কালের হিসাবে তিন-চার মাস সময় পিছিয়ে গিয়ে সুমিতিদের লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মনসার একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। দু মাসের ছেলেটিকে নিয়ে সে শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেছে।
অনসূয়া ক্লান্তি বোধ করছেন। তার সংসারে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে কিছুকাল থেকে। সদর থেকে মজুর মিস্ত্রি মিলে প্রায় দশ-পনেরোজন এসেছিলো।চারুর তত্ত্বাবধানে তারা খিড়কির ঘাট থেকে কাছারীর বারান্দা পর্যন্ত বাড়ির যেখানে-সেখানে বাঁশ বেঁধে বেঁধে মেরামত করে বেড়ালো প্রায় পনরো-বিশ দিন। তারা চলে গেলো, এলো একদল উড়ে মিস্ত্রি, প্রায় তাদের সঙ্গে সঙ্গে এলো লোহালক্কড় যন্ত্রপাতি। তাদের কাজ শুরু হয়েছে কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। তাদের অধিকাংশ চলে গেলেও এখনো কয়েকজন আছে। চারু এদের তত্ত্বাবধান করে না শুধু, এদের কাছে কিছু কিছু কাজও শিখছে। এরা ইলেকট্রিকের এবং জলের কলের মিস্ত্রি। এদের কয়েকজন নাকি ছোটো ডায়নামোটা চালানোর জন্য থেকে যাবে। অন্দরের সেই স্তব্ধ শান্তি আর নেই।
আজ থেকে ঠিক পনেরো দিন আগে এমনি একটি সাময়িক ব্যবস্থার শেষ পর্যায় শেষ হয়েছিলো। গ্রামের ডাক্তারের পরামর্শে সদর থেকে ডাক্তার আর তার পরামর্শে একজন যাত্রী এসেছিলো। সদরের ডাক্তার সপ্তাহে একদিন করে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতো। ধাত্রী একটানা প্রায় তিন মাস ছিলো। সদরের ডাক্তার বেশ জোর দিয়েই বলেছিলো, স্বাস্থ্য কিছু খারাপ তা নয়, আজকাল আমরা অকারণে রিস্ক নিতে চাই না।
ধাত্রী যাওয়ার আগে হাসতে হাসতে বলেছিলো, আবার তো আসতে হবে।কী বলা উচিত সহসা অনসূয়া খুঁজে পেলেন না। সে যে সুমিতিকে ইঙ্গিত করেছে এ তত সহজেই বুঝতে পারা যায়, কিন্তু সুমিতির ব্যাপার কি সত্যি তাই? এ যদি কেউ জানতে পারে যে তিনি চোখের সম্মুখে মেয়েটিকে রেখেও বুঝতে পারেননি তাতে এটাই প্রমাণ হবে এ বাড়ির শাশুড়ি ও পুত্রবধূর মধ্যে এমন একটি ব্যবধান আছে যে এমন একটি ব্যাপারও শাশুড়ির চোখে পড়েনি। অনসূয়া কোনো কথায় না গিয়ে বলেছিলেন, যদি রাখি এখানে, তোমাকেই আবার আসতে হবে বৈকি।
কথাটা এখন মনে হলো। এ বাড়ির অন্য কারো মুখে কথাটা উচ্চারিত হওয়ার আগেই তারই মানানো উচিত দু-একজন বর্ষীয়সীকে। তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবে, শুধু তিনি আলোচনাটা কীভাবে গ্রহণ করবেন তা বুঝতে না পেরে হয়তো চুপ করে আছে।
কিন্তু তারও আগে। এটা সুমিতির মর্মপীড়ার কারণ হতে পারে, এই উপেক্ষার ভাবটি। অনসূয়া সুমিতির ঘরে গেলেন।
অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার : তাঁর বাড়ির এই ঘরখানিতে যা নাকি তার নিজের মহলের অঙ্গীভূত, সেটায় আজ প্রায় চার মাস পরে আবার এই এলেন। অথচ এর আগে এটায় সপ্তাহে একবার আসতেন দাসীদের ঝাড়পোঁছের কাজ তদ্বির করতে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে সুকৃতির ছবিটিতে চোখ পড়লো প্রথমে। তারপর সুমিতির ছোটো লিখবার টেবিলটিতে। টেবিলটার উপরে দু-তিনখানা বই, তার পাশে একটা জাপানি ভাস-এ একটা লাল গোলাপ রাখা হয়েছে, সুমিতির কলম আর প্যাডের কাছে একটি পোস্টকার্ড সাইজের ফটো। মায়ের চোখ, ফটোতে ছেলের চেহারা আবিষ্কার করার জন্যে ফটোকে তুলে নেওয়ার দরকার হলো না, মাথা নিচু করে দেখতেও হলো না। কিন্তু ফটোতে চেহারা এত অস্পষ্ট যে কখনো কারো তৃপ্তি হতে পারে না। আর গোলাপ ফুলটিও যেন কেমন বিবর্ণ। একটা যেন সংকোচের ভাব কোথাও ছড়ানো রয়েছে।
সুমিতি জানলার গোড়ায় একটা সোফায় বসে ছিলো। সোফাটার পিঠের আড়াল থেকে সুমিতিকে দেখা যায়নি। অনসূয়া ফিরতে গিয়ে তাকে দেখতে পেলেন।
সমিতি!
সাড়া দিয়ে সুমিতি উঠে দাঁড়ালো।
অনসূয়া এগিয়ে গিয়ে সুমিতির সোফাটায় বসে তাকেও বসতে বললেন। অনসূয়া বললেন, ধাত্রীকে এখন খবর দেওয়া দরকার। সে এসে থাকুক এখানে, কি বলল? অকস্মাৎকথাটা শুনে সুমিতি লজ্জায় সিঁদুরমাখা হয়ে গেলো। সোজা হয়ে বসে থেকে যতদূর সম্ভব মুখ নামানো যায় তেমনি করে সে নিচের দিকে চেয়ে রইলো। তার স্বামীর মায়ের পক্ষে এমন প্রশ্ন তো খুবই স্বাভাবিক। প্রত্যহ দেখা হয় না বলে প্রশ্নটা এতদিন ওঠেনি। সংকোচে ও কুণ্ঠায় মনসাকে সে ঘোষণা থেকে নিরত করেছিলো বলে বাড়ির সর্বত্র প্রচারিত হয়নি। কিন্তু যে দাসী তার ব্যক্তিগত হয়ে দাঁড়িয়েছে তার চোখেই হয়তো ধরা পড়েছে। ধাত্রীর চোখে ধরা না পড়লেই অবাক হতে হতো। অনসূয়া বললেন, প্রথম সন্তান কিনা, তাই একটু সাবধানে থাকতে হয়। তুমি কি এখানেই থাকবে?
কিন্তু সুমিতি কোথায় থাকবে এ প্রশ্নটা করা তার উচিত হয়নি। প্রথম কথা ওই যে, এই মেয়েটি অন্য সব বিষয়ে যত অভিজ্ঞ হোক, সন্তানবহন এই প্রথম করছে, এবং তার পক্ষে কোন অবস্থায় কী করা সম্ভব এবং নিরাপদ এটা অনসূয়ারই বলে দেওয়ার কথা। দ্বিতীয় কথা, তাদের কলকাতার বাড়িতে এখন কারা আছে এবং তাদের পক্ষে এমন একটি দায়িত্ব গ্রহণ করা সম্ভব কিনা সেটাও চিন্তা করে দেখা দরকার।
সেজন্য অনসূয়া বললেন, এ সময়ে অনেক কিছু চিন্তা করে এগোতে হয়। ধাত্রী এসে বলুক এখন ট্রেনে চলা তোমার পক্ষে সম্ভব কিনা, তারপর আমি তোমাদের বাড়িতে চিঠি লিখবো। যদি সবদিক দিয়ে সুবিধা হয়, তবেই যাওয়ার কথা চিন্তা করা যাবে।
অনসূয়া কিছুমামুলি উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন। ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে তিনি বললেন, ফুলটা শুকিয়ে গেছে, ঝি-চাকরের এদিকে দৃষ্টি নেই কেন?
.
অনসূয়া কয়েকটি দিন ধরে দেখলেন–এ কখনো প্রকাশ করা চলে না যে, সুমিতির ব্যাপারগুলি তার মনঃপুত হয়নি। নিজের মনেও তিনি অনেক যুক্তির সাহায্যে একয়েকটি দিনে। প্রতিষ্ঠিত করেছেন, এ সন্তানকে না মেনে নেওয়াটা একটা গর্হিত অন্যায়। সেই যুক্তিগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে মহাভারত ও অন্যান্য গ্রন্থের সাহায্য নিতে হয়েছে তাকে।
কিন্তু সে যেন আলো দিয়ে অন্ধকার সরিয়ে রাখা, কৃত্রিম কিছু এই মনোভঙ্গি। হৃদয়কে যুক্তির প্রাবল্য দেখিয়ে বাধ্য করা হচ্ছে মস্তিষ্কের কাছে মাথা নত করতে। কয়েকদিন আগে এক সন্ধ্যায় অন্য একটি বিষয়ে আলাপ করতে করতে মস্তিষ্ক এবং হৃদয় নিয়ে একটা আলোচনা উঠে পড়েছিলো। রূপু যোগ দিয়ে চূড়ান্ত আপাত সত্যটা বলেছিলো :হৃদয় মানুষকে রক্ত জোগাতে পারে, চালাতে পারে না। সান্যালমশাই মস্তিষ্কের জয় ঘোষণা করেছিলেন; অনসূয়া নিজে যুক্তি দিতে ইতস্তত করলেও বলেছিলেন: মানুষ হৃদয়ের সাহায্যে আহার গ্রহণ করে, গান করে, বন্ধু সংগ্রহ করে। সদানন্দ বলেছিলো: আমি এ কথা হলপ নিয়ে বলতে পারি পৃথিবীর সবগুলি আবিষ্কারের পিছনে আছে হৃদয়। কল্পদ্রষ্টা না হলে, হৃদয়বেগে বেগবান হতে না পারলে গভীর চিন্তা করা যায় বটে, আবিষ্কার বা সৃষ্টি করা যায় না। কথাগুলি নতুন নয়। একখানি ইংরেজি মাসিক পত্রিকায় লেখা সদানন্দর একটি প্রবন্ধে এরকম কথা ছিলো বটে। সে বলেছিলো, মস্তিষ্ক দিয়ে ভূতার্থকে বিশ্লেষণ করা যায়, দুয়ে আর তিনে দশ করা যায় না। হৃদয় এই দশের সংবাদ না দিলে কাব্যও হয় না, কোয়ান্টাম থিয়োরিও না।
অনসূয়া যে চিঠিটা লিখেছিলেন সেটা লেখা হলো না। মৃদুস্বরে দাসীকে ডেকে খবরের কাগজ আনতে বললেন।
কাগজে চোখ রেখে একটি-দুটি খবর নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অনসূয়া ভাবলেন : এ কী সমস্যা! জীবনের যে স্তরে এসে ভাবা গিয়েছিলো হৃদয়, মস্তিষ্ক ও দেহের একটি সামঞ্জস্য হয়ে গেছে তখনই আবার তরঙ্গ-উৎক্ষেপটা দেখা দিলো। তিনি ভেবেছিলেন সুমিতির এ বাড়িতে আসবার অভিনবত্ব এ কয়েক মাসে পুরনো খবরের কাগজের মতো অনুল্লেখযোগ্য হয়ে গেছে। কিন্তু ঠিক যে সময়টা ধরে সেটা হওয়া দরকার তখন যে তিনি সহজ হয়ে চলেননি তার প্রমাণ যেন সুমিতির অন্তর্বত্নী হওয়ার ব্যাপারে লক্ষ্য না রাখা। হৃদয়বিমুখ না হলে এমন হয় না। তিনি বুদ্ধির সহায়তায় যাকে গ্রহণ করেছেন ভেবেছিলেন, তার বেলাতেই এমন হলো।
দাসী এসে খবর দিলো কর্তাবাবু ডাকছে।
সেই পুরনো স্টাডির রূপগত পরিবর্তন হয়েছে। দেয়ালগিরি অপসারিত, সান্ডেলিয়ার ঝাড়টি অপসৃত নয় কিন্তু অকারণে রয়েছে বলে মনে হয়। অভ্যস্ত চোখে দেয়ালগিরির অভাব যাতে বোধনা হয় সেজন্য পোর্শলেনের প্লেট দেয়াল কেটে বসিয়ে তার আড়ালে অতি নিষ্প্রভ বা থেকে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আলোগুলির একটি যেখানে ছবিতে আঁকা চাঁদের কিরণের মতো মরক্কো বাঁধানো ব্লটিং প্যাডের উপরে পড়েছে সেখানে দুটি হাত একত্র করে সান্যালমশাই কথা বলার জন্য প্রস্তুত হলেন। তার বাঁ হাতের তেলোর বড়ো তিলটি এবং ডান হাতেরনীলাটি অনসূয়ার লক্ষ্যে এলো। সান্যালমশাই বললেন, তোমার ধাত্রী এসে যাচ্ছে কাল। চিঠি দিয়েছে। সে তো এখন এখানেই থাকবে?
তাই তো বলেছিলাম সদানন্দকে।
সদানন্দ তার হসপিটালের চাকরির কথায় বলছিলো, ওর তেমন ইচ্ছা নেই চাকরিতে ফিরে যাওয়ার।
নিজে প্র্যাক্টিশ করতে চায়?
তোমার একখানা সার্টিফিকেট পেলে সুবিধাই হবে ওর। কিন্তু সদানন্দ দেখলাম ওর অনেক খোঁজখবর রাখে। শুনলাম নাকি মেয়েটি দু-তিন বছর হলো খৃস্টান হয়েছে। হিন্দু সমাজে নাকি ফিরবার উপায় ছিলো না। ইতিমধ্যে নাকি একদিন আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলো, সদরে নাকি এ নিয়ে হৈচৈ হয়েছিলো।
সদানন্দ এত খবর নিচ্ছে কেন? ধাত্রী তার কাজ ফুরুলে চলে যাবে।
সান্যালমশাই বললেন, সদানন্দর কাছে খবরগুলি আপনা থেকেই এসেছে। সদরে এসব মুখরোচক সংবাদ, বুঝতেই পারো।
উত্তর দেওয়ার আগে অনসূয়াকে কুণ্ঠা কাটাতে হলো, তিনি বললেন, এরকম আলাপে আমি অভ্যস্ত নই, তুমি কোনদিকে এগোচ্ছো ধরতে পারছি না।
সান্যালমশাই বললেন, এইসব পরিচয়ের পরেও কি তাকে তুমি দীর্ঘদিন বাড়িতে রাখতে রাজী আছো?
কাজ মেটা পর্যন্ত বলছো?
না। আমি ভাবছিলাম শিশুটিকে মানুষ করার জন্যে যদি ওকে রেখে দেওয়া যায়, কেমন হয় তাহলে?
সুমিতি কি পারবে না? মনসা তো নিজেই পারবে।
সান্যালমশাই একটু চিন্তা করে বললেন, তা হয় না এমন নয়। সেকথা যদি বলো পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস আছে যা না হলেও চলে কিন্তু পেলে সুবিধা হয়। গভর্নের্স বা নার্স যা-ই রাখতে চাও সেটা নিরক্ষর আয়ার চাইতে ভালো। আর তাছাড়া এই ধাত্রী-মেয়েটিও তার নিঃসঙ্গজীবনে একটি বলিষ্ঠ আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে বলে মনে হয়েছে আমার–এই জন্যেই তার পরিচয় দিলাম।
অনসূয়া কিছুকাল নীরব থেকে বললেন, আমি বুঝতে পারছি এটা একটা পরিকল্পনা যার সব দিক চিন্তা করে তুমি এগিয়েছে।
কিন্তু সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটা তোমার মতের অপেক্ষা রাখে। যদি সংগত বোধ করো তাকে কথায় কথায় জানিয়ে রাখতে পারো, তুমি নাতিদের জনে গভর্নেস রাখবে।
অনসূয়ার হাসিটা হঠাৎ প্রকাশ পেলো বটে কিন্তু কয়েক মুহূর্ত থেকেই মনে মনে এটার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন; তিনি হাসিমুখে বললেন, গভর্নেসের জন্য ঘরদোর, নাতিদের নার্সারি, এসবও নিশ্চয় তোমার পরিকল্পনায় আছে?
একটু সলজ্জভাবেই ড্রয়ার থেকে ব্লুপ্রিন্ট বার করলেন সান্যালমশাই। হাতে একটা পয়েন্টার নিয়ে ব্লুপ্রিন্টে একটি জায়গা উদ্দিষ্ট করে বললেন, এঞ্জিনিয়ার বলছে এদিকটায় দোতলা তোলা যাবে না, চুন-সুরকির পুরনো দিনের গাঁথুনির উপরে দোতলা তোলা নিরাপদ বলে মনে হয় না। সিমেন্ট কংক্রিট এবং লোহা দিয়ে সম্পূর্ণ একটা ব্লক তৈরি করতে চায় সে, এটাকে ভেঙে ফেলে।
অনসূয়া অনেকটা সময় ভাবলেন, তারপর ধীরে ধীরে প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বললেন, আমার শ্বশুরের সময়ের এই চুন-সুরকির গাঁথুনি আমার জীবনকালে স্থায়ী হবে এই আমার বিশ্বাস। তোমার বাগানটা প্রয়োজনের অতিরিক্ত বড়ো। যদি মনে করো নতুন ধরনের কিছু দরকার, কংক্রিটের ক্যাটালগ এনে যথেষ্ট পরিমাণে কাঁচ ও হাল্কা ধরনের আসবাব দিয়ে একটা বাংলোবাড়ি তৈরি করো।
কথা বলতে বলতে প্রিন্টের উত্তর দিকটা অনসূয়া দেখিয়ে দিলেন, বললেন, সুমিতির পক্ষে এই নতুন বাড়িটাই আরামপ্রদ হবে। মনের সঙ্গে মিলবে। সেখানে নার্সারি হোক, গভর্নেসের ঘর।
সোনার চশমার আড়ালে অনসূয়ার চোখ দুটির চেহারা কিরকম হলো দেখবার জন্য চোখ তুললেন সান্যালমশাই, কিন্তু অনসূয়ার চোখে কাঠিন্যের কোনো ছাপ এসে থাকলেও ততক্ষণ সেটা সেখানে ছিলো না।
সান্যালমশাই বিস্মিত হলেন, কিন্তু সে বিস্ময় তার ভাষায় প্রকাশ পেলো না। তিনি বললেন, তোমার দুই ছেলে, অনু, তুমি কি দুখানা নতুন বাড়ির কথা চিন্তা করছো?
না, আপাতত একটি হোক।
কথাটা আগে বলোনি।
অসুবিধা হবে?
না, না। সান্যালমশাই হাসলেন, নতুন করে ব্লুপ্রিন্ট করাতে হবে।
কিছুকাল দুজনে নীরবে বসে রইলেন। তারপরে অন্য কথা হলো, অনসূয়াই নিয়ে গেলেন সেদিকে। তারপর তিনি কাজে গেলেন।
খানিকটা নীরব অবকাশে সান্যালমশাই আবার বিস্ময়ে তলিয়ে গেলেন। যে অনসূয়াকে এতদিন ধরে চিনে এসেছেন এ যেন সে নয়। কণ্ঠস্বর ও উচ্চারণের ভঙ্গিটা এতদূর বিশিষ্ট যে, প্রায় আট-দশ বৎসরের পুরনো একটা সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে গেলো সান্যালমশাইয়ের। এই গ্রামের রায়বংশের ছেলে মন্মথ রায় তার সমবয়সী এবং কলকাতার কলেজের সহপাঠী। তিনি এসেছিলেন গ্রামে; নিজের জমিজমার বন্দোবস্ত করাই উদ্দেশ্য ছিলো। শিকারের প্রস্তাব এসেছিলো। বোটে করে বিলে বিলে ঘুরে পাখি শিকার হচ্ছিলো ( কোনো সন্ধ্যায় তারা ফিরতেন, কখনো বোটে রাত কাটতো। একদিন আকস্মিকভাবে সদানন্দ উপস্থিত বিলের ধারে। তার হাতে সিলমোহরকরা চিঠি। তাতে লেখা ছিলো তোমার একবার আসা দরকার। একথা কয়েকটি আষ্টেপৃষ্ঠে সিলমোহরে আটকানো। কী ব্যাপার বলে স্ত্রীর সম্মুখে হাসিমুখে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সান্যালমশাই। অনসূয়া ঠিক কি কথাগুলি বলেছিলেন এতদিন পরে তা উদ্ধৃত করা যায় না, কিন্তু তাতে ছেলের বড়ো হওয়ার কথা ছিলো, এবংনৃশংসতা মানুষকে শুধুহৃদয়হীন করে তোলে না, তার শুভবুদ্ধিকেও আড়ষ্ট করে, রুচিকে তামসিক করে–এরকম কিছু বক্তব্য ছিলো। কিন্তু বক্তব্যের চাইতে ভঙ্গিতেই বেশি কাঠিন্য ছিলো। মর্মরের মতো মোলায়েম, শীতলস্পর্শ, সুন্দর, কিন্তু পাথরও বটে। শিকার বন্ধ হয়েছিলো। কিন্তু, বলে ভাবলেন সান্যালমশাই–ওদের পৃথক করে দেবো?
তিনি স্থির করলেন–অবশ্য এটার অন্য দিকও আছে। ছেলেরা বড়ো হয়ে উঠলে তাদের রুচি ও প্রকৃতি পৃথক হতে পারে। তখন তাদের পৃথক স্বয়ংপূর্ণ জীবনের প্রতি আকর্ষণ দেখা দিতে পারে। বাড়িটা তৈরি হোক যেমন অনসূয়া বলছে। যদি ওরা এই পুরনো বাড়িতেই থাকতে চায় নতুন বাংলোটা অন্য কোনো ব্যবহারে আসবে। মানুষের একাধিক বাড়ি থাকতে নেই এমন নয়।
অন্দরমহলের উঠোনে নামার সিঁড়ির মুখে থমকে দাঁড়ালেন অনসূয়া। নিজেকে নিয়ে সেই প্রথম জীবনের পরে আর কবে এমন বিস্মৃত হয়েছেন? এ কী করে এলেন তিনি? কী ভাবলেন উনি? আমি কি ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় পেয়ে এমন করে সুমিতিকে পৃথক করে দিচ্ছি? তার কি বলা উচিত ছিলো, এই বাড়ির প্রতিষ্ঠা সুমিতিকে দিয়ে আমার আর তোমার জন্য ছোট্ট একটা বাড়ি করো–এরপরে এত বড় একটা বাড়িকে গুছিয়ে রাখতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়বো?
সদানন্দ এলো।
কিছু বলবে নাকি?
বলবার ছিলো, কিছুদিন যাবৎ আপনাকে পাচ্ছি না।
কী রকম? সান্যালমশাই হাসলেন, কতদিন থেকে পাচ্ছো না?
যেদিন থেকে চারুর দল আপনাকে দখল করেছে।
স্কুলের জন্য টাকা চাই?
না। এবার সদরে গিয়ে কথা বলে এসেছি। কমিটি করে দেবো। সরকার থেকে সাহায্য দিয়ে চালাক।
মতের পরিবর্তন করলে যেন।
বহুদিন আগেই করা উচিত ছিলো। শহরের স্কুলে পড়ে ছেলেরা শহরে থাকছে, গ্রামের স্কুলে পড়েও তারা শহরমুখো হচ্ছে। স্কুল করা মানে গ্রামের বুদ্ধিমান ছেলেদের শহরের দিকে লুব্ধ করা। তাই যদি হবে তবে আর বোঝা বয়ে মরি কেন?
এমন কথা কোনো শিক্ষক বলতে পারে বলে ধারণা করিনি। আপাতত কী ঘটেছে?
রূপুকে ম্যাট্রিক দেওয়াবো কিনা এ-বিষয়ে আলাপ করতে চাই।
এতদিন কী স্থির ছিলো? কেম্ব্রিজের কোর্সে পরীক্ষা দেওয়ার পর কী-একটা হবে, এরকম যেন শুনেছিলাম তোমার মায়ের কাছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ। সেরকমই ছিলো। কিন্তু ভাবছি এদেশের ইতিহাসটার উপরে জোর দেওয়া যায় কি না। মাও বলেছিলেন বটে প্রাচীনের কথা।
এ সম্বন্ধে কি খুব তাড়াতাড়ি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনো দরকার?
দু’এক মাসের মধ্যে দরকার হবে।
দু মাস পরে আলাপ করলে হয়?
সদানন্দ হেসে বললো, চারু বোধহয় এখন আসবে?
অন্তত সাময়িক একটা পরিবর্তন যে হয়েছে সান্যালমশাইয়ের জীবনভঙ্গিতে এটা আর গোপন নেই। তার সঙ্গে সঙ্গে তার কর্মচারীদেরও কাজ বেড়েছে। তাদের কাউকে কাউকে একটু বেশি দ্রুতগামী হতে হয়েছে, এবং কারো কারো জীবনধারায় রদবদল হয়েছে।
নায়েব একদিন হন্তদন্ত হয়ে বেরুচ্ছে। তার স্ত্রী বললো, এমন ছুটোছুটি কি এ বয়সে চলে? শরীর শুকিয়ে গেলো যে।
গেলেও উপায় নেই। জামা গায়ে দিতে দিতে নায়েব বললো।
কিছুদিন থেকেই এরকম হয়েছে। কাজ যেন বেড়েই যাচ্ছে।
বাড়াকমা কিছু নেই। বিলমহলে কর্তা নিজে যাওয়ার আগে আমার যাওয়া দরকার। মামার মুখে শুনেছি বিলমহলের দাপটেই তিনি চাকরি ছেড়ে আমাকে বহাল করেছিলেন।
সেখানে কী হচ্ছে এখন, তহসিলদাররা পারে না?
সাহস পায় না। আমিও যে খুব পাই তা নয়। গুলবাঘ দিয়ে জমি চাষ করানো, বুঝতেই পারো।
রসিকতা রাখো।
গৃহিণীর হাত থেকে শরবৎ নিয়ে নায়েব বললো, তোমার জেনে রাখা ভালো বলেই বললাম। সেখানকার চাষীদের গুলবাঘ না বলে গণ্ডারও বলা যায়। তাদের দিয়ে বিল দখল করতে যাচ্ছি।
এমন বিপদের কাজে হাত দিচ্ছো, কর্তা মত দিয়েছেন?
এটা কর্তারই বুদ্ধি। এই ফিকিরেই ত্রিশ বছর আগে হাজার বিঘা খাসজমি বিল থেকে উদ্ধার করেছিলেন। নিজে যা করেছিলেন আমি এখন সেটা করলে খুব একটা রাগ করতে পারবেন না। যদি নিষেধ করেন হুকুম ফিরিয়ে নেবো। না করেই বা উপায় কী? লাখ টাকা খরচ হবে এই চৈত্রের আগে। টাকা আনি কোথা থেকে, যদি জমি না বাড়াই?
স্ত্রীর হাত থেকে পান নিয়ে নায়েব রওনা হলো। পাল্কি খাড়া ছিলো। সে বললো, তেমাথায় থাকগে যা। গাঁয়ের মধ্যে আর পাল্কিতে চড়াস নে, লোকে হাসাহাসি করবে’ নায়েবের লোকজন পাল্কি নিয়ে চলে গেলো। নায়েব হাঁটতে হাঁটতে চারুর বাড়ির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো।
চারু বাড়িতে ছিলো। সে বেরিয়ে এলে নায়েব বললো, এদিক থেকে ছুটি নিয়ে একবার বিলমহলে যেতে হয়। জমি দখল করতে হবে।
সর্বনাশ! মারপিট নাকি?
তার চাইতেও বেশি। বিল থেকে জমি কেড়ে আনতে হবে।
সে তো বিলমহলের লোকরা করে শুনেছি, খাল কেটে, পাড় বেঁধে নৌকো দিয়ে জল ঘেঁচে।
তা করে। গত ত্রিশ বছরে নিজেদের বুদ্ধিতে একশ ঘর বর্গাদার তিনশ বিঘা নিয়েছে। আমি যে এক বছরে হাজার বিঘা চাই। নিজেদের মাইনা বাড়িয়ে নিয়েই তো বিপদে ফেললে। বছরে বারো হাজার টাকা খরচ বাড়ালে। এখন চলো দেখি, বাঁধটা কীভাবে দিলে ছোটো বাঁধে বড়ো কাজ হয়। আর তোমার সেই কী যন্ত্র আছে, পুকুরের জল তুলে ফেলতে, সেটাও চাই।
কর্তাকে বলে রাখবেন, যাওয়া যাবে।
নায়েবমশাই হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করলো, মাঝখানে দীর্ঘদিন সান্যালমশাই ধীরস্থির হয়েছিলেন বটে কিন্তু বিশ-বাইশ বছরের যে লোকটি শুধুমাত্র বন্দুক সম্বল করে বিলমহল শাসন করেছিলো, আর সেই শাসিত বিলমহল দিয়ে বিলকেও শাসন করেছিলো তার মূলগত পরিবর্তন আশা করাই অন্যায়। টাকার প্রয়োজন হওয়ামাত্র তিনি নিজেই বিলমহলে গিয়ে উপস্থিত হতে পারেন।
.
এক সন্ধ্যাবেলায় পরিচিত গলার শব্দে সুমিতি অবাক হলো। ধাত্রী দাসীকে দরজার কাছে বিদায় দিয়ে একা একা এলো ঘরে। তার বেশভূষার ঢিলেঢালা ভাব দেখে বোঝা যায় অনেকটা সময় আগেই সে এসেছে।
অল্পবয়সী ধাত্রী, পরীক্ষা দিয়ে পাস করা শুনেই তার উপরে নির্ভর করা যায়। নমস্কার করে সে হেসে বললো, আমি আবার এলাম।
আসুন।
মনসাদিদির চিঠি পেয়েই ভাবছিলাম আসি আসি, কালকের ডাকে গিন্নীমার পত্র পেলাম। দেখতে মনে হয় ভালোই আছেন। আপনি কী বলেন?
সুমিতির মনের কুণ্ঠিত অবস্থায় একটি-দুটি এক শব্দের বাক্য রচনা করার বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো না। সে রক্তহীনের মতো হেসে বললো, কী বলবো?
ধাত্রী বললো, সে যা বলার আমিই কাল বলবো, এখন মনে হচ্ছে আর একটু কায়িক পরিশ্রম করা দরকার। আপনি বেড়াতে ভালোবাসেন তো? তা হলেই হলো।
সুমিতি কথা বাড়ালো না। ধাত্রী এখানে আসতে পেরে যেন খুশি হয়েছে। সে এ কথা ও কথা তুলে কিছুক্ষণ আলাপ করলো।
ধাত্রী চলে গেলে সুমিতি ভাবলো, এ ভালোই হলো। এভাবে যদি অনসূয়া না আসতেন, এইসব ব্যবস্থার সূচনা না করতেন, তবে তাকে নিজের সম্বন্ধে আর একটি সিদ্ধান্ত নিতে হতো। এক্ষেত্রে সেটা ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও ছিলো। এটা শহর নয়, মোটর নিয়ে বেরিয়ে পড়লে পথের মোড়ে ক্লিনিক পাওয়া যায় না।
এরপরে আবার লজ্জা এসে তাকে আবৃত করলো। এরপর থেকে সকলের চোখে যে প্রশ্ন কিংবা কৌতূহল প্রকাশ পাবে সেটা যেন এখনই সে সর্বাঙ্গে অনুভব করলো। এ বাড়িতে আসবার পরই যে কুণ্ঠা তাকে নিয়ত বিব্রত করতো, কিছুদিন চাপা থাকার পরে এখন যেন সেটা আবার আত্মপ্রকাশ করলো।
মনসা রহস্যছলে যে প্রশ্নগুলো তুলেছিলো তাছাড়া আর কেউ কখনও তাকে প্রশ্ন করেনি। অবহেলাও তাকে কেউ করেনি। তার ব্যক্তিগত সুখসুবিধার দিকে একাধিক দাসদাসীর সতর্ক দৃষ্টি নিযুক্ত আছে। তার ব্যক্তিগত পরিচারিকাটি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। সবসময়েই সে ডাক শোনার প্রতীক্ষায় আছে, কিন্তু সম্মুখে এসে যখন দাঁড়ায় নিজে থেকে, মনে হবে যেন ঘটনাটা আকস্মিক। হয়তো সুমিতি বিকেলের দিকে লাইব্রেরিতে যাচ্ছে, পরিচারিকা যেন শূন্য থেকে আত্মপ্রকাশ করে বললো, বিড়োবউদি, আজকাল তো এমন সময়ে আপনারা চা খেতেন মাঝে মাঝে, আনবো?
না, সেটা মনসার খেয়ালে হতো।
পরিচারিকাটি তখন সুমিতির একখানা শাড়ি আলসে থেকে তুলে নিয়ে কেঁচাতে-কেঁচাতে চলে গেলো, যেন এ কাজটার জন্যই এদিকে সে এসেছিলো।
ধাত্রী এসেছে। এবং সুমিতি এখন থেকে আন্দাজ করছে এরা সে ব্যাপারটাকে অবলম্বন করেও একটাউৎসবের আয়োজন করবে। সর্বত্র না-হলেও সে উৎসবে কোথাও কোথাও গভীর আনন্দ বিচ্ছুরিত হবে। তার সন্তানকেও কেউ হয়তো অবহেলা করবে না।
সেদিন রূপুর সঙ্গে দেখা হলো সিঁড়ির গোড়ায়। রূপু অনেক সময়ে পৃথিবীর অনেক সুখবর ও আনন্দ বহন করে আনে। আজও তার মুখচোখ হাসিমাখা। সুমিতি প্রত্যাশা নিয়ে দাঁড়ালো।
রূপু দূর থেকেই বললো, কংগ্রাচুলেসনস্ সিস্টার সু।
কী হলো?
রূপু এত আনন্দের কারণ, এতখানি বিচলিত হওয়ার কারণ বহুদিন পায়নি। দিদিকে যেমন ছোটো ভাই জড়িয়ে ধরতে পারে তেমনি করে সে সুমিতিকে বাহুবেষ্টনে ধরে বললো, তুমি ভালো, কিন্তু এত ভালো আমি জানতাম না। এত ভালো তুমি? এতদিনে যা হোক কিছু একটা হবে এ বাড়িতে।
সুমিতি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলো।
কিন্তু প্রশ্নগুলো নিজের মনে উঠছে আবার নতুন করে। আর পুরনো প্রশ্ন নতুন করে উঠলে প্রায় নতুন চেহারা নেয়। তার বিবাহটা এরকম হলো কেন তা কি আবার প্রশ্ন? সব বিষয়ে যারা অগ্রসর চিন্তার পরিপোষক তারা বিবাহের মতো ব্যাপারে, যা মনসার ভাষায় এক বিপ্লব, মন্ত্রোচ্চারণ এবং ক্রিয়াকাণ্ড, যাতে তাদের বিশ্বাস নেই মেনে নেবে কেন? মানেনি কারণ মানা যুক্তিসঙ্গত নয়। কাউকে আঘাত করার কথা দূরে থাক, কারো কথা চিন্তা করার অবকাশ ছিলো না। আর সেভাবেই তো প্রমাণ করা সম্ভব কারো বাকি জীবনটা আধুনিক থাকবে কিনা।
সুমিতি মনে মনে যেন মনসার সঙ্গে কথা বললো, হ্যাঁ, মণিদিদি, তোমার তুলনাটা হয়তো আমার পক্ষেও খাটে। গর্গার জীবন আর তার ছবি আঁকা এক হয়ে গিয়েছিলো, তোমার জীবন আর সংসার মিলে একটামাত্র নাটক হয়তো যা তুমি রচনা করছে; তেমনি কারো জীবন আর একটা গ্রাম তো এক হয়ে যেতে পারে। কেউ যদি এই গোটা গ্রামটাকেই তার সংসার করে নিতে চায়? তুমি বলবে, নতুন কি? আকাশে বাতাসে এখন গ্রামে ফেরা, গ্রামকে স্বাবলম্বী করার কথা।
সুমিতির মুখে নিঃশব্দ হাসি দেখা গেলো। সে মনে মনে বললো, মণি, না হয় বলো সেই জার্মান ভদ্রলোকের কথা, যিনি কঙ্গোর গ্রামে গিয়ে বাস করছেন। একটু পরে সে আবার তেমন করেই মনে মনে বললো, হয়তো কেউ টেনিস র্যাকেট ত্যাগ করেছে; হয়তো কারো সেই বহু অটেভের অর্গান, যাকে তুমি চার্চ অর্গানের মতো প্রকাণ্ড বলেছে, তা আর কাজে লাগে না; হয়তো গোটা গ্রামটার দারিদ্র্য আর অজ্ঞতার চাপে অন্য কেউ অকালবৃদ্ধা হবে, ততদিন আমার স্বামীর গ্রামটাকেও আমাকে ভালোবাসতে দিও।
কিন্তু সুমিতির চিন্তা সহসা প্রায় আর্ত হলো।
সুকৃতি তার নিজের বোন। কাল্পনিক একটা কলঙ্কের মিথ্যা রটনা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য সে যা করেছিলো তাতে সবরকমেই আত্মহত্যা হয়েছে। অথচ সে নিজে কলঙ্কের–অন্তত এদের চোখে তো বটেই এবং কলঙ্ক মানেই প্রতিবেশীর দৃষ্টিভঙ্গি–উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে এ বাড়িতে এসে উঠেছে। সুকৃতি যে কালের প্রতিভূ সেটা গত হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র কালই কি? সুকৃতিকে যেমন সে সৃষ্টি করেছিলো তেমনি কি আমাকেও করছে?