২০
আগে পশুপতি জ্যাঠাবাবুর কথাটা বলে নিই। সেই সময় উনি আমাদের সংসারে কয়েকটা দিন বয়ে গিয়েছিলেন একটা ভরসার বাতাসের মতো।
“প্রণব আছে, প্রণব আছে?” বলতে বলতে একদিন সকালে পড়েছিলেন আমাদের ঘরে ঢুকে, তখনকার দিনে টোকাটুকি দিয়ে ঢোকার ব্যাপার-স্যাপার ছিলই না। বাবাকে দেখতে পেয়ে “আরে এই তো প্রণব” বলে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন, বলেছিলেন, “কিন্তু বিছানায় কেন।” তুমি শশব্যস্ত, মাথায় ঘোমটা তুলে এক পাশে, আগন্তুক ওই লোকটি, যাঁর চেহারা দশাসই, কাঁধ চওড়া, গায়ে মোটা ফতুয়া, অনেকটা বাবাকে আগে যেমন দেখাত, প্রশস্ত কপাল, চোখ উজ্জ্বল, তোমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি আমাকে চিনবে না বউমা! আগে দেখনি। আমি পশুপতি। প্রণব কোনওদিন আমার কথা তোমাদের বলেনি?”
বাবার তখন কথা বলতে কষ্ট হত, কিন্তু এক ধরনের সম্বিত তখনও ছিল, দেখলাম ওঁর শীর্ণ-ক্লিষ্ট মুখ আকস্মিক একটা আলোকে ভরে গেছে। পশুপতি বললেন, “আমি ওর দাদা হই।”
বাবা জড়িয়ে জড়িয়ে কোনওমতে বললেন, “দাদারও বেশি।”
পশুপতি জ্যাঠা বললেন, “সম্পর্ক হিসেব করলে, খুব দূরের যদিও, এক রকম নেই-ই। তবু আমরা অনেকের চেয়েই আপন, কাছাকাছি। সুখে-দুঃখে বহুদিন একসঙ্গে কাটিয়েছি।”
তুমি তখন তাঁকে প্রণাম করলে। তোমার দেখাদেখি আমিও।
পশুপতি নিঃসঙ্কোচে বসলেন বাবার বিছানার এক ধারে। বললেন, “ওর এই অবস্থা তা-তো জানি না। আমি তো অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম, গত মাসে আমরা সবাই ছাড়া পাই, জানো তো? আমি সঙ্গে-সঙ্গে চলে যাই রাঁচিতে, শ্রীঘরবাসে শরীর তো একেবারে ভেঙে পড়ে? প্রণব সে-সব নিজেই তো জানে। রাঁচিতে আমাদের গ্রুপের আরও কয়েকজন এল, আন্দামান-ফেরত, পুরনো দু’জন বন্ধুও দেখি জুটে গেল। সেখানে দিনের পর দিন ধরে অনেক পরামর্শ। প্রণব”, বাবার দিকে স্থির চোখে চেয়ে পশুপতি বললেন, “একটা প্ল্যান পাকা করেই এখানে এসেছি।”
বাবার চোখের পাতা আর ঠোঁটের কোণ কাঁপছিল।
পশুপতি আসন করে বসেছেন। বললেন, “এখনই ভেঙে কিছু বলব না। বলব ক্রমে ক্রমে। তার আগে” বুক পকেট থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে তিনি বললেন, “যাও তো, গরম-গরম জিলিপি নিয়ে এসো আগে। আর খাস্তা কচুরি। সকাল থেকে পেটে বিশেষ কিছু পড়েনি।”
তুমি অবাক হয়ে চেয়েছিলে। কচুরি আর জিলিপি যখন এল, পশুপতি তখন বললেন, “হাত মুখ ধুয়ে আসি, তারপর। কলঘরটা কোন্ দিকে?”
ঘরটর যে নেই সেটা তাঁকে আর বলা হল না, ইশারায় দেখিয়ে দেওয়া হল কলতলার দিকটাকে।
তুমি বললে বাবার মুখের দিকে চেয়ে, “ভারী চমৎকার লোক তো, একেবারে খোলামেলা।”
বাবা অস্পষ্ট স্বরে যে-উত্তর দিলেন তার মানে দাঁড়ায় এই, পশুপতিরা হলেন আলাদা জাতের মানুষ। মনে মুখে এক। কোনও ময়লা নেই। ময়লা নেই বলেই এত সহজে সব পরিবেশে মিশে যেতে পারেন।
উনি একটু পরেই ফিরে এলেন। তুমি তখন খাবার ভাগ করে করে রাখছ ডিশে ডিশে। বাবা শুধু চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন। মুখে বলছেন না কিছুই। অসুখটার পর থেকে ওঁর নোলা বেড়েছিল।
একটা ডিশ পশুপতির সামনে সাজিয়ে ধরে তুমি ফিসফিস করে আমাকে বললে, “জিজ্ঞেস করতো, উঠেছেন কোথায়?
“উঠেছি একটা মেস-এ, মির্জাপুরের ওদিকে,” পশুপতি সরাসরি জবাব দিলেন, “ওটা অনেক দিনের জানাশোনা জায়গা, তাছাড়া আমাদের দলেরও একটা আড্ডা।”
“খাওয়া দাওয়া কেমন?” জিজ্ঞাসা করলে তুমি, এবারও আমার দিকে মুখ রেখে। “ঠাকুরের রান্না তো, বিশেষ ভালো না। আমার ইচ্ছে আছে বউমা, একদিন তোমার হাতে খেয়ে যাই।”
“বেশ তো, খান না”, এতক্ষণে তুমি বলতে পারলে সরাসরি, ঘোমটাটা যদিও টানাই রইল, তারপর খুব কুণ্ঠিতভাবে, খুব আস্তে-আস্তে, “ক’দিনই বা থাকবেন, সাহস করে বলতে পারছি না আপনাকে। যদি—যদি খুব অসুবিধে মনে না করেন, তবে দু’বেলাই খান না এখানে! “
আমি স্তম্ভিত হয়ে শুনছিলাম। মা, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি, একেইতো আমরা নিজেরাই এইভাবে আছি, পাপোশের তলায় চাপা-পড়া পোকার মতো কায়ক্লেশে, এই বিমুখ-বিমাতা শহরে, সকালে আজকাল রোজ আমি মুড়িও পাই না, বাবার মাথার ঠান্ডা তেলটা কেনাই হচ্ছে না ক’দিন, এর মধ্যে খেতে ডাকছ আর একজনকে? কী খাওয়াবে বিশিষ্ট ওই ভদ্রলোককে তুমি, থালায় কি শুধু পান্তাভাত আর নুন-কাঁচালঙ্কা বেড়ে দেবে? আমি লুকিয়ে তোমার পায়ে আঙুলে চিমটি কাটছি, তার মানে সংকেতে তোমাকে বলছি চুপ করতে, কিন্তু ওই যে, ওই তো, পশুপতিবাবু বলছেন “নিশ্চয়, নিশ্চয়”, আর তুমি ইতিমধ্যে যেন আরও লজ্জাবতী ভাদ্রবধূ, মাথা আর তুলছই না, চোখ দু’টিকে সারাক্ষণ রেখেছ মেঝের শানে, আরও মিষ্টি, খুব মৃদু গলায় বলছ, “আপনার অবিশ্যি খেতে কষ্ট হবে”, মা, এ-গলা তুমি পেলে কোথায়, আর সাজানো-গোছানো সুন্দর করে বলা ওই কথাগুলো, তৈরি করে বলছ, না তৈরি করাই ছিল, যেন একটা শেখা পার্ট, তুমি মুখস্থ বলছ; পশুপতিবাবু হাসছেন হো-হো করে— – “কী যে বলো, জীবনের শুক্লপক্ষ আর কৃষ্ণপক্ষের মতো দুটো ভাগের একটা যাদের কেটেছে জেলে, সেখানে লসিই হল গিয়ে অমৃত, আর তুমি বলছ, এখানে খেতে কষ্ট হবে? হা-হা-হা।”
পশুপতিবাবু একবার হাসি থামিয়ে ঘরের চার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন।—”কিন্তু বউমা, ঠিক করে বলো, তোমার অসুবিধে হবে না তো। দেখছ তো আমার শরীরের বহর, আমি আজকাল পেটুকও। আগেকার খেতে না-পাওয়াটা এখন পুষিয়ে নিচ্ছি আর কী। এ-বেলার বাজার তোমাদের নিশ্চয়ই হয়ে গেছে।
(উনি ইদানীংকার কিছু জানেন না, হালে আমাদের আবার রোজ বাজার হয় কবে) তাহলে একটা কাজ করা যাক, আমি আসব ও-বেলা, তুমি যাও তো খোকা, বাজারের সেরা মুগডাল আনবে, কেমন? আর পেট মোটা কই, কেমন? আলু পেঁয়াজ যা-যা চাই সব ওকে বলে দাও তো”—তিনি এবার জামার ভিতরের পকেট থেকে দশ টাকার নোট টেনে বার করলেন।
একটু আগে জিলিপির জন্যে পাঁচ, এখন বাজারের জন্যে দশ, নোটগুলো নক্শাকাটা ফুল হয়ে এই ঘরের হাওয়ায় ভাসছে। ভাসছে সত্যিই, না ভেল্কি দেখছি আমরা। পশুপতিবাবু, আকস্মিক ওই অভ্যাগত মানুষটি কে জানে রক্তমাংসের কিনা, হয়তো কোনও রূপকথার মানুষ উনি, রূপকথার পাতা থেকে নেমে এসেছেন; তাহলে তো এই নোটটা সত্যি নয়, এক্ষুনি উবে যেতে পারে—ভয়ে ভয়ে নোটটাকে আমি মুঠো করলাম।
প্রথমে অবাক হয়েছিলাম অবিশ্যি, এখন আর হচ্ছি না, যেন এখন বুঝতে পারছি, এ সমস্তই আমার জানা, আগেই কোথাও দেখা ছিল, জানা ছিল যে, পশুপতি নামক ওই বলীয়ান পুরুষটির আবির্ভাব ঘটবে, তাঁর গল্প, তাঁর হাসি, তাঁর নোট, পর পর এসব ঘটবেই তো, আমি দু’বার করে দেখছি।
“দুভাই মিলে অনেকদিন পরে জমিয়ে খাওয়া যাবে, কী বলো ভাই প্ৰণব”, ওই অলীক প্রায়, অপরূপ, প্রেরিত পুরুষ-প্রতিম ব্যক্তিটি দরাজ গলায় বলছেন তখন। তিনি, যাঁর নাম পশুপতিবাবু।
বাবা কিছুই বলছিলেন না। একটু আগে যেমন পশুপতির, তখন বাবারও বালিশে রাখা মাথা থেকে চোখ দুটি ঘরের চার দিকে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছিল। মা, তুমিও ঘোমটার তলা থেকে চাইছিলে এদিক-ওদিকে, আর আমি?—আমি কি তখন সহসা উপস্থিত এক সৌরজগতে, সৌরজগৎ তখন ওই ঘরটাই, যেখানে নানা দৃষ্টি গ্রহ উপগ্রহের মতো ঘুরে-ঘুরে যাচ্ছে?
.
“চমৎকার লোক এই পশুপতিবাবু, না?” উনি চলে যেতে বলে উঠলাম। আসলে বললাম আমরা তিনজনেই, তোমরা দুজন চোখ দিয়ে, আমি মুখে।
“ছিঃ, অত বড় মানুষটা, নাম ধরে বলতে নেই, জ্যাঠাবাবু বোলো।” ঠিক বকছ না তখন তুমি আমাকে, শুধু যা সমীচীন তাই শিখিয়ে দিচ্ছ।
আর, মা, যখন খানিক পরে বাজারে যাচ্ছি নোটটা নাচাতে নাচাতে, তখন মনে-মনে তোমাকে প্রণাম করছি, মা, তুমিও তবে নিশ্চয়ই জানতে, যখন ওঁকে হঠাৎ খেতে বলেছিলে, ওঁর চেহারাই কি দিলদরিয়া ভিতরটাকে ধরিয়ে দিয়েছিল, অথবা অভিজ্ঞা তুমি, তাই! অথবা অভাবই দিব্যদৃষ্টি দিয়ে থাকে? যাই হোক, তুমি ধরতে পেয়েছিলে কিন্তু—পশুপতিবাবুর
(ছিঃ পশুপতি তো নয়, জ্যাঠাবাবু)
দরাজ ঔদার্য সব বুঝি মন্ত্রবলে তোমার দিব্যদৃষ্টিতে আভাসিত ছিল?
.
মশলা পেশা হল বিকালের দিকে, দুটো উনুন জ্বলল, এ সব খুঁটিনাটি না-হয় বাদ দিয়ে যাই, কিন্তু বালতি-বালতি জল ঢেলে ঘর ধোয়া-মোছা, আচ্ছা ওটাও থাক, কিন্তু মা, কোথায় ছিল ধবধবে ওই শাড়িটা, গা ধুয়ে এসে যেটা তাড়াতাড়ি পরে নিলে? এ-ও বুঝি সেই দিব্যদৃষ্টি দূরদৃষ্টি, তুমি জানতে কোনও-না-কোনওদিন এই রকমই একটা আবির্ভাব-অভ্যুদয় ঘটবে, তাই আগামীর দিকে চেয়ে একটা ভালো শাড়ি তোরঙে তুলে রেখেছিলে?
আমার দৃষ্টিতে কী ছিল—বিস্ময়, না মুগ্ধতা? একটু কি সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিলে? তাই কেমন-যেন ধরা পড়ে-যাওয়া গলায় বললে, “কী দেখছিস?”
আর তো সেই বালকটি নই, যে-বালক দেশের বাড়িতে বাবা প্রথম আসার দিনটিতে তোমার রঙিন শাড়ি দেখে ব্যথিত-আহত বোবা হয়ে ছিল। আজকের শহুরে-সেয়ানা ছেলেটা সটান বলে বসল, “তোমাকে! না এই শাড়িটাকে।”
“পরলাম”, কুণ্ঠিত গলায় তুমি বললে, “পরলাম। বড্ড নোংরা হয়ে থাকি, বাইরের একজন খাবে, যদি ওঁর গা ঘিনঘিন করে?”
মা, তুমি বাইরের মানুষটির চোখ দিয়ে দেখছিলে, তাই সেদিন বুঝতে পারিনি। আজ যদি বলি, গা ঘিনঘিন করছিল আমারও?
(যদিও তখন শহুরে, তখনই মিথ্যেবাদী, তখনি বলেছিলাম, “ভালোই তো লাগছে এই শাড়িটায় তোমাকে।”)
আর কী বলছিলে তুমি, নোংরা? যে শাড়িটা পরে ছিলে তখন, সেটা ফরসা বটে, তবু টের কি পাওনি ওর সুতোয়-সুতোয়, প্রত্যেকটা টানা আর পোড়েনে কত ধুলো লুকিয়ে আছে? এই শাড়িটা রঙিন নয় অবশ্য, কিন্তু কোথায় যেন লোভের রঙ নির্লজ্জভাবে কটকট করছে, তোমার চোখে পড়েনি? দিব্যদৃষ্টি এমনই হয় বুঝি? একটা দিকে খোলা থাকে, অন্য দিকে কানা?
এত ধোয়া-মোছা, আমাদের ঘর অনেক দিন পর যেন ঝকঝক করতে থাকল, তবু কই, তেমন পরিচ্ছন্ন তো লাগছে না! বরং ময়লা একটি মেয়ে, ফুটফুটে হওয়ার আশায় ঝামা দিয়ে ঘষে-ঘষে মুখখানা কি রক্তাক্ত করে ফেলল?
এত স্পষ্টভাবে বুঝিনি সেদিন, তবু নামহীন অন্য একটি নয়ন দিয়ে আবছাভাবে দেখছিলাম।
সেই দৈন্যটা। জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে ক্ষুধার্ত-ধূর্তটা, যে শিক ঝাঁকাত। সে সরসর করে সাপের মতো চলে এসেছে ঘরের ভিতরে।
.
পশুপতি, না না জ্যাঠাবাবু, সময় মতো এলেন। খেলেন পরিতোষ সহকারে, কাঁটা চুষে চুষে পাতের পাশে ফেলে-ফেলে।
(‘ভাবছ প্রণব, আমার দাঁত বাঁধানো? তা নয়, তা নয়, এখনও বেশ মজবুত আছে’।) ঝোলের বাটিতে কব্জি ডুবিয়ে
(“তুমি কিন্তু খেতে পারছ না প্রণব, হঠাৎ যেন বুড়ো হয়ে গেছ। অথচ এই সেদিনও তো—যাক, ভেবো না কিছু, আমি যখন এসেছি আবার দাঁড় করিয়ে দেব তোমাকে, কাজের মধ্যে টেনে নামাব! যা ছিলে তাই করে দেব। ভেবো না’)। পানও মুখে একটা পুরলেন জ্যাঠাবাবু, যাবার সময় আমাকে কাছে ডাকলেন, দেখছেন তো সেই থেকেই কিন্তু ঠিক ওইভাবে নয়, এতক্ষণ ওঁর কাছে আমি ছিলাম এই বাড়ির অংশমাত্র, কিন্তু যেন ওই প্রথম আলাদাভাবে চোখে পড়লাম।
“কী পড় তুমি?”
বললাম।
“সায়েন্স, না আর্টস?”
“আর্টস।”
“অঙ্কে মাথা নেই বুঝি?”
সময় বিশেষে আর-একটু ছেলেমানুষ কী করে হয়ে যেতে হয়, মুখে লাজুক-লাজুক ভাব রাখতে হয় ফুটিয়ে, তখন থেকেই বেশ জানি। খুব সারল্যের হাসিখানি এঁকে নিয়ে উজ্জ্বল চোখে চেয়ে রইলাম। কিন্তু উত্তর দিলাম না, গুরুজনদের সঙ্গে সমানে কথা বলে যেতে নেই, কখনও-কখনও না বলাটাই সহবত, সেটাই বিনয়, এ সব শেখা ছিল তাই খুব সরল হাসি আর দীপ্ত দৃষ্টি মিলিয়ে চেয়ে থাকলাম।
বাবাও কিছু বললেন না, তখন এগিয়ে এলে মা, তুমি নিজেই। ঘোমটা কপাল পর্যন্ত ঠেলে দিয়ে, সত্যি-সত্যি কিন্তু ভাসুর নন তো উনি, সুতরাং কী এসে-যায়, নিচু গলায় বললে, “ওর ঝোঁক অন্য দিকে। লেখায়-টেখায়।”
“ওর বাপের মতো?” জ্যাঠাবাবু হাসলেন, আর সেই মুহূর্তে কী হল, বাবা হঠাৎ দু’হাতে চোখ ঢেকে অস্থিরভাবে মাথা এদিক-ওদিক নাড়াতে থাকলেন, কী অস্বীকার করতে চাইছিলেন উনি, জানি না। উনি লেখক নন, না আমি না? অথবা ওঁর মতো না? সে তো ঠিকই, সে তো ঠিকই রেগে যাচ্ছিলাম আমি, ফুঁসছিলাম, আড় চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছিলাম, ‘তোমার মতো একটুও নই আমি, কেন হব, যদি সত্যি-সত্যি কখনও লেখক হই, তবে আমি হব সময়ের মাপমতো, ঝকঝকে, মডার্ন। কিছু হয়েছে কি তোমারগুলো? ওই পালা-টালা? কিছু না।’
আর বাবা? শুধুই মাথা নেড়ে যাচ্ছিলেন। অস্পষ্ট, অর্থহীনভাবে।
পশুপতি অতসব দেখছিলেন না, বললেন, “কী পড়ো দু-একটা বই নিয়ে এসো তো। আজকালকার কোর্সে কী সব আছে, ভালো করে জানিওনে।”
“সব বই তো নেই ওর’, তাড়াতাড়ি বলে উঠলে তুমি, “কিনতে পারেনি।”
“পারেনি কেন”, পশুপতি জিজ্ঞাসা করলেন একবার, কিন্তু একবারই শুধু, দু’বার নয়, দু’বার জিজ্ঞাসা করতে হল না, এবার আমি মুখের সেই সরস হাসিটুকু ঘুচিয়ে ছলছল চোখে চেয়ে রইলাম কিনা।
(মা, আগে থেকেই কেউ কি নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল, নাকি আমরাই, আমরা দু’জনে মিলে বোবা ভাষায় ঠিক করে নিয়েছিলাম যে, কথা-টথা যা তুমি জুগিয়ে যাবে, আর আমি কখনও স্মিত, কখনও দুঃখিত মুখে এই সব ভাবভঙ্গি ফুটিয়ে রাখব, বদলাতে থাকব? )
আমি খুব করুণভাবে চেয়ে রইলাম কি না, তাই পশুপতি আর জিজ্ঞাসা করলেন না, বই কিনতে না-পারার কারণটা বুঝে নিলেন। একটু পরে বললেন, “পরীক্ষা কবে?”
“এই তো সামনেই। ফীজ এখনও জমা দেওয়া হয়নি।” এবারও বললে তুমিই, এই শহরটা কী মা! কী এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে সে জড়োসড়ো গৃহবধূর মুখে প্রয়োজনীয় কথা যোগায়, ঘোমটাটা ঠেলে-ঠেলে দেয় একটু-একটু করে পিছনে, আরও পিছনে!
এবার আর কারণ জিজ্ঞাসা করেননি পশুপতি শুধু বলেছেন, “ও।”
তিনি যখন চলে যাচ্ছেন, তখন আরও একবার মাথা নুইয়ে প্রণাম করছ, তুমি, আমাকে করতে বলছ। মৃদু গলায় বলছ, “আবার আসবেন।”
“আসব বইকি, এমন চমৎকার খাওয়ালে তুমি বউমা, আসব না?” পশুপতি বললেন,. আর কিছু না হোক, ওই খাবার লোভেই আসব।” চলে গেলেন হাসতে হাসতে। বাবা উঠলেন না। ওর মাথা নাড়ানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু চেয়ে দেখলেন।
আর তখনই, মা, তুমি বলে উঠলে, “আরে?”
আমি তাকালাম।
আঁচলের খুঁটটা খুলতে খুলতে তুমি বললে, “ওর দশ টাকার বাজার-ফেরত চার টাকা ছ’ আনা—তা যে রয়েই গেল, ফেরত দেওয়া হল না!”
আমি তাকিয়ে রইলাম, কিছু বললাম না। তুমি বাবার দিকে চাইলে বাবাও চুপ। তুমি তাড়াতাড়ি বললে, “বোধহয় ভুলে গেছেন।” আমরা কিছু বলছি না, সেই দৃশ্যে কথা তোমার একারই। এবার একটু হাসছ-তুমি, মানে, হাসতে চেষ্টা করছ।—যাক, আবার তো আসবেন। “
আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল মা, ভীষণ কষ্ট, তোমাকে ওইভাবে একা করে দিতে একাই কথা বলিয়ে নিতে, তাই এবার মুখ খুলতেই হল, বলতেই হল সায় দিয়ে, “আবার আসবেন। ওঁর নিশ্চয়ই মনে ছিল না।”
“তাই তো, তাই তো, তাই”, তুমি বুঝি আমার ওই একটা কথারই অপেক্ষা করছিলে, সঙ্গে সঙ্গে বোঝা নামিয়ে হালকা হয়ে গেলে, তোমার খুশি মন হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে যেন তালি বাজাচ্ছিল, তাই-তাই-তাই।
“ওঁর মনে ছিল না। বলেছিলাম। কথাটা হয়তো ঠিকই, কিন্তু আংশিক ঠিক। ওইটুকু বললাম। কিন্তু বাকিটুকু? তোমার যে মনে ছিল, ফেরত টাকাটা তোমার সজ্ঞান আঁচলের খুঁটে আগাগোড়া বাঁধা ছিল, সে কথা বললাম না, বলতে পারলাম না, ছেলে হয়ে মাকে ও-কথা বলা যায়!
বাবা শুধু চেয়ে দেখেছিলেন। দেখতে থাকলেন, পর-পর চার দিন কি পাঁচ দিন ঠিক মনে নেই, পশুপতি, মানে জ্যাঠাবাবু আসছেন, যাচ্ছেন, কোনও দিন বাজার আনছেন নিজেই, কোনওদিন বা এসেই দিচ্ছেন, নোট বাড়িয়ে, কত রকমের রান্না, তার গন্ধ কী চমৎকার, আঃ, জানলার বাইরের সেই ভয়-দেখানো দৈন্যটা, এখন ভিখারি হয়ে সেই দৈত্যটা, পাতের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে সব চেটেপুটে খাচ্ছে।
বাবার সঙ্গেও অনেক কথা হত জ্যাঠাবাবুর। আগেকার কথা, পরে কী হবে, সেই সব কথা! শুধু এক দিন দেখলাম, জ্যাঠাবাবু ঢুকছেন হাতে মস্ত একটা ইলিশ নিয়ে আর বাবা শুধু আড়চোখে তাই দেখে নিয়ে চুপে চুপে বেরিয়ে যাচ্ছেন।
রান্না হতে থাকল, জ্যাঠাবাবু কাগজ পড়ে যেতে থাকলেন, প্রথমে ব্যাপারটা তেমন কিছু বিসদৃশ মনে হয়নি, কত কাজেই তো মানুষ এক্ষুনি আসছি বলে বেরিয়ে যায়, বাবা অন্তত নীচের বাথরুমেও তো গিয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু শেষবারের মতো কড়াটা ছ্যাঁক করে উঠল, গরম গরম ফেনা গড়িয়ে দিয়ে ভাতের ঝরঝরে হাঁড়িটা সুস্বাদু চালের গন্ধ ছাড়তে থাকল, ওদিকে খবরের কাগজটাও পড়া হয়ে গেল আদ্যোপান্ত, জ্যাঠাবাবু তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে চশমার কাচ সাফ করতে শুরু করলেন, ঘাড় ফিরিয়ে তুমি আমাকে বললে, “মানুষটা কোথায় গেল, দ্যাখ তো,” আর তখন জ্যাঠাবাবু, হঠাৎ যেন সচকিত, বললেন, “তাই তো, প্রণব গেল কোথায়?”
আমি জানতাম কোথায়।
.
গঙ্গার জলে ব্যস্ততাহীন একটার পর একটা ফুল ভেসে যাচ্ছিল, বাবা ঝুঁকে পড়ে তার দু’একটা তুলে শুঁকছেন, আমার পায়ের শব্দেই আমাকে চিনে বললেন, “পশুপতি রোজ রোজ আসে কেন!”
আমি তখনও ওঁর মুখ দেখতে পাইনি। যখন এদিকে ফিরলেন, দেখলাম, সেই মুখটা ভয়ার্ত, হাতের ভিজে ফুলটা কাঁপছে! চাপা অথচ দ্রুত গলায় বাবা নিজেই বললেন, “আমি জানি কেন।” মাথা নিচু করে জুড়ে দিলেন, “ওরা আমাকে আন্দামানে নিয়ে যেতে চায়, নিয়ে যাবে বলেই পশুপতি এসেছে।”
বললাম, “আন্দামানে নয় তো। ওঁর কয়েকজন বন্ধু আন্দামান ফেরত, এইমাত্র।“
বাবা তবু বিহ্বলভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “আমি জানি।”
জোর দিয়ে বললাম, “ভুল বুঝেছেন। ওঁরা নতুন করে একটা কিছু আরম্ভ করবেন ভাবছেন। সঙ্গী হিসাবে আপনাকে পেতে চান, আপনাকেও আন্দোলনে নামাতে চান।”
“না না, না” নুয়ে পড়ে জল ছুঁয়ে বাবা হাত তুলে নিলেন সভয়ে, ধরা-ধরা গলায় বললেন, “আমার শীত করবে যে, পারব না। আমি নামব না।”
আস্তে আস্তে ধরে উঠিয়ে ওঁকে ফিরিয়ে আনলাম বাড়ি। রাস্তায় বিড়বিড় করে বাবা বলেছিলেন, “অনেক টাকা কিনা এখন ওদের, দুহাতে তাই ছড়াচ্ছে। এ সব হল পুরনো আমলের স্বদেশি ডাকাতির টাকা।”
পশুপতি উঠে দাঁড়ালেন আমাদের দেখে।—”ভালোই হল, দেখা হয়ে গেল। আমি বেশ কিছু দিন আর আসতে পারব না প্রণব।”—রহস্যময় হাসি হেসে বললেন, “যাচ্ছি আসামের জঙ্গলে।”
বলতে বলতে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি, ফিরে তাকিয়ে বললেন, “সব ব্যবস্থা ঠিক ঠাক করে ফিরব আবার—তা অন্তত চার পাঁচ মাস তো বটেই। তখন আশা করি তুমি সুস্থ হয়ে উঠেছ দেখতে পাব প্রণব। তখন তৈরি থেকো।”
বাবার ঠোঁট কাঁপছিল, কী বললেন, বোঝা গেল না। মোটা মোটা আঙুলে খামচে ধরেছিল আমার জামাটাও। আশ্রয় চাইছিলেন? আঁকড়ে থাকতে চাইছিলেন?
কিন্তু ওই খামটা, বিছানার উপর পড়ে ছিল যেটা, নোটভর্তি খামটা আবার কি ভুলে ফেলে যাচ্ছিলেন জ্যাঠাবাবু, ওটার কথা ওঁর মনে ছিল না? তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে খামটা দিতে গেলাম ওঁকে, উনি স্বর্গীয় হাসিতে পরিব্যাপ্ত হয়ে গিয়ে বললেন, “থাক।”
ওই “থাক” বলাটাই কাল হল। আমাদের পক্ষে ভীষণ একটা ঘটনা। সেই ভিখিরিটা ঘরের মধ্যে উবু হয়ে বসে “থাক” কথাটা কান পেতে শুনল। আপ্যায়িত হাসিতে ভরে গেল তার মুখ। তার মুখ থেকে লালা ঝরছিল।
এতক্ষণ পরে, মা, তুমি এগিয়ে এসেছ। একটু তিরস্কারের ভঙ্গিতে আমার উপর স্থির দৃষ্টি রেখে বলেছ, “কেন খামটা ফিরিয়ে দিতে গিয়েছিলি?”
“ভাবলাম, আবার বুঝি ভুল করে—”
“ভুল করে নয়। ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করেই ওটা রেখে যাচ্ছিলেন উনি। আমি জানি।”
“জানো?” আমার বিস্ময়ের অবধি ছিল না—”জানলে কী করে?”
“আমাকে বলেছিলেন যে, বউমা, কিছু যদি মনে না করো তো এটা রাখো। এত চালাক চতুর ছেলে তোমার, টাকার অভাবে ওর পড়ার কোনও ক্ষতি হয়, এ আমি চাই না।”
“পৃথিবীতে, আশ্চর্য, এখনও এ-রকম মানুষ আছে”, অভিভূত উচ্ছ্বসিত, তুমি বলেই চলেছ, আর যেহেতু বাবা আগাগোড়া বাক্যহারা, তাই রোখ চেপে গেছে তোমার মাথায়, প্রতিটি শব্দে জোর দিয়ে-দিয়ে বলেছ তার পরে—”তোমার থিয়েটারের লোকেদের চেয়ে ঢের ভালো, যা-ই বলো বাপু। ওরা যেই দেখল তুমি পড়ে গেছ, অমনই ছাড়িয়ে দিল! ছাড়িয়েই তো দিয়েছে, তাই না?”
যেহেতু ততক্ষণে তুমি বুঝে নিয়েছ বাবার নিষ্পলক চোখে কিছুই ফুটবে না, সুতরাং সায় পাবার আশায় তাকিয়েছ আমার দিকে, আর আমি বাধ্য অনুগত, আমি ছাড়া তোমার কেই বা আছে, তৎক্ষণাৎ দেওয়ালের টিকটিকিটার সুরে সুর মিলিয়ে বলেছি, ঠিক ঠিক।
এই পশুপতিরা, আমারও মন তখন বলছিল, যেন গল্পে পড়া গোপাল দাদার মতো; যেন আকালের মাসে এক পশলা বর্ষার মতো; হঠাৎ এলে ভিজিয়ে দিয়ে যান, বাঁচান। মারেনও কি? মায়ের দিকে তাকাইনি তখন কায়মনোবাক্যে এতই বাঁচতে চাইছিলাম। নইলে খামটাকে মুঠোর মধ্যে ভরে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে যখন নামছি, তখন মাথাটা একটু ঘুরত নিশ্চয়ই? মনে হত, ওটা যেন একটা ঘোরানো সিঁড়ি, গড়িয়ে পড়ছি, তুমি আমি দু’জনেই, এক দিকে প্রয়োজন, আমরা পড়ছি, সম্ভ্রমবোধ অন্য দিকে, পড়ছি তো পড়ছিই, কে কাকে আঁকড়ে ধরব, টলমল সময়ে কী করে টাল সামলাব যা দিয়ে আমরা ঢাকা থাকি সেই চামড়া টামড়া ছড়ে যাচ্ছে চোখের পরদাও যাচ্ছে ছিঁড়ে।
.
জগতের কাছে অনাবৃত, সে-কথা তো পরে, পরস্পরের কাছেও আমরা যে বেরিয়ে পড়েছিলাম, সেইটাই ভয়ঙ্কর, আজ ভাবতেও লজ্জা করে। এত মিথ্যে তখন বলেছি, অবিরল, অনর্গল, বাড়িওয়ালা থেকে শুরু করে মুদি; মুদি থেকে প্রতিটি পাওনাদারের কাছে, জমিয়ে রাখলে তা হত প্রকাণ্ড একটা স্তূপ, ছড়িয়ে দিলে সেই মিথ্যে যেত দুর্গন্ধ একটা ধাপা হয়ে। কোনওটা তুমি বলছ, কোনওটা আমি; একে আমি ঠেকাচ্ছি, ওকে তুমি, আমরা জানি কার পালা কোনটা, কার কথায় কোথায় কাজ হবে, আঃ আজকের অস্তিত্বটাকে টেনে-টেনে কোনওক্রমে কালকের ঘরে জমা দিতে, এত যে গ্লানি, কত যে কষ্ট, আর কালকের ঘরে জমা দিয়েই কি নিষ্কৃতি আছে, কালকের পরেও তো আছে পরশু, পরশুর পরে—পৃথিবীর কোথায় যেন আছে ছয় মাস রাত? এই সংসারেও নেমে এসেছিল সেইরকম একটানা এক অমানিশা, অন্ধকার দিয়ে তার শরীর মোড়া, অন্ধকারে তার অপার শরীর গড়া, আমরা তার ভিতর দিয়ে চলছি, মাথা হেঁট, কখনও-বা হামাগুড়ি, তবু শেষ কোথায়, আলোর ঝিলিক সীমা-টীমা কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
বরং বেঁচে গিয়েছিলেন বাবা, কায়ক্লেশ ছাড়া অন্য সর্বপ্রকার ক্লেশ থেকে বিধাতা তাঁকে ধীরে-ধীরে মুক্ত করে দিচ্ছিলেন, হয়তো আশা-বাসনা-মোহ এইসব থেকেও মোচন। এই কৃপা সকলে পায় না।
না, তাড়াতাড়ি লিখতে গিয়ে খানিকটা ভুল করছি হয়তো, বরং কলমটা একটু কামড়াই, এখানে একটু থামি। শরীর নির্জীব হয়ে আসছিল বাবার, সেটা ঠিক। কিন্তু মন? দু’টি চোখের রহস্যপথ দিয়ে নেমে অন্য মানুষের মনে তলদেশে কতদূর অবধি চলে যাওয়া যেতে পারে? মা, বাবার বোধগুলি তখন কী অবস্থায় ছিল আমি জানি না, সেখানে সতত কী ঘটত, বিস্ফোরণ? অথবা সে কি ছিল প্রশান্তির রাজ্য, তার থই আমি পাব কী করে। কখনও মনে হত বাবা অনুভূতি ইচ্ছা ইত্যাদি সমেত অস্তিত্বের কোনও নির্লিপ্ত স্তরে পৌঁছে গেছেন, কখনও বা টের পেতাম, ওঁর দেহে যত যন্ত্ৰণা, মনেও তার চেয়ে কম নয়। সজীব উৎসুক চোখ দু’টি কেবলই চারদিকে ঘুরত, ঘুরে ঘুরে সব দেখত, কিন্তু কী দেখত তারা, আমাদের কি দিত বুঝতে?
২১
সেই সব দিন। তখন তুমি বুঝতে দিতে আমাকে। আমি তোমাকে বুঝতে দিতাম। পাশাপাশি রাখা দু’টি বই, পাতা খোলা, হাওয়ায় দুটোরই পাতা উড়ছে। অথবা হঠাৎ ঝড়ের মুখে যদি পড়ে দুই পথচারী, পরনে যাদের হালকা কাপড়-চোপড়, তারা পরস্পরের কাছে শরীরের কতটুকু সেই দিশাহারা সময়ে রেখে ঢেকে চলে? কিংবা দু’জন ডুব দিতে নেমেছে একই ঘাটে, তখন নিজেদের কাছে তাদের বাকি থাকে কয় রতি লজ্জা? আর দুটো বিড়াল যখন চুপে-চুপে মুখ ঠেকাতে আসে একই পাতে, উপমার পর উপমা, এর মা, প্রত্যেকটা হাতের তালুতে অঙ্গারের মতো পুড়ছে; থাক আর উপমা দেব না।
অমানিশার কথা লিখেছি একটু আগে, শুধু ওইটুকু বলাও কিন্তু আংশিক, কেবল ওই বিবৃতিটুকুতে তখনকার বোধ বিধুত হয় না। অন্ধকার যেখানে সম্পূর্ণ সেখানে তো সে শালীন ও পবিত্র। কিন্তু সেই অন্ধকার আকাশেও একটা লুব্ধক নক্ষত্র জ্বলত। পশুপতি ওই একটুখানি লোভ দেখিয়ে দিয়ে গেলেন যে সেই ধক ধক লুব্ধক। রাত্রে শুকনো রুটি যখন আর রোচে না, কাটতে গিয়ে দাঁতের গোড়াসুদ্ধ যেন নড়ে যায়, তখন সিদ্ধ সরু চালের সুবাস উঠতে থাকত কোথা থেকে, ছড়িয়ে পড়ত, মৃদু-মিষ্টি কিন্তু মাতানো গন্ধ, কিন্তু সূক্ষ্ম, এত চমৎকার গন্ধ চালগুলো জড়ো করতে থাকে কবে থেকে, কিশোরী কুমারীর মতো জমিয়ে রাখে বুকের নিভৃতে, অতি পবিত্র, অথচ পরে সেই সুবাসই পাপ-বাসনার আকারে ছড়িয়ে দেয় আমাদের ভিতরে, তার পাশে, ফুলটুল, দূর কোন্ ছার ওইসব ফুল যখন চালের ঝিমঝিমে ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে স্নায়ুপথ ধরে শুধু নাকই তো নয়, সকল ইন্দ্রিয়তে? সেই ঘ্রাণের নাম স্মৃতি, স্বপ্নও তার নাম।
ব্যথিত চোখ তুলে আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। কথা নয়। চোখের তারায় একটা সংকেত-বদল হত। কথা নয় একটা আশা ঝলসে যেত, সেই আশার নাম কী? একটা স্বপ্ন ফুটত, সেই স্বপ্নের আকারে কী, দুজনেই–হয়তো দু’জনেই—যা দেখতাম। পশুপতি বা ওই রকম আর কেউ এসেছেন, বাড়িয়ে দিয়েছেন নোট, গোছাগোছা নোট, সেই নোট ভাসছে, সেই নোট পড়ে থাকছে থাক্-থাক্ হয়ে বিছানায়, তারই একটা দু’টো হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছি বাজারে, থলে-ভরতি মাছ যার চওড়া চওড়া চাকতির মতো দেখতে আঁশ, ফিনকি দেওয়া রক্তমাখা কানকো; সেইসব মাছ, আর/অথবা মাংস কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার, অসম্ভব এক মহোৎসব, আমরা মাংস খাচ্ছি আবার, বাটি ভরপুর, বাটি একটার পর একটা, থরে থরে সাজানো, জলতরঙ্গের বাটি যেন, ছুঁলেই রঙ আর গন্ধের টুংটাং বেজে ওঠে—এইসব স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম, তোমার পরনে মড়মড়ে মাড় দেওয়া নতুন শাড়ি, পাড় যার টকটকে, তোমার চোখে আর আতঙ্ক নেই, কপালটুকু তকতকে একটি আঙিনার মতো আয়ত, কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম, যেন ঘাম নয়, শিশির দিয়ে তৈরি একটা টায়রা, খুন্তি আর চুড়ি নড়ছে, বাজছে, ওঠাপড়ার তালে তালে, সরু মোটা দুই তারে সুর মেলানো এক বাজনা। শুনতাম। অদৃশ্য কোনও মৌচাক ঘিরে মৌমাছির মৃদু গুঞ্জনের মতো অস্পষ্ট রান্নার সৌরভ। খেতাম।
মা, এই পর্যন্ত রোমান্টিক, এই পর্যন্ত কাব্য। হোক না রান্না নিয়ে, তবু কাব্য, উপোসীর প্রাণ হু-হু করানো গান। কতদিন ভরপেট খেতে পাইনি বলো তো, স্বপ্ন দেখা চোখ দিয়ে সে-জন্যে না-হয় জল ঝরত, কিন্তু সেই স্বপ্ন লালা হয়ে থালায় ঝরে পড়ত কেন; সেই লালা কালি হয়ে গিয়ে কেন পাতে লিখতে থাকত, অনবরত, দীনহীন একটি আকুতি, একটি প্রার্থনা; আর কেউ, আবার কেউ আসে না? কোনও অতিথি, আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, যারা বর্ষার স্নেহের মতো কিংবা দেবদূতের মতো সহসা আবির্ভূত, অকৃপণ হাতে ছড়িয়ে দেন কৃপা আর করুণা?
বোবা ভাষায় আমাদের মধ্যে এইসব বলাবলি হত।
(কিন্তু এ কী লিখছি আমি, কাকে লুকোচ্ছি? সব বলব বলে আজ মুখোমুখি বসেও এ-লজ্জা কাকে, এ লজ্জা কিসের? ব্যাপারটা আসলে একটা ন্যাংটো হ্যাংলামি, তাই কি তাকে কচি-কচি কলার পাতায় তুলে সাজিয়ে রাখছি? গুণ্ডামি ঝেড়ে ফেলে তা-হলে সাফ সাফ বলে ফেলা যাক : নিরুপায় দেউলিয়া দশায় আমরা পশুপতির পুনরাগমনের জন্যে লালায়িত হয়ে উঠেছিলাম। দু’পয়সা ছড়াতে পারে এমন কাউকে বাড়িতে এনে রান্না যে মোটের উপরে বেশ লাভজনক ব্যবসা, প্রায় একটা কুটির শিল্পই—সেটা বুঝেছিলেন। বিশেষ কোনও পশুপতি অবশ্য নয়, নির্বিশেষ : কোনও আত্মীয়, কোনও হিতৈষী, কোনও দাতা, কোনও পরিত্রাতা—যে কোনও।)
কিন্তু তারা কেউ এল না! ঈশ্বরের এই এক রহস্য, নির্ধারিত এক বিধান, এক খেলা তিনি দু’বার দেখান না। কেউ আর এল না, বরং গেলাম আমরা, আমাদের যেতে হল। তার আগে তোমার হাতবাকসের তুলে-রাখা, সিঁদুর-মাখা টাকা—সেই সব ভারী ভারী খাঁটি রুপোর টাকা—সব গেল। শুধু অন্য লোকের হাতে তুলে দেবার আগে সেগুলো ধুয়ে ফেলা হত জলে, সিঁদুরের দাগ মুছে মুছে টাকাগুলোকে বিধবা করে দেওয়া হত।
.
তুমি সরল, তুমি ভীষণ বোকা, মা, ভাত বেড়ে দেবার সময় অত ঝুঁকে পড়তে কেন বলো তো, নইলে হয়তো আরও অনেক দিন পরে আমি টের পেতাম যে, তোমার দুটি হাতই খালি।
চাপা গলায় বলে উঠেছিলাম, “মা, তোমার চুড়ি?”
একটি সেকেন্ড মাত্র সময় নিয়ে বলেছ, “খুলে রেখেছি! কী হবে চুড়ি পরে। আমি–আমি তো বুড়ি!” একটু ফ্যাকাশে হেসেছ।
আমি সরল, ভীষণ বোকা আমি, সঙ্গে সঙ্গে ভাত মেখে মেখে গ্রাস মুখে তুলতে শুরু করেছি। কথাটায় কাজ হল দেখে তোমার মুখের ফ্যাকাশে হাসিটায় একটু রঙও ধরল। আমাকে গালে আলতো একটা আঙুলের খোঁচা দিয়ে বললে “সব দিকে নজর, দুষ্টু ছেলে। ওসব চুড়ির প্যাটার্ন সেকেলে, আজকাল কেউ পরে নাকি। পাশের বাড়ির বউকে দিয়েছি, ও হালফ্যাশানের সব জানে, স্যাকরার সঙ্গেও চেনাশোনা আছে, ভেঙে নতুন করে গড়াব তৈরি হয়ে তোলা থাকবে। তোর বউ আসবে যখন, টুকটুকে বউ, আমিই পছন্দ করে আনব তো, তখন তাকে পরিয়ে দেব”–যতিচিহ্নগুলো চোখের সামনে লেখা হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছিলাম।
(“আমিই পছন্দ করে আনব”—ছেলের বউ তারাই বাছাই করে আনবে, তখন পর্যন্ত মায়েরা এইসব কথা ভাবত।)
মিথ্যে? হোক না। অনেক মিথ্যে, ফুঁ দিয়ে তপ্ত দুধ জুড়িয়ে দেওয়ার মতো, অনেক মিথ্যে মিষ্টি এবং সত্যের চেয়েও কোনও-কোনও সময়ে মনে হয়, দরকারি। কিন্তু মিথ্যের মুশকিল, মিইয়ে যায় তাড়াতাড়ি, ফুরিয়ে যায় অনেক সুন্দর জিনিসের মতো, যথা ফুল রামধনু ইত্যাদি; মিথ্যের আয়ু বেশি না।
বেশি হলে তুমি অসুখে পড়বে কেন, আর পাশের বাড়ির বউটি আমাকে বলবে কেন যে, “তোমার মা চুড়ি ক’গাছি তো ছাড়িয়ে নিল না। যার কাছে বাঁধা রেখেছি, সে কিন্তু তাড়া দিচ্ছে, বলছে বেচে দেবে এর পরে। মাকে বোলো।”
তোমাকে বললাম, তুমি বিবর্ণমুখ, শুনলে। কিছু বললে না।
চুড়িগুলো গেল। এর পরের পালা সেই গিনিটার, যেটা দিয়ে তুমি বলেছিলে, তোমার কোন্ বড়লোক জ্যাঠাশ্বশুর মুখ দেখেছিলেন দাদার—সেই গিনিটাও গেল। গিনিটার ব্যাপারে মধুর কোনও মিথ্যের আড়াল ছিল না। যেহেতু তখনও দুর্বল তুমি, সবে অসুখ থেকে উঠেছ, তাই মুখ তেতো হয়ে আছে, বলেছ “ওই বউটা ঠকাচ্ছে আমাকে—বাঁধা রাখা চুড়ি বেচল অথচ বাড়তি একটা টাকা দিল না। সদরে তো কত দোকান আছে, তুই—তুই নিজে একবার যাবি? যাচাই করে বেচবি। পারবি, পারবি না?”
কী যে বলো, পারব না? তোরঙটার পাশে হাঁটু মুড়ে বসেছ, আমাকে সাহস দিচ্ছ, যেন তুমি এক বীর মাতা, সেকালের বীর মাতারা বুঝি এইভাবেই রণসাজে সাজিয়ে দিত পুত্রকে, আমি তৈরি তোমার পিঠের উপর উপুড় হয়ে গিনিটা কত নীচে পড়ে আছে দেখছি।
তোরঙের তলায় কত কাপড়, পুরনো ছেঁড়া, তবু ভাঁজভাজ, কাচানো; রঙফিকে একটা শাল, তার নীচে একটা কোট, ধূসর সেই কোটটা যার পরতে পরতে পোকাদের অস্থি থাকলে এতদিনে জীবাশ্মে পরিণত হত; তার নীচে তাড়াতাড়া কাগজ, ভীত, পশ্চাদ্ধাবিত পশুদের যেমন গুহা, প্রত্যাখ্যাত, পৃথিবীর কাছে অপ্রয়োজনীয়, অকারণে-লেখা রাশিরাশি পালারও তেমনই ওই তোরঙটা শেষ আশ্রয়। তারও নীচে একটা কড়ির কৌটোয় রাখা ঝকঝকে একটা গিনি, নিছক জমানো ধাতু পিণ্ড না হলে, এতটুকু প্রাণ থাকলে সেদিন হঠাৎ চোখে আলো লেগে সেটা নিশ্চয়ই চমকে উঠত। এইটে দিয়েই পৌত্রের মুখ দেখেন একজন, সে কতকাল আগে? সে মানুষ মরে গেছে, যে দিল আর যে পেল দু’জনেই, সে-সময়ে মরে আছে। সোনা নিজেই মরা, কিংবা একেবারে নির্মম কিনা, তাই ডালা খোলা হতেই ওর নির্লজ্জ উজ্জ্বল আলো উথলে উঠছে।
কাঁপছিলে, যখন চাকতিটা আমার হাতে তুলে দিচ্ছিলে।
লোভীর মতো, বোকার মতো গোল চাকতিটা হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলাম আমি, আমারও চোখ চকচকে। –কত দাম, কত দাম এর?” জিজ্ঞাসা করলাম, রুদ্ধ, লুব্ধ, উত্তেজিত স্বরে।
“কত দাম?” তোমার মুখ সাদা হয়ে গেছে, তখন কি জানি বিশ্বজগতের কূটতম প্রশ্নটি করেছি তোমাকে? তাই তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে, এত আস্তে এত ফেঁসে যাওয়া স্বরে বলছ কেন, মা, ও মা, একটু জোরে বলনা, নইলে কী বলছ কিছুই যে কানে আসছে না, তুমি কি মুখ ফিরিয়ে বললে যে “জানি না” কিংবা “আমার কাছে কিচ্ছুর কোনও দাম নেই, কিচ্ছু না?” কী মূর্খ আমি, তখনও ওটাকে হাতে ঘোরাচ্ছি, সোনার চাকতির লেখাটা পড়ে বিজ্ঞের মতো বলছি, “সরিন লেখা আছে। রাজা-রানির মুখ আঁকা। এক গিনি—দাম অন্তত টাকা পনেরো-কুড়ি তো হবেই, তাই না?’
“জানি না। কিচ্ছু না–তুই যা।”—ছি, এত জোরে চেঁচিয়ে উঠতে নেই মা, গলার নলি ছিঁড়ে যেতে পারে।
রাজা-রানির মুখ? এই দ্যাখো মা, এতদিন পর কথাটা লিখছি আর বোকা সেই ছেলেটাকে কৃপা করছি। গিনিটাতে আসলে কার মরা মুখ আঁকা, ছেলেটা জানত না। আর দাম? সে যে পনেরো-কুড়ি টাকা বলেছিল, রতির ওজন ধরে, না বাট্টার হিসাব করে? কয় ফোঁটা রক্তের দাম কত? তার ঠিক উত্তরটি কি কোনও ব্লাড ব্যাংকের বেচাকেনার খাতায় লেখা থাকে!
.
একটু ছুটি দাও। জিনিসটা তুলে দিতে যার হাত কাঁপছিল, ঘরের দরজা অবধি এসে যে দাঁড়িয়ে রইল, তাকে ওইখানেই রেখে দিয়ে যে নিল, গিনিটা নিয়ে গলির পর গলি, তারপর সদর, সদরের পর চৌরাস্তার মোড়, সেখানে গিয়ে যে হাঁপাতে থাকল, তার পিছু পিছু যাই, তাকে একটু দেখি। দূরে, তার পিছনে পড়ে আছে স্থির একটি পাথর, কঠিন হলে কী হয় পাথরেরও বড় কষ্ট, এই পাথরের মধ্যেও লুকোনো ফোঁটা ফোঁটা রক্ত—আর ছেলেটার মুঠোর মধ্যে লুকোনো একটা লজ্জা, জমাট জ্বল-জ্বলে ধাতু, সাহসই কি কঠিন হয় শুধু!—ভীরুতা, লজ্জা, এইসবও শক্ত বরফের আকার ধারণ করে কঠিন হয়ে যায়।
গ্যাসের আলোর নীচে আর পোস্টটার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছ, তুমি কে? আমি কি তোমাকে চিনি? মুখ একবার তোলো, তোলোই না, আরে, ওই ডৌলটা আমার চেনা বৈকি। অন্তত এক সময় প্রত্যেকটা ভাঁজ, প্রত্যেকটা কাটা দাগ, চুলের থাক, চোখের পাতার ওঠাপড়া সমেত আমার কাছে চেনা ছিল। একটা ছিল খানিকটা পারা-চটা পুরনো এক হাত-আয়না— পুরনো কিন্তু তার নজর খুব সেয়ানা—তার মারফত রোজ আলাপ হত, সে তন্ন তন্ন করে চিনিয়ে দিত। ঠোঁট, চিবুক, গলা, তোমার সবই আলাদা আলাদা এবং স্পষ্ট—কী ব্যাপার বলো তো, যেমন ছিল, মানে তখন যেমন দেখতাম, অবিকল তাই যে আছে। কিন্তু কী জানো, আমার আর তেমন নেই আর, ঘাড়-গর্দান, চোয়াল-চিবুক সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। অর্থাৎ যাচ্ছে। কী করব, সেই হাত-আয়নাটা খুঁজে পাই না যে আর, অনেক দিন থেকেই পাই না, নতুন যেসব আয়না ফিটফাট, দেওয়ালে দেওয়ালে কিংবা আলমারিতে, ড্রেসিং টেবিলে সেট করা, তারা ঝকঝকে খুব, কিন্তু তাদের একটা দোষ, মুখের সব ভাঁজ, পেশি-টেশি মিলিয়ে মিশিয়ে দেয়, তা-ছাড়া চুল নিয়ে তাদের ইয়ার্কি সবচেয়ে বিশ্রী; যতটা পারে সাফ করে, যেগুলো রাখে তার উপরে রূপালি রঙ দেয়। তুমি কিন্তু তেমনই আছ, কী করে আছ? জানি, জানি, ম্যাজিকটা জানি; কোনও কায়দায় সেই হাত-আয়নাটা নিজের কাছে বুঝি রেখে দিয়েছ তুমি? স্বার্থপর! দাও না, ধার দাও না! না দাও তো অন্তত ওটাকে মাঝখানে বসিয়ে দাও আমাদের, সেই আগেকার মতো, নইলে আমি যে আর এগোতে পারছি না, তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াব কী করে? সঙ্কোচ বুঝি তোমার একার; আমারও নেই? প্রথমে, সঙ্কোচ তো অপরিচয়ের। মাঝখানে কতগুলো বছর কেটে গেছে বলো তো, ক—ত! বলা যায়, যুগ যুগ পার। ইতিমধ্যে কতবার হলদে পাতা নামঞ্জুর করে ডালগুলো অজস্র সবুজে কচি হয়ে কখনও কাঁপল, কখনও পাগল হল, তদানীন্তন বৃক্ষসমুদয়ের বেশির ভাগই সম্ভবত অদ্যাপি বর্তমান, কিন্তু তৎকালীন মনুষ্যেরা সকলে নয়, মানুষদের মুশকিল, তাদের পাতা একবার ঝরে গেল তো গেলই, গেল তো আর গজাল না, এক জীবনে দু’বার নয়, কোনও কোনও গাছ যেমন একবারই মাত্র ফল ধরে, মানুষও কতকটা তেমনই, তার যত পত্রপুষ্প, এক জন্মে শুধু একবারেরই তরে। উপরন্তু মনুষ্য বৃক্ষের মতো কেন, অশ্বের মতোও দীর্ঘকাল দণ্ডায়মান থাকতে পারে না।
তাই তো তাড়া দিচ্ছি তোমাকে, সময় ফুরিয়ে আসছে। সময় ফুরিয়ে আসছে আমার, আমার তো বটেই, তোমারও। মাকে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছ ঘরের চৌকাটে, মনে নেই? ভেবে দ্যাখো, তিনি হয়তো সেখানেই এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। তুমি যাবে, তবে উনুন জ্বলবে। দুপুরে তোমাকে আর বাবাকে খুদেডালে জ্বাল দিয়ে
(খিচুড়ি নয়, ‘জাউ; “খেয়ে দ্যাখ, জাউ স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী ) খাইয়ে তাঁর নিজের একরকম উপোস গেছে, তাই বলছি তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি। এত বছর পরে তোমাকে দেখছি তো, তাই একটু ঝাপসা ঠেকছে। ওই গ্যাস-পোস্টটা কোথা থেকে এল, ওটা আজকাল নেই তো। আজকাল, জ্বলুক চাই নাই জ্বলুক, সব ইলেকট্রিক আলো।
এত বছর পরে তোমাকে দেখছি তো, তাই দেখামাত্র ভিতরটা কেমন টনটন করে উঠল, হঠাৎ বুকের শিরে টান পড়লে যেমন লাগে। একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল সব, হঠাৎ আঁধি উঠলে যা হয়, অথবা চোখে কাঁকর-টাকর পড়লে যেমন জ্বালা করে। কুয়াশা? না। কান্নাও না। তবু। তবু কী? ওই যা বলেছি—একটু টনটন। তাই তো সামলে নিতে একটু সময় নিলাম, ইনিয়ে বিনিয়ে অবান্তর বকে, আসলে তৈরি হলাম। চশমার কাচ মুছে নিয়েছি, এবার আমি ঠিক ঠিক দেখতে পাব। কলমটা আবার ধরেছি শক্ত করে, এবার আমি লিখতে পারব।
গ্যাসের আলোটার নীচেই ছায়া, সেই ছায়ায় রক্ষিত হয়ে আছ এখন, অথবা তারই অংশ হয়ে। ছায়ার ভাগ হয়ে যাবার ওই একটা সুবিধে, পুকুরের জলে ডুব দিয়ে থাকার মতন, কেউ দেখতে পায় না।
আমি কিন্তু পাচ্ছি। তুমি কাঁপছ—কাঁপছ কেন? এটা তো চৈত্র তবু তোমার গায়ে চাদর জড়ানো কেন? হাতের মুঠোয় গিনিটা লুকোনো, সেই হাত আবার পকেটের মধ্যে পোরা, তবু কি স্বস্তি নেই, তবু কি আরো লুকোতে চাইছ! তাই এই চৈত্রেও চাদর জড়িয়েছ গায়ে—লোক হাসবে না? এইবার বেরিয়ে এসো ছায়া থেকে, মুখ থেকে লাজুক, ভীতু চোর-চোর ভাবটা মুছে ফেল। অনভিজ্ঞ করুণ চোখে তাকাচ্ছ কেন, কী বলছ, মোছা যায় না? এ তো ঘাম নয় যে রুমাল বোলালেই মুছে যাবে? জানি, জানি, চোর-চোর ভাব-টাবের ওই মুশকিল, যতোই ঘষো না কেন, চামড়া কেটে রক্ত দেখা দেবে তবু মুছে-ফেলা ভাবটা ফের ফুটে উঠবে। জানি, জামা-কাপড়ের পরতে পরতে জড়িয়ে নিজেদের আমরা যতটা পারি ঢেকে-ঢুকে রাখি, কিন্তু মাঝে মাঝে সারা দুনিয়ার চোখ রঞ্জনরশ্মি হয়ে যায় যে; বাহিরটাকে ভেদ করে ভেতরটাকে বাহির করে আনে।
তবু সাবধান। ওই যে সাইনবোর্ডটার উপরে ফণা ধরে, তিন-তিনটে আলো ফোঁস-ফোঁস করছে, তাতে বাহারের হরফে লেখা আছে—পড়তে পারছ কি?—আর্ট জুয়েলার্স। পিছনে একটা কোটর, সেখানে সুতো-বাঁধা চশমা এঁটে যে বসে আছে, তারও চোখ দুটো নজর করে দ্যাখো, সাপের মতোই ক্রূর এবং শীতল। তুমি সটান এগিয়ে যাও, কেঁপো না কিন্তু, কেঁপো না। তা-হলেই পেয়ে বসবে ও, ওই ধূর্ত লোকটা, যার কুতকুতে চোখ।
“কী কেনা হবে?” চশমা খুলে তোমাকে খুঁটিয়ে দেখে কী বলবে, তুমি না আপনি ঠিক করতে না পেরে সে ভাববাচ্যে সম্বোধন করল, “কী কেনা হবে?” তার স্থির চোখ তোমাকে দেখছিল।
দেখুক, চাদরে ঢাকা, তাই কনুইয়ের কাঁপুনি ও টের পাবে না, কথা বলতে গিয়ে স্বরনালিটা থরথর করে উঠেছে এই যা!—”কিনব না, বেচব”, এ যেনো কারও গলা, অন্য কেউ বলল, অন্য কোনও মানুষ চাদরের তলা থেকে হাত বের করে মুঠোটা মেলে ধরল, গিনিটা ভিজে, লজ্জায় চাপে এতক্ষণে গলে যে যায়নি, এই রক্ষে—ভীষণভাবে স্নায়ু-কবলিত সেই মানুষটি কোনও রকমে বলে ফেলল, “এইটে।”
“দেখি”, লোকটা বলল সম্মোহক স্বরে। চৈত্র-সন্ধ্যা, রাস্তার বিস্তর ধুলো ঢুকে পড়ছিল বলে লোকটা কাশছিলও। কাশি নয়, পরে বুঝেছিলে, ওটা ছুতো, পরের কথাটা মনে মনে তৈরি করা। জিনিসটা হাতে নিয়েছে লোকটা, একবার ধরছে চিৎ করে, একবার ঘষছে, মাথা কাটা যাচ্ছে তোমার, কান ঝাঁঝা, গিনিটা তো নয়, তুমিই চিৎ হচ্ছ, উপুড় হচ্ছ, কাৎ হচ্ছ এক-এক বার, যেন কুস্তিতে, কোনও পালোয়ান তোমাকে, তোমার সম্মানকে মাটিতে ফেলে চাপড়া ধুলোবালি বুকে-পিঠে-মুখে মাখাচ্ছে, আঃ! রাস্তার ধুলোয় তোমারও দাঁত কিচকিচ, জিভ-ঠোঁট ভরে গেল।
“চোরাই মাল?” হিলহিলে সাপটা হাসল, সাপও হাসতে জানে, চাইল টেরচা চোখে।
সাবধান, অপমানে তোমার হাতের মুঠো পাকিয়ে উঠছে উঠুক, কিন্তু ওই পর্যন্ত। হাত তুলতে যেও না। রোগা হলে কী হয়, এই সাপেরা বড় সাংঘাতিক, দরকার হলে ধারালো কিছু বের করে তোমাকে একেবারে জব্দ করতে জানে। অজ্ঞ, অনভিজ্ঞ তুমি বাড়াবাড়ি করতে যেও না।
“চোরাই কেন হবে। আমার, আমাদের।” তোতলা গলায় উত্তর? হোক, সে-ই ভালো।
“মার বাক্স ভাঙা হয়েছে?” সাহস চরমে উঠেছে লোকটার, তবু সামলে থাকো। কান একটু লাল হয়ে যাচ্ছে, তাতে দোষ নেই, চোখ দুটিকে নিষ্প্রভ, শান্ত রাখো। শুধু বলো, “না।”
এর চেয়ে বেশি বলতে যাওয়া সমীচীন হবে না। বাক্স ভেঙেছ বললে কসুর কবুল করা হবে, আবার ভাঙোনি যে, সেটাও বিস্তারিত বলতে গেলে তো শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়াবে যে, মা-ই দিয়েছে? মা গিনি বেচতে পাঠায় কেন? পেটের দায়ে, খিদের জ্বালায়? বলার পর–বলার পরও কি মাথাটা সোজা আর উঁচু করে ধরে রাখা যাবে? তোমরা যে মধ্যবিত্ত, তোমরা যে যাকে বলে ভদ্র, সেই অভিমানটাকে একেবারে শুকনো নারকেলের মালা করে দেবে?
কান ঝাঁঝাঁ তবু শুনতে পাচ্ছি, সে বলছে, “গিনি দিয়ে তো লোকে মুখ দ্যাখে। এটা দিয়ে মুখ দেখা হয়েছিল কার—তোমার?”
গলানো সীসে কানে ঢুকছে। আর ওই গিনিটা, সোনা হলেও ধাতু তো! জেল্লা দিতে পারে শুধু, ধাতু কি না, তাই স্নায়ু নেই, সাড়া নেই, সাড়া দিতেও পারে না।
কার মুখ দেখা হয়েছিল, কার, কার, সেই মুখ কি আঁকা আছে ওখানে, লোকটা কি অন্তর্যামী, অথবা ওর সব-জানা চেনা আছে, ও কি সেই-মুখটা দেখতে পারে; দেখে ফেলেছে এরই মধ্যে?
একী, ঘামছ কেন তুমি। মুছে ফ্যালো। সাহসে তাকাও। নইলে ক্রমশ ওর বশে চলে যাবে, ওই সেয়ানা স্যাকরাটার। ও যদি, বলা তো যায় না, গিনিটা, পকেটে পুরে ফ্যালে, যদি, বলা তো যায় না, যদি, হাসতে হাসতে টুপ করে মুখে ফেলে বলে, “গিলে ফেলেছি, এই দ্যাখো, কই, আর নেই তো!” ম্যাজিকওয়ালাদের মতো বলে, এই বোকা, রোগা-পটকা এই ছেলেটা! কী করবে তখন তুমি, ভ্যাঁ করে কাঁদবে, না চেঁচিয়ে উঠবে? কে বিশ্বাস করবে তোমাকে। গিনিটা যে ছিল, তোমার ছিল, তার প্রমাণ কী। যারা ছুটে আসবে, যদি আসেও, ধরাই যাক আসবে, তবু তারা যদি হেসে ওঠে তোমার চোখে চোখ রেখে, হাত ঘুরিয়ে বলতে থাকে, প্রমাণ কী, প্রমাণ কী, তুমি কী বলবে তখন, হাঁপাতে হাঁপাতে বড় জোর এই কথাটি—”ছিল
ছিল? হাঃ হাঃ, খুব হাসির ওই কথাটা : “ছিল”। যতক্ষণ “আছে” ততক্ষণই খাঁটি, সত্যি-সত্যিই থাকে। কিন্তু যেই “ছিল” হয়ে গেল, অমনই কোথায় আর কী, সব মায়া, সব মুছে-যাওয়া মিছে। এই পৃথিবীতে কত কী-ই তো ছিল। কিন্তু কোথায় ছিল, কবে কার হয়ে, কার কাছে, তার কতটুকু চিহ্ন-ছাপ-স্মৃতি- রেখা-রেণু, এইসব পড়ে থাকে? তুমি ঘামছ। মুছে ফ্যালো। আর কেউ নেই, শুধু, তুমি আর ওই দোকানি, তাই ভয়?
লোকটি অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে দেখছিল। একটু আগে যাচাই করেছে গিনিটা যেভাবে, সেই ভাবেই এখন যাচাই করছে তোমাকে। কিংবা চাউনিটা ওর বঁড়শি, তোমাকে বিঁধে রেখেছে, ছটফট করছ তুমি মাছের মতো, কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়ে চলে আসতে পারছ না, তা-ছাড়া গিনিটা যখন ওর হাতে, তুমি আসবেই বা কী করে। যারা মাছ ধরে তারা বুঝি এইভাবেই টোপেগাঁথা মাছকে খেলায়, সুতো টানে, সুতো ছাড়ে?
“কুড়ি টাকা দিতে পারি।” লোকটা বলল অনেকক্ষণ ধরে তোমাকে পরখ করার পরে।
“কুড়ি—মোটে কুড়ি?” তবে আমি যে শুনছিলাম তিরিশ, মা বলেছিল…”
“খবরের কাগজ পড়ো, খবরের কাগজ? আজকের সোনার বাজারের দর কী লিখেছে জানো। এই দ্যাখো।” লোকটা মস্ত বড় একটা পাতা মেলে ধরল। অনেকগুলো অক্ষর, অনেকগুলো সংখ্যা শুধু, তার কিছুমাত্র অর্থ তোমার কাছে স্পষ্ট হল না। মূক-বধির ভিক্ষুকেরা যেভাবে হাত পাতে, তুমি সেইভাবে হাত বাড়িয়ে ধরলে।
দশ টাকার নোট একটা, তারপর ঝনঝন শব্দ হচ্ছিল, কারণ লোকটা গুনে গুনে টাকা দিল আরও দশটা, তখন রুপোর টাকাও বেশ চলত!
“দেখে নাও, অচল দিয়েছি কিনা। ফিরে এলে কিন্তু ফেরত হবে না”, তুমি নেমে আসছ, লোকটা পিছন থেকে কথাগুলো ছুঁড়ে মারছে তোমাকে। তুমিও বুক পকেট থেকে টাকাগুলো বের করে করে ছুঁড়ে মারবে নাকি ওর মুখে? পারলে না।
(সারা জীবনে যে কতবার ওই না-পারাটা কতভাবে ফিরে এসেছে! পারার ইচ্ছেটা কচ্ছপের মতো চিৎ হয়ে বোবা চিৎকার করেছে শুধু। কত চড় কতজনকে মারা হল না, কত থু থু ছিটোতে গিয়ে কেবল গিলতেই হল, আপসটাকে গাধার টুপি পরিয়েছ আর নিজেকে ঠকাতে সেই টুপিটার গায়ে বড় বড় হরফে লিখে রেখেছ “মহত্ত্ব” শব্দটা।)
এই তো বাইরে নেমে এসেছ তুমি, এখানে খোলা হাওয়া তবু শ্বাস নিতে কেন কষ্ট, আমি জানি কষ্ট কেন, তোমার তখনকার সব কথা আমার খাতায় টোকা আছে, পার্কের ভেতর গিয়ে দম নিচ্ছ, দম তো নয়, নিজের সঙ্গে নখে নখে আঁচড়ে একটা লড়াই চলছে, আমি জানি। তোমার লজ্জা এখন লোপ পেয়ে সবটাই লোভ হয়ে যাচ্ছে। উপরের দিকে শুকনো মুখে চাইছ তুমি, অনেক তারা, কলকাতায় কেবল এইসব পার্কের আকাশেই তারা থাকে, জল-জ্যান্ত চোখে চেয়ে তারা ভিতরটাকে দেখতে চায়, হয়তো দ্যাখেও। চোর! চোর! ওকী করছ তুমি, একটা রুপোর টাকা কেন তুলে নিচ্ছ, কী করবে ওটাকে, রাখবে কোথায়, আলাদা করে প্যান্টটার বেল্ট পরানোর ফোকরটার ফাঁকে।
.
মা, এই দ্যাখো মা, আমি ফিরে এসেছি। মা, আমার পকেটে টাকা বাজছে, অনেকগুলো টাকা, কিন্তু ওভাবে তাকিয়ে আছ কেন তুমি, তোমার চোখ জ্বলজ্বল করছে, তুমি কি ঝাঁপিয়ে পড়বে, বলবে “দে, দে, দে”—বলে কেড়ে নেবে?
“কত?”
“উনিশ।”
(উনিশ, আমি কি বললাম উনিশ? কিন্তু আমি বলতে চেয়েছিলাম কুড়ি? বিশ্বাস করো, মা, বিশ্বাস করো, কুড়িই চেয়েছিলাম বলতে, আমার ফসকে বেরিয়ে গেছে উনিশ।)
“ঊনিশ?”
(মা, ওভাবে চেয়ে আছ কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি, উনিশ হবে না কেন, হতেই পারে, নিশ্চয় পারে উনিশ আর কুড়ি তো একই, লোকে কথাতেও তো বলে উনিশ-বিশ।)
“জিজ্ঞেস করছ কেন?” আমার গলা কাঁপছে।
“উনিশ, মানে ভাঙা হিসেব কিনা, তাই। কুড়ি নয়, পঁচিশ নয়, উনিশ?”
“তুমি আজকের কাগজ দ্যাখোনি, সোনার বাজার দর পড়োনি, পড়লে—” গলা আরও কাঁপছে, আমার তোতলামি বাড়ছে, ভয় পেয়ে টাকাগুলো তোমার হাতে গুঁজে দিতে চাইছি আমি—”এই নাও, রাখো।”
নিতে গিয়েও হাতটা গুটিয়ে নিয়েছ তুমি, তোমারও চোখে ভয়, তোমারও কণ্ঠ আর্ত। “থাক, তোর কাছেই রাখ।”
ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছি তোমার দিকে। তাকাতে পারছি। কই, অবিশ্বাসের ছোপ তোমার মুখে লেগে নেই তো। আমি—আমি এবার বোধহয় বুঝতে পেরেছি।
“থাক। তোর কাছেই রাখ। ওর জিনিস ভাঙিয়ে এনেছিস…দরকার মতো চেয়ে নেব, তুই-ই খরচ করিস।” আমার কানে এখনও বাজছে।
কিন্তু মা, সেদিন আমার কান সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁঝাঁ করছে, আমি মাটিতে মিশে যাচ্ছি। ও-টাকা ছুঁতে পারবে না তুমি, তোমার হাত জ্বলবে, বুঝেছি। অথচ আমি এখন কী করি। সব টাকাটা আমার কাছে থাকবে, আগে যদি জানতাম, আলাদা করে সরানো একটা টাকা, সেই টাকাটা, সেই একটা টাকাই’ কী-এক আশ্চর্য অদ্ভুত উপায়ে বেজে উঠছে। তোমার হাতের পাতা বাঁচল, আমার কোমরের কাছটা ছ্যাঁকা লেগে পুড়ছে। আমাকে একী শাস্তি দিলে তুমি। মৃতের প্রতি মমতা, বেশ তো, যত খুশি তাকে মনে রাখো, তাই বলে এত নিষ্ঠুর হবে যে জীবিত তার প্রতি? এত পক্ষপাতী তুমি।
বেশ, শোধ নিতে জানি, আমিও জানি।
এই দ্যাখো না, ছুটছি। এখন ছুটছি আমি, দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছি মণিহারী দোকানটার সামনে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলছি, “তরল আলতা এক শিশি।” শিশিটা পেয়ে দাঁড়াইনি একটুও, এক লহমাও না, একটা টাকা দিয়েছি ফেলে, সেটা সত্যিই তখন বেজে উঠেছে, আমি ততক্ষণ পিছন ফিরে ফের বাড়ির দিকে, অবাক-দোকানি বলছে, “আরে, আরে, দাঁড়ান, এর দাম তো ছ’আনা মোটে”, কিন্তু শোনে কে। রেজগি? ও ভেবেছে কি? কোনও জের রাখব বুঝি আমি।
বাড়ি ফিরে, “মা, তোমার পা দু’টি দেখি।”
“পা? এখন? কেন রে?”
“দেখিই না! একটিবার। শুধু পাতা দু’টি।” বলতে বলতে শিশিটা তোমার পায়ের কাছে রেখেছি।
“কোথায় পেলি?”
“কিনে এনেছি।”
“কী দিয়ে, কেন, এই রাত্তিরে?”
“তুমি পরবে বলে। পরো না মা, এক্ষুণি।”
যথেষ্ট অবাক হওয়ার সুযোগও পাওনি—”এখন এখানে, এই রান্নাঘরে? পাগল ছেলে”, হাত বাড়িয়ে আমার চিবুক ছুঁয়ে বলেছ, পাগল ছেলে! দেখছিস না, এখন রাঁধছি? তা ছাড়া—ওসব পরা আমি তো আজকাল ছেড়েও দিয়েছি।”
“পরতেই হবে।”
আমার অবুঝ চোখের দিকে চেয়ে কী যেন পড়ে নিলে। তুলে নিলে শিশিটা। যেন বর দিচ্ছ এমনই গলায় বললে, “ঠিক আছে, পরব—কাল সকালে।”
সেদিন রাত্রের স্বপ্ন, আঃ সেই স্বপ্নটা! একটা রুপোর টাকা লুকিয়ে গলছে গলানো রুপোর রঙ কখনও লাল হতে পারে? অথচ হচ্ছিল, একেবারে গলগল, তরল, টক্টকে আলতার মতো। পাতা দুটি পেতে রেখেছ তুমি, শাড়ির কোণ একটু সরিয়ে, আমি উপুড় করে আলতা ঢালছি তোমার পায়ে, আলতাই তো! নাকি রক্ত, আমার অপরাধের ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে উঠে-আসা রক্ত, দুটি পা ধুইয়ে দিয়ে দিয়ে ক্ষমা চাইছে? উনিশ আর বিশ সত্যিই আলাদা থাকল না তো, এক হয়ে ওই দ্যাখো, এক রঙে মিশে যাচ্ছে।
আবার তুমি আমার। এ এক দারুণ মজা তো, নয় মা? একজন চলে গেছে, কিন্তু ফিরে আসছে মাঝে মাঝে; আর রয়ে গেল যে, সে-ও চলে যাচ্ছে মাঝে মাঝে তবু ফিরে আসছে। আসতেই হচ্ছে তাকে। পাপ ধুয়ে ফেলছে অনুতাপে, তার সমৰ্পণ শেষ প্রণামে।
যাওয়া-আসায় অতএব কোনও বিরোধ দেখছি না, যে গেছে আর যে আছে তাদের মধ্যে কোনও হিংসা নেই।
২২
মা, আমি চলে গিয়েছিলাম, আবার ফিরে আসতে চাইছি। মন্ত্রপাঠ ছাড়া মুক্তি নেই, স্থির জেনেছি, কিন্তু পাঠের আগে হাত ধুয়ে বসতে হবে তো! তাই ধুচ্ছি।
এই অনর্গল লেখাটা সেই প্রক্ষালন, সেই শুদ্ধি, এ-কথা বুঝি, আগেও একবার বলেছি। ধোওয়ার পালা এখনও শেষ হল না। কবে শুরু করেছিলাম, সেই শীতে, তখন নিজেকেই যারা প্রতি বছর এই সময় নিমন্ত্রণ করে আনে, গাছে গাছে ম্রিয়মাণ পাতাগুলি কাঁপছিল সেই সব বিদেশি পাখির সুরে, অথচ তাদের দেখা যাচ্ছিল না। কেন না কুয়াশা একটা টানটান পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছিল দূরের সব-কিছুকে অগোচর করে দিয়ে। দূরকে যখন দেখা যায় না, তখনই সে সবচেয়ে কাছে আসে। যে-পাখিকে চোখে দেখতে পাই না, তার সুরই মনে আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ফোটে।
সেই শীতে। তখন সকাল-সন্ধ্যায় আমি বিছানায় পড়ে অস্থিরের মতো আকাশ দেখতে চাইছি বারে বারে—সবে অসুখ থেকে উঠছি কিনা, তাই সব কিছু লাগছে নিষ্প্রভ, নিষ্পত্র রিক্ত। যখন টের পেলাম আর কোথাও কিছু নেই, আমার জন্যে কেউ অপেক্ষা করে নেই, তখন নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমি অপেক্ষা করছি কিসের, কার জন্যে। উপরের আকাশটা যেহেতু ঝাপসা, তাই তো তাকালাম ভিতর দিকে, কী আশ্চর্য, সেখানেও একটা আস্ত আকাশ যে! এতদিন দেখিনি? সেই আকাশে মস্ত করে আঁকা তুমি।
উঠে বসতে চাইলাম, অসুখটাকে অস্বীকার করে। অসুখ তো নয়, নোটিশ,মৃত্যুর নোটিশ, সেই শমনটা ফিরিয়ে দিয়ে বলছি, “যাব না, এখন যাব না আমি, আর কিছুদিন পরে। আর একটু সময় দাও, একটি গণ্ডুষ জল। সময় হল সেই এক গণ্ডুষ জল।”
“যদিও”, চোখ বুজে আমি মৃত্যুকে বলেছি, “আর অধিক আয়ুতে অধিকার নেই আমার। কারণ, আমার এখনকার বাঁচা শুধু দিনেরবেলায় একটি সাদা চাদর পাতা আর প্রতি রাত্রে তাকে কালো কম্বলে ঢেকে দেওয়া, ফের তুলে ফেলা সকালে, রাত্রে আবার ঢাকা—এই মতো ক্রমাগত, পৌনঃপুনিকতায় জর্জরিত। আমি জানি। সুতরাং শান্ত মনে নতুন দিগন্তের দিনে বেরিয়ে পড়তে আপত্তি ছিল না, বিশেষ করে কাজ-অকাজ সবই যখন সারা, কিন্তু একটুখানি কাজ বাকি আছে’যে। উৎসর্গপত্র লিখতে হবে, একটি বা কয়েকটি; ইহকালে কার কার ছিলাম, পেয়েছিলাম কাকে, কাকে এবং কী। এই সবই মৃত্যু দণ্ডিত ব্যক্তির শেষ বাসনা।
একটু সময় চেয়ে নিয়েছিলাম সেই শীতে, তারপর অনর্গল লেখায় কত পাতার পর পাতা ভরে গেল। এখনও কিনারার কাছাকাছিও যেতে পারছি না। শীতে হিম পড়ছিল, গোড়ার দিকের পাতাগুলো তাই ভিজেভিজে হয়ে যেত। তারপর চৈত্র এল, রুক্ষ রঙ, শুকনো ধুলো, লেখাটাকে নিষ্ঠুর করে দিচ্ছিল। কিন্তু মা, আবার আষাঢ় এসেছে, থেকে থেকে বৃষ্টি টপ্ টপ্ কান্নার মতো ঝরছে, জানি না সেই জলে অক্ষরগুলো ধুয়ে যাবে কি না।
তবু লিখে যাব, লিখতেই হবে। এখনও বাকি আশ্বিন, আমার সোনায়-সবুজে সহাস শিউলি-উতলা আশ্বিন, সে এসে এই লেখাকে নীল নরম আকাশের রঙে চুবিয়ে দেবে। এক-এক ঋতুতে এক-একটা রঙ নেবে এই উন্মোচন; এই কাল-পরিক্রমা, এই উৎসর্গ। কখনও মধুর, কখনও তিক্ত, কখনও সিক্ত, কখনও বিরস হবে–ঋতুর ছাপ আমরা বদলাতে পারি না, ওরাই আধার হয়ে আমাদের ধরে, লেখার জাত-ধাত সব কিছুকেই আকার দেয়, প্রকারও বদলে দেয়।
দিক। তবু ব্যক্ত হয়ে যাক। হয়ে যাক, হতে থাক। আমার দায় লিখে যাওয়া খালি। ওই তো দ্যাখো না, মাঝে মাঝে ক্লান্ত কলম তুলে নিই, কোথায় থামব, টেনে দেব শেষ দাঁড়ি? ভাবি। অবশেষে টের পাই থামা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে মনের তলায় কোথায় গুটি বাঁধছে স্নায়বিক ভয়, অযৌক্তিক ভৌতিক একটি ধারণা : যেদিনই থামব সেদিনই আমার মৃত্যু অবধারিত। শেষ হিম ঋতুটি আমাকে গ্রাস করে নেবে।
এখনও সে আছে, টের পাই, ওত পেতে আছে, কখনও কবাটের বাইরে, অন্ধকার বারান্দায়, কখনও বা টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে, ঘন পাতার মগডালে বৃদ্ধ রাতে পেঁচা যেমন গভীর করে শ্বাস নেয়। টের পাই। একটু লিখি, আড়চোখে চাই, ঢকঢক জল খেয়ে তাকে বলি, “একটু দাঁড়াও আর-একটু। ফুঁসতে ফুঁসতে আততায়ী ছায়াটা সরে যায়, ঘাড় ফিরিয়ে ঘর্মাক্ত আমি ফের কলম ঠেলতে থাকি। ঠেলতে আমাকে হবেই, কারণ যতদিন ঠেলছি ততদিন কেউ আমাকে ছুঁতে পারবে না।
.
হারানো সুতোটা কোথায় ধরব? স্বপ্ন যখন রক্তে-আলতায় মাখামাখি হয়ে গেল, ফিরে যাব সেইদিনে? স্বপ্ন সেই একটাই তো নয়, আরও অনেক দুর্বোধ্য দৃশ্যে আমার তখনকার ঘুমের আকাশ ভরে উঠছিল।
কলকাতা কিছু দেবে না, এখনো কোনওমতে পা যদি-ও-বা রাখা যায়, এই শহরটা আমাদের মাথা তুলতে দেবে না, ক্রমশ তার আকার ছোট হয়ে আসছে, তার গলি চিমটে হয়ে টিপে ধরছে, আর তার কজেকে কালি করে দেওয়া কয়লার ধোঁয়া ক্রমশ যত দম বন্ধ করে ফেলছিল, ততই আমি অভ্যাস করে নিচ্ছিলাম অন্য কোথাও চলে যাওয়া, নিজেরই তৈরি বিকল্প এক জগতে।
অথবা সে-জগৎ তৈরিই ছিল, যেমন ছাদ। ঘরে খুব গরম লাগল তো সেখানে চলে গেলাম, নইলে না। কিংবা পার্ক। বাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম তো ছুটে গেলাম ফুর-ফুরে হাওয়ায়, ঘাসে শুয়ে পড়লাম। নইলে না।
আজব দেশে একা আমরাই যাইনি। যায় সবাই। শুধু একজনের কথা লেখা আছে। একজনের কথাই সকলের কথা, একটি ছোট্ট কৌটোর মাতানো যত আতরের ঘ্রাণ। যখন তখন বেরিয়ে পড়ার নেশা তখন থেকেই আমাকে পেয়ে বসে নাকি, দূরে দূরে ঘুরে বেড়ানোর এই পিপাসা? হাঁটতাম, তখন খালি হাঁটতাম আমি, গলির পর গলি, নোনা-ধরা ইটে শহরটার সাবেকি শরীর কোন্ শতকের গন্ধ মেখে রেখেছে, তাকে পেতে পেতে চৌরাস্তায়, যেখানে চলে ছত্রাকার মৌচাকের গুঞ্জন, মোটরের পোড়া তেলে বুঁদ হয়ে, বুক ভরে নিয়ে, ফের চলতাম-ঘোড়দৌড়ের মাঠ, ডক, যেখানে জাহাজের জঙ্গল। তাদের মাস্তুলে আকাশ আর সাগরের নিশানা, কোন্ দিকে সাগর, কোন্ দিকটা দক্ষিণ সেটা বলে দিতে হেলেপড়া সূর্য আছে, আমি যাব। কিংবা এক-এক দিন রেল লাইন ধরে ধরে ইস্টিশনের আওতা ছাড়িয়ে পুল, কালভার্ট, ধোবার মাঠ, যেতে থাকতাম।
এই সব পাগলামি। কিন্তু বেশি দূর যাওয়া যেত না তো; ফিরে আসতেই হত, সেই একই রাস্তা ধরে, বড় জোর একটু অন্য পথ ঘুরে, শেষ পর্যন্ত সেই কবাট, সেই চৌকাঠ। চষে চষে চরে বেরিয়ে সেই শহরটাই শুধু তার সমুদয় অলিগলি সমেত তন্নতন্ন চেনা হয়ে গেল। কোথায় যাওয়া যায় না, আমি তখনও বুঝিনি তো। তখনও যে শুধু সামনের সমতলের দিকে চেয়ে দিশা খুঁজেছি, উপরের দিকে তেমন করে তাকাতে শিখিনি।
(তাঁকে খুঁজতে হবে আকাশের দিকে আশা করে—একি শুধু সংস্কার? শুধু আকাশে কেন, তিনি মাটিতেও কি থাকতে পারেন না। পারেন, নিশ্চয়, হয়তো আছেনও। কিন্তু আকাশের যে ব্যাপ্তি, মাটি তা পাবে কোথায়। উপরের দিকে চাইলে দৃষ্টি নীলে-নীলে, কালো-কালোয়, অথবা শুভ্রতার অসীমায় হারিয়ে যায়, সেই অবলুপ্তি মাটিতে কোথায়? নীচের দিকে তাকালে নজর তো খানিক পরেই থেমে যায়। বিরাট-স্বরাট, প্রচণ্ড প্রকাণ্ড কোনও মহিমা নিঃসীম থেকে নেমে এসে একই সঙ্গে অনুভব আর কল্পনাকে যত কম্পিত করতে পারে মাটি তা পারে না। স্বভাবতই মনে হয় সে-কারণে তাঁর প্রতিষ্ঠা আকাশেই।)
মা, বিকল্প জগতের কথা বলতে বলতে এই দ্যাখো, কোথায় এসে ঠেকেছি। বিকল্প, মানে কল্পনা। মানে তৈরি করা, এই তো? তখন আমি করতাম কী?
বলছি। ধরো, একটা সাঁকো। কোনও ঘাটে এসে যেন দেখলাম, খালটার গায়ে জোয়ারের টসে জ্বর। চোখ বুজলাম, চট্ করে তৈরি করে ফেললাম একটা সাঁকো, তারপর আমি পার হয়ে যাচ্ছি। কোথায়? জানি না।
আর কী? ধরো, একটা বাড়ি। রূপকথায় যেমন লেখে তেমন নয়, অবশ্য, মানে মেহগিনি, হাতির দাঁত, সোনার খাট-টাট অত সব কিছু নয়, তা-হলে তো বাস করতে, পাশে ফিরতে, শুতে পারব না আমি, মখমলে, পঙ্খের কাজকরা দেওয়ালে অস্বস্তি হবে, সাদা পাথরের মেঝেতে পা পিছলে যাবে, কিন্তু অন্য এক বাড়ি। ছোট্ট একটু লন চাই আমার, নরম ঘাস, বেলফুলের চারার সুবাস, চড়া নয়, মৃদু। আর যারা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়, এমন কোনও তরুণ তরুর সারি, যাদের পাতা ফিকে ঝিঝিকে সবুজ এইসব তরু। তাদের ডালপালা বেশি আবোল-তাবোল বকবে না, তারা শুধু ছিমছাম সটান ছায়া ফেলবে, অবক্র কয়েকটি রেখা, তাদের গুঁড়িতে পিঠ দিয়ে সেই ছায়ায় আমি জুড়োব, পাখিরা খুঁটে খুঁটে মুখে কী তুলে ফিরছে, পিঁপড়ে চলেছে সার দিয়ে, মগ্ন আলস্যে দেখব—এই সব কল্পনা।
বিকল্প জগৎ আরও একটা তৈরি হচ্ছিল—আমার লেখা। তখন কবিতা লেখাই ছিল শুধু, তা যদি কবিতা হয়, মানে কেবল কথার পর কথা গাঁথা লাইনের পর লাইন মেলানো। সে-ও তৈরি করা। কারণ, উদ্দিষ্ট কেউ ছিল না তো, না ঈশ্বর, না তখনও কোনও ঈশ্বরী, তবে কাকে নিয়ে লিখতাম, কী নিয়ে? তার সবটা হয়তো-বা বানানো না। ওই যে ছটফট, ওই যে চৈত্রের বাতাস চোখেমুখে লাগলেই বুকের ভিতর হঠাৎ একটা কষ্ট, কোনও ফুলের, বাসী কি তাজা যাই হোক না, গন্ধ নাকে লাগল তো কেমন একটা যন্ত্রণা, অনেক—অনেক রাত পর্যন্ত একটা শূন্যতার বোধকে জড়িয়ে এ-পাশ ও-পাশ করা, এর কোনওটাই তো আমার বানানো না, তবু ওরা আসছিল, সেই শূন্যতাই ছন্দ-মিলের শরীর পেয়ে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তাকে নিয়েই বড় বড় শ্বাস ফেলতাম আর আঁকতাম ছোট ছোট ছবি—কার?
মনে পড়ছে, একদিন লিখছি, চমকে এক সময়ে মুখ ফিরিয়েছি। লাজুক লাজুক তোমার মুখে ধরা পড়ে-যাওয়া ভাব।—”দেখছিলাম কী লিখছিস। এসেছিলাম তো পা টিপে টিপে, চুপ করে দাঁড়িয়েছিলাম। কী করে টের পেলি আমি এসেছি?“
তুমি ফিরে যাচ্ছিলে, আমি টানলাম আঁচল ধরে!—”টের পেলাম কী করে?” ফস্ করে বললাম, “মা, তোমার নিশ্বাস থেকে, গন্ধ থেকে।”
আজ লিখতে বাধা নেই, সেদিন ঠিক কথা বলিনি। কেউ এসেছে টের পেয়েছিলাম নিশ্চয়ই, পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু কল্পনা করেছিলাম সে অন্য কেউ যাকে কখনও দেখিনি অথচ নিরন্তর ভাবি, খুব কমনীয়, খুব লোভনীয় কোনও আকৃতি, কিন্তু দৃষ্ট নয়, বলেই সে আমার অদৃষ্টের মতো, চমৎকার একটি মুখের ডৌল, কিংবা তার গ্রীবা আর আয়ত নয়নের ভঙ্গি, তাকে আমি গদগদ ভাবাবেগে কত কথা বলি, তার গান শুনি।
কল্পনা। তারই আবির্ভাব ঘটেছে ভেবেছিলাম। তাকিয়ে দেখি, তুমি। হতাশই হলাম। তোমাকে বলিনি।
হতাশা ঢাকতেই তোমার আঁচল ধরে টানলাম।—”বোসো একটু, বোসোই না। কী লিখেছি, শুনবে?”
“পড়।”
পড়ে গেলাম। তারা, ফুল, পাখি, জ্যোৎস্না—এই সব তো ছিলই, কিন্তু সব শব্দসজ্জা আর বর্ণনার সমারোহ ছাপিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল কোনও কন্যা, যে দিব্যা, তার ধ্যান, তার ঘ্রাণ, স্পর্শ প্রভৃতির জন্য আকুতি মোহজ অনুভূতি—সবই ছিল। আটকাচ্ছিল একটু-একটু, তবে তখন স্রোতের তোড়ে নেমে যাচ্ছি, থামার সাধ্য নেই, কানে একটু ছোপ ধরেছে? ধরুক না, মা হয়তো সব কিছু বুঝছেও না।
বোঝা? তুমিই বরং সবটা শুনে ওই প্রশ্নটাই করলে আমাকে। চুলে আঙুল ডুবিয়ে দিয়ে বললে, “এই, তুই এ-সব বুঝিস?”
(বোঝা? ছেলে কবে নিজে থেকে উপুড় হল, কবে সে শুরু করল হামাগুড়ি দিতে, কিংবা একটা-কিছু ধরে টলমল পায় উঠে দাঁড়াল, হাসল কবে সবে ওঠা একটি-কি-দুটি দাঁত বের করে, সব মা তা জানে, তা চোখের উপর দেখতে পায়, কেউ কেউ ডায়েরিতে টুকেও রাখে, কিন্তু—। ছেলে কবে যে সব বুঝতে শিখল, কোনও মা কোনখানে কোনও দিন তা কি টের পায়? ওই না-জানাটা পরদার মতো দু’জনের মাঝখানে নেমে পড়ে হঠাৎ আড়াল করে দেয়।)
কাগজটা টেনে নিয়ে নিজেই একবার চোখ বুলিয়ে নিলে।—”কার কথা?”
আমি কি মিথ্যেবাদী, অথবা মাথার বুঝি ঠিক ছিল না, তাই-ই কী বলতে কী বলে বসলাম, বললাম যা হয় না।—”তুমিও তো হতে পার?” বললাম হাসতে-হাসতে, ওই হাসিটা যে ফুঁ-এর মতো, জড়োসড়ো ভাবটা জুড়িয়ে দেব বলে।
“যাঃ।”—ওই একটি ছোট্ট কথা, পলকে কী ছোট্টটি করে দিয়েছিল তোমাকে মা সেদিন যদি দেখতে পেতে।—”যাঃ।” অন্তত এক মুহূর্তের জন্যেও তুমিও বিশ্বাস করলে বুঝি যা হয় না! মিথ্যেটা মাত্র এক ঝলকের আয়ু পেল, সত্যের মতো, মিষ্টি এক ফোঁটা বৃষ্টির মতো পাতার উপরে টলমল করল।
তারপর আস্তে আস্তে বললে, অস্বস্তিটা উড়িয়ে দিতে আবার উচ্ছ্বসিত, “কী সুন্দর লিখেছিস রে। এ-রকম—এ-রকম আর কারও লেখা না। “
বোকা আমি সেদিন তাই বিশ্বাস করেছি। স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে মাখা কথা গোগ্রাসে খেয়েছি। বিনয় করে, বিনয় কিংবা অনুকম্পাবশত, যদিও বলেছিলাম “কেন বাবা?”
“উনি তো অন্যদের নিয়ে লেখেন, সে-সব কেমন যেন দূরের দূরের। তুই কার কথা লিখেছিস জানি না, তবে তুই লিখিস তোর মতো করে।”
বিশ্বাস করলাম।
কাগজটা তোমার হাত থেকে টেনে নিয়ে বললাম, “একটা মাসিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকায় পাঠিয়ে দেব। আমার লেখা ছাপা হবে, দেখো!”
দেখেছ, কিন্তু তুমি আর কতটুকু। তার পর বছরের পর বছর জুড়ে সেই ছাপার দাম নিয়ত দেখছি।
.
মা, এখন মার্চ মাস, অতীতের জলস্রোতের ধারায় নতুন করে স্নাত হতে হতে এই মাসে এসে কথাগুলোকে একটু গুছিয়ে নিতে চাইছি। এখন হিম নেই, হাওয়া ঈষৎ তপ্ত, আর আমি যেখানে বসে লিখছি সেখানকার বাগান, বারান্দা শুকনো পাতায় মর্মরিত। তবু গুমোট দিনের পরে বিকেলটা ঝিরঝিরে আর শেষ রাতটা বিশেষ করে শান্ত। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে, গা ওঠে শিরশির করে, পা নেড়ে নেড়ে তখন আন্দাজে চাদরটা কোথায় বুঝে গলা অবধি ঢেকে নিই। লিখতে লিখতেই একটা উপমা মনে হল; সেটা লিখি, লিখে দিই?—যদিও উপমাটা গুরুজনদের কাছে উচ্চারণ করার ঠিক উপযুক্ত নয়। মনে হচ্ছে মার্চ যেন কোনও মেয়ে, যার সদ্য বিবাহ হয়েছে রুক্ষ-রূপ কারও সঙ্গে, কিন্তু সেই মেয়ে তার স্নিগ্ধস্বভাব পূর্বপ্রণয়ীকে এখনও ভুলতে পারেনি।
খুব মিষ্টি করে সেদিন কবিতা পড়ার ছবিটা এঁকেছিলাম, তবু ছবিটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি সেই সুরটা সেদিন বিকালেই কেটে গিয়েছিল এ-কথা লিখতে ভুলি। পা টিপে টিপে তখনও এসে দাঁড়িয়েছিলে আমার পিছনে। হাসলাম। “আবার পড়ে শোনাতে হবে বুঝি? কিন্তু নতুন আর কিছু এখনও তো লিখিনি।”
খুব কুণ্ঠিত, বলেছ, “না, না, তা নয়!
“তবে?”
কাপড়ের পাড় খুঁটে খুঁটে তখন তুমি কথা খুঁজছ।—”তুই—তুই তো খুব চমৎকার লিখিস।”
(লিখিই তো। তাতে কী। কী বলতে চাইছ বলে ফেল)
–”গুছিয়ে খানকয়েক চিঠি লিখতে পারবি?”
“চিঠি? কাকে?”
“বলছি, আমাদের কয়েকজন আত্মীয়কে। কতকাল কারুর খবর তো নেওয়া হয় না, আমাদের খবরও ওরা পায় না।”
“ইচ্ছে হলেই পেতে পারে। তা-ছাড়া তুমিও তো লিখতে পারো। চিঠি—তা আবার এত গুছিয়ে লেখার আছে কী?”
“আছে।” তোমার গলা আরও নীচে নেমে গেছে, তুমি একটু একটু কাশছ,
(মা, তুমিও ছলনার আশ্রয় নিচ্ছ?)
–”মানে, চার পাঁচটা ঠিকানা খুঁজে পেতে জোগাড় করেছি। একজন হলেন আমার মামাশ্বশুর, তোর বাবাকে তিনিই মানুষ করে তুলেছিলেন, একজন আমার এক মাসিমা, ছেলেবেলায় আমাকে-“
“ঠিকানা পরে দিও। কী লিখতে হবে এখন তাই বলো।”
তুমি তখনও একটু-একটু কাশছ।—”মানে লিখবি, এই আমাদের কথা আর কী। ওঁর এত বড় অসুখ, জানানো তো আমাদের কর্তব্যও? আর তোর কথা, কলেজে পড়ছিস, শিগগিরই পরীক্ষা দিবি, এই সমস্ত খুলে।
“খুলে লেখার মানে? “
“যদি—যদি—শুনেছি তো ওদের অবস্থা ভালো, যদি পরীক্ষার কথা শুনে ওরা ফীজ্ বাবদ কিছু পাঠিয়ে দেয়—“
“তার মানে ভিক্ষা চাইব, ভিক্ষে নেব?” শুনতে শুনতে আমার কান গরম হয়ে উঠেছে, চিৎকার করে বলে উঠেছি “মা”
আরও কাছে এগিয়ে এসেছ তুমি। গন্ধ পাচ্ছি, বিকট গন্ধ, “সরে যাও, সরে যাও, সহ্য করতে পারছি না।”
“পারবি না?”
“না। তাছাড়া ফীজ বাবদ একবার তো পশুপতি জ্যাঠার কাছ থেকে টাকা পেয়েছ। জানি না, আমি কিছু জানি না। অত ছোট, অত নীচ কাজ আমি করতে পারব না!”
প্রথম কি ছলছল করে উঠল তোমার চোখ, ঠোঁট কেঁপে গেল, তার পরেই কি বিদ্যুৎ ঝলসে উঠতে দেখা গেল? দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরেছ তুমি, একটু, নিজে থেকেই একটু সরে গিয়ে বলেছ, “তার মানে আমাকে তুই ছোট, আমাকে তুই নীচ বললি? বেশ। তাহলে বল্, যদি সাহস থাকে তো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বল্, যার মা ছোট আর নীচ, তার পেটের ছেলে তবে কী? খুব উঁচু, খুব সৎ, খুব মহৎ, তাই, না?”
মা; এত জোরে জোরে কথা বোলো না, এত তাড়াতাড়িও না। তোমার চোখের পাতা এত ঘন ঘন পড়ছে কেন, থামোই না একটিবার, নিশ্বাস নিতে যখন এতই কষ্ট হচ্ছে তোমার। চোখের সামনে আমি একটা বাড়িকে গোড়া থেকে আগাসুদ্ধ কেঁপে উঠতে দেখছি, ভূমিকম্পে যেমন টলে, পাছে পড়ে যাও তাই দু’হাত বাড়িয়ে আমি তোমাকে আটকাতে যাচ্ছি, কিন্তু কঠিন হাতে আমাকে সরিয়ে দিলে তুমি, তীব্র স্বরে বলে উঠলে, “ছিঃ! আমি ছোট, আমি নীচ, আমাকে ছুঁলে তোর হাত নোংরা হয়ে যাবে যে, ছিঃ! আমাকে ধরিস না।”
ক্রমশ পিছিয়ে গিয়েছ তুমি, প্রায় দেয়াল পর্যন্ত, সেখানেই বসে পড়ে মুখ ঢেকেছ। কিন্তু ছোঁব না কেন, ছেলে মাকে ছোঁবে না এ আবার কী অসম্ভব হুকুম, আমি মানব কেন, এই দ্যাখ আমিও এগিয়ে যাচ্ছি নির্ভয়ে, তোমার সামনে হাঁটু মুড়ে মাথা নুইয়ে দিয়েছি, যেভাবে, তুমিই শিখিয়ে দিয়েছ, প্রতিমাকে প্রণাম করে। একটু ছোঁয়া লাগল কি, লাগবেই তো, আর তাতেই ঠান্ডা হাওয়া লেগে যেভাবে ফোঁটা ফোঁটা জল জমে ওঠে কাচে, তোমার চোখও সেই ভাবে জলে ভরে গেল? ভরুক, ছাপিয়ে যাক, উপচে ঝরুক, আমি তা-হলে ততক্ষণ কিছু বলব না, না-হয় ততক্ষণ বসেই থাকি তোমার পায়ের কাছে, কতক্ষণে তোমার মুখের ঢাকনা সরে যাবে, সেই অপেক্ষায় চেয়ে থাকি।
তাই, “মা, ক্ষমা কর,” মুখ ফুটে এই কথা বলেছি বটে, কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরে, যখন তুমি, অবসন্ন, ঠান্ডা শানে শুয়ে পড়েছ, আঁচল তখনও টানা মুখের পরে।
“মা, আমি চিঠি লিখব”, একটি অনুতপ্ত গলা আবার বলেছে। তুমি তবু পাশ ফিরে, তুমি চুপ। একটা হাত, সেই হাত সেই সময়ে সাহসী আর ভীরু দুই-ই, এগিয়ে গিয়ে আঁচল সরিয়ে দিতে চেয়েছে।—”লিখব, আমি লিখব। কী লিখতে হবে, আর-একটিবার বলে দাও তুমি।”
হাতটা বাধা পায়নি। বৃষ্টি থেমে মেঘ সরে যাওয়া একটু রোদ, ভিজে ভোরের চোখ ফুটেছে।
লিখছি, এখন লিখে যাচ্ছি আমি। চিঠির পর চিঠি। দূরের, দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের নামে নামে। চোখা নিবের মুখ দিয়ে যতটা করুণা খুঁচিয়ে তোলা যায়, সেই চেষ্টায় কোনও লাজলজ্জার লেশটুকু না-রেখে। লিখছি আমি লিখছি, বাইরে পাঠানো সেই আমার প্রথম লেখা, আমার যত মুনশিয়ানা উজাড় করে দেওয়া কথার বাঁধুনি, ওরা ছড়িয়ে গিয়ে ফিরে আসুক মুষ্টি ভিক্ষা হাতে নিয়ে। ওরা ব্যর্থ হবে না নিশ্চয়। লিখছি আর অক্ষরগুলো নাচছে যেন যাত্রা দলের সখী, ওদের দেহে ঢঙ, ওদের চোখে ঢলঢল ছলাকলা আর মিনতি।
পড়ছ তুমি, আড়চোখে চাইছ, বলছ “ঠিক আছে।” দুই-একটাতে তুমি সই করছ, দুই-একটাতে আমি। তোমার মুখে ম্লান একটু হাসি দেখতে পাচ্ছি। হাসিই তো, না আর কিছু দেখি। আ–হ্ ওই হাসিটুকুই তো আমি এত কথা, কথার পর কথা সাজিয়ে কিনতে চেয়েছি।
শেষে, সব কথা সারা, তখন আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়েছ তুমি। মাথায় হাত রেখে বলেছ, “তুই ঠিক বলেছিলি। খুবই নিচু হলাম, সত্যি। কিন্তু নিজে থেকে হইনি তো। আমাদের অদৃষ্ট—সেই অদৃষ্টই আজ জোর করে মাথাটা হেঁট করিয়ে দিল। থেকেও নেই তোর বাবা। ঈশ্বর জানেন, আমাদের কেউ নেই যে। শুধু আমরা দু’জন।” হঠাৎ উপর দিকে চেয়ে বলেছে, “আর আকাশের চন্দ্রতারা শুনছে, ওরা সাক্ষী, নিজের জন্যে কিছু তো করিনি, সব তোর জন্যে। তুই যাতে বেঁচে থাকিস, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিস। যে-মাথা আজ নিচু হল, সেই মাথা আবার উঁচু হবে। এর একটা কথাও মিছে নয় রে, এই তো তোকে ছুঁয়ে বলছি। ছেলেকে ছুঁয়ে কোনও মা কখনও কি মিছে কথা বলতে পারে।”
তুমি উচ্চারণ করছিলে দৃঢ় স্বরে, তখন সেই খোলা আকাশের তলে আমূল কেঁপে যাচ্ছিলাম আমি।
(মা, আমাকে শক্ত করে ধরেছ, কী বলছিলে, আবার বলো। সেদিনের কথা, যা ওই খোলা হাওয়ায় তোমার এলোচুলের মতো আকুল, অথচ যার প্রতিটি শব্দ আবার শিলাবৃষ্টির ন্যায়, আবার সেই শব্দগুলির পর্তন শুনি। আবার বলো। অথবা বুঝি শিলা নয়, সেই কথা কয়টি নিঃশব্দ শিশির আকাশের বুকে নিংড়ে পড়া হিম। শুনতে পাচ্ছি : ‘যেদিন মাথা তুলে দাঁড়াবি, সেদিন আমি হয়তো থাকব না। চলে যাব। কিন্তু তোর মা এইখানে দাঁড়িয়ে একদিন কী বলেছিল মনে রাখিস।’)
গ্লানি তোমার মুখের হাসিটুকু দিয়ে ঢেকে দিয়েছ। থাক, ঢাকা থাক। আমার কষ্টটার কথা তবে আর তোমাকে বলব না। আমার আয়ত্ত বিদ্যাকে ব্যবসায়িক কাজে লাগিয়েছি, শুরুতেই সরস্বতীকে নামালাম যাচিকার ভূমিকায়—প্রকারান্তরে সে-ও তো বেশ্যাবৃত্তি? সেই পাপ সারা জন্ম অনুসরণ করুক আমাকে; তার অভিশাপ একাই বহন করি, আত্মবিক্রয়ের সেই অপরাধের ভাগ দিতে ডাকব না, আজও ডাকিনি বা ডাকছি না—মা, তোমাকে কিংবা কাউকে।
২৩
মা, চলো এইবার সেখানে যাই, বাগানওয়ালা সেই লাল রঙের বাড়িটা, জায়গাটা এখন কলকাতার সঙ্গে মিশে গেছে, তখন ছিল এরকম শহরতলিই। দেশের বাড়ি ছেড়ে আসার পরে এখানে আমাদের দ্বিতীয় ডেরা, ঘিঞ্জি গলির পাট উঠে গেলে সেখানে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম।
পাট শেষ পর্যন্ত তুলে দিতেই হল। চার মাসের ভাড়া বাকি, লেসী লোকটা উঠতে নামতে রোজ তাগাদা দিতে শুরু করেছিল। বাবা বিশেষ বেরোত না, তুমি জানোই তো, বোধটোধের ঘেরা ঘর থেকে তিনি যেন বারান্দায় বেরিয়ে পড়েছিলেন, শুধু তাঁর চোখ চক্রাকারে ঘুরত। লেসীর সঙ্গে কথা বলতে হত তোমাকেই, মনে পড়ছে? লেসী একদিন অভদ্র একটা কথা বলল তোমাকে, ফাটা শানে জুতোর গোড়ালি তার জোর আর রাগ দুটোকেই জাহির করল। আমি তেড়ে দৌড়ে গেলাম তার দিকে, তুমি দু’চোখ দিয়ে বলছ “না, না, না,” দু’হাতে সাপটে আমাকে সামলাচ্ছ! তবু ওই লোকটার গায়ে একটা স্কেল-টেল কি কাঠের একটা টুকরো পড়ল, চোখ দিয়ে জ্বলন্ত গোলা বর্ষণ করল সে, ওই কাঠটাকে কুড়িয়ে নিয়ে বলল, “বটে! আচ্ছা, এর শোধ আমি নেব। তিন দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে যাবি বুঝলি? না যাস যদি, তবে আদালতে নালিশ করব, পুলিশ-পেয়াদা এনে তাড়াব।”
লোকটা আমাদের “তুই” বলল। নতুন গোড়ালি লাগানো জুতোটা ফাটা শানে আরও ঠুকল, খুব রেগে গেছে সে, ওকে এখন দেখাচ্ছে যেন আস্তাবলের টাট্টু ঘোড়া—আর ওর জুতো জোড়া নাল বাঁধানো খুরের মতন, অবিকল।
বাবা ভিতরে; হাতে-গড়া রুটির খানিকটা প্লেটে পড়ে ছিল; তাই ছিঁড়ে ছিঁড়ে ওঁর স্নেহের চড়ুই দুটিকে খাওয়াচ্ছিলেন। স্নেহের মানে চেনা হয়ে গিয়েছিল। যখন উনি ঘুমোতেন তখনও ওই পাখি দুটো তিরতির করে ঘরেই ঘুরত, মাঝে মাঝে শিয়রের কাছে থাকত দাঁড়িয়ে, পাহারা দিত? অথবা, অসম্ভব নয়, ওরা ঠোঁট দিয়ে খুঁটে বাবার দু’চারটি পাকা চুলও বোধ হয় তুলে দিতে পারে! যাক, বাবা চড়ুই দুটোকে খাওয়াচ্ছিলেন, ওই লোকটার জুতো ঠোকার শব্দ শুনে চমকে তিনিও তাকালেন। কী যেন বলতে গেলেন তাড়াতাড়ি উঠে! নির্বাক মুখভঙ্গিই শুধু ফুটে উঠল, কথা শোনা গেল না, কথা হয়তো তিনি বলেনওনি, বলতে চেয়েছেন শুধু, তার আগেই ইতর ছোট লোকটা বাবাকেও ধমকে বলে উঠেছে—”চুপ! জোচ্চোর!”
জোচ্চোর—বাবাকেও ও বলল কিনা জোচ্চোর! তখন, মা আমাকে আর ঠেকাবে কে, আমি ফুসছি, ঝাঁপিয়ে পড়ব, আঁচড়ে দেব, নাকি ওর কাঁধের মাংস নেব খুবলে, অধীর-অন্ধ আক্রোশে এই সব কথা ভাবছি, লোকটা ভ্রূক্ষেপও করছে না, কিন্তু অত্যন্ত অপমানকর ভঙ্গিতে হাসছে, কী নাটুকে ব্যাপার, বলো তো কী নাটুকে, আসলে ও কি আমার সাহসেরই আন্দাজ নিচ্ছে, সাহস অথবা ভীরুতার? ও বুঝতে পেরেছে নাকি যে আমি সত্যিসত্যি বেশি ঝুঁকি নিয়ে নিজেকে বিপন্ন করব না, টের পেয়ে গিয়ে থাকবে, আমার সাহসের অভাব আর হিসাবি স্বভাব? আশ্চর্য, সমস্ত জীবন যা আমার লজ্জা, যা-নিয়ে আমার-আত্মগ্লানি ওই ধূর্ত লোকটা আমার চরিত্রটা সেই সময়েই ওইটুকু ক্ষণের মধ্যেই পাঠ করে ফেলেছিল? বাহাদুর, ওকে বলতে হবে বৈকি! আমার সাহসের অভাব থেকে ও সাহস নিচ্ছিল, বিশ্রী দাঁতগুলো বিকশিত করে হাসছিল।
“তিন দিন সময় দিলাম, মাত্র তিন দিন”, চলে যাওয়ার আগে দুটো আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লোকটা বলে গেল।
ফিরে তাকিয়ে দেখি বাবা গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে আবার চড়ুই পাখিদের রুটির টুকরো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াচ্ছেন। কোনও চাঞ্চল্য নেই। আমাকে দেখে হাসলেন। ইশারায় বললেন—’আস্তে।’ তারপর রুটি ছড়ানো শেষ হয়ে গেলে চড়ুই দুটো যখন জানালা দিয়ে ফর ফর করে উড়ে বেরিয়ে গেল, বাবা তখন গুঁড়োটুড়ো ঝেড়েঝুড়ে বসলেন।—”আজকের মতো, ব্যস্। ওরা কত সুখী, দ্যাখ্ তো। কষ্টভাবনা কিছু নেই যেই জানল, আজকের পাওনা ফুরিয়ে গেছে, অমনই—একটুও আপত্তি নেই—নিজে থেকেই চলে গেল। আমরা পারি না!” বাবা খুব লুকিয়ে একটা শ্বাস চাপলেন, “মানুষ পারে না। মানুষ জানতে পারে না কবে তার এখানকার পাওনা ফুরোলো, তাই তখনও পড়ে থাকতে চায়। কষ্ট পায়।”
আমরা কথা বলছিলাম না।
একসার পিঁপড়ে জানালার শিক বেয়ে ভিতরে আসছিল, এক-একটার মুখে এক-একটা টুকরো, এক-এক কণা চিনি, মেঝের কোণে ফাটা শানের খাঁজে কোথায় ওদের গর্ত, সেখানে টুকরোগুলো জমা দিয়ে ফের শিক বেয়ে বেয়ে চলে যাচ্ছে বাইরে। বাবা, তখনও মগ্ন, দেখতে দেখতে বললেন, “দেখছিস? দায় ওদেরও কম। যার যেটুকু সাধ্য, সে তাই বহন করে। মানুষের মতো নয়। মানুষের বোঝা মানুষকে ভেঙে চুরে গুঁড়িয়ে দিয়ে যায়।” বাবা নিজের শিরদাঁড়া একটা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করলেন কি? আমরা দেখলাম না। আমরা কথা বলছিলাম না।
এই বাসা, এখানকার বাস শেষ হয়ে এল, আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, লেসী লোকটার এই অভদ্র ব্যবহারে, আর সদ্য-সদ্য যা হয়ে গেল সেই ঘটনায়, তুমি আর আমি পরস্পরকে চোখে চোখে তাই বলছিলাম। যেন অন্ধকার হয়ে আসছে, লণ্ঠনে তেল নেই, জ্বালাব কী। জ্বালাব কী, জ্বালাব কী, মা, আমরা যাব কোথায়?
আর ঠিক তার পরদিনের ডাকেই–না, আমাদের সেই চিঠিগুলোর জবাবে কারও কাছ থেকে টাকা-টাকা নয়, তোমার সেই মাসিমার কাছ থেকে চিঠি এল।
আমি তথাকথিত যুক্তিবাদী, তার্কিক, আমি অকৃতজ্ঞও; তবু জীবনে বারবার অলৌকিক কোনও করুণার পরিচয় পেয়ে সর্বসত্তায় শিহরিত হয়েছি। মুখ থুবড়ে পড়ব মাটিতে, ধুলোয় একেবারে মিশিয়ে যাব, যখন সেই ভয়ঙ্কর সংকেত পাঠ করে থরথর কাঁপছি, তখন শেষ মুহূর্তে দেখেছি কোথা থেকে নেমে এসেছে কোনও পরিত্রাতা, অলক্ষ্য হাত, আমাকে আবার সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, আমি বেঁচে গেছি। কেঁপেছি, তখনও–তখনও বিশ্বাসে বা ভক্তিতে নয়, কৃতজ্ঞতায়। কিন্তু সেই নিছক কৃতজ্ঞতায় আবেশও এসেছে অনেক পরে।
“দেখলি তো।”—তুমি আমার অবিশ্বাসী মনের কথা জানতে, তাই সেদিন চিঠিটা পড়ে দিব্য হাস্যে পূর্ণ হয়ে বললে, “দেখলি তো। আমার সেই মাসিমা যেতে লিখেছেন। ভগবান আছেন”, উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলেছ, “তোকে বলেছি না, আমার এই মাসিমা মানুষটি চমৎকার। আপন নয় অবিশ্যি, তবে আপনের চেয়ে বেশি। ভগবতী নাম, রূপেও সাক্ষাৎ ভগবতী। গরিবের মেয়ে, শুধু ওঁর রূপ দেখেই পাত্রপক্ষ নিজে থেকে এসে ওঁকে তুলে নিয়ে যায়—গল্প শুনেছি। খুব বড় ঘর, ওঁর বিয়েয় নাকি, পঞ্চাশটা নৌকো এসে ঘাটে লেগেছিল। বরপক্ষ নিজেরা সারা শরীর সোনায় ঢেকে ওঁকে সাজিয়ে দিয়েছিল,
(এ-সব রূপকথা শোনাচ্ছ কেন মা, হঠাৎ কেন এত প্রগল্ভ হয়ে গিয়েছ, সেই কোন্ আদ্যিকালের এক বিয়ের বৃত্তান্তে আমার কাজ কী?)
শুনেছি ওঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল যেন এক রাজপুরী,
(তোমার মুখে নোলা পড়ছে যে! মা, মুছে নাও।)
কিন্তু বছর যেতে না যেতেই কপাল ভাঙল।”
“স্বামী মারা গেল বুঝি?”
“হ্যাঁ। মেসোমশাই গেলেন, কোলে ছেলে-পুলে আসার আগেই। মাসি তবু ওখানেই থেকে গেলেন, শুনেছি পুষ্যি নিয়ে ছিলেন ওর শ্বশুরকুলের জ্ঞাতিদের ঘর থেকে, শাস্তর মতে কিনা জানি না, তবে পোষ্য তো, দত্তকের মতোই—মাঝে মাঝে আসতেন বাপের বাড়ি, তখন খরচ করতেন দু’হাতে, আমরা ছোট, তবু দেখেছি তো, আমাদের ছিল পাশের বাড়ি, আমাকে কোলে তুলে কত আদর করেছেন,
(মা, তোমার ছোট্ট মেয়েটি হয়ে আদর পাওয়ার লোভ মনের তলা থেকে উপরে উঠে এসেছে বুঝি? )
বলতেন, উনি বলতেন, ওই পুষ্যি ছেলেটির সঙ্গে আমাকে বিয়ে দেবেন,
(লজ্জা করছে না, তোমার এসব বলতে লজ্জা করছে না? বাবা ভাগ্যিস এখন অন্যমনস্ক, বসে আছেন পিঁপড়েদের আনাগোনার রহস্য-ধ্যানে নইলে—নইলে যদি শুনতে পেতেন?)
বলতেন অবিশ্যি মজা করে, তুই ওঁদের বাপের বাড়ির পোড়ো ভিটেটা দেখেছিস, পুকুরটার ঠিক উত্তরে–ঝোপঝাড়ে ভরা, যেখানে খেলতে যেতেও ভয় পেতিস; যাক আমার বিয়ে তো ঠিক হল অন্য জায়গায়, মাসিমা খবর পেয়ে কী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন জানিস?—একটা বেনারসী?
কতটা সত্যি, কতটা বানানো ওই মুগ্ধ উচ্ছ্বসিত বর্ণনার? জানি না। চিঠিটা তুমি পড়ছ ফিরে ফিরে, বাবাকে একটু ঠেলা দিয়ে বলেছ, “শুনছ? মাসিমা একবার যেতে লিখেছেন আমাদের।”
বাবার সংবিৎ ঠিক ফিরল কি? বোঝা গেল না। একেবারে উদাস স্বরে তিনি একবার খালি বললেন, “যাব? যাব কোথায়?”
“এই তো ঠিকানা।“
চিঠিটা তোমার নাকের কাছে, মুখের কাছে, চিঠিতে গন্ধ থাকে আমি জানি, চিঠিতে আর নতুন বইয়ের পাতায় পাতায়, প্রগাঢ় একটা ঘ্রাণ—ওই চিঠিতে সেদিন ছিল কী; কী পাচ্ছিলে তুমি, তোমার সেই ছেলেবেলার কোনও সুবাস কি? বাসী বকুলের কোনও গন্ধ-টন্ধ? চিঠিটাকে কোলের কাছে ধরে তোমার কোলে চড়ার বয়সটাকে ফিরে ছুঁচ্ছিলে? কিংবা চোখে লাগছিল কোনও রঙ, পুরনো কোনও বেনারসী?
বাবা নিস্পৃহ গলায় বললেন, “তোমার এই মাসিমা কে? আমি চিনি না।” বলেই
বিছানার চাদরে নখ দিয়ে কী লিখে যেতে থাকলেন, আজকাল মাঝে মাঝেই লেখেন, বিছানার চাদরে কি বালিশের খোলে; কী লেখেন, শুধু আঙুলের ঘোরানো ফেরানো থেকে তা বোঝা যায় না।
“চেনো। মনে নেই?” মরিয়ার মতো তুমি বললে, “সেই বেনারসী?”
বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, “মনে নেই।”
তখন আমার দিকে কাতরভাবে চেয়ে তুমি বলেছ, “আমাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করে, মাসিমা বলেছেন।”
“এত দিন এই ইচ্ছে ছিল কোথায়?”
‘কোথায় আছি জানতেন না তো। এখানে এসে খবর তো দিইনি। কোন্ আত্মীয়ের সঙ্গে কোন্ সম্পর্কটা তুমি রেখেছিলে? ছিলে তো নিজের পাগলামি নিয়ে।”
“পাগলামি?” বাবা শিশুর মতন সরল চোখে তাকালেন, হাত বুলিয়ে নিলেন না-কামানো গালে একবার—”আমার সব পাগলামি সেরে গেছে।
সেই কথা শুনে ভীষণ চমকে আমরা আবার দু’জন দৃষ্টি বিনিময় করেছি। তুমি এগিয়ে গিয়ে বাবার কপালে হাত রেখেছ। খুব মরমী গলায় বলেছ “সেরে তো গেছই। শুধু তোমার ওই অসুখটা—শরীর আর একটু সুস্থ হোক, দেখবে, সব দিক থেকে সেরে গেছ একেবারে!”
“সেরে গেছি?” বাবার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, অবোধ অসহায় বিশ্বাসী হাসি, মাথা নেড়ে নেড়ে ফিসফিস করে খালি বলছেন “সেরে গেছি” এখনও সেই নিষ্পাপ হাসি দেখতে পাচ্ছি, সেরে গেছি, সেরে গেছি, সুস্থতার জন্যে পিপাসার্ত ভগ্নস্বর শুনতে পাচ্ছি।
কিন্তু বাবা তাঁর গোঁ ছাড়লেন না। যখনই তুমি বলেছ, “মাসিমা এখন অথর্ব হয়ে পড়েছেন, চোখে ভালো দেখতে পান না, চিঠিটা লিখিয়েছেন আর কাউকে দিয়ে, নিজে কোনও রকমে করেছেন শুধু সই—আমাদের একবার শুধু দেখতে চেয়েছেন—যাবে না? “ বাবা শুধু বলেছেন, “না, না। অনেক গিয়ে গিয়ে তো দেখলাম। এবার একটু থেকে দেখি কোথাও যাওয়া যায় কি না।’
মা, ও-সব কথার অর্থ সহজবোধ্য নয়। তুমি বোঝনি। আমার দিকে তাকিয়ে বলেছ, “তবে তুই নিয়ে চল্। মাসিমাকে দেখাশোনা করার লোকও তেমন কেউ নেই আর-
“কেন, সেই লোকটি, যাকে উনি পুষ্যি নিয়েছিলেন”
“সে নেই তো।”
“মারা গেছেন?”
“মাসিমা তাই তো লিখেছেন—সে নাকি অনেক বছর হয়ে গেল।”
(তোমার ঈশ্বর সত্যিই আছেন, মানছি মা! দ্যাখো তো, কীভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছেন তোমাকে! ওই বিয়েটা সত্যিই যদি—!)
“আর কেউ নেই?”
“তার বউ নেই?”
“সে-ও গেছে আর বছর। মাসিমা সর লিখেছেন। তোদের দু’জনের একজনও তো পড়েও দেখলি না। পড় না, এই তো আছে। মাসিমা কত দুঃখ করে লিখেছেন! লিখেছেন, পাতানো ছেলে গেল, অন্য বাড়ি থেকে আনা পরের মেয়েটা—মানে ওঁর বউ—সে-ও গেল, অথচ দু’জনে বুড়ির কাছে সঁপে রেখে গেছে দুটো শত্তুরকে, নাতি একটা, একটা নাতনি। বুড়ি দু’জনকেই আগলাচ্ছে কিন্তু পারবে কেন। মেয়েটাকে তাই রেখেছে বোর্ডিং-এ। ছেলেটাকেও পাঠাবে পাঠাবে করছে। নিজেই বলে হাত-পা পুড়িয়ে খান উনি!”
“নিজেই? নিজে কেন? “
“কারও ছোঁয়া যে খান না উনি। সেকালের নিষ্ঠাবতী বিধবা যে!”
(তুমি সেদিন বলেছিলে “সেকালের।” আমিও আজ কথা লিখছি সেকালের। ‘সেকাল’ কথাটা, কী মজা, দ্যাখো কত আপেক্ষিক, একটা করে সেকাল চেপে বসে আছে সব কালেরই পিঠের’ পরে।)
“অথচ” তুমি বলছিলে, “ঠাকুর-চাকর সব আছে। যাক, শোন্, উনি তো ভাবে বিভোর, ওঁর মাথায় কিছু ঢুকছে না। তোকে বলি। মাসিমা লিখেছেন, পর যারা তারা চলে গেছে, তুই আপন মেয়ে মানে মেয়ের মতো।—তোরা সব্বাই মিলে একবার আয়, সব দেখে যা, পরামর্শ করি। যাবি?”
সম্মোহিতের মতো সেদিন বলেছি “যাব মা।” আমি ততক্ষণে তোমার সব উচ্ছ্বাস, তোমার চক্ষে অস্বাভাবিক সব প্রগলভতার অর্থ বুঝেছি! খড়কুটো যা-হোক একটা কিছু আঁকড়ে ধরতে চাও। বাঁচতেও চাও, বাঁচাতে চাও আমাকে। আমিও তো, মা, তাই। বাঁচতে চাই, বাঁচাতে চাই তোমাকে।
কিন্তু বাবা? সেইভাবেই বেঁকে বসে আছেন। তন্ময় হয়ে দেখছেন পিঁপড়ের সারি। তুমি যেই সরে গিয়েছ শুকনো কাপড় তুলে আনতে, বাবা ইশারায় আমাকে ডেকেছেন। উদ্দীপ্ত, বিস্ফারিত দৃষ্টি—চাপা ‘স্বর, বলেছেন, “ওই দ্যাখ। পিঁপড়েগুলো হেঁটে হেঁটে চলেছে জানালা বেয়ে বাইরে। ভাবছে চিনি ওই দিকে পাবে। অপেক্ষা কর, গরম হাওয়া বইছে, বিষ্টি নামুক! দেখবি ওরা ফিরে আসছে একে একে। যেহেতু জানালার ও-পাশে চিনি নেই, পাবে না।”
“আ-স-বেই”, বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন ভীষণ কোনও ঘোষণার স্বরে, মা, ঠিক যখন তুমি শাড়ি পাটে ঘরে ঢুকছিলে। তুমি কিন্তু চমকে ওঠোনি, মুছে গেছে একটু আগেকার সেই উত্তেজনা। চোখে পলক পড়েনি, একবার চেয়ে দেখে নিলে বাবাকে, তারপর শান্ত, অবিচল, আমার দিকে ফিরে বললে, “তৈরি? তা হলে চল্!”
.
ঠিক এক্ষুনি যেন কোনও কথা বলে উঠে তুমি আমাকে চমকে দিও না। ধরেই নাও না এখন সেই রোদ-পড়ে আসা বেলা, আমরা দু’জনে ফিরছি। সেই লাল রঙের বাড়িটা, যার চার ধারে মাথা সমান পাঁচিল, বাগানও আছে একটা, বাগানের পিছনের রাস্তাটা গিয়ে ঠেকেছে গঙ্গার ঘাটে, সেই বাড়িটা থেকে ফিরছি। টম টম, টম টম কী গাড়ি এটা বলো তো, এই গাড়ির নামও টম্ টম্, যে ঘোড়াটা টানছে সেটার রঙ কী গাঢ় বাদামি, আর সেটা কী তেজি, চড়বার আগে তুমি নজর করে দেখনি, দেখলে তোমার ভয় করত। সামনে কোচম্যান, পিছে সহিস, টম্ টম্ টম্ টম্, আমাকে খানিকক্ষণ ওই শব্দের তলায় চোখ বুজে শুয়ে থাকতে দাও, ভয় নেই, ওই শব্দে, রাজবেশ-পরা ঘোড়াটার নালবাঁধা খুরের তালে তালে ঠক্ঠক্ চলায় থেঁতলে যাব না আমি।
এ-রকম গাড়িতে তার আগে চড়িনি। তাই নতুন করে সেদিনের ফেরাটা তৈরি করে নিচ্ছি, অতীতকে এইভাবে তৈরি করে নেওয়া যায় তো, তুমি দ্যাখোনি, যেভাবে তৈরি করে নেয় থিয়েটারে, সকল সেট-টেট এনে আর পিছনের সিন-টিন এঁকে, মোগল পাঠান যুগে যেমন হতো, পৌরাণিক কালে হতে পারত যেমন?
ভেবে দ্যাখো, সেই বিকেল, আমার তখনও ঘোর কাটেনি, কোথাও ঢংঢং ঘণ্টা বাজছে, মন্দিরের চুড়ো, ওই বুঝি দক্ষিণেশ্বর?—তুমি দু’হাত জুড়ে প্রণাম করছ। তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে, তার নরম আলোয় জুড়োচ্ছে ধনুকের মতো পিঠ-বাঁকানো পর পর সাতটা মহাকায় মহিষ, ওগুলো কী; এর নাম বালি পুল নাকি? সেদিনকার চোখ দিয়ে আমাকে আর-একবার দেখতে দাও।
এই তো একটু আগে ছিলাম সেখানে, চৌকোচৌকো পাথরের বাঁধা তক্তকে মেঝে, পা পিছলে পড়ব না তো, এ কি ইন্দ্রপ্রস্থ, রাজসূয় যজ্ঞের সময়কার, আর আমি দুর্যোধন? সাদা-কালো পাথর, কোনা-কুনি বসানো, ঘরজোড়া অবিকল এক দাবার ছক—দাবার ছক? ভাবতেই বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে, দাবার ছক যদি, তবে এই ঘরে আমি কী, আমরা কী, আমাদের নাম কী—বোড়ে নয় তো? কেউ কি ঘুঁটির মতো চালছে আমাদের অন্তরাল থেকে, আমরা কি মরে যাব, অথবা মন্ত্রী-গজ-নৌকা এই সব হয়ে বেঁচে উঠব নতুন করে, পুনরায় হব সচল এবং প্রবল?
তোমার মধ্যে কিন্তু অস্বস্তি দেখিনি। এত তাড়াতাড়ি ওখানে সহজ হয়ে গিয়েছিলে!
(মেয়েরা পারে, যেহেতু এক ঘর ছেড়ে আর এক ঘর একবার তো তাদের যেতেই হয়। নতুন মাটিতে তরতর করে তারা বাড়ে, আমরা পুরুষেরা তা পারি না।)
বসেছিলে লক্ষ্মী মেয়েটির মতো তোমার সেই মাসিমার পাশে।
তাঁকে দেখলাম। তোমার এই মাসিমা সত্যি। রূপসী? ছিলেন কোনওদিন তো নিশ্চয়ই, আমি দেখলাম রূপের চিহ্ন পড়ে আছে শুধু ফিকে ফ্যাকাশে রঙে। সরু শুকিয়ে যাওয়া মুখ, সোনার পাড়-বোনা চশমা চোখে, ধবধবে থান পরনে, তোমার মাসিমা, প্ৰণাম করলাম, তোমার ইঙ্গিতে বাধ্য হয়ে তাঁকে বললাম, “দিদিমা।।
তিনি দেখলেন তোমাকে, চশমাটা পরে তো দেখলেনই, একবার খুলে নিয়েও। তোমাকে কাছে টেনে নিলেন। আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়, কপালে, গালে, পিঠে। চোখে জল এসেছে ওঁর, দেখতে পেলাম, কিন্তু কেন, সেদিন অবাক হয়ে ভেবেছিলাম। তখনও জীবনের খুব বেশি তো দেখা হয়নি। জানব কী করে যে, বেশি বয়সে কথায় কথায় চোখে জল আসে, কখনও কখনও কারণও থাকে না, কাউকে দেখলে, পুরনো কালের কোনও কিছু হঠাৎ আবার চোখে পড়ে গেলে আলোড়িত হয় স্মৃতি, আর এসে পড়ে বহু অনুষঙ্গ—এলোমেলো ঠান্ডা বাতাস থেকে হঠাৎ যেমন বৃষ্টি, স্মৃতি তেমনই সহসা পরিণত হয় অশ্রুতে।
চোখের জল মুছে তিনি ভিজে গলায় তোমাকে ডাকছিলেন “খুকি।” তোমার চোখও ভিজে।—”উঁ–উঁ”, তুমি সাড়া দিলে।
“উঁ!”—ওই ছোট্ট, আদরের অবদারের, আধো আধো একটা অক্ষর কিন্তু সব কিছুর মানে বুঝিয়ে দিলে আমাকে। মা, আমি তোমাকে দেখতে পেলাম সেই বয়সে যে-বয়স কোনও দিন দেখিনি। কোথায় সেই বিষাদ-প্রতিমা, যা স্থির, ভারী, পাথর কুঁদে তৈরি? আহত, নানা তাপে জর্জরিত? হালকা হয়ে গেছ তুমি, খুশিতে, অসংবৃত অহেতুক উচ্ছ্বাসে।
ঘোর কাটেনি, গাড়িতে ফিরতে ফিরতেও তোমার সেই রূপ ধ্যান করছিলাম। ভাবছিলাম, ওই রূপান্তরের রহস্য কী। পড়ন্ত আলোয় দেখেছি তোমার মুখের খুশির ছোপ তখনও মোছেনি।
তোমার মাসিমার সঙ্গে তুমি যতক্ষণ কথা বলছিলে, তার সব সময় আমি সেখানে বসে থাকিনি। ঘুরে ফিরে দেখছিলাম, বেরিয়ে পড়েছিলাম বাগানটাতে, একবার দেখে এসেছিলাম গঙ্গার ঘাট অবধি।
গাড়ি যখন টালার পুলে, তখন ঘোলাটে ঘন শহরটা সম্মেলনের পর্দাটা ঘুচিয়ে সম্বিৎ আবার ফিরিয়ে এনেছে। তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, “কিছু হল? কী বললেন তোমার মাসিমা—ওই দিদিমা।”
বাস্তব প্রশ্ন, অন্তরঙ্গ স্বর। তুমি চোখ-বড়-বড় করে বললে, “দেখলি না, কী খুশি।”
“খুশি তো বুঝলাম, বললেন কী?”
“সব শুনলেন। বললেন, আমরা সবাই মিলে ওখানে গিয়ে থাকতে পারি। আসলে, মাসিমাও বেঁচে গেছেন আমাকে দেখে, আমাকে পেয়ে।”
“তুমি ওখানে কী করবে?”
“ওঁর পুজো, ওঁর রান্নার জোগাড়যন্তর করে দেব, আবার কী। আর তোর বাবা–উনিও তো বিশেষ কিছু করছেন না এখন, করতে পারছেন না। যত দিন সুস্থ না হন, ততদিন এখানকার সব তদারকি করতে পারেন, ঠাকুর-চাকরে মিলে চুরি করে শেষ করে দিচ্ছে, মাসিমা বলছিলেন। “
“আর আমি?”
“তুই পড়বি, পরীক্ষা দিবি, পাস করবি। তোর আবার কী। বুঝছিস না, সব তোরই জন্যে, বুঝছিস না?”—বলতে বলতে তোমার গলা নেমে আসা সন্ধ্যার মতো ভারী হয়ে এল। বুঝেছি। আমারও জন্যে একটা ভূমিকা ঠিক হয়ে ছিল, তখন জানতাম না। অথবা আমি সেই ভূমিকাটা ঠিক করে নিয়েছি।
বুঝেছিলাম আরও কিছু। বুক থেকে একটা বিষম ভয়ের ভার নেমে যাচ্ছে, তাই তুমি এত খুশি। তাই, মা, “সব তোর জন্যেই তো”, ভারী গলায় এই কথাটা বলে উঠেই হঠাৎ আবার বাচ্চার মতো গলায় হেসে উঠছ তুমি।
“কী হল?”—জানতে চেয়েছি।
“একটা কথা মনে পড়ে গেল কি না। তুই শুনেছিলি, মাসিমা আমাকে আনু বলে ডাকছিলেন না, বলেছিলেন ‘খুকি’!’
“শুনেছি।”
“আর চশমা খুলে আমার মুখটা খুব কাছে নিয়ে দেখছিলেন, দেখেছিলি? চামড়া একেবারে কুঁচকে গেছে, চোখে ভালো দেখতে পান না তো, তাই টেরও বোধহয় পেলেন না যে, আমি এখন গিন্নি-বান্নি। হাসির কথা নয়? বল্, তুই-ই বল্, তোর বাবা তো আমাকে কবে থেকেই বলে, বুড়ি! ঠিক কি না বল্”, তুমি চতি গাড়িতে বসেই আমাকে ঠেলছিলে, আর চোখ উপছে হাসছিলে!
হাসতে হবে না আর, আমি বুঝেছি। ধরে ফেলেছি তোমার ছেলে-মানুষী খুশির আর-একটা মানে। আশ্রয়ের আশ্বাস পেয়ে নির্ভাবনার হাসি, সে তো আছেই। কিন্তু কারণ আর-একটাও নেই কি? সেটা আছে ওই কথাটায়—”খুকি।” তোমার মাসিমার কাছে সেই জাদু, যা পলকে তোমাকে করে খুশি, তাঁর পাশে দাঁড়ালেই তুমি আধো-আধো সেই ছোট্টটি। ওঁর চামড়া কোঁচকানো, চোখে জ্যোতি নেই, দেখতে পান না ভালো করে—ওঁর চোখে এখনকার তুমি ধরা পড়বে না কোনও দিনও, সেই ভয় নেই বলেই, এত খুশি—এই তো! বুঝেছি।
(আমাদের হারানো বয়স আমাদের চেয়ে যারা বয়স্ক, শুধু তারাই আমাদের ফিরিয়ে দিতে পারে। তোমার তখনকার বয়সে পৌঁছে যাবার পর থেকে মা, এই আনন্দের স্বাদ আমিও মাঝে মাঝে পাই, আজও পাচ্ছি।)
.
গলির ভিতর আর গাড়িটাকে নিয়ে গেলে না। মোড়ে নেমে কোচোয়ানকে বললে, “মাসিমাকে বোলো, আমরা কাল কি পরশুই যাচ্ছি।”
চাপা গলি, ধসা দেউড়ি, নড়বড়ে সিঁড়ি। কয়েকটা চামচিকিকে উদ্বাস্তু করে দিয়ে আমরা অলীক থেকে আবার আমাদের প্রাত্যহিক সত্যে প্রবেশ করছি। এই সত্য পরিত্যাগ করে যাব।
কিন্তু কী করছেন বাবা, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে? হাতে একটা মোমবাতি। ফিরে তাকালেন আমাদের পায়ের শব্দে, তারপরই আবার ঘুরে গেলেন জানালার দিকে।
“কী করছিলে? আমরা আসব বলে আলো জ্বালিয়ে পথ দেখাচ্ছিলে?”—তোমার মন তখন হালকা, তাই তুমি ঠাট্টা করতে পেরেছ।
কিন্তু বাবার গলা শান্ত, সুদূর—”না। দেখছি।” কাপড় বদলাতে তুমি চলে গেছ আড়ালে, তখন বাবা একটা আঙুল নেড়ে আমাকে ডাকলেন।
“দেখতে পাচ্ছিস?”
দেখব কী—”কই, কিছু তো নেই!”
তখন কানের কাছে মুখ নামিয়ে বাবা গূঢ় কোনও সত্য ব্যক্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, “দেওয়াল বেয়ে বাইরে গিয়েও ওরা কিছু পায়নি, তাই ফিরে আসছে। সারে সারে। এবার দেখছিস?”
তখনও তুমি উনুন জ্বালোনি। বদলানো আটপৌরে কাপড়, পিছনে চুপচাপ এসে দাঁড়িয়েছিলে, যেন চিত্রার্পিত। আমাদের অংশটুকু তো বটেই, সমস্ত বাড়িটাই স্তব্ধ হয়েছিল।
আমাদের প্রাত্যহিক সত্য। এই সত্য পরিত্যাগ করে যাব।
.
আমরা যাব। সব গুছিয়ে তুলছ তুমি, পাটপাট করে রাখছ, গরিবের সংসারেও কত জিনিস জমে ওঠে, দরকারির সঙ্গে অদরকারি, ওই কয়েক বছরে আমাদেরও জমেছিল, ছড়ানো ছিল বলে বুঝিনি, তুলতে গিয়ে টের পাওয়া গেল, বোঝা কত।
গাঁটরি আর পুঁটলি বাঁধতে বাঁধতে তুমি কপালের ঘাম মুছছ, ক্লান্ত পা ছড়িয়ে বলছ, “এ–ত!” কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি যেই বলে উঠেছি, “থাক না, ওখানে তো সবই আছে”, তুমি অমনই ব্যথিত, বলেছ “বা—রে। পরে আমাদের আবার আলাদা ঘরকন্না হবে না? বরাবর ওখানে থাকব নাকি। তোর বাবা একটু উঠে দাঁড়ালে, আর তুই মানুষ হলে আমরা আবার তো নতুন বাসা করব। করব না?”
“তবে থাক।” সায় দিয়ে আমি আবার অন্য দিকে হেলছি।
“কিন্তু সব নিয়ে যেতে গেলে বোঝা হয়ে ওঠে যে, আবার ফেলে যেতেও মায়া লাগে। কোটা কবে যে কাজে লাগবে বলা তো যায় না।”
“ঠিক ঠিক”, বাবা বলে উঠেছেন, “বলেছ ঠিক। কোন্টা যে কবে কাজে লাগে কিচ্ছু বলা যায় না।
বাবাকে নিয়ে সমস্যা হবে, ওঁকে রাজি করাতে বেগ পেতে হবে, তুমি আর আমি আগে দু’জনেই ভেবে ভয়ে ভয়ে ছিলাম, অথচ আশ্চর্য, বাবার মত পরদিন সকালেই একেবারে অন্য রকম। ভালো করেও সব শুনলেন না, তোমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘যেতে হবে? তা হবে বৈকি। পড়ে থাকা সম্ভব নয়, আমরা কেউ তো পড়ে থাকতে আসিনি।”
শান্ত, সম্মত বাবা একদৃষ্টে দেখছেন তোমার জিনিস গোছানো। কখনও বলছেন, “দরকারি-অদরকারির কথা বলা তো যায় না, নিয়ে চলো, নিয়ে চলো সব”, কখনও “ফেলে দাও, ফেলে দাও সব”–একটা যন্ত্রণার অস্থিরতা ওঁর মুখে আঁকা হয়ে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি।
‘ফেলে যাব?” হাত থামিয়ে তুমি বলেছ, “ফেলে যাব কেন?”
“কিচ্ছু বোঝো না তুমি, বরাবরই এক রকম। জানো না, একেবারে হাল্কা হয়ে চলে যেতে হয়?”
মাঝে মাঝে কী যে নিষ্ঠুর হয়ে যেতে তুমি! নইলে বাবার নিরাসক্ত, সুন্দর কথাটার ওইভাবে উত্তর দিতে হয়? তোরঙের তলা থেকে হাতড়ে হাতড়ে বের করেছ হলদে কাগজের বাঁধা বান্ডিলগুলো, এত দিন পরে দেখে চমকে উঠেছি, কঠিন গলায় তুমি বলেছ, “তবে বলো, ফেলে দিয়ে যাই ওগুলোও?”
বাবা যেন চেনেননি। —”ওগুলো কী? “
“তোমারই কীর্তি তো, এ-সব। দেখছ না, সেই সব পালার পর পালা?”
তাকিয়েছিলাম। স্থির দৃষ্টিতে বাবাকে দেখছিলাম। একটু কেঁপে উঠেছেন। ঘন ভুরুর নীচে চোখের তারা একবার নড়ে উঠেছে। একটু ছায়া পড়ল কি, রুগ্ন শীর্ণ মুখে খেলে গেল একটুখানি মায়া? খুব ধীরে ধীরে উচ্চারণ করছেন, “তাই তো, ওগুলো ওগুলো”, বিবর্ণ গলা, কিন্তু এই তো, মুখ সহসা প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে, আঙুল বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে ছিঁড়তে চাইছেন কিছু, আপাতত যা অদৃশ্য, হয়তো-বা কোনও মায়া, ছিঁড়ছেন, টুকরো করে দিচ্ছেন হিংস্র হাতে।
মা, সেই মর্মান্তিক হিংস্রতার কাছে তোমার হিংস্রতা কিছুই নয়। ফেলে দিয়ে বলেছিলে? ওই শোনো, বাবা কী বলছেন, কী স্পষ্ট, কী তীব্র, কী নির্মল-নির্মম ওঁর কণ্ঠস্বর, বলছেন “ফেলে দাও ফেলে দাও সব।”
সেই বৈরাগী-গৈরিক আদেশের আঘাতে তুমি বিবশ, তুমি কাঁপছ। কাঁপা, অতি ভীত, অতি সঙ্কুচিত গলায় বলছ “স–ব?”
বাবা এগিয়ে এসে তোমার পাশে বসেছেন। আলগোছে একটা হাত রেখেছেন তোমার পিঠে। নিবিড় স্বরে বলছেন, “ভয় পাচ্ছ? মায়া হচ্ছে?”
“তোমার মায়া নেই জানি! কোনও-কিছুতেই নেই, কোনও দিনই না! জানি।”—কোনও রকমে বলতে পেরেছ, কিন্তু মা, তোমার শুকনো কণ্ঠস্বর।
“আছে। মায়া আছে। তুমি জানো না আনু।”
(বাবা তোমার নাম ধরে ডাকছেন, আমার সামনে এই প্রথম। আমার উপস্থিতি কি সেই ক্ষণে ওঁর কাছে লুপ্ত হয়ে গেছে?)
“তুমি জানো না, মায়া আছে। কিন্তু সব ইন্দ্ৰিয়বৃত্তির মতো মায়াকেও স্থির করে ধরে রাখা যায়, সেই শক্তি আমি অর্জন করেছি। ফেলে যাও ওগুলো, যাও না। লেখালেখির ওগুলো একটা পর্যায় মাত্র, একটা পদ্ধতির নমুনা। আরও পদ্ধতি আছে, আমি শিখেছি। আমার লেখালিখি এখনও চলছে, অনবরত, টের পাওনি, না? কত কী লিখি সাদা চাদরে, আঙুল দিয়ে, দ্যাখনি? সে-লেখা পড়তে পার না। লিখি আর মুছি বা নিজেই মুছে যায়, কালির লেখা তো নয়। মনে কিন্তু গাঁথা থাকে, সমস্ত, নিজের কাছে থাকে। সব লেখা দেখলাম, শেষ পর্যন্ত নিজেরই জন্যেই তো। কথাটা—আমি লিখতে পারছি কি না। পারছি। আগে কাগজে লিখতাম কালি দিয়ে, কালি-বড় কালো, কালিই হল আসক্তি, তাই কষ্ট পেতাম। এখন সাদা চাদর, সাদা অক্ষর, আসক্তি নেই, কষ্ট নেই। আনু, যা ইচ্ছে এই বাক্স বোঝাই করে নিয়ে যেতে পারো, যা ইচ্ছে তা ফেলে রেখে যাও, কিছুতেই আর আমার লাভ নেই, ক্ষতি নেই।”
কথাগুলো কঠিন, তার চেয়েও স্থির কঠিন ছিল সেদিন বাবার কণ্ঠ। আমি তাঁর সেদিনের নিরাসক্তিকে আমার আজকের যথাসাধ্য শক্তি দিয়ে সাজালাম। ভাষা অবিকল হোক বা না হোক, তাঁর ভাবটাকে হয়তো প্রতিধ্বনিত করতে পেরেছি।
তোমরা যখন কথা বলছিলে, অভিভূত আড়ষ্ট, আমি তখন কিন্তু ধীরে ধীরে এসেছিলাম সরে। যেন শুনছি না, এইভাবে দেওয়ালে আঁকা বসুধারা-চিহ্নটার উপরে চোখ রেখেছিলাম, আসলে সঙ্গে কী নেওয়া যায়, আর কী পড়ে থাকে, বিচার করে দেখছিলাম মনে মনে
ওই বসুধারা চিহ্নটা। কবে আঁকা, তবু এখনও টকটকে। খুব অসহায়, কিন্তু অভিযোগপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সেই মুহূর্তে খেয়াল হল, এই বসুধারা চিহ্নটি তো নিয়ে যাওয়া হবে না; আবার কেউ মুছেও দেবে না ওই লেখাটাকে যাবার আগে। ওটা রয়ে গেল।
রয়ে যাবে আরও কত কী, টুকিটাকি, পরিত্যক্ত আত্মীয়ের মতো, এখন মূল্যহীন, কিন্তু কোনও-না-কোনও দিনের স্মৃতি-বিজড়িত। নালিশ চোখে নিয়ে তারা পড়ে থাকবে, আমরা চলে যাব, অজস্র সেই অশ্রুত আর্তনাদ শুনতে পাব না।
২৪
ঘর-টর ঝাঁট দিয়ে, মুছে, তবে যেমন আসন পাতে, পূজায় বসে, তুমি দেখতে পাচ্ছ কিনা জানি না, আমি রোজ বসছি সেই ভাবে। লম্বা এই চিঠিটার খেই ধরবার আগে তাঁর উদ্দেশে নমস্কার করে নিই। লম্বা ঢিবি, একটি মিছিলের মতো; কত দূর থেকে আসছে, কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে! সারি সারি অক্ষর, মরুভূমিতে। সার্থবাহীদের উটের মতো। কিংবা মাথায় মোটঘাট বাঁধা সেকালের সব তীর্থযাত্রী। এরা কোন্ মন্দিরের অঙ্গনে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়বে, কত দূরে সেই মোহানা অথবা সঙ্গম, এই লেখাগুলো ডুবে যাবে যার জলে? সেইজলে ধুয়েও যদি যায় তো যাক না!
অথবা আমি এখান থেকেই তাদের ভাসাচ্ছি। পাতায় করে কিছু ফুল, একটি আলো, একটার পর একটা নামিয়ে দিচ্ছি স্রোতে; ফুল কাঁপছে; কাঁপছে আলো, পাড়ে বসে কাঁপছি আমি। অনেক দূরে চলে গেলে তাদের আর দেখা যাচ্ছে না।
আমিও নেমে যাই না ওই জলে, মাঝে মাঝে ভাবি। তা-হলে আর পাতার নৌকো তৈরি করারও দরকার হয় না। নিজেই নিমজ্জিত, প্রশান্ত এক পাতালে স্থির হয়ে থাকি। অস্থিরতা যত, সব উপরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে, বৈঠার ঘায়ে ঘায়ে ঢেউ ভাঙে, আমি জানি। ‘নীচে এ-সব কিছু নেই। সেখানে অজস্র স্থির-পদ্ম প্রস্ফুটিত, নীল, পাটল কিংবা সোনালি আলোর বর্ণ দিয়ে গড়া তাদের পাপড়ি, যে-আলো জলের উপরিতলে আছড়ে পড়ে নির্যাস তলদেশে চুঁইয়ে পড়ে।
সেই অসুখটার পর থেকে স্থায়ী সুখের জন্যে ব্যাকুলতাও আমার বেড়েছে। জরার হাত থেকে রেহাই নেই, কিন্তু জ্বালার হাত থেকেও বাঁচব কিসে, অস্থির হয়ে ভাবছি। নিরালম্ব শূন্যে আর ঝুলতে পারি না, ওখানে যত নীচতা, ছোট ঈর্ষা, তাৎপর্যহীন ঘটনার ঝড় আমাকে নিরন্তর ঝাপটা মারে, পায়ের নীচে তাই খুঁজলাম মাটি—পেলাম। সেই মাটি এই লেখা। সেই মাটি তুমি। তদবধি তোমার আশ্রয়ে আছি। খুঁড়ছি, খুঁড়ছি, কখনও আবেশের বশীভূত হয়ে, কখনও নিষ্ঠুর আক্রোশে, তবু কোথাও দাঁড়িয়ে আছি। এই মাটি কেড়ে নিও না, জীবনের শেষ ক’টা দিনের জন্যে আর উদ্বাস্তু করে দিও না।
উন্মোচিত করো, সেই অতীত, তোমাকে আমাকে। প্রত্ন-রত্নগুলি ঘষে মেজে আমার হাতে তুলে দাও।
পরিপার্শ্ব, মা, আমাকে এখনও বিচলিত করে। আগে ঋতুর কথা লিখেছি। এখন দেখছি, এক-একটা দিনেরও নানা প্রহর আমার ধ্যানভঙ্গ করে। বর্তমানের ধুলো, রাজনীতি আর তার তুচ্ছতা; সমাজ, পরিজন, তাদের কাছে প্রত্যাশা এখনও কিনা ছিটিয়ে পড়ছে আমার সত্তায়। চমকে উঠে আবিষ্কার করছি আমি আজও প্রকৃতির দাস, বৃত্তির সামান্যতার সুতোর জালে জড়িয়ে আছি, জড়িয়ে যাচ্ছি।
অথচ স্নান করে সব ধুয়ে শুচি হয়ে বসব, এই লেখার শর্ত তো এই! তবু কোনও কোনও দিন এরই মধ্যে মন-মুখ তেতো হয়ে থাকে, কারও ভীরুতায় নিজের সংশয়ে মেজাজ যায় বিগড়ে, সেদিন আর এই জবানবন্দী শান্তিবারির মতো ঝরতে চায় না, আজ যেমন চাইছে না, অকিঞ্চিৎকর অনুভবের শরশয্যায় শুয়ে-বলো তোর কী?—মনে পড়ছে ছোট্ট একটি ছেলেকে। একবার তাকে দেখছিলাম! মেলার ভিড়ে হট্টগোলে হারিয়ে গিয়ে ভীষণ বিপন্ন সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, দু’হাত বাড়িয়ে ফিরে ফিরে একটি কথাই শুধু বলছিল “মার কাছে যাব, মার কাছে যাব।”
একটি ছেলে কিংবা একটি মেয়ে। সব মেলাতেই যারা হারায়। মাকে ডাকে। তাদেরই মতো।
মা, কাল সারা রাত কতগুলো কষ্টের শকট আমার বুকের উপর দিয়ে চলে গিয়ে আমাকে মথিত করে গেছে। এই প্রভাতেও তার বসে যাওয়া চাকার দাগে ব্যথা পাচ্ছি, প্রয়োজনীয় প্রসন্নতা কিছুতেই ফিরে পাচ্ছি না। সেই বাগানঘেরা বাড়িটাতে পৌঁছতে তাই দেরি হয়ে যাচ্ছে।
অথচ সেখানে তো আমাদের পৌঁছতেই হবে। আমাদের মাল বোঝাই ঠেলা গাড়িটা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আগেই, পরে আমরা গিয়েও দেখলাম সেটা কাৎ হয়ে পড়ে। হয়তো সেটাই স্বাভাবিক, তবু বুকটা কেমন করে উঠেছিল, কাৎ হয়ে পড়ে থাকা গাড়িটা কি আমাদের কুণ্ঠিত আশ্রিত অবস্থার প্রতীক। হয়তো কল্পনা, তবু অনাদরের চেহারা যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।
বাবা কিন্তু খুব খুশি। চার দিকে চেয়ে দেখে বলেছিলেন, “বেশ, বেশ। কোন্ ঘরটা আমাদের হবে বল তো?”
“এসেই আগে ঘরের খোঁজ?” তুমি চাপা ধমক দিলে, “অদ্ভুত মানুষ তো তুমি!”
“বাঃ, ঘরই তো চাই আগে। সবচেয়ে আসল কথা হল স্থিতি। কোথায় স্থিত হব, জানতে চাইব না?“
ব্যস্তভাবে চলাফেরা করছিল যারা, দাস-দাসীই হবে, তারা কেউ দাঁড়াচ্ছে না, কথা বলছে শুধু নিজেদের সঙ্গে, তা-ও চাপা গলায়, আমাদের দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে অথচ আমরা তাকালেই ফিরিয়ে নিচ্ছে চোখ, ঠিক কী করব বুঝতে পারছিলাম না সেদিন—একটা নতুন অধ্যায় শুরু করার আগে কোনখানে ঠিক কী ভাবে ধরব, এখনও যেমন ভাবি।
“যাই মাসিমার সঙ্গে দেখা করে আসি।” তুমি ওপরে চলে গেলে।
বাবা ঘুরতে থাকলেন বাগানে। ঠেলাওয়ালাকে তো ছেড়ে দিতেই হবে। আমি এগিয়ে গেলাম সেখানে, তার সঙ্গে হাত লাগিয়ে খুলে ফেললাম দড়াদড়ি, জিনিস নামিয়ে তুলতে থাকলাম রকে। বেশ পরিশ্রম হচ্ছিল। গেট দিয়ে তখন ঢুকল একজন লোক, মাঝবয়েসি, একটা শার্টের সঙ্গে সে পরেছে ধুতি, চেহারা দেখে মনে হল আধা-ভদ্রলোক। “আধা”–আধা কেন? যেহেতু—যদিও পিছলে পিছলে চরম দুর্দশায় তখন পড়ে রয়েছি—মধ্যবিত্ত শ্রেণীবিজ্ঞান আমাদের জন্মার্জিত ও মজ্জাগত!
তার হাতে কী সব সওদা ছিল, আমার গলদঘর্ম দশা দেখে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটা দয়াপরবশ। তার সহায়তায় জিনিস নামানো হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। ঠেলাওয়ালা বিদায় নিল। তখন, কাঁধে-রাখা ঝাড়নে হাত ঝেড়ে ফেলে সে বলল, “কোথা থেকে?” বোধহয় সে ঠিক করতে পারছিল না, তুমি বলবে, না আপনি, আমার বেশভূষা আর বয়স থেকে।
“ঝামাপুকুর”–আপনি-তুমি এড়াতে আমিও একটি কথাতেই উত্তর দিলাম।
“ও বুঝেছি”, সে বলল খুব প্রাজ্ঞ গলায়।—”মা বলেছিলেন বটে।” দূরে, বাগানের ধার ঘেঁষে বাবার পায়চারি-করা চেহারা দেখা যাচ্ছিল। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে লোকটা বলল, “তাহলে এর পর উনিই হচ্ছেন এ-বাড়ির নতুন ম্যানেজার?”
ম্যানেজার? বাড়ির আবার ম্যানেজার কী। বুঝতে পারলাম না, আবার পারলামও যে, কথাটা যেন তেমন সম্মানের নয়। কান ঝাঁ ঝাঁ করছিল। কী বলা যায় চট করে ঠিক করতে না পেরে, কতকটা অসংলগ্নভাবে কিন্তু ঝোঁক আর ঝাঁঝ দিয়ে, বলে ফেললাম, “আমরা এদের আত্মীয়।”
লোকটা হাসল। সেই হাসিটার পুরনো প্রিন্ট নাড়াচাড়া করে এখনও বুঝছি না, ওই হাসির জাত কী। ধূর্তের? দার্শনিকের? যাই হোক, সে হেসেছিল। বলেছিল, “আত্মীয় তো সবাই। আমার মামাও এখানে আসেন জ্ঞাতি হিসাবেই—এই গিন্নিমার শ্বশুরের আমলে। তা, কী হল? সেই মামা হলেন গোমস্তা, আর তার ভাগনে এই আমি? বরাবর বাজার সরকার। শুনি আমি চুরি করি, তাই আমার উপরে তদারকির জন্যে ম্যানেজার বসাচ্ছে।”
তার স্বরে তিক্ততা, হতাশা, ঈর্ষা, ঘৃণা; কিন্তু চোখে বেদনা ছিল। আমি মিলিয়ে দেখছিলাম। আবার “ম্যানেজার–ম্যানেজার” শব্দটা কানের পটাহে বিকটভাবে বাজছিল। আরও জোর দিয়ে, যেই সেই কর্ণপটাহ ভেদ করে নিজেরই কল্জেকে শোনাতে আবার বলে উঠলাম, “আমরা আত্মীয়। দিদিমা–দিদিমা নেই?”
মা, তোমার মাসিমাকে সেই প্রথম স্বেচ্ছায়, উপযাচকের মতো দিদিমা বললাম। এ কয়দিন মনে মনেও যা মানতে পারিনি। “দিদিমা, দিদিমা” শব্দটাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছি কাঙালের মতো প্রাণপণে। প্রাণ, অপমানবোধ, আমার সম্মান।
“না। ত্রিবেণী গেছেন পুণ্যিস্নানে। কালই ফিরবেন কি পরশু। তা সেজন্য ভাবনা নেই। বলে গেছেন আমাকে। সব বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। নীচের দুটো ঘর খুলে দিচ্ছি।”—বলে সে আর অপেক্ষা না করে হুকুম খাটিয়ে উঠিয়ে দিল আমাদের সব জিনিস ভিতরের উঠোনের সামনাসামনি দুটো ঘরে।
.
উপরে গিয়ে তুমি একটা দরজায় ঠেস দিয়ে বসে আছ, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠলে, “আয়। কিন্তু মাসিমাকে দেখতে পাচ্ছি না। বুঝতে পারছি না কোথায়। সেই তখন থেকে বসে আছি। মাসিমা বোধহয় চানের ঘরে ঢুকেছেন, কি পুজোর ঘরে। এখনও বেরোননি। ওকে জিজ্ঞেস করছি, অথচ ও কিছু বলছে না। কী যে করব!
দেখলাম দরজার সামনে দিয়ে দাসী মতন কে চলে যাচ্ছে। দাসী? ও যদি দাসী, তুমি তবে কী? বাবা কোথায়, এখনও বাগানে ঘুরছেন? বাবাই বা এ-বাড়িতে কী? ম্যানেজার হবেন? ম্যানেজার—মানে তো নায়েব? বাবা যদি নায়েব, তুমি তবে কী? বামুনদি যাকে বলে তাই?—হেড রাঁধুনি? শব্দটা মনের উপর গরম মোমের মতো পড়ল। নায়েব—বানি, নায়েব — রাঁধুনি, বারবার যেন দুটো মশা এসে জ্বালাচ্ছে, মারব বলে হাত তুলছি, ঠাস্-ঠাস্, শব্দ হচ্ছে, তবু কই, ওদের গায়ে লাগছে না তো, নায়েব-নায়েব, রাঁধুনি-রাঁধুনি—মশা দুটো ফিরে ফিরে ঠিক উড়ে এসে বসছে।
“খিদে পেয়েছে?” তুমি বললে, “খেয়ে নে না খানিকটা চিঁড়ে, দ্যাখ গিয়ে বারলির পুরনো কৌটোটায় আছে। তোর বাবাকেও দে। জানিস, ও কোথায় আছে?”
জানতাম। একটা গাছের নীচে বাঁধানো বেদিতে বসেছেন, উপরে উঠে আসার একটু আগে দেখেছিলাম। নেমে গিয়ে দেখি, তখনও তিনি সেইখানে। এক মনে কী শুনছেন, উপরের ডালপালার দিকে মাঝে মাঝে চাইছেন।
আমাকে দেখে ঠোঁট ছুঁচলো করে আস্তে একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন— আন্দাজে শব্দটা ওঁর ঠোঁটের ধরন থেকে পড়ে নিলাম—ঘুঘু। কিসের ডাক শুনছেন বুঝিয়ে দিলেন। আমার হাসি পেল। ঘুঘু?
হাত তুলে তখন আমাকে মারবার মতো করে একটা আদরের ভঙ্গি করলেন বাবা। “হাসছিস যে? দুষ্টু। ভিটেয় ঘুঘু চরে শুনেছিস, তাই হাসি পাচ্ছে বুঝি? মন দিয়ে শোন, তাহলে আর হাসি পাবে না। ভিটেয় হয়তো চরে, তবে আমি কখনও চরতে দেখিনি, জানি না, কিন্তু চরলেও ওর তো স্পষ্ট দুই রূপ? যখনই একা তখনই কী যন্ত্রণায় যে ডেকে চলে! শোন্ শুনতে পাচ্ছিস, এখনও ডাকছে, ডেকে চলেছে—একটানা!”
.
ছাদ-টাদ ঘুরে অনেক পরে আবার নীচে যখন এলাম, তখন তোমাকেও দেখলাম নীচে। ওই লোকটা কিংবা অন্য কোনও পরিচারক-পরিজনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই তোমার কিছু কথা হয়ে থাকবে, তুমি জিনিসপত্র গুছিয়ে তুলছ নীচের একটা ঘরে। পাশে একটা তক্তপোশ, বাবা পা ঝুলিয়ে সেখানে বসে।
তোমার মুখ থমথমে, কথা নেই। গুছিয়ে তুলছ, সাজিয়ে রাখছ, কিন্তু ঠিক যেন তোমার মনোমতো হচ্ছে না, সাজাতে শুরু করছ ফের অন্যভাবে। বাবা নির্বিকার, বরং হাসছেন, তুমি এক-একটা কৌটো খুলে, ভিতরে কী সেটা গন্ধ শুঁকে পরখ করে তাকে তুলে রাখছ, বাবা হেসেই চলেছেন, হঠাৎ একটা কৌটোর কিনারায় কি ছিল, ধারালো টিনের কোনও টুকরো ছিল, তোমার আঙুলে লাগল, নাকি আঙুলটা বুঝি কেটেই গেল, কৌটোটা পড়ে গেছে হাত থেকে,–ঠন! সেই শব্দের আমোদে বাবা হাসছেন, কিন্তু ইস, রক্ত! ইস্, তুমি কেঁদে ফেলেছ। কেটেছে, কতটা, খুব বেশি? কিংবা কাটা-টাটা কিছু নয়, তুমি কাঁদতেই চাইছিলে, অসাবধানে কৌটোর ঢাকনা খুলতে যাওয়া ওটা ছুতো, তুমি যা চেয়েছ তাই পেয়েছ—কাঁদতে পারছ, অনেকক্ষণ গুমোটের পরে যেমন হঠাৎ বৃষ্টি ভেঙে পড়ে।
বাবা পা দুলিয়েই যাচ্ছেন খাটে বসে, তোমাকে কাঁদতে দেখে প্রথমে অবাক, খানিকটা চেয়ে থেকে কী বুঝে নিলেন। মাথা নেড়ে জ্ঞানী-জ্ঞানীভাবে বললেন, “নতুন বাসা হল নতুন জুতোর মতো। গোড়ায় একটু লাগে, পরে সয়ে যায়।”
নীচের ঘর, জানলায় জাল, কেমন চাপা-চাপা লাগছিল। সেদিন বোধহয় গরমও পড়েছিল খুব। উঠোনের ঝাঁঝরি দিয়ে তলাকার ভ্যাপসা পচা-পচা গন্ধ উঠে আসছিল। “আমরা এই ঘরেই থাকব বুঝি মা, এই নীচের ঘরে?”
“মন্দ কী”, বাবা বলে উঠলেন, “পাশের ঘরটাও খুলে দিয়েছে, আমি দেখে নিয়েছি। আমার তো খুব পছন্দ। নীচের ঘর, তাতে কী! ওখানে—ওখানে আমি নতুন সেই বিজনেসটা করব। বেবি ফুড, শটি ফুড, তোমাকে একবার বলেছিলাম, মনে আছে? সেই যে ফর্মুলাটা, যেটা আমি সেবার চিটাগং-এ আরাকানি লোকটার কাছে পেয়েছি। তোমাকেও তো শিখিয়ে দিয়েছিলাম। একবার—সেই অনেক, অনেক বছর আগে। মনে নেই? আমার কিন্তু আছে। দেখো এইবার, ব্যাপারটাকে দাঁড় করিয়ে ফেলব, এবার ফেলবই। আর এটা চললে ধরব সেই আর একটা ফর্মুলা, সেটাও শেখা আছে, শুধু হাতে কলমে করা হয়নি; আলাদা জিনিস অবিশ্যি—সেটা, অন্য লাইনের জিনিস— স্কিন-ডিজিজ-এর ওষুধ, নাম দেব “স্কিনোকিউরা”, কেমন নাম? যে গাছড়া দিয়ে তৈরি হবে, সেটা কী আশ্চর্য জানো, এখানেই আছে, এই বাড়িতেই; গঙ্গার পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে, আমি দেখে এসেছি। ভগবান নিশ্চয়ই সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন, নইলে এত জায়গা থাকতে এখানেই বা আমরা আসব কেন?”
বাবার চোখে স্বপ্ন জ্বলছিল। মাঝে মাঝে ওঁর গলা, বলার ধরন এত স্বাভাবিক লাগে! তখন মনের ভিতরকার চাপা মেঘগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, কিংবা আশা ঝিলিক দেয় সেই মেঘে, ভয় নেই, আবার আমরা স্বাভাবিক হব, সুস্থ, নিজেদের উপর যাদের নির্ভর, বাবা সেরে উঠবেন, আর আমি, পাস-টাস করে, আমি সব ক’টা পরীক্ষা তরতর করে উতরে গিয়ে—তারপরে বলো তো মা, তারপরে কী!
“শটি ফুড, স্কিনোকিউরা; স্কিনোকিউরা—শটিফুড”, বাবা কথাগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার বলছেন, হাতের আয়না ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেউ কেউ যেমন একই মোহিত মুখ দেখে, গুনগুন শটিফুট, গুনগুন স্কিনোকিউরা। জ্বলজ্বল করছে দুটি চোখ, সেই দৃষ্টি স্বাভাবিক, না অস্বাভাবিক? ধাঁধাঁ লাগছিল, ঠিক যেন ধরতে পারছিলাম না।
বাবা বলছিলেন, “কোম্পানির নাম কি হবে বলো তো, এবার কোম্পানি হবে তোমার নামে। বিরাট করে লেখা সাইনবোর্ড—অ্যানা প্রোডাক্টস। আনু নামটা একটু ইংরেজি ধাঁচে অ্যানা করে নেওয়া হবে। কেমন শোনাবে?”
সগর্বে তাকিয়ে আছেন বাবা, আমি এখন আর ওঁর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না।
তুমি আস্তে আস্তে বললে, “ভালো। তবে আমার নাম আবার কেন? আমি তো অপয়া। বরং অন্য কোনও নাম ভাবো। সেই যে একবার কী নাম যেন দিয়েছিলে?”
“মিম্।” বাবা বুকটা চিতিয়ে দিলেন। “মিসলেনিয়াস ইন্ডিয়ান ম্যানুফ্যাকচারিং কোং—সংক্ষেপে মিম্। ইন্ডিয়ান; স্বদেশি। স্বদেশি শিল্পের পুনরুজ্জীবন—তখন যা করতাম তারই সঙ্গে একটা আদর্শ, বড় একটা আদর্শ, বড় একটা লক্ষ জড়ানো থাকত যে। তখনও সব এভাবে ভেঙেচুরে ছড়িয়ে ছিটকে পড়েনি, আদর্শ ছাড়া কিছু হত না।”
এতক্ষণে বাবার বুঝি খেয়াল হল যে, ইতিহাসের যে অধ্যায়টার কথা বলছেন, তখনও আমি জন্মাইনি। আমার সুবিধার্থে, সুতরাং, ব্যাখ্যা করে বোঝাতে লাগলেন। “মিম্ ছিল কোম্পানির নাম—বুঝলি? আর ছিল কবরী-কল্যাণ, বিউটিবাম, মধু-সোডা, নবীন স্কোয়াশ, সব কবির নামে নাম, তুই দেখিসনি। তোর মা জানত, লোকের মুখে শুনেও ছিল, কিন্তু বিশ্বাস করেনি।”
“তখন করিনি।” তুমি বললে।
“এখন করো?” ওঁর মাথাটা তোমার মাথার কাছে নিয়ে গেছেন, নিষ্কল্প দৃষ্টিতে বিদ্ধ করে তোমাকে বলছেন—”এখন করো?”
“করি।”–তোমার গলা কেঁপে গেল।
“ব্যস, তা হলেই হবে।” বাবা সোৎসাহে বলে উঠলেন, “বিশ্বাসে সব হবে।” একটি শিশু যেন ওঁর গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে তালি দিচ্ছিল। আমরা শুনছিলাম। আমরা দেখছিলাম। সেই শিশুটি খানিক পরে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার চোখ কড়িকাঠে। সে শ্রান্ত, শুধু অপলক; বুঝতে পারছিলাম সে স্বপ্ন দেখছে।
“একেবারে ভোলানাথ”; তুমি আমার দিকে ফিরে বললে আস্তে আস্তে। সে-শব্দ বাবার কানে গেল। তক্তপোশেই কাৎ হয়ে ফিরে কনুইয়ে রাখলেন মাথা। বোঝা যায়, ওঁর দৃষ্টি এখন অনেক দূরে চলে গেছে—সামনে, না পিছনে ধরতে পারছিলাম না।
তারপর হঠাৎ উপুড় হয়ে কাঁপতে থাকলেন তিনি, যেন অসহ্য কোনও কষ্ট। সাঁতার জানেন না, কোনও রকমে উঠে যেন একটা কষ্টের পুকুরে পড়ে গেছেন, আসছেন অনেক হাবুডুবু খাওয়ার পরে, ভিজে শরীর, ভারী, জামাকাপড় শপশপে–সেই কষ্ট সামলে আবার মুখ ফেরালেন যখন, দেখলাম ওঁর চোখ দুটো লালচে।
“বিশ্বাস—বিশ্বাস”, তিনি বলছিলেন ভাঙা ভাঙা স্বরে—”এই বিশ্বাসটা তখন যদি করতে আনু! হয়তো কিছু কিছু থেকে যেত, সব এভাবে ধসে যেত না, সবটাই নতুন করে গড়তে হত না। এখন কি আর পারব। কবে আমার ভাঙা শরীর আবার জোড়া লাগবে—এখন খুব দেরি হয়ে গেছে!”
“খুব দেরি হয়ে গেছে”, বাবা বললেন আস্তে আস্তে। “আর পারব না।”
স্থির হয়ে দেখছি আমরা দু’জনে। নীচের ওই ঘরটা আজ তার যে চেহারা দেখতে পাচ্ছি, যেন বিমূর্ত এক বিচারসভা; কিন্তু কে অভিযোগকারী, কে অভিযুক্ত, সাক্ষীই বা কে? যেন পড়া হচ্ছে কারও জবানবন্দি, যেন কড়া কড়া জেরা করে কেউ তলব করছে কারও কৈফিয়ত—সেই দৃশ্যটি পুনর্নির্মাণ করতে বসে আজ এইসব দেখছি। অস্পষ্ট কোনও কাঠগড়াও যেন আছে, সেই কাঠগড়ায় মুখ দেখা যাচ্ছে না এমন অপরাধীর মূর্তি। মা! বলে দাও, সেই মূর্তি কার–আমার? তোমার?
.
ও-বাড়িতে বিজলি আলো ছিল, নীচের ঘরেও ছিল। মা, একটু পরেই তুমি সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিয়েছিলে। এটা মানুষের একটা সহজাত প্রবণতা, একটা স্বয়ংক্রিয়তা যা তার স্বভাবেরই অংশ—পরে নানাভাবে অনুভব করেছি। ভয় আর অন্ধকারকে আমরা এক করে দেখি। ভয় কাটাতে চাই যে, অন্ধকার দূরে সরে যাক, আলো জ্বালানোর অর্থ হল সেই আকুতি।
বৃষ্টি থেমে যাবার পরও যেমন পাতা থেকে টুপটাপ জল পড়ে, সেদিন তার পরেও ছোট ছোট ঘটনা ঘটছিল। উঠে বসে বাবা একবার হাত বাড়ালেন—”জল, এক গ্লাস।” ঠোট মুছে তাকালেন আমার দিকে। “খাতা কলম এনেছিস, এখানে আছে? দে তো!” চুপ করে বের করে দিলাম।
ক্রমশ বাবা সহজ হয়ে আসছেন। এই দ্যাখো খাতাটার উপরে ঝুঁকে পড়েছেন। তুমি দেখলে—সর্বাঙ্গে আড়ষ্ট—দাঁড়িয়ে। বাবা মুখ তুললেন! বাবা এখন হাসছেন।
কী বলছেন বলো তো? বলছেন যে, “ভয় নেই। নতুন কোনও পালা-টালা লিখতে বসেছি তাই ভাবছ বুঝি? দূর, তা আর হয় না! তারও খু-উ-ব দেরি হয়ে গেছে। সেদিন তুমি আমার লেখা টেখাতেও বিশ্বাস করনি, না? যদি করতে, তাহলে—কী হবে আর সেসব ভেবে, যাকগে। এখন আমি এই খাতাটায় অন্য একটু আঁকি-বুকি করি—ধরো, নতুন যেসব দেশি শিল্পের কথা ভাবছি, তার স্কিম?”
“কিন্তু বেশি মাথা খাটালে যদি—তুমি এখনও দুর্বল, ডাক্তার বলেছে বেশি চিন্তা করা মানা—”
“আঃ”, কী প্রসন্ন সুখে, কী ক্ষমার রৌদ্রে ভরে গেছে বাবার মুখ—”তুমি খুব চালাক, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছ। ভাবছ, এটাও আমার খেয়াল, নতুন একটা পাগলামি, কেমন? বেশ তো, তাই নিয়েই না-হয় থাকি, থাকতে দাও না। একটা কিছু নিয়ে থাকতে তো হবে? সবই কেড়ে নাও যদি, এই দ্যাখো আমি একা, আরও একা হয়ে পড়ছি, সবই কেড়ে নাও যদি, তবে কেন ওষুধ দাও রোজ? কেন দিচ্ছ বাঁচিয়ে রাখার যন্ত্রণা? “
দু’হাতে কপাল টিপে বাবা আবার শুয়ে পড়েছেন, দু’হাতে মুখ ঢেকে তুমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেছ। আমি দেখছি।
অনেক পরে, তখনও আমি দাঁড়িয়ে, টের পেলাম উনি আমাকে ডাকছেন। দুষ্টু দুষ্টু ধরনের হাতছানি। কাছে গেলাম। আমার মাথায় ওঁর হাত, ওঁর হাত আমার পিঠে। কয়েক বছর আগেকার সেই স্টেশনের রাতটা আবার ফিরে আসছে নাকি? আমার অভ্যন্তরে শিহরন, সম্মোহন, সব ঘটে যাচ্ছে।
“তোর মাকে আমি ঠিক কথাই বলেছি”–মিষ্টিমিষ্টি করে হাসছেন বাবা। “ও কষ্ট পেল, কিন্তু কী করব। আবার কষ্টটাকেও তো ভাগ করে দেওয়া চাই। এটা হল, পাশের লোকটার ওপরেও বোঝা চাপিয়ে দেওয়া, লোকে বাধ্য হয়েই যা করে। ধর, তুই আর আমি এক সঙ্গে অনেক দূর যাচ্ছি, সব ক’টা সুটকেস-বাক্স বয়ে নিয়ে যাচ্ছি আমি একাই। তবু খানিক পরে, যদি না পারি, যদি বুকে লাগে, তাহলে তোর হাতেও আমি একটা সুটকেস তুলে দিতে চাইব—চাইব না? এ হল তাই।” বলতে বলতে বাবা আমার দু’হাত চেপে ধরলেন, “আর পারছি না। আমার কষ্টভরা বাক্সগুলোর অন্তত একটা-দুটো তোরা তুলে নে।”
তখনও তিনি বলে চলেছেন, গলা তো নয়, দূর থেকে ভেসে আসা ঘড়ঘড় ঘড়ঘড়, আমি ব্যাকুল, আমি বিচলিত, বলছি, “কেন বাবা, আপনার এত কষ্ট কেন?”
“কষ্ট? কেন?” আমারই বাক্য থেকে বাবা শুধু দুটি শব্দ নুড়ির মতো কুড়িয়ে নিলেন, তখনই কোনও উত্তর দিলেন না। তারপর দম নিয়ে—”কষ্ট—কেন? এই বয়সে তুই কি বুঝবি? ধর, সকালে একদিন বেরিয়ে পড়েছিলি, সারা দিন টো-টো করে ঘুরেছিস, কোথাও এতটুকু জিরানো ছিল না, সন্ধ্যায় ফিরে এলি হয়রান হয়ে। দেখলি ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিচ্ছিস, দরজা খুলছে না, অথচ তোর পা কাঁপছে মাথা ঘুরছে। এ হল গিয়ে সেই কষ্ট। কিংবা মাঝরাত্তিরে কেউ ঠেলে দিয়েছে তোকে বাইরে, অন্ধকার, সব দিকে অন্ধকার, আকাশে একটা তারা নেই যে দিকের নিশানা পাবি, তুই সরে যাচ্ছিস, আরও সরে যাচ্ছিস—অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে; অথবা পায়ের নীচের মাটিই সরে সরে তোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও দূরে—বুঝেছিস—”
আমি পাতা ফেলছি না, ঘাড়ও নাড়ছি না।
“কষ্ট আরও আছে। যা করতে চাই, তা করতে না পারা। যা বলতে চাই, বলতে না পারা, অথচ কত কী বলার আছে, ভেতরে ফুলে ফুলে উঠছে। নিজের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখার যন্ত্রণা, একটা পাহারাদার যেন ফাটকের মধ্যে আটকে ফেলেছে নিজেকে। চাবি খুঁজে পাচ্ছে না, বুট ঠুকে ঠুকে পাগলের মতো বাঁধানো শানটা ফাটিয়ে দিচ্ছে। হাসি-কান্না, কথা সব নিকাশ হয়ে যাবে, রোজ ঘর ঝাঁট দিয়ে ধুয়ে ফেলার মতো, মানুষের মন তেমনই এক ঘর, নইলে সে সাফ থাকবে কিসে।” বাবা অস্থির হয়ে হাত নাড়তে থাকলেন—”অথচ আমি এসব কথা কিছুই বলতে-লিখতে পারছি না।”
“বেশ তো, লিখুন না।” আমি বলছি, “বাবা, সত্যিই আপনি আর কিছু লিখবেন না?”
ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বাবা বুঝিয়ে দিলেন—না। বালিশে পিঠ এলিয়ে দিয়ে বললেন—”বলেছি তো, অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
“কোনও দিন না?
“যদি লিখি তবে এই দেরি হওয়ার কথাটাই লিখব।” হঠাৎ দীপ্ত দেখা যাচ্ছে তাঁর মুখ—”লিখব, বুঝেছিস? লিখব! সেটা হবে আমার শেষ পালা। আমার শেষ পালাটা, ধর যদি এইরকম করে বাঁধি–বিয়ে করতে আসছে এক বর, তেপান্তর পার হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে—কিন্তু মাঝখানে এক পাহাড়; একবার একটা মরুভূমি, সে রাস্তা হারিয়ে ফেলল, চোখ জ্বলছে, চুল উড়ছে, মুখ শুকনো — শুনছিস?”
নকল উত্তেজনার ভঙ্গি করে বললাম, “বাবা, তারপর?”
“এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে সামনে পড়ল এক নদী, তার বুকে ভীষণ ঢল, বড় বড় গাছ উপড়ে, পাথরের পর পাথরের চাঙড় ভেঙে-চুরে গুঁড়িয়ে স্রোত ছুটছে। সে থমকে দাঁড়াল। কী করে পেরোবে, ঘুরে যাবে? এদিকে বেলা আর বেশি নেই। তখন যাচ্ছিল সেখান দিয়ে, পারঘাটার এক বুড়ি, সে বলল, ভয় নেই, পাহাড়ি ঢল তো! এক্ষুনি নেমে গিয়ে সব খটখটে শুকনো হয়ে যাবে, একটু দাঁড়াও। হলও তাই। পার হল সে, কিন্তু বেলা আরও বয়ে গেল। তাছাড়া ওপারে শুরু হল গভীর বন, সেখানে তখনই ছমছমে অন্ধকার, নানা দিকে নানা ডাকের কুহক, গর্জন, কলরব, রাস্তা চেনা যায় না, ঘোড়া যেন আর এগোয় না।”
“বাবা, বরটা পৌঁছতে পেরেছিল?” যত ছেলেমানুষি গলায় আমি বলছিলাম তত ছেলেমানুষ আমি আর নই, শুধু ইচ্ছা করছিল খুব খোকা খোকা হয়ে যেতে।
“পেরেছিল। কিন্তু তখন রাত্রি নেহাৎ চাঁদ উঠেছিল তাই সে কোনওরকমে পুব-পশ্চিম ঠিক করে ধরে বেরিয়ে এল।”
“তার মানে সে জানত কোন্ন্দিকে তাকে যেতে হবে?”
“জানত।” হঠাৎ খুশি হয়ে বাবা বিরাট করে পিঠ চাপড়ে দিলেন আমার। “ঠিক পয়েন্টটা ধরেছিস। পথ হারায়, হারাক, তাতে কী এসে যায়; কোন্ দিকে যেতে হবে, সেটা যদি জানা থাকে? সেটাই আসল কথা; সেটাই জানা থাকা দরকার।”
বাকিটা বাবা শেষ করলেন এইভাবে : “শেষ পর্যন্ত পৌঁছল সে, কিন্তু অনেক রাত, লগ্ন পেরিয়ে গেছে, বিয়ে বাড়িতে আলো জ্বলছে না। ওর ঘোড়াটা সওয়ার নামিয়ে দিয়ে ধুঁকছে, মুখে গাঁজলা। আর তার কনে—”
“তার কনে, বাবা, তার কনে?” যতটা পারি ততটাই উদগ্রীব হয়ে বললাম, হল সেই কনের?”
“বর শুনল, অনেক ডাকাত হামলে পড়ে তাকে কেড়ে নিয়ে চলে গেছে।”
“এই পালা?”
“আপাতত এই। এই পর্যন্ত ভেবেছি।” বলে বাবা একটু অপেক্ষা করলেন, “কষ্ট হচ্ছে?”
এড়িয়ে গিয়ে বললাম, “আর নেই?”
“কী থাকবে আর? লগ্ন পেরিয়ে যাবার পালা যে, বেলা বয়ে যাবার পালা। শেষ পর্যন্ত বর যদি-বা পৌঁছয়, কনে বসে থাকে না। বুঝতে পেরেছিস? লিখব হয়তো এটা, আমার শেষ পালাটা”–সংকল্প বাক্যটা উচ্চারণ করেই বাবা কিন্তু ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, কাঁপতে থাকলেন থরথর করে, “কিন্তু লিখব যে, কে পড়বে? এটাতে রূপকথার গন্ধ যে। একালে রূপ-কথা কেউ পড়ে না।”
“তবু লিখবেন।” একী? আমি কি আদেশ করছি? আদেশ, না আমি সান্ত্বনা দিচ্ছি তাঁকে?
“লিখব” বাবা সম্মতি দিলেন, কিন্তু প্রগাঢ় ক্লান্তি তাঁর স্বরে। “লিখব। কিন্তু যদি শেষ করতে না পারি, তবে তুই শেষ করে দিস, দিবি তো?” তুই—তুই ইচ্ছে হলে অবিশ্যি আর-একটু বাড়িয়েও দিতে পারিস, টেনে নিয়ে যাস আরও খানিক দূর। ওখানে দাঁড়িয়েই সেই বর মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা নেবে, ঘোড়াকে ফের তেজি করে তুলবে দাবড়ে দাবড়ে। তারপর কনেকে নিয়ে যারা পালিয়েছে পিছু নিয়ে তাদের ধরে ফেলবে পারঘাটায়। তারপর—তুই তো বুঝতেই পারছিস কী হবে তারপর। সেটা অবিশ্যি অন্য গল্প হবে। লিখবি?”
লিখব বলেছি কি বলিনি মনে পড়ছে না আজ কিছুই।