১
তার প্রথম চিঠি “শ্রীচরণেষু মা!” চিঠি লিখে লিখে তামামশোধের যে-খেলায় সে নেমেছে, তার প্রথম চিঠি মাকে লেখাই তো ভালো। যিনি মূল, যিনি ধাত্রী, তাকে এনেছিলেন, ধরেছিলেন। প্রাণের ঋণ, ধারণের ঋণ। রক্তের, স্তন্যের, স্নেহের, নীড়ের ঘিরে থাকার, ঢেকে রাখার, দৃষ্টি দিয়ে পিছনে ছোটার…মমতায়, উৎকণ্ঠায়, আতঙ্কে। অহর্নিশ “ভালো হোক” ভাবনায়।
[এই ব্যক্তিটি কে, একে কি আমি চিনি, দেখেছি কখনও? কী করে চিঠিগুলো আমার হেপাজতে এল, স্পষ্ট মনে করতে পারছি না। যেন এক যাদুকর হঠাৎ কোথা থেকে একদিন সামনে এসে দাঁড়াল, টেবিলের উপরে ছুঁড়ে দিল কাগজের বান্ডিল, সম্মোহক দৃষ্টিতে আমাকে বিদ্ধ করে বলল, “সাজিয়ে নাও”। রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনীতে যেমন ঘটে। তার চোখে শীত, তার স্বরে শীত, মানে শীতে, যেন শিটিয়ে-কঠিন, আর আদিষ্ট আমি কাগজগুলো হাত বাড়িয়ে ধরে অনিশ্চিত, কম্পমান। “সাজিয়ে নাও”, হুকুম শুনেই আমি ‘অবশ্য অবশ্য’ বলে একটু একটু হাসতে গেলাম, সেই হাসি কাগজ ছেঁড়ার ফড়ফড়ের মতোই শোনাল, সাজাব যে, কিন্তু কীভাবে তার কূল পাচ্ছিলাম না; খেলা ভেঙে গেলে যেভাবে পড়ে থাকা তাস কুড়িয়ে সাজিয়ে তুলি সেইভাবে?
কতক্ষণ সে ছিল মনে নেই, কখন দেখি মগ্ন হয়ে গিয়েছি সেই পত্রস্তূপে, আর পড়তে-পড়তেই টের পেয়েছি আমাকে কী করতে হবে। আগাগোড়া ঢেলে সাজালাম আমার নিজের প্যাটার্নে, তাতে উন্নতি কিছু হল কিনা জানিনে। জানি, যেহেতু সে উপস্থিত আছে, কোথাও আছে, হঠাৎ না-জানি কখন আবার আবির্ভূত হয়, অতএব নিরুপায়, আমাকে গুছিয়ে তুলতেই হবে।
“কেননা আমি পৌত্তলিক”, তার লেখা প্রথম বাক্যটি এই ছিল, এভাবে আবার অন্বয় হয় নাকি! তাই ঘুরিয়ে, যেভাবে লেখা হয়ে থাকে, মানে লেখকেরা লিখে থাকেন, সেই অভ্যস্ত ছাঁচে তার গলগল তারল্য ঢেলে দিলাম। একটু চিটচিটে হোক, নইলে পড়া যাবে না।
এইবার শুরু। ]
তার প্রথম চিঠি “শ্রীচরণেষু মা।”
যে-পূজায় সে বসেছে, বয়সের বেশ কয়েকটা বাঁক পার হয়ে এসে, তার উদ্দিষ্ট দেবতা অনেক, কেন না সে পৌত্তলিক, কেন না সে বহুর সঙ্গে বাসনায়, ঘৃণায়, আশায়, হতাশায়, আচারে-অভিচারে—এবং কৃতজ্ঞতাতেও—লিপ্ত। যত পুতুল আর প্রতিমা আজ সুদূর-উদ্ভাসে ঝাপসা চোখে ধরা দিচ্ছে তার প্রথমটি মা হবেন না তো কে!
কিন্তু কেন। বোঝাপড়ায় সব চুকিয়ে দেবার দুর্মর সাধ তাকে কেবলই মর্মরিত করে কেন! কোন্ ঋণ শোধ হয় কবে, আর দেউলিয়া দশায় দাঁড়িয়ে কি কেউ ধার মিটিয়ে দিতে পারে?
তবে হয়তো কথাটা ঋণ নয়। পাপবোধ। যাদের প্রতি পাপ করেছি, তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। যাদের সঙ্গে করেছি, তাদের ভাগ দিতে ডাকব, আরও কে-যেন একদিন ডেকেছিল না? কী নাম, কী নাম যেন তার। রত্নাকর। সে সাড়া পায়নি, আমি পাব। আর যারা অন্যায় করেছে আমার প্রতি, তাদের, তাদের প্রত্যেককে ডেকে ডেকে চুল ছিঁড়ে অভিশাপ দেব। দেব, যেহেতু আমি রক্তমাংসের মানুষ, জিতেন্দ্রিয় নই, আমার সত্তায় ত্রিগুণাতীত কোনও দৈবী আবেশ নেই, অতএব আমি বলে যাব। একে আমার সওয়াল বলতে চান বলুন, জবাব বলতে চান বলুন, কাউকে অনুযোগ, কাউকে নালিশ—এই আমার শেষ টেস্টামেন্ট, আখেরি বোঝাপড়া। আসলে বোঝাপড়া এই পৃথিবীর সঙ্গে, পরিচিত মানব-মানবীর—একটু আগে যাদের দেব-দেবী বলেছি—সমষ্টি যে-পৃথিবী। যার জরায়ুতে এতকাল বাস করেছি, শ্বাস নিয়েছি, কখনও ফুঁসেছি দম বন্ধ করে, যে জুগিয়েছে কত সুখ আর যতেক অসুখ, তার সঙ্গে একটা হেস্ত-নেস্ত না করে চলে গেলে পুনর্জন্ম নামক একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে না! অন্তত অতৃপ্ত আত্মা প্ৰেত হয়ে ফিরে আসবে। ইহজন্মের কোনও জের তাই রেখে যেতে চাই না।
.
হঠাৎ একটা কঠিন অসুখে পড়ে শীতের শেষ-বেলায় সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এইসব ভাবছিল। অদ্ভুত এই খেয়ালটা এসেছিল তার মনে, চিঠি লিখে-লিখে যাবার। সবাইকে ডাকার, মুমূর্ষুর শয্যাপার্শ্বে যেমন ডাকে। ডাক্তারবাবুর উপস্থিতিকে উড়িয়ে দিয়ে, সকলকে কাছে ডাকা, তখন মুখে কথাও ফোটে না, মাথায় কপালে হাত বুলানো, চোখে জল, মুখে ফোঁটা কয়েক গঙ্গাজল।
সেদিন কী-যেন-কেন তার কেমন ধারণা হল, সে বেশি দিন আর বাঁচবে না। আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ধারণাটা মনের মধ্যে আস্তে আস্তে বসে গেল, টিউবওয়েলের নল, যেমন স্তরের পর স্তর ফুঁড়ে মাটিতে বসে। আকাশের আকার ডিমের ঘোলাটে সাদা খোলার মতন, শীত কিনা তাই নীলরঙ। অনন্ত-টনন্ত এ সব মাথায় তখন আসছিল না, হতাশ ছাই-ছাই ডানার কয়েকটা পাখি তখনই ক্লান্ত ফিরে আসছে। বিড়বিড় করে সে নিজেকে বলল, শীতের বেলা দ্যাখ, কেমন হঠাৎ বুজে যায়, সোনাদানায় ভরা সিন্দুকটায় ঝপাং করে ডালা পড়ার মতো। বেলাটা এই জ্বলছিল, এই নিবে একেবারে ধোয়া-মোছা চিতা হয়ে গেল।’
পেটের যন্ত্রণাটা তখনই নড়ে চড়ে উঠল, যেন গর্ভস্থ ভ্রূণ যার বিনাশ শতমারী বৈদ্যেরও অসাধ্য, হাতড়ে হাতড়ে একটা বড়ি খেল সে, কুঁচকে যাচ্ছে ঠোঁট, চোখের কোণ, দুই ভুরুর বিভাজিকা কপাল, তলপেট চেপে ধরেও ত্রাণ নেই।
বিস্তারিত আকাশের আশ্বাসে মরা মাছের মতো চোখ দুটি ন্যস্ত করে সে বিড়বিড় করে বলে উঠল, “এইবার আমি যাব। স্বদেশে ফিরব।” ভিতরে ভিতরে এই সে প্রথম যথার্থই প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল, স্বদেশ! স্বদেশ! একটা আকস্মিক আলোড়নের মতো। যেখানে সে আছে, এই শয্যা, এই ঘর, তার নয়, সাময়িক সরাই শুধু, এই যন্ত্রণার আগে এবং পরে আছে যা তার উৎস, বা যা তার পরিণাম। যেখানে সে সহজ, স্বচ্ছন্দ, শান্ত। তার স্বদেশ।
কষ্ট হবে না? হবে। দুঃখ পাব। সে তো—সে বিচার করে দেখল-কতবার যে বিদেশে যাই, ফেরার সময় ঘরের হাতছানি সত্ত্বেও, একটু টন্টন্ করে। এত আলো, এত ঐশ্বৰ্য, ঝকঝকে রাস্তা, বিলাস, আরাম, মসৃণতা এ সব ছেড়ে সেই শহরে আবার, যেখানে কত ধুলো, সব কত চাপা-চাপা, অভাব সর্বত্র।
তবু সেই স্বদেশের শহর তাকে টানে। আজ আরও দূরের, সামনের, হয়তো পিছনেরও, আর-এক স্বদেশ যেমন টানছে। সেখানে গেলে এ-দেশ থাকবে না, পায়ের তলার এই মরমী মাটি, শয্যার উষ্ণতা, এই স্বাদ, প্রাণ, মোহ, পরিজন, কত সুখ, কত ক্ষত। এ সব ছেড়ে যেতে একটু লাগবে বইকি, বিদেশ ছেড়ে আসতেও যেমন লাগে। তবু ফিরতে হবে, ফিরতে চাই, যদিও সেই জীবন সেই অস্তিত্ব কেমন, তা জানি না, অন্তত মনে নেই। সেখানে সবই হয় বায়বীয়, অথবা বায়ুর চেয়েও নির্ভার, নীরূপ, যা ভাসমান। মোহানার নদী, নদীর প্রার্থিত নিয়তি সমুদ্রও তো অলক্ষ্য সূক্ষ্মাকারে আকাশে ফেরে।
স্বদেশে ফেরার আগে সব দুঃখ-সুখ, আঘাত-অভিমানের খোপে খোপে সে একটি করে চিঠি লিখে রেখে যাবে ভাবল। তার সব অতৃপ্তিতে এইভাবে পূর্ণাহুতি। বিষয়ী মানুষের শেষ সই যেমন তার উইল।
মনে মনে ডাকল সে অনেককে একে একে, যারা জীবিত; যাদের জীবদ্দশায় সব খুলে বলে ফেলা অসম্ভব বলে সে এতকাল জানত। ডাকল তাদেরও, যারা মৃত। হ্যাঁ, মৃতদের কাছেও নতজানু হয়ে স্বীকারোক্তি পেশ করবে, তবে সে মুক্ত। তাই কাগজ-কলম টেনে, ব্যথায় অস্থির সে মাঝে মাঝে থেমে, শিরোনামায় লিখল “শ্রীচরণেষু মা!”
শ্রীচরণেষু মা, সম্বোধনের এই পাঠটা লিখেই তোমার যে ছবিটা ফুটে উঠেছে, সেটা বাঁধানো, টাঙানো, প্রায়-জীর্ণ একটি বয়সের ফোটো মাঝে মাঝে যাতে স্মরণদিনে মালা-টালা ঝুলিয়ে দিই। কম বয়সের ছবি বিশেষ মনে আনতে পারছি না। যদিও এক-আধখানা তোলা হয়েছিল নিশ্চয়, সেকালের সেই ফোটোয়ালরা তেপায়ার উপরে ক্যামেরা রেখে কালোকাপড়ে মাথা মুড়ি দিয়ে যে রকম ছবি তুলত। তোলা কি আর হয়নি, ধর তোমার বিয়ের সময় কিংবা তারও আগে, থর-থর একটি কিশোরী কুসুমকুমারী, নকল চাঁদ-আঁকা পট পিছনে রেখে গালে হাত দিয়ে উদাস, ভাবছে। পাত্রপক্ষকে যেসব ছবি ডাকে পাঠানো হত, কিংবা যারা দেখতে আসত, গুঁজে দেওয়া হত তাদের হাতে। যারা পছন্দ করতে আসত, তাদের শোনাতে তুমি কি গানও গাইলে, বলো না মা, বলো না! নাকি এসব রেওয়াজ হয়েছিল আর একটু পরে, তোমাদের কালে শুধু মুখে মুখে সম্বন্ধ, স্নানের ঘাটে কোনও গৃহিণীর হঠাৎ নজরে পড়ে যাওয়া, তারপর কুষ্ঠিঠিকুজি মেলানো, মেয়ে পয়মন্ত কিনা; কটা পদ জানে রাঁধতে, পারবে ক’জনের হাঁড়ি ঠেলতে। যারা দেখতে আসত, তারা বাটা-ভরা পান গাল ভরে খেত, আর বড় চুল খুলিয়ে পা-পা হাঁটিয়ে, দেখত চলন, কখনও শাড়ি তুলিয়ে পায়ের গোছ গড়নও দেখত। খুশি হলে বলত, “যেন লক্ষ্মী ছাপ।”
যে ছবিটা এখন দেখছি, সেটা ঝোলানো আছে এই বাড়িরই কোনও ঘরের দেয়ালে। ওটা বোধ হয় একটা গ্রুপ থেকে আলাদা করে নেওয়া, তোমার মৃত্যুর পরে যখন মাথা খুঁড়ে মরছি ছবি কই, ছবি কই, যেভাবে হোক আবিষ্কার করা চাই, নইলে ছাই বাঁধিয়ে রাখব কী, ঘটা করে স্থাপিত করব কোন্ প্রতিকৃতি শ্রাদ্ধবাসরে?
এই গ্রুপের কুণ্ঠিত, একান্ত ছবিটা তোমার জবুথবু অশক্ত বয়সের, মুখটা যখন মাকড়সার জাল, মায়াবী ভীরু ভীরু চোখ দু’টি চশমার পুরু কাচে ঝাপসা। বেশি নড়া-চড়া করতে পারতে না, এক ঠায় বসে তোমার চোখ দু’টি দুপুর গড়িয়ে বিকেলের সূর্যের মতন ঘুরে ঘুরে যেত। ফোটোটা তোলার আগে তোমাকে ধরে ধরে চেয়ারে বসানো হয়েছিল, তোমার ঠোটে তখন কয়েৎবেল-মাখা আচার লেগেছিল। আঁচলের কোণে মুখটা মুছেছিলে। তবু কিন্তু হাসি ছিল না, মা, তখন তুমি হাসতে না, তোমার হাসি ঢের আগেই ফুরিয়ে গিয়েছিল। এই ছবিটা দেখতে দেখতে আরও যত ক’টা ছবি ভেসে উঠছে, সবই ওই এক-ধারা বিষণ্ণ, গম্ভীর, ভীতু-ভীতু। হয়তো অনেক ঘা খেয়েছিলে বলে একটা ভয়ই হয়ে গিয়েছিল, তোমার মুখমণ্ডলের প্রসাধন, চর্চিত মুখে যেমন স্নো-ক্রিম, তোমার মুখে ও তেমনই একটা আতঙ্ক লেপা থাকত। একটা ভরসার নিশ্চিন্ত খুঁটি তোমার আগেই নড়ে গিয়েছিল, তোমার প্রথম যখন দাঁত নড়ে তারও অনেক আগে, তোমাকে সজ্ঞানে যবে থেকে জেনেছি, তবে থেকেই তুমি একটি কাঁপা-কাঁপা স্নায়ুর পুটুলি।
তোমার যৌবনকাল আমি দেখিনি। মানে স্মরণে আনতে পারছি না, স্মরণে রাখিনি অর্থাৎ পাতা কেটে তুমি চুল বাঁধতে যখন, তুমিও বাঁধতে, নইলে বাবা যেদিন-যেদিন হঠাৎ-হঠাৎ আসত, সেদিন খাটে পা দুলিয়ে মুখ তুলতে কী করে, কিংবা যে বয়সে তুমি ঝুপঝাপ ডুব দিতে পুকুরে, কলসি বুকে দিয়ে দিতে সাঁতার, পাড়ে ভিজে পায়ের ছোপ এঁকে শপশপে কাপড়ে ঘরে ফিরতে। তুমিও কি ছিলে কোনও প্রতাপের শৈবলিনী? ক্ষমা করো, এসব আমার বলার কথা নয়, বলা উচিত কিনা ঠিক করতে পারিনি।
(আমার জন্মকালে যে মেয়েরা যুবতী ছিল, তাদের আর দেখা যায় না। তারা নেই। আর তখন যারা জন্মাল? হাহাকারের মতো টের পাচ্ছি, তাদের কেউ আর যুবতী নেই, কেউ বিগত, কেউ জরতী। আজ তাদের বয়স দিয়ে আমার বয়সটাকে মাপি, কুন্কো দিয়ে চাল মাপার মতো।)
কী জানি, কখনও ভাবি, সেই কুড়িতে বুড়ির কালটাও এক হিসাবে ছিল ভালো। জুড়োতে যখন হবেই, তখন তাড়াতাড়ি জুড়িয়ে যাওয়া, সেই বা মন্দ কী। মুখের শিরাগুলি তো কষ্টের রক্তেও ফুটন্ত। দীর্ঘকাল যৌবনকে ধরে রেখেছি বলে যারা দাপাদাপি করি, তারা বুঝি না যে আসল সময় থেকেই না-হোক খানিকটা সময় খোয়া যাচ্ছে, বেশিক্ষণ ধরে হাবুডুবু খায় যে, তার জিৎ, না তাড়াতাড়ি পাড়ে যে পৌঁছে গেল, জিৎ তার? ভালোমন্দ যা কিছু আছে যত শিগগির সম্ভব চুকে যাক, ক্ষণায়ু প্রাণীদের জগতে যা দেখি—জনন, প্রজনন সব লহমায় পার। তারা কি ঠকে? আমাদের সীমিত বিচারে তাই বটে, কিন্তু তুচ্ছ আপেক্ষিক অর্থে। মহাকালের পরমায়ু কোনও মানুষও তো পায় না। তবে কিসের ডগমগে দেমাক?
মা, তোমার সেই পাড়ে-বসা রূপই বেশি দেখেছি। একের পর এক থাক থেকে থাকে, ক্রমাগত না পাওয়ায়; নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই পাড়ে পৌঁছে গিয়েছিল।
.
তোমাকে আকুলিত হতে কখনও কি দেখেছি, কোনও হাসিতে কি ঠাট্টায়, জাঁতি হাতে সুপুরি কুচোতে কুচোতে পড়োশিনীদের গায়ে গড়িয়ে পড়ায়? মনে পড়ছে না। গানের কথা তো ওঠে না, তখন গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা গান কমই গাইত, বেশির ভাগ জানতই না।
তবে তারা শুনত। চিকের আড়ালে ধোঁয়া ধোঁয়া মুখ, মাথায় ঘোমটা, সারা গায়ে আলোয়ান জড়ানো, দল বেঁধে পালাগান কি কীর্তন শুনতে যেত, বাচ্চাদেরও নিয়ে যেত কোলে বা কাঁকালে। তুমি ঢুলছ, আশেপাশে ফিসফিস,চাপা হাসি, ঠিক তখনই হয়তো আসরে দুই সৈনিক তরোয়াল খুলেছে, আমি সেই ঝনৎকারে উত্তেজিত তোমাকে ঠেলেছি, ‘ওমা, দ্যাখো, দ্যাখো না!’ জয়দেব, হরিশচন্দ্র—কেঁদে তোমার চাদর ভাসিয়েছি, কখনও তুমি যখন মুগ্ধ মগ্ন, ঠেলে ঠেলে তোমাকে বিরক্ত করেছি, বায়না তুলেছি ‘বাইরে যাব, বাইরে যাব’ বলে। সরিয়ে দিয়ে তুমি বলেছ, ‘যা না, ওই তো মাঠে।’ আমি যেতাম না। ওই বয়স থেকেই আমি একটু ভীতু।
ওই ভয়-ভয় ভাবটা আমি কি তোমার কাছ থেকেই পাই? রাত্রে পেঁচার ডাক শুনে চমকানো, স্বপ্নে আঁতকে ওঠা, সন্ধ্যায় গা-ছমছম, দেয়ালের দাগে নানা না-জানা মানুষের ছাপ খুঁজে পাওয়া, বটগাছের গোড়ায় তেলে-সিন্দুরে মাখামাখি রঙটা তো ভয়াবহ রকম, সর্বত্র অশরীরী কিছুর অস্তিত্ব কল্পনা, কারা যেন কাঁচা মাছের আঁশ চিবোয়, দুপুরে কুকুরের কঁকিয়ে কান্না—সব সেই থেকে আমার স্নায়ুতে জড়ো করে জমিয়েছি। আজও, এই বেমানান বয়সেও, পুষে রেখেছি। ওরা যাচ্ছে না কিংবা ওদের যেতে দিচ্ছি না, কারণ গেলে তো বেবাক সাদামাটা হয়ে গেল, যা-দেখতে পাই ভয় ব্যতিরেকে তার বাইরের কিছুর অনুভব আমি কী করে পাব।
আমাদের সেই আধা-শহরের বাড়িটার চারপাশে মৃত্যু যেন সততই হালকা পায়ে ঘুরে বেড়াত। টিনের চালটা মাঝরাতে কেন যে থেকে থেকে কটকট ডেকে উঠত, পেয়ারা-গাছে ঝোলা বাদুড়গুলো কাকে যে দেখতে পেয়ে দুদ্দাড় উড়ত, আমি কিছুই বুঝতাম না, খালি কাঁথার নীচে আরও গুটিগুটি তোমার গায়ের গন্ধ নিতাম।
জীবনে প্রথম কবে সজ্ঞানে কাঁদি মনে নেই, কবে কী দেখে প্রথম হেসে উঠি ভুলে গিয়েছি তাও, কিন্তু প্রথম দেখা মৃত্যুটি মনে আছে—আমার দাদার। এক অর্থে তোমারও বোধ হয় মৃত্যু সেই দিনে। হঠাৎ চিৎকার করে উঠেই পাথর হয়ে গেলে, তার আগের আর পরের তুমি একেবারে আলাদা, কে বা কারা যেন তোমাকে ধরে রইল, ধীরে ধীরে উঠিয়েও নিতে চাইল, তুমি উঠছিলে না, জাপটে রইলে দাদার দেহটা, তোমার প্রথম সন্তানের, ওরা জোর করতেই ঠাস করে পড়ে গেলে মাটির উপরে। হয়তো তখন তোমার সম্বিত ছিল না। লণ্ঠনটা জ্বলছিল, মৃত্যুর দৃশ্যে পরে দেখেছি, সিনেমায় যেমন নেবে, প্রতীকী ধরনে, কই, তেমন করে তো নিবল না।
তখন আমার বয়স কত আর, বারো-তেরো, একটু একটু মনে পড়ছে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ার মতো। মৃত্যুকে সেই থেকে আমার ভয়, আবার মৃত্যু আমাকে টানত। আজ স্বীকার করি, কেউ কোথাও মরছে শুনলে পরেই সেখানে যেতাম ছুটে, ভিড়ের সঙ্গে মিশে, উঠোনে নাওয়া নেই, খাওয়া নেই দাঁড়িয়ে থাকতাম; ড্যাবডেবে চোখে দেখতাম ডাক্তার গলায় নল জড়িয়ে বেরিয়ে আসছে, ওষুধ আনতে ছুটছে কেউ কিংবা কমপাউন্ডারের হাতে ছুঁচে-ভরা ইনজেকশন, আমার চোখের পাতা কাঁপছে অধীর অপেক্ষায়, কখন চাপা ফোঁপানিগুলো হা-হা কান্নায় ফেটে পড়ে, শুনতে পাব! যদি রোগী না মরত, যদি অন্তত মৃত্যুটা পিছিয়ে যেত, বোঝাতে পারব না কী যে হতাশা, কী যে অবসাদ আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেত! যেন কেউ কথা দিয়ে কথা রাখল না, চোখে-কানে শোক চাখার চমৎকার স্বাদ পেতে দিল না, সেই নীচ নিষ্ঠুর, অদ্ভুত মনোভাবটা কথায় বোঝাব কী করে! আর কারও ভিতরে ভিতরে এই জিনিসটি আছে কিনা জানি না, আজ সরাসরি লিখে দিচ্ছি আমার আছে।
দাদার মৃত্যুর পরদিন সকালের সেই ছবিটা। সুধীরমামার চেহারাটা মনে পড়েছে, শবের শিয়রে দাঁড়িয়েছিলেন, হয়তো সারারাতই ছিলেন, তোমার মাথায় হাত রেখেছিলেন, আর তখনই কি বিশ্রী চিৎকার করে উঠলে তুমি, মা! পাগলের মতো মাথা নেড়ে নেড়ে বলে উঠলে “না—না—না।” সকলে মিলে যা পারেনি, সুধীরমামার একটুখানি ছোঁয়াতেই তাই হল, চুল খোলা, আলুথালু, তুমি ছিটকে সরে গেলে, খুঁটিতে মাথা ঠুকছিলে।
সুধীরমামা গেলেন সেখানেও। এবার জোর মুঠিতে ধরলেন তোমার শাঁখা সমেত হাতের কবজি, “ছি, আনু, ওরকম করে না, শান্ত হও”, পুট করে শাঁখাটা ভেঙে গেল, ফুটল তোমার সাদা চামড়ায়, অল্প একটু রক্ত দেখা দিল! রক্ত দেখে একটু থতমত তুমি ডুকরে উঠলে ভাঙা গলায়, “বলে দাও সুধীরদা, কী রইল আমার, আমি কী নিয়ে থাকব।”
দৃশ্যের ফ্যালফ্যাল দর্শক আমি একটু দূরে অবোধ দাঁড়িয়েছিলাম, যেন সেদিন সকালে এইটেই আমার ক্লাসের পড়া, কিন্তু এক ফোঁটা মানে বুঝছি না। মৃত্যুতে কী যায়, কার যায়, কিছুই তখন বুঝতাম না তো!
সেই দর্শক অকস্মাৎ দৃশ্যে উৎক্ষিপ্ত হল। কখন আমাকে টেনে নিয়ে গেছেন সুধীরমামা বসিয়ে দিয়েছেন তোমার কোলে, বলেছেন, “ওর দিকে তাকাও, একদিন ওই তোমার সব হবে।”
কী ঠান্ডা হাতে আমাকে তখন তুমি চেপে ধরেছিলে মা, আমার শরীর শিরশির করছিল। তোমার চাহনি বিহ্বল, দেখছ আমাকে, অথবা দেখছ না কিছুই, কিংবা সেই মরা দৃষ্টি কি তখন ঘুরে ঘুরে একটি মরা মুখের সঙ্গে আমার মুখটা মিলিয়ে দেখছিল?
নিচু গলায় হরিধ্বনি দিতে দিতে ওরা যখন দাদাকে তুলল, তখন আমাকে কোলে জাপটেই পিছু পিছু ছুটে গেলে তুমি, সকলে মিলে পথ আটকাতে আমাকে কোলে নিয়ে ফিরে এলে।
ওরা ফিরে এল দুপুরের পরে। শূন্যতা হাতে নিয়ে কেউ যে ফেরে, ফেরা যায়, সেটা তখন বুঝতাম না, বুঝেছিলাম অনেক পরে বিজয়ার বিসর্জনের সন্ধ্যায়, আরও বড় হয়ে, কিন্তু সেদিন ওরা ফিরল, অথচ দাদাকে ফিরিয়ে আনল না, দাদা আর নেই, ফিরবে না; সেটা তখনই যেন প্রথম নির্ভুল জেনে আমিও হঠাৎ গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলাম, যে-দাদা অঙ্ক ভুল হলে মারত, যে এদিক-ওদিক বেরিয়ে গেলে বাঁচা যেত, বাজার থেকে কখনও আমার জন্যে সন্দেশও আনত, সে আর ফিরবে না বুঝে, সব মিলিয়ে, তার জন্যে কাঁদলাম।
মা, তখন তোমাকে আর ধরে রাখা যাচ্ছিল না, মাথা নাড়ছিলে বেভুলের মতো, আঁচলের দিশা নেই, হঠাৎ কী হল, সুধীরমামার কাঁধ খামচে ধরে—এবার তুমি নিজেই ধরলে—কেবলই বলছ, “কোন্ পাপে আমার এমন হল, বলে দাও তুমি সুধীরদা, বলে দা—ও!”
আমি আজও সেই দৃশ্যটা দেখছি। তোমার রুক্ষ চুলে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন সুধীরমামা, খুব নম্র, খুব ধীর স্বরে বলছেন, “পাপ? সেকথা তো আনু জানা থাকে শুধু একজনের—যিনি ওপরে। মানুষ তো পাপ-পুণ্যের হিসাব রাখে না!”
.
সুধীরমামা। অনেকদিন নামটা মনে ছিল না, আজ তোমাকে এই চিঠিটা লিখতে বসে অবশ্যম্ভাবী ফিরে এল। পুরনো একটা পানা পুকুরে নাড়াচাড়া দিচ্ছি কিনা, তাই একের পর এক মরা মাছ ভেসে উঠছে।
সুধীরমামা কে, কোন্ সম্পর্কে মামা জানতাম না, তুমিও কোনওদিন বলে দাওনি। তখনকার কালে এসব দরকারও হত না। কাছে যে আসত, হাত বাড়িয়ে তাকেই নিতাম, মন এইভাবেই তৈরি থাকত কিংবা তৈরি করা হত! যেন স্বতঃসিদ্ধ কয়েকটি মানুষ বিনা প্রশ্নে জল, হাওয়া, সকালের ফেনাভাত, বিকালের মুড়ি পাটালির মতো স্বীকৃত, গৃহীত। গুরুজন, ওদের মান্য করতে হয়, এই সব শিক্ষা মজ্জায় মজ্জায় মিশে যেত। চট করে কেউ কাউকে পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করছে, আজকাল আর বড় একটা দেখিনে। ওপাটটা বোধ হয় উঠতে বসেছে।
সুধীরমামা, জীবনের সেই সকালে যেন একটি নিয়ম, একটি অভ্যস্ততা, একটি পৌনঃপুনিকতা। আজ ছবিটা অস্পষ্ট, তাই ঠিক ঠিক বর্ণনা হয়তো করতে পারব না, শুধু প্রস্থহীন একটা দৈর্ঘ্যের কথাই মনে পড়ছে। ওঁর পাশে সব কিছু কত ছোট, আমি তো সেই বয়সে কখনও ওঁর কোমর ছাড়িয়ে উঠতে পারিনি। মা, মনে হয় না যে তুমিও ওঁর বুকে ছাড়াতে পেরেছ। উনি ফরসা ছিলেন কিনা মনে নেই, পল্লীগ্রামে সে সময় ঠিকঠাক যাকে ফরসা বলে, সেরকম লোক বেশি দেখা যেত না তো, পুকুরের জলে, মাঠের রোদে, অন্তত পুরুষদের চেহারা কেমন একটা পোড়া-পোড়া হয়ে যেত। সুধীরমামাও, অনুমান করি, ছিলেন তামাটে।
ওঁর আর যেসব অনুষঙ্গ মনে পড়ছে তার মধ্যে একটা ছিল কমফরটার, উনি সর্বদাই গলায় জড়িয়ে রাখতেন।
(মা, তুমি ঠাট্টা করে বলতে ‘মহাদেবের সাপ’। হাসতে হাসতে জবাব দিতেন সুধীরমামা—’মহাদেবই তো, দেখছ না নীলকণ্ঠ হয়ে আছি।’ তুমি ভ্রূকুঞ্চিত করতে। কিন্তু সুধীরমামা যেই কণ্ঠনালীর কাছে ফুলে ওঠা নীল শিরাটা দেখিয়ে দিতেন, তুমিও হেসে ফেলতে তখন—’ওঃ এই মানে!’ )
ওই কমফরটার, প্রায় সুধীরমামার গায়ের চামড়ার মতো, নিতান্ত গরমের ভরদুপুর ছাড়া, ওঁকে কমফরটার ছাড়া দেখিনি। থেকে থেকেই খকখক কাশতেন, ওঁর কাশির ধাত, কখনও কখনও দেখেছি দমক পারছেন না সামলাতে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, গলার সেই নীল শিরাটা বুঝি পাইপের মতো ফেটে যাবে। হাত বাড়িয়ে এক গ্লাস জল নিতেন সুধীরমামা, সুস্থির হয়ে হাত বোলাতেন জিরজিরে বুকে, কেমন লাজুক হেসে বলতেন, বুকেই আঙুলে ঠেকিয়ে, “বিলকুল জখম, ভিতরে কিছু আর নেই, ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।”
মা, তুমি বলতে, “মাথায় তো আছে। যা আছে তারই খানিক আমার এই ছেলে দুটোকে দাও না।” সুধীরমামার চোখ দুটো প্রদীপ্ত হত–”দেব, দেব! ওরা বিদ্যায় বুদ্ধিতে মানুষের মতো মানুষ হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে, দ্যাখোই না।”
শীতে দেখতুম সুধীরমামা আরও নুয়ে-পড়া, গলাবন্ধ পাটকিলে কোটটার উপর জড়াতেন একটা বেখাপ্পা কমলা রঙের দোলাই, আরও শীর্ণ, জবুথুবু নিষ্প্রাণ ঠেকত। তখন আরও বিশেষ করে চোখে পড়ত ওঁর হাতের লাঠি। লাঠি ছাড়া ওঁকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ঠিক ভর দিয়ে চলতেন না, তখনও না, লাঠিটা কেমন একটু আগে ফেলে ফেলে এগোতেন, যার ফলে টকাটক আওয়াজ উঠত, বেশ খানিকটা দূর থেকেই বোঝা যেত উনি আসছেন, মনে হত যেন লাঠি ঠুকঠাক করে সুধীরমামা পরীক্ষা করছেন মাটিটা কত খাঁটি।
আর মনে পড়ছে সুধীরমামার নাকের লম্বা দুটি চুল, শুঁয়ো পোকার মতো লাগত, অনেকটা বেরিয়ে এসে গোঁফের চুলগুলোর দলে মিশে যেত।
(স্মৃতির ব্যাভার কী আশ্চর্য দেখছ? এত কিছু ভুলে গুলে খেয়ে নাকের দুটি চুল অ্যাদ্দিন বাদে কোথা থেকে তুলে এনেছে!)
চেয়ারে ঢুলতে ঢুলতে যখন নাক ডাকত সুধীরমামার, ওই চুল দুটি তখন কাঁপত। আমার তলপেটে তখন হাসির সুড়সুড়ি লাগত। তোমাকে ডেকে দেখিয়েছি কতদিন! চেয়ারে বসে ঘুম তো, একটু সাড়া শব্দেই ছুটে যেত। সিধে হয়ে বসতেন সুধীরমামা পিটপিটে চেয়ে বলতেন, “কী রে, কী দেখছিস?” নজরটার নিশানা দেরি হত না ধরে ফেলতে। চুল দুটো সোজা টানটান করে ধরে বলতেন, “ওঃ, এই! শুধু কি এই দুটি? ভালো করে চেয়ে দ্যাখ, আরো অনেক আছে, একটা ঘন অরণ্য। এই নাক কোথায় গেছে কেউ জানে না। কেউ ঢুকে ফিরে এসে বলেনি। দিশাহারা নিবিড় বন, শ্বাপদসঙ্কুল, তীর ধনুক হাতে আদিবাসী কিংবা”–মুচকি হেসে সুধীরমামা জুড়ে দিতেন, “বলা তো যায় না, হয়তো তপস্যারত মুনি ঋষিদেরও সাক্ষাৎ পেয়ে যাবি!”
২
রোজ সকালে সুধীরমামা ছিলেন ঘড়ির মতো বাঁধা। দাওয়ায় সকালে রোদ্দুর পড়ল আর উনি গ্যাঁট হয়ে মোড়ায় বসলেন। গুনগুন করে কী-একটা ভজন-না-কীর্তনের সুরও ভাঁজতেন, তার একটা লাইনই শুধু মনে পড়ছে, “নিশি অবসান হে।”
তুমি আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে বলতে, “কোথায় অবসান? অন্ধকার কাটার আমি তো কোনও লক্ষণ দেখছিনে।”
সুধীরমামা বলতেন, “কাটবে কাটবে!” আকাশের আলোর দিকে মুখ তুলে কী বিশ্বাসে যে কথাটা উচ্চারণ করতেন! তার আভাসও আমি, আমরা, একালে খুঁজে পাইনে
তারপর, সুধীরমামা পড়তেন আমাদের নিয়ে। দাদাকে শেখাতেন শক্ত শ্লোক, আগে মুখস্থ, পরে ব্যাখ্যা। একটা শ্লোকে ‘বক্র-নেত্র’ বলে কী-একটা খটমটে কথা ছিল, দাদা, কিছুতে তার মানে মনে রাখতে পারত না। আমাকে পড়াতেন ইংরিজি, মানে পড়ে পড়ে গল্পটা বলে দিতেন। ‘ফোকটেল্স অব বেঙ্গল”, রাক্ষস খোক্কসের গল্প, হাঁউ মাউ কাউ, এ-সব তখনই শুনি। ইংরিজি ভাষাটা সেই থেকেই কান-সওয়া হয়ে যায়, সেটা খুব বড় কথা নয়, রূপকথার একটা মায়াবী রাজ্য তখনই যে তৈরি হয়ে গেল মনে, অনেকদিন সে রাজ্যপাট অন্তরে বহাল ছিল। অলীক-অসম্ভব, জগৎ-টগৎ উবে গেছে কবে, তবু তার একটুখানি রেশ আনাচে-কানাচে কোথাও কি রেখে যায়নি?
পড়ানো শেষ হতেই সুধীরমামা হাত বাড়িয়ে বলতেন, ‘দাও।’ তুমি সবুজ রসে টসটসে একটা গ্লাস ধরিয়ে দিতে। নিমপাতা সিদ্ধ রস, সুধীরমামার পিত্ত দোষ ছিল, কোনও-কোনও দিন ‘সর্দিকাশির জন্য আলাদা করে তুলসি-আদাও নিতেন।
মা, তোমার নিজের ছিল চায়ের নেশা, পেয়ালায় চিনি মেশাতে মেশাতে সামনে এসে বসতে। একদিন তোমাকে বলতে শুনেছি, “চা খাবে একটু সুধীরদা? একটি দিন খাও না!”
সুধীরমামা বলতেন, “নতুন আর একটা অভ্যাস? আর ধরিয়ো না। তাছাড়া চা মিষ্টি যে! মিষ্টি কিছু এই মুখে স’বে না।”
তোমাকে মৃদুস্বরে বলতে শুনেছি, “তোমাকে শুধু তেতোই দিয়ে গেলাম। ভাবতেও খুব খারাপ লাগে। “
সুধীরমামা ঈষৎ হেসে বলেছেন, “যার যা প্রাপ্য!” পরে ওই হাসির নাম জেনেছি—দার্শনিক নিবেদ। একভাবে একটা বিধান মাথা পেতে নেওয়া,স্নান যে করতে পারছে না, সে যেভাবে ঘাটে দাঁড়িয়ে মাথায় গঙ্গাজল ছোঁয়ায়।
সুধীরমামা কোনও-কোনওদিন হঠাৎ-হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেছেন, “প্রণববাবুর চিঠি-টিঠি এল?”
বাবার নাম শুনলেই, মা, তুমি যে কীরকম ফ্যাকাশে হয়ে যেতে! তোমার পাতলা ঠোটের কোণ বেঁকে যেত, অথবা ঠোঁট অল্প হাওয়ায় পাপড়ির মতো কাঁপত।
শুকনো গলায় তুমি বলেছ, “ন্ নাহ্!”
“ছাড়া পাননি?”
“গবরমেন্ট ছেড়ে তো দিয়েছে ওদের সবাইকেই, কাগজে লিখেছে শুনেছি। তুমি পড়োনি?”
“পড়েছি। তাই তো জিজ্ঞেস করছি। তাছাড়া টাকা-কড়ি— “ওর মামা মনি-অর্ডার করেছিল, সেও তো ওই মাসে। আর কোনও খবর আসেনি।” সেই পাটকিল কোটের পকেট থেকে সুধীরমামা তখন, খুব কুণ্ঠিত, বের করেছেন একটা দশ টাকার নোট।—”এটা রাখো। যদি হঠাৎ আটকে যাও—”
মা, তুমি টাকাটা ছুঁয়েও দ্যাখনি। একই রকম নিঃস্পৃহ গলায় বলেছ, “তোমার কাছেই থাক। খুব টানাটানিতে যদি পড়ি, চেয়ে নেব।”
“না হয় শোধই দিতে।”
মুহূর্তের মধ্যে, মা, অপরূপ একটি বিষাদ মহিমা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে তোমার মুখে।—”শোধ? তোমাকে? না সুধীরদা, এবারের যাত্রায় তা বোধ হয় আর সম্ভব হল না।”
একবার সুধীরমামা কোথায় গিয়ে জ্বরে পড়ে দিন সাতেক আটকে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন, আরও শীর্ণ, আরও সরলতররেখা হয়ে! মা, তোমাকে সেদিন হঠাৎ হালকা চাপল্যে বিস্তারিত হতে দেখলাম। আঁচল ধরেছ মুখের কাছে, হাসছ, “আমরা তো ভাবলাম সুধীরদা, তুমি একেবারে—”
“বিয়ে করে ফিরছি?”
“ঠিক, ঠিক। তাই। তোমার দরকারও। এই বয়সে জ্বরে বেঘোরে-
“তাই বলছ টোপর পরি?”
হাততালি দিয়ে হেসেছ তুমি। “দেখি টোপর পরলে কেমন মানাবে! উঁহু”, মাথা দুলিয়ে বলেছ তুমি, “না সুধীরদা, তাহলে আরও ঢ্যাঙা হয়ে যাবে।”
সুধীরমামা আমাদের দিকে চেয়ে বলেছেন, “তালগাছ, এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে, সেই ছড়াটার মতো, না রে?”
একটি মৃত্যু সিঁথিচিহ্নের মতো পূর্বাপরকে বিদারিত করে দিয়ে সোজা চলে গেল। পরে যা রইল—এই সংসারের রূপ, কিছুই আর আগের মতো রইল না। সব কেমন সাদা হয়ে গেছে, নিঝুম, খাঁ-খাঁ গ্রীষ্মের দুপুরের মতো, কিংবা কোনও-কোনও একলা সময়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হত ছাই-ছাই, যেন শীতের বিকাল, যত সময় আসে যায়, আমরা খাইদাই ঘুমিয়ে পড়ি, তার চেহারা একটা ন্যাড়া ডালের মতো, সব অর্থ শুকনো পাতার মতো ঝরিয়ে দিয়ে বসে আছে।
বিশেষ করে কী সর্বস্বান্ত লাগত শীত শেষের মাঠঘাটকে, পুকুরগুলো মণি-খোয়ানো চোখের গর্ত, আর মাঠ খড়খড়ে, কারা সব ফসল নিড়িয়ে নিয়ে গেছে, খালি পায়ে হাঁটলে পায়ে ফোটে। তবু একা একা ঘুরতাম, ফাঁকা মাঠে মরা পশুর হাড় মাঝে মাঝে চিকচিক করত, কী বীভৎস ধবধবে সাদা,এই কি মৃত্যুর চেহারা, আমি কখনও-কখনও কাঠ হয়ে ভেবেছি, না, না, মৃত্যু তো কালো, ফকিরের আলখাল্লার মতো কালো, বস্তুত অনেকদিন পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি মৃত্যুর রঙ কালো, না সাদা।
আর তার গন্ধ? তাও একদিন টের পেয়েছি, মৃত্যুর গন্ধও আছে। সেবার খুব হিম পড়েছিল, হঠাৎ করে বুঝি সন্ধ্যার পর লণ্ঠনের তেল ফুরিয়ে গেল, তুমি বললে, “চট করে যা তো দোকানে, খানিকটা নারকেল তেলও আনিস”, সারা রাস্তা ছমছম, সারা রাস্তা ভয়ার্ত, কারা যেন আমার সঙ্গ নিয়েছে, কে যেন হাসছে হাওয়া-হাওয়া কণ্ঠস্বরে, আমি দৌড়লাম, এক ছুটে বাজার, কিন্তু ফেরার পথে এক ঝলক সেই গন্ধ। তেলের। দাদার একবার পা ফাটে, তুমি তখন তার পায়ের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে কর্পূর মিশিয়ে এই তেল মাখিয়ে দিয়েছিলে, আমি ঝুঁকে পড়ে দাদার পায়ের ক্ষত দেখতে গিয়ে তার গন্ধ পেয়েছিলাম। সেই গন্ধ চেতনায় যে ছিটিয়ে গিয়েছিল তা জানতাম না তো, সেদিন সেই মুহূর্তে ফিরিয়ে আনল দাদাকে। তার মৃত্যুকে।
এক-একটা মৃত্যুর এক-একরকম গন্ধ। ইদানীং শহরে মড়ার চাদরে ঢেলে দেয় কী-একটা আতর, বেশির ভাগ দেখা মৃত্যুর গন্ধও তাই ওই আতরের, আতর আমি এই জ্যান্ত অঙ্গে কখনও মাখিনি।
আমার সেই স্নায়ু-শিহরিত শীতল শৈশবে দাদা আরও কতভাবে ফিরে-ফিরে এসেছে। স্বপ্নে তো বটেই, কখনও-কখনও কল্পনা করেছি—ভূত হয়েও। মা তুমি যদিও বলতে “দূর, ও-সব বলে না! ভালোবাসার লোক কখনও ভূত হয়ে আসে না।” তোমার সেই বিশ্বাস, আহা, আমি যদি কণাও পেতাম! তা-হলে দরজার টকটক শব্দে, পুকুরের শালুক ফুলের ঠোঁট-তোলা হাসিতে দাদাকে বারেবারে উঁকি দিতে কি দেখতাম! কত তেঁতুলের আচার তেতো হয়ে গেছে, ডাঁসা পেয়ারায় দাঁত বসাতে গিয়ে ফেলেছি ছুঁড়ে, বাটিভরা গুড় আর মুড়ি তুমি দিয়েছ যদি, আমি অপেক্ষা করেছি কখন তুমি সরে যাবে কিংবা একটু পরে আসছি বলে অনেকটা দূরে গিয়ে সব মুড়ি পাখিদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছি।
তুমি কিন্তু সহজেই একটা বিশ্বাসের মধ্যে প্রবেশ করেছিলে। তোমার হাসি সেই যে ফুরিয়ে গেল আর ফিরল না। একটা মন্ত্রের বই কোথা থেকে জোগাড় করলে, ঘরের কোণে বসেছ আসন বিছিয়ে, মানে-না-জানা মন্ত্র একটার পর একটা পড়ে যাচ্ছ, এই ক্ষণে তোমার সেই শান্ত বিশ্বাসী, সমর্পিত রূপটি দেখতে পাচ্ছি।
সেই সময়ে সারা সকালটার অর্থই হয়ে গিয়েছিল তোমার স্তব। শুনে শুনে আমারও মুখস্থ হয়ে যেত। আজও যত স্তব, যত মন্ত্র ভাঙাভাঙা ভাবে জানি, উচ্চারণ করি, সব তখনকার কানে শোনার অবশিষ্ট ভাগ। কিন্তু তোমার উদাসীনতার ভাগ আমি পাইনি। দাদার অভাবের বোধটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, কবে আমি প্রত্যাবৃত্ত হলাম স্বভাবে, চাপল্য আর লোভে, কিন্তু তুমি যা ছাড়লে তা আর ধরলে না। একেবারে আলাদা। একটি মৃত্যু এল, কী নিয়ে গেল, বিনিময়ে তোমাকে দিয়ে গেল সম্পূর্ণ একটা শুভ্রতা, যেন যেই শীত পড়ল অমনই তুমি পুরু একটা চাদরে নিজেকে জড়িয়ে নিলে। সেই চাদর সহজে আর খুলে পড়ল না।
এই চিঠি লেখার একটা অসুবিধে এই যে, তোমার কাছ থেকে কোনও উত্তর পাব না। যদি ভুলচুক কিছু লিখে ফেলি, ঘটনা-পরম্পরায়, কিংবা আমার চোখ দিয়ে তাদের বোঝায়, তোমার ভুরু কুঁচকে উঠবে না। শুধরেও তো দেবে না তুমি। দ্যাখো লিখছি আর আমার হাত কাঁপছে, ভয়ে ভয়ে এগোচ্ছি। ভাঁটিতে বসে উজানের কথা লেখা খুব সহজ নয়। ভাবছি বটে যা দেখেছি তাই হুবহু টুকে দিচ্ছি, কিন্তু যে দেখেছে সে তো লিখছে না, এই বয়সের চোখ দিয়ে সেই বয়সের ফুলে আর কাঁটায়-কাঁটায় বিচরণ—ওখানে বড় রকমের একটা তফাত ঘটে যেতে পারে, হয়তো ঘটেছে। কে জানে, হয়তো যা-দেখেছি তা লিখছি না, যা দেখতে চাইছি যেভাবে চাইছি দেখতে, তাই কলমে কালি হয়ে সরছে।
তুমি সুদূর ধূসর নিরাসক্ত হয়ে গিয়েছিলে দাদার মৃত্যুর পর, খুব করুণ তুলিতে এই ছবিটা আঁকলাম, কী জানি, সেটা হয়তো ঠিক নয়, কোন্ প্রতিকৃতিই বা কবে একেবারে ঠিক-ঠিক হয়ে থাকে, এখন যেন মনে হচ্ছে ওই মৃত্যু তোমাকে খালি যে দূরেই সরিয়ে দিয়েছিল, তা তো নয়, আমার আরও অনেকখানি কাছেও নিয়ে এসেছিল।
এক সঙ্গে শুতাম, সে-তো শুয়েছি বরাবরই, কিন্তু এত কাছে ঘেঁষে এর আগে আর কখনও কি! নিশ্বাসে নিশ্বাস মিশিয়ে, গুটিসুটি হয়ে, যতটা পারি পরস্পরকে আঁকড়ে? একটি মৃত্যু ঘটল ঠিকই, কে একজন ছিল সে নিরুদ্দেশ হল, যাবার সময় সে যেন নিশ্চিত একটি অলিখিত চিরকূট রেখে গেছে যে এখন থেকে আমরা দু’জনের জন্যেই দু’জন। কুয়োতলায় আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে শীতের সকালেও ঘটি ঘটি জল ঢেলে নাওয়ানো, মা, এইসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যপারাগুলো কি তুমি শেষ পর্যন্ত মনে রেখেছিলে?
রেখেছিলে নিশ্চয়। রাখিনি আমি। কারণ একজন গেল বটে, তার বদলে এল আর একজন, না-না বউয়ের কথা বলছি না, ওসব বাইরেকার ব্যাপার, আসলে মা আর ছেলের সম্পর্কের মধ্যে পা টিপে টিপে যে আসে, তার নাম বয়স; সেই বদলে দেয়, সেই মূল, আমরা ভুল করে তাকে ‘বন্ধু’ ‘বউ’ এইসব নাম দিই। আদম আর ইভের মধ্যে যেমন ছদ্মবেশী সাপ, মা আর ছেলের সম্পর্কের নন্দনেও তেমনই বয়স। সেই বয়সই আমাকে বদলে দিচ্ছিল, ফুসলিয়ে ফুসলিয়ে ক্রমশ দূরে ঠেলে দিতে চাইছিল।
যাক, সে-সব বৃত্তান্ত আরও পরের। তখন কিন্তু মা, আমরা এক থালায় খেতাম, ভাত মেখে-মেখে তুমি এক-একটা গ্রাস ডেলা পাকিয়ে সাজিয়ে রাখতে, আমি কখনও টপাটপ মুখে তুলতাম, কখনও তুলে দিতে তুমি, গালে, এঁটো লাগল তো হাতের পিঠ দিয়ে মুছিয়ে দিতে, আজ সেই সুখস্পর্শের কথা লিখে রাখতেও রোমাঞ্চ হচ্ছে। আর ছিল শেষ চাঁচিমুছি, ওটার সর্বস্বত্ব আমার তো ছিলই, এমন-কী তোমার মুখের চিবানো পানের দিকেও সতৃষ্ণ চেয়ে থেকেছি, কখন তুমি জিভের আগায় তুলে ধরে একটুখানি দেবে সেই লোভে অধীর, ক্লাসে শেখা সরল স্বাস্থ্যবিধিকে একটুও কেয়ার করিনি। খঞ্জনি বাজিয়ে বৈরাগী এলেই তোমার কাছ থেকে চাল চেয়ে নিয়ে দৌড়ে যাওয়া, তোমার পাশে বসে জোড়হাতে প্রতি বিষ্যুৎবারে লক্ষ্মীর পাঁচালি শোনা—পদ্মাসন করে বসা কাকে বলে তুমিই শিখিয়েছিলে, তোমার ঠাকুরের জন্যে অন্যের বাগানের ফুল চুরি, সজনে আর বকফুল পেড়ে আনা, আজও দেখছি স্মৃতির ঝুড়ি এমন অনেক কড়িতেই ভর্তি। ছুটির দুপুরে তোমার চুলে বিলি কেটে দিয়েছি, এসব লেখার কোনও মানে নেই, কারও কাছে এর কোনও দাম নেই, আমার কাছেই বা কতটা আছে?
রাত্তিরে উঠে বাইরে যাবার দরকারে তোমাকে ডাকতাম যখন, ঘুমকাতুরে তুমি উঠে বসতে, কোনও দিন বা দেখতাম তোমার দুষ্ট ভ্রূভঙ্গি : “ভীতু ছেলে! এখন না হয় দাঁড়াচ্ছি, এর পর দাঁড়াবে কে? তোর বউ এলে তাকেও দাঁড়াতে হবে। কেন এত ভয়, এত ভয় কিসের!”
তোমাকে তখন কী করে বোঝাব মা, ভয় কিসের। যাদের দেখা যায় না, কিন্তু যারা নিরন্তর নানা অবোধ্য শব্দ তুলে কথা বলে, রাত হলেই সার দিয়ে পাহারা দেয় বাইরে। একলা সেখানে গেলেই যে তাদের অধিকারে চলে যাব!
মধ্য রাত্রের আরও দু’একটি ছবি উঠে আসছে। গা থেকে লেপ কি কাঁথা সরিয়ে দিলে তুমি ঢেকে দিয়েছ, কিংবা জ্বরে যদি ছটফট করছি, কপালে ঠান্ডা হাত, হাতটাই যেন জলপটি, বুলিয়ে দিচ্ছ, এসব তো মামুলি। কিন্তু এক-একদিন দেখেছি যে, মশারির মধ্যে তুমি ঠায় বসে, হাত দুটি জড়ো করা উপাসনার ধরনে, দৃষ্টি উপরে, সর্বাঙ্গ যেন কঠিন, আমার চেনা মা হঠাৎ যেন পাষাণ-মূর্তি; তুমি স্তব্ধ, বিবিক্ত, নিস্তরঙ্গ; মূক প্রশ্নে অদৃষ্ট কাউকে বিদ্ধ করছ। তুমি যেখানে আছ, সেখানে যে তুমি আসলে নেই, স্পষ্ট বুঝতে পারতাম।
যদি টের পেলে আমি জেগে গেছি, চেয়ে আছি, অমনিই তুমি ফিরে আসতে। তাড়াতাড়ি বলতে “ঘুমো! বাইরে বোধহয় একটা সাপে ব্যাঙ ধরেছিল, কোঁ-কোঁ আওয়াজ শুনতে পেলাম, ঘুম ভেঙে গেল।”
একটা পাণ্ডুর মিথ্যা তোমার মুখে ছড়িয়ে পড়ত কিনা, কমিয়ে-রাখা লণ্ঠনের ম্রিয়মাণ ফিতেটাও সেটা ধরিয়ে দিত, আমি বুঝতে পারতাম। তুমি দাদার কথা ভাবছ। তোমার বাকি সময়টার সমস্তটাই আমি আত্মসাৎ করে নিয়েছি, খালি এই নিভৃত নীরব খানিকটা ক্ষণ আলাদা করে রাখা। বিনিদ্র এই সময়টুকু দাদার।
কখন আস্তে আস্তে তোমার হাঁটুতে মাথা তুলে দিতাম আমি, হাত বাড়িয়ে তোমার গলা জড়িয়ে ধরতাম।—”মা, বাবা আজও এল না?”
তুমি উত্তর দিতে না।
“এত বড় খবরটা পেয়েও,…দাদা-দাদা নেই শুনেও এল না?”
“ও ওই রকম! কিংবা কী জানি হয়তো খবর পায়নি।”
“চিঠি তো দিয়েছ।”
“যে ক’টা ঠিকানায় থাকতে পারে তার সব ক’টাতেই। লোকের মুখেও খবর পাঠিয়েছি।”
“তারা হয়তো খুঁজে পায়নি?”
“হবে। আবার শুনেও আসেনি, হতে পারে। আসবে কি, ওর আসার মুখ কি আছে? চিরকাল বাইরে বাইরে, দূরে দূরে, সংসার দেখল না। দেখবেই না যদি, তবে সংসার করল কেন।”
সংসার করা কাকে বলে, তখন আমি তার মানে জানতাম না।
“বাবা কোথায় থাকে মা, কী করে?”
“ছি, থাকেন বলতে হয়। উনি দেশের কাজ করেন।”
দেশের কাজ কাকে বলে, ঠিক বুঝিনি। তবে জেলে যেতে হয়, জানতাম। বাবা মাঝে-মাঝে গেছেন শুনেছি।
“শুধু দেশের কাজ?”
“ছাড়া পেলে, পালা লেখেন : অনেক বই লেখা হয়ে আছে, বড় হয়ে পড়িস। খাতার পর খাতা বোঝাই। তা-ছাড়া ওর মাথায় সব সময় কত যে টুকিটাকি ব্যবসার ফন্দি। ওই করেই তো সব গেল। আমার বাবা বেঁচে থাকতে কত বুঝিয়েছেন সুধীরদাও কতবার বলেছেন—”
সুধীরমামা, একটি নোঙর সুধীরমামা। আমাদের উত্তরের ভিটেয় ঘরটার পাশে একটা মস্ত নারকেল গাছ, ঠিক সেইরকম ঠায় দাঁড়িয়ে।
একদিন সকালে খুব শীত-শীত করছিল, তা-ছাড়া অ্যানুয়েল’ পরীক্ষা শেষ, ঘুম ভেঙেও লেপের তলায় চুপচাপ আছি। টের পাচ্ছি সুধীরমামা এসেছেন। যথারীতি চুমুক দিচ্ছেন নিমের রসে। রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে তুমি বুঝি দিচ্ছিলে বড়ি। বলতে শুনলাম সুধীরমামাকে—”তোমার বড়টা এভাবে না গেলে, আনু, আর দশটা বছর মাত্র, তুমি একটা নির্ভর পেয়ে যেতে।”
হঠাৎ ডাল-গোলা বাটিটা পড়ে গেল ঝনঝন করে। মা, তুমি জানো না, আমি হঠাৎ বিছানা থেকে টুপ করে লাফিয়ে পড়েছি। দাঁড়িয়েছি কবাটের ঠিক এপাশে রোদ্দুর যেখানে একটা অবিরত তির হয়ে ঠিকরে পড়েছে, ঠিক সেখানে। তোমার স্থির আয়ত দৃষ্টি দেখতে পেয়েছি, সেই দৃষ্টি কাঁপল না, কিন্তু কথা বলতে গিয়ে, তোমার গলা কেঁপে গেল, “কোন্ পাপে এমন হল সুধীরদা, আজ আবার জিজ্ঞাসা করছি। ঈশ্বর জানেন, কোনও পাপ তো আমরা করিনি।”
“পাপ? হয়তো অনেক রকমের হয়, আনু, সজ্ঞানে না হোক অজ্ঞানে। ঠিক জানিনে।”—এই রকমই কী একটা কথা হয়তো বলেছিলেন সুধীরমামা, অস্পষ্ট স্বরে অথবা সেই নিমের গেলাসেই মুখ রেখে আস্তে আস্তে উচ্চারণ করেছিলেন বলে ঠিক শুনতে পাইনি।
কিন্তু বলতে বলতে বিষম খেয়েছিলেন সুধীরমামা। মা, তুমি তাড়াতাড়ি উঠে, যে-হাতে বড়ির গোলা নেই, সেই হাতটা বুলিয়ে দিচ্ছিলে ওঁর পিঠে; সুধীরমামা একটু স্থির হতে তুমি বললে, “এখনও সময় আছে সুধীরদা। তোমার এই শরীর! কাউকে এনে তোমাকে দেখাশোনার ভার তুলে দাও।”
পলকে আরও যেন ফ্যাকাশে, ভাঁজ ভাঁজ কাগজের মতো দেখাল সুধীরমামার মুখ। কেমন অপরিচিত স্বরে তাঁকে বলতে শুনলাম, “কেন, তোমরাই তো দেখছ শুনছ।”
“আমরা?” তোমার মুখে ফুটতে দেখলাম যে-হাসি, হাসি নয় সেই হাসি। “আমরা? আমি তো নিজের শোকে, দুঃখে, নিজের মায়ায় সংসারে জড়িয়ে আছি। বরং তুমিই আমাদের জন্যে—কেন, কেন সুধীরদা, তোমাকে তো কিছু দিতে পারিনি। তুমি শুধু দিয়েই গেলে। একটি ফোঁটাও কখনও পাওনি।”
তখন দিব্য যে-আভা ছড়িয়ে গেল, সুধীরমামার মুখে, এখনও তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।—”কী জানি আনু, পাইনি যে, তা-ও জোর করে বলতে পারব না, ওই তো মুশকিল। পাওয়ার চেহারা বোধ হয় সব সময় ঠিক এক রকমের হয় না। না-পাওয়াটা কতকটা অভ্যাস হয়ে গেলে তারও একটা নেশা লাগে, সেটাও তখন এক ধরনের পাওয়া হয়ে দাঁড়ায়।”
ঠিক এই কথাগুলোই কি বলেছিলেন সুধীরমামা, পাতার ফাঁকে ফাঁকে চলা বাতাসের মতো স্বরে, আর আমি অবিকল তাই মনে রাখলাম? কী-জানি মা, মিথ্যে বলব না, হয়তো কথাগুলো অন্য ভাষায় ছিল, কিন্তু তার ভাবটা ছিল এইরকম, আমি আমার এই বয়সের আশা-হতাশার সমীকরণের দর্শন দিয়ে তাঁর বিস্মৃত কথাগুলো এইভাবে বসালাম। বানালাম।
মাঝে মাঝে চিঠি আসত বাবার কদাচিৎ টাকা। কিন্তু তিনি আসেননি, অন্তত অনেকদিন পর্যন্ত না, দাদার মৃত্যুর অন্তত বছর দেড়েকের মধ্যে তাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না, তার মানে দাদা গেল এক শীতে, মাঝখানে আর একটা শীত, বাবা যেদিন হঠাৎ উদয় হলেন, তখন চৌধুরীদের বড় বাগানে পাখিগুলো ডেকে থেমে গেছে, শুনেছি ওরা শীতে আসে, গ্রীষ্মে ওদের কোথায় না কোথায় দেশে ফিরে যায়। আমের বোল ফুরিয়ে গুটি ধরেছে, বাবার আসার দিনটি আমার মনে কীভাবে আঁকা আছে তোমাকে বুঝিয়ে বলব পরে, এখন ওই পর্যন্ত বলি, পরিবার নামক সংস্থায় পিতা নামক ব্যক্তিটি যে অনিবার্য অঙ্গ, অনেকদিন অবধি সেটা আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ধরা দেয়নি। কতকটা মাতৃতন্ত্রে মানুষ, আমার কাছে বাবার মূর্তি সেই শিশুকালে ছিল একটি বিলীন জলরেখা, পরোক্ষ একটি অস্তিত্ব মাত্র।
কেন যে আমরা এই বাড়িতে থাকতাম, শুনতাম, ওটা ছিল আমাদের মামার বাড়ি, মামা নেই, তাই একমাত্র ওয়ারিশ তুমিই পেয়েছিলে, ওটা যে আমার পৈতৃক বাড়ি বলতে যা বোঝায় তা নয়, এ-সব বোধ বেশ কিছুটা বয়স পর্যন্ত মনে জাগেনি। ক্লাসের আর-সব ছেলে বাবাকে ভয় পায়, কিন্তু ফিরে ফিরে বাবার কথা বলে, বেড়াতে যায় তার সঙ্গে, আমার বলার মতো ছিলে তুমি, কেবল তুমি—কিন্তু তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন, কোনও দৈন্য বা অভাববোধ বিশেষ পীড়া দেয়নি। কারও বাবা নিয়ম, কারও মা। এইটেই ধরে রেখেছিলাম। আমি, দাদা আর তুমি মিলে বেশ ছিলাম।
দাদা চলে গেল, ফলে বলেইছি তো তিনের জায়গায় হল দুই। সারা সকালটা হল তোমার স্তব, সারা দিনমানরাত্রি জুড়ে তোমার প্রগাঢ় আবরণ। প্রথম যেবার শীত ফিরে এল, কী-জানি কেন, সেবার অকাল-মেঘ চুঁইয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও পড়তে থাকল, কনকনে ঠান্ডা, বেরুতে পারছি না, পাতলা একটা চাদরে মুড়ি দিয়ে পড়ছিলাম, পড়ার বই থেকে বাংলা একটা পদ্য—”ডেকে দাও, ডেকে দাও দাদারে আমার। একা আমি পারি না খেলিতে”, পরে জেনেছি ওটা বিদেশি একটা কবিতার তর্জমা, পড়তে পড়তে হিহি করে কাঁপছিলাম—শীতে? নাকি ভিতরে ভিতরে কবিতার কথাটা কুয়াশার মতো একাকার হয়ে হুহু করে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল? কখন তুমি যে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছ টের পাইনি। আড়চোখে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে যাচ্ছ।
ফিরে এলে একটু পরে, হাতে একটা কোট, আমার গায়ে ছুঁড়ে দিলে। মুখে বলোনি, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম, পরতে বলছ।
পরলামও, আমাদের মধ্যে একটা নির্বাক ছায়াছবির অভিনয় চলছিল, বেশ আরাম লাগছিল কোটটায়, আমার কোট ছিল না, দাদা স্কুলের স্পোর্টস ক্লাব থেকে একটাই পেয়েছিল, পলকে চলে গেল শীত, তোমার মুখেও ফুটি-ফুটি খুশি, আমি দেখতে পাচ্ছিলাম।
এই কোটটা এতদিন তুমি দাওনি, তুলে রেখেছিলে, আজ দিলে, দিতে পারলে। বস্তুত দাদার ব্যবহার-করা সব জিনিসই যত্ন করে তুলে রেখেছিলে তুমি রঙ-ওঠা তোরটাতে যে-তোরঙে, ন্যাপথলিনের গন্ধ, কোটটার গায়ে মরা কয়েকটা পোকা সেঁটে আছে, আমি খুঁটে খুঁটে বাছছিলাম, আর তার ওম্ আমার শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল।
সাহস করে একদিন দাদার পড়ার বইও বের করলাম, এবার আমি নিজেই কয়েকটা বই ওর প্রাইজেও-পাওয়া, যেমন রবিনহুড্ পাতা উল্টে পড়ছিলাম সেই গ্রিনউড্ ডাকাতের গল্প, তুমি দেখে অবাক!—”ওর বই তুই পড়তে পারিস?” বললাম, “পারি, একটু একটু”, তুমি বললে “পড় তো দেখি”, আমি আস্তে আস্তে শুরু করলাম, তুমি তন্ময় হয়ে শুনছিলে, কী
বড়-বড় চোখ তোমার মা, কী ছোট-ছোট বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস! খানিক পরে তুমি বললে, “ওর মতো কিন্তু হয় না”, সরে গেলে, আমি বইটা মুড়ে হিম হাওয়ার ঝাপটায় কয়েকটা কাকের কর্কশ কান্না শুনলাম, উঠোনে-লাগানো পেঁয়াজ কলিতে ফোঁটা ফোঁটা জল জমেছিল, পিছনের পুকুরের শালুক ফুলগুলি মড়া-মড়া, ন্যাতানো।
স্বীকারোক্তি করব বলে কলম ধরেছি, অবশেষে আমি কি তবে প্রমাণপূর্বক প্রচ্ছন্ন একটু অভিমানও পেশ করছি? জানি না। খানিক আগেই তো লিখেছি কত কাছাকাছি এসেছিলাম আমরা তার মধ্যে হঠাৎ একী! সেই সরল বাল্যেও শাখা-প্রশাখা লতায়-পাতায় জড়ানো কত যে জটিলতা, তার জট ছাড়াতে গেলে আজও চমকে যাই।
তুমি বলেছিলে, এবার আর পিঠে হবে না। তাতে আমার এমন কিছু এসে যেত না, কেননা পিঠে আমার কখনই প্রিয় নয়, তবু কী করে সে বছর তেতো হয়ে গেল, সেই কথা বলে খালাস হতে চাইছি। সুধীরমামা না-হয় এসে পিঁড়েতে চেপে বসে বললেন, “করো, পিঠে করো,’ আর ওঁর হাত থেকে খেজুর গুড়ের হাঁড়িটা নিয়ে বিনাবাক্যে উনুন জ্বেলে বসলে, তা-ও-না-হয় বোঝা গেল, ওই বসার ভঙ্গিটাই একটা প্রতিবাদ, কিন্তু শুধু চন্দ্রপুলি কেন, পাটিসাপটা কেন নয়, পাতে বসেও আমার মনে মনে সেই যে আহত-চিৎকার তুমি টের পেলে কি পেলে না জানি না, কিন্তু আমাকে ভরপেট শুধু পুলি খাওয়ালে। আমি লোভীর মতো চেটেপুটে খাচ্ছিলাম, চুকচুক শব্দ করছিলাম মুখে বলছিলাম, ‘ভীষণ ভালো’, কিন্তু কেউ বুঝল না, না তুমি না সুধীরমামা, ওই উবুড় হয়ে খাওয়াটাই একটা হাহাকার, চন্দ্রপুলি দাদা ভালোবাসত, তাই তুমি মাথা হেলিয়ে আমাকে দেখছিলে, সুধীরমামাকে বলছিলে আস্তে-আস্তে “সে-ও ঠিক এইভাবে খেত।” একটিও পাটিসাপটা পেলাম না।
তার মতো, তার মতো, যে আমাকে একলা পড়ার টেবিলে উদাস করে দিত, সেই আবার বিছে হয়ে কামড়াল, আশ্চর্য আমি কি নিজেই না-বুঝে একটা মরা মানুষকে হিংসা করছি!
স্কুল খুলেছে, সেই কোটটা পরে যাচ্ছি, তুমি ঝেড়েঝুড়ে দিলে, না মরা পোকাগুলোর একটাও আর নেই, ন্যাপথলিনের একটা ঝিমঝিমে নির্জীব গন্ধ শুধু লেগে আছে, দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলে, ‘ঠিক ওর মতো লাগছে’ বললে থুতনি ছুঁয়ে, কী স্নেহ, কী স্নেহ, তখন পর্যন্ত ছবিতেই দেখা ঝরনার মতো, কিন্তু আমার থুতনি পুড়ছিল! ওর থেকে আমি বুদ্ধিতে কম, গায়েও কালো, বরাবর এই শুনে আসছি, সেদিন হঠাৎ তারই মতো দেখতে হয়েছি শুনে, কই বুক ফুলে দশহাত হল না তো! তার মতো, তার মতো কেন তার হয়ে তার প্রাপ্য স্নেহ আমি নেব কেন, নিলে হবে নাম ভাঁড়ানো। আমি তো আমার মতো। যে যেমন, সে সেই মতো। অন্য কেউ হতে ভালো লাগে খালি থিয়েটারে জমকালো পার্ট পেলে, কিন্তু জীবনে? না, কক্ষনো না।
মরা মানুষকে হিংসা করছি, শুধু তাই নয়, ওই কোট পরে মনে হত আমি একটা মরা মানুষও হয়ে গেছি, কোটের তলায় তার শরীরকে টেনে চলছি। কিন্তু তারও তলায় বিস্মিত আহত আর-একজন তো থাকত! সে মানত না, বিকল্প একটি সত্তা হয়ে যাওয়াটাকে বিলকুল বরদাস্ত করতে চাইত না।
কোটটাকে মাটিতে ফেলে একদিন চটকাচ্ছিলাম, সে কবে? বোধ হয় সরস্বতী পূজার সকালে, আসলে অবচেতন স্বার্থ কী সেয়ানা দ্যাখো, দুর্জয় শীতকালটাকে পার করে তবে সে কোটটাকে খারিজ করে দিতে চাইছিল! কোটটার দুর্দশা দেখে তুমি শিউরে উঠেছিল, তোমার চোখে যা ফুটে ছিল তার নাম শুধু ক্রোধ নয়, আতঙ্কও, ঝলসাচ্ছিল তোমার চোখ দুটি, না মা, আমার গায়ে তুমি হাত তোলোনি, কিন্তু চাউনি দিয়ে চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছিলে, সেই মুহূর্তে যেন স্নেহের ক্ষীর কেটে কেটে ঘৃণা হয়ে গেল, নিচু হয়ে আলগোছে কোটটা কুড়িয়ে নিলে, ধুলো ঝাড়লে, ঝাড়লে না তো যেন হাত বুলিয়ে আদর করলে, কোটটাকে, না আর কাউকে, অপ্রত্যক্ষ সে অকস্মাৎ সেখানে উপস্থিত হল, আমার মতো সে-ও চেয়ে চেয়ে দেখল, ঝেড়ে পুঁছে কোটটাকে তুমি ফের টিনের বড় বাক্সটায় ভাঁজ করে শুইয়ে দিচ্ছ।
কোটটা আবার মিশে গেল অন্ধকারে, পড়ে রইল ন্যাপথলিনের বিকট গন্ধে ম’ম, এক অবশ জগতে, কত কাল কে জানে, অথবা মরা কতিপয় সেই পোকারা প্রাণ ফিরে পেয়ে কি কোটটাকে ধীরে ধীরে খুঁটে খেয়েছিল?
জানি না। ওই কোট আমি আর পরিনি। পরের শীতে সুধীরমামা আমাকে আর একটা কিনে দিয়েছিলেন, যদিও সেটা ছিটের।
৩
ওই শোক কখনও শান্ত-সংযত থাকত, কখনও বা মাত্রা ছাড়াত, দিনের পর দিন এই দেখেছি। শীতের দিন তবু চট করে ফুরিয়ে যেত, কিন্তু গরমের লম্বা দিন আর কাটতে চাইত না। খুব ধুলো উড়িয়ে দোলের দিন এল গেল, কত রঙ মাখামাখি, কত ঢোলক, রাস্তায় কী উৎকট চিৎকার আর মাতামাতি, কিন্তু আমাদের বাড়িটা তার বিরস বিধবার চেহারা ধরেই রইল, একটু আবির কিনে এনে তোমাকে প্রণাম করব যে, আমার সেই সাহসও হল না। শেষে দুপুরের পরে, সবাই যখন ফিরে যাচ্ছে, তখন আমি আর থাকতে পারলাম না, বললাম, “মা একটু রঙ কিনে আনি?” তুমি যেন ভয় পেলে।—”খেলবি?”
“না, তোমার পায়ে দেব শুধু।” আমি তাকিয়ে আছি, তুমিও কিছু বলছ না, অনেক পরে আস্তে আস্তে বললে, “যা।” টাকা হাতে দিয়ে বললে, “ওই সঙ্গে বাজার থেকে ঘি রঙের কয়েক গাছি ডি এম সি সুতো কিনে আনিস।”
তোমার হাতে বোনা চমৎকার কারুকার্য করা লেখাটা কত দিন আমাদের ঘরের দেয়ালে ঝোলানো ছিল বলো তো! ধবধবে এক খণ্ড পাট পাট করা লংক্লথ আমাদের বাড়িতেই ছিল, আমি রেশমি সুতো এনে দিলাম, তুমি সেদিনই বোধ হয় ছুঁচ নিয়ে বসলে। তোমার বয়স তখন কত আর–হিসাব করে দেখছি তিরিশ কি বত্রিশ। চশমা লাগত না।
চার পাশে লতা-পাতার নক্শা হল, কোণে কোণে পাখি। বিকালে সুধীরমামা এলেন। “ওটা কী করছ?”
একটু অপ্রতিভ হলে বোধ করি। নক্শাটা টানটান করে ধরে বললে, “কেমন হয়েছে বলো না।”
লাঠির উপর ভর দিয়ে একটু ঝুঁকে সুধীরমামা বললেন, “চমৎকার। কিন্তু কেন। কার জন্যে, তা-তো বললে না।”
“দিন যে কাটতে চায় না, সুধীরদা। তাই ভাবছিলাম, ওর জন্যে, ওর কথা ভেবে একটা কিছু করি।”
(দাদার একটা নাম ছিল, কিন্তু সে চলে যাবার পর তার নামটা তুমি সহজে মুখে আনতে চাইতে না। হয়তো তোমার জিভের ডগা জ্বলত।)
সান্ত্বনার স্বরে, যেন সান্ত্বনা নয় একটা মলম, আর কথাগুলো আঙুল, সেইভাবে প্রলেপ দিতে দিতে সুধীরমামা বললেন, “ভুলতে পারছ না?”
মাথা নাড়ছিলে তুমি। মানে, বলা হয়ে গেল যে, একদম না। “ভোলা সম্ভব না। ভুলে থাকতে যদি পারি।’
তখনই বুঝি কী খেয়াল হল তোমার, গলায় আঁচল ফিরিয়ে প্রণাম করলে সুধীরমামাকে। ওঁর পায়ে বাজার থেকে যে আবির কিনে এনেছিলাম, তার প্রায় সবটাই ঢেলে দিলে।
পরে নক্শা কাপড়টার মাঝখানটা দেখিয়ে দিয়ে বললে, “এইখানে ওর উদ্দেশে কিছু লিখে দেওয়া যায় না? তুমি তো অনেক পড়েছ সুধীরদা, কয়েকটা লাইন বলে দাও না, কোনও কবিতার গোটা কয়েক উপযুক্ত লাইন?”
সুধীরমামা পরদিন এনে দিলেন একখানা বই। তারই একটা পাতা থেকে
হেথা হতে দূরে দূরে
স্বরগে, অমরপুরে
হৃদয়ের ধন মম কত দিন গিয়েছে।
না, না, না, যায়নি সে তো,
তারা ধরে নিয়েছে।।
সে-সব মরমে রোক
আমারি পরাণে শোক,
সে-আগুন এ-হৃদয়ে জ্বলিতেছে জ্বলিবে
কাজ কি দেখায়ে পরে, কার বুকে বাজিবে।।
মনে আছে বইটার নাম “কাব্যকুসুমাঞ্জলি”। স্বামীবিরহাতুরা নারীর ব্যথাকে পুত্রশোকাধীরা মাতার কথা করে তুলতে একটু বদলে নিতে হয়েছিল।
তারপর দাদার একটা ফোটোও না খুব কড়া করে বাঁধানো হল! রোজ টাকা ফুলের মালা দেওয়া হত তাতে, ফুল আমি আনতাম, তুমি গেঁথে তুলতে। সুধীরমামা আসতেন, দেখতেন। মাথা নাড়তেন, যেন তোমার বেদনা স্পর্শ করছে তাঁকে। বলতেন, “একটুও ভুলতে পারছ না?”
তুমি চমকে উঠে বলতে “না, না!” হিংসায় নয়, তখন সমব্যথায় ‘আমিও আর্ত হয়ে পড়তাম। আজ কিন্তু একটু খটকা লাগছে মা। “না–না” বলে কী অস্বীকার করতে তুমি? ভুলতে না পারাটা নাকি একটু একটু করে যে ভুলতে শুরু করেছিলে, সেই কথাটা? শোকের গাঢ় রক্ত কি একটু ফিকে হয়ে আসছিল, তাই কি স্মৃতি নিয়ে অত ঘাঁটাঘাঁটি, ফ্রেমে বাঁধিয়ে উঁচু করে ধরা, মন্ত্রজপের মাত্রা বাড়ানো দরকার হয়ে পড়ছিল?
তখন বুঝিনি তাই জিজ্ঞাসা করিনি। আজ ধারণাটা কেন্নোর মতো নড়ছে, কিন্তু জেনে নেবার উপায় নেই, উপায় তুমি রাখোনি।
বাবাকে বোধহয় তার দিন কয়েক পরেই দেখা গেল।
.
সে-ও হঠাৎ। শীতকালে যেমন শরীরে চামড়া ফাটে, আর প্রখর জ্যৈষ্ঠে মাঠ, আমাদের সংসারেও তখন থেকেই তেমনই কেমন-কেমন সব ফাট ধরতে থাকল, অন্তত তুমি যেভাবেই দ্যাখো, আমি ওই ভাবেই দেখেছিলাম। ভালো হোক মন্দ হোক, এতদিন একভাবে চলছিল, সেই ধরনটাই জানতাম অভ্যাস, সেই ধরনটাই জানতাম নিয়ম, কিন্তু বাবা আসতে কী যেন বদলে গেল, একটু আলাদা রকম, আমি সবটাকে মেনে নিতে পারছিলাম না।
(মা, তুমি কি কিছু মনে করবে যদি জনান্তিকে এখানে বাবাকে কিছু লিখি! এইভাবে লিখতে ইচ্ছে করেছে যে, বাবা, তোমার কাছে আমার অপরাধের অন্ত নেই। তার মধ্যে প্রথম অপরাধ তো তোমাকে গ্রহণ করতে না-পারা। এই অক্ষমতা তৈরি হয়েছিল অদর্শনে, অনভ্যাসে। আমার শৈশবে, বাল্যেও দীর্ঘকাল জুড়ে, আমার জীবনে তোমার এক রকম কোনও অস্তিত্বই ছিল না। ক্বচিৎ এসেছ তুমি, ক্বচিৎ তোমার চিঠি দেখেছি, তাও হাতে লেখা খামের ঠিকানাটাই শুধু, মাকে লেখা সে-সব চিঠি মা লুকিয়ে ফেলত, কোনওদিন পড়তে দিত না, দেওয়া বোধ হয় সম্ভবও ছিল না। আমাদের ঘরে তোমার নাম উল্লেখ করা হত আভাসে, শুনে শুনে যে-ছবিটা আন্দাজে তৈরি হয়ে গিয়েছিল মনে, সে-ছবি এক নির্বিকার বাইরের জনের, যে-সংসারের দায় নেয় না, পুত্র-পরিজনের প্রতি যার স্নেহ নয় যথোচিত, সর্বদাই সে হয় রাজবন্দি, নয় ভবঘুরে, মাঝে মাঝে কখনও কখনও বছরের পর বছর পাড়ি দিয়ে, বিদ্যুৎ-চমকের মতো সহসা ঝলসে যেত, নিজের পরিবারে নিজের জন্য বিশেষ কোনও আসন তার জন্যে রক্ষিত ছিল না, অন্তত আমি দেখিনি, কোনওকালে যদিও বা থেকে থাকে, আমি তখন জন্মাইনি। সধবা থেকেও যিনি জীবনযাপন করেছেন যেন শূন্য-শুভ্র এক বিধবা, যার কপালটা ছিল যখনও সূর্য ওঠেনি, শুকতারা জ্বলছে সেই শীতল স্নিগ্ধ আকাশের মতো, তিনি ব্যবহারিক শুচিতায় তোমার জন্যে, বাবা, সবখানি যদি সন্তর্পণে সংরক্ষিত করেও থাকেন, তাঁর অন্তরের কথা আমি জানি না। দিঘি নিরন্তর কাটা না হলে ধীরে ধীরে বুজে আসে, আর আমারটা তো কখনো কাটাই হয়নি, বোজাই ছিল। নিরামিষে অভ্যস্ত যে, সে যেমন পাতে হঠাৎ মাছ দেখলে অরুচিতে আক্রান্ত হয়। তার চেয়েও বরং একটা তুলনা দিয়ে বলি, কর্ণের প্রাণে যেমন তার প্রকৃত মাতার জন্যে হাহাকার ফুরিয়ে এসেছিল, প্রয়োজন এসেছিল শুকিয়ে, আমারও তাই। বাবা ক্ষমা কোরো, তোমার আকৃতি প্রকৃতি কিছুই তখন আমার গ্রহণীয় মনে হয়নি, তুমি যেন উৎপাতের মতো একটা অবাঞ্ছিত অনাবশ্যকতা; কারণ একটি প্রতিরোধ, একটি বিরোধিতা আগে থেকেই লালিত ছিল।)
খুব ঝড়জল হয়েছিল সেদিন মাঝ রাতে, ভিজে সকালটা চোখ খুলতেই চাইছিল না, আর ঝড়ে খুঁটিসমেত আমাদের টিনের চালাটা দুলছিল বলে যেহেতু আমাদেরও ঘুম ছিল না, ঠায় বসেছিলাম বিছানায়, উত্তাল মশারির তলায়, জানালার একটা পাল্লা সেদিনই আবিষ্কার করা গেল যে, আলগা, ওর ঠক ঠক কাঁপা প্রতিধ্বনি তুলছিল আমাদের হাড়ে, বায়বীয় ভয় হয়ে আমাদের মনেও, আর বিদ্যুৎ! বিদ্যুৎ তো না, যেন ডাকাতেরা আকাশটাকে ফালা-ফালা করে কাটছিল, আগুনের রঙ লালঘেঁষা হলদে হয় তো। আমি বিদ্যুতের ঝিলিকে দেখছিলাম রক্তের ফিনকি, কালো রাতটার গা-চুঁইয়ে পড়া রক্ত।
শেষ রাতে ওই হাওয়াই আবার মৃদু হয়ে এসেছিল, কালোয়াতী কসরতের মাতামাতির পর যেন তার করুণ রেশ, মৃদু হাওয়ার স্নেহ-শীতল আঙুলের ছোঁয়ায় আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তোমার ঘুম ভাঙল যখন, তখন সকালটা অনেক আর্ত পাখির—পরে দেখেছি কারও বাসা ডাল ভেঙে ঝুলছে, গাছের গোড়ায় ছড়ানো থ্যাতলানো কাঁচা ডিম—অনেক আর্ত পাখির গলায় সকালটা ডাকছে। কাঁচা ডিমের কুসুমের রঙের মতোই রোদ্দুর, রোদ্দুরটাও ভাঙা ডিমের মতোই আঁটা-আঁটা, বিছানায় পড়তেই তুমি ধড়মড় করে বসলে। রোজ তুমি উঠে সকালের সূর্যের ঘুম ভাঙাও, সেদিন সূর্যই তোমার ঘুম ভাঙাল।
মা, তুমি উঠোনের স্তূপাকার পাতাগুলো জড়ো করে রাখছিলে এক পাশে, শুকনো ডালপালা আর পাতায় উনুনের আগুন হবে, তার পরেই সুধীরমামা এলেন, তাঁর লাঠির ঠকঠকে তাঁকে চেনা গেল, মাথাটা একবার তুলে আমি দেখলুম তাঁর মাথাটা সুদ্ধ আজ ঢাকা-দেওয়া কমফরটারে, তখনও নিমের গ্লাস পাননি, তাই কালকের ঝড় আর আজকের সকালটার বিষয়ে তোমার সঙ্গে মৃদু স্বরে দু’চারটে কথা বলছিলেন, তেমন দরকারি কথা নয় অবশ্য, শুধু চুপচাপ অস্বস্তিটা কাটাবার জন্যেই কথা।
তখন আরও একবার বাইরের দরজায় ঘন ঘন ধাক্কা শোনা গেল, কী কাজে তুমি রান্নাঘরে ঢুকেছিল, সেই জন্যেই বোধ হয় উঠতে হল সুধীরমামাকে, আমিও তখন বিছানায় উঠে বসেছি, খিল খোলা হল, সঙ্গে সঙ্গে সুধীরমামার গলায়, “আরে আপনি! আসুন আসুন”, যাকে বলা হল তিনি প্রত্যুত্তরে ঘড়ঘড়ে গলায় কী বললেন বোঝা গেল না, হয়তো বলেননি কিছুই, খালি একবার আড়চোখে চেয়েছেন তারপর পাশ কাটিয়ে সোজা এসে উঠেছেন শোবার ঘরে, যেখানে আমি তখনও বিছানায়।
আমি চোখ বিস্ফারিত করে দেখছিলাম তাঁকে, এমনকী সুধীরমামার পাশ কাটিয়ে যখন এগিয়ে আসছিলেন, তখনই তাঁর চেহারাটা টোকা হয়ে গিয়েছে। মাথায় খাটো, বোধ হয় সুধীরমামার কাঁধের চেয়ে উঁচু না, কিন্তু মজবুত, ভারী ভারী পা ফেলার ধরন। এক পাশে লাঠিতে ঝুঁকে দাঁড়ানো কৃশ, দুর্বল, বেখাপ্পা লম্বা সুধীরমামার চেহারাটা এমন কুণ্ঠিত, বিসদৃশ ঠেকছিল।
চৌকাট পেরিয়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন, বিছানার সামনে, ছড়ানো ছায়ায় আমাকে ঢেকে অন্ধকার করে দিয়ে, খুব উৎসুক, তীব্র, স্থির দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিলেন। আমি দেখলাম একটি মোটা কোর্তা, পাঞ্জাবি নয় ফতুয়া, চওড়া কাঁধ, রোমশ-বলিষ্ঠ দুটি হাত, যেন দুটি থাবা, ঘন ভুরুর মাঝখানে একটা প্রায় আর্-সাইজের আঁচিল।
বেশিক্ষণ তাকাতে পারিনি, চোখ নামিয়ে নিয়েছিলাম। তিনি হঠাৎ পিছন ফিরে তাকিয়েছিলেন, গমগম গলায় বলে উঠেছিলেন, “কই এদিকে এসো। গল্প বন্ধ হল না এখনও? ও জানে না যে আমি ওর বাবা? গুরুজনকে প্রণাম করতে হয়, শেখাওনি?”
দরজার আড়ালে একটি ছায়া পড়েছিল—তোমার। সেই ছায়াকে আগে ঘরে পাঠিয়ে পিছু-পিছু এলে তুমি। চাপা গলায় বললে, “বাবা যে, কী করে জানবে কথাটা গায়ে লেখা থাকে না তো!”
সেই গম্ভীর গলা হেসে উঠল, মজা পেয়ে না, বিদ্রুপে, বলা যায় না, হো-হো ধ্বনির পর শোনা গেল, “ঠিক বলেছ, গায়ে লেখা থাকে না, পরিচয় থাকে রক্তে, শিরায় শিরায়, রগে রগে।”
ততক্ষণে আমি প্রণাম করেছি, তিনি আমাকে তুলে নিয়েছেন দু’হাতে সাপটে, চেপে ধরেছেন আমাকে ওঁর বুকে, আমার মাথাটা ওঁর জামার যেখানে মাঝের বোতামটা, ঠিক সেইখানে, কপালে লাগছিল, মোটা–না-জানি কতদিন না-কাচা ধুলোয় ভর্তি-ফতুয়াটার গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছিল, তবু একটি শিহরন, একটি রোমাঞ্চ, একটি ভয়, দুর্বোধ্য সেই অনুভূতি আর আবেশটাকে মা এত দিন পরে কথায় কী করে ফোটাব!
একবার মনে হয়েছিল ছাড়লে বাঁচি, কিন্তু সাহস হচ্ছিল না, তাছাড়া উনি ধরে রেখেছিলেন কতক্ষণ আর! আসলে সেকেন্ড কয়েক তো মাত্র, তারপর মাথা তুলেই খড়খড়ে চিবুকটা এগিয়ে আড়চোখে তাকাতেই তোমাকে দেখলাম, মা!
অল্প একটু ঘোমটা তুলে তুমি পাশেই দাঁড়িয়েছিলে। মাথায় ঘোমটাতোলা তোমাকে সেই প্রথম দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে এদিক-ওদিক একটু ত্রস্তে চেয়ে তুমিও গড় হয়ে প্রণাম করলে।
তিনি বললেন, “থাক, থাক”, তুমি উঠে দাঁড়ালে যখন, দেখি তোমার মুখ হাসি-কান্নাতে ভেজা-ভেজা, আজ ভোরের ধোয়া চিকচিকে গাছের পাতার মতন। পুরনো কথাটার খেই ধরে তুমি বলেছিলে, “কী করে চিনবে, সেই এক্কবারে যখন ছোট্টটি, তখন দেখেছে তো? বরং চিনতে যে পারত, সে তো—“
মা, এতক্ষণ এই কথাটা বলার জন্যেই বুঝি তোমার মুখ টসটসে হয়ে ছিল, “যে চিনলেও চিনত পারত, সে তো—” শেষ হতে না হতেই তোমার মুখে যেটুকু বা রোদ ছিল সব মুছে আষাঢ়ের বর্ষা নামল। দরজার কাঁপা-কাঁপা কবাটটা ছেড়ে তুমি দু’হাতে মুখ ঢেকে বিছানায় অসহায় বসে পড়লে। আজও তোমার সেই ফোঁপানি শুনতে পাচ্ছি।
আস্তে আস্তে মাথা নাড়ছিলেন তিনি, এই মাত্র জেনেছি যিনি আমার বাবা। ইতিমধ্যেই তিনি অসহিষ্ণু অব্যক্ত কোনও অপরাধভারে অস্বস্তিগ্রস্ত, তোমার কথা শুনছেন না, অথবা চাইছেন না শুনতে।
“তুমি খবর পাওনি? তুমি জানতে না?” নম্র অথচ অকম্পিত তোমার কণ্ঠ, বাবাকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। ওই ভারী-ভারিক্কি মানুষটি কেমন যেন জেরার মুখে বিপাকে পড়ে অসংলগ্ন উত্তর দিচ্ছিলেন।—”জানতাম কিনা? না, জানলাম কই আর, যখন খবর পেলাম, তখন তো চলে গিয়েছি অনেক দূরে, ছাড়া পেয়েই গিয়েছিলাম হরিদ্বার, কনখল, তারপর হৃষীকেশে, সেখান থেকে কোথায় কোথায়, রুদ্রপ্রয়াগ, চামোলি তুমি নামও জানো না। নেপালের তরাই হয়ে নেমে এসেছি বিহারে, শোনপুরে হরিহরছত্রের মেলায়, সে যে কী বিরাট ব্যাপার, তুমি কল্পনা করতে পারো না। সে সব গল্প করব আর একদিন, হাতি ঘোড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের পায়ের ছাপ, তার পরে আর একটু পশ্চিমে গিয়ে সরযূ নদীতে স্নান, ভরা অমাবস্যা, মাঘের শীত, কী কনকনে জল, টলটলে, কী জানো, এবার জেল থেকে বেরিয়ে কেমন বিবাগী-বিবাগী লাগছিল, মনে হল, দেশের কাজ করব যে,; তার আগে দেশটাকে তো জানা চাই, দেখলাম এই দেশটা ছড়িয়ে আছে তার তীর্থে, তীর্থে, কোটি কোটি মানুষের সহজ জীবনধারায়, সরল, বিশ্বাসী মুখের রেখায়, তাকে চিনতে চেষ্টা করলাম।”
“শুধু তোমার নিজের পরিবারকে জানতে চিনতে পারলে না”, তুমি বললে মৃদু স্বরে। “দেখাশোনা করে কে, সংসার চলে কী করে—”
এইবার বাবা যেন রেগে উঠলেন, রাগটার মাথা থাবড়ে, গোঁ-গোঁ ডাকা কুকুরকে লোকে যেমন নিরস্ত করে, ফোটালেন একটা ঠাট্টার হাসি, “তোমরা স্ত্রীলোক শুধু ঘরের কোণটুকুই বোঝো। দেখাশোনার কথা বলছ?” একটু বাঁকা ভঙ্গি দেখা গেল তাঁর ঠোঁটে, বাইরের দাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখাশোনার লোকের তোমার অভাব ছিল নাকি! মনে তো হয় না।”
তখনই কেমন একটা দম-আটকানো আওয়াজ এলো বাইরের দাওয়া থেকে। বরাদ্দ নিমের গ্লাসটি সেদিনও বাদ পড়েনি, কিন্তু তেতো রসটা হঠাৎ বুঝি গলায় আটকে গেছে।
আমরা সকলেই এসে দাঁড়ালাম বাইরে। সুধীরমামা ততক্ষণে লাঠিটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, বাবার দিকে তাকিয়ে কেমন বোকার মতো হাসলেন; হাসলেন তোমার দিকে চেয়েও, শেষে চোখ সরিয়ে বললেন, “আমি যাই আনু, বেলা হয়ে গেল, দেখি প্রণববাবুর জন্যে যদি মাছ-টাছ—”
অপসৃত দীর্ঘ দেহটা দেখতে পাচ্ছি, মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকে-পড়া, সুধীরমামা চলে যাচ্ছেন।
বাবা উঠোনে নেমে নেতিয়ে-পড়া একটা গাঁদাফুলের গাছ তুললেন।—— -”উপড়ে ফেললে?” তুমি যেন ভয় পেয়ে বললে।
‘ফেললাম”, বাবা বললেন অনায়াসে; হাত থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে ‘ফেললাম। শুকিয়ে গিয়েছিল। জঙ্গল হয়েছিল। আর ফুল ধরত না।”
“কিন্তু আসছে বছরের বীজ যে ও থেকেই-–“
“আবার হবে”, বাবা একেবারে নির্বিকার গলায় বললেন। ওপড়ানো গাছটাকে পা দিয়ে শুট করে ছুঁড়ে দিলেন বেড়ার গায়ে।
বাবাকে তখন ঘৃণা করলাম।
.
আজ স্বীকার করছি, পরবর্তী অনেক বছরে উপরে যতই আস্তর পড়ুক, ওঁর প্রতি আমার অনুভূতির তলায় বিরাগ কিংবা ঘৃণাই ছিল মূল উপাদান। ওঁর প্রতি সুবিচার আমি করতে পারিনি, কিন্তু নিয়তির দ্যাখো, কী ক্রূর বিধান! বাবার আকৃতি, শক্ত-সমর্থ চওড়া কাঁধ, জোড়া ঘন ভ্রূ, ভুরুর আঁচিল, গলার ঠিক উপরে থুতনির দু’তিনটে ভাঁজ, হাঁক-ডাক বাজ-ডাকা কণ্ঠস্বর—সেদিন কিচ্ছু আমার পছন্দ হয়নি, কেন না আমি তখন হালকা, পলকা, হলদেটে, রোগা, নিজেকে কবি-কবি ভাবা, সবই অভ্যাসে রপ্ত হয়ে গিয়েছিল, আজ কিন্তু আয়নাকে সাক্ষী দাঁড় করালে তার মুখে হুবহু বাবার তখনকার চেহারার বর্ণনাই শুনতে পাই। কড়কড়ে চামড়া, ভারী গাল, জোড়া চিবুক, গাঁট্টা-গোট্টা গর্দানঘাড়, দেখে চমকে উঠি। প্রকৃতি প্রতিশোধ নিয়েছে, উত্তরাধিকার সুদ-আসল সমেত আমার প্রাপ্য আমার সর্বাঙ্গে চাপিয়ে দিয়েছে। ওই আকৃতির সঙ্গে কবে থেকে আমি নিয়ত বসবাস করি, বহন করি শরীরকে, যে শরীর আমার অস্তিত্বেরও প্রত্যক্ষ রূপ, যে আজ সর্বস্বত্বে আমার। বাবার প্রতি ঘৃণা-বিরাগের মাশুল চুপেচুপে উশুল হয়ে গেছে।
ঘৃণা সেদিন মা, করেছিলাম তোমাকেও, একটু পরে, একটুখানি। তুমি হঠাৎ কেন সুন্দর হয়ে উঠেছিলে। পুকুরে ডুব দিয়ে এলে, রোজই যাও, সেটা কিছু না, কিন্তু ফিরে এসে সেদিন বাক্স থেকে বের করে নিলে একটা তুলে-রাখা শাড়ি। হলদে জমি, পাড় লাল। রঙিন শাড়ি পরতে তোমাকে আগে কখনও দেখি নি, কী চমৎকার যে লাগছিল, কী খারাপ যে লাগছিল! ভালো লাগা আর খারাপ লাগা একটা কাটারির মতো আমাকে কুপিয়ে কুপিয়ে কাটতে লাগল, ফিনকি দেওয়া রক্তে মন ধুয়ে যেতে থাকল, তার রঙও লাল। আগে পুজোয় যখন বসতে তুমি, তখনও যে শাড়ি পরেছ, তার পাড়ও টকটকে লাল, কিন্তু সাদা জমি, সাদায় লালে ঘিরে থাকা তোমাকে অপরূপ লাগত, যে দেবীমূর্তির পায়ে তুমি ফুল দিচ্ছ, মহিমায় তাকেও যেন যেতে ছাড়িয়ে, লালপেড়ে সাদামাটা সেই শাড়ি আমার নয়নে প্রগাঢ় পবিত্র কিন্তু রঙ আঁকত। আমার অবচেতনে সেদিনকার ওই শাড়িটা তোমার মহিমা চুরি করে বিনিময়ে নিশ্চয়ই একটা ছটা দিল, নইলে আমি অনিমেষ চেয়েছিলাম কেন, ভঙ্গিতে একটা ঘূর্ণির ছন্দ, না থাকুক তোমার সেই দিব্য দ্যুতি, মা, তুমি এত কোমল, এত অপরূপ, এত সলজ্জ হতে পারো, জানতাম না তো। সলজ্জ সৌন্দর্য আমাকে প্রবল মায়ায় টানছিল, তবু তার মধ্যে কোথায় যেন নিহিত একটা অলজ্জতা আমাকে তেতো করে দিচ্ছিল।
.
খেতে বসে বাবা জেনে নিলেন আমি কী পড়ি, পাশাপাশিই বসলাম দু’জনে, তুমি মাথায় অল্প একটু কাপড় তুলে পরিবেশন করছিলে, অনভ্যস্ত ঘোমটা খুলেখুলে পড়ছিল, বিড়ম্বিত তুমি হাতের পিঠ দিয়ে বরাবর যথাস্থানে ন্যস্ত করছিলে, এই সব দেখতে দেখতে ভালো লাগা-না লাগায় অস্থির হতে হতে মুখে গ্রাস তুলছিলাম, বাবা যা জানতে চাইছেন, যতটা পারি গুছিয়ে তার উত্তর দিচ্ছিলাম।
স্নানের পর বাবাও একটু আলাদা যেন, সেই খোঁচা-খোঁচা ভাবটা মুখে বা কথায় নেই, সব ধুয়ে মুছে গেছে যেন, একটু কমনীয়, একটু ক্লান্তও, আমাকে মাঝে মাঝে নিরীক্ষণ করছেন, যেন পরীক্ষক, আমি, সাবধান, সচেতন, যথাসাধ্য তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছি।
খাবার পর শোনাতে হল আবৃত্তি। ‘আজি কী তোমার মধুর মুরতি’ ধরতে বললেন “ন্যাকামি। বিদ্রোহী’ জানিস না?’ বলে নিজেই দু’লাইন পড়লেন, “বল বীর/বল উন্নত মম শির/শির নেহারি আমারি মতো শির ওই শিখর হিমাদ্রির!—শুনিসনি?”
কাঠের পুতুলের মতো মাথা নেড়ে বললাম – “না।”
—”ওই মধুর মূরতি কবিতাটা তোকে কে শিখিয়েছে? পড়ার বইয়ে আছে?” বললাম, “হ্যাঁ!”
—”কিন্তু এভাবে ঢঙ করে পড়তে শিখিয়েছে কে?”
—”সুধীরমামা।”
—”কে? ও। তোকে পড়ায় বুঝি?”
—”হ্যাঁ”—
–”বলতে হয় আজ্ঞে হ্যাঁ’। রোজ পড়ায়?”
—”রোজই।”
—”তুই যাস?”
–”উনি আসেন।”
—”ও।”
কিছুক্ষণ বাবা আর-কিছু বললেন না, নিঝুম হয়ে থাকলেন। মনে হল ঘুমিয়ে পড়েছেন। সেটা যে ভুল, তা টের পেলাম পা-টিপে বেরিয়ে আসতে গিয়ে।
– “কোথায় যাচ্ছিস?”
–”এই এমনি। বেশি দূর যাব না, স্কুলের মাঠ অবধি। ব্রতচারী স্যার ডেকেছেন।” বলে একটু অপেক্ষা করলাম। অল্প পরেই ওঁর নাক থেকে ভোঁস ভোঁস শব্দ বেরুতে থাকল, শোনার অভ্যাস নেই, কেমন অদ্ভুত, বিশ্রী লাগছিল। ওঁর তলপেট তালে তালে উঠছে নামছে, প্রবল পরাক্রান্ত মানুষটা এখন অবসন্ন, দুর্বল–সেদিন এই দৃশ্যটাও ঠেকছিল হাস্যকর। আজ তো জানি, আমারও নাক ডাকে, অনেক দিন থেকেই ডাকে।
বেরিয়ে দেখলাম, মা তোমাকে। দাওয়ার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পা ধুয়ে ঘরে উঠছ। থমকে দাঁড়ালাম, ভাবলাম বকবে। তুমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তাই জোরে জোরে বলে উঠলাম, “স্কুলে যাচ্ছি। ব্যায়াম স্যার ডেকেছেন।”
“আজ না ছুটি?” এই প্রত্যাশিত প্রশ্নটা কিন্তু শুনতে হল না, যদিও ঠা-ঠা রোদ্দুরে ঝলসানো আকাশটার দিকে চেয়ে, উত্তরের ভিটের নারকেল গাছটার মরা ডালে দুটো কাকের হাহাকার শুনতে শুনতে অপেক্ষা করে রইলাম। তারপর দৌড়ে সদর দরজা পর্যন্ত ছুটে গিয়ে বেপরোয়া খিল খুললাম, তখন রোখ চাপল, সাহস বাড়ল। যেন দরজাটাকেই উদ্দেশ্য করে আরও চিৎকার করে বললাম, “যাচ্ছি। বিকেলের আগে ফিরব না।” কিন্তু “টো-টো করিস না, মাথা ধরবে” পিছন থেকে কেউ বলল না।
সারা দুপুর, তুমি জানো না, সেদিন ঘুরলাম। প্রথমে সঙ্গী ছিল ভয়, পরে কখনও দেখি, যেই দিঘির জলে মুখ নোয়ালাম, দাদাও এল। ঝুঁকে হাত দিয়ে জল সরাতেই দেখি, সে নেই। জল থিতিয়ে যেতেই সে আবার এল। সে এল, গেল, এল, আমি জল নাড়ি আর থামি, তাকে অনেক কথা বললাম, বাবার আসার খবর, আমার বিতৃষ্ণা, আমার অভিমান। সে সব বুঝল, যেন ঘাড় নেড়ে সায় দিল, বিশেষ করে যখন বললাম, “তুই তো চলে গিয়ে বেঁচেছিস”, সে নিশ্চয়ই হালকা হাসল, নইলে ঠিক তখনই বোষ্টম দিঘির পাড়ে যে গাছতলায় বসেছিলাম, তার ডাল থেকে টুপটুপ কয়েকটা পাতা আমার মাথায় খসে পড়বে কেন। একটা বক কেবলই উড়ে উড়ে দিঘির জলে ডুব দিচ্ছিল, কলমিদাম অল্প অল্প কাঁপছিল, একটা দুধ-ধবল শঙ্খচিল হা হা করে উড়ে গেল, তখনও আমি বসে, আমি কি আরও এই সব দেখব, কিংবা বকটা দিঘির জলের তলে কী খুঁজছে আমিও কি নেমে ওকে সাহায্য করব, করা উচিত হবে নাকি, এইসব ভাবছিলাম। ভয়? না, তখন আমি আছি আর দাদা আছে, ভয়-টয় কিছু ছিল না।
প্রায়ই বেরুতে থাকলাম যখনই একটু ফাঁক, তখনই, স্কুল ছুটির পর বিকালেও। বকুনি খাব বলে তৈরি, জবাব কী দেব তাও ঠিকঠাক করে রেখেছি, কারণ ঢুকেই দেখছি তুলসীতলায় পিদিম জ্বলছে, তার মানে সন্ধ্যা; তার মানে আকাশের এখানে-ওখানে তারার পাহারা, সব এড়িয়ে যখন ঘরে ঢুকতাম তখন পালা পড়া হচ্ছে। বাবা পড়ছেন, তুমি গালে হাত দিয়ে শুনছ। বাবার পড়ার ধরনটা অস্বাভাবিক, কোনওখানটা পড়ছেন থিয়েটারি কায়দায়, হঠাৎ আবার গলা নামিয়ে আনছেন, আর ওই ভরাট গলায় মেয়েদের অংশ বলতে গিয়ে যখন স্বরটা সরু করতে চাইতেন, যেন ভোঁতা পেনসলিটা চেঁছে ছুঁচোলো করা হচ্ছে, তখন কী-যে অদ্ভুত শোনাত। কখনও বা একটু সুর দিয়ে গেয়ে উঠতেন, সে কী মজার গলা কাঁপানো, নিজের পায়ে হাত থাবড়ে থাবড়ে দিতেন তাল। বুঝতাম না কিছুই, হয়তো বুঝতাম না বলেই ভালোও লাগত না।
তবু শুনলে বাবা খুশি হতেন, গোঁয়ার গোঁয়ার মুখখানা একধরনের আহ্লাদে ঝিলিক দিত। তুমি উসখুস করছ হয়তো, বলছ, “যাই, রান্না চাপাই”, বাবা হাত ধরে টেনে বসাতেন, ‘আহা শোনো আর-একটু শোনাই না! এই জায়গাটা খুব মন দিয়ে লিখেছি।”
তোমার হাত যে ছাড়িয়ে আনব, তখন আমার অত জোর কই মা, আক্রোশ আর অক্ষমতা আমাকে কামড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করত। যে অনিচ্ছুক তাকে জোর করে লেখা পড়ে শোনানো—জোর? জোর কিসের, এ-তো হ্যাংলামি।
(সেই হ্যাংলামি আমাকেও যে একদিন করুণার পাত্র করে তুলবে, তখন কি জানি!)
তুমি বলতে, “তুই পড়তে বস গে।”
জর্জর রাগে বলতাম, “একটাই যে লণ্ঠন। “
পাতা থেকে চোখ তুলে বাবা বলতেন, “কাল থেকে ওকে আলাদা একটা লম্ফ জ্বালিয়ে দিও, ও ওই কোণে বসে পড়বে। আজ বরং এই পালাটাই শুনুক।” বাবা বলতেন অম্লানবদনে।
ফের শুরু হত পাঠ। একটানা অনেকখানি পড়ে বাবা বললেন, “বুঝতে পেরেছ কী বলতে চাইছি। দেবযানীকে নিয়ে লেখা তো, তিনি হলেন দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের কন্যা। ভালোবাসলেন পিতৃশিষ্য দেবপুত্র কচকে। ভালোবাসা পেলেন না, তখন অভিশাপ দিলেন যাকে চেয়েছিলেন তাকে। কিন্তু পরকে অভিশাপ দিয়ে নিজের দুঃখ কি যায়! যায় না। দেবযানীর বিয়ে হল, রাজা যযাতি স্বামী। মনে হল এইবার বুঝি দুঃখের শেষ, কিন্তু সেখানেও সপত্নী। ঈর্ষায় কাতর দেবযানীর ইচ্ছায় নির্বাসিতা শর্মিষ্ঠা, কিন্তু তবু দেবযানী জয়ী হতে পারলেন কি? বিশেষ করে যখন জানলেন যে, স্বামী চলে যান সেই নির্বাসন স্থানে, নির্বাসিতা পত্নীর সঙ্গে মিলিত হন গোপনে, তখন যে দাউ-দাউ চিতা জ্বলে উঠল দেবযানীর মনে, সেই অসহ্য যন্ত্রণার কথা ভাবাও যায় না। আবার অভিশাপ, এবার স্বামীকে। কিন্তু সেই অভিশাপে কি নিজে যে অভিশপ্ত, তার জ্বালা ঘোচে? বারবার যে ভালোবাসল, কিন্তু জীবনে সত্যকার ভালোবাসা কারও কাছে পেল না, সেই নারীর বেদনা এই পালাটায় আমি বুঝতে, বোঝাতে চেয়েছি।”
মা, তখন তুমি আড়চোখে চেয়ে দেখেছ, আমি শুনেছি কিনা, বুঝছি কিনা। তখন অতটা বুঝিনি ঠিকই, কিন্তু গিলেছি, কথাগুলো সেই বয়সে কেমন অনায়াসে মনে গেঁথে যেত, তাই তাদের সারাংশটা আজ উগরে দেওয়া অসম্ভব হল না।
দেবযানীর বেদনা বুঝতে চেয়েছি, চেয়েছি বোঝাতেও—বাবা এই বলে যেই শেষ, করলেন, তখনই দেখলাম, মা, তুমি আস্তে আস্তে উঠে পড়লে। রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছ, কিন্তু শুনতে পাচ্ছি যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে কেমন যেন বদলানো গলায় বলছ, “অন্য সব মেয়ের দুঃখই তুমি বোঝো। একটুও দেরি হয় না।”
ওই গ্রীবাভঙ্গি আর ওই উচ্চারণে কাকে দেখলাম মা, কাকে। তার নাম কী? অভিশাপ দেয় যে, সেকি সেই দেবযানী?
৪
পরদিন তুমি সন্ধ্যা থেকেই ছিলে রান্নাঘরে, বাবা সেদিন কিছু শোনাচ্ছিলেন না, লণ্ঠনের সামনে খাতা খুলে বসেছিলেন হয়তো-বা লিখছিলেন একটা নতুন পালা, আমার জন্যে আলাদা একটা ছোট্ট হারিকেন এসেছিল, আমি বিছানার আর-এক কোণে বসে ঘাড় গুঁজে অঙ্ক কষছিলাম, কারণ জোরে কিছু পড়লে বাবার আবার ব্যাঘাত যদি ঘটে, বাবা কিন্তু লিখতে লিখতেই সুর করে খানিকটা লেখা পড়ে নিচ্ছিলেন, কখনও যেন আপন গন্ধে আমোদিত, নিজেই হাসছিলেন, একটা অঙ্কও ঠিক হচ্ছিল না, শেষে খাতা-পেনসিল রেখে, মা, গেলাম তোমার কাছে। উনুনের সামনে বসে কড়ায় কী নাড়ছ, তোমার পিঠের উপরে, এখন তোমার ঘোমটা নেই, চুল খোলা, উপুড় হয়ে কাঁধে গাল ঘষে, বেশ কয়েকদিন পরে আধো-আদর, আধো-আবদারের সুরে বললাম, “কানের কাছে অত জোরে জোরে কেউ চেঁচাতে থাকলে, বলো তো, অঙ্ক মাথায় আসে?”
তুমি কিছু বললে না। কড়া খুন্তিতে অত মনোযোগ দেবার কী ছিল কে জানে। বললাম, “নির্ঘাত ফেল করব টারমিন্যাল পরীক্ষায়। তার চেয়ে ধরো যদি কোথাও সন্ধ্যার পর পড়তে যাই?”
মুখ তুলে তুমি বললে, “কোথায়?”
“ধরো”, ফস্ করে বলে ফেললাম, “সুধীরমামার বাসায়? সুধীরমামা তো অনেক দিন আসেন না।”
তুমি মাথা নেড়ে সায় দিলে—”না।”
“কোনও অসুখ-টসুখ হয়নি তো?”
“বোধ হয় না। মাছ তো একদিন দুদিন পরে পরে ঠিক ঠিক পাঠিয়ে দিচ্ছে।” কড়াটা খুব ছাঁকছাঁক করছিল, খুব শুকনো ধোঁয়া উঠে যাচ্ছিল ছড়িয়ে, তোমার মুখ ঢেকে গেল, ঝুঁকে পড়ে ফুঁ দিতে তুমি ব্যস্ত হয়ে পড়লে।
তবু আমি বলতে থাকলাম, “যাব, মা?”
ফুঁ দিতে দিতেই মুখ ফিরিয়ে তুমি বললে, “উনি যদি বকেন? “
“বকবেন না। বলে নেব। তাছাড়া বাবারও তো সুবিধে হবে। যখন লেখেন, তখন পাশে কেউ থাকলে—দেখো, বাবা রাজি হয়ে যাবেন।“
তুমি আর কিছু বললে না।
বাবাকে বলব বলে ঘরে গেলাম, বলতে কিন্তু তখনই সাহস হয়নি, কারণ দুই ভুরু কুঁচকে ঠিক মধ্যিখানে একটা আঙুল রেখে উনি কী-যেন ভাবছিলেন। পা টিপে উঠলাম খাটে।
.
সুধীরমামা আসছিলেন না। বারো ভূঁইয়ার শেষ গল্প ঈশা খাঁর কাহিনিটা শেষ পর্যন্ত শোনা হয়নি, ভাবলাম সেই জন্যেই বুঝি মনটা কেমন-কেমন, দিনগুলো আলুনি। পরে ভেবে বুঝেছি ওটা কারণই নয়, ওটা আমি আবিষ্কার করে নিয়েছিলাম, ঈশা খাঁর গল্পের শেষটা জানার জন্যে এমন কিছু মরে যাচ্ছিলাম না, আসলে কাঁটার মতো যেটা ফুটেছিল সেটা শূন্যতা, একটা অভাবের জন্য অস্বস্তি। রাস্তার ধারে নিমগাছের পাতাগুলো প্রথম ফাল্গুনের ধুলোয় ভরে যাচ্ছিল, কতদিন পাড়া হয় না, কেন না, যার দরকার সে আসে না। কিছুকাল আগে একটি সত্যিকার মৃত্যুকে জেনেছি, তখন আবার যেন নিজে-নিজেই টের পেলাম, অনুপস্থিতিও একটা মৃত্যু, মৃত্যুর মতোই। আমাদের ক্লাসের একটি ছেলে কয়েকদিন ধরে আসছিল না, তার সঙ্গে আমার তেমন ভাব নয়, তবু বেঞ্চে তার নির্দিষ্ট আসনটা ফাঁকা দেখে কেমন খালি-খালি লাগত, ঠিক সাত বছরে প্রথম দাঁত পড়লে যেমন লাগছিল, জিভটা বৃথাই ঘুরে ঘুরে কিছু খুঁজত। একদিন জানা গেল সেই ক্লাস-ফ্রেন্ড আর আসবে না, তার বাবা চাকরি করতেন কলকাতায়, সেখানে মারা গেছেন, ওর মা প্রথমে কলকাতায়, সেখান থেকে পরে সবাইকে নিয়ে ওদের মামার বাড়ি চলে গেছেন। তার মামাই একদিন এসে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে গেল।
প্রায়ই শুনতাম বাবার সঙ্গে তোমার কথা কাটাকাটি, বিশ্রী লাগত। আমাদের সংসারে আগে এ-সব ছিল না। কিন্তু কী আশ্চর্য, হঠাৎ এসে-পড়ে যখন দেখেছি তোমরা হাসি-গল্প করছ, তখনও কিন্তু চমকে যেতাম, মুখের ভিতরটা শুকনো ঠেকত।
সেদিন বিকালে খেলার মাঠ থেকে ফিরে থমকে গেছি। তোমার মুখে আঁচল চাপা, খুশিতে চোখ উপছানো, তুমিও তবে হাসতে জানো, সব তবে মিথ্যে, মিথ্যে–মিথ্যে তোমার সকালের স্তব, সূর্যপ্রণামমন্ত্র শ্লোকটা শুধু মুখোস, কেবল আমাকে ঠকানো।
আমাকে দেখে একটু সরে গিয়েছিলে—ওই ভঙ্গি আমি চিনি, কেন না আচারের বয়ম খুলতে খুলতে কত দুপুরে ধরা পড়ে গিয়েছি—বাবা ফের পুঁথি হাতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল, তুলসীতলায় সেদিন প্রদীপ জ্বলছিল না, নারকেল গাছটার মাথায় বিশ্রী-বিকট কাঁচিকাটা একটা চাঁদ ঝুলছিল বলে তার পাতায় আবাসিক ভুতুম পাখিটা অন্য দিন থেকে অনেক আগেই ‘বুঝি বুঝি সব বুঝি’ গলায় ডাকাডাকি শুরু করে দিলে।
বিরস গলায় বললাম, “দিঘির পাড়ে মস্ত একটা শামিয়ানা পড়েছে মা, শুনলাম ম্যাজিক-লণ্ঠন হবে দেখতে যাবে?”
“আমি? ন্-না। তুই যাবি? যা না, দেখে আয়।”
“বাবা যদি—”
“আমি ওঁকে বলছি!”
বাবা খাতার উপর ঝুঁকে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, কোনও কথাই যেন তাঁর কানে যচ্ছিল না।
চট করে অনুমতি, আমি সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে চলতে থাকলাম, তুমি এগিয়ে এসে খিল দিলে, কিন্তু ‘বেশি ঠান্ডা লাগাসনে, এখনও হিম পড়ে’ এই শেষ কথাটি শুনতে চেয়েছিলাম, পেলাম না।
প্রতারিত, প্রতারিত আমি রাস্তায় পড়ে ছুটছিলাম, ঠিক ভয়ে নয়, যদিও তখন সন্ধ্যা, এ অন্য-কিছু, ক্লাসের গুণ্ডাগোছের মানিক নামে ছেলেটা একবার আমার পকেট ঝেড়েঝুড়ে সব মারবেল-গুলি, লাট্টু, এমন-কী হাতের গুলতিটাসুদ্ধু, কেড়ে নিয়েছিল, বাধা দিতে পারিনি, জোর নেই কিনা তাই চোখে জল, ঠোঁট নোন্তা, ভেবেছি আমার সব গেল, আমি রোগা, আমি দুর্বল, কিছুই আমি ধরে রাখতে পারি না, এই দিনও দিঘির পাড়ের দিকে ছুটতে ছুটতে ঠিক সেই রকমই লাগছিল, দৃষ্টি ঝাপসা, আমি ভাবছি, যাবে, যাবে, এইভাবেই সব যাবে, দাদা গেছে, সুধীরমামাও আছেন দূরে সরে, তুমি, তোমরা দুজনেই, আমাকে আজ বাড়ি থেকে অনায়াসে বেরিয়ে আসতে দিলে, দিয়ে যেন বেঁচে গেলে, খুঁজছিলে এই অছিলাটাই, আমার মা নেই, ভাই নেই, ভাবতে ভাবতে সত্যি ভয় করছিল, সামনের রাস্তাটা এত ফাঁকা কেন, সব যখন যায় তখন এইভাবে কি খালি হয়ে যায়, থাকার মধ্যে শুধু আমি আর বুকের মধ্যে দম ভর্তি করে-নেওয়া বাতাস, আর কিচ্ছু না?
(সেদিনের অনুভূতি আজ কেমন উলটে গেছে, দ্যাখো, যখন ক্লান্ত, প্রস্তুত আমি টের পেয়েছি, আমিই যাব, আর. সব ঠিক ঠিক থাকবে। এই গাছগুলো থাকবে ঠায় খাড়া, যত ঘাস শুকিয়ে আবার মাটি ছেয়ে ছেয়ে দেবে, উড়বে ধুলো, মরা-মরা জ্যোৎস্না ফুটবে, সকালের সূর্য বরাবর হবে রক্তের ফোয়ারা। যে-সীটে বসে প্রেক্ষাঘরে রইলাম এতক্ষণ, সেই সীট পরের ‘শো’-য়ে অন্য লোক বসাবে। যা কিছু ছুঁয়েছি, ছেনেছি, মেখেছি যত কাদা, সব পরে এসে অপরেরা ছানবে, মাখবে। আমি থাকব না। কিন্তু সেইদিন এই জ্ঞান ছিল না। )
ভাবিনি সুধীরমামাকে ওখানে দেখতে পাব। সন্ধ্যার পর উনি পড়াশোনা নিয়ে ঘরেই থাকেন জানতাম, ঠান্ডার ভয়ে বের হন না। সেই সুধীরমামা আজ বসে আছেন আসরের এক কোণে, দুই হাঁটু জড়ো করে ঠেকানো ওঁর মাথা, কিন্তু কোথায় গেল সেই কমফরটারটা? আমাকে দেখে প্রথম অবাক, সুধীরমামা পরে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিলেন। মুখে কেমন বোকা বোকা হাসি, আসলে উনিও একটু অপ্রতিভ, এতদিন দেখা হয়নি কিনা, তাই। গাল আরও যেন তোবড়ানো, চোখ বসে গেছে, রগ-ওঠা রোগা-রোগা হাতে খড়ি উড়ছে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। কিন্তু কমফরটারটা?
বেশি কথা হল না, যদিও তখনও আলোয় ছায়াছবি দেখানো শুরু হয়নি, একবার বুঝি বললেন সুধীরমামা, “আনু কেমন আছে”, আর-একবার “তোকে একা আসতে দিল?”
“আপনি এখানে?”
সুধীরমামা হাসলেন। কথার তুবড়ি ছোটাতেন যিনি দেখা হলে, শীর্ণ কণ্ঠ থেকে কলকল কথা বেরিয়ে আসত, কত প্রশ্ন, কত উত্তর।
(‘আনু, তোমার এই ছেলেকে আমি মানুষের মতো মানুষ করে দেব!’—”আমার ছেলে?’–’না, না এক হিসেবে তো আমারও, ওকে সেই মতোই দেখি, এই নিয়েই তো আছি’—
এই সুধীরমামা কেমন চুপচাপ, ম্রিয়মাণ গ্যাসের আলোয় তাঁর মাথাটি হাঁটুতে হেলিয়ে বসে আছেন। “কিন্তু কমফরটারটা?”
সুধীরমামা বললেন, “ভুলে গেছি। তাছাড়া তেমন ঠান্ডা তো নেই। আর একটু-আধটু ঠান্ডা লাগলেই বা কী।”
সাধারণ কথা, সেদিন অবাক লাগছিল, আজ লাগছে না। “ঘরে পড়ার মতো বই নেই, ফুরিয়ে গিয়েছে”, সুধীরমামা বলছিলেন, “তাই ভাবলাম এই ল্যান্টার লেকচারটাই শুনি। শুনেছি এটা শিক্ষামুলক, দেশের কথা আছে। মন দিয়ে দ্যাখ, তুই শেখার অনেক কিছু পাবি।”
না, কমফরটারটা আনেননি, ভুলে গেছেন। আরে দূর ঠান্ডা নেই, ঠান্ডা লাগবে না। তা-ছাড়া লাগলেই বা কী, বড় জোর বিছানায় দু’দিন, সে তো ভালোই, খানিকটা বিশ্রাম।
লাগলেই বা কী। অস্পষ্টভাবে হলেও সেদিন যদি চেষ্টা করতাম, কথাটার ঠিক মানেটা বুঝতে পারতাম। সুধীরমামা যে-জন্যে এসেছেন, আমিও তো সেইজন্যই। পরাস্ত, প্রহৃত, প্রতারিত, পরিত্যক্ত ‘প’-য়ের পর ‘প’– যেখানে কিছুতেই কিছু এসে যায় না, দু’জনকে ঠিক সেই এক জায়গায় এনে ফেলেছে।
সুধীরমামা আমাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। আসলে ঠিক দরজা পর্যন্ত কিছুতেই এলেন না, সদর রাস্তার ঠিক মুখ থেকেই চলে গেলেন। তুমি যদি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে মা, দেখতে পেতে। কিংবা আমি যেই গিয়ে দরজায় দাঁড়ালাম, চাপা গলায় ডাকলাম, “মা, মা, মা”, যদি তখনই খিল খুলে দিতে, তা-হলে শীর্ণ-দীর্ণ একটি দেহ, তখন ছায়াকার লম্বা লম্বা পা ফেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ততই তাড়াতাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে অন্ধকারে মিশে যেতে চাইছে দেখতে পেতে। অন্ধকার ঠিকই, কারণ তখন রাত, কিন্তু ফাল্গুনের উতলা বাতাস পুরনো ঘি-রঙের জ্যোৎস্নার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে তো ছিল।
তবু আমি কিন্তু বলেছিলাম, “আসুন না সুধীরমামা, আসবেন না?” বেশ সহজেই বলতে পেরেছিলাম, কেন না ফেরার সমস্ত রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়গুলো জোনাকির চোখ জ্বেলে পিট্ িজ্বলছিল বটে, হাওয়ার দৈবাৎ-ফাটা লুকনো কুঁড়িগুলো গন্ধে ব্যাকুল হয়েছিল, যদিও একটু-একটু অদ্ভুত কষ্টও পাচ্ছিলাম, ফাল্গুন মাস কী-জানি কেন তখন থেকেই আমার বড় কষ্টের, ওই আধো-অন্ধকারে ফুলের গন্ধটাই যেন কাঁটা হয়ে যায়, অহেতুক ফুটতে থাকে শরীর অথবা মনের না-দেখা কোনখানে ঠিক ঠিক জানিনে, যাই হোক সেদিন আমার ভয় ছিল না, বিশেষত একজন যখন সঙ্গী আছে যাকে এতকাল সমীহ করতাম, কিন্তু এখন যার সঙ্গে আমি স্বচ্ছন্দ, এই হেতু যে উভয়ের মধ্যে একটা সাঁকো তৈরি হয়ে গেছে। তাই বলতে পেরেছিলাম, “আসুন না, সুধীরমামা আসবেন না?”
উনি ইতস্তত করলেন, এক লহমা, তারপর বললেন, “না, থাক্। আনু বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।” আমি জোর দিয়ে বলেছিলাম, “আমার মা এত তাড়াতাড়ি কখনও ঘুমোয় না।”
কিন্তু তুমি তো ঘুমিয়েছিলে! চাপা গলায় কতবার ডাকলাম, “মা, মা, মা”, তবে তো শুনতে পেলে। যেন নিশির ডাক ডাকছি, সাড়া দিতে নেই, তুমি সাড়া দেবে না। একটি ছায়ামূর্তি জোলো জ্যোৎস্নায় ভাসতে ভাসতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, আমার পা ক্রমশ-অবশ, “মা–মা” ডাকতে গিয়ে গলা কাঁপছে।
আমার মা এত তাড়াতাড়ি ঘুমোয় না। বলেছিলাম। কিন্তু তুমি তো ঘুমিয়েছিলে। একটা লম্ফ’ হাতে খিল খুলে দিতে এলে, তার কালো-লালে মেলা পিঙ্গল আলোয় দেখলাম তোমার ফোলা ফোলা চোখ, সারা কপালে সিঁদূর—খুব বড় করে টিপ পরো কিনা ইদানিং, তাই বেশি করে ছড়ানো—আলগা কাপড়টা তোমাকে জড়িয়ে কোনওমতে দেখেই বুঝলাম ঘুমিয়েছিলে। তোমার কোল ঘেঁষে, বুকের গন্ধে ভোর হয়ে চিরকাল ঘুমিয়েছি, তোমার ওই চেহারা আমি চিনি না?
সোজা নিয়ে গেলে রান্নাঘরে। খাবার ঢাকা ছিল, বেড়ে দিলে। হাই তুলছিলে লুকিয়ে টের পাচ্ছিলাম, তোমার যাতে বেশি কষ্ট না-হয়, তাই তাড়াতাড়ি খেলাম। একটু নতুন ধরন বৈকি, পিঁড়িতে বসে আমি ঢুলতে থাকব, আর তুমি মুখে জোর করে গ্রাস ঢুকিয়ে দেবে বরং এই তো ছিল নিয়ম, সেই নিয়মটা আজ কি হঠাৎ উলটে গেছে?
খেয়ে উঠেই এক দৌড়ে বিছানা, যে-বিছানা তোমার-আমার, টান টান করে পাতা চাদর, মনে মনে ঠিক যেন মিলছে না, বালিশে মাখামাখি তোমার মাথার তেলের গন্ধ ছাপ কিছু নেই, তাতে তেমন-কিছু বিস্ময় নেই, কারণ তোমার রুক্ষ চুল, সবটাই খোলা, সেদিন বোধ হয় তেল মাখোনি, কিন্তু বালিশটাই যে নেই, বিস্ময় সেইটেই
বাবার ওদিকটা আবছায়া-অন্ধকার, কিন্তু ওঁর নাক ডাকছিল না, তবে ঘুমোননি? তা নিয়ে বিশেষ ভাবছিলাম না, তুমি ঘুমিয়েছিলে কি ছিলে না, এই ভাবতে ভাবতে আমি নিজেই কখন ঘুমিয়ে পড়লাম।
একটু একটু করে সব যে বদলাচ্ছে, বাইরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম। বদলাচ্ছে আকাশের রঙ, গরম বাড়ছে, তালপাখা কিনে আনা হল, সকালের রোদ্দুর দেখতে দেখতে রাগী হয়ে যায়, সমস্ত দুপুরটা তামাটে। এক-একটা বিকেল আবার ঘোলাটে হয়ে যায়, যখন হা-হা করতে করতে এক-একটা ঝড় রাক্ষসের মতো ছুটে আসে, কাঁপায় কাঁপায় সব কাঁপায়, আমাদের ঘরের চাল আর খুঁটিসুদ্ধ থর-থরিয়ে দেয়। রাত্রে ছটফট সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে, দাওয়ায় কি উঠোনে এসে কুণ্ডলী পাকায়, অন্ধকারে সরসর করে রাস্তার এপার-ওপার হাঁটে।
এক-একটা ঋতু তখন এক-একটা ছাপ ফেলত, যেমন গ্রীষ্ম, তেমনই বর্ষাও, তার বড় বড় ফোঁটা মনের মাটিতে গেঁথে যেত।
বর্ষার একটু আগেই বোধ হয় বাবার বড় রকমের অসুখটা হল। কাশি তো ছিলই সেই সঙ্গে বুকের ব্যথাটা। জ্বরটা কিছুতেই যচ্ছিল না, চোখ সারাদিন লাল, বাবাকে কেমন অন্যরকম লাগত। যখন চোখ বোজা থাকত বাবার, তখন ঠোঁট, দেখতাম, নড়ছে। কণ্ঠস্বরও চিরে গিয়ে চিকণ, বিড়বিড় কথাগুলো সব বোঝা যায় না, কখনও শুনতাম “এখানে থাকব না, আমি এর পর ছত্রিশগড়ে যাবো ঠিক ছিল যে! সেখানে থেকে আরও দূরে, পশ্চিমে, একবারে দ্বারকা, এই বলো না, আমি সেরে উঠব তো। উঠব না?”
কাছে ডেকে কখনও আমার মাথায় হাত রাখতেন, কড়া-পড়া হাত, কিন্তু শিথিল দুর্বল, তবু তাতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কখনও-দৌড়ে ওষুধ আনতে ছুটেছি, কখনও-বা দেখছি চৌকাটে দাঁড়িয়ে, তুমি নিশ্চল একটি মূর্তি বাবার শিয়রে। তাপ নিচ্ছ, বুকে হাত রেখে, কপালে ঠান্ডা জলপটি, বাবা যদি উপুড় হয়ে শুয়ে, তবে ঘরেই বালতি বালতি জল এনে, ওঁর মাথায় ঢালছ, মুছিয়ে দিচ্ছ গামছায় আলগোছে, মাথাটা বালিশে তুলে দিলে সন্তর্পণে, আস্তে আস্তে যখন হাতপাখা নাড়ছ তখন যেন একটি মেঘের মতো মমতা তুমি! অপলক, ঘননিঃশ্বসিত তোমাকে কখনও ক্লান্ত, ওখানেই এক পাশে এলিয়ে পড়তে দেখলাম।
কিন্তু, আশ্চর্য লাগত না। নতুন বর্ষা আমাকেও নরম করে ফেলেছিল।
.
আশ্চর্য, সুধীরমামাও ঠিক ওই সময়েই কাবু হয়ে পড়লেন। ওঁর সঙ্গে মাঝে মাঝে ছিপ হাতে বেরিয়ে পড়তাম আমি, আগেই বলেছি ইতিমধ্যে দু’জনের মধ্যে একটা সহমর্মী সখ্য হয়ে গেছে যদিও আমরা অসম-বয়সি,তাই যখন ক্লাস নেই, ঘরেও আমার করার মতো কিছু কাজ নেই, তখন সোজা চলে যেতাম ওঁর ওখানে, সেখান থেকে মাঠঘাট পেরিয়ে ঘন শরবনের ছায়ায় কোমল নিমাই রায়ের বিল, সেখানে পাশাপাশি একটানা অনেকক্ষণ। ফাতনা ভাসছে, উঠছে, কিন্তু আড়চোখে চেয়ে টের পেতাম, সুধীরমামার লক্ষ্য নেই, আসলে মনই নেই ওখানে, মাছধরা-টরা তো সুধীরমামার নেশা নয়, কোনও দিন ছিল না, বুঝতে পারতাম উনি নতুন একটা অভ্যাসে প্রবেশ করতে চাইছেন।
দু-একটা কথা হত মাত্র! কথার কোনও দরকার ছিল না। আমরা দু’জন দু’জনকে বুঝতে পারতাম। যেদিন হয়তো একটাও মাছ উঠল না, সেদিন শেষবেলায় সুতোটুতো সব গুটিয়ে সুধীরমামা ওঁর নড়বড়ে শরীরটা নিয়ে উঠছেন, নিয়ে উঠছেন, হাড়েহাড়ে-লাগা-ঠোকাঠুকিরও যেন আওয়াজ পাচ্ছি, বলছেন, “আসলে কেন আসি জানিস? মাছ ধরাটা হল ধৈর্যের পরীক্ষা। এখানে বসে বসে সহিষ্ণুতা শিখি।”
কেন যে আসতেন, আমি জানতাম।
একদিন কিন্তু আসতে পারলেন না। ওঁর বাসাতে গিয়ে দেখি, শুয়ে আছেন, আগাগোড়া চাদরমুড়ি, জানালা বন্ধ, ঘর অন্ধকার। পায়ের শব্দ পেতে মুড়ি সরিয়ে বললেন, “খুব মাথা ধরেছে রে, ছিঁড়ে যাচ্ছে, কম্প দিচ্ছে, আমাকে চেপে ধরবি? একবারটি চেপে ধর।”
চেপে ধরলাম, উনি যেন তৃষ্ণার্তের মতো আমার মাথার ঘ্রাণ পান করলেন, যেন শুষে নিতে চাইছিলেন আমাকে, আমার সত্তাকে।
আঁকড়ে-ধরা হাত দুটো আপনা থেকেই এক সময়ে শিথিল হয়ে এল, আমি মাথা তুললাম, উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন কিন্তু তপ্ত শ্বাস তখনও গালে লাগছিল, পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলাম।
তোমাকে বললাম, “সুধীরমামারও অসুখ। খুব জ্বর দেখে এসেছি।”
তুমি চেয়ে রইলে, যেন চোখ দিয়ে শুনলে, তোমার মুখে ভাবলেশ ছিল না, তখনই কিছু বললে না।
বললে, পরদিন দুপুরে, পুকুরঘাটে।
—”কেমন আছে রে?”
–”আজ তো যাইনি! “
–”যাবি না?”
—”বলো তো যাব।”—বলো তো কথাটা একটু ঝোঁক দিয়ে বললাম। সঙ্গে সঙ্গে শুনলাম তুমি বললে “আমাকে নিয়ে যাবি?”
“বাড়ি ছেড়ে? ঘরে বাবা একা—“
“উনি তো এখন একটু ভালোর দিকে। পথ্য দিয়ে এসেছি। তা-ছাড়া এখন তো আমার চান করার সময়—যার আর আসব, বেশি দেরি হবে না।”
.
সেই জানালা-বন্ধ ঘর, এবার আমি সাক্ষী। সুধীরমামা ঘুমোচ্ছিলেন, গলা অবধি ঢাকা, বিছানার সঙ্গে রোগা মানুষটি আরো যেন লেপ্টে।
আমি শুধু দেখছি। তোমাকে এগিয়ে যেতে দেখলাম, আঁচল থেকে বের করলে একটি শাখা-করুণ হাত, খুব আলগোছে সেই হাতের পিঠ ওঁর কপালে একবার না-ছোঁয়ার মতো ছোঁয়ালে। ব্যস, আর কিছু না! আমার দিকে ফিরে বললে, “এখনও তো বেশ জ্বর।” ব্যস, আর কিচ্ছু না। জলপটি না হাত পাখা না, শুধু কলসি থেকে গড়িয়ে ওঁর শিয়রের কাছে রেখে দিলে এক গ্লাস জল। বললে “এবার চল্।” যেমন চুপিচুপি এসেছিলে তেমনই চুপিচুপি বেরিয়ে এলে।
আর কিছু না কেন, বাবার শিয়রেও তো মূর্তিমতী শুশ্রূষা, সেবা, উৎকণ্ঠা আর মায়া তোমাকে দেখেছি, এখানে এই কৃপণ-কৃচ্ছ্র, নীরব নিস্পৃহতা, এই বৈপরীত্য ভালো লাগছিল না। সারা রাস্তা তোমার সঙ্গে একটা কথা বলিনি।
(সেদিন যাকে ভেবেছি অমানুষী নির্মমতা, পরে তার মানে জেনেছি। একই জিনিসের দু’পিঠ—কোথাও সব ঢেলে দিয়েও মনে হয় আরও দিই, কোথাও হাত থাকে শামুকের মুখের মতো গুটিয়ে, কিছু না-দেওয়া, দিতে না-চাওয়া বা না-পারাটাও সব দেওয়া।)
বাবা জেগে গিয়েছিলেন। উঠে এসে বসেছিলেন দাওয়ায়, তুমি আঁতকে উঠেছ, “অসুখ শরীর নিয়ে এ কী” প্রায় চিৎকারের মতো শুনিয়েছে তোমার গলা, কিন্তু বাবার চোখ তখন একেবারে ঠান্ডা, ভীষণ মসৃণ-সমতল কণ্ঠে বলেছেন, “কোথায় গিয়েছিলে?”
পুকুরঘাটে যে নয়, তোমাকে দেখে সেটা বোঝাই যাচ্ছিল, পেয়ারা গাছ থেকে তরতর নেমে এসে দুটো কাঠবিড়ালি উঠোনে কী খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল। তারা দৌড়ে পালাল। একটু থমকে দাঁড়ালে—এক মুহূর্তমাত্র, তারপর যেন বাবারই নিস্তরঙ্গ সমতল কণ্ঠস্বর নকল করে বললে, “সুধীরদার ওখানে।
বাঁচালে তুমি মা, একটা-কিছু যে বানিয়ে বলোনি তখনই, তাতে সেইদিন আমার কাছে তুমি বেঁচে গেলে। আমি দম ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। যেই তোমার উত্তরটা শোনা গেল, অমনই একটা বেজি খিড়কির দিক থেকে খালি কুতকুতে চোখে উঁকি দিচ্ছিল, একটা লাঠি নিয়ে সেটাকে তাড়া করে গেলাম।
“ওখানে কেন?”
“সুধীরদারও জ্বর।”
“খবর আনল কে?”
হাত দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিলে তুমি। সত্য অস্বস্তির, কিন্তু তার রঙ সে কী-সাদা, এই উঠোনের উপরকার খোলা আকাশটার মতো, তখনই টের পেলাম।
দেখলাম, বাবা উঠছেন কাঁপতে কাঁপতে, খুঁটিটা ধরে দাঁড়ালেন। টলতে টলতে ঢুকলেন ঘরে, ফের সেই অসুখের বিছানায়
সেদিন বিকালেই বাবার বোধহয় আবার জ্বর এল।
আর সেদিন রাত্রে? হঠাৎ ঘুম ভেঙে ভয় পেয়েছিলাম, মুখের উপর গরম বাতাস, কার তপ্ত শ্বাস। একটা নিবু-নিবু আলো জ্বলছিল, বাবার অসুখের সময় থেকে রোজই জ্বালা থাকত, বুঝতে দেরি হল না সেই শ্বাস কার। অনেক দিনের না-কামানো দাড়িগোঁফ, ঘন ভ্রূ, বাবাকে চেনা গেল সহজেই। সেই দাড়ি-ভুরুর জঙ্গলে বাঘের মতো জ্বলছিল এক জোড়া চোখ—বাঘ, না, সে-দৃষ্টি পাগলের—আমাকে খড়-খড়ে জিহ্বা দিয়ে লেহন করছে, মা, ও মা, তুমি এখনও কেন খাটের একপাশে যেন লুটানো লতা, তোমার ঘুম ভাঙে না কেন।
আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলেছি, যেন দেখিনি এই ভান, ঘুমের ভানের চেয়ে ঘুমিয়ে-পড়া কত সহজ, কিন্তু আমি তো ঘুমোব না, জেগে থাকব, সব নড়া-চড়া নিশ্বাস বন্ধ করে দিয়ে, সেকেন্ড কাটছে, এক, দুই, তিন, কত সেকেন্ডে এক মিনিট কত মিনিটে, হে ভগবান, একটা গোটা রাত? তারপর চোখ বুজেই টের পেয়েছি শিকারি ব্যগ্র একাগ্র চাউনিটা সরে গেছে, যেতে যেতে একটা পা লণ্ঠনটা দিয়েছে উলটিয়ে। তেল গড়াচ্ছে নিশ্চয়, কাল সকালে নিশ্চয় মেঝের উপর কালো একটা দাগ দেখতে পাব, ফিতের মতো, ফিতে কিংবা জবজবে একটা বেণী, ঘামে নেয়ে উঠতে উঠতে আমি এইসব কল্পনা করলাম। ঘামের কুলুকুলু ধারাও কখনও শোনা যায়।
আকাশ-পাতাল অনেক কিছু ভাবতে থাকলাম, খালি ভেবে পেলাম না, ঝুঁকে পড়ে বাবা কী দেখছিলেন আমার মুখে, অত ঘন ঘন ওঁর শ্বাস পড়ছিল কেন।
পরদিন সকালে উঠে শুনতে পেলাম বাবা বলছেন তোমাকে, “আমি এবার যাব।”
দু’জনেই বারান্দায়, বাবার গলা মৃদু যেন আলাদা মানুষ, একবার হঠাৎ ঘরে ঢুকলেন, বোধহয় একটা গামছা নিতে, আমার দিকে তাকাননি, তবু দেখতে পেলাম, এরই মধ্যে বাবা কখন দাড়িটাড়ি কামিয়ে দিব্যি।
আসলে শেষ রাত্রের ঘুম তো, আমিই বোধহয় বেলা করে উঠেছিলাম।
আবার বাবা বেরিয়ে গেলেন বারান্দায়, তোমাকে বললেন, “যাব কাল কি পরশু। তুমি বললে শুনলাম, “সে কী, শরীর এখনও সারেনি”, বাবা তৎক্ষণাৎ “আমার অসুখ কি সারবার, তুমি কি বলো?” গলা থেকে বোঝা যাচ্ছে বাবা হাসছেন মিষ্টি-মিষ্টি, চমৎকার, কী মধুর, কিন্তু মা, তুমি ছাড়ছ না, গলা আরও নামিয়ে বলছ “কিন্তু আমার এই অবস্থায়”–
“ভয় পাচ্ছ?”
“পাচ্ছি।”
“ঠিক জেনেছ একেবারে?”
‘একেবারে ঠিক কী করে বলি আর। তবে আর-আর বারের মতোই সব কিছু—এক-একবার তুমি আসো, আর এই হয়। তোমার কী! দায়হীন, দয়াহীন একটা দস্যু- মা তুমি যেন আর কথা খুঁজে পাচ্ছিলে না।
হো-হো করে নির্মল হাসতে শুনতে পেলাম বাবাকে, যেন নিজের মজা-পাওয়া গলায় নিজেই মজে গেছেন, “ভালোই তো হল, তুমি ভাবছ কেন, এরাই তো দেশের ভাবী সংগ্রামের এক-একজন সৈনিক —”
“তা হয় না। হবে না।” মা, তুমি হাঁপাচ্ছ, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে তোমার দাঁতে দাঁত গেছে চেপে, “হয় না, হবে না।”
“হবে না কেন?
“কে টানবে এত, কে মানুষ করবে?”
হা-হা-হা-হা, অনাবিল অকুণ্ঠ হাসি বাবার, কিন্তু বলছেন আস্তে আস্তে, “কেন, টানবার লোক তো আছে। মানুষ করা? সেটা ঠিক জানি না।”
“মানে?”
“না যদি জানো তো বলব না! কিন্তু দ্যাখো, যেটা আছে, সেটা ঠিক মানুষ হচ্ছে না।” এইবার বাবা সেই সাংঘাতিক কথা বললেন, “ভাবছি ওকে আমি নিয়ে যাব। এখানে
ও বরং খারাপ প্রভাবে অমানুষ হচ্ছে। ওকে আমার কাছে রেখে মানুষ করে গড়ে তুলব।”
ওকে, মানে আমাকে। কাঠ হয়ে শুনছিলাম। মা রুদ্ধশ্বাসে তোমাকে বলতে শুনলাম, “বলছ কী?”
“ভেবে-চিন্তেই বলছি।”
“তুমি রাক্ষস, তুমিই বলতে পারো এ-কথা।”
একেবারে ঘাবড়ে যেও না।” দরজা ফাঁক দিয়ে দেখছি, বাবা চোখ টিপছেন—”ওকে আবার ফেরত পাঠাতেও পারি।”
“মানে।”
“বলছি। তার আগে তুমি হিসেবটা আর-একবার ভালো করে বলো তো? আমি সেই একবার এলাম, কোন্ সালে যেন, বছরটা মনে করিয়ে দাও। তারপরে এলাম যেবার, সে কবছর পরে? বোধহয় দুই-কি-তিন। ওকে দেখলাম, তুমি বললে ওরও ঠিক দু’বছর পূর্ণ হয়েছে। সত্যি বলো তো, ও কি তখন দু’বছরেরই ছিল, তার চেয়ে কমটম নয় তো?”
তোমার মুখে কথা ছিল না। কান্না, রাগ, ঘেন্না সব মিশিয়ে যেন মিলিয়ে যাচ্ছিল, “নির্লজ্জ, বদমাস, ইতর?” খুঁটি ধরে সামলে এই তিনটি শব্দই খালি বলতে পেরেছিলে।
“আ-হা-হা গালাগাল পরে, আগে শোনোই না। কথাগুলো চটপট বলে ফেললেই তো খটকা মিটে যায়। সোনামণি, আমার দিকটা তুমি কেন দেখছ না। জানো, আমি মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে নিজের মুখটা মিলিয়ে দেখি! তারপর নিজেকে দেখি আয়নায়। কোনও-কোনও রাতে, ও যখন ঘুমিয়ে, দেখি, দেখতেই থাকি, আমার যন্ত্রণাটা তুমি বুঝছ না?”
তোমার মুখে কথা ছিল না, চোখের মণি ঠিকরে বাইরে আসতে চাইছিল, কিন্তু সারা মুখ ছিল অসম্ভব সাদা। কোনওমতে টেনে টেনে কিন্তু
টেনে টেনে কিন্তু তীব্রস্বরে, তুমি বললে—”তুমি—চলে—যাও।”
“যাবই তো। বলো তো আজই। তবে একেবারে এইভাবে বিদায় দেবে? পাঁজি খুলে যাত্রা শুভ-টুভো কিনা একবার দেখে দেবে না?”
উত্তর নেই।
“বলেছি তো, ওকেও নিয়ে যাব। কলকাতায় আজকাল অনেক রকম পরীক্ষা হয়েছে, ব্লাড টেস্ট, কখনও শুনেছ? রক্তের সঙ্গে রক্ত মেলানো। কথাটা যখন উঠেছে, তখন যাকে নিজ হাতে মানুষ করব, তার সম্পর্কে একেবারে নিঃসংশয় হওয়াই তো ভালো।”
হাতের কাছে কী-একটা পেয়ে তুমি ছুঁড়ে মেরেছিল বাবাকে। সমস্ত দৃশ্যটা চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। খালি আমার কান দুটোয় প্রতিটি শব্দ ঢুকছিল। সেই ভয়ঙ্কর সকালটাকে আজও ভুলিনি। অনেক কথা, অনেক ইঙ্গিত সেদিন ছিল অস্বচ্ছ, কিন্তু কথাগুলো যে ভয়ানক, সেটা অবোধ বয়সের সহজাত বোধেও গেঁথে যেতে বাধা হয়নি।