০৫. সেই দুপুরটাও কাটল

সেই দুপুরটাও কাটল। সময়ের একটা মহৎ স্বভাব, সে কেটে যায়। যদি না কাটত, যদি জমে যেত হঠাৎ একখানে—আমরা চলতে চলতে ভিড়-টিড় দেখে মজা পেয়ে যেমন দাঁড়াই! সে একটা দুঃসহ অবস্থা হত, জমে-ওঠা জঞ্জাল বিকট গন্ধ ছাড়ত, পচা-গলা যত আঁশ, কাঁটা আর নাড়িভুঁড়ি, কলকাতার ঝাঁঝরি বন্ধ হয়ে, পরে কলকাতায় দেখেছ তো মা, কী নোংরা, কী ঘেন্না, এঁটো বাসন, শালপাতা, নারকেলের ছোবড়া আর ছাই, সব থৈ-থৈ। সময়ের মস্ত গুণ, তার চরিত্রে থামা নেই, সে বয়ে যাচ্ছে, সব সাফ করে দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে, জলের তোড়ে কেবলই ধুয়ে যাওয়া, সময় কি এক শুচিবাই বিধবা?

কিংবা সে বুঝি এক অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর যুবা, এই ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে জলে, এক-একটা ঋতুতেই দ্যাখো না, মনে হয় ডুবে গেল বন্যায়, তার পরেই চিকচিকে রোদে পিঠ মেলে দিল নীল-নিবিড় আকাশে, কাঁপতে থাকল বাঁশঝাড়ের ফেটেপড়া স্থির-সবুজ তুবড়িতে, আর অজস্র ছড়ানো ফুলে ফুলে সৌরভে মুহ্যমান পড়ে রইল। এই সে কুয়াশায় কানার মতো হাতড়ে হাতড়ে হাঁটে, তখন সময়ের হাতে একটি নুড়িও যেন দেখতে পাই, তার খানিক পরেই চৈত্রের ঊর্ধ্বশ্বাস ধুলোয় আর পাতায় সময় সওয়ার হয়ে ছুটছে।

আমাদের বাড়িতেও সেদিন সময় বৈরাগীর মতো “ভিক্ষে দাও গো” বলে হাত পেতে বসে ধুঁকতে থাকল না। আর সেইজন্যেই সব সহজ হল।

.

মা, তুমি আর বাবা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছিলে না, লক্ষ্য করছিলাম। একটা পরদা পড়ে গেছে মাঝখানে তবু কাজকর্ম চলছে। তুমি ঠিক সময়েই উনুনে আঁচ দিলে, চা হল, বাবা চুমুকও দিলেন, সময় মতো তাঁর শিয়রে তুমি দাগ-মাপা ওষুধের শিশি-গ্লাসও রেখে এলে। এরই মধ্যে বাবা ওঁর টুকটাক জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছিলেন, ফতুয়ার বোতাম নেই কেন বলে গজগজ করতে থাকলেন খানিক, কখন নিজেই ছুঁচ-সুতো জোগাড় করে বসে গেলেন রিফু করতে। সন্ধ্যা হতেই রোজকার মতো শাঁখ বেজে উঠল, বড় বাড়ির মন্দির থেকে কাঁসর ঘণ্টা পিটে পিটে ঘরে-ফেরা শেষ পাখিদের আরও ভয়ার্ত করে তুলল, এই সময়টা আকাশটায় এমন পোড়া লোহার মতো নিত্যি জং ধরে যায়! আর এই সময়েই মন্দিরের ঘণ্টা সরব হয় কেন, ওরা কি রাত্রির বন্দনা করে, নাকি আলোর শেষ রেশটুকুকেও ‘যেয়ো না’ বলে—আমি ঠিক বুঝতে পারি না।

যেহেতু আমি সেদিন কিছুর মানে বুঝতে পারিনি, হিস হিস গলার কথা-কাটা-কাটি শুনেছি এবং বুঝতে পেরেছি যে ব্যাপারটা বিশ্রী, কিন্তু ঘণ্টার ঢং ঢং আঘাতে মনে হচ্ছিল, কেটে যাচ্ছে, যা ছিল সব আবার তাই হবে, আমি তোমার পাশটিতে শুয়ে তোমাকে জড়াব, তোমার শরীরের উষ্ণতা পাব, শিকড় যেমন শুষে নেয় মাটির গভীরকে, তোমার প্রগাঢ় মমতা তেমনই শুষে নেব, যেহেতু আমি ব্যাকুল হয়ে ভাবছিলাম সব মিটে যাক, তাই আরও কী কী ঘটনা আগামী এক প্রহরের সাজঘরে তৈরি হচ্ছে, আমি জানতাম না।

.

নিজের ব্যাগ গোছানো শেষ, বাবা হঠাৎ চমকে দিয়ে বললেন, “তুই কী নিবি গুছিয়ে নিলিনে?”

আমি? হ্যাঁ, বাবা যখন বলেছেন তখন নিশ্চয়ই। স্থির স্বরে তিনি বলছেন, “তুই-ও যাবি। একবার আমি যা ঠিক করি তার আর নড়চড় হয় না। আজ রাত্রেই গাড়ি আছে, বোধ হয় ন’টায়। তৈরি হয়ে নে।”

তুমি সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলে। আমি, যেখানে, সেখানেই। বাবারও বাক্‌স গোটানো শেষ হয়ে গিয়েছিল। এতদিন পরে ফিরে চেয়ে মনে হয় যেন একটি দৃশ্য যাদের পার্ট সেই তিনজনে তিনটি স্থানে প্রোথিত, প্রত্যেকে তার পার্ট ভুলে গিয়ে, নির্নিমেষ, কেউ কারও দিকে একচুল এগোতে পারছে না।

সেই সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে একটা নাটক আমাদেরই বাড়িতে অভিনীত হচ্ছিল। আমার নির্মমতম কয়েকটি স্মৃতির মধ্যে এটি অন্যতম

না, কোনও বিস্ফোরণ ঘটেনি। একটা হিমস্রোত বয়ে যাচ্ছিল। বাবা একবার কেমন জড়িত অদ্ভুত গলায় বলে উঠলেন, “কই, তোর কী-কী নেবার আছে, আনলি না।”

পুরনো টাইপিস্ ঘড়িটা প্রায়ই বন্ধ হয়ে থাকে, সেদিন ঠিক টিকটিক, একটানা চলছিল।

সেই ফুল-আঁকা ছোট্ট টিনের সুটকেসটা তোমাকে মনে করিয়ে দেব, মা? দু’তিনটে কাপড়-জামা, বই-টই দিয়ে তুমি ভরে দিচ্ছিলে। যেন মড়া সাজানো, যেন দাদার মৃত্যুর মতো আর-একটা রাত্রি ফিরে এসেছিল। শুধু তফাত—তোমার শুকনো চোখে কান্না ছিল না।

সেই অসম্ভব অবিশ্বাস্য সময়ে কাটাকাটা ফালি হয়ে আমরা কী করছিলাম? মুখে ভাত গুঁজছিলাম, কিংবা তুমিই কি একটির পর একটি গ্রাস মুখে তুলে তুলে দিচ্ছিলে?

আমি তৈরি হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি, এবার যাব, তুমি মৃদু স্বরে একবার বললে, “চুলটা আঁচড়ে নিবি না?”—ওই একটিমাত্র সাধারণ একটা নিরুত্তাপ কুণ্ঠিত কথা, বাবা বলে উঠলেন, “না, রাত্তিরে আয়নায় মুখ দেখে না।” তুমি বললে, “তবে ফিতে বাঁধা জুতোটা পরে নে”, বাবা বললেন, “না বাবুগিরির দরকার নেই, চটিটাই দিব্যি আছে”, তারপর তোমার দিকে তাকিয়ে “তুমি বুঝতে পারো নি যে, ও তোমার মতো আর চলবে না, তোমার হুকুম খাটবে না?”

তুমি শুনলে। আমি শুনলাম। যে নখগুলো কাকে যেন ছিঁড়তে চায়, কিন্তু পারে না, না পারুক, কিন্তু সমস্ত জীবন ভেবেছি, তারা তখন নিজেরই ভিতরটাকে হিংস্রভাবে আঁচড়াতে থাকে কেন।

.

দাদাকে মনে মনে বললাম, যাচ্ছি। তোমাকে প্রণাম করছি। কোথায় যাচ্ছি কত দিনের জন্যে, জানি না। প্রণাম করছি। তুমি হাত বাড়িয়ে ছুঁলে, স্পর্শে সাড়া ছিল না, বাইরে অন্ধকার, দূরে দূরে দু’একটা আলো। ওরা জেগে আছে, কিন্তু জানছে না কে চলে যাচ্ছে, তবু আশ্চর্য, শোক নেই, অন্তত বাইরে তার কোনও চিহ্ন নেই। এই পাড়াটা আমার যেন আর-এক মা, সে-ও সেদিন যেন, মা, তোমার মতোই হঠাৎ পাথর, স্তব্ধ! সোজাসুজিই বলে দিই, আমার বুক ঠেলে কান্না, ভয়, উঠে আসছিল। অন্ধকার হলেও আমার চেনা রাস্তা, এর প্রত্যেকটা ভাঙা-চোরা গর্ত আমি জানি, তবু হোঁচট খাচ্ছি, আর আগে-আগে হেঁটে বাবা তাড়া দিচ্ছেন, তাড়াতাড়ি চল, তাড়াতাড়ি।

যাচ্ছি তো, কিন্তু এভাবে কেউ যায়, এই রকম চোরের মতো? কালও সকাল হবে, পাড়াটা কি তখন টের পাবে, কে ছিল, কে নেই তাকে আর এখানে দেখা যাবে না? আমার পকেটটা একবার ছেঁড়া ছিল, তখন টের পাইনি, দুটো পয়সা পড়ে যায়। তবু তো আমি সেদিনই একটু পরে টের পাই, হারানো পয়সা দুটো আঁতিপাতি করে খুঁজি! এই পাড়াটায় কি ততটুকু সাড়াও পড়বে না, এদিক-ওদিক চোখ মেলে আমাকে সে খুঁজবে না। আমার কি দু’টো পয়সার মতো দামও না? কান্না পাচ্ছিল।

পাড়া ছেড়ে তাকালাম আকাশে, না ওখানে ওরা আছে, হাজার-হাজার জ্বলজ্বলে চোখে একজনের চলে-যাওয়া দেখছে! সাহস পেলাম, ভরসা এল। যেখানেই যাই, ভয় কী। যেখানেই যাই না কেন, চোখ বুজে অবাক আকাশটাকে বললাম, যেখানেই যাই সেখানে তোমরা থেকো।

তুমি হয়তো বিছানায় লুটিয়েছিলে, অথবা গেঁথেই গিয়েছিলে দরজাটায়, কবাটের মতো, তুমি জানতে পারোনি, কত জনের কাছে সেদিন মনে মনে বিদায় নিতে নিতে যাচ্ছিলাম। এক-একবার এক-একজনকে বলি, আর সকলকে সরিয়ে দিয়ে বারবারই ভেসে ওঠো তুমি। তোমাকে কী বলব, তোমাকে কিন্তু কিছুই বলা হয় না।

সেই মজা কুয়োটা, রাস্তা যেখানে বাঁক নিতে গিয়ে পা পিছলে মাঠে পড়ল, মেঠো-রাস্তার মোড়ের পাহারা সেই ইদারায় ঝুঁকে পড়ে কথা বলা হল একটা মজা। ইঁদারায় কিছু ফেলে দিলে, টপ্ করে ডুবে যায়, আর ওঠে না, অথচ তার বুকে মুখ রেখে যা-খুশি বলো, প্রত্যেকটা শব্দ সে দশগুণ ছড়িয়ে বাড়িয়ে উপরে ছুঁড়ে দেবে। চমৎকার সেই খেলাটা, হারানো কথা ফিরে পাওয়া, শেষবারের মতো খেলতে ইচ্ছো হল। ভাবলাম ওর বুকে মুখ ডোবাই, ডোবাই, ডুবিয়ে অনেকক্ষণ থাকি, শেষে হঠাৎ বলে ফেলি, আমি যাচ্ছি, আর হয়তো আসব না।’

“আসব না”, মেঠো রাস্তাটা শর্টকাট, ওপারে স্টেশনের রাস্তার মুখেই যে অশ্বত্থ গাছ, অন্ধকারে দূর থেকে যাকে বারি-চুল ডাকাত ভেবে কেঁপে উঠতাম, আর বিশ্বস্ত-পরিচিতের মতো তাকেও সেই কথা বললাম।

কয়েকটা লাইন কেবলই মনে পড়ছিল, সেই সীতাহরণের জায়গাটা, সুর করে পড়তে পড়তে যেখানটায় গলা ধরে যেত, তোমার, আমার। এইখানেই সেই দিঘিটা, যার ওপারে সেই বাসাটা। আজ দুপুরেও গিয়েছি। মাথার কাছে রাখা গ্লাসটা থেকে এতক্ষণে তিনি নিশ্চয়ই জল খেয়েছেন? তিনিও কিছু জানেন না। তাঁর জ্বর কি এখনও আছে, না ছেড়ে গেছে? আমি ছেলে, তবু নিজেকে ভাবছিলাম ওই জানকী। সীতা তো যেতে যেতে, কত-কী ছড়িয়ে ফেলেছিল, যাতে চিহ্ন থাকে, যাতে রাম-লক্ষ্মণ জানতে পারে, চিনতে পায়, কিন্তু, হার, কাঁকন-কেয়ুর, কিছুই তো আমার নেই, আমি কোন্ চিহ্ন রেখে যাব?

বাবা একটু এগিয়ে, আমি একটু পিছিয়ে, এক সেকেন্ড দাঁড়ালাম। পকেটে ক্লিপলাগানো স্টাইলো কলম, সুধীরমামা দিয়েছিলেন, টুপ করে সেটাকে ফেলে দিলাম। রাস্তার ধারে। বাবা ধমক দিলেন, “কী হল, পা চালিয়ে আয়”, ফের তাড়াতাড়ি চলতে থাকলাম। খুব আস্তে আস্তে কাকে যেন বলছিলাম, “ওঁর যেন জ্বর সেরে গিয়ে থাকে, রোজ ‘মর্নিং ওয়াক’ করা তো ওঁর অভ্যেস, কালও খুব সকালে যেন বেরিয়ে পড়েন। যেন দেখতে পান। ওঁরই দেওয়া জিনিস তো, নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন কলমটাকে, কুড়িয়ে নেবেন। কলমটা সব বলে দেবে, সুধীরমামা জানবেন।”

চারপাশে সব চুপচাপ, নিথর, কিন্তু স্টেশনটা সরগরম। আগাগোড়া মুড়ি দিয়ে কারা সব শুয়ে আছে, গোটা দুই ছ্যাকরা গাড়ি, আর-একটা সেই কাপড়ের ঘোমটা-দেওয়া ট্যাক্সি, যেটা গাড়ি এলেই যত পারে প্যাসেঞ্জার লুঠ করে, আমাদের ওই মফস্সলের শহর থেকে জেলা-সদরের দিকে ধোঁয়া ধুলোয় গা ঢাকা দিয়ে ছুটতে থাকে। জেলা-সদরে রেল নেই।

তখন গাড়ি আসেনি, আমরা গেলাম, আর ঢং ঢং করে প্রথম ঘণ্টা পড়ল। তার মানে গাড়ি আসতে এখনও মিনিট পনেরো দেরি। গ্যাসের আলো জ্বেলে বুড়ো পানওয়ালা পান সেজে চলেছে, গাড়ি এলেই ছুটবে প্লাটফর্মে—পান-বিড়ি-সিগ্‌রেইট— আমি ওর গলা ফার্স্ট-ক্লাস নকল করতে পারি—বাবা টিকিট ঘরের সামনে দাঁড়ালেন, ভিতরে ঘটাং ঘটাং শব্দ, ঝোলানো টেলিফোনের একটা দিক কানে তুলে চোঙে মুখ রেখে স্টেশনবাবু দূরের কাকে বলছেন, “হ্যালো হ্যালো” মাঝে মাঝে খট-খট টরেটক্কা, নিশ্চুপ চারধারের নদীতে এই স্টেশনটা তার গমগম, আলো, চাঞ্চল্য আর ব্যস্ততা নিয়ে চরের মতো জেগে আছে।

বাইরের প্ল্যাটফর্মটা অনেক ঠান্ডা, পড়ে-থাকা পাথরে বাঁধানো, উপর দিয়ে কালো একটা ওভার-ব্রিজ, ওই ভারী জিনিসটা বুকে নিয়েও সে নির্বিকার, সারকাসে পালোয়ানের বুকে অনায়াসে নেওয়া যেন প্রকাণ্ড এক হাতি। প্লাটফর্মের সীমানার ঠিক শেষে সিগন্যালের খুঁটি, টিমটিমে আলো, অন্ধকারে হঠাৎ উঁচু, যেন ফস্ করে তারা হয়ে উঠে যেতে চাইছে আকাশে, কার্তিক মাসের আকাশপ্রদীপও যেমন চায়, কিন্তু পারে না, এই সিগন্যালের আলোগুলোও পারছে না, ইচ্ছেটা সামলে চকচকে চোখে চেয়ে আছে।

যে-ল্যাম্পপোস্টগুলোর কাছে স্টেশনের নাম লেখা তারই একটার নীচে দাঁড়ালাম, পাশে একটা করবী গাছের ঝাড়, খুব নিচু হয়ে নুয়ে আস্তে আস্তে নিশ্বাস ফেলছে, সেই হাওয়ায় হালকা একটা গন্ধও যেন টের পেলাম।

বাবার মুখটা ঠিক দেখতে পাচ্ছি না, যদিও তিনিও পাশেই দাঁড়িয়ে, কিন্তু মুখ অন্য দিকে ঘোরানো, ওই দিক থেকেই বুঝি গাড়ি আসবে, তাই মুখটা দেখতে পাচ্ছি না, অস্পষ্ট, অন্ধকার, সেই ফেরানো মুখ, সহসা টের পেলাম, কী বলছে। কান পাততেই বোঝা গেল, একটা জিজ্ঞাসা, আমাকেই। —”আমাকে তোর কী মনে হচ্ছে রে? বদরাগী, খেয়ালী, তাই না? তোকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছি

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বাবা চেপে ধরেছেন আমার মুঠি, ওঁর হাত কাঁপা কাঁপা, আমারও শরীর কাঁপছে। এ আলাদা একটি মানুষ, একেবারে আলাদা গলা। আমি চিনি না। ওই মায়াবী মনোরম আলোয়, অভিসারী সিগন্যালটা সাক্ষী রেখে তিনি কি বদলে গেলেন! এখনও ঠিক বুঝি না, সেই মুহূর্তে ওঁর ভিতরে ভিতরে কী ঘটছিল, কেন হাত কাঁপছিল শক্ত সমর্থ মানুষটার,আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন জেনেও কেন, আমরা দু’জনেই যেন একলা, অমনই অন্য লোক হয়ে যেতে চাইছিলেন।

“আমাকে তুই চিনিস না। আগে দেখিসনি, দেখলেও মনে রাখিসনি! বল তো আমি কে?”

“বাবা তো।” পুতুলের মতো বললাম।

“কিন্তু কী করি, আমি কে?”

কী করেন, তার স্পষ্ট ধারণা ছিল না, তাই যা মনে এল তাই বলে ফেললাম, “আপনি পালা লেখেন, না?”

“পালাগান?”, করবীর ঝাড়ের নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে আর একটি নিঃশ্বাস নিঃশব্দ হল।—”লিখি। কিন্তু সে-কথা ক’জন আর জানে। কে পড়ে? দু’একজনকে ডেকে শোনাই, এই যা। নইলে সব তো বাক্‌স-বন্দি হয়েই রইল। অনেকগুলোর পাতা হলদে। ছিঁড়ে আসছে।”

“প্লে হয় না?” বলে ফেললাম।

“কারা করবে। দল চাই, টাকা চাই।”

হঠাৎ যেন মাথায় বুদ্ধি এল, বললাম, “বাবা, বই ছাপালে তো অনেক টাকা হয়, এই পালাগুলোকে বই করা যায় না?”

“বই, মানে ছাপানো বই?“

আমার কাছে তখন বই মানেই তাই। বাবা বললেন, “দূর। ছাপতেও অনেক টাকা চাই। টাকা কোথায় আমার? টো-টো করে ঘুরি, কোথাও বাঁধা পড়ি না, হাতে যা আসে সব খরচ হয়ে যায়, সারা জীবনে কিছু কি আর জমাতে পারলাম!” বাবা টেনে টেনে বলছিলেন, বলার সময় কোথায় যেন ওঁর লাগছে, সেই কষ্টটা আমার গায়েও হাওয়ার ঝাপটার মতো লাগছিল—”জমা কিছু নেই। কেউ চেনে না, নিজে থেকে অন্য কে এ সব আগ্রহ করে ছাপবে? এ-সব ব্যাপার তুই জানিস না। আমি—আমি শুধু লিখব, লিখে যাব। ছাপা হবে না।”

আমারই মুখে চোখ রেখে কথা বলছেন, বাবার মুখ এখন আর ঘোরানো নেই, সবটা দেখা যাচ্ছে, ভারী গাল, গলা, ভাঁজ ভাঁজ চিবুক, জোড়া ভুরুর মাঝখানে হঠাৎ প্রদীপ্ত দু’টি চোখ। তিনি যা বলেছিলেন এখনও শুনতে পাচ্ছি।

-–”ছাপা হবে না, কিন্তু থাকবে। রেখে তো যাব। তুই বড় হয়ে পড়ে দেখিস। আর-আর” ওঁর স্বর শুকোতে দেওয়া কাপড়ের মতো তারে কাঁপছিল, “আর–আর, তোকে যদি মানুষের মতো মানুষ করতে পারি, যদি তোর কোনওদিন টাকা হয়, তবে তুই ছাপতে দিস।”

খুব ক্লান্ত, তাই বাবা থেমে বুক ভরে বাতাস নিলেন।—”একটা স্মৃতি। কী রকম জানিস? তুই কি বুঝবি? পড়ে থাকা এক টুকরো কাগজ, পেরেক কিংবা ছেঁড়া দড়ি, এক্ষুনি কোনও কাজে লাগছে না, তবু অনেকে কুড়িয়ে নেয়, তুলে রাখে যদি হঠাৎ কখনও কাজে লাগে! এই পালাগুলোও ধর, তেমনই। আজ হয়তো এতে কারও কোনও দরকার নেই, তাই কেউ চেয়েও দেখছে না, কিন্তু বলা তো যায় না, অনেক অনেক দিন পরে কারও হয়তো নজর পড়ল, আজ যা, খারিজ করেছে, হঠাৎ কখনও পৃথিবীর কাছে তাই দরকারি হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তোলা থাকবে, তবে তো?”

তখন দ্বিতীয় ঘণ্টাটা বাজছে, তাড়াতাড়ি খুব তাড়াতাড়ি, গাড়ি এসে পড়ল বলে, বাবার মূর্তি অসহায়, কিন্তু চোখ ধক্ধক্ জ্বলছে, ইঞ্জিনের গনগনে আগুনকে ওইভাবে জ্বলতে দেখেছি, খুব তাড়াতাড়ি, লোহার যে-প্রকাণ্ড ডাণ্ডিটা সামনের চাকাগুলোকে ঠেলে, সেইভাবে, অস্থির অথচ সহসা শক্তিমান বাবা ব্যাকুল কণ্ঠে বলছেন, “কথা দে, যে-দিন পারবি, সে-দিন তুই লেখাগুলো ছাপবি?”

‘কথা দে কথা দে’—ওঁর না-কাটা নখগুলো আমার হাতে ফুটছে, সেই যন্ত্রণায় নয়! এমনিই কেন জানি আমি চিৎকার করে উঠতে চাইছি, ধস ধস, ধস ধস, কয়লার ধুলোয় মিটমিটে আলোগুলো চোখ বুজে ফেলল, গাড়ি এসে পড়েছে। ঠেলাঠেলি, কামরায় কামরায় বন্ধ দরজায় ধাক্কা, একটা দরজা বুঝি খোলা পাওয়া গেল হুড়মুড় হুড়হুড়, সবাই ঢুকতে চাইছে, আমার হাত বাবার মুঠিতে, সবার শেষে উঠে তিনি দরজায় হাতল ধরে হাঁপাচ্ছেন, আমিও উঠতে যাব, তখনই শুনলাম বাবা বলছেন, “থাক।”

থাক, মানে উঠব না? ওঁর হাত আলগা হয়ে গেছে, জানলা দিয়ে আমার বাক্সটা ফের আমার হাতে তুলে দিলেন। স্তম্ভিত আমি কী শুনছি?—”তুই থাক।” গলা বাড়িয়ে বাবা যেন আমার কানে কানে বলছেন, “আমি একটা ভুল করতে যাচ্ছিলাম। আমি বাউণ্ডুলে, মুসাফির, ঘুরে ঘুরে বেড়াই, তোকেও তাই করতে চাইছিলাম। তুইও আমার মতো হলে—কী করে ওগুলো ছাপবি?”

যেন আমি চলে গেলে ওই বইগুলো ছাপবে কে, সেইজন্যেই বাবা আমাকে গচ্ছিত রেখে যেতে চাইছেন। আর কোনও কারণ নেই।

ইঞ্জিন জল নিচ্ছিল, গাড়ি ছাড়তে দেরি হচ্ছিল, কখন দেখি উনি টুপ করে নেমে এসেছেন নীচে। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “জীবনে কাউকে সুখী করতে পারিনি, তোর মাকেও না। তোকেও কেড়ে নিলে ওর থাকবে কী। দিতে না-ই পারি, কিন্তু নেব না। তুই থাক, তুই ফিরে যা।”

কী-রকম করুণ একটা হাসি ওঁর মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছিল, সিগন্যালের রক্তচক্ষু তখনই নরম হয়ে গেল, উনি আস্তে আবার পা-দানিতে উঠলেন। ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, “মার্কে বলিস—কী বলবি? তোর খামখেয়ালি বাবার আর একটা কাণ্ড, না? না-হয় তাই বলে দিস। কিন্তু এত রাতে তোর একা-একা ফিরতে ভয় করবে না?”

ভাঙা গলার একটা বাঁশি ওঁর কথাগুলোর উপরে জোয়ারের মতো আছড়ে পড়ল, সব ডুবে যাচ্ছে, এই লোকজন, ওই ওভারব্রিজ, ধোঁয়ার কুয়াশায় ঢেকে সব পলকে ঝাপসা। বিরাটকায় একটা অজগর ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলেছে, বাবা তখনও দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন কি না জানি না, চোখে কয়লার গুঁড়ো লাগছে, দেখব কী করে, ওঁকে দেখতে পাচ্ছি না। টিনের বাক্সটা হাঁটুতে লাগছে ঠকঠক করে, আমি গেটের দিকে এগোতে থাকলাম।

ভয়, দূর, ভয় কোথায়! কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম, জীবনে সেই বোধ হয় আমি নির্ভয়ে প্রথম একা এতটা রাস্তা পাড়ি দিলাম, এত দীর্ঘ পথ পার হলাম এত তাড়াতাড়ি। একটা গোটা দিন আমাকে একটা বলের মতো লোফালুফি করে ছেড়ে দিল। ভয় ছিল না।

মা, এখান থেকে লেখার কালিটা একটু আলাদা, কী করে হয়ে গেল বলো তো। মাঝখানে কয়েকটা দিন ফাঁক গেছে, সেই কলমটাও আজ পাচ্ছি না খুঁজে। যখন লিখতে বসি, তখন ভাবিনি, এত কথা লেখার আছে। কাজটা তুলে নিয়েছিলাম এই ভেবে যে, এটা একটা কৃত্য, একটা সমাপন। প্রত্যহ প্রত্যূষে হস্তপদ প্রক্ষালনের পর আসন পেতে আহ্নিকে বসার মতো, সজ্ঞানে একটি-দুটি পুষ্প নিবেদন করে যাব, এই তো স্থির করেছিলাম। কিছু অপরাধ স্বীকার করে নেব, শোনো-শোনো বলে ডেকে আত্মউন্মোচন–না, উন্মোচন নয় তো, শুধু নিজেকে মোচন—তাপে-সন্তাপে বয়সের এই হিমঋতুতে হাত-পা সেঁকে নেব, ভেবেছিলাম। কিন্তু তর্পণের সেই পরিকল্পনা খাটছে না, দিব্য দেখতে পাচ্ছি, পাতার পর পাতা ভরে যাচ্ছে, অথচ আমি লিখছি না, অথবা কেউ লিখিয়ে নিচ্ছে আমাকে দিয়ে, যেন লেখার ডেসকো নয়, এটা প্ল্যানচেট, অনুভব করছি, অদৃশ্য অমোঘ এক শক্তির ভর, তারই অঙ্গুলি-সংকেত, কী আশ্চর্য দ্যাখো, এত দিন ধরে এত যে কলাবিদ্যা শিখেছি, আয়ত্ত করেছি কত বাকচাতুরি, সে-সব কোনও কাজে আসছে না তো, মনে হচ্ছে, হায়, সব ভুলতে পারাই ভালো, সব ভুলতেই তো হল, কেউ শক্ত হাতে ধরেছে আমার কজি, দেখিয়ে দিচ্ছে অক্ষরের পর অক্ষর এঁকে যেতে হয় কী-করে, যেন প্রথম বর্ণ-পরিচয়, সেই গোড়াকার হাতে খড়ি।

এত কথা বলার আছে, কাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবার কাতরতা, কাদের ক্ষমা করতে না-পারার লজ্জা আর অক্ষমতা—সেদিন অনুধ্যায়ী কোনও সুহৃদ বলে দিল যে, শ্রদ্ধায় যাদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারো না, তাদের সঙ্গে ঘৃণাতেই বা যুক্ত থাকবে কেন—এইসব কথা, লেখাটার ধাঁচ-ধরন সব বদলে দিচ্ছে। তাছাড়া আছে ক্লান্তি, রোজ একটি-দু’টি করে উৎসর্গপত্র রচনা সম্ভব হচ্ছে না।

তা-ছাড়া আবার অসুখে পড়লাম কলম ক’দিন বন্ধ রইল। এ-ও দৈব, নইলে একে আর কী বলা যায় বলো, আমি যে আমি, নিজেকে যে লোহার শরীর ভাবত, নিজের সেই শরীরটাকে নিজেই যে বরাবর করে গেছে ধর্ষণ, প্রবল সেই অনিয়মের ফণাও আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ছে। অন্যের অসুস্থতাও যার কাছে অসহ্য, বরাবর রুগ্ন ব্যক্তিদের সঙ্গ যাকে দিত পীড়া, সে নিজেই শয্যালীন হয়ে আজ সাহচর্য প্রার্থনা করছে, ছিটে-ফোঁটা করুণ, অনুকম্পা ইত্যাদির মুষ্টিভিক্ষা চাইছে। সময়ের শোধ—একটি চক্রবৃত্ত ঘুরে এসে ঠিক একটি নির্ধারিত বিন্দুতে আঘাত করছে।

মধ্যবয়সের মধ্যরাত্রি কী ভীষণ, এখন মর্মে-মর্মে টের পাচ্ছি, মা! শাস্তি? প্রায়শ্চিত্ত? জানি না! এই মধ্যরাত্রিগুলি হঠাৎ-হঠাৎ এক-একদিন জেগে উঠে কোলাহল করে ঠেলে ঠেলে জাগিয়ে দেয় ঘুমন্তকে, তারপর শুধু পুড়েই-চলা চোখের পাতা, স্মৃতি, মরা পাতা, আর ইতিহাস, কুঁজো উপুড় করে ঢক ঢক জলের গ্লাস, অবশেষে গ্লাস ঠনঠন, ঘনঘন ক্রমান্বয় সিগারেট। হরিধ্বনি দিতে দিতে যে শববাহীরা পালকি-কাহারের মতো ছুটে যায়, তারা এত কর্কশ ত্রাহি ত্রাহি চেঁচায় কেন? আসলে ওরা ভয় পায়, মৃত্যুভয়, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ভয়টা তাড়াতে চায়। আজ আমি জানি, পথ-চলতি ট্যাক্সি অযথা ক্রমাগত ভেঁপু বাজায় কেন, কেনই-বা রাত্রির চৌকিদার শান-বাঁধানো ফুটপাতে জোরে জোরে লাঠি ঠুকে জানান দেয়। ভিতু, হিংসুক—ও একা জেগে আছে কিনা তাই সকলকে তুলে দিয়ে তুমুল হতে চায়।

তখন গোরুর গাড়ির টুংটুং ঘণ্টা, আড়তদার আর পাইকারেরা ছইয়ের সঙ্গে এক-একটা লণ্ঠন ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিয়ে ঝিমোতে ঝিমোতে যায়। কিন্তু ঘণ্টাটা কেন? একটু আওয়াজ, তালে তালে ঘুমতাড়ানি, নতুবা ওরা স্তব্ধতার কালীদহে ডুবে যেত।

এইসব আমি এখন জানি, জানতে থাকি। নিঃসাড় নিশীথে প্রতিটি সূচিপতন শুনি। আজ মুখহীন, কিন্তু কোনওদিন জানা নানা মানুষ ভিড় করে আসে। বিশ্ব-রহস্য একটা কবরের ঢাকনায় ঢাকা, একমাত্র মানুষকেই তিনি মাঝে মাঝে ঢাকনা খুলে একটু-একটু দেখান। অর্জুনকে যেমন দেখিয়েছিলেন। একা অর্জুনকেই তো নয়, বিশ্বরূপ কোনও না কোনও প্রহরে প্রত্যক্ষ হয় প্রত্যেকটি মানুষের কাছে, ব্যক্ত হয়। যেটুকু তখন ভরতে পারি, তারই খানিক আমরা কেউ-কেউ পরে কাত করে ঢালি—”শ্রীভগবান উবাচ”, ওই উদ্‌গীতির একটা ব্যাখ্যা আমার কাছে এই।

পাগল হয়ে যাব? পাগল হওয়াও তো সহজ না। যারা হয়, তাদের আজ ঈর্ষা করি। ওরা অস্তিত্বের অন্যতর একটা ছায়ায় জুড়োচ্ছে, স্থান-কালের খড়িআঁকা গণ্ডির বাইরে। জানো মা, ওই স্থানকালের আপেক্ষিকতার দিশা, আমিও বুঝি, সেই বয়স থেকেই অল্প অল্প পেতে শুরু করেছি, ধরো সেদিন সেই স্টেশনে দাঁড়িয়ে যখন হঠাৎ দেখলাম, একটি সময়, একটি স্থান একটি মানুষকে বদলে দিল। বাবাকে আলাদা হয়ে যেতে দেখলাম। কথা দিলাম, মানে মনে মনে, ওঁর পালাগুলো ছাপব।

মা, এইখানে একটি স্বীকারোক্তি করতে দাও, একটি স্খালন। নইলে এ লেখার কোনও অর্থ হবে না। বাবার ওই লেখাগুলো আমি ছাপিনি, যদিও সঙ্গতি ছিল। ওঁর পুরনো বাক্সটায় পুঁথিগুলো ছিল, তারপর ক্রমাগত জায়গাবদল, বাসাবদলের ঘণ্টায় কবে হারিয়ে গেল। আমি হারিয়ে যেতে দিলাম। কারণ বয়সের অহংকারে—সেই স্থানকাল!—আমি জেনে ফেলেছিলাম কিনা যে, ওগুলো কিছু না, সেকেলে, পুরনো, ব্যর্থ।

সেদিন অলক্ষ্যে নিশ্চয় কেউ হেসেছিল। আজ নিজেও প্রায় বরবাদ হতে বসে ওই অহমিকা কত ভয়ানক বুঝতে পারি। যেন এক অছি গচ্ছিত তহবিল তছরূপ করল। এক অভিভাবক যেন হত্যা করল তার কাছে পালনের জন্য সমর্পিতা কারও সন্তানকে। দত্তবাক্যকে হত্যার সেই পাপবোধ অশরীরীর কঙ্কালের মতো আমাকে অনুসরণ করে।—”এই! আমার লেখা!”

“কোথায় রেখেছিস, ফেলেছিস কোথায়?” কখনও-ব্যাকুল কখনও নির্মম প্রশ্নের পর প্রশ্ন কর্ণ-পটহে আঘাতে করে। মা, আমি যন্ত্রণায় কান চেপে ধরি, তবু এক অট্টহাস্য শুনি, প্রশ্নকর্তার সঙ্গে সময়ের স্বর মিশে গেছে। সময় বাবার পাশে একটানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাকে, তাঁর পুঁথির পাশে আমার সৃষ্টিকেও কুঁকড়ে উড়ে যেতে দেখে শিউরে উঠি। এক হাতে মাপা বিচার—সেদিন কি জানতাম আমিও একদিন হব পরিত্যক্ত, জীর্ণ, পুরনো? অমোঘ দৈব—সময় মানে হল মৃত্যু-মৃত্যুতে ভরে-ওঠা এক ভাগাড়।

.

সেই রাত্রে দরজায় ঘন ঘন ঘা দেওয়ার পরে অবাক তোমাকে কী বলেছিলাম? হাঁপাতে হাঁপাতে একটা কথা কি শুধু—”ফিরে এলাম।” তুমি কি বিশ্বাসে অবিশ্বাসে চোখ কচলে কচলে দেখছিলে, নিজেকে চিমটি কেটে পরখ করছিলে, সত্য কিনা? চাপা স্বরে একবার বলেছ বুঝি “উনি কোথায়”, উঁকিও দিয়েছ।

“বাবা আসেননি, আমি একা।”

আর তখনই সেই বিস্ফোরণ ঘটল। ঠায় দাঁড়ানো তুমি হঠাৎ এগিয়ে আমাকে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় মারলে। “একা এসেছিস, ফিরে এসেছিস, তুই একা-একা!” বলে উঠলে অপ্রাকৃত কণ্ঠে, তারপর, একী, তোমাকে দেখছি দু’হাতে মুখ চেপে পাগলের মতো ফুঁপিয়ে উঠতে।

চড়ের দাগ গালে বসে যাচ্ছিল, আমার লাগছিল। মিথ্যে কথা, লাগছিল না। তুমি কাঁদছিলে আমি কাঁদিনি। সহর্ষ, সর্বাঙ্গ দিয়ে বরং জানতে পেরেছি সেদিন আমি আমিই আমি দাদা বা অন্য কারও ডুপ্লিকেট না।

পরদিন সকালে এক ছুটে সেইখানে, যেখানে কলমটাকে ফেলে এসেছিলাম সেখান থেকে সুধীরমামার ওখানে। না, সেরে ওঠেননি, বিছানায় উঠে বসেছেন শুধু, তাঁর মুখে কথা নেই একরকম টানতে টানতে তাঁকে নিয়ে এলাম আমাদের বাড়ি।

উঠোনে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন সুধীরমামা, আমি মহোৎসাহে নিমপাতা পাড়ছি, সব ঠিক আগের মতো লাগছে, সব ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে, মাঝের এই ক’টা দিন যে কিছু না আর মিছে সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছি।

কিন্তু ঠিক আগের মতো হল না তো। মা, তুমি কথা বলতে পারছিলে না, সুধীরমামাও না। উনি ফিরে গেলেন, পরদিন আবার অবশ্য এলেন, গেলেন, এলেন। এলেন গেলেন। যাওয়া-আসাটা আগের মতো কথায় কথায় ভরে উঠছিল না।

সে-ও তবু ভালো ছিল। কথা না-বলা। কিন্তু একদিন, বোধ হয় মাসখানেক পরে, কেননা তখন দিনমান জুড়ে আকাশ মেঘে মেঘে ছেয়ে থাকত, সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ অকস্মাৎ হয়ে উঠত, তুমি কী বললে সুধীরমামাকে যে, ওঁর মুখটা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল, কেমন যেন অপ্রস্তুত, আহত, আচমকা কিছুর সঙ্গে যেন ঠোক্কর খেলেন? তুমি বললে, না ওঁর চোখে নিজে থেকেই কিছু ধরা পড়ে গেল?

দেখতে পাচ্ছি শুধু ওঁর মুখ নয়, স্বরও কখনও বিবর্ণ হয়ে যায়, তখন তো হয়ে গেল, উনি বলছেন, “কী বলছ তুমি আনু?”

“এবারও? আবার?” দুর্বোধ্য সংক্ষিপ্ত, সাংকেতিক কোনও ভাষা।

তুমি দাওয়ায় বসে, দু’হাঁটুর মাঝখানে তোমার মুখ একেবারে ডুবে গেছে, সেই মুখ আস্তে আস্তে তুললে। কেমন অস্থির সুধীরমামা, ছটফট করছেন, ওঁর জ্বর ফিরে এল নাকি, তীব্র, ওঁর পক্ষে অস্বাভাবিক স্বরে বলে উঠলেন, “এ আমি ভাবতেও পারি না, ছি-ছি-ছি!

এই বিনম্র তুমি, হঠাৎ জ্বলে উঠলে কেন, দেখতে পাচ্ছি তোমার দু’টি চোখ তখন আর চোখ না, তেল-ফুরনো কোনও প্রদীপ দপদপ জ্বলছে, সব জোর দিয়ে মরিয়া হয়ে, সব সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে তুমি সহসা একটা চিৎকার হয়ে গেলে—”তোমার–তোমার কী?”

“আমার?” মাথা নিচু সুধীরমামার, থর থর হাত-পা নাড়ছেন, যেন লজ্জা এক-টুকরো কাপড়, তুমি এইমাত্র তোমারটা ছুঁড়ে দিলে ওঁর গায়ে, সেই কাপড় জড়িয়ে গেল ওঁর মুখে, চোখ নাক থেকে সেটা সরাতে সরাতে বললেন, “আমার? না, আমার কী আর। কিছু না। কিন্তু ভেবে দেখো এটা তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা কিনা—’, সুধীরমামা এখানে দাদার নাম করলেন, রোগা মানুষটা এখন হাঁপাচ্ছেন, ওঁকে এত রেগে যেতে কখনও দেখি নি, সতত শান্ত চোখ দুটো যেন ছোট্ট হয়ে গেছে, রাগলে লোকে দেখতে হঠাৎ বিশ্রী, রাগ বড় বিশ্রী, মা, তুমিও এক্ষুনি রেগে উঠবে নাকি, পায়ে পড়ি, মা, তোমার চোখ দুটো দপ করে উঠেই মরা-মরা ছাই হয়ে উড়ছে কেন, দুটো বিড়াল কি সময় বুঝে ঠিক এখনই বাড়ির পিছনে ঝগড়া করছে—আঃ।

এই তো একটু আগে কেমন অপরাধী, লাজুক লাজুক দেখছিলাম তোমায়, সেই লজ্জাই কি বেপরোয়া ভঙ্গি হয়ে গেল নাকি, এত চট করে যায়?

“বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা উঠছে কী করে, বলেছি তো, একটা ভুল, একটা জবরদস্তি-

“শুধু জবরদস্তি?” সুধীরমামা কেমন-গলায় বলছেন, রোগা, রোগা, আর রাগী, ওঁর হাতের লাঠিটার মতোই শুকনো যেন একটা মরা ডাল, সুধীরমামা দেখতে এত খারাপ যেন সেদিনই প্রথম বুঝলাম।

—”তোমাকে একটু আলাদা ভেবেছিলাম আনু।” গলায় যখন রাগ-রাগ ভাব, চোখ দুটো তখনই দ্যাখ, কী করুণ, পৃথিবীর ঘেরা-টোপের মতো দুঃখী, মেঘ যেন ওখানে জমছে। ওঁর রাগটা কেড়ে নিয়ে তুমি বললে, “আমি যা আমি তা-ই।”

সুধীরমামা আর দাঁড়ালেন না।

কিছু বুঝলাম না। কিছু বুঝলাম না তাই দু’জনের কারও দিকেই যেতে পারছিলাম না, আমার হয়েছিল সেই মুশকিল। আমি কার দিকে?

কুয়োতলায় গিয়ে চোখে-মুখে জল ঢেলে এলে, এখন অনেক শান্ত, কিন্তু সেদিনই তোমাকে খুব শুকনো দেখলাম মা, চোখে কালি। কী রোগা হয়ে গেছ, গালের হাড় তোমার এত উঁচু কখনও ছিল না তো।

·

একটু টলছিলে। দাওয়ায় ঠেস দিয়ে রাখা ছিল একটা গোটানো মাদুর, সেটা দাওয়াতেই বিছিয়ে শুয়ে পড়লে, মুখ অল্প একটু ‘হাঁ’, এইটুকুতেই হাঁপাচ্ছ কেন, তোমার চোখের কোণে রক্তের একটু ছিটে নেই, আমি ছুটে এসে ধপ করে তোমার পাশে বসলাম। নেতিয়ে রয়েছ, তবু যে কৌতূহলটা কুরে কুরে খাচ্ছে, তাকে ধরে রাখতে পারছিলাম না।

“তুই আজ চাল ধুয়ে আনতে পারবি?” তুমি আস্তে আস্তে বললে।

‘পারব, মা।’

“আমিই ফুটিয়ে দেব। একটু ঘুমিয়ে নিয়ে উঠে, তারপর। আলু-ভাতে, কুমড়ো ভাতে, আর বেগুন-পোড়া। খেতে পারবি না? “

বললাম, “খু-উ-ব।”

“লক্ষ্মী ছেলে। না-হয় ডাল ভাতেও দিয়ে দেব।” তুমি হাত বাড়িয়ে আমার কপাল ছুঁলে, ঠান্ডা সেই নরম, বিশ্বস্ত হাত–ঝুঁকে পড়ে বললাম, “সুধীরমামা কী বলছিলেন মা? কী যেন বিশ্বাস-টিশ্বাস—”

“তুই শুনেছিস?”

“এইখানেই তো ছিলাম।”

একটু কি কেঁপে উঠলে, তুমি, না, তোমার ঠোঁট দুটি? কী যেন বলতে না? না, বলছ। চোখ বুজে আমাকে বলছ, “আমার অসুখ কিনা, তাই বলছিল।”

অসুখ ঠিক, কিন্তু কারও অসুখের সঙ্গে বিশ্বাস ভাঙার টাঙার সম্পর্ক কী, তাই ভাবছিলাম।

“আমার খুব অসুখ, জানিস, আরও বড় অসুখ হবে। সারাদিন গলা জ্বলে, অম্বল, গা গুলোয়, মাথা ঘোরে—”

“তুমি একটু ঘুমোও না। আমি এক্ষুণি চাল ধুয়ে আনছি।”

“দাঁড়া, বেছে দিই।” তুমি উঠে বসলে, তখনও শ্বাস টানছ, চোখ নামিয়ে থামানো কথাটার খেই টেনে বলছ, “বিশ্বাস! বিশ্বাস ভাঙা-টাঙার কথা ওঠে কী করে? ও ওইরকম বলে, তোর সুধীরমামা। বরাবর মুখচোরা, কিছু কোনও দিন বলল না, করল না, আজ এখন মুখ ফুটছে।”

কাকে শোনাচ্ছ তুমি, আমাক না নিজেকে?

“মানে হয় না, মানে হয় না”,

(মা, এ-সব কথার অর্থ কী)

“ওরা সবাই এমনি অবুঝ, হিংসুক—যেমন তোর বাবা, তেমনি ওই সুধীরমামা। তুমি বলছ কিনা, তাই আমার সাহস বাড়ছে, জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পাচ্ছি। “কিন্তু সুধীরমামা হঠাৎ যেন কেমন হয়ে গেলেন, চট করে চলে গেলেন, নিমের রসটসও কিছু খাননি!”

“একটু জল এনে দে।” আনলাম। খেয়ে ঠোঁট মুছলে। দেখলাম। তারপরই হঠাৎ—”জানিস! তোর দাদা ফিরে আসছে।”

কী—কী—কী, আমার কান, আমার না অন্য কারও, তোমার গলাই তো, না অন্য কারও—কী শুনছি, কী শুনছি আমি। অসম্ভব একটা ঘোষণা করছ, কিন্তু করছই যদি, মা, তোমার চোখ হাতের ডালায় নামানো কেন।

“আসছে।” তুমি বললে আর-একবার। এবার বিশ্বাসের সুর!

“আর যাবে না? “

“তাই যেন হয়, প্রার্থনা কর।” উপরের দিকে চেয়ে তুমিই যেন একটিবার প্রার্থনা করে নিলে, “যেন আর না যায়। যেন ভালোভাবে আসতে পারে।”

আর কিছু শোনার দরকার নেই তো, আমি একটা লাফ দিয়ে এক ছুটে ঘুরে, দাঁড়ালাম দাদার ফটোটা যেখানে। খুব মজা পেয়ে আসছিল সে, যেন ওই ফ্রেমটার মধ্যে আটকে থাকতে চাইছে না, পারলে এখুনি নেমে আসে। এলে আমি কী করব ঠিক করতে পারছি না, গলা জড়িয়ে ধরব যেমন ধরতাম, পায়ে ভর দিয়ে একটু উঁচু হয়ে ওর কানে মুখ রেখে এ-কথাও কি বলব যে, “তবে ওরা যে বলত তুই স্বর্গে আছিস, দেবতার সঙ্গে, তুইও নাকি দেবতা হয়ে গেছিস?”

“কে বলত, মা, আর সুধীরমামা?” দাদার ঠোঁট-নড়ায় যেন শুনতে পাচ্ছি “ওরা ভুল বলত।”

“বলুক গে।” রুদ্ধশ্বাসে, চাপা খুশিতে, ওকে ভরসা দিতে, বলেই ফেললাম কথাটা—”দাদা, তুই দেবতা ছিলি, আবার মানুষ হবি।”

আর, সারাদিন উন্মনা কেটে যাওয়ার পর সেদিন রাত্রে? তুমি একটু আগেই শুয়ে পড়েছ, আমি বিছানায় লাফ দিয়ে প্রথমেই কী করব কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, হঠাৎ মুখ গুঁজে দিলাম তোমার বুকে, কেন না, তোমার শরীর খারাপ, এখন আর কোন কথা না, দাদা-বাবা-মামা, কারও বিষয়ে কোনও আলোচনা না, তোমাকে জড়িয়ে শুধু, তোমাকে জড়িয়ে তবু, একটাই প্রশ্ন করতে পারলাম, অদ্ভুত সেই প্রশ্ন—”মা, দাদা এলে তোমার কোন্ দিকটাতে শোবে?”

.

বাবার চিঠি এল, হঠাৎ একদিন পোস্টকার্ড—এবার আমার নামে। আমার নাম-লেখা, আমাকে লেখা সেই প্রথম চিঠি। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এপিঠ-ওপিঠ, কতবার যে পড়লাম। তোমাকেও দিয়েছিলাম, তুমি চোখ বুলিয়ে একবার দেখলে শুধু, পাশে রেখে দিলে। তারিখের উপর ছিল ‘জব্বলপুর”–সে কতদূর, ম্যাপে মিলিয়ে নিলাম, আঙুল দেখিয়ে তোমাকে বুঝিয়ে দিলাম, “দ্যাখো, এইখানে।” চিঠিতে বিশেষ কিছু ছিল না, নতুন কোনও পালা-টালা লিখছেন কিনা সে-সব কথা একদম না, কেবল কেমন আছি, তোমার শরীর কেমন, ভালো হয়ে থেকো, মানুষ হতে হবে, এইসব। নর্মদা নদী, মারবেল রক নিয়ে একটা লাইন ছিল বোধহয়, কিংবা আমি ভূগোলের বইয়ে যা পড়েছিলাম তখন-তখন, তার সঙ্গেও মিলিয়ে ফেলতে পারি। স্মৃতি যেমন আলাদা-আলাদা বাটিতে অনেক কিছু রাখে, অনেক-কিছু আবার সিরাপ-বরফ-জলের মতো একই গেলাসে ঢেলে মেলায় কখনও-কখনও।

চিঠিতে কিন্তু ঠিকানা ছিল না, চিঠি দিতে হলে কোথায় দেব, তার কোনও উল্লেখ না। ওইটাতে একটু খচখচ করছিল, প্রথম চিঠি পেলাম অথচ তার উত্তর দেবার উপায় নেই, বাবা যেন কেমন! আমার একটু দূর-দূর-পর-পর লাগছিল ওঁকে, নিজের খবর পাঠিয়েই খুশি, আমরা কী-রকম আছি সে-সব যেন জানাবার দরকার নেই, ধরো যদি মরে যাই, দাদা যেমন গিয়েছিল, ওঁকে জানানো যাবে না, জানার জন্যে উনিও এমন-কিছু উতলা থাকছেন না,—নিশ্চিন্ত, নির্বিকার। মনে মনে সাব্যস্ত করলাম, তুমিই ঠিক, ওঁর সম্পর্কে যা বলতে তা এক্কেবারে খাঁটি—বাবা নিষ্ঠুর, ভীষণ নিষ্ঠুর, আর স্বার্থপর।

এরই মধ্যে বুড়ো ডাক্তার একদিন দেখে গেল, তোমার বুক-পেট টোকা-ঠোকা দিয়ে বলল, “এখনও অনেক দেরি আছে।” ওই বুকে মাথা পেতে, ওই পেটে কান পেতে, যখনই তুমি মেঝেয় শোওয়া, কষি-ঢিল-শিথিল, তখনই ওই পেটে কান পেতে আমি কী জানি কী শুনতে চাই। শুনি। দাদা আর ফোটোতে নেই তো ওইখানে আছে।

ও-পাড়ার বুড়ি দাই একদিন খবর নিয়ে গেল। কোমরে হাত রেখে, একটু বাঁকা হয়ে তেরছা চোখে তোমাকে দেখল। মিশি-মেশানো থুথু ফেলে বলল, “দূর-উ-র! এ-তো মোটে দু’-আড়াই মাস দেখছি। এতেই এত কাবু বাছা, তুমি বিয়োবে কী করে?”

আমি ওর পিছু নিলাম। পুকুর পাড়ে ধরে ফেলে বললাম, “কত দেরি?’ ভুরু কুঁচকে সে বলল, “কিসের?”

“মানে, মানে” ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছিলাম না, হাঁপাচ্ছিলাম।  

“তোর মা কবে বিয়োবে, তাই জানতে চাইছিস?” কী বিশ্রী কথার ধাঁচ বুড়িটার, শব্দটা ওর মুখের মিশি-মেশানো থুথুর মতো, সেই দিনই দু’দুবার শুনলাম। বুড়ি বলল, “না বাকি আছে অন্তত পাক্কা সাত মাস, কি সাড়ে ছয় মাস তো বটেই।’

“তুমি যেন হাত গুনতে জানো।”

“পেত্যয় হচ্ছে না? আমি জানি না? কত বউঝি এই হাতে পার করলাম, তোকেও খালাস করেছিল কে রে? আমি।” নিজের বুকে বুড়ি আঙুল দিয়ে দেখাল। “মাগীরা তো পেটে ধরেই খালাস, তোদের খালাস করি আমি।”

রাগে অন্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি, খারাপ সব গালাগালি শুনে, যা, মা, তোমাকেও স্পর্শ করছে। বললাম, জোরে মাথা নাড়িয়ে, “না অতো দেরি নেই, কক্ষনো নেই।”

“তর সইছে না বুঝি! দেখি, দেখি, ব্যাটার মুখখানা দেখি!” বুড়ি যেন ঠেকার দিয়ে বলল, “ব্যাটা, হেদিয়ে মরছিস কেন, যে শত্তুরটা আসছে, এলে যে সে তোরটাতে ভাগ বসাবে!”

ওকে মনে মনে তখন আমিও একটা খারাপ গালাগালি দিলাম। ও জানে না যে দাদা আসছে। মারব, মারব ওকে আমি। একটা ঢিল তুললাম।

হাত তুলে বুড়ি মাথা বাঁচাল, যেতে যেতে মুখ ঘুরিয়ে বলে গেল, “তোর মা কাঁচা-পোয়াতি, রোজ-রোজ পলতা-পাতা তুলে এনে খেতে দিবি, বুঝলি? থু-থু।”

.

পাক্কা সাত মাস কি সাড়ে ছয়, তার মানে পুজো-টুজো পেরিয়ে সেই শীতকাল? একটু ছমছম করে উঠল গা-টা, দাদা যে গিয়েছিল, সে-ও তো সেই শীতকালেই? শীতে গিয়েছিল, শীতেই আসছে। দাদা-ই যে ফিরছে, আমি তখন একেবারে নিঃসংশয়।

ডাক্তারখানা থেকে মাঝে মাঝে মিকশ্চার আনি, যে-দিন তুমি একটু বেশি কাবু হয়ে পড়ো, সেদিন। গাঙ্গুলিবাড়ির পিসিমা সেদিন এসে রান্না করে দিয়ে যান। আঁচলে ঢেকে নিয়ে আসেন আচার। তুমি খাও, আমি খাই, তুমিই বারে বারে, বেশি বেশি। সবাই আসছেন, কিন্তু সুধীরমামা কোথায়, তিনি আসা বন্ধ করেছেন কেন। বাবা গেলেন, তবু, কই, সব ঠিক আগের মতো হল না?

একটু ভালো থাকলেই কাঁথা নিয়ে বসতে তুমি, আমার জন্য নয়, সে-আমি-বুঝেছিলাম, আমাকে অতটুকুতে ধরবে কেন। কথা নেই, তবু তোমার পাশে বসতাম। ফিরে ফিরে সেই একই কথা, তাই বারে বারে, “দাদা আসছে মা?”

ঘাড় হেলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে তুমি।

“তার মানে আমরা আবার তিনজন? “

“তিনজন।” সায় দিয়েই বলেছ, “কিন্তু সে আসছে ছোট্টটি হয়ে”–কাঁথাটা দেখিয়ে—”এইটাতে সে শোবে।”

“ছোট্টটি হয়ে?”

“ছোট্টটি।”

আর চেপে ধরে রাখেতে পারছিলাম না নিজেকে, মনে যে আন্দাজটা এসেছিল, সেইটাই যাচাই করে নিতে চাইলাম তোমার মুখ থেকে।—”ছোট্টটি, মানে আমি হব-

“দাদা।” আমার গায়ে আলতো একটা টোকা দিয়ে বলেছ, রি এবার সে হবে ছোট্ট ভাইটি।”

একেবারে উলটে যাবে, বুঝেছি, তবু যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, যা ছিল তাই, তবু একটু অন্যরকম, কী মজা, মনের সুখে শোধ—আগের বারের শোধ তোলা যাবে। ভালোবাসব, ঠিকই, যখন দুষ্টুমি করছে কি পড়তে চাইছে না,তখন–তখন কি ওকে আমি বকব? কিংবা সুযোগ পেলেই ফস করে একটু কানমলা—কী?—ভ্যাঁ করে কাঁদবে? তো বয়েই গেল। কিন্তু যদি সে-ও ফিরে তেড়ে আসে, চোখ পকিয়ে, কি ছলছল করে, বলে “অ্যাই! আমি আর জন্মে তোর দাদা ছিলাম না! মা, ও মা, তোমাকে বলতাম, কী হলে কী হবে তুমি একটু বুঝিয়ে দাও না।

কিন্তু সুধীরমামা আসা বন্ধ করেছেন কেন। দাদা-ই যে আসছে তা হয়তো উনি বোঝেন নি, জানেন না। মনে হল ওঁকে জানানো দরকার, খুবই দরকার তাই, তাছাড়া রথেরও মেলা এসে পড়েছে; একা যাব কী করে, সে-জন্যেও, এক দিন—কতদিন, কতদিন পরে—দৌড়ে, পার হলাম সেই মাঠটা, দৌড়ে।

চেনা বাড়ি, চেনা ঘর, কিন্তু কী দেখলম সেদিন? তখনকার ভাষা দিয়ে তা ফোটানো কঠিন, যা বুঝেছিলাম তখনকার বোঝা দিয়ে তা বোঝানো–সে তো কঠিন আরও। কিন্তু একটা কিছু বুঝেছিলাম। সেদিন ফিরে এসে তোমাকে বলিনি, বলিনি বোধ হয় কোনদিনই

সুধীরমামা শুয়ে নেই, বসে আছেন একটা হেলানো চেয়ারে, একটু দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিলাম, আর বুক থেকে একটা ভার নেমে গিয়েছিল। কারণ সারা রাস্তা যদিও তাড়াতাড়ি পা চালিয়েই এসেছি তবু অনেকদিন পরে তো, একটু বাধো বাধোও লাগছিল। কী দেখব গিয়ে, ওঁর আবার অসুখ? শুয়ে আছেন, এক হাতে মাথা টিপে? ওঁর মাথার কাছে কেউ জল রেখে যায়নি? কিংবা, হে ভগবান, যদি ভালো থাকেন, কী বলবেন আমাকে দেখে, খুশিতে মুখ ভেসে যাবে? হাত বাড়িয়ে বলবেন, “আয় এত দিন আসিসনি যে” আমি তখন যা বলব তা-ও মনে মনে তৈরি, বলব যে “আপনিও তো যাননি তার পর? কাছে টেনে নিয়ে যদি ঘ্রাণ নিতে শুরু করেন, তা হলে কিন্তু কেমন করবে যেন, আমার ওতে সুড়সুড়ি লাগে, যদি পড়ার কথা জিজ্ঞাসা করেন—ভাবতে ভাবতেই আমি সেখানে।

হেলানো চেয়ারে সুধীরমামা, পায়ের সাড়া পেয়ে ঘাড় ফেরালেন, আলগা একবার হাসলেন শুধু, কিন্তু বললেন না তো “আয়?” আমি পাপোশে পা ঘষছি, না ডাকতেও একটু একটু এগোচ্ছি, কারণ নেই, তবু একটু অচেনা লাগছে, সুধীরমামা, সুধীরমামাই তো? ফিনফিনে একটা লুঙ্গি গায়ে, জালি-কাটা গেঞ্জি, আগে কখনও ওঁর এই বেশ দেখিনি। হাতে একটা আয়না, আর-একটা ছোট কাঁচি, দেখলাম সুধীরমামা এ কয় দিন একটু গোঁফও রেখেছেন, সেটাই কি ছাঁটছেন যত্ন করে? ওঁর পাতলা চুল, তবু টেড়ি, নিজের ঘরে সর্বদা বইয়ে যে মুখ ডুবিয়ে থাকত, সেই মানুষটি কোথায় গেল, একটু বাবুয়ানির গন্ধ পাচ্ছি। একবার ভাবলাম। তা নয়, আসলে সুধীরমামা তেমন হাসছেন না, বিশেষ কথা বলছেন না, সেই জন্যেই হয়তো ঠেকছে আলাদা-রকম, নতুন-নতুন, আমি আরও উদাস, এলোমেলো-চুল, আরও রোগা হয়ে যাওয়া সুধীরমামাকে দেখতে চেয়েছিলাম। পাশে অবশ্যই রাখা ছিল একটা বই, বাঁধানো, মোটা, কিন্তু আমি কাছাকাছি যেতেই তিনি চমকে উঠে সেটাকে চাপা দিলেন কেন, কী আছে ওই বইয়ে, জানবার জন্য আমি মরে যেতে থাকলাম।

আর-একটু অবাক হতে বাকি ছিল, ওদিকে ঘুরে গিয়ে যখন দেখি, সুধীরমামার বাঁ-দিকের চুলগুলো, কানের পাশে যা কাঁচা পাকা ছিল, এখন একদম কালো। আর, চুল বেশ ছাঁটা, ঘাড় কামানো। সব বিশ্রী, সব অন্য রকম। উনি নিশ্চয় চুল ছাঁটিয়েছেন, বাবুই পাখিরা উড়ে গেছে, আগে তো তুমি কতদিন হেসে বলেছ তাদের বাসা ছিল ওই মাথায়,

(‘ওরা খুঁটে খুঁটে কী খায়, সুধীরদা, তোমার ঘিলু? মাথা তো বিদ্যে বুদ্ধিতে ঠাসা একেবারে)

তাই কি আলাদা? পাকা চুলগুলো কালো হল কী করে, একটা শিশি দেখতে পাচ্ছি, তার পাশেই একটা তুলি, তুলিটার মুখ কালো রঙ মাখা। কাঁচা চুলের রহস্য ওরই মধ্যে আছে কিনা জানব বলে যেই ঝুঁকে পড়েছি, সুধীরমামা অমনই সেটাকে তাড়াতাড়ি তুলে নিলেন। তাড়াতাড়ি, আজ ওঁর সবতা’তেই তাড়াতাড়ি, খালি পিছন-ফেরা, খালি লুকানো নিজেকেও। পিছন ফিরে আমিও একটা চিরুনি আমার চুলে বসিয়ে জোরে জোরে টানছি, মাথা বেশি আঁচড়ালে উনি বকতেন, সেদিন যেন বুঝতেই পেরেছিলাম—বকবেন না, তাই জোরে জোরে চিরুনি চালাচ্ছি। লাগছিল। বকলেন না বলে ব্যথা পাচ্ছিলাম।

তাকে-রাখা বইগুলোর পাশে একটা কৌটো, পাউডারের, একটা লাল রঙের তেলের শিশি। না-চেনা গন্ধ, শুধু বিস্কুটের সেই টিনটাই, খুলে মুখে পুরলাম, কড়মড় শব্দ হল, উনি ফিরে তাকালেন, কিছু বললেন না। বলেছেন কি, ‘খাচ্ছিস, আর-একটা খা?” তা-ও না।

বলছেন না, কিছু বলছেন না, অথচ এমনিতেই বেশ স্বাভাবিক, কেমন আছি, কেমন ছিলাম, কে কেমন, কিছু না, যেন রোজই আসি আজও এসেছি, মাঝখানে কিছু নেই, কিছু হয়নি, বাইরে একটু শব্দ হলেই কিন্তু চমকে উঠছেন,একবার তো ভিতরের বারান্দায় বেরিয়ে উঁকি দিয়েও এলেন, কিছু বলছেন না, তার মানে উনি কি আর কারও অপেক্ষা করছেন, কে আসবে, আসতে পারে কে, ওঁর তো তেমন কেউ বন্ধু নেই, কিছু বলছেন না, খাটে ছড়ানো তাস, ওগুলো কার, সেই তুলি আর শিশিটা লুকিয়ে ফেলেছেন এখন কোথায়, ওটায় কী আছে আমি দেখব, বলছেন না একেবারে কিচ্ছু না, আমি আর একটা বিস্কুট খাব, আমি—আমি চলে যাব।

দাদাই যে আসছে, সুধীরমামাকে বলা হল না।

আমি তোমাকে বলিনি, বলতে চাইনি, কেন না বলার মতো কিছু তো ছিলও না। তবু, মা, ধরা পড়ে গেলাম, কী-করে তার কোনও বিশ্বাস্য ব্যাখ্যা আজও দিতে পারব না। মুখের কথা ছাড়াও আমাদের দু’জনের মধ্যে কি একটা সাংকেতিক কূট-গূঢ় কোনও ভাব-চালাচালির আলাদা ভাষা ছিল, চোখে-চোখেও হত বলাবলি? লুকোনো যেত না কিছুই লুকোনো থাকত না, যেমন আমার মুখ দেখেই তুমি বলে দিতে পারতে কী হয়েছে সেদিন ইস্কুলে, বকুনি খেলাম কি খাইনি, এমন-কী একদিন তো বাইরে মশলা-সুপুরি খেয়ে এসেও তোমার নজর এড়াতে পারি নি। অনেক দিন পর্যন্ত, আমার অনেক বয়স পর্যন্ত এই অলৌকিক শক্তি ছিল তোমার, যেন মন্ত্রবল, আজ আমি যেমন যে-কোনও শক্ত বই অন্তত পড়ে ফেলতে পারি, তখন ছেলের মুখ দেখামাত্র পড়ে ফেলা অসাধ্য ছিল না তোমার। মনে মনে গর্ব অনুভব করতাম, গর্বের সঙ্গে ভয়ও ছিল যেন একটু—আমার মা জাদু জানে; এমন কী কবে কোন্ মাঠ থেকে ঘুরে এসেছি, ঠিক ঠিক বলে দিতে পার পায়ের ধুলো থেকে। পাঠোদ্ধার করার সেই ক্ষমতা তোমার কবে লুপ্ত হয়ে গেল, তোমার বেশি বয়স কেড়ে নিল তা কি, নাকি সেটা কেড়ে নিয়েছিল আমারই বয়স, বড় হয়ে নিজেই চালাকি করে আস্তে আস্তে নতুন, তোমার অজানা, এক লিপিতে লিখে নিলাম আমার চোখের চাউনি আর মুখের রেখাগুলিকে, যখন উপরের ঠোঁটে অল্প-অল্প গোঁফ, থুতনিতে, দু’এক গাছি সদ্য-দাড়ি, চোখ বসা, চোয়াল শক্ত আর উঁচু, আর গাল-ভর্তি দগদগে ব্রণ। প্রথম দিকে নতুন পাঠ তৈরি হবার সূত্রপাতে, নিজেই কিন্তু ভয় পেয়েছিলাম, যেদিন গলার স্বর হঠাৎ কেমন ভাঙা কিন্তু ভরা-ভরা অন্যরকম হয়ে গেল। ওটাও যেন একটা অপরাধ, আমারই অপরাধ, ভেবেছিলাম, আদা-নুন গরম জল দিয়ে গলাখাঁকারি দিলে বুঝি সারবে। দুর, কিছু হল না, তুমি বললে, ওতে কিছু ভয় নেই, বড় হলে সকলেরই হয়। বড় হওয়ার প্রথম দাম বুঝি কণ্ঠস্বর, যা নিয়ে জন্মেছি তার অনেক কিছুই যেমন একে একে খোয়া যায়, ক্রমশ থাকে না, যেমন গোড়াকার দাঁত, তেমনই স্বর, আকৃতির সঙ্গে প্রকৃতি, প্রকৃতির সঙ্গে নানা বিশ্বাস ভরসা, ভালোবাসা ইত্যাদি।

যাক এসব কথা আসবে অনেক জোয়ার অনেক ভাঁটা খেলে যাওয়ার পরে, সেদিন কিন্তু তুমি ধরে ফেলেছিলে।

“কী বলল রে?”

“কে?”

“তোর সুধীরমামা।”

“কিছু না।”

“কথাই বলল না?”

একেবারে কিছু না বললে তো কথা ছিল না, কিন্তু সুধীরমামা কথা বলেছিলও যে, ওই তো গোলমাল, কিন্তু কথার মতো কথা কিছু না, যেমন এত দিন আসিনি কেন, উনিই-বা কেন আসেননি, আগের মতো করে একটা কথাও যদি বলতেন, আগের মতো একটা কিছুও যদি দেখতে পেতাম, তবে সেদিন আমার ভিতরে ভিতরে বিনা ভাষায় যে-সব জিনিস উথলে উঠছিল, তার কিছুই দেখা যেত না। নিজেই যা বুঝিনি, তা কী করে বোঝাব।

তুমি কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব বের করে নিচ্ছিলে।

“কিছু খেয়ে এসেছিস ওখানে?”

বললাম, “বিস্কুট!” মুখের কোণে গুঁড়ো লেগেও ছিল।

“নিজে থেকেই দিল? “

উত্তর দিলাম না। তুমি এখন ছুঁচ সুতো কাঁথার কাপড় সরিয়ে রাখলে।—— করছিল?”

“কী আবার করবেন। বই পড়ছিলেন।”

সুধীরমামার ব্যাপারে চেনা ওই একটা ব্যাপার শুনে তুমি যেন একটু হাঁপ ছেড়ে সহজ হয়ে বসলে।—”ওই তো স্বভাব ওর। বইয়ের পোকা। তোকে কিছু পড়ে শোনাল? মানে বুঝিয়ে দিল?”

“না তো।”

একটু অবাক, বাজারের হিসেব না মিললে তুমি যেমন উশখুশ কর, তুমি নড়াচড়া করলে। ছুঁচটা ফের তুলে নিয়ে বললে, “বোধ হয় খুব শক্ত বই, তোকে শোনাবার মতো না।”

মা, তোমাকে সেদিন বলিনি বইটার ব্যাপারে পুরো ব্যাপারটা। সুধীরমামা একটুখানির জন্যে বাইরে গিয়েছিলেন তো, ঠিক তক্ষুণি যে ঝুঁকে পড়ে পাতা উলটে ফেলেছিলাম বইটার। শক্ত কিনা জানি না, কিন্তু ওই ছবি, ছবির পর ছবি! মা, তখন আমি চান করার সময়েও যে গামছা পরে নিই, তুমি হঠাৎ সেখানে কিছু ধুতে এসে পড়েছ কি অমনই চলে গেছি কুয়োর আড়ালে, হাত নেড়ে নেড়ে অস্থির বলছি “চলে যাও সরে যাও তুমি”, কিংবা পুকুরঘাটে তোমাকে দেখে, মা, তোমাকে দেখেও, তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি, ভিতরে ভিতরে তখনই কী-একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে এই সব ঘটছে, ওই ছবি, ছবির পর ছবি, অবাক কী যে, আমার চোখের পাতা পুড়িয়ে জিভসুদ্ধ শুকনো করে দেবে! তোমার পেটের চেনা আড়াআড়ি দাগগুলো পর্যন্ত তখন চোখ মেলে দেখতে পারি না, আর না-চেনা ওই সব লাজলজ্জাহীন চেহারা আর ভঙ্গি, সহজাত যে ভাষাহীন, ব্যাখ্যাহীন, বোধশক্তি অবোলা প্রাণীরও থাকে, আমিও সেই বয়সে তো প্রাণীই, তবু টের পেয়েছি ওই ভঙ্গিটা বিশ্রী, ওদের চাউনি অন্তত তোমার মতো নয় কখনও, কানে হাত দিয়ে দেখি গরম গরম, কী ঘন থুথু, ছিঃ। আমার জ্বর হল নাকি! ভাগ্যিস সেকেন্ড কয়েকই মোটে, সুধীরমামা ফিরে এসেছিলেন, তার আগেই আমি মুড়ে ফেলেছি বইটা; অবিকল যেমন ছিল তেমনই, অবিকল ছিলাম না একমাত্র আমি।

সুধীরমামা তবে একা-একা এই বই পড়েন, পড়েন তো না দেখেন, দেখেন মানে আগে দেখতেন না, দেখছেন; এই বইটা আগে কখনও দেখিনি।

সেদিন তুমি যদি অত কথার পর কথার ফোঁড় না দিয়ে শুধু হাত বাড়িয়ে একবারটি আমার কপালে ছুঁতে, দেখতে তখনও ছ্যাঁক ছ্যাঁক, ঘোলাটে, জ্বর-জ্বর ভাব, তা-ছাড়া ওই চুলের রঙ ফেরানোর শিশি, তুলিটার মুখে কালি, কালি সুধীরমামার সারা মুখে, তাকে ছড়ানো পাউডার, গন্ধ তেল, মা, আমার গা কেমন কেমন করছিল, বমি, বমি করব নাকি আমি, ঠেকিয়ে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল।

তোমাকে বলতে পারিনি। কারণ, ওই যে বলেছি, টনটনে অবোধ একটা বোধ, বলে দিচ্ছিল, তোমাকে কেন জানি না, ও-সব বলা যায় না, উচিত হবে না, তুমি কষ্ট পাবে কষ্টটাকে আমি একাই বরং মেখে থাকি। কোনও ছেলে কোনও বয়সে আমাদের কালে মাকে ও-সব কথা বলতে পারে না তো, এমনকী বলা যায় না বড় হয়েও, অথচ পটপট করে তোমাকে যে খোলাখুলি লিখে দেওয়া গেল, সেই জিনিসটার কথা, যেটা শক্ত, শুকনো, শিরশিরে, যার নাম পরে জেনেছি যৌনবোধ, সজ্ঞানে আমার প্রথম যৌনবোধ, তার কারণ, লিখে দেওয়া সহজ, পাকা হয়ে আমরা কম বয়সের বন্ধুরা, অনেক খারাপ কথা যেমন প্রকাশ্যেই বলাবলি করেছি সাঁটে, কিংবা মজা করে বানান করে করে, অথবা অশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দে বা ইংরেজিতে। এই লেখা তুমি পড়লেও শরীর দিয়ে পড়ছ না, আজ আমার সেটাও একটা সুবিধে।

(স্তব, স্তব করা তোমার বন্ধ থাকেনি, বোনা আসনটি পেতে বসা ছিল নিত্য। আমি মানে বুঝতাম না, শরীর যখন খারাপ, তখনও কেন রোজ ভোরবেলাতেই স্নান করে ঠান্ডা লাগানো, তা ছাড়া দাদা যাবার পরেই তো এর আরম্ভ! সেই দাদাই যখন ফিরে আসছে, তখন আর এ-সব কেন। অথবা, আমার পরের বয়সের একটা কঠিন সন্দেহের কথা বলি, তুমি জানতে দাদা সত্যি-সত্যিই তো কিছু আসছে না, খালি আমাকে ছেলে-ভুলিয়েছিলে, তাই দাদার কল্যাণে মন্ত্রপাঠ কাঁথা বোনার পাশাপাশি চলেছিল। এ-সব, বলেছি তো, পরবর্তী সময়ের হিসাবী গদ্য, তখন অবশ্য সবই ভাবেবিশ্বাসে ঢলঢল পদ্য।)

আমি বললম না, কিন্তু কানাঘুষোতে চাপাই কি কিছু রইল! আমি না হয় নির্বোধ সহানুভূতিতে ঠিক করেছিলাম, কষ্টটা কোনও ভাগ না দিয়ে একাই সহ্য করব, একা কষ্ট পাওয়া, কিংবা কষ্টে একা হয়ে যাওয়ার অভ্যাসটা তখন থেকেই শিকড় গাঁথছিল, অনেক বেদনা আছে যা কাউকে বলা যায় না, বললেও লাভ হয় না কোনও। তাই বিচার করে দেখেছি, আমার চরিত্রের একটা দিক মেলে দেওয়া, বহির্মুখী, উচ্ছল, চপল, আর একটা দিক গুটিয়ে-নেওয়া, অন্তর্মুখী, যেমন আয়না—একটা দিকে ঝক-ঝকে কাচ কিন্তু পিছন দিকটা পারা দিয়ে লেপা, অব্যক্ত। হয়তো অনেকেরই।

আমি সুধীরমামার ওখানে যেতাম, যেতে থাকলাম, কী-একটা অন্ধ টান থেকে থেকেই আমাকে ওখানে ছুটিয়ে নিয়ে যেত। না, ওই ঘরের ভেতর নয়, বাইরে রাস্তায়, কাছাকাছি কোথাও। দাঁড়াতাম, দেখতাম, যেটুকু-বা দেখা যায়, একটি মানুষ কী করে আলাদা হয়ে গেল, আমাকে, আমাদের বাড়িটা ছেড়ে, আর কী পেল, অথবা সে কি আলাদাই ছিল, এখন যে-রকম? যে-মানুষটা লুঙি পরে, ওইসব ছবির বই রাখে, ছাঁটা চুল, চুলে টেড়ি, রঙ ফেরানো, ও কি চৈত্র মাসের সঙ, ও কি বহুরূপী? গুনগুন করে সে সুর ভাঁজে, কীর্তন তো নয়, অন্য গান, এ-সব গান, কি ওঁর আগে থেকেই জানা ছিল?

ঘরেও যেতে পারতাম, যাইনি। সেদিন উনি তো আমায় বকেননি, কিন্তু সেই না বকাটাই, ভাবলেশহীন নির্বিকার যেন কিছু হয়নি সেই মুখ, একদম কিছু রেখাপাত হয়নি. এমনই একটা সাদা কাগজ, বাধা হয়ে দাঁড়াল। ভালোবাসেন না, আমাকে আর ভালোবাসেন না, বাসেন না যে তার কোনও স্পষ্ট প্রমাণ নেই, কিন্তু প্রমাণ না থাকাটাও যেন ওঁরই অন্যায়, আমার ভিতরটাকে দোলাতে থাকত। যেন আমাদের খেলার টিম থেকে একজন অন্য টিমে চলে গেছে। বিশ্বাস ভাঙা-টাঙা না কী যেন সেইদিন বলেছিলেন সুধীরমামা? ওঁর এই বদলে যাওয়াটাও তো একরকম বিশ্বাস ভাঙা, এই তো ক’দিন আগে, বাবা যখন এখানে, না বলে ক’য়ে, মা, তুমি আর বাবা এক দলে হয়ে গেলে, আমি আর সুধীরমামা আর এক দলে, যেন মুখোমুখি দুটো টিম, কিন্তু এখন কী হল, আমার দলে কেউ রইল না, কী করব, আমি একা, নাকি মনে মনে চলে যাচ্ছি বাবার দলে, তুমিও আছ অবশ্য, কিন্তু তুমি তো মেয়ে! যে বন্ধু হতে পারে, সঙ্গী হতে পারে, ছেলেদের যে সেই রকম অন্তত একজন ছেলেও চাই।

ওই যে মানুষটাকে দেখছি, যে সুধীরমামা, কিন্তু সুধীরমামা তো না! এতদিন অন্যরূপে ছিল, কোথায় চাপা ছিল এই রূপ, ওঁকে আর তেমন স্থির স্থিত দুঃখী মনে হয় না তো, বেশ তো ফুর্তিবাজ, তেমন রোগাও আর ঠেকে না, আর অসহায় নয়, দিব্যি শক্ত মজবুত একটি মানুষ। প্রমাণ নেই, তবু ওই ধারণাটা গড়ে তুলছিলাম, আমি তখনই যেন পোটোপাড়ার সেই বুড়ো কুমোর, যে কাদা দিয়ে মূর্তি গড়ে, মনোমত না হলে ভাঙে, আমিও তেমনই একটি মূর্তি ভেঙে একেবারে কাদার তাল করে, আর-একটা-তৈরি করে নিচ্ছিলাম, তার মূর্তি, যে আসলে আলাদা, কিন্তু সেটা লুকিয়ে রেখেছিল! সে আমাকে ঠকিয়েছিল, সেই বহুরূপীটা।

কিন্তু বলেছি তো, কিছুই লুকোনো থাকত না তোমার চোখে। তুমি কি গল্পের সেই জাদুকরি, যে হাতের ফটিকে নজর রেখে সব বলে দিতে পারে? ঠিক তৃতীয় একটা চোখ দিয়ে তুমি টের পেতে, কোথায় আমি ফাঁক পেলেই ছুটে যাই, গায়ে ঘাম, পায়ে ধুলো, এইমাত্র ছুটে ফিরে আসছি কোথা থেকে।

কিন্তু সেদিন মা, তুমি মিছিমিছি আমার চুলের মুঠি ধরলে, তোমার না শরীর খারাপ! হাই তুলছ আর গড়াচ্ছ, কুয়োতলায় ঘনঘন গিয়ে চোখে দিচ্ছ জলের ঝাপটা, হঠাৎ এত রেগে যাওয়া তোমার উচিত হয়নি। ভাবাই যায় না, আমার গায়ে হাত তুলছ তুমি। অবাক হয়ে চেয়েছিলাম, তাই সময়মতো মাথাটা সরাতে পারিনি। মুঠি করে ধরেছ, ঝাঁকানি দিচ্ছ বারে বারে, কুল পাড়তে আমরা যেমন ডালে নাড়া দিই, যন্ত্রণায় আমি বোবা, শরীরের যন্ত্রণা তো বটেই, একটা অসম্ভব ঘটনা বলে, মনেও। কোলে বসিয়ে ঝিনুকে দুধ খাওয়াতে যখন মারতে—মারোনি কি আর–কিংবা না-ঘুমোলে ছড়া থামিয়ে রেগে চড় মারতে—মেরেছ নিশ্চয়ই— সে-সব তো আমার মনে নেই, ও-সব ঘটে থাকে মানুষের চিরতরে জলের তলে তলিয়ে যাওয়া বয়সে, কিন্তু জ্ঞান হয়ে কোনওদিন তোমার হাতের আলতো চাপড়ি খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। স্টেশন থেকে হঠাৎ ফিরে যে-রাত্রে আসি, সেই রাত্রির চড়টা অবশ্য স্বতন্ত্র। সে তো মার নয়, নিজের অবিশ্বাস্য আহ্লাদে ফুলঝুরি হয়ে যাওয়া

(নিজেই যে পড়ে পড়ে মার খায় ভাগ্যের হাতে, সে তো নিয়ত মিশে আছে মাটিতে অথবা উঠে গেছে উপাসনায়, সে আবার অন্যকে মারবে কী!)

তাই সেদিন বেজেছিল। চেয়েছিলাম। সুধীরমামার মতো তুমিও আলাদা হয়ে গেলে নাকি, যে-মাকে জানি তুমি কি সেই মা নও! সবই কি বদলে যাচ্ছে, সক্কলে?

–“কেন যাস, কেন যাস ওখানে তুই, সে-কি তোকেও জাদু করেছে?” দাঁত দিয়ে ঠোঁট চাপা, ঠোঁটের কোণে ফেনা, যেন অনেকগুলো মারবেল তোমার মুখে, একটার পর একটা ঠিকরে আমার চোখে মুখে লাগছে।

“যাই না তো, দাঁড়িয়ে থাকি। রাস্তায়।

“যাস না? দাঁড়িয়ে থাকিস? তা হলেও সে তোকে তুক করেছে।” চুলের মুঠি ছেড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে।

“কে? সুধীরমামা?”

তুমি অপলক তাকিয়ে ছিলে। ক্লান্ত, একটু একটু নেতিয়ে পড়ছ।—”না। সেই—সেই খারাপ মেয়েটা। তুই তাকে নিশ্চয় দেখেছিস।”

বলে উঠলাম, “আমি কাউকে দেখিনি মা।”

কানাঘুষো তোমার কানেও এসেছিল। ক্লাসে এই সব নিয়ে বলাবলি হত, সব কথা তখন আমি বুঝতাম না। আমাদের মধ্যে মাথায়-বড় যে-মানিক, সে একদিন কেমন রসিয়ে রসিয়ে বলছিল, শুনছিল ওর প্রাণের বন্ধুরা, কেউ কেউ আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিলে। একজন আমাকে ঠেলা দিয়ে বলল, “কী রে, তোর সুধীরমামা তোদের বাড়ি আসছেন তো, রোজ? আসছেন না?” বলেছি “না”। সে বলল, “একদম বন্ধ? “ মাথা নাড়ালাম। তখন “হুঁ-হুঁ, আসবে কী করে, শামুকে পা কেটেছে যে!” শামুকটা কী বুঝিনি, বোকার মতো আমি ভেবেছিলাম, সুধীরমামার পায়ে, কই, শামুক-টামুকের কোনও দাগ তো দেখিনি!

কানে কানে ফিরে কথাটা তোমার কানেও এসেছিল।—”দেখিসনি, তুই তাকে দেখিসনি?”

“কই না তো”, বলে দিলাম এক নিশ্বাসে।

কিন্তু মা, তোমাকে আমি মিথ্যে কথা বলেছিলাম, তাকে আমি দেখেছি।

.

মুখে মিথ্যে, কিন্তু আমার চোখে তখন এক ঝোপ থেকে আর এক ঝোপে এক-একটা খরগোশ যেমন তরতর ছুটে যায়, যেমনই পর-পর এক-একটা ছবি; সুধীরমামা বের হচ্ছেন, আমি একটা গাছের আড়ালে চট করে চলে গেছি। খিল খোলার পর দু’পা বেরিয়ে এসেই হঠাৎ পিছিয়ে গেল কে, একে তো আমি আগে দেখিনি। যে-বুড়ি ওঁর জল তুলে দেয়, উনুন সাজায়, জল তুলে আনে, তাকে তো আমি চিনি, কালিদাসী। আবছা যাকে দেখা গেল সে অন্য, মার চেয়ে ময়লা, কিন্তু বয়সে মারই মতো, বরং একটু ছোট, সবাই এখন বদলাচ্ছে জানি, তবু এতটা ভোল পালটানো বুড়ি কালিদাসীর পক্ষে কি সম্ভব? বোধ হয় না।

“বাজে মেয়ে, খারাপ মেয়ে”, উঠোনেই বসে পড়ে মুখ ঢেকে তুমি বলছ, “লোকের কথায় আর কান পাতা যায় না।”

আমি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে কখন রাস্তায় গুটি গুটি এগিয়ে একটা খোলা জানালার সামনে। শিকে মুখ রেখে—এই তো সে। খিল খুলে যে বেরিয়ে এসেছিল সেই না? মস্ত কালো পেড়ে একটা শাড়ি, ভরা-ভরা গাল একটা মুখ, চোখ ফোলা ফোলা, কিন্তু চোখ কি কারও অত কালো হয়, তাই বলো কাজলা-টানা, কাজল তো পরে বাচ্চারা, আমার চেয়েও যারা বাচ্চা, তারা, বড় মেয়েরা আবার কাজল পরে নাকি, আমি তখনও অন্তত দেখিনি। কিন্তু ময়লা, মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, আমারই তো, গোলগাল মুখটা নীচের দিকে ক্রমশ সরু, কেমন ওই মুখটা, কেমন যেন? – ঠিক, ঠিক, মনে পড়েছে, তাসে-দেখা ইসকাবনের মতো। “শুনেছি তো দেখতে একটা কোলা ব্যাঙ, একটা বাচ্চা হাতি”, মা, কে বলছে কথাগুলো, তুমি? তুমি যদি, তবে কোথায় আমি, আমি এখন কোথায়, কার গলা শুনছি, কিন্তু, ওই, ওই যে, দ্যাখো এক্ষুনি আমায় ডাকছে। দাঁত দিয়ে কালো ফিতে টেপা, এক হাতে কেমন দু’আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুকের সামনে এনে পাকাচ্ছে বেণী, অন্য হাতটা হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছে। আমি যাচ্ছি। ডাকলেন কেন? তুই কে? কেন ওখানে দাঁড়িয়েছিস? সুধীরমামা বাড়ি নেই? উনি আমার মামা। তোর মামা? তার মানে তোর মা, ওর বোন, বোন না দিদি, কেমন বোন হয় রে? তা তো জানি না, উনি আমার মামা, সুধীরমামা, আপনাকে তো আগে দেখিনি। আমি? আমি এসেছি, এখানে থাকি, থাকছি। কিন্তু কালিদাসী? দূর করে দিয়েছি কবে, দু’জন তো মোটে মানুষ, এমন আর কাজ কী, আমি একাই পারি, ফুঃ, আমার কবজি, হাত কী মোটা দেখেছিস, তোর সুধীরমামাও মচকাতে পারে না, বরং ওর হাতই একদিন পুট করে মচকে গিয়েছিল, কিন্তু এত কথা কেন জিজ্ঞাসা করছিস, দেখতে তো মেনিমুখো, কিন্তু তুই ছোঁড়া তো খুব পাকা রে, পেটে পেটে ফন্দি, আমার পেট থেকে কথা টেনে বের করতে চাইছিস। যাঃ, এবার পালা, না দাঁড়া, ছুট্টে ওই দোকান থেকে আমার জন্যে দোক্তা এনে দে, এই নে, দু’আনা, হাত পাত, আমি ছুঁড়ে দিচ্ছি, হাত পাত না! “সব সময়েই মুখে নাকি পানের খিলি, এ দিকে তো শুনি বিধবা।” মা একটু থামো, থামো না, দু’রকম গলায় আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে, দেখছ না, দোক্তা পাতা নিয়ে দৌড়ে এসে আমি এখন হাঁপাচ্ছি?—জানলাটা উঁচু, ওখান থেকে দিবি কী করে, এই ছোঁড়া ওরে কড়ে আঙুল, তার চেয়ে ভেতরে আয়, আয় না, খিল খুলে দিচ্ছি, ও মা, মোটে এই ক’টি, বোকা পেয়ে তোকে ঠকিয়েছে, তোকে যা ভেবেছিলুম তুই তো-তা না—একদম সেয়ানা না, দোকানদারটা ঠগ, ও আসুক, ওকে বলব। “ও—ওকে” বললেন কেন। কথা শোনো, কী বলব তবে। কেন, সুধীরদা! দাদাঃ? দা-টা ও আমার হল কবে, ও আমার দাদা-টাদা কিচ্ছু না। তবে কী। বললে কি তুই বুঝবি, ওর মামাতো এক ভাই, লতায়-পাতায় কেমন ভাই কে জানে রে বাবা ওর এক মামাতো না কী-তুতো ভাই হল গিয়ে আমার ভাসুর। “আপনার বিয়ে হয়েছে?” কপালটা সাদা দেখে বলছিস, এই বয়সে তুই তো দেখছি সব কিছু জেনে বসে আছিস, বিয়ে? তা হয়েছে, মানে হয়েছিল, আমি বিধবা।—”ছি, ছি, এই বয়সে, যাকে ভাবতাম, গোবরগণেশ যেন ঠাকুরটি, গণেশ তো নয় ইঁদুর, গণেশের বাহন ইঁদুর, তা-ও খড়ে তৈরি”–কে বলছে আমি বুঝছি না, শুনতে চাইছি না, দেখছ না উনি আমার গাল দুটো এইমাত্র টিপে দিলেন, নাকের ডগাও।—ইস্, টিপলে এখনও দুধ গলে, দোক্তা এনে দিলি, তোকে কী দিই বল্ তো, বাতাসা খাবি, বাতাসা? আর তার সঙ্গে নেয়ে উঠেছিস যে, ঠান্ডা জল, নাকি নেবু-মেশানো চিনির শরবত? কী ঠান্ডা, কী ঠান্ডা, তোমরা কেউ এখন কথা বোলো না, ঠান্ডা! কুলুকুল বয়ে যাচ্ছে, বুকের তলা দিয়ে। “কী বলে ডাকব আপনাকে?” মামি, মামি বলতে পারিস, না মামি না, কে আবার কী বলবে, বরং বলিস, মাসি, আর দোক্তা পাতা আমার যখন-তখন ফুরিয়ে যায়, এনে দিবি বুঝলি, আর রোজ আসিস।

.

তোমাকে এ-সব কিচ্ছু বলিনি, মা, সেদিন মুখ ফসকে মিথ্যে কথাটা বেরিয়ে গেল কেন যে! বলিনি, আবার বলেছি-ও। রাত্রে, শুতে গিয়ে, মনে মনে, হয়তো বা ঘুমের ঘোরে, স্বপ্নে। তাকে আমি দেখেছি, দেখেছি, দেখেছি। তার হাতের শরবত খেয়েছি। এর পর আরও দু’দিন ফুট-ফরমাস, একদিন সেই দোক্তা, আর-একটি চুলের ফিতে। সব তোমাকে ওইভাবে বলে ফেলে হালকা হয়ে গিয়েছি। তুমি শুনতে না-ই বা পেলে, না বলে দিলে আমি সেদিন ঘুমোতাম কী করে!

আর তুমি? প্রথমে চুলের মুঠি ধরেছ, ঠাসঠাস করে মারলে। কিন্তু আমি কাঁদিনি তো, তুমি নিজেই বরং কড়া করে জবানবন্দি নিতে নিতে, ঝাঁঝ আর ঝাল মিশিয়ে কত কী বলতে বলতে, হঠাৎ চোখ ভাসিয়ে ফেললে। হু-হু,হু-হু, থামেই না, এ-যেন নদীর পাড়ের হিমেল হাওয়া শুধু, কী আশ্চর্য, মা,আমার কান্নাটা আমার হয়ে তুমিই কাঁদলে?

আর মাঝে মাঝে এক-একটা ওই কথা, ছপছপ জলে পা ফেলার মতো! তুমি ভাবছিলে ওগুলো স্বগত, কেউ শুনছে না, কিন্তু শুনেছে। সেদিন বোঝেনি, পরে, একদিন সবখানি মানের ডালা তার কাছে খুলে গেছে।

“এইভাবে শোধ নিচ্ছে ও, এইভাবে”, মাথা নিচু, স্বর আরও নিচু, তুমি বলছিলে। “না হয় পাড়ার বাইরে, তবু এই সাহস, এই সাহস, শরীর খারাপের ছুতো করে কাকে আনল, আর তাকে রেখে দিল?’ তুমি ফুঁসছিলে, “রেখে” কথাটাকে অত বিশ্রীভাবে ঝোঁক দিয়ে বলারই বা কী মানে ছিল?

সেদিন পারিনি, এখন “কর-খল জল”-এর মতো সোজা বাক্যগুলো পড়ছি। সেদিন পড়তে পারতাম যদি, তবে তক্ষুনি তোমাকে বলে দিতাম, জানি না, উনি কী স‍ইতে পারেননি, কিন্তু শোধ, কোথায় শোধ? তুমি হারোনি, একেবারে হেরে গেছেন সুধীরমামা। দোক্তায় আসক্ত একজনকে যে আনতে হল—ষোলো-আনা জিত তাতে তো তোমারই!

কিন্তু তুমি ক্রমে ক্রমে আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছিলে। আজ মনে হয়, দিচ্ছিলে ইচ্ছা করে। এক-একটা সময় আসে যখন বেঁচে থাকাটাকে মনে হয় একটু বুদ, ফুঁ দিলেই ফটাস। তাতে কিছু যায় আসে না, কারও না, যে যায় তারও না, কারণ বুদটার মানে নেই, বরং ওই অর্থহীনটাকে টিকিয়ে রাখাটাই যন্ত্রণা। যেন অনেক কষ্ট করে কষা অঙ্কটার পাশে মাস্টারমশাই ঢ্যারা এঁকে দিলেন, বসিয়ে দিলেন একটা গোল্লা।

তোমার মুখেও ফিনফিনে সাদা একটা ছায়া পড়তে দেখেছি, শুকনো ঘায়ের উপরে নতুন চামড়ার আস্তর পড়লে দেখায় যেমন। লক্ষ্য করেছি, ভালো করে খাচ্ছ না, গাঙ্গুলি বাড়ির পিসিমা বলতেন, ‘তোমার এত অরুচি! ওষুধ আনিয়ে খাও।’ ওষুধ আনা হত, তুমি খেতে না, দু’চার গ্রাস মুখে যা তুলেছ সে শুধু আমার খাতিরে।

ও-বাড়ির পিসিমার মতো সত্যি-সত্যি আমি বিশ্বাস করিনি যে, তোমাকে কিছুতে ভর করেছে, ওঝা-টোঝা ডাকা একদম বাড়াবাড়ি, তা-ছাড়া ঝাড়া-ঝাড়ির গল্প-টল্প যা শুনেছি, এই শরীরে তোমার সহ্য হবে না। তবু জল-পড়া এনে দিলাম, পিসিমার কথামতো একদিন বড় বাড়ির মন্দিরের পেছন গিয়ে এক টুকরো নুড়ি বেঁধে দিয়ে এলাম। ওদিকটায় ঝোপঝাড় ফণিমনসা, সাপখোপ, শেয়াল, যাদের কটা চোখ জ্বলজ্বল করে, ধূর্ত-ধূসর নেউল, তা-ছাড়া এখানে ওখানে লুকোনো বিছুটি, খালি পায়ে গেলে চুলকোয়, জ্বালা করে, তবু তোমার জন্যে কোথায় না যেতে পারি, পাশের বাড়ির পিসিমা শিখিয়ে দিয়েছিল মানত করতে, কী-ভাবে তা করে আমি কি জানতাম, মাথায় হাত ঠেকিয়ে ঠাকুরকে বলা ‘মাকে সারিয়ে দাও’, এই তো! শুদ্ধমতো করা না হলে কি পাপ হবে, হয় হোক গে, হলে তো আমার হবে, কিন্তু মা যেন যা ছিল আবার তা-ই হয়ে যায়। মানত করে ফিরছি, সন্ধ্যা লেগেছে কি লাগেনি, ঘরে ঢুকতে যেতেই এ কী, খোলা চুল একেবারে ছড়ানো, চৌকাটের ঠিক ওপাশে তুমি চিৎ হয়ে পড়ে, কাপড়-চোপড় এলোমেলো, মা, তোমার বুকটাও যে ওঠানামা করছে না!

ভীষণ চিৎকার করে আমিও উপুড় হয়ে পড়েছি তোমার বুকের উপরে, ফুঁ দিচ্ছি, জলের গ্লাস করে তোমার চোখে ঝাপটা। এ-সব করতে কে বলে দিল জানিনে, হয়তো ফিটের ব্যামোয় সাড় ফেরাতে এইসব যে করে তা কোথাও দেখে থাকব, সেই জ্ঞান উপরে ছিল না, হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে তলা থেকে মাথা ঠেলে উঠে এল। ভর করেছে? সেইটেই তবে বোধহয় ঠিক, নইলে সর্সর্ সর্সর্ চার পাশে শুনছি কেন, ঝিঁঝিঁ পোকারা একসঙ্গে ডেকে উঠেছে, বাইরে নয়, আমার মাথার মধ্যে, নারকেল গাছটার ছায়া প্ৰকাণ্ড কচ্ছপের মতো মুখ নেড়ে এগিয়ে আসছে, তোমাকে ঢেকে দেবে, ওঠো, বলছি এক্ষুনি উঠে পড়ো! নইলে আমিও ঠিক তোমার পাশে ফিট হয়ে পড়ে যাব।

কত পরে, কত পরে দেখলাম যে, তুমি চোখ মেলছ। একটা হাত কাত হয়ে পড়ল আমার কপালে, চোখের ইশারায় তুমি আমাকে উঠে বসতে বলছ। চোখেরই ইশারা বুঝে গ্লাসে নতুন করে জল ভরে তোমাকে দিলাম, তোমার হাত কাঁপছে, কিন্তু ঢকঢক করে এক চুমুকে সবটা শেষ করে দিলে।

“ওখানে স্বর্ণসিন্দুর আছে, খলটাও আছে, মেরে এনে দিতে পারবি?” জেগে উঠে সেই তোমার প্রথম কণ্ঠস্বর। পারব না! তুমি ফিরে এলে, কোথায় না কোথায় তলিয়ে গিয়েছিলে, পুকুরঘাটে মাঝে মাঝে যেমন ডুব দাও, অনেকক্ষণ আর মাথা তোলো না, জলের নীচে আমি তোমার গোল হয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠা কাপড়ের আভাস দেখি, উঠছ না, এখনও উঠছ না কেন, ডুব দিয়ে তুমি কি তুলে আনতে চাও তলাকার মাটি, কিন্তু তলায় যে অনেক শ্যাওলা, ওর মধ্যে জড়িয়ে গেলে তুমি আর উঠবে না। হাতে তোমারই শুকনো একটা কাপড়, বদলে যেটা পরার কথা, সেই গচ্ছিত কাপড়টা হাতে নিয়ে আমি কাঁপতে থাকি।

সেই ডুব দিয়ে ভয় খাওয়ানোর মজার খেলাটাই অন্যভাবে আজ তুমি খেললে নাকি, খেলেছ বেশ করেছ, এখন তুমি ক্লান্ত, তোমার মুখে গাঁজলা, হাঁপরের মতো শ্বাস নিচ্ছ, কিন্তু ফিরে তো এসেছ! তুমি পেরেছ ফিরে আসতে, আর আমি সামান্য একটু স্বর্ণসিন্দুর খলে করে মেরে আনা, এটুকুও পারব না? ঘরের কাজে আমি আনাড়ি, ঠিক, কিন্তু এক-একটা বিপাক আমাকে কাজ শিখিয়ে দিচ্ছে, এক-একটা ঘটনা ধাক্কা দিয়ে দিয়ে আমাকে দিচ্ছে বড় করে। ইস্কুলে একবার এক ভেলকিওয়ালার হাতের ঢেউয়ের মতো ওঠানামায় যেমন একটা টবের চারাগাছকে তরতর করে বেড়ে উঠতে দেখেছি।

আমি বড় হচ্ছি। এবার রথের মেলার একদিনও যাইনি, না-গিয়ে থাকতে পারলাম, দেখলে না?

বড় হয়েও হঠাৎ-হঠাৎ বোকা-বোকা এক-একটা কথা বলে ফেলার স্বভাবটা কিন্তু আমার গেল না। ওই সেদিনই তো, তুমি খল থেকে স্বর্ণসিন্দুরটা চেটে চেটে খাবার পরে আমি ওরা যেন শুনতে না পায় এমনি গলায় বললাম, “মা, ওরা ভর করল কেন। দাদা আসছে বলে হিংসে? সইতে পারছে না?”

তুমি হেসেছ; মনে পড়ছে সে-হাসি পাণ্ডুর, মধুর, মৃত্যুরই মতো। খলটা নামিয়ে রেখে বলেছ, “আমি বোধহয় এবার আর বাঁচব না রে। সে আসবে না আমাকেই বুঝি নিয়ে যাবে।”

তোমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছি “চুপ, চুপ, বলছি। চুপ করো,” আর হাত সরিয়ে তুমি, “কিন্তু আমার মন যে কেবল তাই বলছে। নইলে কোনও বার তো এরকম হয় না! শরীর একেবারে ভাঙা, এই মূর্ছা যাওয়া, ভয়ভয় রোগ।

চুপ করলে না তুমি? “এক্ষুনি যদি না থামো, ওসব বাজে অলক্ষুণে কথা বলে চল, তবে আমি খাব না, শোব না, এই রাত্তিরে শ্যাওড়া গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়াব, তারপর, তারপর ভূত-পেত্নী সব নেমে আসুক, আসুক না, আমি কেয়ার করি না। তুমি তো তা-ই চাইছ?”

বসে বসেই, হাতে ভর দিয়ে, আরও কাছে এসেছ তুমি।—”সত্যি বলছি, সত্যি, ওই দ্যাখ টিকটিকিটা ডেকে উঠল। বল্, না, কী হবে যদি মরে যাই!”

তার মানে দাদার কাছেই যেতে চাও, আমি তোমার কেউ না, অভিমানে ফোলা ঠোঁটে, টসটসে চোখে এইসব কথা, শব্দ করে নয়, যেন লেখা হয়ে যাচ্ছিল। আমার পিঠে হাত রেখেছ তুমি, চাই না, চাই না ওই আদর, সরিয়ে নাও, সরে যাও-যাও এক্ষুণি।

হাত বুলিয়ে তবু বলছিলে, সে কি আমায় আরও কষ্ট দিতে, না নিজের কষ্ট ঢাকতে? বলছিলে, “মরে যাই-ই যদি ভগবান যদি টেনেই নেন, তবে তোর, আর কী।

(না আমার কিচ্ছু না),

তোর বাবা এসে তোকে নিয়ে যাবে, লেখাপড়া শিখবি, বড় হবি, তোর টুকটুকে একটা বউ হবে।

(বউ, বউ, তোমাকে বাদ দিয়ে; কিন্তু তোমারই মতো মিষ্টি আর একজনের ছবি তুমি তখন থেকেই তৈরি করে দিচ্ছিলে, দ্বিতীয় একটা অনুভূতি; তখনও কামনা না, শুধু সুন্দর একটি কল্পনা),

তখন, তখন আমাকে ভুলে যাবি তো?”

“গেলি তো গেলি”, তখন তুমি সামলে উঠে হালকা গলায় হাসতেও পারছ, ঠাট্টা দিয়ে শরীর-মনের ব্যথার উপরে চাদর টেনে দেওয়া—”গেলি তো গেলি, আমি তখন কোথায়, দেখতে তো আসব না! দেখি। মুখখানা দেখি। উঁহু একটু একটু মনে পড়বে, না রে? মাঝে মাঝে। কী মনে পড়বে, একটা মা ছিল, সেই তোর গল্পের বইয়ের দুয়োরানি, ঘুঁটেকুডুনি যে খালি সকলকে দুঃখই দিয়ে গেল, জ্বালাল, সব্বাইকে, তোকে তোর বাবাকে—সুধীরমামাকে জ্বালাল, নিজেও জ্বলে-পুড়ে শেষ হল।”

(মিথ্যে, মিথ্যে, আমার কিচ্ছু মনে পড়বে না)।

“মনে পড়বে রে, পড়বে। যে তোকে ভালো করে খেতে দিত না, কেমন? তোকে চুলের মুঠি ধরে মারত, কেমন? শীতের দিনেও জোর করে ধরে নাওয়াত, মাছের কাঁটা ঠিকমতো বেছে দিত না বলে গলায় কাঁটা ফুটত, আর কী-কী, সব এই বেলাবেলিই বলে দে, জেনে যাই, তখন তো আর জানব না! এই! চোখ মোছ বলছি, দেখিসনি, তোর বাবা কেমন করে চলে-ফেরে গটগট করে, তার ছেলে হয়ে তুই ছিচকাঁদুনি, ছি, তোকেই দেখছি বউ সাজিয়ে বিয়ে দিতে হবে, নাকে নোলক, মাথায় ঘোমটা, দেখি দেখি কেমন মানাবে।”

(খবরদার বলছি, তোমার আঁচল আমার মাথায় ফেলে দিয়ে ঘোমটা বানাতে এসো না)।

লাফ দিয়ে সরে গেছি, দরজার পিঠ দিয়ে আঙুল তুলে তোমাকে শাসাচ্ছি, কাঁদছি কোথায়, এই মিথ্যেবাদী, তোমার চোখের দুষ্টুমির খানিকটা আমার চোখে ভরে নিয়ে এই তো আমিও হেসে উঠছি, দেখছ না?

.

দোক্তা পাতাগুলো হাতে নিয়ে সে বলল, “এই শেষ, তোকে আর বোধ হয় আমার জন্যে দোকানে ছুটোছুটি করতে হবে না।”

“ছেড়ে দেবেন?”

খিলখিল হেসে সে বলল, “এই জায়গাটাই ছেড়ে যাব। এখানে আর টেকা যাচ্ছে না।”

তার মানে বলছে, ও চলে যাবে, তার মানে কি যা ছিল ফের ঠিক তেমনই হবে। আমার ভেতরটা লাফাচ্ছিল, তার কতটা সত্যি-সত্যি আহ্লাদে, কতটা একটু মুষড়ে পড়ে, তোমাকে বোঝাতে পারব না। এখন কিন্তু বেশ বুঝি, আমার একটা ভাগ খুশি হয়েছিল নিশ্চয়, যে মনে মনে চাইত কিনা যে ‘চলে যাক, ও চলে যাক’, তোমার সেই কাটাকাটা কথার ছিটে আমার সেই ভাগ্যটার গায়েও লেগেছিল, তাই “ও, চলে গেলেই সুধীরমামা আবার আমাদের হবে” এই আশাটার উপরে মন উড়ে উড়ে গিয়ে পড়ছিল, পায়রা পাখি বারে বারে এই চালে আর এই খোপে ঢুকে ডিমের উপর পাখা ছড়িয়ে যেমন বসে।

(এটাও সেই বয়সের আর-একটা বোকামি, প্রকৃতিতে যা দেখি জীবনেও তাই প্রার্থনা করা, কুয়াশা কাটলে যেমন গাছপালা আবার স্পষ্ট, ঢল নেমে গেলে মাঠ-ক্ষেত-দাওয়া যে কে-সেই, বৃষ্টি থামল তো আকাশ আবার রোদ্দুরে থৈ থৈ হল, তেমনিই, সব তেমনই। একটা কিছু ঘটে কিছু-কিছু অন্য রকম করে দেয়, সে সরে যাক, অমনিই দেখবে চেনা ব্যাপারগুলো তাদের পুরনো চেহারা ফিরে পাবে। পরে দেখে দেখে বুঝেছি, জীবনে তা হয় না, অনেক জিনিস আছে যা যায় তা চলেই যায়, জোড়া আর লাগে না, একবার যদি ভেঙে যায়। ধাক্কা খেয়ে যে স্রোত নেমে গেছে নীচের দিকে সে আর কখনো পিছনের পাড়ে ফিরে আসবে না। একটি ভাগ তবু চাইছিল ও চলে যাক, এত কিছু পাবার আছে মন তখন জানত না, পেতে পেতে আর হারাতে হারাতে জীবনে চলতে হয়; তাই যা ছিল তার সবটুকুকে সেদিন আঁকড়ে রাখতে চাইত, যা ভাঙছে তাকে জোড়া দেবে কী করে ভেবে ভেবে ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে পড়ত।)

আর-একটা ভাগ, মা তোমাকে বলিনি, আমারই মনের আর একটা ভাগ, অন্য একটা মজা পেয়েছিল যে, সে বলেছিল থাকুক না ও, কী আসে যায়, ওই যে দোক্তাপাতা আনা, চুলের ফিতে কেনা, নেবু-চিনির সরবৎ; বুকের সামনে ঝুলিয়া দেওয়া বিনুনি, এসব কিছুরই একটা আলাদা স্বাদ, বড় হলে এরই নাম দেওয়া যেত নেশা, অবচেতন একটা আসক্তি। অবচেতন, কারণ শরীরের আঁটসাট গড়নে তোমার সঙ্গে তার যে-তফাত, সেটা ওই বয়সে সজ্ঞানে সে ধরতে পারেনি। আহা, সেই ভাগ, যে চপল, যে লোভী, সে জানে না কেন যে, অন্য রকমের লাগে কেন। উচিত, অনুচিত? ভালো, মন্দ? এ-সব বাছ-বিচার টনটনে বয়সেই হয় না, আর তখন তো মন চোখ না-ফোটা পাখির বাচ্চা, অন্ধ।

(অন্ধ যে, সে অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে তমসায়, মানুষের গভীর দার্শনিক উপলব্ধিও এই কথা বলেছে, পরে পড়েছি। আলোকের সীমা ছেড়ে সে যে অন্ধকারে চলে গেল তা কি অনুভব করে)

পায়েসের পাত্রটি আছেই, থাক, তবু ঝোঁক যায় আচারের বয়মের দিকেও। তোমার সঙ্গে আমার এই দ্বিতীয় অংশের একটা আলো-আঁধারির লুকোচুরি চলছিল।

দ্যাখো মা, ধারাবিবরণীকে খানিকক্ষণ “তিষ্ঠ” বলে তোমাকে অকপটে সাফসাফ কয়েকটা কথা এখনই বলে ফেলি; তা-হলে পরে, যখন জীবনের জটিলতর অধ্যায়ে প্রবেশ করব, তখন কাজটা সহজ হবে। হ্যাঁ, যে লুকোচুরিটার কথা বলছিলাম, ওটা সকলেরই থাকে, গোচরে বা অগোচরে, প্রীতি-অপ্রীতি, অনুভূতির নানা স্তরে। সবচেয়ে বড় একটিমাত্র মনোহারী দোকান থেকেও তো সব জিনিস কেনা যায় না, সর্বোত্তম বা সর্বোত্তমাকে দিয়েও সব চাহিদা চিরতরে মেটে না। প্রত্যেক মানুষ, নর কিংবা নারী, এর খানিকটা, গ্রহণ করে, ওর খানিকটা, ভিতরে-বাইরের স্থূল-সূক্ষ্ম, বিবিধ প্রয়োজন পূরণের জন্য, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, অসংখ্য ব্যক্তির জন্য স্থান আছে। তা ছাড়া কেউ গতকালের, কেউ আজকের, কেউ আগামীকালের। প্রিয়তমাকে পাশে বসিয়েও পটপটিয়সীর অভিনয়-নৈপুণ্যের, এমন কী শারীর রেখাটেখারও তারিফ করতে কারও বাধে না; অতি বিশ্বস্ত কুলবতীও তুখোড় খেলোয়াড়ের চাতুর্যে, পটু নটের মাধুর্যে, অস্ফুট হর্ষধ্বনি করে ওঠেন, জননায়কের নিমেষ-দর্শনের আশায় কুতূহলী বাতায়নে দাঁড়ান। মনের মৌচাকে আলাদা সব খোপ আছে, নিজ্ঞানে যাই থাক, সজ্ঞানে কোনওটার সঙ্গে কোনওটার বিরোধ নেই, অদ্ভুত এক সন্ধি আর সমন্বয়, রক্তপাত নেই, অশ্রুও না, দিব্য এক শান্তি; কিন্তু খোপে খোপে যদি কখনও একাকার হওয়ার অঘটন ঘটে, প্রায়ই ঘটতে চায়, তখনই বিপত্তি, ভাঙে সেই চমৎকার সামঞ্জস্য, তখনই অশ্রু, রক্ত, এমন-কি প্রাণপাত। তার চেয়ে অগোচর মন যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে দেয়, তার কোনও লেখাপড়া থাকে না বটে, কিন্তু সেটাই নির্ঝঞ্ঝাট, কেন না তার অনেকটাই যা যে না-জেনে। মা, তুমিও তো না জেনেই এমনটাই কয়েকটা খোপ তৈরি করে নিয়েছিলে?—কোনওটা আমার, কোনওটা বাবার, কোনওটা সুধীরমামার। সুধীরমামার—তাঁর পূর্ব-পর্বের কথা বলছি—নীরক্ত—নিরাসক্ত নিষ্পত্র মা-ফলেষু ঋজুতাকে শ্রদ্ধা করেছ, তাই বলে বাবার প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বকে প্রতিহত করার বেড়াও তোমার শক্ত ছিল না, তদুপরি ভগবানেও ভক্তি ছিল খাঁটি আর অচলা, দ্যাখো, মন কেমন ভারসাম্যের বাঁধা তার, একের পর এক ভর সয়েও টানটান থাকে, কেউ হেলে যায়, কেউ টলে পড়ে, কিন্তু পড়বেই যে এমন কোন কথা নেই। মা, এতদিন পরে আমার সেদিনকার দ্বিমুখী টানের এই সাফাই; আমার, অর্থাৎ আমার একাংশের। অন্য ভাগের কথা আগেই বলেছি।

এইবার খেই ধরে যা বলেছিলাম, সেই বিবরণে ফিরে আসি।

সে বলছিল, “এখানে আর থাকা যাবে না, ছেড়ে যাব। রোজ ঢিল পড়ছে উঠোনে, টিনের ছাদে। সাঁঝের আঁধারে টিউ-কলের পাশের গাছটায় কারা চড়ে বসে।”

“ভূত?”

সে হাসল। “ভূত ঠিকই, তবে মানুষ-ভূত।” বলতে বলতে সে কৌটো খুলে টপ করে একটা লেবেস গালে ফেলল, একটা আমার মুখে গুঁজে দিল, একটু টক একটু মিষ্টি, একই সঙ্গে দু’রকম। তাছাড়া সে আঁচলটার খানিক খুলে উড়িয়ে উড়িয়ে নিজেকে বাতাস করছিল। আমাকে অবাক দেখে তাকাল যেন কেমন একটু করে, রেগে গেলে তুমি যেমন চোখ সরু আর ছুঁচলো করো, কতকটা তেমনই, তবে সে করছিল কৌতুকে। বলল, “থাকিই না একটুখানি এমনি, যা গরম! তোর সুধীরমামা তো দেখছে না।”

তা ঠিক। সুধীরমামা যখন নেই, তখনই ওখানে যাওয়াটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমার অভ্যাসে। দেখা না হতে হতে ক্রমে এসে গেল একটা আড়ষ্টতা, মনে হত মুখোমুখি হলেই সর্বনাশ, কী বলব, কোথা দিয়ে পালাব? সুধীরমামাও নিশ্চয় জানতেন আমি যাই-আসি। উনিও কি চাইতেন আমাকে এড়াতে?

সে বলছিল, “ওই গাছটায় ওরা চড়ে বসে, কলতলায় উঁকি মারে, ভেবে দ্যাখ তখন হয়তো আমার গায়ে কাপড় নেই। পরশু যাত্রা শুনতে গিয়েছিলাম, ও একটু এগিয়ে পড়েছিল, কারা আমার পিছু নিল। ধপ্ ধপ্, ধপ্ ধপ্ শব্দ, বাপ রে, ভাবলেও এখন বুক ধপধপ করে। শুনিয়ে শুনিয়ে কী শিস্ আর কত বাহারের গান! বাড়ির কাছাকাছি আসতে একেবারে যা-হয়-তা-হবে বলে তো একটা দৌড় দিলাম। খিল তুলে দিয়েছি, তবু কাঁপছি। ওরা জানালার বাইরে দিয়ে যেতে যেতে, হাড়-হাবাতের দল, জোরে জোরে বলে গেল, “তুমি ওকে গুণ করেছ, তোমার ভাগ আমরা চাই’–তুই এ-সব সাঁটমারা কথার মানে বুঝিস?“

আলগোছ খোঁপাটাকে হঠাৎ সে খুলে দিল, ঘামাচি নেই তবু যে কেন কণ্ঠার হাড়ের ঠিক নিচটা চুলকাচ্ছিল!—”তোর সুধীরমামাকে বললাম সব। ও কেমন মেনিমুখো জানিস তো, একদিন মজা করে কলপের শিশিটা লুকিয়ে রেখেছিলাম, কী দুর্দশা বেচারার! পরদিন চুলগুলো সব নতুন-ওঠা আমের পাতার মতো তামাটে, সে যা ছিরি হল, যদি একবার দেখতিস। ঘুরে মুরে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ‘দাও দাও’ বলে আমাকে সাধাসাধি আর-কী, ওই যাত্রায় রাধার কাছে কেষ্ট হাঁটু মুড়ে যেমন করছিল। যাক, এখন যে মেনিমুখো ও-ও কিন্তু সব শুনে বলল, “ভামতী, আমরা এখানে থাকব না।”

ভামতী, ওর নাম ভামতী। আমাকে ভামী-মাসি বলে ডাকতে বলত।

ছোট্ট হাই তুলে সে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া নাড়ছিল, ঘাটে বসে হাত দিয়ে ছোট ছোট ঢেউ তুলে জল নাড়ার মতো! বলছিল, “এখানে কাছারির কাজটা অবিশ্যি ভালোই ছিল, ছুটিই তো দেখি বেশি, তা ছাড়া আগে নাকি ডেকে ডেকে ছেলে পড়াত, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর পাগলামিটা ঘুচেছে ভালোই হয়েছে। যাক গে, ব্যাটা ছেলে, লেখাপড়াও শিখেছে, অন্য জায়গায় গিয়েও চালিয়ে নিতে পারবে, দুটো তো পেট মোটে! না পারে তো আমার কী, আগে যেখানে ছিলাম সেখানেই ফিরে যাব।”

“ফিরে যাবেন, সুধীরমামার কাছে থাকবেন না?”

“না রাখতে পারে যদি, কী করা। এখানে পাজী লোকেরা পিছু নিয়েছে, শিস্ দিচ্ছে, ঢিল ছুঁড়ছে, হ্যাঁরে, ও যে বলে ঢিল যারা ছোঁড়ে তাদের মধ্যে ইস্কুলেরও গোটা কয়েক ছেলেও আছে?”

“হবে।” আমি বললাম।

“একদিন হেডমাস্টারকে বলবে বলে বেরোল। কিন্তু ফিরে এল মুখ চুন করে। বল্ তো কেন? আগে খেয়াল করেনি, খানিকটা যেতে টের পেল, বলবে কী, তা হলে আমি যে কে, তা-ও তো বলতে হয়, তা-হলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে যে।” সে, যার নাম ভামতী, একটু আগে যে-আঁচল হয়েছিল তার হাতপাখা, সেটাই মুখে পুরে হাসি সামলে নিচ্ছিল।—”কেঁচো খুঁড়তে তা-হলে, সাপ বেরোবে, হি-হি”, হাসিটাকে কমা সেমিকোলনের মতো ব্যবহার করছিল সে, কিন্তু তার চোখ চকচকে হয়ে উঠেছিল। হাসি থামাতে গেলে চোখ এ-রকম চকচকে হয়ে যায়, বিশেষ করে পেট থেকে হাওয়া বেরিয়ে যায় কিনা তাই কষ্ট হয়, আমাদের সকলেরই হয়, চোখের তারা তখন যেন ঠিকরে আসে, যেন ভাসতে চায়, অল্প জলে চক্‌চকে পুঁটিমাছ যেমন, ভামতীর চোখের মণিও ভাসছিল।

“বুঝেছিস, তোর সুধীরমামা তাই ফিরে এসে মাথা নেড়ে নেড়ে বলল, ‘উপায় নেই, আমাদের চোরের মার খেতেই হবে, উপায় নেই। নইলে আমরা শেষ পর্যন্ত না-হয় চলেই যাব!”

‘চোরের মার’ কথাটা বলতে বলতে তার মুখটা হঠাৎ কেমন করুণ হয়ে গেল, গলাটাও ধরা-ধরা, যদিও তখনও সে হাসছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে তার চোখে-চোখে তাকিয়ে আমি ধরতে পারছিলাম না, চকচক করছে কেন; এর সবটাই কি ফাজলামো আর ফুর্তি, নাকি পেটে খিল ধরেছিল বলে কষ্ট, অথবা এই কষ্টটা ফুটছিল শরীরের আর-একটা অংশে, যেটা পেটের বেশ খানিকটা উপরে, যেখানটা দেখাতে আমরা আলতো ভাবে শুধু একটু আঙুল ছোঁয়াই? আর তাই ওর গলায় হঠাৎ অন্য সুর লেগে গেল।

এ-সব আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, মা, তাই আমারও কেমন কষ্ট হচ্ছিল। ওই হাসিখুশি ভামতী, চাল-চলন তোমার বিপরীত বলেই যার ছিল আলাদা অদ্ভুত একটা আকর্ষণ, পলকে যেন তাকে ‘তুমি’ হয়ে যেতে দেখলাম—তোমার মতন। তার মুখে তোমার ছায়া পড়ছিল, কোথা থেকে এসে তুমি তাকে ঢেকে দিচ্ছিলে, ফুটফুটে চাঁদের উপরে পাতলা একটা মেঘের আবরণ, ওরও তবে চোখ ছলছল করে, কী-আশ্চর্য, ভামতীরও?

সারাজীবন, পরে এরকম কম ধূপছায়া ব্যাপার দেখেছি মানুষের পর মানুষ, কাউকে সব সময় একটা ধারণার পাত্রে বসিয়ে রাখতে পারিনি। শ্রদ্ধার লোকটির আকস্মিক একটা অন্ধকার দিক দেখতে পেয়ে শিউরে উঠি, যাকে ঘৃণা করি, হঠাৎ কোনও কোনও ক্ষণে, তার কোমল মায়াবী অন্য একটা পিঠ দেখে চমকে উঠি; আরে, এতো ঘৃণ্য নয়! তার সেইটুকুকে তখন বুঝতে, ভালোবাসতে চেষ্টা করি, যতক্ষণ-না আবার ছকের দানের মতো উলটো পিঠ ঘুরে যায়। এইভাবে ক্রমাগত লেপা-পোছা সে আবার লেখা চলে, প্রথমবার পার্বত্য উপত্যকায় গিয়ে যথা সবিস্ময়ে দেখি এই রৌদ্র, এই ছায়া, এই বুঝি কুয়াশা কিংবা ঝিরঝিরে বৃষ্টি, প্রত্যেক মানুষও তেমনই বুঝি বহুরূপী; না না, বহুরূপী কেউ না, আমরা তাদের বহুরূপে দেখি। সম্পর্কের বড়জোর শুধু বাইরের দিকটা স্থায়ী; ভিতরের সম্পর্কে কোনও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেই। ভাঁটা, জোয়ার, আবার ভাঁটা।

এই দর্শনের সূচনা বয়সের সকালেই ঘটে, শুধু তখন এভাবে চিরে দেখার চোখ থাকে না, আমারও ঘটছিল, কত ফকির তাদের ছাদের ছাইরঙা জামার তলা থেকে হাতের মুঠো খুলে দেখিয়ে দিল ঝিকমিকে এক ফটিক, কত কুহকিনীর অন্তর্বাসের দুর্গন্ধ ভক্ করে নাকে লেগে মুখ ফেরাতে হল। বাইবেলের সেই গল্পটা তুমি জানো না, ছিল সৌল, হল পৌল, সেই গল্প। আসলে সৌল যে, সে হয়তো বা সৌল-ই থাকে, তাকে “পৌল” বলে একদিন দেখতে পায় অন্য লোক।

এইভাবেই, বাবা একদিন ইস্টিশানের ছায়া-ছায়া আলোয় কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিলেন; খানিকক্ষণের জন্যে। কত ঢঙ, কত রঙ্গ-জানা থপথপে ভামতীও কৃশ-করুণ হয়ে, তোমারই আদল নকল করে আমাকে ছপাৎ হঠাৎ করে দিল—সে-ও হয়তো খানিকক্ষণের জন্যে। মনটা যেন বরফ-ভরা কাঁচের গ্লাস, ঠান্ডা হাওয়ার একটু ছোঁয়া পেলেই তার গায়ে ফোঁটা ফোঁটা জল জমে ওঠে, সে-জল আবার শুকিয়েও যায়।

তবু ওই যে বাবাকে, যাঁর সঙ্গে তোমার আড়াআড়ি তাঁকে, সহসা আর্দ্র চোখে দেখা, ভামতীর কষ্টে ভিতরটা একটু কেঁপে যাওয়া, এর মধ্যে স্পষ্ট টের না পেলেও প্রচ্ছন্ন ছিল কি কোনও অন্যায়বোধ, তোমার প্রতি কি এক ধরনের বিশ্বাসভঙ্গ করে ফেলেছি? বলা মুশকিল। ইচ্ছা করে ভাঙি না। বিশ্বাস যত্রতত্র ছড়ানো থাকে খোলামকুচির মতো, সারাজন্ম না-জেনে অহরহ মাড়াই, পায়ের চাপে মুচমুচ করে ভাঙে, মানুষ তার কী করবে বলো, মানুষ নিরূপায়।

সুধীরমামার জন্যেও সেদিন কষ্ট হচ্ছিল বৈকি, ভামতীর মুখে শুনে। হেডমাস্টারকে বলতে গিয়ে মুখ লুকিয়ে ফিরে এসেছেন। যিনি ছেড়ে যাবেন, ছেড়ে যাচ্ছেন, তুলে দিচ্ছেন এখানকার পাট, সেই সুধীরমামা! মাথায় কমফরটার, নিমের গেলাস, লাঠিতে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটা, সুপুরিগাছের মতো রোগা কিন্তু সোজা, এখন না-হয় কী কারণে কে জানে, অন্তরিত অন্য জীবনে। কিন্তু ওঁর সেই আগের ছবিটাই তো বেছে রেখেছি। চোখ বুজলে আজও সেইটাই দেখি। তিনি চলে যাবেন, আর কাছে পাব না, কত পড়ানো, মেলায় মেলায় ঘোরানো, ম্যাজিক লণ্ঠনের সেই আসর, ঝিলে-বিলে মাছধরার চুপচাপ কয়েকটি দুপুর, সব শেষ, উপড়ে যাবে, বাবা যেমন একদিন উপড়ে ফেলেছিলেন উঠোনের গাঁদা ফুলের গাছ। সুধীরমামা। ওঁর বাবা আর তোমার বাবা, মানে আমার দাদু সেই কত বছর আগে এখানে আসেন এক সঙ্গে, ছোট্ট কী সম্পর্ক ছিল জানি না, তখনকার দিনে ঘনিষ্ঠতার জন্যে রক্ত-সম্পর্কের বিশেষ দরকারও হত না—এখন তো রক্ত-সম্পর্কের মানুষও একসঙ্গে কিংবা কাছাকাছি থাকে না, রক্ত বুঝি আর ঘন নেই জলের চেয়ে—তখন কিন্তু একটু লতায়-পাতায় আত্মীয়তা থাকলেই যথেষ্ট হত। ওঁরা এসেছিলেন, সত্তর আশি কি তারও বেশি বছর আগে, তখন এখানে শুনেছি রেল ছিল না, বড় গাঙ থেকে যে খালটা বেরিয়ে এসেছে তার ঘাটে নৌকো ভিড়ত, একজন কাজ নিয়ে এলেন সেরেস্তায়, মানে আমার দাদু, আর সুধীরমামার বাবা নাকি চাঁদসির চিকিৎসা করতেন, মলম-টলম এইসব আর কী। দু’জনেই তখন নবযুবা, অবিবাহিত, সুতরাং চোখে স্বপ্ন, চোখে আশা, সেই চোখ, উপনিবেশে বসতি করতে-আসা প্রথম মানুষদের দৃষ্টিতে যে-ঔজ্জ্বল্য থাকে। একটু একটু করে ডালপালা দেখা দিল, শিকড় ছড়াল; নরম মাটি, তার পরতের পর পরতের মায়ায়, প্রাণের গভীরে।

সব উপড়ে যাবে। ভিতরটা হু-হু হয়ে যাচ্ছিল, ভামতীর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। তখন ও-তো ভামতী নয়, সুধীরমামার প্রতিনিধি। তোমাকে একটু আগে ভুল বলেছি মা, ওই যে ভামতীর অন্যস্বাদের আকর্ষণ-টানের কথা যখন বললাম। শুধু তার জন্যে তো নয়, সুধীরমামার টানেও যে এখানে আসি, এই ঘরে তাঁর উপস্থিতি, এই ঘরে তাঁর স্মৃতি ছড়ানো, আজকের সুবাসের পিছনে ধুলোমলিন সেই পুরু চাদরটা, চাদরটা মুড়ি, নয় তো লেপমুড়ি, রবিবার দুপুরে আমাকে নিয়ে, সেই সঙ্গে আরও কয়েকটি ছেলে জুটিয়ে ক্লাস—গ্রিমের গল্প, আসছে বছর ল্যাম্ নামে কার লেখা থেকে বিলিতি নাটকেরও গল্প পড়ে শোনানোর কথা ছিল। সব মুছে যাচ্ছে।

সব মুছে যাচ্ছে, ওঁর জ্বর, মাথার কাছে জলের গেলাস, সব। বারান্দার টাঙানো দড়িটা ছিঁড়ে গেলে যেমন ঝুলতে থাকে, রাত্রে সেটা ভয়-দেখানো হয়ে যায়। শুধু ভামতীর টানে আসি না তো, আমার খুব ইচ্ছা করে, আমাকে—আমাদের নিয়ে উনি কী বলেন, এখনও সেসব মনে রেখেছেন কিনা, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেই। জিজ্ঞাসা করা হয় না, ঠোঁটে কী-যেন আটকে যায়, তাই জেনে নেব প্রতিজ্ঞা করে আবার আসি।

ভামতী এখন খাওয়া লজেন্সটার স্মৃতি ঠোঁট দিয়ে চাটছে, চোখে সেই দুষ্টু-দুষ্টু হাসি।—”চলে যাব ঠিকই। তবে ওকেও ছেড়ে যেতে পারি তোকে একটু আগে বলেছিলাম না! সব ঠাট্টা। রোগা জিরজিরে, একদম দুর্বল যে, আমাকে বলেছে কোনওদিন কারু কাছে কিচ্ছু পায়নি, বাচ্চার মতো এখন আঁকড়ে আছে আমাকে। আমিও গেলে ওর থাকবে কী?”

এতদিন বুঝিনি, তখনই যেন বোঝা হয়ে গেল ভামতী ওঁর কে। মনে মনে বলতে থাকলাম, “না, না, তুমি যেও না।”

‘খুব দুর্বল, ও খুব দুর্বল’, ভামতী বারবারই বলছিল বটে, কিন্তু ওর অত বেশি-বেশি করে বলায় চোখের সামনে দেখেছিলাম যে, দুর্বল কি একা সুধীরমামাই?—না।

আজ বিকেলে, আজ বিকেলেই, ক্লাসের ক্যাপটেন জগন্নাথ; আর মানিক এরা টিফিনের সময় গোল হয়ে কী বলাবলি করছিল, আমাকে দেখে ওরা চোখে চোখে ইশারা করে চুপ হয়ে গেল। আমাকে ওরা বিশেষ ডাকত না, ওরা বয়সে আর মাথাতেও বড়, ওদের দু’তিন জন তো প্রোমোশন না পেয়ে এক ক্লাসেই আটকে আছে। জগন্নাথ বলত, ‘আমরা হলাম গিয়ে রেলের পয়েন্টসম্যান, এক কেবিনে দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাগ উড়িয়ে গাড়ি পার করিয়ে দি’।

সেই জগন্নাথ, আমি যখন সরে যাচ্ছি, তখন হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকল, ওরা মত বদলে থাকবে, অথচ আমাকে সরাসরি কিছু বলল না, কুড়মুড় ভাজার খানিকটা ভাগ দিয়ে, আমাকে শুনিয়ে শুনিয়েই বলতে থাকল, “মৌচাকে ঢিল ছুঁড়েছি, আজ চাক ভাঙব। ডুবে ডুবে জল খাওয়া বের করছি।”

“ডুবে ডুবে কোথায়”, আর-একজন ফোড়ন কাটল, “একেবারে খটখটে আলোয়, পাড়ায় বসে—“

“পাড়ায় বসে বের করছি। মাথা মুড়িয়ে দেব, ঘোল ঢালব, গাধার টুপি পরিয়ে কিংবা বেড়াল-পার। বস্তায় পুরে কত বেড়াল দূরে দূরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে এসেছি আর এই একটা হুলো আর একটা মেনিকে পারব না?”

“হুলো আবার কে, দুটোই মেনি”, মানিক বলল মূল গায়েনের ঢঙ-এ, আর বাকি সকলে হাসির দোহার ধরল।

“বাজারের শ্যাম পোদ্দার, ওই যে যার বাসায় হরিসভা বসে, সে আমাদের পাঁচ টাকা দিয়েছে। যদি পার করতে পারি, তবে বলেছে আরও পাঁচ টাকা দেবে, কড়কড়ে, তা-ছাড়া একদিন পাঁঠার মোচ্ছব দেবে জুত করে।”—ওরা ঝনঝন করে পাওয়া-টাকা বাজাচ্ছিল, একজন ঠং করে টস্ করছিল এক-একটা টাকা, বুড়ো আর দ্বিতীয় আঙুলে, অন্যেরা হুমড়ি খেয়ে কুড়িয়ে নিচ্ছিল সেটা কিংবা লুফে নিচ্ছিল কায়দা করে।

টেরচা চোখে আমার দিকে চেয়ে জগন্নাথ বলল, “তুই তো ওখানে ঘুরঘুর করিস। আজ বিকেলের পরে চলে আসিস, বত্রিশ মজা দেখতে পাবি, দেখবি সে কী খেল, বাছাধনকে চূড়ান্ত জব্দ করব!”

.

মা, আমার ভয় করছিল, গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। টিফিন পিরিয়ডের পরও ক্লাসে গেলাম, কিন্তু স্যারের অনুমতি নিয়ে বার দুই বাইরে এলাম, জালা থেকে তুলে তুলে জল খেলাম। আজ বিকালে, আজ বিকালে—কী? একটা মজার খেল, ওরা বলছিল। সত্যিই কি ওরা ওইসব করবে, যা-সব বলাবলি করছিল, ঘোল, গাধার টুপি, এইসব? লীডারি করবে জগন্নাথ, সেবার ফেল করার পরে সুধীরমামা নিজে যেচে যাকে পড়াতে শুরু করেছিলেন?

ওরা যখন ওইসব করবে, ঢিল, কাদার তাল, এই সব—আমি, আমি তখন করব কী, ঠেকাব যে গায়ে সে জোর কই। তবে কি গা-ঢাকা দিয়ে দেখতে থাকব, দেখে যাব, গাছের আড়াল থেকে আর ছায়ার সঙ্গে মিলিয়ে গিয়ে? ভীরু, ভীরু কোথাকার। কিছুই করতে পারব না এই কথা স্থির জেনে নিজেকেই মনে মনে থু থু দিতে থাকলাম, তাকেও চড়ালাম গাধার পিঠে, ঢিলে ঢিলে ঘায়েল করতে থাকলাম, আমাকে আমি, কেন পারি না, কেন কিচ্ছু খুঁজে পাই না–জোর, সাহস, কিচ্ছু না?

কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর সন্ধ্যায় আমি শেষ পর্যন্ত ওখানে যাইনি। কেন, মা, তুমি তো জানো। সেদিন বিকেলটা এল খুব তাড়াতাড়ি, দেখতে দেখতে রোদ মিলিয়ে গেল, সময়ের আগেই যেন বুড়ো দারোয়ান শেষ ঢংঢং-টা বাজিয়ে দিলে ঘটা করে, পিলপিল করে বেরিয়ে আসছি সকলে, কিন্তু আমি কেন পিছিয়ে, পা টলছে, খাতা বই বার দুই খসে পড়ল হাত থেকে, ধুলো, ধুলো, কী ধুলো, ঝেড়ে মুছে বইগুলো তুললাম, তবু দাঁত কিচকিচ, মুখে নাকে বালি, কেননা বিকেল থেকেই সেদিন ধুলোর ঝড় বইছে, কেননা সেদিন দেখতে দেখতে রোদ মুছে আসছে, যদি বলি আমার ডান চোখের পাতা ও নাচছে সেটা হবে বানানো, কারণ “বামে সর্প দেখিলেন, দক্ষিণে শৃগাল,” প্রকৃতি এ-সব ঘটিয়ে দিত সেকালে, সেই ত্রেতাযুগে, রামচন্দ্র যখন মারীচকে মেরে ফিরছিলেন, এখন সে-সব আর হয় না, তবু বুকের ভিতরে কে যেন পুট্ করে টিপে দিচ্ছিল একটা টিপকল, ওরা, জগন্নাথ আর মানিকের দল অনেকটা এগিয়ে গেছে, দূর থেকেও শুনতে পাচ্ছি ওদের “হুররে” ভয়ার্ত আমি ভাবছি, আজ একটা সর্বনাশ হবে। কিন্তু—

একটা সর্বনাশ যে ঘটে গেছে, তার একটুও আভাস পাইনি।

দরজা খোলা, উঠোনে পাড়া-প্রতিবেশী মাসিমারা কয়েকজন ফিসফিস করে কথা বলছেন, ঘরের ভিতরটা কেউ ঝুঁকে ঝুঁকে দেখেছেন। থমকে গেছি, হাত থেকে বইখানা খসে পড়েছে আবার, আবার আমি কোনওদিকে না তাকিয়ে এক ছুটে ঘরে। মা, আমার মা, তুমি বিছানায় ওভাবে কেন, চাদরটা রক্তে ভাসাভাসি, তোমার চোখ সাদা, ওখানে মণি নেই যেন, আকাশ থেকে অস্ত গেছে সন্ধ্যাতারা। বিছানা রক্তে মাখামাখি, তুমি মাখামাখি, আমাকে ভয় দেখাতেই কি এইসব দেখাচ্ছ? তুমি জানো না, রক্ত দেখলে আমি কত ভয় পাই! আঙুলটাও কাটলে চোখ বুজে ঠোঁটে সেখানটা জোর করে চেপে ধরি, যে-বার বারোয়ারি কালীতলায় রাত জেগে বলিদান দেখি, সেবার অন্তত মাস দু’য়েক মাংস মুখে তুলতে পারিনি! তুমি জানো, সব জানো—তবু। মা, চোখ খোলো, বলো, কী হয়েছে। তোমার শিয়রে বসে গাঙ্গুলিবাড়ির পিসি, একখানা হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে আছেন। কী বলছেন উনি, আমাকেই কি, আমাকে যদি তবে অত চাপা গলায় কেন, বলছেন কি যে, তুমি পুকুরঘাটের পৈঠা থেকে হঠাৎ পা পিছলে—এসবের অর্থ কী, আমি শুনতে পাচ্ছি না, মাথামুণ্ডু বুঝছি না। আমি শুধু ওই বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ব, তোমার ঘ্রাণ নেব, এলানো চুলের, নিথর বুকের, তোমার আর-একটি হাত মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে, কী? চেপে ধরে, আবার কী!—ব্যস, ঘুমিয়ে পড়ব!

“কখন হল, আমাকে ইস্কুল কেন খবর পাঠাননি?”–বোকার মতো এসব কী বলছি আমি, পিসিমার দিকে চোখ পাকিয়ে, এখন, এই ঘরে, এসব হট্টগোলের কোনও মানে হয়?

“এই তো মোটে ঘণ্টাখানেক আগে, ভাগ্যিস ঘাটে ও-পাড়ার ওরা ছিল, ছুটে গিয়ে ধরাধরি করে ঘরে তুলল! তুই বাচ্চা, তোকে খবর দিলে কী হত, তখন আগে দরকার ছিল ডাক্তার ডাকা। ডাক্তারবাবু এইমাত্র দেখে গেলেন, অনেকক্ষণ ছিলেন, ওষুধ ইঞ্জেকশন সব পড়েছে, জ্ঞান ফিরেছে দেখে তবে উনি বেরিয়ে গেলেন। এখন একটু শান্তি। ও ঘুমোচ্ছে, মাঝে মাঝে জাগছে। জানিই তো, এক্ষুনি ইস্কুল ছুটি হবে, তুই এসে পড়বি, আগে এলে তো তোকে নিয়েই আর এক ঝঞ্ঝাট হত, কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিতি। যা এখন বাইরে যা। নিজেই নামিয়ে চিড়েমুড়ি যা আছে খেয়ে নে, ইস, মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, যা বাইরে যা। এসব দেখতে নেই, মা’র এই অবস্থায় ছেলেরা ঘরে থাকে না। ওকে আমি একটু পরে তুলব, মোছাব।”

গাঙ্গুলি পিসিমা বলেছেন আদেশ করার মতো সুরে, কিন্তু আমি রোয়া ফুলিয়ে গোঁয়ারের মতো দাঁড়িয়ে আছি, চট করে নড়ছি না।

(চোখ খোলো মা, শোনো, একটা কথা শোনো, ওরা আজ সুধীরমামাকে তাড়াবে। সুধীরমামা, সুধীরমামা, শুনতে পাচ্ছ?)

পিসিমা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তোমার মাথায়, তুমি চোখ দিয়ে ওঁকে বলে দিলে, আর দরকার নেই।

(মা, ওই দ্যাখ, ওরা এতক্ষণে ওখানে গিয়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে। একজন উঠেছে গাছে, ঢিল ছুঁড়ছে। কে একজন এইমাত্র ভেঁপু বাজাল। ওটা সংকেত। সুধীরমামা নয়, প্রথমে বেরিয়ে এসেছে ভামতী, তার কপালে একটা ইঁট—তাতে তোমার কী? তা অবশ্য, ভামতীকে তো তুমি দেখতে পারো না। )

পিসিমা উঠলেন, তোমার মুখটা বালিশেই কাত করে কাপ্-এ একটু জল ধরলেন। তুমি অস্ফুট গলায় বলে উঠলে “উঃ!”

(“উঃ” কেন মা, সুধীরমামাও যে বেরিয়ে এসেছেন, ওঁর মাথাতেও যে তাক করে মারা একটা ঝামা এসে লাগল, তুমিও বুঝি তাই দেখতে পেলে? গাছ থেকে ওরা নেমে আসছে সর্-সর্, ভামতী টেনে হিঁচড়ে ফের ঘরে নিয়ে যাচ্ছে সুধীরমামাকে, ভামতীর এখন গাছকোমর, গলার পরদা চড়িয়ে বলছে, “কে আসবি আয়, আর একবার এগিয়ে আয় দেখি।” এবার সুধীরমামা ওকে ঠেকাচ্ছেন। ভামতী কি চাট্টিখানি, ও হল গিয়ে বাঘিনী)।

তোমার বুক ওঠা-পড়া করছে, তুমি ওরকম আঁ-আঁ করছ কেন। পিসিমা তোমার ঠোঁটের কষ মুছিয়ে দিচ্ছেন।

(বড় রাস্তার গাছের তলায় এতটা ছায়া, বল তো কে? বাজারের শ্যাম পোদ্দার। উনি সামনে আসেননি, পিছন থেকে সাপের মতো করছেন হিস্-হিস্‌, ছায়ায় মিলিয়ে থেকেই ওদের লড়িয়ে দিচ্ছেন। মানিকের পকেটে ঝন্‌ঝন্ টাকা—কার? শ্যাম পোদ্দারের। উনিই দিয়েছেন। পরে পাঠাও খাওয়াবেন। তাঁরও পিছনে আর একজন ও কে? চিনতে পারছ না? ও তো তোমার ছেলে, এই যে আমি! ভীরু, কেঁচো ছোট্টটি।)

পিসিমা গলা থেকে ডলে দিচ্ছেন তোমার বুক, ঝুঁকে পড়ে বলছেন, “খুব কি কষ্ট?”

(কষ্ট হবে না? সুধীরমামা আজ চলে যাচ্ছেন যে। ওরা খারাপ একটা ছড়া পড়ছিল, উনি দুহাতে কান ঢাকলেন। তারপর আতঙ্কিত মুখ, সামনে যারা ছিল, তাদের জনচারেককে ডাকলেন।—”কী চাও, কী চাও তোমরা?” ঠান্ডা স্বর। “চাকের মধু ঝরিয়ে দিতে চাই”, পিছনের জন বলল, আর-একটা গলা : “পাখির বাসা পাড়ব, ডিম-ফিম ভেঙে দেব।” “তাই দাও” উনি বলছেন মাথার চুল চিমটি করে ধরে, “কিন্তু হাঙ্গামার দরকার কী। আমি তো তৈরি।” আমি তো তৈরি, আঃ, কী সুন্দর বাতাসের মতো কথাটা, সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক’জন বলতে পারে “আমি তৈরি”? সুধীরমামা পেরেছেন! ওরা এখন ঘরের ভিতরে। পোঁটলা-পুঁটলি তো আগেই বাঁধা। ভামতী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে, ওর কপালে আজ আবার একটা কাঁচপোকার টিপ, কালোর উপরে সবুজ, যাবার সাজ, দৃষ্টি স্থির, কিন্তু কাঁপছেন সুধীরমামা, চুল কাচাপাকা, দূর, কলপ-টলপ উপে গেছে, হাত বাড়িয়ে উনি খেতে গেলেন জল, কিন্তু ইস, গ্লাসটা পড়ে যে খান খান হয়ে গেল। ভামতী নিচু হয়ে কুড়িয়ে তুলছে কাচের টুকরো, এটা কি সেই গ্লাস, তুমি . চুপে চুপে একদিন যেটা ভরে দিয়ে এসেছিলে?)

আমাকে পিসিমা এখানে আর থাকতে দেবেন না, তোমাকে প্রথম একটু গরম দুধ, পরে আর-এক ডোজ ওষুধ খাওয়ানো হলেই আমাকে সরিয়ে দেবেন। সেই ওষুধ, পিসিমা বলেছেন, যা খেলে ব্যথা একটু কমে ঘুম এসে যায়।

(“আজই যাব”, ওদের বলেছেন সুধীরমামা, “আজ রাত্রেই”। এখন আর কাঁপা কাঁপা নয়, শান্ত কণ্ঠস্বর। পোঁটলা-পুঁটলি জড়ো করে বাইরে রাখছেন। তবু দূর থেকে পিছনের কারা এখনও ঢিল ছুঁড়ছে, মজার খেলা, মজার খেলা, ওরা একটা মজা পেয়ে গেছে যে। আমি কী করব, ছায়া হয়ে লুকিয়ে আছি যে—আমি? আমিও একটু মজা পাব নাকি, দু’একটা ঢিল আমিও ছুঁড়ব? না তো। ভীরু হলেও তোমার ছেলে ইতর নয় মা, সে বরং ভাবছে এগিয়ে গিয়ে একটা পোঁটলা বয়ে দিয়ে আসবে কিনা, কিন্তু সে সাহসই কি ওর হবে?)

.

আমি এখন বাইরে, উঠোনে। পিসিমা এইমাত্র আমাকে ঠেলে বের করে দিয়ে দরজাটা-বন্ধ করে দিলেন। চাদর-টাদর পালটে তোমাকে সাফ করবেন। করুন, আমি এখন উঠোনে। পুকুরপাড়ে কারা পাটে ‘জাগ’ দিয়েছে, তার পচা-পচা গন্ধ, কিন্তু আকাশে অনেক তারা, কোনও কোনও তারা আবার রাত্তিরেই এদিক থেকে ওদিক হাঁটা চলা করে। এক-একটা আকাস্মিক খসে পড়ে। তুমি এখন ঘুমোবে। তুমি ঘুমিয়ে থাকতে থাকতেই—

(ওই দ্যাখ, সুধীরমামারা রওনা হয়েছেন। সুধীরমামা আর ভামতী। সুধীরমামাও তারা দেখছেন। তারা দেখছেন কিনা, তাই এখন আর কিছু শুনছেন না। আমরা যখন তারা দেখি, তখন চিৎকার হট্টগোল টিটকারি, এ-সব কিছু শুনি না। গাছের আড়ালে চোর আমি, ভিতু আমি, আমাকেও উনি ভ্রূক্ষেপ করলেন না। এখন ওঁর মাথা সোজা, টানটান, কই হাতের লাঠির উপরে তো ঝুঁকে পড়লেন না?) মা, তুমি এখন ঘুমের মধ্যে চলে যাচ্ছ, জলের তলায় যেন ডুব সাঁতার। সেই সঙ্গে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছেন আর-একজন, কাল সকালেই ভেসে উঠবে তুমি ফিরে আসবে, কিন্তু ফিরবেন না উনি, ফিরে আসবেন না। তোমার এই আচ্ছন্ন তন্দ্রাঘোরে তোমার অগোচরে ভীষণ একটা ঘটনা ঘটে গেল, কিন্তু ভগবান তোমাকে বাঁচালেন, কিছু জানতে দিলেন না।

.

কিন্তু আমি জানলাম। শুধু ওই ঘটনাটা নয়, ভীষণতর আর-একটা অন্তত আমার কাছে। তোমার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম যখন, কী-জানি ওই ফ্যাকাশে মুখ, রক্তাক্ত চাদর নির্বাক স্বরে আমার কানে অমোঘ বাক্যটি উচ্চারণ করেছে: দাদাও আর আসছে না।

মিছিমিছি তবে এতদিন তার অপেক্ষা করেছি, ফোটোর দিকে তাকিয়ে আশায় আশায় দিন গুনেছি, সে-সব শেষ হয়ে গেল। ডাক্তার এল, ডাক্তার গেল, খুঁটি ধরে ধরে তুমি একদিন দাওয়াতেও এসে বসলে, তখন নিয়মিত সেই চারটে চড়ুইও এল, ডালপালা ছাড়িয়ে রোদ ছড়িয়ে পড়ল, চান করার পরে মাথা মোছা শেষ হলে তোমার ধোয়া মুখ যেমন গামছার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ে, এই রোদ তেমনই, এই রোদ তোমার মুখের মতো, আমি একা-একা আবার বেরোতে থাকলাম। সেই দিঘির ধারে, যেখানে দাদার সঙ্গে জলে মুখ রাখলেই দেখা হত, একটা দুপুরে গিয়ে তাকে বললাম, “আসবি না যখন, তখন কেন আশা দিয়েছিলি? মাকে ঠকালি, আমাকেও।”

গাছের গুঁড়িতে পিঠ দিয়ে, পিঁপড়েদের বলাবলি শুনতে শুনতে চোখ জড়িয়ে আসত, একটা কাঠঠোকরা উপরের ডাল ঠোকরাতেই থাকত। আর ঘুঘু পাখি, তার ডাকে, আঃ কী ক্লান্তি, কী ক্লান্তি, দিঘি-পাড়ের চষা ক্ষেতটার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতাম, সব ফাঁকা, শূন্য। যে চলে গেছে, আর যে এলই না, তারা হয়তো একজন, হয়তো দু’জন—দু’জনেই আমাকে ঠকাল। আমি না রইলাম কারও ভাই, কারও দাদা হওয়াও হল না—আমি একা।

একা, পরে জেনেছি সব মানুষই আসলে একা, ভিতরে একটা জায়গা আছে যেখানে কাছে-পিঠে কেউ নেই, পাশে দাঁড়িয়ে কেউ ছায়া ফেলে না; কিন্তু তখন তো এসব জ্ঞান ছিল না। পুরনো দাদা তো কবে থেকেই নেই, নতুন হয়েও সে আসছে না, কোথায় চলে গেছেন সুধীরমামা, কোন্ দূর-দূর ঠিকানায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাবা—তখন, সেই সব শুকনো নির্জন নিঃসঙ্গ দুপুরে হঠাৎ হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ে যেত।

এইভাবে, মা, আমার সেই সকালের প্রথম বেলাটি শেষ হল।

.

মা, তাড়াতাড়ি, একটু তাড়াতাড়ি। তোমার, এখন আর তাড়া নেই, অফুরান সময়ের সাজি কোলে নিয়ে বসে আছ, যেন কোনও চির-শরৎকালের শিউলিতলার ছবিটি, ফুল ঝরছে, ঝরছে, ফুল তো নয় সময়ের ফুলকি, তাকে ইচ্ছে হলে গেঁথে তোলো, ইচ্ছে হল না তো দাও ছড়িয়ে, তোমার চারপাশে, তারা জমে জমে পাহাড় হয়ে উঠল তো কী এল গেল, সব তাড়ার পাড়ে তুমি, তোমার অবসর তো এখন অনন্ত।

কিন্তু তাড়া আছে আমার। আমি এখনও যে পড়ে আছি, তোমার ছেলেটি এখনও স্থানকালের গরাদখানার কয়েদি, খুব দুষ্টুমি করছিল বলে তুমি তাকে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়ে ঘরের মধ্যে বসিয়ে রেখে গেছ, শাস্তি, এই তার শাস্তি, মা, শিকল খুলে দেবে না?

তবু আমি জানি, এর মেয়াদ ফুরিয়ে আসছে। ভালোভাবে বাস করলে কয়েদিদের দণ্ডভোগের মেয়াদ কমে যায়, জানো তো? শেষ কটা বছর অত্যন্ত সদ্ভাবে বাস করেছি বলে, বাকি কালটা আরও সদ্ভাবে বাস করব স্থির করেছি বলে তোমারও উপরে যিনি, তিনি একটু তাড়াতাড়িই মেয়াদটা মকুব করে দিচ্ছেন। আমি টের পেয়ে গেছি। ফুরিয়ে আসছে, এখানকার পালা ফুরিয়ে আসছে।

তার চিহ্ন—ফুরিয়ে আসছে আমি। আমি, আমার সব স্বপ্ন, সব শক্তি, সব আসক্তি আর বাসনা নিয়ে ফুরোচ্ছি। আগে পড়তাম ভীষণ কোনও জলপ্রপাতের মতো শব্দ করে, যেন এক নায়াগ্রা যেন হুনডু অথবা কোনও উশ্রী, আজ পিছল কোনও চৌবাচ্চার নালা দিয়ে হড়হড় করে বেরিয়ে যাচ্ছি!

একে একে সব যাবে। আমার আশা, আমার সাধনা।

(কিসের সাধনা, একটা কিছু হব বলে? দূর-দূর কেউ কি কিছু হতে পারে, কোনওদিন পেরেছে—কেউ না। শুধু হতে চাওয়ার সাধটা ফুটতে থাকে, বড় জোর সাধের সঙ্গে যুক্ত হয় সাধনা)

সব নিঃশেষে মিশে যাচ্ছে, সবাইকে একে একে রওনা করে দিচ্ছি, সাধ আশার সঙ্গে সঙ্গে যত নেশা, যত ভালোবাসা, সবাইকে তুলে দিয়ে আমি উঠে পড়ব সব শেষে, কাচ্চা-বাচ্চা বউকে বাসে তুলে দিয়ে যেমন নিশ্চিন্ত হয়ে পা-দানিতে পা রাখেন গৃহস্বামী, তেমনই।

(পরিজনদের প্রসঙ্গে, মা, আমার কবে লেখা কয়েকটা লাইন মনে পড়ছে :

“তার মৃত্যুকালে ওরা সকলে
পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছিল,
তার যত পরিজন,
তার আশা, তার ভালোবাসা।
সুর করে করে ইনিয়ে বিনিয়ে
বলছিল, ‘আমাদের কী দিয়ে
গেলে। আমাদের জন্যে কিছু
রেখে গেলে না?”)

যাব। রেখে যাব। যাব বলেই তো যাবার আগে কলম নিয়ে বসেছি, একটু আগে কয়েদির মেয়াদ-টানার কথা বলছিলাম না? শেষ ঘানিটা বার-কয়েক ঘুরিয়ে তবে নিষ্কৃতি। একে একে অনেককে চিঠি! যাকে যা বলতে চেয়েছি বলা হয়নি, মনে-মনে পুষে রাখা অনেক পাখি উড়িয়ে দিয়ে হালকা হব; শুধু পাখিই না, খাঁচা খুলে ছেড়ে দেব হিংস্র কিছু প্রাণীও, যারা বিষাক্ত, যারা জিভের লালায় এতকাল আমারই ভিতরের দেওয়ালগুলো চেটেচে, কিংবা আঁচড়েছে ধারালো নখরে, তারা এবার ছাড়া পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুক সকলের উপরে—পড়ুক; পড়ুক না! কাউকে কামড়াক, কারও গা লেহন করুক একান্ত বশংবদ ধরনে, তপ্ত কিংবা হিমশ্বাস, হা-হা করে ফেলে চলুক, যত পারে।

এই সব করে, তবে আমার ছুটি। কিছু হতে পারা আর কিছু হতে না পারা যখন একাকার হয়ে গেছে, তখন এই একটুখানি মোহ একফোঁটা টসটসে রক্তের মতো জমিয়ে রেখেছি।

কিন্তু মা, একটি প্রণামেই এতখানি সময় কেটে যায় যদি, তবে চোখ তুলে বাকি সকলের দিকে তাকাব কখন, তাকাব কী করে। ওদের খুঁজে পেতে আনতে আনতেও সময় ফুরিয়ে যাবে না?

“শ্রীচরণেষু মাকে” বলে একটি পর্ব শেষ করব ভেবেছিলাম, আর একটি পর্ব হবে “সুচরিতাসু তোমাকে”। “তুমি” এই একটি মন্ত্রে আবাহন সকলকে, ‘অর্চিত যারা, যারা বিসর্জিত, যারা বাঞ্ছিত। “মাকে আর তোমাকে”।—এই সামগ্রিক পরিকল্পনাটাকে, পায়ে পড়ি মা, এলোমেলো করে দিও না। সবখানি তুমি একাই কেন ঢেকে রাখছ শ্রাবণের সর্বব্যাপী মেঘের মতো?

.

তাই বলছি, মা, আমাকে একটু তাড়াতাড়ি বড় হতে দাও, সেই বয়সে যখন আমি তোমার আবরণ, তোমার কুসুম ভেঙে ফুটে বের হচ্ছি।

আচ্ছা, আমিই একটু খেই ধরিয়ে দিচ্ছি। বাবার একটা চিঠি এল, মনে পড়ছে এবার, কত দিন পরে, কতকদিন পরে, মা? তখন তুমি অনেকটা ঠিক হয়ে গেছ, মানে তোমার শরীরটা, যদিও চোখের তারা যেমন মরা-মরা হয়ে গিয়েছিল, তেমনই রইল, সজীব ঝিকিমিকি আর ফিরে এল না, মাথাটাও ঠকঠক করে এদিক-ওদিক ঘুরত, যেন স্প্রিং-লাগানো জোড় দেওয়া একটা পুতুল, মেলায় যা বিক্রি হত, হয়তো-বা এখনও হয়, কেষ্টনগর না কোথাকার আমদানি, তুমি নড়ছ, চড়ছ, অথচ একটু যান্ত্রিক, কথা বলতে বলতে কী বলছ তাই গুলিয়ে ফেলে থেমে যাচ্ছ, তাকাচ্ছ আমার দিকে, চোখে কাকুতি, ‘ধরিয়ে দে না, ধরিয়ে দে না একটু’–তবু সজনে গাছটায় নতুন করে ফুল ধরছিল, যত পাখি উড়ে গিয়েছিল, তারা ফের ডাকাডাকি শুরু করেছিল পাতার আধো-অন্ধকারে—সারা দুপুর, সারা দুপুর, আকাশের রঙ সোনা, কাঁসা, অভ্র, আবির, সিঁদুর, সীসে, সব বদলে যাচ্ছিল পরে পরে, যেমন যায়, যেমন বরাবর যেত, তাই মনে হত তুমিও যেন সেরে উঠছ, সামলে গেছ ধাক্কাটা,

(সব ধাক্কাই সামলানো যায়, যে গেল তার শোক যেমন সামলে নিয়েছিলে একবার, তেমনই যে এল না, তার শোকও সামলে নিলে? )

কত দিন কেটে গেল হিসেব নেই। মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে, কিন্তু বাবার চিঠি হঠাৎ একদিন এল মনে আছে।

.

নিবারণ, ডাক-পিওন, আমরা বলতম নিবারণদা, ওর পুরু খাকি রঙের থলেটা সম্পর্কে ছিল একটা সকৌতুক লোভ, সব অজ্ঞাত রহস্য বিষয়েই ওই বয়সে যেমন থাকে, একদিন দেখলাম সে বড় সড়ক ছেড়ে আমাদের বাড়ির দিকের রাস্তাটা ধরেছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “মা, নিবারণদা আসছে, এ-দিকেই! “

উত্তেজনার মতো ঘটনা বৈকি। এদিকে আসত এক সুধীরমামা; সে চলে যাবার পরে, ডাক-পিওন তো দূরে থাক, বিশেষ কেউ আমাদের বাড়ির দিকে আসে না।

“নিবারণদা, আসছে মা”।

তুমি নিরুৎসুক গলায় বললে, “আসুক গে”। আঙুলের কর গুনে গুনে তোমার নাম-জপ চলছিল, চলতে থাকল। আমি কিন্তু পারলাম না, ছুটতে থাকলাম নিবারণদার দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে, মাঝপথে ওকে রুখে হাত পেতে বললাম, “দাও।” সে মিটিমিটি হাসছিল।—”কী দেব, বলো দেখি।”

“কী আবার, চিঠি।”

সে বলল, “উঁহু, চিঠির চেয়ে ভারী আর বেশি। এর নাম ইসিওর, ভেতরে তিরিশ টাকা আছে। মার নামে, মার সই লাগবে।”

তখন আমি ছুটতে থাকলাম নিবারণদা আগে আগে। তুমি তো “আসুক গে” বলে ঢুকে গেছ হয়তো রান্নাঘরে, তোমাকে খুঁজে বের করে আনতে হবে!

দরজা আলগাই ছিল, যেহেতু আমি দাঁড়াইনি, তখনও দৌড়চ্ছি, সুতরাং কবাট খুলে গেল ঝপাং করে, কে যেন অস্ফুট গলায় বলে উঠল, “উঃ!”

তোমার লেগেছে। আগে কি জানি, “আসুক গে” বলে যে সরে গেছে, দম বন্ধ করে সে-ও কবাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকবে!

দৌড়ে ঘরে গিয়ে আমি নিয়ে এলাম দোয়াত, ধরে রইলাম, কলম নিবারণদার কাছেই ছিল, সে বাড়িয়ে দিল, থরথর হাতে তুমি সই করলে, কেমন গোটা-গোটা অক্ষর তোমার, অথচ সেদিন কেঁপে কেঁপে বেঁকে গেল।

রসিদটা মুড়ে রেখে নিবারণদা বলছিল, “মা পার্বণী চাই কিন্তু”, তুমি রক্তলেশ-শূন্য, আঁচলের গিঁট খুলে তাকে কত দিলে, সিকি না দুয়ানি, আজ মনে নেই।

কী আশ্চর্য, নিজের হাতে খামটাও কি খুলবে না তুমি? নিবারণদা ফিরে যাচ্ছে, দরজার খিল তুলতে তুলতে খামটাই খসে পড়ল মাটিতে, আমি কুড়িয়ে তুলে খামটা ছিঁড়লাম! তিনটে দশ টাকার নোট, আর, আর কী? একটা চিঠি। চোখ বুলিয়ে তুমি পড়লে কি পড়লে না, টাকা সুদ্ধ খামটা আমার হাতে দিলে। টাকা, খাম, একটা চিঠি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *