১০. তোমাকে লেখা, বাবার চিঠি

১০

তোমাকে লেখা, বাবার চিঠি। তুমি কি এতই সুদূর নিরাসক্ত হয়ে গিয়েছিলে মা, যে, চিঠিটার পাঠ যে ছিল “প্রাণাধিকাসু”, তা-ও খেয়াল করলে না, ওটা আমার হাতে দিতে একটুও কি সংকোচ হল না?

তখন অত সব বুঝিনি বা তলিয়ে দেখিনি, বুক ঢিপ্ ঢিপ্, মুঠোর মধ্যে দোমড়ানো নোট—আমি জড়ানো অক্ষরের জট ছাড়িয়ে যত তাড়াতাড়ি পারি পড়ছি। পড়া শেষ হল, চিঠিটা মস্ত খবরের মতো মুঠিতে ধরাই রইল, আমার চোখ দপ্ দপ্ করছিল, কথা ভীষণ উত্তেজনায় জড়ানো, অস্পষ্ট; বললাম, “মা, আমরা এখান থেকে চলে যাব। বাবা যেতে লিখেছেন।”

তুমি নিস্পৃহ, যেন তখনও বোঝনি, এইভাবে বললে, “কোথায়।”

“কলকাতায়। সেইখান থেকেই তো বাবা লিখেছেন। চাকরি পেয়েছেন, লিখেছেন। মানে নিয়েছেন।”

“কোথায়।”

বিরাট শব্দভাণ্ডারের ওই একটিমাত্র কথাই কি জানা তোমার, “কোথায়”, শুধু “কোথায়।”

জোর দিয়ে বললাম “থিয়েটারে, মুন থিয়েটারে। মুন থিয়েটার বুঝি খুব বড় থিয়েটার মা?”

“জানি না।”

“পড়োই না। আচ্ছা, আমি পড়ছি, তুমি শোনো। বাবা লিখছেন, ‘দক্ষিণে যাইব বলিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছিলাম, কিন্তু পুরীর পরে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হইল না। জ্বরে পড়িলাম। তার চেয়েও সর্বনাশ, ধর্মশালায় পড়িয়াছিলাম, একদিন সকালে উঠিয়া দেখি, সঙ্গে সামান্য যে-কয়টি টাকা ছিল, তাহা নাই। আমার জ্বর-বিকারের সুযোগে কে বা কাহারা লইয়া পলাইয়াছে। ভাগ্যে আলাদা করিয়া ফতুয়ার পকেটে পাঁচ টাকার একখানি নোট রাখা ছিল, উহারা বোধ করি সন্ধান পায় নাই। অর্থশোক নহে, যাহা গিয়াছে, তাহা তো সামান্য, গিয়াছে বেশ হইয়াছে, আমি সেইদিন চক্রতীর্থের সৈকতে দাঁড়াইয়া সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করিয়া, আনু, নূতন এক ভাবে আবিষ্ট হইলাম। জ্বর হঠাৎ সেদিনই যেন একেবারে ছাড়িয়া গেল, সেই সঙ্গে ছাড়িয়া গেল আমার অনেক দিনের কতগুলি ধারণা আর সংস্কারের ভূত। সঞ্চয়টুকু গেল, কিন্তু অন্য এক অনুভূতির সঞ্চয় যেন শিরায় শিরায় সঞ্চারিত হইয়া যাইতে থাকিল। আনু, তোমাকে কি তাহা বুঝাইতে পারিব, তুমি কি তাহা বুঝিবে?

‘আমার সম্মুখে সমুদ্র’ এতদিন সমুদ্রকে দেখতাম যেন বাধা-বন্ধনহীন সদাহাস্যময়—টুথপাউডারে দাঁত মার্জনা করিলে যেমন ফেনা হয়। আজ দেখিলাম সাদা নয়, লালও আছে—ফেনার সঙ্গে যেন দাঁতের গোড়ায় রক্ত মিশিয়াছে। আসলে অবশ্য সকালের সূর্য ঢেউয়ের জলে নিজের ছায়া দেখিয়া আহ্লাদিত হইয়া আপনাকে শতগুণ করিয়া গুলাইয়া ফেলিতেছিল বলিয়াই ওই দৃষ্টিভ্রম।

দৃষ্টিভ্রম? ভ্রমই বা কী করিয়া বলি। নূতন দৃষ্টি! আগে ভাবিতাম সমুদ্র মোহহীন, উদাসীন, ওই রক্ত দেখিয়া মনে হইল সমুদ্রেরও তবে কষ্ট আছে। আগে দেখিতাম সে মুঠা মুঠা ভরিয়া ঝিনুক ইত্যাদি যাহা কিছু তীরে ফেলিয়া ফিরিয়া যায়, চাহিয়াও দেখে না, কিন্তু সেদিন দেখিলাম, তাহা তো নয়, সে বারে বারে পাগলের মতো ফিরিয়াও আসে, আছড়াইয়া পড়ে, ভাঙে আকুল হইয়া। তাহার কাছে অন্তরীক্ষের চন্দ্র-সূর্যের আকর্ষণ যতটা সত্য, স্থির, তীরভূমির টানও ঠিক ততটাই সত্য। হয়তো যাহা রাখিয়া গিয়াছে তাহাকে আবার কুড়াইয়া লইতে চায়, হয়তো নিজেকে উজাড় করিয়া আরও দিতে চায়। তীরভূমি যে তাহাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারে না বরং নিজেই ক্ষইয়া ক্ষইয়া গলিয়া যায়, সেই ব্যর্থতা তীরভূমির নিজের। নহিলে অলক্ষ্য আকর্ষণে অস্থির সমুদ্র তো ধরা দিবে বলিয়াই, আপনাকে সমর্পণ করিবে বলিয়াই, আশ্রয় আর সান্ত্বনার আশায় ক্রমাগত তীরের বুকে মুখ গোঁজে।

‘সমুদ্রের বৈরাগ্য দেখিয়াছি। সেদিন প্রভাতের রক্তিমা দেখাইয়া দিল তাহার আসক্তি। যে ধীবরেরা ডিঙি বাহিয়া ঢেউয়ে ঢেউয়ে দূরে দূরে ছায়াসম হইয়া গিয়াছিল, দেখিলাম তাহারা ছড়ানো জাল গুটাইয়া ফিরিয়া আসিতেছে।

‘তখন স্থির করিলাম, আমিও ফিরিব। আমাকেও জাল গুটাইতে হইবে, ফিরিতে হইবে পাড়ে—ওই দৃশ্য তাহারই ইঙ্গিত। পাথেয় যা ছিল হিজলি অবধি আসিতেই ফুরাইল। সেখান হইতে গ্রাম গ্রামান্তর পাড়ি দিয়া, এখানে নদী, ওখানে বন, পার হইয়া, গৃহস্থের আতিথ্য গ্রহণ করিতে করিতে পদব্রজে অবশেষে কলিকাতা।

‘শিরোনামের ঠিকানা দেখিয়াছ তো? আনু, আমি কাজ লইয়াছি মুন থিয়েটারে। ঠিক থিয়েটারে নয় অবশ্য, থিয়েটার-সংলগ্ন ছাপাখানায়, উহাদের নিজেদেরই ছাপাখানা থিয়েটারের পোস্টার, হ্যান্ডবিল, প্রোগ্রাম, এমন কী কখনও কখনও নাটক-টাটকও এখানেই ছাপা হয়। অগত্যা এইখানেই। কেন না, অন্যান্য জায়গায় চেষ্টা করিয়া দেখিয়াছি, সুবিধা হয় নাই। যে-সব ব্যবসায় আমার সহায়তা আর উদ্যোগে স্থাপিত হইয়াছে, ধরো ইনডিয়ান ট্রাঙ্ক কোম্পানি, এখনও যাহারা স্বদেশির নাম ভাঙাইয়া দিব্য ফলাও ব্যবসায় ফাঁদিয়া লইয়াছে, দেখিলাম আমাকে তাহারা আর চিনিতেই চায় না।

“কিংবা, তোমার মনে আছে তো, সেই ন্যাশনাল সোডা, সেই মিলেনিয়াস ইন্ডিয়ান ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি—সংক্ষপে এম-আই-এম অর্থাৎ “মিম” আমারই প্রতিষ্ঠিত, টাকাটা অবশ্য এক বন্ধু সঞ্জীব রায়ের, আর চাঁদা তোলা, কিন্তু শ্রম আমার—সেই “মিম্”-এ প্রথম তৈয়ারি হইল “নবীন লেমোনেড” আর “মধু লেমনস্কোয়াশ”

(কারণ দেখিয়াছিলাম কিনা যে বিলাতী সব কয়টি সোডা ইত্যাদিরই কবির নামে নাম, বায়রণ, মিলটন বা স্পেনসার, তাই আমাদের পণ্যেরও দেশীয় কবিদের নামে নামকরণ করিয়াছিলাম।)

—ভাবিতাম স্বদেশি জাগরণের হেতু খুব কম চলিবে, রোজ গড়ের মাঠে র‍্যামপার্টের আশেপাশে পাঠাইতাম, কত বন্ধুবান্ধব যে নিত্য আসিয়া খাইয়া যাইত, দাম দিত না, কেবল হিসাবটা টোকা থাকিত জাবেদা খাতায়—আরও কত কী তৈয়ারি করিব সাধ ছিল, কিন্তু জেলে গেলাম, বাহির হইয়া আসিয়া ভারত ভ্রমণে, আসিয়া দেখি, কোথায় সেই স্বদেশি শিল্প মিম্‌কো? কারবার আগেই বেহাত হইয়া গিয়াছে, এখন তালা ঝুলিতেছে।

তারপর সেই “কবরীকল্যাণ তেল”, তোমাকে একশিশি দিয়াছিলাম, মনে পড়ে। আর ছিল “সৌন্দর্য মলম” (ইংরেজিতে বিউটি বাম), জোর চলিতেছে, কিন্তু যাহারা গুছাইয়া লইয়াছে তাহারা আমাকে স্থান দিল না। বাড়তি ভাগীদার আর চায় না। গান্ধি-আরউইন চুক্তির পর এখন আন্দোলন বন্ধ যে। ভাবিতেছি ইহার চেয়ে বরং বিপ্লবী হওয়া শ্রেয় ছিল, না-হয় দ্বীপান্তরই হইত কিংবা ফাঁসি, কিন্তু বিশ্বাসী বন্ধুদের এই প্রতারণা।

‘অবশ্য ইহাও হইতে পারে, আমিই ভুল বুঝিতেছি। যে-অশান্ত প্রণবকুমারকে ইহারা চিনিত, আমি তো আর সে নই। শ্রান্ত, আশ্রয়প্রার্থী এই প্রণবকে দিয়া ইহাদের প্রয়োজন নাই।

‘তাই মুন থিয়েটার—অগত্যা। কাজটা খারাপ নয়, আমাকে মোটামুটি এই প্রেসটার ম্যানেজারই বলা চলে, বেতন আপাতত পঞ্চাশ। বাহিরের কাজ আনিতে পারিলে কমিশন। তাছাড়া থিয়েটারমহলের সঙ্গে, জানাশোনা মঞ্চের সঙ্গে, একটু সংযোগ, বলা যায় না, ইহাতে ভবিষ্যতে আমার বোধহয় সুবিধাই হইবে। কী সুবিধা, চিঠিতে তাহা আর খুলিয়া লিখিলাম না। এখানে তোমরা আসিলে বলিব।

‘তাড়াতাড়ি চলিয়া আসিও। ত্রিশ টাকা পাঠাইলাম। রেলভাড়া তো পাঁচ টাকার মতন। বাকিটায় যাহার যা পাওনা চুকাইয়া দিয়া আসিও—যত শীঘ্র পারো। যাত্রার দিন ঠিক হইলে জানাইও, স্টেশনে থাকিব।

‘মোটের উপর আর পারিতেছি না। বয়স হইতেছে, পাইস হোটেলের খাওয়া আর সহে না। তা-ছাড়া, একটু বিশ্রাম চাই। একটি বাসা দেখিয়া রাখিয়াছি, তোমাদের পত্র পাইলেই ঠিক করিয়া ফেলিব। আনু, এতদিন পরে নিজেদের একটি নীড় রচনা করার স্বপ্ন তুমি নিশ্চয়ই সফল করিয়া তুলিবে। তুলিবে না?”

.

চিঠিতে আরও কয়েক ছত্র ছিল, আমার সম্পর্কে প্রশ্ন, শুভাশীর্বাদ ইত্যাদি। কিন্তু যে-ই আমার এই পর্যন্ত পড়া হল ‘তুলিবে না?—’ অমনিই মা তুমি ছিনিয়ে নিলে কাগজ কয়টি, ছিঁড়ে ছিঁড়ে বললে, “মিথ্যে কথা।“

কী শুকনো গলা তোমার, কী অপ্রত্যয় দীপ্ত চোখে অনির্বাণ হয়ে উঠছিল। বললে, “মিথ্যে কথা। বিশ্রাম, শান্তি ওসব কিছু না। শুধু কথার চালাকি। যেভাষায় ও পালা লেখে সেই পালারই কয়েকটা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে পাঠিয়েছে।”

উঠোনে শুকোতে দেওয়া কাঁচা মুগের উপরে কয়েকটা চিল ছায়া ফেলেছিল। ডালাটায় ডালগুলো তুলে ফেলতে ফেলতে আরও কঠিন হয়ে উঠলে তুমি। বলে উঠলে, “যাব না, কিছুতেই না। সব হবে ওর ইচ্ছেমতো! চিরদিন আমাকে নিয়ে যা-ইচ্ছে করেছে, সব মুখ বুঝে সহ্য করেছি। সমুদ্র-টমুদ্র ও-সব দুদিনের খেয়াল, হঠাৎ যা মনে হল তাই লিখেছে। এখানে তবু যা-হক একটা স্থির জায়গায় আছি, মাথা গুঁজে আছি নিজের বাড়িতে, কলকাতায় সবসুদ্ধ টেনে নিয়ে গিয়ে আবার কোন্ বিপদের মধ্যে ফেলবে কে জানে। যদি ও আবার পালায়? সমুদ্র না-হয় এবার ফিরিয়ে দিয়েছে, ওকে যদি ঝড় ডাক দেয়? দ্যাখ, ওসব কাব্য করতে আমিও জানি আমি ওকে চিনি। আমি যাব না। আমাকে পুরোপুরি ও নিজের কবলে নিতে চাইছে—আমি বুঝি না।”

বলতে বলতে মা, তুমি চিঠিটা ছিঁড়লে কুটি কুটি করে। কী ভাগ্য যে ঝোঁকের মাথায় নোট ক’টাকে ছেঁড়োনি।

(শুধু তোমার নয়, সব মানুষেরই বরাবর দেখেছি এক রীতি। তার একটা ভাগ অন্ধ, বেহিসেবি, অগ্রপশ্চাৎ কিছুমাত্র বিবেচনা নেই তার—আর একটা অংশ ওরই মধ্যে সংগোপনে সতর্ক সাবধানী।)

.

“যাব না কিছুতেই”, ওটাও কিন্তু তোমার শেষ কথা নয় মা। যে নিয়মে চিঠি ছিঁড়েও নোটগুলো তুমি বাঁচিয়েছ, সেই বিচিত্র নিয়মেরই একটা রকমফেরে কলকাতায় যেতে তো তুমি চেয়েছ। না, শুধু ওখানে একটা বাসা বাঁধার লোভে নয়। আসলে এই জায়গাটা ক্রমশ কেমন শূন্য হয়ে যাচ্ছিল। দাদা—নেই। সুধীরমামার প্রস্থান—অভ্যস্ততায় আর একটা ছেদ। তুমি আর একটা অভ্যাসে পৌঁছনো যায় কিনা, মনে মনে তারই জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠছিলে, তখনই বাবার চিঠি। অতো জোরে জোরে যে বলেছ ‘না–না–না’ সে কি ওই আকুলতাই চাপা দিতে? হায় মন, হায় তার তত্ত্ব। আমি তার কিছু যদি-বা বুঝি, বেশিটাই বুঝি না।

না, একা আমাকে নিয়ে তুমি পূর্ণ হয়ে উঠছিলে না। দাদার জন্যে হা-হুতাশ, আমার জন্যে স্নেহ, একটি আগন্তুক সম্ভাবনার বিনষ্টি, বাবার অদর্শন, সুধীরমামার অন্তর্ধান, এ-সব মিলেও তোমাকে সর্বক্ষণের জন্যে ব্যাপৃত করে রাখতে পারেনি, কেন না এত রেখে ঢেকে বলে আর কাজ কী মা, তুমি তখনও যুবতী।

তুমি তখনও অবিগতবয়সি, সেটা আমি এখন হিসেব করে খতিয়ে দেখে বলছি। নইলে, এই চিঠির গোড়ার দিকেই তো বলেছি, তোমাকে কোনও বয়সেই আমি যুবতী ভাবতে পারিনি। মা—আমার কাছে শুধুই মা—যিনি মা, তিনি নিজে যে আবার যুবতী হতে পারেন, অন্তত হতে পারতেন, এই সব চমক লাগানো রূঢ় শলাকা সেই বায়বীয় বয়সের ধারণাকে বিদ্ধ করেনি। অথচ দ্যাখো, তোমার তখন যে বয়স, সেই বয়সের নারীদের আমি পরবর্তীকালে প্রার্থনা, এমন কী কামনা করেছি। বয়স শুধু দৃষ্টিশক্তি নয়, দেখার ভঙ্গিটাকেও বদলে ফেলে। মার্জনা কোরো, যদি অসহ্য লাগে এই স্বীকারোক্তি।

শুধু শোকে নয়, শুধু বাৎসল্যে নয়, তখন কত রাত্রি তোমার ঘুম হত না। শর-শয্যার গল্পটা মহাভারতের লেখক কোথা থেকে পেয়েছিলেন জানি না, আমি তো পরে জেনেছি, বিনিদ্র অন্ধকার রাত্রির নামই শরশয্যা, প্রত্যেকটা তারা এক একটা তীক্ষ্ণ তীর—শুধু কি পিঠে?—বুকেও বেঁধে?

তখন জানতাম না, তোমার শরশয্যায় শয়ন প্রত্যেক রাতে, সেখানে আমি নেই, আমি না, আমরা কেউই-ই কিছু না।

কিন্তু মা, তুমিও আমার কাছে ক্রমে-ক্রমে কিছু-না হয়ে উঠছিলে? ঠিক কবে থেকে, মনে পড়ে না। একটু চঞ্চল হতে শুরু করেছি, সে তো কলকাতায় গিয়ে। রিনরিনে গলা শুনলেই মাথা ঝিনঝিন করা, গালে ফুসকুড়ি, চোখে গর্ত—এ-সব অনেক পরে। লজ্জার বালাইটুকু বিলিয়ে দিয়ে চুপে চুগে জিজ্ঞাসা করছি; একদিন সকালে বিছানা তোলার সময়ে আমার চাদরে একটা দাগ দেখতে পেলে, মনে পড়ে? খুব যখন ছোট, তখনও বিছানা ভিজিয়েছি—সে অন্য রকম। তখন বকুনি খেতাম। সেদিন বকুনি খেলাম না তো, তুমি যেন কী রকম চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে ছিলে। আমি বড় হয়ে উঠছি, সেই ভয়ে?

.

এ-সব কথার দিন তো পড়ে আছে, আগে তখনকার পালা শেষ করি। আমাদের ওখানকার পাট তোলার কথা বলি।

তুমি কলকাতা যেতে চাওনি, আবার ওখানে থাকতেও পারছ না, তলে তলে অস্থির হয়ে উঠেছ, এই পর্যন্ত বলেছি। সেই তুমি। আমি, সুধীরমামা আর বাবা, এই ত্রয়ীকে নিয়ে তুমি। একজনকে ভালোবাসো : একজন ভালোবাসত তোমাকে, আর-একজন তোমাকে তীব্রভাবে টানছে—এই টানা-পোড়েনে বিশৃঙ্খল তোমাকে আমূল অসহায় দেখেছি।

চলে যাবে, মুছে যাবে এখানকার স্মৃতি, এখানকার সব কিছু মুছে দিয়ে যাবে। আমরা তৈরি হচ্ছি। কলকাতায় চিঠি গেছে। আমার নামে। বাবাকে। যেন স্টেশনে থাকে। বাঁধাছাদা সারা। কী আশ্চর্য দাদার সেই ফোটোটা? মা, ওটা নামিয়ে নিতে অত দেরি করলে কেন তুমি, তোমার হাত কেন কাঁপছিল, সেটা না-হয় বুঝলাম—স্নায়বিক অধীরতা। কিন্তু—

পাড়তে গিয়ে কাচ কেন ভেঙে গেল খান্ খান্ হয়ে, অবাক অবোধ আমি তার অর্থ বুঝতে পারছিলাম না। এ কি অসতর্কতা? এ কি এখনকার কালো পরকলা পরে ব্যাপারটা দেখে জিজ্ঞাসা করছি—এ কি দৈব অথবা ইচ্ছাকৃত? তার নির্দেশ, আমরা যাকে অবচেতন বলে থাকি। এ কী এখানকার চিহ্ন লোপ করে নিজ্ঞানে নতুন হবার বাসনা? ফোটোর কাচগুলো আমার চোখে ফুটছিল। আর ছবিটা কুড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখি, উই ধরে ঝরঝরে। মা, এতদিন তোমার কি লক্ষ ছিল না, অথবা সময়ের দস্যুতার মুখে আমরা সবাই ফতুর, সব ঝুরঝুর, ফোটোর কাগজ, দেয়ালের চুন-বালি-আস্তর, সব?

অতএব দাদা আমাদের সঙ্গে গেল না।

সেই স্টেশন, যেখান থেকে একদিন ফিরে এসেছিলাম। সেই ট্রেন, যে ট্রেনে সেদিন বাবাকে তুলে দিলাম। গাড়িটা দুলে উঠল, গাড়িটা ছাড়ল, টের পেলাম, আমরা সব ছেড়ে যাচ্ছি, আমরা দুজনে দাদাকে, এখানকার সব কিছুকে। অথবা রেখে যাচ্ছি—আমাদের দুজনকেও।

আসলে আমরা, পরে জেনেছি মা, কিছুই কখনও সঙ্গে নিই না, নিজেকেও না। সব রেখে রেখে ফেলে ফেলে যাই, অথচ ভাবি বুঝি কিছুটা নিলাম। যা নিই, তার নাম স্মৃতি, বিবর্ণ একটি ছবি, মৃত, দীর্ঘকাল পরে যার পাঠোদ্ধারও করা যায় না, এমন বিবর্ণ কোনও প্রাচীন লিপি।

আমরাও সেদিন ওখানে সব কিছুকে রেখেই চলে এসেছিলাম। বাঁধাটাধা অতএব সব মিথ্যে, বাক্স-পুঁটুলি সব ভুয়া বোঝা, নিজেকে ঠকানো। আজ তো জানি, প্রতি যাত্ৰাই এক অর্থে শবযাত্রা, কোনও শব কোনও দিন কি সাদা আবরণ-বস্ত্র, পুষ্প প্রভৃতি সঙ্গে নেয়? ওগুলো শুধু মন সাজানো।

আমরা যাচ্ছি, কিন্তু যে-আমরা ছিলাম তারা থেকেই যাচ্ছি যদিও। যারা চলল তারা নতুন কিছু হতে চলল। চলল নতুন কিছু তৈরি করে নেবে বলে।

আগের বারে, যখন যাওয়া হল না তখন কত কেঁদেছিলাম। আর এবারে, সত্যি-সত্যি যখন বিদায় নিলাম, তখন আশ্চর্য, চোখে এক ফোঁটা জল এল না। লিখেই ভাবছি ওই ‘আশ্চর্য’ কথাটা কেটে দিই। আশ্চর্য আবার কী, কিছুই আশ্চর্য নয়। মানুষের জীবনে সব কিছুর বরাদ্দ রেশনের চাল-চিনির “কোটা”র মতো মাপা থাকে—হাসিকান্না, প্ৰেম প্রভৃতি সব কিছুর। নির্দিষ্ট-মাত্রা পূর্ণ হলে পরের জন্যে কিছু বাঁচে না। যেমন, মা, তুমি সেবার পাড়ার দলের সঙ্গে চূড়ামণি যোগে স্নান করতে গিয়েছিলে, যে-দিন ফেরার কথা ছিল সেদিন ফেরোনি বলে পিসিমাদের ঘরে শুয়ে আমি কত কান্না কেঁদেছি। যখন তোমাদের ফেরার কথা, ফিরলে না; যেদিন আসার কথা ছিল সেদিনও পেরিয়ে গেল। প্রতিটি পায়ের শব্দে আমি চমকে উঠেছি, বারে বারে দৌড়ে যাচ্ছি বাইরে, ফিরে এসে ছটফট ছটফট আর চোখ ছাপিয়ে জল।

ওটা তখন অপর্যাপ্ত ছিল। ক’দিন তোমাকে দেখতে পাইনি বলে সেবার কত চোখের জল ফেললাম, আর এই তো ক’বছর আগে, যেদিন জানলাম, আর কোনওদিন দেখতে পাব না?—তার সিকির সিকিও না। জানি না তুমি, তুমি উপর থেকে সেটা দেখতে পেয়েছ কি না। ক্ষমা করেছ? যদি না করে থাকো, তবে দোহাই, আমাকে নয়, দায়ী করো, আমার পরের বয়সকে, যখন আঙুলের গিঁটে গিঁটে কড়া পড়ার মতো মনেরও গিঁটে গিঁটে কড়া পড়ে। জলের উৎস শুকিয়ে যায়। ওই যে বলেছি, রেশনের মাপা বরাদ্দ, কান্নার কোটা! ওটা আমাদের, অধিকাংশ পুরুষের বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় কিনা! বেহিসাবি বাবুদের মতো চোখের জলের পুঁজি কম বয়সেই খরচ করে ফেলি, বাকি জীবনের জন্যে কিছুই বাঁচে না, তখন শুধু ফুটিফাটা মাঠের বুক চিরে বেরিয়ে আসা বাতাস, তপ্ত দীর্ঘশ্বাস, মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠা, বিনা তেলের পলতের মতো চোখের শুকনো পাতা পোড়ানো—কিন্তু কান্না না। পরিণত কাল সকলের পক্ষেই নিঃসঙ্গ, নিস্তৃণ, শূন্য, কিন্তু পুরুষদের পক্ষে আরও বেশি, একটা নিরশ্রু অস্তিত্ব।

তাই মা, আমার প্রগাঢ় যৌবনে তোমার মৃত্যু হল’ কিন্তু তেমন করে কাঁদতে পারলাম না।

.

ট্রেন চলছে। তুমি একটানা জপ করে চলেছ। মাঝে মাঝে দোলানিতে আমার গায়ে এসে পড়ছ। জপ থামিয়ে আঙুল দিয়ে দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিচ্ছিলে বাইরের যা-কিছু আমাদের সঙ্গে চলছিল বা পাল্লা দিতে না পেরে পিছিয়ে পড়ছিল। কোনওটার মানে কী জানতে চাইছিলে। দূরের বক; কাছের ধানের ক্ষেত, লাইনের ধারের নালায় ফোটা ফুল, আলের রাস্তায় হুমহুম পালকি, অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের চেনা হয়ে যাচ্ছিল। ডাকগাড়ি, সব স্টেশনে দাঁড়ায় না, যেখানে না দাঁড়ায় সেখানকার মানুষেরা কেমন নির্বাক নালিশ নিয়ে চেয়ে থাকে।

এইভাবে বিকেল এল। কোন্ একটা বড় স্টেশনে গাড়ি দাঁড়াতেই একজন লোক একটা বালতি আর পিতলের জগ্ নিয়ে “হিন্দু পানি হিন্দু পানি” বলে হেঁকে গেল, চা সিগারেট, নানা সুরে হাঁকাহাঁকি আরও কত কী। একটা লোক যখন গাড়িতে উঠে যেখানটায় লেখা আছে “কুড়িজন বসিবেক” সেখানে পিঠ ঠেকিয়ে বক্তৃতা দিতে থাকল তখন মজায় আমোদে তোমার চোখ জ্বলজ্বল, ঘোমটা একটু সরিয়ে তুমি দেখছিলে। তখন তোমাকে লাগছিল নতুন- বিয়ে-হওয়া লাজুক বউটির মতো। কামরায় অনেক লোক, তাই ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বললে, “ওর ঝুলিতে কী রে? কী বলছে এতছড়া কেটে কেটে? “

“মিষ্টি মশলা, মা। “

,

এ-গাড়িতে আমিও নতুন, তবু আমি সব জানি। তোমার তুলনায় তখনই আমি বড় হয়ে গেছি। “ব্যাটাছেলে যে!” আমার গাল টিপে তুমি আদর করে বললে।

লোকটা দেখছিল, ভরসা পেয়ে এগিয়ে এল—”নেবেন মা? নিন না। এক প্যাকেট এক পয়সা, তিনটে নিলে দু পয়সা।”

তুমি আঁচলের খুঁট খুললে। মশলাটা এক রতি মুখে পুরে বললে, “কী ঠান্ডা রে! যেমন ঠান্ডা, তেমনি মিষ্টি। আমরা পানের সঙ্গে অবিশ্যি জয়িত্রি, জায়ফল, এলাচ, এইসব খেয়েছি। কিন্তু এর কাছে কিছু লাগে না।“

লোকটা খুশি হয়ে বলল, “আর দেব মা?” তুমি ফের আঁচল খুলে কিনে ফেললে পুরো এক আনার। ফলে একটু পরে একটা অন্ধ ছেলে যখন গাইতে থাকল “অন্ধকারে অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে রে—” তখন তুমি চোখ মুছে বললে, “থিয়েটারে এ-গান শুনেছি। কোন্ পালাটায় যেন? তোর বাবা জানে। কিন্তু আমার কাছে আর তো ভাঙানি নেই রে, তোর কাছে কিছু আছে?”

.

আমি সব স্টেশনের নাম পড়তে পড়তে যাচ্ছিলাম, চেষ্টা করছিলাম যাতে মুখস্থ থাকে। সে কি সহজ ব্যাপার। ধরে রাখতে পারি না, যেন পিছলে পিছলে যায়। একটা ছবি মনে গেঁথে গেল। একটা স্টেশনে সবে সন্ধ্যা হল। রোদ্দুরের শেষ রেশ টালির ছাতের ইঁট-রঙের সঙ্গে এক হয়েছিল। দু’ একটা ফুল ছিল তারের বেড়ার সঙ্গে লেপটে থাকা গাছে। গেট পেরিয়ে নিচু জমি, একটাই মেঠো পথ। সেখানে মোটে একজনই নেমেছিল। নেমে এসে টিকিটবাবুর পাশ কাটিয়ে মাটির রাস্তাটা ধরেছে, আর পিছন ফিরে সেই টিকিটবাবু চেঁচাচ্ছেন, “ও মশাই, কই চলছেন, শুনছেন—ও মশাই।” শেষ বেলায় দুপুরের পাতিহাঁসকে ডাঙায় তোলার জন্য মেয়েরা যেমন সার করে করে ডাকে—চৈ-চৈ-চৈ, ঠিক সেরকম গলা।

গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল। টিকিটবাবু নাগাল পেয়েছিলেন কিনা জানিনা। কিন্তু সামান্য ওই ব্যাপারটা কাঠখোদাই ছবি হয়ে আছে। কেমন যেন, আমরা ইদানীং যাকে বলি প্রতীক, তার মতো। এখনও যদি ট্রেনে চড়ি আর কোনও একটা স্টেশনে হঠাৎ সন্ধ্যা নামে, ভারী লোভ হয় নেমে পড়ি-আচ্ছা নেমেই যদি পড়ি অজানা এই জায়গাতে? ধূসর পরিবেশের ভিতর দিয়ে ছুটছি, ঠিক নেই কোন্ দিকে যাচ্ছি, লোভ হয়, ভারী লোভ হয়, তা-হলে? পিছন থেকে কোনও টিকিটবাবু কি হেঁকে হেঁকে ডাকবেন, শুনছেন, ও মশাই শুনছেন? তিনি ডেকেই চলেছেন আর আমি ছায়ার পুকুরে সাঁতরে সাঁতরে যাচ্ছি, আমি অনির্দিষ্ট কোনও সন্ধ্যায় আকস্মিক নেমে-পড়া এক যাত্রী, নিজের এই ছবিটা সম্মোহিত হয়ে দেখি। জানি, ওটা শুধু স্বপ্ন, ওটা শুধু সাধ, এই মাপা-জোকা হিসাবি জীবনে ওই অসম্ভব সাধ কখনও পূর্ণ হবে না।

১১

সূর্যাস্তের আলো যত পিছিয়ে গেল, ট্রেনটা মরিয়া হয়ে উঠল তত। একটা কমলা রঙের বল যত ফসকে ফসকে গড়িয়ে যাচ্ছে, একপাল শিকারি কুকুর ক্ষেপে তাড়া করছে তত।

রেলে চড়ে যতবার পশ্চিমে গেছি, ততবারই সন্ধ্যার মুখে মুখে এই ব্যাপার ঘটতে দেখেছি।

সেদিন বাইরে হঠাৎ একটা বাঁকের পরে দেখলাম মালা, তারার পর তারার মালা। আকাশটা চৈত্র মাসের বকুল গাছ হয়ে গেছে নাকি? হাওয়ায় হাওয়ায় সব ফুল ঝরিয়ে দিয়েছে নীচে? না। তারা তো নয়, আলো। বিজলির আলো—তীব্র; চোখে ধাঁধানো। কলকাতা কাছে এসে পড়েছে।

এতক্ষণ তুমি কেমন একটু উদাস, হয়তো-বা খানিকটা উৎফুল্লই ছিলে, হঠাৎ দেখি তুমি ধীরে ধীরে আবার শক্ত হয়ে উঠছ। এক সময়ে দেখি জোরে আমার কাঁধ চেপে টেনে আনছ। টিনের ছাপে টপ টপ বৃষ্টি পড়ার মতো তোমার এক-একটা কথা শুনছি।—”এই, সাবধান। ওখানে ও কেন আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে জানি না। আমার ভীষণ ভয় করছে, মনে হচ্ছে কোনওদিন আর ফিরব না। তোকে—তোকেও হয়তো ও খুন করে ফেলবে, তুই—তুই ওর হয়ে যাবি, আলাদা হয়ে যাবি। এই দ্যাখ আমার শরীর কাঁপছে, ধড়ফড় করছে বুক, হাতটা জোর করে চেপে ধর। ধরে থাক, থাক না! আমাকে ছুঁয়ে বল যাই ঘটুক, যাই আসুক, আমি আর তুই একই থাকব, আমাকে কোনওদিন ছাড়বি না?”

না বুঝে বলেছিলাম “ছাড়ব না।”

“মার ছেলেই থাকবি, বাবার হবি না, বাবার মতো তো কখনই না।”

প্রতিজ্ঞা করলাম, “কখনো না।”

কিন্তু মা, সেই প্রতিজ্ঞা থাকেনি। সেদিন তুমি জানতে না, আমিও বুঝিনি। বুঝিনি যে, আমি তোমারও থাকব না, বাবারও হব না, আমি হয়ে যাব আর একজনের—কলকাতার। তার মমতা, মর্ম, হৃদয় এসব আছে কিনা জানিনে, কিন্তু খুব আবর্ত-প্রখর রূপ আর অহরহ মুখরতা আছে। তুমি নও, বাবাও না, সেই বিশালাকার ঘনশ্বাস বিলাসিনী আমাকে তার রূপ-রস-গন্ধ- মোহের দহে নিমজ্জিত করবে।

সেই রূপ! আর দেখি না। সেই গন্ধ! আর পাই না। আমার চোখ গেল আর নাক গেল, না সেই রূপ আর গন্ধ উবে গেল? তখন কিন্তু পেতাম। চুন-বালি, নর্দমার ঝাঁঝরি, আলোয় আলোয় বিজ্ঞাপিত লেখা, কালো পিচের সপাং বিনুনি সব ঝিম ধরিয়ে দিত, অবশ করত, যদিও এবং তখনও নগর জীবনের গভীরে ডুব মারিনি। সবে উন্মোচিত হচ্ছে মাত্র, সবে স্বাদ পাচ্ছি।

.

জমকালো স্টেশনে বাবাই এসেছিলেন। তুমি ঘোমটা-টানা জবুথবু, ওখানেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলে।

বাবা বললেন, “উহুঁ হুঁ, এখানে নয়, এখানে নয়। এখানে রাস্তাঘাটে লোকের সামনে কেউ পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে না। লোকে হাসে। চেয়ে থাকে। তাছাড়া উপুড় হয়েছ কি ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। দেখছ না, কী ভিড়, কী ভিড়! অ্যাই কুলি—উধর নেহি, ইধর ইধর –”

বাবা একটু বদলে গেছেন। আমাদের সেই দেশের বাড়িতে যেমন দেখেছি, তার চেয়ে একটু রোগা, কিন্তু অন্য দিকে আলাদা, যেন কমবয়সি, বলতে কী সেই হৃষ্টপুষ্ট ভাবটা কেটে যেতে বাবাকে একটু কম রাগীরাগী লাগছিল। জোড়া ভুরুর মাঝখানে আঁচিলটা আছে কিনা আমি লক্ষ করছিলাম।

বাবা এক হাতে আমাকে ধরেছিলেন, অন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন তোমার দিকে, তুমি সরে যেতে গিয়ে ঠোক্কর খেলে, বাবা বললেন, “ধরো ধরো, এখানে ও-রকম কলাবউটি হয়ে থাকলে চাপের তলায় চেপটে যাবে।”

কিন্তু মা, তুমি তো কলা-বউটি ছিলে না। তোমার ঘোমটা নিজে থেকেই কখন অন্যমনস্ক, ঘাড় তুলে তুলে, মুখ এদিক-ওদিক ফিরিয়ে তুমি অবাক হয়ে চাইছিলে। বাবা তাড়া দিলেন, “সামনের দিকে তাকিয়ে চলো, নইলে হোঁচট খাবে, এখানে তাই নিয়ম।”

আমি কিন্তু শক্ত করে ধরেছিলাম বাবার কব্জি। কোন্‌টা নিয়ম? সামনে চেয়ে চলা, না হোঁচট খাওয়া, ঠিক ধরতে পারছিলাম না।

মা, তুমি খালি আড়চোখে তাকাচ্ছ আমি কোথায়, আমাকে ইশারায় বলছ তোমার কাছ ঘেঁষে চলতে, বাবা ধরেছেন তোমার হাত, আর আমি ধরব বলে খুঁজছি বাবারটা, এইভাবে তিনজনে মিলে কলকাতায় আমাদের প্রথম পথচলা শুরু হল।

আজ পিছন ফিরে ভাবছি, ওটাও একটা প্রতীক না-তো! সজ্ঞানে মা, সেই কি প্রথম আমি তোমার হাত ছাড়লাম, খুঁজলাম আর-একজনের? টিনের দোচালার ঠিক নীচে প্রচণ্ড একটা শক্তিকে হেঁইও বলে কষে রাখা ইঞ্জিন, তার ধোঁয়া—অন্তরের কালিমা তার সোঁ-সোঁ বাষ্প–ভিতরের জ্বালা, এই সব নিয়ে শহরটার চেহারা ফুটছিল, আর সেই গমগম ঘরে সর্বক্ষণ একটা অদ্ভুত আওয়াজ, যা বাড়ে কমে, কিন্তু কখনও থামে না, তার গোপনে কোনও প্রাণকেন্দ্র থেকে অবিরত উত্থিত হচ্ছিল।  

এই শব্দ আমি দীর্ঘকাল ধরে শুনেছি, অনেক রাত্রে কান পেতে পেতে, যখন শেষ ট্রামও চলে গেছে তখন মাটির তলাকার ঝর্ঝর ধারায়। গ্রামে যেমন ঝিঁ ঝিঁ পোকা, রাত্রের কোনও রাত-জাগা পাখি, দুরের শেয়াল, খালপাড়ের আটচালায় সংকীর্তন, এই শহরের তেমনই নিজস্ব কিছু সরগম আছে, অনর্গল একটা স্রোত, তার সঙ্গীতের আকার অন্যরকম।

মা, তুমি মৃদুস্বরে বলেছিলে, “ইস্, আগেও তো এসেছি, সেই যে মামিমাদের সঙ্গে ছেলেবেলায় একবার। তখনও মানুষে গিজগিজ করত, কিন্তু এখন আর চেনা যায় না। এখানে কত লোক হবে—দশ হাজার?”

“দশ হাজার কী বলছ, তার একশো গুণ কি দুশো গুণ কি তারও বেশি। আন্দাজ করো। তখন স্রোত ছিল, এখন সমুদ্র।”

“তোমার সেই সমুদ্র!” তুমি ম্রিয়মাণ হাসলে—”সমুদ্র আমি দেখিনি, একবার দেখব।”

“কুলি, কুলি, অ্যাই কুলি”, বাবা এগিয়ে গেছেন কুলিটাকে ধরতে। এখানে ওঁকে আলাদা লাগছে কেন এবার বোঝা যাচ্ছিল, এই শহর বিরাট বটে, কিন্তু এখানে বাবাও সপ্রতিভ, কী চটপটে, চতুর, অনায়াসে সব কিছুর মধ্য দিয়ে চলাফেরা করছেন, আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।

(তখন কি জানি, এ-সব কিছুই না, তুড়ি মেরে শহুরেপনার চূড়ায় চড়া যায়, কিন্তু চড়ার পরে আর মজা থাকে না, আমিও তো চড়ে দেখেছি, এখনকার শল্যবিদ্যার ভাষায় কৃত্রিম হৃদয় সংযোজন করে তার স্পন্দন শুনেছি, কিন্তু হৃৎপিণ্ড আর প্রাণ এক না। ও কেবল একটা কথার ঘরানা, হাসির চালাকি, পালিশের ঝকমকি, জুতো থেকে কণ্ঠ-বন্ধনীতে জুতসই একটা চৌকস ব্যক্তিত্ব, প্রয়োজনের পর প্রয়োজন বাড়ানো, তৃপ্তিকে চিতায় চড়িয়ে তৃষ্ণার শূন্য কলসিটি আছড়ে, স্নেহহীন পাথর আর কাঁকর আর ঝুটো মোতি, পোশাকের পর পোশাক, আঃ পোশাক তো নয় যেন পেঁয়াজের খোসা, পেঁয়াজে চোখ জ্বালা করে, পেঁয়াজে চোঁয়া ঢেকুর ওঠে, কিন্তু সেদিন—

সেদিন আমি মোটরের ভেঁপু, ট্রামের টিকিতে বিজলির ঝলক, মেওয়ার দোকানে কাটা নাসপাতির গন্ধে, বাঁধানো রাস্তায় ফিটন গাড়ির ঠকাঠক শুনে ভরপুর হয়েছিলাম। একই সঙ্গে আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল বিস্ময় আর দীনতা, দীনতা আর বিস্ময়, নিজের সরলতাকে অতিক্রম করব, গ্রামীণতাকে অস্বীকার করে শহুরে হব, সব ভঙ্গি, সব নাগরিক নৈপুণ্য আয়ত্ত হবে আমার, আয়ত্ত করতেই হবে—এই সংকল্প ভ্রূণাকারে, গঠিত হচ্ছিল মনে। আর তাই—

তাই বুঝি মা, কলকাতার মাটিতে—মাটিই বা বলি কেন, শান; পাথর আর শান; এখানে তো মাটিও কেনা-বেচা হয়—কলকাতায় পা দিয়ে তোমার হাত ছাড়লাম। যদিও তোমার অসহায় সরু আঙুলগুলো তখনও আমাকে খুঁজছিল।

তখন কি জানি, শহুরে অভ্যাস, ভাব-ভঙ্গি, ভান এসব হল মেক্-আপের মতো, প্রলিপ্ত করতে বেশি সময় লাগে না, একেবারে অন্য চেহারা হয়ে যায়, কিন্তু মুশকিল ঘটে যখন ফিরতে চাই স্বরূপে। তখন বাটি বাটি গরম জল আর কষে কষে রগড়ালেও প্রলেপ যেতে চায় না, এই যে আমি গত কত বছর ধরে তো চোখের জলে, সে জলও গরমই তো, সব ধুয়ে ফেলতে চাইলাম, তবু টাইয়ের ফাঁস গলায় সেঁটেই রইল, কোন্ পরতের তলায় চাপা পড়ে আছে আমার আপন স্বরূপ, ঘষে ঘষে বরং রক্ত বের হল, তবু সেই ধুলোমলিন বিস্ফারিত গ্রামীণ চামড়া তো আর ফুটে বেরোল না!)

দশ হাজারের দু’তিন শ’ গুণ কত তার আন্দাজ ছিল না, তবু কিন্তু সেদিন ওই সংখ্যাটাই সম্ভ্রম এনে দিয়েছিল মনে। আড়চোখে বাবার দিকে চাইছিলাম। উনি কি সত্যিই একটু মায়াবি, একটু আলাদা হয়ে গেছেন, ভাবছিলাম, নাকি এই যে চোখ-ধাঁধানো নীল আলোই ওঁকে এমন নরম মরমী অন্যরকম করে দিল? সচেতনভাবে না হলেও অস্পষ্টভাবে বোধ করছিলাম, এই চড়া আলোরও অবদান কিছু আছে, আমার অভিভূতভাব ক্রমেই বাড়ছিল, ঘোড়ার গাড়ির ঘেরাটোপে বসেও অনেকক্ষণ আমি বাক্যহারাই ছিলাম। শুনেছিলাম চাবুকের শিস, চোখে কানে গয়নার সাজসজ্জা পরা তেজিয়ান টগবগে ঘোড়ার সঙ্গে তার গাড়োয়ানের দুর্বোধ্য ভাষায় কথোপকথন, অথবা বলা উচিত, কথা, একতরফা—শুধুই কথন!

.

গাড়ি গড়াচ্ছিল, ভিতরটা অন্ধকার, তুমি-আমি একপাশে, বাবা ও-পাশে। উঁকি দিয়ে দেখছিলাম, একটা আলো জ্বলে জ্বলে কী লিখে ফের নিবে যাচ্ছে, বললাম, “বাবা, ও কী বিদ্যুৎ?”

“বিদ্যুৎ?” বাবা কী ভাবলেন। “ঠিক বিদ্যুৎ নয়, গ্যাস। নিয়ন। বিদ্যুতের মতো দেখায়।”

(‘মতো দেখায়’—তখন যদি চোখকান অভিজ্ঞ হত, এই শহরটার চরিত্রের আর একটা দিক দেখা যেত। এখানে যে জিনিস যেমন দেখায়, সবটাই তাই নয়, এক জিনিস অন্য জিনিসের চেহারা নিয়েও বেরিয়ে আসে।।)

গাড়ি চলছিল। বাবা তোমার গায়ে আলগোছে রাখলেন একটা হাত, টের পাচ্ছি, বলছেন “তারপর?”

“কিসের পর। পরে যা তা তো তোমার হাতে। সব তো চুকিয়ে দিয়েই এসেছি।”

“সে তো বটেই।” বাবা একটু কি কাশলেন? “চুকিয়ে দিয়েই তো এলে। বলছি যে, তা-হলে এলে?”

“এলাম।’

“দু’জনে?”

“দু’জন, শুধু দু’জন।” একটা শ্বাস চাপতে তুমি বাইরের দিকে মুখ ফেরালে কিনা জানিনে। মা, তোমার কি লাগছিল? আস্তে আস্তে বাবার হাতটা ঠেলে কেন দিচ্ছিলে?

“তিনজন হতে পারত।” বাবা বললেন, কতকটা স্বগত স্বরে।

“সে তো চলে গেছে।”

“ক’জন?”

“জানি না।”

“এখন দু’জন?” তিনজন হল না কেন?”

পায়ে পড়ি, তোমরা একটু সহজ ভাষায় কথা বলো না, যাতে আমি বুঝতে পারি। “হল না। ভগবানের বোধ হয় ইচ্ছে ছিল না।”

“ভগবানের, না তোমার? ঠিক বলো তো, সে এল না, না তুমি ইচ্ছে করেই আসতে দিলে না?”

তুমি মুখ ফিরিয়ে রইলে। মাথা বাড়িয়ে দিলে গাড়ির বাইরে, হু-হু ঠান্ডা হাওয়া। তখন আমি, মা, মরিয়া আমি বোকার মতো বলে উঠলাম, “কেন, আমরা তিনজনই তো। আমি মা আর আপনি। আপনাকে নিয়ে তিনজন।”

“হ্যাঁ, আমাকে নিয়ে।” বাবা অন্যমনস্কভাবে সায় দিলেন, তার পরেই সোজা হয়ে—”ও হো, ভুলে গিয়েছিলাম। আরও একজন তো ছিল?”

তুমি, মা, চমকে বললে, “কে?”

বাবা সোজা উত্তর দিলেন না। নিজের হাঁটুতেই টোকা দিতে দিতে বললেন, “ছিল তো! সেই যে একজন! যে তোমাকে আসতে দিল?”

তুমি তো অনায়াসে কথাটাকে উড়িয়ে দিতে পারতে। তবু কেন যে আবার কঠিন হয়ে উঠছিলে! ওই অস্পষ্ট আলোতেও চোয়ালের দৃঢ়তা ধরা পড়ছিল। তারপরই, মা, সহসা তোমাকে নরম হয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখলাম। দু’হাতে মুখ ঢেকেছ তুমি, অনুনয় এমন-কী প্রার্থনার সুরে বলছ, “এখানেও ওসব কথার জের টেনে আনছ কেন। সমুদ্র-টমুদ্র—এই বুঝি তোমার নতুন হওয়া? চিঠিতে তবে বুঝি সব বাজে কথা লিখেছিলে? আমাদের নিয়ে এসেছ নতুন করে সব শুরু করবে বলে নয়, ইনিয়ে-বিনিয়ে চিঠিতে কত-কী লিখেছিলে, শুধু ভোলাতে।”

বাবা কিছু বলছিলেন না!

আর সেই সময় একটা বোকার মতো কাজ করলাম আমি। আমি যে বড় হয়েছি, আমার যে বুদ্ধি আছে, বাবার কাছে যেন সেটাই জাহির করতে ফশ্ করে বলে বলাম “সুধীরমামা নেই তো। চলে গেছেন।”

বাবা একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিলেন। পলক পড়ছিল না। মাঝের আঁচিলটাকে সাক্ষী রেখে ভুরু দুটো আবার কি জুড়ে গেল? এই শহরে এতো আলো অথচ এই গাড়িটার ভিতরে কত অন্ধকার, রক্ত শুকিয়ে যেমন চাপচাপ কালো হয়ে যায়, তেমনই শুকনো ছোপছোপ অন্ধকার, একটা ভয়ংকর ঘর্ঘর তুলে ঘোড়ার গাড়িটা ছুটছিল।

“কী ভাবছ।” তুমি বললে আস্তে আস্তে, সন্তর্পণে, যেন ভয়ে ভয়ে নিজে থেকেই এবার বুঝি বাবার গায়ে আন্দাজে একটা হাত রাখলে।

“ভাবছি।”

“তোমার নতুন কোনও পালা? “

স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থেকেই বাবা ধীরে ধীরে বললেন, “হ্যাঁ, এই আমাদের নতুন পালা।” তার কত পরে বাবা বাইরে গলা বাড়িয়ে বলেছেন, “এই গাড়োয়ান রোকে, না, না, ডাহিনা গলি, ডাহিনা গলি, যাও, যাও, আউর থোড়া, আচ্ছা এইবার, এইখানে— বিলকুল রোকে।”

আমাদের দিকে চেয়ে বাবা বললেন, “পৌঁছে গেছি।”

আর কত বছর তো কেটে গেছে, এখনও ঠিক বুঝতে পারি না, বাবা সেদিন যা বলেছিলেন তার অর্থ কী! কোথায় পৌঁছে গেছি। কখনও মনে হয় অলীক অদ্ভুত একটা ধারণা, মনে হয়, সেদিন গাড়িটা ওখানে, ওই গলিতে বসতবাড়িটার সামনে সত্যি সত্যিই দাঁড়িয়েছিল তো? সেখানে নিবু নিবু একটা গ্যাসের বাতি সাক্ষী ছিল? কে জানে, হয়তো সবটাই ভ্রম, বাবা রোকে বললেও গাড়িটা দাঁড়ায়নি, এ-গলি ও-গলি কাঁথায় ছুঁচের মতো এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে চলেছেই, ক্রমাগত চলেছে, চাকা টলমল-টলটল, ক’টা রিকশাকে সে ধাক্কা দিল কে জানে, তার পাশ কাটাতে গিয়ে কোন্ মোড়ে বেচাল বেহেড একটা লোকের মাথা ঠুকে গেল দেয়ালে, একটা পা হড়কে পড়ল খোলা নালাতে, উবুড় ডাবিনটার কিনারা জাপটে ধরে সে গোঙাতে থাকল ক্রমাগত, কী সে আর্ত গদ্‌গদ্ চিৎকার এসব মিলিয়েই কলকাতা, কিন্তু সব কি সেদিনই ঘটেছিল, সেই প্রথম দিনে, যখন গাড়িটা একটুও না থমকে না-থেমে বেপরোয়া ছুটছিল, খেয়াল করল না তার সওয়ারীদের, তারা কি হুমড়ি খেয়ে রইল গাড়ির ভেতরেই, অথবা একসময়ে ঝাঁপ দিল বাইরে কিংবা ছিটকে পড়ল?

যে-কোচেয়ান অদৃশ্য কোচবাকসে বসে, কারও কথা শোনে না, থামে না, থামতে দেয় না, কাউকে পৌঁছে দেয় না কোথাও, কেবলই গাড়ি হাঁকায়, আমি প্রথম দিনের স্মৃতি থেকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে অস্বস্তিগ্রস্ত, তার ধরনধারণ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে আছি, থেকে থেকে তার চাবুকের সাঁ-সাঁ শাসানি শুনি। হয়তো আমার ভ্রান্তি কিন্তু আমি পুষে রেখেছি।

.

‘এই বাড়ি?”

“এই বাড়ি!”

তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে, তোমার যে প্রশ্ন, বাবারও সেই উত্তর।

প্যাসেজে আলো ছিল না, এই শহরটা, তখনই কি টের পেলাম, একই সঙ্গে উদাম আর গোপন, নানা স্থানে নানা রকম, এখানে আলো ওখানে আঁধারি, অনেককে নিয়ে তার অনেক ধরনের লুকোচুরি।

“এই বাড়ি।” বাবা বললেন, যেন অমোঘ কোনও নির্দেশ, হাত বাড়িয়ে প্রথমে নামালেন আমাকে, তুমি হাতল ধরে কোনওক্রমে টাল সামলে নামলে।

আলো ছিল না, তাই বাবাকে দেশলাই জ্বালতে হল। মোটঘাট নামানো হল দেউড়িতে। পুরো একটা টাকা পেয়ে গাড়োয়ান খুশি হয়ে শিস দিতে দিতে চলে গেল, তার পায়ের চাপে একটা ঘণ্টি টমটম বাজছিল। গলির মোড় যখন ঘুরে গেল গাড়িটা, তখনও তার মুখে হিন্দি একটা গানের কলি শুনছি—কাঁহে নজর বাঁচাকে হাসে প্রিয়তম, ছিপাকে যাতে হো। এখন হাজারবার মাইকে শুনলেও কথাগুলো ধরতে পারি না, আর ওই বয়সে একবার শুনেই হিন্দি গানের একটা কলি মনে গেঁথে গেল।

“মাল আমি নেব পরে। তোমরা আগে চলো।” দেশলাই জ্বেলে জ্বেলে বাবা চলেছেন আগে, আমরা পিছনে, পাশাপাশি জালঘেরা পর পর কয়েকটা জানালা, কিন্তু ঘরগুলো অন্ধকার একটা খিলেনের তলা দিয়ে একটু এগোলে স্যাঁতসেতে একটা উঠোন, অল্প অল্প আলোতেও শ্যাওলা দেখা গেল, মনে হল কী পিছল, একটা কল ভালো করে বন্ধ হয়নি তাই চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জল, টপ-টপ, টপ-টপ—আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখতে থাকলাম, বাবা তখন দেশলাইয়ের কাঠি ধরে তাড়া দিচ্ছেন, “দেখছিস কী, তাড়াতাড়ি চল”, কাঠিটা নিবে গেল, তখন সামনে দেখা গেল একটা কাঠের সিঁড়ি, যেন কাত করে শোয়ানো একটা মইয়ের মতন, সিঁড়িটার একদিকে হাতল।

কাঠিটা নিবে গেছে, অনেক দূরের লাল তারাটির মতো বাবার মুখে তখন জ্বলছে বিড়ি, উনি স্বদেশি কিনা তাই তখন সিগারেট খেতেন না, বিড়ির আলো কতটুকু আর, তবু আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছিল উঠোনটার পাশে ছিল শানবাঁধানো একটু উঁচু রক, তার ধার ঘেঁষে ঘেঁষে সিঁড়িটার মুখে পৌঁছনো গেল।

থরথর করে কাঁপছিল সেই সিঁড়ি, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে চটে গিয়ে খচখচ শব্দ করছিল, সেই প্রথম ওঠা, তারপর কত ঝকঝকে সিঁড়ি দেখেছি জীবনে, এমন-কী বেলে-পাথর মারবেলেরও, কিন্তু কলকাতার প্রথম কাঠের সিঁড়িটা আজও থেকে থেকে কাঁপে, ক্যাচ ক্যাচ করে বিরক্তিতে, তবু নানা প্রসঙ্গে তার ফিরে ফিরে আসা শেষ হল না।

সিঁড়িতে পা দিতেই তার তলায় একটা কুকুর গোড়ায় ধমকে উঠে হঠাৎ ককিয়ে ককিয়ে অহেতুক কাঁদতে থাকল, উপরে কোথাও দুটো বিড়ালের চলছিল ঝুটোপুটি, সিঁড়িটার মাথায় ঠিক ওই উঠোনটার মাপে চৌকো করে কাটা আকাশ, একফালি কাটা চাদর যেন, আমাদের পায়ের শব্দে কোন্ এক চোরা ঘুলঘুলিতে কয়েকটা গোলা পায়রা ডানা ঝটফট করে উঠল, তারপর।

“এই ঘর?”

“এই ঘর।”

“আলো নেই?”

“জ্বালছি। লণ্ঠন একটা আছে ওই কোণে। দ্যাখো।”

আমাদের সাড়া পেয়ে কারা যেন এসেছিল, তারা ভিতরে এল না, খালি তাদের ছায়ারা চাপা গলায় কথা বলতে থাকল। বাবা বেরিয়ে গিয়ে কী বলে এল তাদের, তারপর আবার সব চুপচাপ। এই তো এইমাত্র দেখে এলাম সদর রাস্তায়, আলোগুলো সব জ্বলজ্বলে, শহরটা ঘুমোয়নি, একেবারে ড্যাবডেবে চোখে জেগে, অথচ এই গলিটা, গলিটার এই বাড়িটা কিনা এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে!

নীচের ঘরে কে কাশছিল, অন্য দিক থেকে একটা বেসুরো জড়ানো গলার চিৎকার ঝনঝন বেজে উঠল, সিঁড়িতে মচমচ সেই সঙ্গে মিষ্টি একটা রিনিরিনি, যারা এসেছিল, তারা কারা, ওই মিষ্টি আওয়াজটা কি তাদের হাতের চুড়ির?

কলকাতা, কলকাতা, এই সব মিলিয়ে প্রথম দিনের কলকাতা।

মা, তুমি কোমরে আঁচল বেঁধে ঘর সাফ করছিলে, একবার মুখ তুলে বাবাকে বললে, “কেমন ভ্যাপসা গন্ধ না?”

“প্রাসাদ কোথায় পাব। এই ঘরটারই ভাড়া কুড়ি টাকা, তা জানো?”

তুমি একটা জানালা খুলতে যাচ্ছিলে, বাবা হাত তুলে ইশারায় মানা করলেন।—”ওই জানালাটা খুলো না। “

“খুলব না, সে কী!”

“কারণ জেনে কী হবে, ও দিকটা, মানে ওদিকটা ভালো না, আর কী। মানে জানতে চেও না। সেই যে এক রূপকথায় আছে উত্তরের জানালা খুলতে নিষেধ, তেমনই ধরে নাও আর কী। পরে আস্তে আস্তে টের পাবে।”

“কিন্তু জানালা না খুললে গন্ধটা—”

“ইঁদুরে নোংরা করেছে। কালো কালো বড়িগুলো দেখেছ তো, ওর মানে হল তাই। অনেক দিন কেউ বাস করেনি কিনা! পরে দেখো, সয়ে যাবে। যখন টের পাবে লোক এসেছে তখন আরশোলাগুলোও পালাবে।”

“আরশোলাও আছে বুঝি?”

“আছে, আছে, সব আছে। এই নিয়েই তো—”

সবটা না শুনেই আমি মনে মনে বললাম, “কলকাতা।”

“সব জেনেশুনে তুমি এখানে—”

“এর চেয়ে ভালো পাব কোথা! তবু তো সতীশ রায় খবরটা দিয়েছিল, তাই। সতীশকে জানো তো? আমাদের থিয়েটারে প্রশ্ট করে, মানে আড়াল থেকে সব্বাইকে পাটের খেই ধরিয়ে দেয় আর কী। সতীশও এখানে থাকে, সপরিবারে। চমৎকার লোক, কাল দেখবে।”

“ওর বউ?”

“আছে। একটি মেয়েও আছে, ফুটফুটে। ওরাই তো একটু আগে এসেছিল, খবরটবর নিয়ে গেল। কাল সকালে আবার আসছে।”

“দ্যাখো, এত কাজ থাকতে তুমি শেষ পর্যন্ত থিয়েটারে—আমার যেন কেমন-কেমন লাগছে।”

“আমার জন্যে জজিয়াতি নিয়ে কে বসে আছে বলো তো। হাকিম করতে হয়, কোরো! তোমার ছেলেকে।”

তুমি আমার মাথায় হাত রেখে বললে, “হাকিম হবে, হবেই তো। জানো,ও পড়াশোনায় কত ভালো। এবার ইয়ারলি পরীক্ষায়—কত যেন পেয়েছিস রে?”

বললাম, “ছশো তিরিশ—সাতশোর মধ্যে। “

“ব্যস্”, হেসে উঠলেন বাবা, “তবে তো হাকিম হবার আদ্ধেকটা রাস্তা পার হয়ে এসেছে। কিন্তু আমার কথা যদি খাটে, ও হাকিম হবে না। হাকিমি মানেও তো সাহেবদের গোলামি।”

“তবু সম্মান, স্থায়িত্ব, এই সব তো পাবে?”

চোখ টেরচা করে বাবা বললেন, “তোমার সেই কী রকম দাদা যেন, সে যা পেয়েছিল? সেরেস্তা না কোথায় কাজ করত না? আসলে আমি জানি ও ছিল পুলিশের টিকটিকি। ছদ্মবেশী, ওর সবটাই ছদ্মবেশ। আমার ছেলে”–হাঁপাতে হাঁপাতে বাবা বললেন, ঈষৎ উত্তেজিত, “ও আমারই ছেলে যদি হয় তবে গোলাম কখনও হবে না। টিকটিকি ইঁদুর কিচ্ছু না। ও হবে বাঘ, বাঘের বাচ্চা বাঘ!”

এই বলে বাবা আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন।

“বাঘ তো এখন থিয়েটারের খোঁয়াড়ে ঢুকেছে। ছি-ছি, এত জেল-টেল খেটে শেষে”—

“চিঠিতে সব তো বুঝিয়ে লিখেছি। দ্যাখো, খোঁয়াড় বোলো না। কপালে থাকে তো ওই থিয়েটারই আমাকে তুলে ধরবে। হয়তো ওখানেই—” বলতে বলতে প্রদীপ্ত হয়ে উঠল বাবার চোখ, নাকের ডগা স্ফীত, কপালের শিরাও ফুটে উঠেছে—”হয়তো ওখানেই একদিন আমার লেখা নাটকও প্লে হবে।”

“তোমার নাটক!”

“হতে তো পারে। সেই আশাতেই তো ঢুকেছি। ছুঁচ হয়ে। ছিদ্র পথে। সব্যসাচীবাবু, নাম জানো? এখনকার সবচেয়ে নামি অ্যাক্টর। তিনি কথা দিয়েছেন—”

“প্লে করবেন?”

“না! ফুরসুত পেলে দু-একটা পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখবেন। এক সঙ্গে উনি দুটো বোর্ডে -নামেন, ফী বৃহস্পতি, শনি আর রবিবারে, তাছাড়া টকি-স্টুডিও—নিশ্বাস ফেলারই বা সময় কই?”

ঝাঁটা হাতে নিয়ে তুমি ছবির মতো স্থির হয়ে চেয়ে রইলে। বোধ হয় আশা আর অবিশ্বাসের মধ্যে দুলছিলে।

“আজ আর বেশি কিছু কোরো না। আমি চট করে দোকান থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসি। পুরি-তরকারি আর রাবড়ি, কিংবা দই—মিষ্টি দই। কলকাতার দই একেবারে আলাদা জিনিস, জানিস তো?”

এই বলে বাবা আমার দিকে চোখ টিপে একটা লোভ-দেখানো ইশারা করে বেরিয়ে গেলেন।

১২

সেই বাড়ি, সেই ঘর।

ঘর কেমন, তার চেহারা ফুটে উঠল পরদিন সকালে। সাঁতরে সাঁতরে আমরা যেমন দেশের পুকুরে এক ডুবে জল থেকে পৌঁছে যেতাম পাড়ে, এই ঘরটাতেও, তেমনই সকাল হতে না হতে এক-একটা জিনিস যেন অন্ধকার থেকে আকার নিয়ে পাড়ে উঠে আসছিল—ছোপ-ধরা দেয়াল, মাথার উপরে উই-ধরা কড়ি, মরচে-ধরা জানালার শিক। রোদ একটুখানি ঠিকরে পড়ছিল অবশ্য, কিন্তু ঘরটা কিনা খুব লাজুক, কাউকে মুখ দেখাতেই চায় না, তাই ঘরে-ঘরে-ধরানো উনুনের ধোঁয়ায় নিজেকে ঢেকে ফেলছিল। চোখে জ্বালা, আমি উঠে পড়লাম। দেখলাম তুমি উঠেছ তার আগেই। দেয়ালের একটা দিকে পেরেক না কী একটা ঠুকে বসাতে চাইছ।

বাবা একটু পরেই ফিরলেন থলেতে কাঁচা বাজার নিয়ে। “কী, করছ। কী। এমনিতেই তো দেওয়ালটার আস্তরখসা, চুন বালি সব ঝুরঝুর করে ঝরে পড়লে বাড়িওয়ালা বলবে কী।”

-”আমি—আমি একটা জিনিস করব।”

-”কী করবে তাই জিজ্ঞেস করছি।”

তোমার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে, হাওয়ায় চুনের গুঁড়ো তাই নাকে সুড়সুড়ি, তুমি স্পষ্টই বোঝা যায় কী-একটা গোপন করতে চাইছ।

–”তুমি যাও, তুমি যাও না। ফিরে এসে দেখবে।” কোনও দিকে না তাকিয়ে তুমি

একমনে পেরেক ঠুকতে লাগলে, ঠোকার যন্ত্র তো ওই একটাই, ছোট্ট জাতি, পেরেক বসল না, কিন্তু একবার তোমার আঙুল থেঁতলে গেল শুয়ে শুয়েই আমি দেখছি। বাবা রাগ করে গেলেন বেরিয়ে।—”ফিরে এসে ভাত যেন পাই। রোজ বাজারের খাবার, এত বড়মানুষি পোষাবে না, তাই বলছি।’

–”ফিরে এসে দেখো।”

শেষ পর্যন্ত পেরেকটা বসল, যদিও তেমন মজবুত হল না, খানিকটা হেলেই রইল। আমি দেখছি তুমি প্রথমে বের করলে রাধাকৃষ্ণের একটা পট, কোলে নিয়ে দেখলে। সেটা পাশে রেখে দিয়ে বের করলে আর-একটা—হরগৌরীর। না, সেটাও পছন্দ হল না। ততক্ষণে পা টিপে টিপে উঠে পড়েছি আমি, সবার নীচে সাবধান ছিল যে-ছবিটা সেইটে টেনে বের করেছি। বলেছি ফিসফিস করে, একমাত্র ছেলেই মাকে ও-রকম অন্তরঙ্গ স্বরে বলতে পারে, “এইটে–এইটে টাঙাবে তো। এই নাও। কিন্তু টাঙাবে কী করে। যেমন তোমার দেয়াল, এই ছবিও তো ঠিক তাই। ভাঙা কাচ, খসে পড়ছে ঝুরঝুর করে।”

আর তখন যা ঘটবার তাই ঘটল। ফোটোটা কেড়ে নিয়ে ঠাস করে একটা চড় মারলে আমাকে,—কেন?—তোমার মনের কথা টেনে বের করেছি বলে? কিন্তু সে জন্যে, মা ওই ফোটোটাকে বুকে চেপে কেঁদে ওঠার কী দরকার ছিল।

কিন্তু আজ ভেবে দ্যাখো, যা ভবিতব্য তাই তো ঘটল? দাদার ছবিটা পুরনো, ঝরঝরে, আনা হবে না হবে না করেও সেটা যদি বা এল, সেটা ফের চলে গেল বাসের তলাতে, কলকাতায় এসেছিলাম তুমি আর আমি, আমরা দু’জন, থেকেও তো গেলাম সেই দু’জনই? এখানে, এমন কী এখানকার দেওয়ালে ফোটো হয়েও, দাদার স্থান হল না। তাই কি ফোটোটা বুকে চেপে কাঁদলে তুমি। দাদার জন্যে কলকাতা এসে সেই প্রথম আর এক রকম সেই শেষ।

সেকালে বিয়ে করতে যাবার আগে ছেলেরা যেমন বলত “অনুমতি দাও মা, তোমার জন্যে দাসী আনতে যাচ্ছি,” তেমনই মা, আমি, এতক্ষণ ধরে কলম টেনে টেনে ক্লান্ত, বুঝতে পারছ, এখন কী বলতে চাইছি?—”অনুমতি দাও মা, সেই বয়সে প্রবেশ করি।’

কোন্ বয়স? যে-বয়সে কলকাতা আমাকে তাড়াতাড়ি তৈরি করে নিচ্ছিল, হাত-গড়া রুটি যেভাবে উলটেপালটে চাপড়ে আগুনের তাতে সেঁকে নেয়, সেইভাবে, আমি ফেঁপে উঠছি, ভিতরে চাপা ভাপ, মুখে কথার তুবড়ি, আমাকে দেখে কে বলবে সেই ভীতু, রোগারোগা গ্রামের ছেলেটি?

বন্ধ চালের হাঁড়িতে কলা যেমন তাড়াতাড়ি মজে, আমিও তেমনই মজে উঠছিলাম, যদি স্কুলের শেষ পরীক্ষার তখনও অন্তত বছর দুয়েক বাকি। অতি ধীরেধীরে সেই বৃত্তান্ত উন্মোচন করলে পরিসরে কুলোবে না, তা ছাড়া বয়সের ছাঁকুনি দিয়ে অনেক স্মৃতি গলে গেছে।

আমিও মজে উঠছিলাম, মজা পাচ্ছিলাম, নানা বই পড়ে, নানা লোকের কথায়, ঠারেঠোরে ইশারায়, তা ছাড়া বিবিধ পারিবারিক অভিজ্ঞতায়। আমিও।

একটু পাউডার নাকের কাছে ধরে কেমন কেমন লাগত, কেন যে ফাল্গুন পড়তে-না-পড়তে রাস্তার দু’পাশের সংযমী গাছগুলো ওড়া ধুলোতে মস্ত হয়ে যেত! আমি তখন থেকেই দেখতাম।

হায়, পুরুষের বয়ঃসন্ধিকালের কথা কোনও কাব্যগ্রন্থে লেখেনি, পুরুষেরা জানতে পারে শুধু নিজেদের কঠিন কষ্টে, বিগলিত নিষ্কৃতিতে, আর—আর মেয়েদের অনুরূপ বয়সের বর্ণনার সঙ্গে আপনার যন্ত্রণা মিলিয়ে। আমিও জানছিলাম।

কলকাতা, মোটের উপর আমার ক্রমে ক্রমে রপ্ত হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তোমার নয়। নতুন জুতোর কামড়-কাঁকর আমার সহ্য হয়ে এল, কিন্তু চটি জুতো পরে চলাফেরা কিছুতেই তোমার অভ্যাস হচ্ছিল না।

বাবা বলতেন, “তুমি সেই গেঁয়ো ভূতই রয়ে গেলে।”

তুমি : “রাতারাতি শহুরে পরী হব তাই কি ভেবেছিলে তুমি?”

বাবা : “যাও না, তবে তিলক কেটে রোজ বুড়িদের মতো গঙ্গাচ্চান করো।”

তুমি : “করবই তো, করব। একেবারেই একদিন গঙ্গাযাত্রা করব। রাস্তাটা তুমি একদিন দেখিয়ে দাও না।”

বাবা : “সোজা রাস্তা। পশ্চিমমুখো হেঁটে গেলে আধমাইলও না।“

এই রকম বিশ্রী কথা কাটাকাটি। আমি পালিয়ে যেতাম বুলাদের ঘরে।

সেই যে যারা প্রথম দিন রাত্রে আমরা আসতেই ছায়ার মতো বাইরে দাঁড়িয়েছিল, তারাই বুলা। বুলা আর বুলার মা। যে সতীশবাবু থিয়েটারে প্রশ্টার, এই বাড়ির খোঁজ বাবাকে দিয়েছিলেন, যিনি, তিনিই বুলার বাবা।

মা, প্রথম দিকে তুমি কিন্তু ভুলে গিয়েছিলে। সেই ডুরে শাড়ি, চওড়া করে সিঁদুর পরা সব ফিরে এসেছিল। বাবাও রোজ সকালে বাজারে তো যেতেনই, সন্ধ্যার পর কোনও-না-কোনও মিষ্টির ঠোঙা নিয়ে ফিরতেন। যেখানে বসে আমি পড়তাম, যে দেয়ালের গায়ে বড় বড় করে লিখেছিলাম, “পাঠ-পীঠ”, মানে নেই, ওমনি ওমনি, তুমি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলতে, “সব থিয়েটারি ঢঙ, নাটুকে”, বাবা বলতেন, “হবেই তো আমার ছেলে যে”, সেই পাঠ-পীঠের সামনে বসে ঢুলছি, বাবা ঠেলে ঠেলে আমাকে তুলে দিতেন।

মা, তুমি এগিয়ে এসে আমার মুখে গুঁজে দিতে মিষ্টি। বাবা যখন মুখ ধুতে বাইরে গেছেন, তখন নিজেও একটু চেখে বলতে, “আমি ভুল করেছিলাম রে”–বলতে আস্তে আস্তে। কী ভুল? “তোর বাবা সত্যিই বদলে গেছে। আগের চেয়ে সংসারের ওপর ওর কত মায়া পড়েছে, দেখেছিস”?

দেখছি না? দেখব কী, তখন তো হাতে আরও বড় প্রমাণ—চাখছি।

.

কিন্তু ক’দিন আর, ক্যালেনডারে তো দাগ দিয়ে রাখিনি। বাবার সকালে বাজার করা বন্ধ হল। থলে নিয়ে নীচে যেতেন ঠিকই, কাঁটায় কাঁটায় ন’টায় উঠেও আসতেন, কিন্তু তুমি যা-যা আনতে বলে দিতে, ফর্দের সঙ্গে তার সবটা মিলত না। রাগে একদিন সব ছড়িয়ে দিলে, ফুঁসতে ফুঁসতে বললে, “কী আনতে বললাম, আর তুমি এ এনেছ কী।”

বাবা চুপচাপ রইলেন, চোখে কেমন-একটা নিরর্থক দৃষ্টি। এখন ওই দৃষ্টির মানে আমি জানি—অপরাধীর।

অপরাধটা কী, সেটা একদিন ধরিয়ে দিল বুলা। একদিন নীচে থেকে বাজারের থলিটা

সে-ই উপরে নিয়ে এল।

তুমি একটু অবাক হলে। বললে, “তুই?”

“বাবা পাঠিয়ে দিলে, মাসিমা।”

“বাবা–মানে তোর বাবা? কেন তোর মেসোমশাই—”

“মেসোমশাই গল্প করছেন, মাসিমা।”

“বাজার থেকে ফিরে অমনই গল্প করতে বসে গেল? আচ্ছা আক্কেল তো মানুষটার!”

“মেসোমশাই তো বাজারে যাননি মাসিমা। “

“বাজার আনল কে।”

“কেন বাবা! বাবাই তো রোজ যান। মেসোমশাই নীচে গিয়ে রোজ করেন কী, বাবাকে টাকা ধরিয়ে দিয়েই গল্প করতে বসে যান।”

“গল্প? কার সঙ্গে?”

“কেন, আমার মা নেই? মা খুব ভালো চা বানাতে পারেন মাসিমা? খাবেন এক দিন?” ফ্রকের কোণ মুখে তুলে বুলা হাসছিল। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম। মা, আমার শরীরের যন্ত্রণার সেই শুরু, অথচ বুলার পা দুটো দেখতে মোটেই সুন্দর ছিল না, হাঁটুর কাছে কালচে দাগ, তার উপরে পাতলা চামড়ার পরতে নীল শিরা, আমার গা শিরশির করত।

মা, তুমিও কি লক্ষ্য করতে? নইলে বলতে কেন, “বুলা, জামা নামিয়ে দাঁড়াও, ও কি বিচ্ছিরি অভ্যেস।” খুন্তির ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দ তোমার রাগটাকে চেঁচিয়ে বলে দিত।

বয়স কত ছিল বুলার, আমার চেয়ে বড় না সমান? তবে বুলার মা, যাকে আমিও বলতাম মাসি, লীলা মাসি, তোমার চেয়ে বোধ হয় ছোটই ছিল, অন্তত তাকে ছোট দেখাত। ঠিক সেই ভামতীকে দেখেই যেমন টের পেয়েছিলাম এ একেবারে অন্য ধরনের, লীলা মাসিকেও তেমনই। কারণ নিজের অজান্তে তোমাকেই আমি অনেক কাল ধরে স্বাভাবিকতার প্রামাণিক মাপ ভাবতাম কিনা।

ভামতী কালো ছিল, লীলা মাসি ফরসা, বোধ হয় তোমার চেয়েও ফরসা। কিংবা খুব সাজগোজ করে থাকত আর মুখে চটচটে কী-সব মাখত বলে তোমার চেয়ে দু-এক পোঁচ ফরসাই লাগত। তোমাকে একদিন সে কথা বলতে তুমি হঠাৎ রেগে গেলে। আয়না সামনে রেখে খোঁপা ঠিক করছিলে, দাঁতে কালো ফিতে চাপা, ঘাড় ফিরিয়ে বললে, “মুখ ধুয়ে একদিন সকালে ওই লীলাকে আমার পাশে দাঁড়াতে বলিস, ওই সাদা মলম-টলম যেন না থাকে। তখন দেখা যাবে কে বেশি—” আর বলা হল না, মুখ থেকে ফিতেটা খসে পড়ল। প্রসাধনের ব্যাপার-ট্যাপারকে তুমি বলতে “মলম” তোমার সাজ-সজ্জা বলতে তো ছিল খালি সিঁদুর আর আলতা। পাউডার? না, তা-ও মনে পড়ছে না।

ভামতী ছিল গোলগাল, মোটা, লীলা মাসি রোগা। গাল কেমন ভাঙা-ভাঙা, গলার হাড় তো আমি সর্বদাই দেখতে পেতাম, তা ছাড়া লীলা মাসির ব্লাউজের গলা ছিল তে-কোনা করে কাটা; আর তোমার? তুমি তো ব্লাউজই পরতে না। কলকাতা এসেও শুধু সেমিজই নিয়েছিলে।

বলতে, “ও তো একটা বেহায়া। মেয়েটাকেও করে তুলেছে তেমনি ধিঙ্গি। তুই ওদের সঙ্গে মিশিস না। “

মা, আমার মা, তুমি তো মা। তুমি কেন ওদের হিংসে করবে?

.

প্রায় রোজ সন্ধ্যাবেলা লীলা মাসি ঘটা করে সাজসজ্জা সেরে কোথায় বেরুত। ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যেত। ফিরত রিক্‌শা করে! কদাচিৎ কখনও ট্যাকসিতে। আঃ, সেই ট্যাকসির ভেঁপু, পিছনে ছড়িয়ে যাওয়া ধোঁয়া, আমি ছুটে যেতাম, বুক ভরে তার গন্ধ নিতাম। কতদিন আর সেই গন্ধ পাই না। মোটরগাড়ির না, কোনও গাড়িরই না। আগে প্রত্যেকটা বাস ছেড়ে দেবার সময় শব্দ হত “ভোঁ-ও-ও” এখনও কি চনমন-করা আওয়াজটা বাজে? বোধহয় না, অন্তত আমি শুনি না। অথচ আজকালকার বাস তো, কলকব্জা, চালানোর কায়দা সবই হয়তো বদলে গেছে।

লীলা মাসিকে যারা নামিয়ে দিয়ে যেত, তাদের মুখ কোনওদিন দেখতে পাইনি। ওদের মুখ ছিলও না সম্ভবত। ছিল অন্ধকারে আধো-ঢাকা শরীর। তাদের মুখ যদি-বা থাকে, সেই মুখে কথা ছিল না, ছিল অদ্ভুত এক ধরনের হাসি, খানিকটা খলখল, বোতল উপুড় করে তরল কিছু ঢাললে শোনায় যেমন—সেই তারা! লীলা মাসি নাকি কোন্ একটা গানের ইস্কুলে গান শেখাতে যায়। বুলার কাছে শুনেছিলাম। একটু অবাক লেগেছিল বৈকি। লীলা মাসির মুখ দেখে মনে হয় চামড়া তেল-তেলে, অথচ গলা কী-রকম খস খসে। ওই গলায় গান শেখানো যায়?

বুলার বাবা সতীশ রায়। তোমাকে বলতেন ‘বউদি’, কিন্তু তুমি আমল দিতে না! বলতে মেনিমুখো। বাবা বলতেন, “তুমি শুধু ওর মেয়েলি গলাই শুনেছ, ও বড় একটা অসুখে পড়েছিল যে, লিভারের অসুখ, সেই থেকে গলা ওইরকম হয়ে গেছে।”

“লিভারের অসুখে গলা খারাপ?”

“হয়, হয়। কিন্তু লোকটার অনেক গুণ জানো, প্রাণ দিয়ে প্রশ্ট করে, শুধু ওই গলা আর চেহারার জন্যেই কিছু হল না। নইলে যে-কোনও পার্ট ওর আগাগোড়া মুখস্থ, যে-কোনও নাটকের যে-কোনও পার্ট। শুনতে চাও তো একদিন, যেদিন থিয়েটার নেই, ডেকে শুনিয়ে দেব-আলেকজান্ডার চাও তো আলেকজান্ডার, আলমগীর বলো তো আলমগীর, নইলে আবন কি নাদির শাহ্ কি সিরাজ—”

“থাক, থাক, ওই গলায় বরং মেয়ের পার্টই মানাবে ভালো।”

“বেশ, তা-ও পারবে। সীতা, জনা, কৈকেয়ী—এমন ফিলিংস দিয়ে পড়বে যে সেকালের তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, চারুশীলারা কোথায় লাগে। লোকটা যে কী মজলিশি জমজমাটি, তুমি না শুনলে বুঝবে না।”

আড়চোখে চেয়ে তুমি বলেছ, “সেই জন্যেই ওখানে রোজ আড্ডা দাও বুঝি?”

“সেই জন্যেই তো।”

“চুপ করো।” যেন তোপ পড়ল, যেন আমাদের নড়বড়ে দেওয়ালের চুনবালি আরও খসে যাবে। “তুমি যাও ওই পটের বিবির টানে।”

“কার কথা বলছ।” বাবার মুখে কথা ফুটছে না, আমি তখন ঠিক বাবাকেও তো দেখছি না, যেন ছোট্ট একটি পোকা, আরও ছোট্টটি হয়ে নিজের জুতোর তলাতেই সেঁধিয়ে যাবেন।

“কার কথা বলছি তুমি ভালো করেই জানো। রোজ যে চা খাওয়ায়, গল্প করে, বিকালে ফিটফাট হয়ে বের হয়—”

“তখন তো আমি থাকি না।”

“সেইটেই আপশোশ বুঝি?” ঘাড় হেলিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে এত কথা বলতে কবে শিখলে তুমি মা! না কি কলকাতাই এত কম সময়ের মধ্যে শেখাল?

“সতীশের বউ, জানো, একেবারে ফেলনা নয়। ওর অনেক গুণ।”

“জানি না? নইলে তোমাকে গুণ করেছে?”

“বাজে কথা বোলো না। ও গান জানে, নাচও শিখেছে, তা-ছাড়া ভালো প্লেও করতে পারে। খুব শীগগিরই চান্স পাবে একটা থিয়েটারে।”

“কোন্ থিয়েটারে?”

(আমার সামনেই আজকাল এইসব চলে, আমি যে আছি তোমাদের সে সম্পর্কে একটু হুঁশও নেই কেন, মা, আমার মা, তোমাকে একটা রোঁয়া-ওঠা বিড়ালের মতো লাগছে কেন, আর বাবাকে, লিখতেও বাধছে, সেই ঘিয়েভাজা ঘেউঘেউটার মতন, যে নিত্য কাঠের সিঁড়িটার নীচে শোয়, আর যত লোক আসে যায় সকলকে শাসায়, বিড়ালগুলোর সঙ্গে মাছের কাঁটা আর সক্‌ড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি করে।)

“বলো, কোন্ থিয়েটারে?”

এবার বাবা থতমত খেলেন! “ওই যে-কোনও একটায়। তুমি আর ক’টার নাম জানো। মহলা চলছে, তাই ওকে রোজ বেরোতে হয়।”

“পাতাটি কেটে, চুনকাম করে, ঝলমল ঝলমল শাড়ি, জরি—মহারানির পার্ট নাকি? তবে? তবে যে গান শেখাতে যায় শুনি? সেটা তবে মিথ্যে?”

বাবা আমতা আমতা করে বললেন, “না, গান না, মানে, বোধহয় না। নাটক হ্যাঁ, নাটকই তো।”

“কার নাটক–তোমার?”

(তর্ক করতে হলে যে কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে নিতে হয়, সেটা, মা, তুমি শিখলে কোথায়! কলকাতায়? এই শহর শুধু আমাকে নয়, আমাদের প্রত্যেককে বদলে দিচ্ছিল। বাবাকে, তোমাকে; অথচ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রোজ সকালে চুল আঁচড়ানোর সময় আমরা টের পেতাম না কে কতটা বদলে গেলাম। সহজ সময়ে পরস্পরের চোখের দিকে চেয়েও না। চুলের সিঁথিতে ও-সব পরিবর্তনের কথা লেখা থাকে না, কোনও-কোনওটা এত ধীর এত সূক্ষ্ম যে ধরা পড়ে অনেক দিন কেটে গেলে তবে। রোজই তো দেওয়ালে একটু-একটু দাগ পড়ে, ঘরের মেঝেয়, কোণে কোণে সারাক্ষণই ধুলো জমে, আমরা কি টের পাই?)

তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে, “কার নাটক, তোমার?” আর বাবা অত্যন্ত কুণ্ঠিত লজ্জিতের মতো বলেছিলেন, “না, মানে এখনই না। এটার পরে, পরে হয়তো ওরা আমারটাও ধরবে।”

“বাঃ চমৎকার! উনি নায়িকা আর তুমি নাট্যকার। এই তো নাটক। আমাকে একটা পার্ট দেবে না? বলো, আমার কী পার্ট, বলো, বলো!” হঠাৎ হিংস্র হয়ে বাবার কাঁধটা খামচে ধরেছিলে। ফতুয়া ছিঁড়ে একটা নখের দাগ ওঁর গলা থেকে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছিল।

হাঁপাতে হাঁপাতে তুমি বলেছিলে, “কী পার্ট আমার, দেবে না একটা? কোটা, বলো না, কোটা বাঁদির?”

বলতে নেই, লিখতেও নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে, তোমার উপরে ঠিক ওই সময়টাতে ঘৃণা হচ্ছিল বলে নিজের উপরই ঘৃণা—তখন তোমাকে সত্যি সত্যি কিন্তু তেমনি দেখাচ্ছিল, যে-শব্দটা তুমি উচ্চারণ করেছিলে।

বাবা আর কিছু বলছিলেন না। অসহায় অপ্রতিভ, পরাভূতের মতো সেখান থেকে আস্তে আস্তে সরে গেলেন।

আর তুমি? সেমিজের কাঁধ ঢিলে, পিঠেও আঁচল নেই, কাঁপতে কাঁপতে মেঝেয় বসে পড়ে ভেঙে ভেঙে কাঁদতে থাকলে। আমি পিঠের কাছে দাঁড়ালাম। তুমি একবার মুখ তুলে দেখলে। হাত দিয়ে ঠেলে ভাঙা ভাঙা গলায় বললে, “সরে যা, চলে যা এখান থেকে।” তারপর ওই দুটি হাতেই আবার ডুবিয়ে দিলে মুখ। সেদিন অভিমান হয়েছিল। আজ নেই। জানি কিনা, এমন অনেক মুহূর্ত আছে, তারা সারা দিনমানে কতবার যে ফিরে ফিরে আসে, যখন নিজেরই দুটি করতল ছাড়া মানুষ নিজেকে লুকোনোর কোনও আশ্রয়, কোনও বিশ্বস্ত সুহৃদ খুঁজে পায় না।

তবু আমি যাইনি। তোমারই কোলের কাছে চুপ করে বসে পড়লাম, সেই বসে পড়তাম যেমন আগে, কতকাল পরে আমার সেই শিউলি-শিশুকাল ফিরে এল। কলকাতায় শিউলি গাছ নেই?

অনেক পরে তোমার কাঁপুনি থামল, বুঝলাম তুমি আর আর কাঁদছ না, তখন তোমার পিঠে একটা হাত রাখলাম। তুমি মুখ তুললে। এই কয় মিনিটে কী ভয়ানক বিস্ফারিত হয়ে গেছে তোমার মুখ, চৌবাচ্চার জলে কোনও জিনিস ডুবিয়ে ধরে থাকলে যেমন ছড়িয়ে-পড়া দেখায়।

আমার থুতনিটা তুলে ধরলে তুমি। খুব স্থির গলায় বললে, “এখানে থাকব না, এই নরকে। চল আমরা চলে যাই। ফিরে যাই সেখানে। তুই আমাকে নিয়ে যেতে পারবি?”

কিছু বলছিলাম না। আমার ভিতরে যে ইতিমধ্যেই বড় হয়ে গেছে, সে বলে দিচ্ছিল, চুপ করে থাকো, এখন শুধু শোনো, এ-সব সময়ে কথা বলতে নেই।

মাথা সোজা তুলে ম্রিয়মাণ দুটি চোখ অনেক দূরে পাঠিয়ে দিয়েছ, এই নোনাধরা দেওয়াল ভেদ করে চটের পর্দা উড়িয়ে দিয়ে চৌকো করে কাটা আকাশে আর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে চিলকোঠা পেরিয়ে। অথবা সেখানেই পৌঁছে গেছ, অনেক দূর থেকে বলছ, অতি মৃদু এক-একটি শব্দতরঙ্গ তোমার স্বর বয়ে নিয়ে আসছে, “ভুল বুঝেছিলাম। ও বদলায়নি। কলকাতায় এসে ওকে যখন একটু আলাদা দেখেছিলাম, জানিস, মনে হয়েছিল, ওই চিঠির কথাটাই বোধহয় ঠিক, সেই যে সমুদ্র-টমুদ্র কী সব লিখেছিল না?—ভালো করে বুঝিওনি। মনে হয়েছিল সত্যিই বুঝি ওর মন ফিরেছে সংসারের দিকে। তোর দিকে, আমার দিকে। এখন দেখছি”, কী দেখছি? কিচ্ছু না। সব মিথ্যে। বদলায়নি। কিংবা যদি-বা বদলেও থাকে, তোর জন্যে আমার জন্যে তো নয়। ওকে বদলে নিয়েছে অন্য জন। এর চেয়ে ও যখন জেলে জেলে থাকত নয়তো বিবাগি হয়ে ঘুরত, সে-ও ভালো ছিল। শেষে কিনা শামুকে পা কাটল?”

বেশ তো আস্তে আস্তে বলছিলে মা, হঠাৎ আবার অস্থির হয়ে উঠলে কেন তুমি? কেন আমার হাতের কব্জিটা চেপে ধরে বললে, এইমাত্র মহীয়সী ছিলে; এক্ষুনি যেন ভিখারিনী, “চল্, আমরা চলে যাই।”

“কোথায়?”

“যেখান থেকে এসেছি, সেখানে। ফেরা যায় না? তুই তো এখন রাস্তা চিনিস, আমাকে নিয়ে যেতে পারবি না।”

মুহূর্ত না-ভেবে বললাম, “পারব, মা।”

.

তুমি জানো না, আমি মিথ্যে কথা বলেছিলাম। কোথাও ফেরা যায় কিনা, ফেরা সম্ভব কিনা, এ-সব তত্ত্ব তখনও আমার বিচারবুদ্ধিকে আঘাত করেনি ঠিক, কিন্তু তোমাকে বলতে পারতাম না,. সেখানে ফেরার আগ্রহ-উৎসাহ আমারও আর ছিল না। আমারও মন বদলে গিয়েছিল। গাঢ় চিনির রসে মাছি যেমন, আমিও তেমনিই লেপটে যাচ্ছিলাম।

১৩

বুলা বলল, “আসবি?”

কাঠের সিঁড়িটার মুখেই ওদের ঘর। উঠোনটা বেলা যেতে না যেতেই চক্রান্ত করে অন্ধকার ডেকে নিয়ে আসে, বুলা উপরের চৌকাঠে হাত দুটি তুলে ঠিক ওদের ঘরের সমুখে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি পার্ক থেকে বেড়িয়ে ফিরছি, পকেটে এক রাশ চিনেবাদাম, তখন পকেটে চিনেবাদাম থাকলেই নিজেকে মনে হত স্বচ্ছল, বুলা কবাট ছেড়ে একটু পিছিয়ে গিয়ে বললে, “আসবি?”

দোনোমনায় আটকে গিয়েছিলাম। পকেটে বাদাম, মা তোমাকে দেব। তা-ছাড়া সামনে পরীক্ষা, পড়তে বসব। বুলা বলল, “আয় না। মা গেছে বাইরে, বাবা থিয়েটারে। একা-একা কেমন ভয়-ভয় করে।”

.

আর কিছু বলার দরকার ছিল না। গেলাম।

ওদের ঘরখানা বড়, মাঝখানে পরদা, আলাদা-করা দুই ভাগ। বুলা আমাকে নিয়ে গেল ওই দিকে, আলো জ্বালল, ওদের লণ্ঠনটা ঝকঝকে, মাজা দাঁতের মতো, কালো ধাতু দিয়ে তৈরি, চিমনিটাও চমৎকার। পেটের কাছটায় বাতাবি নেবুর মতো গোল, উপরের দিকটা ফিকে রঙ-করা। আলো জ্বালল বুলা। কিন্তু ফিতেটাকে বাড়াল না, ওর খাটটায় বসে পা দোলাতে থাকল। একবার বলল, “কী দেখছিস?” তারপরেই হাত বাড়িয়ে হঠাৎ—”কী খাচ্ছিস?”

যে ক’টা চিনেবাদামের খোসা ছাড়ানো ছিল, ওর হাতে দিলাম। এনেছিলাম তোমার জন্যে।

বুলা দাঁত দেখিয়ে দেখিয়ে বাদামে কামড় বসাচ্ছিল, একবার বালি কিংবা ওইরকম কিছু মুখে লাগতে টুকটুকে জিভ বের করে বলল, “থুঃ! দেখে শুনে কিনতে পারিস না! নাকি কিনিসনি, তোকে ওমনি দিয়েছে?”

আত্মসম্মানে ঘা লাগল, বললাম, “আমাকে কেউ ওমনি কিছু দেয় না। দস্তুর মতো পয়সা দিয়ে—“

বুলা আবার বলল, “থুঃ! আমাকে এমনিই দেয়। রিবন, চকোলেট, এমন কী ছোট্ট সেন্টের শিশি, মা-টা আবার ভাগ বসায়। তাই সেদিন যেটা পেলাম সেটা বুকের মধ্যে লুকিয়ে আনলাম। গন্ধ পাচ্ছিস?”

না পেলেও আমার মাথায় ঝিম ধরছিল।

বুলা কী রকম চোখে হাসছিল, কী-রকম কী-রকম, চোখ যেন, ঠিক মনে পড়েছে নীল রঙের মারবেলের মতো চকচক করে, আঙুলের ডগায় কায়দা করে টিপ করে মারলে ঠিকরে গিয়ে লাগে। আমার লাগছিল।

বুলা বলছিল, “নিশ্বাস ছাড় না! এই যে এমনি করে—বুক ভরে বাতাস নিবি, তারপরেই হা—আ-আ – বুঝেছিস, নিশ্বাস ছাড়, তোর মুখে কেমন গন্ধ দেখি।”

ও যা যা বলছিল তা-ই তা-ই করছিলাম।

বুলা বলল, “থুঃ। বিশ্রী গন্ধ। তোদের মানে ছেলেদের মুখে। আমার মুখে নেই! বুকে না হয় সেণ্ট মেখেছি, কিন্তু মুখে আমি সর্বদা এলাচ পুরে রাখি। একটা খাবি?”

এলাচ নয়, আমার তখন খালি মনে হচ্ছিল, জল খাই।

বুলা, ওর কড়ে আঙুলের বাড়তে-দেওয়া নখটা পোষা হলেও ধারালো গাল খুঁটছিল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরও তো ব্রণ উঠেছে রে। তাহলে যত ন্যাকা সেজে থাকিস, তুই তা নোস্? তুইও পাকা।“

বললাম, “বুলা আমি এবার যাই।”

“বোস্ না আর-একটু। বললাম না আমার একা ভয় ভয় করে?”

“আমারও ভয় করছে। মা বকবে।”

“বকবে না। মাসিমাকে বলবি, তুই বাড়িতে ফিরিসইনি। যদি টের পেয়ে থাকে, তবে বলবি আমাকে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছিলি।”

“আমার নিজের পড়াও আছে যে! পরীক্ষার পড়া।”

বুলো হাসছে, এতক্ষণ পা দোলাচ্ছিল, এবার বিনুনিসুদ্ধ মাথাটাও আস্তে আস্তে এদিক-ওদিক দোলাতে শুরু করল, অল্প হাওয়ায় ফুলের ডাল যেমন দোলে, কিংবা বাঁশির সঙ্গে সাপের ফণা। কিন্তু যে-ই আমি উঠে পড়লাম অমনই সে-ও উঠে পড়ল টকাস, আমার হাত চেপে ধরল জোরে, টানছিলও কিনা বুঝতে পারছিলাম না। “বললাম না, বললাম না তোকে’ একা-একা ঘরে খালি-খালি লাগে, বসবি না, একটু বসবি না?” জল-ফোলা কেতলির ঢাকনার মতো ও কাঁপছিল, ওথলানো কড়ার গা বেয়ে ফেনা যেমন গড়ায়, ওর দু’গাল বেয়ে তেমনিই কষ-কষ কী চুঁইয়ে পড়ছিল, গরম শ্বাস, আমার গালে ওর নাক ঠেকাল কি, কে জানে কেমন গন্ধ তার, বুকে-ছিটানো সেন্টের সঙ্গে মিশে আছে, মা তুমি কোথায়, কেন টের পাচ্ছ না, কেন কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে নেমে এসে আমাকে বাঁচাচ্ছ না।

অথচ, নির্জলা এই সত্যটাও শুনে রাখো, তুমি নেমে এলেও আমি কিন্তু তখন খুশি হতাম না।

“যদি বুলা”, আমি কেবল ধরা-ধরা গলায় বলতে পারলাম, “যদি কেউ এসে পড়ে—সতীশ মেসোমশাই কিংবা মাসিমা – “

আমাকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে দাঁড়াল বুলা, মাথাটা পিছনে হেলিয়ে শরীরটাকে করল ধনুকের মতো, আর তাতে ওর দেহের রেখাটেখা খেলে গেল ছোট দীঘিতে ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো, বুলা হিল্লোলিত হাসছিল।

—”মেসোমশাই? মাসিমা? তার মানে বাবা আর মা?” হাতের বুড়ো আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে বলছিল, “উঁহু, এক্ষুণি কেউ আসছে না। বলেছি না মা গেছে—কোথায় বল তো, আরে না, গান-টানের স্কুলে না, হেঁড়ে গলায় ও আবার গান কী গাইবে, হি-হি, মা গেছে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে, অনিরুদ্ধ রায়দের সঙ্গে, ওরাও কী-একটা বই স্টেজে নামাবে, মাকে বলেছে, মাকে করবে হিরোইন, হি, হি, ওই চিমসে চেহারায় হিরোইন? তবেই হয়েছে। সাত মণ তেল পুড়ছে না, রাধাও নাচছে না। নাচব বরং আমি, দেখবি আর একটু বড় হলে স্টেজে নামছি আমি। অনিরুদ্ধ রায় আড়ালে আমাকে কথা দিয়েছেন। মাকে বলিনি, বেচারা মিছে কেন কষ্ট পাবে, রায় বলেছে, মাকে শুধু খেলাচ্ছে, ওদের আসল নজর আমার দিকে। আমি নাচ শিখছি, তিরছি নজর একটা গান আছে না? সেই গানটার সঙ্গে।”

বলতে বলতে বুলার চাউনি এখনই তেরছা হয়ে গেল কি, সরু কোমরটা দু’হাতে ধরেছিল বলে দেখাল আরও সরু? সে কি তালে তালে পা ফেলতেও শুরু করেছিল? কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথা ঘুরছিল।

বুলা বলছিল, “আর বাবা। বলেছি তো, সে এখন উইংস-এর পেছনে বই ধরে আর সবাইকে পার্ট বলাচ্ছে। সে আসছে না। এলেও”–বুলা চোখ ঘুরিয়ে বলল, কী রকম ঘোরানো সেটা কথা দিয়ে ফোটানো যাবে না, মেয়েদের নাচ কি শুধু পায়ে? – চোখের তারাতেও নাচ আছে সেই প্রথম দেখলাম। চোখ ঘুরিয়ে বুলা বলছিল, “এলেও বাবা কিছু বলবে না। সাহস হবে না। দেখছিস না, ওর চালচলন কেমন ভিতু-ভিতু, মিহি গলা, সর্বদা পিটপিট করে চোখের পাতা? কিছু বলবে না, বরং যেন একটা সিগারেট নিতে এসেছিল এইভাবে ঘরে ঢুকে বিছানার তলা থেকে প্যাকেটটা হাতিয়ে সুড়ুত করে বেরিয়ে যাবে, মা যখন বন্ধুদের সঙ্গে বসে বসে হাসিগল্প মসকরা করে, তখন যেমন বেরিয়ে যায়; রকে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফোঁকে কিন্তু কাশিটাও ভয়ে ভয়ে রাখে চেপে। দেখিসনি?”

বুলা একটু থামল, দম নিতে না বুকটাকে সেই ছুতোয় আর-একটু-ফুলিয়ে দেখাতে, বলা শক্ত। শুরু করল ফের—”না চেপে করবেই বা কী। টো-ফো করলে মা সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ধরে দেবে না বের করে? ও সেটা জানে।”

“কেন, উনিও তো থিয়েটারে—”

বুলা এবার বুড়ো আঙুলটা বাড়িয়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে মুখেও বলল, “কাঁচকলা। মাইনে পায় না। সব আপখোরাকি। বাবুদের মন জুগিয়ে, মন আরও কী-না-কী জুগিয়ে দু’চার পয়সা হাতায় অবিশ্যি, যাকে বলে বকশিস। যেমন মেসোমশাই, মানে তোর বাবা সকালে যখন মার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা চালান, তখনও ও বেরিয়ে যায়। বাজারের ছুতোয়। আমাদেরটা করে আনে, তোদেরটাও। ভাবছিস মিনি-মাগনা? তা নয়, ও নিশ্চয় দু’চার পয়সা রোজ সরায়, ওর কমিশন। মার সঙ্গে তোর বাবার আড্ডা মারার দালালি নেয়। ওকি সোজা ঘুঘু! জানিস, একবার একটা সাইকেল রিক্‌শায় চড়িয়েছিল আমাকে, রিক্‌শা-ওলার পিঠে আমার হাঁটু ঠেকেছিল বলে, লোকটাকে দরদস্তুর করে যা ঠিক হয়েছিল, তার চেয়ে দু-আনা কম দেবে বলে সে কী ঝুলোঝুলি! আমি লজ্জায় মরি। ওকে সোজা ঘুঘু ভাবিস না। ঘুঘু আর চোর।”

“ছি বুলা, তোমার না বাবা।”

দু’হাত ডালা ধরার মতো চিত করে বুলা বলল, “বাবা না হাতি। বাবা বলি তাই। আমার আসল বাবা এখন কে জানে কোথায়, হয়তো স্বর্গে। আমি পৱে জানতে পেরেছি। আমি যখন খুব ছোট্টটি, তখন মাকে নিয়ে ও পালিয়ে আসে। তাই তো বলছি, ও চোর।”

একটু থেমে বুলা বলল, “ভেবে দ্যাখ একবার, ওই চেহারায়। মা-কি তখন কানা হয়ে গিয়েছিল? তাই হবে হয়তো। কিংবা তখন হয়তো এর চেয়ে একটু চেকনাই ছিল, জোয়ান বয়স তো! তারপর মদ খেয়ে লিভার পচল, চেহারা হল হাড়গিলের মতো, এখন সকলের হাততোলা কুড়িয়ে বেঁচে আছে, বে-চা-রা”। শেষ কথাটা বুলা টেনে টেনে বলল।

.

কাঠের সিঁড়িটা বেয়ে সেদিন উপরে উঠতে কী-জানি ভয় করছিল। মচ-মচ, মচ-মচ, মনে হচ্ছিল, ধূর্ত বাচাল সিঁড়িটা তোমার চর, তোমাকে সব বলে দিচ্ছে। পায়ের জুতো খুলে নিলাম, সামনে জলকাদা পড়লে, যেমন খুলি। কাদা, কাদাই তো, ঘিনঘিন করছিল, কাদা যেন সারা পায়ে লেগে আছে। কিন্তু গায়ে? জামার আস্তিনটা শুঁকলাম। সেন্ট-টেন্ট, গন্ধ-টন্ধ কিছু—যদি লেগে থাকে?

চোরের মতো উঠছিলাম। জানি না কেন এক–একদিন এমন এক-একটা অন্ধকার ছেয়ে আসে যে, মনে হয়, চোর, চোর, সবাই চোর। বুলা কিন্তু মিছে কথা বলেনি। চোর সতীশ রায়, ও যাকে বাবা বলে। ওর মাকে চুরি করে এনেছে। এখন ও নিজের বাড়িতে চোর বনে বসে আছে। আমার বাবাও চোর—রোজ সকালে ওদের বাড়ি ঘাপটি মেরে বসে থাকে। চোর আমিও, এই তো অহেতুক কেবলই দু’আঙুলে গাল ঘষছি, মুছে ফেলতে চাইছি, সেই কখন-লাগা একটি গরম নিশ্বাসের স্পর্শ, এখন চুপি চুপি পা টিপে টিপে উঠছি—নিজের বাড়িতে এইভাবে কেউ ঢোকে?

গোটা পৃথিবী এইভাবে এক-একদিন লুকোচুরি খেলার আসর হয়ে যায়, কিন্তু মা, চোর তুমিও কি? না-হলে সেদিন কেন ঘরে আলো জ্বলছিল না, উনুনও ধরানো হয়নি, সব নিঝুম, যেন গল্পে-পড়া খাঁ-খাঁ, ছমছমে এক রাজপুরী। আশ্চর্য, সেদিন সিঁড়ির নীচে কুকুরটাও ডাকল না, বিড়ালগুলোও অদৃশ্য, বোধহয় ওত পেতে ছিল অন্ধকারে, ইঁদুর ধরবে বলে, সেই সাদা-ছটফট-পাখা আরশোলারাই বা গেল কোথায়। কানের কাছে দু’একটা মশা গুনগুন করলেও বাঁচা যেত, বুঝতে পারতাম সব কিছুই উধাও হয়ে যায়নি, চরাচরে অন্তত কেউ-না-কেউ সজীব আছে। চৌকো আকাশটার চাঁদোয়ায় সেদিন একটি তারাও ছিল না, কালপুরুষ আর লুব্ধক, তুমি যাদের চিনিয়ে দিতে। তারা সব গা-ঢাকা দিয়ে রইল কোথায়!

বারান্দায় দাঁড়ালাম। কোথায়, কোথায়—প্রাণপণ চিৎকার করে বললাম কিন্তু মনে মনে। চোরের গলা তো ফোটে না। কোথায়, কে কোথায় আছ, সাড়া দাও, যে-কোনও কোণের যে-কোনও একটি প্রাণ ‘এই যে আমি’ বলে সাড়া দাও। পাহারাওয়ালা সদর রাস্তায় যদি থাকো, তবে ‘খবরদার!’ বলে হেঁকে ওঠো একবার। এই তো আমি, চোর্, এই ক্ষণে ধরা দেব বলে দাঁড়িয়ে আছি।

কিন্তু মা, তোমাকে তো জানি চিরকাল স্বপ্রকাশ, তুমিও গুপ্তচরের মতো আচরণ করলে কেন। কেন কবাটের আড়ালে দাঁড়িয়েছিলে, কেন আমি চৌকাট পার হতে না হতেই ঠাস করে গালে ভীষণ একটা চড়। তোমার গায়ে এত জোর। এই নাকি তোমার ভালোবাসা, অথবা তোমার ভালোবাসা কি এতই বেশি?

দেওয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে দিচ্ছিলে, ভাগ্যিস দেওয়ালটা নরম, যদি দাঁত ভেঙে যেত আমার, যদি কপাল ছড়ে গিয়ে রক্ত পড়ত? ঘর অন্ধকার, দেখতে পেতে না অবশ্য!

.

মা, মিছেই সেদিন তুমি আমাকে মারলে। তুমি জানো না, আমিও সেদিন মেরে এসেছিলাম। হ্যাঁ, বুলাকে। আমার দিগ্বিদিক জ্ঞান ছিল না। তোমার চড়টার মতো ওজনেরই একটা থাপ্‌পড়। ওর তুলতুলে গালে আঙুলের মাপে মাপে রক্তজমাট, ওর মুখের বাকিটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল।

তার কারণ, বুলা হঠাৎ সীমা ছাড়িয়ে গেল যে। বেশ তো হাত নেড়ে নেড়ে কথার খই ফোটাচ্ছিল, মাঝে মাঝে খাটে বসে দোলাচ্ছিল পা, নখ দিয়ে খুঁটছিল মুখ,

(“ব্রণ কিংবা ঘামাচি খুঁটতে খুব সুখ, আমি তো পারলেই গেলে দিই, ভেতরে শাঁস মতো থাকে না? বার করে দিই। আমার গায়ে কাঁটা দেয়। এই দ্যাখ না, দিতে না দিতে এক্ষুণি কাঁটা দিয়েছে। দ্যাখ্!”),

বলতে বলতে বুলা ওর ধুলোভর্তি পা তুলে দিল আমার কোলে, দেখলাম সত্যিই ওর পায়ের রোমকূপগুলি কূপ-চিহ্নের মতোই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে, ওর কনুই থেকে কবজিও তাই, আমার একটি হাত টেনে ওর নিজের উন্মুক্ত হাতটার উপর দিয়ে ছড়ের মতো বুলিয়ে নিয়ে গেল।

একটা শিরশির ভাব শুধু, না, তার চেয়ে খানিকটা বেশি। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, স্পর্শমাত্র তাকে তুলে রাখা একরাশ বাসন যেন ঝনঝন করে পড়ে গেল—মনে হল। শরীরও কখনও কখনও কাঁসার বাসন হয়ে যায়

তখন অদ্ভুত গলায় আধবোজা চোখে বুলা অদ্ভুত একটা কথা বলল, ওর ঠোঁট টুকটুকে নয়, বরং হাওয়ায় সিঁটিয়ে যাওয়া কমলালেবুর কোয়ার মতো শুকনো, সেই ঠোঁট নেড়ে নেড়ে বুলা অদ্ভুত গলায় বলল, ‘জানিস, তোর সঙ্গে আমার ভাব হবে। হবেই। তার একটা প্রমাণ আছে!”

“কী প্রমাণ?” শুকনো গলায় বললাম।

“প্রমাণ এই যে”, বুলা আঙুলের কর গুনে গুনে যেন হিসাব মিলিয়ে বলতে থাকল, “ধর তুই আর আমি। কেমন তো? আমার বাবা, মানে যাকে বাবা বলি, ভিজে বেড়ালটি, চুপচাপ বসে থাকে, যেটুকু কাঁটা পায় তাই চোষে। অথচ আমার মা? এই বয়সেও—কী বলে যেন নবেল-টবেলে? —রঙ্গিণী। বাবা ওকে বাঁধতে পারেনি! আর মাসিমা, মানে তোর মা, দ্যাখ, কী শান্ত, যাকে বলে লক্ষ্মী, মাথা নিচু লাজুক, মুখচোরা, কিন্তু তোর বাবা উড়ুউড়ু উড়ুনচণ্ডী, মাসিমা তোর বাবকে বাঁধতে পারেনি। আমাদের অমিলটাই আমাদের মিল, এইবার বুঝলি? কী মজা, ভগবান আমাদের মিলিয়েছেন। ওই হিসেবে বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হলে যেমন বলে, আমরা দু’জনে একেবারে পালটি ঘর, হি-হি, তুই আর আমি। তোতে আমাতে ঠিক মিশবে, ভাব হবে, ভগবান ঠিক করে দিয়েছেন, আমাদের দু’জনের একই দুঃখ যে। আমার এই বাবা একদিন ঠকিয়েছিল একজনকে, তারপর দ্যাখ কী শাস্তি, এখন ঠকছে নিজে। সে-ই মা-ই ওকে ঠকাচ্ছে, সুতরাং ও দুঃখী। আবার ওদিকে দুঃখিনী তোর মা, বুঝেছিস তো, নাকি আরও খুলে বলতে হবে?”

“আর বলতে হবে না”, জড়ানো গলায় বললাম।

এই পর্যন্ত বেশ ছিল, যদিও আমার হাত পা হিম এবং চোখ জ্বলছিল, গলা ভেজাতে হচ্ছিল থুতু গিলে, নইলে স্বর বেরোবে না, তবু বুলার ওই ব্যাখ্যা, বুলার ওই ছোঁয়া নতুন একটা দিকের ইঙ্গিত দিচ্ছিল। বেশ মজা তো, ওদের দেওয়ালে দুটো টিকটিকি খুব কাছাকাছি এসে ফিরে যাচ্ছিল, আমরা দু’জনেও টিকটিকি নাকি, বুলার ছোঁয়া পেতে পেতে আমি, কটকটিয়ে ওঠা গোটা শরীর, ভাবছিলাম, বেশ মজা তো বুলার মা/আমার বাবা; বুলার এই বাবা/আমার মা—স্বভাবে আচারে একরকম, তাই আমরা দু’জন, ‘হি-হি।

একটা টিকটিকি দেওয়াল থেকে খসে মেঝেয় চিৎ হয়ে পড়ে ছটফট করতে থাকল। বুলা তখনই উঠে বসল সোজা সটান হয়ে। একটা বালিশ টেনে নিয়ে ওর বুক আড়াল করল? ওর পায়ের কাঁটা, হাতের কাঁটা মরে এসেছে, কিন্তু আমারগুলো যাচ্ছে না কেন? ও বালিশের সেলাইগুলো নখে টেনে টেনে ঢিলে করছিল, আস্তে আস্তে আঙুল ডুবিয়ে দিচ্ছিল আমার চুলে মাঝে মাঝে। আমি ঘুমিয়ে পড়ব।

(‘তোর চুলের গোড়া বেশ শক্ত আর রঙ কালো, আমার মতো নয়, আমার চুল বাদামি, তাছাড়া চিরুনি টানলেই উঠে যায়।’ ‘কেন বুলা, তোমার চুলও তো সুন্দর, হলই বা বাদামি, কিন্তু ফাঁপানো, ঢেউ খেলানো, আজ কি সাবান দিয়েছ, নাকি রোজই চুলে সাবান মাখো?’)

এই পর্যন্তও বেশ ছিল। কিন্তু বুলা হালকা একটা হাই তুলল, ওর সাজানো সমান দাঁতের পাটি দেখা গেল, তার ফাঁকে টকটকে তুলতুলে একটি ছুঁচলো জিভ, দুটো ঠোঁট আলাদা হয়ে যাওয়া দু’টো ঝিনুক, চোখ ছিল আধবোজা, একেবারেই বুজে ফেলবে বুঝি, তখন আমি কী করব, আমি যে একা হয়ে পড়ব, এই ঘর, ওর বুক চেপে ধরা বালিশ, মেঝেয় চিৎ টিকটিকিটা, কী সর্বনাশ, না-না, ওই যে বুলা চোখ খুলেছে, ঘাম দিয়ে আমার জ্বর ছাড়ছে।

বেশ ছিল। বুলা তখন ঢিলে ঢালা হয়ে বসল, ঢিলেই তো, ওর জামাটার ছাঁট ঢিলেই তো, এতক্ষণ লক্ষ করিনি, আমার প্যান্ট, তখনও হাফ প্যান্ট, তখন তাই রেওয়াজ, কেন এত আঁটসাঁট? কষ্ট হচ্ছে।

ঢিলেঢালা হয়ে বসল বুলা, শুনতে পাচ্ছিলাম টিকটিক, টিকটিক, না টিকটিকি নয়, ওদের ঘড়িটা; একটা কাঁটা টিকটিক করে আর একটার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ছে। বুলা একটা হাত আমার কাঁধে রাখল! না, আর কিছু না। ও আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসেছে, আমার কানের লতিতে এত সুড়সুড়ি?

আর কিছু নয়। বুলা এবার আমাদের কথা জিজ্ঞাসা করছে। কোথায় ছিলাম আগে, কলকাতায় এই কি প্রথম?

(‘ওমা, তুই তবে গাঁইয়া’ মিটমিটে বদমাস, একটুও বুঝতে দিসনি তো? ফিচেল শয়তান, এমন কায়দায় কথা বলিস যেন এই শহরেই বরাবর আছিস।’ বুলা আমাকে চিমটি কেটে বলল। চিমটি কাটছ কেন বুলা? আমার লাগছে।)

সেখানে ছিলাম কে-কে।

বললাম, “মা আর আমি।”

“শুধু মাসিমা আর তুই? আর কেউ ছিল না?”

“ছিল। দাদা। নেই!” উপর দিকে আঙুল দিয়ে দেখালাম।’

বুলা বুঝল। ঠোঁট, ওর সেই ঠোঁট, বেঁকিয়ে একটা শব্দ করল, যার মানে আহা কিংবা উঁহু। বলল, “মেসোমশাই?”

“কোথায় থাকতেন ঠিক ছিল না তো। মাঝে মাঝে যেতেন।”

“তার মানে”, বুলা যখন বলল, “তার মানে মানে ফুল ফুলে মধু খেতেন”, তখন মা, আমি রেগে গেলাম। ও কি জানে না, আমার বাবা স্বদেশি, কতবার জেল খেটেছেন, তা-ছাড়া ভারত ভ্রমণ, তা ছাড়া মিসলেনিয়াস ইন্ডিয়ান ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ইত্যাদি?

বুলো ঢিলেঢালা পা ছড়িয়ে বসে হাসছিল—”বেশ বুঝলাম। তার মানে তোরা একাই ছিলি, তুই আর মাসিমা এই দু’জন?”

“বললাম তো।”

“আর কেউ আসত না?”

“আসত আর-একজন।” ভেবে নিয়ে বললাম, “আসত সুধীরমামা।”

‘কেমন মামা?”

“জানি না। মামা—মামা, এই পর্যন্ত।” আমি চটে উঠেছিলাম। আমার রাগ বাড়ছিল।

“রোজ আসত?”

“রোজই—প্রায়ই।”

পরে হিসেব করে বললাম, “পরে অবশ্য আসা ছেড়ে দিয়েছিল।”

“ছেড়ে দিয়েছিল কেন!”—বুলা তখনও নখ দিয়ে বালিশের সুতো খুঁটছে, ভিতরের তুলোটুলো সব বের করে নিতে চাইছে।

“ছেড়ে দিয়েছিল, এই এমনি।”

কিন্তু বুলা ছাড়ল না, ওকে সব বলতে হল। বললাম। যতটা জানি, যতটা বুঝেছিলাম। সব শুনে বুলা, সেই বুলা বালিশটা বুকে চেপে বেরিয়ে পড়া আঁশ-আঁশ তুলায় মুখ ডুবিয়ে কেবলই হাসতে থাকল।

বলল, “বুঝেছি।”

আমি যদি আগে বুঝতাম, মা, বলতাম না। নেশায় সব হয়, আর সেই আমার জীবনের প্রথম নেশা। আসলে মিথ্যেই শহুরেপনার নকল করেছি, ও শুধু নকলই, আসলে আমি তখনও হয়তো সেই সরল গ্রাম্য সুবোধ বালকটিই রয়ে গিয়েছিলাম। নইলে বলতাম না।

বুলা শুনে বলল, “বুঝেছি।” ওর ব্রণ ভর্তি মুখ, জ্বলজ্বলে চোখ বিকটভাবে বেড়ে গিয়ে যেন আরও বীভৎস দেখাল। বলল, “তবে তো, তবে তো—শুনবি? তবে তোর মা-ও যা ভেবেছি তা নয়, ডুবে ডুবে জল খেত!”

“তার মানে?” যতটা চিৎকার করা যায়, ততটাই গলা চড়িয়ে বললাম।

“তার মানে এই”, বুলা আমার গালে টোকা মেরে বলল, “তার মানে যা তা-ই। আমার মা যা, তোরা মা-ও তাই। এক কথায় অ—সো—তী।” বুলা কেমন ককিয়ে ককিয়ে বলল। বলল, “আর সেই জন্যেই মেসোমশাই, তোর বাবা, ওখানে বেশি যেতেন না। “

মা, তখনই আমি হাত তুলে বুলাকে মারলাম। একটা প্রচণ্ড—ঠাস! যত রাগ, যত দুর্বলতা ছিল, আর যত কান্না, সব দিয়ে।

তোমার জন্যে, তোমারই মান রাখতে বুলাকে যখন মেরে এসেছি মা, যখন আমার আঙুলগুলো নিঃশেষে অবশ হয়ে আছে, তখনই তুমি আমাকে মারলে।

চমৎকার দাম কিন্তু, চমৎকার দাম দিলে।

১৪

আমাকে সেদিন দাম-চুকিয়ে দিলে ওইভাবে, অথচ বাবার ব্যবহারটা দেখো, হাত তুললেন কি? সেই যে, মা, তুমি চূড়ান্ত অপমান করলে একদিন, একেবারে মর্মের মূলে গিয়ে আঘাত, তবু উনি সব সহ্য করলেন, ঠায় দাঁড়িয়ে, বৃক্ষ যেমন বজ্রপাত প্রাপ্য বলে মাথা পেতে নেয়।

সন্ধ্যা থেকেই সেদিন বৃষ্টি, আমি ন’টা বাজতে না বাজতেই বই বন্ধ করে খেয়ে নিয়েছি, শুয়ে পড়েছি মাথা অবধি কাঁথা টেনে।

টের পাচ্ছি, তুমি একবার দক্ষিণের জানালায় গিয়ে দাঁড়ালে ছাঁট আসছিল, তবু ভেজালে কনুই অবধি। সেদিন তুমি চমৎকার একটা খোঁপা তৈরি করেছিলে। একবার বুঝি ভাবলে জানালা টেনে দেবে কিনা, পাল্লা ধরে একবার টেনেও ছিলে, কিন্তু কী ভেবে থেমে গেলে। শুধু ছাঁট নয়, ভিজে হাওয়াও তার সঙ্গী ছিল, আমার চোখ আরামে জড়িয়ে আসছিল। তুমি ঘরের ওপাশে গিয়ে খানিক দাঁড়ালে উত্তর দিকের সেই বরাবর বন্ধ জানালায়। বন্ধ খড়খড়ি, কিন্তু ছোট্ট একটা ফুটো আছে। কান পাতলে। খুব করুণ একটা সুর ভেসে আসছিল, কেউ বোধহয় সরু তারের কোনও যন্ত্র বাজাচ্ছে! ওদিকে বরগা চুঁইয়ে ছাদ থেকে জল পড়ছিল, কয়েক ফোঁটা পড়ল আমার কপালে। তুমি আমাকে তুলবে বলে ঠেলেছিলে। উঠলাম না দেখে তখন আমাকে সুদ্ধ বিছানাটা টেনে নিয়ে গেলে একটু ওদিকে, যেদিকটা খটখটে।

এ-সব বুলাদের ঘরের সন্ধ্যাটার বেশ কয়দিন পরে।

সিঁড়িতে শব্দ হল। জুতোর চলন মুখস্থ! বাবা আসছেন। আমি চোখ বুজে। বাবা আসছেন।

রাত ক’টা তখন? দশটা তো নিশ্চয়। বৃষ্টির শপশপে রাতে মনে হচ্ছিল অনেক বেশি।

বাবা এলেন। তুমি একটা গামছা ছুঁড়ে দিলে। সব টের পাচ্ছি। বাবা বললেন, “ধন্যবাদ।” ধন্যবাদ কেন? ও আবার কী রকম ভাষা। যেন বানানো বানানো। কেউ কাউকে বলে না। অন্তত আপনজনকে না। কিন্তু বাবা বললেন। বাবার গলাটা একটু অন্য রকম শোনাল।

মাথা মোছা সারা হলে বাবা বললেন, “চিরুনি।”

তুমি বললে, “এখন? এই রাতে তোমার মুখ আবার কে দেখছে?”

বাবা বললেন, “কেন, তুমি?” তুমি সতর্ক, তাড়াতাড়ি আমার বিছানার দিকে তাকালে আমার মুখে কাঁথা মুড়ি।

জুতোটা খুলেছেন বাবা, কিন্তু জামা ছাড়েননি। ইতিমধ্যে পকেটে পুরে দিয়েছেন একটা হাত, একটু এগিয়ে আর-একটা হাত তোমার গালে। “ঠান্ডা যে?”

আজ যে বৃষ্টি।” তুমি বলছ চুপে চুপে, আমার বিছানার দিকে আবার তোমার সন্তর্পণ দৃষ্টি।

“তাই ঠান্ডা?”

“হয়তো তা-ই। কিংবা ঠান্ডা হয়তো আমি-ই, বরাবর তাই তো জানি।”

“না, তুমি গরম। আজ গরম খিচুড়ি আছে তো। কিংবা গরম-গরম লুচি?”

“বলো তো ভাজতে পারি।”

“তার আগে”, বাবা বললেন, “তার আগে এসো। এই যে এইখানটায়। চুপ করে দাঁড়াও—লক্ষ্মী মেয়ে।“

“আমি তো লক্ষ্মীই।”

“কে বলে?”

“সকলে। খালি কপালটাই যা-“

“কথা থাক। দাঁড়াও।” ইতিমধ্যে পকেটে পোরা হাতটা উঠে এসেছিল, নাকি কেঁপে গেল খোঁপাসুদ্ধ তোমার মাথাটা? ততক্ষণে চুল জড়িয়ে গিয়েছে ফুলে।

তুমি অবাক, হঠাৎ সেন সন্দিগ্ধ, বললে, “এ কী। ফুল?”

“চেনো না? গন্ধ পাচ্ছ না? সাপও তো শুনেছি ভুলে যায় ফুলের গন্ধে, বিভোর হয়ে থাকে।”

“আমি সাপ নই, হলে হয়তো বিভোর আমিও হতাম

“বিষ আর ফণা তবে কার?”

তুমি চুপ করেছিলে। বাবা তখন আরও এগিয়ে তোমাকে ঝাঁকুনি দিচ্ছেন।–”বলো, আনু, একবার বলো, ‘তোমার।’ বলো।“

তুমি একেবারে অন্য কথা বললে। আঙুলে মালাটা জড়াতে জড়াতে—”ঘরের বউ হয়ে ফুলের মালা! লোকে বলবে কি। তাছাড়া এই বয়সে-“

(সেই সময়ের পক্ষে কথাটা, মা, একেবারে ভুল বলোনি। আমাদের ঘরে ঘরে ফুলের চল হয়েছিল আরও পরে। তখন ফুলের বাজারের বেশিটাই টেনে নিত—পুজো-আচ্চা বাদ দিলে বিয়ে কিংবা মৃত্যু। আর ফুল ছিল সেই মহলেই, যেটা সমাজের বাইরে।)

তুমি, অপ্রস্তুত, যখন বলবে, “তাছাড়া” দেখছি, বাবা তখন তোমার চিবুক তুলে ধরেছেন, “এই বয়সে—” তৎক্ষণাৎ বাবা দাঁড়িয়েছেন আরও গা ঘেঁষে, মিটিমিটি তাকিয়ে দেখছি, তোমার চিবুক তুলে ধরেছেন, “কত বয়স হল দেখি, বয়সটা কি আঁকা আছে গালে? দেখি এসো তবে মুছে দিই—” আর তখনই!

ছিটকে সরে গিয়েছ তুমি, লজ্জায় নয়, তা হলে তো ঘোমটা খসে পড়ত না মাথা থেকে, সরে গিয়েছে রাগে। থরথর কাঁপছ। কাঁপছেন বাবাও, স্পষ্টই বোঝা যায় দু’টি পা-ই টলমল, যেন হাড় নেই, ভেলকিতে দাঁড়িয়ে ওঠা এক গাছা মোটা দড়ি।

“তুমি—তুমি কী খেয়ে এসেছ?”

“কিশ্ চুতো না এ–ই এক টু।”

বাবা কাঁপছেন, আমি কঠিন কাষ্ঠ, এতক্ষণে বোঝা যাচ্ছে ওঁর গলা কেন আজ অন্য রকম। ‘কিশ্ চু খ-খাইনি, এ-এই একটু-উ।” উনি বারবার বলতে থাকলেন, “একটু”-র “টু” অক্ষরটা টু–উ”-এর মতো শোনাল, যেন একটা পাখি ডাকছে “কুউ”, ‘এই একটু’, ‘এই একটু’, একটি কথায় আতসবাজির আলোর মতো ঘরের মধ্যে চক্রাকারে ঘুরতে থাকল।

“একটু—কতটুকু? তোমার মুখে গন্ধ।”

“অন্-ন্যায় হয়েছে। গন্-ধোটা থাকা অন্যায় হয়েছে। একশোবার মানব। বিশ্‌শাশ্‌ করো, ঢাকতে. আমি পাত্তাম, এলাচ—ওই যে এলাশ্ না কী বলে—খেতেই চেয়েছিলাম—কিন্তু খাইনি, বিশ্শাশ্ করো ঢা আকতে আমি চাইনি।”

“এত রাত, আমি ভেবে মরি, ছেলেটা জেগে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়ল—”

“পড়ল? আহা। পড়ে গেল? পড়ে কোথাও লাগেনি তো আনু? আহা। পড়ুক, পড়ুক, ঘুমিয়ে পড়ুক। আবার উঠে পড়বে। আমি জানি। লোকে পড়ে আর ওঠে। এই নিয়ম। যেমন, এই দ্যাখ, আমি উঠেছি।” বলতে বলতে বাবা গৌরাঙ্গ ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে দাঁড়ালেন।

আমার হাসি পাচ্ছে, কোনওমতে নিজেকে চেপে ধরে আছি, কিন্তু, মা, তুমি একটুও হাসছ না যে? বিশেষ করে বাবা যখন পুরনো কথায় ফিরে বলছেন, যেন গর্ত হয়ে যাওয়া চাকার দাগে একটা কথাই গড়িয়ে গড়িয়ে ফিরছে, তখন হাসি সামলানো যায়?

বাবা বলছিলেন, “য়ু আর রাইট। অন্যায় হয়েছে। ঘরে গন্ধ আনা নিশ্চয় অন্যায়, ওটা বাইরে রেখে আসা উচিত ছিল, লোকে যেমন জুতো বাইরে রেখে ঘরে ঢোকে, গন্ধটাও…তেমনই…বলছ তো? য়ু আর রাইট। স-শেই জন্যেই তো নিয়ে এলাম ফুলটুল, তা তোমার পশদো হল না। বেশ, ফুল যদি পছন্দ না হয়, তবে জ্বালাও ধূপকাঠি ফিনাইল ঢেলে ধুইয়ে দাও—ধধুৎ!” বাবা পাক্কা একটি হিক্কা তুললেন।

“গিয়েছিলে কোথায় শুনি? এত রাত হল। কোথায় যাও রোজ, কাটিয়ে আসো এত রাত অবধি—”

“জানো তো।—ীয়েটারে।”

“সেখানে এইসব গেলা হয়?”

“শেখানে? উঁহু, ঠিক শ্শেখান নয়”, বাবা মাথা নাড়ছিলেন, “তবে কাছাকাছি। এই তোমার গা ছুঁয়ে বলেছি, কাছাকাছি। দূরে নয়, দূরে নয়। আর—আর তুমি যা ভাবছ তা-ও নয়। বিলিতি জিনিস ছুঁইনি। আমি স্বদেশিওয়ালা, যা খেয়েছি—সব দিশি, খাঁটি দিশি। বাওয়া, চরিত্রভ্রশ্ট হইনি। নীতি ঠিক রেখেছি।”

“তোমার আবার চরিত্র, তোমার আবার নীতি!” কী ঘৃণায় কথাগুলি উচ্চারণ করেছিলে। ঘৃণা? অথবা, মা, তুমি কি ভয় পেয়েছিলে?

নাকে চাপা দিয়েছ কাপড়, কিন্তু চোখে না। না, সেদিন তুমি কাঁদছ না। বাবা একটা বিড়ি ধরাতে চাইছেন, পারছেন না, হাত কাঁপছে, কাঠি কেবলই নিবে যাচ্ছে, একবার তো ওঁর আঙুলের ডগা অবধি আগুন ধিকিধিকি এগিয়ে এল, এখন চোখ দিয়ে অনুনয় করছেন বাবা, তোমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন দেশলাইটা ধরিয়ে দিতে, তুমি দিচ্ছ না, পিছনে সরছ, আমি নিশ্চল, গোপনে নিষ্পলক, একটা মুক-অভিনয় দেখছি। “এর চেয়ে তুমি যা ছিলে তাই বেশ ছিলে, এ আমি কি দেখছি। সব শিক্ষা করা হচ্ছে—”

বাবা মহাজ্ঞানীর মতো মাথা নাড়লেন, “উঁহু, শিক্ষা না। আমাকে শিক্ষার্থী বোলো না। সব শেখাটেখা সারা বলেই তো শেষ পর্যন্ত এখানে পৌঁছতে পেরেছি। আনু, আমাকে শিক্ষার্থী বোলো না। শিক্ষার্থী তোমার ছেলে, ও ছাত্র। ওরই শেখার বয়েস, ও-ই বরং এখন শিখবে।”

“শিখবেই তো, শিখছে। বাপের ধারা পাচ্ছে।”

“পাবে, আলবত পাবে। বাপের ব্যাটা যদি হয়, নির্ঘাত আমার সব ধারা পাবে।” উচ্চাঙ্গের রসিকতা করছেন এই আত্মপ্রসাদে বাবা উচ্চহাস্য করে উঠলেন।

(বাবা অপ্রকৃতিস্থ, অথচ নিয়তির মতো সেদিন অমোঘ বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন।)

তুমি বলছিলে, না করুণ কোনও প্রার্থনা নয়, আনুনাসিক আবেদন নয়, দৃঢ়তার সঙ্গে বলছিলে, যেন আদেশ, বলছিলে, “আমাকে তুমি আবার সেখানে পাঠিয়ে দাও।”

“সেখানে?” মোয়ার মতো হাত ঘুরিয়ে বাবা বললেন, “শুনেছি সেখানে কেউ তো নেই।”

ধৈর্যচ্যুতি ঘটল না তোমার। যতটুকু রেগেই ছিলে তার চেয়ে একরতি বেশি রাগ দেখা গেল মা।—”না থাকুক। আমি যাব।”

“সঙ্গে যাবে কে?” বাবা অপাঙ্গে আমাকে দেখছিলেন।

-”কেউ না। আমি একা। ছেলে, তোমার ছেলে ও যাবে কোন দুঃখে। বললাম তো, শিখে উঠেছে। ও এখানেই থাকবে। বাপ আর ছেলে এক ঘাটেতেই মুখ ধোবে বাঃ দিব্যি।”

(মা, তুমি কি এত নীচ, সংকেতে কি নীচে বুলাদের ঘর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে?)

তলিয়ে বোঝার মতো অবস্থা বাবার ছিল না, একটা হেঁচকি তুলে তোমার কথাটারই পুনরুক্তি করে বললেন, “বাঃ দিব্যিই তো, দিব্যি।”

ভবী তবু ভুলল না। কঠিন কণ্ঠে তখনও বলে চলেছ তুমি, “কিন্তু বলো, আমাকে এখানে এনেছিলে কেন তুমি? বলো, বলতেই হবে। মিথ্যে কেন ছলছুতো করে চিঠিতে ভুলিয়েছিলে। এখানে এসে কী পেলাম বলতে পারো?”

“কষ্ট হচ্ছে?” দরদ দিয়ে বাবা বললেন, “হবেই তো। দেশে কত খোলামেলা আর এখানে সব বন্ধ আটকানো। বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে যাদের শোবার অভ্যেস, যদি তাদের ছোট্ট চেয়ারে গুটিসুটি হয়ে–“

“কথার চালাকি রাখো। বন্ধ জায়গাতেও আটকাত না, যদি চারধার ভদ্র হত। বিশ্রী বাড়ি, উত্তরের জানালাটা খোলা যায় না কেন”, বাবার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে তুমি বললে, “তা কিন্তু জেনে ফেলেছি।”

“কি জেনেছ?” বাবা কি ভয় পেলেন?

“জেনেছি ওদিকের একটা ঘরে কারা একটা মেয়েকে ধরে এনে আটকে রেখেছে। মেয়েটা সব সময় কাঁদে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কান পেতে শুনেছি, ওর কান্না খুব করুণ, গানের মতো শোনায়।”

“তাতে আমার দোষ কী।”

“দোষ কী আর! তবে তুমি এর চেয়ে ভালো একটা বাসায় আমাদের আনতে পারতে। নইলে যেভাবে ছিলাম, বেশ ছিলাম। সুখে-দুঃখে একরকম দিন কেটে যাচ্ছিল। নতুন একটা অপমানের মধ্যে কেন টেনে আনলে। বলো, বলো, বলো।”

তোমার চোখে ফুলকি ঝরছিল। তোমার দাঁতে দাঁত ঘষে যাচ্ছিল। এত তেজ আগে কখনও তো দেখিনি।

বাবা কাঁচুমাচু হয়েছিলেন এতক্ষণ, এইবার গর্জে উঠলেন—”আঃ আনু ক্ষ্যামা দাও। এতক্ষণ থিয়েটারে ছিলাম, অনেক বক্তৃতা শুনে এলাম, ঘরে এসে আবার সেই পার্ট শোনা? এক নাইটে দুটো শো দেখা? মাপ করো, আমাকে দিয়ে হবে না। এতবার ক্ল্যাপ দিতে পারব না।”

“থিয়েটারে রোজ যাও কেন? কে যেতে বলে? তোমার ঠোঁট বিদ্রূপে বেঁকে গেছে, আমি যেন সাপের শিস্ শুনছি, তুমি কি সেই মা, যাকে চিনি, যিনি শান্ত আপাতত-স্থির একটি প্রতিমা? প্রতিমার রঙ জলে ধুয়ে গেছে, আর পিছনের কাটখড়ও দেখতে পাচ্ছি। বলে চলেছ, “তুমি তো থিয়েটারের কেউ নও, তুমি, তুমি তো শুধু তার প্রেসের ম্যানেজার, হ্যান্ডবিল ছাপাও—তবে রোজ রোজ ওখানে যাও কিসের টানে?” একটা চোখ ছোট করে ফেললে তুমি, এ-সব কায়দা এখানে এসে বুঝি আপনা হতেই শিখেছ, বললে, “কিসের টানে, বলো না কিসের? কোনও থিয়েটারউলির? তা রোজ রোজ সেজন্যে মাথায় হিম লাগানো কেন, একজন তো নীচেই ছিল। বিকেলে সে বাড়ি থাকে না সেই জন্যে?”

“চুপ করো।”

“করব না। সকালে তো নিত্য যাও, ওর ভেড়ুয়া স্বামীটাকে বাজারে পাঠাও। সত্যি করে বলো তো, এক দিনও তুমি কি বাজারে যাও, গিয়েছ?”

ঘড়ঘড়ে গলায় বাবাকে বলতে শুনলাম, “সে তুমি বুঝবে না। বাজার করা আমার কাজ না। আমি একজন আর্টিস্ট।”

এইবার বিকট একটা কলের বাঁশির মতো বেজে উঠল তোমার গলা। কাঁথা-মুড়ি দিয়েও ঘুমের ভান বজায় রাখা সম্ভব হল না। সোজা হয়ে বসলাম বিছানায়, একবার তোমার, একবার বাবার মুখের দিকে চাইছি…

“আর্টিস্ট, তুমি আর্টিস্ট? ওই কথাটার আমি মানে জানি। তুমি কিসের আর্টিস্ট আমার গুণনিধি, বুঝিয়ে দাও না, একবার বুঝিয়ে দাও। গাদা-গাদা পালা লিখেছ বলে? তুমি যদি আর্টিস্ট, চামচিকেও তবে প্রজাপতি। ও-রকম ছাইভস্ম সবাই লিখতে পারে।”

হিস হিস করছিলে এতক্ষণ, এবার তোমাকে ছোবল মারতেও দেখলাম। বাবা টলছেন, বাবার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে যাচ্ছে। বিকৃত, অস্পষ্ট স্বরে শুধু বলতে পারলেন, “যা লিখেছি তা ছাইভস্ম? সবাই লিখতে পারে, স–বা—ই? তুমি এই কথা বললে?”

“বললাম। ঠিক ঠিক শুনতে না পেয়ে থাকো যদি, বলছি আবার। ছাই—ছাই—ছাই।”

দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছেন বাবা, সেই রকমই অসহায় গলায় বলছেন, “তবে যে তুমি কত মন দিয়ে শুনতে, তারিফ করেছ কত, কত হা-হুতাশ”-

“শুনেছি, মানে শুনতে হয়েছে। তোমার স্ত্রী বলে।”

“শু–ধু আমার স্ত্রী বলে? নইলে—”

“নইলে ওগুলো ছিঁড়ে উনুনের আগুনে ফেলে দিতাম।’

খুব বুঝি কষ্ট হচ্ছে, বাবা দেওয়ালের ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু তুমি থামোনি, কাটা ঘায়ে নুন ছিটিয়েই গিয়েছ। বাবা যখন বললেন, “এতদিন এ কথা বলোনি কেন”, সঙ্গে সঙ্গে তুমি : “বলিনি তুমি কষ্ট পাবে বলে। খেয়ালি মানুষ, ঘর বেঁধেও বাঁধোনি, ভাবতাম, না-হয় ওসব নিয়ে ভুলে থাকুক।”

“ভোলাতে, খালি ভোলাতে? এত দয়া তোমার, দয়াময়ী?“

“দয়া কিনা জানি না! মুখুসুখ্যু মানুষ, এমনিতে তো কিছু বুঝি না! তবে আজ না বলে পারছি না, তুমি যখন পড়ে শোনাতে, আমার হাই উঠত, ঘুম পেত। সত্যি বলছি। সত্যি, সত্যি, সত্যি।”

“ঘুম আর হাই?” সম্মোহিতের মতো এক-একটা কথার সূত্র বাবা মরিয়ার মতো টেনে চলেছেন, হঠাৎ যদি তোমার কথা বন্ধ হয়, উনি ধপাস করে বসে পড়বেন। “ঘুম পেত, আর হাই?”

“আর হাসিও পেত। দ্যাখো, তোমার ও-সব মাথামুণ্ডু কোনও দিন কেউ নেবে না, প্লে হবে না। যদি হয়ও–” শেষ পাথরটা তুমি ছুঁড়ে দিলে,–”যদি–হয়-ও লোকে দেখবে না। টিটকারি দেবে, উঠে পালাবে।”

ঠিক এই সময়েই বাবা বুঝি হাত তুলেছিলেন। মা, তোমাকে মারতে নয়, পাথরটা ঠেকাতে। পারলেন না, পাথরটা ঠিক বুকে গিয়ে লাগল। বাবা কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ছেন। অন্ধের মতো হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে কী যেন ধরতে চাইছেন।

“মা! ধরো, ধরো বাবাকে, দেখছ না বাবা পড়ে যাবেন?” চিৎকার করে উঠেছিলাম। তুমি নড়বে না, তুমি নড়ছ না দেখে নিজেই তড়াক করে উঠেছি লাফিয়ে।

(পরে জেনেছি, আমাদের ভিতরকার কয়েকটা সজাগ-স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র এইভাবেই সহসা তড়িৎ-শক্তি-তাড়িত হয়ে ওঠে।)

কিন্তু বাবা ততক্ষণে দুমড়ে-মুচড়ে মেঝেতে আসন নিয়েছেন।

একটা পুরনো ইমারতকে ইঁটকাঠ সমেত আমার চোখের সামনে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে এর আগে কখনও দেখিনি। কাছে যেতে বাবা হাত তুললেন আবার, এবার আমাকে ঠেকাতে। জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে, ভিজিয়ে, তবে কোনওরকমে শুকনো দুটি কথা বলতে পারলেন, “থাক। ঠিক আছি।”

কই, মুখে গন্ধ কই, বাবার চোখে আর নেশাও নেই। সেখানে বদ্ধ, বাণবিদ্ধ একটি পশুর ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখতে পাচ্ছি।

ইটকাঠগুলো পড়েই রইল। হাঁটুতে মাথা গুঁজে! এই ভগ্নস্তূপ কোনও ইতিহাসের সাক্ষী হবে না।

কোথায় দয়াময়ী? চার দিকে চেয়ে তখন ভীষণা ছাড়া আর কোনও মূর্তি আমি দেখতে পেলাম না। সত্যি-সত্যি নেশা হঠাৎ মাথায় চড়ে গিয়েছিল কার, বাবার না তোমার? ঘরের ছবিটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, দেওয়ালগুলো টলতে টলতে এগিয়ে আসছে। নেশা কি আমারও?

সেদিন বাবার মড়ার মতো মুখচ্ছবি দেখেই ভয় পেয়েছি। আঘাতটা কত গভীর ক্ষত বুঝিনি। আজ অনুভব করছি। পরে নিজেও কলম ধরেছি কিনা! কিন্তু দয়াময়ী, তোমাকে কী করে বোঝাব! ওর চেয়ে যে বড় মার নেই সেকথা যারা কোনওদিন কিছু-না কিছু লিখেছে তারাই জানে; যারা লেখে না, তারা বুঝবে না।

.

সেই সময়টাতে স্কুলের শেষ পরীক্ষাটা সামনে থেকে মুখ ভেংচে যদি ভয় না দেখাত, সেবার বছরের ওই ক’টা মাস আমার আরও কষ্টে কাটত। পড়ার চাপে আমি তলিয়ে গেলাম। দেখলাম না দমকা হাওয়ায় হাওয়ায় সেবার কত ধুলো উড়ল, পার্কের হলুদ ঘাস কবে আবার সতেজ হল। বাড়ির লিজ নিয়েছে যারা—যারা তেতলায় চিলেকোঠা আর-একখানা ঘর নিয়ে থাকে—তাদের পোষা পায়রাগুলো কখন তপ্ত হয়ে ডেকে ওঠে, ক্লান্ত হয়ে কখন যায় চুপ করে, কিচ্ছু টের পেলাম না।

আর মন দিলাম না, মা, আমাদের সংসারের মূর্তিটা যে ত্রিভঙ্গ হয়ে আছে সেদিকেও। ত্রিভঙ্গ, কিন্তু তিন খণ্ড নয়। জোড়াই ছিল, কিন্তু জোড়াগুলো যে কত আলগা বোঝাও যাচ্ছিল। তবু দেখেও দেখতাম না। দেখতে গেলে আমার পাস করা হবে না। পাস? ভুল বললাম। পাস, আমি জানতাম, করব ঠিকই, কিন্তু খুব ভালো রেজাল্টটা না করলে—

হাকিমি? দূর, হাকিমির কথা তখন কে ভাবছে? কলেজে অন্তত একটা ফ্রি-স্টুডেন্টশিপ্, বিনে মাইনেয় পড়ার অধিকার। কী হব, আমি তখনও ঠিক করতে পারিনি, শুধু “চয়েস অব্ এ প্রফেশন”, এই “এসে”-টা এলে কী লিখব, কষে সে বানানো ব্যাপারগুলো মুখস্থ করতাম। বাবা যা ছিলেন, সেই স্বদেশি হব না তো নিশ্চিত। জেলে-টেলে যাব না। তার মানে এই নয় যে, আমার দেশপ্রেম নেই। আছে যথেষ্টই, কেননা দুনিয়ার তামাম পরাধীন দেশের আন্দোলন, অগ্নিপরীক্ষা, আত্মত্যাগের ইতিহাস তখনই পড়ে ফেলেছি। ক্লাসের যে-ছেলেরা টিফিন-পিরিয়ডে দল বেঁধে আড্ডা দিতে বের হয় না, যারা মাঠে, দুপুরের রোদে, গোল হয়ে বসে, যাদের স্বভাবতই নেতা বীরেন, আকারে যে-ছোট্টটি, কিন্তু তেজে অপরিসীম, তাদের কাছ থেকে বইয়ের পর বই চেয়ে নিয়ে পড়েছি!

কিন্তু দলে নাম লেখাইনি। সাহসের অভাব? এক অর্থে তাই। যখনই ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম, ওরা তর্ক করছে, ক্লাবঘরেই ডেস্ক চাপড়ে বক্তৃতা দিচ্ছে, মাস্টারমশাই এলেও সরছে না, এক-একদিন তো বেপরোয়া ধ্বনি দিতে দিতে জলের তোড়ের মতো ক্লাস থেকে বেরিয়েও যায়, ওদের পিছনে গিয়ে যখন দাঁড়াই, তখনও ভাবি, দিই আমারও নামটা লিখে। ওরা সবাই পারছে, আমি পারব না।

কিন্তু পারি না। মা, তখনই হাত কাঁপে, চোখের পাতা ক্রমাগত পড়তে থাকে, যেহেতু তুমি সব কিছু আড়াল করে দিয়ে দাঁড়াও! আমি তোমাকে দেখি। আমিও যদি, বাবা যা করছেন সেই মতো, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাই, তোমার হবে কী?

আমার বুকের বয়সোচিত আগুন তুমি বারে বারে স্নিগ্ধকরুণ চাহনির মিনতি দিয়ে নিবিয়েছ, কোনও দিন তাই বড় রকমের ঝুঁকি নিতে পারিনি, বে-হিসাবের সঙ্গে হিসাব আমার জীবনে জড়িয়ে গিয়েছে—মা, তুমি আমাকে কাপুরুষ করেছ।

এক দিকের অকৃতার্থ ব্যর্থতা আমাকে অন্য পথে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই পথ অন্তর্মুখী, একই সঙ্গে সঙ্গলোভী অথচ আবার লোকের সাহচর্যে ক্লান্ত-কুণ্ঠিত; সেই বহিবিমুখ মন ইতিমধ্যে খাতার পাতায় পাতায় কাঁচা অপটু বর্ণপাত করছিল। সে-সব লেখা লুকোনো থাকত, কাউকে দেখাইনি। পিতৃরক্ত নিয়তির মতো, তার হাত থেকে নিস্তার কোথায়!

কিন্তু সেবার, পরীক্ষা খুব কাছে কিনা তাই, সব বন্ধ ছিল। নইলে চোখ পড়ত বাবা আগেকার মতোই সময়মতো কাজে বেরোন বটে, কিন্তু ওঁর পা ফেলা যেন অনিশ্চিত একটু অন্য রকম। বাজার নিজেই নিয়ে আসছেন, কিন্তু কী আনতে হবে জিজ্ঞাসা করা নেই, কোনও-কোনওদিন তুমি বড়জোর একটুকরো কাগজে লিখে দিচ্ছ।

বিকেলে একজন উপযাচক টিচারের বাড়ি থেকে পড়া বুঝে ফিরতে দেরি হত। বকুনির ভয় ছিল না, কেননা অন্যায়ও তো কিছু করছি না, তা-ছাড়া জানতাম, তুমি আর বকবে না।

তবু উঠোন পার হয়ে কাঠের সিঁড়িটায় যখনই পৌঁছেছি, তখনই পা একটু ঠেকে গেছে। এখনই বুঝি কেউ বেরিয়ে আসবে, “আসবি? আয় না, আয়” শুনতে পেয়েছি। হাত তুলে চৌকাট ধরে কে যেন ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে। গায়ে কাঁটা দিত, সিঁড়িটা নড়বড়ে জানি, তবু লাফিয়ে লাফিয়ে টপকে একেবারে উপরের বারান্দায় এসে দম নিয়েছি। আর ভয় নেই, নিরাপদ এবার।

তাই, দিনগুলো পড়ার ঘোরে কেটে গেল, কী ঘটছে না ঘটছে খেয়াল করিনি। পরীক্ষা যেদিন শেষ, সময় ফুরোবার আগেই শেষ খাতাটি জমা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি, আকাশের দিকে চেয়ে আর পলক পড়ে না, এ অপর্যাপ্ত আলো, দশ দিক খোলা তবু সারা অঙ্গ সোনার পাতে মুড়ে ওই আকাশ কী-করে যে এমন স্থির-নিশ্চিন্ত নির্ভয় থাকে!

আসলে দশ দিক খুলে গিয়েছিল আমার। রেলিং-এ ঝুঁকে-পড়া এক মহিলা, মনে হল এর চেয়ে মহীয়সী আমি কাউকে দেখিনি, ঠেলা গাড়িতে চড়া ভিখারিকেও ঠেকছিল সুন্দর, সুন্দর রাস্তার প্রত্যেকটা ঘরবাড়ি, ফলওয়ালারা হাঁকছে “গেণ্ডারি গেণ্ডারি!” আমার জন্যে। মেয়েদের স্কুলের একটা রূপসী বাস এসে দাঁড়াল—আমার জন্যে। অনেকগুলো গাড়ি মোড়ে মোড়ে ভেঁপু দিচ্ছিল, যেহেতু আজ আমি নির্ভার, নির্ভাবনা, তাই এতদিন ধরে দেখা শহরটা এইদিন অপরূপ হয়ে দেখা দিল। বিকালের রোদ্দুরে পানের দোকানে ঝলসাচ্ছে আয়না, আজ একটা পান খাব, সেই সঙ্গে নিজের মুখ একবারটি দেখে নেব। সুর করে কী বলছে ওই ফিরিওয়ালাটা?—”যা লেবে তা দো-আনা, লে যাও বাবু দো-আনা?” নেব, নেব, সব নেব, কিচ্ছু ভেবো না।

প্রথম ‘পরীক্ষা চুকে যাওয়ার সেই অনুভূতি। সেই স্ফূর্তি, সেই মুক্তি—তার স্বাদ পরের বারগুলোতে তেমন করে পাইনি। কী করব এখন, আমাকে নিয়ে, এই সময়টাকে নিয়ে? বেলা-তো, বড় একটা ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে চারটে মোটে, বাড়ি যাব কি? কিন্তু পা সরছে না সেদিকে, সবিস্ময়ে অনুভব করছি, আমি আর নেই আমার বশে, কে যেন উড়িয়ে নিয়ে চলেছে আমায়, টানছে, ঠেলছে, যেদিকে খুশি সেদিকে, আমি—আমি অপহৃত হয়ে যাচ্ছি।

মা, এতখানি ভণিতা শুধু সংকোচ কাটিয়ে উঠতে। এবার তোমাকে সেদিনের পরিণতির কথা বলি।

.

“এদিকে কোথায়”, ভয়ে ভয়ে বলেছিলাম।

“ভয় নেই, বিপথে নিয়ে যাব না”, মুচকি হেসে একজন বলেছিল।

বলেছিল যে, সে বুলা। এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত যে গঙ্গার পাড়ে পৌঁছে যাব, আগে বুঝিনি। এদিকে রাস্তাগুলো সব যেন পাতা-কাটা পরিপাটি, জোরে জোরে হর্ন বাজিয়ে তার চেয়েও জোরে চলে যায় গাড়ির পর গাড়ি। সাবধানে পার হচ্ছি, দূর থেকে ফাঁপানো একটা ফ্রক দেখেই চমকে উঠেছিলাম, কিন্তু তখন আর সময় ছিল না।

উঁচু ভাঙামতো জায়গাটা থেকে নেমে এসেছিল বুলা, মুখে লাল-রিবন হাসি, একটুও অবাক হল না, একবার জিজ্ঞেস করল না আমি ওখানে কী করে এলাম, এসেছি কেন। আসব, যেন ও জানত। তাই নেমে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আয়।”

“কোথায়।”

বুলা হাত ধরে টেনে আমাকে রাস্তা পার করে দিচ্ছিল, ঘাড় ফিরিয়ে বলল, “ভয় নেই, বিপথে নিয়ে-যাব না।”

ওপারে রেল লাইনের ওপর পরির মতো শরীর রেখে, যেন উড়ে যাবে সেইভাবে, বলল, “এটা একটা ঘাট, নাম আউটরাম্। আঘাটায় তোকে নিয়ে আসিনি।”

বুলার জুতোর আজ গোড়ালি উঁচু, ফলে মাঝে মাঝেই আমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিল, ফলে ওর পা আজ কতকটা সুডৌল দেখাচ্ছিল। হেসে বলল, “নাগাল পাচ্ছিস না?”

চট করে জবাব দিলাম, “তোমার নাগাল আমি এমনিতেও পাব না। যা জোরে ছুটছ!”

“বেশ, দাঁড়াচ্ছি—ওই ওখানে গিয়ে। ওটার নাম জেটি, ওর দোতলায়। জোয়ার এলে সবটা দোলে।”

কূলে কূলে লোহার বেড়ি-পরানো বাঁধা জাহাজ, অতিশয় বাধ্য বশ-মানা, মাঝে মাঝে ধৈর্য হারিয়ে মোটা গলায় ডেকে ওঠে বটে, কিন্তু হাত-পা ছোঁড়ে না, বিশ্বাস করা শক্ত যে, এই জাহাজগুলোই কখনও অকূলের ঠিকানা খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে, বা খুজে পেতে ফিরে এসে পাড়ে ভেড়ে আবার। দেখে মনে হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *