২৫
তোমাকে খুঁজে পেলাম ছাদে।
(শহরের এই ছাদগুলো অদ্ভুত এক বিস্ময়, নয়? একতলাগুলো যেখানে ছোট মাপে শ্বাস নেয়, চক্রান্তের মতো চাপা গলায় কথা বলে, মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে যত প্রকারের নোংরামিতে, সেখানে এই ছাদগুলো হঠাৎ বিরাট, অবাধ অকপট, হা-হা করে হাসে, বড় বড় চোখ মেলে আকাশের মায়া দ্যাখে, মনে-মুখেও মাখে; দিগন্তকে তুলে ধরে খানিক উপরে। সব ছাদেই কিছু-না-কিছু কল্পনার বিস্তার, অল্প অল্প শিশিরে ভেজা স্বপ্ন।
ছাদের উপরে একটাই মোটে ঘর, আকারে চিলেকোঠার চেয়ে বড়, কিন্তু তখন জানালা-টানালা সব বন্ধ, দরজাতেও তালা। সেই দরজার সামনে সতৃষ্ণ ভাবে দাঁড়িয়েছিলাম?
তুমি কারনিশের কাছে ছিলে। আস্তে আস্তে সরে এসে আমার পাশে দাঁড়ালে—”কী দেখছিস?”
“এই ঘরটা, মা।”
ওই একটা কথাতেই আমার মনের ভাব যদি না বুঝে ফেলবে তবে আর মাকে ‘মা’ বলেছে কেন।—”এই ঘরে থাকতে ইচ্ছে হয়েছে বুঝি?”—হেসে বললে “বসতে পেলে শুতে চায়!”
“সে-কথা নয়। এখানে থাকলে, খুব নিরিবিলি তো। পড়াশুনোর সুবিধে। পরীক্ষার কতই বা বাকি আর।”
“ঘরে তো তালা দেখছি। জানি না কে থাকে। দেখি, মাসিমা এলে বলব।“
“শুনেছি, কে এক দাদাবাবু থাকে। ওরা বলছিল।”
“দাদাবাবু?” তুমি একটু ভাবলে।—”তার মানে তবে নিশ্চয় মাসিমার সেই নাতি। শুনেছি ওর ঠাকুরমার সঙ্গে সে-ও ত্রিবেণী গেছে। সে যদি থাকে, তাহলে তো—তাহলে—” বুঝতে পারছি, ঘরটা পাব না সেটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিতে মা হিসাবে তোমার কষ্ট হচ্ছিল। “দেখি, মাসিমা আসুন তো।” শেষ পর্যন্ত এই বলে তুমি উপসংহার টানলে।
এদিকে উঁচু-উঁচু বাড়ি কম, দূরে দূরে কালো কালো ওগুলো কী, কলের চিমনি আর গাছের ফাঁক দিয়ে গঙ্গা দ্যাখো, চলকে চলকে উঠছে। বোধহয় জোয়ার, তাই মনে হল নদী খুব কাছে এসে পড়েছে এখন আছে বাগানের ঠিক নীচে; ঠিক যেন অন্ধকারে একটা জন্তু জঙ্গলের ঝোপের ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখতে পাচ্ছি না, শুধু তার বড় বড় করে শ্বাস টানার শব্দ শুনছি।
গা শিরশির করে উঠল, পলকে ওই পরিবেশটাই হয়ে গেল কেমন প্রতিকূল, এই তো ছিল ছাদটা খোলামেলা, এই দ্যাখো হঠাৎ সেখানে যেন অদৃশ্য শক্তির সমাবেশ অনুভব করছি—তাড়াতাড়ি তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আমার কাঁধে হাত রেখে তুমি বললে, “এই সাহস নিয়ে তুই ছাদের ঘরে একলা থাকবি ভেবেছিলি?” আদর করে, অথবা ঠাট্টা-ছলে আমার গালে একটা টোকা দিলে। লজ্জাটা কাটাতে, তাছাড়া যেহেতু আর সেই বয়স নেই যখন সব লজ্জা ঢাকতে তোমার বুকে মুখ লুকোতে পারি,
(আদম আর ইভের মধ্যে সঙ্কোচের আমদানি যে করেছিল, তার নাম না-হয় শয়তান, কিন্তু মা আর ছেলের অবাধ ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেও সঙ্কোচ যে ডেকে আনে তার নাম কী? সেই শয়তানটার কথা কোনও পুরাণ কিংবা কিংবদন্তি লেখেনি।)
সেই হেতু আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “গঙ্গাকে তো খুব পবিত্র বলো? গঙ্গাও কিন্তু বেশ হিংসুটে মা, বেশ রাগী। খুব ধার আছে ওর নখে, পাড়ের পর পাড় আঁচড়ে চিড় খাইয়ে দেয়, ধসিয়েও ফেলে; আমি দেখেছি।”
নিঃশব্দে যে-নদী জোয়ারে বাগানের ঠিক নীচে এসে ঘন ঘন শ্বাস নেয়, তার বিরুদ্ধে আমি আর নালিশই বা জানাতে পারতাম কি?
“ঠিক আছে। এখন তো তুই নীচেই থাকছিস। পরে যা হয় দেখা যাবে।” একটু থামলে।—”তোর বাবার কিন্তু নীচের ঘরটাই খুব পছন্দ।” থামলে আবার। তারপর, মা, একী, তোমারও গলা কাঁপছে কেন, তুমিও কেন হঠাৎ বলে উঠেছ “আমারও ভয় করছে রে। অন্য একটা ভয়।”
কিসের ভয়? এবার তুমিই শক্ত করে চেপে ধরেছ আমার হাত—”তুই টের পাসনি? একটুও বুঝতে পারিসনি? শুনছিলি, এখানে আসার পর তোর বাবা যেন কেমন করে কথা বলছিলেন?”
“বরাবরই তো বলেন।”
“বলেন, কিন্তু এ তার থেকে আলাদা।”
“কেন, উনি অনেক কথা যা বলেছেন, তা তো খুব স্বাভাবিক। বরং নতুন করে ব্যবসা-ট্যবসা শুরু করার কথা বলছিলেন–“
“আমার ভয় তো সেই জন্যেই। ওকে আমি যে তোর জন্মের অনেক—অনেক আগে থেকে চিনি। দ্যাখ, সেই থেকে আমার কেমন যেন লাগছে। যে দিকেই হোক, ও আবার বদলে যাচ্ছে। হয় একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যাবে, নয় তো হিসেবের বাইরে চলে যাবে একেবারে। ওকেওকে আমরা আর ধরে রাখতে পারব না।“
“আবার বেরিয়ে চলে যাবেন, তাই কি ভাবছ মা।”
তুমি হাসলে।—”চলে যাওয়া অনেক রকমের হতে পারে…যাই বলিস আমার ভালো ঠেকছে না। কী-যেন চাপা দিতে চাইছে ও; একটা কষ্ট প্রাণপণে চাপছে।”
“কিসের কষ্ট, মা।”
“বুঝতে পারিসনি? ও যে সংসার চালাতে পারল না, সেই কষ্ট। এখানে এসে যে উঠতে হল, সেই কষ্ট। পরগাছা হতে হল আমাদের, নিজেও হয়ে গেল। বুঝছিস না? আজ তো আমরা পরগাছাই!”
মা, যা বলছ, আস্তে আস্তে বলো। এই খোলা আকাশে লক্ষ কোটি কৌতূহলী চোখ নিচু হয়ে চেয়ে আছে, দেখছ না? ওদের মধ্যে যেগুলো কিছু টের পেলেই মিটমিট করে ওঠে, অথবা দপদপ করে উত্তেজনায়, তাদের আমি বিশেষ পরোয়া করি না। কিন্তু স্থির হয়ে যারা দ্যাখে, দেখেও স্থির থাকে? মা, সেই তারারা বড় শয়তান আর সেয়ানা ব্যক্ত হবে তো হও, তোমার ভয়টাকে বানান করে উচ্চারণ করো; কিন্তু ধীরে ধীরে; জনান্তিকে; ওদের বুঝতে দিও না।
“ওর মনে”, তুমি বলছিলে, “ওর মনেও একটা কাঁটা ফুটে গেছে। সেই কাঁটাটা উপড়ে ফেলতে চাইছে। নইলে এতদিন পরে ওইসব পুরনো ব্যবসা-ট্যবসার কথা ফেঁদে বসার অর্থ কী? আসলে আমরা যে আশ্রিত, আমরা যে অন্নদাস, সেটা জোর করে ভুলতে চাইছে। নিজেকে ভোলাচ্ছে।”
বুঝেছি মা, এখন একটু থামো। আশ্রিত আর অন্নদাস—শব্দ দুটোকে কাটা ঘায়ে নুনের মতো দিতে হবে না ছড়িয়ে। কোন্ লজ্জা বাবার, কীভাবে চাইছেন তাকে ঢাকতে, আমি উপলব্ধি করেছি। বে-আবরু কোনও মেয়ে কারও চোখে পড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি দু’চোখ ঢেকেছে, ভাবছে, কেউ আর তাকে দেখতে পাচ্ছে না। তাড়া-খাওয়া খরগোশ দৌড়ে মুখ লুকিয়েছে ঝোপে। বাবা অতীতের ঘরে ঢুকে খিল তুলে দিয়ে বসে আছেন। স্বপ্নে বিভোর, যে স্বপ্নটা ছলনা।
“ওঁর চোখ কথা বলতে বলতে কেমন হয়ে যাচ্ছিল, দেখেছিলি? ওই দৃষ্টি আমি চিনি। একটুও ভালো ঠেকছে না। মন বলছে, একটা কিছু ঘটে যাবে।”
কেউ না কেউ আমাদের কথা শুনছিল নিশ্চয়ই; নজর রাখছিল। নইলে বাগানের আমের গাছে এত বোল, নিশ্চয়ই ঝিমঝিমে গন্ধ ছড়াত; ডালগুলো দোল দিয়ে দিয়ে শিরশিরে হাওয়া বিলোত, বিশেষ করে এতো কাছেই যখন নদী! একটু আগে চোরা জোয়ার এসেছিল না? সেই নদীও কি এই মুহূর্তে নিদ্রিত। নিদ্রিত অথবা জাগরিত, দুই নদীই বড় ভীষণ হয়।
এই ছাদেও বিশ্রী গুমোট লাগছিল। উপরে আকাশজোড়া তারা, কিন্তু কোণে কোণে বিদ্যুতের ইশারা পাচ্ছিলাম। কোনও একটা ভয়ংকর সংকেত, যার শুধু ঝলসানি দেখছি, কিন্তু পড়তে পারছি না। যখন এইসব দেখা দিতে থাকে, তখন, একটানা রোমাঞ্চ ঘটে চলে অনুভবে; এই রাতের অন্ধকারে আর কী গুপ্ত আছে, আর কী-কী ক্রমে ক্রমে দেখা দেবে তার পেট চিরে চিরে—আতঙ্কিত আমি ভাবছিলাম। ঝড়-বৃষ্টি? দূর, শুধু ঝড়-বৃষ্টিতে ভয় কী। আরও কিছু যা উড়িয়ে নিয়ে যায়, উপড়ে ফেলে, সেই সব সর্বনাশের কল্পনায় একদিন কাঠ হয়েছিলাম।
একটি ভয় আর-একটি ভয়ের উপরে ভর করে সাহস সন্ধান করছিল।
“চল্ যাই” তোমাকে বলতে শুনলাম। সাধারণ কথা, তবু শিউরে উঠেছিলাম অকারণেই, মনে আছে ফিসফিস করে বলেছি “কোথায়?” আমরা দু’জনেই ফিসফিস করে কথা বলছি, কণ্ঠনালীতে কোথায় একটা অদৃশ্য রন্ধ্র—সব কথা মুখে ওঠার আগে সেখান দিয়ে বাতাস হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।
“এখান থেকে। যেখানে হয়। এখানে আর না।” মা, তোমার সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্য সমুদয় উচ্চারিত হয়েও ফুরিয়ে যায়নি তবে, এতদিনেও না? কোথায় ছিল তবে এরা এতকাল, ভাসছিল বুঝি তরঙ্গিত সময়ের অপার ইথারে? অথবা মুদ্রিত ছিল অলৌকিক কোনও শব্দধর যন্ত্রে, এই আবহমান জগতে প্রত্যেকটি ধ্বনি তাই থাকে, মুদ্রিত কিংবা সঞ্চিত, লয় হয় না, মাঝে মাঝে অলস-অসহায় কোনও কোনও ক্ষণে পুরনো রেকর্ডের মতো তাদের বাজিয়ে শুনি।
“এখানে আর না”, তুমি বলছিলে “এখানে যা হবার তা তো হয়ে গেল। তবে আর থাকব কেন?”
(বড় কঠিন প্রশ্ন মা, এই “কেন।” সব হয়ে যাবার পরেও আসরের ফরাসে, ধুলোয়, নিবু নিবু বেলোয়ারি কাচের ঝাড়ের দিকে চেয়েও আমরা ঢুলতে থাকি কেন। কেন তোমার জিজ্ঞাসায় সেদিন চমকে আমি ভাবছিলাম, সত্যিই তো—কেন। এই শহরে আমরা আর পড়ে থাকব কেন, তুমি কি তাই বলতে চাইছ? গ্রাম থেকে যারা এখানে আসে, দর্শনীয় সব কিছু দ্যাখে, যথা যাদুঘর, চিড়িয়াখানা, কালীঘাট, মনুমেন্ট, গঙ্গাস্নান, সবই যখন সারা, তখন? তারপর? তারপরও পড়ে থাকার অর্থ শুধু ধরমশালার খরচ টানা, শুধুই পুনরাবৃত্তি, একই কার্বনের কপির পর কপি? যত পরের কপি, তত তাদের রঙ ফিকে হয়ে আসে, অক্ষরগুলোও আর চেনা যায় না। )
“আমাকে নিয়ে যাবি, পারবি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে?”—তোমার কথাগুলো প্রার্থনার মতো শোনা যাচ্ছিল।
কোথায় ফেরার কথা বলছ, তার নাম যেন পড়তে পারছিলাম তোমার চোখের তারায়। তাই জিজ্ঞাসা করে নেওয়ার আর দরকার হয়নি।
“আমরা ফিরে যাই চল।” বুঝেছিলাম তুমি ফিরে যেতে চাইছ সেখানে, আমাদের সেই আধা-গ্রামের বাড়িতে। সেই দিঘি, মাঠ, গাছের সবুজ শুধু এই সবের টানে নয়—অন্য কোনও অন্ধ আকর্ষণ। যেখানে অনেক শোক, অনেক স্মৃতি আমরা রেখে এসেছি। তাদের হাত ছাড়িয়ে একদিন ট্রেনে চেপে ছিটকে এসেছিলাম বাইরে। হয়তো উপায় ছিল না বলে। হয়তো-বা এও ভেবেছিলাম, তাদের অস্বীকার করে আমরা নতুন স্থানে নতুন জীবন পাবো!
লোকে যখন পুরনোকে ছাড়ে, সেইসব শোক আর স্মৃতি কি আহত, বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে? পরিত্যক্ত হয়েও মরে না, অপেক্ষা করে থাকে, যার যেথা স্থানে? যারা গেল, তারা ফিরবেই একদিন-না-একদিন—এই আশায়? আমরা তাই ভাবি বটে। ভাবি সব সেই থেকে একঠায় রয়ে গেছে, যেখানে যে যেমনটি ছিল; সেই খেজুরের গুঁড়ি পাতা পুকুরের ঘাটলা, যেখানে তুমি একদিন পিছলে পড়েছিলে—রক্তমাখা, মুর্ছিত, আমাকে কী ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে বলো তো? বড়ঘরের বারান্দায় চালের নীচে বাবুই পাখির বাসা–সেটা কী সেই রকমই আছে? পেয়ারা গাছের পাতার অন্ধকারে রাতবিরেতে বাদুড়গুলো কি তেমনই ডানা ঝাপটায়? আর সদর রাস্তায় ডাকাতের মতো ঝাঁকড়া-চুল অশ্বত্থ গাছটা, যেটা দিনের বেলা যেন পাগড়ি পরা পাহারাদার, আর রাত হলে, বিশেষ করে কৃষ্ণপক্ষে, তার ডালপালা থেকে নামিয়ে দেয় ছমছম ভয়, এখনও কি সেটা তেমনই জমকালো আকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে? মানুষই যদি নেই, তবে কাকে সে ভয় দেখায়? সেই কাঁচা রাস্তাটা, সেই—মা, পর পর সব মনে পড়ছে। ওরা আছে, তোমার নয়, আমারও বুকের ভিতরে চাপ-চাপ রক্তের মতো জমে আছে। যাদের ছেড়ে আসি তারা এইভাবে শোধ নেয়। থেকে থেকে ডাকে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আর টানে। যখনই ওরা টের পায়, পলাতকেরা অন্যত্র গিয়ে সুবিধে করতে পারেনি, তখনই পরিত্যক্ত স্মৃতিস্তূপ প্রবল, প্রাণবান মূর্ত। আমরাও সাড়া দিতে চাই তার ডাকে ক্ষীণস্বরে বলি, “যাচ্ছি।” যেমন তুমি সেদিন বলেছ। যেতে চেয়েছ। কারণ তুমি অনুভব করেছিলে এই শহরটা আমাদের সব কেড়ে নিচ্ছে, সব কিছু; ভিতরের বাইরের। সর্বস্বান্ত হবার আগে তাই তুমি যেটুকু বাকি আছে, সেটুকু সেখানে ফিরে গিয়ে গচ্ছিত রাখতে ও।
আমিও, মা, যখনই আঘাত পাই এখানে ওখানে, তখনই প্রত্যাবৃত্ত হতে চাই। কোথায়? অনেক দিন, আমাদের ছেড়ে-আসা সেই না-শহর না-গ্রামটি তার প্রতীক হয়েছিল! যখনই আমার স্বভাবের শামুকটা গুটিয়ে গিয়েছে ভিতরে, তখনই সে তার বর্জিত শৈশব-কৈশোরকে সেখানে সগৌরবে সংস্থিত দেখেছে। মন্দিরের নিভৃত গর্ভগৃহে দেবীপ্রতিমার মহিমা নিয়ে অধিষ্ঠিতা অতীত, কখনও-বা তিনি আবার স্বপ্নেও আবির্ভূতা হন।
“নিয়ে যাবি?” তুমি হয়তো বলেছিলে একবার, আমার কি শ্রুতিভ্রম ঘটেছিল? আমি কি সেদিন ওই একটা অনুরোধকে বক্রাকারে বারবার ফিরে আসতে দেখলাম?
.
“মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে”–রাত্রি গভীর হলেই আমার ওই ছড়াটার কথা মনে পড়ে। মীন কারা? ছোট ছোট শব্দরা। দুপুরে, বিকেলে তারা মিলিয়ে থাকে অগাধ সলিলে, কিন্তু জেগে ওঠে সন্ধ্যার পরে; ক্রমশ, যত রাত বাড়ে। আশ্চর্য নয় কি, ওরা জেগে থাকে, কেউ কেউ সিপাই-সান্ত্রির মতো দাপটে পা ফেলে ফেলে চলে, আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি। যেদিন আমরাও জাগি, সেদিন ওই শব্দটা আর আমরা, ক্রমাগত দেওয়া-নেওয়া নেওয়া-দেওয়ায় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। শেষ রাত আর সকাল অবশেষে আমাদের নির্জীব দেহগুলি দখল করে নেয়।
ওই বাড়িতে প্রথম রাত্রিটি ভুলতে পারছি না বলেই এত কথা লিখলাম। বাবা আর আমি একটা ঘরে, তুমি অন্য ঘরে। কখন এসে শুয়ে পড়েছ, টের পাইনি।
আরও খানিক পরে, বাবা যখন শোবেন, তখন দরজায় একটা টোকা, কার যেন গলা খাঁকারি—”প্রণববাবু ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?”
অবিনাশের গলা! লোকটা অপেক্ষা না করেই ভিতরে এল “দেশলাই আছে, দেশলাই?” বাবার দিকে তাকিয়ে কেমন সুরে যেন বলল। বাবা বললেন, “আছে।” ওর হাতে বাক্সটা দিলেন। লোকটা হাতের পাতা আড়ালে করে একটা কাঠি জ্বালাল, সেটা নিবে গেল, সে জ্বালল আবার, আবার কাঠিটা নিবল! “থুঃ”, জানালার কাছে গিয়ে থুথু ফেলে অবিনাশ বলল “বিড়িটা ধরতে চাইছে না। নিবে নিবে যাচ্ছে।” শুয়ে শুয়েই কাঠির আলোয় জ্বলজ্বলে ওর মুখ দেখতে পাচ্ছি। কোনও মতলব কি আঁকা সেই চোখে, গূঢ় কোনও ফন্দি? বুঝতে পারছি না। ভালো লাগছে না। ছটফট করছি। ধরাতে পেরে লোকটা বিড়িতে একটা লম্বা টান দিল, তারপর আগের মতোই অন্তরঙ্গ ঢঙয়ে বাবার দিকে একটা বিড়ি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “চলবে নাকি? আমার অদ্ভুত লাগছিল, আমি ঘামছিলাম। সমস্ত রোমকূপ যখন চোখ হয়ে ফুটে উঠতে চায়, তখন তাদের সব কান্না কুলুকুলু ঘাম হয়ে যায়।
“চলবে নাকি?” সে বলল আবার, বাবাকে ছুঁয়ে প্রায় আলগোছে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, নিন না মশাই, একটা। কাশি হবে না। এর নাম হল গিয়ে মেনকা বিড়ি।” বাবা কী বললেন শুনতে পেলাম না, অথচ দেখলাম কিছু না বলে তিনি বিড়িটা নিচ্ছেন। নিচ্ছেন, উনি নিয়েছেন। আমি ঘামছি। চাদর ভিজে যাচ্ছে। অবিনাশ বলল, “রেখে দিন আরও দু’তিনটে, রাত্রে যদি লাগে?” বলে সে বিছানায় আরও বিড়ি ছুঁড়ে দিল, আমি ঘামছি, মা, বাবা দেখতে পাননি, আমি চোখও মুছছি, অবিনাশ বেরিয়ে গেল।
অন্ধকার ঘর, চারধারের যত শব্দ, সব বিকট রব তুলে আমাদের আক্রমণ করল, তার কোন্টা ঝিঁ ঝিঁ কোন্টা কর্কশ কোনও রাতজাগা পাখি, আমি জানি না, কিন্তু একটা স্বর চিনি—কুকুরের। হঠাৎ মাথায় কী রোখ চাপল, ছুটে গেলাম বাইরে, কুকুরটাকে তাড়া করে বাগান অবধি দিলাম তাড়িয়ে। বাবা তখনও বসে দুটি হাত চোখের সামনে মেলে, শূন্য করতল। আমাকে দেখে তিনি আস্তে বললেন “এক গ্লাস জল।” দিলাম। খেলেন। ওঁর ভঙ্গি ভাঙা-ভাঙা, ভেঙে-পড়া, চোখ চকচকে, তবে জলে নয়। তেমনই ক্লান্ত স্বরে বললেন “কোথায় গিয়েছিলি?”
“কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিয়ে এলাম, বাবা। বিশ্রী ডাকছিল।”
তাই তাড়িয়ে দিয়ে এলি?—বাবা মাথা নেড়ে নেড়ে ফের বললেন, “আর তাড়াসনি।”
অবাক হয়ে চেয়ে আছি, তাই আবছা আলোয় দেখা গেল, বাবা অল্প হাসলেন। নিষ্প্রভ হলদে আলোর সঙ্গে সেই হাসি মিশে গেল।—”কেন মানা করছি? কুকুরটাকে বাইরে থেকে দেখি নোংরা, কিন্তু সব তো আমরা জানি না, ওরা হল রাতের পাহারা। কিংবা বিবেক। বিবেক বলে একটা জিনিস আছে জানিস তো? রাত্রির জাগ্রত আত্মাই হয়তো ওর কণ্ঠে কণ্ঠ পেয়ে আর্তনাদ করে।”
এসব অর্থহীন কথা, মা, আমি বুঝতে পারছিলাম, অন্য কোনও আর্তনাদ চাপা দেওয়ার কঠিন চেষ্টা। বিছানার উপরে তখনও ছড়ানো দু’তিনটে বিড়ি।
“বাবা”, আমি ফিসফিস করে বললাম, “ওই লোকটার কাছে কিন্তু দেশলাই ছিল, আমি টের পেয়েছি। ও যখন চলে যাচ্ছে তখন পকেটে হাত ঠেকতে বাক্সটা বেজে উঠেছিল।”
“আমি জানি”, প্রশান্ত মুখে বাবা বললেন, “আমি জানি। ও ইচ্ছে করে আমাকে অপমান করে গেল। বুঝিয়ে দিল ও আর আমি দুজন সমান-সমান। এ বাড়ির চাকর দু’জনেই।”
সেই স্তরহীন তরঙ্গহীন স্বর আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “কিন্তু বাবা, কাল কি পরশু তো দিদিমা এসে পড়বেন। তিনি এসে পড়লেই—”
বাবা খুব অস্বাভাবিক জোরে হেসে উঠলেন।—”হ্যাঁ, তাহলে একটা বিহিত হবে বটে। ঠিক বলেছিস। প্রোমোশন পাব—চাকর থেকে ঘরজামাই; ‘
ঝুঁকে পড়ে আমার গাল টিপে দিলেন তিনি, আর তেমনই জোরে হাসতে থাকলেন।
কতক্ষণ পরে ঘরে ঢুকেছিলে তুমি, তখনই ওই হাসির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গিয়ে, না আরও অনেক পরে? চোখ ফোলাফোলা, এদিক-ওদিক চাইছিলে। বসা-বসা গলায় বললে, “কী ব্যাপার?”
বাবা আর হাসছিলেন না, কিন্তু হাল্কাভাবের রেশটা তখনও ধরে রাখতে চাইছিলেন। ভীষণ কোনও ব্যথাকে ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে দেওয়ার ওই ব্যাপারটাকে আমি এখন বুঝি, ফুঁ দিয়ে দিয়েই বলতে কী, আমিও তো এখন বেঁচে আছি, বাবা বলছিলেন, “কী আবার, আর-একটু পরে এলে আমাকে আর পেতে না।”
“ও আবার কী রকম কথা?”
“আবার বিবাগী হয়ে বেরিয়ে পড়তাম আর কী। তুমি তখনও ঘুমোতে থাকবে। বুদ্ধদেব বা চৈতন্যদেব গৃহত্যাগ করেছিলেন, জানো? আসলে কারণটা আমি বুঝেছি। মানুষ যখন ঘুমোতে পারে না, ছটফট করে, প্রহরের পর কাটে প্রহর, তখন যদি দ্যাখে, তার আশে-পাশের যারা, বিশেষত তার স্ত্রী, নিশ্চিন্ত ঘুমে অচেতন, তখন সংসারকে মনে হয় বড় উদাসীন, তুমি কার, কে তোমার, পরিবার-পরিজন-স্বার্থপর, বুদ্ধদেব আর শ্রীচৈতন্য তাই—”
গম্ভীর মুখে তুমি বললে “থামো। তুমি বুদ্ধও নও, চৈতন্যও নও।
এতক্ষণ বাবার মুখে ছায়া পড়ল, হাসিহাসি মুখের উপরে আঁকা হয়ে গেল যন্ত্রণা। একটি শ্বাস চেপে তিনি বললেন, “জানি। আমি কেউ না। কিছু না।”
নিজের অন্যায়টা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলেছ তুমি!—”ছিঃ, ভেঙে পড়লে চলে না।” আমাকে দেখিয়ে বললে, “ও তো আছে। ভাগ্যে থাকলে ও দাঁড়াবে। আসবার সময় বাড়িওয়ালাকে বড় মুখ করে বলে এসেছি যে, আমরা পালাচ্ছি না। আমার ছেলে মানুষ হবে, আপনার পাওনা প্রতিটি পাই-পয়সা মিটিয়ে দেবে।” বলতে বলতে তুমি আমার মাথায় হাত রাখলে—”কী রে, দিতে পারবি না?”
কোনওরকমে বললাম, “পারব।” একটি জাগতিক বিষয়ে বস্তুত অনভিজ্ঞ, অপরিণত বয়সি ছেলেটি তখনও নিশ্চয়ই বোকা ছিল, নইলে ঠিক এই মুহূর্তে কথার পিঠে কথা দিয়ে সে বড়াই করত না। আর, আমার বিশ্বাসী মা, তুমি বাবার দিকে ফিরে তখন গাঢ় স্বরে বললে, “ভগবানকে ডাকো। সব নিশ্চয়ই আবার ঠিক হয়ে যাবে। পরীক্ষার ফল ভালো হবে, ভালো হয়ে যাবে তোমার শরীরও ভগবানকে ডাকো।”
“ডাকব না।”—চমকে দিয়ে স্পষ্ট গলায় বাবা বলে উঠলেন, “ডাকব না।”
“বিশ্বাস করো না?” তীব্র কণ্ঠে বলে উঠলে তুমি, “এখনও না?“
“করি”, বাবা বলছেন ধীরে ধীরে, জানালার বাইরে পড়েছে জ্যোৎস্না, সেই দিকে মুখ ফিরিয়ে “করি। করি বলেই তো ডাকব না।”
“সেই হেঁয়ালি?”—–তুমি বললে বিদ্রূপের সুরে।
“হেঁয়ালি নয়, হেঁয়ালি নয়,” বাবা অস্থির গলায় বলে গেলেন “তুমি বুঝতে পারছ না? আমাদের খুব ছোট ছোট দরকারে তাঁকে ডাকি কিনা, তাঁকে কাজে লাগাতে চাই, তাই বৃহৎ কিছুর বেলায় আর পাই না। কত সামান্য ব্যাপারেও তাঁকে স্মরণ করি, ভাবো তো। বাড়ি ফেরার পথে মানুষ যদি মেঘ দ্যাখে, প্রার্থনা করে ‘হে ঈশ্বর! আধঘণ্টার মধ্যে যেন বৃষ্টি না নামে। যেন আমি যে গাড়িতে চড়েছি সেটার অ্যাকসিডেন্ট না হয়। যেন ছেলেটি ভালোভাবে পাস করে। যেন চাকরি না যায়,”–কত আর নমুনা দেব। মানুষ তুচ্ছাতিতুচ্ছ স্বার্থে আর খুচরো কারণে আহরহ তাঁর সাহায্য চায় বলে ঠকে, অন্তত আমি চেয়েছি আমি ঠকেছি।”
“অন্তত আমি চেয়েছি” এই আত্মধিক্কারের পরে বাবা তাঁর আবেগে রুদ্ধ কণ্ঠকে মুক্ত করতেই বুঝি থামলেন, তবু কষ্টে বিকৃত হয়ে গেল তাঁর স্বর “চেয়েছি বলেই তো যেখানে সত্যিকার দরকার ছিল, সেখানে না পেলাম তাঁর কৃপা, না করুণা। সকলের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলছিলাম, দেশের মুক্তির জন্যে আন্দোলনে। সেখানে পিছিয়ে পড়লাম, সরে এলাম। আর লেখা? সেখানে আরও কঠিন শাস্তি দিলেন তিনি—কই, আমাকে দিয়ে তাঁর উপযুক্ত কিছুই তো লিখিয়ে নিলেন না! ভাবলাম, তোমাদের নিয়ে একটি মায়ার সংসার তৈরি করব শেষের ক’দিনের জন্যে—তা সেই স্বপ্নও আমার শরীর আর স্বাস্থ্যের সঙ্গে ভেঙে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন।”
কোনও কথা বলছিলাম না আমরা, তখন কথা বলছিল না কেউ, রাত্রির যত বিচিত্র প্রগল্ভ কলরব, এক সুবিশাল দহে ডুবে গিয়েছিল।
“তাঁর দয়া লাগে গভীর শোক মুছে ফেলতে; তুমি পেয়েছ কিনা জানি না। তাঁর দয়া লাগে বিপুল কোনও প্রাপ্তিতেও, অপার কোনও আশার পূরণে। আমি পাইনি।
বাবা বলছিলেন এক প্রত্যয়াদিষ্ট কণ্ঠস্বরে – “স্তব, মন্ত্র, জপ আমরা ভাবি এসব করি আর পড়ি তাঁর জন্যে। আসলে আমাদের প্রয়োজনে—আমরা মুক্ত হব বলে। তাঁর তো এ সবের কিছুতে দরকার নেই। জীবন যাতে খুব দম বন্ধ করে না ফেলে তাই মানুষের জন্যে কয়েকটা ঘুলঘুলি ফুটিয়ে দিয়েছেন তিনি, জানালা খুলে দিয়েছেন। যাতে মানুষ ক্লান্ত না হয়ে পড়ে। শিশুকে বাইরে কোথাও গেলে বড়রা যেমন নজর রাখে তার ভালো লাগছে কিনা। তার হাতে ভেঁপু বাঁশি দেয়, ভুলিয়ে রাখতে। আমাদের সব রচনা, সব স্তব-স্তোত্র, শিল্পসৃষ্টি, সংসারও সেই ভেঁপু বাঁশি, আমাদের নিজেদেরই খুশির খেলনা। আনন্দের আস্বাদ দেয়, ভরপুর রাখে আমাদেরই। এ সব কিন্তু তাঁর নিজের কোনও কাজে লাগে না।”
বলতে বলতে বাবা, অন্যমন অথবা বিহ্বল, ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ওঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম বারান্দায়, স্তম্ভিত একটি মূর্তি, অপার্থিব জ্যোৎস্না লুণ্ঠিত যেখানে। খুব মৃদু অথচ মর্মভেদী স্বগত ভেসে আসছিল কানে : “তোমার কাছে অনেক ছোট ছোট প্রত্যাশা পুষে রেখেছি বলেই তোমাকে পাই না। ভক্তি তো নেই-ই, শুধু ভয়, আর একটু বিশ্বাস আর সামান্য কৃতজ্ঞতা। কত সামান্য কাজে তোমাকে ব্যবহার করব বলে বাহু বাড়াই। অন্য সব মোহ থেকে—কাম, কামনা, অর্থ, স্বীকৃতি—মুক্ত না হলে তোমাকে পাব কী করে!”
মা, তুমি আমার দিকে তাকালে। চোখে উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক—”কী বুঝছিস?” তোমার চোখের তারা বলছিল, “এখানে এসে ওঁর অসুখটা কমেছে। না বেড়েছে?”
“বুঝতে পারছি না”, আমি চোখ বুজে বললাম মনে মনে, “কিছু বুঝতে পারছি না। এই বাড়িটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে, মা, এখানকার সব কিছু ছাড়িয়ে যেতে চাইছে আমাকে।”
২৬
সুধীরমামা বললেন, “কী ছেলেমানুষি করছিস? আয়, এখানে আয়।”
(মানুষের ভাষায় যত ডাক আছে তার মধ্যে এই “আয়” ডাকটা সবচেয়ে সবুজ, সুশীতল, তৃষ্ণার কোনও পানীয়ের মতো। গভীর অর্থবহ, আশ্বাসে অনুরণিত ওই কথাটা—”আয়।” ওই আহ্বানে লোকে কখনও সাড়া দেয়, কখনও দেয় না, অবহেলায় উদাসীন থাকে। কিন্তু ওই ডাক যখন বন্ধ হয়ে গেছে, তখন কখনও ক্লান্ত, কখনও জর্জর, আবার কখন শোনা যাবে, এই আশায় মানুষ অধীর অস্থির হয়ে থাকে।)
সুধীরমামা বললেন, “আয়।” সেই সুধীরমামা, মা! তোমার মনে পড়ছে?
কী করে তাঁর সঙ্গে দেখা হল জিজ্ঞাসা করছ? বলছি, আমাকে একটু স্থির হতে দাও।
তার পরের দিন সকাল খুব বিশ্রী কেটেছিল। কিছু ভালো লাগছিল না, ওই বাড়ি না, বাগান না, গঙ্গা তো নয়ই, নদীটাকে মনে হচ্ছিল একটা নোংরা ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার নালা! কে আমাকে খেতে দিল, কোথায় বসে খেলাম, স্যাঁতসেঁতে রান্নাঘরে পিঁড়িতে বসে না, তার পাশের কামরায় রাখা তকতকে সাদা পাথরের টেবিলে, এ-সব দিকে কিছু মনোযোগ নেই, কোনও রকমে মাথা হেঁট করে খাচ্ছি, যত তাড়াতাড়ি পারি, খাওয়া তো নয়, অসম্মানের মুঠো, তা-দিয়ে শুধু পেটের হাঁ বোজানো, খাচ্ছি আর ঠিক করছি, শেষ হলেই ছুট দেব।
দেব, কিন্তু যাব কোথায়, কলেজে? ভালো লাগছিল না, একবর্ণ লেকচার ঢুকছিল না মাথায়, আমার প্রিয় কত কাব্য, সব তেতো, তেতো ঢঙ আর ন্যাকামি। যারা পরাশ্রিত, তাদের ওসবে অধিকার নেই।
ক্লাস থেকে পালিয়ে গেলাম স্টেশনে। সেই স্টেশন, বহু দিন আগে, কত দিন আগে হে ভগবান, কোন্ কালে?—যেখানে এক সন্ধ্যায় এসে নেমেছিলাম। স্টেশনটা আমাকে এখনও অবশ আবিষ্ট করে, অন্তত অনেকদিন অবধি করত। আমরা যেখানটা ছেড়ে এসেছি আর এসেও যাকে পাইনি, এই দুই বিন্দুর মধ্যে এই স্টেশনটা একটা সম্পর্কের সূচক, একটি পেতে দেওয়া লোহার লাইনে আর টেলিগ্রাফের তারে তারে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে।
এক-একটা গাড়ি চলে যায়, আমার চোখের পাতা কাঁপে ঈর্ষায়, আমি দেখি। কামরার বাইরে কাঠের তক্তায় লেখা এক-একটা নাম, বানান করে করে পড়ি। সেদিন ও পড়ছিলাম, দগ্ধ হচ্ছিলাম। এই ট্রেনগুলো কখনও সোজা, কখনও সর্পিল পথ ধরে উধাও হয়ে যায়, কোথায় যায়? যেখানেই যাক, আমার কাছে সে-সব শুধু ফলকে-লেখা নাম, তারা কোথায় কতদূরে আমি জানি না, সে-সব স্থানে আমার যাওয়া হবে না।
কিসের টানে তবু যেতাম স্টেশনে? কিন্তু যেতাম প্রায়ই। সেদিনও গেলাম! কারণ তো বলেইছি, মন টনটন করছিল, ফিরতে ভালো লাগছিল না। আর ফিরবই বা কোথায়? সেই বাড়িতে? যেখানে বাবা বাজার সরকার, ম্যানেজার, না ঘরজামাই, আর তুমি? মুখে আনা দূরে থাক, মা, মনে মনেও যে উচ্চারণ করা যায় না, তুমি কী। সেদিন স্থান-কালের আধারে রেখে তোমাকে দেখছিলাম বলে কষ্ট হচ্ছিল, আজ সব কিছু ছাপিয়ে ছাড়িয়ে বেরিয়ে গিয়েছ, তুমি যা তাই তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। তুমি বেরিয়ে গিয়েছ আমি পড়ে আছি।’
সেদিন স্টেশনে দাঁড়িয়ে কিন্তু তোমারও মুক্তির কথা ভেবেছি। তিষ্ঠোতে পারছ না তুমিও, চলে যেতে চাইছ যেখান থেকে আমরা এসেছি সেখানে
(কত পিছনে, মা, কত পিছনে? পুরো দূরত্বটা সাহস করে অথবা মায়ার ডোরে জড়িয়ে পড়ে ভাবতে পারি না, যদিও অস্পষ্ট আকার সে আমাদের ঢাকনা-দেওয়া চেতনায় থাকে; তাই তাকে মোটে কয়েকটা মাস আর মাইলের হিসাবে মাপি যেন এই ক’টা বছরের পৃষ্ঠা পিছন দিকে ওলটালেই পারব বেঁচে যেতে। লড়াইয়ে মার-খাওয়া সৈন্যরা এইভাবেই পিছু হঠে, দিব্য পরিকল্পনা মাফিক, কিন্তু পিছু হঠতে হঠতে কত দূর আর যেতে পারে? যদি কঠিন কোনও দেওয়াল থাকে, অথবা কোনও অতল গহ্বর? ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে সেদিন যে আমরা ফিরতে চেয়েছি প্রাক-কলকাতা পর্বে, সেও তো একটা হিসাবি আপস, একটা ভীরু আত্মছলনা? অত্যাচারী জীবনের হাতে পরাস্ত-পর্যুদস্ত মানুষ ভীষণ ভয় পেয়ে আসলে হয়তো পূর্বজন্মে ফিরে যেতে চায়। সে উপায় নেই যখন স্থির জানে, তখন পরজন্মের দিকে সতৃষ্ণ হয়ে তাকায়।)
.
হঠাৎ সেদিন একটা কাণ্ড করলাম, একটা গাড়ি দম নিয়ে আস্তে আস্তে যেই স্টেশন ছাড়ছে, অমনই জানি না কী করছি, খেয়াল করিনি আমার টিকিট কেনা নেই, ঝুলে পড়লাম তার হাতল ধরে, পা-দানিতে পা রাখলাম।
(জন্মভীরুও হঠাৎ-হঠাৎ এক-একটা সাহসী কাজ করতে পারে, হিসাবিরাও সহসা বে-হিসাবি হয়ে যায়।)
প্রথমটা বেশ লাগছিল, গাড়ির দোলানির চমৎকার একটা আবেশ আছে, বিশেষ করে যদি দাঁড়িয়ে থাকা যায়। টলমল, টলমল, গাড়ি খালি নিজেই দোলে না, চারপাশে যা কিছু বাঁধানো ছবির মতো স্থির, তাদেরও তীব্র বাঁশিতে চমকে দেয়, ধরে ধরে দোলায়। যাত্রী যারা, তারা কেউ কাগজ পড়ছে, তার মানে পারিপার্শ্ব থেকে সরে গিয়ে নিজের মতো তৈরি করে নিয়েছে আলাদা একটা জগৎ; কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে হাসিতে গল্পে গড়িয়ে পড়ছে। তার মধ্যে আমি, অপরিচিত অনধিকারী এক আগন্তুক, আমারও একটা আলাদা জগৎ—অস্বস্তির, ভয়ের। কোথায় যাচ্ছি, যাচ্ছি কেন, কী হবে গিয়ে, এই সব প্রশ্নের কুটকুট শুরু হয়েছিল।
বৃদ্ধমতন এক ভদ্রলোক জানালার বাইরের বিকালটির সঙ্গে নিজের চোখ দুটিকে মিলিয়ে দিয়ে বসেছিলেন, একবার ভাবলাম, তাঁর পাশে বসি, কিন্তু ভরসা হল না, তাঁর দিকে ঝুঁকে নিচু হয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, “এই গাড়ি কোথায় যাবে?”
তিনি চোখ ফিরিয়ে তাকালেন। মাথা থেকে পা, এক নজরে আমার আন্দাজ নিয়ে বললেন, “আপনি—তুমি কতদূর যাবে?”
“অনেক দূর”, আমি থতমত খেয়ে বললাম।
(তাই তো, ঠিকই তো, অনেক দূরই তো আমি যেতে চাই)
একটু সন্দেহের চোখ বাঁকাভাবে তাকালেন তিনি।—এ গাড়ি তো অনেক দূর যাবে না।” তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে জানালার বাইরের বিকালে মগ্ন হয়ে গেলেন।
তখনই সে এল, সেই চেকার। পা-দানি বেয়ে বেয়ে কী অবলীলায় যে আমাদের কামরায় এসে ঢুকল। “টিকিট কই, টিকিট! টিকিট, টিকিট!” ঘুরে ঘুরে সে সকলের সামনে দাঁড়াচ্ছিল, ঘুরে ঘুরে একই কথা বলছিল।
এক সময়ে আমার পালা—”টিকিট?” মৌখিক পরীক্ষায় সবচেয়ে শক্ত শক্ত প্রশ্ন করেছেন স্যার, উত্তর দিতে পারছি না।
সে-ও আপাদমস্তক মাপ নিল। চোখটা ছুঁচের মতো ফুটিয়ে দিয়ে বললে, “নেই?” তখন পুতুলনাচের বোবা কোনও নকল বীরের মতো শুধু মাথা নেড়েছিলাম?—মনে নেই!
সে আবার বলল, “কোথায় যাবে? “
(আহা, তা-ই যদি জানতাম। অথচ টের পেলাম ও-ও আমাকে তুমি বলছে। ভীষণ রাগ হচ্ছিল।)
বলে ফেললাম “শেয়ালদা।”
শুনে চেকারটা নিজের মুখটা খুব কুৎসিত করে হেসে উঠল। সকলকে শুনিয়ে বলল, “শুনছেন? এই ছোকরা বলছে শেয়ালদা যাবে।” তখন কোলে ঝাড়ন বিছিয়ে যারা তাস খেলছিল, তাদের একজন মুখটাকে উটের কায়দায় উপরে তুলে সেই হাসিতে তার হাসি মেলাল।
চেকার বলল, “ছোকরা, ফোকোটের প্যাসেঞ্জারি করতে চাইছে, কিন্তু ফাঁকি দেবার বিদ্যেটা রপ্ত করোনি। বুদ্ধির ঘট ঠনঠন বুঝি? এই গাড়িটা আসছেই তো শেয়ালদা থেকে, হ্যা-হ্যা। নাকি ওই বদমায়েশি করেই পার পাবে ভেবেছ, ওহে ছোকরা।”
ছোকরা, ছোকরা, বারবার ওই একটা কথার ছ্যাঁকা লেগে আমার মাথায় খুন চেপে গেল। ফস্ করে বলে উঠলাম, “নসেন্স! কাকে কী বলতে হয় জানো না?”
সে আমাকে “তুমি” বলেছিল বলে আমিও তাকে “তুমি” বললাম। সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল সে, ক্ষিপ্র পায়ে। আমার জামার কলার চেপে ধরে ক্ষেপে গিয়ে দিতে থাকল ঝাঁকানি, একটা কুকুরের মতো গর্র্-গর্র্ গলায় বলতে থাকল, “তুমি জানো? আজ তোমাকে জানিয়ে দেব। জানো, জানো, ননসেন্স কথাটার মানে জানো?”
কলার চেপে আমার প্রায় চুঁটি টিপে ধরেছিল সে, আমার চোখ আপনা থেকেই উছলে উঠতে চাইছিল। তখন ক্ৰমাগত ঝাঁকানি, আর কানে ঝাঁকে ঝাঁকে ভিমরুল হুল ফুটিয়ে বলে চলেছে, “জানো, ননসেন্স-এর মানে জানো?”
একটি কেঁচো তখন কাতর ভাবে আমার গলায় লেপটে নিস্বরে বলছিল, “ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও” আর হাত দুটি অস্থিহীন অবশ হয়ে সরীসৃপের মতো ঝুলছিল, আর কত কেন্নো যে হাঁটছিল শিরশির করে ওঠা শিরদাঁড়ার মজ্জা বেয়ে, মা সে লজ্জা লেখায় লেপে দেওয়া অসম্ভব।
“জানো, জানো, মানে জানো?” যখন ক্রমশ পরদা চড়াচ্ছিল সে, তখন সেই অন্য লোকটি, যে উটের মতো মুখটি তুলে হেসেছিল খানিক আগে, হাঁক দিয়ে বলে উঠল, “যেতে দাও, যেতে দাও হে মল্লিক। ছেলেটার চেহারাটা কী, দেখছ না? ননসেন্স কাকে বলে ও জানে না। আহা, জানলে কী আর বলত?”
চেকার কলার চেপে ধরায় আমার শুধু দম বন্ধ হয়ে এসেছিল, কিন্তু ওই লোকটা যে-ই বলল “জানে না, আহা!”—ওই ‘আহা’ কথাটা আমার মাথার উপরে এক বোতল কালি যেন উপুড় করে ঢেলে দিল।
গাড়ির গতি কমে এসেছিল। ধস ধস শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে দাঁড়িয়ে পড়ল একটা স্টেশনে। যদিও তখনও চেকারটা তড়পাচ্ছিল, “জানিয়ে দেব আজ আচ্ছা করে, ভালো করে শিক্ষা দেব”, তবু অন্য সকলের কথায় শেষ পর্যন্ত কলারের মুঠি আলগা করল সে, গাড়ি থামতেই ছোট্ট একটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে শীতল পিছল প্ল্যাটফরমের উপরে ছুঁড়ে দিল।
চোখ ঝাপসা, তাই কি ছানি-পড়া গোছের দেখছি সব, সেই স্টেশনের চারধারে সরষে ফুলের মতো আলো। মিটমিট করে জ্বলছে, আলো না বিড়ির ফুলকি ওগুলো? অজস্র বিড়ি জ্বলছে, দেখতে পাচ্ছি, এধারে ওধারে—কাল না অবিনাশ এগুলোই ছুঁড়ে দিয়েছিল বাবার বিছানায়, অপমানের সেই ফুলকিগুলো এতদূর অবধি উড়ে এল কী করে?
অপমান, অপমান, এই ফুলকিগুলো অপমান। অপমান এই ইসটিশনের গরম হাওয়ার হল্কায়। প্ল্যাটফর্মের শেষ অবধি গেলাম, গাড়িটা ছেড়ে গেছে, কিন্তু তার টলমল ভাব রেখে গেছে আমার চলায়, ভিতর থেকে কী সব যেন ঠেলে উঠবে, বমি, বমি হবে নাকি আমার, না, এই যে একটা কল, ঝাপটা দিলাম মাথায় জল, ঠান্ডা জল, আঁজলা ভরে—আ-হা! কলের ঝর্ঝর ধারায় স্নেহ আর সান্ত্বনা সঞ্চারিত হয়ে যেতে থাকল, আমার স্নায়ুতে, শিরায় শিরায়।
তখনই শুনতে পেলাম, “আয়।” চমকে চেয়ে দেখি, সুধীরমামা
সেই সুধীরমামা। যদি বলি দেখামাত্র চিনলাম সেটা চটক দেওয়া একটা মিথ্যা কথা হবে। মা, তোমাকে তো ঠকাতে পারব না। যেই তিনি আবার বললেন, “আয়”, তখনই চেহারায় নয়, তাঁকে তাঁর কণ্ঠস্বরে চিনলাম। ওই ডাক আজন্ম আমার চেনা না? অনেক—অনেক সময়ের স্তর পার হয়ে কতদিন পরে এল, আবার এল। যেন আকাশের দিকে চোখ তুলে চেয়েছিলাম সেই মেলে রাখা চোখের পাতার উপরে “আয়”, এই দুটি অক্ষর নয়, টপটপ কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জল পড়ল।
সুধীরমামা একটা বেঞ্চে বসেছিলেন, আস্তে আস্তে যেই বললেন, “কী হয়েছে”, তখন, সেই জল, টের পেলাম আমার চোখ ছাপিয়ে যাচ্ছে। “কী হয়েছে”, তিনি বললেন আবার। আমার চোখ ছাপিয়ে যাচ্ছে, জবাব দেব কী, আমি বসে পড়েছি ওঁর পায়ের কাছে, সেই বেঞ্চটার নীচে, চোখ ছাপিয়ে যাচ্ছে আমার, বসে পড়েছি, সেই একদিন যেমন বসতাম, এক দিন, কত দিন, এতক্ষণ…আটকে রেখেছিলাম, এখন আর জলের তোড়ে সব ভাসিয়ে আমার ছেলেবেলার ফিরে আসা ঠেকাতে পারছি না, আমার বয়স, এই ক’-বছরের পেকে-ওঠা, আমার কলকাতা, সব মুছে যাচ্ছে, আমি ওঁর হাঁটুতে মুখ ঠুকছি, আমার সুধীরমামার, লাগছে, মুখে নয়, আমার বুকে, তিনি কাঁপা -কাঁপা হাত দিয়ে আমার মুখটা তুলে ধরে দেখতে চাইছেন।
“কী হয়েছে” আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমার গালে হাত বোলাতে গিয়ে কী অনুভব করে একটু সরে আমাকে দেখতে থাকলেন।—”বড় হয়ে গেছিস”, বললেন বেশ ভালো করে নিরীক্ষণ করে।
আর আমি, উতলা অবোধ আমি তখনও তাঁর পায়ে মাথা ঘষে ঘষে বাক্যহারা অভিমানে আর অস্বীকারে বুঝিয়ে দিতে চাইলাম, বড় কোথায়, বড় কোথায়, যা ছিলাম তাই আছি, কিংবা তাই হতে চাইছি, চোখ নেই, চোখ নেই আপনার? আপনি বুঝতে পারছেন না? আমার চোখের নীচের কালি মিথ্যে, গালের টসটসে ব্রণগুলো মিথ্যে, আর ভাঙা গলা? কোথায় ভাঙা গলা, এই তো আমি সেই ছেলেবেলার সুরেলা গলায় মনে মনে ডেকে উঠেছি, “সুধীরমামা!”—শুনতে পাচ্ছেন না? আমরা সারাজীবন কতবার এক-একটি ক্ষণে নিষ্কলুষ ধৌত হয়ে যাই, ফিরে পাই আমাদের সেই প্রথম-কে।
.
অন্তত আমি পেয়েছিলাম। “বড় হয়ে গেছিস” শোনার পরে ভালো করে আমিও তাকিয়ে দেখলাম তাঁকে। কতটা বদলে গেছেন তিনি? গায়ের রঙ সেই আগের মতোই আছে, তামাটে, তবু উজ্জ্বল, নাকের গড়, চাউনি—ও-সব আবার বদলায় নাকি! শুধু হাত দুটি যে আরও শীর্ণ, সেটা অনুভব করেছিলাম আমি, আমাকে যখন ধরে ছিলেন তখন বোধ করেছিলাম তাঁর করতলের কম্পন।
“কী দেখছিস?” তিনি স্মিত মুখে বললেন।
“আপনি কিন্তু বুড়ো হয়ে গেছেন, সুধীরমামা”, বললাম লাজুক স্বরে। “বুড়ো আর আরও রোগা।”
“বুড়ো?” তিনি হাসলেন আগেকার মতোই, বুকের সব দরজা জানালা হা-হা করে খুলে দিয়ে।—”তা হয়েছি। বয়স কম তো হল না। রোগা হয়েছি? সে তো ভালোই, চরবি-টরবি ঝরছে। শুধু কি চরবি, অনেক কিছু ঝরে গেছে।”
আহত খিন্ন গলায়, কিন্তু মনে মনে আমিও তাঁকে বলতে থাকলাম, মানে বলতে চাইলাম, “সুধীরমামা, আমাদের সব কিছু ঝরে গেছে। কলকাতা কেড়ে নিয়েছে সব একে একে, বাবার শরীর ভাঙা; সেই বলিষ্ঠ মানুষটা এখন কেমন উদ্ভ্রান্ত। মা—”
“ওরা কেমন আছে রে?” কী আশ্চর্য, মনের ভিতরে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আমার চিন্তা যেখানটায় পৌঁছেছিল, উনি কি টের পেয়ে সেখানেই হাত বাড়িয়ে তাকে খপ করে ধরে ফেললেন? ওরা মানে কারা, ওরা মানে কে, মা, আমার বুঝতে এক নিমেষও লাগল না।
সংক্ষেপে বললাম, “ভালো না”, তারপর তাড়াতাড়ি “ভালো।”
চশমার ফাঁকে চোখ পিট পিট করছিল তাঁর। “ভালো না—ভালো? তার মানে? কলকাতায় এসে এই ক’বছর বুঝি খুব হেঁয়ালি শিখেছিস? আমি গ্রাম্য মানুষ, তায় সেকেলে জানিসই তো। আমাকে একটু বুঝিয়ে বল।”
একটা হঠাৎ উচ্ছ্বাসে বলে উঠলাম, “কলকাতা আমার ভালো লাগে না, সুধীরমামা।” আর কিছু বলতে পারলাম না, যদিও বুকের মধ্যে অনেক কথা আগুন-লাগা বাঁশের মতো ঠাস ঠাস ফেটে যাচ্ছিল। টের পাচ্ছি উনি এক দৃষ্টে চেয়ে আছেন, মূর্ছিত রোগীর নাড়ি ধরে অপেক্ষমান ডাক্তারের মতো। সেই রোগী তখন মূর্ছাঘোরে বলছে, “তাই তো আজ ট্রেনে উঠেছিলাম, কিন্তু কী যে হল! মন-খালি চলে যেতে চাইছিল—কোনওখানে। ভগবান দিলেন না, আবার খানিকটা দিলেনও। সশরীরে ফিরতে পারলাম না বটে, তবু যেখানে ফিরতে চেয়েছিলাম, তারই খানিক, তারই প্রতীক সুধীরমামা হয়ে ফিরে এলো।”
.
এসব কথা অবশ্য বললাম না, মুখে পরিস্ফুট করে যেহেতু বলা যেত না। বোকা বোকা গলায় হঠাৎ বললাম, “এটা কোন্ স্টেশন, সুধীরমামা?”
এবার তিনি সত্যি অবাক হয়ে গেলেন। “কেন, দমদম! কোন্ স্টেশন তা-ও জানিস না, তবে এলি কী করে?”
সবটা বুঝিয়ে বলতে হল না, উনি আমার পিঠে রেখেছিলেন একটা হাত, স্পন্দন থেকে কিছুটা আন্দাজ করে নিলেন। “পালিয়ে যাচ্ছিলি?” কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, “ধরা পড়েছিস? তাই ওরা নামিয়ে দিল? তাই কাঁদছিলি?”
এ গলা তো তিরস্কারের নয়, সমব্যথীর। আমি আর সুধীরমামা কবে সমব্যথী ছিলাম, কখন, কোন্খানে, মা, অতীতের কয়েকটা পৃষ্ঠা সেলাই ছিঁড়ে শুকনো পাতার মতো ফর ফর করে উড়ে বেড়াতে থাকল, আধো-কাঁদো গলায় আমি কেবল বলতে পারলাম, “আমার টিকিট ছিল না যে।”
.
তিনি শুধু বললেন, “আর পালাস না। টিকিট যতক্ষণ না মিলছে ততক্ষণ গাড়িতে উঠতে নেই। নেমে যেতে হবে কিংবা ওরা নামিয়ে দেবে।” তখনও খুব নিচু তাঁর কণ্ঠস্বর, বলার ধরন নেই সেই আগেকার মতন, “যেমন আমাকে কতবার নেমে যেতে হয়েছে। পালাতে—কোথাও চলে যেতে আমিও চাইনি! তবু।”
তিনি থেমেছিলেন। সেই সময়টাতে আমার দৃষ্টিভ্রম, শ্রুতিভ্রম, সব ঘটে যাচ্ছিল। কাকে দেখছি, মুখটা ভালো ধরতে পারছি না তো, কার কণ্ঠস্বর? মা, তখনই আমি, সেই বোধহয় প্রথম, দু’জনকে এক হয়ে মিলে যেতে দেখলাম, সুধীরমামাকে আর বাবাকে। একজন ছিলেন চিরকাল আত্মসমর্পিত, অন্যজন উদ্ধত, বিশৃঙ্খল। কালো তাল তাল কাদার মতো দু’জনকে পিটে পিটে পাশাপাশি বসিয়ে দিয়েছে, একই কারাগারে, বদ্ধ, বন্দি, বিপরীত চরিত্রের দুটি মূর্তি, সময়ের হাতের নিশানায় একত্র মিলিত, একাকার!
.
“আমিও চলে যেতে চেয়েছি তো, পারিনি। তা ছাড়া এখন আরও পারব না। এই যে লাঠিটা দেখছিস, এটা আগেও ছিল, কিন্তু এখন আমার একান্ত নির্ভর। এটায় ভর না দিয়ে এক-পা নড়তে পারি না। বাতে এই লম্বা শরীরটাকে একেবারে ভেঙে দিয়েছে। কতটা নুইয়ে দিয়েছে, উঠে দাঁড়ালে দেখিস। একেবারে বাঁকা—যা ছিলাম তার চেয়ে অন্তত সাত-আট ইঞ্চি কম।”
(তার মানে, সেখানেও এখন বাবার মতন, কথাটা একবার ঝিলিক দিয়ে গেল, তবে ওই গাঢ় পরিবেশ সস্তা কোনও কথার চালাকি বরদাস্ত করত না।)
“মজবুত ছিলাম যত দিন”, সুধীরমামা বলে যাচ্ছিলেন, “একদিন টের পেলাম, সত্যি সত্যি খুব দূরে যাওয়ার দরকার হয় না। বসে বসেই যাওয়া যায়। রাত্রে ট্রামে উঠেছিস? কিংবা বাসে সামনের সীটে? একটু অভ্যেস করলেই মজার খেলাটা শিখে যাবি। খালি চোখ বুজে থাকবি, শুনবি শোঁ-শোঁ, কিন্তু কক্ষনো চোখ খুলে বাইরে চাইবি না কোথা দিয়ে যাচ্ছিস জানতে চেষ্টা করবি না, খালি ওই শব্দ, শোঁ-শোঁ-শোঁ গতির; অনুভূতি শুধু—মনে হবে দূর থেকে কত দূরে ভেসে চলেছিস।”
সম্মোহিতের মতো শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন, “আর একটা খেলা, এইটেরই রকমফের, আর-একজন লোক, সে এই স্টেশনেই আমাকে শিখিয়ে দিল। সে ছিল ক্যানভাসার, বছরের পর বছর শুধু গাড়িতে ঘুরে কাটিয়ে দিল, শেষে একদিন কাটা গেল ওর একটা পা। প্রাণ নিয়ে টানাটানি, হাসপাতালে অজ্ঞান হয়েই কাটল তিন দিন। সেখান থেকে ছাড়া পেতে পেতে আরও দু’তিন মাস। ওর সঙ্গে আমার মুখচেনা ছিল। একদিন ওকে এখানে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ‘—কাজ শুরু করেছেন নাকি আবার, সেই ঘোরাঘুরির কাজ?’ জিজ্ঞাসা করলাম। সে পাশে রাখা কাঠের পা-টা দেখিয়ে দিল।——সেই কাজ আর করব কী করে। এখন—এখন একটা দোকানে খাতা লিখি।’ বললাম——তবে যে এখানে? শুনে ও শুধু হাসল। বুঝলাম। ঘোরাঘুরির নেশা রক্তে ঢুকেছে যে। সেই টানে আসে। চেয়ে চেয়ে দ্যাখে, সব ট্রেনের আসা-যাওয়া গোনে। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই লোকটি ক্লান্ত হয়ে চোখের পাতা বন্ধ করল। দেখলাম, চোখের কোণ থেকে কষের মতো ধারা গড়াচ্ছে। বুঝলাম না, কী কষ্ট পাচ্ছে। এ কি সেই কষ্ট, অপঘাতে মৃত মানুষের আত্মা যে-কষ্টে কাছাকাছি ঘোরে, মোহমুক্ত হতে পারে না? পরে, জানিস ভেবে দেখলাম চোখের পাশের ওই জলের রেখা আনন্দের তো হতে পারে? চোখ বুজে প্রত্যেকটা চাকার ঘুরে-যাওয়ার আওয়াজের সঙ্গে হয়তো ওর বুকের আওয়াজ মেলাচ্ছে? চল উঠি।”
সুধীরমামা উঠলেন। আগে দাঁড় করিয়ে দিলেন ওঁর লাঠি, সেটাকেই ভর দিয়ে দাঁড়ালেন নিজে। অনেকটা সেই আগেকার মতোই আছেন, তবু ততটা ঢ্যাঙা লাগছে না দেখতে, পিঠ ধনুকের চাপের মতো হয়ে গিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
স্টেশনের ছাউনির নীচে যতটা অন্ধকার লাগছিল, বাইরে ততটা নয়, দূরে-কাছে কাছে গাছের আগাগুলো আর কোনও-কোনও বাড়ির ছাদ তখনও যেন বেশ খানিকটা খুশি মেখে ছিল। আকাশটা মস্ত একটা থালা, খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরও তার কিনারাতে খানিকটা রোদের এঁটো লেগে আছে।
রাস্তায় ভিড়ও ছিল। কয়েকটা তরি-তরকারির ঝুড়ি ঘিরে ছোট-খাটো একটা বাজারও বসেছিল। একটা জায়গায় সুধীরমামা কিছু কিনবেন বলে দাঁড়ালেন। অন্য খদ্দেরদের কাটিয়ে সামনে যেতে সময় লাগছিল। কী কিনলেন শেষ পর্যন্ত? তাকিয়ে দেখলাম, বেশি কিছু নয়, একগোছা বাসী ফুল। তারপর আবার চলতে থাকলেন।
বুঝতে পারলাম, একটু হাঁপিয়ে পড়েছেন ইতিমধ্যেই। হাতের লাঠিটা ঠিক জায়গায় পড়ছে না। বললাম, “সুধীরমামা, আপনার চলতে কষ্ট হচ্ছে?” মাথা ঘুরিয়ে বললেন, “ও কিছু না। এইটুকু কষ্ট করতেই হয়—বাঁচতে হলে। তোকে একটু আগে যা বলছিলাম না? পুরোপুরি ঠিক নয় কথাগুলো। কিংবা ততটাই ঠিক, সব আদর্শ যেমন। সবটা খাটানো যায় না। মনসা মথুরাং গচ্ছামি, মনে মনেই যাওয়া যায় মথুরায়—ওটা আসলে শুধু বিশ্বাস। অভিজ্ঞতা নয়! পঙ্গু সত্যিই যদি গিরি লঙ্ঘন করতে চায়, তবে তাকে কষ্ট করে কয়েক পা হাঁটতেই হবে। নইলে, যে পা-খোয়ানো ক্যানভাসারটির কথা তোকে বললাম, সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্টেশনেই বা আসবে কেন? ঘরে বসে- ছাপানো টাইমটেবলের হরফে আঙুল বুলিয়েই দূর থেকে দূরে যাওয়ার স্বাদ পেয়ে যেত। তা হয় না”–সুধীরমামা বললেন, “যে বধির সে স্বরলিপি পড়ে আসল গান শোনার আনন্দ কিছুমাত্র পায় না। ওটা নিজেকে ভোলানো, দুধের বদলে অশ্বত্থামাকে পিটুলি-গোলা খাওয়ানো। বুঝতে পারছিস!”
একটা গলির মুখে আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, “না। কিন্তু সুধীরমামা—” যে কথাটা মনে এসেছিল অনেকক্ষণ আগে, মুখে ফুটে সেটা বলেই দিলাম এতক্ষণে—”আপনি ঠিক বাবার মতো কথা বলেন।”
“বলি বুঝি?”—একটু কি চমকে উঠলেন তিনি, কিন্তু চট করে সামলে নিয়ে বললেন, “হতে পারে। ঘুরে ফিরে আমরা হয়তো একটা জায়গাতেই এসে পড়েছি। হতে পারে।”
বলতে গিয়েও, মা, সুধীরমামা একবার কাশলেন, ওঁর গলা কেঁপে গেল একবার।—”কী বলেন তোর বাবা—প্রণববাবু?”
“সে কি আমি আপনাকে বলতে পারব? খুব শক্ত শক্ত কথা যে! অসুখ খুব হয়েছিল তো বাবার, এখনও সারেননি। সেই থেকে কেমন আলাদা আলাদা ধরনের কথা বলেন। মানে— যত এলোমেলো হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল আমার কথা আমি ততই ব্যগ্র হয়ে বুঝিয়ে দিতে চাইছিলাম সুধীরমামাকে—”বাবার মনে, আজকাল খুব বিশ্বাস। ভগবান মানেন।”
“মানেন?” সুধীরমামা উপরের দিকে তাকালেন, যেন ভগবান ওখানেই ব্যাপ্ত হয়ে আছেন কিনা দেখতে চাইলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “কই, আমি তো বিশ্বাস করি না।”
“করেন না?”
সুধীরমামা বললেন, “না। তবে কয়েকটা রুচি-অরুচি, ন্যায়-অন্যায় মানি।” হাতের হলুদ ফুলগুলো দেখিয়ে বললেন, “যেমন এগুলো। সকালেও তো কিনতে পারতাম? কিন্তু তখন ওরা খুব টাটকা থাকে, মায়া হয়। এখন দেখছিস কেমন মিইয়ে এসেছে। এখন আর ওদের নিতে বাধা নেই। জীবনের সাধ যাদের আছে, তাদের নষ্ট করে দিতে আমার কষ্ট হয়। যারা শুকিয়ে এসেছে বা ফুরিয়ে গিয়েছে, তাদেরই আমি নিই, নেড়েচেড়ে স্বস্তি পাই। “
“তাই তো বললাম সুধীরমামা, আপনি ঠিক বাবার মতো কথা বলেন।”
তিনি বললেন, “কই! তাঁর বিশ্বাস আছে, আমার নেই।”
ফস্ করে তখন বলে ফেললাম, “সুধীরমামা, বাবার উপরে আপনার খুব রাগ, তাই না?”
বলেই বুঝেছিলাম মূর্খের মতো কাজ করেছি। উনি রেগে যাবেন এক্ষুনি, হাতের লাঠিটা কাঁপতে থাকবে। কিন্তু কাঁপল না। আতঙ্ক-গ্রস্তের মতো বলে উঠলেন, “রাগ? না। একটুও না।”
আমরা আবার চলতে শুরু করেছিলাম, তখন হঠাৎ একটু হাওয়া উঠে সব সহজ করে দিচ্ছিল। উনি সব খবরাখবর নিচ্ছিলেন। একবার বললেন, “তুই তো জেনট্লম্যান হয়ে গেছিস।” কোথায় আছি শুনে বললেন, “তবে তো বিশেষ দূর নয় এখান থেকে। কাছেই—এই রাস্তা ধরে চলে যাবি, সোজা পশ্চিমে, মাইল দুই মতন হবে বোধ হয়; আমি থাকি এই গলিটার শেষে—ওই যে টালির চালাটা দেখছিস, সামনে কল, ওইটে।” একটু অপেক্ষা করলেন ‘সুধীরমামা, বললেন—”আচ্ছা।” তার মানে বিদায় দিচ্ছেন। তবু একটু ইতস্তত করছি দেখে আবার কাছে এলেন—”যাব একদিন তোদের ওখানে। তোর ভাই কত বড়টি হয়েছে—ভাই, না বোন রে?—দেখে আসব।”
বলেই আস্তে আস্তে তাঁর বাসার দিকে এগোতে থাকলেন, আমার কয়েকটা কৌতূহল থেকেই গেল। ওই বাসায় আর কে আছে—ভামতী? ভামতীর কথা জিজ্ঞেসই করা হল না।
২৭
সেদিন যখন ফিরছি, তখন একটা সুখাবেশ সবুজ ঘাসের মতো মন ছেয়ে ছিল। একটু একটু হিমও জমছিল সেই ঘাসের শিষে শিষে–ভয়ের হিম। না-চেনা রাস্তা, তখন আবার সন্ধ্যার পরই এসব দিক একেবারে নিঝুম হয়ে যেত। সোজা চলছি, এইটেই ঠিক পশ্চিম তো? আকাশে কোনও চিহ্ন লেখা নেই। সুধীরমামা বলেছিলেন, সোজা পশ্চিম। সুধীরমামা, এক-একটা রক্তোচ্ছ্বাস থেকে থেকে বুকের ভিতরটা ছাপিয়ে যাচ্ছিল। সুধীরমামা—অবিশ্বাস্য। একটা মৃদু ভূকম্পও চাপা গুরুগুরু ধ্বনি তুলছিল।
শেষে, অনেকটা হাঁটার পরে চেনা জগৎটা আবার দেখা দিতে থাকল, কখন এক ঝলক গঙ্গাও দেখা গেল, তারপর—এই তো সেই ফটকটা। রাত হয়েছে তাই দরজা বন্ধ, কিন্তু তার শক্ত ইস্পাতের কবাটটা বিরাট একটা আশ্বাসের মতো। পেয়ে গেছি। কবাটের ঠান্ডা লোহায় হাত রেখে হাঁফ ছাড়লাম আমি, দম নিলাম। এই তো খুঁটি, এই তো আশ্রয়—গোহালে ফিরে গাভী যে রকম বড় বড় আরামের শ্বাস নেয়, আমিও তাই নিচ্ছিলাম। একে ছেড়ে কোথায় সারাদিন ঘোরাঘুরি করেছি—পাগলামি। ট্রেনে চেপে বসাটা একটা পাগলামি ছাড়া কী। যারা ভীত, তারা মাঝে মাঝে নিজের কাছে নিজের ইজ্জত ফিরে পেতে এইরকম সস্তা কাণ্ড করে। ফটকটার সামনে পৌঁছতে পেরে বেঁচে গিয়েছিলাম।
প্রথম দেখা তোমার সঙ্গে, সে তো হবেই, জানি। অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে, না-জানি খেতে হবে কত বকুনি, সে-সব চট করে চাপা দেব কী করে ভাবতে ভাবতে সবচেয়ে যেটা স্বাভাবিক, সেইটাই বলে ফেললাম, ভিতরে যা টগবগ করে ফুটছিল তাকে উচ্ছ্বাসের তোড়ে বের করে দিলাম।
“সুধীরমামাকে আজ দেখলাম, জানো মা!”
তোমার মুখে এতক্ষণ যে-চামড়াটা কোঁচকানো চাদর, তা যেন এইমাত্র মসৃণ টান-টান করে পাতা হল। ফ্যাকাশে গলায় একবার বললে “কে?” আর একবার “কী—কী বললি?”
“সুধীরমামা।”
কোথায় সেই একটু আগেকার রুক্ষ রূপ, তুমি একেবারে ভাব-লেশ শূন্য সাদা হয়ে গেছ। এতক্ষণ আমি ছিলাম ভয় ভয়ে, হঠাৎ যেন জোর পেয়ে গিয়েছি, সব রহস্যের চাবি আমার মুঠোতে। খুলব, একটু দেখাব; মুঠো বন্ধ করব আবার, দুষ্টুমির নেশাটা মাথায় বেশ জমছিল। তারপর—সেই আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া, জেরা আর জবাব একটানা, তুমি তো জানো। আমি আজ শুধু তার কাঠামোটা লিখি।
.
কী? আর কী?—আর কিছু না।—কেমন দেখলি?—ভালোই, বললাম তো। —ভালো? তা তো থাকবেই। কী বলল?—খবর নিলেন, আমাদের।—আমাদের মানে? কার কার? —বাবার আমার। –তোর বাবার আর তোর? ও। আর কী। —আর কিছু না। –কোনও কথা না? কথা অনেক, বলেছি তো। বাবার ওপর আর রাগ নেই। —নেই? তোর বাবার ওপর রাগ নেই? ও। আর? আর কিছু না।
“বাবার ওপর রাগ নেই”, কথাটায় বিস্ময় বা হতাশার এমন কী ছিল, মা, আমি তো জানি না। আমার জবানবন্দির ওই একটি বাক্য তুমি স্বগত-উক্তির মতো বার দুই নিজেই বলে বলে বাজিয়ে নিলে কেন? ঠিক তখনই বাবা উপরে এসে পড়েছিলেন, তাই। নইলে ওই জেরা জবাব, স্বগত-সংলাপ কতক্ষণ চলত, ঠিক নেই। তুমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলে, “শুনেছ, সুধীরদার সঙ্গে তোমার ছেলের আজ দেখা হয়েছে। সেই সুধীরদা। উনি কী বলেছেন জানো?”
বাবা চোখ তুলে তাকালেন।
“বলেছেন, তোমার ওপর ওঁর আর রাগ নেই।” যেন খুব মজার কথা, তুমি এইভাবে বলেছ। যেন খুব মজার কথা শুনলেন, বাবা হেসেছেন সেইভাবে। “রাগ তাহলে কোনও কালে ছিল বলো?”—এই পালটা প্রশ্ন করার সুযোগটা হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েও ছেড়ে দিলেন। বরং নির্মল গলায় বললেন, “নেই তো? আমি জানি, থাকবে না। আমারও নেই। রাগ কেন, কোনও কিছুই বেশি দিন থাকে না, উবে যায়, জুড়িয়ে যায়, মিলে যায়। বুঝেছ?”
তুমি তীব্র-দ্রুত বেগে বললে, “বুঝেছি। তোমরা দু’জনে মিলে গেছ। বুঝেছি।”
বাবার চোখ তখন আকাশে। মগ্ন কণ্ঠে বলছিলেন, “মন দিয়ে দেখলে সর্বত্র এই মিলে-যাওয়ার ব্যাপারটা দেখতে পাবে। আমরা যাকে তীক্ষ্ণ, তির্যক অথবা সরল রেখার মতো সটান ছিটকে ছুটে যেতে দেখি, সে-সবই কম সময়ের পরিসরে। সংঘর্ষ যত ঘটে, তা-ও সীমিত কালের গণ্ডির ভিতরে। সময়ের সুতো ছাড়তে থাকো, দেখবে একটা সীমার বাইরে গিয়ে আর কোনও বিরোধ নেই, কারও সঙ্গে কারও না সেখানে শুধুই বিস্মরণ, সেখানে শুধুই ক্ষমা। পুরোটাকে এক সঙ্গে দেখতে হলে খালি একটু ধৈর্য, একটু অপেক্ষা চাই—বুঝলে না?”
“না, না।” দাঁতে ঠোঁট চেপে তুমি বললে, “ওসব বড় বড় কথা আমার মাথায় আসে না। পুরো-টুরো দেখার সাধ নেই, ধৈর্য আমার ধাতে নেই—কিচ্ছু না।”
দাঁতে ঠোঁট চাপা, তোমার মুখের রঙ মুছে যাচ্ছে কেন, আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম। দাঁতে—ঠোঁটে, মা, কোথায় তোমার যন্ত্রণা?
আমি আস্তে আস্তে বললাম, “সুধীরমামা একদিন আসবেন বলেছেন, জানো? বলেছেন, সে ভারী মজার কথা, আমার ভাই না বোন কত বড়টি হল, দেখে যাবেন।”
কথাটা মজার বলে, নাকি অন্য কোনও কারণে, তোমার মুখ থেকে কষ্টের ছাপটা ম্যাজিকের মতো মুছে গেল। ওই একটা সাধারণ কথায় পলকে সহজ হয়ে গেলে তুমি। সহজ, স্বাভাবিক।—”আগে বলিসনি কেন এই কথাটা?” তুমি হাসছিলে।—”সুধীরদা মিছে কথা বলেছে, বুঝলে?” বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাগ একেবারে পড়েনি, একটুখানি পুষে রেখেছে বুঝলে ভোলানাথ?” তা না-হলে ভাইবোনটোনের কথা বলত না।”
.
ওই বাড়িতে আমাদের আশ্রিত জীবন কিভাবে কাটতে থাকল তার রোজনামচা রাখিনি, তবে মনে আছে কষ্ট, অপমানবোধ ইত্যাদি ছুঁচগুলো ক্রমশই তাদের সূক্ষ্মতা হারাচ্ছিল। প্রথম দিনটাই ছিল ভারী—একটা বইয়ের মলাটের মতো। মলাটটা খুলে দিলেই হাওয়ায় পাতার পর পাতা যেমন আপনা থেকেই উড়ে উড়ে যায়, এক একটা দিনও সেইভাবে কাটছিল। অন্ধকার ঘরে প্রথম ঢুকলে চোখে কিছু পড়ে না, তারপর দৃষ্টি নিজে থেকেই ফুটতে থাকে, কাছে-দূরের খাট, আলনা, আসবাব ইত্যাদি ক্রমশ অস্পষ্ট আকার নেয়। দুঃখ বেদনাও তাই। তার সঙ্গে সহবাস ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যায়, আমাদেরও হচ্ছিল। জানছিলাম যে, সবই শেষ পর্যন্ত সহনীয়, বিশেষ করে প্রতিষেধক ওষধি খুঁজে পাওয়া যায়।
বাগানের আনাচে-কানাচে, গঙ্গার পাড়ে, বাবা যখন নানা গাছ-গাছড়া খুঁজে বেড়াচ্ছেন, শিকড়সুদ্ধ উপড়ে আনছেন কোনও-কোনওটাকে—এই দৃশ্য এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই। এবং এ-ও বুঝি, ব্যবসার উপাদান সংগ্রহ করা ওটা আসলে ছিল অছিলা, বাবা নিজের জন্যেই খুঁজছেন ওষুধ—সম্মানবোধ জাগিয়ে রাখার কোনও শিকড়, কিংবা এমন-কিছু যাতে অপমানবোধটাকে অন্তত ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায়।
আর আমি? আমার নিজের জন্যও ওই রকম একটা ওষুধ আমিও পেয়ে যাই দৈবাৎ—মা, সেদিন তুমি বোঝোনি, বুঝতে চাওনি, তবু আজ আবার বলছি, সেদিন আমার মনের তলাটা দেখতে যদি, তবে কিশমিশকে নিয়ে ঘটনাটা তোমাকে ক্ষিপ্ত করে তুলত না। কেন যে কী ঘটে, হঠাৎ কী কুড়িয়ে পেয়ে কেউ বেঁচে যায়, আজ আবার গুছিয়ে বলতে বসেছি—তোমার এজলাসে এই আমার জবানবন্দিতে। এই আমার শেষ চেষ্টা।
ওই ঘটনাটা ঘটল বলেই তো আমি বেঁচে গেলাম, সেই নেতিয়েপড়া দিনগুলোতে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রত্যয় ফিরে পেলাম। আজ এতদিন পরেও লিখতে লিখতে ভাবছি, আঃ, কিশমিশ যদি ওই বাড়িতে গোড়া থেকেই থাকত! তা তো না, সেই এল সব চেয়ে পরে, তার আগে আমার অনেকগুলো নিংড়োনো, শুকনো, কষ্টের দিন কেটেছে!
.
তোমার মাসিমা, ওই বাড়ির যিনি কর্ত্রী, তিনি অবশ্য দিন দুই পরেই ফিরেছিলেন। সঙ্গে তাঁর নাতি। ওরা আসতে আসতেই বাড়িটায় কেমন সাড়া পড়ে গেল, বদলে গেল আবহাওয়া।
সত্যিই চমৎকার মানুষ তোমার মাসিমা, আমার দিদিমা। আমি সেদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখি, যেন ধুম পড়ে গেছে। ঝাড়পোঁছ, ধোয়ামোছার ঘটা। আড়ষ্ট হয়ে উপরে গিয়ে তাঁকে যেই প্রণাম করলাম; সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমার থুতনি তুলে ধরলেন—”আহা, যেন কেষ্ট ঠাকুরটি?!”
“দিদিমা, আমি তো কালোই”, লজ্জা পেয়ে বললাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে গাল দিলেন টিপে।—”লাগল বুঝি? আমি কিন্তু ভাই গায়ের রঙের কথা বলিনি। ঢলঢল ভুলিয়ে-দেওয়া মুখখানি—তাই বলেছি। কেষ্টঠাকুর, তোমার, এই রাধা কিন্তু থুথুড়ে বুড়ি। মনে ধরবে তো? দেখো, শেষে ঠকিয়ো না।”
আরও লজ্জা পাচ্ছিলাম আমি, তার উপরে তুমি ছিলে পাশেই, জুতসই রসিকতা দু’একটা মনে এলেও মুখে আনার জো ছিল না। তুমিই তাড়াতাড়ি বললে, “কী যে বলছেন মাসিমা? এখনও এমন রূপ আপনার! সাক্ষাৎ যেন অন্নপূর্ণা। রঙ যেন জ্বলছে। আমার মাসিমা বলে মনেই হয় না।”
তুমি ওঁর মন জোগাচ্ছিলে, বোঝাই যাচ্ছিল। ঠিক ধরে নিয়েছ তোমার যা কাজ। কিন্তু আমার কাজ কী? তখনও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। এইটুকু টের পেয়েছিলাম যে, পরমা রূপবতী উনি খুব বুদ্ধিমতীও—আমার গ্লানিটা মুছে দিতে চাইছেন। কিন্তু কেষ্টঠাকুর বললেই কি প্রকৃত সত্যটা ঢাকে? সেই সত্য এই—উনি অন্নপূর্ণা, আর আমি অন্নদাস অন্নপূর্ণার।
হঠাৎ খেয়াল হল চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে কে একজন আমাকে থেকে থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। রঙ টকটকে ফরসা, কিন্তু সে ছেলে না মেয়ে সেটা চট করে চেনা যায় না।
দিদিমা সেইদিকে চেয়ে বললেন, “আমার নাতি।”
নাতি? ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম আবার। কোনও ছেলে এত লম্বা চুল রাখে, আগে দেখিনি। চুল তো নয়, বাবরি। সে গুটিগুটি এগিয়ে আসছিল ঘরের দিকে, তাই তার চোখের সুর্মা, গলার কাছের পাউডারের ছোপও একে একে দেখতে পেলাম। গায়ের জামাটাও ফিনফিনে; পাঞ্জাবিই—কিন্তু ছাঁটে যেন ঢিলে সেমিজ। আর সে অসম্ভব রোগা, ফ্যাকাশে একটা পাটকাঠি। কাছে এসে আবার চোখ টিপল সে, বুঝলাম উঠতে ইশারা করছে। তখন তুমিই বললে, “যা না। ওর সঙ্গে একটু বেড়িয়ে আয়।”
নীচে নামতে নামতে সে নাম জেনে নিল আমার। ভ্রূভঙ্গি করে করে বলল, “বয়স? শুনে থুতনিতে কড়ে আঙুল ঠেকিয়ে সে ঘাড় বেঁকিয়ে কী ভেবে বলল, “আমার বড়, না ছোট?” কোনও ছেলেকে ওমনি কায়দায় ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়াতে দেখিনি। আসলে ওর গলা যতবার শুনছিলাম, ততবার চমকে চমকে উঠছিলাম। রিনরিনে মিষ্টি স্বর, বাঁশিতে ফুঁয়ের মতো। সেই গলাতেই সে বলছিল, “আমার নামও বাঁশি। বোধহয় আমার এই রকম গলা বলেই ওরা এই নাম রেখেছে। ভালো নাম? আমার ভালো নাম নীলা—নীলাচল।” ওর কোমল স্বর সন্ধ্যার ঝিরঝিরে হাওয়ায় কাঁপছিল। ওর কালো দুটি চোখের দৃষ্টি ব্যথিত হয়ে ছিল। অন্তত আমি বিশেষ কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আমরা বসলাম একটা গাছের গোড়ায় বাঁধানো বেদিতে। তার আগে সে পকেট থেকে রুমাল বের করে জায়গাটা সাফ করে নিল। আমি কথা বলছি না দেখে সে কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত দুলিয়ে আমাকে অদ্ভুত কায়দায় একটা ধাক্কা দিল।—”আমি জানি তুমি কী ভাবছ”, তার হিল্লোলিত শরীরে অপর্যাপ্ত সুবাস, সে টেনে টেনে বলছিল।—”ভাবছ এই ছেলেটা কী ভীষণ মেয়েলি, তাই না?” সে আমাকে আবার একটা ঠেলা দিল।
আমার নাকে উগ্র সুগন্ধি লাগল বলেই আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম, একটু সরে বসলাম।—”তুমি—তুমি সেন্ট মাখো কেন?“
সে ঢুলুঢুলু কাতর চোখে তাকাল।—”মাখি। পাউডারও মাখি তো। অভ্যেস হয়ে গেছে। নইলে গা ঘিনঘিন করে। নিজের কাছে নিজেরই বমি-বমি ভাব আসে।” বলে, বিলোল হেসে সে বলল, “ঘেন্না করছে?”
“আর এই কাজল? মাখো কেন?”
“চোখ স্নিগ্ধ থাকে। সব সুন্দর দেখি। নইলে এমনি অভ্যেস যে, চোখের পাতা পোড়ে চারদিকে সব দাউদাউ জ্বলতে দেখি। বিশ্বাস করো। নইলে কিছু সহ্য করতে পারি না আর। বিশ্বাস করো।”
সেই কথায় অনুভব করলাম, এই যে বাঁশি, ছেলে হয়েও কোমল লবঙ্গলতিকা প্রতিম, আর ভিতরেও কোথাও একটা জ্বালা, একটা প্রতিবাদ জ্বলছে।
একটি লোক তখনই সেখানে এসে জানাল চা জল-খাবার তৈরি। বাঁশি বলল, “নিয়ে এসো না। এইখানেই নিয়ে এসো।”
একটি থালা এসেছিল মোটে। সে অবাক হয়ে তাকাল। মানে বুঝে, বিশেষ করে ওই পরিচারকটির অস্বস্তি অনুমান করে তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “আমি—আমি তো বিকালে বিশেষ—” চাকরটাও সুযোগ বুঝে সায় দিয়ে বলল, “উনি, উনি তো—” ঝনঝন করে একটা কাঁসার থালা বেদির শানে কে আছড়ে ফেলল, আওয়াজ শুনলাম, সেই মেয়ের মতো দেখতে ছেলেটি সাংঘাতিক রেগে গেছে, ওর সারা শরীর কাঁপছে।
চাকরটি ভয় পেয়ে বলল, “বেশ তো উনি খাবেন তো, আসুন না।“
“না, না। চলো, আমিও যাবো।”
দু’জনে মিলে বসছি খাবার টেবিলে। থালা গ্লাস, সব আবার এল। দু’প্রস্থ। আমি যে কয়দিন ঠাঁই পেতে খেতাম রান্নাঘরের মেঝেতে, সেটা আর বাঁশিকে বললাম না। সাপের মতো ঠান্ডা যার শরীর, সে তখনও সাপের ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ফেলছিল।
সেই থেকে আমারও খাবার জায়গা টেবিলেই নির্দিষ্ট হয়ে গেল।
আর রাত্রে তুমি বললে, “বাঁশি বলেছে ওর ঘরে তোরও বিছানা নিয়ে যেতে। ওঘরে শুতে পারবি তো; শুবি?”
সোজা জবাব না দিয়ে বললাম, “আর তুমি?”
“আমি থাকব মাসিমার ঘরে।”
বাবার কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন হত। বাবা একাকী, এ আর নতুন কথা কী! চিলেকোঠা চেয়েছিলাম, অযাচিতভাবে সেই চিলেকোঠাতেই প্রোমোশন পেলাম। মা, সারা জীবনে এইভাবেই অনেকের তাচ্ছিল্য, অপমান, অবহেলা আমাকে ছ্যাঁকা দিয়েছে। কিছু দাগ থেকেই গেছে। অনেক তুচ্ছতাকে আবার মুছতে মুছতে এগিয়েছি।
আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে সে আঙুলের ডগায় ক্রিম তুলে মুখে ঘষছিল। পায়ের সাড়া পেয়ে আমাকে বলল, “এসো।”
ঠাট্টা করে বললাম, “তুমি এর পরে চুলও বাঁধবে বুঝি?” আমার সাহস বাড়ছিল। কিন্তু চাহনি খুব করুণ করে সে তাকাল। লম্বা লম্বা চুলের গোছা মুঠো করে ধরে বলল, ঠাট্টা করছ? করো। সবাই তো করে।” তার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। এগিয়ে এসে সে তার একটা তুলতুলে হাতে আমার হাত ধরল।—”আমাকে দেখলে কার কথা মনে পড়ে, সত্যি করে বলো তো? ঠিক যেন বৃহন্নলা, না?“
বলতে গেলাম “তা কেন, তা কেন, সে কী?” বাধা দিয়ে বাঁশি বলল, সেই সুরেলা গলা কিন্তু বিষাদে আক্রান্ত “মিছিমিছি আমাকে ভোলাতেও চেও না। আমি জানি। আমি বৃহন্নলাই তো। অর্জুন নই, অর্জুন কোনওদিন হতে পারব না।“
একটা ব্যর্থতা বলয়ের পর বলয়, তৈরি করে ছড়িয়ে পড়ছিল। একটু পরে ক্লান্ত গলায় সে বলল, “আলোটা নিবিয়ে দাও। রাত হল। এসো শুয়ে পড়ি।”
অন্ধকারেও তার অস্বস্তি টের পাচ্ছিলাম। মৃদু একটা সৌরভ বিজলী পাখার ঝাপটায় ছড়িয়ে পড়ছিল। আরও খানিক পরে বুঝলাম বাঁশি উঠে এসে বসেছে আমার শিয়রে।—”ঘুমিয়েছ?”
বললাম, “না।” ও কী বলবে তার অপেক্ষা করে রইলাম।
“একটা কথা বলব বলে উঠে এসেছি। এক বাড়িতে এক ঘরে আমরা থাকব, আমাদের দু’জনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে যাওয়া ভালো। শোনো, বৃহন্নলা আমি ইচ্ছে করে হইনি। ওরা আমাকে সবাই মিলে করেছে।”
“সবাই—মানে?”
“সবাই মানে সবাই। মা, বাবা, ঠাকুমা—সকলে। মা আর বাবা আজ নেই, কিন্তু বুড়িটা রয়েছে।” একটা ঘৃণা অন্ধকারেও ওর গলায় হিসহিস করছিল। ও কি কাউকে ভালোবাসে না এই পৃথিবীতে?
নিজে থেকেই এই প্রশ্নটা ধরে নিয়ে বাঁশি বলল, “কাউকে না। আমার বাইরেটাকে আমি ঠান্ডা কাদা দিয়ে লেপে রেখেছি। ভেতরটা রাগে ফাটছে। আমার বুকে হাত দিয়ে দ্যাখ।”
আন্দাজে হাত বাড়িয়ে সে আমার একটা হাত ধরে তুলতে গেল। ছাড়িয়ে নিলাম। বললাম, “বুকে হাত-টাত, এসব ঢঙ মেয়েলি।”
“মেয়েলি, মেয়েলি!” রুষ্ট হয়ে সুইচ টিপে আলোটা জ্বেলে দিল সে।—”আমাকে মেয়েলি করল কে? ওরাই তো।” বাঁশি বলে গেল, “সে ভারী মজার গল্প জানো? একটি
বোন হয়ে মরে যায় আমার আগে। আমার মা পাগলের মতো হয়ে গেল। শোকে পাথর হয়ে গেল এই বুড়িও। সে কী রকম, বুঝতে পারছ?”
আস্তে আস্তে বললাম, “পারছি। আমি দেখেছি।”
“তার তিন বছর পরে এলাম আমি! ওদের কী হল জানো? বুড়ি নাকি কোন্ তীর্থে গিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল, মার আবার মেয়েই হবে। যে গেছে, সে-ই ফিরে আসছে। মরা মানুষ ফিরে আসে, এ কি হয় কখনও?”
মাথা নেড়ে নেড়ে বললাম, “হয় না। কিন্তু মানুষ ভাবে। স্বপ্ন দ্যাখে।” মা, তোমার একটা পুরনো ছবি ভেসে উঠছিল।
বাঁশি বলছিল, “হলাম আমি। ওরা আবার ঘা খেল। সেই দুঃখ ভুলতে, সেই মেয়েটা ফিরে না আসতে কী কাণ্ড করল জানো? অবাক হবে শুনলে। আমাকে বরাবর মেয়ে সাজিয়ে নিজেদের ভুলিয়ে রাখতে চাইল। ফ্রক, চুড়ি, হার, বালা এসব তো ছিলই—এমন কী এই দ্যাখো, আমার নাকে নাকছাবির, কানের মাকড়ির ফুটোও আছে। মেয়েলি হাবভাব, ধরন সব ওই বুড়ি আমাকে বসে বসে শেখাত।”
“তুমি শিখতে কেন?”
“বারে! আমি কি বুঝতাম অতশত? অনেক দিন অবধি আমি আমার বয়সি আর কোনও ছেলে দেখিনি।”
“আষাঢ়ে গল্প।”
“আষাঢ়ে নয়। এই তো আমি তোমার সামনে বসে আছি জলজ্যান্ত।” সে একটু থামল। বলল, “পরে আমার একটি বোন হল অবশ্য। তুমি এখনও দ্যাখনি, তার ডাকনাম কিসমিস। ওদের মেয়ে হল, কিন্তু আমার আর ছেলে হওয়া হল না।”
বললাম, “শুধু ওদেরই দোষ দিচ্ছ কেন। তুমি নিজেও কেন বদলে যেতে পারলে না?”
বাঁশি ম্লান হাসল।—”পারলাম না। অভ্যাস চামড়ার মতো সেঁটে গেল যে। ইচ্ছে করলেই নতুন হওয়া যায়। টমবয়-টাইপের মেয়েও আছে শুনেছ তো? ইচ্ছে হলে তারাই কি আর মেয়েলি হতে পারে? পারে না।”
আমি বললাম, “সব বাজে কথা। ইচ্ছে করে তুমি এমনি হয়ে আছ। দোষ তোমারও। কেন, কেন এই লম্বা চুলগুলো রেখেছ? এগুলো ছাঁটতে বাধা কী?”
“বাধা? কিচ্ছু নেই।” বলতে বলতে বাঁশি শক্ত মুঠোয় ধরল ওর গুচ্ছ গুচ্ছ কেশরের মতো ফাঁপানো চুল—কাঁচি নিয়ে এসো, আমি এক্ষুনি সব কুচিকুচি করে কেটে ফেলতে পারি। কিন্তু”—দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে, গা এলিয়ে দিল “তা হলেও কিছু হবে না। আমি দু’বার তো কেটে দেখেছি। মাথা মুড়িয়ে ফেলতে হয়েছিল না? আমার বাবা আর মা মারা যাবার পরে? আমার সারা মাথায় চাকা চাকা দাগ—সব বেরিয়ে পড়ল একেবারে। আমাকে একা কি ওরা, ভগবানও নানা দিক থেকে মেরে রেখেছেন।”
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে। অতো বড়ো ছেলেকে আমি এভাবে কখনও কাঁদতে দেখিনি।
বাঁশি বলছিল, “কদমছাঁট চুল রেখেও দেখলাম-সে আরও কুৎসিত দেখায়। আয়নায় নিজেকে দেখে ভয় পেতাম। আমার এই বসা চোখ, তোবড়ানো গাল, বড় বড় চুলে তবু খানিকটা ঢেকে যায়।” টুকটুকে ঠোঁটে সে একটুখানি হাসি ফোটাল, বলল, “বলেছি তো ভগবানের মার। নইলে বাইরেটা না-হয় ওরা সাজিয়েছিল, কিন্তু আমার গলার স্বরও ছেলেদের মতো হল না কেন—ধরো এই তোমার মতো?”
মা, আমার কণ্ঠস্বর নিয়ে কোনও কালে কিছুমাত্র অহংকার ছিল না, বরং মোটা আর ভাঙা ভাঙা বলে লজ্জাই পেতাম, বিশেষ করে যখন থেকে জেনেছি আমার গলা বেসুরো তখন থেকে মন রীতিমতো খারাপ, এ-গলায় গান আসে না, চলতে ফিরতে কত সুরই না শুনি, সারাজীবন শুনেই যেতে হবে আমাকে; শোনা গান নিজের গলায় কখনও তুলতে পারব না, ভারী বিশ্রী, সে ভারী অক্ষমতা মা! এ-নিয়ে অনেকদিন পর্যন্ত মনে কষ্টের একটা ভিমরুল পুষে রেখেছি, সেই ভিমরুলটা আমাকে মাঝে মাঝেই হুল ফুটিয়ে দিত। আজ যে আমার এতখানি বয়স, ওই ভিমরুলটাও অবশ্যই জরাগ্রস্ত; তবু তার ওই হুল ফোটানোর স্বভাব গেল না। মানুষ যত বাড়ে, ততই চারধারের দিকে তাকিয়ে আর সকলের তুলনায় তার কী আছে কী নেই তার হিসাব করে। আরও যত বড় হয়, ফুরোনোর শুরু, তখন কী থাকবে, শেষের কালে কী নিয়ে থাকতে হবে, থাকা যাবে, মনে মনে তা-ও মেলায়। ব্যাঙ্কের পাস বই খুলে বসার মতো। আমি যেমন আজ দেখছি, আমার বিশেষ কিছু নেই। আমার আকর্ষণ অন্যের কাছে, অন্যের প্রয়োজন আমার কাছে, ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে, সঙ্গ-অসঙ্গ, নেশা, প্রার্থনা, অর্থহীন সব। দুপাশে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে ঘর বাড়ি, মাঝখানে সরু রাস্তা একটুখানি, প্রাণপণে তারই ভিতর দিয়ে ছুটছি, ইদানীং চোখ বুজলে এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি। সব মানুষকেই অবশেষে বাস করতে হয় নিজেরই সঙ্গে। আর কেউ নেই, আর কেউ না। একা হবার পরে অহরহ কাটাব যে আমার সঙ্গে, কী আছে আমার? খুব গোপনে, নিজের মুখের দিকে চেয়ে আমাাকে আচমকা প্রশ্ন করে বসি; দেখি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। যেন বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। আমিই ‘বরপক্ষ, আমিই পাত্রী।
(—রাঁধতে জানো?—না। গান জানো, গান? তা-ও না! তবে ছবি আঁকতে? ছি-ছি-ছি, কিছুই যখন জানো না তখন তোমাকে নিয়ে করব কী! আমার সকাল, আমার বিকাল, আমার রাত্রি-আঃ, এই জীবনের শেষ এই কয়টা রাত্রি—যে আমি পরিপূর্ণ করে তুলতে পারব না, তার সতত-সান্নিধ্যের বিধিলিপি, সাধ যায় যে চিৎকার করে অস্বীকার করি। মা, একটু ছবিতে তুলির টান দেওয়ার বিদ্যা সময় থাকতে থাকতে শিখে রাখতাম যদি, ক্ষতি ছিল না। একটা উপকরণ হয়ে থাকতে পারত সেই বিদ্যেটা অনেকেরই প্রৌঢ় বয়সে হয় যেমন।
কিংবা গান! যার গলায় আছে, তার শৈশব, যৌবন, সর্বকাল সুরে সুরে ধন্য হয়ে আছে। আছে শেষ বয়সেও, আর কিছু না হোক, নাই বা হল অন্য কারও জন্য—অন্তত শেষ পারানির কড়ি হয়ে নিজের কাছে!
আমার গান নেই, কোনও কালে ছিল না। এই শুষ্ক বঞ্চনার যন্ত্রণা বরাবর বহন করেছি। ভিতরটা যখন শব্দ-স্বাদে স্পন্দিত-মধুর, দেহও কখনও কখনও কোনও কোনও স্পর্শে হয়ে উঠতে চায় গান, গুনগুন, গুনগুন, হৃদয়-মন যেন আকুল একটা মৌচাক, তখন গলা ফোটাতে পারি না, বোবার যে-কষ্ট, সেই কষ্ট পাই। তার কারণ আমি কণ্ঠহীন সুরহারা।
কিন্তু বাঁশিকে সেই চিলেঘরে খাটের উপর বসিয়ে এ আমি কোথায় এলাম। বেশি বয়সের মুশকিলই এই; মুখের রাশ, ভাবনার বাঁধুনি, কথার সংযম থাকে না। প্রৌঢ় বয়সের ঘাটে বসে কম বয়সের কথা লেখা, এ কী কম জ্বালা! বেশি বয়স বারে বারে এসে সব ঢেকে ফেলে, বড় বউ হঠাৎ-হঠাৎ শোবার ঘরে ঢুকে পড়ে; ছোট বউকে হটিয়ে খাটের দখল নিতে চায়, তার আঁচলেই সব চাবি বাঁধা কিনা!—সেই জোরে। এই বয়সের আমিও বারে বারে সেই রোগা বয়সের আমির সঙ্গে সেই ব্যবহার করছে। থেকে-থেকেই তাই ভাবছি, দূর ছাই! যুবকেরা যৌবন আর যুবকদের কথা লিখুক; আমি প্রৌঢ় এই বয়সে যা পারা যায় তাই করি; আমি বরং প্রৌঢ়ত্বের কথাই লিখে যাই। উজানে আসা না রেখে ভাটির দিকে মুখ ফিরিয়ে বসি।
বসতামও হয়তো। কিন্তু তা হলে শ্রীচরণেষু—মা! তোমাকে প্রণাম করা যে সারা হয় না।
.
বাঁশি দুলে দুলে উঠছিল, বাঁশি নির্নিমেষ নীল দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। বুঝলাম ও আমাকে হিংসা করছে। আমার এই ভাঙা-ভাঙা গলাকেও যে হিংসা করার কিছু আছে, সেই প্রথম টের পেলাম। বাঁশি কাঁপছিল। ওর ফুলের কলির মতো তুলতুলে আঙুল দিয়ে আমার কণ্ঠনালির একটা শিরা স্পর্শ করল। আমি ওর হাতটা সরিয়ে দিলাম। তখন ও আরও কাঁপতে কাঁপতে আরও এগিয়ে এল, আমার চোখের পাতা প্রায় স্পর্শ করে ওর নীল চোখ রাখল। আমি ছটাস করে হাত ওঠালাম। ও চমকে বলল, “কী?” বললাম, “মাছি।” মাছি? এত রাত্তিরে এই ছাদের ঘরের হাওয়ায় মাছি? ও যেন বিশ্বাস করল না, বিষণ্ণ দুটি চোখ দিয়ে খুঁজতে থাকল—আমার চোখের মধ্যেই সেই মাছি কিনা।
বললাম, “ছি, এ-রকম করে না।”
অদ্ভুত আচ্ছন্ন স্বরে ও বলল, “কি রকম?”
কথাটা কীভাবে বলব ঠিক করতে না পেরে বললাম, “এই রকম। ছেলেরা ছেলেদের সঙ্গে এ-রকম করে না। করতে নেই।”
“ছেলে?” ফ্যাকাশে গলায় বাঁশি বলল, “আমি কি ছেলে? তবে ওরা আমাকে কেন খালি মেয়ের পার্ট দেয়, বলে আমি নাকি খুব ফাইন করতে পারি? আমাদের পাড়ার ক্লাবের যে-কটা প্লে-তে নেমেছি, সব মেয়ের রোলে। আমার সংযুক্তা শুনবে? শুনিয়ে দেব একদিন। সেবার একটা সীনে এমন ফিলিংস দিয়ে করেছিলাম যে, হীরো সেজেছিল যে, সে উইংস-এর পাশে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে, তারপর জাপটে—’
বাঁশি হাঁপাচ্ছিল, বাঁশি ঘামছিল। আমি তাড়াতাড়ি ওর মুখে হাত চাপা দিলাম। ওর চোখ চিকচিক করছিল।
ধরা ধরা গলায় সে বলল, “আমাকে ওরা একবার হসটেলে পাঠিয়েছিল। ছেলেরা কী অসভ্য তুমি ধারণা করতে পারবে না। ওরা আমাকে খ্যাপাত, দেখি দেখি বলে চিমটি কাটত, কাতুকুতু দিত শরীরের যেখানে-সেখানে। দু’তিন সপ্তাহ—সপ্তাহ তো নয়, যেন দু’তিন মাস, আমি রোজ কাঁদতাম, শেষে পালিয়ে এলাম। বুড়ি আবার আমাকে আর-একটা হসটেলে পাঠাবে পাঠাবে করছে, কিন্তু—” জোরে জোরে মাথা নেড়ে বাঁশি বলল, “আমি আর যাব না।” হসটেলে বিভীষিকার ছাপ ওর মুখ তখনও বিবর্ণ করে দিচ্ছিল, আমি ওকে শুয়ে পড়তে বললাম।
২৮
মেয়েলি ওই ছেলেটি, যার নাম বাঁশি, সে আমার জীবনের ওই অধ্যায়ে প্রক্ষিপ্ত, গৌণ চরিত্র কিনা, এখন ভাবছি। আর ভাবছি এই অংশটা একটু কেটে দেব কিনা। কিন্তু গৌণই যদি হবে, তবে এতক্ষণ ধরে সবিস্তারে কেনই বা লিখলাম। নিশ্চয়ই ও তবে গৌণ নয়, আসলে গৌণ হয়তো কেউই নয়। যত জনকে আমরা জীবনভোর দেখি, যত জনের সংস্পর্শে আসি, তাদের প্রত্যেকেই ছাপ ফেলে, পুকুরে যেমন আকাশের সব তারারই ছায়া পড়ে। যে-ছাপ মুছে যায় বলে ভাবি, তা-ও বস্তুত মোছে না, তারা হঠাৎ হঠাৎ ফিরে আসে, শোধ নেয়, যেমন আমার এই শেষ লেখার খেলাটায় একে একে ফিরে আসছে অনেকে। ঠেকাতে পারি না। বাঁশি, প্রথম দিনই যে বালিশে মুখ ডুবিয়ে বলছিল ককিয়ে ককিয়ে, “আমি জানি, আমি, তোমরা যাকে হিজড়ে বলো, একরকম তাই,” তবে কি আমি একটু মমতাও করছিলাম, আর মমতা করতে পেরে নিজেই বেঁচে গেলাম? মা, কথাটা বোধহয় একটু জটিল হয়ে গেল, কিন্তু কথাটা একটু জটিলই। এ-বাড়িতে আমরা আশ্রয়ের ভিখারি, সেই যন্ত্রণা-জ্বালা আপনার কাঁটাতারের তারে মন যখন আষ্টেপিষ্টে বাঁধা, তখন সেই তার টারগুলোকে খানিকটা আলগা প্রথমে করে দিল যে, সে তো ওই বাঁশিই; করুণার দাস সহসা জানল আরও করুণার পাত্র আছে একজন। ভিখারি হাতের মুঠো তুলে ভিক্ষা দিতেও শিখল, আত্মপ্রত্যয় বেড়ে গেল তার; বাঁশি আর আমার সম্পর্কে মোটের উপর এই ব্যাপার।
সে বিচিত্র, সে অস্বাভাবিক, কিছুটা অসুস্থও, সেইজন্যেই কি তার জন্যে মমতা আর কৌতূহল একটু বেশি খরচ করে ফেলছি? কি জানো, অসুস্থ অস্বাভাবিক—এসবও বোধহয় দেখা, বোঝা আর বলার ভ্রান্তি। দ্বিপদ যে-প্রাণীর নাম মানুষ, তাদের মধ্যে ঠিক ঠিক অর্থে সুস্থ কে? আটপৌরে মানুষ, সাদাসিধে মানুষ—অসুস্থ, প্রত্যেকে। ́ যে-গাছটাকে দেখি সোজা উঠে গেছে, তারও তলার দিকটা খুঁড়লে, মাটি কুপিয়ে তুললে দেখতে পাব সে-ও অজস্র সরুমোটা শিকড়ের জালে জড়িয়ে রয়েছে। মাহাত্ম্য, মহত্ত্ব, এ-সবও এক অর্থে অস্বাভাবিক, কারণ আতিশয্য আছে। কেউ দয়াধর্মে অস্বাভাবিক, কেউ পরম-কারুণিকতায়, বুঝতে পারছ? কোথাও একটা কিছু গোলমাল না থাকলে কেন এক রাজপুত্র স্ত্রীপুত্র ফেলে জরা ব্যাধি মৃত্যুর কিনারা খুঁজতে, জগতের যত কিছু দুঃখের রহস্য বুঝতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে? আবার অকিঞ্চিৎকর যে, সে-ও অস্বাভাবিক, যেহেতু সে সব কিছু তার রুগ্ন, অসহায় দৃষ্টি দিয়ে দ্যাখে। কামনার চোখে সব হলদে হয়ে যায়।
বাঁশিরও ব্যাধিটা ছিল কঠিন, সেদিন যা বুঝেছিলাম, ওর মন তার চেয়েও জট পাকানো ছিল।
মা, তোমাকে আজ সব কথাই বলা যায়, অন্তত আমি তো বলতে পারছি। বাঁশির একটা বাঁধানো খাতা ছিল। তাতে আঁটা ছিল রাশি রাশি ছবি। কিসের ছবি বলো তো? দূর, তুমি পারবে না, যা ভাবছ তা নয়। সে সব ছবিই ব্যায়ামবীরদের আর পালোয়ানদের। ছবির নীচে ছাপানো ছোট-ছোট পরিচিতি।
যেদিন খাতাটা দেখাল, ভাবলাম একটু ঠাট্টা করি।—”তুমি এসব ছবি রেখেছ কেন?”
“ওদের মতো আমি হতে পারব না, তাই বলছ তো? জানি।” বাঁশি আহত গলায় বলল, “তাতে কী। ওদের পুজো তো করতে পারি?”
“হীরো ওয়ারশিপ?”
“বলতে চাও, বলো। বোধহয় বলবে এই অভ্যেসটাও মেয়েলি?”
“না, না। আসলে ছেলেরা কিন্তু মেয়েদের ছবিই লুকিয়ে জমায়, বিশেষ করে বিলিতি ফিল্মস্টারদের। আমাদের ক্লাসের কেউ কেউ জমায়, দেখেছি।“
ভুরু উপরের দিকে তুলে বাঁশি বলল, “মেয়েদের ছবি জমিয়ে আমি করব কী? কোনও মেয়ে তো” এবার সে যেন বুকের ভিতর থেকে কলজে ছিঁড়ে শিরা বের করল—”কোনও মেয়ে তো আমাকে তার পায়ের নখ দিয়েও ছোঁবে না! আমার নরম হাত, তুলতুলে গাল–“
ওকে হাসাবার জন্যে আমি বললাম, “গালে টোল পড়ে”, কিন্তু বাঁশি হাসল না। আমার হাতের পিঠ ওর চিবুকে গালে ঘষে বলল, “একটা দাড়িও আজ অবধি গজায়নি। এই গলা, এই গাল, তোমাকে বলেছি তো, সব দিক থেকে আমাকে নিয়ে মজা করেছেন ভগবান।” হঠাৎ উত্তেজিত হাহাকারে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া স্বরে সে বলল, “পারবে, পারবে তুমি আমাকে কোনও একটি মেয়ের ভালোবাসা এনে দিতে? একটির—যে-কোনও।” আমার হাতের পিঠ পুড়ছিল। নরম একটা মানুষের শ্বাস এতও গরম হতে পারে?
আস্তে, আস্তে আমি বললাম, “আমি তোমাকে বদলে দেব।”
ওই অঙ্গীকার অর্থহীন, তবু বললাম। বদলানো খুব সহজ একটা ব্যাপার, ওই সময়ে আমি তাই ধরে বসেছিলাম নাকি? একটি গ্রাম্য ছেলে যেমন অনায়াসে শহুরে হয়ে গেছে, একটি মেয়েলি ছেলেও তেমনই চট করে বদলে যেতে পারে, সত্যিই কি বিশ্বাস করেছিলাম? তবে তো তখনও বিশ্বাসের সারল্য আর প্রাবল্য দুই–ই ছিল আমার। আমি তখন কি প্রকৃতভাবে কৃত্রিম, যথার্থরূপে শহুরে হতে পারিনি?
সে স্থির চোখে চেয়ে আমার কথা শুনল, ব্যাকুল হয়ে বলে উঠল, “দাও, দাও। দাও, দাও।” কী দিতে বলছিল সে? তার রূপান্তর-জন্মান্তর ঘটিয়ে দিতে? সেই আর্ত প্রার্থনা ভুলতে পারব না।
কেন ছেলে হতে এত সাধ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল ওর চিত্তে—শুধু একটি মেয়ে, অথবা মেয়েদের প্রেম-প্রীতি পেতে? কোনও বিপন্ন নৃপতির ঘোটক-প্রার্থনার মতো? এ পর্যন্ত যেটুকু লিখেছি সেইটুকু লিখলে তাই মনে হয় বটে, কিন্তু মা, এখনও ওই বৃহন্নলা বাঁশির আর-একটা দিক দেখাইনি।
একদিন টের পেলাম, আরও একটা কঠিন অসুখে সে ভুগছে। ওর সেই দিকটায় জ্যোৎস্নার মেয়েলি মায়া নেই, সেদিকটা নিরন্তর পুড়ছে।
সেই অঙ্গারবর্ণ জ্বলন্ত দিকটা দেখতে পেয়ে চমকে গিয়েছিলাম। “ছেলে করে দাও, দিতে পার যদি, তোমাকে সব দেব” এটা তার সংলাপের একাংশ মাত্র। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে যে ভঙ্গিতে দ্বিতীয়াংশ উচ্চারণ করল তা বিস্ফোরণের মতো : “ছেলের মতো হব যেদিন, হে ঈশ্বর, যদি হতে পারি, তবে —”
“তবে কী?”
“আমি একটা লাথি মারব।”
“কাকে?”
“সবাইকে। সবচেয়ে আগে এই বাড়িটাকে। এর দেয়াল থরথর করে কাঁপিয়ে, এর দরজা মড়মড় করে ভেঙে চুরে ছিটকে বেরিয়ে যাব।”
“কোথায়?”
“যেখানে পারি, যেখানে প্রাণ চায়। এখানে নয়। তুমি জানো না, আমি এই বাড়িটাকে কী ভীষণ ঘৃণা করি। কত রাগ পুষে রেখেছি।”
“এ তো তোমাদের নিজেদের বাড়ি!”
নিজেদের? থুঃ! সে বিকৃত গলায় হাসল।—”সব বাজে। জোচ্চুরি! নিজেদের কিচ্ছু না। আমার বাবা, তুমি জানো না, আমার বাবা ছিল ওই বুড়ির দত্তক?”
“জানি—শুনেছি।”
“তবে আর নিজেদের কী। উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। আমার বাবার বাবা, মানে আসল যিনি বাবা তিনি ছিলেন গরিব। লোভে পড়ে ছেলে বেচলেন—বড় মানুষ আত্মীয়কে। সেই পাপ, প্রথম পুরুষের পাপ। পাপ করলেন বাবাও—সুখে মজে নিজের মাকে ছেড়ে অন্য একজনকে মা বললেন। মা বদলানো, এ কি কম পাপ?”
কিছু বুঝছিলাম, কিছু বুঝিনি। ওই মিনমিনে ছেলেটির কথার তোড়ে এবার আমার তোতলামির পালা। বোকা বোকা ভাবে বললাম, “কিন্তু তুমি তো কোনও পাপ করোনি?”
“সকলের পাপ আমার সারা গায়ে বিষ্ঠার মতো লেগে আছে”, সে অস্থির স্বরে বলল, “পাপ করেছে ওরা, আমি প্রায়শ্চিত্ত করব। তার আগে আমাকে সত্যিকারের ছেলে হতে হবে।”
.
এতক্ষণ ওর একটা মুখ দেখতে পেয়েছি—যে-মুখ ফ্যাকাশে, রঙ-মাখা, সঙ সেজে থাকা। এইবারে টের পেলাম বাঁশির মনের প্রবল, সাহসী কোনও দুঃখের দিক; হঠাৎ সন্দেহ হল, ইচ্ছে করে ও সঙ সেজে থাকে। ওর এই নকল সাজ ওর আসল মনের একটা প্রতিবাদ। অমায়িক নপুংসক ওর আকারটা ভিতরে ভিতরে প্রকারে সাহসী, বক্র আর কঠিন রূপ নিচ্ছে। যারা কৃত্রিম করেছিল ওকে, আরও বেশি কৃত্রিম হয়ে ও তাদের সকলের পরে শোধ নিচ্ছে। “দ্যাখো, দ্যাখো” সে চেঁচিয়ে বলছে, “কৃত্রিমতার শেষ বিকৃতিতে।”
কথাটা হয়তো স্পষ্ট হল না। ছোট্ট একটা আলোঁ হাতে নিয়ে মনের খনির অন্ধকার খাদে যখন নেমে যাই, তখন প্রায়ই এই অসার্থকতায় ভুগি। দম বন্ধ করা কড়া গ্যাস মাঝে মাঝে নাকে এসে লাগে, হাতড়ে হাতড়ে ঘুরে ফিরছি আমি সুড়ঙ্গপথে, গোলক-ধাঁধা গ্যালারিতে, হাতে অস্ত্র আছে আমার, কিন্তু সেই ক্ষণে অনুভব করি অস্ত্রটা যেন ধারালো নয় তেমন, চতুর্দিকে চাপা স্বর, ছমছম, নিজেরই শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রতিধ্বনি শুনি, শ্বাসপ্রশ্বাস কি ফিসফিস, আর এদিকে-ওদিকে পিছল দেওয়াল, চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছে, কোথাও জল, কোথাও ফাটলের ফাঁকে উষ্ণ ধোঁয়া, বাঁশির মনের গভীরে যখনই কথার কুলিকামিন হিসাবে নেমে গিয়েছি—বাঁশির, অথবা অন্য কারও—তখনই ওই জল আমার হাতে ফোঁটা ফোঁটা পড়েছে, ওই গরম শ্বাস, গ্যাস বা বাতাস লেগেছে আমার নাকে।
সেদিনও লেগেছিল। ওর তলাকার ভিতরকার দেওয়ালে হাত দিয়ে প্রথমে বুঝলাম, ভিজে, স্যাঁতসেতে; পরে দেখলাম, সে-দেওয়াল পাথরের। যথোপযুক্ত শব্দগুলো পিছলে পিছলে যাচ্ছিল। আজও যাচ্ছে।
অত কসরতে কাজ কী। একটা করুণ কাহিনিকে সে বিদ্রূপের রূপে পরিবর্তিত করেছিল, বরং এইভাবে বলি। তা হলে বলা আর বোঝা দুই-ই সহজে হবে।
মা, পরগাছা, তখনকার মতো পরগাছা, বলে আমার যে কষ্ট, সেই কষ্ট বাঁশিরও। আমরা পরগাছা, সে পরভৃত। ‘আমার গলা এত মিহি কেন জানো’, সে একবার হাসতে হাসতে বলেছিল ‘আমি যে কোকিল। কোকিল যদি নিজের বাসায় বড় হত, তবে তার গলা সুরেলা না-হোক, সবল হত। আমরা ওর সুরে ভুলি, আসলে কিন্তু কোকিলের কান্নাকে গান বলে ভুল করি। ‘
ক্রমে যত বড় হয়ে ওঠে বাঁশি, ততই ওর মনে ধারণাটা দানা বাঁধে যে, ও পরভৃত। ও, ওর মা, বাবা সবাই। যেখানে থাকার নয়, সেখানে থাকছে। যা পাবার নয়, তা পাচ্ছে। স্বাভাবিক, সঙ্গতভাবে বেড়ে উঠছে না, অনর্জিত ওই পর্যাপ্ত প্রাপ্তি স্বাভাবিক না। যেখানে ওর নিজস্ব পরিবেশ, সেখানে যদি জন্ম হত, সেই ধুলোয় কাদায় আছাড় আর গড়াগড়ি খেয়ে যদি বড় হত, তবে গড়ে-পিটে ও যথার্থ মানুষ হত—একটা বিচিত্র বিচারবোধ থেকে সে এই থিয়োরিটা তৈরি করে নিয়েছিল। ওর মধ্যে খেদ ছিল। খেদ এই যে, ও কিন্নর।
(“কিন্নর মানে শুধু কি নাচ-গান? হাবভাব ছলাকলা মিলিয়ে কুৎসিত যে নর, তাকেই বলে কিন্নর,” বাঁশি আমাকে বলেছিল “ব্যাকরণের বইয়ে শব্দটার এই মানে দেখি। দেখে চমকে উঠি। অথচ কী দরকার ছিল আমার কিন্নর হবার? ঘামে রক্তে মাখামাখি জীবন, যে জীবন খেটে খাওয়ার, প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার, সেই খাঁটি জীবন হলে ক্ষতি ছিল কী? আমি কেন অলস, নকল, ধনী হয়ে আছি?”)
বাঁশি এইসব বলত। হয়তো এত পরিপাটি করে নয়, মাঝে মাঝে ফিনকির মতো ফুটে ওঠে।—”ওরা নিজেরা এই হল, আমাকে এইরকম করল। তাই তো ওদের আমি ঘৃণা করি, যে দু’জন মারা গেছে, আমার বাবা আর মা, মারা গেছে, কিন্তু ওদের ভূতটাকে আমার উপরে চাপিয়ে গেছে। তাই আমিও শোধ নিচ্ছি। সার্কাসের সব খেলা জানা ক্লাউন যেরকম ভাঁড় হয়ে থাকে, সেই রকম। মুখে চুন মেখে আর সুর্মার টানে টানে জানিয়ে দিচ্ছি যে, এই জন্ম, এই জীবন, একটা ভাঁড়ামি।”
এই কষ্ট, এই যন্ত্রণা প্রথম দেখেছিলাম বাঁশির মধ্যে। তার প্রতিবাদের পৌরুষ একটা উৎকট ক্লীবতার ছদ্মবেশ নিয়েছিল। তারপরে দীর্ঘকাল জুড়ে সময় যত জটিল হয়েছে, এই প্রতিবাদেরই রকমফের দেখেছি নানা মানুষের মধ্যে নানা আকারে। যারা রুপোর চামচে মুখে নিয়ে বড় হল; মানুষকে তৈরি করে দেয় যে লড়াই, কত লবণাক্ত অভিজ্ঞতা, তা থেকে বঞ্চিত হয়ে রইল। মনের দিক থেকে অপুষ্ট থাকে তারা; অপুষ্ট আর অপূর্ণ। সেই অপূর্ণতাবোধ ধীরে ধীরে নিজের রাস্তা খোঁজে। বাঁশির মধ্যে খুঁজেছিল একভাবে, অন্যদের মধ্যে খুঁজে নেয় অন্যভাবে। কিন্তু কোনও-না-কোনও আকারে বেরিয়ে পড়ে।
বেরিয়ে পড়ে—কী—? একটা পাপবোধ, যা ব্যক্তিগত; একটা অন্যায়বোধ যা সমাজগত। সমাজের প্রতি ওরা একটা অপরাধ করছে, সচেতন বা অচেতন মনে এই পীড়া। ওরা ফলে হয় উৎকেন্দ্রিক। কোনও-না-কোনও নিয়মের বেড়া ভাঙতে চায়, ভাঙে। বিবেকের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া যার দৃষ্টান্ত অগণিত গণিকার প্রাত্যহিক গঙ্গাস্নানে, অকাতর দাতাদের দানে উন্মুক্ত সেবাসত্র অথবা আতুরাশ্রমে, কিংবা পানীয় জলের সরোবর খননে; মন্দির নির্মাণে। অযাচিত, উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত প্রাচুর্যের প্রহারে জর্জরিত কেউ-বা মুক্তি খোঁজে ভীষণ দুঃসাহসিক বৈপ্লবিক স্বপ্নে, কেউ গুরুবাদে, কেউ ধূমসমাচ্ছন্ন তূরীয় ভাবে বিভোর, বিদেশের গোঠে গোঠে, হাটে মাঠে বাটে নামগান কণ্ঠে ধরে। মূলে এক মনস্তত্ত্ব—একঘেয়েমির গারদে কয়েদিদের পালানোর প্রয়াস।
বাঁশি বেশিদূর পালাতে পারেনি, শুধু কিম্ভূত থেকে কিম্ভুততর করে নিজের ব্যঙ্গচিত্র এঁকে চলেছিল।
.
মাঝে মাঝে ওই বাঁশি আমাকে দস্তুরমতো খাইয়ে দিত। শুধু একটি মেয়েলি ধরনের ন্যাকা ছেলে হলে এত ভাবনা হত না।
সকালে যখন বাগানে বেড়াত সে, শিস দিত, গলা নকল করত দোয়েলের, কোকিলের, তার যা পার্ট, তাই যখন করত সে, তখন কোথাও কোনও গোল আছে বলে মনে হত না। পায়ে লপেটা, কাঁচিপাড় ধুতি, পায়ের তলায় কোঁচা লোটানো—সেই কালের সেই বাবুদের প্রতিমূর্তি একালে আর বিশেষ চোখে পড়ে না। বাড়িতেও বরাবর ওই বেশে থাকত বাঁশি, কিংবা রেশমি পা-জামায়, মুগা বোনা পাঞ্জাবি, যার সর্বদাই গিলে করা আস্তিন—আর? লপেটার বদলে কখনও-বা জরির কাজ-করা নাগরা। ওটাও ওর একটা প্রতিবাদ নাকি, কাঁপানো বেলুনের ভিতরে গিয়ে সেটাকে ফুটো করে দেওয়া? “নবমীর গৌরীশৃঙ্গে বসে পা নাচিয়ে দেখছি”, সে বলত হেসে হেসে, গন্ধভরা রুমালে খালি খালি ঘাড়-গলা মুছে মুছে “দেখছি যে কেমন লাগে। ভালো লাগবে না যে-ই, অমনি ঝাঁপ দেব ঝপ করে।”
যদিও সে হাসত তবু আমার বুক ঢিপ ঢিপ করত।
সেদিন সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠলাম—”বাঁ—শি”। সে শান-দেওয়া থামাল। তার চোখ তার হাতের ক্ষুরটার মতো ঝকঝক করছিল। শান্ত গলায় বাঁশি বলল, “ভয় নেই। গলার রগ-টগ কিছু কাটব না। আমি শুধু পরখ করছি। এতেই ভয় পেলে? তুমি ভাই, আমার চেয়েও মেয়েলি।”
তার স্বর স্বাভাবিক, তার পক্ষে যতটা সম্ভব ততটাই স্বাভাবিক, কিন্ত চেয়ে দেখেছি, সেই দৃষ্টি পাগলের
তবু সেই দৃষ্টি দিয়েই সে যেন ভরসা দিতে চাইল আমাকে।—”ভয় নেই। রক্তারক্তি কিছু ঘটাব না। বড় জোর গালের চামড়া কেটে-টেটে ফেলতে পারি। তার বেশি না।”
“তুমি—তুমি দাড়ি কামাবে?”
চোখ টিপে সে বলল, “বাঁজা ডাঙায় চাষ, না? হা—হাঃহাঃ।”
“তোমার সব ঢঙ, সব থিয়েটারি।”
“থিয়েটারই তো করি। ওই একটা জিনিসে এখনও যা মজা পাই। মেয়ে সেজে স্টেজে নামি, কেউ এতটুকু খুঁত ধরতে পায় না। সব্বাইকে ঠকাচ্ছি, ছি-ছি। নতুন একটা প্লে নামছে ক্লাবে—এটা দারুণ নতুন ব্যাপার, সোশ্যাল। যাবে রিহার্সাল দেখতে?”
বললাম, “যেতে পারি।”
পর পর কয়েকদিন সত্যিই পার্ট নিয়ে মেতে রইল সে। একটা খাতা এনে মুখস্থ করছে সারা সকাল, কখনও গভীর রাত্রে আমাকে জাগিয়ে তুলছে।—”শোনো শোনো এইখানটা। কেমন তুলেছি?” সত্যি ওর উচ্চারণে, ভঙ্গিতে কোনও খুঁত ছিল না, টেরচা করে তাকানোর কায়দাও ছিল অদ্ভুত। বুকের উপর মাথা রেখে খানিকটা হয়তো আমার প্রাণস্পন্দন শুনল সে, তারপরেই ঠেলে দিয়ে বলল, “পার্ট করছি তো! ভাই, রাগ করলে?”
রাগ?—ওর উপরে করা যেত না, তবে গা যেন কেমন করত।
.
তবু ওর হাত থেকে ক্ষুরটা কেড়েই নিতে হল একদিন। সেদিন ও কাঁপছিল। ধমক দিয়ে বললাম, “ছি, করছ কী। আজ রিহার্সালে যাবে না? “
“গিয়েছিলাম। আর যাব না। যেতে হবে না।” যে আঙুল দিয়ে ক্ষুরের ধার একটু আগে চেপে ধরেছিল সে, সেখানে যেন সদ্য সকাল হচ্ছে, এই রকম কয়েকটা দীপ্ত রেখা ফুটছিল।
সেদিন মুখে কিছু মাখেনি বাঁশি, মর্মাহত দুটি চোখ সুর্মার ব্যাপারেও নির্লিপ্ত ছিল। হাতের পাতায় চোখ ঢেকে সে বলল, “আর যাব না। আমাকে ওরা বোধ হয় ওই নায়িকার পার্টস আর দেবে না। একটা মেয়ে এসেছে। কোথা থেকে ওরাই ধরে এনেছে।”
“মানে?”
“মেয়ে মানে মেয়ে। বুঝতে পারলে না? মেয়ে দিয়ে মেয়ের পার্ট করানো আজকালকার হাওয়া—পাবলিক স্টেজে আগেই ছিল, এখন এইসব ক্লাবেও লেগেছে। আমি করতাম, সেটা ক্লাবের দু’চারজন মাতব্বরের পছন্দ হচ্ছিল না। তবে অনেক টাকা চাঁদা দিই তো, তাই চট করে সোজাসুজি বলতে চাইছে না আমাকে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি। সেই মেয়েটা আজ এসেছিল। সারাক্ষণ বসে থেকে থেকে আমার পার্ট বলা শুনল। একবার একবার ইশারায় উঠে এসে কী করে কোমর দুলিয়ে গোড়ালির ওপর ঘুরে যেতে হয়, আমাকে দেখিয়ে দিল। আমি সব বুঝতে পারছিলাম, আমার পা কাঁপছিল; মুখস্থ পার্ট তো! আমার তাও ভুল হয়ে যাচ্ছিল। যে ছেলেটা হিরো; সেই যে, আমাকে যে একবার ফিলিংস-এর মাথায় উইংস-এর কোণে…সে কী করল তখন? মুখ ভেংচাল, আমাকে ঠেলে দিল। আমি বুঝতে পেরেছি, এই ছেলেটাও লোভে পড়েছে, ও চাইছে ওর অপোজিট রোল-এ ওই মেয়েটাকে কাছে পেতে। আমি বুঝি না?”
তকতকে মেঝে, আলো-জ্বালা ঘর, কিন্তু সেখানে একটা সাপ হিসহিস করছিল!
“আমি বুঝি!” বাঁশি বলছিল, “বুঝি সব। ওরা মিছিমিছি আমাকে মিথ্যে কথায় ভোলাতে আসছে। আমি বুঝেছি আগেই। সেক্রেটারি, ধাড়ি উকিল ব্যাটা, তারও নোলা ঝরছে, সে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে কত কী বলল, ইনিয়ে বিনিয়ে। আমি যেন কিছু মনে না করি। যুগ পালটাচ্ছে। যুগের রুচি, যুগের দাবি–এইসব মেয়ের পার্টে ছেলে দেখলে এখনকার লোকে নাকি নাক সিঁটকোয়, ছ্যা ছ্যা করে।”
রক্তশূন্য মুখে বাঁশি চেয়ে ছিল। দৃষ্টির শূন্যতাও এত ভয়ঙ্কর হয়, উপস্থিত দ্বিতীয়জনকে আক্রান্ত করে—আমি দেখিনি আগে।
“ওরা এখন ছ্যা-ছ্যা করে, করুক।” বাঁশি আস্তে আস্তে বলল, “কিন্তু আমি করব কী? এতদিন ধরে মেয়ের পার্ট করার বিদ্যে যে রপ্ত করলাম, সব হঠাৎ মিথ্যে হয়ে গেল? আমি করব কী! আমার অন্য এক লাইন রোলও জুটবে না যে। প্রতিহারী, কাটা সৈনিক—কিছুতে আমাকে তো নেবে না। মেয়ের রোল গেল, ছেলেদেরটা পাব না, আমি, আমি তবে কি একটা না-মানুষ হয়ে যাব?”
“করব কী, করব কী”— দেয়ালঘড়ির লকলকে জিহ্বার মতো একটা জিজ্ঞাসা তালে তালে ঠকঠক করে বাজছিল।
বাঁশির হাত থেকে ক্ষুরটা একটু একটু খসিয়ে নিলাম আমি। পকেটে পুরে বললাম, “সব ঠিক হয়ে যাবে, কাল তোমার সঙ্গে রিহার্সালে যাব, কেমন?”
কোন ভরসায় সেদিন বলেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে? রিহার্সালের ওখানে কী ঘটবে কেউ কি আমাকে তার আভাস দিয়েছিল, আমি কি জানতাম? কত ঘটনা সামনের দিকে লম্বা লম্বা ছায়া আগে থেকে ফেলে রাখে?
এটা ঠিক, বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠছিল, অবাক হয়েছিলাম। অথবা ততটা হইনি যতটা হওয়া ছিল স্বাভাবিক। কলকাতা অনেক আগে থেকেই ভোঁতা করে দিয়েছিল আমার অবাক হওয়ার ক্ষমতা।
বাঁশি আগে থেকেই ছিল ওখানে, আমি একটু পরে গিয়েছিলাম। বুকের উপরে মুখ ঝুলে পড়েছে, বাঁশি বসেছিল একটা চেয়ারে। পার্ট বলছিল না, যদিও মহলা শুরু হয়ে গেছে। বলছিল অন্য একজন। আমি বাঁশির কাঁধে হাত রাখলাম, সে চোখ তুলল। মাছ মরে গেলে যে চোখে তাকায় সেই চোখ। আমাকে সে ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় বসতে বলল, চোখের ইশারাতেই আসরের দিকে দেখিয়ে দিল।
(মা, আমি মাঝে মাঝে চৌবাচ্চায়, পুকুরে শিশি ডুবিয়ে মজা করেছি ব্রু-ব্রু-ব্রু, ডুবতে থাকা বোতল-শিশি কী বলতে চায়, বুঝতে চেয়েছি কখনও কখনও মনে হত আমি যেন ওই অর্ধস্ফুট ভাষা বুঝতে পারি সেদিন মনে হল, পড়তে পারছি বাঁশির চোখের ভাষা “ওই যে। ওই তো সেই মেয়েটা। আমাকে হটিয়ে দিয়েছে। আজ পার্ট বলছে।”)
আমি দেখলাম—দেখলাম কাকে?
মা, যদি অনুমতি করো, তবে এই ব্যাপারটার ঘণ্টাখানেক পরে শোনা একটা সংলাপ দিয়ে শুরু করি।
“আমি ট্যাক্সি হয়ে গিয়েছি।” বুলা বলছিল, ওই আসরে নয়, ওদের ঘরে বসে। কিংবা “বসে” বলা ঠিক হল কি?—আধশোয়া হয়ে।
আধশোয়া হয়ে বুলা বলল, “তুই বুঝিসনি এখনও? আমি ট্যাক্সি হয়ে গিয়েছি।” ট্যাক্সিতে আমরা তো এইমাত্র এলাম বুলা। মানে, তুমি এলে, আমি তোমার সঙ্গে এলাম। ট্যাক্সি হয়ে যাওয়া আবার কি?
এইসব কথা নাড়াচাড়া করছিলাম মনে মনে, আমি, মা, তোমার ছেলে, ভ্যাবা গঙ্গারাম আমি। কিন্তু বুলা বুঝল। এমনিতেই বরাবর পাকা সে, তাতে আবার বিশেষ একটা বয়সে, বিশেষ করে এক-একটা পরিস্থিতিতে, সব মেয়েই অন্তর্যামী। বলল, “বুঝিস নি? তার মানে তোর এই ক’বচ্ছরের কলকাতায় থাকা বৃথা গেছে। যা ছিলি তাই আছিস, সেই একই রকম গাঁইয়া।” বুকের ওপর একটা বালিশ এনে সিলিং-এর ফ্যানটার দিকে তাক করে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল বুলা, ফের লুফে নিচ্ছিল, চেপে ধরছিল বুকে, সাধের বেড়াল-ছানাকে যেমন চেপে ধরে। আর যেহেতু আমি তখনও গাঁইয়া, ব্যাখ্যাও করে দিল সেই।—”ট্যাক্সি মানে হল গিয়ে ট্যাক্সি। আচ্ছা, বাড়িগাড়ি বুঝিস তো? বাড়িগাড়ির ক’জন মালিক থাকে?”
থতমত খেয়ে বললাম, “একজন। একজনই থাকে বলে তো জানি।”
“বাঃ, এই তো চাই, এই তো। ঠিক বলেছিস। আর ট্যাক্সির?”
“মালিকের কথা জানি না, তবে—তবে সবাই চড়ে।”
“আবার ঠিক। তবে ফুল মার্কস হল না একটুর জন্যে। চড়ে কথাটা শুনতে বিশ্রী! চড়ে না, চড়ায়।—স্টেজে। ট্যাক্সির যে নিয়ম একদম তাই। যে ভাড়া দেয়, সেই চড়তে পারে।”
বলে উঠে বসল বুলা। গালে হাত রেখে আমাকে দেখল। অনেকক্ষণ ধরে, চোখ ভরে। ওর চুলের একটা ফুল ছিঁড়ল, শুঁকল, চটকাল তার পাপড়ি, ছড়িয়ে দিল বিছানার চাদরে। খুব জহুরির গলায় বলল, “তুই বদলে গেছিস—অনেক। “
“আমার কিন্তু সব শোনা হল না বুলা। টেনে এনেছ, অথচ সেই থেকে খালি বাজে কথা বলছ। তুমি—তুমি, বদলেছ তো তুমিও!”
“মেয়েরা বদলায়। তাড়াতাড়ি।” বুলা বলল, ফের সোজা হয়ে বসে ঢেকে ঢুকে বসার ভঙ্গি করল।—”এই! ওভাবে তাকাবি না বলছি। তাহলে চোখ গেলে দেব। আর ক’বছর আগে হলে তোর নাক টিপে দুধ গেলে দিতাম।”
খোলাখুলি সব লিখছি বলে যত বড়াই করেই না থাকি, তবু, মা, কীভাবে তাকাচ্ছিলাম, তোমাকে খুলে লেখা যাবে না। কীভাবে তাকাচ্ছিলাম, কিংবা বুলা তাকাতে দিচ্ছিল। একটু পরে হাই তুলল সে, “যাই গা ধুয়ে আসি” বলে উঠে গেল। “তুই যেন পালাসনি। কী খাবি, চা? না আর কিছু? আমি যাব আর আসব। বড় জোর দশ মিনিট। গা ঘিনঘিন করছে, গুলিয়ে গেল বড্ড। মাকে বরং পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“মা? তোমার মা বুলা? লীলামাসি? তিনিও কি—”
“এখানে থাকেন।” বেরিয়ে যেতে যেতে বুলা ঘাড় ফিরিয়ে হাসল—”মা আর মেয়ে দেখছ তো, আবার একসঙ্গে মিলেছি।”
দেখছি। ঘড়ির দুটো কাঁটার যে সম্পর্ক, বিশেষ দুটি মানুষের সম্পর্কও মাঝে মাঝে দেখা যায়, কতকটা তাই। ছেড়ে ছেড়ে যায়, আবার ঘুরে এসে এ-ওকে জড়িয়ে ধরে। বুলা আর তার মার ব্যাপারটাও তাই কি না ভাবছিলাম, এক সঙ্গে মিলেছি, এক সঙ্গে মিশেছি, বুলার ছুঁড়ে দিয়ে যাওয়া কথাটার তাৎপর্য কী, দেখছি কোয়া ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে।
(‘মিলিনি। মিথ্যে কথা’। লীলামাসির গলা বাজছে ঢং ঢং করে।—’এই পর্যন্ত বলতে পার, আমি ওর এখানে আছি। আছি, উপায় নেই বলে’–’এটা ওর বাড়ি মাসিমা, মানে বুলার?’—’বুলারই তো। ও ভাড়া দিচ্ছে, কিংবা ওর হয়ে কেউ দিয়ে দিচ্ছে।’)
রাগে লীলামাসির মুখ আরও বড় দেখাচ্ছে, সম্প্রসারিত ভাবার্থের মতো বেশ কিছুকাল পরে ওঁকে দেখছি তো, মুখের সেই লম্বা ডিমেল ছাঁদটা একে বারেই নেই, পুরানো খাদ মাটিতে বুজে আমার মতো চাপ চাপ মাংসে ভরে গিয়ে মুখটা গোলাকৃতি দেখাচ্ছে।
আগে লীলামাসির চাউনিও ছিল যেন অন্যরকম…বলো তো কী রকম? ঠিক ঠিক মনে পড়েছে খিদে পেলে যেমন খিনখিনে দেখায়, কতকটা সেই রকম। কখনও কখনও সেই চোখে উনি অন্যভাবও আনতেন। চোখ দুটো এখন বেশ খানিকটা নীচে, কুয়োতে দড়িবাঁধা বালতি খানিকটা নেমে, আরও নামবে কিনা সেই অপেক্ষা করছে।
বয়স, এ কি বয়স, আমি ভাবছিলাম। তার ব্যবহার-আচার দেখছিলাম। বুলাকে বদলে দিল কে মোটে এই কয় বছরে?—বয়স। চমৎকার একটা সাজির মতো করে সাজিয়ে দিল। আবার তীরের মতো তীক্ষ্ণ লীলামাসিকে এমন থথপে কে করে দিল, তিনি বসেছেন প্রায় গোটা চেয়ারটা জুড়ে, দেবার নাম করে কে তাঁর অনেকখানি, ঠিক কী-জিনিস জানি না, কিন্তু অনেকখানি কেড়ে নিল-কে, কে? সেও ওই বয়সই তো! একজনকে যে দেয়, অন্য জনের কাছ থেকে কেড়ে নেয়। একই মালিক একদলকে বহাল করছে, ছাঁটাই করছে অন্য দলকে। কেউ ভীষণ নিষ্ঠুর হয়ে লাথি মারল একটা কুকুরকে অথচ আর একটাকে কোলে তুলে নিল। সময়েরও সেই পক্ষপাতী রীতি, লীলামাসিকে দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম।
নিজেদের আমরা সর্বদা দেখি না তো, অথবা একটানা দেখি বলে তফাতটা টের পাই না, চমকে উঠি অনেকদিন পরে পরে এক-একজনকে দেখতে পেয়ে। দিন, মাস, বছর—বছর মানে একটা সময়ে শুধু পাওয়া, আর-একটা সময়ে খালি হারানো ফুরিয়ে যাওয়া।
২৯
চেয়ারে বসে আছেন লীলামাসি, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে, হাত দুটি কোলের উপরে বিন্যাস করা। কোথার সেই টানটান সোজা ভাব, উদ্ধত গ্রীবা, চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে ক্রমাগত চাওয়াকে ছড়িয়ে যাওয়া, আমি সেই লীলামাসিকে কোনওখানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কোলে রাখা হাতের আঙুলে আর একটা আঙুল ওঠা-পড়া করছিল তাঁর। জপ করছেন? নখ খুঁটছেন? ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না।
আবার সেই অলৌকিক ব্যাপার ঘটল, আমার চেনা চরিত্রগুলোকে নিয়ে জীবনে বারবার যা ঘটতে দেখেছি। যাকে এক ভাবে দেখে দেখে একটা ধারণা রপ্ত করে নিয়েছি, ধরেই নিয়েছি একে আমি চিনি, সে হঠাৎ তার মুখের অন্য দিকটা ফিরিয়ে একেবারে সব হিসাব ভুল করে দিল। তা-ছাড়া—যাকে বলছি অলৌকিক—একজনের মুখে অভাবিত একজনের ছায়া পড়েছে। যেমন লীলামাসির মধ্যে সেই সময়টাতে দেখতে পাচ্ছিলাম তোমাকে। সেই বিষাদে বিরাট হয়ে যাওয়া প্রতিমা? জানি এই ছায়া স্থায়ী নয়, এই চিহ্ন থাকবে না, তবু মুছছে না যতক্ষণ, ততক্ষণ দৃষ্টিকে আতুর করে রাখে।
লীলামাসি উঠলেন, বনবন পাখাটার সুইচবোর্ডে হাত দিয়ে সেটার গতি কমালেন, বাড়ালেন একবার, আসলে বোঝা যায় উনি চঞ্চল, কোথাও অস্থির, হয়তো বা আমার হঠাৎ এসে পড়াতে কুণ্ঠিত, অপ্রস্তুত বুঝিবা, অথবা সেই উনি আর এই উনি, নিজের এই পরিবর্তিত রূপ দেখতে পাচ্ছেন আমার চোখের আয়নায়, তাই উঠে যাচ্ছেন একবার, ফের বসছেন, নইলে ওই ফ্যানের বন্ বন্ বাড়ানো-কমানোটা আসলে কিছু না।
“বুলার সঙ্গে দেখা হল কোথায়?”
বললাম “থিয়েটারে—এক থিয়েটারে। ক্লাবের মহলায়।”
“কী বই?” আমাকে উনি জিজ্ঞাসা করলেন একবার, অথচ নামটা যখন বললাম তখন শুনলেন না কি শুনতে পেলেন না, অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন, নিজেই বললেন একটু পর, “হ্যাঁ, ওর তো আজকাল বেশ নাম। ডাক আসে নানা জায়গা থেকে।”
(‘ট্যাক্সি হয়ে গিয়েছে’, ওই কথাটাই কি অন্যভাবে বলতে চাইল লীলামাসিমা?) মাঝখান দিয়ে তরতর সময় বয়ে যাচ্ছে, দু’জন বসে আছি দু’পাশে। মাঝে মাঝে কথা থাকছে না। বুলা এল না কেন এখনও, দশ মিনিট বলেছিল, না পনেরো? যতই হোক, নিশ্চয় পেরিয়ে গেছে এতক্ষণে? এক-একটা মিনিট এক এক সময় যেন সোলা কিংবা পাখির পালক, হাওয়ায় ওড়ে? কখনও বা প্রতিটি সেকেন্ড হয়ে ওঠে পাথরের টুকরো, যা দিয়ে মেয়েরা মালা গাঁথে।
কিছু বলব কিন্তু কী বলা উচিত ঠিক করতে না পেরে একবার বললাম, “আপনার সেই গানের স্কুলটা—নেই বুঝি মাসিমা?” বললাম খানিক ইতস্তত করে।
“গানের স্কুল, গানের স্কুল” উনি মাথা নেড়ে চলেছেন, কথাটার যেন ঠিক অর্থ বুঝছেন না। “কিসের স্কুল বললে? গানের তাই না? ছিল বুঝি? ও হ্যাঁ-হ্যাঁ ছিল। কিন্তু নেই তো। উঠে গেছে। না, না, না”, হঠাৎ তীরস্বরে বলে উঠলেন তিনি—”তুমি ভুল বলছ। কোনও দিন ছিল না।’
“বুলা বলত যে।”
“মিথ্যে কথা বলত। আমার মেয়ে কী সাংঘাতিক, তুমি তার কতটুকু জানো!” পা মচকে পড়লে যেভাবে লোকে যে-কোনো রকমে উঠতে চেষ্টা করে, আমিও তখন তাই করছি।—”তা-হলে ওই যে বুলা বলত, প্লে-টে।”
“না। ও-সবও কিছু নেই।” তিনি আবার গম্ভীর হয়ে গেলেন। গম্ভীর হয়ে গেলেন মানে দূরে চলে গেলেন। এ-ও একটা অদ্ভুত ব্যাপার, তোমরা তোমাদের কালেও নিশ্চয় লক্ষ করেছ? যারা ধরো এক আসরে আছে, হাসি-মশকরা চলছে, তারা কাছাকাছি আছে। কিন্তু যেই কেউ চুপ করে গেল, সেই সঙ্গে সঙ্গে সুদূর হয়ে গেল। কথা থামলেই পরস্পর বলে কিছু থাকে না, সবাই পর-পর।
“বুলা আপনার গুণ পেয়েছে। মানে পার্ট-টার্ট করার আর কী।” আমি মরিয়া হয়ে বললাম। আমি তোতলামি করলাম।
“বুলা আমাকে ছাড়িয়েছে।” তিনি সংক্ষেপ করে দিলেন।
আরও খানিক সময় যেতে লীলামাসি, তখন আর বিষণ্ণ বলা যায় না তাঁকে, গম্ভীরও নন ঠিক, বরং উদাস কিছুটা, শেষ মাঘের হাওয়ায় হিম-টিম শুকিয়ে গিয়ে যে ঔদাস্য থাকে, বললেন, আস্তে আস্তে, “তারপর কেমন আছ তোমরা। মা? বাবা? ভালো, সবাই ভালো তো?” যেন এতক্ষণে খেয়াল হয়েছে তাঁর, এতক্ষণ ধরে কথা বলছি, অথচ জরুরি খবরাখবরগুলো তো নেওয়া হয়নি?
“বাবা বিশেষ ভালো নেই, মাসিমা।”
“তোমরা সেই বাসাতেই আছ তো। তোমার বাবা ওই থিয়েটারেই আছেন তো?”
“আপনি কিছু জানেন না?” বলেই বুঝলাম অবাক হওয়ার মানে নেই। ওঁর কিছুই জানবার কথা নয়।
“না, মানে, আমি–আমরা তো—।” বুঝলাম লীলামাসি যে অনেক আগেই ওই বাড়িটা ছেড়েছেন, সেটা বলতে চাইছেন। কিন্তু সোজাসুজি নয়, কারণ তাঁর কাছে প্রসঙ্গটা অস্বস্তিকর।
তখন সব বললাম তাঁকে। বাবার ভীষণ অসুখ, অক্ষম হয়ে যাওয়া, এইসব। কেবল মা, বললাম না, বলতে পারলাম না, যেখানে তখন আছি সেই বাগানওয়ালা বাড়িটার কথা, বলতে পারলাম না যে, আমরা আশ্রিত।
লীলামাসি শুনলেন সব। মন দিয়ে শুনলেন, অথবা মনের মধ্যেই মগ্ন হয়ে গেলেন। আমার কথা ফুরোতে বললেন, কতকটা খাপছাড়া ভাবে, “তোমার বাবা পালা-টালা, মানে নাটক লিখছেন নাকি আর?” ওঁর স্বরে সামান্য ঠাট্টার ছোঁয়াও ছিল কিনা সেটা আবিষ্কার করব বলে আমি ভালো করে তাকিয়ে রইলাম।
ছিল না। তখন বললাম, “মাসিমা, বাবাকে ইদানীং তো দ্যাখেননি আপনি। উনি একেবারে আলাদা মানুষ। বোধ হয় ছেড়েই দিলেন সব। বোধ হয় কিছুই আর লিখবেন না।”
“ছেড়ে দিলেন?” মনে হল লীলামাসি একটু যেন নড়েচড়ে বসলেন, একটু যেন উৎসুক হলেন।—”ছেড়ে দিলেন সব তো ধরে রাখলেন কী? আমি জানি, কী। কিচ্ছু না।” এতক্ষণে ওর মুখে খানিকটা হাসি দেখা গেল, খানিকটা হালকা হলেন। —”কিছু না। একটা সময়ের পরে লোকে শুধু যে-যার চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরতে পারে। আর কখনও-কখনও পারে পাশের বালিশটা চেপে ধরতে। আর কিছু ধরে রাখতে পারে না।”
এই কঠিন কথাটা বলার পরেও বসে ছিলেন লীলামাসি। অল্প অল্প হাসছিলেন। ওই হাসি আমি চিনি। পরাস্তের হাসি, প্রহৃতের; কিন্তু সে হাসি দিব্য। আমি চিনি। বাবার মুখে দেখেছি।
লীলামাসি চেয়ারটাকে আর-একটু কাছে টেনে আনছেন। সেই হাসির সঙ্গে একটা লজ্জা চটকানো হয়ে গিয়ে অপূর্ব এক আচার তৈরি হয়ে গেছে, সেই আচারে ওঁর ঠোঁট মাখামাখি, আমি দেখতে পাচ্ছি, লীলামাসি গলা নামিয়ে বলছেন, “তোমার বাবাকে একটি কথা বোলো, বলবে তো? উনি যেন সামলে নেন। আমি ইচ্ছে করলেই ওঁকে সেদিন নাট্যকার করে দিতে পারতাম, উনি হয়তো এই ধারণাটা নিয়ে বসে আছেন। ওঁর অভিমানও থাকতে পারে। ওঁর পালা আমি সেদিন পছন্দ করিনি ঠিক। কিন্তু বোলো, তুমি তো দেখে গেলে, তুমি বোলো, আমার ইচ্ছে কি ওঁর, ইচ্ছেয় কিছু যায় আসে না। আমাদের সকলের ইচ্ছের ওপরে আরও একজনের ইচ্ছে আছে, তিনি আমাদের দু’জনকেই খারিজ করে দিয়েছেন। খারিজ—নাকচ—বাতিল। আমারও আর অভিনয় করা হয়নি। মেয়ের হাত তোলা খেয়ে বেঁচে আছি। বোলো। তুমি তো দেখে গেলে।”
“উনি—উনি যেন মনে কোনও দুঃখ না রাখেন।”—একটু থেমে লীলামাসি আবার বললেন।
“বাবার তো কোনও দুঃখ নেই মাসিমা!”—কী ভেবে বিমূঢ়ের মতো বললাম।
.
লীলামাসি এক দৃষ্টে চেয়ে কথাটা শুনলেন—”দুঃখ নেই?”—বলেই তিনি আমাকে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে বসলেন। “তোমার বুক পকেটে কী?” চমকে উঠে তাড়াতাড়ি বুকে হাত দিলাম। জড়োসড়ো হয়ে বললাম, “কই, তেমন কিছু তো—” মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উনি বললেন, “নেই। এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তোমার জামার ভেতর পকেটে কী আছে, তা তো বলতে পারব না।” একটু থেমে, মেঝের ওপর দিয়ে টুকরো কাগজ উড়ে যাওয়ার স্বরে লীলামাসি বললেন, “কার যে কোথায় কী লুকোনো থাকে, তুমি জানো না।”
ভিতরের প্যাসেজে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। লীলামাসির মুখের ভাব বদলে গেল অকস্মাৎ, গলার স্বরও। বললেন, “তুমি আজ কী-করে এখানে এসেছ জানি না, হয়তো বুলাই ধরে এনেছে তোমাকে। কিন্তু তুমি আর এসো না। বুলা—বুলা অন্য ধরনের মেয়ে নিজের মেয়ে, তবু বলছি, তুমি কী রকম পরিবারের ছেলে তা জানি তো, তুমি পারবে না।”
(ট্যাক্সি হয়ে গেছে? সেই একটি বাক্য যেন রেকর্ড হয়ে গেছে, সেটাকেই আর একবার বাজালাম মনে মনে, লীলামাসির মুখের দিকে চাওয়ার মতো ভরসা ছিল না। তিনি চেয়ারটাকে ফের নিয়ে গেছেন একটু দূরে টেনে। একখণ্ড মেঘ একটুখানি বৃষ্টি ঝরিয়েই গেছে।)
ঘরে স্নিগ্ধ, সূক্ষ্ম একটু সৌরভ ছড়াচ্ছিল কোনও জলোদভিন্ন সতেজ, সবুজ শৈবালের যে-সৌরভ থাকে; সদ্য স্নানে মানুষেরা যে-গন্ধ পায়, তাই ছড়াচ্ছিল। ঘাড় ফেরাইনি, তবু টের পেয়েছি বুলা এসেছে।
.
দুটি অঙ্কের মাঝখানে সে-আমলে কনসার্ট বাজানোর চমৎকার একটা নিয়ম ছিল, বাঁশি-বেহালা প্রভৃতি সহযোগে মনমাতানো এক বাদ্যবৃন্দ। শেষ হল যে-দৃশ্য তার রেশ ধরে রাখত সে, পরবর্তী উত্তোলন-উন্মোচনের জন্যে উৎসুক করে রাখত।
তোমাকে নিবেদিত এই পত্রে, কতকটা অর্ধচেতন ভাবে আমিও সেই পদ্ধতি গ্রহণ করেছি নাকি! এক-একটা ঘটনার অবতারণা করি, ছত্রের পর ছত্রে আঁকা হয়ে যায় এক-একটা চরিত্র, তারপর? তারপর কী? যেই একটু বিরতি, অমনি ফাঁকটুকু নিজের কিছু ভাবনায় ভরে তুলি।
যেমন এক্ষুনি। বুলা ঘরে এসেছে, থাক; না-হয় অপেক্ষাই করল কিছুক্ষণ। তাকে দাঁড় করিয়ে বরং একটু ভেবে দেখি, লীলামাসির ছবিটা এত যত্ন করে আঁকলাম কেন এতক্ষণ।
তার কারণ, মা, আমি ফিরে ফিরে এই লেখাটার যেটা মূল সুর, তাকে ফিরে পেতে চাইছি। মূল সুরটা কী? জগতের কাছে একটা ফরিয়াদ, একটা জবানবন্দি। যারা ভুল বুঝেছে আমাকে, অন্যায় করেছে আমার প্রতি। অবরেণ্য অকিঞ্চিৎকর মনে হয়েছে যাদের তাদের ধিক্কার দেব, অভিযুক্ত করে যাব! অথচ কী আশ্চর্য, লিখতে লিখতে অনুভবে হঠাৎ এই কথা এল যে, যারা যতই ভুল বুঝে থাকুক আমাকে, আমিও তো ভুল বুঝে থাকতে পারি অনেককে? আমার বোঝাটাই ভুল হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। তবে উপলব্ধিটা লেখার ধাঁচটাই বদলে দিল, জেনে গেলাম কিনা যে শেষ বোঝাপড়া বলে কিছু নেই, বোঝাপড়ার কোনও অর্থ নেই বৃহৎ কালের পরিধিতে মহৎ পরিবেশে বিশাল ছায়াতে নালিশ-টালিশের ব্যাপারগুলোই সঙ্গতিহীন অসঙ্গত। ফলে অভিযোগ অন্তরিত হয়ে গেল ক্ষমায়—ক্ষমা করায় আর চাওয়ায়।
আর যেহেতু মা, এই পর্ব আগাগোড়া অধিকার করে নিলে তুমি, আচ্ছন্ন করে রইলে, তাই সব নিবেদন হয়ে গেল তর্পণ। সেই তর্পণই আমাকে চকিত করে বলে দিল, আমার পক্ষে যা সত্য, তা তো সত্য হতে পারে তোমার পক্ষেও।
মা, তুমিও তো যতদিন বেঁচে থেকেছ, অনেক জ্বালা পেয়েছ আর অশেষ যন্ত্রণা অবিচার আর অবহেলা। দৈবী আর মানুষি স্বভাবের ক্রমাগত পালাবদল প্রত্যক্ষ করেছি তোমার মধ্যে : এই ক্ষণে উদাস, এই তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। পরিচিত আর স্বজনের কতজন ভুল বুঝেছে তোমাকে। কিন্তু—কিন্তু মা, সহসা মনে হল, তুমিও যদি ভুল বুঝে থাকো তাদের কাউকে কাউকে? যদি তাদের সম্পর্কে ক্ষোভ, অ-ক্ষমা, ঘৃণা নিয়েই তোমার মৃত্যু হয়ে থাকে? তবে তো চলে গিয়েও মুক্তি পাবে না তুমি, ইহ-জাগতিক কষ্ট ওই লোকেও তোমাকে অনুসরণ করবে। এই তর্পণটাই মিথ্যে হয়ে যাবে।
তাই তো, মা, প্রথমে যদিও ভেবেছিলাম, খালি আমার কথাই বলব, আমার পাপ, আমার অন্যায় সব কিছুর স্বীকারোক্তির প্রক্ষালনে তোমার কাছে সাফ হয়ে যাব, তবু ক্রমে ক্রমে মনে হল ডেকে আনি আর সবাইকে : বাবা, সুধীরমামা, ভামতী, এমন-কী লীলামাসি। এপিঠ-ওপিঠ করে দেখাচ্ছি প্রত্যেককে : দ্যাখো, দ্যাখো, তোমারই মতো ভালো-মন্দ মিলিয়ে সকলে। সম্পূর্ণ সাফ কেউ না, কেউ হতে পারে না, কিন্তু সকলেরই ভিতরে একটি করে বেদনার বিশ্ব আছে। অন্ধকার গুহায় যাদের বাস, তারাও কখনও না কখনও বাইরে বেরিয়ে আসে, পা টিপে টিপে জীবনে অন্তত একবার-দুবার চূড়ায় চড়ে।
তাদের পেশ করছি। তাদের স্বার্থে, আমার স্বার্থে, তোমার স্বার্থে। কেন বলছি তোমার স্বার্থে? না-হলে তুমিও, বিরাটের মধ্যে যদিও স্থিত তবুও, ক্ষুদ্রতায় বদ্ধ থাকবে। প্রেতের অতৃপ্তি যাকে বলে। মা, সেই জ্বালা থেকে তোমাকে মুক্তি দিতে চাইছি, নেবাতে চাইছি একটি চিতা, যে-চিতা মরণের পরেও জ্বলে। এই, তর্পণ, এই কৃত্য সেই জন্যে।
.
“তুমি এত দেরিতে এলে বুলা?”
“দেরি কোথায়, বা-রে! বলেই তো গেলাম, গা-টা ধোবো। বলিনি?”
“কিন্তু বুলা—”
“এতক্ষণ বলিনি তোমাকে। আমাকে বারবার ‘বুলা বুলা’ কোরো না তো। আমি বিচিত্রা।”
“তোমার নতুন নাম, বুলা?”
“কিন্তু ফেমাস নাম। জানো না? শোননি?”
“ট্যাক্সিটার নাম বুঝি বিচিত্রা?”
মনে কোরো না লীলামাসি তখনও ওখানে বসে ছিলেন। কিংবা তাঁর সাক্ষাতেই ঠারে-ঠোরে আমাদের ওই সংলাপ চলছিল। তিনি কখন উঠে গিয়েছিলেন, হয়তো বুলা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই।
“বাহ্, এই তো বেশ কথা ফুটেছে দেখছি।” বুলা তারিফ করল, না, ঠাট্টা, স্পষ্ট বোধগম্য হল না, তবে সে আমার গাল টিপে দিল।
“তোমাকে এভাবে দেখব ভাবিনি বুলা।”
ভ্রূভঙ্গি করল সে। “কোন ভাবে?”
কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, “ভালো লাগছে, এই জীবন?”
“বয়স এখনও কম তোর, তাই এইভাবে ভাবছিস। কোন জীবন?”
“কষ্ট দেওয়ার, কষ্টের।” অনেক কষ্টে আমি বললাম। “কষ্টের কথা থাক”, সে বলল, “কষ্ট দেওয়ার কথা কী বলছিলি?”
আবার কথাটা ঘুরিয়ে বললাম, “বলছিলাম—এই জীবন। ভালো লাগছে?” তৎক্ষণাৎ সে-ও একই কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, “বয়স অল্প তোর নইলে জানতিস। ভালো কিছুই নিজে থেকে লাগে না। ভালো লাগাতে হয়। নইলে বড় জোর সব চলে যায়, সয়ে যায় এই পর্যন্ত।”
“তোমার মাকে দেখলাম বুলা। লীলামাসি অনেক বদলে গেছেন কিন্তু।” বুলা মুচকে হাসল। ওর চোখ দুটো নাচছিল। বলল, “আর আমি?”
“বদলে যায় তো সবাই বুলা, কেউ কি আর যা ছিল তাই থাকে নাকি! তবে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, সব কেমন গোলমেলে লাগছে—”
“তার মানে ইতিহাস শুনতে চাস? এই ক’বছর, যখন আমাদের দেখা হয়নি, সেটা হল তোর পড়ার বিষয়? আমি বলে যাব আর তুই মুখস্থ করে নিবি? বেশ তো?” বলে বুলা চেয়ারটাতে পা তুলে আসন করে বসবার মতো করে বসল—”কেমন লাগছে দেখতে? ব্রতকথা শোনাব বলে বসেছি— ঠিক যেন সেই পোজ, না-রে?” এইবার একটু গম্ভীর হল সে, চাহনিতে, কথার ধরনে সংবৃত। আগেও এই ক্ষমতা দেখেছি ওর মধ্যে—নিজেকে জালের মতো ছড়িয়ে নিয়ে অদৃশ্য হাতে হঠাৎ গুটিয়ে নিত।
“বলার তেমন কিছুই নেই, জানলি। ভেসে তো গিয়েছিলাম আমরা দু’জনে, মা আর আমি। আবার ঘাটে এসে লেগেছি। হ্যাঁ, খুঁজে পেয়েছিলাম আমার মাকে, বেশি দেরি হয়নি, খুব উঠে পড়ে লাগলে কতদিন লাগে আর, মা হাবুডুবু খাচ্ছিল, সাঁতার জানে না তো, কী আর করবে, আমি ওকে টেনে নিয়ে এলাম ঘাটে। বুঝতে পারছিস?”
আমার দিকে তাকিয়ে বুলা একটুক্ষণ অপেক্ষা করল।—”তেমন কিছু মজা দিয়ে বলছি না বলে ভালো লাগছে না তোর, না? রস-টস পেলে মজে যেতিস। কিন্তু এটা তো লড়াইয়ের গল্প, আমাদের। লড়াইয়ের রস-টস কোথায়? মেয়েদের লড়াইকে তোরা অবিশ্যি লড়াই-টড়াই বলতে চাস না। ‘জীবন-সংগ্রাম’-এর মতো ভারী ভারী বাছাই করা শব্দ শুধু ছেলেদের জন্যে রেখেছিস। আমাদেরটা খালি বিকি-কিনির হাট বলতে চাস, নাক দিয়ে শুঁকে শুঁকে আঁশটে গন্ধ পাস, সব জানি।”
ছোট একটি শ্বাস চেপে বুলা বলল, “সব জানি!” সেই কণ্ঠস্বর, মা, কী বলব তোমাকে, যেন মৈত্রেয়ীর মতো। সেই যে কোন্ ঋষিপত্নী না—যার গল্প বাবা একবার শুনিয়েছিলেন আমাদের? অবিকল তাঁকেই শুনতে পাচ্ছি একটি হালকা-চটুল মেয়ের স্বরে—কোন্ মেয়ে? যে বলেছে যে সে নাকি ট্যাক্সি হয়ে গিয়েছে! এমন সব অসম্ভব ঘটনাও দেখা যায় সংসারে!
“মাকে ঘাটে টেনে এনেছি”, বুলা বলছিল মেঝের শানের দিকে দৃষ্টি ন্যস্ত করে, –”আমার মা আর কোনও দিন জলে নামবে না!” সে থামল, পরে হঠাৎ বেগে, আবেগে বলে উঠল, “আর আমি—আমিও ঘাটে এসেছি বটে, কিন্তু পাড়ে উঠতে পারছি না।
একেবারে খাড়া পাড় যে; ধসে গেছে ওখানে-এখানে, আগাছাতেও ভরা। তোর কি—তোর কি কখনও এমন হয়নি, কখনও? মানে জল ডাঙা ছেড়ে পেয়েছিস, কিন্তু কাদা, চারধারে নোংরা, ওপরে ওঠার রাস্তাটা খুঁজে পাচ্ছিস না?”
“তুমি হেঁয়ালির ভাষায় বলছ, বুলা। ঠিক এভাবে ভেবে দেখিনি।”
শান্তস্বরে বুলা বলল, “অন্তত আমি তো পাচ্ছি না। জলের ধার দিয়ে দিয়ে হেঁটে হয়রান হয়ে যাচ্ছি। জলেও ছিল শ্যাওলা—সেই গন্ধ আমার গায়ে লেগে আছে”, বলেই সে করল কী, কাচের বাসন আছাড় দিয়ে ভাঙার ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে খিলখিল হেসে উঠল। হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করার তালে তালে বলল, “ঠকে গেছিস তুই, একদম বোকা বানিয়ে দিয়েছি তোকে। প্লে-তে যেমন পার্ট থাকে, তারই একটা পুরো স্পিচ আগাগোড়া উগরে দিলুম, তুই ধরতেই পারলি না। দূর, ওর একটা কথাও আমার নয়। বইয়ে আছে, বলে দিয়েছি। বই মানে হল নাটক রে, নাটক।
সংবিৎ ফিরে আসছিল আমার, মনে পড়ে গেল ওখানে গিয়েছি কী কারণে বুলাকে রাজি করাতেই হবে। নিজে যে এত দুঃখী, সে আর একজনের দুঃখ বুঝবে না?
বললাম, “তুমি আমাদের পাড়ার ওই ক্লাবের পার্টটা ছেড়ে দাও বুলা।” এত চটপটে, চতুর যে, সে-ও আমার কথাটা ঠিক ধরতে পারল না। অবাক হয়ে বলল “মানে?”
“মানে কী আবার। ওই পার্টটা না করলে কী চলছে না তোমার?”
বুলা ততক্ষণে সামলে নিয়েছে, তার সপ্রতিভ ভাবটা ফিরে পেয়েছে। পায়ের আঙুল শানে ঘষতে ঘষতে বলল, “চলবে না কেন। ও-রকম কত পার্ট তো আমি পা দিয়ে ঠেলে ফেলি, এইভাবে।” কীভাবে, সেটাও সে তার পায়েরই একটা ভঙ্গি করে বুঝিয়ে দিল—কোনও শাহজাদির মতো।—”কিন্তু ছাড়তে বলছিস কেন।”
“আছে, কারণ আছে।”
বুলা বুদ্ধিমতী। বলল, “বুঝেছি। তুই কারো হয়ে ফড়েগিরি করছিস। কে রে? বল না। তোর কেউ আছে? জুটিয়ে ফেলেছিস কাউকে?” বুলা উঠে এসে আমার কাঁধ ঘেঁসে বসল। একটা হাতে লম্বা লম্বা নখ রেখেছিল সে, আলতো ভাবে আমার ঘাড়ে তাই ফুটিয়ে দিচ্ছিল; ব্যথা নয়, আমার লাগছিল সুড়-সুড়ি, হাসিও পাচ্ছিল, মনের খুশি থেকে যে হাসি ফুটে বেরোয় সে-হাসি নয়, এ হল যকৃৎ অথবা তলপেটে কোথাও পেশি সঙ্কোচনে যা তৈরি হয় সেই হাসি! আর ওই হাঁচি! লিখতে খুব হাস্যকর লাগছে, তবে আমার হাঁচিও পাচ্ছিল। তার কারণ ওই গন্ধ, বুলার শরীরটাই একটা সৌরভ হয়েছিল। এক একটা পানীয় যেমন স্নিগ্ধ, শীতল, আবার এক-একটা উগ্র, তপ্ত, বিভিন্ন সান্নিধ্যও তেমনই বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, এইসব অভিজ্ঞতায় প্রথম দিককার পাঠের কথা বাদ দিলে জবানবন্দি সম্পূর্ণ হয় না, তাই লিখলাম। প্রকৃতিনামা প্রধানা এক শিক্ষিকা আমাদের ভিতরেই নিহিত থাকে।
বুলা বলছিল, “কে সে বল না, তাকেই বুঝি পার্টটা দিবি তুই, তাই ধরতে এসেছিস আমাকে? তোর সাহস তো কম না! একটা মেয়ের জন্যে আর একটা মেয়েকে তুই—” কথা গড়াতে গড়াতে নাগালের বাইরে চলে যায় দেখে তাড়াতাড়ি বললাম, “বুলা মেয়ে নয়।”
বাঁশি যে মেয়ে নয়, সেটা জোর গলায় বলতে একটু আটকাচ্ছিল বইকি, হয়তো সেই দ্বিধা, সেই একটু ঠোঁট-কাঁপা থেকেই বুলা ধরে ফেলল, সহর্ষে বলে উঠল, “বুঝেছি। সেই ন্যাকা ন্যাকা ছেলেটা। আরে, ও তো মেয়েই।”
যতটা গম্ভীর হতে পারি ততটাই হতে চেষ্টা করে বললাম, “বুলা ও বড় আঘাত পাবে বুলা। আর কিছু নেই ওর, এই নিয়ে ভুলে থাকে। এইটুকুও কেড়ে নিও না।”
সোজা হয়ে বসল বুলা, ছিঁড়ে টানটান হয়ে গেল ধনুকের পিঠ। খুব দ্রুত কথা বলতে শুরু করেছিল সে এবারে, খানিক আগেকার সেই আয়েসী ভাবটা আদৌ ছিল না—”ওর কিছু নেই—নেই বুঝি? আর আমার-আমার বুঝি সব আছে? কী আছে আমার, কী-কী-কী; বল বলতেই হবে তোকে। আমার মধ্যে কী দেখেছিস? ছেড়ে দেব, ছেড়ে দেব—তাই না? বেশ দিলাম। কিন্তু ছেড়ে দিলে তোরা আমাকে দিবি কী? কিছু দিবি তো, না বিনে পয়সায় বন্দোবস্ত করতে এসেছিস?”
সে হাঁপাচ্ছিল, না হাসছিল বোঝা যাচ্ছিল না, হয়তো দুটোই, কখনও কখনও বিকারের ঘোরে আমাদের মধ্যে অনেক বিপরীত মিশে গিয়ে থাকে, বুলারও যাচ্ছিল।—”কী দিবি আমাকে, কী-কী-কী” শুনতে লাগছিল উৎকট খি-খি-খি হাসির মতো। আমি বললাম, মানে তোতলামি শুধরে যতটা বলা যায় সেই ভাবেই বলতে চেষ্টা করলাম, “তুমি যদি দয়া করো বুলা, তবে ও মানে ওই বাঁশি তোমাকে ক্ষতিপূরণও দিতে পারে। ওর—ওর অনেক টাকা।”
টাকা শব্দটা শুনেই জোরে জোরে হাসতে শুরু করেছিল বুলা, হাওয়ার দোলে, সুপুরি গাছ যেমন টলে টলে হাসে, পরে চোখের কোণ ছুঁচলো করে সে বলল, “অনেক টাকা বুঝি, অ—নে—ক? কত টাকা, কত? কে রে, ছেলেটা, কী নাম বললি, বাঁশি? তোর কে হয় রে?”
বললাম, “আত্মীয়।” আমরা আসলে আশ্রিতও যে, বললাম না, বলতে পারলাম না।
বোকার মতো আবার বললাম, “ওদের অনেক টাকা।”
“টাকা টাকা খালি টাকা শোনাচ্ছিস, তুই কাকে?” বুলা হঠাৎ যেন খেপে গেল, হাতও তুলল, সে কি আমায় মারবে বলে, কই, না তো, হাত আর সুর দুই-ই নামিয়ে নিল সঙ্গে সঙ্গে—”তুই তবে টাউট—দূত হয়ে এসেছিস? যাঃ, তবে আর তোকে মারব না। দূত তো অবধ্য। তুই যার দূত, তাকেই বরং পাঠিয়ে দিস এক দিন বোঝাপোড়া করতে হয় তো করব তার সঙ্গেই। বোঝাপড়া, মানে যা বলেছিলি তুই—টাকা, টাকাকড়ি।” হাতের বুড়ো আঙুলে তর্জনী ঠেকিয়ে বুলা পর পর অনেকগুলো অদৃশ্য রুপোর টাকা নিঃশব্দে বাজিয়ে গেল।
নিয়তিকে কেউ মাকড়সা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পেরেছে কিনা জানি না, অনেক খুঁজেও কিন্তু মা, আমি ওর চেয়ে ভালো একটা উপমা বের করতে পারিনি। সে আছে, নিশ্চিত, নিপুণ, জাল ছড়াচ্ছে। মন আর দৃষ্টি স্থির করে কেন্দ্রবিন্দুতে বসে লক্ষ করছে বদ্ধ কীট আমরা, বন্দি; সেই জালে সূক্ষ্ম, অপ্রত্যক্ষ চক্রান্তের অন্ত পাব কী করে। আমাকে নিয়েও অন্তরালে কিছু চলছিল, টের পাচ্ছিলাম। তার আগে বাঁশির কথায় ফিরে আসি।
“দেবে, দেবে, পার্ট ফিরিয়ে দেবে, সত্যি বলছ?” তার মুখটা সকাল বেলাকার ফুলতলা হয়ে গিয়েছিল।—”যদি দেয়, যদি ওকে রাজি করাতে পারো, তবে দেব, দেব, সব দেব আমি।” বাঁশি ব্যাকুল গলায় বলছিল। বলার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য ছায়া পড়ল ওই ফুলতলাতে—”কিন্তু কী দেব, কী দিতে পারি আমি, দেবার মতো আমার কী আছে।” তবু সে দিয়েছিল, দিতে পেরেছিল। আমার একটি নিয়তিকে এনে দিয়েছিল আমার কাছে। আমি তাকে দিয়েছিলাম তার নিয়তি। আমাদের দু’জনের মধ্যে একটা বিনিময় ঘটে গিয়েছিল।
.
তাকে প্রথম যখন দেখি, চিনতে পারিনি। কিংবা ভুল দেখেছিলাম। আমাদের জীবনের অনেক প্রবল সংবাদ প্রথমে ভ্রান্তির রূপ নিয়ে আসে।
ভুল করাটা আরও সহজ হয়েছিল যেহেতু যেদিনের কথা লিখছি সেদিন ঘুম থেকে উঠে বাঁশিকে দেখতে পাইনি। তারই ফলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এ-ও মনে পড়ছে, খুব সুন্দর একটি অনুভবে মনটা ভরে গিয়েছিল। তার ভরে যাওয়ার কথা কি না,’মন তাই তাকে আজও সযত্নে তুলে রেখেছে।
তার সারাজীবনটা কেমন যাবে সেটা যদি বিধাতা পুরুষ স্থির করে দেন নবজাতকের সূতিকাঘরে, তবে এক-একটা দিনের অদৃষ্টও নির্দিষ্ট হয়ে যায় এক-একটা সকালে, এ সত্য আমি পরে জেনেছি, ‘সকাল দিনকে দেখায়’ শুধু এই বিদেশি প্রবাদটার প্রতিধ্বনি করছি না, দেখায়, মা, সত্যি। তুমি বিশ্বাস করো। আমি প্রায় প্রতিটি প্রভাতের অভিজ্ঞতা দিয়ে এই অমোঘ নিয়মটিকে জেনেছি।
সকালে উঠেই আজও যদি খোলা নর্দমার ভকভক নাকে লাগে, সারা দিনটাই, বিগড়ে বিষিয়ে যায়, প্রথম থেকেই সব কেমন তেতো-তেতো লাগে। সেদিন তখনই জানি, আজকের দিনটির উপর ঈশ্বরের করুণার বৃষ্টি ঝরবে না। চায়ের কাপ ফসকে যাবে, লিখে লিখে পণ্ডশ্রমের চিহ্ন কাগজগুলো বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলব ছুঁড়ে, কোনও না কোনও রকমের অপঘাত ক্রমপর্যায়ে ঘটবেই, সংস্কারে আচ্ছন্ন আমি টের পাই। তাই বেতারের কান মুচড়ে তাকে বোবা করে রাখি, সঙ্গীতেও সেদিন গোলোকে গমন নেই। জানি। সকালের যে-রৌদ্র সোনালি ডানার কোনও বিপুল পক্ষী অথবা পক্ষিরাজ, সেদিন সে ডোরাকাটা হিংস্র হালুম হয়ে চামড়ায় দাঁত বসাবে। জানি। এ-ও জানি যে, প্রত্যহ ঊষাকালে যাদের খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে হয়, তারা তৎক্ষণাৎ সামান্যতায় আক্রান্ত হবে, এটা একরকম অবধারিত সেই, হতভাগ্যদের অন্তত সেই দিনটিতে উদ্ধারের আশা নেই, তাদের করুণা করি। প্রাতরাশে বসলে রাশি রাশি কালো হরফের পিঁপড়ে, তাদের চোখে কুটুস কুটুস কষ্ট হবে, সেই কালো পিঁপড়েরা তাদের মগজ কামড়াবে, তার পরে তারা সেই পিঁপড়েরা, মগজ, ফুঁড়ে কণ্ঠনালি বেয়ে নেমে, তখন তাদের গোগ্রাসে গিলতে গিয়ে যে ওয়াক-থুঃ, তাকেও জানি।
এবার সেই দিন। সেই দিনটি কিন্তু ছিল আশীর্বাদের মতো। কেননা, জানালা দিয়ে বাইরে চাইতেই দেখেছিলাম শালমঞ্জরী—অজস্র অজস্র, সুকারু কোনও কর্ণাভরণের মতো। বাগানে নাগকেশরগুলি অদম্য হয়ে উঠছিল। নাগকেশর, সমগ্র পুষ্পের বিশ্বে একমাত্র যাকে মনে হয় পুরুষ। আর দেখেছিলাম কিছু নীল—কিছু। নীল তো একটা রঙ, কিন্তু নীলের রঙ কী। সেদিন জেনেছিলাম। আজও তাই জেনে বসে আছি। নীল আমার রঙ। না, সবুজ, না, সেই কাঁচা কালেও সবুজ আমার রঙ ছিল না। সবুজ, মানে বড় বেশি উচ্চারিত। লাল? সে তো শুধু চিৎকার। গৈরিকে বৈরাগ্য আছে; শুনেছি, কিন্তু কখনও অনুভব করিনি। আর সাদা। যদিও সহাস্য, নির্মুক্ত, নিরাসক্ত সে, তবু এই পরিণত কালেও সে আমার রঙ হল না। এই হেতু যে, দেখতে যদিও সর্বত্যাগী সে, তবু বিজ্ঞান বলে, সাদাই নাকি সর্বগ্রাসী, অতএব তার আপাত ভালোমানুষির মধ্যে কোনও লুকোচুরি আছে। বাকি রইল কালো। কিন্তু কালোকে কেউ তো গ্রহণ করে না, সে-ই গ্রাস করে সকলকে, রাত্রির মতো, মৃত্যুর মতো। কালো অনিবার্য।
কিন্তু নীল, আমার নীল? তাকে যে আমার মধ্যে ছুপিয়ে নিয়েছি, সেকি সে নিবিড় বলে, নরম বলে, চেয়ে চেয়ে সাধ মেটে না কেন কোনও নয়নের মতো বলে? আকাশ আর সমুদ্র দুই-ই নীল নীল, দূরের অরণ্যও—এরা সবাই অশেষের স্বাদ এনে দেয় বলে?
তা-ও বোধ হয় নয়। নীল আমার প্রিয়, নীল আমার রঙ, এর পিছনে কোনও নীলাম্বরী অনুষঙ্গ নেই, নীল দিগন্তও নয়, আসলে রঙের মধ্যে একমাত্র নীলই নিজের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখতে পারে। বাকি সব রঙ বড় বেশি ব্যক্ত, তাই না?—যেন ফেটে ফেটে পড়ে। একমাত্র রঙ যে নীলের কাছাকাছি তার নাম ধূসর। সে কিছু আঁকে না, ফেটেও পড়ে না, প্রগাঢ় বিষাদে সে শুধু সব মুছে দিতে জানে।
এই সব দেখলাম সেদিন। দেখলাম বাবাকেও–বাগানে। ঘুরছিলেন, কিন্তু পাশে ও কে?
একটু এগিয়ে গিয়ে খেইটা ধরি।
বাঁশিকে বলেছিলাম, “তুমি কি শাড়ি পরে একটু আগে বাগানে বেরিয়েছিলে নাকি?”
বাঁশি হাসল। নিজেকে নিয়ে একটু তামাশা করা ও শিখেছিল।—”শাড়ি পরে, আমি? না, আমি না। মেয়ে হতে আমাকে শাড়ি পরতে হয় না। স্টেজের বাইরে শাড়ি আমি পরিও না। তুমি বোধহয় কিশমিশকে দেখেছ।”
“কিশমিশ?”
“আমার বোন। হসটেলে থাকে, জানো না? কাল রাত্রে এসেছে! ইস্টারের ছুটি ক’দিন থাকবে।”
শুধু ওইটুকু বলে থামলেই তো চলত, কিন্তু খানিক আগে নিয়তির কথা বলেছি না? সেই মাকড়সার সূক্ষ্ম নির্দেশে বাঁশি গলাটা হঠাৎ নামাল কেন, কেনই বা বলল, “তোমার বুলাকে যদি রাজি করাতে পারো, মানে ওই পার্টটা আমাকে ছেড়ে দিতে—তা হলে আমিও তোমার সঙ্গে কিশমিশের আলাপ করিয়ে দেব।”
কীট-জগতের কোনও চতুর অধিপতি তখন তাঁর জালের কেন্দ্রবিন্দুতে বসে বুঝি একটু টান দিলেন। সরু সরু লতাতন্তুতে আমার চিত্ত কি জড়িয়ে গেল? তখনই টের পাইনি।
মানুষের প্রথম প্রলুব্ধক কী হেতু সর্পরূপে এসেছিল, আমি জানিনা। বোধ হয় তার শিরদাঁড়া ছিল না বলে। বাঁশির সঙ্গে তার মিল আমি খুঁজে পাচ্ছি এইমাত্র। এখনও বাঁশির সেই ভঙ্গি মাঝে মাঝে দেখি, যেন স্বপ্নে। সাপের মতোই তার নিরস্থি শরীর হেলছিল, দুলছিল। তার চোখে সাপের মতোই ইশারা খেলছিল অথবা খেলছিল না, আমি কি আমারই এক অবচেতন ইচ্ছাকে সাপের আকারে দুলে উঠতে দেখেছিলাম?