৩৪. রামচন্দ্র কাঁদতে কাঁদতে

রামচন্দ্র কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরছিলো। মুঙ্‌লারা শব-সল্কারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো কিন্তু নায়েবমশাই বলে পাঠালো, দারোগারা দেখে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু করা উচিত হবে না। দারোগারা খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে এলো না, পরদিন সকালে এলো। সারাটা দিন, সমস্তটা রাত্রি মৃতদেহকে পাহারা দেওয়া দরকার। আর কে রাজী হবে? মুঙ্‌লা তুলসী গাছ এনে মৃতদেহটার চারিপাশে ছড়িয়ে দিয়েছিলো। ফুলের কথা তার মনে হয়নি। চৈতন্য সাহার দোকান থেকে একটা নামাবলী কিনে এনে সেশবটিকে ঢেকে দিয়েছিলো। অস্নাত অভুক্ত প্রায়-উন্মাদিনী পদ্ম মাটিতে মাথা কুটে কুটে কেঁদে শবের অনতিদূরে স্থির হয়ে বসেছিলো, আর ছিলো রামচন্দ্র। সন্ধ্যায় একটা প্রদীপ কে এনে দিয়েছিলো।

এমন একটি দিন এবং রাত্রি অতিবাহিত করার স্মৃতি মন থেকে সহসা মুছে যায় না।

শিবমন্দির উদ্ধার করার পরিকল্পনা রামচন্দ্র ত্যাগ করলো। যে গাছগাছড়াগুলির মূলমাত্র অবশিষ্ট ছিলো দু-তিন সপ্তাহে সেগুলির কোনো-কোনোটির মূল থেকে কচিপাতা আবার আত্মপ্রকাশ করেছে। আরও দু-এক সপ্তাহের মধ্যে পল্লব এবং তারপরে ডালপালা তৈরি হবে। আবার আগেকার মতো জঙ্গল হয়ে যাওয়া শুধু সময়ের কথা। ছিদাম যেন মৃত্যু দিয়ে বলে গেছে, এই শিবমন্দির উদ্ধার করার যোগ্যতা তার নেই।

অনেক রাত্রিতে শয্যায় উঠে বসে একদিন রামচন্দ্র স্ত্রীকে ডেকে তুললল, শুনতেছে, সনকা?

কও।

কাজটা আমি ভালো করি নাই।

কী করছো?

ছিদামেক শাসন করছিলাম; কও, শাসন করার কী যোগ্যতা আমার আছে?

উইলের যে-অবসাদ তার অন্তরকে বিষণ্ণ ধূসরতায় আচ্ছন্ন করেছে তাকে কমনীয় করে। তুলেছিলো একসন্ধ্যায় পদ্মর চিহার-পরা কণ্ঠদেশ। এতগুলি কথা বলতে না জানলেও তার অনুভবে অব্যক্ত, সুতরাং, অধিকতর দ্যোতনা নিয়ে তা ধরা দেয়।

অন্য আর-একদিন রামচন্দ্র বাড়িতে ফিরে স্তব্ধ হয়ে বাইরের দিকের দাওয়ায় বসেছিলো।

সনকা এসে দাঁড়ালো, অমন করে বসে আছো যে?

না। ভাবি।

কী ভাবো?

এমন হবের পারে–ছিদামের এছাড়া উপায় ছিলো না।

তা পারে।

কও, এ কি ধর্ম না?

দার্শনিক কোনো সূক্ষ্ম যুক্তি রামচন্দ্রর মাথায় আসেনা। তার মনে হয় ধর্মের পথ বড় কঠিন। সে-পথে চলতে গিয়ে ভীমসেন অর্জুন প্রভৃতিও বেঘোরে প্রাণ হারায়।

ইতিমধ্যে সে একদিন কেষ্টদাসের বাড়িতে গেলো। যেন সে অনুতাপ জানাতে চায়।

আছো?

পদ্ম ঘর থেকে বেরুলো। ইতিমধ্যে পদ্মর যেন বয়স বেড়ে গেছে।

রামচন্দ্র ইতস্তত করে বললো, গোঁসাইয়েক একটা খবর দেওয়া লাগে।

আমি আর কী খবর দিবো?

রামচন্দ্র খানিকটা চিন্তা করে বললো, তাই। খবর আর কী দিবো।

হঠাৎ পদ্ম রামচন্দ্রর মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিপাত করে বললো, আপনে কি তাক খুব গাল দিছিলেন?

না কন্যে, না কন্যে, তা আমি দেই নাই।

কিছুটা সময় নীরবতার মধ্যে দিয়ে কাটলো। মৃদু মৃদু হাওয়া চলতে চলতে হঠাৎ যেমন কালবৈশাখীর নির্মম রূপ প্রকাশ পায় তেমনি আকস্মিক পরিবর্তন হলো পদ্মর। তার মুখে স্নিগ্ধতার অস্পষ্ট ছাপও অবশিষ্ট রইলো না। সে যেন তার হৃদয়টিকে বিচ্ছিন্ন করে উন্মুক্ত বায়ুতে এনে বিশুদ্ধ করে নিতে চায়। মুহূর্তের জন্য যোগারূঢ়ার মতো সে যেন পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও গেলো। সে বললল, পাপ ছিলো আমার মনে। চোখের সামনে আপনে, যে সংসারে টানতেন। লোভ লাগতো।

জ্বলন্ত লোহার মতো কথা। জ্বলন্ত বলেই কোমল স্পর্শ বলে ভ্রম হয়, কিন্তু নিমেষে সে ভ্রান্তিও দগ্ধ হয়। রামচন্দ্র কিছুক্ষণ বসে রইলোবটে কিন্তু তার মুখে আর কথা ফুটলোনা। সান্ত্বনা দিতে গিয়ে প্রাণে অশান্তির বীজ বহন করে সে ফিরে এলো।

.

প্রায় এক মাস পরে রামচন্দ্র একদিন তার স্ত্রীকে বললো, শুনছো, এখানে আমাদের এখন কোন কাম আছে? ওই দ্যাখো, আমি যখন শিবমন্দির নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, মুঙ্‌লা একলাই সব কাজ করছে। তাছাড়া মানুষ যদি নিজের মনে কাজ করবের না পায় কোনোদিনই শেখে না। ভান্‌মতিও সংসার করা জানবি নে, মুঙ্‌লাও চিন্তাভাবনা করা শিখবি নে।

শিখে নেয় সেই তত ভালো।

আর তাছাড়া ওরা দুইজন দুইজনেক আরও ভালো করে চিনেজানে নিউক।

তা-ও লাগে।

রামচন্দ্র প্রস্তাবটা ভয়ে ভয়ে করলো, কেন্‌, সনকা, তীত্থ করবের যাবা?

তীত্থ?

হয়। ওরা সংসার চিনুক, আমরাও তীখ চিনি।

নিয়ে যাবা, না ঠাট্টা করো?

যদি যাই, তোমাক নিয়ে যাবো।

বিষয়টি আরও কিছুদিন তোলাপাড়া করলো রামচন্দ্র। সেআবার কেষ্টদাসের বাড়িতে গেলো।

মাটির দিকে চোখ রেখে রামচন্দ্র বললো, গোঁসাই আমাদের পথ দেখায়ে দিছে, মনে কয় তীখ করবের যাবো।

তা যান। পদ্ম বললো।

মনে করছি তোমাকও নিয়ে যাবো। আমি, তুমি আর সনকা। সেখানে গোঁসাইও আছে।

পদ্ম কিছুকালের জন্য যেনবা লুব্ধ হয়ে রইলো, পরে বললো, আমি আর কনে যাবো? সে এত কষ্ট করে ঘরবাড়ি করছিলো সেসব দেখে রাখা লাগবি তো।

তাতে কি শান্তি পাবা?

তা পাবো না।

প্রস্তাবটা শুনে মুঙ্‌লা বিষণ্ণ মুখে বললো, এখনি যায়ে কী হবি? ফসল উঠুক, তখন না হয় আমিও যাবো।

রামচন্দ্র মনে মনে হাসলো, তুমিও যদি যাবে তবে আর তীর্থ হলো কী করে। তুমি হয়তো এর পরে বলে বসবে, জমিজমাও নিয়ে যাবো।কষ্টই যদি না হয়, তোমাদের বিচ্ছেদ যদি কাটার মতো না বেঁধে তবে তীর্থ করার তৃপ্তি আসবে না।

শুভদিন দেখে রামচন্দ্র রওনা হলো। নবদ্বীপেই সর্বপ্রথম সে যাবে। সেখানে গোঁসাইকে খুঁজে বার করে তার পরামর্শ নিয়ে যদি আরও কিছু দেবদর্শন ঘটে কপালে, ঘটবে। মুঙ্‌লা প্রস্তাব করেছিলো গোরুগাড়ি করে দিঘা পর্যন্ত যেতে। রামচন্দ্র বললো, তীখ গেলেও টাকার হিসেব করতে হয়। হাঁটেই যাবো।

সামান্য কিছু বিছানার উপকরণ একটা বড়ো রকমের পুঁটলিতে জড়ানো,দু-একখানা পরিধেয় বস্ত্র একটা ঝোলায়। অন্যান্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি সব ওই ঝোলাতেই যাবে। দাওয়ায় এসব গুছানো ছিলো।

সনকা ভানুমতির হাত থেকে পান নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। ঝোলা ও পটুলিটার পাশেই পাকা একটা বাঁশের লাঠি ছিলো। ঝোলা ও পুটুলি লাঠির ডগায় ঝুলিয়ে লাঠিটা কাঁধে তুলে নিয়ে ‘শিবো’ ‘শিবো’ বলে রামচন্দ্র তীর্থের পথে বেরিয়ে পড়লো।

ভান্‌মতি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলো।হঠাৎ এদের মঙ্গল কামনায় সেউলু দিয়ে উঠলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *