। আমার পুত্র আমারই উপযুক্ত উত্তরাধিকারী। আমাকে সে অতিক্রম করিবে, তাহার সূচনা দেখিয়াছি। পরম তৃপ্তিতে নিজেকে উৎসর্গ করিয়া দিতে আর তো আমার বাধা নাই, বাধা রহিল না।’ এ-সব কথার তাৎপর্য কী, বুঝেছিস?”

আর্তস্বরে বলে উঠলাম, “আর পারছি না সুধীরমামা। একটি স্বেচ্ছামৃত্যু, আর-একটি জানি না কী। মা নিরুদ্দেশ, হয়তো বা আত্মঘাতী। কী করব, কোথায় যাব বলে দিন; নাকি সারা জীবনই এই দুইয়ের ভার বহন করে যেতে হবে?”

সুধীরমামা স্মিতমুখে বললেন, “আবার কী। ভার বয়ে যেতে হবে, স্বীকারোক্তিতে আর প্রায়শ্চিত্তে, রোজ শরীরকে রগড়ে রগড়ে মুছে সাফ থাকার মতো। ভার বইতে হবে, এই আমি যেমন বইছি, যদি না, যতদিন না, তাঁর উপরে সব ভার অর্পণ করে হালকা হতে পারি।”

[লেখকের উক্তি : সেই ব্যক্তিটি একেবারে গোড়ায় যার কথা আছে; তার ধারা বিবরণীর পাতাগুলো “সাজিয়ে দাও” বলে একদিন যে আমাকে আধি-ভৌতিক আদেশ দিয়েছে; এই কাহিনি উত্তম-পুরুষে যার জবানি, তাকে আমি আর দেখিনি। তার খসড়াটা পড়া শেষ হলে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার মাকে সত্যিই কি পাননি আর, খবর-টবর কোনও কিছু? আজও কি জানেন না তিনি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন?” ক্লিষ্ট স্বরে লোকটি বলল, “ঠিক জানি না যে। কখনও মনে হয় নেই, আর নেই। কোথাও—বাইরে কি ভিতরে-তাঁর অস্তিত্বের চিহ্ন খুঁজে পাই না। কখনও আবার অনুভব করি, আছেন, প্রবলভাবে আছেন। যেন বড় করে মেলে-রাখা দুটি চোখ রেখে গেছেন। একটু ইতস্তত করে সে বলল, “সে-কথাও লেখা আছে, বাকি কয়েকটা পাতা পড়ে দেখুন।”

বলেই সে তিরোহিত হল, তাকে আর দেখিনি। সে মিলিয়ে গেছে অথবা মিশে আছে আমারই মধ্যে। আমি শুধু তার এলোমেলো বাকি পাতাগুলো সাজাচ্ছি।]

শ্রীচরণেষু-মাকে ।। সব শেষে ।।

সেই থেকে তোমাকে খুঁজছি। কোথায় নয়, বলো! গঙ্গার ঘাটে ঘাটে কোথাও কি কোনও চিহ্ন পড়ে আছে, পরিত্যক্ত পরিধেয়-র অংশ-টংশ কিছু? খবর নিয়েছি হাসপাতালে, এমন-কি মর্গে।

রেললাইনের ধারে ধারে হেঁটেছি, যদি কোথাও রক্তের দাগ লেগে থাকে। সেই রেললাইন মা, যে-লাইন চলে গেছে আমাদের দেশে। দেশ, আমাদের ঘরদুয়ার, আমাদের বাড়ি। কলকাতায় ক্লান্ত, ক্লিষ্ট, তুমি কতদিন আমাকে বলতে, “যাবি, আমাকে সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবি?” নিয়ে যেতে পারিনি। তুমি কি একদিন একাই তাই সেই পথ ধরেছিলে, আঘাতে, অভিমানে আর অপমানে—কেন মা? হয়তো পৌঁছে গেছ। যদি দুর্দম কোনও লৌহরথ তোমার বুকের উপর দিয়ে চলে গিয়ে থাকে অতর্কিত কোনও ক্ষণে? পৌঁছে গেছ তবুও। যেখানে বাবা আছেন, দাদা আছে। সেখানে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সেখানে আমিও আছি। আর দেরি নেই, মা, দেরি নেই, ছাড়াছাড়ির পর সকলের মিলন, এক স্বদেশে। তোমাকে নিয়ে যাইনি, কিন্তু আমরা সবাই যাব, সবাই সেখানে আছি।

মা, সেদিন বিজয়া গেল, আজ কোজাগরী। মধ্যযামেও জেগে জেগে এই “শ্রীচরণেষু”-র পাঠ শেষ করে দিচ্ছি। বিজয়ার রাত্রেও এই সময়ে পথে আর কোলাহল-কলরব নেই, শেষ প্রতিমাটিও বিসর্জিত। কিন্তু আর একটি প্রতিমা? কলম থামিয়ে ভাবলাম, তার কথা জানি না। বিজয়া—জানি না। এই তিথি বিচ্ছেদ আর বিষাদের, না মিলনের। আমি শেষ বেহাগের সুরে মিলনেরই আবাহন করছি।

কবে আরম্ভ হয়েছিল আর সবে এই উদ্যাপন, মাঝখানে কত মাস, বলো তো! শুরু হয় সেই শীতকালে আর এখন শরৎ শেষ হতে চলল, পদ্ম বা শিউলি কিছু আর অবশিষ্ট নেই, গভীর নীল অনচ্ছ একটা আবরণে ঢেকে ফেলছে নিজেকে! দশ মাস এই লেখার প্রয়াসকে আমি ধারণ করেছি।

থামিনি। কিন্তু কেন। সে কি এক স্নায়বিক ভীতি, যা পেয়ে বসেছিল আমাকে? এই লেখায় যেই ক্ষান্তি দেব, অমনই আমার মৃত্যু হবে? হোক না, যা অবধারিত তা নেমে আসুক, আমার আর ভয় নেই, অবশেষে এই তো আমি মুক্ত হতে পেরেছি।

এর মূল্য কী জানি না। কিছুই নেই। আর অল্পকাল পরে আর ও থাকবে না। জানি যে, সেই সময় আসছে যখন কোনও কিছু লেখাই দুষ্কর হবে। ভেবে দ্যাখো সেই সময়, তখনও কত মানুষ দলে দলে, কিন্তু তারা কারা? হৃদয় দিয়ে তারা কোনও হৃদি কি অনুভব করবে? কার কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড, মৃতের অক্ষিতারা নিয়ে কে বাঁচছে, কে দেখছে, কিছুই বোঝা যাবে না। সমান ইথার তরঙ্গে দুটি মানুষ কথা বলতে পারছে না, ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়। জীবনের সমস্ত অর্থ বিপর্যস্ত হবে। মৃত্যুই কি অটুট থাকবে তার সব অর্থ নিয়ে? মানুষ যখন জীবকোষ সৃষ্টি করতে পারছে, তখন মৃত্যুও যে ঠিক মৃত্যু হবে না। পুনর্জন্ম প্রভৃতি সব বিশাল কল্পনার মাধুর্য লুপ্ত হবে।

তাই এই লেখা, তার আগে আগে। সমসময়কে অস্বীকার করে, কেননা তাকে বুঝি না। ভাবীকালের কোনও ভরসা না রেখে, কেননা তখন হয়তো শুকনো বিজ্ঞান বই কিছু থাকবে না।

তাই লিখে গেছি। কী অদ্ভুত ধারণা জানো, মনে হত, এই লেখা যখন লিখছি, তখন যদি আয়নায় আমার ছায়া পড়ে, দেখব, যা ছিলাম, তার চেয়ে বুঝি একটু সুন্দর হয়ে গেছি!

আসলে জানতাম না, এই লেখা শেষ না হলেও কোনও ক্ষতি ছিল না। শ্রীচরণেষু পাঠটা এতই কি আবশ্যক ছিল, যার পাতায় পাতায় মায়ার সঙ্গে এত কালো কালো ছায়া, আত্ম-উন্মোচনের পর্বে পর্বে এত আত্মগ্লানি? যদি অসমাপ্ত থাকত? থাকতই বা

প্রথমে তো প্রতিজ্ঞা ছিল, একটার পর একটা চিঠি লেখার—অনেক চিঠি অনেককে! অন্তিম উপকরণ এই ম্রিয়মাণ জীবনের। কেউ শেষ শ্বাস টানে অক্সিজেনের নলে, কেউ আসন্নের আতঙ্কে কম্পিত কণ্ঠে অবিরত মন্ত্রপাঠে, নামগানে আর কীর্তনে, কেউ বা তার লেখায়। লেখা আর লেখা— অন্তর্জলিকালের অক্সিজেন।

তাই ভেবেছিলাম, অনেক চিঠি অনেককে। পাতার পর পাতা ভরে দেব দেদার ফরিয়াদে। অথচ শেষ পর্যন্ত সব চিঠি ঠেকল এসে একটিমাত্র চিঠিতে। শ্রীচরণেষু। কিন্তু এটাও শেষ না হলে কী হানি ছিল, যদি শেষ পত্রটি উৎসর্গ করে দিয়ে যেতাম তাঁকে—সেই একজনকে? তাঁকে লিখলে আর কাউকে লেখার দরকার হয় না। আমাকে তাঁর প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমার যে বড় দরকার তাঁকে! এক খঞ্জকে যিনি একটু হাঁটতে দিচ্ছেন, নির্বিবেক এক অবিশ্বাসীকে পৌঁছে দিচ্ছেন নির্বেদে তার এই শেষ নমস্কারে।

মা, আমি কিছুকাল আর তোমার ছবিটার দিকে চাইতে পারি না। চোখ নামিয়ে নিই। কোথায় যেন লাগে। ওই ছবি মস্ত করে আমি বাঁধিয়েছিলাম। তুমি হারিয়ে যাবার বেশ কয়েক বছর পরে। ফিরে আসবে আশা যখন লুপ্ত, তখন বিধিমতো শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে। সেই বাসরের পুষ্পমাল্যে ছবিকে সাজিয়েছি, চর্চিত করেছি চন্দনে তবু খোঁজা শেষ হল না তো!

যখন জানি দৈহিক, ঐহিক প্রভৃতি অর্থে তুমি মৃত, খুঁজছি তখনও। চোখ বুজে কখনও দেখি, রাত্রে কোনও রেলপথের ধারে নিঃসঙ্গ এক জননীমূর্তি, অভিমানিনী; ক্রমাগত দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে চলেছেন, দূর থেকে দূরে। আবার গয়া-কাশী-পুষ্করের ভিড়ে, তীর্থে তীর্থে থমকে দাঁড়াই। কোনও সন্ন্যাসিনী কিংবা আশ্রমবাসিনী–আমার মা? অথবা রিক্ত, হাত প্রসারিত করে যে বসে আছে, সেই বা কে। আমার মা কি আজ এই ভিখারিনি? কী আশ্চর্য, মৃত্যুতে তুমি কি আরও জীবিত, পরিব্যাপ্ত হয়ে গেছ স্তরে স্তরে? তাই কি আজ তোমাকে দেখতে চাই করুণা আর লাবণ্য দিয়ে গড়া অৰ্চিত দেবী প্রতিমায়, চিনতে চেষ্টা করি আকাশে চিরায়ত শুভ্র কোনও কোনও তারায়? কোটি তুমি?

জীবন থেকে মায়েরা হারিয়ে যায়, তাই নিয়ম, জানি, তবু সমস্ত জীবন সেই জন্যেই কি মার জন্য একটা শূন্যতা, একটা শোচনা, সতত একটা প্রয়োজনবোধ চেতনাকে আঘাত করে, এমন কি অবচেতনকে?

জিজ্ঞাসায় কাজ কী। বরং খুঁজে চলি। তোমাকেই কি? হয়তো না, একমাত্র তোমাকে না, তোমার সঙ্গে এক করে—তাঁকে। জীবনের যিনি মূল, আর মূলাধার যিনি, একসঙ্গে উভয়কে। সব স্তর পার হয়ে সবশেষে ওই একটা খোঁজই বুঝি বাকি থাকে। মা, তাই না?

‘শেষ নমস্কার’-এ আত্মজৈবনিকতা – অলোক চক্রবর্তী

‘শেষ নমস্কার শ্রীচরণেষু মাকে’ উপন্যাসের প্রারম্ভিক অংশের উচ্চারণ— “এইবার আমি যাব। স্বদেশে ফিরব।” কিন্তু এই ‘ফেরা’ ও ‘স্বদেশ’-এর প্রকৃতি ভিন্ন। এই স্বদেশ তার শৈশবের মফস্সল শহর নয়, যৌবনে গলির জীবন নয়, এই ‘স্বদেশ’–”যেখানে গেলে এ-দেশ থাকবে না, পায়ের তলার মরমী মাটি, শয্যার উষ্ণতা, এই স্বাদ, প্রাণ, মোহ, পরিজন, কত সুখ, কত ক্ষত।” বুঝতে পারা যায় এক বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে লেখক জীবনের কথা বলতে শুরু করেছেন “শেষ নমস্কার শ্রীচরণেষু মাকে’ উপন্যাসটিতে।

“স্বদেশে ফেরার আগে সব দুঃখ-সুখ, আঘাত-অভিমানের খোপে খোপে সে এক একটি চিঠি লিখে যাবে” এরকম পরিকল্পনা কাজ করেছিল নায়ক তথা পত্ৰলেখক চরিত্রের পত্ররচনার ক্ষেত্রে। আর এই পরিকল্পনাতেই—তার প্রথম চিঠি “শ্রীচরণেষু মা!” বলাবাহুল্য দ্বিতীয় কোনও চিঠি আর লেখা হয় না পত্রলেখকের। এই একটি চিঠিই সম্পূর্ণ উপন্যাস। উপন্যাসটির নামও ‘শেষ নমস্কার শ্রীচরণেষু মাকে’। এই নামকরণ কেবল মায়ের কাছে সন্তানের আত্ম-উন্মোচন বলে নয়, এই লেখা মাতৃ-অন্বেষণও বটে। উপন্যাসের শুরু এবং শেষ মাতৃসম্বোধনেই। আত্মউন্মোচনের পাশাপাশি, শৈশব থেকে নায়ক-চরিত্রের মনে যেভাবে তিলে তিলে নির্মিত হয় মাতৃ-চরিত্র, সেই মাতৃচরিত্রকেই পূর্ণাবয়ব দিয়ে মায়ের উদ্দেশেই নৈবেদ্য সাজিয়েছেন লেখক।

নির্দিষ্ট সময়কাল পরে মাতৃগর্ভ থেকে সন্তান একদিন ভূমিষ্ঠ হয়। কিন্তু মাতৃস্নেহের গর্ভগৃহ থেকে সন্তানের নির্গমনের নির্দিষ্ট কোনও বয়স নেই। সারাজীবন ধরেই চলে এই গর্ভগৃহের পবিত্রতাকে অতিক্রমণের প্রয়াস। এই দৃষ্টিতে দেখলে উপন্যাসটির পত্রলেখক চরিত্রের ক্রমিক রূপান্তরের প্রতিটি স্তর জ্ঞানে-অজ্ঞানে মাতৃ-স্নেহ-গর্ভগৃহ অতিক্রমণের প্রয়াস। কেবল তাই নয়, এই দৃষ্টিতেই পত্রলেখকের কাহিনি হয়েও এটি একটি মাতৃকাহিনি। লেখকের পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলির সঙ্গে এখানেই পার্থক্য তৈরি হয়ে যায় আলোচ্য উপন্যাসটির।

পত্রলেখকের শৈশব মাতৃ-আচ্ছন্ন শৈশব। মাতৃ-জগতের বলয়রেখার অন্তর্গত তার জগতের ক্ষুদ্র বলয়টি। ফলে মাতৃ-জগতের বাইরে তার কোনও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই আবার শিশুটির চেতনাতে মা বলতে তার এই ক্ষুদ্র জগতে উঠে আসা মাতৃরূপ। এর বাইরে মা-সম্পর্কিত কোনও ধারণা তার নেই। ছেলেটির মাতৃ-আচ্ছন্নতার দুটি কারণ। প্রথমত, বাবার দীর্ঘ অনুপস্থিতি। ছেলেটির কাছে, “বাবার মূর্তি সেই শিশুকালে ছিল একটি বিলীন জলরেখা, পরোক্ষ একটা অস্তিত্ব।” দ্বিতীয়ত, দাদার মৃত্যু। দাদার মৃত্যু মা ও ছেলের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করে।

মা ছাড়া শৈশবজীবনে দ্বিতীয় ব্যক্তি সুধীরমামা। বলাবাহুল্য সুধীরমামার প্রাথমিক অবস্থান মাতৃ বলয়-রেখার মধ্যেই। সুধীরমামা ছেলেটিকে পড়ানোর দায়িত্ব নেয়, এবং সুধীরমামার হাতে মা তুলে দেন ‘নিমের রস’। এই ‘নিমের রস’ যেন মা ও সুধীরমামার সম্পর্কের মাঝখানে যে ব্যবধান তারই প্রতীকী উপস্থাপনা। ‘নিমের রস’ বলেই মা ও ছেলের মাঝখানে তৃতীয়জন হতে পারেন না সুধীরমামা।

বালকটির আচার-আচরণকে মৃত সন্তানের সঙ্গে তুলনা করার জন্য মায়ের প্রতি ছেলেটির স্ফুরিত অভিমান। তবে মৃত দাদাও মা ও ছেলের মাঝখানে তৃতীয়জন হতে পারে না। মা ও ছেলের মাঝখানে তৃতীয়জন হয়ে দেখা দেন বাবা (প্রণববাবু)।

বাবা দেশের কাজ করেন, পালা লেখেন, টুকিটাকি ব্যবসার ফন্দি আঁটেন—ইত্যাদি কথা দিয়ে বাবা সম্পর্কে ছেলের মনে একটি শ্রদ্ধামিশ্রিত মূর্তি তৈরি করার চেষ্টা করেন মা। কথাগুলি মিথ্যে নয়, অথচ বারো-তেরো বছরের বালকের মনে এই মূর্তিটি জায়গা করে নিতে পারে না। কারণ বালকটি মায়ের জীবন-যাপন ও পারিবারিক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে বাবার যে মূর্তিটি কল্পনা করে নিয়েছিল তা হল—সংসারের প্রতি দায়দায়িত্বহীন, পরিবার-পরিজনের প্রতি স্নেহহীন এক ব্যক্তি। বলাবাহুল্য, এই মূর্তি সচেতনভাবে মা সন্তানের মনে নির্মাণ করার চেষ্টা করেন না, কিন্তু এ কথা ঠিক মায়ের জীবনকে আশ্রয় করেই এ-মূর্তি বালক মনে সৃষ্ট হয়। আবার বাবাকে সাক্ষাৎ দর্শনের কালে বর্ণিত চেহারা (“চওড়া কাঁধ, রোমশ বলিষ্ঠ দুটি হাত, যেন দুটি থাবা, ঘন ভুরুর মাঝখানে, একটা প্রায় আব সাইজের আঁচিল।” কথা বলার বাঁকা ভঙ্গি, সুধীর-মামার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাঁদা ফুলের গাছ উপড়ে ফেলা ইত্যাদি মিলিয়ে বাবার প্রতি বালকটির মনে ঘৃণা জাগ্ৰত হয়।

বাবার আগমনে মায়ের অন্য জগৎ বালকটি আবিষ্কার করল। তার জগতের ক্ষুদ্র বলয়টিই যে মাতৃজগতের পরিধি নয়, সে জগৎ বিস্তৃত, এই বোধ তাকে পীড়া দিল। বাবা-মায়ের দাম্পত্যজীবন সে মেনে নিতে পারল না। তাই বাবার আগমনে মাতৃ-মূর্তির ‘সলজ্জসৌন্দর্য’ তাকে যেমন আকর্ষণ করল, তেমনি আবার এর মধ্যে নিহিত অলজ্জতা’ তার মনকে তিক্ত করল। এইজন্যই ঘৃণা কেবল বাবার প্রতিই নয়, মায়ের প্রতিও বর্ষিত হল। তার মাতৃ-সাম্রাজ্য অপরের অধিকৃত, তাই ‘পরাস্ত, প্রহৃত, প্রতারিত, পরিত্যক্ত, বালকটি বেদনার্তচিত্তে ম্যাজিক-লণ্ঠন দেখতে চলে যায়। সেখানে গিয়ে যেন তারই মনের প্রতিবিম্ব আবিষ্কার করে সুধীরমামার মধ্যে। সুধীরমামা ও বালকটির মধ্যে এমন একটি সম্পর্ক-ভূমির ভিত্তি মা তথা আনু চরিত্রের প্রতি উভয়ের বিরাগ।

প্রণববাবু স্ত্রীর প্রতি প্রবল অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পরোক্ষে বালকটির মাতৃসাম্রাজ্যকে দখল করে নেন, তেমনি আবার বালকটির ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মায়ের জগৎকেও শূন্য করে দিতে উদ্যত হন। এইজন্যই ছেলেটিকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেন। স্টেশনে গিয়ে অবশ্য সেই সংকল্প ত্যাগ করেন। রক্তপরীক্ষা নয়, তাঁর লিখিত পালাগান ছাপানোর প্রতিশ্রুতি আদায়ের মধ্যেই যেন পিতৃত্বকে স্বীকার করেন। বালকটির অনুভব—”(ধরো) সেদিন সেই স্টেশনে দাঁড়িয়ে যখন হঠাৎ দেখলাম, একটি সময়, একটি স্থান একটি মানুষকে বদলে দিল। বাৰাকে আলাদা হয়ে যেতে দেখলাম। “ বাবা-সম্পর্কিত এই অনুভব বালকটির হৃদয়ে ভিন্নতর ক্ষেত্র অধিকার করে। আবার সেই রাত্রেই স্টেশন থেকে ফিরে এলে মায়ের হাতে চড় খায়। কারণ—”একা এসেছিস, ফিরে এসেছিস, তুই একা একা।” পিতার আগমন-পূর্ব মায়ের জীবন-যাপন ও পারিবারিক কথাবার্তায় যে পিতৃ-চরিত্র বালকের মনে নির্মিত হয়েছিল এবং পিতার আগমন-পরবর্তী আচার-আচরণে যে পিতৃ-চরিত্র মায়ের মনে অঙ্কিত হতে পারে বলে মনে হয়েছিল, তা ধূলিসাৎ হয়ে যায় এই চড়ের মধ্যে। মাকে আবার নতুনরূপে আবিষ্কার করে সে।

গাঁদা গাছ উপড়ে ফেলার মধ্য দিয়ে আনুর জগৎ দখল করে সুধীরমামাকে স্থানচ্যুত করেছিলেন প্রণববাবু। প্রণববাবু চলে যাওয়ার পর সে জগতে সুধীরমামার পুনঃপ্রবেশ ঘটে না। এই পুনঃপ্রবেশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আনুর সন্তান-ধারণ। সুধীরমামা ও আনু চরিত্রের সম্পর্ক ভূমিটি তৈরি হয়েছিল—মৃত সন্তানের প্রতি বেদনাবোধকে আশ্রয় করে। আনুর সন্তান-ধারণ সুধীরমামার চোখে মৃত সন্তানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। আসলে এই সন্তান-ধারণ তাঁদের সজীব-সহৃদয় সম্পর্কের মৃত্যু ঘোষণা। তাই ফিন ফিনে লুঙি, জালিকাটা গেঞ্জি, চুলের টেরি এবং ভামতী নামের নারীটিকে ঘরে স্থান দেওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের নতুন ভাষা তৈরি করেন সুধীরমামা

সুধীরমামার এইরূপে বালকটির মনে ব্যথা জন্মায়, ভামতীর প্রতি ক্রোধ হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই রূপ নিজের ক্রমিক রূপান্তরের পথটিকেও প্রশস্ত করে। সুধীরমামার বই তার মনে যৌনতাবোধের উন্মেষ ঘটায়, আবার মায়ের পাশাপাশি ভামতীর প্রতিও একটি আকর্ষণ তৈরি হয়। প্রথমদিকের মায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ককে ঘিরে যেমন বালকটির আত্ম-আবিষ্কার ঘটে, তেমনি মায়ের সঙ্গে সুধীরমামার সম্পর্কের ক্রম-অবনতিকে আশ্রয় করে বালক চরিত্রটির ক্রমিক রূপান্তর ঘটে।

আধা-শহরে জীবন কাটানোর পর প্রণববাবুর চিঠি পেয়ে মা ও ছেলে কলকাতায় যাত্রা করেছে। কলকাতা-পর্বের গল্প কেবল মা ও ছেলের থাকে না, হয়ে ওঠে মা, বাবা ও ছেলের গল্প। প্রণববাবু আনুকে কলকাতায় আহ্বানের কারণ হিসাবে চিঠিতে জানিয়েছিলেন—”নিজেদের একটি নীড় রচনা করার স্বপ্ন।” এ-ছাড়াও স্বদেশি, সংসার-বিরাগী প্রণববাবু আরেকটি স্বপ্ন লালন করেছিলেন মনে মনে, একদিন তাঁর নাটক অভিনীত হবে। আনুর মনোজগৎ লক্ষ করলেও দেখব, তাঁর মধ্যেও প্রণববাবুর মতোই কাজ করেছিল নীড় বাঁধার স্বপ্ন। এ-ছাড়াও তাঁর ছিল ছেলেকে বড় করে তোলার স্বপ্ন। ছেলে বা পত্রলেখক চরিত্রটি সেরকম কোনও স্বপ্ন লালন করার কথা উচ্চারণ করে না। কিন্তু মায়ের কাছে ছিল সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, একান্তই মায়ের হয়ে থাকার জন্য।

কলকাতা কিন্তু তাদের স্বপ্ন সফল করে তোলে না। তীব্র অর্থনৈতিক সংকট নিজেদের নীড় বাঁধার স্বপ্নকে তছনছ করে দেয়। শেষপর্যন্ত বড়লোক আত্মীয়ের বাড়িতে তারা আশ্রিত ও অন্নদাসে পরিণত হয়। তবে নীড় বাঁধার স্বপ্নভঙ্গের এটি বহিরঙ্গ দিক। আনুর নীড় বাঁধার স্বপ্নের মধ্যে ছিল এক ধরনের মানসিক আশ্রয়বোধ। কলকাতা আগমনের আগে প্রণববাবুর যে-মূর্তিটি আনুর মনে অঙ্কিত ছিল, সেখানে প্রণববাবু সংসার বিরাগী, স্বদেশি-করা সাহিত্য-পাগল এক মানুষ। এর জন্য স্বামীর প্রতি অভিমান ছিল, দূরত্ব ছিল, সেইসঙ্গে শ্রদ্ধাও ছিল। কলকাতা আগমনের প্রাথমিক-পর্বে প্রণববাবুর আচার-আচরণে তাঁর মনে হয়েছিল প্রণববাবু সত্যিই বদলে গেছেন। এই আচার-আচরণে স্বামীর সঙ্গে নৈকট্য অনুভব করেন তিনি; কিন্তু এই মূর্তি স্থায়ী হয় না, বেরিয়ে আসেন অন্য প্রণববাবু। এই প্রণববাবু মদ্যপ, স্বামীকে ঘিরে যে একটি মানসিক-আশ্রয়ের স্বপ্ন তিনি রচনা করেছিলেন, তা নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু স্বামীর পূর্ব-মূর্তিতে আশ্রয় পান না। কারণ প্রণববাবুর পরিবর্তন পূর্বাবস্থায় গমন নয়। আর এখানেই আনু অনিকেত হয়ে ওঠেন।

আনুর মতোই অনিকেত হয়ে যান প্রণববাবুও। প্রণববাবু বহির্জীবনের টান ত্যাগ করে গৃহজীবনকে আশ্রয় করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু মনে মনে লালন করেছেন অন্য এক স্বপ্ন—সফল নাট্যকার হবার স্বপ্ন, যাকে বলা যায় বহির্মুখী টানের বিকল্প আশ্রয়। মুন থিয়েটারের প্রেসে ম্যানেজারের কাজ নেবার মধ্যে যেমন আশা ছিল নাটক ‘প্লে’ হবার সুবিধা পাওয়া যাবে, তেমনি প্রম্পটার সতীশের নকল বউ লীলার পশ্চাৎধাবনের মধ্যে, নলিনীকে পাচনের গ্লাস এগিয়ে দেওয়াতেও ছিল সেই স্বপ্ন; অভিনেতা সব্যসাচীর মোসাহেবির কারণও ছিল তাই। এই স্বপ্নের সাম্রাজ্যে প্রথম আঘাত স্ত্রী আনুর কথা। মদ্যপ স্বামীকে সহ্য করতে না পেরে আনু তাঁর লেখাকে ‘ছাইভস্ম’ বলেন, এবং তাঁর নাটক ‘প্লে হবে না’, হলেও লোকে ‘টিটকারি দেবে, উঠে পালাবে’ একথা উচ্চারণ করেন। কিন্তু তাঁর এই স্বপ্নের জগৎ চুরমার হয়ে যায় সেদিন, যেদিন সব্যসাচী মদ্যপ অবস্থায় জানায় তাঁর লেখা ‘মানুষ তো কোন ছাড়, ষাঁড়-শিয়ালের মুখেও মানাইবে না।” নাটক ‘প্লে’ করার অন্ধ-একমুখী প্রচেষ্টায় তিনি নিজেই নষ্ট করেছেন—নীড় বাঁধার স্বপ্ন, অন্যদিকে তাঁর ‘প্লে’ হবার স্বপ্নটিও সফল হয় না। দুটি ক্ষেত্রেই পরাজিত এই মানুষটি শেষপর্যন্ত মানসিক ভারসাম্য রাখতে পারেন না। সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে না পারার ব্যর্থতা এবং আশ্রিত অন্নদাস হয়ে থাকার অপমানের হাত থেকে নিস্তার পেতে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি খোলার কথা ভাবেন। এই ভাবনার মধ্যে বাস্তবজগতে কোম্পানি খোলার কোনও নিশ্চিত স্বপ্ন নেই। কোম্পানি খুলবেন—ভাবনার এই অলীক কল্পজগতটি বাঁচিয়ে রেখে তিনি যেন শেষ আশ্রয় পেতে চেয়েছেন। এইখানেই নিরাশ্রয়ী রূপটি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। তবে সাহিত্য-জগতে নিজে প্রতিষ্ঠা না পেলেও, ছাপার অক্ষরে ছেলের কবিতা-প্রকাশ, মৃত্যুর আগে যেন প্রণববাবুকে নিজের সাফল্যের ভিন্ন আস্বাদ দান করে। প্রণববাবুর কথায়—”আমি এবার মরতে পারব, কেন না জেনেই গেলাম আমি বাঁচব। জানলাম, যার না। বা গেলেও আমি থাকব।”

কলকাতায় আসার সময় ট্রেনের মধ্যেই মা

মধ্যেই মা ছেলের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন—”মার ছেলেই থাকবি, বাবার হবি না, বাবার মতো কখনই না।” আসলে আধা-শহরের জীবনের আশ্রয়স্থল এই সন্তানটি পাছে কাছছাড়া হয়ে যায়—এই ভয় ছিল। এছাড়াও আশঙ্কা ছিল ছেলেটি যদি পিতার স্বদেশি ও সংসার-বিবাগি স্বভাবের উত্তরাধিকারী হয়ে ওঠে—এই কারণে। কিন্তু ‘মার ছেলেই’ হয়ে থাকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে না পত্রলেখক। ফলত, মায়ের স্বপ্নভঙ্গ হয়। পত্রলেখক চরিত্রের ক্রম-অবনমনের মধ্যেই এই স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাসের সন্ধান পাব।

কলকাতা নগরের মানবীরূপ নিয়ে পত্রলেখকের সামনে হাজির হয় বুলা। পত্রলেখকের জীবন-বিবর্তনে বুলার আবির্ভাব দুটি পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে বুলার আবির্ভাব যখন মায়ের হাত ধরে সদ্য আধা-শহরের বাসভূমি ত্যাগ করে পত্রলেখক কলকাতায় পা রেখেছে। মফস্সল জীবনের সুকুমারবোধগুলি তখনও তার নষ্ট হয়নি। বয়সের দিক থেকেও পত্রলেখক সবে তখন কৈশোর উত্তীর্ণ হতে চলেছে। এই কিশোরটির সদ্য জাগ্ৰত যৌনতাবোধ উস্কে দিয়ে বুলা নিষিদ্ধ জগতের সন্ধান দেয়। বুলাই প্রথম মা-বাবার সম্পর্ককে নিয়ে কূট-প্রশ্ন তার মনে প্রবেশ করিয়ে দেয়। প্রম্পটার সতীশ রায় বুলার বাবা নয়, লীলামাসি (বুলার মা) ভেতরে ভেতরে মেয়েকে হিংসা করে—এই তথ্যগুলি মা, বাবা সম্পর্কে আজন্মলালিত ধারণাকে ক্রমশ বিনষ্ট করে।

বুলা পত্রলেখকের মুখে তাদের কলকাতা-পূর্বজীবনের কথা শুনে মন্তব্য করে—”আমার মা যা, তোর মাও তাই। এককথায় অ-সোতী।” এই কথা শোনার পর রাগে, ঘৃণায় পত্রলেখক বুলাকে চড় মারে। কারণ তখনও ছেলেটির চেতন-মন জুড়ে বিরাজ করছে এক পবিত্র মাতৃ-মূর্তি। বুলাকে ফেলে রেখে বুলার মায়ের পালিয়ে যাওয়া, বুলার সন্ধান ও ব্যর্থতা—পত্রলেখকের বুলার প্রতি রাগ ও ঘৃণা সহানুভূতিতে রূপান্তরিত করে। আমি নিজেকে বাঁচাব’–এই দৃঢ় অঙ্গীকারে বুলা ঝামাপুকুরের বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। যাত্রার “প্রাক্কালে বুলা পত্রলেখকের চোখে হয়ে ওঠে ‘প্রণম্য তুলসীর মতো পবিত্র’। বুলার বিদায় তার মনে বেদনা জাগ্রত করলেও তখনও পত্রলেখক একান্তই মায়ের সন্তান। মায়ের প্রতি তাই তার উক্তি—”মা, তুমিও লীলামাসির মতো চলে যাবে না তো।” এমনকী একসময় মা যখন জিজ্ঞাসা করেন ‘কেমন বউ তোর পছন্দ’, তার উত্তরে পত্রলেখক জানায়, ‘তোমার মতো’।

পত্রলেখকের একান্তই মায়ের সন্তান হয়ে থাকার প্রচেষ্টার অন্যদিক হল কলেজে স্বাধীনতা-আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের সংস্রব পরিত্যাগ। তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা “বাবা যা ছিলেন, সেই স্বদেশি হবো না তো নিশ্চিত। জেলে-টেলে যাব না।” অবশ্য ‘পিতৃরক্ত নিয়তির মতো’ তাই সাহিত্য-রচনা চলে। বলাবাহুল্য এর জন্য পুত্রকে ঘিরে মায়ের কোনও আশঙ্কা তৈরি হয় না, বরং ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

ছেলেকে ঘিরে তৈরি হওয়া মায়ের কল্পজগৎটি প্রথম আঘাত পেল রজনীর সঙ্গে প্রায়ান্ধকারে নিজের সন্তানকে আবিষ্কারে। মাতৃত্বের অধিকারে শাসন করে ছেলেকে নিরস্ত করতে উদ্যত হলে ছেলে মাকে পাল্টা আক্রমণ করে। কৃতকর্মের দোষ স্বীকারের পরিবর্তে ছেলেটি মায়ের চরিত্রকে কলঙ্ক লেপন করে নিজ অপরাধকে যৌক্তিক প্ৰতিষ্ঠা দান করে। ছেলেটির চেতন-জগৎ জুড়ে এক পবিত্র মাতৃমূর্তি একসময় বিরাজ করেছিল বলেই বুলার ‘অ-সো-তী’ উচ্চারণে চড় মেরেছিল, কিন্তু অবচেতনে তা গৃহীত হয়েছিল বলেই মায়ের সঙ্গে সুধীরমামার সম্পর্ক ঘিরে মাকে আজ আক্রমণ করে। এখানেই মা ও ছেলের সম্পর্কের আপাত বিচ্ছেদ ঘটে।

পত্রলেখক চরিত্রটির পরবর্তী ক্রম-অবনমনের পরিচয়টি উঠে এসেছে—পত্ৰলেখক, রজনী, বুলা ও বাঁশি—এই চতুষ্টয়কে কেন্দ্র করে। রজনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় মা রুষ্ট হলেও রজনী পত্রলেখকের জীবনে পবিত্রতার প্রতিমূর্তি রূপেই হাজির। আর রজনীর ঠিক বিপরীত সত্তা হিসাবে বুলা হাজির পত্রলেখকের জীবনে। বুলার দ্বিতীয়বার আবির্ভাব যখন, তখন বুলার ভাষাতে সে ট্যাক্সি’ হয়ে গেছে। ভাড়ার ট্যাক্সির মতো সে ক্লাব-থিয়েটারের ভাড়ার অভিনেত্রী এবং বারবণিতা। পত্রলেখক বুলার বাড়িতে যায় তার একটি ক্লাব-থিয়েটারের অভিনয় প্রত্যাখ্যান করার কথা আদায় করতে। উদ্দেশ্য, মেয়েলি-পুরুষ বাঁশি ওই থিয়েটারের মেয়ের রোলটি যাতে ফেরত পায়। বিনিময়ে বাঁশি পত্রলেখক মারফত বুলাকে অর্থপ্রদান করতে চায়। পত্রলেখক মারফত বাঁশির সঙ্গে বুলার যোগাযোগ ঘটলে বাঁশি বুলাকে পেয়ে পুরুষ হওয়ার নেশাতে মত্ত হয়ে ওঠে। বুলা বাঁশির কাছে প্রেমের অভিনয় করে মাত্র। এই অভিনয় সম্পর্কে পত্রলেখক অবহিত, কিন্তু তার জন্য পত্রলেখকের অপরাধবোধ নেই। আবার বুলার বাঁশির সঙ্গে ছদ্ম-ঘনিষ্ঠতাকেও সে সহ্য করতেও পারে না, বরং পীড়িত হয়। বুলার শরীরী মোহ বারে বারেই তার দিকে তাকে ধাবিত করে। পত্রলেখকের মনোজগৎ থেকে মা সরে যাওয়ার পর রজনীকে আশ্রয় করে তার যে সৎ, বিবেকী-সত্তা জীবিত ছিল, তা যেন সম্পূর্ণ নিহত হলো রজনী হস্টেলে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। এরপরে একদিন রাত্রিবেলায় বুলাদের বাড়ির ছাদে বাঁশিকে অতিরিক্ত মদ্যপান করিয়ে বেহুঁশ করিয়ে দিয়ে এবং নিজেরাও দু-জনে মদ্যপান করে কামোন্মত্ত হয়ে ওঠে। বুলা এই অবস্থায় রজনীকে ঘিরে রজনী ও পত্রলেখক সম্পর্কে এবং পত্রলেখকের মা সম্পর্কে কটূক্তি করলে বুলাকে থাপ্পড় মেরে পত্রলেখক সে স্থান ত্যাগ করে। ‘অ-সো-তী’ বলার জন্য যে কিশোর-পত্রলেখক বুলাকে থাপ্পড় মেরে ঘরে প্রত্যাবর্তন করেছিল তার সঙ্গে বর্তমান যুবকের ফারাক বিস্তর। এইজন্য চরিত্রভ্রষ্ট পত্রলেখকের বাড়ি ফিরেও বুলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় অনুশোচনা নেই। তাই সন্তান হয়েও মা ও সুধীরমামাকে সরাসরি তাঁদের অতীত সম্পর্ক নিয়ে কটূক্তি করতে দ্বিধা করে না এবং সুধীরমামার সঙ্গে মায়ের বর্তমান ঘনিষ্ঠতাকেও সে ভালো চোখে দেখে না। ছেলের কাছে অপমানিত হয়ে সেই রাত্রেই মা গৃহত্যাগ করেন। পত্রলেখকের এরপর সারাজীবন ধরে চলে মাকে অনুসন্ধান।

পত্রলেখক চরিত্রটির ক্রম-অবনমনের পরিচয়টি নিলে দেখতে পাই পত্রলেখক মার ছেলে হয়ে থাকে না। কিন্তু তার হয়ে ওঠা কি বাবার মতো হয়ে ওঠা? মা যে-আশঙ্কায় ছেলেটিকে বাবার মতো হওয়া থেকে নিরস্ত করতে চেয়েছিলেন, ছেলেটি তা হয় না। অর্থাৎ মায়ের সম্ভাব্য আশঙ্কার বাস্তব রূপায়ণ হয় না। কিন্তু ছেলেটি যে বৈশিষ্ট্যগুলি অর্জন করে সেগুলি আপাতভাবে তার বাবার চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের অনুরূপ—

বাবাছেলে
সাহিত্যরচনা -> সাহিত্যরচনা
মদ্যপমদ্যপ
নারী-আসক্তি (লীলা, নলিনী)নারী-আসক্তি (বুলা)
স্ত্রী (আনু)কে আঘাতমা (আনু)কে আঘাত

‘সাহিত্য-রচনা’ বিষয়টি ছেলেটির পিতৃবৈশিষ্ট্য অর্জন—একথা অস্বীকার করা যায় না। ছকে বাবা-র ‘সাহিত্যরচনা’-র অভিমুখ এইজন্য ছেলের ‘সাহিত্য-রচনা’র দিকে দেখানো হয়েছে। তবে বাবার মতো সাহিত্যিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে ঘিরে পত্রলেখকের সাহিত্য-জীবনের আশা-নিরাশার পরিচয় তেমন উঠে আসে না। কিন্তু ‘সাহিত্য-রচনা’ ছাড়া যেসকল বৈশিষ্ট্য অর্জন, তা ছেলের পিতৃ-বৈশিষ্ট্য অর্জন বলা যেতে পারে না, এগুলি যেন এমন সাধারণ বৈশিষ্ট্য যা বাবা ও ছেলেকে একসারিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। আসলে বাবা (প্রণববাবু) যেমন বাবার মতো থাকে না এবং আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নে পৌঁছাতে পারে না, ঠিক তেমনি ছেলে নিজ সম্ভাবনায় অবিচল থাকতে পারে না, দু’জনেই হয়ে ওঠে কলকাতার মতো। এই কলকাতার মতো হয়ে ওঠা যেমন তাদের অন্ধকারে নিমজ্জিত করে, তেমনি আনুর জগৎকেও অন্ধকার করে দেয়।

.

উপন্যাসটির মূল কাহিনি ও চরিত্রগুলির রৈখিক পরিচয় দিয়ে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে কী বিশিষ্টতা নিয়ে হাজির তা আলোচনা করতে পারি।

আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস আলোচনার ক্ষেত্রে লেখকের স্ব-জীবনের তথ্য কতখানি উঠে এসেছে—এই বিষয়টির দিকে আলোকপাত করা হয়ে থাকে। যদিও এই উপন্যাসটি কতকগুলি প্রামাণিক ঘটনার সমষ্টি নয় বলে লেখক দাবি করেছেন, তবুও কিছু প্রামাণিক ঘটনা উপন্যাসটিতে আছে। কলকাতা-পূর্ব আধা-শহরে মা ও ছেলের জীবন-যাপন, দাদার মৃত্যু, কলকাতায় মা-বাবার সঙ্গে ভাড়া বাড়িতেই অর্থকষ্টে জীবন-যাপন, বড়লোক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া—ইত্যাদি তথ্যগুলি স্ব-জীবন থেকেই গৃহীত হয়েছে। উপন্যাসে বাবা, মায়ের চরিত্র অঙ্কনে অনেকাংশেই নিজের বাবা-মায়ের চরিত্র বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানো হয়েছে।

অবশ্য ‘নানা রঙের দিন’ উপন্যাস থেকেই লেখক উপন্যাসে স্ব-জীবনকে ব্যবহার করে আসছিলেন। তাই আলোচ্য উপন্যাসের আগে রচিত উপন্যাসগুলিতে আত্মজীবনের যে তথ্যগুলি ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলির কিছু এখানেও পরিবেশিত হয়েছে। তবুও এই উপন্যাসটি আত্মজীবনকে ব্যবহারের মাত্রায় বিশিষ্ট বলা যেতে পারে।

‘নানা রঙের দিন’ উপন্যাসেও উঠে এসেছিল আধা-শহরের জীবন। সেখানেও মা-বাবা চরিত্রের যে সকল বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে—সেই সকল বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলও খুঁজে পাওয়া যায়। তবে নানা রঙের দিন’-এর সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে একটা বিশেষ কালকে আলোকিত করার চেষ্টা আছে, এই উপন্যাসটিতে তা অনুপস্থিত। এছাড়া মা, বাবা ছাড়াও দিদি, দাদু ইত্যাদি চরিত্র সংযোজন করে ‘নানা রঙের দিন’ উপন্যাসটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই চরিত্রগুলি আলোচ্য উপন্যাসে অনুপস্থিত। আলোচ্য উপন্যাসটির গল্প আধা-শহরের পটভূমিকায় কেবল মা-ছেলের গল্প।

‘নানা রঙের দিন’ উপন্যাস নায়কের কৈশোর অবস্থা ও আধা-শহরের পটভূমিতেই শেষ। ‘মুখের রেখা’, ‘জল দাও’, ‘স্বয়ং নায়ক’—তিনটি উপন্যাসে আলোচ্য উপন্যাসটির নায়কের মতো শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের গল্প উঠে এসেছে। কিন্তু উক্ত তিনটি উপন্যাসে শৈশব-কৈশোর গল্প কোনওক্রমেই কেবল মা-ছেলের গল্প নয়, তেমনি কলকাতার পটভূমিতে বর্ণিত যৌবন-পর্বের গল্পেও পরিবার-প্রেক্ষিত অনুপস্থিত। কিন্তু ‘শেষ নমস্কার শ্রীচরণেষু মাকে’ গল্পটি কলকাতা শহরের পটভূমিকায় মা, বাবা ও ছেলের পরিবার জীবনের গল্প।

আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে এই উপন্যাসে বাবা চরিত্রটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলা যেতে পারে। উপন্যাসের প্রণববাবুর সাহিত্যানুরাগ, সাহিত্যকার হিসাবে ব্যর্থতা সন্তোষকুমারের বাবার অনুরূপ-একথা আমরা জানি। কিন্তু কেবল তাই নয়, আসলে প্রণববাবু চরিত্রের মধ্যে মিশে রয়েছেন সন্তোষকুমার নিজেও। উপন্যাসটিতে পত্রলেখক চরিত্রটিও একজন সাহিত্যিক। যদিও সাহিত্যিক হিসাবে তাঁর উত্থান-পতনের বিশদ পরিচয় দেওয়া হয়নি। তবে যে প্রৌঢ় পত্রলেখক মায়ের উদ্দেশে পত্ররচনা করেছে, সেই পত্রলেখক যে বর্তমান অবস্থায় ‘পরিত্যক্ত’ সাহিত্যিক—এই তথ্য জানিয়ে দেয়। পত্রলেখকের ভাষায়—”এক হাতে মাপা বিচার – সেদিন কি জানতাম আমিও একদিন হব পরিত্যক্ত, জীর্ণ, পুরোনো?” – “জল দাও’ উপন্যাসের ভূমিকা, ‘লিখছি না কারণ : হিতৈষীরা শীতল’–সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখা, ‘স্বয়ং নায়ক’ উপন্যাসে ব্যর্থ নাট্যকার-নায়ক চরিত্রের উপস্থাপন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে লেখাকে কেন্দ্র করে লেখকের মনে তৈরি হওয়া চিত্ত-বিক্ষোভ ও যন্ত্রণাকে প্রকাশ করেছেন। আলোচ্য উপন্যাসে ‘পরিত্যক্ত’ সাহিত্যিক—এই তথ্যটি পরিবেশন করলেও সাহিত্যিক হিসাবে যন্ত্রণা ও ক্ষোভকে যেন বাবা চরিত্রের সঙ্গে মিশিয়ে প্রকাশ করেছেন। তাছাড়া প্রণববাবুর জবানিতে সাহিত্য-সম্পর্কিত যে সকল বোধ প্রকাশিত হয়েছে, তা লেখক সন্তোষকুমারেরই বোধ। যেমন প্রণববাবুর কথায়—”সব লেখা দেখলাম, শেষপর্যন্ত নিজেরই জন্যে তো।” সারাজীবন নিজেকেই নানা উপন্যাসে সন্তোষকুমারের লেখার আয়োজনের রোধ প্রায় অনুরূপ। পত্রলেখকের পাশাপাশি বাবা চরিত্রটির মধ্য দিয়ে লেখকের আত্মপ্রতিফলনের মাত্রাতেই চরিত্রটি বিশেষ স্তরে উন্নীত হয়েছে।

আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে ধরবার চেষ্টা হয় শিল্পীর আত্মাকে, বা বলা যায় আত্ম-অনুভব ছড়ানো থাকে উপন্যাসের সারা শরীরে। শিল্পী তথা লেখকের প্রত্যেকটি রচনাতে প্রকাশিত আত্ম-অনুভব আসলে লেখার, অলক্ষে লেখকের আত্ম-চরিত্রের নব-নির্মাণ। এই সদা নির্মীয়মান আমি-কে লেখক মধ্যবয়সে পৌঁছে নির্মোহ দূরত্বে যেন শিল্পরূপ দিতে চেয়েছেন এই উপন্যাসটিতে। তাই পূর্ববর্তী সাহিত্যসৃষ্টিতে তিলে তিলে নির্মিত লেখকের আত্ম-অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে কীভাবে লেখক বর্তমানে স্বয়ং নায়ক হয়ে উঠেছেন তা লক্ষ করব।

পত্রলেখক চরিত্রটির সাহিত্য-রচনার উন্মেষ লগ্নটির পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন—”তখন লিখতাম কী? মনে পড়ে না। কাকে, কার উদ্দেশে? জানা নেই। নৈর্ব্যক্তিক নিরুদ্দেশ কেউ সেই উদ্দিষ্ট।’ ‘মুখের রেখা’ উপন্যাসের সৌর পত্রলেখকের সাহিত্য-রচনার মতোই নিরুদ্দিষ্টের প্রতি পত্র রচনা করে—’কী লিখল, সৌর জানে না। এ চিঠি তার প্রথম প্রণয়ের লিপি, কাকে পৌঁছে দেবে, তাও না। তবু লিখতে ভালো লাগছিল।’

প্রণববাবুর মৃত্যু-পরবর্তী পরিবেশ বর্ণনা করতে গিয়ে পত্রলেখক বলেন—’এক একটা মৃত্যু এই সব ঘটায়, অনেককে স্পর্শ করে, প্রথমে সমবেদনা, পরে সেটাই মহৎভাবে আবিষ্ট করে। হয়তো খানিকক্ষণের জন্য।’ পত্রলেখকের এই বোধই ‘কান্নার মানে’ গল্পের মূল উপজীব্য। যেখানে খারাপ মানুষরাও মৃত্যুসংবাদে খানিকক্ষণের জন্য মহৎভাবে আবিষ্ট হয় তার কথা আছে।

পত্রলেখক শেষপর্যন্ত মায়েরও থাকে না, বাবারও হয় না, হয়ে ওঠে কলকাতার। কলকাতার প্রতি আসক্তি বোঝাতেই লেখা হয়েছে—”তুমি নও, বাবাও না, সেই বিশালকায় ঘনশ্বাস বিলাসিনী আমাকে রূপ-রস-গন্ধ-মোহের দহে নিমজ্জিত করবে।” ‘সুধার শহর’ উপন্যাসে কলকাতার প্রতি সুধার ক্রম-আসক্তি ভিন্ন ভাষাতে হলেও একই ভাবে তুলে ধরা হয়েছে—’কী করে তাকে সুধা বোঝাবে নিশীথ নয়, নিশীথ নয়, মনে মনে সে যাকে বরমাল্য দিয়ে বসে আছে, তার নিঃশ্বাসে কালি, যন্ত্রে হৃদস্পন্দ…!”

‘ভেবেছিলাম’ গল্পে লেখক চিত্রিত করেছিলেন একটি পরিবারের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস। ‘কলকাতা এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’—এই ভাবনাতে ভাবিত ছিল পরিবারটি। কিন্তু সে স্বপ্ন সফল হয় না এবং তাদের ‘কলকাতা’ সম্পর্কিত ‘মিথ’-টিও নষ্ট হয়ে যায়। আলোচ্য উপন্যাসেও কলকাতাকে ঘিরে মা, বাবা, পত্রলেখকের মনে তৈরি হওয়া স্বপ্ন সফল হয় না, এবং ‘ভেবেছিলাম’ গল্পের নায়কের মতোই স্বপ্নজগতের আশ্রয়টিও বিনষ্ট হয়।

অর্থাৎ প্রত্যেকটি সাহিত্য-কর্মের মধ্যে যে-ভাবে আপন অনুভবকে খণ্ড খণ্ডভাবে লেখক প্রকাশ করেছিলেন, এই উপন্যাসে নিজেকেই আধার করে সেই অনুভবকেই একত্রিত করে সঞ্চার করতে চেয়েছেন অখণ্ডবোধ। আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে এ-এক নব-নিরীক্ষা বলা যায়।

মা নিরুদ্দেশ হলে যন্ত্রণায় দগ্ধ পত্রলেখককে সুধীরমামা এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে জানিয়েছেন—”ভার বয়ে যেতে হবে, স্বীকারোক্তি আর প্রায়শ্চিত্তে রোজ শরীরকে রগড়ে রগড়ে মুছে সাফা থাকার মতো।” স্বীকারোক্তি ও প্রায়শ্চিত্ত এই শব্দদ্বয়, দুটি ধর্মীয় ধারণাকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে। স্বীকারোক্তি বা কনফশন খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে পাপক্ষালনের উপায়। আবার প্রায়শ্চিত্তকরণ হল হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে পাপক্ষালনের উপায় স্বরূপ। ঔপন্যাসিক পত্রলেখক চরিত্রটি তথা উপন্যাসটিকে কোনও ধর্মবিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত করেছেন তা বলা যায় না। কিন্তু অপরাধবোধে সন্তপ্ত পত্রলেখকের যন্ত্রণাদগ্ধতা এবং তা থেকে নিজেকে মুক্ত করার আকুতিকে বোঝাতে এসেছে স্বীকারোক্তি ও প্রায়শ্চিত্ত প্রসঙ্গ। এই ধর্মীয় ধারণা দুটি গ্রহণ করেছেন সন্তোষকুমার, পাপক্ষালনের ধর্মীয় উপায়টি গ্রহণ করেননি। পত্রলেখক তার পাপবোধ থেকে মুক্ত হতে চেয়েছেন একান্ত নিজস্ব উপায়ে। মায়ের উদ্দেশে পত্ররচনা করেই সে মুক্ত হতে চেয়েছে। দশমাস ধরে ধারণ করা এই লেখার পর পত্রলেখকের অনুভব—”অবশেষে এই তো আমি মুক্ত হতে পেরেছি।” কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হয় এই রচনাটি কেবল পত্রলেখক রচিত পত্র হয়েই থাকে না, হয়ে ওঠে উপন্যাস, যার লেখক সন্তোষকুমার ঘোষ। ফলে স্বীকারোক্তি ও প্রায়শ্চিত্তের মধ্য দিয়ে যে আত্মশোধনের আয়োজন, তা স্বয়ং লেখকেরও। সমালোচকও উপন্যাসটির পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন—”একদা গর্বিত, নিষ্ঠুর এক তরুণ যুবা আঁধার ঘনালে উৎসের দিকে ফিরে তাকায়, প্রায়শ্চিত্ত করে তার দেবতা বা দেবীর বেদীতে, বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে। সন্তোষকুমার সেই বক্ষরক্তের অক্ষরে নির্মাণ করেছেন ‘শেষ নমস্কার শ্রীচরণেষু মাকে’। সমারসেট মম তাঁর ‘Of Human Bondage’ উপন্যাসের ভূমিকায় জানিয়েছিলেন – “… The Book did for me what I wanted and when it was issued to the world…I found myself free for ever from the pains and unhappy recollections that tormented me.” লেখকের এই মন্তব্যের সূত্রেই উপন্যাসটিতে আত্মজীবনীমূলক হিসাবে বিচার করতে গিয়ে Richard Cordell মন্তব্য করেছেন এই উপন্যাসটি যন্ত্রণাদগ্ধ লেখকের কাছে ‘great psychological cathersis’ প্রদান করেছে। সন্তোষকুমারের কাছেও ‘শেষ নমস্কার শ্রীচরণেষু মাকে’ উপন্যাসকে ‘psychological cathersis’ রূপেই চিহ্নিত করা যেতে পারে।

মুখের ‘রেখা’ থেকে ‘শেষ নমস্কার শ্রীচরণেষু মাকে’ পর্যন্ত লেখকের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস রচনার ক্রমিক বিবর্তনটি এক নজরে দেখলে বলা যায়—’মুখের রেখা’ উপন্যাসের নায়ক জীবনের অর্থ সন্ধান করতে গিয়ে বিশ্লেষণ ও যুক্তির আশ্রয় নিয়েছে, ফলে নায়ক ও লেখকের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে, আবার ‘জল দাও’ উপন্যাসে অপরাধবোধে সন্তপ্ত নায়ক চরিত্রটি লেখকের আত্মোপলব্ধিজাত হলেও এই নায়কের উপলব্ধিকে নির্বিশেষ করার প্রতি আগ্রহ আছে, ‘স্বয়ং নায়ক’ উপন্যাসে লেখক ও নায়ক একাত্ম হবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু কাহিনিটিই সম্পূর্ণতা লাভ করেনি, ‘শেষ নমস্কার শ্রীচরণেষু মাকে’ উপন্যাসে লেখক এবং নায়ক একাত্ম হয়ে গেছেন, কেবল স্বীকারোক্তি, বা প্রার্থনা, বা প্রাণিত হওয়ার আকুল আর্তিতেই উপন্যাসটিকে শেষ না করে আত্মশোধনের আয়োজন আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে নবমাত্রা যোগদান করেছে।

সন্তোষকুমার ঘোষের জীবনী ও গ্রন্থপঞ্জী

জীবন

জন্ম—৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২০

মৃত্যু—২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫

জন্মস্থান—রাজবাড়ি, ফরিদপুর, বাংলাদেশ

বাবা/মা-সুরেশচন্দ্র ঘোষ, সরযূবালা ঘোষ

স্ত্রী—নীহারিকা ঘোষ, ছেলে—সায়ন্তন, মেয়ে—কথাকলি, কৃষ্ণকলি, কাকলি। শিক্ষা—স্নাতক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

পেশা— সাংবাদিকতা। প্রথম জীবনে যুগান্তর, প্রত্যহ, জয়হিন্দ, মর্নিং নিউজ, নেশন, স্টেটসম্যান প্রভৃতি পত্রিকায় কাজ করার পর ১৯৫১ সালে দিল্লি হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড-এ যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় বার্তা সম্পাদক হয়ে আসেন। পরে, আনন্দবাজার ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের সংযুক্ত সম্পাদক ও শেষে আনন্দবাজার পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হন।

বিদেশ যাত্রা—
১৯৫৭–বর্মা (বর্তমান মায়ানমার) ও পূর্ব ইউরোপ ১৯৬০ ইংল্যান্ড
১৯৬১–জার্মানি ১৯৬৪—ইংল্যান্ড ও পশ্চিম ইউরোপ
১৯৬৫—জাপান, ইংল্যান্ড ১৯৬৬—আমেরিকা
১৯৬৮–থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ১৯৭২–রাশিয়া
১৯৮২-আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জাপান, হংকং

প্রথম যৌবনের যৌথ সাহিত্যচর্চা—’মিলন সংঘ’ নামক সাংস্কৃতিক সংস্থায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সাহিত্যচর্চা। জগৎ দাসের সঙ্গে ‘ভগ্নাংশ’ নামক গল্পগ্রন্থের প্ৰকাশ।

পুরস্কার :

আনন্দ ১৯৭১, বিশেষ আনন্দ ১৯৭২, আকাদেমি–১৯৭২, তাইওয়ান কবি সংঘ থেকে ১৯৮৪-তে ডি. লিট উপাধি প্রাপ্তি।

গ্রন্থপঞ্জী :

উপন্যাস

১। কিনু গোয়ালার গলি, (১৯৫০, ডি. এম.)

২। নানা রঙের দিন (১৩৫৯, ক্যালকাটা বুক ক্লাব)

৩। মোমের পুতুল (১৩৬১, বেঙ্গল পাবলিশার্স)

৪। মুখের রেখা (১৩৬৬, ত্রিবেণী)

৫। রেণু তোমার মন (মিত্র ও ঘোষ)

৬। ফুলের নামে নাম (এভারেস্ট)

৭। জল দাও (১৯৬৭, আনদ)

৮। স্বয়ং নায়ক (১৩৭৬, গ্রন্থপ্রকাশ)

৯। শেষ নমস্কার (১৩৭৮, দে’জ)

১০। সময়, আমার সময় (১৩৭৯, আনন্দ)

১১। ফুল নদী পাখি (১৯৭৬, রামায়ণী)

১২। সুধার শহর (দে’জ পাবলিশিং)

১৩। নিশীথ রাতে (‘চতুরঙ্গে’ প্রকাশিত, অগ্রন্থিত) )

১৪। আমার প্রিয় সখী (১৩৬৭, ক্যালকাটা পাবলিশার্স)

১৫। করকমলেষু (গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত, ‘চতুর্দোলা’ ত্রৈমাসিক প্রকাশেও অসম্পূর্ণ)

১৬। সন্তোষকুমার ঘোষের উপন্যাস সমগ্র (২টি খণ্ডে সমাপ্ত) : আনন্দ পাবলিশার্স

বড় গল্প :

১। ত্রিনয়ন (১৩৭৬, মিত্র ও ঘোষ)

২। দূরের নদী (১৩৮৪, দে’জ)

৩। সেই পাখি (১৩৮৪, বিশ্ববাণী)

ছোট গল্প সংকলন :

১। শ্রেষ্ঠ গল্প (১৩৫৯, দীপজ্যোতি প্রকাশনী

২। চীনেমাটি (১৯৫৩, মিত্ৰালয়

৩। শুক-সারী

৪। পারাবত (১৩৬০, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং

৫। কড়ির ঝাঁপি (১৩৬৩, ক্যালকাটা বুক ক্লাব)

৬। পরমায়ু (১৩৬৪, ত্রিবেণী)

৭। দুই কাননের পাখি (১৩৬৬, কারেন্ট বুক শপ)

৮। চিররূপা (১৯৫৯, নাভানা )

৯। কুসুমের মাস (১৩৬৬, ক্লাসিক প্রেস)

১০। ছায়াহরিণ (১৯৬১, সুরভি)

১১। বহে নদী (১৩৭০, গ্রন্থপ্রকাশ)

১২। যুবকাল (১৯৭৬, বিশ্ববাণী)

১৩। সন্ধ্যা সকাল (১৯৭৯, আনন্দ )

১৪। দুপুরের দিকে (১৯৮০, আনন্দ)

১৫। কুসুমাদপি (১৯৮৪, সংবাদ)

১৬। সমস্ত গল্প ৩ খণ্ড (১৩৮৪, ১৯৭৯, ১৯৮৩ স্বরলিপি)

১৭। সন্তোষকুমার ঘোষের গল্প সমগ্র ১ম, ২য়, ৩য় খণ্ড (দে’জ পাবলিশিং)

নাটক :

১। অজাতক (১৩৭৬, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ)

২। অপার্থিব (১৩৭৮, মিত্র ও ঘোষ)

কবিতা :

১। কবিতার প্রায় (১৯৮০, দে’জ)

২। মিলে অমিলে (স্বরলিপি)

প্ৰবন্ধ :

১। বাইরে দূরে (১৩৭৩, বেঙ্গল পাবলিশার্স)

২। বাংলাদেশ কোন পথে (১৯৭৩, নবপত্র)

৩। সোজাসুজি (১৩৭৭, দে’জ)

৪। রবীন্দ্রচিন্তা (১৩৮৫, হেমলতা প্রকাশনী)

৫। রবির কর (১৯৮৪, আনন্দ)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *