৩০
“আমার বোন।” অতি সাধারণ কথা তবু কেন যে বাঁশি অত ফিসফিস করে বলছিল।—”তবে আমি যেমন ছেলে হয়েও মেয়েই, ও কিন্তু মেয়ের বেশে ছেলে না। আমার বোন মেয়েই।”
এই সব বলছিল বাঁশি, কেন বলছিল? শুধু কৌতূহল নয়, সে কেন করুণাও জাগিয়ে তুলতে চাইছিল? আমি জানি না। বাঁশি বলেছিল, “শুধু ওর একটা কষ্ট আছে। চোখে খুব কম দ্যাখে। বোধ হয় অন্ধ হয়ে যাবে।”
“অন্ধ?” যাকে দেখিনি, দূর থেকে যাকে শুধু তার ভাইয়ের মতো ঠেকে চমক লেগেছিল, তার আসন্ন কোনও ভীষণ বিপদের জন্যে সমবেদনা নয়, হয়তো আপনা-আপনি, যান্ত্রিক ভাবেই প্রশ্নটা বিদারিত হয়েছিল।
“ওর দোষ নেই”, বাঁশি বলল আস্তে আস্তে, “আমার বাবার পাপ। তিনি পালিয়ে গিয়েছেন, তবু এক দিক থেকে সেই পাপ বহন করছি আমি, আমার বোনও তার ভার বইছে।”
এ-কথার সম্পূর্ণ তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করলাম না। জানতাম, বাঁশি পূর্ব-পুরুষদের প্রতি কী ঘৃণা পোষণ করে।
বাঁশিকে দরকার হল না, সে নিজেই ছাদে উঠে এসেছিল বিকালে, মা, তোমার সঙ্গে। মনে আছে?
যেন চকখড়ির একটা লেখা, ঋজু শুভ্র একটি রেখা, আবার মাঝে মাঝে ঝুঁকে পড়ে সে টবের প্রতিটি চারা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল, যত তুলসী, ফণীমনসা, কিংবা এলানো যত লতা ছিল—সব। শুধু তার চোখে অসুন্দর ঘষা কাচের একটা চশমা ছিল।
“জল কেন মাসিমা, রোজ দিতে হয় এই গাছগুলোতে? কেন, নিজে থেকে বাঁচতে পারে না ওরা?” সে বলছিল, শেষ বেলার হলদে রোদে মিলে-যাওয়া কয়েকটা ফুল দেখিয়ে। অনেক প্রজাপতি বাতাসে সাঁতার দিতে দিতে চলে যাচ্ছিল গঙ্গার দিকে, আবার ফিরেও আসছিল, ওকে ঘিরে চক্রাকারে ঘুরবে বলে।
“জানেন মাসিমা, মেসোমশাই আজ চমৎকার একটা কথা বলেছেন কিন্তু, আজ সকালে। যখন রাগানে নেমেছিলাম। ফুলগুলো দেখে দেখে বেড়াচ্ছিলাম, তখন উনি অদ্ভুত একটা কথা বললেন। কালো এই চশমাটা চোখে ছিল তো, মেসোমশাই কী বললেন জানেন? বললেন যে, কালো চশমা পরে নাকি আলোয় বের হতে নেই। অথচ আমরা তো আলোর জন্যে চোখে ঠুলি পরি? উনি কিন্তু বললেন, “যদি তাঁকে দেখতে চাও তবে কালো চশমা পোরো না। এই তো দ্যাখো, ফুলগুলো, ওরা তাঁর দিকে সটান তাকায়, চেয়ে চেয়ে দ্যাখে। ফুলেরা কী কখনও সানগ্লাসে চোখ ঢেকে রাখে?’ অদ্ভুত কথা নয় মাসিমা? ভালো বুঝলাম না, কিন্তু দারুণ ভালো লাগল।”
“ও তো খুব ভালো কথা বলতে পারেই” তুমি বললে, কোনও প্রকার উত্তেজনাহীন কণ্ঠস্বরে।
.
মা, লেখাটা আমার জীবনে আমি বারবারই দেখেছি, জ্বরের মতো, জোয়ারের মতো। কম্প দিয়ে আসে, মাঝে মাঝে, সব ভাসায়, কিন্তু স্থায়ী হয় না, ছেড়ে যায় সরে যায়! তখন সব হিম, ভীষণ শীতল, এমন-কী মৃত, বরফের পরে মেরুদেশের মতো দীর্ঘকাল আচ্ছাদিত থাকে। ছাড়ে ধরে, আবার পরমা কোনও প্রণয়িনীর মতো সে আমাকে অধিকার করে, এবং যদিও তখন সম্মোহিত আমি তার করতলগত, তবু তখনই আমি জীবিত, একমাত্র তখনই, অন্যথা এই জীবন শুধুমাত্র চিকিৎসা-বিদ্যাতেই স্বীকৃত একটা মরুশুষ্ক অস্তিত্ব।
সে-সময়টার কথা লিখছি, তার কিছু আগেই আমি নতুন করে লেখা ধরেছিলাম। আমি তাকে ধরেছিলাম, না সে ধরেছিল আমাকে, বলা কঠিন, কেননা একটু আগেই বললাম যে, মা, তোমার কিছু মনে থাকে না, বললাম না যে আমার লেখা কোনও চঞ্চলা রমণীর মতো, যতটা আমার প্রতি বিশ্বস্ত, অবিশ্বস্ত ততটাই, সে ছেড়ে যায়, আবার ফিরে ফিরে আছড়ে পড়ে আমাকে মারে, মেরে বাঁচায়। আমার ঈশ্বরও আমার কাছে সেই মতো একই সঙ্গে আমার প্রতি নির্মম অথচ মমতাঘন আমি কাউকে দেখিনি।
আমি তখন লিখছিলাম। নাটক? না, তখনও না। নাটক আসে পরে, অনেক পরে, অনেক অভিজ্ঞতার স্তর পার হয়ে, যখন উপলব্ধি হয় সমস্ত জীবন, গোটা জগৎটাই একটা নাটক, ঘাত প্রতিঘাতে কণ্টকিত অথবা অভিঘাতহীনতায় অতি-প্রশান্ত, শুধু সে বিয়োগান্ত না মিলনান্ত, একজন ছাড়া কেউ জানে না। কে সেই জন? নাট্যকার নামে নাম যার ছাপা সে? দূর, সে তো কেবল নিমিত্ত, তার তো শুধু হস্ত, যে জানে সেই লেখে, লিখিয়ে নেয়, নাটক কেন সবই। কবিতা, কাহিনি—সব। তারই কথা, বস্তুত সংলাপমাত্র তারই সঙ্গে কথোপকথন। আমার হাত কাঁপছে, মা, তোমাকে লেখা এই চিঠিও বুঝি তাই।
তখন লিখতাম—কী? মনে পড়ে না। কাকে, কার উদ্দেশে? জানা নেই! নৈর্ব্যক্তিক নিরুদ্দেশ কেউ—সেই উদ্দিষ্ট। শুধু একটা বেদনা ছিল, একটা প্রার্থনা। কেউ আছে, কোথাও আছে, যে আমার অপেক্ষায় আছে, আমাকে যে অপেক্ষায় রেখেছে—সে। তপ্ত হাওয়ার স্পর্শে, পত্র-পল্লবের ব্যাকুলতায়, রক্তাক্ত রৌদ্রে রক্তাল্প জ্যোৎস্নায় তাকে পেতাম, সব-কিছুর আঘ্রাণে, শ্রবণে, সেই অদর্শনার বিভোর-কামনা, সব মুহূর্ত, তার জন্যই তো, সর্ব ইন্দ্রিয়ের উচ্চৈঃস্বর সংকীর্তন! তার নাম? হয়তো অপূর্ণতা, তার নাম হয়তো অভাব। ভাব-আবির্ভাব ঘটলে সে থাকে না। থাকলেও সেইভাবে না।
.
বুলাদের বাড়ি বাঁশিকে পৌঁছে দিয়ে যখন ফিরে এলাম, তখন হয়তো—দোতলার জানালা থেকেই হয়তো—সে আমাকে দেখেছিল। আমি দেখিনি তাকে। খাতাটা খুলে লিখতে বসে গেছি, তখন লিখতে বসাটাই ছিল মুক্তি, অপ্রতিরোধ্য কোনও-কোনও জৈব বেগের মতো।
ছাদেও এসেছিল সে, কোনও-কোনও উপস্থিতি মৃগনাভির মতো, অপ্রত্যক্ষ, তবু স্বতঃই আমোদিত। দিন কয়েক আগেকার সেই চরিতার্থ প্রজাপতিগুলিকেই কি খুঁজছিল সে? আমি জানি না। আমি তখন শব্দের পর শব্দের সিঁড়ি ভেঙে আরোহণে ব্যস্ত।
সেই সময় ভীষণ আওয়াজ করে বে-নোটিস একটা ঝড় উঠল বলে, অথবা ঝড় ওঠেনি, দিগ্বিদিক রুদ্ধশ্বাস হয়ে যায়নি ধুলোয়, বাগানের একটা ডালও মড়মড় করে পড়েনি, ওসব আমার শুধুই ভুল, শুধু অনুমান, তবে আকাশে মোষের মতো রাগী-রাগী রঙের মেঘ ছিল, নিশ্চয় ছিল, তারা গাঁ-গাঁ জন্তুটার মতো ডাক ছাড়ছিল আর। আর তাইতেই সে ভয় পেল, অথবা সে কি ভয় পেয়েছিল ওর চশমার কাচের রঙ পাঁশুটে মেঘের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল বলে?
কিন্তু সে এল। এল তাড়াতাড়ি, ত্রস্ত, তার চশমা খুলে কাচ আঁচলে ঘষছিল।— “কী লিখছেন, দেখি।”
.
এই কথাটা সে বলেছিল কতক্ষণ পরে? আজ আমার মনে নেই। অনেক সময়ের শব্দতরঙ্গ পেরিয়ে, “কী লিখছেন দেখি”, এই বাক্যটি আবহমান বাজছে।
নিশ্চয়ই বেশ কিছুক্ষণ পরে কথাটা সে বলেছিল? প্রথমে প্রথামতো একটু চমকে যাবার পরে, কালো কাচ খুলে সে যখন ভারী পাওয়ারের পুরু কাচের চশমা পরে নিল, আমাকে দেখল, তারও পরে? সহজ হবার জন্যেই কি হঠাৎ সে বলল ওই কথাটা “কী লিখছেন, দেখি”– প্রকাশ করল নারী-স্বভাবের ওই স্থায়ী-সম্বাদী সুরের ঔৎসুক্যটা, অথবা তার আগেই আমাদের আরও কিছু-কিছু মৌখিক আলাপ হয়েছিল? মনে নেই।
তাকে দেখালাম। সেদিন যা লিখছিলাম, সেই না-কাব্য, না গদ্য লাইন ক’টা। সাদা পাথরের মতো ভারী আর পুরু চশমার কাচে লুকোনো চোখ দিয়ে, যেহেতু লুকোনো সেই হেতু চোখ দুটি দেখতে পেলাম না ভালো করে, সে পড়ে গেল :
বৃক্ষতলে রাত্রিযাপন আমার ভরপুর স্বপ্নগুলির অন্যতম। যদি কোনো রাত—একটি রাত্রিও—সেখানে কাটাই, তবে পত্রে-পুষ্পে সমাচ্ছন্ন হয়ে যাই। পত্র-পুষ্প, অথবা অনুভূতি? অনুভূতি, না উপলব্ধি…?”
এই পর্যন্ত সে পড়ল। ধীরে ধীরে, প্রতিটি স্বরে ভর করে, পিছল উঠোন লোক যেমন প্রতিটি পাতা ইঁটের উপর ভর দিয়ে পার হয়।—”কিছু বুঝলাম না কিন্তু”, সে বলল, “এর মানে কী?”
বললাম, “এর মানে নেই।”
“যাঃ। মানে তো একটা থাকবেই।”
“সব সময়ে নয়। কিংবা থাকে, শুধু একজনেরই কাছে। এক-একটা ঘর বা বাসের
চাবি যেমন একজনের কাছেই থাকে, একা সে-ই খুলতে জানে।
“আপনি খুলতে পারেন?”
“পারি, তবে বললেই নয়। চাবিটা মাঝে মাঝেই হারিয়ে যায়।”
দৃষ্টিহীন দৃষ্টিতে সে চেয়ে রইল। আবার আর-একটা পাতা টেনে পড়ল : “দিঘিতে হাওয়ার অত্যাচারে দেখেছি, সে-ছবি যেন আসক্তির। কিন্তু আসক্ত হাওয়া, তা-ই কি তার সব স্বরূপ? তাকে অন্যত্রও দেখেছি, প্রান্তরে যখন ঝড় বয়ে যায়। কিছু মাখে না, কোনও চিহ্ন রাখে না, প্রান্তর আর ঝড় দু-ই উদাসীন। একজন সয়ে যায়, বয়ে যায় আর-একজন।
পড়ে সে বলল, “বুঝিয়ে দিন।”
“বোঝানোর দরকার কী?”
আসলে তার পুরু কাচে সুদূর চোখ দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম। এ-সব চাপা দিয়ে চাইছিলাম অন্য কথা টেনে আনতে! আপনি কাল এসেছেন? কালই, কিন্তু আপনি কেন, আমি তো ছোট।—ছোট-বড় বুঝি না। ও কী, ওকী, কালো চশমাটা আবার পরবেন না।—পরব না কেন?—বিশ্রী দেখায়।—কাকে, আমাকে?—আপনাকে কেন, আমাকে; আপনি যা দ্যাখেন তার সমস্তটাকে।
সে বলল, “ঠিক! সব কেমন কালো দেখায়।” বলে সে উঠে ড্রেসিং টেবিলের ধারে গেল। গন্ধ তেল আর ক্রিম, ক্রিম আর পাউডারের কৌটো-শিশিগুলো তুলে তুলে বলল, “দাদা মাখে। আপনিও এ-সব মাখেন বুঝি?”
“আমি? কখনও না।”
“আমি মাখি না।” সে বলল বিষাদের সুরে। “তোমার দরকার হয় না।”
“হলেও মাখতাম না। দেখছেন না আমাকে? একেবারে সাদাসিধে /শুকনো/ খসখসে।”—কথাগুলোকে সে যেন নিচু হয়ে কুড়িয়ে কুড়িয়ে ঠোঁটে তুলে বলছিল, তার প্রসাধনহীন অধর আর ওষ্ঠ তখন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। তারপর আস্তে আস্তে তার দৃষ্টি আমার উপরে ন্যস্ত করে সে বলল, “জানেন না? আমি যে অন্ধ হয়ে যাচ্ছি।”
“তার সঙ্গে প্রসাধন করা না-করার সম্পর্ক কী?”
দেখব না”, সে দুঃখিত অথচ প্রতিজ্ঞা স্বরে বলল, পৃথিবী আমাকে আর বেশি দিন তাকে দেখতে দিতে চায় না, অন্তত সুন্দররূপে নয়। আমিই বা তবে তাকে দেখব কেন, দেখা দিতে চাইব কেন!” বলতে বলতে কোথা থেকে আরও একটু জোর পেল সে—”দেখব না, দেখতে চাই না, দেখা দিতেও না।”
“কিশমিশ” আমি বললাম, “কিশমিশ, এত নিষ্ঠুর হয়ো না। এই নিষ্ঠুরতা তোমার নিজের প্রতি।” জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল-সে, যেন তার ফুল-ফলগুলি কেউ আঁকশি দিয়ে পেড়ে নিচ্ছে। “কিশমিশ? কে বলল আমার নাম কিশমিশ? আমি তো ফাজিল ফুর্তিবাজ একটা মেয়ে নয়, ওই ডাক নামটা আমাকে মানায় না। আমার আসল নাম কী জানেন? জানেন না? আসল নাম হল রজনীগন্ধা।” বলে সে অপেক্ষা করল।—”খুব ভারী নাম না?”
“সুগন্ধিও!’
“দিনে থাকে না।”
“থাকে”, আমি বললাম, “যদি জল পড়ে। যদি ভিজে-ভিজে থাকে। যদি—”
তার চোখ দুটিও ভিজে ভিজে হয়ে এসেছিল, সাদা-কালো দুটো চশমাই খুলে সে টলটলে চোখে চেয়েছিল, সেই চোখের মণি নীল, কিন্তু বড় নিষ্প্রভ নীল, হেমন্তের ম্রিয়মাণ স্বসিজের মতো; কিন্তু চোখের পাতা যেন জলজ দীর্ঘ ঘাসে পূর্ণ, তার গলা ভিজে হয়ে এসেছিল। “যদি জল পড়ে, যদি—” আমার কথার একাংশ কেড়ে নিয়ে সে-ও বলল “যদি—?” তারপর অপেক্ষা করে রইল।
মা, এইখানে সেই বাক্যটি লেখা কঠিন, কিন্তু কাজটা আরও কঠিন, দুঃসাহসিক ছিল। লিখতে তবু পারব—এই বয়স আর বছরগুলো তো ফিল্টারের কাজ করে—পারব আরও এই কারণে যে, তুমি ঘটনাটা জানো, হঠাৎ সেখানে এসে পড়ে দেখে ফেলেছিলে।
তার চোখের সেই দীর্ঘ জলজ ঘাসের শিষেও ভিজে-ভিজে ছোপ লেগেছিল। কাঁপা-কাঁপা হাতে কাঁপা কাঁপা পাতা মুছে ফেলে সে ভীতু অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, “এ কী!” রজনীগন্ধার ডাঁটা থেকে ডগা অবধি শিহরিত হচ্ছিল। যদিও আমিও তখন থরথর, তবু প্রবল প্রগাঢ় আবেগে তাকে বলতে গেলাম “এমন আর কিছু কী। ঘৃণা হচ্ছে, খারাপ লাগছে?”
তার দু’হাতে চোখ ঢাকা ছিল, হাত সরাতে তার চাহনির পাণ্ডুরিমা পূর্ণিমা হয়ে গেল। তার চোখে ক্লান্তি ছিল, ঈষৎ মথিত, আড়ষ্ট ভাব, আড়ষ্ট ভাবেই সে আরও আনত হয়ে পড়ে বলল, “ঘৃণা? না, ঘৃণা না।”
আরও সাহসী হয়ে আমি তার পিঠে হাত রাখলাম। পরিম্লান দৃষ্টিতে যত বিস্ময় ছড়ানো যায়, ছড়িয়ে ছড়িয়ে সে বলল, “কিন্তু কেন।”
“ওই চোখের দৃষ্টির অস্বচ্ছতা মুছে দিতে, পৃথিবীকে তোমার চোখে আরও সুন্দর করে তুলতে”–কিংবা এই রকমই অনেক কিছু সাজিয়ে সাজিয়ে তাকে বলতে থাকলাম ক্রমাগত, কিন্তু মনে মনে, আর যদিও মনে মনে তবু আমার মুখ রক্তোচ্ছ্বাসে ভরে যাচ্ছিল, এত সৎ, এত শুদ্ধ তথাপি এত বিচলিত এর আগে কখনও বোধ করিনি, মনে যা বলছিলাম, মুখেও তাই হয়তো আনতাম, বলতাম একটি অন্ধপ্রায় মেয়েকে, প্রায়ান্ধ একটি সন্ধ্যাকালকে সাক্ষী রেখে, কিন্তু মা, তখনই তোমার ছায়া পড়ল, আড়াল থেকে তোমার কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
তুমি কখন এসেছ, বাইরে কতক্ষণ ছিলে?
.
সে বলেছিল “এ কী!” তুমিও বললে “এ কী, এ-সব কী”–কিন্তু তার চেয়ে অনেক কঠিন সুরে। তুমিও কাঁপছিলে—রাগে। টেনে, আমার হাত মুচড়ে মুচড়ে নিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকলে।
“এ-সব কী।” নীচের ঘরের একটি কোণে, সেখানে জানালা নেই, জায়গাটা আপনা থেকেই কেমন ফাঁদ মতন হয়ে যায়, সেই ঘরে আমাকে কোণঠাসা করে ফেলেছ তুমি হাতুড়ি-পেটার মতো শব্দ করে বলছ “এ-সব কী”, পিটছ বটে হাতুড়ি, কিন্তু তোমার গলা যেন কোনও ভারী ধাতু, ধপধপ আওয়াজ বের হচ্ছে।
আমার হৃৎপিণ্ডও সেই ধাতুতে তৈরি হয়ে গেছে। তোমার চোখ? সীসের গুলি দিয়ে যদি তৈরি হত অক্ষি-গোলক, দেখতে এই রকমই হত। আমার চোখও কোনও ধাতুতে পরিণত হয়ে গেছে টের পাচ্ছিলাম আমি—পারা, বা অনুরূপ কোনও চঞ্চল ধাতুতে, ফাঁদে-পড়া জন্তুর মতো আমি ছটফট করছিলাম। ব্যূহ বদ্ধ কোনও অসহায় সৈনিক ও হতে পারি, কিন্তু কোথায় আমার তীরধনুক, কিংবা তলোয়ার? খুঁজে পাচ্ছি না, বিনা যুদ্ধে প্রাণ দিতে হবে নাকি, আমার সামনে দুই হাত বাড়িয়ে রাস্তা আগলে যে দাঁড়িয়ে সে কে, মা না রাক্ষসী? রাক্ষসী ধারালো নখে ছিঁড়ে খাবে নাকি, ভীষণ ভয় পেয়ে ভীষণ ঘৃণা করে, হ্যাঁ মা, তোমাকে ভীষণ ঘৃণা করার পাপ তখন চাপ-চাপ রক্তের মতো আমার বুকে জমাট, আমিও কঠিন করে নিয়েছি নিজেকে, আমাকে আত্মরক্ষা করতেই হবে, কিন্তু কী-ভাবে কী ভাবে কী বলব আমি তোমাকে?
“কী আবার, কিছু না।” বললাম শুষ্ক স্বরে। “এসব কী” এই প্রশ্নটার উত্তরে।
“কিছু না। কিছু না?” ভাগ্যিস ওখানে, ওই কোণটাতে আলো পড়ে না, তবুও আমি দেখছিলাম তোমাকে, দ্বিতীয় রিপুটি দখল করে নিয়েছে, পরাক্রান্ত সেই ক্রোধ আমার আর কী করবে, তার আগে তোমাকে অন্ধ করে দিয়েছে, অন্ধ তুমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছ না, আমার আর ভয় কী তোমাকে, আমিও তখন বেপরোয়া, কোমরের কাছে ছুরি-টুরি পাওয়া যায় কিনা খুঁজছি।
তারপর? তুমি বললে “তুই তবে শুধু বদমাশই নয়, মিথ্যে কথা বলাও শিখেছিস? কিছু না, এখনও বলছিস, কিছু না? অথচ আমি নিজের চোখে যা দেখলাম—”
“হাত ছাড়ো” হঠাৎ আমার গলার জোর এল, রক্তোচ্ছ্বাসে মুখ ভরে গেল। কী বলছি কী করছি খেয়াল ছিল না। বললাম “হাত ছাড়ো”, শুধু যে বললাম তাই না, জোর করে হাত ছাড়িয়েও নিলাম। আমার সাহস এসেছিল, কিংবা আমি মরিয়া হয়ে যাচ্ছিলাম জানি না; তবে পরে অনেক অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এক-একটা পরিস্থিতিতে মানুষ, জন্তু সবাই মরিয়া হয়ে যায়, হিতাহিত, সম্মান, শ্রদ্ধা-টদ্ধা কিছু অবশিষ্ট থাকে না, গুরুজন তো গুরুজন, ঈশ্বর এমন-কী তাঁর নির্দেশ, বিধান সব কিছুকে অস্বীকার করে। আমিও করলাম—তোমাকে। ‘হাত ছাড়ো’ এই কথাটা বলার ভঙ্গিতে কিছুমাত্র ভালোবাসা ছিল না, হাত ছাড়ানোর ধরনের সবটাই বেঁকে-দাঁড়ানো, বেপরোয়া নিষ্ঠুরও, কারণ আমি জেনেছিলাম নিষ্ঠুর হয়ে তোমার নিষ্ঠুরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তবে বাঁচতে হবে, পাঞ্জা লড়ব আমি, তোমার ছেলে, তোমার সঙ্গে, তার জন্যে তৈরি হয়ে নিচ্ছিলাম, বিষাক্ত বাতাসে বুকের ভিতরটা বেলুনের মতো ফুলিয়ে নিলাম, পরে সব ঢেলে দেব বলে। মা, পালাও, সরে দাঁড়াও, এখনও, কোন্ ভরসায় তাকিয়ে আছ, কী নীচ, কী ভয়ানক হয়ে উঠছি আমি—টের পাচ্ছ না? পরশুরামে পরিণত হয়ে যেতে পেরেছি এত দিনে, আঃ এতদিনে, কিন্তু একালের পরশুরাম তো, কুড়ুলের মতো প্রবল অস্ত্র সে পাবে কোথায়, সে খালি কোমরে গোঁজা চকচকে ছুরিটা বের করতে পারে।
আমি তাই করলাম। বিশেষ করে তুমি যখন বললে, “ঠিক তোর বাবার স্বভাব পাচ্ছিস—ও যেমন ছিল।”
“চুপ করো।”—তোমাকে ধমক দিয়ে বলে উঠলাম, “বাবাকে এর মধ্যে আর টেনে আনা কেন?”
“সেই ছলনা, ভোলানো, ধরা পড়ে গিয়েও মিছে কথা—সব তার মতো।”
“কার মতো ঠিক বলা যায় না।” ঠিক তখনই সাবধানে সেই গুপ্ত ছুরিটা বের করে দেখিয়ে দিলাম আমি—”তোমার মতোও তো হতে পারি!”
চমকে গেলে তুমি।—”কার মতো, কার মতো বললি?”—”তোমার মতো, তোমার মতো”, বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছিল, আমার গলার স্বরে চমকে যাচ্ছিলাম আমি, ঝলকে ঝলকে বলে গেলাম, কথা তো নয়, রক্ত; বেরোচ্ছে ফিনকি দিয়ে, গলগল করে—”তোমার মতো। তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু আমি জানি। আজ কী দেখেছ জানি না, তবে জেনে রাখো, আমিও অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু জানি।”
“কী দেখেছিস, কী জানিস?” শ্বাস-নালি থেকে বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে, তাই বুঝি গলার কাছে রেখেছ একটা আঙুল, একটু পিছনে সরছ, বিবর্ণ, তোমার চোখ মুখে আতঙ্ক, তোমার স্বর নীরক্ত, তোমার পুত্র আততায়ী, সেই আততায়ীর হাতে ছুরি দেখে মা, তুমি ভীত।
“দেখেছি, একজনকে দিনের পর দিন আসতে। দেখিনি? কেন আসত, তার মানে কি জানি না? জানি। বাবাও জানতেন নিশ্চয়ই। তাই তো—” আমি বললাম, “তাই তো তিনি ওখানে বিশেষ যেতেন না। সব জানি।”
দিয়েছি, বিধিয়ে দিয়েছি সেই শানানো ছুরিটা এতক্ষণে, রক্তাপ্লুত একটা দেহ টলে পড়ে যাচ্ছে, ঘাতক তথাপি উল্লসিত, সে সরে যাচ্ছে নাচতে নাচতে, শোণিত স্নাত শাণিত ছুরিটা নাচাতে নাচাতে, একটি মৃতবৎ দেহকে শোনাতে শোনাতে, তাই তো বললাম, “বেশি ঘাঁটিও না, চাপা থাক, ঢেকে রাখো! নইলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে যাবে। বাবার মন বিরাট তাই শেষ পর্যন্ত ফিরে গেলেন, নিয়ে এলেন আমাদের–“
তুই এইসব বলছিস-তুই?” কে, কে বলল কথাটা, যে-কথা আর্তনাদের মতো? একটা মৃতদেহই তো আমার হাতে যে নিহত হল এইমাত্র, এখন ভূলুণ্ঠিত, মৃতের কণ্ঠস্বরে কর্ণপাত? কে করে! আমি করলাম না, দেহটির পাশ কাটিয়ে চলে এলাম।
সমস্ত জীবনে এই ভাবে কত মড়া দেখেছি, মড়ার মতো মুখচ্ছবি। বাবার, তোমার, সুধীরমামার। কতবার। এতবার মৃত্যু ঘটে, দাহ হয় শুধু শেষবার, হিসাবে সেইটেই টোকা থাকে। আমিও বারে বারে মরি নিশ্চয়ই—শুধু নিজের বলে মড়া-মুখটা দেখতে পাই না। মৃত্যু ঘটে স্বজনের হাতে, যাকে বড় ভালোবাসি, যাকে বিশ্বাস করি, যে-কাছাকাছি, সেই মারে, বস্তুত মারতে পারে একমাত্র সেই, অন্য কারও আঘাতের মর্ম স্পর্শ করার তো সাধ্য নেই। আর একপ্রকার মৃত্যু ঘটে—নিজের হাতে। সে আরও জটিল ব্যাপার, আরও যন্ত্রণার, ভীষণ লোভ যখন পেয়ে বসে, অথবা অন্ধ ক্রোধ; কোনও ক্ষুদ্রতা, বিশেষ করে ঈর্ষা, আত্মপরতা; অপরের প্রতি অপরাধ—এর প্রত্যেকটাই অভিমানী মনে কাতরতা আনে, সত্তা মুছে গেল বলে চিত্ত করে হাহাকার। নিজের মৃত্যুতে নিজের শোক, সেই কান্না চলে সঙ্গোপনে। অন্য শোকের সঙ্গে তার তফাতও এই—সেই কান্না কেউ শুনতে পায় না, কাউকে শোনানো যায় না। পৌনঃপুনিক মৃত্যুর দৃশ্যরূপ পাই চাঁদে, চন্দ্রমার রাহুগ্রাসে।
.
আরও কী মজা দ্যাখো, সব হত্যাকাণ্ড হয়তো, একতরফা ঘটে না। ঘাতক নিজেও তৎক্ষণাৎ মরে, জানি না, সব ঘাতকের বেলায় ব্যাপারটা ঘটে কিনা, তবে সেদিন আমার ঘটেছিল। একটি শবের পাশ কাটিয়ে যখন চুপে চুপে বেরিয়ে এলাম নিশুতি বাগানে, ফাটা বেদিটার উপরে বসতে গিয়ে দেখি, সেই ছুরিটা মুখ ফিরিয়ে আমার বুকেও বিঁধে বসে আছে। ঘাতকের স্পর্ধা তখন কই আর, চোরের মতন বেরিয়ে এসেছিলাম, চোরের মতোই ফিরে গেলাম।
হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে আস্তে আস্তে বললাম, “মা!” সেই দেহটি কেঁপে উঠল, একটি মুখ বস্ত্রাবৃত, বলছিল, “আর কেন। আমাকে মা ডাকিস না। যা। তোর মা নেই।
মা নেই? মৃত মুখের অভিশাপ যে কঠিন, ওই একটা কথা আমার দিগ্বিদিক লুপ্ত করে দিল, মা নেই। ছিল না? ছিল। এখন নেই। আর থাকবে না। একটা অস্তিত্ব মুছে গেল, মিথ্যে হয়ে গেল সেই ছেলেবেলার চাঁছিমুছি, জিভের ডগায় তুলে ধরা ছেঁচা পানে ঠোঁট রাঙানো দিনগুলো, যেহেতু মা বলে কেউ রইল না। সেই তখনকার কোলের কাছ ঘেঁষে গুটিসুটি হয়ে শোয়া, মিথ্যে, মিথ্যে সব, মানে মিথ্যে হয়ে গেল। যা মৃত, মিথ্যে তাই তো। অথবা মিথ্যে বলেই মৃত।
মা, তবু বেহায়ার মতো “মা” বলেই ডাকছি, তোমাকে সেদিন নৃশংসের মতো আঘাত করেছি ঠিক, কিন্তু তুমি যা দেখেছিলে তার সম্পূর্ণ অর্থ জানতে না। আগেই রাগে অন্ধপ্ৰায় হয়ে গেলে, বলার সুযোগই বা পেলাম কই। আর, বুঝিয়ে বলাও হয়তো যেত না।
ওই ঘটনা হয়তো আকস্মিক, কেন না এক-একটা মুহূর্তে আমরা মানুষেরা বিচার বিবেচনা রহিত, শুধুই প্রবণতার বশে চালিত—সব ঠিক। তবু আমার অবচেতনায় যে প্রতিশোধস্পৃহা ছিল, তাকেও মুক্তি দিলাম—হতে তো পারে। মুক্তি দিলাম, মুক্ত হলাম—আমি নিজে; তোমাকেও মুক্ত করলাম। হ্যাঁ মা, তোমাকেও। ও-বাড়িতে আমরা তিনজন অন্নদাস বৈ তো নই! আমরা স্রোতের শ্যাওলা, ভাসতে এসেছি। বাবা গোমস্তা কি ম্যানেজার, আর তুমি? লিখতে বাধা নেই, তুমি দাসী, সম্ভ্রান্ত হলেও দাসীই তো! প্রধানা তত্ত্বাবধায়িকা। আর আমি? আমার কথা। আমি লজ্জায়, গ্লানিতে মাখামাখি একটা প্রাণী, বাইরে মানিয়ে নিয়েছি খানিকটা হয়তো, কিন্তু ভিতরে ভিতরে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে আসে, মনের উঁচু-নিচু নানা স্তরে একটা ছদ্মবেশ পরা আক্রোশ ফুঁসতে থাকে। সেই অবস্থায় ওই ব্যাপারটা। সেটা বয়সের ধর্মবেশে হঠকারী একটা কর্ম হয়তো, কিন্তু যেই আমি নিচু হয়ে তাকে ওই মেয়েটিকে…আমার ঘুষ-ঘুষে জ্বর যেন ঘাম দিয়ে ছাড়তে থাকল। আরোগ্যের কত রাস্তা আছে তুমি জানো না। প্রতিশোধ, প্রতিদান, একে যা-খুশি-তাই বলো, কিন্তু ওই মেয়ে, ও সেই মুহূর্তে ওই বাড়ির প্রতীক হয়ে গেল, আমি যে তার উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারলাম, সে কেবল আমার শরীরের কোনও ব্যাপার নয়। বলেছি তো, মনের দিক থেকেও আমার মুক্তি। আমার, আমাদের। আমি আর দাস রইলাম না, সুতরাং তুমিও রইলে না দাসী। তার ঘুঁটেকুড়ুনি মায়ের দুঃখ একটি ছেলে ঘোচাল—সেই পুরনো রূপকথাটা। লেখা হয়ে গেল, নতুন ধরনে মা, তুমি তার মানে বুঝলে না?
৩১
শ্রীচরণেষু—শ্রীচরণেষু শ্রীচরণেষু। আজ সকাল থেকে এই পর্যন্ত অনেক কাটাকুটি করে, একটা কথাই খালি লিখতে পারলাম “শ্রীচরণেষু।” মানে কি কথাটার, শ্রীচরণেষু মানে কি প্রণাম, শ্রীচরণেষু মানে কি ক্ষমা-প্রার্থনা? না, না, এই শেষ সময়ে বানানো একটা মিথ্যে দিয়ে নিজেকে, তোমাকে, আর আমার এই স্বীকারোক্তি যে ক’জন শুনছে তাদের সবাইকে ভোলাব না।
প্রণামের কোনও বিকল্প হয় না, কাগজে-কলমে শতকোটি নিবেদন-মিদং লিখলেও না। প্রণাম একটি আনত, বিনম্ৰ ভঙ্গি, সর্বাঙ্গ দিয়ে যা তৈরি করতে হয়, সে ভঙ্গি, সৰ্বস্ব দিয়ে মিলিয়ে উচ্চারিত এক নির্বাক ভাষা, লিখতে হয় নিজেকে হটিয়ে দিয়ে, কথা নেই তাতেই অনেক বলাবলি, যার পড়বার সে ঠিক পড়ে নেবে, সে তুলেও নেবে সস্নেহে। আশীর্বাদ আর প্রণাম মিলে যাচ্ছে একটি মুহূর্তে, এর চেয়ে পবিত্র দৃশ্য হয় না।
কুৎসিত-কুরূপ যাই হোক, যে-মুহূর্তে কেউ প্রণাম করতে পারল, তার মানে নিরভিমান, আত্মবিস্মৃত সমর্পণ, সেই মুহূর্তেই সে সুন্দর হয়ে গেল। পঞ্চভূতে তৈরি শরীর প্রণামের চেয়ে প্রয়োজনীয় কাজ আরও করে থাকে, করতে হয় তাকে; কিন্তু প্রণামের চেয়ে সুন্দর কোনও চিত্র শরীর দিয়ে রচনা করা যায় না।
কারও পদতলে অথবা কোনও প্রতিমার বেদিমূলে উজাড় করে দেওয়া—”শ্রীচরণেষু” কি তার বিকল্প হতে পারে? ও তো আচরিত একটা পাঠ, তৈরি একটা গৎ। তাকেই শিরোধার্য করে পাতার পর পাতা ভরছি বলেই কি ঘুরে মরছি, গোলক-ধাঁধার ভিতরে আর মাঝে মাঝে আটকে যাচ্ছি, যেমন আটকে গেলাম এই ক্ষণে, আমাদের দু’জনের সম্পর্কের একটা চরম সংকটের সময়ে?
যেন একটা দেওয়াল উঠে গেছে। কিংবা তার চেয়েও বেশি—যেন কোনও গিরি-শ্রেণী, আন্দোলিত প্রান্তরের বক্ষ ভেদ করে যাদের তরঙ্গিত চলে যেতে দেখি, নতুবা তার স্থির, প্রকৃতপক্ষে নড়ে না, পথও দেয় না, দুই দিগন্তের মধ্যে পাহাড় এক-একটা আড়াল, এক-একটা আড়ি।
সেই পাহাড়ের তলদেশে দাঁড়িয়ে আছি। উপর দিকে চাইছি। ডাকছি, “মা, ও মা! “ তুমি সাড়া দিচ্ছ না। দূর নক্ষত্রকে ডাকলে সেও ফিরে একটু ঝিকিমিকি ইশারা জানায়। তোমার কাছ থেকে আজ তা-ও পাব না।
তবে এই লেখা-টেখা থাক, আরও ডাকি, ডাকি চিৎকার করে—প্রাণভয়ে? না, প্ৰাণ নিয়ে ভয়-ডর আমার আর বিশেষ নেই, ও তো যাবেই, কিন্তু কী থাকবে, কী রেখে যেতে পারব, একটি পাপীতাপিত কণ্ঠের মা ডাক ছাড়া?
তাই ডাকি। কতকাল ডাকিনি-তোমার জীবনের শেষ পরিচ্ছেদে মুখ খুলে আর তো ডাকতাম না! তার শাস্তি এই লেখা।—লিখিয়ে নিলে। সেই লেখাও না-হয় উড়ে যাক, শুধু ডাকটা থাক। আমার প্রায়শ্চিত্ত। বারে বারে বোধ করছি, বিশেষ করে এই লেখাটা ধরার পরে, লেখার সবচেয়ে সামান্যতা—লেখাটা হয় কালি দিয়ে। তা-ই সে থেবড়ে ছড়িয়ে যায়, ফিকে হয়, কিংবা মুছে আসে। চোখের সাদা জল দিয়ে যদি লেখা যেত, সে-লেখা থাকত। শুধু তাই নয়, সেই জলের ধারা নিজের পথ নিজে খুঁজে নিত। আমি আজ পথ দেখতে পাচ্ছি না, ঝাপসা, সব ঝাপসা, অথচ এটা কুয়াশার কাল নয়, আঁধি, তবে কি এটা আঁধি? সেই সে ধূলিঝড় উঠল দু’জনের মধ্যে, তারপর থেকে নিরন্তর তা কি বইতেই থাকল?
মা আর ছেলে। এই পৃথিবীতে যে সম্পর্ক প্রথমতম। তাকে নিহত করে কত দিন ছুরিটা ফের খাপে পুরে নির্বিকার ঘুরলাম। দূর থেকে দূরে চলে এসেছিলাম, তাই সেবার কালীপূজায়—
.
রজনীগন্ধা বলল, “এ কী, তুমি প্রণাম করলে না?”
আমরা সবাই মিলে মণ্ডপে দাঁড়িয়েছিলাম। খুব ঘুরেছিলাম, তার আগে দেওয়ালির সন্ধ্যায়। অনেক আতশবাজি ঝলসে গেল আকাশে, অনেক হাউই তারাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে ছুটে গেল। পটকা ফাটছিল ফটাফট, কত ফুলঝুরি চোখ ধাঁধানো আলো ছড়িয়ে ফুরিয়ে গেল।
রজনীগন্ধা বলল, –ওকে তখন আমি ওই ভারী গহনার মতো নামেই ডাকতাম, কারণ ডাকনাম কিশমিশটা খুব খেলো শোনাত—”যতক্ষণ জ্বলে, ফুলঝুরিগুলো ততক্ষণই ভালো। নইলে ওদের বড় কষ্ট, না?’
“কষ্ট কেন?”
“দেখছ না? শুধু ছাই আর শক্ত, সিঁটিয়ে যাওয়া একটা শিকই থাকে যে। তখন খানিকক্ষণ শুধু ছ্যাঁকা দিতে পারে, তারপর?—একেবারে ঠান্ডা, শীতল।”
“রজনী”, আমি বললাম, “রজনী, তুমি বড় বেশি ভাবো।”
“রজনী বোলো না,” সে বলল, “ডাকতে হয় বরং পুরো নামেই ডেকো। রজনী শুনলে কেমন ভয় করে।”
“ভয় কেন?”
“বঙ্কিমচন্দ্রের বই—মনে নেই? সেই রজনী অন্ধ ছিল। আমি—আমিও তো অন্ধ হয়ে যাচ্ছি।”
বলতে পারতাম, তোমার প্রকৃত দৃষ্টি খুলে যাচ্ছে। বললে কুরুচিপূর্ণ ঠাট্টার মতো শোনাত। তাই কিছু না বলে এগিয়ে গেলাম একটা মণ্ডপের দিকে। সেখানে সবে জোর ঢাকের বাজনা শুরু হয়েছিল। বুলা আর বাঁশিও ছিল, একটু দূরে। বুলা একটা ভ্রূভঙ্গি করে কানে হাত দিল। দূর থেকে একটু জিভ বের করে আমাদের ডাকছিলও সে। কাছে যেতে বুলা বলল, “এই দ্যাখ্ আমিও মা-কালী হতে পারি। জিভ্ বের করাটা ঠিক তেমনি হয়নি, বল?
“হয়েছে।” বলেই পাশ কাটতে চাইছিলাম, বুলা আমার জামার আস্তিন ধরে টানল আবার। বলল, “দাঁড়া! হয়েছে বটে, হয়নিও আবার। মহাদেব কোথায়? নেই তো!” বাঁশি ছিল পাশে, সে-করুণ চোখে চাইছিল। বুলা হুকুম করলে ও যেন শুয়ে-পড়ে তখনই, তার পায়ের তলায় শিব হয়ে যায়।
বুলা বলল, “ভাঁওতা। আসলে পুরুষেরাই মেয়েদের রেখেছে পায়ের নীচে, এই কালী প্রতিমায় সেটাকেই উল্টে দিয়ে মেয়েদের ধাপ্পা দিচ্ছে।”
“ধাপ্পা নয়,” আমি আস্তে আস্তে বললাম, “সুন্দর একটি কল্পনা, চমৎকার একটা উপহার। পুরুষেরা আজ অবধি মেয়েদের যত উপহার দিয়েছে এর চেয়ে ভালো তার একটাও নয়। এ উপহার সম্পূর্ণ বশ্যতার।” রজনীগন্ধার চোখে চোখ রেখে শেষ কথা কয়টি বললাম।
তারও খানিক পরে, যখন চলে আসছি, রজনী বলল, “এ কী, তুমি প্রণাম করলে না?”
“প্রণাম আমি করি না, কাউকেই না।” খুব তুখোড় একটা ঝোঁক দিয়ে বললাম; ওদের কাছে আমি যেন আরও, শহুরে বলে নিজেকে চালাতে চাইছিলাম—দ্যাখো দ্যাখো, আমি ডিম-টিম ফাটিয়ে বেরিয়ে এসেছি, কোনও গেঁয়ো সংস্কার আমার নেই—ভাবখানা এই
অবাক হল রজনী। আহত গলায় বলল, “মাসিমাকেও না? “
তখন তো তোমার-আমার মধ্যে সেই দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে, অনায়াসেই তাই বলে দিলাম, “ওই মাঝে মাঝে ঠেকাই। নেহাৎ ঠেকাতে হয় তাই! “
“ছি”, ওর চোখ দু’টিকে আরও আয়ত করে রজনীগন্ধা বলল, “প্রণাম করতে হয়। মন দিয়ে প্রাণ দিয়ে। তাতে দেখবে নিজেরই ভাল লাগবে।”
“ওই মাটির মূর্তিকে? ফুঃ”, বলে সব কিছু উড়িয়ে দেবার নেশার ঘোরে সেদিন সরে এসেছি।
.
সেই মূঢ়তার, সেই সীমাহীন অশ্রদ্ধার প্রায়শ্চিত্ত তখনকার মতো তোলা রইল, কিন্তু এড়ানো গেল না তো। সময় নামে যে মন্ত্র, তার দাঁতে সব অহঙ্কার-অস্বীকার একটু একটু করে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। সময় মন্দিরে মন্দিরে আমাকে দিয়ে মাথা ঠুকিয়েও নিয়েছে, নিষ্ঠুর প্রতিশোধ। কত তীর্থের চত্বরে আমি পরবর্তী কালে কপালে সিঁদুর লেপেছি, পবিত্র গাভীর লেজ ধরে, ভক্তিভরে, পাণ্ডারা যেমন বলে দিয়েছে, সেই মতো পরিক্রমা করেছি, আরও শত শত ভক্ত নরনারীর সঙ্গে, তাদের মধ্যে মিলে গিয়ে ভক্তি, বিশ্বাস মুক্তি এই সব খুঁজেছি। খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। কিছুই পাইনি কি? কিছু পেয়েছি নিশ্চয়ই। আর্ত প্রার্থনায় আমার পাপবোধ অন্তত সাময়িকভাবে হালকা হয়ে গেছে!
ঈশ্বরের কথা থাক। মা, সবচেয়ে বড় শোধ নিয়েছ তুমি নিজে। আজ বেশ কয়েক বছর ধরে যে-কোনও উৎসবের দিনে–নববর্ষ, বিজয়া কি জন্ম দিন—সকাল থেকে কেবলই মনে পড়ে কত দিন তোমাকে প্রণাম করা হয়নি। কোনও দিন আর হবেও না, তোমাকে এ-জীবনে প্রণাম করতে পারব না। সামান্য ক্ষতি, কিন্তু ওই অনুভূতিটাই ছড়িয়ে যায় ধীরে ধীরে, ভিতরটা ছেয়ে আসে।
সব চেয়ে কষ্ট হয় যে-কোনও ছুটির দিনে, যেদিন কেউ আসে না। অপেক্ষা করে থাকি। আসে না। টের পাই, আমি নিঃসঙ্গ। আমাকে কারও প্রয়োজন নেই, ওরা আসবে না। যাদের পরিত্যাগ করেছিলাম আমি, তারাও আমাকে ত্যাগ করেছে একে একে। বিশেষ করে এক-একটা উৎসবের দিনে মনের ভিতরে এই সব ঘটে।
আর প্রণাম, সে আরও যন্ত্রণা! কেউ পায়ের কাছে মাথা নিচু করলেই গুটিয়ে যাই, ভাবি শুষ্ক নিয়মরক্ষা ঝরছে মাত্র, এর ভিতরে প্রাণ নেই। আমার গুরুজনদের আমি প্রণামের নামে যে-ছলনা করতাম, ফিরে পাচ্ছি সেই ছলনা ৷
আর? সেই ভাবনাটা আরও ভয়ের। ধরো দিনটা কোনও বিজয়া। স্নেহের কেউ প্ৰণাম করতে এলে চমকেও উঠি। ভাবি, এই বছরও পেলাম, কিন্তু আসছে বছর? তা-ও হয়তো পাব? তার পর? কোনও একটা বছর নিশ্চয়ই আসবে, যখন পাব না, কেন না, আমি থাকব না। অথচ তখনও বিজয়ার পর বিজয়া আসবে, শুধু একটি প্রণাম আর আশীর্বাদের পাট উঠে যাবে।
শুধু কি বিজয়া? কোন্ দোলের দিনে কাকে রঙ দিতাম, আর দিই না, কোন্ পার্বণে কার হাতে পিঠে খেতাম, আর খাই না, এক-একটা জানালা দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছি—জীবন মানে এই তো!
সমুদ্রের ধারে সতত যে হাওয়া বয়, বাতাসও সেখানে নির্ঝর, লিখতে বসে নিয়ত তার শন্ শন্ শুনি। কিন্তু কোনও কোনও দিন শুনিও না। সমুদ্রের হাওয়াও যেমন কখনও-কখনও পড়ে যায়! তখন লেখা আসে না। অন্তত খেই থাকে না।
যেমন আজ কিছুতেই ভেবে ঠিক করে উঠতে পারছি না, কোন কথাটা আগে লিখব । বুলা-বাঁশি-রজনী আর আমি এই ক’জনে মিলে যে চৌকো ছক তৈরি হয়ে যাচ্ছিল, সেই কথাটা? অথবা সুধীরমামা যেদিন এসেছিলেন, সেই দিনটি?
সত্যিই উনি এসেছিলেন একদিন। বলেছিলেন ; আসবেন। কথাও রাখলেন। বাঁশি উপরের ঘরে এসে খবর দিল “তোমাদের কে একজন আত্মীয় এসেছেন নীচে, ডাকছেন তোমাকে।” গেলাম। চৌকাঠে-রাখা জুতোর সাইজ দেখে কে এসেছেন বুঝলাম। তখনই ঢুকিনি কিন্তু। কারণ? এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই, ওই ঘটনাটার পর চট করে তোমার সামনে যেতে পারতাম না আমি, ওর পরেও সহজ হওয়াটা সহজ ছিল না।
তোমার মুখের একাংশ ঢাকা। কানে এল, “তুমি এখানে যে আছ জানতাম। এত দিনে বুঝি খবর নিতে এলে? ছাড়া পেলে ?”
“ছাড়া? না আনু, ছাড়া আমি এখনও পাইনি। ভীষণভাবে বাঁধা পড়ে আছি। আজ আর তোমাকে সে-সব বলব না। তুমি—তোমরা কেমন আছ বলো।”
“দেখছ তো” তুমি বললে, মাটি থেকে একবারও চোখ না তুলে।
আলাপ জমছিল না, ছেঁড়া সুতোর দু টুকরো দু’দিকে উড়ে এসে আর জুড়ছিল না। সুধীরমামা বললেন “চলি”, বেশ হঠাৎই বললেন, আর তুমি শুধু শুকনো একটা “এসো।”
“আসব। আমি আরও একদিন এসেছিলাম কিন্তু। প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা হল। উনি বলেননি?”
বোধহয় ভুলে গেছেন।
.
বাইরে এসে সুধীরমামা আমাকে দেখতে পেলেন। ডেকেও নিলেন—”আয়। একটু এগিয়ে দিবি।”
গেটের বাইরে এসে উনি হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে শক্ত করে ধরলেন আমার একটা হাত।—”একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। মিথ্যে বলবি না। তুই কি আনুকে খুব দুঃখ দিচ্ছিস?”
মাথা নিচু করে রইলাম। দুঃখ? উনি জানেন না। দুঃখ বলতে কতটুকু আর বোঝায়। আমি তো নিহত করেছি তোমাকে।
সুধীরমামা বললেন, “ছি, মাকে দুঃখ দিতে নেই।” যেতে যেতেই বললেন, “কথাটা কেন মনে হল ভাবছিস? মনে হল আনুকে দেখে। ওর চেহারায়, ভাবে-ভঙ্গিতে। তা-ছাড়া ওর একটা কথা আমাকে চমকে দিল। বলল, সব তো হয়ে গেল সুধীরদা, এখন শুধু চলে যেতে চাই। বলল কেন?”
শুকনো গলায় বললাম, “আপনিই বলুন না, কেন।”
“বললাম তো। খুব সম্ভব তোর জন্যে। চাপা মেয়ে তো, বরাবরই। ভেঙে বলল না।”
তেতো গলায় বললাম, “অন্য কারণও তো থাকতে পারে। সে-সব ভাবছেন না কেন। আমরা এই বাড়িটায় পড়ে আছি, বাবা সেই অসুখটার পর আর সেরেই উঠলেন না।” আসলে আমার মনে তখন একটা রাসায়নিক প্রক্রিয়া ঘটছিল, আমার অপরাধবোধ বদলে রঙ নিচ্ছিল রাগের, হিংসার—এই সব ঘটে। তাই সহ্য করতে পারছিলাম না ওই লোকটিকে। মা, সুধীরমামা, সেই সুধীরমামাও তখন হয়ে গিয়েছিল স্রেফ “লোকটি”, আমাদের সংসারে যার অনাহূত ছায়া বারে বারে পড়ে, ওঁর গায়ে-পড়া উপদেশ, নাক গলানো এ সব কিছুই বরদাস্ত করতে পারছি না, উনি আবার এলেন কেন।
ওঁর চোখে ধরা পড়ার ভয়, আমিই যে ঘাতক, তোমার হত্যাকারী, উনি টের পেলেন কী-করে, নিজে থেকেই পেলেন, না তুমি বলে দিলে, মা, ছি! তাই আমি কঠিন হয়ে উঠেছিলাম।
“অন্য কারণও থাকতে পারে, ঠিক।” গলা সাফ করে সুধীরমামা বললেন, “তবে সে-সব কারণের ছাপ আলাদা, আমি জানি। তাছাড়া আনুকে তো চিনি, সেই কবে থেকে–“
“থাক, কবে থেকে চেনেন সেসব শুনতে চাই না, জেনে দরকার নেই আমার”, ভীষণ চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি, তখন স্নায়ু-রোগীর মতো কাঁপছিলাম, নিজের স্বর চিনতে পারছিলাম না। একটা অতিকায় গাছের শাখাপ্রশাখার বিস্তারের নীচে নিহিত হয়ে ছিলাম, একটু দূরে পুকুরে একটা শালুক ফুল তখনও দেখা যায়, তারই একটাকে লক্ষ্য করে একটা ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে আমি ছুঁড়লাম। ছপ করে শব্দ হল, কাকে আঘাত করলাম?
সুধীরমামা বিবর্ণ হয়ে গেলেন, অস্পষ্ট আলোতেও আমার মুখটাকে পড়তে চেষ্টা করেছিলেন ঝুঁকে পড়ে, খুব লম্বা মানুষ তো, ঝুঁকে পড়ার জন্যে এখন হাতের লাঠিটার সমান, কিন্তু আমি দমছি না, দম বন্ধ করে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি—মনে মনে একটা পার্ট পড়ে নিচ্ছি—’পালান সুধীরমামা, পালান, পালান, আমি আরও ঢিল ছুঁড়ব কিন্তু, আমি একজন হত্যাকারী, আমার চোখে ছুরি ঝলসাচ্ছে দেখতে পাচ্ছেন না? পালান।’
সত্যিই খুন চেপেছিল আমার মাথায় সেই সময়ে। একটা পাপ করে ফেলার পর আর পাপের সীমাবোধ থাকে না। একটা সম্পর্ক, তোমাকে দিয়ে নষ্ট করেছিলাম বলে বাধা-বাঁধ কিচ্ছু আর ছিল না; কালাপাহাড়ি রক্ত টগবগ করছিল রগে-রগে—সব নষ্ট করব এই খ্যাপামি। কোনও সম্পর্ক মানব না।
হাতের লাঠিটা, আগে আগে রাস্তা দেখাল সুধীরমামা তার পিছে পিছে যাচ্ছেন, যান না। আমি ভাবব না। যাচ্ছেন—যাওয়াটা যদি ঠিক হয়, তবে আবার আসবেন, যাওয়া-আসা নিয়েই তো সব। শেষ যাওয়া কিংবা শেষবারের মতো আসা বলে কিছু যদি সত্যিই থাকত, তবে পৃথিবী, পৃথিবীর কক্ষপথ, ইত্যাদির আকার বৃত্ত বা বৃত্তবৎ হত না।
আমি আস্তে আস্তে সেই পুকুরের জলের দিকে নামতে থাকলাম। হাত ধোব। ধুয়ে ফেলব। কী? নিহত প্রীতি স্মৃতির রক্ত নাকি? আমি তখনও কাঁপছিলাম।
.
রজনী বলল, “সে কি আমার জন্যে?”
বাড়ি ফিরে আসার পরই সে-আমাকে ডেকে নিয়েছিল একটি নিরালা কোণে। গিয়েছিলাম। মা, সঙ্কোচ রাখিনি, ভয়টয়ও তখন আমার বিশেষ ছিল না, তুমি তো জেনেই গেছ, সুতরাং আমার আর ভয় কী; আর বাঁশি, ওর দাদা বাঁশি? তাকে আবার পরোয়া কে করে, সে নিজেই তো সবার কাছে নত হয়ে আছে।
রজনী বলল, “মাসিমা এখান থেকে চলে যেতে চাইছেন—
“চাইছেন নাকি?”
আমার নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সে বুঝি আহত হল।—”তোমার মা, আর তুমি জানো না।“
“মার সব কথাই ছেলে জানবে, এমন কোনও কথা আছে নাকি?”
“উনি কিন্তু ছেলের সব কথা জানেন।” রজনী বলল স্থির স্বরে। “তাই তো জিজ্ঞেস করছি, যেতে যে চাইছেন সে আমার জন্যেই কি?”
“জানি না। কিন্তু যেতে চান তোমাকে বলল কে।”
“দাদা। দাদাকে উনি জিজ্ঞেস করছিলেন সে ওঁকে তোমাদের দেশের বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারবে কিনা। ভেবে দ্যাখো, ওঁকে পৌঁছে দেবে দাদা? যে একা-একা রেলেই চড়তে পারে না, সে নাকি হবে চলনদার!”
“রেলে চড়তে পারে না, কিন্তু বাঁশি ওদিকে বুলাকে খুব ট্যাক্সিতে ঘোরাতে পারে!” আমাদের আলাপে ঠাট্টার ছোঁয়া লাগতে বললাম!
“সে-ও তোমারই কীর্তি। তুমিই ভিড়িয়েছ। দাদার সর্বনাশ করছ। ছিল থিয়েটারের নেশা নিয়ে, এখন ছেলে হওয়ার পাগলামি ওকে পেয়ে বসেছে। টাকা পেয়ে বুলা দাদার পার্টটা দাদাকে ছেড়ে দিয়েছিল তো, দাদা নাকি পার্টটা আবার বুলাকেই ফিরিয়ে দেবে। পার্টে ওর আর দরকার নেই বলছে, যদি বুলাকে পায়।”
“পেয়েছে তো।”
“ওকে পাওয়া বলে না। বুলা শুধু ওকে নিয়ে খেলছে।”
“যেমন আমাকে নিয়ে তুমি?”
রজনী হাসল না—”কিংবা তুমি আমাকে নিয়ে। তা-ও তো হতে পারে? তুমি–তুমিও হয়তো বুলাকেই—”
আমি ওর মুখে হাত চাপা দিলাম। হাত সরিয়ে দিল সে, কিন্তু ধাক্কা দিয়ে নয়, সন্তর্পণে দোল দেওয়ার ধরনে। অন্ধকার জমছিল।
রজনী বলল, “এই কোণটাতে তোমাকে ডেকে আনি কেন জানো?”
“আন্দাজ করতে পারি।”
লাজুক গলায় সে বলল, “না, না। তুমি যা ভাবছ তা নয়। তোমার বোধটোধ বলে কিচ্ছু নেই। এই অনুভূতি নিয়ে তুমি আবার লেখক হবে! শোনো, এখানে আসি এই জন্যে যে, এই কোণটাতে আমরা দু’জনে সমান হই।”
তবু চেয়েছিলাম। রজনী বলল, “আমার দৃষ্টি ক্ষীণ, অন্যখানে যেখানে আলো, সেখানেও ভালো করে দেখতে পাই না। অথচ আর সবাই পায়, তুমি পাও। এখানে আলো নেই, তাই সমান। আমি তো দেখতে পাচ্ছি না, তুমিও না।”
সে থেমেছিল। আর-একটু সরে আসবে বলেই বুঝি চুপ করল।—”দ্যাখ, মাসিমা সব জানেন। আমি বরং হস্টেলেই ফিরে যাই। তুমি ওঁকে কষ্ট দিও না।”
ভাঙা কর্কশ গলায় বলে উঠলাম, “কষ্ট? কাউকে কষ্ট দেব না, আমি একাই সব কষ্ট পাব, এমন কোনও কড়ার করে তো আসিনি?” বলেই শিউরে উঠলাম, নিজের স্বরের রোমশ নিষ্ঠুরতায় এই মাকড়সার জালে ঘেরা অন্ধকার কোণে আরও একটি কোমল সম্পর্কের টুটি টিপে ধরব নাকি। কত হত্যাকাণ্ড এই দুটি হাত দিয়ে ঘটবে, হে ঈশ্বর!
“তুমি ঠিক বলছ না”, সে আস্তে আস্তে বলল, “সবাই আপনার কষ্টটাই বড় করে দ্যাখে, অপরেরটা দেখতে পায় না। এই যেমন—” যেন অনেক যন্ত্রণা চাপা দিতে দিতে সে বলল, “অন্ধদের কত স্তোক দেয় লোকে। তাদের চোখের আলো নাকি বাইরে থেকে ভেতর দিকে। অন্তরটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, তারা উঠে গেছে ওপরে, এইসব আর কী। সব বাজে কথা, কথার চালাকি। অন্ধ হইনি, তবু এখনই বুঝতে পারি, তাদের কী কষ্ট, কী যন্ত্রণা।”
আমি এখন শুধু দুটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওর চোখের পাতা স্পর্শ করে কষ্টটা অনুভব করতে চেষ্টা করছি; মা, বিশ্বাস করো, তার চেয়ে গর্হিত আর কিছু না। আর এতদিন পরে, আমিও যখন ছ’মাস অন্তর চশমার পাওয়ার বাড়িয়েই চলেছি, রক্তে চিনির অনুপাত দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করছে ধীরে ধীরে, তখন আমিও বুঝতে পেরেছি, চোখের আলোর ক্ষতিপূরণ কোনও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে হয় না। বাইরের জগৎকে দেখার তৃষ্ণা চক্ষুহারাদের যায় না। তারা বরং অভ্যাস করে, নকল করে দৃশ্য জগতের চলাফেরার, সকল ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিকে সূচিমুখ করে ক্ষতবিক্ষত হয়। যেমন, জরাগ্রস্ত অক্ষমেরাও কি কখনও উপভোগের সাধে জলাঞ্জলি দেয়? দেয় না।
.
হঠাৎ শিউরে উঠে রজনী চাপা গলায় “ওই শোন।”
মৃদু অথচ স্পষ্ট একটি কণ্ঠস্বর সত্যিই ভেসে এসেছিল, সে কি স্বগত কোনও উচ্চারণ, অথবা আর্ত প্রার্থনা কোনও?
“সন্ধ্যা হল, এখন আমাকে হাঁসের মতো ডেকে নাও। সারা দিন সাঁতার দিয়েছি, আর পারি না, এখন পাড়ে তোলো।”
কে বলছিল, কাকে? আরও সন্নিহিত হয়ে এল রজনী, ফিসফিস করে বলল, পাচ্ছ? মাসিমা।”
“শুনতে পেয়েছিলাম। কোথায় যেতে চাও তুমি মা, সাঁতারে ক্লান্ত; উঠতে চাও কোন্ পাড়ে? ভয় করছিল, যাকে মৃত বলে জানি, তাকে জীবিত হয়ে উঠতে দেখলে যেমন ভয় করি। কঠোর হয়ে তীব্রস্বরে তিরস্কার করেছিলে যেদিন, সেদিন তো ভয় পাইনি, তবে তখন পেলাম কেন। কথাগুলো কান্নার মতো, কান্না আবার মন্ত্রের মতো লাগছিল বলে? ওই রোমাঞ্চিত কোণে সেই ক্ষণে আমারও চোখ ঝাপসা। আমি আর রজনীগন্ধা সত্যিই সমান হয়ে গিয়েছি।
৩২
এই সময়টাতেই বাবার অসুখ আরও বাড়ল। অনেক গাছ-গাছড়া আর পুরনো-টিনের কৌটো জড়ো করে রেখেছিলেন তিনি, তার মধ্যেই বসে থাকতেন, কী-সব লিখতেন, কিন্তু দেখতে দিতেন না, নতুন পালা-টালা? বাবা তাড়াতাড়ি সব লুকিয়ে ফেলে বলতেন, “না। পালা? ওসব আমি আর লিখব না। ওগুলো ছিল পরের জন্যে। আর এগুলো! আমার নিজের জন্যে। এখন থেকে যা লিখব, সব আঁকিবুকি, কিন্তু সবই আমার।”
স্বদেশি শিল্পের পুনরুজ্জীবন নিয়ে একটা প্রবন্ধও ফেঁদেছিলেন, সেটাও আগলে রাখতেন, দেখতে দিতেন না। আমি জেনেছিলাম ওটাও ফাঁকি। ফাঁকি ওই গাছগাছড়া, টিনের কৌটোগুলো আসলে দেওয়াল-বাবা ক্রমশ নিজের জন্যে একটা আড়াল তৈরি করে নিচ্ছেন।
সেই লেখা আমি পরে পড়েছি। মা, তুমি কোথাও যেতে চেয়েছিলে, কিন্তু পারোনি; বাবা কিন্তু চলে গিয়েছিলেন অনেক দূর। কোথায় পৌঁছেছিলেন, ওই নিজের লেখাগুলোতে তার আভাস ছিল। তার কিছু তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি :
আনু একটা ভুল করিতেছে। আমার প্রতি, নিজের প্রতি, সকলের প্রতি। তার ধারণা, আমি বুঝি সুধীরবাবুর বিষয়ে এখনও বিদ্বেষ পোষণ করি। তাই সেদিন সুধীরবাবু যখন আসিলেন, আমার সহিত দেখা করিতে দিল না। ও জানে না, ঈর্ষা-বিদ্বেষের যে স্যাঁতসেঁতে জমি, সেখানকার বাস আমি কবে তুলিয়া লইয়াছি। আছি কোথায়? সেইটাই তো বুঝিতে পারি না। একবার ভাবি, আমার এই নূতন বাসগৃহের নাম দিই ‘আনন্দ’। হ্যাঁ, আনন্দও একটা বসবাসের স্থান, তবে অতি অল্পকাল হইল সেটা জানিয়াছি।
“এই একটা মস্ত অসুবিধা—জানিতে জানিতে, জায়গাটা খুঁজিয়া পাইতে বড় দেরি হইয়া যায়। মধ্য বয়সে সবে থিয়েটারের সংস্পর্শে যখন আসিয়াছি, তখন সব্যসাচীবাবু একদিন বলিয়াছিলেন, “সুরাপানের দোষ কী, জানো হে? পর পর অনেকগুলি পে না চড়ালেই জমে না, জমি তৈয়ারি হয় না—ওই মুশকিল।’—তাঁহার সেই কথাটা আজ এই শেষ বয়সে অন্য কোণ হইতে দেখিতেছি। দেখিতেছি যে, অনেকগুলি বৎসর পার করিয়া না দিলে যথার্থ কোনও উপলব্ধি হয় নানা আনন্দের, না বৃহত্তর কোনও সত্যের। আমার তো প্রায় জীবনকালটাই বহিয়া গেল।
“তা যাক। কিছুটা যে আভাস পাইয়াছি এই ঢের। আনু পায় নাই, তাহার সুধীর দাদাও না। ভদ্রলোক সেদিন সামনে আসিলেন না বটে, আগে যেদিন আসিয়াছিলেন সেদিন আমার দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর দেখিয়া বোধহয় রীতিমতো বিচলিত হইয়া পড়েন। সেদিন দেখা হইয়াছিল বাগানে, পত্রপল্লব আর সূর্যরশ্মি মিলিয়া যেখানে অপার্থিব এক মমতায় ঘন হইয়া রহিয়াছে। তিনি কথায় কথায় হঠাৎ বলিয়া ফেলিলেন তাঁর প্রতি আমার মনোভাব তেমনই বিরূপ রহিয়াছে কি না। আমি হাসিলাম। সেই হাসির তিনি অর্থ বুঝিলেন না। তখন হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল ‘রাজর্ষি’ নামে একটি উপাখ্যানের কথা। বলিলাম ‘অরণ্যের একটা মহান মায়া আছে, জানেন না? মায়াবী পরিবেশে ভ্রাতৃহত্যায় কৃতসংকল্প নক্ষত্র রায়ের হাত হইতেও ছুরিকা খসিয়া পড়িয়া যায়।” তিনি তবু বুঝিলেন না, বলিলেন ‘এই বাগানটা কি একটা অরণ্য?’ হাসিয়া বলিলাম ‘বাগান নহে, অরণ্য হইল এই বয়স, যাহা স্বভাবকে গভীরতা দেয়। পরিবেশের মতো বয়সেরও আবেশ আছে, হাত হইতে বিদ্বেষের ছুরি সেখানেও খসিয়া পড়ে।’ সুধীরবাবু থতমত খাইয়া বলিলেন, “তার মানে আপনার মধ্যে এখন ক্ষমা-ধর্মই প্রবল হইয়াছে?’ বলিলাম ‘ক্ষমা? সুধীরবাবু, কে কাহাকে ক্ষমা করে। ওটা অহমিকা আর অভিমান বৈ তো কিছু না! যাহাকে ক্ষমা করা হয় তাহার কী উপকার হয় জানি না, তবে ক্ষমা যে করে, বাঁচিয়া যায় সে। শান্তি পায়, নিজের কাছে শান্ত হইয়া রহে! যে ক্ষমা করে, তাঁহার স্বার্থেই কাজটা বেশ জরুরি।”
মা, আরও পড়ব? এর পরে বাবা লিখেছেন : “ওই শান্তি। যেমন দুর্লভ তেমনই আশ্চর্য। কে যে কীভাবে কবে পাইয়া যায়, তাহার ঠিক থাকে না। যেমন সব্যসাচীবাবু। শক্তি, জনপ্রিয়তা থাকিতে থাকিতেই তিনি হঠাৎ এক দিন স্টেজ ছাড়িয়া দিলেন। কেন, কেহ জানিত না; কানাঘুষায় বিস্তর কুৎসা রটিতেছিল। আমি তো জানিয়াছি, তিনি এখন সন্ন্যাসী, একটা মঠেই প্রায় সারাক্ষণ কাটাইয়া দেন। গেরুয়া ধরেন নাই বটে, তবু সন্ন্যাসী। সাদাসিধা পোশাক, নিরহংকার চালচলন। মাস দুই আগে হঠাৎ আমার সঙ্গে দেখা। চিনিলেন, ডাকিতে গিয়া নিজেই উঠিয়া কাছে আসিলেন। কয়েকটা কথা মাত্র, তাহাতেই বোঝা হইয়া গেল! সব ছাড়িয়াছেন। বলিলেন, ‘কী করি। কিছু বাড়াবাড়ি করিয়াছিলাম কিনা, তাই ছাড়িতেই হইল। কিছু তাড়াতাড়ি।’ ভালো বলেন নাই? দেখিলাম, সেই দিব্য কান্তি তেমনই আছে, বরং ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়াছে। অর্থ? আগে উড়াইয়া, পরে বিলাইয়া দিয়াও ফুরাইতে পারেন নাই। তবু এই পথেই আসিয়াছেন। কেন না, উহারই ভাষায় সব কিছুর হিসাব কোথাও মাপা আছে। মানুষের জীবনকেও মহাভারতের মতো পর্বে পর্বে ভাগ করা যায় : সুখ-দুঃখের পর উহার এখন চলিয়াছে শান্তি পর্ব।
সব্যসাচীবাবুর কথার ঘরানা সেই রকমই আছে, পরিহাসমিশ্রিত, একটু নাটকীয়। হাসিয়া বলিলেন, ‘এ কেমন শান্তি শুনবেন? আমার স্বাস্থ্য এখনও ভালো, জানি নানা রমণীতে এখনও লিপ্ত হইতে পারি—কিন্তু হই না। যত খুশি মোটরবিহার করতে পারি, কিন্তু করি না। টাকা খরচ করিয়া যে-সব বিলাস আর আরাম ক্রয় করা সম্ভব, তাহার সবই এখনও আমার আয়ত্তে—কিন্তু ছুই না। এই যে প্রত্যাখ্যান, ফিরাইয়া দেওয়া, মুখ, ফিরাইয়া লওয়া, ইহার মধ্যে শুধু অগাধ শান্তি নহে, অনির্বচনীয় একটা শক্তিও আছে। আজ আমি প্রতিদিন সেই শক্তির স্পন্দনও অনুভব করি।’
“আমি সব্যসাচীর মতো ভাগ্যবান নহি, তাই ওই শক্তির স্বাদ পাই নাই, যেটুকু পাইয়াছি তাহার নাম শান্তি। সুধীরবাবু আরও কম ভাগ্যবান, এই শান্তিও পান নাই। কিন্তু পাইবেন। বৃত্তাকার পথে মিছিল চলিয়াছে, একে একে আসিতেছে সকলে—সুধীরবাবু, আনু, প্রত্যেকে। সকলেই শান্তির সন্ধানী। তবে সুধীরবাবু যে পাইবেন; নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি। নহিলে সেদিন যাওয়ার আগে আমার কথা শুনিয়া তিনি ভাঙিয়া পড়িবেন কেন? কেনই-বা শেষ পর্যন্ত ভাঙা গলায় বলিয়া যাইবেন ‘শুধু কাড়িয়া লওয়া কিংবা চুরি করাই পাপ নয়, মনে মনে কামনা করাও পাপ—প্রণববাবু, আমি আজ বুঝতে পারছি, কিন্তু দরজা খুলছে না যে!”
“খুলিবে। খুলিবে স্বীকারোক্তিই সুধীরবাবুকেও মুক্তি আনিয়া দিবে, আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি।”
সেই সময়টা কেমন ছিল বলো তো, যখন প্রকৃতির মধ্যেই মানুষ কিছু বিশ্বস্ত চর খুঁজে পেত? তারা কী ঘটবে, ঘটতে চলেছে, বা ঘটল এইমাত্র, মানুষকে তার খবরাখবর এনে দিত।
কোথায় গেল সেই ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমী, যারা তাদের ডালে বসে মানুষকে শুনিয়ে শুনিয়েই যা হবে তার খোলাখুলি আলোচনা করত? হয় সেই পাখিরাই আর নেই, সেই প্রজাতিটি একেবারে লুপ্ত, অথবা মানুষের ভাষা ভুলে গেছে তারা, কিংবা আমরাও আর তাদের কথা বুঝতে পারি না। এ-ও হতে পারে, মানুষের ব্যবহারে বিরক্ত ওই পাখিরা আর মানুষের সুহৃদ নয় আদৌ, তাই কোনও সংবাদ আমাদের আর দেয় না। এই অসহযোগে অসুবিধা হয়েছে আমাদেরই। কিছু টের পাই না আগে থেকে।
অথবা আমাদের চোখ গেছে, তাই “বামে সর্প, দক্ষিণে শৃগাল” এ-সব দেখেও দেখি না, উপরন্তু শহরে ও-সব প্রাণী পাবই বা কই! আসন্ন অমঙ্গলের আগে আরও কত চিহ্ন থেকে জানা যেত। গায়ে টিকটিকি পড়া, চোখের পাতা নাচা, এ-সব কবে থেকে উঠে গেল।
অথচ ঘটনারা আজও আসে, দৈত্যের মতো লম্বা-লম্বা, পা ফেলে, শরীরের সম্মুখভাগে তাদের সবিস্তার ছায়া পড়ে। দেখতে পাই না। তুলনায় অবোধ প্রাণীরা এখনও সুখী; দ্যাখো না কখন ঝড় উঠবে, আবহ-বার্তার বর্ণমাত্র না পড়েও তাদের বোধে-অনুভবে তা অগ্রিম রটে যায়, ব্যস্ত পিঁপড়েরা সার বেঁধে উঠে পড়ে, আর? ত্রস্ত পাখি কুটো মুখে বাতাসের আগে আগে ঘরে ফেরে।
এত জ্ঞানী মানুষ, অথচ এ-সব বিষয়ে সবচেয়ে অজ্ঞান। নইলে কিছু যে একটা ঘটতে যাচ্ছে, তখনই টের পেতাম।
কিন্তু স্বপ্ন, মা, শেষ রাতের স্বপ্ন! তা তো ছিল। তাদের মূল নিহিত মনের ভয়ে, সেই বিষাক্ত লতার মতো স্বপ্ন এক-একটা রাত্রে ভীষণ জ্বলুনি ধরিয়ে দিত।
বারবার ফিরে আসত সেই দৃশ্যটি : জলে নেমে সাঁতরে সাঁতরে কেউ কেবলই দূরে চলে যাচ্ছে, দূর থেকে দূরে, দাঁড়িয়ে ডাকছি, সে সাড়া দিচ্ছে না, শুনছে না, কই, তার মুখটাই বা কই, মুখ সে কেন তোলে না, একবারও ফেরায় না? আমার ভয় করে। জলে আমিও নামব নাকি ভাবছি, তখন জলের উপর দিয়েই তার গলা ভেসে ভেসে এল “নামিস না। তোর এখনও সময় হয়নি।” সেই কণ্ঠস্বরে তাঁকে চিনলাম : বাবা। বাবা ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছেন, গিয়েছিলেন তো আগেই—আরও যাচ্ছেন। আমি চিৎকার করে বললাম। “আর সময় হলে—?” উত্তর এল “নামবি।” আবার বললাম “তখন আপনি—?”
“থাকব, ওপারে থাকব”, বলেই মাথাটা জলের তলায় ডুবে গেল।
সেই জলের তলাতেও তাঁকে কখনও কখনও শয়ান দেখি, সে অন্য স্বপ্ন, অন্য দৃশ্য, কিংবা পূর্ব-দৃশ্যেরই অনুক্রম। স্বচ্ছ জল, স্ফটিকের মতো নুড়ি, সেই তাঁর শয্যা, চারপাশে নানা উজ্জ্বল উদ্ভিদ, নানা রঙের মাছের খেলা, কিন্তু তিনি কিছুই দেখছেন না, তিনি ঘুমন্ত, তিনি শয়ান।
বাবার সেই প্রশান্ত নিমগ্ন মুখমণ্ডল এখনও মাঝে মাঝে ঘুমঘোরে দেখি।
তখন ক্রমশ ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়ছিলেন উনি, অসুখ বাড়ছিল।
.
তোমার আমার মাঝখানের দেওয়ালটা থরথর করে উঠেছিল দুই বার, মনে পড়ে? আমার দু’টি চিৎকারে। দু’বারেরই ভাষা এক–তীব্র, তীক্ষ্ণ “মা!” দেওয়াল ভাঙুক না ভাঙুক ওই ডাক মাঝখান দিয়ে যাওয়া-আসার একটা পথ তৈরি করে দিল।
মাঝারি সাইজের সেই পত্রিকাটি আমার হাতের মুঠোয়, চোখ বিস্ফারিত, বিস্মিত আমি দৌড়ে আসছি, বাইরের ফটক ঠেলে, বাগান পার হয়ে আসছি, এই যে অবিনাশরা অবাক হয়ে চেয়ে আছে, কিন্তু ওদের দিকে তখন চেয়ে তাকায় কে, আমি ছুটছি, আমার হাতে তখন বিরাট কোনও সম্পদ, কাকে দেখাব আগে, কাকে, রজনীকে? হয়তো তাই ঘটত, কিন্তু ঠিক সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়েছিলে তুমি।
যা ঘটবার তাই ঘটল, যা ঘটা উচিত তাই। কোথায় সেই দেওয়াল, দেখতে পেলাম না, যত চাপা আবেগ, যত উত্তেজনা উজাড় করে বলে উঠলাম, “মা।” দেওয়ালটা দুলে উঠল—”এই দ্যাখ। বলো তো কী?”
“কী?”
“দ্যাখোই না। এই লেখাটা।
“কার?”
“নামটা তো ওপরেই ছাপা আছে। পড়তে পারছো না?”
জ্বল জ্বল করছিল নামটা, কালো কালিতে নয়, যেন সোনার জলে ছাপা। গোটা লেখাটা। “তোর?” একই সঙ্গে বিস্ময়, অবিশ্বাস, উল্লাস ইত্যাদি অনেক কিছু অনাগত কোনও গানের সপ্তস্বরের মতো তোমার মুখে খেলে গেল, সেই মুখে সপ্তবর্ণের আশ্চর্য সম্পাত ঘটছিল। “তোর?” আর কিছু বলছ না তুমি, বলতে পারছ না, খালি একটা কথাই ফিরে বলা হয়ে যাচ্ছে “তোর—তোর—তোর?”
“আমারই তো। পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।”
“ওরা ছাপল?”
“পড়ো না মা, একটু পড়ো। কবিতাই তো, কয়েকটা তো লাইন মোটে।”
ঝকঝকে ছাপা পৃষ্ঠাটা তখন প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা মাটির মতো সুন্দর গন্ধ ছড়াচ্ছিল, তখন নতুন বইমাত্রেরই পাতায় পাতায় একটা গন্ধের আবেশ থাকত, এখন থাকে না, অথবা থাকে, আমি তার খোঁজ পাই না, নিজের নাম ছাপা দেখে সেই সচকিত বিভোর ভাব উবে গেল কবে? এখন চোখ শুধু তার কৃত্য করে, আর সেদিন? ওই লেখাটার প্রতিটি অক্ষর কখনও উৎক্ষিপ্ত হচ্ছিল জলোচ্ছ্বাসের আকারে, হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠছিল তালে তালে, কখনও সেই বর্ণমালা যেন এক-আকাশ ব্যাপ্ত মেঘ, কখনও ভারী চমৎকার কোনও ঘনকালো নির্ঝরিণী,— পড়ো না মা, কয়েকটা লাইন তো মোটে!
পড়বে কী, পড়া কি যায়, চোখ যদি ঝাপসা হয়ে আসে, দিগন্ত ছাপিয়ে ঝেঁপে বৃষ্টি নামে যদি? পড়া হল না, কিন্তু দেওয়ালটা ধুয়ে যেতে থাকল। জলে ধুয়ে যাবে বইকি, মাটির দেওয়ালই তো।
.
“আমাকে শোনাবে না?” রজনী বলল, সেই চিলে কোঠায় দাঁড়িয়ে!– “কবিতাটার কি নাম দিয়েছ দেখি।”
গাঢ় গলায় আমি বললাম, “রাত্রি।”
“ও,” সে বলল, আমার নামেরও ওই মানে।”
“সে তো এক ভাগের। সম্পূর্ণ মানে তুমি ফুল-রাত্রির পুষ্প। কিন্তু দিনেও থাকো।”
পাতাটা জড়ো করে বুকের কাছে রাখল সে, ঘ্রাণ নিল। ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি পড়ো।”
“তুমিই পড়ো না।”
“পারব কি? যদি ভুল পড়ি?”
তবু সে পড়ল, ধীরে ধীরে, মুদ্রিত প্রত্যেকটি বর্ণকে যেন তার ওষ্ঠের স্পর্শ দিয়ে দিয়ে। রাত্রিকে প্রাণদাত্রী বলেছ তুমি? বলেছি। বুঝেছি কেন। শুধু মেলাতে? এই কবিতাটায় তো মিল নেই। নেই? বেশ। যা বলেছ তাতে বিশ্বাস কর? বিশ্বাসের চেয়ে ঢের বেশি করি।
তখন সে চোখ বুজে পর্যাপ্ত একটা শ্বাস হৃদয়ের মধ্যে টেনে নিল। তারপর ফের লেখাটায় চোখ বুলিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ হোঁচট খেল : “রাত্রিতে আবার আকাশ-গঙ্গাও দেখি।’—এর মানে কী? লিখেছ, ‘তখন ভয় করে, মনে হয় এক-একটি মরা নক্ষত্র এক-একটি বিশাল ছায়াপথের অধিপতি।’ ‘কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। একটু বুঝিয়ে দেবে?”
“বুঝলে আমিই কি লিখতাম? বুঝিনি বলেই তো লিখেছি।”
সে আবার বলল, “আমার ভয় করছে।”
“ভয় আমারও করে।” আমি তাকে ধরে ফেললাম, একটা পা ভুল বাড়াতে গিয়ে আর একটু হলেই কবাটে তার মাথা ঠুকে যেত।
সেইদিন রাত্রে তুমিও কী ভুলটা করতে যাচ্ছিলে, কী ভয়ংকর অন্যায়, বলো তো?
কত দিন পরে নিজে থেকে পাতে সব দিয়ে খাওয়ালে তুমি, বাঁশি উপরে উঠে গেল, তুমি চট করে সিঁড়ির মুখটা আগলে দাঁড়ালে।
“আয় এদিকে, আয় না একটু। দুটো কথা বলি দু’জনে, বলবি না?” ইস্ মা! তোমার গলা অভিমান আর অনিশ্চয়তার সর্দি জ্বর-লাগা কেন, ও-রকম কাকুতি মিনতির সুরে কথা বলছ কেন। আমাকে তো তুমি ইচ্ছে হলে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে পার, তাই না? মাঝের ফাঁকটুকু কতখানি “হাঁ” হয়ে আছে আমি ভাবছিলাম।
আমার মাথায় একটা হাত রাখলে, সসঙ্কোচে, কত সন্তর্পণে, আর কত কাল পরে সেই ছোঁয়াতেও ভাবি বা নিশ্চয়তা ছিল না। অধিকারের অহংকার? তা তো একেবারেই না।—”আর তো রাগ নেই, না রে?” তোমার গলা কাঁপছিল। “রাগ?” আমি হাসলাম, “কার ওপরে?” যদিও তোমার প্রশ্নটা ঠিকই বুঝেছিলাম।
(একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে বোকা মেয়ে, মনে মনে তোমাকেও বললাম বোকা মেয়ে, সেই এক কালের মতো আদরে, বৃষ্টিতে সব ধুয়ে গেল না? রাগ মানে তো রোদ, রাগ থাকবে কী করে? তুমি কিচ্ছু বোঝ না।)
“রাগ করার কিছু নেই মা”, আমি আবার বললাম। সেদিন যা বলা হয়নি তোমাকে এখন বলছি, শোনো। অনেক ঠেকে, প্রত্যাখ্যানের পর প্রত্যাখ্যান পেয়ে, এতদিনে বুঝেছি, রাগ দিয়ে কিছু লেখাও যায় না। রাগ হল লালকালি, বড় কড়া, চোখ কড়কড় করে, ও দিয়ে শুধু খাতার পাতায় ট্যাড়া মারা যায়। কত জনের উপরে কত রাগ নিয়ে এই লেখাটা শুরু করেছিলাম। আস্তে আস্তে সব উত্তাপ, উম্মা জুড়িয়ে যাচ্ছে, দেখছ তো। লেখার ধরনটাই বদলে গেছে, মা। আমি সেই কবে থেকে ভালোবাসা দিয়ে বাকিটা ভরে ফেলতে চাইছি।
‘সেই বইটা কই”, তুমি হঠাৎ বললে ফিসফিস করে।
“এই তো।” পত্রিকাটা তখনও আমার পকেটেই ছিল।
“দে, আমাকে দে।”
কারণটা আন্দাজ করে উৎফুল্ল গলায় বলে উঠলাম, “বাবাকে দেখাবে? “
ঠোঁটে আঙুল তুলে তুমি বললে, “এই। আস্তে। উনি শুনতে পাবেন।”
“বাবাকে দেখাবে না? সে কী! তবে—তবে কি আমি দেখাব? যাই দেখাই?” তুমি ধীরে ধীরে বললে, “না। লুকিয়ে রাখতে হবে।”
“লুকিয়ে। কেন মা?”
“তুই কিচ্ছু বুঝিস না। ওঁর শরীরের এই অবস্থা। আমি যা বলছি তাই ঠিক, কোনও আঘাত দেওয়া চলবে না ওঁকে। ওটা লুকিয়ে রাখতে হবে।”
ঠিক তখনই, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হল।—”কী লুকিয়ে রাখতে হবে, কী, কী?” বাবার স্বর শুনতে পাচ্ছি, অনেক দিন পরে আমাদের দু’জনের গলা শুনতে পেয়ে কৌতূহলী বাবা ওঁর টিনের কৌটোর খেলার সংসার ছেড়ে, গাছ-গাছড়ার জগৎ ফেলে কোনও মতে কিছু ধরে ধরে উঠে এসেছেন, মা, দেখতে পাচ্ছ না? শুনতে পাচ্ছ না যে বাবা বারবার বলছেন “কী লুকোতে হবে, কী—কী?”
তুমি বললে না/বলছ না/বলবে না দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম আমি। বললাম, “বাবা! এই যে!”
পৃষ্ঠাটা ওঁর চোখের সামনে মেলে ধরলাম, তুমি সরে দাঁড়ালে একটু। বাবা প্রথমে পড়তে পারছিলেন না, ফতুয়ার পকেট হাতড়ে বের করে নিলেন ওঁর সুতো বাঁধা চশমাটা, তার পরেই তাঁর মুখে, মা বিস্ফোরণ ঘটল, বিকালবেলা তোমার যা ঘটেছিল। অলৌকিক আলোকে প্লাবিত হয়ে যেতে থাকল একটি মুখ, পুরু ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে, কানের পাশের নালিগুলি নীল এবং স্ফীত, বিড়বিড় করে উনি পড়ছেন, তারপরেই “তুই—তুই–তুই, তুই লিখেছিস” বলে সোল্লাসে চিৎকার করে, হ্যাঁ মা, তুমি তো শুনেছিলে, কোনও জমাট বারুদ-জাতীয় পদার্থের মতো প্রচণ্ডভাবে বিস্ফারিত হয়ে গিয়ে, কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে গোলাকার একটা ডেলা পাকিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিলেন।
তোমার চোখে তখন তিরস্কার, যার মৌন মর্ম : ‘কেন দিতে গেলি, কী হল দেখলি তো? আমি আগে বলিনি?”
একটু অপেক্ষা করো মা, পরে কী ঘটতে যাচ্ছে দ্যাখো। ওই যে বাবা নুয়ে পড়ে তুলে নিয়েছেন দোমড়ানো ডেলাটা, পাতাগুলো টেনে টেনে মসৃণ করছেন, পড়ছেন সবটা আগাগোড়া, মাথা নিচু করে, উনি এখন শান্ত, কই এতটুকু উত্তেজনার ভাব তো আর দেখা যায় না, উনি এখন নিস্তেজ, ওঁর সমস্ত মুখে এখন শুধু সংবৃত আনন্দের মহিমা।
“মৃত নক্ষত্র, মৃত নক্ষত্র”, পড়া শেষ হলে উনি আমার দিকে চেয়ে বললেন “চমৎকার ভাষা, কিন্তু তুই এসব বুঝিস? একটু ছেলেমানুষি মিশিয়ে ফেলেছিস তা ভালোই, যাক গে। কিন্তু ধর, একটা দুটো নক্ষত্র নয়, মৃত যদি হন ঈশ্বর নিজে? ‘গাড়ির আড়ি’ বলে সেই যে একটা গল্প পড়েছিলি না? অন্ধকারে দুর্যোগে গাড়ি ঠিকই চলছে, তীরবেগে, কিন্তু তার ড্রাইভার বজ্রাঘাতে নিহত, অদৃশ্যভাবে মরে পড়ে আছে। গাড়ি তবু ছুটছে। এই বিশ্বের ব্যাপারটাও তেমন তো হতে পারে, পারে না? কী সর্বনাশ বল্ দেখি,। ঈশ্বর মৃত কিংবা ধর মৃত না হলেও পাগল কিংবা অর্বাচীন কারও হাতে ভার দিয়ে অবসর নিয়ে আছেন—ভেবে দেখেছিস?”
আমি শুধু ঘাড় নাড়লাম। উনি আবার পড়লেন লেখাটা, ছাপা হরফ-গুলো উপরে মোটা মোটা আঙুল ঘষে কী যেন পরখ করলেন, তখনও তিনি শান্ত, তোমার দিকে এতক্ষণে দৃষ্টি পড়ল তাঁর।—”কিন্তু এটা তুমি লুকোতে চাইছিলে কেন বলো তো?”
তুমি উত্তর দাওনি।
এবার বিষণ্ণ, বাবা আস্তে আস্তে বলেছেন, “বুঝেছি। তুমি ভেবেছিলে আমি আঘাত পাব।”
তুমি তাড়াতাড়ি বলে উঠেছ, “তোমার এই শরীর—”
বাবা আরও আস্তে আস্তে বলেছেন, “শরীর নয়, সত্যি করে বলো। তুমি ভেবেছিলে আমি ঘা খাব মনে, তাই না?”
যেহেতু তুমি আবার চুপ, অতএব নিজের বাক্যটিকেই বাবা সুতোর মতো তুলে নিলেন ফের—”সারা জীবন ধরে আমি কত লেখা লিখেছি, তার একটাও ছাপা হল না, কেউ পড়ল না, কিন্তু আমার ছেলে? কলম ধরতে না ধরতে তার লেখা ছাপা হয়েছে, লোকে নিয়েছে—তুমি ভেবেছ সেটা আমার বুকে খুব বাজবে? আমি ব্যথা পাব? তাই, না?”
একটু থেমে বাবা, আরও গভীর, আরও ধীর, কিন্তু স্বচ্ছ অনর্গল কোনও জলস্রোতের মতো বলে চলেছেন, “ছিঃ আনু, ছিঃ! আমাকে বড় ছোট ভেবেছ তুমি। নিজে মা তুমি, অথচ পিতৃত্বের কথা জানো না। ছেলেকে সবাই জানবে, চিনবে, এই আনন্দ নিজের লেখা ছাপা হওয়ার চেয়ে এক তিল কম নয়। বরং বেশি, অন্তত এই বয়সে আমি তো বুঝতে পারছি, এই গৌরব ঢের বেশি। ছিঃ, না জেনে-বুঝে কাউকে ছোট করে না।”
আর তার পরে? মা, তার পরের মুহূর্তটিকে আর বর্ণনা করে কাজ নেই, বর্ণনা করার সাধ্যও নেই আমার, বরং এইখানে কলম থামিয়ে সেই মুহূর্তটিকে ধ্যান করি। কষ্টের যে পুঁটলিটা বুক থেকে সোজা উঠে এসেছে কণ্ঠমূলে, সেখানেই সে থমকে থাক।
বাবা ঘন হয়ে এসেছেন, ঘ্রাণ নিচ্ছেন আমার চুলের, ওঁর চোখে এক—কী? আনন্দ? আনন্দ কি বিদ্যুতের মতো এমন চকিত হতে পারে? আগে দেখিনি। কোনও মুখমণ্ডল সহসা হয়ে যায় পবিত্র এক যজ্ঞস্থলী।
উনি আমার মাথায় হাত রেখেছেন, সেই স্পর্শ অকম্পিত স্থির; কিছু বলছেন,
সেই উচ্চারণ প্রত্যয়ী নিবিড় : “আমার আর ভাবনা নেই। আমি এবার মরতে পারব, কেন না জেনেই গেলাম আমি বাঁচব। জানলাম, যাব না। বা গেলেও আমি থাকব।”
আশীর্বাদ—আমাকে? আশ্বাস—নিজেকে? না, কোনও চতুর বিচার পদ্ধতি দিয়ে ওই গভীর-গম্ভীর আবৃত্তির মূল্যায়ন করব না। চোখ বুজলে আজও শূন্যোদ্যানে আকাশকুসুমের হৃদয়সন্ধানী বিপুল এক ভ্রমরের গুঞ্জন শুনি।
.
ঠিক তার পরদিন প্রভাতে, আমার সেই দ্বিতীয়বার চিৎকার—”মা—!” তুমি ছুটে এসেছিলে। চৌকাঠে আমরা দুজন পাশাপাশি, কতদিন পরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলাম ঘরের ভিতরে : চারধারে ছড়ানো টিনের কৌটো আর নানা উদ্ভিজ্জ, তাঁরই তৈরি স্বপ্নের সংসার, ছড়ানো সেই স্তূপাকার সংগ্রহের মাঝখানে-
বাবা শয়ান। ঘুমিয়ে আছেন।
একেবারে শিশুর মতো সরল এক সুখে, পরম কোনও তৃপ্তিতে। সকালের রোদ কতভাবে তাঁর শরীরের উপরে পড়ে তাঁকে তুলে দিতে চাইছিল, কটা উৎসুক চড়াই ঘুরে ঘুরে তাঁর মুখ খুঁটিয়ে দেখছিল, তিনি নিস্পন্দ। পাশে রাখা গাছ-গাছড়ার পাতা থেকে একটা নিরীহ কীট বাহুমূল থেকে বেয়ে বেয়ে বুকের রোমশ অবারিত অরণ্যে নির্ভয়ে ঢুকে গেল, তিনি সহিষ্ণু, তবু নড়লেন না, কেননা তিনি কোনও প্রাপ্তিতে পরিতৃপ্ত, অবিচল জলতলে মগ্ন তিনি শান্ত, চিরায়ত তিনি ঘুমন্ত
মা, এইবার চিৎকার করে ওঠার পালা ছিল তোমার, সহসা আকুল এক ঢেউয়ের মতো ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ে ভেঙে চুরে শতখান্ হয়ে গেলে।
যেন এইমাত্র মন্দিরে কারও জন্য প্রার্থনা হল, উপাসনা শেষ, সকলে তবু স্তব্ধ বসে আছি। নীরবতাই তবে কিছুক্ষণ বাঙ্ময় হোক। কথা কেবলি জলে দাঁড়ের মতো বাচাল আঘাত করে; নীরবতা টেনে নিয়ে যায় প্রসারিত শুভ্র পালের মতো, তাই থাক। ওই তো সুধীরমামা এসেছেন, আসবেন অবধারিত, কিন্তু চুপ। চুপ এই বাড়ির দাস-দাসীরাও, যারা আমাদের ঘৃণা করে। এই মুহূর্তে করছে না কিন্তু। তুমি দুপুরেও তোমার মাসিমার ঘরে কী একটা কাজের দেখাশোনা করতে যাচ্ছিলে, ওরা সবাই এসে তোমাকে সরিয়ে দিল। এই তো তোমাকে শুইয়ে দিয়েছে, ঠান্ডা মেঝেতে তুমি এখন বিশুষ্ক আঁচল পেতে। ওরা আজ তোমার সব কাজ করে দেবে। এক-একটা মৃত্যু এই সব ঘটায়, অনেককে স্পর্শ করে, প্রথম সমবেদনা, পরে সেটাই মহৎভাবে আবিষ্ট হয়। হয়তো খানিকক্ষণের জন্যে। তবু অকিঞ্চিৎকর ঈর্ষাতুর মানুষকে ঈষৎ মহৎ ভাব কোনও মৃত্যুই দিতে পারে। দ্যাখো, সেই যে অবিনাশ, সে-ও কেমন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, উদ্ধত বিড়িগুলো আর টানছে না। জানি, মহত্ত্বের আশ্রয় থেকে ওরা বেরিয়ে আসবে অচিরে, আবার যে-কে সে-ই হবে, তবু এই সময়টাতে যেটা সত্য তাকে ভুল করা উচিত হবে না।
সুধীরমামা বসে আছেন নিচু মুখে। তোমার দিকে এসে একবারই তাকিয়েছিলেন, তারপর আর না। মাটিতে দাগ টেনে টেনে কী কষছেন? অথবা উনি কি এখন এখানে নেই, পর্যটন করছেন স্মৃতিতে? কোনও অপরাধবোধ দ্বারাও আক্রান্ত কি?—”শুধু কেড়ে নেওয়া কিংবা চুরি করাই পাপ নয়, মনে মনে কামনা করাও পাপ”, এই উক্তিটিকে মনে মনে উচ্চারণ করছেন ফিরে ফিরে, ওঁর শ্রাদ্ধের মন্ত্র এই একটাই?
কিন্তু আমি? আমি কোন্ মন্ত্র পড়ব? শ্মশান-অনলে দগ্ধ, বান্ধবদের দ্বারা পরিত্যক্তকে কোন্ স্নানে পানে সুখী করব?
তার চেয়ে থাক। কিছুক্ষণ মৌন থাকি, সেই কবে এই লেখা-টেখার ভেলায় ভেসে পড়েছি, ঘাটের পর ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে এলাম, এখন ক্লান্ত, মা, এই অধ্যায়ে আর একটাই তো মোটে ঘাট বাকি। সেখানেও যাব, নেমে যখন পড়েছি, তখন যাব নিশ্চয়, কিছু ভেবো না, সেই ঘাটও ছোঁব। আবক্ষ জলে দাঁড়িয়ে অর্পণ করব শেষ অঞ্জলি। যার হওয়ার কথা ছিল অংশত অভিযোগপত্র, তা হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ প্রায়শ্চিত্ত। যাক।
৩৩
মা, এইমাত্র বেতারে বলল, “খবর বলা শেষ হল” লেখা থামিয়ে রেডিওটা খুলেছিলাম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করতে হল, কারণ ওই ঘোষণাটা শোনামাত্র চমকে উঠলাম যে। “অ্যান্ড দ্যাট ইজ্ দি এনড্ অব দি নিউজ”—ওরা কিন্তু অনায়াসে বলে দেয়। আমি পারি না, যেহেতু আমি জানি সংবাদ, সংবাদের শেষ, উপসংহার? কী শেষ হয় মৃত্যুতে? যারা মৃত তারা ফিরে ফিরে আসে। যারা আসে না, এল না যারা, আমি তাদের অপেক্ষা করি।
লৌকিক অর্থে তাদের সবাই হয়তো মৃত নয়। চিরদিনের মতো চলে যাওয়া সরে-যাওয়াকেও মৃত্যুকল্প ধরে নিয়ে এই সব কথা লিখছি। তাদের মুখোমুখি হওয়ার সাধ এখনও পোষণ করি। মোকাবিলা হোক, একবারটি দেখি। একটু কথা শুনি।
তা হয় না। যারা ত্যক্ত তারা আর ফেরে না। যারা পরিত্যাগী, তারাও না। দুরন্ত ঘোড়ার মতো আমার অতীত তার সওয়ারকে ফেলে দিয়ে, আমাকে অতিক্রম করে উড়ে গেছে, সে ফিরবে না।
তবে আমিই ফিরি। পা টিপে টিপে, পিছন পাতাল-পথে। যেখানে তখনও অবশিষ্ট সুধীরমামা, তুমি, বাঁশি, বুলা, রজনী ইত্যাদি।
.
কেন না তখনও তো নেমেছিলাম আমি, নামছিলাম। ফিরে গিয়েছিলাম। কেন না, মুহ্যমান হয়ে থাকে মোটে কয়েকটি মুহূর্ত। শোক সাময়িক। পৃথিবী তার শুষ্কতা দিয়ে সব শুষে নেয়। সেই দিক থেকে প্রতিটি শোক শুচি, প্রতিটি শোক যেন স্নান। স্নানের পর সব আর্দ্রতা আমরা মুছে নিই, খরখরে হাওয়ায় শরীরে আবার খড়ি ওড়ে, আমরা ফিরে যাই যে যার স্বরূপে, আবার সারা অঙ্গে ধুলো পড়ে, সায়াহ্নে বা পরদিন প্রভাতে আবার প্রক্ষালন। সময় অমনিতে শূন্য, নিরাকার, নিরর্থক, তাকে পরিপূর্ণ করে তোলে কখনও সুখ, কখনও শোক। তাৎপর্যে সাজাও।
.
“যখনই একা, তখনই তুমি।”—এই লাইনটা লিখলাম এর কতদিন পরে? মনে পড়ে না। খাতার পাতা অনেক দিন সাদাই ছিল। সেদিন কাগজ টেনে পর পর কয়েকটা শব্দ লিখে ফেললাম কেন কে জানে, লিখলাম, কাটলাম, দুটোই বেশ যত্ন করে, ফের লিখে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম।
রজনী কখন এসেছিল, খালি পায়ে। টের পাইনি। ঝুঁকে পড়ে লাইনটা সে যখন আস্তে আস্তে নিজেই পড়তে শুরু করল, চমকে উঠলাম
“তোমার কোনও নতুন লেখা?” সে জিজ্ঞাসা করল। এর উত্তর দেওয়ার অর্থ নেই। নতুন লেখা? কী জানি। কথাটা হয়তো পুরনো, ভীষণ পুরনো। আসলে যখন কিছুই করার নেই, কিছুই নেই লেখার তখনই মাঝে মাঝে এইসব ঘটে যায়। কেউ বীজমন্ত্র উচ্চারণ করে, কারও মনে শিমুলের মতো এক-একটা বীজ-সত্য ফেটে পড়ে—রক্তাক্ত সেই সত্য।
যখনই একা, তখনই তো। তখনই আমরা কিছু-না-কিছুর সন্নিধানে থাকি। তখনই খালি ঝড়, বিদ্যুৎ, মেঘ এইসব দেখি; কোনও শস্যের শিষ, যা কামনায় কম্পিত। যখন একা তখন আমাদের সঙ্গী অনেক—অজস্র সুখ, শিহরন, কীর্তি-অকীর্তির স্মরণ, কত অপরাধবোধ, গ্লানি ইত্যাদি। বহুর সঙ্গ-জর্জর মুহূর্তগুলি কোনও ভাবনাকেই বিকশিত হতে দেয় না, তখন জীবন একটা ব্যস্ত মুদি-দোকান ছাড়া আর কী, কড়ি ফেলে ফেলে সস্তায় সওদা বেচাকেনা।
“তখনই তুমি”–সে অস্ফুট গলায় উচ্চারণ করল—”তুমি আবার কে?”
তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “তুমি।”
“আমি?” সুন্দর একটি আনন্দের হাসি তার মুখে ছড়িয়ে পড়ল।
মা, আমি মিছে কথা বলেছিলাম তাকে। এই “তুমি” সে নয়, কেউ নয়, অনেকে “তুমি” একটা যৌথ শব্দ, বহুবচন সমষ্টির প্রতিভূ। এক-এক সময়ে এক-একজন তুমি, আমরা যাকে যখন আবাহন করি, কিংবা যে যখন মস্ত হয়ে উদিত হয় সময়ের বিস্তীর্ণ ললাটে, প্রকাণ্ড একটা টিপের মতো আঁকা হয়ে যায়। এতে অন্যায় আছে কি, কোনও অবিশ্বস্ততা, কোনও পাপ? জানি না। তবে নিয়মটা টের পাই। বিশেষ বিশেষ দিনে কিংবা ক্ষণে বাসনার সোনায় অথবা বিষাদের বেদনায় উতল-অধীর করে তোলে বিশেষ কোনও জন, সেই মুহূর্ত সেই বিবেক; সে আবার নিষ্ঠুর এক প্রভুও; কষাঘাতে যখন জর্জর করে চলে, আমরা ভগ্নজানু, তখন করজোড়ে সেই আবির্ভাবকে “তুষ্ট হও” এই সকাতর প্রার্থনাই শুধু জানাতে পারি।
“কী ভাবছ”, আমার মাথায় হাত রেখে—অশৌচান্তের মোটে তো মাস দুই তিন পরে, আমার মাথা তখন প্রথম কদমফুল হয়ে আছে—রজনী বলল। কিছু বললাম না বলে সে নিজেই বলল, “আমি জানি, কী। মেসোমশাইয়ের কথা।”
চমকে উঠলাম। যখনই একা—তার মধ্যে বাবাও কি একজন ‘তুমি’? যাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম একদিন, অন্তত প্রসন্ন মনে গ্রহণ করতে পারিনি, শূন্য হাতে বিতাড়িত অকৃতার্থ একটি মানুষও বারবার যে ফিরে আসে সে কি আমাকে শাস্তি দিতে? কিসে প্রায়শ্চিত্ত হবে, বলো, উতলা রাত্রে এই ক’মাস ধরে প্রতি রাত্রে তাকে ডেকে বলি। বাবা কথা বলেন না, শুধু হাসেন, নিজেকে বিখ্যাত এক বিদেশি নাটকের অস্থিরচিত্ত নায়কের সঙ্গে তখন মিলিয়ে ফেলি। প্রায়শ্চিত্ত করছি বৈকি, তারপর থেকে এই দীর্ঘকাল জুড়ে। যাবতীয় সংস্কার আর বিশ্বাসকে নির্বিচারে গ্রহণ করে সবসময়ের অবহেলা আমাকে ক্রমশ পরলোকে আস্থাবান করে তুলেছে : কোথাও নিশ্চয়ই আছে সুবিচার আর স্বীকৃতি। একটি মানুষ যে কত নৈরাশ্য সয়ে সয়ে সরে গেল, একটি মানুষ একা একা কত কষ্ট পেল, মূর্খের মতো ভালোবাসতে চাইল, ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দিয়ে হরির লুটের মতো, আবার গুঁড়ে গুঁড়ো বাতাসাগুলো কুড়িয়ে নিতে আরও সূর্যের মতো নুয়ে পড়ল, তার সেই শুষ্ক হাহাকার, চোখের পাতার গোপন সিক্ততা, তার প্রেম, তার পিপাসা, তার প্রতি বছর উদাসীনতা, একদিন এ-সব আবিষ্কৃত হবেই। কবে?—ইহলোকে আর নয়, আর সময় নেই, পরলোকে। সকল স্বজন সেখানেই।
“ছি, এত ভাবে না।” রজনী বলল করুণার প্রতিমা হয়ে।
“তুমি বুঝবে না”, বললাম তাকে।
“বুঝব না?” অকস্মাৎ প্রদীপ্ত হয়ে উঠল সে। “শোক আমি পাইনি? আমারও—মা আর বাবা দু’জনেই—সে-কথা যাক। জানো ছেলেবেলায় একটা ফড়িং পুষেছিলাম আমি। বাগান থেকে বাবা ধরে এনে দিয়েছিলেন। সরু একটা সুতোয় কলমদানির সঙ্গে তাকে বেঁধে বাবার লেখার টেবিলটায় রেখে দিয়েছিলাম। পাখা নাড়ত ফড়িংটা, ফরফর করে উড়তে চাইত। বাবা আর আমি দেখতাম, দু’জনেই মজা পেতাম। কিন্তু বাবা একবার বাইরে গেলেন, একদিন রাত্রে খুব হাওয়া উঠল, সকালে ফড়িংটা আর নেই। হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে গেছে? খুব কাঁদলাম। কিন্তু পরে মনে হল ছেঁড়া সুতোটার চিহ্ন থাকবে তো? সন্দেহ হল। মাকে বললাম। মা স্বীকার করল, বলল যে “হ্যাঁ, আমিই উড়িয়ে দিয়েছি। ও কী বাজে খেয়াল! ফড়িংটা কষ্ট পাচ্ছিল, শুকিয়ে আসছিল—তাই।” আরও কাঁদলাম। মস্ত একটা কাগজ টেনে বাবাকে চিঠিতে লিখলাম, “যে-ফড়িংটা তুমি এনে দিয়েছিলে, জানো বাবা, সেটা আর নেই। মা—তাকে—উড়িয়ে—দিয়েছে। কেমন চিঠি?”
“খুব সরল, সুন্দর।” আমি বললাম।
“এর চেয়ে মনের ভেতরের কথা বাইরে এনে কোনও-কিছু আমি কখনও লিখতে পারিনি”, রজনী বলল।—”তুমি সহজে অনায়াসে মনের সব কথা লেখায় ফোটাতে পার?”
“চেষ্টা করি।”
“ফড়িংটা উড়ে গেছে, মা উড়িয়ে দিয়েছে, দুঃখ ফোটাবার জন্যে এর চেয়ে বেশি কিছু লিখতে পারলাম না—তোমরা কত বড় বড় কথা জানো।“
সে সব দরকার হয় না। ছোট কথাতেই বড় দুঃখ বোঝানো যায় ধরো, যেমন গানে।” চমকে উঠে সে বলল, “গানে? আচ্ছা, গান যে ভালোবাসে, সে যদি হঠাৎ শুনতে না পায়, ধরো, শক্ত কোনও অসুখ হল, কিংবা বেশি বয়সে—”
“দৃষ্টান্ত আছে”, আমি বললাম “বইয়ে পড়েছি। বিদেশি এক সুরকার নিজেই—”
সে হাসল। “দৃষ্টান্ত তোমার সামনেই আছে। কান নয়, আমার চোখ যাচ্ছে। জানো, ছেলেবেলা থেকে সব কিছু দেখতে এত ভালোবাসতাম আমি। বাগানে, গঙ্গার ঘাটে, কিংবা এই ছাদে বসে দেখে দেখে সময় কাটিয়ে দিতাম। কত রঙ, লেখা আর মোছা। মোটে সাতটা রঙের কথা আছে তো? আমি কিন্তু ইংরেজি বই পড়ে পড়ে আরও অনেক রঙের নাম জেনে নিয়েছিলাম। ছবির অনেক অ্যালবামও আমার ছিল, ছাপানো, বাঁধানো বই সমস্ত। এখন সে-সব ছবি তত ভালোভাবে আর দেখতে পাই না, বইগুলো মাঝে মাঝে বুকের কাছে টেনে তাদের গন্ধ নিয়ে থাকি।”
বলতে বলতে সে কাঁপছিল।—”আর আকাশ? অনেক দূর চলে যাচ্ছে। আচ্ছা, আমাদের চোখ দুটো ঠিক পাখির মতো, না? দূরে দূরে উড়ে গিয়ে খুঁটে খুঁটে কত কী ঠোঁটে তুলে নিয়ে আসে, কত রঙ, কত দৃশ্য, ছবি। মানে, আসত। আমার চোখ দুটো আটকা পড়ে যাচ্ছে, সুতোয় বাঁধা ফড়িংটার মতো! আর উড়ছে না, কিছু ঠোঁটে তুলে নিয়ে আসছে না।” একটু থেমে রজনী আবার বলল, “সেই ফড়িংটাও আর ফিরে এল না। “
আমি তাকে বললাম, “আসছে তো। এই তো এল, এইমাত্র। সে-ও আসছে, তুমি জানো না।”
মন-রাখা এই প্রবোধবাক্যটা সে আদৌ শুনল কিনা কে জানে, কেননা তখনও সে মাথা নাড়ছিল, বলছিল, “চোখ দুটো গেলে সব চেয়ে দুঃখ কী জানো? তোমাকেও আর দেখতে পাব না।” অথচ, অতিশয় সৎ স্বরে সে বলছিল, “অথচ রোজ দেখতে ইচ্ছে করে, তখন ও করবে।”
“কিংবা কী জানি”, সে নিজেই নিজের জন্য একটি আশ্বাস চয়ন করে নিল “তখনও হয়তো দেখতে পাব। যেমন এখনও দেখি : জানো, তোমার বাবা যখন গেলেন, অশৌচ চলছে তোমাদের, তখন তোমাকে দেখতে এত পবিত্র, এত সুন্দর হয়েছিল! এখনও চোখ বুজলে আমি তখনকার তোমাকে দেখি : তামাটে চুল, রুক্ষ, জট পাকানো। তোমার মা কলার পাতায় মালসা থেকে ঢেলে দিচ্ছেন আতপ চালের ভাত, ঘি মাখানো, কী মিষ্টি গন্ধ, ধোঁয়া উড়ত, স্নান করে সাদা কাপড়টি পরে, না-আঁচড়ানো চুল, তুমি যখন কম্বলে বা কুশাসনে বসতে ঠিক সন্ন্যাসীর মতো লাগত।”
“সেই সময়ে”, রজনী বলে গেল- “একদিন একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। ট্রেনে করে কোথাও যাচ্ছি, সকাল হল। ভালো করে আলো ফোটেনি, তখন কী বলো তো? দেখলাম, ওই কামরায় তুমিও আছ। ঘুমোচ্ছ বেঞ্চের ওপরে, অঘোরে। আমি তোমাকে আস্তে আস্তে ঠেলছি; তুমি তাকাচ্ছ। তখন কী? যেন ঘুমে জড়ানো গলাতেই তোমাকে বলতে শুনছি—’এই! তোমার কোলে মাথা রেখে আমি একটু শোব?’ তোমাকে টেনে নিলাম। আস্তে আস্তে আঙুল ডুবিয়ে তোমার চুলের জট ছাড়িয়ে দিতে থাকলাম। দেখলাম, তুমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছ।”
রজনী থামল। বলল, “এই আমার স্বপ্ন। তোমার জট ছাড়িয়ে দিচ্ছি, এই ছবিটা এখনও দেখি।” বলতে বলতে সে থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠল, হঠাৎ কেমন যেন না-চেনা গলায় বলে উঠল, “আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি, ভীষণ দুর্বল।” বলে সে আরও শান্ত, বিষণ্ণ, সংযত, আস্তে আনত হয়ে আমার একটি করতলে তার ঠোঁট রাখল।
(“রোজ দেখতে ইচ্ছে করে”, কে কবে বলেছিল আজ যে-জবানবন্দি তোমার কাছে, তার মাঝখানে সেই কথাটা ঢুকে পড়ল কী করে। খুঁড়ে খুঁড়ে তাকে তুললাম আমি, ধুলোমাটি মুছিয়ে সব কথার পাশে তাকেও দেখলাম। তার একটা হেতু, আমি আজ লিখছি এক অবারিত প্রহরে, সব দরজা-জানালা খোলা, সারা ঘর ভরে গেছে হাওয়ার হাহাকারে আর শুকনো পাতার মর্মরে—কোনও আব্রু আড়াল, ঢাকনা, পরদা কিছু তোমার কথা লিখতে লিখতে তাদেরও মনে পড়ে, মা, যারা এসেছিল। তুমিই প্রথম, কিন্তু তারাও ছিল। তারা, যারা ওইসব কথা বলত। কোথায় তারা, ডাকছি ত্রাহি স্বরে, তোমার সঙ্গে তাদেরও, যারা চলে গেছে, শুধু দুর্মর কয়েকটি স্মৃতি আর নিশ্বসিত কিছু মূহূর্ত রেখে গেল। সেই সব স্মৃতিই যেন তাদের সন্তান, উদাসীন মায়েরা সেই শিশুদের—স্মৃতিদের— তাদের পিতার কাছে ফেলে রেখে নিরুদ্দেশ, তবু হায়, শিশুরা মরেনি, বুকের মধ্যে তাদের লালন করে চলেছে, রুগ্ন তারা, শীর্ণ, তবু বুকের মধ্যে নড়ে চড়ে ওঠে, নখে আঁচড়ায়, কেঁদে ওঠে। কিন্তু কী করব আমি, ওদের পিতা? বিশুষ্ক-বয়সি প্রৌঢ় পুরুষ, আমি কোথা থেকে যোগাব ওদের স্তন্য? “রোজ দেখতে ইচ্ছে করে”–সেই শ্রুত কথাটিই তাই বারবার পাঠ করি চিৎকার করে, ওদের কথা ওদেরই ফিরিয়ে দিয়ে বলি, “আজ আমারও ইচ্ছা করে।” কিন্তু ইচ্ছা ইচ্ছাই। কেউ ফিরবে না। যারা যায় তারা ফেরে না। কিন্তু এত আসক্তি বুকে চেপে রেখে আমিই বা মুক্ত হব কী প্রকারে?
মা, দরজা-জানালা সব খুলে দাও। হাঃ হাঃ স্বরে উড়ে আসুক আমার অতীত, আমাকে উড়িয়ে সব বাঁধন খুলে ফেলে দিক কোনও নিস্তৃণ প্রান্তরে কিংবা কঠিন কোনও শৈলচূড়ায়। রজনীর যে ভয় ছিল, আজ সেই ভয় আমারও। চোখের সামনে থেকে রূপ মুছে যাচ্ছে, আমি কি অন্ধ হয়ে যাব? অথবা, অচিরে পঙ্গু অসাড়, পক্ষাঘাতগ্রস্ত? এই ভয়। থেকে থেকে নিয়তিলিপি পাঠ করি, কিছুদিন থেকেই মনে হয়, কেবলই মনে হয়…অনেক শোধন বাকি, অনেক জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। কৃষ্ণযবনিকা পড়বেই, তার আগে, তার আগে যদি এই কৃত্য এই পাপবিমোচন লেখাটার উপযুক্ত সমাপন ঘটাতে না পারি—হে ঈশ্বর! বাবা তাঁর অনন্ত একটি রচনা রেখে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেছেন :
আমাকে। আমি রেখে যাব কাকে একথা যখনই ভাবি তখনই আক্রান্ত হই প্রবল পিপাসায়—জল, আকণ্ঠ তলিয়ে দেওয়ার মতো জল!
.
“তুমি কি নীচের ঘরে এখনও শুচ্ছ আনু একা-একা?” সুধীরমামা বলেছিলেন “একা-একা থেকো না। বিশেষ করে রাত্তিরে। না-হয় কাউকে ডেকে নিও। “
“কাউকে আমার দরকার হবে না”, তুমি বলেছ, আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে।
“না, মানে যদি ভয়-টয়—” সুধীরমামা কথাটা শেষ করার আগেই তুমি বলে উঠেছ “না, সুধীরদা কোনও ভয়-টয় আমার নেই। আমাকে যারা ছেড়ে গেছে তারা আমার কাছে আর আসবে না।”
লজ্জিত গলায় সুধীরমামা বলেছেন–”না, মানে আমি প্রণববাবুর কথা ভেবে বলিনি। তিনি পুণ্যাত্মা মানুষ, মুক্ত হয়ে গেছেন। সত্যি, শেষের দিকে অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছিল তাঁর। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।”
“তোমার পরিবর্তন হয়নি?” জিজ্ঞাসা করেছ।
“কই আর। কেবলই উখো ঘষছি। হালকা হতে পারলাম না।”
“অনেক রাত হল, এবার বাড়ি যাও সুধীরদা। কাছেই না কোথায় তোমার বাসা?”
“ওই একটা ডেরা আর কী।”
“একদিন গিয়ে দেখে আসব।”
“যাবে, তুমি যাবে? সত্যি, আনু! বলতে ভরসা হয় না। গেলে কিন্তু দেখতে, এখনও কী সাংঘাতিকভাবে জড়িয়ে আছি।”
“থাক। দেখে কী করব আর। সুধীরদা, মেঘ করেছে, বৃষ্টি নামবে বোধহয়।”
(কথাটাকে তুমি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলে?)
“হ্যাঁ, এইবার যাই।” সুধীরমামা বললেন, কিন্তু তখনই উঠলেন না।
উনি আসছিলেন, আসতে শুরু করেছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর থেকে, সেটাই স্বাভাবিক। তোমার মাসিমার সঙ্গে গ্রাম সুবাদে একটু-একটু পরিচয় ওঁরও ছিল।
আসছিলেন, কেননা এই সময়েই মানুষ প্রিয়জনের কাছে আসে, আসতে হয়, যদিও সব সময়ে কথা থাকে না। দূর থেকে, কখনও, বা কাছে এসে দেখেছি তোমাদেরও থাকত না। চুপচাপ অনেক সময় কেটে যেত। মিছিমিছি কতগুলো মামুলি সান্ত্বনার কথা আওড়ানো সুধীরমামার স্বভাবে নেই। তাই বারান্দায় দুটি মোড়া পাতা, দু’জন দুটিতে, কথা নেই, সূর্য ডুবল, বাগানের গাছগুলো থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো অন্ধকার ঝরে পড়তে থাকল, কথা নেই, অকস্মাৎ চাঁদ উঠে ফুল ফুটে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল, কথা বলছ না কেউ, বাসায়ফেরা পাখিদের কলরবে এমন তন্ময় হয়ে যাওয়ার মতো তোমরাই জানো কী আছে।
কানে দু’একটা কথা আসত মাঝে মাঝে, কোনও অসুখের, কিংবা ওষুধের। তোমার হাঁপানির কষ্টটা একটু কমেছে, সুধীরদা? আমার বাতের ব্যথাটা তো ক্রমেই বাড়ছে, বোধহয় অথর্ব হয়ে যাব। কী-একটা মালিশ আছে শুনেছিলাম না? আচ্ছা ওই যে ইতুগ্রামের সেই অবধূত, তাঁর কথা তোমার মনে আছে? হাঁপানির জন্যে নতুন কী একটা ওষুধ বেরিয়েছে শুনলাম একেবারে ধন্বন্তরি—অব্যর্থ। আচ্ছা সুধীরদা—
আমি কি মজা পেতাম অথবা ওই কথোপকথনের তাৎপর্য কিছুই কি বুঝতাম না? মাঝে কত বছর তোমাদের দেখা হয়নি, এতদিন পরে যা-কিছু আলাপ সব রোগ নিয়ে ডাক্তার, সালসা, মালিশ, ঘুরে ফিরে খালি ওই, আর কোনও কথা নেই? অবাক লাগত। আজ একটা মানে পেয়ে গিয়েছি বৈকি, শেষ বয়সে ওই হয়, পুরনো জীবনে ফিরে যাওয়া, চর্বিত-চর্বণ। অসুখটাই একমাত্র সূত্র দু’জনের ওইখানে কিছু স্মৃতি যা যৌথ, অসুখ নিয়ে কথামালা গেঁথে যাওয়াও এক প্রকার সুখ।
“এমনও হতে পারে সুধীরদা, ক্রমেই যেমন শক্তিহীন হয়ে পড়ছি, একদিন তুমি হয়তো এলে আমি আর বেরোতে পারলাম না। বারান্দা থেকেই তুমি ফিরে যাবে। তুমি যে এসেছিলে আমি টেরও পাব না। না—না, পাব, পাব। তোমার লাঠিটা ঠকঠক করবে তো, তাতেই আমি জানব। “
“কিংবা আনু, এ-ও সম্ভব যে, একদিন আমিও হয়তো আর এলাম না। শরীর আরও ভেঙে পড়বে, আর আসতেই পারব না। হয়তো আমি আর নেই, অনেক দূরে চলে গিয়েছি সেইজন্যেও। আমি যে নেই, তুমি জানতেও পারবে না।”
প্রতিবাদ করলে না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরে ধীরে বললে, “হতে পারেই তো। সবই হতে পারে। আচ্ছা, সুধীরদা, তুমি আর সেই ইস্টিশনে গিয়ে বসো না, যেখান থেকে নানা গাড়ি যায়, নানা দিকে?”
“যাই আনু। মাঝে মাঝে। সেখান থেকেই তো চলে আসি তোমাদের এখানে।”
“আমাকে একবার দেখিও তো। খুব ইচ্ছে করে!”
“বেশ তো। বাইরে একটু-আধটু বেরোনো তো ভালোই। ওতে তোমার মন শান্ত হবে।”
.
“ও কী করছিস?” উপর থেকে আমাকে নীচে চাদর-বালিশ নিয়ে নেমে আসতে দেখে বললে।
“আজ থেকে আমি এই ঘরেই শোব, মা। “
দুটি বিছানা কাছাকাছি, দু’জন দু’জনের নিঃশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। খানিক পরে তোমার গলা : “সুধীরদা যা বলছিল শুনতে পেয়েছিস বুঝি? তুই একটা পাগল। দ্যাখ, ভয় নেই। সে আসবে না। আর আসেই যদি তোর জন্যেই আসবে। আমার জন্যে না।”
মনে মনে বললাম, বাবা আসবেন না! তিনি নিষ্কৃতি পেয়েই গিয়েছেন। যযাতির গল্পটার সঙ্গে মিলিয়ে নাও না। ভোগের সাধ না মিটলে তবেই মানুষ চায় পুনর্যৌবন। তেমনই জীবনের সাধ যার মেটেনি, একমাত্র সেই আত্মাই চায় পুনর্জন্ম। সব সাধ থেকে মুক্ত হয়ে বাবা চলে গেছেন, তিনি আর আসবেন কেন। তুমি ভেবো না।
“তোকে সে বড় ভালোবাসত”, শুনতে পেলাম আস্তে আস্তে বলছ তুমি “তুই বড় হবি, সেই বিশ্বাসটুকুকে নিয়েই সে গেল। তার বিশ্বাস তুই নষ্ট করিস না। মানুষের মতো মানুষ হয়ে দাঁড়াবি, এই প্রতিজ্ঞা কর। দ্যাখ, আগেও এসব বলতাম খানিকটা নিজের জন্যেও, ভাবতাম তোকে ধরে আমি দাঁড়াব। আজ আর সে সব ভাবি না। আমারও বেশি দিন বাকি নেই আর—আমিও যাব! এখন তোকে যা বলছি, সে তোরই জন্যে।”
ঠিক তখনই দূরে জোরে জোরে কোথাও ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিল।
সেই ঘণ্টাধ্বনি থেমে গিয়েছিল নিশ্চয়ই, কোনও-না-কোনও সময়ে?—কারণ কিছুই বরাবর বাজে না। ভোরে অন্তত তার রেশও ছিল না। আমি আজও জানি না এক-একটা শীতল প্রহরে কোথাও, সচরাচর খুব দূরে, কোনও ঘণ্টা বাজতে শুরু করে কেন, আর বাজে যদি, কী হেতু থামেই বা। বেজে বেজে কী বলে, কোন্ কোন্ জট আর গিঁট খোলে, অথবা থামার পরেও কিছু বলতে থাকে কিনা। নিখিলে নিহিত এইসব রহস্যের কিনারা খুঁজে লাভ কী, খোঁজা তো কেবলই কষ্ট, তার চেয়ে মা যেমন অবোধ শুয়ে আছি, তাই থাকি না! ওই তো দ্যাখ, তাকাও জানালার বাইরে, তারার ধারায় আকাশটা ধুয়ে যাচ্ছে, চমৎকার। এই পর্যন্ত বেশ, কিন্তু আর-একটু যেই এগোতে যাবে, অমনই চমকাবে। টের পাবে, গতকাল যত তারা ছিল, আজ হয়তো তত তারা নেই, রোজ যত তারা অস্ত যায়, পরদিন ঠিক-ঠিক হয়তো তত তারাই ওঠে না, কে বলতে পারে প্রত্যহ একটি দুটি করে খোয়া যায় কি না-যায়। সেই লুপ্ত মৃত তারাদের কথা চিন্তা করা বৃথা। সব জেনে ফেলার অভিমান কাউকে কি সাজে, ওই সাধ শোভা পায় একমাত্র শিশু বয়সে।
কেন—কেন—কেন—আমাদের ছেলেবেলার মাঠটার সবটাই এই জিজ্ঞাসার চোর-কাঁটায় ভর্তি। আকাশ নীল কেন, গাছের পাতা কেন সবুজ, শিশুরা শুধায় আর হাততালি দেয়, মূঢ় বড়রা। আমিও পেয়েছি সুধীরমামা বলতেন, “তোমার ছেলে কি বুদ্ধিমান দেখেছ আনু, ও নিশ্চয়ই—” ইত্যাদি। আজ তো জানি, ছেলেবয়সের ইচ্ছাটাকে বেশি বয়স পর্যন্ত টেনে হিঁচড়ে আনাটাই অর্থহীন, শুধু কষ্ট পাওয়া। তুমি পেয়েছ, পেয়েছেন সুধীরমামা, আর আমি? আমার কথা থাক। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কত সাপের যে ছোবল পেয়েছি। ইতিহাসের গল্পটা তুমি জানো না মা। ভয়ংকর সত্যকে জানতে গিয়ে সে দংশিত হয়েছিল! আর রানী সুদর্শনাকে নিয়ে সেই নাটক? তুমি পড়োনি। ভয়ংকর রূপ স্বচক্ষে দেখতে চাওয়ার অহংকারে তার জীবনটাই জ্বলে যাবার জো হয়েছিল।
জানব কী, জানা যায় কতটুকু। জানার চেয়ে না-জানা অনেক বড়, ঢের বেশি পরিব্যাপ্ত। যেমন ‘হ্যাঁ’-এর চেয়ে ‘না’ কত ছড়ানো যতগুলি ‘হ্যাঁ’ আছে, তার সব কটা ছোট্ট মুঠোয় ধরে, আর ‘না’? ‘না’-এর ‘না’ উপছে উথলে নিরন্তর স্রোতে ভেসে যায়।
মা, সব জানতে গিয়ে তোমাকে কাঁদতে দেখেছি। সব জানতে চেয়ে কেঁদেছি আমিও। আমাদের মনে একটা করে কান্নার ঘর চিরকাল থাকে, সেই কোণে। সব কান্না ফুরিয়ে তোমরা সকলেই মুক্ত হয়ে গেলে, আমারটা এখনও ফুরোল না! কষ্ট আর কান্না দিয়েই তো আগাগোড়া এই লেখা।
কান্না কেন? কষ্ট পাই বলে। কষ্ট—প্রাপ্ত কিংবা সৃষ্ট, দুই-ই। অথবা কৃত অন্যায়ের জন্যে পরে কান্না। অপরাধগুলিই সকলে দ্যাখে, কিন্তু অনুশোচনা? কেউ দ্যাখে না।
যেহেতু সেই ঘণ্টাধ্বনি থেমে গিয়েছিল, আমি তাই অপরাধের ঢালু রাস্তায় নেমে যাচ্ছিলাম। তুমি অনুমান করতে, কিন্তু তখন অনেক সেয়ানা আমি আর খুব সাবধান, ধরতে পারতে না। খালি বুঝতে যে, একটা কিছু ঘটছে তোমার নজরের পরিধির বাইরে, নিষ্পলক দৃষ্টি দিয়ে আমাকে দণ্ডিত করা ছাড়া আর কিছু তোমার সাধ্য ছিল না।
কী ছিল বুলার, যার সম্মোহন বলে সে আমাকে নিয়ত একটা কষ্টের গর্তের মধ্যে টেনে নিয়ে যেত? কী ছিল না রজনীর, রজনীগন্ধার, ওই শুভ্রতা আর সুবাসটুকুই কি তার সম্বল, শুদ্ধতাই কি স্বাদহীনতা? যেমন ঠান্ডা এক গ্লাস জল, জানি তৃষ্ণা মেটাতে ঠান্ডা জলের কাছে কিছু না, তবু ঠান্ডা জলে সব সময়ে পিপাসা মেটে না, সব পিপাসাও না, জানি, জানি, তবু জেনে শুনে বিষ পানের মতো, কিন্তু বুলা কি বিষ, কত বিষই না এইমতো আমরা ঠোঁটে ছোঁয়াই, আর আবর্তের মধ্যে পড়ে গিয়েছি আমি, পৃথিবীতে তবে সুধা কোথায়, সুধা কী, সুধা কি একমাত্র যিনি মূল তিনি, যাঁর প্রতিরূপ জননী, সেই রক্ষয়িত্রী, বিশাল প্রতিমা, মাতৃমূর্তি—মা অথবা যে রমণীরা মাতৃস্বরূপিণী? ‘শ্রীচরণেষু তোমাকে’, সেই সত্যেরই অন্বেষণ, মুক্ত যদি না-ও হতে পারি, স্থিত হতে চাই আমি, অন্তত প্রত্যাবৃত্ত।
একটি পাপের কথা লিখব বলে এত ভণিতা অথচ লেখার ঠিক মুখে বেনো জলের প্রক্ষিপ্ত রাশি রাশি কথা ঢুকে যাচ্ছে, আসলে ওটা কি এড়িয়ে যাবার ছুতো? ঘণ্টা-ধ্বনি ইত্যাদির প্রসঙ্গ তুলতেই হত না, যদি না শেষ মুহূর্তে সঙ্কোচ এসে সব বিপর্যস্ত করে দিত। বাধছে, তোমাকে লিখতে বাধছে। অথচ এসব ঘটেছে তুমি যখন জীবিত। তখন যা করতে আটকায়নি, আজ তা বলতে বাধে কেন। অস্বস্তি, ভয়? জীবিত মা’র চেয়ে তবে আমি মৃত মা’র ভয়ে বেশি ভীত?
তবু পরিত্রাণ নেই, লিখতেই হবে।
ছোট ছোট হাততালি দিয়ে বুলা বলল, “বুলা যাবে, বাঁশি যাবে, সঙ্গে যাবে কে?”
“কোথায়?”
“বাঁশি বলছিল কাল ওর জন্মদিন। ভাবছি একটা আউটিং করলে মন্দ হয় না! ধর, গঙ্গার ওপারে, আমার এক বন্ধুর ছোট্ট একটা বাংলো আর বাগান আছে। তাই বলছিলাম, বুলা যাবে, বাঁশি যাবে, সঙ্গে–“
কিছু না ভেবেই ফস্ করে বলে বসলাম, “আমি।”
৩৪
ভুরু কুঁচকে বুলা বলল, “তুই—তুই যাবি কেন?” ভুরু কোঁচকাল, যদিও সন্ধ্যার অল্প আলোতেও ওর ঠোঁটে বাঁকা হাসি দেখা যাচ্ছিল। ছাদে মাদুর পেতে বসেছিলাম আমরা, বাঁশি আধশোয়া, ওর বাবরি চুলওয়ালা মাথাটা হেলে প্রায় বুলার কোলে, চোখ আধবোজা বাঁশির, সম্ভবত কোনও সুখে, বুলার পা দুটি ছড়ানো, দুটি পায়ের পাতা যেখানে শেষ, সেখানে আমি। আমি উপর দিকে চেয়েছিলাম। বুলা তখন ভ্রূভঙ্গি করে বলল, “তুই যাবি কেন”, সঙ্গত কোনও উত্তর না পেয়ে বলে ফেললাম, “কষ্ট পেতে।” একেবারে মিথ্যে বলিনি। ওদের দু’জনকে এতটা কাছাকাছি দেখলেই—জানি ওই সম্পর্কটা কিছু নয়, ভুয়ো, তবু—আমার গলার কাছটায় শুকনো একটা শিখা জ্বলতে থাকত, তার নাম হিংসা, আর তখন, সেই ছাদে পা মেলে দিয়ে বুলা আমাকে যা দিচ্ছিল, সে-ও মানসিক-শারীরিক মিশিয়ে এক রকম দুঃখ। এক হাতে বাঁশির লম্বা লম্বা চুলগুলো টেনে টেনে সোজা করছিল সে, আর ওই একই কালে ওর টকটকে পায়ের নখ বিঁধিয়ে দিচ্ছিল আমার কব্জিতে! বুলা এই সব খেলা পারত, আমার নরম মাংসে বিঁধছে, তবু সরে বসছি না আমি, শারীরিক ক্লেশ, হোক, একটু—একটুই তো। ওই নখের ছোঁয়াটুকু সরে গেলে ক্লেশ আরও পাব। সেই বশীভূত বয়সে এই সব সহ্য করেছি আমি কতদিন, কত স্বাদ, যা নোন্তা আর তিক্ত, রক্তাক্ত বা ঘর্মাক্ত।
বলতে কী, যতক্ষণ বুলা পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিচ্ছিল, ততক্ষণ যতটা, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেলাম, যখন সে হঠাৎ একটা নাচের ঘূর্ণির মতো ঘুরপাক খেয়ে উঠে গেল।
কার্নিসে ভর দিয়ে পলকে অবলীলায় সারস হয়ে গেল বুলা, সেই সন্ধ্যাকালে যখন অজ্ঞাতকুলশীল এক-একটা হাওয়া হঠাৎ সহসা উঠে এসে অতিকায় অথচ অদৃশ্য কোনও তিমি বা কুমিরের মতো পিঠ পেতে দেয় শুধু পাখিদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বলে, নইলে পাখিরা ঘরে ফেরার সময়ে আকাশ পেত না। কিংবা ভেসে ওঠা কুমির নয়, সেই হাওয়ারা দৈত্যকুলোদ্ভব, দুর্বৃত্ত—তারা অশালীন হস্তক্ষেপে ব্যস্ত করে যতেক ডালপালাকে। যে পাতারা কচি তারা সুখে অস্থির তিরতির করে ওঠে, কিন্তু কুড়মুড় ভাজার মতো ভাঙে সেই সব পাতা, যারা বীত-দীন, পীত। আকাশ তখন জ্যোৎস্নায় শুক্ল, অনেক দূরে আর বিপদের বাইরে বলেই সে হাসছিল, যেন কোনও সহাস্য রমণী, যে সাহসিকাও; এক-গা গহনা, তবু তার ছিনতাইয়ের ভয় নেই।
“আমাদের এই ছাদে ফুল ফোটে না। এখানে খালি চৈত্রর ক্যাকটাস, আর কোনও কোনও বর্ষায় ক্যানা!”
বুলা বলছিল, কার্নিসে বুক ঠেকিয়ে ঝুঁকে, এক প্রকারের ছুঁচলো পুলকে। অথবা সে গলায় আঙুল ডুবিয়ে বমি করার মতো, খেদকে বাইরে টেনে এনে বলছিল, তার স্বরে বিজড়িত হয়ে যাচ্ছিল শ্লেষ্মা, সর্দি প্রভৃতি যা কিছু অনুষঙ্গ; সে-স্বর তো নয়, যেন গোটা কতক চিড়চিড়ে চড়ুই, এবং তাদেরই গলা নকল করে বুলা বলছিল, কী বলছিল? বলছিল যে, ওদের ছাদে ফুল ফোটে না।
হাত বাড়িয়ে দিল বুলা, যেন এক জাদুকরী, সেই ইঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল বাঁশি, সেই দেখতে সখি-সখি বাঁশি এখন হতে চায় সখাসম, সেও দিল হাত বাড়িয়ে যদি পারে বুলাকে ছোঁবে, বুলা কি ধরা দেবে, এই তো দিল, না, দিল না দুটি চেষ্টা তার একটি কপট একটি প্রকট, কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো কেমন বেঁকে রইল, অসমাপ্ত একটা সাঁকো এখন দু’জনের মধ্যে ঝুলন্ত মাঝের ফাঁকটাতে ইচ্ছা-অনিচ্ছার, ছলায়-কলায় মিলে বুড়বুড়ি তৈরি হচ্ছে বালতিতে সাবানের টুকরো-গোলা জলে যে রকম বুড়বুড়ি হয়, ব্যক্ত আর অব্যক্ত ধরনে, আমি তাই দেখেছি—আমি দর্শক, সাক্ষী আমি। সেই ক্ষণে অন্নদাস আবার অন্নদাস হয়ে গেছি।
বুলা একটু আগে বলেছিল কিনা ফুল ফোটা-না-ফোটার কথা, তাই তারই খেই ধরে সেই অন্নদাস বোকার মতো বলে উঠল, “একটি ফুল কিন্তু ফুটেছে!” রজনীকেও অনেক দিন আগে যা বলেছিল।
বুলা সরে এসে জ্যোস্নায় ওর হাসি বিকশিত করে হাসল—”ফুল? না বোধ হয়। সজনের ডাঁটাও তো হতে পারি।…জানো, আগে সত্যিই একটা সজনের গাছ ছিল এখানে, আমরা যখন এ-বাড়িতে এলাম। রোজ ছাদে উঠে ফুল পাড়তাম। রোজ ওপরে ওঠা তখন থেকেই অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেল। গাছটা মরল, কিন্তু অভ্যেসটা থেকে গেল। এখনও রোজ উঠি সকালে কিংবা বিকালে।”
সেই শুক্ল জ্যোৎস্নায় বিকশিত হয়ে বুলা বলল, “ফুল যদি দেখতে চাও, তবে চলো ওই বাংলোতে; ওখানকার বাগান ভরে আছে দেখতে পাবে।”
(বুলা আমাকে, তুমি বলত কখনও-কখনও; আবার পুরনো অভ্যাসে তুই-ও। গুলিয়ে ফেলত।)
“তুমি তো গ্রামের ছেলে, ফুল টুল নিশ্চয়ই খুব ভালোবাস?”
ভাঙা গলায় বললাম, “বাসতাম, যখন তার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু বেরিয়ে এসেছি বুলা, আমি শহুরে হয়ে গিয়েছি।”
“ফুল টুল আর ভালো লাগে না তোমার?
“লাগাতে চাই। নতুন করে আবার। হয়তো কোনওদিন পারব। ফিরে ফিরে যাব। বুলা, গোবিন্দলালের গল্পটা তো পড়েছ, সেই ভ্রমর, আর রোহিণী? রোহিণী হল শহর।”
“আর ভ্রমর হল গ্রাম—পল্লী?”
“গোবিন্দলাল ভ্রমরের কাছে ফিরতে চেয়েছিল।”
“কিন্তু পারেনি।”
(বুলা নিতান্ত নিশ্চিত স্বরে দুটি মাত্র শব্দ সেদিন উচ্চারণ করেছিল, ও কি তখনই জানত যে ও ত্রিকালজ্ঞ ডাকিনী? এক ব্যক্তি, একদা যেচে বর নিয়েছিল তার অন্য সত্তায় রূপান্তরিত হবে বলে, সে পরবর্তী-কালে ধার করা মেকি মুখোশটা খুলে নাও, আমাকে আমার স্বভাবী রূপ ফিরিয়ে দাও বলে কাতর মিনতি জানাচ্ছে সেই বরদাতা দেবতাকে, কিন্তু বিমুখ দেবতা কিছুতেই ফিরিয়ে নিলেন না তাঁর বর—অথবা তখন যা বর নয়, অভিশাপ—এই বিষয়বস্তু নিয়ে একটি উপন্যাস রচনা করেছিলাম আমি, কিন্তু সেটা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তবু ওই ব্যর্থ প্রার্থনার থিম্-টা ফিরে ফিরে আসে। নগরবাসে জর্জরিত এক আত্মা বার বার অগত্যা নিয়ম করে প্রকৃতির কাছে প্রত্যাবর্তন করে, এক মাস দুই মাস পরে পরেই—কখনও পর্বতে, কখনও বনে, কখনও সমুদ্রতীরে; তার উদ্দেশ্য কী? সে-ও আমার পৌনঃপুনিক বিষয় আর একটি : গ্লানি প্রক্ষালন করে শুদ্ধ হতে। ক্লান্ত ফুসফুস সবুজ পত্রপল্লবের কাছে যেমন অক্সিজেন বাঞ্ছা করে! )
বাঁশি একটু আগে নীচে নেমে গিয়েছিল, গাড়ি-টাড়ি ঠিক করবে বলে; সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বুলা একটা হাত রাখল আমার কাঁধে। —”কাল আসিস। দেখিস, ওখানে তোর ভালো লাগবে। আমার আজকাল কষ্ট টষ্ট বেশি হয় না তো, তবু জানিস, তুই যখন বলছিলি একটু আগে যে, তুই শহুরে হয়ে গিয়েছিস? আমার বুকে ধাক্কা লেগেছিল। “শহুরে” কথাটা যেন ভালো মতো শুনতে পাইনি। কী শুনছিলাম জানিস? বললে তুই রাগ করবি। মনে হল তুই যেন বলছিস ‘বেশ্যা হয়ে গিয়েছি।’ দুঃখ পেলি তো? পাস্ না। আমিও তো একদিন তোকে বলেছিলাম যে ট্যাক্সি হয়ে গিয়েছি, বলিনি?”—বলে বুলা আমার পিঠে হাল্কা একটা হাত রাখল।
সেই বুলাই তৎক্ষণাৎ নীচে নেমে গেছে তরতর করে, বাঁশি বসেছিল গাড়িতে, তার গালে আলতো একটা চাপড় মেরেছে, ঢলঢল হয়ে-বলেছে, “কাল খু-উ-ব ভোরে কেমন?” আমার দিকে চেয়ে, “তুই-ও আসিস।”
বুলাকে আমি বুঝিনি। বুঝিনি বলেই কষ্ট পেয়েছি বেশি। তবে কষ্ট পাওয়াও একটা নেশার মতো মনে হয়ে যায়, কষ্টের দাঁত একটু একটু করে বসে মাংস-মজ্জা ছাড়িয়ে আরও অন্তর্লীন কোনও স্তরে; সে-ও সুখ, একটু বিকৃত, তবু পেতে ভালো লাগে—মা, কতকাল থেকে আমি যে জানি যন্ত্রণাও আমাদের জীবনে নিমন্ত্রিত।
.
রজনী যে-ই শুনল, অমনই তার ভাসা-ভাসা চোখ তুলে বলল, “আমি যাব না? নিয়ে যাবে না আমাকে?” আমার কিছু বলার অধিকার ছিল না, কিন্তু বাঁশিকে বলতেই সে রাজি হয়ে গেল। ভালোবাসার বিশ্বাস বাঁশিকে বড় উদার করেছে।
নৌকো-বাঁধা ঘাটে রজনীকে দেখে হাসল বুলাও, কিন্তু আসলে হাসতে চেষ্টাই শুধু করল। যদিও বুলার মুখে মেঘের লেশমাত্র ছিল না, পাটাতনে উঠেই সে শাড়িসুদ্ধ পা ডুবিয়ে দিল জলে, তারপর আড়চোখে এদিক-ওদিক চেয়ে সেই জল নিংড়ে নিংড়ে নিল বের করে; যদিও সে চলন্ত নৌকো টলমল করে দিয়েই এক পাক উঠল নেচে, অপাঙ্গে ভ্রূভঙ্গি ইত্যাদি সব-কিছু করে বলল, “দেখলে কত অল্প জায়গাতেও ঘুরে যেতে পারি, একে বলে বল্-বেয়ারিং কোমর ইলেকট্রিক পাখায় আর সব নাচজানা মেয়ের কোমরেই থাকে”, তবু সে সত্যিসত্যি হাসছিল না আদৌ, ও-পারে আমরা যখন বাংলোটাতে গিয়ে পৌঁছলাম, তখনও না।
সেই বাগানে পৌঁছে সবটাকেই আমোদ আর ফুর্তি দিতে আমি বললাম, “যদি তোমাদের দু’জনকেই আমি দুটো ফুল তুলে দিই, তোমরা কী করো?”
রজনী আস্তে আস্তে বলল, “চুলে পরব, আবার কী?”
আর বুলা বলে উঠল, “আমি চটকাই।” বলে, সে সত্যিই একটা ফুল তুলে দু’আঙুলে তার সব ক’টা পাপড়ি চটকে ফেলল। তারপর কোথা থেকে মালিকে ডেকে বাংলোর দরজা-জানালাগুলো পটাপট খুলে ফেলল।
কিন্তু বদলে গিয়েছিল রজনী। সেই ফুলের বাগানে গিয়ে সে অতিশয় উৎফুল্ল হয়ে গিয়েছিল। চটিটা সে খুলে ফেলল প্রথমেই, খালি পায়ে ঘাসে ঘাসে ঘুরল। কিংবা তখন তার পা দুটিও বুঝি ছিল না, বা না থাকলেও চলত, কেন না সে পাখির মতো হয়ে গিয়েছিল। আলো পেলেই যার ডানা আপনা থেকেই মেলে যায় সেই পাখি।
“খুব ভালো লাগছে, সত্যি।” আয়ত চোখ তুলে সে বলল। একটু উঁচু হয়ে নুয়ে-পড়া একটা গাছের পল্লব পাড়ল। নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিয়ে তারপর বলল, “কী সুন্দর।” কৃতজ্ঞতা তার চশমার পুরু কাঁচ ভেদ করে উঠে আসছিল। — “কই ঝাপ্সা নেই তো কিছু। ঠিকই দেখতে পাচ্ছি। আমার ভাবে। গন্ধ ছোঁয়া, এসব দিয়েও অনেক পাওয়া হয়ে যায়।”
“হয় বুঝি?” একটু রহস্য-মতন করে বললাম।
“তোমরা বুঝবে না”, বলে সে আবার ঘ্রাণ নিতে থাকল, বুকের কাছে গুচ্ছ করে ধরা সেই পল্লব, যার প্রতিটি পত্র দীর্ঘ টানাটানা নয়নোপম।
এমন সময় পিছনের বারান্দা থেকে বুলা আমাকে ডাকল। প্রথমে ইশারায়, পরে হাতছানি দিয়ে। ও যখন হাতছানি দেয় তখন ওর হাতটা ছোট্ট একটা ছোবল-তোলা সাপের মতো হয়ে যায়।
একটি ক্রীতদাস সেই হাতছানিতে গুটি-গুটি এগিয়ে গেল।
“কেন এনেছিস, কেন এনেছিস ওটাকে”, বুলা বলল, সাপেদের গলায় ভাষা থাকলে তারা যে-স্বরে বলত।—”ও কি তোর রক্ষাকবচ, রক্ষা করবে তোকে?”
আমি কথা বলছি না দেখে; আমি কথা বলব না বুঝে নিয়ে, সে আমাকে ঝাঁকুনি দিতে থাকল।—”কী পেয়েছিস তুই ওর মধ্যে? ও ফরসা, তাই? শুধু রঙ?”
আস্তে আস্তে আমিও তখন বললাম, “আর তুমি? তুমিই-বা কী পেয়েছ বুলা ওই ছেলেটার মধ্যে, ওই মাকাল ফলটার কী আছে?”
টাকরায় জিভ ছুঁইয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ বের করে বুলা বলল, “টা–কা।” বলেই নিষ্ঠুর কোনও কিরাতরমণীর মতো হিংস্র হয়ে সে আমার গালে একটা টোকা দিল।—”তোর যা নেই, সেই টাকা। নেই বলে ওদের ওখানে পড়ে আছিস। আমি সব জানি। দাঁড়া, ওকে মাকাল ফল বলেছিস, তোর বন্ধুকে এক্ষুনি বলে দেব আমি।”
বুলা চোখ টেরচা করেছিল, থেকে থেকেই আমাকে নিয়ে মজা করার জন্যে, ইঁদুরকে নিয়ে বিড়াল যেমন মজা করে, বলতে থাকল, “যদি বলি, যদি বলে দিই?”
ওই দু’টি কথা ভয়ংকর একটা বোল্লার মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি ভয় পেয়েছিলাম। বাঁ পা একটু বাড়িয়ে বুলা আমার পায়ে আঘাত করল।—”বেইমান, বদমাশ, যে খেতে পরতে দিচ্ছে, তাকে তুই মাকাল ফল বলিস, তুই নিজে কী জানিস? তুই-ও তাই। ওই মেয়েটার পেছনে হ্যাংলার মতো ঘুরছিস, পুজো করছিস, ফুলটুল দিচ্ছিস। তার মানে তুই যে ওর চাকরের মতো, সেটা ভুলতে পারিস না। তার ওপরে উঠতেও পারছিস না। শোন, মেয়েরা ফুলটুল চায় না, যে দেয় তাকে বড় জোর করুণা করে। ওই মেয়েটা, ওই কিশমিশ, আমি তোকে বলে রাখলুম, নির্ঘাৎ তোর হ্যাংলামির জন্যে তোকে ঘেন্নাও করে। ও তোকে ভালোবাসবে, যদি—যদি তুই জোর করে ওর সব কিছু ছিনিয়ে নিস, ঝাঁপিয়ে পড়িস দস্যুর মতো। সে-সাহস তোর হবে?”
বুলা হাঁপাচ্ছিল, বুলা দাঁতে একটা কাঠি কাটছিল।
কিশমিশ আসছিল এই দিকেই। তাকে আবার দেখতে পেয়ে বুলার চোখে যেন আগুনের একটা ফিনকি ছুটে গেল। চাপা গলায় বলল, “আয়, একটা মজা করি ওকে নিয়ে।”
কিশমিশ তখনও কিছু দূরে, বুলা অকস্মাৎ সেই কাণ্ডটা করল। কী করছে টের পাওয়ার আগেই দেখি সে আমাকে সাপটে নিয়েছে তার বুকের মধ্যে, তার ঠোঁট, তার জিভ, আর দাঁত—তারা কোথায় ছিল, কী করছিল, যতই কেন না স্বীকারোক্তি হোক, আমি এখানে লিখি কেমন করে! বুলা ওই কাণ্ডটা ঘটাল। না, না, মিথ্যে কথা লিখলাম মা, ঘটালাম আমিও। আমিও যে শরিক হলাম, সুখ নিলাম, লেপটে রইলাম। সেই পাপের উপরে অবাধ্য শরীরটার লুব্ধ হওয়ার কথাটা চেপে যাওয়া আরও মহাপাপ হবে।
রজনী কিন্তু শেষ পর্যন্ত এদিকে এল না, খানিকটা এসেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল, হয়তো কিছু শুনল, দুপুরের কোনও হরিয়ালের ডাক কি অন্য কিছু, তারপর আস্তে আস্তে অন্য পথ ধরল।
বাংলোটার বাবুর্চিরাও তখন সুস্বাদু এক পাখির মাংস চড়িয়ে থাকবে ডেকচিতে। কাঁচা কয়লার ধোঁয়া, তা-ছাড়া পেঁয়াজ-রসুন-মশলা মাখানো হলদে সুগন্ধে তখন চারদিক আমোদিত হয়ে উঠছিল।
বীভৎস স্বরে বুলা বলল, “কী মজা, কী মজা। কানিটা কিছু দেখতে পায়নি। একটা অন্ধ মেয়ের চোখের সামনে তার প্রেমিককে নিয়ে যা-খুশি তাই করা যায়, না? এইটেকেই বলছিলাম মজা।”
আমার দুটি হাত ছিল আমার গালে। ঘষে ঘষে বিষাক্ত কয়েকটি দাঁতের দাগ তুলে ফেলতে চাইছিলাম।
.
এর পরেও দুপুরটা স্বাভাবিক ভাবেই কাটল, যদিও গুমোটটা যাচ্ছিল না, আমরা পাতা পেড়ে খেতে বসলাম, রান্না হয়েছিল অতি চমৎকার, তাতে আবার মাংসর খুসবু ছড়াচ্ছিল, যদিও আমি আড়-চোখে মাঝে মাঝে চেয়ে দেখছিলাম রজনীকে, সে কি দেখেছে, কতটুকু দেখেছে, কিন্তু রজনী স্থির, নিজের মধ্যে নিজে সংবৃত ধীর, কথাও বলছিল সে, এমন-কী বুলার একবার কী একটা রসিকতায় হেসেও উঠল। আমি স্বস্তি পাচ্ছি, খুনি যেমন কোনও চিহ্ন রেখে যায়নি সে-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হলে আশ্বস্ত হয়।
খেতে খেতেই বাঁশি বলল, “আমার জন্মদিনে বুলা, তুমি আমাকে কিছু দেবে না।” বুলা বলল, “দেব, দেব। সঙ্গে এনেছি। খাওয়া দাওয়া সারা হোক, তারপর।” কী এনেছে, বুলা ভাঙল না।
খাওয়া শেষ, তখনও খুব বেশি বেলা হয়নি। তেজিয়ান ঘোড়ায় চেপে সূর্য সবে মাথার উপরে এসে দম নিচ্ছিল। বুলা চোখে কালো একটা চশমা এঁটে বলল, “এই সূর্যটা কেমন বল্ তো?—পুরুষদের মতো শয়তান। প্রথমে খুব মিষ্টিমিষ্টি থাকে, নরম। আস্তে আস্তে ভীষণ হয়ে যায়, প্রেমিক থেকে ক্রমে ক্রমে অত্যাচারী স্বামী! “
মৃদুস্বরে, কিন্তু ওকে বুঝতে দিয়ে বললাম, “ভীষণ কিন্তু বুলা, মেয়েরাও কম হয় না।” বুলা বলল, “হবে না কেন, হয়। তবে যারা স্ত্রী হতে পেরেছে, তারা কমই হয়। হয় তারা, যারা কোনওদিন কিছু হবে না—স্ত্রী না, মা না, যারা কারও মেয়ে ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু পরে তা-ও থাকে না। তারা হিংস্র হয়, ভীষণ হয়, তুমি যা-যা বললে, তা-ই। পারলে তারা সব ধসিয়ে দিয়ে যায়।”
বুলাকে তখন ওদের ছাদের সেই ক্যাকটাস গাছের মতো লাগছিল।
“এবার—এবার কী?” বুলা নিজেই বলল, খানিক পরে, কোমরে হাত দিয়ে বিজয়িনী-বিদ্রোহিণীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে।
“এবার? এবার গান।” বোধ হয় বাঁশিই বলল ম্রিয়মাণ স্বরে। “বুলা—আমি হারমোনিয়াম ছাড়া গাই না।” তখন আমি যখন রজনীর দিকে তাকালাম সে মাথা নিচু করে বলল, “আমি আমি তো গান জানি না।”
তবে তাস? আনা হয়নি। তা-ছাড়া আমি আর বুলা ছাড়া তাস খেলা কেউ জানে না। সেই সময় বুলা—হঠাৎ—তলোয়ারের মতো হাতখানি নিষ্কাশিত করে দিয়ে বলে উঠল, “সিগারেট আছে, সিগারেট?”
রজনী অবাক চোখ তুলে তাকাল। আমি আর বাঁশি সমস্বরে বললাম, “তুমি খাবে?” বাঁশি কাঁপা-কাঁপা হাতে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিল। বুলা নিপুণ কায়দায় ধরাল সেটা, কিন্তু একটা দুটো টান দিয়েই ফেলে দিয়ে বলল, “থুঃ!”
একটু পরেই “চৌকিদার-চৌকিদার!” চেঁচিয়ে সে ডাকছিল, শুনলাম। তার হাতে একটা টাকা দিয়ে বুলা অক্লেশে ফরমাশ করল, “চুরুট।”
তার আগে তখনকার দিনে চৌরঙ্গী এলাকায় সিনেমা-টিনেমাতেই খালি মেমদের দু’চারজনকে যা সিগারেট খেতে দিয়েছি। চুরুট? কখনও না। ভাবাই যায় না। বোঝাই যাচ্ছে বুলা আজ সংহাররূপিণী, সব কিছু সংস্কারকে গুঁড়িয়ে মাড়িয়ে দিয়ে ধাঁধিয়ে দিতে চাইছে আমাদের। সকালে একটা ফুল চটকানো দিয়ে যে-দিনের শুরু, তার উপযুক্ত উপসংহার সে টানবেই।
অত্যন্ত বিশ্রী কায়দায় দুটো ঠোঁটের মধ্যে একটা চুরুট চেপে ধরে ধরিয়েছিল, তার পাশে আমরা দুটি ছেলে; খাচ্ছি ফ্যাকাশে-ফরসা-লিকলিকে সিগারেট— প্যাকাটির মতো সরু ওই ধূমায়িত বস্তুটাকে অকিঞ্চিৎকর লাগছিল। লাগল বলেই রোখ চেপে গেল আমার—উঠে দাঁড়িয়ে ভাঙা ঘড়ঘড়ে গলায় বললাম, “দাও, বুলা, আমাকেও একটা চুরুট দাও।”
“তুই! খাবি!” সে বেঁকে দাঁড়িয়েছিল, বাঁকা থেকেই তখনই সোজা হয়ে গেল, ঠিক আমার নাক তাক করে একটা ছুঁড়ে মেরে বলল, “নে–।”
এক অঘোষিত লড়াইয়ে নেমেছি দু’জনে, অলিখিত কোনও প্রতিযোগিতা। এক টান, দু’ টান, তিন টান—জমে যাচ্ছে, ধোঁয়া, পুরু ধোঁয়া আমার মগজে, ধোঁয়া, আমার বুকে, হৃদয়ে, জমে পাথর হয়ে যাবে নাকি, ধোঁয়ারই কি জমাট রূপ বাঁধা থাকে পাহাড়ে, ভূপৃষ্ঠের কোথাও কি তবে বৃহৎ কোনও চুরুট নিহত, আমরা দু’জনেই এই মুহূর্তে ধূমায়িত, বুলা আর আমি—চোখে জ্বালা, তার দৃষ্টিকে নিবিয়ে জড়ানো গলায় শুনলাম বলছি, মানে বুলাকে বলছি আমি, “জোরসে, বুলা, জোরসে। ওই কলের জলটাকে হারিয়ে দেব।”
খানিক দূরে, ওই প্রেক্ষাপটেই একটা কারখানার চিমনি আরও অনর্গল প্রবল, আরও সাহসী ধোঁয়া উদ্গার করে চলছিল। ইশারায় বুলাকে বললাম, “আমরা ওর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছি নাকি?”
বুলা সতেজে বলে উঠল, “দূর! আমরা এখন আগ্নেয়গিরি। কী ছড়াচ্ছি বল তো! লাভা, লাভা, সোরা, ধুনো, গন্ধক, এই সব—আরতিতে যা লাগে। সে সত্যিই যেন কোনও অশ্ৰুত আরতির বাজনার তালে তালে জানু-জঙ্ঘা কটি বক্ষ-গ্রীবা-করবী সমেত হেলে দুলে নাচের ভঙ্গি করছিল। তার দাঁতে চেপে ধরা চুরুটটা বিকালের ময়লা বাতাসে লাল অক্ষরে কিছু অপাঠ্য কথা লিখে, মুছে, ফের লিখছিল।
ধোঁয়ার ঝাপটায় বুলার চোখ জ্বলছে, ফলে একটু লালচেও, বলে উঠল, “ওই চিমনিটার সঙ্গে তুই আমাদের তুলনা দিলি? আমরা পুজো করছি, মানে আরতি তো! ওই একই হল। আর চিমনিটা করছে কী? না, কালো কালো কতগুলো কেচ্ছা ছড়াচ্ছে…চেয়ে দ্যাখ!”
এক মুহূর্ত চেয়ে দেখে বললাম, “ওর বুকের যত কষ্ট, কালিঝুলি যত, সব বের করে দিচ্ছে, বুলা, ব্যাপারটা তাও-তো হতে পারে! “
“আমি এসব মানি না”, একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বুলা বলল, “আমি এখন বিকেলের এই মরা আলোটাকে একদম ঢেকে দেব, চারিদিক ধোঁয়ায় ধোঁয়াক্কার হয়ে যাবে”, ক্রুর কুটিল কোনও প্রতিশোধ তোলার মতো ভয়ংকর একটা ভঙ্গি করে সে বলল, বলেই সন্ধ্যা যেন আরও ঘনিয়ে এল, আমার মাথা হঠাৎ চরকির মতো এক পাক ঘুরে গেল, ধোঁয়া, অন্ধকার কিছু দেখছি না, বুলা হেসে উঠেছে শুনছি, বলছে, “এই ছেলেটা ভেলভেলেটা! তুই যে লাট্টু হয়ে যাচ্ছিস! দুয়ো, হেরে গেলি”—বলেই বুলা তরতর করে দৌড়ে বাংলোটার পিছনের দিকে বারান্দায় অন্তর্হিত হল।
তখন আর আমার মগজে বিন্দুমাত্র ধোঁয়া অবশিষ্ট নেই, চোখ স্থির ঘাসের নরম আসনে বসে আমি স্বচ্ছ শ্বাস নিচ্ছি। পাশে এসে দাঁড়াল যে, তাকে ধরে আমি উঠতে চেষ্টা করলাম। “রজনী, আমার মাথাটা কেমন—” লাজুক কৈফিয়তটা আপনা থেকেই বেরিয়ে এল।
“জানি, তুমি চুরুট খেয়েছিলে।”
“বুলা দিল যে!”
“দিলেই বুঝি খেতে হয়?”
“ও যে অফার করল। ভেবেছিল, পারব না। আমি ছেলে তো।”
সে হেসে বলল, “অফার পেলেই বুঝি নিতে হয়! সত্যিকারের ছেলেরা ফিরিয়ে দিতেও জানে, ওইখানেই তাদের জোর, মনের জোর।”
“আমি পারি না। কেমন রোখ চেপে যায়। ‘না’ বললে পাছে ওরা ঠাট্টা করে। তাই যে যা বলে, তাই করি। কিছুমাত্র না ভেবেই টলে যাই। ঢলে পড়ি।”
মন আর মমতা দিয়ে শুনে সে বলল, “এটা দুর্বলতা, আসলে একটা রোগ।”
তার একটি হাত নিজের হাতের মধ্যে টেনে বললাম, “তুমি সারিয়ে দাও।” সে বলল “দেব।” অস্পষ্ট আলোয় তাকে আশীর্বাদিকার মতো লাগছিল। সে কি আরও কাছে আসছিল তখন, তার শ্বাস আর আশ্বাস নিয়ে, সেই মুহূর্তে পরিপূর্ণ স্নায়ুজালে সম্পূর্ণরূপে ধৃত আমি সম্ভাবিত ঘনিষ্ঠতায় ভীত, হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বলে উঠেছি, “রজনী, আমার মুখ তেতো!”
সে পৃথিবীর পবিত্রতম হাসিটি হেসে তখন বলল, “চুরুট খেয়েছ বলে? আর খেয়ো না।”
স্বীকারোক্তির আবেগ আমাকে পেয়ে বসেছে, তাড়াতাড়ি বলেছি, “শুধু কি চুরুট? তারও আগে…দুপুরে…আমার মুখ এঁটোও হয়ে আছে রজনী, তুমি জানো না।”
সে বলল, “জানি। বরং তুমিই জানতে না–“
“কিন্তু তুমি—তুমি তো ছিলে দূরে। তাছাড়া তোমার—” কথাটা কীভাবে বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না, তাই অনাবশ্যক শব্দের পরে শব্দ; বেড়েই চলেছিল।
“আমার চোখের জ্যোতি কম, তাই বলছ তো। আমার চোখ দুটো তবু তো পুরোপুরি যায়নি। গেলেও কিন্তু ঠিক দেখতে পেতাম। তুমি জানো না। চারধারে কী ঘটছে, অন্ধরা কিন্তু দ্যাখে, দেখতে পায়। তাদের অনুভব দিয়ে! তুমি জানো না?”
আস্তে আস্তে বলছিল রজনী, ছোট ছোট বাক্য সাজিয়ে। শব্দগুলো হিমশীতল হাওয়ার মতো নামছিল আমার মজ্জা, আমার মেরুদণ্ড বেয়ে। কানের ভিতর দিয়ে মেরুদণ্ডে কোনও প্রবেশপথ আছে নাকি? আগে জানতাম না।
মা, আমার পাপ আমাকে প্রহার করছিল, একটি অন্ধপ্রায় মেয়েকে প্রতারণা করার প্রয়াস ভীষণ ভারী একটা বোঝার মতো আমার মাথায় চেপে রইল, ওই স্তম্ভিত অন্ধকারে নিষ্পেষিত করতে থাকল আমাকে। পারছি না, সেই পাপের দায় ঝেড়ে ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হবে, নইলে নিঃশ্বাস নেব কী করে, তাই নিস্তার পেতে অদ্ভুত স্বরে বলে ফেললাম, চাপা গলা, আমার ধরন অবিকল কাপুরুষের মতো; “বুলা–আমি না—বুলাই—“
হাত দিয়ে সে আমার মুখ চাপা দিল—”ছি। নিজের দোষের ভাগী অন্যকে করতে নেই। একটু আগে নিজেই তো বলেছ, তুমি দুর্বল, সাড়া না দিয়ে পারো না।”
মরিয়ার মতো তখনও বলছি, “কিন্তু রজনী, বুলা খুব খারাপ যে, ও সবাইকে— ছোট ধমকটাকে স্নেহ দিয়ে মিশিয়ে সে বলল, “আবার! কে কী করে তা দিয়ে তাকে ভুল বুঝতে নেই, কেন করে তা-ও দেখতে হয়। সবারই কিছু না-কিছু দুঃখ আছে। বুলারও আছে নিশ্চয়। দুঃখ-কষ্ট কাউকে বাইরে থেকে দেখতে খারাপ করে; কষ্ট পার হয়ে কেউ আরও বড় হয়ে যায়।”
হাত দুটি ছেড়ে তখন ওর দুটি পা স্পর্শ করার আকাঙ্ক্ষা আমাকে ঘাসের মধ্যে মিশিয়ে দিতে চাইছে। বয়সে ছোটকে প্রণাম করা যাবে না, এ কী অন্যায় একটা নিয়ম, বলো তো মা! শুভ্র শুদ্ধ পবিত্রতার কাছে, শুধু বয়স্ক বলেই পাপ মাথা নোয়াবে না? কী অর্থহীন নিষেধ, বলো তো!
.
শাড়ির খসখসের সঙ্গে ক্রমশ-স্পষ্ট একটি আকৃতি, বোঝাই যাচ্ছিল বুলা ঘনিয়ে আসছে। সামনে এসে সে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “কী ব্যাপার। যেতে-টেতে হবে না, নাকি আজ এখানেই—” বলতে বলতেই হঠাৎ থেমে, একটু ঝুঁকে, যেন বাতাসে কিছু শুঁকে সে ফের বলল, “কী ব্যাপার! ওখানে ফ্যাচফ্যাচ, এখানেও সেই ফ্যাচফ্যাচ? তোরা নাকে-কাঁদুনি ছেলেগুলো সব হলি কী?” বুলা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নে, ওঠ। খেয়েছিস তো একটা চুরুট, তা নিয়ে এত নাটুকেপনা করে না। এর পরে যখন পিপে পিপে গিলবি, সময় তো আসছে, তখন করবি কী। আজ তো সবে হাতেখড়ি, যাকে বলে দীক্ষে। আমি হলুম গিয়ে তোর গুরুঠাকুরানি।”
(নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী বুলার, তবু প্রথম চুরুট টানার সেই বিকট গন্ধ, উত্তেজনা, কষ্ট, বুক ধড়ফড়, জীবনে পরে, তীব্রতর নেশার ঘোরেও ফিরে আসেনি। প্রথম যা, তা সব দিক থেকেই প্রথম।)
একটা উতলা হাওয়া উঠে আসছিল গঙ্গার দিক থেকে, সটান গাছগুলোর ডালপালার প্রতিরোধের কোথায় ফাঁক, খুঁজে পেতে গিয়ে সেই হাওয়া কিছু শুকনো পাতাকে উড়িয়ে ঝরিয়ে উদাস করে দিচ্ছিল পার্থিব বন্ধন থেকে, তার সঙ্গে স্বর মিলিয়ে বললাম, “বুলা, বাঁশি কাঁদছে কেন? “
“কাঁদছে, কান্না ওর অভ্যেস বলে ছিঁচকাঁদুনে বলে।”
তখন আরও স্পষ্ট করে বললাম, “বুলা বাঁশিকে তুমি কী করেছ?”
মাথা নেড়ে নেড়ে বুলা ওর খোলা চুল আরও এলোমেলো করে দিল।—”ওকে আমি জন্মদিনের উপহার দিয়েছি। এই তো একটু আগেই দিলাম।”
“উপহার পেয়ে কান্না?”
(বুলা, তুমি বাংলা বলছ অথচ কথাটার কোনও মানে পাচ্ছি না। )
“কী দিয়েছি শুনবে? নকল দাড়ি আর গোঁফ, হি-হি।” বুলা ওর বিশ্রী হাসিটা মুখের পিচকারিতে পুরে নিয়ে চারদিকে ছড়াতে থাকল।—”বেশি ফ্যাচফ্যাচ যদি করিস তবে তোকেও দেব! ভেবো না, সোনা ভেবো না, তোমাদের সব ক’টাকে আমি ব্যাটাছেলে বানাব।” বুলা সুর করে করে বলছিল।
“তুমি কী বিশ্রী বুলা, কী নিষ্ঠুর।” ওকে আঘাত দিতে বলে উঠেছি, কিন্তু আঘাতটা আত্মসাৎ করে বরং আমারই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বুলা বলেছে, “আর তোরা? বাকি সকলে? আমার চারধারে যা-কিছু সব বুঝি দয়ায় ভরপুর? আহা-রে”, বুলা বলে গেল, “আহা-রে, অত দয়া আমার সইবে না, আমি যে নিষ্ঠুর! ফুঁ দিয়ে দয়াটয়াগুলোকে খানিক উড়িয়ে দিই।”
বলে বুলা সত্যিই ঘুরে ঘুরে পাগলের মতো চারিদিকে ফুঁ দিতে থাকল।
অথচ বুলা, বুদ্ধিমতী বুলাও বোঝেনি বাঁশির কান্নার মানে। খরগোশের মতো সাদা সুন্দর পিকনিকের দিনটিকে গোড়া থেকেই বুলা যেন তাড়া করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারল, নিজের সেই বীভৎস কীর্তিতে নিজেই বিমোহিত সে তার শিকারের চোখের জলের উপরে ফুটে-ওঠা ফোঁটাই শুধু দেখেছে, তলার দিকে তাকায়নি।
সমস্ত সুরটা সেদিন কেটে গেল, ফেরার পথে কথা বিশেষ হল না। আর অনেক রাত্রে বাঁশি আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ছাদে। ওর চোখে তখন জল নেই, তবু মুখটা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরে মাটি যেমন নরম থাকে, সেই রকম।
বাঁশি অল্প হাসল—”ও বলেছে বুঝি? বলেছে কেঁদেছি? নকল দাড়ি গোঁফগুলোর জন্যে? দূর তা নয়, সেজন্যে কেন হবে। ওটা অপমান, কিন্তু ঠাট্টা বলেও তো ধরা যায়, বন্ধুতে বন্ধুতে। তা ছাড়া থিয়েটারে কত কিছুই তো নকল, পরচুলোও তো পরি। তা ছাড়া আমি কাঁদছি—না। চোখ চকচক করে উঠেছে হয়তো, চোখের পাতা পুড়েছে। কেন? কারণ—ও সব জানে। আমি টের পেয়েছি। ওখানে ওর চলায় ফেরায়— গোড়া থেকেই সব বুঝতে পেরেছি। আগে একবার গিয়েছিল, সে তো জানতাম। তাই বলে সব এত চেনা হবে—প্রত্যেকটা ঘর, খাট, দেওয়াল, জানালা, এত তন্ন তন্ন করে জানা? আমার খটকা লাগল যে। বেশ তো ছিলাম, বাইরে বাইরে, কিন্তু বিকালে ও এসে আমাকে চোরা কুঠুরিটার ভেতরে টেনে নিয়ে গেল কেন, ভালো লাগছিল, তবু অসম্ভব যন্ত্রণা হল আমার, সব ধরিয়ে দিল, ধরে ফেললাম, ফিসফিস ফিসফিস, শুনতে পেলাম, এই প্রথম নয়, আরও অনেকবার ওখানে এসেছে ও, প্রায়ই আসে, ওই চোরা কুঠুরিটার মধ্যে আরও কতজনকে— বলতে-বলতে বাঁশির গলা আবার ধরে এল।
বললাম, “তুমি তো জানোই বুলা একটু অন্য রকম—“
সে বল, “জানি। জানা এক কথা আর দেখা আলাদা। ধাক্কা লাগে।”
আজ হলে কথাটা আরও গুছিয়ে বলতে পারতাম বাঁশিকে। বলতাম, বাঁচা নামে যে খেলা, সব খেলার মতো তারও কয়েকটা নিয়ম আছে, তুমি বোধ হয় সব নিয়ম জানো না একটা নিয়ম এই যে, বেশি কষ্ট পেতে নেই। বাঁশি, অতো বেশি কষ্ট পেও না।