১৫. আঙুলের ফাঁক দিয়ে

১৫

ওর আঙুলের ফাঁক দিয়ে মণিবন্ধে রস চুঁইয়ে পড়ছে, বুলা একটা কাঠি আইসক্রিম চুষছে। বললে, “কী ঠান্ডা, আমার গালের মতো,” বলতে বলতে সে আমার গালেই একটা ঠান্ডা হাত রাখল। কাঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “খাবি! খেতে চাস তো খা না।” ইতস্তত করছি দেখে চোখ টিপে ভঙ্গি করল একটা—”বুঝেছি আপত্তি কেন তোর। আইসক্রিম কী এঁটো হয়? হয় না! গলে ক্ষয়ে যায় যে। দেখছিস না?” বলে,. বুলা মুখ নামিয়ে জিভ বের করে নিজের কবৃজি নিজেই চাখল।

কথা বলে চলেছিল সে একাই। “জানতিস আমি এখানে থাকব? জানতিস না? তুই তো ডুমুরের ফুল হয়েছিলি কদ্দিন যেন? সেই যেদিন, হি-হি, আচ্ছা আমাকে কী বলে মারলি বল তো, একটুও কষ্ট হল না? কষ্ট হয় কোন্‌খানে জানিস তো? কষ্ট হয় এইখানে”—বলে আঙুল ঘুরিয়ে কষ্টের জায়গাটা দেখিয়ে দিল।

তারপর : তোর মা-গঙ্গার কাণ্ড দ্যাখ। সূর্যের মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছে অথচ এমনিতো শুনি নাকি পবিত্র। পবিত্র না পবিত্র, ঘোলা জল এখন লালেলাল, আমাকে বাবা দশটা টাকা দিলেও এ জলে আমি নাইতে নামব না।

সে একটু চুপ করল, বোধ হয় আমাকে করুণা করে রেহাই দিল, কিন্তু না তো, ওই রে! এই যে বুড়বুড়ি ফুটছে আবার : অনেক লোক নাইছে কিন্তু, এদিকে আয়, চেয়ে দ্যাখ ওই বাবুঘাটে। বল তো গঙ্গায় নিত্যি চান করে যারা তারা পাপী, না পুণ্যবান? পাপ—পাপ, ধুলো নোংরা ধুয়ে ফেলতে আসে। ওরা পাপ করে কিনা, তাই পুণ্যের জন্যে এত পিটপিটানি, নিত্যি নিত্যি স্নান। মাগো মা, কী বেহায়া, মেয়েগুলোর গা খালি, নয় তো ভিজে কাপড়ে সব ফুটে বেরুচ্ছে। ওরা কি মেয়ে! আমার কিন্তু, সে খুব গোপন কথা বলার মতো গলা করল—আমার কিন্তু শোবার ঘরেও…এই যে ফ্রক পরে আছি, দেখছিস তো পায়ের কতটা অবধি খোলা, দেখ না, আজকাল এতেই কেমন গা শিরশির করে।

বলে সে আমাকে খানিকক্ষণ নিরীক্ষণ করল। তোদের ছেলেদের বাপু ও-সব বালাই নেই, এই যে শার্ট আর হাফপ্যান্ট পরে আছিস, বেশ মানাচ্ছে। তুই অবিশ্যি একটু রোগাপটকা আছিস, পায়ের গোছ, মাল এইসব আর-একটু পুষ্ট ভারী হলে আরও মানানসই হত। মানায় মেমসাহেবদেরও–সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, মানাক গে যাক, আমরা তো আর মেমসাহেব নই। এই বছরটা গেলেই আমি শাড়ি ধরব, মাকে দিয়ে কড়ার করিয়ে নিয়েছি, বলেছি আমার বাইরের আর নীচের দুটো জামা-ই চাই।

এবার সে একটা প্রশ্ন করে বসল, আমার পক্ষে দস্তুরমতো কঠিন প্রশ্ন। এখানে এসেছি কেন বল তো? এক, দুই, তিন–তিনটে বল, একটা মিলেই যাবে ঠিক।

পারবি না? ধুউ-র বোকা-টা, দু-য়ো। এসেছি মাকে ধরব বলে।

এতক্ষণ কথা যার কলের-জলের মতো ঝরছিল, তার গলা হঠাৎ কলতলার মতো স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেল।

বললাম, “মাসিমাকে! কেন, মাসিমা তো বাড়িতে—”

কথা কেড়ে নিয়ে সে বলল, “নেই। দু’দিন ধরেই নেই। তুই জানবিই বা কী করে। খবর তো রাখছিস না। আজকাল আমাদের ঘরের দিকে একবার তাকাস না পর্যন্ত। জানিস, আমি কতদিন দরজায় দাঁড়িয়ে—”

“আমার পরীক্ষা এসে পড়েছিল যে। তা-ছাড়া বুলা”, ওই পরিবেশে যতটা হওয়া যায়, ততটাই অকপট হয়ে আমি বললাম, “বুলা আমার ভয় করত।”

“পাছে আমি পেছন থেকে এসে পেত্নীর মতো ঘাড় মটকে দিই?” গলার জমা বাষ্প উবিয়ে দিয়ে সে আবার ঝকঝকে হাসিতে ভরে গেল, “তাই হনহন করে চলে যেতিস, সিঁড়ি পার হতিস তিন লাফে? রামনামও জপ করতিস নাকি, এই! বল্ না!” সে আমাকে তার কাঁধ দিয়ে আলগোছে একটু ঠেলে দিল। ওর কানে দুল, পড়ন্ত আলোয় ঝলমল করছিল।

বললাম, “কিন্তু বুলা, লীলা মাসিমার কথা যেন কী বলছিলে?”

“শটকেছে। নিজের মেয়েকে ফেলে যে ওভাবে পালায়, সে কি মা, সে কি মানুষ। তোরও তো মা আছে!”

বললাম, “আর মেসোমশাই?”

“ওই লোকটার কথা বলছিস, যাকে আমি বাবা বলি?”

(মা, নমস্যদের প্রতি অশ্রদ্ধা, পারিবারিক কয়েকটি স্বীকার্য স্বতঃসিদ্ধকে অস্বীকার করা, এর নির্মল-নির্মোহ নমুনা আমি কি প্রথম বুলার মধ্যেই পেয়েছিলাম? সবাই প্রকাশ্যে যাকে মূল্যবান জ্ঞান করে, তাকে মূল্যহীন করে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার উদ্ধত শূন্যতা? বুলার অবিশ্বাস, বুলার তিক্ততা, নিঃসঙ্গ নিষ্প্রেম বুলার নিষ্ঠুরতা গোপনে কলির মতো আমার ভিতরেও সংক্রামিত হয়েছিল নিশ্চয়; তোমার-আমার, আমার আর বাবার সম্পর্কের অনেকগুলো অধ্যায়কে প্রভাবিত করেছিল।)

“যাকে বাবা বলি?” বুলা বলছিল, “তার আর কী, বেচারা! তামাক খাচ্ছে, নিজের কলকে নিজেই সাজাচ্ছে আর কাশছে, ওদিকে আবার সারারাত হাঁপানির ছটফটানি, তবু ছিলিমটুকু চাই, তার ওপরে আবার হা-হা-হু-হু জুটেছে। সইতে পারিনে। আসলে কিন্তু ওর আর এমন-কী। বউ গেলে বউ হয়, কিন্তু মা গেলে আর-একটা মা আমি কোথায় পাবো।”

বুলা আবার গাঢ় হয়ে গেল, যেন দুপুরের পুকুরে হঠাৎ মেঘের ছায়া পড়ল। টের পাচ্ছিলাম, ওর ঝিকমিক হাসির বালি একটু সরালেই তলায় জল।

দেখতে দেখতে সে আবার চকচকে বালুকণা খুঁড়ে খুঁড়ে ঢেকে ফেলল, টলটলে, জল।—”তাছাড়া বুঝলি না, ওর বয়স গেছে, তিনকাল গিয়ে বাকি আছে এককাল, স্বাস্থ্য খারাপ, বউ-টউয়ের তেমন আর দরকার নেই তো; যে বউ আবার বাগ মানেনি, যে বউ আবার আসল নয়, নকল। তা নকল বউ গেল, নকল মেয়ে তো রইল! জানিস, দু’রাত্তির আমি ঘুমোতে পারিনি, খালি মনে হয়, ওই লোকটা উঠে এসেছে, আমাকে একদৃষ্টে দেখছে! আমার আবার শোয়া বিচ্ছিরি, ঘুমের মধ্যেও গা ছমছম করে।”

গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, কেন যে বুলার কাছ থেকে কাঠি-আইস-ক্রিমটা নিয়ে নিইনি তখন, বললাম—বরং বলা উচিত নিজেকে বলতে শুননলাম—”কিন্তু বুলা, মেসোমশাই তো তোমার—”

“বললাম যে! যেমন নকল মেয়ে, তেমন নকল বাবা। পাতানো বাবা, বানানো বাবা যা-খুশি হয় বলতে পারিস। ও সব পারে। অবিশ্যি চোখ দিয়ে। সব যদিও গেছে, তবু চোখ দুটো তো আছে!”

আমি মাথা নাড়তে থাকলাম। যে কথা কাউকে বলিনি, নিরুপায় হয়ে সেই নিভৃত একটি অভিজ্ঞতার কথাটাও ওকে বললাম।—”শুধু চেয়ে দেখলে কিছু হয় না”, বুলাকে জানালাম, তারপর চোখে চোখ রেখে : “জানো, আমার বাবাও দেশে থাকতে এক-একদিন আমাকে ওই ভাবে দেখত।”

‘সে-দেখা অন্য দেখা। তোরা, ছেলেরা, বুঝবি না। আমরা তো মেয়ে, আমরা সব টের পাই। জানি। বুঝি।”

প্রতিটি শব্দের শেষে পূর্ণযতি ওর ধারণার দৃঢ়তা প্রমাণ করছিল।

“তা হবে না”, বুলা বলল, নিশ্চিত স্বরে, “মাকে আমি খুঁজে বার করবই। যেখানেই থাক।”

যেখানে থাক, সে বলে গেল, “ওকে আমি পাবই। আমি জানি যে। নেহাত যদি কলকাতার বাইরে না গিয়ে থাকে, ধর গিরিডি কি হাজারিবাগে, একবার তাও গিয়েছিল—তবে একটা-না একটা বিকেলে এখানে তো আসবেই? বিকেলে ওর মাথা ধরে, গঙ্গার হাওয়া হল ওষুধ, বন্ধুদের নিয়ে হাওয়া খেলেই দেখছি ওর মাথা ধরা ছেড়ে যায়।”

একটা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুলা বলে গেল, “সওয়া পাঁচ। তার মানে আরও আধঘন্টা কি তিন কোয়ার্টার। আসবে ছ’টা নাগাদ। আজ না আসুক, কাল? নয়তো পরশু নিশ্চয়ই। ধরে ফেলব হাতেনাতে। ওই বটগাছটার তলায় বুড়ো পানওয়ালাকে দেখতে পাচ্ছিস? ওর কাছ থেকে মা জর্দা-দেওয়া পান খাবে। খেয়ে পিচ ফেলবে, ফুড়ুৎ! ফিনকি দেওয়া রক্তের মতো। মার অভ্যেস। বুড়োটাকে বলে রেখেছি, দেখতে পেলেই ইশারায় আমাকে জানাবে।”

বোকার মতো বললাম, “বুলা, উনি আজ যদি পান না খান?”

“তাই ভাবছিস?” বুলা তালি দিয়ে উঠল, “তা হলে আছে কুলপি—সিদ্ধির কুলপি- —মার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। ওই যে কুলপিওয়ালারা ঘোরাঘুরি করছে ওখানে, ওই গম্বুজের দিকটায়। ওদের বলে রেখেছি। আঁটঘাঁট বেঁধেই নেমেছি রে বোকচন্দর, মা যদি ঘুঘু, আমি হলাম গিয়ে তারই তো কন্যে? লীলা বানির মেয়ে আমি বুলা বাম্‌নি।”

নিজের চালাকিতে নিজেই মোহিত বুলা একটু কেমন করে হাসল।—”ভাবছিস, এত অন্ধিসন্ধি আমি জানলাম কী করে? মা নিজেই আগে বোকামি করেছে যে। মুখে তো বলেইছে, তাছাড়া মাঝে মাঝে সঙ্গে নিয়েও এসেছে। যখন ছোট ছিলাম। একা ঘরে থাকব কী করে, ভয় পাব, তাই। আগে ওর স্নেহ ছিল, মায়া ছিল।”

“এখন নেই?”

“এখন আছে ভয়। আর হিংসে। বন্ধুরা তখন বিরক্ত হত, রেগেও যেত, তবু মা পরোয়া করত ক্!ি ওর তখন বয়সও ছিল যে। জানত যতই ওরা গরগর করুক কুকুরের মতো, সব শুধু মুখে। শেষ পর্যন্ত ল্যাজ নেড়ে লুটিয়ে পড়বেই। মার সেই জোর ছিল। জোরটা গেছে, তার জায়গায় হিংসে এসেছে। ওর পাতের মাছে আমি পাছে ভাগ বসাই, সেই হিংসে। যেই অরিন্দম রায়েরা আসে, ওমনি বাড়ি থেকে শুট করে বেরিয়ে পড়ে। আমাকে ওদের কাছে চা-টুকুও দিয়ে আসতেও পাঠায় না। বন্ধুদের নজরে নজরে রাখে।”

হরির লুটের বাতাসা ছড়াবার ঢঙ-এ হাত তুলে বুলা বলল, “রাখুক, আমার তো বয়েই গেল। আমি তো আর ওর মতো হিরোইন হবার জন্যে হ্যাংলামি করে বেড়াচ্ছি না। চান্স এলে আসে আসবে। ওকে ওই এক নতুন বাতিকে পেয়েছে, ওই বুড়ি নাকি হবেন হিরোইন, না কচু। কচু না ঘোড়ার ডিম। ছুঁড়ি পেলে কেউ বুড়িকে পার্ট দেবে? কোথায় দিয়ে থাকে, বল?”

বললাম, “থিয়েটারের কথা আমি তো বিশেষ জানি না। “

“জানবি, জানবি। না হয় মেসোমশাইকে–তোর বাবাকে জিজ্ঞেস, করিস। ঘোরাঘুরি তো শুনি উনিও করেন, রকম-টকম কি আর না জানেন? “

বুলা বুক ভরে বাতাস নিল। জাহাজের মতো দেখতে একটাকে আর-একটা জাহাজ সিটি বাজিয়ে কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। বুলা বলল, “এখানে দম আটকে আসছে, কালিতে জামা নষ্ট হয়ে যাবে। আয়, ওই ছায়ায় যাই।”

পাটাতনের উপর দিয়ে আমাকে হিড়হিড় করে টেনে এনে বুলা একটা কোণে, এক আড়ালে দাঁড় করিয়ে দিল। তার ঠিক নীচেই জলের ছলাৎ-ছলাৎ, গোটাকতক ডিঙ্গি বাঁধা, মাঝিরা রান্না চাপিয়েছে, সেখানেও ধোঁয়া।

“ন্‌নাঃ” বুলা বলল, “সুখের জায়গা এই পৃথিবীতে কোথথাও নেই। এই ঘরটায় যাবি? দেখবি টেবিল চেয়ার পাতা চমৎকার চা করে। এখনও তো হাতে বেশ কয়েক মিনিট সময় আছে, চা খাওয়াবি? পয়সা আছে?”

পকেট থেকে যা ছিল তা বের করে দেখাতেই বুলা হেসে উঠল খিলখিলিয়ে।—”মোটে বারো পয়সা? ভাগ, ওই দামে এখানে ধোয়া পেয়ালায় গরম জল দেয় না। এই নিয়ে তুই মাঠে আসিস, গঙ্গার ধারে? তোর প্রেমের দাম কি তিন আনা?”

পাটাতনের সঙ্গে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। বুলা আমাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গেল আরও ধারে। জলে ফেলে দেবে, এই ওর মতলব নাকি, পকেটে মোটে তিন আনা নিয়ে এসেছি এই পাপে?

চোখ বুজে ফেলেছিলাম, অথবা ঠিক ঠিক বলতে পারব না, বুলাই হয়তো ওর ঠান্ডা একটা হাতে আমার চোখ চাপা দিয়ে থাকবে।

কিন্তু না, ঠেলে তো ফেলল না, সেরকম কিছুই ঘটল না। বরং অনুভব করেছিলাম, ও যেন আর একটু কাছে টেনে নিয়েছে। ঘন শ্বাস, ওর মুখের কোনও অংশ আমার মুখে কি—? জানি না। তাকাইনি। বলতে পারব না।

এবার সত্যিই বুঝি বুলা আমাকে একটু ঠেলে দিল। ওর চকচকে চোখ যেন টর্চের মতো, আমার মুখে ফেলতে ফেলতে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল, “হল না। তুই চোখ বুজে ফেলিস কেন রে? অন্ধ নাকি? আমার গা-টা তাই কেমন করে উঠল। হঠাৎ মনে হল, অন্ধ ছেলেকে চুমু খেলে, জানিস, আমার কেমন মনে হয়, বুঝি অন্ধ হয়ে যেতে হয়, বুঝি গান্ধারী যা হয়েছিল। অবিশ্যি গান্ধারী করেছিল বিয়ে। চুমু তো আর খায়নি!”

গোল ঘড়িটায় তখন সময় দেখাচ্ছিল পৌনে ছ’টা।

আমাকে ছেড়ে দিয়ে বুলা বলল, “মার সময় হয়ে এল। চল এবার যাই।”

নেমে এলাম দু’জনে; রাস্তা পার হলাম। ওদিকে ঢালু জমি, বিছানো ঘাস। রাস্তা পার হবার সময় বুলা আড়চোখে বুড়ো পানওয়ালাটাকে দেখে নিল। সত্যিই পর পর অন্তত দুটো কুলপিওয়ালা আমাদের সেধে গেল। পাহারাওয়ালারাও ছিল দূরে দূরে।

কেল্লার উপর ভূতুড়ে খুঁটিগুলো টকটকে চোখে চেয়ে আছে। ঘাড় উঁচু করে দেখে বুলা বলল, “ওই দ্যাখ, ওরাও পাহারাওয়ালা, ওরাও নজর রাখছে। ফাঁকি দিয়ে মা পালাবে কোথায়?”

ঘড়ির কাঁটা ঘুরে গেল। সাড়ে ছয়। গঙ্গার বুকে এপার-ওপার কারা আলোর দু’নরী হার পরিয়ে দিল। একটা মোটরলঞ্চ চারদিকে বিস্মিত আলো ফেলে ফেলে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

বুলা বলল, ‘জ়ল পুলিশ ওরা। আমরা দু’জনও ঠিক যেন গোয়েন্দা না রে? ডিটেকটিভ গল্পে যেমন পড়েছি। খুনি ধরব বলে ফাঁদ পেতে দাঁড়িয়েছি—তোর রোমাঞ্চ হচ্ছে না? বলে বুলা আমার হাত ধরল। “অবিশ্যি ঠিক খুনি বলা যায় না। তবে খুনির চেয়েও খারাপ–ফেরারি। নিজের মেয়েকে ফাঁকি দিয়ে ফেরারি।”

ঘড়ির কাঁটা ঘুরছিল। হঠাৎ খানিকটা ধুলো উড়ে গঙ্গার গলার হারের সব ক’টা আলোকে লালচে করে দিয়ে চলে গেল। বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে দেখে আমি ভয় পেলাম। ফুচকাওয়ালারা ঝুড়ি-ঝাঁপি গুটিয়ে সরে পড়তে শুরু করেছে। ভাঙা আসরে যে যা পারে বেচে দিয়ে খালাস হতে কুলপিওয়ালাদের মরিয়া হয়ে ছুটোছুটি। তাদের ডাকাডাকি এখন খুব করুণ—কাতর আর্তনাদের মতো।

আমি ভয় পেলাম। বললাম, “এই! আমি যাই। সন্ধ্যা উৎরে গেল। বিকেল থেকে বাড়ি ফিরিনি।”

বুলা আমার হাত তো চেপে ধরলই, পাও জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ে বলল, “যা তো দেখি। তুই না ছেলে? তুই পুরুষ, না কাপুরুষ। আমাকে ফেলে পালাবি? এই তোর রীতি?

(মা, আজ সবই যখন একেবারে হৃদয় খুলে ঢেলে দিচ্ছি, কোনও আড়াল কোনও লজ্জা সংকোচ রাখিনি, তখন স্বীকার না করে পারছি না, বুলা, প্রগলভ বুলা, সেদিন কিন্তু অব্যর্থ ব্রহ্মবাক্য উচ্চারণ করেছিল। আজ ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়, যেন-দিব্য দৃষ্টিবলে সে বলে দিয়েছিল আমার ভবিতব্য। হ্যাঁ, ওই আমার রীতি। পরে হয়েছিল। বারে বারে। কাপুরুষতার পৌনঃপুনিকতায় বহুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কলঙ্কিত। কেবলই ফেলে পালিয়েছি। কেন? কেন আবার। গা বাঁচাতে। যঃ পলায়তি স জীবতি। যে পালায় সে বাঁচে। বাঁচে? আমি কি বেঁচেছি?) ঘড়ির বড় কাঁটা ঋষির মতো এক হাত সোজা উপরে তুলে দেখিয়ে দিচ্ছিল—সাতটা। পুরোপুরি সাত্। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হল। মনকে বললাম, ‘যা হবার তা হবে। থেকে যাই শেষ পর্যন্ত দেখি। আজ তো পরীক্ষা শেষই হয়ে গেল, বাড়ির কড়াকড়ি ঢিলে, মা আজ কিছু বলবে না। বললেও বলব বন্ধুদের সঙ্গে টকি দেখে ফিরছি।’

কিন্তু বুলাই বলল, “চল। আর না। আজ এল না।” ওর কথার সঙ্গে যা মিশে বেরিয়ে এল, আমাকে ছুঁলো, সেটা শ্বাস, না বাতাস? বুলার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। ফোঁটা ফোঁটা জল, সমস্ত মুখ ভিজে। তবু জোর করে বলতে পারি না কান্নার ফলে ও-রকম চেহারা হয়েছিল কিনা। বৃষ্টির জলেও হতে পারে।

জোর জোর পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল বুলা, অনেক দূরের নিয়ন বাতি লক্ষ্য করে। পাশাপাশি চলতে আমাকে বেগ পেতে হচ্ছিল দস্তুরমতো।

“আজ এল না”, বুলা বলছিল কাকে? হয়তো নিজেকেই—”কাল আসবে। কাল আসব। রোজ আসব। যতদিন না পাই। নিস্তার নেই। এদিকে না পাই তো ওদিকে যাব—ওই বুরুজটার ওদিকে, যেখানে সামনে অনেকটা খোলা জায়গা, প্রিন্সেপ ঘাট। সেখানে দেখব। একদিন দু’দিন। না পেলে চলে যাব আরও দক্ষিণে”–বুলা একটু দাঁড়িয়ে হাতের আঙুল হিসাব করে দেখল—”কবে যেন শনিবার? পরশু, না তার পর দিন? সেদিন আরও দক্ষিণ দিকে যাব, রাস্তাটা বেঁকে গিয়ে যেখানে রেসের মাঠ।”

“তুমি সব চেনো?’

“তোকেও চেনাব, আমার সঙ্গে ক’দিন ঘুরবি, ব্যস। তোকে চিনিয়ে দেব। মার বন্ধুরা ওকে যেমন চিনিয়েছে। ফী-শনিবার ওর ঘোড়দৌড়ের মাঠে আসা চাই।”

“তু-তুমি অতো চিনলে ক-কী করে?’, নিজে থেকেই তোতলা হয়ে যাচ্ছিলাম।

(তুমি জানো, ওটা আমার পুরনো রোগ, সেরে যায়, আবার সময় বিশেষে ফিরে ফিরে আসে। লোকে বলে, তোতলামিটা অভ্যাস বই কিছু নয়। কথাটা ভুল, ওটা বাগ-জড়তার চেয়ে কিছু বেশি—বলা যায় স্বভাবেই নিহিত। এক-একটা সংকটে যেমন বুদ্ধি লোপ পায়, অনেক সংকটে তেমনই কথা। তখন তোতলামি আসে আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকে। সংকট বা বিপদ মানুষকে নিয়ে দু’রকম খেলা খেলে—লুডোর দু’দিকে দু’রকম দান পড়ার মতো—কারও উপস্থিত বুদ্ধি উবে যায়, কেউ তখনই হঠাৎ ভীষণ তুখোড় হয়ে ওঠে। কারও কথা জড়িয়ে যায়, কেউ-বা আল্ট-সাল্ট যা মনে আসে বলে যেতে থাকে। সেদিন আমি যে এক একটা শব্দের উপরে হোঁচট খাচ্ছিলাম, তার কারণ আমার হীনম্মন্যতা; বুলার পাশে নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছিল।)

“চিনলাম কী করে? বুলা যে চালু মেয়ে, শুনিসনি? ওই মারই এক বন্ধু একবার নিয়ে এসেছিল, সে এক মজার ব্যাপার। মা তো গেছে অরিন্দমের সঙ্গে, তখন দেবপ্রিয়-না-কী-যেন-ওর নাম, সে এসেছে। মা নেই? মা নেই তো মেয়েই সই, হিহি, এখানে আমাকে নিয়ে এল, শরবত খাওয়াল, রেলিংয়ের ধারে দাঁড় করিয়ে, হুফ হুফ হুফ, ঘোড়ার খুরে কত যে ধুলো ওড়ে দেখিয়ে দিল, বাস রে! কী তেজ এক-একটার ঘোড়ার—ইয়া-ইয়া উঁচু বাদামি বা কালচে-বাদামি মাজা মজবুত শরীর, যেন তেল চুইয়ে পড়ছে, হ্যাঁ শক্তি ওকেই বলে।”

চোখ বুজে বুলা বুঝি শক্তিমান, দ্রুতধাবমান দু’একটা রেসের ঘোড়াকে ধ্যানে অনুভব করে নিল। আমি আরও বোকার মতো হয়ে যাচ্ছি।

সামলে উঠে বুলা বলল, “যাক, এই রেসের মাঠেই সেদিন মা-মেয়ে মুখোমুখি চোখে চোখে কোলাকুলি—কী যেন, হ্যাঁ, সেয়ানে-সেয়ানে। তারপর আর-একদিন আমি জানালায় দাঁড়িয়ে, অরিন্দম রায় মাকে “টা-টা” বলে চলে যাচ্ছে, জানালায় আমাকে দেখে একটা চোখ ইসক্রুপের মতো করে হাসল। মাও লক্ষ্য করেছিল সেটা। সেটা থেকে শুরু। বোধহয় ভয় পেল, আমাকে আটকাতে পারবে না, তার চেয়েও ওর পক্ষে যেটা ভয়ের— আটকে রাখতে পারবে না ওর বন্ধুদের। ফ্রক-ট্রক পরিয়ে রেখে আর কতদিন। ফ্রক ছাড়ালেও ওর মুশকিল কিছু কম নাকি! ফ্রকেই বরং চাপা পড়ে কম—ওর বন্ধুরা যা-সব এক-একটা যুধিষ্ঠির। এই রকম দু’চারটে ঘটনা—” বুলা বলেছিল—”মা তাই তো ভয় পেল। ওর ভেতরটা উঠল গুরগুর করে, বদহজম হলে পেটের মধ্যে যেমন শব্দ হয়।”

“কিন্তু”, একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বুলা ঘাসে পা ঘষে ঘষে বলল, “ওই ধরনের হিংসুটে তো হয় ছেলেরা, হুলো বেড়াল যেমন শুনেছি বাচ্চাদের খেয়ে ফেলে। কিন্তু মা বিড়াল কি নিজের বাচ্চাকে—মা তো নয়, ও রাক্ষসী। রাক্ষসী আমার মা, বলল, ‘হা-হা’।”

‘হি-হি’কে প্রসারিত করে বুলা এবার বলল ‘হা-হা’।

গোল চক্করের পর চক্কর পেরিয়ে আমরা প্রায় সেই পার্কটার কাছে এসে পড়েছিলাম, যার ওপাশে ট্রামগুলো ঘুরে ঘুরে নানা দিকে আবার বেরিয়ে পড়ে। তারই কাছের চৌমাথায় নানা নম্বরের বাস সওয়ারীর জন্য হাঁকাহাঁকি করে।

বুলা বলল, “আয় -দোতলায় বসি”, বলেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল তরতর করে, একটু পরে সামনের আসনটাতে আমরা পাশাপাশি। ঝলকে ঝলকে হাওয়া এলোমেলো করছিল ওর রেশমি চুল, ওর রেশমি চুল লেগে লেগে এলোমেলো করছিল আমাকে, ওগুলো কি চুল, নাকি সরু সরু বিদ্যুতের তার, চমক, চমক; চমক নয়, সুড়সুড়ি; না, সুড়সুড়িও না—একটা আবেশ; নতুন কাপড় পরার মতো, নতুন বইয়ের পাতা নাকের কাছে নিয়ে এসে গন্ধ পাওয়ার মতো—কিন্তু আমার কী হচ্ছে বুলা তা টের পাচ্ছিল না।

সে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল। পিতলের রডে গাল রেখে। গালে বৃষ্টির ছিটে লাগছে। সেই বুলা, চালু বুলা, এখন আলাদা হয়ে গেছে। খুব আস্তে আস্তে বলছে, “জানিস, আমার বাবা ও-রকম ছিল না, মার মতো একটুও না। বাবা, মানে আমার আসল বাবার কথা বলছি।”

“মনে আছে?”

“একটু-একটু। চেহারাটা মনে নেই, চশমাটা মনে আছে। গোল ধরনের মুখ, চোখ দুটো মস্ত। কাগজে. যাদের ছবি ছাপা হয়, সেই লিডারদের কারও কারও সঙ্গে যেন মিলে যায়; ফোটো নেই তো, মা নিয়ে আসেনি, তাই প্রত্যেকটা নামকরা মানুষের ছবি দেখলেই উপুড় হয়ে পড়ি—আমার বাবা বুঝি ওইরকম ছিল আবছা মনে পড়ছে শুধু। আমাকে বুকের ওপরে শুইয়ে ঘুম পাড়াত, কাতুকুতু দিয়ে হাসাত, একবার সোনালি চাকতির মতো কী-একটা মিষ্টি জিনিস খেতে দিয়েছিল—এইসব টুকরো-টুকরো ব্যাপার আর কী। জোড়া লাগবে কী করে, মা যে আমাকে ছিঁড়ে নিয়ে এল, বোঁটাসুদ্ধু। কেন আনল, কেন আনল ও,—বাবা তো একটাই ছিল, তাকে সরিয়ে দিল, কিন্তু নতুন কিছু তো দিল না!—বরং—মা ও তো একটাই—তাকেও, কেড়ে নিল। নিজেকে কেড়ে নিল নিজেই। আমি, আমি, আমি, এখন,–”

বুলা শেষ করতে পারছিল না। মা, আজ এ-কথা বলায় কোনও নির্লজ্জতা নেই, আমি তখন ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিলাম। ওর হাতের তালুতে ঘাম, আমি আমার সবটুকু অনুভূতি দিয়ে সে-সব শুকিয়ে দিতে, শুষে নিতে চাইছিলাম।

.

আমি ওদের দেখতে পেলাম। সেদিন নয়, তবে কবে? মা, এই চিঠিতে দিন তারিখ মিশিয়ে নিও না। ওইটুকু মনে আছে যেদিন ওদের দেখতে পেলাম, সেদিন বুলা ছিল না। হয়তো সে-ও এসেছিল, আমি তাকে দেখতে পাইনি।

বাবুঘাটে সেদিন জোর সংকীর্তন চলছিল। ঢোলক বাজিয়ে। স্নান করে দলে দলে লোক ফিরছিল, থপথপে পুরুষ আর থলথলে মেয়েরা।

(কারা নিত্য গঙ্গাস্নান করে? বুলা সেদিন কী একটা বলেছিল না? বলেছিল ‘যারা পাপী’, তারাই। “বেশ্যা”, আর “বদমাশ”, এই দুটো শব্দ সে উচ্চারণ করেছিল। বিশ্বাস করিনি। ওর সবটাই বিকৃত দৃষ্টিতে দেখা, তাই বিশ্বাস করিনি।)

কিন্তু আমার নেশা ধরেছিল, আমি রোজ আসতাম। ওদের সঙ্গে যেদিন দেখা হল, সেদিন কিন্তু বুলার দেখা পাইনি। জর্দা-পান আর কুলপির বিষয়ে ও বড় বেশি নিশ্চিন্ত ছিল কিনা! কী জানি, কী ভেবে আমি সেদিন ইডেন গার্ডেনের সামনের দিকে দাঁড়ালাম। এখান থেকেও জ্বলজ্বলে ঘড়িটা দেখা যায়—ছ’টা বেজে যখন কুড়ি, কাঁটাটা লাফিয়ে একুশ ছোঁবে-ছোঁবে, তখন হঠাৎ দেখতে পেলাম। আমার শেষ চিনেবাদামটার খোলা আর ভাঙা হল না।

দেখলাম : ট্যাক্‌সি নয়, একটা ফিটন। তক্ষুনি ওখানে এসে দাঁড়ালাম। ছায়ার মতো কারা ফিটন থেকে নামল। আমি চিনলাম। ছায়ার মতো আমিও ওদের পিছু নিলাম। আমি টিকটিকি, জায়গাটা যাকে বলে অকুস্থল, অকুস্থল—আসামীদের ঠিক ধরে ফেলেছি।

(বুলা, তুমি আজ কোথায়)

ওরা প্যাগোডার পাশ কাটিয়ে লিলিপুলের দিকে গেল, সেই ছায়ারা! ঝাউ কিংবা পাইন গাছগুলি ছায়া ধার দিয়ে সেই ছায়াদের আরও ছায়া হয়ে যেতে সাহায্য করছিল। চিনে নিয়েছিলাম। একজন লীলা মাসিমা। আর-একজন…হতেই হবে অরিন্দম রায়। তৃতীয় জন কে?

১৬

তাকে চেনা যাচ্ছিল না। যাচ্ছিল না বলেই আমি দূর থেকে চমকে উঠেছিলাম, আমার চেনা এক-একটা মানুষের কায়ার আকার-প্রকার, বেধ-ব্যাস-উচ্চতা প্রভৃতির সঙ্গে আন্দাজে মিলিয়ে ফেলে কষ্ট পাচ্ছিলাম।

মা, তখন থেকেই এই দেখার ভুল আমার একটা রোগ, জানো? যেখানে চিত্রটা অস্পষ্ট সেখানেই অদ্ভুত-অসম্ভব সব কল্পনা পেয়ে বসে। কী-জানি ওই রোগটা হয়তো-বা ওই বয়সের—আকাশের ছড়ানো মেঘে জলহস্তী-টস্তী জাতীয় চিরন্তন ছবি তো বটেই, কখনও বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সাঁওতালি মা, কখনও পরম-প্রাজ্ঞ মহীয়ান কোনও সন্ন্যাসী অথবা অশ্বারূঢ় সৈনিক, এ-সবও মামুলি। তার চেয়েও রোমাঞ্চ হয় যখন আকাশে দেশ-মহাদেশ, দ্বীপ-উপদ্বীপ, রাঙামাটি-কালোমাটিতে গড়া পৃথিবীর মানচিত্রের প্রতিফলন দেখি। সেই চিত্রও বেশিক্ষণ স্থির অথবা, অর্পিতবৎ থাকে না, ক্রমাগত বদলায়, দু’টি দেশ আরও কাছাকাছি হয়, মহাদেশগুলি পরস্পরের হাত ছাড়িয়ে দূরে দূরে সরে পড়ে ছড়িয়ে পড়তে চায়, রঙে-রেখায় এই সব মায়া বিস্তারিত হতে থাকে, কদাচ সেই প্রকাণ্ড পটে বিপুল এক-একটি পুষ্পও ফোটে, এ-সব আমরা কে-ই বা না-দেখি, অন্তত আমি তো দেখতাম। ভাবতাম আমাদের উঠোনে-বাঁধা পালিত আকাশটুকুতেই যখন এইসব ঘটছে তখন যে-মহাশূন্য আরও দূরের অরণ্য, উদ্দাম এবং বন্য, সেখানে ঘটছে না-জানি আরও কত-কী। দেশ-মহাদেশ আলোর গঙ্গা-যমুনা ক্ষণে ক্ষণে দিক, সীমা ইত্যাদি সব অস্থিরভাবে ভেঙেচুরে-গুঁড়িয়ে নিচ্ছে, সহস্র-দল এক-একটি মহাকুসুম বিকশিত হয়েই দিকে দিকে ব্যাপ্ত-বিকশিত অবশেষে বিদারিত হয়ে যাচ্ছে।

সেই চমৎকার ভ্রান্তিরই খানিক ঘটে যখন মাটিতে দাঁড়িয়েও একটু দূরের জিনিসও বুদের মতো অর্ধব্যক্ত দেখি। ভয় হয়, কষ্ট হয়। কষ্টটা মেলাতে না পারার, ছাঁচে ঢালতে না পারার, সাদা দুধ গ্লাসে ঢালব, তবেই তো নিশ্চিন্তে পারব চুমুক দিতে! খুব কষ্ট হয়, কাঁটা ফোটে, সেদিনও ফুটছিল, তৃতীয় ছায়াটিকে আমি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম বলে। এ-রকম হয় এখনও, যখন যন্ত্রসঙ্গীত শুনি! যে-গানে কথা আছে, তার তো ভাব-সুর-বাণীসমেত সবই বোঝা গেল, কিন্তু যন্ত্রসঙ্গীত? যখনই বাজে মনে হয় গানটা যেন জানি, অথচ ধরতে পারছি না, ধরা দিতে দিতে ফসকে যাচ্ছে কোন্টা, কোটা? একই সুরের তিন-চারটে গান মনে ভেসে ওঠে, তবু পুরোপুরি কোনও একটা খোপে পুরতে পারছি না, জানা-না-জানায় মিলে বিষম বিভ্রম, চোরা পোকার মতো একটা যন্ত্রণা কুটকুট করে হুল ফোটায়।

তৃতীয় ছায়াটিকে নিয়েও সেই যন্ত্রণাই হচ্ছিল সেদিন। কে-কে-কে। ওরা একটা ঝিলের পাশে বসেছিল, জলে লোকে ডুব দেয়, কিন্তু জলটাই ডুবে গিয়েছিল অন্ধকারে, উপরের কোনও তারা কিংবা বিজলি বাতির ছায়া পড়ছিল ভাগ্যিস, ঝিলের জলে সাপের মাথার মানিকের মতো জ্বলছিল।

খলখল হাসি, শুনতে এমন বিশ্রী লাগছিল! একটা বাদাম বেচতে-আসা বাচ্চাকে ওদের একজন মারবে বলে হাত তুলল, আর ঢিল কুড়িয়ে নিল আর-একজন—সে কে?

চিনেছিলাম। অনেকখানি ঘাম একসঙ্গে কুলুকুলু হয়ে হঠাৎ চেনাটাকে জবজবে করে দেয়। ঢিল কুড়িয়ে নিয়ে তৃতীয় ছায়াটা বাচ্চাটাকে তাড়া করে বেশ খানিকটা ধেয়ে এল বলেই মুখ দেখা গেল তার—চিনলাম।

মা, তোমারও খুব কষ্ট হবে, না-না, কষ্ট কেন, তুমি তো এখন সব দুঃখ কষ্টের বাইরে, নইলে হয়তো হত।

.

লীলামাসি মাঝে মাঝেই খলখল হাসছিল, একবার তৃতীয় ছায়াটিকে উদ্দেশ করে বলল, “যান না মশাই, ক’টা মালাই কিনে আনুন, দেখবেন, বেশি সিদ্ধি যেন না-থাকে, ভাঙ খেলে আমার মাথা ঘোরে” – বলে ঘোরানোটা বোঝানোর জন্যেই লীলামাসি যেন ঘাড়টা ঘুরিয়ে একটু তুলে ধরল, তখন ওর মুখে আলো, পেইন্‌ট করে নিশ্চয়, রঙটা কী উৎকট, লীলামাসি স্টেজে নামবে, সেটা একেবারে ঠিক হয়ে গেছে নাকি, এখন থেকেই কি তাই পেইন্ট করতে শুরু করেছে?

ছায়ার হাতে কী গুঁজে দিল অরিন্দম, বোধহয় টাকা-ঠাকা, ছায়া নড়তে নড়তে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে চলে গেল। চিনেছিলাম।

কলহাস্যে পিছন থেকে লীলামাসি বলে উঠল কিনা, “যান, যান, দৌড়ে যান, ফিরে আসবেন কিন্তু চটপট, দেরি হলে অরিন্দমবাবু চটবেন, আপনার নাটকটা তাহলে আমরা আর নিচ্ছি না।”

ছায়া সামনের দিকে ঝুঁকছে বলে একটু কুঁজো এখন, সত্যিই দৌড়চ্ছে নাকি, কিন্তু ঈশ্বর, হে ঈশ্বর আমি ওর একটা লেজও দেখতে পাচ্ছি কেন! তোমাকে তো বলেছি, মা, আমার এই রকম অসম্ভব সব দেখার ভুল তখন থেকেই হয়!

লীলামাসি শাড়িটা ঘাঘরার মতো ফাঁপিয়ে বসে পড়ে একটু নিচু হয়ে সে—কী?—বোধহয় চোরকাঁটা বাছছিল।

“তুমি লোকটাকে নাচাচ্ছ কেন বলো তো! বোকা আধপাগলা লোকটা সেই থেকে ছিনে জোঁকের মতো লেগে আছে”, গলা যখন পুরুষের তখন নিশ্চয়ই অরিন্দম বলছে, “ও কিন্তু সত্যিই ধরে বসে আছে আমরা ওর নাটকটা নামাব, হাঃ হাঃ।”

“নাটক? তুমি ওগুলোকে বলছ নাটক? পালাগান তো ওগুলো, স্রেফ যাত্রা, প্যান-প্যানানি একদম। ক’টা শুনিয়েছে যেন? এক—দুই তিন–চারটে। বাস্ রে, মাথা ধরে যায়?” একমুঠো লম্বা ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে লীলামাসি বলল।

“তবু তো তুমি শোনো। “

“মজা লাগে যে।”

“আমাদের আজকের মজাটা কিন্তু মাটি করে দিলে। কমিক ফিগার—লোকটা একটা আস্ত বাফুন।”

লীলামাসি একটা ঘাস কামড়ে বলল, “থুঃ”, ঠিক ভামতী যেভাবে ফেলত।

ছায়া ফিরে আসছে তড়বড় করে, আমার চোখ জ্বালা করছে, ওকে দেখতে চায়ের দোকানের ‘বয়’-এর মতো লাগছে কেন, ভগবান আমার চোখ দুটো অন্ধ করে দাও, ভাবছি আড়াল থেকে বেরিয়ে আসি আমি, ওর পথ আগলে দাঁড়াই কিংবা লুটিয়ে পড়ে বলি, “যেও না, ওদের কাছে যেও না, এমন চাকরের মতো করছ কেন, তুমি—তুমি না সম্ভ্রান্ত, শিল্পী না তুমি? ওরা তোমাকে নাচাচ্ছে, ওরা বিরক্ত হচ্ছে, মজা পাচ্ছে, তুমি যেও না।”

মনে মনে “পিতা হি পরমন্তপ” সেই মুখস্থ শ্লোকটি আওড়াচ্ছি, আর দেখছি সেই ছায়া আমার পাশ কাটিয়ে ওদের ওখানে হাঁটু গেড়ে বসল, অন্ধকার ওর গায়ে যেন লোমের কোট পরিয়ে দিল, অন্ধকার ওকে ভাল্লুক করে দিল নাকি, ছায়াটা কি এবার ভাল্লুকের মতো নাচতেও শুরু করবে?

ভীষণ কষ্টে বোবা আমি ডুগডুগির বাজনাও শুনতে পাচ্ছি।

.

বেশ খানিকক্ষণ পরে ওরা আর-একটা ফিটন ডেকে যাত্রা করল, কিন্তু দেখলাম সেই অনুগত ছায়াকে সঙ্গে নিল না। অথবা গেল না সেই। লীলামাসি একমুখ হাসি হেসে বিদায় নিল।

তখন ছায়া আর আমি সামনাসামনি। সরে যাওয়ার সময় পাইনি। সে আঁতকে উঠল, ভূত দেখল যেন, তার মুখ শুকিয়ে গেছে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু কিছু বলল না, ধমক না, হাতছানি দিয়ে ডাকাও না, চিনতে পেরেছে যে, তার কিছুমাত্র ওই নির্বাক মুখমণ্ডলে ছিল কি? সে হঠাৎ পিছন ফিরে হনহন ঘুরে উলটো দিকে চলতে শুরু করেছে, দেখতে পাচ্ছি।

এবার আমিই ছায়া হয়ে পিছনে।

আবার পাশাপাশি, ট্রাম যেখানে ঘোরে সেইখানে। হাইকোর্টটা রাত্রে মন্দিরের চূড়া হয়ে গেছে। ঘাট থেকে এই অবধি ফুটপাথে সারি সারি ভিখারি, লোকজন বেশি নেই, তবু নিতান্ত অভ্যাসবশতই ওরা “দান করে যান বাবু, পুণ্য হবে, পুণ্য হবে” বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে।

আমার পাশের উনি আড়চোখে আমাকে দেখছেন। তখনও কথা নেই। একটা ট্রাম ঢংঢং আওয়াজের ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা সাফ করতে করতে এগিয়ে আসছে, তিনি করলেন কী, হঠাৎ পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমার হাতে গুঁজে দিলেন একটা গোল চাকতি, যেটা, অনুভবে বোঝা গেল, শক্ত, ঠাণ্ডা, কোনও ধাতুর। তৎক্ষণাৎ তিনি হাতল ধরে উঠে পড়েছেন ট্রামে, অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে আমিও—পিছনের ক্লাসটাতে।

মুঠো খুলে দেখি, একটা সিকি।

মা, তখন আমার বয়স কত আর–পাকা কিংবা পচ্-ধরা, ঝুনো কিংবা পোড়খাওয়া তো হয়ে যায়নি! তবু আমি চট করেই বুঝে ফেলেছি ওই সিকিটার মানে কী। সিকিটা মানে আমার মুখ সেলাইয়ের ছুঁচ, সিকিটা ‘ঘুষ্’ বাড়ি গিয়ে কিছু যেন ফাঁস না করি, আগাম দাম তারই।

.

বাবার সঙ্গে ওই সময় থেকে আমার একটা সমঝোতা হয়ে গেল। পারস্পরিক একটা বোঝাপড়া। ধূর্ত, নিঃশব্দ একটা লুকোচুরি চলেছে আরও বেশ কয়েকবার। ওঁর উপরে একটা অদৃশ্য জোর পেয়ে গেছি; পরে জেনেছি, বিদেশি ভাষায় একে বলে ব্ল্যাকমেল সুবিধা পেলেই শুধু শুধু চোখে চোখে কথা, পরে নির্লজ্জের মতো আমিও হাত পেতে ধরতাম—সেখানে পড়ত নির্বাক দু-আনি, সিকি, আধুলি।

ভিখিরি, সব ভিখিরি।

ওই ঘটনার কথা কখনও ফাঁস করিনি। আজ তা অমাবস্যার রাত্রে কবর খোঁড়া মড়ার খুলি-টুলি বেরিয়ে পড়লেই বা কী ক্ষতি।

“আমি চলে যাব”, খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে বুলা বলল।

কাঠের যে সিঁড়িটা বুড়োর মতো নড়বড় করতে করতে দোতলা পর্যন্ত এসেছে সেই আবার দোতলা থেকে বাচ্চা ছেলের মতো হামাগুড়ি দিয়ে উঠে গেছে ছাদে, যেখানে চিলেকোঠা, আর-একটা শেভ্ তুলে এ-বাড়ির “লেসী” সপরিবারে মুফতে বাস করে।

সেদিন তারা কেউ ছিল না। দরজায় তালা দিয়ে কোথায় বেরিয়ে পড়েছিল। কলেজের খাতায় নাম ভর্তি করে এলাম, তোমার মনে আছে, যাওয়ার আগে-পরে দু’বারই তোমাকে প্রণাম করেছিলাম?

মন হালকা ছিল, ছাদে ওঠার সিঁড়িটা তাই হাতছানি দিয়ে ডাকল। জানতাম না সেখানে থাকবে বুলা।

আজ বুলার চেহারা আলাদা, খোলা চুল, তখনও ভিজে, বোধহয় খানিক আগে স্নান করে থাকবে। কার্নিসে পিঠের দিকটা রেখে সে খোলা চুল বাইরে ছড়িয়ে দিয়েছিল, কানের কাছের কয়েক গাছি ইতিমধ্যেই রোদে শুকিয়ে হাওয়ায় উড়ছিল।

কাছে এসে দেখলাম বুলার চোখের পাতাতেও জল, চিকচিক করছে। হয়তো সবে স্নান করেছিল বলে, হয়তো খাটো ফ্রকের বদলে কচি রঙের শাড়ি পরেছিল বলে, বুলাকে খুব স্নিগ্ধ, নম্র লাগছিল, ওর পায়ের কালচে ছোপগুলো ঢাকা ছিল, চোখেও সুর্মা-টুর্মা ছিল না, সে-কারণে, অথবা তথাপি, তাকে গভীর আর আয়ত-দৃষ্টি করে তুলেছিল। ছাদের তুলসী গাছটা থেকে তাজা কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে আমি নাকের কাছে ধরেছিলাম, বুলাকে অতএব মনে হচ্ছিল তখনই ওই প্রণম্য তুলসীর মতো পবিত্ৰ।

কোন্ কলেজ, কী পড়ব,

(আর্টস পড়বি, ওমা, ছেলে হয়ে তুই—সে কি! অঙ্কে মাথা নেই বুঝি? আমার কিন্তু সায়েন্সের ছেলেদের দেখতে খুব ভালো লাগে, পুরুষদের পক্ষে ওটাই মানানসই, পরে যারা হয় মেডিকেল স্টুডেন্ট গলায় ঝোলানো বুক পরীক্ষার সেই যন্ত্রটা, ভারী স্মার্ট, কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং— ফিটফাট।)

এই ধরনের মামুলি কয়েকটা কথায় কথায় রোদ তেজ ফুরিয়ে ফেলছিল, সুন্দর, গুঁড়োগুঁড়ো হলুদ বুলার মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছে, একেই আভা, না শোভা, না কী যেন বলে? ওর মুখের বন্ধুর ব্রণগুলো মুছে মসৃণ হয়ে গেল কী করে?

“আমি চলে যাব”, বুলার ছায়া যখন বেয়ে বেয়ে আমার বুক পর্যন্ত উঠেছে, তখন আধো-উদাস ভাবে সে ঘোষণার ভঙ্গিতে উচ্চারণ করল “আমি চলে যাব। “

“কোথায় বুলা, কোথায়?”–জিজ্ঞাসা করতে হল না, নিজেই সে বলল, “কোথায় ঠিক করিনি। আর কোথাও যদি জায়গা না হয়, তবে একটা অরফ্যানেজে।”

আমি কিছু বুঝতে পারছি না, চেয়ে আছি বুলার মুখের দিকে, অস্পষ্ট জড়ানো অক্ষরে লেখা চিঠি পড়তে না পেরে লোকে যেমন বোকার মতো চেয়ে থাকে, বুলা তখন বলল, “যার বাবা নেই, মা পালিয়েছে, তারা কোথায় থাকে? অরফ্যানেজে—অনাথ আশ্রমে। তাই না? তুমিই বলো।

একটু এগিয়ে এসে সে আমার কাঁধে হাত রাখল। সেই ছোঁয়ায় মুখরতা ছিল না, অন্য অন্য দিন যা থাকত, কড়ার মতো ছ্যাঁক করে উঠল না শরীর, বরং একটা শীতল জলের ধারা কাঁধ থেকে কণ্ঠনালীতে, সেখান থেকে বুকে। আবার ওদিকে পিঠে শিরদাঁড়া বেয়ে বেয়ে নামতে থাকল। “তুমিই বলো”–বুলা এই প্রথম আমাকে ‘তুমি’ বলল। ওকে বললাম না যে, লীলামাসিকে আমি দেখতে পেয়েছিলাম। তার ঠিকানা হয়তো আমার বাবাও জানেন। বললাম না, যেহেতু বলতে মাথা হেঁট হয়ে যেত।

“চলে যাবে কেন, বুলা”, আমি চটকানো পাতার সবুজে চিত্ত ভরপুর করে বললাম, “চলে যাবে কেন। এখানে তো এখনও তোমার—” ওখানেই থেমে যেতে হল। সতীশ রায় নামক অকিঞ্চিৎকর ব্যক্তিটিকে সব জেনে ‘তোমার বাবা’, বলতে বাধছিল।

“এখানে আমার আর জায়গা নেই”, বুলা, শান্ত-সংযত, বিষাদে শ্রীমণ্ডিত বুলা বলল, “নীচে আমাদের ঘরে ক-দিন হল লোকজনের সাড়াশব্দ পাচ্ছ না?”

“পেয়েছি। কারা এসেছে?”

“ওই লোকটির বউ। না না, হেঁয়ালি করছি না। ওর বউ আছে, যাকে ও ছেড়ে এসেছিল। সেই বউ তার এক বোনপো না কী-এক সম্পর্কের কাকে নিয়ে চলে এসেছে। ও নিজেও নিয়ে আসতে পারে।”

একটুও উত্তাপ নেই, বুলা বলে চলেছে, “ওকে দোষ দিই না। মা তো ছেড়ে গেছে ওকেও! যে-পাড় ছেড়ে ভেসে পড়েছিল, মাঝগঙ্গা থেকে সাঁতরে সাঁতরে সেখানে ফিরে গেল। ওর দোষ কী, নইলে যে ওকে ডুবতে হত। লোকে আগে নিজেকে তো বাঁচাবে।”

বুলা একটি শরীরিণী ক্ষমা হয়ে গেছে, ক্রমেই বিস্তীর্ণ হচ্ছে। ওর অপার্থিব বিস্তারে আমার সম্মুখের আকাশ আড়াল হয়ে যাবে।

“আমিও নিজেকে বাঁচাব”, বুলা ধীরে ধীরে উচ্চারণ করছিল, মাথা নিচু করে লোকে যেভাবে পুঁথি পড়ে, সেইভাবে “হার আমি মানব না।…স্কুলের উর্মিদি আমাকে সাহায্য করবেন বলেছেন। প্রথমে উঠব ওঁর ওখানে। ওঁর চেনাশোনা আছে, বলেছেন যতটা পারেন সুযোগ করে দেবেন।” এই পর্যন্ত বলে একটু হাসল বুলা, হাতের পাতা যেন আয়না, সেখানে শেষ বেলার রোদটাকে প্রতিফলিত দেখতে দেখতে নিজেই বলল, “ভেবো না। হয়তো সত্যি সত্যি অরফ্যানেজে যেতে হবে না। দাঁড়াতে পারব। আর সেদিন—” উদ্দীপ্ত হয়ে বলে উঠল বুলা, ওর মুখে ছায়া আলো, আলো-আর ছায়া খেলে যেতে থাকল, “দেখো, আমার মা-ও হয়তো আমার কাছে ফিরে আসবে। যখন আমার খুব নাম হয়েছে, দেশ জুড়ে সারা বছর ‘শো’-এর পর ‘শো’, করছি, তখন—বলা তো যায় না। তখন আমাকে দেখার জন্যে টিকিট ঘরের সামনে লম্বা লাইন, হল ভর্তি—বলা তো যায় না। তখন হয়তো একদিন হঠাৎ দেখব, মা, অবাক হয়ে বসে আছে একটা সিটে, আর তুমি—তুমিও আর-একটা আসন থেকে ঘন ঘন হাততালি দিচ্ছ।”

বুলা থামল। হাত উঁচু করে খোলা চুল জড়িয়ে বাঁধল। আস্তে আস্তে ও অপসৃত হয়ে যাচ্ছে, সুন্দর একটি একটি পা ফেলে ফেলে, তখন থেকেই চলার গতিতে নৃত্য রপ্ত করে দিতে চাইছে যেন, নেমে যাচ্ছে সিঁড়ির হাতলটা একবারও স্পর্শ না করে। প্রথমে ওর পা, ক্রমশ জানু, পিঠ, গ্রীবা, কবরীসমেত বুলা অস্ত গেল।

.

“বলা তো যায় না”–মা, অনেকক্ষণ ধরে আমার কানে ওর আবৃত্তির মতো করে বলা কথাটা বাজছিল। নাচের ঢেউ তুলে শিল্পী যখন পটের অন্তরালে চলে যায়, তখনও দূর থেকে শোনা যায় ক্ষীণ রিনিঝিনি, সেই শব্দ রোদ শেষ হয়ে যাবার পরও বাতাসে ভাসতে থাকল। “আমি হার মানব না, বড় হব”, হয়তো বুলার এই মর্মান্তিক প্রতিজ্ঞাটা ছিল সত্য, হয়তো শুধু বাঁচার জন্যে সে দুরন্ত দুর্মর একটি আশার বাসস্থান তৈরি করে নিয়েছিল।

আর সেই ছাদে, যখন একটার পর একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে, অনেক পতঙ্গ একসঙ্গে বিচিত্র ব্যস্ততায় তুলছে নানাবিধ শব্দ-তরঙ্গ, তখন আমি সেই অলীক অনুভূতিটা ফিরে পেলাম। সবাই চলে যাচ্ছে, থাকছি আমি। দিনের আলো, সন্ধ্যার পাখি, রাস্তার ঘরমুখী মানুষ, যেই যখন যায়, আমি আহত অভিমানে তাকিয়ে থাকি। সবাই যাচ্ছে, আমাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে, যেমন বুলাও আমাকে অতিক্রম করে গেল এইমাত্র।

তারপর, তারপর—বলো তো মা, তার পর কী। তারপর তুমি। তরতর করে নেমে এলাম একটু পরে আমি। যে থাকে থাকুক, যে যায় যাক, তুমি তো আছ। তুমি থেকো

নীচে নেমেই, তুমি কী একটা সেলাই নিয়ে বসেছিলে তখন, গলা ফাটিয়ে ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে ডেকে উঠলাম, “মা!”

সেলাই সরিয়ে তুমি চমকে তাকালে। তাড়াতাড়ি উঠে এসে পিঠে হাত রাখলে, বললে, “ভয় পেয়েছিস?”

উত্তর দিলাম না। তখন হাত ঠেকালে আমার কপালে, গলায় বুকে। “জ্বর-টর হয়নি তো? দেখি।”

কী করে বোঝাব মা, ভয় না, জ্বর না, কিছু না। কত দিন পরে তোমার ব্যাকুল শ্বাস এত কাছাকাছি পাচ্ছি, অসঙ্কোচে মুখ ঘষছি তোমার কাঁধে।

(‘সর, সর, কিছু হয়নি তো? সরে যা বুড়ো ধাড়ি!)

তুমি লজ্জা পাচ্ছ, নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইছ।

(‘তোর আজ বল্ তো হল কী?’)

আমি আঁকড়ে ধরছি তত।

সত্যিই কিছু না। এই তো তুমি, এই তো। দেখা যাচ্ছে, ছোঁয়া যাচ্ছে, ঘ্রাণ স্নেহ সব নিয়ে, বরাবরের মতো সেই আশ্রয়টি হয়ে আছ।

সেদিন স্নায়ুমণ্ডলীতে হঠাৎ একটা ঝড় উঠেছিল কেন, ওই অস্থিরতা, তালগোল পাকানো পাগলামির হেতু এখন বুঝতে পারছি। বুঝতে পারা উচিত ছিল সেদিনও, যখন তোমাকে মেঝেয় টেনে বসিয়ে কোলে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছি, তুমি চুলগুলো থাকে থাকে ভাগ করে দিচ্ছ, আর আমি অশ্রুতপ্রায় গলায় বারে বারে বলছি, “মা, তুমিও লীলামাসির মতো চলে যাবে না তো।”

ওই ভয়ংকর আতঙ্কটা হঠাৎ একেবারে নীচের তলা থেকে ভেসে উঠে থাকবে আমার সচেতন মনে। আমাকে সহসা শিশুর মতো আকুলিত করে দিল।

কিন্তু শেষবারের মতো। এর পরে-পরেই আমার অসহায় শৈশব, আমার থরথর কৈশোর আমাকে চিরদিনের মতো ছেড়ে যায়।

.

অনেক গড়াতে গড়াতে এখানে এসে দম নিচ্ছি : ভাবছি সারা জীবনের অনেক ভয় লুকোনো থাকে ওই “ছেড়ে-যাওয়া” নামে আঘাতের পর আঘাতের ধাতুতে তৈরি এক কঠিন কৌটোতে।

(প্রাণ কোথায় থাকে? সে-ও, রূপকথার গল্প বলে, কৌটোতে। সেই কৌটো থাকে কার হাতের মুঠোতে, সে কি জননী, প্রণয়িনী অথবা ঘরণী—কোনও-না-কোনও নারী? এক-এক বয়সে এক-এক জন, এক-এক সময়ে এক-এক জন, আমরা স্বেচ্ছায় কৌটোটা গচ্ছিত রাখি তাদের কাছে।)

ভয়ও তাই। একটা কৌটোয়। যে আছে সে ছেড়ে যাবে, এই ভয়; যা আছে তা চলে যাবে। কিছুই থাকবে না, এই নঙর্থক প্রত্যয়, নানা ছেড়ে যাওয়া ছাপের পর ছাপ রাখে, মনের চেহারাটা হয়ে যায় ডেডুলেটার অফিসের খামের পিঠ—আমার হচ্ছিল, একটা অস্বস্তি, অনিত্যতা-বোধ স্নায়ুকেন্দ্র থেকে নির্গত হয়ে ঊর্ণাজালে আমাকে আবদ্ধ করে ফেলেছিল। দাদা, সুধীর মামা, এসব তো বাসী নমুনা। টাটকা দৃষ্টান্ত দ্যাখো, লীলামাসি বুলাকে ছেড়ে গেল। বুলা ছেড়ে গেল এই বাড়ি—কোথায় জানি না। আরও আছে, আরও আছে, ছাড়াছাড়ির পালা অনেক বাকি, সেদিন একলা ছাতে দাঁড়িয়ে এই ভীষণ সত্যে আমূল বিদ্ধ হয়েছিলাম, পাখিরা ঘরে ফিরছে ঠিক, কিন্তু যে-ক-টা ফেরে, শুধু তাদেরই তো দেখি, অনেকগুলো হয়তো ফেরেও না, কেউ কি তাদের হিসাব রাখে?

তুমি যদি না থাকো। থাকবে কী তবে।

সেদিন অকস্মাৎ আতঙ্ক গ্রাস করেছিল এই কারণে।

শুধু মানুষই যে ছেড়ে যায়, তা-ও তো নয়। ছেড়ে যায় অনেক অভ্যাস, শক্তি। যেমন এক সময়ে ভেবেছিলাম, কলম ধরার শক্তিও হারিয়েছি। ‘ঈশ্বর’, ঈশ্বর!’ অন্তরাত্মা আর্তনাদ করেছে ক্রুশে ক্লিষ্ট মানব-পুত্রের মতো, ‘তুমিও কেন পরিত্যাগ করছ আমাকে, কী দোষ করেছি।’

আবার, এ-ও জানি, ছেড়ে যাবার অনুভূতিটা অর্ধসত্য মাত্র, আংশিক। আমরাও ছেড়ে দিই, সরে আসি। অথচ মনে হয়, ওরা সরে যাচ্ছে, আমি স্থির আছি। তা সম্ভব কি? বস্তুত বিপরীতমুখী দু’টি গাড়িই পরস্পরকে অতিক্রম করে।

.

লীলামাসি গেল, বুলা গেল, তার কত পরে আমরাও ও-বাড়ি ছেড়ে আসি? খুব বেশি হলে কয়েকটা মাস, বড় জোর এক বছর। প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছিল সেবার কলকাতায়, সকালে আঙুল বাঁকানো যায় না, বিছানা মনে হয় ভিজে হিম, আর সন্ধ্যা হতে না হতে শহরটা খানিক ধোঁয়া খানিক কুয়াশা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে। উনুনের পাশে বসে তুমি আর আমি হাত সেঁকি, আমার আবার কাশি-সর্দি জ্বর-জ্বর ভাব, তুমি বলছ, “বুকে পিঠে হাতের তালুতে আর পায়ের তলায় গরম তেল মালিশ করে নে।” রাগী ঝগড়াটে বিড়াল দুটোও শীত-কাতুরে, আগুনের তাতের লোভে উনুনের পাশে শুয়ে থাকত, পাত্তাই পাওয়া যেত না সিঁড়ির নীচের কুকুরটা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবা তখনও বাইরে। ফিরবেন কখন কে জানে।

উনুনের পিঠে মেলে-ধরা হাত গুটিয়ে তুমি হাসলে।—”আর পারছি না। গাঁটে ব্যথা, বোধহয় বাতে ধরল। তোর বয়স কত হল রে?”

“তুমিই তো জানো। কত আর—সতেরো?”

চোখ বুজে কী হিসাব করে বললে, “না ষোলো। ঠিক ষোলো—এইবার পূর্ণ হচ্ছে।” ‘বয়সের কথা এখন কেন?”

“না’ শরীর চলছে না, ভাবছি কবে রথ-বল সব যাবে, অথর্ব হয়ে পড়ব, বরং তোর বিয়ে দিয়ে দিই। বল্ কেমন বউ তোর পছন্দ, “ডাগরডোগর” না একেবারে ছোট্টটি?”

এ-সব কথায় আমার কান লাল হয়, মানে তখন হতে শুরু করেছে; না আরও কিছু-কিছু : গলায় কী যেন জমে যায়, ভিতরটা টনটন করে ওঠে। প্রথমটা তাই কিচ্ছু বলতে পারছিলাম না, পরে আবার যখন জিজ্ঞাসা করলে “কেমন বউ তোর পছন্দ”, তখন, জানতামই তো ঠাট্টা করছ, তাই ঠাট্টার ধরনেই ফস্ করে বলে দিলাম, “তোমার মতো।”

১৭

কতক্ষণ পরে সদরের দরজাটা কড়কড়-কড়াৎ করে উঠেছিল? চার দিক ছমছমে, তাই আমাদের ঘর থেকেও শোনা গেল। আমি চমকে উঠেছিলাম। তুমি কান পেতে শুনলে একবার, বললে, “এ-বাড়ি নয়। বোধহয় পাশের বাড়িতে।”

তখনও শব্দ হতে থাকল।

জানালা খুলে দিতেই কনকনে অনেকখানি হাওয়া একঝলক তিরের মতো ঘরটার দেওয়াল, আমাদের চোখমুখ বিধিয়ে দিয়ে গেল। সদরে শব্দ হচ্ছিল। ঘাড় ফিরিয়ে বিবর্ণ গলায় বললাম, “এই বাড়িতেই তো!”

“কিন্তু দরজা তো খোলা। কড়া নাড়ে কেন?”

“বোধ হয় নতুন লোক। জানে না।“

তখনই বোঝা গেল, যে এসেছিল সে সাড়া না পেয়ে দরজাটা ঠেলেছে, পাল্লাজোড়া হা হা হয়ে গেছে হঠাৎ, সেই ফাঁকটুকু দিয়ে ভারী একটা কণ্ঠস্বর হাওয়ায় ভর করে ভেসে আসছে, “কে আছেন, এ-বাড়িতে কে আছেন?”

রাস্তার গ্যাসের আলো সেই ফাঁক দিয়েই তেরচা ভাবে পড়েছিল বাইরের প্যাসেজে। মাথায় আলোয়ান জড়ানো একজন লোক সেই একফালি আলোর রেখা ধরে ধরে আসছে এগিয়ে, তার মুখে “কে আছেন, কে আছেন?” আর একটু এগোতে সুস্পষ্টভাবে বাবার নামও শোনা গেল, লোকটা জিজ্ঞাসা করছে এটা কি তাঁর বাড়ি? বলতে গেলাম, “হ্যাঁ”, কিন্তু গলায় কথা বেরুল না, স্বর বসে গেছে।

সে তখন ঠিক আমাদের জানালার নীচে। তুমি আমাকে পিছন থেকে একটু ধাক্কা দিয়ে বললে, “যা তুই নেমে যা।”

আমি যাব না মা, ভয় করছে।’

“এত ভিতু! ভয়তরাসে কোথাকার।” ধমক দিয়ে বললে তুমি, কিন্তু স্বর চাপা, অবাক হয়ে দেখছিলাম মাথার কাপড় তোলা, অপরিচিত একটা লোকের উপস্থিতিতেই ঘোমটা টেনে দিয়েছ?

তাড়া খেয়ে গলা বাড়িয়ে কোনও মতে বলতে পারলাম, “হ্যাঁ, এই বাড়ি। কিন্তু বাবা তো বাড়ি ফেরেননি।”

তাকে বলতে শোনা গেল, “জানি। জরুরি খবর আছে। কোনদিকে সিঁড়ি?’

চাইছিলাম না যে, লোকটা আসে। এ-ও বুঝতে পারছিলাম যে, আসবেই। একবার যখন মনস্থ করেছে তখন লোকটা আসবেই, যেহেতু, সে তখনও গুটি গুটি সেই খিলেনের দিকে এগোচ্ছে। যার পরেই বাঁক ঘুরে সেই কাঠের সিঁড়ি।

তখন অগত্যা আমি জানালার বাইরে লণ্ঠনটা নামিয়ে দিয়ে, প্রাণপণে দোলাতে লাগলাম আর বলতে থাকলাম, “এই দিকে, এই দিকে।”

কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ঠকঠক শব্দ উঠে আসছে। কাঠ হয়ে ভাবছি ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেব নাকি, ওর যা বলার আছে বাইরে থেকেই বলুক না, কবাটে কান পেতে ভিতর থেকে আমরা শুনে নিলেই বা ক্ষতি কী।

নীচে যখন ছিল, তখন শুধু মাথায় চাপানো আলোয়ানটা দেখা যাচ্ছিল, উপরে উঠে সামনাসামনি দাঁড়াল যখন, তখন ওর ভুরুহীন দুটো চোখ দেখতে পেয়েছি। মুখ-মণ্ডলের বাকি অনেকটা ভাগ ঢাকা, যদিও সেই মুখেরই প্রায় দক্ষিণ মেরুতে মৃদু ভূকম্পের মতো ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল, তখন দরজা আগলাবার আর সময় নেই, বন্ধ করা তো আরও অসম্ভব, তাই সেই নড়া ঠোঁটের সামনে নিরস্ত্র আমি দাঁড়িয়েছি, ঘোমটা-টানা তুমি পিছনে, হাত আমার কাঁধে—বোঝা যাচ্ছে না ভরসা দিচ্ছ, না পেতে চাইছ।

ওর ঠোঁট নড়ছে কিন্তু কথা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না, হয়তো ওর সব দাঁত নেই, তাই; লোকটা বৃদ্ধ বলে। কিন্তু বুঝতে পেরেছিলে তুমি, পিছন ফিরে দেখি তোমার মুখ ফ্যাকাশে। আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, “তোর–বাবার কী যেন হয়েছে, ইনি বুঝিয়ে বলতে পারছেন না, বলছেন অজ্ঞান হয়ে গেছেন—বলুন, বলুন না কোথায়—কোথায় আছেন তিনি—”

লোকটি একটু ইতস্তত করে বলল, “অফিসে।”

“অফিসে মানে থিয়েটারের সেই প্রেসে?“

ঘাড় নাড়ল লোকটা। জেরা করার সময় ছিল না, ভাববার তো নয়ই, তুমি সমস্ত অস্তিত্বসুদ্ধ নড়ে গিয়ে বলে উঠলে—”তুই যা, এক্ষুণি যা।”

আমি কী বলব, বলবার সময়ই বা দিলে কই তুমি, গায়ের উপর ভারী কী পড়ল, চেয়ে দেখি মোটা চাদর একটা, দেখতে দেখতে জুতোয় পা গলিয়েছি, একটু পরেই দেখতে পাচ্ছি, সেই লোক আগে আগে, আমি তার পিছু নিয়েছি।

.

শীতার্ত রাত্রি, রাজপথ তবু সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়ে পড়েছিল। সম্মোহিতের মতো চলতে না থাকলে আমি ভয় পেতাম। ট্রাম এল, ওর ইশারায় উঠলাম। অনেক পরে ট্রাম একটা জায়গায় থামল, নামলাম। ও কি কাপালিক আর আমি নাগরিক এক নবকুমার?

সেই মোড় থেকে একটা রিকশায়। “এখনও কি অনেক দূরে?” আমার গলা একেবারে পেটের তলা থেকে উঠে এল, শুনলাম, কিন্তু জিজ্ঞাসা করছি কাকে। সে তো আগাগোড়া চাদর মুড়ি, দুরন্ত শীত তার ফোকলা মুখ থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে হি-হি হু-হু ইত্যাদি অব্যয়, সামনে মোটা পরদা টানা, কোথায় যাচ্ছি বোঝা যাচ্ছে না।

সে হঠাৎ বলে উঠল, “থামো, থামো এইখানে”, আর বশীভূত রিকশাটা ঠন্ করে একটা শব্দ করে সত্যিই থেমে গেল! চার দিকে চেয়ে বললাম, ‘কই এ-তো থিয়েটারের সেই প্রেস নয়, এ তো অন্য রাস্তা মনে হচ্ছে যেন?” জোর করে বলার মতো সাহস ছিল না; “যেন” কথাটা জুড়ে দিয়েছিলাম এই অকারণে।

ঘাড় ফিরিয়ে কী বলল লোকটা, আগের মতোই অস্পষ্ট, স্বর, অথচ আশ্চর্য, এখন ওর কথা মোটামুটি বুঝতে পারছি—সে বলল, “না, প্রেস নয়। তোমার বাবা আছেন এই বাড়িতে!”

.

চড়া আলো জ্বলছিল, ঘরজোড়া ফরাস পাতা, ঘরের ভিতর একাধিক লোক আছে বুঝতে পারছি, কিন্তু আমার চোখ ঝাপসা, প্রথমে কিছু দেখতে পাইনি।

চৌকাঠে দাঁড়িয়ে লোকটা বলল—যেন ঘোষণা করল—”প্রণববাবুর ছেলে”, আর সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে টুক করে সেই ঘরের মধ্যে ঠেলে দিল।

তখন সেই ফরাসে বসে থাকা মূর্তিগুলির একটিকে ক্রমশ স্পষ্ট হতে হতে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। “প্রণবের ছেলে তুমি? আরে এসো, এসো”, কিন্তু তিনি কী বলছিলেন আমি ভালো করে শুনতে পাইনি, যদিও খুব সতেজ উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর, আমি চোখ তুলে দেখছিলাম তাঁর কান্তি। দীর্ঘ, সুপুরুষ, স্বর্ণপ্রভ–কোনও মানুষের এত রূপ আমি এত কাছাকাছি থেকে আগে দেখিনি। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, নিচু ছাদটা প্রায় ছুঁয়েই ফেলেছিলেন, বিশাল দুটি চোখ একটু রক্তাভ, বাসি ফুলের পাপড়ির মতো একটু ক্লান্তও। তিনি এগিয়ে এলেন, আর আমাকে দু-হাত এক-রকম সাপটে দাঁড় করিয়ে দিলেন ঘরের মাঝখানে—সময় বেশি নয়, তবু এরই মধ্যে আমার কাশীরাম দাসে পড়া “দেখ দ্বিজ মনসিজ জিনিয়া মুরতি…খগরাজ পায় লাজ নাসিকা অতুল”–এই সব লাইন মনে পড়ে গেল।

“প্রণবের ছেলে, প্রণবের ছেলে এসেছে” তিনি কাকে ডেকে বললে, “বসতে দাও, বসতে দাও, এই জাজিমটাতেই জায়গা করে দাও, ও নলিনী, ও নীলি”—তাঁর কণ্ঠস্বর জ্বাল-দেওয়া দুধের মতো ঘন গাঢ়, শঙ্খের মতো ধ্বনিত হচ্ছিল, আবার শঙ্খের মতো কেঁপে কেঁপে যাচ্ছিল। তাঁর টলমল এক পায়ের ধাক্কায় একটা গ্লাস গড়িয়ে পড়ল।

(গড়ানো গ্লাসের চেহারা কী করুণ, কাত হয়ে শূন্য চোখে চেয়ে থাকে, তার ঠোঁটে ফেনা, গাঁজলা আস্তে আস্তে কষের মতো শুকোয়।)

যাকে নলিনী বলে ডাকা হল, সে এবার সামনে এল। কালোপেড়ে শাড়ি, হাতে কাচের চুড়ি, পাটির মতো পরিপাটি চুল বাঁধা, এগিয়ে এসে সে মস্ত ওই মানুষটাকে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, “আঃ, কি হচ্ছে সব্যসাচীবাবু, দেখছেন না বাচ্চা ছেলে, ঘাবড়ে যাবে যে!”

আস্তে আস্তে পিছু হঠে, ঠিক থিয়েটারে যেভাবে হাঁটে, তিনি ঝপ করে বসে পড়লেন তার-বাঁধা, একটা যন্ত্রের উপরে, সেটা সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণায় ঝঙ্কার দিয়ে উঠল। ফরাসের উপরে কোচাটা পড়ে রইল শুঁড়ের মতো, উনি লম্বা, কিন্তু ওঁর ফিতে-পাড় ধুতিটার কোঁচানো কোঁচা লম্বা ওঁর চেয়েও।

ইনিই সব্যসাচী। বিখ্যাত অর্জুন, বিখ্যাত কালকেতু, বিখ্যাত জাহাঙ্গীর—থিয়েটারে মোটে একবারই দেখেছি, বাবা দেখিয়েছিলেন— দেওয়ালে দেওয়ালে দেখেছি কত পোস্টার—আমার পলক পড়ছিল না। আমার অপলক দৃষ্টি অনুসরণ করে উনিও যেন একটু ফুলে উঠলেন, বুক চিতিয়ে বললেন, “চিনতে পেরেছ তাহলে? হ্যাঁ, আমিই সেই সব্যসাচী, মঞ্চে যে অনবরত রাজা, আমির, নবাব সেজে থাকে আর সাজঘরে? স্রেফ ভিখিরি-হাজার মরণে মরেছি, চরণে চরণে বেজেছি।”

“আঃ, কী হচ্ছে! আপনাকে বললাম না সব্যসাচীবাবু, বাচ্চা একটা ছেলে—”

“বাচ্চা ছেলে?” ছাদ কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন তিনি, আমাকে যাচাই করতে থাকলেন ঢুলু ঢুলু দুটি চোখ দিয়ে, বললেন, “বাচ্চা, বাচ্চা কই! দিব্যি তো গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। নীলি, ওই বয়সেই আমি যা পেকেছি তাতে এখানে ওখানে একটা-দুটো বাচ্চা হয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল না। হয়ে গেছে কিনা তাই বা কে জানে।”

“আঃ”, এইবার সত্যি সত্যি চড়া গলায় একটা ধমক দিয়ে উঠল সে, যার নাম নলিনী, আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এল বারান্দায়, একটা বেনচে বসিয়ে দিল—”তুমি কিছু মনে কোরো না, উনি একটু ওই রকম, পেটে কিছু পড়লেই আলগা হয়ে যান।”

এতক্ষণে আমি বলতে পারলাম, “বাবা? “

“প্রণববাবু পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছেন। এখন একটু ভালো। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান।”

“হঠাৎ?”

নলিনী, ওই মহিলা, এই প্রশ্নে যেন একটু অস্বস্তি বোধ করল “হঠাৎ, মানে ঠিক হঠাৎ নয়, মানে একটা আঘাত পেয়েছিলেন, তোমাকে বলব পরে, সব বলব। তাই থেকেই ফিটটা হল, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল গল গল করে, আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কখনও তো দেখিনি, তা ভয় পাবার তেমন কিছু নেই, তুমি কাঁপছ কেন খোকা, ইস্ কপালটা যে হিম, ঠান্ডা লাগছে বুঝি এখানে, না, ভয়ের বিশেষ কিছু নেই, ডাক্তার এসেছেন, ওষুধ দিয়েছেন, বললেন “স্ট্রোক, প্রথম স্ট্রোক, ওই রকম হয় বোধহয় ব্লাডপ্রেসার না কী ছিল তোমার বাবার—ডাক্তারবাবু বললে, রক্তটা নিজে থেকেই বেরিয়ে গেল সেটা ভালোই হল, না হলেই বরং ভয় বেশি ছিল, এখন চাই কিছুদিন বিশ্রাম, তা-হলেই ঠিক হয়ে যাবে, একি তুমি এখনও কাঁপছ কেন খোকা, একটু গরম দুধ খাবে, এনে দিই?”

.

শুধু দুধ নয়, সে আমাকে প্লেটে করে দুটি সন্দেশও এনে দিল। দুধের গ্লাসে কেমন-একটা কড়া গন্ধ, বললাম “ওষুধ ওষুধ গন্ধ যে!” যেন লজ্জিত হল সে, কালো পাড়ের আঁচল ঘুরিয়ে লজ্জা ঢাকল, বলল “ও কিছু নয়, তোমার বরং ভালোই হবে, গায়ে বল পাবে এই শীতে”, তারপর আমার মুখের কোণে দুধের ছিটে লেগে ছিল বলে, এদিকে-ওদিকে চেয়ে বোধহয় একটা গামছা-টামছা খুঁজল, শেষে নিজেরই কাপড়ের কোণ দিয়ে আমার ঠোঁট মুছিয়ে দিল।

আমি সারা শরীরে জড়োসড়ো, সরে যেতে চাইছি, কিন্তু সে বলল, “লজ্জা কী, তুমি তো আমার ছেলের মতো! মা বুঝি ছেলের মুখ মুছিয়ে দেয় না?”

ভেবে দ্যাখো মা, নিজের সঙ্গে ও তোমার তুলনা টানল! স্থান কাল ভুলে জোরে জোরে মাথা নাড়লাম আমি, বিশ্রী গলায় বললাম, “আপনি আমার মা নন তো!”

প্রস্তুত ছিল না সে, তাই প্রথমে একটু যেন থেমে গেল, তারপর ক্রমশ শক্ত হল তার মুখের পেশি, নাকের বাঁশি কাঁপতে থাকল, সে শক্তি সংগ্রহ করছে, তারপর সেই শক্তির সবটুকু ঢেলে দিয়ে বলল, “আমি তোমার মা! কিছু জানো না তুমি, কিছু না।”

তার কণ্ঠস্বর সুনিশ্চিত, দৃঢ়, একটু আগে যে-স্বরে, সে “আঃ কী হচ্ছে,” বলে বিশাল প্রবল সব্যসাচীকে ধমক দিয়েছিল।

“এসো, এবার তোমার বাবাকে দেখবে এসো।” তার কিছু পরেই, বোধহয় নেই-কথা অস্বস্তি ভাঙতে সে বলল; তার পিছন পিছনে পালিত প্রাণীর মতো গিয়ে ভেজানো ঘরটার চৌকাঠে দাঁড়ালাম।

এই ঘরটার দেওয়ালে মৃদু-নীল আলো, বাবা ঘুমন্ত, আলোর আভা ছড়িয়ে পড়ছে ওঁর চওড়া কপালে, বাবাকে এত সুন্দর আগে কখন দেখিনি।

কী বলতে যাচ্ছিলাম, সে ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল, “চুপ।” আদিষ্ট আমি তার পায়ের পাতায় চোখ রেখে রেখে পাশের ঘরে গেলাম।

সে-ঘরে তখন সব্যসাচী আর শূন্য গ্লাসটা পাশাপাশি, একই সঙ্গে ফরাসে গড়াচ্ছেন দু’জনে। মনে হল, পাশের ঘরে যেমন বাবা, সব্যসাচীও এখন তেমনই নিহিত ঘুমে। কোমরের কষি ঢিলে হয়ে গিয়ে ওঁর ভুঁড়িটা এখন যথেষ্ট স্পষ্ট, যেটা বয়সের লক্ষণ, কোমরবন্ধ এঁটে আঁটসাট পোশাকে যখন রাজা সাজেন, কি বীর সেনাপতি, তখনও কি এ-সব লক্ষণ ফুটে থাকে?

ওখানে বসা উচিত হবে কি হবে না যখন নিজে স্থির করতে পারছি না; পারছি না তাই নলিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি; তাকিয়ে আছি সংকেতের অপেক্ষায়, তখন সে নিজেই একটা ধারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “এইখানে বোসো।”

বলেই বুঝতে পারল সব্যসাচী ওখানে, তাই আমি ইতস্তত করছি। হেসে বলল, “ভয় কী, বোসোই না। দেখছ না, ও এখন একেবারে আলাদা মানুষ, ঘুমিয়ে কাদা? কিছু বলবে না!”

জড়োসড়ো হয়ে বসলাম। সে তখনও অহেতুক সব্যসাচীর হয়ে ওকালতি করে চলেছিল।—”ও ওইরকমই। দশাসই মানুষটা, কিন্তু যখন যা করবে তার চূড়ান্ত করে ছাড়বে। বাড়াবাড়ি ছাড়া জীবনে কিছু করল না। আসলে ভেতরে ভেতরে খুব নরম কিনা, তাই সেটা ঢাকতে ওর যত বাড়াবাড়ি বাইরে।”

সত্যি কথা বলব, আমি এ-সব কথা একবর্ণ বুঝতে পারছিলাম না। উশখুশ করছি, আর কতক্ষণ এখানে থাকব, বাড়িতে তুমি বোধহয় তখনও বসে আছ, এই দুর্জয় শীতে যাবই বা কী-করে, যে নিয়ে এসেছিল সেই কি আবার সঙ্গে যাবে, এইসব নানা ভাবনা, তার উপর অপরিচিত এই পরিবেশ, পাতা ফরাস, ফরাসে গ্লাস, গ্লাসের পাশে সব্যসাচী; আমাদের সেই আধা-শহরের বাড়িতে যেমন সন্ধ্যার পর চারদিক নানা পাখি, পোকা আর ঝিঁঝির স্পষ্ট ডাকে ভরে যেত, এখানে এই বাড়িতে তেমনই কাছে-দূরে অনেক চাপা হাসিহুল্লোড়, তবলার বোল্, মিহি সুরের গান শুনছি। আমার ক্লান্ত স্নায়ু মাছির মতো নানা শব্দের জালে ধরা পড়ে ছটফট করছিল।

আমি যাব কখন, বাবাকে রেখে যাব না নিয়ে যাব, এ-সব প্রশ্ন তো ছিলই, তাছাড়া সবচেয়ে জরুরি কথাটা তখনও যে জানা হয়নি—বাবা এখানে এসেছিলেন কেন।

আমার হয়ে সমস্যাটা মিটিয়ে দিল নলিনী। যেন আমার মনের কথাটা বুঝল।—আঁচলে কপাল মুছে বলল, “ইস্, আজ সন্ধ্যা থেকে কত কাণ্ডই না ঘটল। নাটক হয় থিয়েটারে, আজ আমার ঘরেই। পুরোপুরি একটা নাটক। এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার। প্রথমে তো এলেন প্রণববাবু, তোমার বাবা। “

—”আসেন বুঝি?” মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে এল : আর নলিনীও যেন বুঝল কথাটার নিহিতার্থ।

আস্তে আস্তে বলল, “আসেন বলিনি তো, বলেছি এলেন। আমি তখন সবে গা ধুয়ে উঠে এসেছি ওপরে। দেখি, উনি তক্তপোশে বসে। হাতে একগোছা কাগজ, তাড়ার পর তাড়া। বললাম, ওগুলো কী। প্রণববাবু বললেন, আমার লেখা পালা। আজ তো স্টেজ বন্ধ, ভাবছি, সব্যসাচীবাবুকে শুনিয়ে যাব খানিকটা। বললাম, সব্যসাচীকে শোনাবেন তা এখানে কী। আসলে একটু রেগেই গিয়েছিলাম তোমার বাবার ওপরে উনি সেটা ধরতে পারলেন না, পারলে ব্যাপারটা এতদূর গড়াত না। উনি হেসে বললেন, আসবেন, খবর নিয়েই এসেছি। আমাকে কথা দিয়েছেন সব্যসাচীবাবু, আমার প্লে স্টেজে নামাবেন, অথচ সময় দিতে পারছেন না। আজ পর্যন্ত ওঁর ভালো করে শোনাই হল না। এখানে ওঁকে ধরব বলে এসেছি। আমি অবাক হয়ে বললাম, শোনাবেন এখানে? পারবেন? প্রণববাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন, কত দিন ধরে এগুলো বরে বয়ে সব্যসাচীবাবুর পিছুপিছু ঘুরছি জানেন? আর পারছি না। কথা দিচ্ছি আপনাকে, বেশিক্ষণ আপনাদের জ্বালাব না—ঘণ্টা দুই বড় জোর। একটু বসি? এমনভাবে প্রণববাবু বললেন একটু বসি যে, তুমিই বলো, কেউ কাউকে চলে যেতে বলতে পারে?”

নলিনীর কথা অনর্গল শুনে যাচ্ছি, রাত বাড়ছে, যত বাড়ছে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে তত, তবু ঘুম পাচ্ছে না। সেদিন কতক্ষণ পরে এসেছিলেন সব্যসাচী চৌধুরী? সন্ধ্যার ঢের পরে, বাবা ততক্ষণ নাকি কাকুতি-মিনতি করে নলিনীকেই কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে শোনাতে শুরু করেছেন।

(“তুমি যদি একটু বলে দাও নলিনী’—হঠাৎ বাবা নাকি অল্পপরিচিতা ওই মহিলাকে ‘তুমি’ বলে ফেলেছেন—’তা-হলে সব্যসাচীবাবু নিশ্চয়ই এটা নিয়ে নেবেন। একবার স্টেজড্ হলে আর পায় কে। লোকে এটাকে নেবেই—তুমি দেখো।’)

পড়া চলছে, ঠিক তখনই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেছেন সব্যসাচী। বাবা ফরাসে বসে পুঁথির পাতা ওলটাচ্ছেন, নলিনী তক্তপোশে গালে হাত দিয়ে শুনছে, সেই মুহূর্তে অকস্মাৎ প্রবেশ করেছেন যিনি, তিনি নায়ক ও নটোত্তম, ঘাড় বেঁকিয়ে বলে উঠেছেন, “বাঃ উত্তম, এ উত্তম।”

“তার পরে” নলিনী বলে গেল, “যা যা হল, যে-যে বিশ্রী কথা সব্যসাচী, মানে ওই লোকটা বলে গেল, তোমাকে তা বলতে পারব না। এইটুকু জেনে রাখো, তোমার বাবা ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন, সব্যসাচী ওঁর গায়ে হাত দেয়নি অবিশ্যি, মানে দিতে পারেনি, আমিই ঠেকালাম, তখন সে কুৎসিত ভাষায় আমাকে গালাগালি দিল, নিজে গড়িয়ে পড়ল ফরাসের একধারে, গোঙাতে থাকল, ওদিকে তোমার বাবা অজ্ঞান অন্যধারে, রক্ত, সে কী রক্ত! তোমাকে কী বলব, উনি খুব আঘাত পেয়েছিলেন, হাতের লেখা পাতাগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, ব্যাপারটা কী জানো, তোমার বাবা প্রণববাবু বাইরেই ও-রকম একরোখা মানুষ, ভেতরটাতে খুব নরম; গ্রিনরুমে ঠোঙা ভরে ভরে আমাদের কত খোবানি বিলিয়ে যান, একবার আমার গলা একটু ধরেছিল, উনি ওমনি সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে নিয়ে এলেন এক গ্লাস গরম পাঁচন, প্রায় রোজই থিয়েটারে আসতেন তো; মানে যদিও উনি প্রেসের ম্যানেজার, ওঁর কাজ শুধু প্রোগ্রামে পোস্টারে বড় বড় হরফে সকলের নাম ছাপানো, তবু ওঁর ধারণা, ওঁর আসল কাজ ওটা নয়, উনি আসলে পালা-লিখিয়ে, ওঁর বই অভিনয় হবে, নাম ছড়াবে, এই সব আর কী!”

(মা, এ-ব্যাধি বাবার একার নয়, আমরা যা করি, যার মধ্যে আছি, সেটা আমাদের নয়, আমরা প্রত্যেকেই ভাবি আমরা আসলে অন্যলোক, আমাদের সার্থকতা অন্যত্র—এই ভাবনায় জর্জর থাকি অহরহ, যন্ত্রণায় অস্থির হই অযথা ঘটাই রক্তপাত।)

.

“আমি ওঁর কষ্টটা বুঝতাম, বুঝি”–নলিনী বলছিল, বলতে বলতে ওর স্বর কোমল হয়ে এসেছিল, “যাক, তোমরা ভয় পাবে, তাই খবর দিয়ে তোমাকে আনিয়েছিলাম। দেখে তো গেলে, মাকে বোলো। উনি এখন ভালোই আছেন। কাল সকালে থিয়েটারের গাড়িতে পাঠিয়ে দেব। তুমি—তুমি এখন যাও। অনেক রাত হল।”

ইতস্তত করছি দেখে জুড়ে দিল, “যাবে বৈকি, যাবে। যেতে হবে। এখানে থাকতে নেই। বুঝতে পারছ না?” সব্যসাচীকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এখানে সারা রাত কেউ থাকে না তো। ওরাও না। সবাই চলে যায়, খালি আমি থাকি। আজকের রাত অবিশ্যি আলাদা—দু’ঘরে দু’জনে ঘুমে, একা আমি থাকব। আমাকে জেগে থাকতে হবে—আমার অবস্থাটা দেখছ তো!” বলে নলিনী ম্লান হাসল। আমার সঙ্গে নেমে এল নীচে। ইশারায় যে ট্যাক্সিটা ডাকল, বোঝা গেল তার চালক তার চেনা। আবার আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “ভয় নেই। ও তোমাকে ঠিক পৌঁছে দেবে।” শেষবারের মতো আমাকে স্পর্শ করল সে, হাতে একটু চাপ দিল, “কাল সকালে প্রণববাবুকে পাঠিয়ে দেব। আর—উনি যে আমার এখানে, তা কিন্তু তোমার মাকে বোলো না, বোলো উনি আছেন, থিয়েটারের একটা ঘরে।”

.

মা, কিছুদিন তোমার সেই ধারণাই ছিল। কেননা, আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছিলাম। সজ্ঞানে। বাবা পরদিনই এসেছিলেন ঠিক। থিয়েটারেরই গাড়িতে। ধরাধরি করে ওঁকে উপরে নিয়ে আসা হল। কাঠের পুরনো সিঁড়িটা সেদিন আরো বেশি করে কাঁপল। সেখান থেকে বাবা সোজা বিছানায়। জ্ঞান ফিরে এসেছিল, আরো ফ্যাকাশে মুখ, ঠোঁট থেকে থেকে কেঁপে কী-যেন বলতে চাইত, মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় চোয়াল-চিবুক বেঁকে-চুরে বিকৃত হয়ে যেত। ডাক্তার আসছিল।

তারপর বাবা একদিন মাথাও তুললেন, মাঝখানে কেটে গেছে ক’সপ্তাহ, ক’মাস, হিসাব নেই। একদিন বাবা উঠেও বসলেন। তারপর ক্ষীণ গলায় আমাকে খাতা আর পেনসিল আনতে বললেন—সে কতদিন পরে?

বালিশের উপরে খাতা রেখে বাবা ঘাড় গুঁজে লিখছিলেন। একটানা নয়, থেমে থেমে। ঘরের এদিক থেকে দেখতে পাচ্ছি ওঁর আঙুলগুলো কাঁপছে।

তুমি ঘরে ঢুকলে। একটু ঝুঁকে পড়ে লেখাটা দেখতে গিয়েছিলে বুঝি, বাবা তাড়াতাড়ি খাতাটা চাপা দিলেন। অল্প হেসে তুমি বললে, “থাক থাক, লুকোতে হবে না। দেখতে চাই না, দেখার সময় ত নেই আমার। পালা লিখছ বুঝি—আবার?”

সেই রক্তপাতের পর থেকে বাবার চোখ সর্বদাই সাদা দেখাত। যে-হাসি তখন তিনি হাসতেন তার রঙ সাদা।

-”পালা? না, আনু, পালা না। ও-সব আর লিখব না। লিখছি, মানে, এই এমনি।”

“বোসো। আগে তোমার ওষুধটা আনি!” এই বলে তুমি সরে গেলে, ফিরে এলে খলে চাল-ধোওয়া জল আর কবিরাজী ওষুধ ভরে নিয়ে। অসুখটার পর বাবার সঙ্গে তোমার সম্পর্কট সহজ হয়ে এসেছিল। আগেকার সেই আড়ষ্টতা, সেই কাঠিন্য ছিল না।

.

কিন্তু ওই খাতাটা? খাতাটাই সব গোলমাল করে দিল আবার। বাবা কেন যে এত অসাবধান, রোজই ওটা কোথায় লুকিয়ে রাখতেন কেউ টের পেত না, কিন্তু একদিন হয়তো ভুলে গেলেন। কবিরাজের কথামতো তিনি তখন সকালে-সকালে পার্কে এক-একটা চক্কর দিয়ে আসতে শুরু করেছেন।

কলতলা থেকে মুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখি, তখনও উনুন ধরেনি, তুমি জানালার ধারে দাঁড়িয়ে, খোলা খাতাটা আলোর সামনে ধরে। .

আমার নিঃশ্বাস পড়ল তোমার কাঁধে, তুমি চমকে খাতাটা ঢেকে ফেললে আঁচলে, সেদিন বাবা যেভাবে ঢেকে ফেলেছিলেন, ঠিক তেমনই, তোমার মুখ শুকনো। তখনো আমি বুঝতে পারিনি ওই লজ্জার খাতাটায় গোপন কী এমন কথা লেখা আছে বা থাকতে পারে, তোমরা দু’জনেই যা ঢাকছ?

১৮

সেই খাতাটায় কি যে ছিল, বুঝেছিলাম পরে, তন্ন তন্ন করে খুঁজে খাতাটাকে যেদিন আমিও পেয়ে গেলাম।

না, পালা নয়। ডায়েরি। কয়েক লাইন পড়তেই বোঝা গেল বাবা সেদিনের ঘটনাটা লিখে রেখেছেন।

(তখন বুঝিনি কেন। কেন যে বাবা কাগজে-কলমে সব কবুল করতে গেলেন। এই সর্বনাশা খেয়ালের মানে খুঁজে পাইনি। সেই মানে আজ পরিষ্কার। নিজের কাছে সাফ থাকার জন্যে। মানুষকেই কখনও-না-কখনও এ-কাজ করতেই হয়। করতেই হয়, নতুবা আমিই বা কেন আজ যেচে সব উজাড় করে একাকার করে দিচ্ছি। আমাদের মধ্যে দু’টি আলাদা আলাদা মানুষ বাস করে : একজন অপরাধ করে, করে চলে, আর একজন নিজেকে ধরিয়ে দিতে তলে তলে সর্বদাই জোগাড়-যন্ত্র ক’রে যায়। আমরা দু’টি বিপরীত অভ্যাস মিলিয়েই।)

ডায়েরির ভাষাটা ছিল এই রকম :

সব্যসাচী আমাকে ভুল বুঝিলেন। ভাবিলেন নলিনীর ওখানে আমিও গিয়াছি ফুর্তি করিতে। তিনি টলিতেছিলেন, চোখ রক্তিম, বোঝাই যায় কিছু অতিমাত্রায় পানাদি সারিয়াই তবে তিনি ওখানে উপস্থিত হইয়াছেন। আমাকে দেখিয়া তাঁহার আরক্ত অক্ষি দুইটি হইতে যেন অগ্নিগোলক বর্ষিত হইতে থাকিল। “শালা”, থরথর করিয়া, রাগে কিংবা নেশায় কাঁপিতে কাঁপিতে তিনি কদর্য যে সম্বোধন দিয়া শুরু করিলেন, কলমেও সেটা লিখিয়া রাখিতে কষ্ট হইতেছে, তিনি বলিলেন “শালা চোরের মতো এখানে ঘুরঘুর করিতে শুরু করিয়াছিস! কুকুর হইয়া ঘৃতভাণ্ডে মুখ ঠেকাইতে চাহিতেছিস?”

তাঁহার মাথার ঠিক ছিল না, মুখের কথারও না, সুরচিত, মহচ্ছন্দে পরিপূর্ণ যে-সব সংলাপ তাঁহার মুখে নিয়ত শুনি, তাহার সঙ্গে এই ভাষার কিছুমাত্র মিল নাই। তাঁহাকে বলিতে চাহিলাম, নলিনীর নিকট আমি আসি নাই, আসিয়াছি তাঁহারই নিকটে, আমার রক্ত দিয়া লেখা সব রচনা, আমার বুকের শিরা-ছেঁড়া ধন তাঁহার সম্মুখে মেলিয়া ধরিব বলিয়া, এই আমার শেষ চেষ্টা, আমার সাধনা সার্থক হইয়া উঠিবে কাঁটার মতো যাহা নিরন্তর ব্যথা দিতেছে তাহা পুষ্পের মতো সৌরভে ভরিয়া উঠিবে, সকলে আমোদিত হইবে–আমোদিত হইব আমি নিজেও, আমার নিজস্ব, আমার প্রকৃত এবং মূল ব্যক্তিসত্তায় অবশেষে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারিব। বহু রাত্রির সব স্বপ্ন সফল হইবে আমার—এই আমার শেষ চেষ্টা। ·

বলিতে চাহিলাম এই সমস্ত কথাই, কিন্তু পারিলাম না। পলকে আমার চক্ষুর সম্মুখে যেন চিরকালের চেনা একটি সিংহ ক্ষুদ্রকায় কিন্তু নিষ্ঠুর ও পিচ্ছল সরীসৃপ হইয়া যাইতেছে। করুণ নয়নে তখন চাহিলাম নলিনীর দিকে, সে কিছু বলুক। নলিনী সুন্দরী, স্বভাবে মধুরা, বৃত্তি যাহাই হউক তাহার চিত্তটি উচ্চ, উপরন্তু সে দয়াময়ীও বটে! নলিনী বুঝিল! সব্যসাচীকে যাচিয়া বলিল, “যাহা ভাবিতেছ তাহা নয়, উনি অন্য কোনও কারণে আসেন নাই, আসিয়াছেন উহার রচিত পালাগুলি লইয়া তুমি কী করিবে, সে-বিষয়ে তোমার শেষ কথা শুনিতে।”

শুনিয়া সব্যসাচী অট্টহাস্য করিল। কিছুটা নাসিকা ও কিছুটা ওষ্ঠের সাহায্যে তাহার মুখ হইতে প্রমত্ত এবং অদ্ভুত একটি শব্দ নির্গত হইয়া আসিল, বানান করিয়া লিখিলে যাহা দাঁড়ায় “ফ্লু-উ-উ-ৎ।” খণ্ড-”ত” অংশের সঙ্গে একটি হেঁচকিও ছিল। অতঃপর সব্যসাচী—অর্থহীন ওই আওয়াজটার পর—যাহা বলিল তাহার অর্থ দাঁড়ায় এই : ফ্রু-উ-উ-ৎ! তোর ওই পালা লোকে অভিনয় করিবে? আহাম্মক

(সব্যসাচী সত্যই আমাকে বলিল, ‘আহাম্মক’।)

নিজের মুখ মানুষ নিজে দেখিতে পায় না, নিজের ওই ছাইপাঁশ কী আহা-মরি বস্তু হইয়াছে তুই নিজে বুঝিস না। আমি শুধু তোকে একটু খেলাইয়াছি। নেহাৎ পিছে পিছে ফেউ হইয়া ঘুরিয়া মরিতি, ফাইফরমাশ খাটাইয়া লইতাম তোকে দিয়া, আর-একটু মায়াদয়াও এই শরীরে আছে, তাই এতদিন সোজাসুজি কিছু বলি নাই। আজ মদ খাইয়াছি প্রচুর, এই দ্যাখ আমার চোয়া ঢেঁকুর, তোর আসল রূপ আমার কাছে স্বচ্ছ হইয়া গিয়াছে, তাই, শোন্, সটান বলিয়া দিতেছি তোকে—কিছুমাত্র আশা নাই। তোর ওই লেখা, থুঃ, মানুষ তো কোন্ ছার, ষাঁড়-শিয়ালের মুখেও মানাইবে না।

বলিতে বলিতে আবার একটি হেঁচকি তুলিলেন তিনি এবং নিক্ষেপ করিলেন একটি গ্লাস—লক্ষ্য করিয়া আমাকে। তাঁহার রুষ্ট একটি হা-হা হাসি নির্মম হইতে নির্মমতর হইয়া আমাকে আঘাত করিতে থাকিল। আঘাত। সে তো শরীরে লাগিলেই, আরও প্রচণ্ডভাবে বাজিতে থাকিল শরীরের চেয়েও গভীরতর কোনও স্তরে।

কী ঘটিয়াছিল; তখন হইতে কী ঘটিতে থাকিল জানি না, একবার মনে হইয়াছিল, আমার মাথা ঘুরিতেছে—জানিতাম পৃথিবীর ঘোরে, কিন্তু পৃথিবীকে স্থির রাখিয়া গোটা আকাশটাই ঘুরিয়া গেল তাহার উপরে, বুকের মধ্যে বড় কষ্ট, বড় ভূমিকম্প–আর? আর তৎক্ষণাৎ একটা খোসা, মোহের খোসা, যেন খসিয়া পড়িল। মনে হইল আমি মুক্ত। আর?

সব মনে নাই। আমি পুরুষ, কিন্তু লিখিতে আপত্তি কী, একবার যেন মনে হইল আমি কাঁদিতেছি। চোখের জল মুছিব বলিয়া হাত তুলিতে গেলাম, সে-হাত ঠেকিয়া গেল নাকে, ভিজা-ভিজা-হাতটা সামনে ধরিয়া দেখি, চোখের জল কই, এ তো রক্ত।

রক্ত ঝরিতেছিল, শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল, পায়ের তলায় মাটি নাই, হাতের কাছে ধরিবার মতো একটা অবলম্বনই বা কোথায়, ভয় পাইলাম, দেওয়াল প্রভৃতি সব অদৃশ্য হইয়া গেল নাকি। রক্ত ঝরিতেছিল, তাহাতে দুঃখ নাই, কষ্টও যেন কম ঝরিতেছে ঝরুক না, বরং তপ্ত স্রোতের জোয়ারে শরীরের সর্বত্র যে শিরাগুলি, বুঝিতেছি স্ফীত হইয়া উঠিয়াছে, এখানে এখানে আরও হাজারটা ফুটা হইয়া সেগুলি বরং ঝাঁঝরা হইয়া যাক, গেলে আমি বাঁচি। আর কিছু মনে নাই। একবার যেন দেখিলাম সব্যসাচী ঢলিয়া পড়িতেছেন ও-পাশে, তখনই, কী আশ্চর্য। আমিও পড়িয়া গেলাম ফরাসের এ-পাশে। পড়ার মুহূর্তে বুঝি শক্ত মুঠিতে খামচাইয়া ধরিলাম ফরাসের চাদরটা, একবার যেন বোধ হইল নলিনী ওই দিক হইতে আসিয়া হাঁটু ভাঙিয়া বসিয়াছে আমারই পাশে…যেন বোধ হইল…আমার লুটাইয়া-পড়া মাথাটা কেহ সযত্নে…কোলে তুলিয়া লইয়াছে।

জানিয়াছি পরে—এই নলিনীই আমাকে বাঁচাইয়াছে। কিন্তু আজ আমি মুক্ত—সুস্থ অন্তত এক দিক হইতে। আজ আমার কিছুমাত্র মোহ নাই। তাই লিখিয়া রাখিলাম যে, খোলস খসিয়া পড়িয়াছে।

মা, তাড়াতাড়ি লেখাটা ঢেকে ফেলেছিলে তুমি, আমি এসেছি টের পেতেই ভয়ে অথবা লজ্জায়, বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল তোমার মুখ, অন্তত তখন আর কোনও ভাবলেশ দেখিনি।

তুমি জানো না, এই কয়েক ছত্র পরে পড়ে ফেলি আমিও গোপনে, তারপর কবে কী-করে, বোধহয় বাসা-বদলের হিড়িকে ওই কাগজগুলো আমারই হেফাজতে এসে যায়। বাবা তখন অশক্ত, প্রায় ঘরে অন্তরীণ, ওগুলো খুঁজেছিলেন পাননি; পাননি যে, তাও কাউকে বলতে পারেননি। খোঁজা আর না-পাওয়া, দুটোই গোপনে।

মাঝে মাঝে দেখতাম যে, তিনি তাঁর তোরংটা হাতড়াচ্ছেন অন্ধকারে, হাঁটু মুড়ে, উবু হয়ে, গোপনে—নিজের জিনিসও তবে চোরের মতো সন্তর্পণে কাউকে-কাউকে খুঁজতে হয়, কেউ কেউ খোঁজে? বিশ্বের বিচিত্র বিধানে কত শাস্তি যে কতভাবে তোলা থাকে!

তারপর, আবার দ্যাখো, সেই শাস্তির মেয়াদ আপন নিয়মেই কবে মকুব হয়ে গেছে, আর শেষের দিকে খুঁজতে দেখিনি বাবাকে, হয়তো ওর দাম, ওগুলো নিয়ে চিন্তা-ভয়-সংকোচ তাঁর নিজের কাছেই মসৃণ ভাবে মুছে ঘুচে গিয়েছিল। আর আজ? আজ তো সব একেবারে সাফ—পরিষ্কার–আজ বাবা নেই, তুমিও নেই, ওগুলোর দাম যাচাই করব কার কাছে, তাই মূল্যহীন কয়েকটা দলিল আমার কাছ থেকেও হারিয়ে গেছে।

সেদিন কিন্তু এত সহজে জের মেটেনি।

ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে বাবা বাইরে বেরিয়েছেন সেদিন, কাছাকাছি পার্কটাক কোথাও হবে। আমি পড়ছিলাম। তুমি সামনে এসে দাঁড়ালে, সটান, সোজা। ইদানীং কাজ ফেলে এভাবে আমার এত কাছে আসতে না। একটু চমকে গিয়েছিলাম, আনন্দ ও পেয়েছিলাম। বইয়ের পাতা মুড়ে, কত দিন পরে প্রগাঢ় গলায় বলে উঠলাম—”মা।” হাত বাড়িয়ে দিলাম।

কিন্তু দেখলাম তুমি ফিরে যাচ্ছ। আর প্রত্যাখ্যাত হাতটা এল ফিরে, গলায় দড়ি দেওয়া লাশের মতন অধোবদন, রইল ঝুলে।

“তুই তাকে দেখেছিস?” এই কণ্ঠস্বর তো জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসেনি, সুতরাং তোমার। “কাকে?” আমি শুধু চোখ তুলে একবার বলতে পারলাম।

আমার জন্যে আমার কাছে তুমি আসনি, অন্য কী-একটা আছে জেনে নেওয়ার—তাই অভিমান নামে আর-একটা ঢেউ দুলে উঠল, দুলে উঠে সে আগেকার ঢেউ আবেগটাকে তারই পিছেপিছে টেনে নিয়ে গেল। আমি আবার যা তাই, যেখানে ছিলাম সেখানেই ফিরে এলাম। তাই শুকনো গলায় শুধু বলেছিলাম, “কার কথা বলছ, কাকে।”

বেশ কিছুক্ষণ তুমি কথা বলতে পারোনি। খালি কথা বলার কয়েকটা প্রয়াস তোমার চোখে, ঠোঁটের কোণে নানা আকারের ভাঙাচোরা রেখা হয়ে খেলে যাচ্ছিল। শেষে খুব আস্তে, কোনওরকমে বলে ফেলা এই কথাটা শুনতে পেলাম—”তোর বাবা, মানে প্রথম যেদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল।”

“ওঃ সেইদিন!” পুরোনো কথা, সুতরাং যেন কিছুই-না আমি এইভাবে হালকা গলায় বললাম, “সে তো থিয়েটারে। অনেক তো লোকজন ছিল সেখানে। তুমি কার কথা বলছ?”

স্পষ্ট দেখেছি মা, তোমার চোখের পাতা কাঁপছে, তোমার একটা হাত উঠছে। আমাকে মারবে? না, মারোনি। এত বড়, এই বয়সের ছেলেকে চট করে আর মারা যায় না, কারণ, আগেই বলেছি, মা-বাবার বিরুদ্ধে বয়সটাই তখন ছেলেদের বন্ধু, সহায় অথবা বডিগার্ড যে। নতুবা তুমি মারতে, জেনেশুনে সজ্ঞানে আমি মিথ্যে বলেছি, ন্যাকা সেজেছি, সেই কারণে। কিন্তু যে-দৃষ্টি তোমার চোখে দেখলাম, মা! তার চেয়ে মারও বুঝি কম অপমানের ছিল। একটিবারও পাতা-না-পড়া সারা চোখের ধিক্কার দিয়ে আমার মিথ্যেটাকে পুড়িয়ে দিয়েছ তুমি। “ছি-ছি’, সেই চাউনি বলছিল ‘ছি-ছি’ তোর বাবা সেদিন থিয়েটারে অজ্ঞান হয়ে পড়েনি। “আমি জানি।”

“আমি জানি”, তোমাকে বলতে শুনলাম, “কোথায় ছিল, কোথায় গিয়েছিল সে।” স্থির দৃষ্টি আমার দৃষ্টিতে ন্যস্ত করে বললে, “তুই তাকে দেখেছিস?”

“দেখেছি, মা।”

“কেমন দেখতে, বল্ না, বল্ না, সেই নলিনী দেখতে কেমন? “ আমি নিরুত্তর।

তোমার প্রত্যেকটা প্রশ্ন তখন চিমটির মতো কাটছে আমাকে, আমি কথা বলব না দেখে তুমিই কথা জুগিয়ে যাচ্ছ, আমাকে দিয়ে কবুল করিয়ে নেবে বলে—”বল্ না, বল্ না, দেখতে সে কেমন? খুব হাসে বুঝি, আর দাঁতে মিশি দেয়?”

“দেয়, মা।” অম্লানবদনে বললাম।

(নলিনী আমাকে গরম দুধ খাইয়েছিল।)

“গায়ের রঙ কেমন? আমার মতো?”

“তোমার মতো রঙ ক’জনের আছে মা। তোমার পাশে সে মিকালো।”

(নলিনী তার নিজের আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিয়েছে।)

“বাজে কথা বলিস না”, তুমি তেড়ে উঠলে সতেজে, “চিনি তোদের সব ক’টাকে। সব এক জাত এক ধাত।”

(আমি আর বাবা এক-জাত এক-ধাত, তুমি ঠিক জানো তো মা?)

“সত্যি বলছি, ভীষণ কালো। থথপে, মোটা, বিশ্রী।” এবার আরও জোর গলায় বললাম।

(আমাকে নীচে অবধি পৌঁছে দিয়েছিল নলিনী, স্নেহে মমতায় আমার হাত চেপে ধরেছিল—হে ঈশ্বর, এই কৃতঘ্নতার পাপে আমার যেন কুষ্ঠ, কালব্যাধি হয়। কিন্তু না, ওই ভীষণ সব শাস্তি আমি পাবই বা কেন, মার–আমার দুঃখিনী মার মান আর মন রাখতে বানিয়ে সব বলছি, ঈশ্বর, তুমি জানো না? )

“ওর মুখের ভাষা খুব বিশ্রী তো?”

“বিচ্ছিরি, মা। তোমাকে মুখ ফুটে বলতে পারব না। বে-হায়া বলতে যা বোঝায় তা-ই।”

“তোর বাবা–তোর বাবাকে নিয়ে করছিল কী, কীভাবে চাইছিল?”—শেষ সঙ্কোচের লেশটুকুও খসিয়ে ফেলে হঠাৎ দ্রুত বলে উঠছ তুমি, যেন চোখ বুজে—আমরা খানাখন্দ গর্তটর্ত সামনে পড়লে যেভাবে পার হয়ে যাই।

“সে-সব তোমাকে বলা যায় না। মানে, ওইসব মেয়ে যে-রকম করে থাকে আর কী।”

(বাবা অজ্ঞান হতে না হতে নলিনী তাঁর মাথাটা কোলে তুলে নিয়েছিল।) এবার তুমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলে। বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছে তোমার মুখ, দেখতে পাচ্ছি। তারই মধ্যে একটু সান্ত্বনার খোরাক আমার কথা, মা, আমি তো যথাসাধ্য শান্তির ছিটেফোঁটা যোগান দিয়ে যাচ্ছি।

“তুই তো এতদিন কিছু বলিসনি। সর্ব চেপে গিয়েছিলি।”—অনেক পরে বললে আস্তে আস্তে।

“বলা যায় না যে, বলা উচিত নয়। ছেলে হয়ে কী করে—বলো, তুমিই বলো তো!”

“ঠিক।” আমার মাথায় একটি হাত রাখলে, যে-হাতটা মারবে বলে একটু আগে তুলেছিলে। “এখন তুই মস্-তো হয়ে গেছিস।“

“মস্ত না, মা।” খুব অবনত ভাবে বললাম, “একটু বড়ো; বলতে পার। এখন আমি একটু-একটু বুঝতে পারি।”

“যা বুঝবি, এবার থেকে সব আমাকে বলিস।” এ কি প্রত্যাশা, এ কি আদেশ? বড় হওয়ার স্বীকৃতি এ কি, বড় হওয়ার দাম?

মাথায় অনেকদিন থেকে বড় তো বটেই, মেপে দেখেছি। সেদিন টের পেলাম, বয়সেও সেই প্রথম আমি তোমার সমান-সমান।

মা আর ছেলের মধ্যে লুকোচুরি আর ব্যবধান সেই প্রথম ঘুচে গেল। আর বোধহয়, সেই শেষ বার।

তবু কিন্তু একটা অপরাধের বোঝা আমার ঘাড়ে চেপে মাথার ভিতরকার সব বিচার আর চিন্তা এলোমেলো করে দিতে চাইছিল। তোমাকে একটু স্বস্তি দিতে, তোমার সমান-সমান হতে কার প্রতি যেন আমি ঘোরতর অন্যায় করলাম। সে-কে? বাবার ভেঙে পড়ার ক্ষণটিতে সহসা যে করুণাময়ী হয়েছিল, গরম দুধ খাইয়ে আমার মুখ দিয়েছিল মুছিয়ে, তার কথা মনে পড়ে ভিতরটা হু-হু হয়ে যাচ্ছিল। তাকে অপমান করেছি, কোনও অন্যায় করেনি সে, তবু। এই অপরাধের ক্ষমা নেই, তবু সে যেন আমাকে ক্ষমা করে। এই পর্যন্ত লেখা সোজা হল। কিন্তু মা, এর পর ক্ষমা চেয়ে নেব তোমার কাছেও। তোমাকেও সেদিন ঠকিয়েছি আমি, মুখে যা-ই বলি, মনে মনে তো জানি যে, বিশ্বস্ত থাকতে পারিনি। মনে মনে ওই নলিনীর প্রতিও শ্রদ্ধা-অনুরাগ-কৃতজ্ঞতা মিলিয়ে একটা আকর্ষণ বোধ করছিলাম। যে বারবার মমতাময়ী একটি প্রতিমার রূপে আমার মনে উঁকি দিচ্ছিল। মা, আমার দুঃখিনী মা, তোমার প্রচণ্ড সংশয়-সন্দেহ, মনঃকষ্ট যন্ত্রণার সেই মুহূর্তেও আমি তোমার সঙ্গী হতে পারিনি। বরাবরই একা তুমি, তখনও একা রয়ে গিয়েছ।

আমি, নির্বিবেক, সেদিন একই সঙ্গে তোমাদের দু’জনকেই ঠকিয়েছি।

.

এর পরে, এর পরে মা, এই চিঠির খেই ধরব কোথায়, কালানুক্রমিক আর কত ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে যাব। ঘটনার বর্ণনা বা ঘনঘটা তো এ-লেখার লক্ষ্য ছিল না, এ-তো, চেয়েছিলাম, হোক শুধু উন্মোচন আর বিশ্লেষণ; বদলে-যাওয়ার বিবরণ, কয়েকটি সম্পর্কের, অনেকগুলি মূল্যের; বোধের, বিশ্বাসের, ধারণার। এ-তো নিজেকে বিকাশ করা শুধু, বলে বলে আত্মশোধন। যেমন কিনা সকালের কুলকুচি, মুখে জল পুরে পুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া বাইরে; সব গন্ধ ধুয়ে যাক, গত রাত্রি দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে তার বাসী যত স্মৃতি, বাসী আর তেতো, আচমন করে আবার নূতন।

কী জানি কেন, সেবার শীতে দিন যত তাড়াতাড়ি গুটিয়ে আসতে থাকল, ততই মনে হতে লাগল যে, আমাদের তিনজনকে নিয়ে ছোট্ট যে-টুকু জীবন, তারও একটা অধ্যায় গুটিয়ে আসছে ক্রমে ক্রমে, সহসা সব কোথাও শেষ হয়ে যাবে, উৎক্ষিপ্ত হব আবার, নির্ধারিত এক নিয়তি আমাদের টেনে নিয়ে কোনও এক বাঁকের মুখে হয়তো ঠেলে দেবে।

টের পাচ্ছিলাম। নিয়তি যদিও কাজ করে গোপনে, তবু আগামীর উপরে, বরাবরই দেখি, আজকের ছায়া পড়ে। কে একজন চর বাস করে ভিতরে, সে আগে-ভাগে সব বলে দেয়। সেই ছায়া, অস্পষ্টভাবে, একটা অনিশ্চয়তার আকারে আঁকা হয়ে যায় মুখে মুখে, তোমার মুখে, তোমার মুখে সেই ছায়া পড়ছিল। আমারও।

অথচ বাইরে কোনও লক্ষণ, আতঙ্কের কোনও কারণ ছিল না। হয়তো সবই স্নায়ুর কারসাজি। স্নায়ুরা যেন খোজা প্রহরী, তারা অত্যাচারী, জর্জরিত করে আমাদের; আবার তারা আমাদের প্রতি বিশ্বস্তও বটে।

নইলে দৃশ্য-বাহ্য ভয়ংকর কোনও কিছুর আভাস ছিল না। বাবা আবার কাজে যেতে আরম্ভ করেছিলেন, বেরুতেন একটু দেরিতে, বিকেলের দিকে। আমার কলেজ চলছিল; তোমার পুজো, কাপড়-কাচা রান্না। একটু টানাটানিও চলছিল অবশ্য। এই ক’মাস বাবা ঘরে বসে, ঠিকমতো টাকা আসছিল না, তার উপরে ডাক্তার, ওষুধ, খরচের ধাক্কা।

কিন্তু তাতেই তো মুষড়ে পড়োনি তুমি। বাতাস থেকে লোকে যেমন শ্বাস নেয়, তুমিও তেমনই উপর দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য কোনও নল থেকে টেনে নিতে সাহস। তাই নিচ্ছিলে।

প্রথম কবে ভয় পেলে তুমি, কবে? কাজে ফের যোগ দেওয়ার পরও যখন মাস ঘুরে গেল, অথচ ঘরে মাইনে এল না, তখন কি? সে মাসে তোমার হাত একেবারে খালি। একটা শার্টই কোনওমতে এ-বেলা ও-বেলা কেচে ক্লাসে যাওয়া চালিয়ে দিচ্ছিলাম। জামাটা, যেহেতু ইস্তিরি করা সম্ভব ছিল না তাই তা কুঁচকেই থাকত আমার কুণ্ঠিত-অস্বচ্ছন্দ মনের মতো।

তুমি ভয় পেলে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করে লাভ হল না, উনি এলোমেলো উত্তর দিয়ে ব্যাপারটা কীভাবে যেন ব্যাখ্যা করতে চাইলেন, ব্যাখ্যা করতে কিংবা উড়িয়ে দিতে, তাতে তোমার সন্দেহটা আরও বাড়ল। এমনিতেও অসুখটার পর থেকে বাবার কথা-টথা কেমন জড়িয়ে যেত, সব সময় অর্থ বোঝা যেত না।

তুমি বললে, “এই, আমার ভালো ঠেকছে না। উনি কেমন হয়ে গেছেন দেখছিস তো। উনি—উনি বোধহয় কাজে যান না।”

“কাজে যান না? কোথায় যান তবে?”

“কী জানি কোথায়। কোথাও নিশ্চয়ই। সেই জন্যেই তো বলছি। বলছি যে, তুই-ও একদিন না-হয় ওঁর সঙ্গে যা। দূর থেকে দেখবি, লক্ষ্য রাখবি।”

: তুমি ভেবেছিলে বাবা কাছে-পিঠে নেই, সুতরাং শুনছেন না! কিন্তু তিনি শুনেছিলেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কী-একটা ভুলে-যাওয়া জিনিস নিতে ফিরে এসেছিলেন—ঠিক তক্ষুনি। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন তিনি, বন্য জন্তু যেভাবে শুকনো ডালপালা মচমচ করে ভেঙে-চুরে ধেয়ে আসে, সেইভাবে। কিন্তু হঠাৎ একেবারে স্থির ঘরে ঢুকে। একবার আমার দিকে তাকালেন, একবার তোমার দিকে। অদ্ভুত একটা হাসি মুখের দিক-রেখায় ধীরে ধীরে উদিত হল। সেই হাসি দিয়েই মাখিয়ে মাখিয়ে, অথচ আহত গলায়, বাবা বলছিলেন—”সঙ্গে যা! লক্ষ্য রাখ! তার মানে, আনু, আমার ছেলেকে বলছ আমারই পেছনে স্পাই হতে? ছিঃ!”

তুমি কাঠ, কথা বলছিলে না। বাবাই বলে চলেছিলেন, হঠাৎ মুখ খুলে গিয়েছিল তাঁর, তাই অনায়াস সাহসে বলে গেলেন, “স্পাই লাগাবার দরকার তো নেই। ঠিকই ধরেছ তুমি আনু। আমি প্রেসে যাই না, থিয়েটারেও না। আমি যাই তার কাছে।”

নাম উচ্চারিত হল না; অথচ বোঝা গেল। বাবা তেমনই সোজাসুজি চেয়ে, স্পষ্ট গলায় বললেন, “হ্যাঁ, তার। তোমার কোনও ধারণা নেই, সে কত উঁচুতে। সে দেবী, সে আমাকে বাঁচিয়েছে। আমি তার কাছে ঋণী,—প্রাণের ঋণ; যাই সেটা শোধ করতে।”

“সে দেবী?” এতক্ষণে একটুখানি হাসি দেখা দিল তোমার মুখে, যে-হাসির নাম ব্যঙ্গ অথবা অবিশ্বাস, যে-হাসি ছুরির মতো ধারালো।—”সে দেবী?” তুমি বলছিলে, “একটা থিয়েটারের মেয়ে, খারাপ মেয়ে, সে দেবী হয়ে গেছে তোমার চোখে?”

“থামো!” চমকে গেছি বাবার নির্ভয়, দৃঢ় কণ্ঠস্বরে।

আর, মা, তার চেয়েও চমকে দিয়েছ তুমি। আমাদের কান চকিত করে দিয়ে বলে উঠেছ, “আমি যাব, আমাকে দেখাবে তাকে?”

চকিত বাবাও, কিন্তু রোখ্ যখন চেপে গেছে, তখন সেই উত্তর-প্রত্যুত্তরের খেলায় তিনি হার মানবেন কি অত সহজে! তাঁকে গম্ভীর গলায় বলতে শুনলাম “যাবে? দেখবে তাকে? সে-সাহস কি তোমার আছে?”

“দেখানোর সাহস তোমার আছে তো?” এবার তোমার গলা। সেই হাসিমাখা ছুরিটাই আবার ঝলসালো।

এ কী নাটক! জীবনে এমন নাটক পড়িনি, কিংবা লিখিনি। জীবনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কিনা, তাই সেই মুহূর্তে এই বিবেচনাবোধও লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল যে, ওই দৃশ্যের কতটা বাস্তব, কতটা অলীক। এমন-কী তিনজনে মিলে যখন দৃশ্যান্তরে চলে যাচ্ছি—একটা ঘোড়ার গাড়িতে, এ-পাশে বাবা আর আমি; তুমি ও-পাশে, ঘোমটার উপরে চাদর মুড়ি দিয়ে—তখনও সেই অভিজ্ঞতার আস্তরণ নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা আর অযোগ্যতার টানাটানি চলছিল।

.

বাবা হঠাৎ বললেন, “নামো এইখানে।” তুমি নামলে। তখনও আপাদ-মস্তক ঢাকা, খালি চটিজোড়া দেখা যায়, আলতা-পরা দু’টি পা তার উপরে।

নলিনী ছিল পাশের ঘরে, যে-ঘরে একদিন বাবাকে ঘুমোতে দেখেছি সেই ঘরে, দেওয়ালে, একটি পট, সিঁদুরে-আঁকা মাঙ্গলিক। বাবা, প্রথম সংলাপ তাঁরই, আঙুল তুলে বললেন, “ওই দ্যাখো।”

চমকে ফিরে তাকাল নলিনী। থতমত খেয়ে বলল, “আরে! আপনারা—আপনি!” তখনই সে বাবার পিছনে দেখতে পেল কিনা তোমাকে, অথচ আশ্চর্য বসতে বলল না একবারও নিজেই উঠে দাঁড়াল, এগিয়ে আসতে থাকল। আস্তে আস্তে। ওর পা টলছে, কিন্তু সেটা লুকোতে চেষ্টা করল না, একটুও, বরং দেখিয়েই যেন টলাচ্ছে।

আজকের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেদিন থাকত যদি, তবে তখনই বুঝে ফেলতাম নলিনী একটা কিছু করার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে।

গালে হাত দিয়ে সে আমাদের সকলকে দেখতে থাকল, শীতের সকালে ঝাঁপ দিয়ে পড়ার আগে লোকে যেমন পুকুরটাকে ভালো করে দেখে নেয়। তারপর আমাকে বলল, “খোকা, তুমি একটু বাইরে যাও তো, ওখানে গিয়ে বোস।”

আদেশের ভঙ্গি, অমান্য করার সাহস হল না।

তুমি তো সেখানেই ছিলে, চৌকাঠে স্থির, তুমিই বলো তো, এখন কি আস্তে আস্তে মুখের ভাবও বদলে যাচ্ছিল নলিনীর, যেমন সে নিজের গলাটাও যেন বদলে নিয়ে বলেছিল, “ওঁকে—ওঁকে এখানে এনেছেন কেন?”

আমি ওর মুখ দেখতে পাইনি। কিন্তু গলা শুনেছি।

“তোমাকে দেখাতে।”—বাবার গলা।

“আমাকে? আমরা কী নোংরা, কী বিশ্রী, কী খারাপ হয়ে থাকি, তাই দেখাতে প্রণববাবু, আপনার মাথা একেবারে খারাপ। মাথাটার চিকিৎসা করান আগে।”

হেসে হেসে বলছিল নলিনী, তখন কি তার কোমরও উঠছিল দুলে দুলে? আমি দেখতে পাইনি।

“নোংরা তো নও, খারাপও নও তুমি।” বাবা বিস্মিত, তবু বলে চলেছেন পূর্ব বিশ্বাসে, “এই তো এসে দেখলাম, তুমি পুজোয় বসেছ।”

“ঠিক যেমন লেখে শরৎবাবুর নবেলে?” ঝলক দিয়ে দিয়ে হাসছে নলিনী, হাসি তো নয়, যেন রক্ত উঠছে, “আর দূর, দূর, আপনার মাথা খারাপ বলেছি না, প্রণববাবু? খারাপ খালি মাথাটাই, নইলে ভেতরটা ভালো—একেবারে নিপাট সাদা ভালোমানুষ, এ-লাইন আপনার নয়। জানেন তো, আমরা থিয়েটার করি? বুঝছেন না, ওই পুজো-টুজোও আমাদের ভড়ং? অভিনয়? আমরা হলুম গিয়ে বজ্জাত, ধড়িবাজ—আমাদের নাড়ি-নক্ষত্তোরের হদিশ পাওয়া আপনার সাধ্যি নয় যদি বলি”–বলতে বলতে খিলখিল হাসতে থাকল নলিনী—”যদি বলি, এই চন্নামেতো দেখছেন, আসলে ওটা হল চোলাই মদ, চাখি, খাই চুক চুক করে, দেবো, খাইয়ে দেবো একটু আপনাকে?”

বলতে পারব না নলিনী আঁচলে গাছকোমরও বেঁধে নিয়েছিল কিনা। আমি তখন শুনলাম তোমাকে চাপা গলায় বলতে—”চলে এসো, চলে এসো তুমি এখান থেকে।”

কথাটা নলিনী যেন কান পেতে শুনল। এবার টিকটিকির মতো গলা করে বলে উঠল, “ঠিক ঠিক। ঠিক বলেছেন আপনি। চলে যান, নিয়ে যান ওঁকে এখান থেকে। ভদ্দরলোক থাকে এখানে—ছিঃ।”

স্পষ্টই বোঝা গেল, বাবা ভেঙে পড়ছেন আস্তে আস্তে, অন্তত ওঁর ভাঙা গলাই শোনা গেল, “কিন্তু নলিনী আমি যে বড় বড়াই করে ওদের নিয়ে এসেছিলাম। বড় মুখ করে বলেছিলাম—দেখাব।”

“কাকে?”

“আমার প্রাণদাত্রীকে।”

“প্রাণ?” নলিনী উঠল ভেংচে, “বলে নিজের পেরানটাই রাখা দায়, তায় আবার অন্যকে পেরান-দান? না মশাই দানটান কিচ্ছু করিনি আমি, করতে পারব না। দেখবেন, এক্ষুনি সাত-শকুন এসে আমার প্রাণটা নিয়েই টানাটানি শুরু করবে—তাই তো তৈরি হয়ে আছি সেজেগুজে।”

“চলে এসো, চলে এসো এক্ষুনি।”

একটু থামল নলিনী, হয়তো, তোমার গলা শুনতে; থেমেই ফের গলগল বলে চলল, “আপনার সঙ্গে বেরোতে পারতাম অবিশ্যি, তা আপনি তো মশাই আবার ঘরের বউ সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, ডুডু আর টামাক, দুই-ই?—অ্যাক্কেবারে মাথা খারাপ। তা-ছাড়া, আপনার তো আবার রেস্ত নেইকো, পকেট টু-টু। যান বলছি, পালান শিগগিরি, নইলে বলেছি না কখন আবার ওরা এসে পড়বে। যদি সব্যসাচীই আসে? সেদিন তবু জানে মারেনি, আজ কিন্তু বলা যায় না, থাকবে না রক্ষে। আপনি পাগল একদম, ওদের চেনেন না, আরে মশাই, আপনার ওই ভালোমানুষি পালা-টালা ওই বদমাশেরা ভেবেছেন বুঝি স্টেজে নামাবে?”

মাটিতে নুয়ে-পড়া বাবার গলা—”কিন্তু নলিনী, আজ আমি সে-জন্যে আসিনি। ও-সব আর ভাবছি না।”

“কী ভাবছেন তবে?”

“ভাবছি, এ কি তুমিই, যে সেদিন আমাকে—”

“বলেছি তো অভিনয় করেছিলাম। থিয়েটার মশাই, সব থিয়েটার জানেন না?” নলিনী গুনগুন সুরে ভাঁজতে শুরু করেছিল—”নলিনী দলগত জলমতি তরলং…?”

“চলে এসো।” ধ্বনিত হল এই শেষ বার। তার পরেই দেখলাম, তুমি বারান্দায়। বাবা, মাথা হেঁট, বেরিয়ে আসছেন পিছে পিছে। আর নলিনী? সে তোমাদের পিঠের উপরে ঠাস করে জোড়া কবাট বন্ধ করে দিচ্ছে।

থিয়েটার, সব থিয়েটার। সেদিনকার ওই চমৎকার থিয়েটারটা দেখার পর অনেকক্ষণ আমরা কেউ কথা বলতে পারিনি। বাকরোধ হয়ে গিয়েছিল—ঘৃণায়, বিস্ময়ে, আতঙ্কে।

পরে, অনেক পরে, স্মৃতির রঙ যখন বদলে যেতে থাকল ক্রমে ক্রমে, পুরনো বইয়ের পাতার যেমন যায়, পড়া কবিতার এক-একটা অর্থ-বেরিয়ে আসে হঠাৎ, তেমনই এই থিয়েটারও আমি অন্য দিক থেকে দেখতে পেয়েছি, যেন সিন্-এর পিছনে বসে।

কোনও কোনও সিন্-এ দর্শকও দৃশ্যের অংশ; সীএর মতোই আঁকা হয়ে যায়; চেয়ে থাকে বিস্ফারিত, বোকা। তখন চিনতেও পারে না, ইচ্ছে করে ভূষোকালি মেখে পুতনা রাক্ষসীর বেশে সে দেখা দিল কিনা, গতকালই যে বহুরূপিণী ছিল যশোদা। কারও কারও শেষ মোহটাও গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যায়—থিয়েটার, সব থিয়েটার!

১৯

বাবার সেই একেবারে চূর্ণ চেহারাটা প্রথম আমি দেখতে পাই একদিন, আহিরীটোলায়, গঙ্গার ঘাটে। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিল গঙ্গামৃত্তিকা গায়ে লাগালে শরীর স্নিগ্ধ থাকে, বাবা বিনাবাক্যে সেই ব্যবস্থাটা মেনে নিয়েছিলেন। প্রথমে ভাঁটার সময় গঙ্গা মাটিতে লিপ্ত করতেন সর্বাঙ্গ, তারপর জোয়ার এলে গা ভাসিয়ে দিতেন, পাড়ে উঠতেন সব ধুয়ে ফেলে। কখন জোয়ার আসে, সেই অপেক্ষায়, দেখছি, অনেকক্ষণ ঘাটে বসে আছেন। জোয়ারে গা ঢেলে প্রায় দেখতাম, চলে যাচ্ছেন দূর থেকে দূরে, বাঁধা নৌকো, গাদাবোট, ফ্ল্যাট আর সিটিবাজানো ফেরি-ইস্টিমারগুলোও ছাড়িয়ে, পাড়ে অবিরল ছলাৎ-ছলাৎ ঢেউ, ঢেউ ঘোলা জল, জলে রোদ ঝিকঝিক, বাবাকে আর দেখা যায় না, তখন আমার ভয় করত।

তোমার হুকুমে শুকনো কাপড় নিয়ে আমি প্রায়ই বাবার সঙ্গে যেতাম কি না। ভয় করত, বাবা যেদিন অনেক দূরে চলে যেতেন। দুর্বল শরীর, সবে তো সেরে উঠছেন, মনে মনে ভাবতাম, এতটা ভালো না, যেন বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে—ভাবতাম। যদি হাঁপিয়ে পড়েন, তলিয়ে যান? চিৎকার করে তখন ডাকতাম। কিন্তু উনি যেন শুনছেন না, শুনতে পাচ্ছেন না বা চাইছেন না, দূরে আরও কত দূরে? যেন এ-পারের কথা ওঁর আর মনে নেই, দেখতে পেয়েছেন কিছু ওপারের, অন্তত ওপার থেকে ডাকতে শুনেছেন কাউকে।

(নদীর পারে একটা নিয়ম, ওপারে কারা থাকে, তার ছায়া-ছায়া, তাদের গলা বিলীন উদাস, আকাশে যখন এক-এক ঝাঁক পাখি ছেঁড়া-ছেঁড়া ছড়ানো মালা, বিশেষত শীতকালে, শীতের শেষ দিকের দুপুরে ওরা চক্রাকারে ঘোরে, তখনই ওই পারের অদৃশ্যপ্রায় কারা অকারণে চিৎকার করে কী বলতে থাকে, কাকে ডাকে? হয়তো কাউকেই না, ডাকে না, শুধু কথা বলে পরস্পরকে, সেই গলা ঢেউয়ে-ঢেউয়ে ভেঙে কেঁপে ছড়িয়ে যায়।)

আমার ভয় করত।

সেদিন জোয়ার ছিল বিকালে। বাবা ফিরছেন না, খুঁজতে গিয়ে দেখি তখনও জলে নামেননি, খালি বাঁধানো, ফাটা একটা ধাপে বসে পা দুটিকে ডুবিয়ে রেখেছেন।

আমাকে দেখে নুয়ে পড়ে জল নাড়তে থাকলেন ধীরে ধীরে; ধীরস্বরেই বললেন, “এখনও সময় হয়নি।”

“স্নান করেননি?’

“জোয়ারই আসেনি যে। তবে আসছে, বুঝতে পারছি। এতক্ষণ হয়তো-বা এসে গেছে বজবজে বা খিদিরপুরে।”

“এতক্ষণ ধরে তবে করছেন কী?”

বাবা মুখ তুললেন। একেবারে অদর্শী শূন্য দৃষ্টি, সামান্যতম রঙও লেগে নেই চোখের কোণেতে। সেই দৃষ্টিতে আমার বুকের ভিতরটা কী-রকম করে উঠল, ভয় চাপা দিতে তীক্ষ্ণ গলায় আবার বলে উঠলাম, “এতক্ষণ ধরে তবে করছেন কী?”

“স্রোত দেখছি”, বাবা বললেন জলের উপর ঝুঁকে পড়ে, ঢেউগুলো হাতের এপিঠ ওপিঠ ছুঁতে-ছুঁতে।—”চেয়ে দ্যাখ, এখন এই দিকে বইছে তো, জোয়ার এলেই কিন্তু উলটো দিকে বইতে থাকবে। অপেক্ষা করছি।”

বলে, ওই স্রোতেই ন্যস্ত-দৃষ্টি হয়ে গেলেন। প্রবাহের গতি-প্রকৃতি অত অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করে করে কী রহস্য ধরতে চাইছিলেন তিনি? “কিছুই না”, পরে নিজে থেকেই এক সময় আমাকে বলেছেন, “কিছুই না। পরমাশ্চর্য কোনও তাৎপর্য এখনও উদ্ধার করতে পারিনি। তবে পড়ে যাই, পড়ে যেতে হয়। যেমন সন্ধ্যার পর আকাশে তারা-র খোলা খাতাটা সুযোগ পেলেই পড়ি। উঁহু”—মাথা নেড়ে বাবা বললেন, “মানে বুঝে ফেলি ভাবছিস? মোটেই না। সাংকেতিক ভাষাতে লেখা তো, অক্ষরই যে চিনি না; বুঝব কী করে।”

আমিও বুঝছিলাম না, একটুও না। আর একবার মুখ তুলে বাবা আমাকে বললেন, সহাস্যে কিন্তু সঙ্গোপনে কিছু রহস্য উন্মোচনের ধরনে, “স্রোতের বেলাতেও এই ব্যাপার। বুঝি না। তবে দেখে দেখে এই পর্যন্ত বুঝলাম যে, স্রোত সামনের দিকে চলে। কিন্তু দুষ্টু তো, তাই চলতে চলতে, হয়তো চলায় একটু বৈচিত্র্য আনতে স্রোত নিজেই এক-একটা দ’ তৈরি করে। ওই নিয়ম, জগতের নিয়ম, স্রোতের যেমন, আমাদেরও তেমনই। আমরাও মাঝে মাঝে এক-একটা দ’সৃষ্টি করি, এক-একটা জটিলতায় জড়িয়ে যাই, ঘুরপাক খেতে খেতে এক সময় ছাড়িয়ে নিয়ে আবার চলি। বেশ মজা, না?”

বাবা হাসছিলেন, কিন্তু কেমন করে যেন, ওই ঢেউগুলো পার হয়ে ওপারে গিয়ে যেন, মা, আমি হাসতে পারছিলাম না; গলা থেকে পা আমার সবই কেঁপে যাচ্ছিল।

(সেই দেশের বাড়িতে একবার চৈত্রের রাত্রে উঠোনে কে এসে শিব সেজে দাঁড়াল, তার মুখ সাদা, গলায় সাপ, গায়ে ছাই, আমি জড়োসড়ো, কিন্তু তুমি ক্রমাগত আমাকে ঠেলা দিতে দিতে বলছ ‘যা না, ও তো তোদের ইস্কুলের হরি দপ্তরী, কাছে গিয়ে দ্যাখ না।’ তবু যেতে চাইনি। চেনা মানুষেরাও হঠাৎ-হঠাৎ অচেনা চেহারায় দেখা দিলে, অচেনা গলায় কথা বললে কেমন লাগে বলো তো। হোক না বহুরূপী। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, বহুরূপীকে দেখে যে কোনও লোকের একটু ভয় না লেগেই পারে না।)

ছেলেবেলার সেই ভয় সেদিন গঙ্গার ঘাটে ফিরে এসেছিল, বাবা যখন স্রোতের গতি, তারার ভাষা নির্ণয়, এই সব বিষয়ে অস্বাভাবিক কণ্ঠে, ও অসংলগ্নভাবে কী-না-কী বলে যাচ্ছিলেন।

.

তোমাকে বলিনি। বলিনি যে, বাবা তখন মাঝে মাঝে আরও অনেক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটাতেন। এক দিন খুব ভোরে, তুমি কখন উঠে গেছ, জেগে দেখি বাবা আমার শিয়রে। আমার মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে পড়ে যাচ্ছেন, নিজে নিজেই, নাটকে স্বগত-উক্তি যেভাবে করে, “ছিল আশা মেঘনাদ! মুদিব অন্তিমে/এ নয়নদ্বয় আমি তোমার সম্মুখে/সঁপি রাজ্যভার, পুত্র, তোমায়, করিব মহাযাত্রা/কিন্তু বিধি! তাঁর লীলা বুঝিব কেমনে? ভঁড়াইলা সে-সুখে আমারে।”

যেই টের পেলেন আমি ত জেগে, অমনই দূরে পাঠানো কণ্ঠস্বর টেনে আনলেন কাছে। একটু হেসে বললেন, “বল্ তো কার?”

“মাইকেলের তো”, আমি বললাম।

প্রদীপ্ত হয়ে উঠল তাঁর মুখ “পড়েছিস বুঝি? এরই মধ্যে? বাঃ! পড়ে যা। তারপর— এখানে তিনি বুঝি একটু ইতস্তত করলেন, “তারপর লিখিস্। লিখে যাস।” আমার কপালের উপর প্রবল হাতের চাপ, অধীর একটি আশীর্বাদ।

তোমাকে তখন এ-সব বলিনি।

কিন্তু খটকা তোমারও কি লাগল না, বাবা যেদিন সকালে বাজারে গিয়ে আর কিছু না, নিয়ে এলেন শুধু রাশি রাশি সজনের ফুল, তুমি খুব হতাশ হয়ে, খুব রেগে গিয়ে বললে, “এ কী? শুধু ফুল? এত ফুল কি কিনে আনলে তুমি?”

“কিনেই তো। নইলে আমাকে কে দেবে বলো। তবে আমি তোমাকে দিচ্ছি”, বলতে বলতে বাবা সেই রাশি রাশি ফুল তোমার কোঁচড়ে উপুড় করে ঢেলে দিলেন।

গালে তোমার একটু লালের ছিটে লাগল, বাবা কিন্তু এতটুকু লজ্জিত নন, বললেন, “যদি পাই তবে একদিন শালের মঞ্জরীও নিয়ে আসব। সজনে আর শালের মঞ্জরী। দুটোর তাৎপর্য কী, জানো? সজনের কাছে শিখে নেব হাসির শুভ্রতা, আর শালের মঞ্জরীর কাছে চাইব যেন তার মতো সব তুচ্ছতাকে অতিক্রম করে ঊর্ধ্বে উঠে যেতে পারি!“

“ওসব বড় বড় ভাবের কথা। মানে বুঝি না!” তুমি বলেছ বিরস স্বরে! বাবা তখন “তবে হালকা একটা কিছু শুনবে?” বলেই শুরু করেছেন, “মরি মরি মরি কী আশ্চর্য, পুরুষের ব্রহ্মচর্য হউক সলিল দৃঢ়, তুষার/শীতল/তথাপি আতপ-তাপে যে-জল, সে-জল।“

–যে-জল, সে-জল। বাবা থেমে বলেছেন “বলো তো কার?”

“জানি না।”

“তোমাকে তো মুখস্থ করিয়েছিলাম একবার। নবীন সেনের লেখা।“

বাবার উদ্ধৃতি আবৃত্তির বেশির ভাগই ছিল মাইকেল, হেম, নবীন সেনের।

কিন্তু শুধু ভাবের কথাই তো নয়, অভাবের কথাও আমাদের সংসারে এক একটু করে ঢুকে পড়ছিল, ঢুকে না পড়ুক আনাচে কানাচে তার কালো ছায়ার আভাস মিলছিল। মাঝে মাঝে মনে হত বিকট চেহারার কেউ জানালার বাইরে শিকে মুখ রেখে স্থির ভাবে চেয়ে দেখছে। যেন সুযোগের অপেক্ষায় আছে সে, আর একটু সাহস বাড়ালেই শিক ধরে ঝাঁকাতে শুরু করবে।

তবু গোড়ার দিকে তোমাকে বিচলিত হতে দেখিনি। খুব ভোরে, যেমন করতে তেমনই, স্নান করে আসছ, সিঁদুর পরছ যত্ন করে, আর সকালের দিকে যতক্ষণ টুকিটাকি কাজ সারা না হচ্ছে, ততক্ষণ কোনও কীর্তনের সুর গুনগুন করছ আপন মনে। ওই সুরটা আমি চিনি, যখনই শুনি তখনই মনের খুব নীচের পরতে ছোট্ট একটি কাঁটার মতন কী-যেন ফোটে। আর সেই সময়েই টের পাই, কেউ একেবারে যায় না, কিছু-না-কিছু যায় রেখে, যেমন সুধীরমামা কবে গেছেন, অথচ রয়েও গেছেন ওই সব গানের সুরের রেশে!

যেমন—গল্প থামিয়ে, মা, আরও একটু বলব?—যেমন প্রথম যে-পদ্মটির গন্ধ পাই, আমার বয়সের সেই সকালে, সেই পদ্মটি আর নেই

(সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি ফুল শুকিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় সবচেয়ে তাড়াতাড়ি), কিন্তু যখনই আজও একটি পদ্ম হাতের কাছে পাই, নাকের কাছে এনে তার ঘ্রাণ নিই, স্নিগ্ধ, মৃদু, তখনই সেই প্রথম-পাওয়া সৌরভটিকে ফিরে পাই। মরে-যাওয়া একটি ফুল চিরকালের সব ফুলের মধ্যে গন্ধটুকু হয়ে জেগে আছে।

এই সৌরভের নামই স্মৃতি। বারবার তা ফিরে আসে ছবিতে, গানে, আমাদের আমূল কাঁপায়। দ্যাখো মা, অসুখে পড়ে পাতার পর পাতা তো এই সব লিখে ভরে ফেলেছি, এখনও যদি হঠাৎ অনেক আগে শোনা কোনও গান বেজে ওঠে, অমনই উদাস হয়ে যাব। আমার হাত থামবে, কলমটা কাঁপবে। না, এই বয়সের পথে সমীচীন কোনও ভক্তি বা তত্ত্বমূলক গানেই না। খুব কাঁচা, হয়তো খুব জোলো প্রেমের গানেও। অথচ এখন কি আর প্রেম করা বলতে যা বোঝায় সেই অর্থে প্রেম করি বা প্রেমে পড়ি? না। তবু হারানো একটি গান, পুরনো সেই সুর ধ্বনিত হলে আজও কান পেতে থাকি, তারা থরথর বয়সের যত হাহাকার, প্রেমের প্রথম দংশনগুলিকে ফিরিয়ে আনে। ক্ষতগুলি আবার জ্বালিয়ে দেয় বলেই বুঝি, এখনও আছি। সুরকেই তাই স্মৃতি, আর স্মৃতিকে সৌরভ বলছি।

তুমি বলতে শুরু করেছিলে, “ভালো ঠেকছে না, একটুও ভালো ঠেকছে না।” বুঝেছি যে, তুমি বাবার কথা বলছ। বাবার চালচলন ধরন-ধারণ সবাই বদলে গিয়েছিল। বাড়ি থেকে বের হতেই চাইতেন না। তবু মাঝে মাঝে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হত পার্কে; কোনও-কোনও দিন গঙ্গার ঘাটে, যেদিন ছায়ার মতো আমি সঙ্গী হতে পারতাম।

“এর চেয়ে”, অস্থির হয়ে তুমি এক-এক দিন বলে উঠেছ, “ও আগে যখন বাইরে-বাইরে ঘুরত, সে-ও একরকম ছিল। কিংবা সংসার ছেড়ে দূরে-দূরে, খবর ও পেতাম না হয়তো, তবু মানুষটাকে বোঝা যেত। এখন আর ওকে বোঝা যায় না। বাইরে যায় না, ঘরে পড়ে আছে আধ-মরা হয়ে—ঘরে থেকেও যেন আরও বাইরে চলে যাচ্ছে।”

এর কিছুটা হয়তো অত্যুক্তি। যেটা ঘটে সেটা খোলা মনে আমরা মেনে নিতে পারি না, যেটা চলে যায় দীর্ঘশ্বাস ফেলি তার জন্যে, ভাবি সেটাই ছিল ভালো। তোমার খেদ এই নিয়মের ছকেই পড়ত, তবে অস্বস্তি-আতঙ্কের কারণও ছিল।

একটা বড় কারণ, বাবার যে চাকরিটা আর নেই, সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ওরা ছাড়িয়ে দিয়ে থাকবে।

তোমার অবশ্য বিশ্বাস ছিল ছাড়ায়নি, বাবা নিজেই ছেড়েছেন। বাবাকে তুমি আগে থেকে, আর সন্দেহ কী, আমার চেয়ে ভালো করে চিনতে। বলেছ, “ওর বরাবরের যা ধারা আবারও তাই। তা ছাড়া কাজ করবে কী করে, ওখানে আর টিকতে পারত না তো। প্রেসের চাকরিটা আসলে ছিল ছুতো। থিয়েটারের একটু নামগন্ধ ছিল কিনা, তাই। যে-আশায় ওখানে গিয়েছিল, তাই যখন ভাঙল, তখন আর পড়ে থাকবে কিসের জন্যে। শরীর ভেঙেছে ওর, শরীরের সঙ্গে মনও। কিন্তু আমরা কী করি বল্ তো, আমাদের চলে কী করে?”

তুমি সংসার চলার কথাই ভাবছিলে। মা, ওই কঠিন দিনে, সংকট যখন সাঁড়াশির মুখের মতো ছোট হয়ে আসছে, তখনও আমি কিন্তু একটা পালা-বদল চমৎকৃত হয়ে লক্ষ্য করেছি। যতদিন বাবা ছিলেন রূঢ়-বলিষ্ঠ, পুরুষ-বাস্তব, ততদিন তুমি ছিলে সুদূর, ক্ষীণ, শোকে ধূসর; নিজের রচিত এক অলীক জগতে বাস করছিলে। আর বাবা যখন নির্জিত-নির্জীব, হয় অস্তিত্ব-অনুভূতির কোনও স্তরে সূক্ষ্ম উড্ডীন, অথবা বলা যায়, একটা অবাস্তব বোধের মধ্যে বিলীন, তখন তুমি বেরিয়ে এলে, বেরিয়ে তোমাকে আসতেই হল, গরজে, প্রয়োজনে। নিজেদের সম্ভ্রম আর ভদ্রতা নিয়ে পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখাই তখন একমাত্র উদ্বেগ, আর তাই তুমি স্বাভাবিক বিচারে আচরণে ফিরে এলে।

এক পরিবারে একই সঙ্গে দুটি অস্বাভাবিক চরিত্রের অবস্থিতি অসম্ভব, সেটা প্রায় বে-হিসাবী বিলাসের পর্যায়ে পড়ে। বিধাতা তাই আতিশয্য হেঁটেকেটে সামঞ্জস্য এনে দেন, বরাদ্দের ভারসাম্য বজায় থাকে।

.

এবার সে শিকগুলো দুমড়ে বাঁকিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়তে চেষ্টা করছিল, অনটন-অভাবের সেই ছায়ামূর্তিটা, নতুবা সে সারাক্ষণই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত জানালার বাইরে, ক্লাস থেকে ফিরে ক্লান্ত আমি যখনই চোখে বুজেছি তখনই সেই অশরীরী কেউ ভীষণ অত্যাচারী, দুঃস্বপ্নটা দেখতে পেতাম। ক্লাস পুরো করা ছেড়ে দিয়েছিলাম তো, পড়া মাথায় ঢুকত না, ইচ্ছেও করত না পড়তে, কারণ ভরপেট খেয়ে তো কলেজে যাইনি, একটা দুটো ঘণ্টা পেটা হতে না হতে পেট খালি, তখন করিডরে সিঁড়িতে ভিড়, ঠেলাঠেলি, পাশের গলিতে একটা বাড়ির ছাতে, দূর ওসব দেখে কী হবে, খালি পেটে কি আর ও-সমস্ত ভাল্লাগে, ওরা ফিজিক্স থিয়েটারের ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে চোরা শিস দিচ্ছে দিক, শিস দেওয়ার কায়দা ওরা জানে, আমার জিভটা একটু মোটা, জড়—আমি পারিনে। ঢংঢং ঘণ্টা, এর পর কী, কার ক্লাস, ও হ্যাঁ হ্যাঁ পি. আর. সির বাংলার। মাথা ঝিম-ঝিম, পি. আর. সি. রোজ অমন টেড়ি বাগিয়ে আসেন কী করে, এই সুমন্ত শুনছিস, নটবর কার্তিক মাইরি, কাঁধে চাদরটা পাট-পাট, একটুও কোঁচকায় না, ওর বউ ওকে নিশ্চয় রোজ-রোজ সাজিয়ে দেয়, সাজিয়ে-গুছিয়ে ক্লাসে পাঠায়, দ্বিতীয় পক্ষের বউ যে, বৃদ্ধস্য তরুণী…., এই তরফদার তুই তো সব জানিস, তরুণী বউয়েরা আর কী-কী করে দেয় একবাট্টি বল না শুনি। লেকচার শুনছিস, তাই বলছিস চুপ করতে? খুব যে! লেকচার শুনছিস না ঘোড়ার ডিম, ওটা হল তোর পোজ, কী আছে এত শোনার, শুনি! স্যারের কোন্ কথাটা নতুন, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁহার জীবনদেবতা, অ্যাক্কেবারে পচে গ্যাছে, রবীন্দ্রনাথ পচেননি। শুনে শুনে ওই কথাটা পচেছে, এর পরের পিরিয়ডটা তো আরও যাচ্ছেতাই, ও. পি. সি.-র ক্লাস, পি. সি. পড়ান পলিটিক্স, ডেমোক্রাসি কী অ্যাকরডিং টু আরিস্টট্ল ইজ দি পারভারটেড ফরম অব, অব, অব কী যেন কথাটা কী যেন, আমি কিন্তু কাটছি, পরের ক্লাসটা থেকে পালাচ্ছি, তরফদার চাঁদু ভাইটি, তুই প্রক্‌সিটা দিয়ে দিস, মাথাটা ঝিম ঝিম করছে, মাথার আর কী দোষ, খেয়েছি সেই কোন্ সকলে তা-ও ভাতে-ভাত, সে-সব হজম হয়ে গেছে কোন্ কালে, ফেরার পথে খাব চিনেবাদাম, তা-ও এক পয়সার মোটে, তার আগে দাও না দারোয়ান ভাই মিশিরজী, আমাকে আঁজলা ভরে জল খেতে দাও, নইলে এতটা পথ আমি যাব কী করে, পেটে খিদে চনচনে, রাস্তায় শেষে মাথা ঘুরে পড়ে না যাই, চোখ মুখে যদি অন্তত জলের ছিটে থাকে তবে পানের দোকানের আয়নায় নিজের-মুখ দেখার সুখ পেতে-পেতে দিব্যি যাওয়া যাবে।

এই অংশটা এইভাবে লিখলাম, তখনকার মনের ভাব, চিন্তার ধরনের খানিকটা আভাস দিতে, ভিজে মাটি, শুকনো ঘাস, কাদা শিকড়সুদ্ধ কিছুটা আনলাম উপড়ে

কিন্তু এই চালে কেন? মা, তুমি এই কথাটা জানতে চাইবে তো? অন্য কোনও রকমে তখনকার দারিদ্র্যের বিকট মুখচ্ছবি ফোটাতে পারব না যে। এককালে পারতাম, যখন সে কাছের ছিল, আমার পিঠের কাছে, বুকের কাছে, ঘাড়ের উপরে তার গরম-গরম নিশ্বাস ফেলত। ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে চোখ বুজলে তাকে দেখতে পেতাম, একটু আগে লিখেছি না? ভুল লিখেছি। মা, তখন চোখ খুলে রেখেও সর্বক্ষণ তাকে দেখতে পেয়েছি, দেখতে পেয়েছি বাড়ির আনাচে-কানাচে, জমে থাকা ধুলোয়, তরকারির খোসায়, ভাঙা চেয়ারের পায়ায়, দেওয়ালে খসে পড়া আস্তরে-চুনে। তোমার রুক্ষ-চুলে; মোটা শাড়ির এখানে-ওখানে ফেঁসে-যাওয়া কিন্তু লজ্জায় রেখে ঢেকে ঘুরিয়ে পরা প্রতিটি অংশে। আমার মাড় দিয়ে কাচা জামার প্রতিটি সেলাই রিফু আর তালিতে। কথায় কথায় সর্দি জ্বর-কাশিতে বিছানায় পড়ে থাকায়। ঢকঢক জলে আর আধ-পয়সার বাদাম ছোলায় টিফিন সারায়। ক্লাসের বন্ধুদের বই চেয়েচিন্তে এনে পড়ায় আর সেই অপমানটা নানান তৈরি-করা তুখোড় মিথ্যে দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ায়। আঃ মা! আমার সেই কৈশোরের শেষে আর প্রথম যৌবনের লক্ষণের দিনগুলিতে কী কষ্ট যে পেয়েছি আর কত মিথ্যার পর মিথ্যা বলেছি! সমাজে, স্বজন-মহলে মুখরক্ষার, মাথা তুলে চলাফেরা করবার আর কোনও উপায় ছিল না।

আরও লিখব? কিন্তু যতই লিখি, সে কেবল কথার পর কথার পাহাড় সাজানো হবে, হাজার চেষ্টা করলেও সেদিনকার সেই দৈন্য, সেই দৈত্যটাকে জ্যান্ত করতে পারব না তো। আমার সেই ক্ষমতা গেছে। এখন বড় জোর শুধু হাড়মাস জড়ো করা সার হবে। সে প্রাণ পাবে না, নড়ে উঠবে না।

অথচ মা, সেদিন সে নড়ত, আমার চোখের সামনে, আর বুকের ভিতরেও—সতত। আমার তখনকার আবেগ-আশঙ্কা সুখের কামনা আর দুঃখ নিয়ে আত্মরতি-ক্রীড়ার মধ্যে সে-ও মিশে ছিল। শিরার যেমন রক্ত থাকে, জলে শ্যাওলা আর বাতাসে বাষ্প মিশে থাকে।

মা, তার চোখের পাতা পড়ত না, কী-জানি, পাতা হয় ছিলই না, পল্লবের লেশও দেখিনি, শুধু তার হিংস্র নিষ্ঠুর বড়-বড় নখ দেখেছি, যা দিয়ে সে আমাকে আঁচড়াত, রক্তাক্ত করে তুলত। আমাকে ঘৃণা করত সে, আমিও তাকে ঘৃণা করতাম, তবু তখন কিন্তু কলমের দু’চার আঁচড়েই তার ছবিটা আঁকতে পারতাম।

আর আজ দ্যাখো, কখনও ঠুংরির স্টাইলে, কখনও পাখোয়াজের গুরুগম্ভীর বোলে তখন থেকে আওয়াজ তুলে যাচ্ছি, গলা চিরে গেল, তবু ঠিক সুরটা ফুটল না। যে ছবিই আঁকি আজ, সেটা হয় কমিক নয় রোমান্টিক হয়ে যায়। কেননা আঁকবে কে? যে ছেলেটা তাকে জেনেছিল, যাকে সে ভয় দেখাত, সে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে কবে, দু’পয়সা বাঁচাতে দিন দুপুর যে দু’মাইল রাস্তা চষে ফিরত, তাকে তো আমি আজ ডেকেও পাব না! আজ আমি কথায়-কথায় একে-ওকে দু’টাকা থেকে দশ টাকা শুধু বখশিস করে থাকি, করতে পারি, সে আর এমন কী শক্ত—সেটা ফশ করে দেশলাই ধরানোর মতো; কিন্তু সেদিনের সেই স্পর্শকাতর, অভিমানী, আত্মসম্মানী ছেলেটি, বখশিসের লোভ দেখলেই সে কি ফিরে আসবে? এভাবে কেউ কি উৎকোচে বিনষ্ট বশীভূত করতে পারে নিজেরই অতীতকে? অতীতে তো কারও তু-তু কুত্তা নয়—ভবিষ্যৎ যেমন অনায়ত্ত, অতীত স্বাধীন; কবলমুক্ত; আমার সেই আমি আজ আর আমারও আজ্ঞাবহ নয়।

আসলে তা-ও হয়তো না। কথায় কথায় অনেকখানি জায়গা যে ভরিয়ে দিলাম, যার মানে দাঁড়ায় ঝোপের চারপাশে লাঠি পিটে পিটে সারা হওয়া, তার কারণ আমার ভিতর থেকে এই মুহূর্তে একটা কিছু বাধা দিচ্ছে। তখনকার আমি কে তুলে আনা সহজ নয়, সে তো ঠিকই। তার চেয়েও বড় অসুবিধা, শুধু “সেই আমাকে”-ই তো তুলে আনলে চলবে না, সেই সঙ্গে যে তোমাকেও তুলে আনতে হবে।

মা, মিথ্যে বলব না। সেই পরিচ্ছেদে পৌঁছে গিয়েছি যখন তোমার আমার সম্পর্কের আরও নির্মম ব্যবচ্ছেদ প্রয়োজন হবে। তাই কলম সরতে চাইছিল না, ইনিয়ে-বিনিয়ে দৈন্য-দুর্দশার রক্তমাংস-হাড়-ছাড়া ছবি এঁকে এঁকেই সময় কাটিয়ে দিতে চাইছিল।

কিন্তু আর না। এই তো আমি শক্ত মুঠোয় ধরেছি কলমটা, আর কাঁপছে না। জহ্লাদ যখন প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ায়, তখন কি তার হাতে খাঁড়া কাঁপে? সে শুধু ভয়ংকর যে কাণ্ডটা সংঘটিত করতে যাচ্ছে, তার জন্যে মনে-মনে মার্জনা চেয়ে নেয় ইষ্টদেবতাদের কাছে। আমি তাই নিলাম না, নিজেকে প্রস্তুত করলাম। কলমটা এখন ধারালো ছোরা। বসান নিজের বুকে, আর তোমার তিলে তিলে তৈরি করা মহীয়সী প্রতিমাখানিকেও হয়তো বাঁচাতে পারব না।

আমি আত্মঘাতী, আবার দ্যাখো, বাবার সেই পরিহাসচ্ছলে জারি করা হুকুমটাই সত্য হল, আমি পরশুরামও, যে মাতৃঘাতী।

(কলকাতায় গোড়ার দিকে বাবা একবার—তখন তিনি সুস্থ—কাহিনিটা মুখে মুখে বলেছিলেন। পিতা জমদগ্নির আদেশে দ্বিরুক্তি না করে পরশুরাম নাকি মাতা . রেণুকাকে হনন করেছিল। বাবা বলেছিলেন “এই হল পুত্র। পিতৃআজ্ঞা যার কাছে বেদবাক্যের মতো। তোকে যদি বলি, তুই পারবি করতে?’ তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন অবশ্য। সেই হাসিটা আমার কানে এখন ঝনঝন করে বাজছে।)

তোমাকেও আঘাত করতে হবে। কারণ অভাব নামে সেই দস্যুটা, যে হ্যাংলা হলেও ল্যাঙট পরা পালোয়ান, আমাদের দু’জনকেই টেনে হিঁচড়ে নীচের ধাপে নামিয়ে আনছিল। বাবা তখন থেকেই নেই, অনেকদিন পরে ফের সেই আমরা দু’জনে।

প্রয়োজন আমাদের ছোট করে ফেলছিল।

মা, কোন্ কথাটা প্রথমে লিখব, পরীক্ষার ফী-জ নিয়ে জোচ্চুরি, না তোমার শেষ দু’গাছি চুড়ি বিক্রি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *