চিকন্দির শ্রীকৃষ্টদাস অধিকারীর বাড়িতেই গ্রামের সংকীর্তনের আখড়া।
গ্রামের এ দিকটায় একসময়ে কারো সখের বাগিচা ছিলো, কতগুলি বড়ো
বড়ো গাছের সুবিন্যস্ত ভিড় দেখে বোঝা যায়। বাগিচার অবশ্য আর কিছু অবশিষ্ট নেই। জায়গাটা প্রয়োজনের চাইতে বেশি ছায়া-সুশীতল।
বহুদিন পূর্বে, শোনা যায় সান্যালরাও নাকি তখন চিকন্দিতে আসেনি, বাগানটির একটা আম গাছের নিচে এক সর্বত্যাগী বৈষ্ণব সন্ন্যাসী আসন করে বসেছিলো। স্থানটি পছন্দ করার কারণ নাকি আম গাছটাকে জড়িয়ে জড়িয়ে একটা মাধবীলতার বোপ ছিলোতখন। এই রকমই প্ৰবাদ।
রায়বাবুরা তখন গ্রামের একচ্ছত্র জমিদার। সেই রায়বাবুদের একটি ছোটো ছেলে বিপথে গিয়েছে এই অভিযোগে রায়কর্তা তাকে গ্রাম ছাড়বার হুকুম দিলেন। সন্ন্যাসী টললো না, ‘রাধারানীর ইচ্ছা–এই বলে সে রায়বাবুদের এক্তিয়ারের মধ্যেই স্থির হয়ে বসে রইলো। রায়কর্তার মৃত্যুর পরে রায়দের বিপথে যাওয়া ছেলেটিই নাকি বাগানখানি বৈষ্ণবদের দান করেছিলো। একটা আখড়া হয়েছিলো সেখানে।
কিন্তু আখড়ার কোনো চিহ্ন আর এখন চোখে পড়ে না। সেই সন্ন্যাসীর পর স-বৈষ্ণবী যে সব সংসারী গোঁসাই এসেছিলো তাদেরও চিহ্ন নেই। পরে একসময়ে আখড়ার জমিতে দাস উপাধিধারী একদল লোক এসে বাসা নেয়।কপালে গঙ্গামাটির বদলে পদ্মার মাটি দিয়েই একটা চিহ্ন আঁকতো তারা, আর গলায় পরতো কাঠের মালা। বাগানের এখানে যে যেটুকু পারলো দখল করে বাইরের একটু-আধটু জমি নিয়ে এটা-সেটা লাগিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করতে করতে কৃষকদের স্তরেই তারা নেমে এসেছিলো।
একটিমাত্র বিষয়ে এরা এদের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে, সেটা এদের বিবাহের ব্যাপার। বৈষ্ণবী আনে এরা কন্ঠি বদল করে। একশোয় একজন বৈষ্ণবী হয়তো তরুণ বয়সী হয়, বাকি আর সব কটুভাষিণী, বিগতযৌবনা মুণ্ডিতশির। তারা যেন ধর্মপালনের জন্যই বেঁচে আছে।
এদের সম্বন্ধে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এই, এরা কখনো আত্মবিস্তার করতে পারেনি। লোকগুলি নিজেরা হ্রস্বজীবী, শিশুমৃত্যুর সংখ্যাও বোধ হয় অন্যান্য পাড়ার চাইতে তুলনায় বেশি এদের মধ্যে। গ্রামে একটা বিদ্রুপাত্মক কথা চালু আছে–আম গাছে মাধবীলতা দেখলে পরগাছাটা কেটে ফেলাই বিধেয়, পরগাছা যারা ভালোবাসে তারা ফল পাবে কোথায়? ডাক্তাররা যদি এ বিষয়ে কথা বলতো, তারা ম্যালেরিয়া প্রভৃতি ছাড়াও যে কারণ দেখাতো সেটা যৌনব্যাধি।
রায় এবং সান্যাল বংশে সব বিষয়ে শত মতভেদ থাকলেও এদের ধর্মমতটাকে কিছুটা অবহেলা, কিছুটা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখার বিষয়ে তারা একমত ছিলেন। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেননি বটে, নামকীর্তনের জন্য দোল-দুর্গোৎসবে হয়তো ডাকতেন, কিন্তু সেটা এঁদের চোখে হীনজাতীয় চামার-ঢাকিদের ঢাক বাজানোর জন্য ডাকার মতো।
কিন্তু কোনো কোনো চামার যেমন জাতব্যবসা ছেড়ে জমিজমা নিয়ে চাষী হয়ে যায় তেমনি হয়েছিলো শ্রীকৃষ্টদাসের বাবা। তিন-চার বিঘা ধানীজমিও করেছিলো সে সানিকদিয়ারের মাঠে।
শ্রীকৃষ্টদাস পিতার ধানীজমিগুলো পেয়েছিলো, উপরন্তু তার দূরসম্পর্কের দুই পিসির দরুন দুখানা ভিটাও পেয়েছিলো। তা ভিটা দুখানা যযাগ করলে এক বিঘারও ওপর হবে। লোকটি সম্পন্ন চাষী হয়ে উঠতে পারত, হঠাৎ হলো ধর্মে মতি। হাতে কিছু নগদ টাকাও পড়েছিলো তার; তীর্থ করতে বেরুলো সে অল্পবয়সে।
নবদ্বীপমুখো মন হলে খেতখামার থাকার কথা নয়। শ্রীকৃষ্টদাস একদিন অধিকারী পদবী নিয়ে গ্রামে ফিরে এলো। তার সঙ্গে এলো এক বৈষ্ণবী, ঝাকড়ঝকড়া একমাথা চুল, লাল চোখ, গাঁজার কল্কে, আর খুসখুসে কাশি। বৈষ্ণবীর সম্বল ছিলো পেতলের একটি ঘাটি, আর একটি কঝুলি। শ্রীকৃষ্ট তার কাছে দুটি পদ গানও শিখেছিলো।
বৈষ্ণব মতে বিরহটা মিলনের চাইতেও মূল্যবান। সেই মূল্যবানের আস্বাদও শ্রীকৃষ্ট পেলো। অত বড়ো চেহারা যে বৈষ্ণবীর, যে নাকি শ্রীকৃষ্টর পক্ষ হয়ে একপাড়া লোককে কায়দা করতে পারতো সে হঠাৎ বিদায় নিলো। একটিমাত্র রোগা বিবর্ণ সন্তানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হলো তার। প্রায় বিশ বৎসর আগেকার ঘটনা।
বিরহ কিন্তু শ্রীকৃষ্টকে প্রেমিক করে তুলেছিলো, পর্যায়ক্রমে সে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৈষ্ণবী . ঘরে এনেছিলো।
শোনা যায় তৃতীয় বৈষ্ণবী যখন দিঘা স্টেশনের দিকে রাত করে পায়ে হেঁটে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ট এসে বলেছিলো–রাধারানী, তুমি নাকি যাবা?
শ্রীকৃষ্ট অনেকদিন থেকে জ্বরে ভুগছিলো, হলদে মুখচোখ, চুলগুলো তামাটে। যে-বৈষ্ণবী পালানোর জন্য প্রস্তুত হয়েছে, সে অবাক হয়ে গেলো কৃষ্টদাসের কথার ভঙ্গিতে। রাধারানী তার নামও নয়।
শ্রীকৃষ্টদাস বললো–রোসো, গাড়ি আনি।
শ্রীকৃষ্ট নিজে গাড়ি চালিয়ে তৃতীয় বৈষ্ণবীকে স্টেশনে তুলে দিয়ে এসেছিলো।
এই ঘটনার প্রায় বছর দশেক পরে শ্রীকৃষ্টর ঘরে চতুর্থ একজন এলো। সে নিজেই এসেছিলো। প্রথমা বৈষ্ণবীর সংসার-আশ্রমের কীরকম এক দূরসম্পর্কের বোন সে। তার মাহিষ্য চাষীপিতা অল্পবয়সে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু এগারোতে পা দিয়েই সে স্বামীকে খেয়ে ঘরে ফিরে এসেছিলো। পিতা তখনও বেঁচে, সংসারে আদরযত্নের অভাব হয়নি, কিন্তু ভাগ্য মানুষকে টানে। পাড়ার একপ্রান্তে কপালিদের বাসা ছিলো, তাদের এক ছোকরার সঙ্গে পালিয়ে গেলো সে। সমাজে বাধলেও সংসার পেতেছিলো তারা; কিন্তু সংসার দুবছর চলেই থেমে গেলো, আঠারোতে দ্বিতীয় স্বামীকে খেলো সে। ততদিনে পিতার মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিক দিয়েও সংসারে ফেরা তার পক্ষে আর সম্ভব ছিলো না। নবদ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছে সে সংবাদ পেলো তার সেই দিদির, যে নাকি শ্রীকৃষ্টদাসের প্রথম বৈষ্ণবী। কিন্তু বিশ বছরের পুরনো খবর। প্রায় তার জন্মের আগেকার ঘটনা।
দিদির খোঁজে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চিকন্দি এসে সে দেখতে পেলো দিদি গত হয়েছে, আরো দুটি বৈষ্ণবী তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে এসেছে, গিয়েছে।
খবর পেয়ে বোকা বোকা মুখ করে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্টর মুখের দিকে চেয়ে মেয়েটি বললোকী করব তাই বলল, জামাইবাবু।
–থাকো যতদিন উপায় না হয়। পায়ের ঘা সারুক।
কিছুদিন পরে একদিন শ্রীকৃষ্ট বলেছিলো–ছোটো-বউ, এখন কী করবো?
–বউ কয়েন না। আমাকে যে বউ কয় সে বাঁচে না। পদ্ম মুখ নিচু করে বলেছিলো। শ্রীকৃষ্ট প্রত্যাহত হলো।
খুব যখন দুঃখকষ্ট চলছে গ্রামে শ্রীকৃষ্টর দিকে লক্ষ্য করার মতো অবস্থা তখন কারো ছিলো না। তাদের শতছিদ্র নৌকার মতো সংসার কী করে অত বড় দুর্যোগের সময়টা কাটালো এ খোঁজও কেউ নেয়নি। দুর্যোগ কাটলেও দেখা গেলো শ্রীকৃষ্টরা আছে।
কিছুদিন থেকে রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্টর বাড়িতে আসছে পড়তবেলায়। শ্রীকৃষ্ট তার দাওয়ায় জীর্ণ মাদুর বিছিয়ে মলাটছেঁড়া ময়লা কাগজের মহাভারতখানি নিয়ে বসে থাকে। রামচন্দ্রকে আসতে দেখে সসম্ভ্রমে বলে–আসেন মোণ্ডল।
শ্রীকৃষ্টর চৈতন্যমঙ্গল ছেড়ে মহাভারত ধরার একটু ইতিহাস আছে। বার বার বৈষ্ণবীদের কাছে আঘাত পেয়ে সে বুঝতে পেরেছে ‘জয় রাধারানী’ বলার যোগ্যতা তার নেই। নিজের নাম শ্রীকৃষ্ট না বলে একসময়ে কেষ্টদাস বলতে সে শুরু করেছিলো, আর ‘রাধারানী’র বদলে ‘গুরুগোঁসাই’। তখন একদিন তার মনে হয়েছিলো-বিরহ-প্রেমের টানাপোড়েন আর নয়, বুকে যত জোর থাকলে বিরহের ঝড়-ঝাঁপটাতেও নিশ্বাস টানা যায় ততটা কেন, তার তুলনায় কিছুই নেই তার। কিন্তু ধর্মগ্রন্থ না-পড়লেও তো নয়, তারই ফলে আসে মহাভারত।
সারাদিনে তার একমাত্র কাজ সন্ধ্যায় ঘন্টাখানেক ধরে মহাভারত পড়া। আহারাদির ব্যবস্থা কী করে হয় এ খবরটাও সে নেয় না। অনাহারে মৃত্যুর খবরগুলি যখন প্রথম কানে আসতে লাগলো সে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালো, তারপর তার নিজের ভাষায়, তার দৃষ্টি এদিক থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ভগবান পাঠালেন ব্যাধি। বুকভরা ব্যাধি নিয়ে বিনা চিকিৎসায় ঘরের মেঝেতে সে পড়ে থাকতো, কোথায় দিন, কোথায় রাত। ব্যাধি সারলো, একসময়ে সে উঠেও বসলো, কাশি তাকে ছাড়েনি, হাঁপানির রূপ নিয়েছে। কিন্তু সে মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছে, এ ব্যাধি ভগবানের আশীর্বাদ। যে নৌকা চালানোর ক্ষমতা তার ছিলো না, সেই নৌকার যাত্রী হিসাবে সে যদি ভয় পেয়ে ছটফট করতো, তবে তার ছটফটানিতে নৌকা ডোবা অসম্ভব ছিলো না। ‘চোখ বেঁধে বৈতরণী পার করালে গুরুগোঁসাই’।
মহাভারতখানায় টোকা দিয়ে ধুলো ঝেড়ে ফেলে শ্রীকৃষ্টদাস মনে মনে বলে : আর না বাবা, এই কাশিতেই কাশী পাবো। ও ঝঞ্ঝাট যখন আপসে আপ খসে পড়লো, ব্যস আর নয়।
সম্মুখে রামচন্দ্রকে পেলে শ্রীকৃষ্ট বলে–বুঝলেন ভাই, আমি পলাইছি এবার, সহজে আর ধরা দিতেছি না।
সবসময়ে রামচন্দ্র উত্তর দিতে পারে না, কিন্তু প্রায়ই বলে–কিছুই যে ভালোনা, গোঁসাই, আমি কী করি বুঝি না।
শ্রীকৃষ্ট মুহূর্তকাল সান্ত্বনা বাক্যের জন্য মনে হাতড়ায়, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে–দ্দোর্ণোপর্ব পড়ি আজ, কি কন মোণ্ডল?
শ্রীকৃষ্ট দ্রোণপর্ব খুলে বসে। রামচন্দ্র একখান রৌদ্রদগ্ধ মেঘের মতো বসে থাকে, বর্ষণের তেমনি নিষ্ফল আগ্রহে বুকের ভিতরটা তোলপাড় করে তার।
মহাভারত থেকে একসময়ে কীর্তনের দিকে মন গেলো রামচন্দ্রদের। আকাশবাতাসভরা অপমৃত্যুর ক্লিন্নতা, দুর্ভিক্ষের প্লাবন নেমে গেছে কিন্তু সে প্লাবনে উৎক্ষিপ্ত আবর্জনার পূতিগন্ধ এখনো আছে। যেন শব্দ দিয়ে, ধ্বনি দিয়ে সে বাতাসকে খানিকটা নিশ্বাস নেওয়ার মতো করা যাবে। ভক্ত কামার নিজে থেকেই খোল নিয়ে উপস্থিত হলো। তারপর থেকে শুরু হলো এদের কীর্তন।
কীর্তন বলতে সচরাচর বুঝি নয়। কতগুল প্রৌঢ় বয়সের চাষী, মিস্ত্রী,কুমোর প্রভৃতির বেসুরো গলায় প্রাণপণ চিৎকার আর তার সঙ্গে বেসুরো মৃদঙ্গের শব্দ। দাঁড়িয়ে শুনলে হাসি পায়। এই পুরুষগুলির কারো পক্ষেই সংগীত স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এদের কীর্তনের ব্যাপার নিয়ে শুধু সান্যালমশাই ঠাট্টা করেননি, সংগীত সম্বন্ধে যার কিছুমাত্র জ্ঞান আছে সে-ই করবে।
রামচন্দ্রের কথা ধরা যাক। পৃথিবীতে চাষ ও মাটি ছাড়া আর কিছু সে বোঝে বা জানে, তার প্রিয়জনরাও এতখানি গুণপনা তাকে কোনোদিন বর্ষণ করেনি। মাটির রঙ দেখে, হাতের চেটোয় মাটির ডেলা গুঁড়ো করে, জিহ্বায় স্বাদ নিয়ে জমির প্রকৃত মূল্য সে বলে দিতে পারে; কিংবা জমির উত্তাপ হাতের তেলোয় অনুভব করে সে অক্লেশে ঘোষণা করতে পারে বিনা বর্ষণে ধানের জমি তৈরি করার দুঃসাহস করা যায় কিনা। কিন্তু অন্য অনেকের পক্ষে অসম্ভব এই কথাগুলি বলতে পারলেও ধান, জমি, চাষ, এর বাইরে কথা বলতে তাকে কচিৎ শোনা গেছে।
বাল্যকাল থেকে এই মাটির সঙ্গে কতরকম সম্বন্ধই স্থাপন করেছে সে। সুখের দিনে মনে, মনে পূজা করেছে, দুঃখের দিনে অব্যক্ত আবেগ নিয়ে বসে থেকেছে মাটির পাশে। জমিদারকে সে সম্মান করে, খাজনা দিতে আপত্তি করা দূরের কথা, বরং তাগাদা আসবার আগেই মিটিয়ে। দিতে গিয়েও কত বিনয়, কত ভঙ্গি। বাহুল্য দেখে একবার তার স্ত্রী বলেছিলো–পাওনাদাররা যেন্ কুটুম, কত আদর, কত ছেদ্দা’। রামচন্দ্র বলে ফেলো, কও কী? কুটুমের উপরে কুটুম। যার কাছে বউ পালাম, আর জমি, দুজনেই ধর যে একই সমান।
রামচন্দ্রের স্ত্রী একদিন অনুভব করেছিলো, এ কথাটা সে বাড়িয়ে বলেনি। দুপুরের খাড়া রোদে সব কৃষক যখন গাছতলায় কিংবা ঘরে তখনো রামচন্দ্র মাঠে। বলদজোড়া খেতের একপাশে দাঁড়িয়ে অতি পরিশ্রমে ধুকছে আর তাদের মালিক খেতের মাঝখানে মই দিয়ে সমতল করা জমির লক্ষণীয় নয় এমন খাজগুলি পাঁচন দিয়ে টেনে টেনে মিলিয়ে দিচ্ছে।
পাগল হলা নাকি? মাথায় রক্ত উঠবি।
রামচন্দ্র স্ত্রীর সাড়া পেয়ে গাছতলাটায় পৌঁছে খেতে বসে বলেছিলো–একটুকু গায়ে হাত বুলায়ে দিলাম।
উয়েরই তো দিবা।
স্ত্রীর মুখের দিকে খানিকটা চেয়ে থেকে পুলকবিহ্বল গলায় ডাক ছেড়ে হেসে উঠে রামচন্দ্র বলেছিলো–কও কী? কিন্তু বাড়িতে মিয়ে জামাই যে।
সেই রামচন্দ্র যখন কীর্তনিয়া হয়ে ওঠে, তখন চিন্তা না করে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না।
কিছুদিন আগে একজন প্রতিবেশী নির্লজ্জের মতো, কিংবা হয়তো অভ্যাসবশেই, চাষবাসের কথাটা তুলেছিলো, জোর দিয়ে নয়, মুদ্রাদোষের মতো মুখে এসে গিয়েছিলো, কিন্তু পরক্ষণেই অন্য সকলের উদাস দৃষ্টির সম্মুখে নিজেকে মূঢ় মনে হয়েছিলো তার।
রামচন্দ্রই কি বলতে পারে চাষবাস করে কী হবে। অতি বিশ্বাসীর বিশ্বাস নড়ে গেলে যা হয়, তার চাইতেও তার বেশি হয়েছে। যেখানে ছিলো বিশ্বাসের দৃঢ়তা, এখন এসেছে ভয়ের অন্ধকার। নিজের ঘরের জীর্ণ দাওয়ায় বসে থাকা আর আকাশের দিকে তাকানো ছাড়া কিছু করার নেই। তার চোখের সম্মুখে মাঠান জমি হলুদে আগাছায় ভরে আছে। ফাল্গুন গেছে, চৈত্র যায় যায়। সূর্যের কাছে তেজ পাচ্ছে না মাটি, রোদে পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে। ভোর রাতের কুয়াশা গলা-স্নিগ্ধতায় মাটি আর কোনোদিন উর্বরা হবে না।
বলার কি মুখ আছে আমার? এই ভাবে রামচন্দ্র। জমির জন্য, জমির লোভই তার মেয়েটির মৃত্যুর কারণ, এই তার বদ্ধমূল ধারণা।
দুর্ভিক্ষের প্রথম পদচারণে যখন জমির দাম নেমে যেতে লাগলো আর পাল্লার বিপরীত দিকের মতো চড়তে লাগলো ধানের দাম তখন চৈতন্য সাহার কাছে সে ধান বিক্রি করে জমি কেনার টাকা সংগ্রহ করেছিলো। তখন কাজটা অস্বাভাবিক বোধ হয়নি। এদিকের সুগন্ধি আমন ধান যায় শহরে, আর শহর থেকে আসে কৃষকদের খাবার মতো কম-দামী মোটা চাল। অনেক কৃষকই ধান বিক্রি করে দেয় সামান্য কিছু বীজধান রেখে। রামচন্দ্র বুদ্ধি করেছিলো খাবার ধান পরেও পাওয়া যাবে নগদ টাকা যদি থাকে, কিন্তু জমির দাম পড়েছে সেটা বাড়তে কতক্ষণ। তখন কেউ বুঝতে পারেনি ধানের দাম এমন সব মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সে-সময়ে যেটা সুযুক্তি ছিলো এখন সেটা চূড়ান্ত বুদ্ধিভ্রংশতা বলে বোধ হচ্ছে।
তার মেয়েটা বোধ হয় মেয়েদের মধ্যেও নরম জাতের ছিলো। এতটুকু অনাদর তার সইলো না। অনাহারে নয়, কু-আহারে মুখ ফিরিয়ে সে চলে গেলো।
জমি! জমিকে কুলটা বলেছে অনেকে অনেক বেদনার সময়ে। রামচন্দ্রর অনুভবটি ঐ কথাটার সাহায্যে সোচ্চার হয় না, কিন্তু ব্যর্থপাপ-প্রেমের অনুরূপ একটা অনুশোচনা ও আক্রোশ তার বুকে জমে ওঠে।
রোদ পড়ার আগেই রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্টদাসের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। শ্রীকৃষ্ট থেমে থেমে বটতলার ছাপা জীর্ণ মহাভারত পড়ে। রামচন্দ্র ভাবে রাজা হরিশচন্দ্র, রাজা শ্রীবৎস এদের কী হলো দেখো। রাজ্যে বিশ্বাস নেই, তার জমি!
কীর্তন করে রামচন্দ্র। প্রাণের উদ্বেলতা উৎক্রোশ কণ্ঠে ছড়িয়ে দিতে থাকে। কীর্তনের কথাগুলিতে এক চিরসুন্দরের স্নিগ্ধ রূপ আঁকার প্রয়াস আছে, কিন্তু উচ্চারণটা অভিযোগের মত, ক্ষুব্ধ অভিমানে ফেটে পড়ে বিরাগ জানানোর মতো।
চৈত্র যায়-যায়।
এই এক দেশ, শাল-মহুয়ার নয়, ধানের এবং পাটের। ফাল্গুনে এখানে উদাসকরা লাল রঙ নেই, এখানে গৈরিক অবান্তর। নিতান্ত মাটির দেশ। গাছ-গাছড়ার সবুজ রঙেও মাটির গাঢ়তা। বর্ষায় গাছপালাগুলি বাঁচবোবাঁচবো বলে দেখ-দেখ করে বেড়ে ওঠে। তারপর আসে বর্ষণহীন অকরুণ দিন। ধু ধু নিষ্ফল মাঠের দিকে তাকিয়ে চোখে পড়ে ফাট-ধরা কালচে মাটি, ইতস্তৃত দু-একটা বাবলাগাছ। গাছগুলোর পাতা নেই, আছে শুধু শুকনো কাটা। প্রাণ-শুকানো রৌদ্রে দাঁড়িয়ে আরো দৃঢ় আরো কর্কশ হবার তপস্যা করছে কাঁটাগুলি। বাঁচবো, বাঁচবো–এই রুদ্ধশ্বাস আকুতি সেগুলির। উদাসীনতা নয়, অত্যন্ত গভীর মোহ।
চৈত্র যায় যায়, এমন সময়ে রামচন্দ্র কীর্তনে মন বসাতে পারছে না। তার জামাই মুঙ্লা গত বৎসর চাষের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেবার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সে যেন দেহাতিদের কোদাল দিয়ে জমি চষার মতো হাস্যকর একটা কিছু। কী করে পারবে বলে মুঙ্লা। বাইশ তেইশ বছরের একটি ছেলে অকরুণ পৃথিবীকে পুরুষ সোহাগে করুণাবতী করে তুলবে, এ সম্ভব নয়। তাকে সাহায্য করবে এমন চাষীও কাউকে চোখে পড়লো না।
কীর্তনের সুর বাড়তে বাড়তে, লয়ে দ্রুততর হতে হতে একটা নীর শব্দদুর্গের সৃষ্টি করে, আর পরাজিত চাষীরা যেন তার আড়ালে মুখ লুকোনোর জন্য প্রাণপণ করতে তাকে।
কার ধান আছে, কে ছিটাবে ধান! ধান ছিটানোর চিত্রটিতে যে পুলকের আভাস আছে, সেটা যেন মনের এই ধূসরপটে মানায় না। বাঁ হাতে ধামাভরা বীজধান চেপে ধরে হাঁটার তালে তালে ডান হাতের মুঠি মুঠি ধান ধামার গায়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিয়ে ক্ষেতময় ধান ছিটানো!
কিন্তু এখানেই অশান্তির শেষ নয়। গ্রামের অশান্তির কিছু কিছু অংশও রামচন্দ্রের গায়ে এসে পড়ে।
সে গ্রামের চাষীদের মধ্যে খানিকটা বিশিষ্ট। এ বৈশিষ্ট্যের কতখানি তার চরিত্রগত আর কতটুকু আকৃতিগত এটার বিচার করা কঠিন। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও যাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে তাদের চালচলনে স্বভাবতই খানিকটা গাম্ভীর্য এসে যায়। এ গাম্ভীর্য রামচন্দ্রের ছিলো; একটু অধিকন্তু ছিলো তার। বোধহয় তার দু পায়ের পেছনদিকের শিরা দুটি কোনো কারণে ছোটো হয়ে গিয়েছিলো, তার ফলে চলার সময়ে তার পায়ের গোড়ালি দুটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত উঠে উঠে যায়। হাট থেকে যখন সে তেলের দুর্মূল্যতার কথা ভাবতে ভাবতে ফিরছে, হঠাৎ অচেনা লোকের তখন মনে হতে পারে–যেন একজন মগ্ন। আখড়ার ধুলো উড়িয়ে পাঁয়তারা কষার অভ্যাস সাধারণ পদক্ষেপেও সংক্রামিত হয়েছে।
এমন হতে পারে, লোকে তার পায়ের খুঁতটির দিকে লক্ষ্য করে করে তার মনে এ ধারণাটা এনে দিয়েছে, সে দর্শনীয় কিছু। এরই ফলে সম্ভবত তার কথাবার্তাও নাটকীয় হয়ে পড়েছে।
তার ঠোঁটজোড়া মস্ত গোঁফনাকের নিচে সূক্ষ্মরেখায় দ্বি-বিভক্ত। গোঁফ চারিয়ে দেওয়া তার মুদ্রাদোষ। সময় নেই, অসময় নেই, পরম যত্নে সে গোঁফ চারিয়ে দেয়। যেহেতু গোঁফ চারা দেওয়ার সঙ্গে আমরা খানিকটা বলস্পর্ধা মিশিয়ে ফেলি, সেজন্য তাকে কখনোকখনো অপদস্থও হতে হয়েছে।
অনাহারে গ্রাম যখন উৎসন্নে যাচ্ছে, সদর থেকে সরকারি আমলারা এসেছিলো চালের পরিবর্ত হিসাবে মাথাপিছু পোয়াভর ছোলা বিলোতে। খবর পেয়ে রামচন্দ্রও গিয়েছিলো। কিন্তু তার অত বড় দেহের কাঠামোটা নিয়ে আঁচল পেতে দাঁড়াতে তার লজ্জা করছিলো। সে সব চাইতে পেছনে ছিলো। অবশেষে সে যখন আমলাদের মুখোমুখি হলো, তারা বলেছিলোতোমার তো লাগবে না বোধ হয়, কি বলল? রামচন্দ্র ছোলা না নিয়ে গোঁফ চোমরাতে চোমরাতে ফিরে এসেছিলো।
সে যাই হোক, রামচন্দ্রকে ওরা টেনে নিয়ে যায়। হরিশ শাঁখারির জন্য তদ্বির করতে তাকে যেতে হয় সান্যালমশাই-এর বাড়িতে। তার কীর্তনের আসরেও চাষবাসের কথা,জমিজমার কথা এসে পৌঁছয়।
হরিশচন্দ্রের ব্যাপার নিয়ে যেদিন সে সান্যালমশাইয়ের কাছে গিয়েছিলো সেই সন্ধ্যায় কীর্তনের মুখে ভক্ত কামার যখন তার খোল নিয়ে ঠুকবুক করছে, হরিশ শাঁখারি ধুয়ো ধরার জন্য প্রস্তুত হয়েছে, এমন সময়ে আর-এক উপদ্রবের সূত্রপাত হলো।
রামচন্দ্ররা শুনতে পেলো আর একটি কীর্তনের দল যেন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এরকম হয়, ছোটোবেলায় এরকম সে দেখেছে:গ্রামের বিভিন্ন পাড়া থেকে, ছোটোখাটো গানের দল এসে গ্রামের মাঝখানে প্রায়ই রায়বাড়ির দোলমঞ্চের সম্মুখে, একত্র হতো। তারপর শুরু হতে অষ্টাহব্যাপীকীর্তনের উৎসব। বোঝো আর না-বোঝো, শোনো আর না-শোনন, খোলর বিরামহীন শব্দের সঙ্গে বহুকণ্ঠের কলশব্দ নেশায় আবিষ্ট করে দেবেই একসময়ে; মাথা ঝিমঝিম করবে; তারপর একসময়ে সেই দলে মিশে নাচতে শুরু করতে গ্রামবাসীরা।
রামচন্দ্র হেসে বললোবোধায় তোমার পাড়ার হবি, হরিশ। বোধায় সান্যালমশাই কিছু হিল্লে করেছে।
শ্রীকৃষ্ট বললো–আপনে যখন গিছলেন তখনই আমি মনে বল পাইছি।
কিন্তু এ কী অদ্ভুত গান!
গাইতে গাইতে যখন ছোটো দলটির কাছে এসে দাঁড়ালো তখন রামচন্দ্র হো হ করে হেসে উঠলো। রামচন্দ্র চিনতে পারলো তার জামাই মুঙ্লা আর শ্রীকৃষ্টদাসের ছেলে ছিদামকে। গানটার একটি কলি গাইছে মুঙ্লা, ছিদাম তার ধুয়া ধরছে, পালটে নিচ্ছে মুখে থেকে সুর ছিদাম, আখর? দিচ্ছে মুঙ্লা। ঢোলকের তালে তালে মুঙ্লা গাইলো
চিতিসা চিত্তিরসাপ আমন খেতের বিষ
বিষের বায়ে সোনার দ্যাশে শুকায় ধানের শিষ।
ছিদাম আখর দিলো ঢোলকে চাটি দিয়ে-হায় রে আমন ধানের শিষ!মুঙ্লা তাল দিলো তার ঢোলকে, ছিদাম সুরে ধরলো–
চিতিসা খুললো মরি জাহাজী কারবার
বেলাতে চালান দিলো দ্যাশের
ষণ্ড হাড়।
মুঙ্লা প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়ে আখড় দিলো–হায় হায় শিশুমান্ষের হাড়।
গানের দোলায় দোলায় শ্রীকৃষ্ট বলতে লাগলো–ঠিক ঠিক।
রামচন্দ্র বললে–কও কী, আঁ, কও কী?
মুঙ্লা ও ছিদাম তখন বলে চলেছে-আকাশে ওড়ে হাউই জাহাজ, মহাজনী নৌকা লাগে ঘাটে। কোথা থেকে কী হয়ে গেলো, কোথায় গেলো ধান, কী হলো প্রাণীর! আর দেখো ঐ চিতিসাকে,কপালে তিলক এঁকে একটামাত্র দাঁত দিয়ে কী করে নরনারীর মৃতদেহগুলো খেলে, কী করে পৃথিবীর মাটি যা আগুনে পোড়ে না, বন্যাও ফিরিয়ে দেয়, তাই সে গ্রাস করলো!
রামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ট স্তব্ধ হয়ে গেলো শুনতে শুনতে। ছিদাম বা মুঙ্লার এই প্রথম গান গাইবার প্রয়াস।সবসময়ে সুর লাগছেনা। কিন্তু এই অদ্ভুত গান কোথায় শিখলোতারা? রামচন্দ্রের বুকের মধ্যে বাতাস পাওয়া আগুন হাঁ হাঁ করছে, শ্রীকৃষ্ট কাঁদো কাঁদো মুখ করে, বোকা-বোকা মুখ করে কেমন যেন ছটফট করছে।
চৈতন্য সাহা এ গ্রামের মহাজন। চিকন্দি ও সানিকদিয়ারের যুক্ত সীমান্তের কাছে তার দোকান। প্রতি বছর ধান ওঠার কিছুদিন পরেই হাজারমনী নৌকাগুলো এসে লাগে পদ্মার ঘাটে। নৌকার মাঝিরা চৈতন্য সাহার পুরনো খরিদ্দার। লোহার কড়াই থেকে আলকাতরার টিন, তেল থেকে আমসি এসবই তার দোকানে পাওয়া যায়, মাঝিরা কেনে। কিন্তু আকাশে অদৃষ্টপূর্ব হাওয়াই জাহাজের আনাগোনার সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্য সাহার কার্যকলাপ অভূতপূর্ব হয়ে উঠলো। অন্যান্য বার সে মাঝিদের হয়ে ধান কেনে, এবার সে নিজে থেকেই ধান কিনতে লাগলো। সানিকদিয়ার থেকে বুধেডাঙা থেকে চিকন্দি আড়াআড়ি পাড়ি দিতে লাগলো সে। পদ্মার ঘাটে নৌকার ভিড় বাড়তে লাগলো। মাঝিদের ও চৈতন্য সাহার একটা খেলা শুরু হলো। মাঝিরা বলে–ছটাকায় উঠলো ধান। চৈতন্য সাহা বলে, সাড়ে ছয়ে আমাকে দাও। দশে উঠলো দাম, দেড় টাকার ধান দশ ছাড়িয়ে বারো ধরলো, চৈতন্য সাহা তবু কিনছে।
একসময়ে ধান গেলো ফুরিয়ে, বীজধানও ধরে রাখলো না কোনো চাষী। হাতে নগদ টাকা নিয়ে চৈতন্য সাহার নির্বুদ্ধিতার কথা উল্লেখ করে হাসাহাসি করেছিলো তারা। কিন্তু শহর থেকে খাবার চাল আনতে গিয়ে তাদের হাসি শুকিয়ে গেলো। দু দিনেই যেন শহরের সব দোকানদার খবর পেয়ে গেছে, তাদের ঘরে খাবার নেই। দু’একজন দোকানদার তো মুখের সামনেই বলে দিলো–বিক্রি করবো কি? কিনবো।
এরপরই চাষীদের ছুটোছুটি শুরু হলো, হায়, হায়, চাল কোথায়! জমি ঘর যার যা সম্বল ছিলো দুর্ভিক্ষের মুখে গুঁজে দিতে লাগলো। আল ভেঙে গেলে চাষীরা যেমন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ফাটলের মুখে নিজের বস্ত্রখণ্ড পুরে দিও জল বাঁধবার চেষ্টা করে, তেমনি করে তারা চেষ্টা করলো। জমির দাম অকিঞ্চিৎহয়ে গেলো। প্রথমে বড়োচাষীরা ছোটোচাষীদের জমি ধরার চেষ্টা করলো, তারপর তারাও প্লাবনে ভেসে গেলো। চৈতন্য সাহা এসে দাঁড়ালো ক্রেতা হয়ে; এবার যেন সে সব কিনবে, পৃথিবী পায় তো তা-ও কিনবে। কোথায় ছিলো এত টাকা তার কে জানে! কিন্তু সে যেন পাগলও হয়েছে। এক বিঘা ধানের জমির দাম দশ টাকা বলে সে, শুনে প্রথম প্রথম চাষীরা না-হেসে পারেনি। দেড় টাকার ধান বারোতে কিনেছে, একশোর জমি দশে চায়। কিন্তু এদিক-ওদিক ঘুরে তার ঘরেই ফিরে এলো চাষীরা, পনরো টাকা হয় না? এক বিঘা দো ফলা জমি?
তা তুমি যখন বলছে, দশের উপরে আর আট আনা দিতে পারি।
তাই দাও, তাই দাও। ছাওয়াল মিয়ে খায় নাই।
নিজের পাঁজরার একখানা হাড় খুলে রেখে দশ টাকা আর কতগুলি খুচরো নিয়ে চলে গেছে চাষীরা। বুড়ো সিন্ধুসিংহের মতো চাষীদের নাক বেয়ে চোখের জল নেমেছিলো; অনাহারে কষ্টে কিংবা জমির শোকে তখন তারা তা বুঝতে পারেনি।
নগদ দামে, রেহানে, খাইখালাসি বন্দোবস্তে চৈতন্য সাহারা চাষীদের দশ আনা জমি গ্রাস করেছে। চৈতন্যর সঙ্গে সহযোগিতা করলো গ্রামের কয়েকজন জোতদার।
গান থামলে রামচন্দ্র বললো–এ তোরা শিখলি কোথায়?
গুরুর নিষেধ, কবের পিরবো না।
এ গান শুনলি লোকে কী কবি?
ছিদাম কী একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলো, কিন্তু লোকে কী বলবে, তার মীমাংসা করে দিলো আর একজন লোক। এদের গানের সময়ে পথচলতি দু’চারজন লোক জড়ো হয়েছিলো, তাদের মধ্যে একজন বললো, কেন ভাই, গায়েন, আমাদের গাঁয়ে একদিন গান শুনাবা না?
কোন গাঁ তোমাদের?
চরনকাশির পর মাধবপুর।
তা যাবো একদিন।
যায়ো ভাই, যায়ো, আমার বাড়িতে যায়ো; সেখানে জলসা হবি। আমার নাম যাদো ঘোষ।
তোমরাও কি চিতি সা-কে চেনো?
হয়। সে গোরুও কিনেছে আমাদের ঘোষেদের কাছে।
যাবো ভাই, যাবো।
লোকটি চলে গেলে রামচন্দ্র আবার প্রশ্ন করলোতোরা কি এখন গাঁয়ে গাঁয়ে এমন সব গান গায়ে বেড়াবি?
হয়। নীলের গাজন ইস্তক এই করব আমরা। আপনেরাও ভগোমানের নাম করেন, আমরাও করি।
এ কি তোদের ভগোমানের নাম, চিতি সা কি তোদের ভগোমান?
একটু থেমে কথাটা গুছিয়ে নিয়ে ছিদাম বললো, ও আমাদের সব খালো, আর আমরা বললিও দোষ।
কয়ে কী হয়? রাস্তার লোকেক মুখ ভ্যাংচায়ে কী হয়, নিজের মুখে ব্যথা।
ছিদাম মাথা চুলকাতে লাগলো।
মুঙ্লা বললো–এখানো গান বাঁধা শেষ হয় নাই, মিহির সান্যালের নামেও গান বাঁধা হবি।
রামচন্দ্র বললো, সাবোধান। দ্যাশের মালিক, রাজা।
কীসের রাজা, আমরা তার জমি রাখি না।
কস কী! হাজার হলিও সান্যালবংশ, রাজবংশ। এর জমি না রাখো, তার রাখো। কোনা না কোনো সান্যালের জমি রাখো। তুমি কি মনে করছে মিহিরবাবুর নামে গান বাঁধলি, নোসল্লা করলি সান্যালমশাই খুশি হলো। কি কও, শ্রীকৃষ্টভাই?
ঠিক কইছেন মণ্ডল,বললো শ্রীকৃষ্ট, মিহিরবাবু কী ক্ষতি করছে তোমাদের?
আমাদের গ্রাম ছাড়া করতিছে। সে সময়ে যারা আমাদের ঠকায়ে জমি নিছে সকলেই চিতি সাপ।
তোমাদের গাঁ ছাড়া করিতেছে তোমাদের বাপরা জানলো না?
আমাদের না হউক, শাঁখারিদের–বললো মুঙ্লা।
শাঁখারি আর তোমরা এক হইছে?
এক হওয়া লাগবি। মরার সময়ে আগে তারা, পরে আমরা মরছি। মরে এক হইছি–বললো ছিদাম।
রামচন্দ্র বললো–আচ্ছা, এক যদি হওয়া লাগে, বাপরা এক হোক। তোমরা ছাওয়ালরা এসব করবা না।
ছিদাম ও মুঙ্লা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাঁইগুঁই করতে লাগলো। রামচন্দ্র মণ্ডল নিষেধ করলে ভাবতে হয়।
সে সন্ধ্যায় কীর্তন জমলো না। যারা এলো তারা এই গানের কথাই বলাবলি করলো। কেউ বললো, ঠিকই করেছে ছাওয়ালরা, বেশির ভাগই বিষয়টির আকস্মিকতায় মুগ্ধ হলো। যারা ল্গানের পদগুলি শোনেনি তারা পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করে জানতে লাগলো।
অন্ধকার পথে বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে গানের পদগুলি রামচন্দ্রর মনে পড়লো। ছেলেদের ছেলেমানুষির সম্মুখে আসা উচিত নয়, হাসিকে দমন করার জন্য গোঁফ চারিয়ে দিয়েছিলো সে। কিন্তু হাসি নয় সবটুকু। আবার তার সেই অনুভব হলো। বুকের ভিতর চাপা আগুন হাঁ-হাঁ করে জ্বলে উঠলো। সেখানে আগুনলাগা বাড়ির মতো কী যেন একটা ভেঙে পড়বে। তার মেয়ের মৃত্যুর সঙ্গেও কি গৌণভাবে চৈতন্য সাহাদের অদ্ভুত ব্যবসার যোগ নেই? লার কাছে আটকে যাওয়া কান্নায় রামচন্দ্রর বুকপাট ফোঁপানোর মতো দুলে দুলে উঠলো।
এর আগেও চৈত্রসংক্রান্তির জন্য গ্রামে গান বাঁধা হতো। এই গ্রামে ছিলো নবীন, সে নিজের পরিচয় দিতো—নব্নে বুড়ো গাঁয়ের খুঁড়ো। সে-ই বাঁধতে গান। দুর্ভিক্ষের প্রায় প্রথম গ্রাসে সে গিয়েছে। আর কেউ গান বাঁধেনি গত বছর। নবীন বুড়োর গানের বৈশিষ্ট্যও ছিলো, জমিতে স্ত্রীজাতির দোষগুণ, দুর্বলতা, সোহাগ-প্রিয়তা আরোপিত করার রীতি সে-ই প্রথম এই অঞ্চলে চালু করেছিলো।
কিন্তু এ কী গান! বাড়ির কাছাকাছি এসে রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে পড়লো। কানের ভুল নয়। দাসপাড়ায় ছিদাম-মুঙ্লার গান শোনা যাচ্ছে। দূর থেকে আখরগুলি কান্নার মতো শোনাচ্ছে। একটা রামশিঙাও জোগাড় হয়েছে। তার শব্দটা তীব্র হাহাকারের মতো ফেটে ফেটে পড়ছে। রামচন্দ্র ভাবলো, এমন গান বাঁধলো কেন্? কী করলো এরা, এ কীসের সূচনা করলো!
রবিশস্যের সময় এটা। ধানের সময় নয় যে প্রকৃতি নিজে থেকে ধান দেবার জন্য সাধাসাধি করবে। গত আমন-চাষ হয়নি এ অঞ্চলে। একেবারে কি হয়নি? যা হয়েছে তাকে চাষ বলে না। আর আউস? কে বোনে আউস? পথ চলতে কোনো চাষীর যদিবা ঘাসভরা আগাছা ঢাকা আউসের খেত চোখে পড়ে তবু তার দৃষ্টি চকচক করে না, মনে হয় না সে আউসের কথা ভাবছে। কানে আসছে চিকন্দির সীমায় সীমায় সান্যালদের খাসজমিতে, সানিকদিয়ারের খামারগুলিতে, চরনকাশির আলেফ সেখের জমিতে আউস চাষের জোগাড় হচ্ছে। রবিশস্যও উঠছে। এমন কথাও কানে আসে, সরষে এবার এ অঞ্চলে ভালো হয়েছে।
চিকন্দির গ্রামের ভিতরে আর বুধেডাঙার মাঠে দু’একটি নির্লজ্জ কৃষক মাঠে নেমেছে, কিন্তু সেসব চাষ নয়, খেলা–যেমন খেলতে পারে রামচন্দ্রর জামাই মুঙ্লা কিংবা শ্রীকৃষ্টদাসের ছেলে ছিদাম। আর রামচন্দ্ৰই একা একথা বলে না। চৈতন্য সাহাও বলে বেড়াচ্ছে। সে নাকি চাষীদের বাড়িতে ডাকিয়ে নিয়ে বলেছে–খেলা খেললে হয় না, কাজ করে খেতে হয়। গত সন টাকা দিছি কাজ করো নাই, খেতে নামে খেলা করলা; যে খেতে দশ মন হবি, হলো চার। এবার টাকা পাবা না।
এই বিস্ময়কর অথচ সত্য কথাগুলিই এই পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্য। দু বছর আগে জমির মালিক ছিলো যে আজ সে মজুর সেই জমিতেই। সকলের মনে হয় কিনা কে জানে, রামচন্দ্রর মনে পড়ে যাত্রায় শোনা সেই হীরার কাহিনী। হীরাকে যখন চাষীর ঘর থেকে বাবু বের করে নিয়ে মোটরে চড়ালো, হীরার স্বামীকে নাকি সেই বাবু দয়া করে একটা চাকরি দিতে চেয়েছিলো, মোটরগাড়ির ধুলো ঝাড়ার কাজ। খাইখালাসিতে জমি আটকে চৈতন্য সাহাও নাকি তাই করছে। গত বছর খেতে না-পেয়ে কৃষকরা যখন তার কাছে ধারে ধান কিনতে গিয়েছিলো। তখন সে নতুন করে কাগজ লিখিয়ে নিয়েছে: ধান দিয়েছে চাকরান শর্তে; এক বছর জমিতে খেটে দেবার শর্তের নিচে টিপসই দিয়ে ধান এনেছিলো চাষীরা। কিন্তু কেউ কি পারে হীরার স্বামীর মতে মোটরগাড়ি সাফ করতে? গত বছর চৈতন্য সাহার খেতগুলিতে যে চাষ পড়েছিলো তাকে সেই জন্যই চাষ বলা যায় না। অবশ্য চৈতন্য সাহার ধার ধারেনা এমন চাষীও আছে। আছে গহরজান সান্দার, আছে আলেফ সেখ, আছে ঘোষপাড়ার বাপবেটা দুজন। কিন্তু দশ আনা জমিতে চৈতন্য সাহা বলে বেড়াচ্ছে–গত বছর ঠকায়েছো। এবার আগাম টাকা পাবা না। দরকার হয় বাঙাল আনাবো, চাষ দিবো।
ছিদাম মুঙ্লার গান যেদিন প্রথম শোনা গিয়েছিলো তার কয়েকদিন পরে এক সন্ধ্যায় শ্রীকৃষ্টদাসের আসরে ধানের কথা উঠে পড়লো কথায় কথায়। স্বর্ণবর্ণ সেই সব ধানের কথা যা সেকালে ছিলো বলে মনে হয়, সেই আমন ধানের শতেক নাম আওড়ানো।
সেদিন ছিদাম মুঙ্লা গান করতে পথে বার হয়নি। ছিদাম বললো–কে, জেঠা, বোরো ধান কি সোনার মতন হয় না?
রামচন্দ্র বললো–হয়, সব ধানই সোনা।
মুঙ্লা বললো–ছিদামভাই, তোমার ধানের কথা কও নাই বাবাকে?
কথাটা বলে ফেলেই মুঙ্লা লজ্জিত হয়েছিলো, নতুন বউ-এর কথা হঠাৎ গুরুজনের সামনে উচ্চারণ করে গ্রাম্য যুবারা যেমন হয়।
ধান কস কি? হা হা।
হা-হা শব্দ দুটিতে রামচন্দ্র কী ইঙ্গিত করলো বোঝা গেলো না। চিকন্দি অঞ্চলে কেউ যদি কোনোকালে বোরো ধান লাগায় তবে সেটা সখ করে। দিঘা থেকে আসতে আসতে সড়কটা যেখানে পদ্মার পার ধরে চলতে শুরু করে সেই লবচরের সেরা বোরো ধানের চাষ করে নিয়মিতভাবে। চিকন্দি অঞ্চলে জমি উঁচু, পদ্মার পলি প্রায়ই পড়ে না। এদিকে বোলোর আবাদ নেই।
ব্যাপারটা ছিদাম বললো। নতুন বিষয়ে অভিজ্ঞজনের পরামর্শ নেওয়া ভালো। শ্রীকৃষ্টদাসে বাড়ির পিছন দিকে আখড়ার পুকুরটার এখন স্নান করার মতো জল নেই। সেটাকে এখন পুকুর না-বলে পচা গাড়ো বলে, পুকুর পাড়ায় অর্থাৎ খানায় পরিণত হয়েছে। শ্রীকৃষ্টর কাশির অসুখটা হবার আগে সে পুকুরের ঢালু পাড়ে কচু, ওল প্রভৃতি লাগাতো। সেই পচা পুকুরের জলের ধারে ধারে, জলের মধ্যে নেমে গিয়েও চাষ দিয়েছে ছিদাম। প্রথম যখন সে চাষ দিতে শুরু করে তখন যে চেহারা ছিলো এখন তা নেই। লবচরের সেখদের কাছে চেয়ে-চিনতে বোরো ধানের কিছু বীজ সংগ্রহ করেছিলো সে। এখন পুকুরটা একটা নিচু জমির রূপ নিয়েছে।
মুঙ্লার চাষ-আবাদের চেষ্টাও এমনই হাস্যকর বৈকি। সে হয়তো ধানহীন দিনে ছিদামের মতো ধান-পাগলা হয়নি, কিন্তু সে তার শ্বশুরের পড়ে-থাকা খেতে মটর-মসুর লাগিয়েছে। সংসার চালাচ্ছে। কিন্তু চাষ কি শুধু কায়ক্লেশে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা? তাহলে তো রামচন্দ্রও চাষ করেছে। গত বৎসর সে-ও তো দু’একদিন মাঠে গিয়েছে, লাঙলের মুঠিটা কিছুকালের জন্য ধরে মুঙ্লাকে খেতে যাবার সুযোগ দিয়েছে।
রাবণের মৃত্যুর পর সদ্য-প্রসূত মহীরাবণও নাকি যুদ্ধে নেমেছিলো। রামচন্দ্র বোকা-বোকা মুখ করে বসে গোঁফ চোমরাতে লাগলো।