শ্রীকৃষ্টের সংসারে চাষী সৃষ্টি হবে এটা কেউ কল্পনা করতে পারেনি, কিন্তু তার ছেলে ছিদাম চাষী হলো।
ছিদামের হাতে সংসার প্রতিপালনের ভার। তাকে অত্যন্ত পরিশ্রম করতে হয়। নিজেদের বলতে সামান্য যেটুকু আছে তার চাষ হয়ে গেলেও সে বসে থাকেনি, অন্যের জমিতে মজুর খেটেছে।
চৈতন্য সাহাকে জমিদার সময় দিয়েছে, সেও খাইখালাসি থেকে জমি মুক্ত করে দিয়েছে। কিন্তু অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এইরকম : কোনো অত্যাচারের বন্দীশালা থেকে মুক্তির এই শর্ত হয়েছে যে একশজন যোদ্ধার ব্যুহ ভেদ করে একটা নির্দিষ্ট সীমায় পৌঁছতে হবে, আর দলপতি রামচন্দ্র যেন খোলা তলোয়ার হাতে তুলে নিয়ে সেই ব্যুহ ভেদ করতে অগ্রসর হলো। খোরাকির ধানের জন্য, হাল বলদের জন্য জমি আবার চৈতন্য সাহার কাছেই রেহানেরাখতে হবে। রেহান ছাড়া করতে প্রাণপণ না করলে চলবে না, প্রাণপণে মুক্তি। ভোর রাত থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিদাম মাঠে পড়ে থাকে।
সংসার প্রতিপালনের দায়িত্বের সঙ্গে কর্তৃত্বের অনিবার্য যোগ আছে, কিন্তু কর্তৃত্ব নিয়ে অনেকসময়ে অশান্তির সৃষ্টি হয়।
কেষ্টদাস জমিজমা থেকে আগেই হাত গুটিয়ে নিয়েছিলো। অসুস্থতার জন্য তাকে বিরক্ত করা অনুচিত ভেবেও বটে, আর তার কাছে উৎসাহব্যঞ্জক পরামর্শ পাওয়া কঠিন বলেও বটে, ছিদাম তার চাষসংক্রান্ত আলোচনাগুলি বাড়িতে পদ্মর সঙ্গে, অন্যত্র মুঙ্লার সঙ্গে করে। এতে একটা উপেক্ষার ভাব আছে, কিন্তু কেষ্টদাস জীবনের কোলাহল থেকে পিছিয়ে পড়তে চায় বলে এটা তার গায়ে লাগেনি।
একদিন কিন্তু তার মনে আঘাত লাগলো।
কিছুদিন থেকে আবহাওয়াটা তার শরীরের পক্ষে অনুকূল যাচ্ছে। সকালে উঠে সে বেরিয়ে পড়ে; এ-পাড়ায় ও-পাড়ায়, বৃদ্ধ জরাজীর্ণদের দাওয়ায়, কারো বাড়ির কোনো গাছতলায় অনেকটা সময় কাটিয়ে দুপুরে বাড়ি আসে। তারপর স্নানাহার ও দিবানিদ্রা। বিকেলে কখনো কখনো তার বাড়ির দাওয়ায় কেউ এসে বসে, কোনদিন সে যায় রামচন্দ্র মণ্ডলের বাড়িতে। সেদিন বাড়ির কাছাকাছি এসে গাছগুলির ছায়া দেখে সে টের পেলো, বেলা গড়িয়ে গেছে।
বাড়িতে ফিরে সে দেখলো শোবার ঘরে শিকল তুলে দেওয়া, রান্নাঘরেও তাই। সে ডাকলো, কই বৈষ্ণবী, গেলা কোথায়? সাড়া না পেয়ে সে ভাবলো হয়তো কোথাও গেছে, এখনই আসবে। রান্নাঘরের বারান্দায় মাটির ঘড়ায় রোজকার মতো তার স্নানের জল ভোলা ছিলো। স্নান শেষ করে সে কিছুক্ষণ আবার অপেক্ষা করলো। তার ক্ষুধার উদ্রেক হওয়ার কথা। রান্নাঘরের দরজা খুলে সে দেখলো পিড়ি পাতা, পিড়ির সম্মুখে ধামা দিয়ে ঢাকা আহার্য সাজানো রয়েছে। একবার সে ভাবলো আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক কিন্তু পরে মনে হলো, পদ্ম যদি তাড়াতাড়িই ফিরবে তবে খাবার গুছিয়ে রেখে যেতো না। তার দুর্বল দেহ উপবাসের পক্ষে অপটুও বটে। আহারের পর মনে হলো তার–হয়তো পদ্ম ছিদামের জন্য আহার্য নিয়ে মাঠে গেছে। একটা অভিমান হলো তার।
চিকন্দির সীমায় সানিকদিয়ারের মাঠগুলির লাগোয়া কেষ্টদাসের সামান্য কিছু জমি ছিলো। কেষ্টদাস সেখানে গেলো। রোদ তখন মাথার উপরেই আছে। জমিটার দিকে এগোতে এগোতে কেষ্টদাস ভাবতে লাগলো পদ্মর সঙ্গে দেখা হলে কী বলবে সে। পদ্ম যদি তার পূর্বের কোনো বৈষ্ণবীর মতো হতো তাহলে তার কাছে বিলম্বের জন্য কৈফিয়ত নেওয়া যেতো। এক্ষেত্রে সে নিজেই একটা কৈফিয়ত তৈরি করে ফেলো, সে স্থির করলো দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করবে হাট থেকে কিছু কেনাকাটা করতে হবে কিনা।
জমিটার চৌহদ্দির আলের উপরে একটা আমগাছ ছিলো, কলমের গাছ খোলা আকাশের নিচে ছাতার মতো গোল হয়ে উঠেছে। ছিদাম, পদ্ম ও মুঙ্লাকে কেষ্টদাস দূর থেকেই চিনতে পারলো। তারা যেন গোল হয়ে বসে কী আলাপ করছে। বিষয়টা কী, তা তার আন্দাজে আসছে না, কিন্তু আর এগোতেও পারলো না সে।
দিনটা গড়িয়ে গেলো। রাত্রিতে কেষ্টদাস তার বিছানায় বসে শুনতে পেলো অন্যান্য দিনের মতো ছিদাম আর পদ্ম জমিজমা ফসল নিয়ে আলাপ করছে। সে আজ দুপুরবেলায় যা অনুভব করেছে সেটা অন্য কারো অনুভব করার কথা নয়। তার মনে হতে থাকলো–পদ্মর কী একবারও প্রশ্ন করতে নেই দুপুরে সে আহার করেছে কিনা? অবশ্য সে আহার করেছে এটা পদ্ম জিজ্ঞাসা না করেও বুঝতে পেরেছে, তবু জিজ্ঞাসা করলেই যেন স্বাভাবিক হতো। কেষ্টদাসের মনে হলো। তেমন সেবাযত্ন আর যেন সে পায় না। এই যে ওরা আলাপ করছে এতেও যেন তাকে অস্বীকার করার ভাবটাই আছে। জমিজমা যতটুকু আছে সবই তার, তবু সে যেন উহ্য। মৃত্যুর পরেই বোধ করি এমন হয়।
কিন্তু সংসারটাকে দাঁড় করানোর অবস্থায় যদি এনে থাকে তবে সেটা করেছে ওঁরাই। এমন অমানুষিক পরিশ্রম করতে হাজারে একজন পারে না। আর তাছাড়া, যদি ওর মা বেঁচে থাকতো তবে সেও ছেলের আহার্য নিয়ে নিশ্চয়ই এমনি করেই মাঠে যেতো৷ ‘গুরু! গুরু! বলে মনকে সংহত করার চেষ্টা করতে করতে কেষ্টদাস শুয়ে পড়লো।
পাঁচ-ছ দিন পরে কেষ্টদাস দিবানিদ্রার আয়োজন করে নিচ্ছে এমন সময়ে পদ্ম এলো তার কাছে।
কী কও পদ্মমণি?
উত্তরদিকের জঙ্গলের ভিটাগুলি কার?
মোহান্তদের মধ্যম গোঁসাইয়ের।
হাতের মাপে এক বিঘা চৌরাস জমি। ওই ভিটায় আমার ঘর তুলে দেও না কেন, আমি থাকি।
এ-ঘরে কি কুলান হয় না, ও-ঘরে কাকে নিয়ে থাকবা, পদ্মমণি?
কেন, মধ্যম গোঁসাইয়ের সমাধি নাই?
তা নাই। গোঁসাই বৃন্দাবনে অভাব হইছিলেন অনেককাল আগে।
তবে তো আরও ভালো। ভিটায় বাগান করবো, শাকপাতা লাগাবো।
পদ্ম চলে গেলো। তার পরনের হলদে ডুরে শাড়িটা জীর্ণ হয়েছে। কেষ্টদাসের মনে হলো, পদ্মর মতো রুচি নিয়ে চলতে গেলে নতুন শাড়ি আবার কিনতে হবে, পরিশ্রম না করেও উপায় নেই।
কেষ্টদাস কিছুকাল ব্যর্থ চেষ্টা করলো দিবানিদ্রার, তারপর উঠে পদ্মকে খুঁজে বার করলো। রান্নাঘরের আড়ালে একটা গাছতলায় বসে কাঠের লাটাইয়ে পাক দিয়ে পাটের সুতলি পাকাচ্ছিলো সে।
কেষ্টদাস বললো, কাজ করো? দিনরাতই কাজ করো!
পদ্ম লাটাই নামিয়ে রেখে বললো, খাওয়ার জল দিবো, গোঁসাই?
না, এমনি আলাম তোমার খোঁজে। দৃঢ়যৌবনা পদ্ম, আর রোগজীর্ণ কেষ্টদাস।
কেষ্টদাস বললো, তোমাদের কাজে আমাকে ডাকলিও পারো।
ভারি কাজ!
মিয়ে ছাওয়াল হয়ে তুমি এবার ক্ষেত নিড়াইছো।
না নিয়ে উপায় কী! পরের বলদ আনে চাষ দিছিলো জমিতে, বলদের ভাড়ার বদলা ছিদাম যায় তার ক্ষেতে কাম করবের।
নিড়ানি তুমি শিখলে কনে তাই ভাবি।
বাপের আহ্লাদি মিয়ে, বাপের কোলে থাকতাম। চাষের কামে বাপের হাত চলা দেখছি।
কেষ্টদাস একটি অত্যন্ত আদরিণী মেয়ের পরিণতির কথা চিন্তা করলো। তারপর বললো, তুমি কাজ করো, বৈষ্ণবী, আমি তোমার পান সাজে আনি।
কেষ্টদাস পান সেজে নিয়ে এলো।
পান নিয়ে পদ্ম বললো, তাহলে ধরো, দড়ি পাকায়ে নি।
পদ্ম সুতলির একটা মুখ কেষ্টদাসের হাতে দিয়ে দড়ি পাকানোর জোগাড় করে নিলো।
কেষ্টদাস বললো, এত দড়ির কী কাম?
মিয়েমানুষের দড়ি-কলসি ছাড়া আর কী সম্বল কও?
কেষ্টদাস হাসতে পারতো কিন্তু পদ্মর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হলো, এটা রসিকতা, কিন্তু এমন যার ঘরনী হওয়ার যোগ্যতা তার সত্যিকারের ঘর বাঁধা হলো না। তার মনে দড়ি কলসির কথা জাগলে অযৌক্তিক হয় না।
কিন্তু পদ্ম তখন-তখনই বললো, কী দ্যাখো, পানে ঠোঁট লাল হইছে?
এর উপরে কি অভিমান করা যায়?
আর ছিদামের কথা? সারা গায়ে তার নিন্দা নেই, প্রশংসা আছে। কয়েকদিন আগে তার বাড়িতে বসেই রামচন্দ্র তার প্রশংসা করে গেছে।
কেষ্টদাস মহাভারত নিয়ে পড়তে বসেছিলো। অভ্যাসের ফলে তার পড়াটা আগেকার তুলনায় অনেক স্পষ্ট হয়েছে। এমন সময়ে ছিদাম এলো। তার গায়ে তখনো মাঠের ঘাস লেগে আছে, কোথাও কোথাও মাটি।
কিছুক্ষণ দ্বিধায় কাটিয়ে অবশেষে সে বললো, জেঠা, একটা কথা কবো?
কও, কও না কে। রামচন্দ্র বললো।
বুধেডাঙায় সান্দারদের ইস্তফার জমি আছে।
তা আছে।
এক পাখি পাওয়া যায় না?
টাকা হলি যায়।
কয়ে বলে পত্তনি–নজর পরে দিলি হয় না?
তা কি ছাড়ে জমিদার; বরগা চায়ে নেও না কেন্? রামচন্দ্র হাসিমুখে বলেছিল।
হাল বলদ মানুষ নাই।
রামচন্দ্র হেসে বললো, তবে পত্তনি নিয়ে বা কী হয়?
এই পরিবেশে রামচন্দ্র কেষ্টদাসকে বলেছিলো, ছাওয়াল আপনের ভালো, গোঁসাই।
কী কলেন?
কই যে, জোরদার ছাওয়াল। এমন গাছ লাগায়ে সুখ। খুব খাটে।
তা তো খাটাই লাগে। কে, আপনার মনে নাই নবনে খুড়ো ক’তো-পুরুষের ঘাম জমির বুকে না পড়লি ফসলবতী হয় না জমি।
হ্যাঁ, এমন একটা ছড়া তার ছিলো।
কিন্তুক আপনার মতো কোনকালে হবি? এক চাষে জঙ্গল-জমি তিন ফসল দেয়, সে আর আপনে ছাড়া কার খ্যামতা?
আউস উঠেছে। এ অঞ্চলে আউসের জমি কম, চাষও ভালো হয়নি। শুধু বর্ষাটা অকরুণ ছিলোনা বলেই কিছু ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু সে ধানের অধিকাংশ চৈতন্য সাহাদের।তবুদীর্ঘদিন রোগভোগের পর একটা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা যেন, হোক না তা লাঠি ধরে ধরে।
এ বাড়িতে ছিদাম বলে যে আর একটি প্রাণী আছে, এটা কিছুদিন যাবৎ ঠাহর হতো না। একদিন সকালে কেষ্টদাস লক্ষ্য করলো, মুঙ্লা একটা গোরুগাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসছে পিছনে ছিদাম।
কিরে?
ধান।
ধান?
হয়।
সব জমির?
জমির, মজুরির।
কিন্তুক খ্যাড়সমেত কেন?
ও তো আমার; ফেলায়ে কী হবি?
গোরু কই? আচ্ছা জারুক কবো যদি সে একটা বকনা বাছুর দেয়।
তা দেয় ভালোই। এখন তো ঘর ছায়ে নিই।
তখন কথা বলার সময় নয়। গাড়ি নামিয়ে ছিদাম ও মুঙ্লা ধান নামাতে শুরু করলো। ধানের আটিগুলি নামানোর সময়ে তারা যেন সেগুলিকে আলিঙ্গন করছে।
.
অনেকদিন পরে পাশাপাশি আহারে বসেছিলো কেষ্টদাস ও ছিদাম। পদ্ম পরিবেশন করছে। আজ অন্তত ছিদামের ছুটি।
খেতে খেতে এ কথা-সে কথা বলতে বলতে সে বললো, আর-এক কথা, এবার বাঙালেক শিখায়ে দিছি ধান কাটা কাকে কয়।
কও কি? কেষ্টদাস বিস্ময় প্রকাশ করলো।
হয়। সাচাই। চরনকাশির সেখের বেটার খেতে বাঙালরা কয়–বিশ আটিতে আটি নিবো। আমি কই-বাইশ আটিতে আটি। মুঙ্লাক নিলাম সাথে। ধান তো কাটবের বসলাম। বাঙাল তিন আটি কাটে তো আমরা কাটি দুই। মুঙ্লাক কলাম-মুঙ্লা রে, হার। খুব হার খালাম। মুঙ্লা কয়কত্স কী? মুঙ্লা যে বসে বসে লাফায়ক কচাক। চায়ে দেখি বাঙাল কাটে তিন, মুঙ্লা কাটে তিন। কী যে হলো। কলাম-নিশ্বাস ছাড়া লাগে ছাড়বো। আঙুল নামে যায় যাক্। চোখে দেখি ধানের গোছ। চায়ে দেখি মুঙ্লা কাটে সোয়া তিন, বাঙালে তিন। কই-মুঙ্লা, ধরলাম তোক। সে কয়–আগগে শালা। কই-মুঙ্লা রে, শালা কয়ো না, ভাই, এই সাড়ে তিন নামালাম। সে কয়-মিতে, এই ল্যাও সাড়ে তিন। চায়ে দেখি, কনে বাঙাল? আলেফ সেখ আলে দাঁড়ায়ে দাড়ি ভাসায়ে গদগদায়ে হাসে আর কয়-সাবাসি বেটা, সাবাসি।
ছিদাম যেন কোন স্বপ্নলোকে চলে গিয়েছিলো। গল্প বলতে বসে উত্তেজিত হয়ে সে ধান কাটার ভঙ্গি নিয়েছে। ধান কাটার কাজে বিশেষজ্ঞ বাঙালদের সে পরাজিত করেছে।
একদিন বিকেলের দিকে ছিদামকে তার রামশিঙাটা বার করে সাফসুতরো করতে দেখে পদ্ম বিস্মিত হয়ে কারণটা জিজ্ঞাসা করলো।
ছিদাম বললো, আজ চৈতন্যকাকার বাড়ি কীর্তন গান হবি।
চৈতন্যকাকা?
ছিদাম হাসিমুখে বললো, সে কালের চিতিসাপ। কইছে তার বাড়ি একদিন কীর্তন গাওয়া লাগবি। মুঙ্লাক কইছে, সেও রাজী। চৈতন্যকাকা সকলেক কবি।
পদ্ম ইতিউতি করে বললো, তাক কাকা কও, সে কি তোমাগের দেনা-দায়িক সব ছাড়ে দিলো?
ছিদাম তার নবলব্ধ শক্তির পরিচয় পেয়ে নির্ভীক। পৃথিবীর সকলকে এমনকী শত্রুকেও সে এখন নিজের ঘরে ডাকতে পারে।
সে বেরিয়ে গেলে পদ্ম বললো, যেন ফাটে পড়বি।
তা ভালোই যদি চৈতন্য সার সঙ্গে মিলমিশ হয়। বললো কেষ্টদাস।
হয় হবি। আমি কৈল তাকে কোনোকালে ভালো চোখে দেখবো না। আখেরে জিতলো সে-ই, তার সুদের সুদ আর শোধ হবি নে। পদ্ম কতকটা বিরস মুখে বললো।
কিন্তু রামচন্দ্রও এ ব্যাপারে পদ্মর সঙ্গে একমত হলো না। বরং তার মতামত শুনে মনে হলো, ছিদামের মতের গোড়ার কথা তার মত থেকেই সংগ্রহ করা।
পদ্ম কিছুটা নালিশের ঢঙে কথাটা একদিন উত্থাপন করতেই রামচন্দ্র বললো, তার বাড়িতে কীর্তন হবি, তাতে দোষ কী?
তার চায়ে তার নামে গান বাঁধা ভালো, শাসনে থাকে।
সে তো মাপ চাইছে। রামচন্দ্র বললো।
কিন্তুক সুদ ছাড়ে নাই।
সুদ ছাড়বি? এ কি খয়রাতি? তা নিবো কেন্? পরম বিস্ময়ে রামচন্দ্র প্রশ্ন করলো।
যে জমি সে ছাড়ে দিছে তা আবার পাকে পাকে তুলে নিবে।
কে, তা হয় কেন? তার সুদ-আসল পরিশোধ করবো যদি!
ফসল তো উনা হবের পারে।
ভগোমানে তা পারে, নাইলে খেতে দু’না চাষে উনা ফসল হয় কেন?
এবার পদ্মকে থামতে হলো। রামচন্দ্র ছিদাম নয়। তার পরিমিত ভাষার প্রকাশভঙ্গিতে কথাগুলি পুরাকাল থেকে বারংবার প্রমাণিত হওয়া সত্য বলে বোধ হচ্ছে। অনেক খরায় পিঠ পুড়েছে, অনেক বর্ষায় শ্যাওলা পড়েছে এমন একজন চাষী যখন কথা বলে তখন সশ্রদ্ধ হয়ে শুনতে হয়।
তথাপি সে বললো, মানুষের বেরামপীড়া আছে। সকলে সমান খাটবের পারে না।
তা হয়।
তাইলে?
জোয়ার-ভাটা হবি, দোলনার মতো উঠবি-পড়বি।
লোক তো ফৌত হবেরও পারে।
কন্যে, চৈতন সা-ও চিরকালের পরমাই নিয়ে আসে নাই। রামচন্দ্র খানিকটা হেসে নিয়ে বললো।
রামচন্দ্র চলে যাওয়ার পর কেষ্টদাস তার বিস্ময় বোধটাকে পুরোপুরি অনুভব করতে পারলো। শুধু যে ধান এসেছে তাই নয়, সমগ্র চাষীসমাজের কর্তব্য-অকর্তব্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তারই ঘরে।
রাত্রিতে পদ্ম উনুন জ্বালে না। তার হাতে এখন খানিকটা অবসর, কিন্তু তার এই অবসরের মধ্যেও ছিদাম হাত পেতে আছে। পদ্ম লাটাই নিয়ে সুতলি পাকাতে বসলো। ধান ঘরে উঠেছে তবু ছিদামের বিশ্রাম নেই। ভোর রাতে উঠে এখনো সে কাজে বেরিয়ে পড়ে। মুঙ্লার এক প্রতিবেশীর ঘরে কাজ হচ্ছে, মুঙ্লা আর ছিদাম তাই নিয়ে ব্যস্ত। তার কাজ শেষ হলে ছিদামের বাড়িতে কাজ শুরু হবে। কখন এসে ছিদাম সুতলি চেয়ে বসে তার স্থিরতা নেই।
সুতলি পাকাতে পাকাতে পদ্ম রামচন্দ্রর কথাও ভাবলো। নিজে সে রামচন্দ্র নয়, ছিদাম পর্যন্ত নয়। মেরুদণ্ড ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে তবু সংহত শক্তির প্রতীক হতে পারবে এমন গঠন ভগবান তাকে দেননি, এই যেন অনুভব করতে লাগলো পদ্ম। নিজের যা নেই তারই আধার চোখের সম্মুখে দেখতে পেয়ে পদ্ম আবার একটা দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করতে লাগলো।
তখন তার মনে পড়লো রামচন্দ্রর বাঁ দিকের চোয়ালের উপরে একটা বড়ো তিল আছে। রাতের বেলায় হারিকেনের আলোতেও সেটা চোখে পড়ে। অমন গোঁফের উপরে অমন একটা তিল না থাকলে পুরুষ কখনো এত আকর্ষণীয় হয় না।
.
চৈতন্য সাহার বাড়িতে কীর্তনের আসরে কথায় কথায় একটা মহোৎসবের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মহোসবের স্থান সম্বন্ধে এই স্থির হয়েছে যে সান্যালমশাই যদি রাজী হন তবে তাঁর বাগানের মধ্যেই হবে। কর্মকর্তাদের মধ্যে কেষ্টদাস আছে, শুধু তাই নয়, এ বিষয়ে তার একটা অগ্রাধিকার লোকে পুনরাবিষ্কার করেছে।
সান্যালমশাই প্রস্তাবটায় হাসিমুখে রাজী হলেন। রামচন্দ্র, কেষ্টদাস, চৈতন্য সাহা এবং গ্রামের আরও কয়েকজন মাতব্বর-স্থানীয় ব্যক্তি গিয়েছিলো প্রস্তাবটা করতে।
ব্যবস্থাটা হবে সমবায় পদ্ধতিতে। যার যে রকম সংগতি তার উপরে তেমন আয়োজনের ভার দেওয়া হয়েছে। সংগতি সম্বন্ধে কৌতুকের ব্যাপার দেখা যাচ্ছে এই যে, রামকে যদি বলা যায় পাঁচ সের চাল দেবে তুমি, সে বলছে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সাড়ে সাত সের নিয়ো। সান্যালমশাইকে তেল চিনি ঘি মশলা প্রভৃতি দামী জিনিসের ভার দেওয়া হয়েছে। চাষীরা নিয়েছে চালের ভার। গ্রামের ভদ্রব্যক্তিরা ডাল আনাজ প্রভৃতির জোগাড় রাখবে। চৈতন্য সাহা ভার নিয়েছে টাকাপয়সার। এটা নিয়ে একটু হাসাহাসি হয়েছিলো।
চৈতন্য সাহা এতক্ষণ দায়িত্ব বণ্টনের কথাবার্তায় উৎসাহের সঙ্গে যোগ দিচ্ছিলো; এমনকী, দায়িত্বের অবহেলা করা কারো উচিত হবে না এমন উপদেশও মাঝে মাঝে দিচ্ছিলো। নিজের দায়িত্বের কথা শুনে সে লাফিয়ে উঠলো তড়াক করে : ‘অন্যাই, অন্যাই। লেখাজোখানাই এমন দায়িত্বের নিবের পারি না।
বেশ তো, লেখাজোখা থাক। পাঁচশ এক টাকা বরাত থাকলো। নায়েবমশাই এসব ব্যাপারে মধ্যস্থ, সে-ই বললো।
কী কন, এক-পঞ্চাশ? আমাকে ঘানিত ফেলে মোচড়ালিও একপঞ্চাশ বার হবি নে। নায়েবের চারিদিকে যারা সভা করে বসেছিলো তাদের দু-একজন বললো, এক-পঞ্চাশ না সাজিমশাই, পাঁচ-শয় এক।
বুঝছি, আপনেরা আমাকে পেড়ন করবের চান। এক-পঞ্চাশ যখন ধরছেন তাই দিবোনা দিয়ে উপায় কী?
তা তো কথা নয়। এসব ব্যাপারে নগদ টাকার দরকার হয়। কীর্তনীয়াদের বিদায় আছে। দীন-দুঃখীদেরও কিছু কিছু দিতে হবে। আপনি যে কানে কম শোনার ভান করছেন তাতে কিছু কাজ হবে না। বললো নায়েবমশাই।
চৈতন্য সাহাকীকরতো বলা যায় না। ছিদাম ভিড়ের মধ্যে থেকে উঠেদাঁড়ালো। এই সভায় চৈতন্য সাহাকে সে-ই বাড়ি থেকে ডেকে এনেছে এবং অহেতুক যোগাযোগের মতো কীর্তনের দিনে চৈতন্যর বাড়িতে ফেলে-আসা রামশিঙাটাও সে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। ছিদাম উঠে দাঁড়াতেই চৈতন্য তেড়ে উঠলো, বোসো, বোসো, তুমি আবার ওঠো কেন। তোমার আধখানও তো আছে । দেখি।
মুঙ্লা শ্বশুরের সম্মুখে জড়োসড়ো হয়েছিলো, সে আরও লজ্জিত হয়ে মুখ নামালো। চৈতন্য বললো, গাঁ কি? না, চিকন্দি। ভাই বন্ধুসকল, দিঘায় সেইবার মোচ্ছব হইছিলো। যদি তোমাদের মচ্ছোব তার চায়ে কমা হয় এক পয়সাও পাবা না। এ যেন অন্য কোনো চৈতন্য। কথাটা বলবার আগে চৈতন্য হাসলো এবং বলতে বলতেও হাসিমুখে চারিদিকে চাইলো।
আর যদি না হয়?
হাজারে এক ধাইযো থাকলো।
মচ্ছোব খেতে বসে হুংকার দেওয়ার প্রথা আছে। তেমনি হুংকার দিয়ে কেষ্টদাস বললো, ট্যাকা কার?
অনেকে প্রত্যুত্তরের ভঙ্গিতে বললো, চৈতন সা-র।
ছিদাম-মুঙ্লারা এখনও চাষী বলে পরিগণিত হয়নি। চাল জোগান দেওয়ার দুশ্চিন্তা তাদের নেই। কেষ্টদাস আর রামচন্দ্রর দেয় চাল তৈরি হচ্ছে রামচন্দ্রর বাড়িতে। পদ্ম সেখানে কেষ্টদাসের চালের ভাণ্ডারি। ছিদাম আর মুঙুলা একটা কাজ বেছে নিলো। আরও চার-পাঁচজন সমবয়সীকে দলে ভিড়িয়ে নিয়ে গ্রামের প্রাচীনতম তিনটি আমগাছকে তারা আক্রমণ করেছে। মহোৎসবের দিন পনেরো আগে লকড়ির কথা উঠতেই ছিদাম জবাব দিলো, পোস্তুত।
সান্যালমশাইয়ের বাগিচার বড়ো বড়ো আমগাছগুলির তলা থেকে আগাছার জঙ্গল কেটে ফেলা হয়েছে। তার কোনো কোনোটির তলায় কাপড় ও খড় দিয়ে দূরাগতদের জন্য আস্তানা করা হয়েছে।
বাগিচার একপ্রান্তে কীর্তনের আসর বসেছে একটি সামিয়ানার তলায়। সামিয়ানার খুঁটিগুলিতে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক কয়েক রকমের ছবি লটকানো। সামিয়ানার তলায় অষ্টপ্রহর নামকীর্তন চলছে। গিতা গিজাং করে খোল বাজছে। বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে কীর্তন করে চলেছে দলের পর দল। কীর্তনের এক-একটি পর্যায়ের শেষের দিকে এসে উদ্দাম নাচে পৃথিবী যেন টলতে থাকে।
বাগিচার শেষ সীমান্তে অন্দরের পুষ্করিণীর পারে এসে মহোৎসবের রান্নার জোগাড় হয়েছে। সারি সারি দশ-পনেরোটা উনুনে গ্রামের সবগুলি বড়ো ডেগ এনে বসানো হয়েছে। হাঁড়ি হাঁড়ি ডাল ঢেলে রাখা হচ্ছে যেগুলিতে সেগুলি বোধ হয় সান্যালবাড়ির জলের ট্যাঙ্ক। ভাত রাখা হচ্ছে নতুন চাটাইয়ের উপরে নতুন কাপড় পেতে, সামিয়ানার নিচে ভাতের পাহাড়। চাটাই দিয়ে একটা জায়গা ঘেরা হয়েছে, তার আড়াল থেকেও মানুষের গলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, ধোঁয়া উঠছে, রান্নার তেলের কলকল শব্দ আসছে। সেখানে নায়েবগিন্নীর তত্ত্বাবধানে তরকারি, ভাজা ও মালপোয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে যে, সান্যালমশাই শেষ পর্যন্ত বলেছেন–রোগী ও শিশুর দুধ রেখে আশপাশের দশ গায়ে যত দুধ, সবদুধই আসবেমহোৎসবে, দিঘায় বা সদরে যাবে না। দামের জন্য চিন্তা নেই। অপেক্ষাকৃত কমবয়সীরা বলাবলি করছে–সকলেই পায়েস পাবে, কেউ বাদ যাবে না।
কথা ছিলো, দুপুর হতে হতেই আহারপর্ব শুরু হবে কিন্তু বিলের পার থেকে যাদের আসার কথা তারা এসে পৌঁছয়নি, পদ্মপাতাও আসেনি। অবশেষে তারা এলো। গোরুগাড়িতে বোঝাই হয়ে আসছে পদ্মপাতা, আর তার আগে আগে বিলের দল আসছে কীর্তন করতে করতে। হৈ হৈ পড়ে গেলো। কথা ছিলো, একবারে একশ জন করে বসবে। কিন্তু গাড়ি থেকে পদ্মপাতা তুলে নিয়ে পুকুরের জলে চুবিয়ে বাগিচার একটা চওড়া রাস্তার দুপাশে এক বালখিল্যের দল আসন পেতে বসলো। সেই দলকে যে থামাতে গিয়েছিলো, পদ্মপাতা থেকে ঝরা জলে পিছল মাটিতে সে গড়াগড়ি দিয়ে উঠলো, কিন্তু বালখিল্যের দলকে রোধ করতে পারলো না। তখন ছিদাম আর মুঙ্লার দল হুংকার দিতে দিতে বালতি-হাতে পরিবেশন করতে এগিয়ে এলো।
নিমন্ত্রণ ভোজ প্রভৃতির তুলনা দিয়ে ব্যাপারটাকে বোঝা যাবেনা, এ আহার নয়। একটি উদ্দাম জীবনভোগ বললে কাছাকাছি বলা হয়। ডাল ভাত দিতে দিতে ছিদাম-মুঙ্লাদের গাল বেয়ে যখন ঘাম পড়ছে তখন বেরুলো তরকারির ঘর থেকে লোক, তাদের পেছনে দিগন্তে রামচন্দ্রর খবরদারিতে মালপোয়া আর পায়েসের দল।
ওদিকে কীর্তনও উদ্বেল হয়ে উঠলো। কেষ্টদাসের গলায় ফুলের মালা, মাথায় ফুলের মালা, সে নবাগত কীর্তনের দলগুলিকে বিষ্ণুপূজার নির্মাল্য বিতরণ করছে।
দুপুর একটু গড়িয়ে যেতে লোকারণ্যে বাগিচার গাছগুলির কাণ্ড অদৃশ্য হয়ে গেলো। সহস্র কণ্ঠে উৎসারিত নামকীর্তন কালবৈশাখীর গর্জনকে ডুবিয়ে দেওয়ার পক্ষেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়ে উঠলো। তবু নতুন নতুন লোক আসছে। কণ্ঠের বালাই নেই, সুর-তান-লয় এই প্রবল স্বননে অর্থহীন। যেন কোনো এক নতুন জগৎ থেকে নিশ্বাস নেওয়ার নতুন বাতাস এসেছে, প্রাণপণে সে দুর্লভ্যকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করছে প্রত্যেকে।
ভোজের মহল্লাতে আনন্দের উচ্ছ্বাস সমুদ্রতরঙ্গের মতো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। প্রত্যেকটি ভোজ্যদ্রব্য যেন এক-একটি রাজ্যলাভ। পরিবেশকরা হুংকার দিচ্ছে পরিবেশন করতে করতে, যারা খেতে বসেছে তারা জ’কার দিয়ে উঠছে।
বিকেলের দিকে সান্যালমশাই এলেন। রামচন্দ্র তাঁকে দেখতে পেয়ে পরিবেশনের মাঝখানে থেমে গর্জন করে উঠলো, রাজো রাজোধিরাজ। সহস্রাধিক কণ্ঠে বজ্রের মতো ফেটে পড়লো, জয়!
সান্যালমশাই ফিরে দাঁড়ালেন হাসিমুখে, তার চোখের কোনায় কোনায় জল এসে গেলো। কিন্তু কীর্তনের আসরে পৌঁছুতে বেগ পেতে হলো তাকে। চৈতন্য সাহা পথ করে দেওয়ার চেষ্টা করছিলো, কেষ্টদাসও তাকে দেখতে পেয়ে যত্ন করে রাখা নির্মাল্যের মালাগাছি পৌঁছে দিতে গেলো। কিন্তু চৈতন্য সাহা জনসমুদ্রে তলিয়ে গেলো, কেষ্টদাসও তার দিকে এগিয়ে যেতে পারলো না, বাইরের চাপে আবার কীর্তনের আসরেই পৌঁছে গেলো।
মহোৎসবের স্বরূপটা রূপুর জানা ছিলো না। তার পড়ার ঘরের ব্যালকনি থেকে দেখা না গেলেও পুরনো মহলের আলসে-দেওয়া ছাদে দাঁড়িয়ে বাগানটা দেখা যায়। কোলাহলের দিকটা আন্দাজ করে সে ছাদে গিয়ে দেখতে পেয়েছিলো এবং মনসা ও সুমিতিকে ডেকে এনেছিলো। সুমিতিও এর আগে এ ব্যাপার কোনোদিন দ্যাখেনি।
মনসা বললো, ভালো কথায় একে মহোৎসব বলার চেষ্টা করতে পারে বটে, এর প্রকৃত নাম কিন্তু মচ্ছোব। লক্ষ্য করে দ্যাখো এখানে এদের অস্পৃশ্যতা বলে কিছু নেই। শ্রীক্ষেত্রে নাকি
সব জাত এক হয়ে যায়; এখানে একটা সাময়িক শ্রীক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
রূপু বললো, দিদি, এদের দেখে মনে হচ্ছে, রোগ-তাপ অভাব-অভিযোগ কারো কিছু নেই।
তাই হচ্ছে। তুই এখন বড়ো হয়েছিস, নিচে গিয়ে দেখে আয়। দাদা থাকলে দেখতিস পরিবেশনে লেগে গেছেন।
রূপু তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো।
মনসা বললো, এ যে দেখছি, জ্যাঠামশাই! ওই দ্যাখো বউদি, যাবে নাকি?
কিন্তু মনসার প্রস্তাবটা শেষ হবার আগেই জনতার জয়নাদে চতুর্দিক কাঁপতে লাগলো।
সুমিতি ভীতকণ্ঠে বললো, কী হলো, মনসা?
মনসা বললো, হুংকার দিচ্ছে।
দুজনে নীরবে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা অনুভব করতে লাগলো।
সুমিতি বললো, মণি, এমন উদ্দাম সংগঠন, সমবায় কাজের এমন প্রয়াস যদি ঠিক পথে চালিত হতো, কত কী না সম্ভব ছিলো এদের পক্ষে!
তুমি কি রাজনীতির কথা বলছো?
রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি যা-ই বলো।
কিন্তু এইবা মন্দ পথ কী? সহসা মনসার কণ্ঠস্বর গম্ভীর হলো। সে বললো, তুমি নিশ্চয়ই আমার চাইতে বেশি জানো, বউদি, এমন একটি কীর্তনমুখর জনতার চাপে পড়ে চাঁদকাজি তার অত্যাচারের পথ ছেড়ে এসেছিলো। আমি কিছু জানি না, মাস্টারমশাইয়ের মুখে শুনেছি সে কালটার গর্ভে নিষিক্ত ছিলো গণসংযোগের বীজ। তারপরও মনসা যা বলে গেলো তার মর্ম উদ্ধার করলে এইরকম শোনায় : বাংলার সংস্কৃতি দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের আবহাওয়ায় পড়ে যুদ্ধ-শিশুদের মতো জাতিগোত্রহীন হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিত্বশালী কেউ যদি শিবের উপাসনা করতে চেয়েছে তার মধুকর গেছে তলিয়ে, লোহার বাসরে কালনাগ প্রবেশ করেছে। বিশ্বজননীর রূপকঙ্কালময়ী। ভালো না বাসো, ভক্তি না করো, ভয়ে মাথা লুটিয়ে রাখো, এই যেন সেকালের দাবি। কিন্তু মানুষ কখনো অন্য কারো মনের খাঁচায় দীর্ঘকাল আবদ্ধ থাকতে পারে না। সমাজমানসের অতি ধীর পরিবর্তন যা অনন্তশয্যায় পার্শ্ব-পরিবর্তনের মতো অদৃশ্য কিন্তু অনিবার্য, তারই লক্ষণ দেখা দিতে লাগলো। নির্ভীক সাধারণ মানুষের ভয়ের মোহ দূর করার জন্য বহু চিন্তাধারার ঘাত-প্রতিঘাতে ও প্রতিযোগিতায় সৃষ্ট একটি প্রতিযোগিতার-অতীত অসাধারণ মানসের প্রয়োজন ছিলো। শ্রীচৈতন্য এলেন।
সুমিতি চুপ করে ছিলো। তার নীরবতায় লজ্জিত হয়ে মনসা থেমে গেলো। তার চোখ দুটি একটা নীরব হাসিতে টলটল করে উঠলো, সে বললো, খুব বকিয়ে নিলে, বউদি।
সুমিতি বললো, কিন্তু সে যুগের অত আয়োজন যদি অন্য পথে যেতে বাঙালির রাজনৈতিক জীবন হয়তোবা মার খেতো না।
মনসা বললো, বউদি, সেযুগে অন্য কিছু একটা ছিলো। দেখতে পাচ্ছো না, যদুরা জালালুদ্দিনের রূপ নিচ্ছে! নিমাই চৈতন্য থেকে গেলো, অন্যদিকে হুসেন শার সৃষ্টি হলো, সেই কি ভালো নয়! এবং এটাই একটা প্রমাণ যেন হুসেন শা কিছুটাবা প্রজা-নির্বাচিত। তোমার কথায় এখন মনে হচ্ছে, হুসেন শা যদি তখনকার বাংলার সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের তাগিদের সঙ্গে পানা-মিলিয়ে চলতো, যেমন হয়েছিলো তা না-হয়ে, হয়তোবা কৃষ্ণের কংসনিসূদন মূর্তি প্রকাশ পেতো।
এরপরে এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে তর্কের মতো শোনাবে মনে করে সুমিতি নীরব হয়ে রইলো, কিন্তু চিন্তা করলো–পাঁচশ বছর আগে জনমানসের আত্মপ্রকাশের যা অবলম্বন ছিলো আজও সেটাকেই অনুরূপভাবে গ্রহণ করা যায় কিনা! এই আজগুবির দেশ ভারতবর্ষে পৃথিবীর সব জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়ে এসে দেবতা রাষ্ট্রশক্তির পরিচালক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। মনসা যেমন প্রবঞ্চিত, সেটা কি তেমন আর একটি প্রবঞ্চনাই মাত্র!
কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মনসার চোখেমুখে তার সদাচঞ্চল প্রাণের ছায়া পড়লো; সে বললো, ভাই বউদি, ওদের তৈরি মালপোয়া খেতে খুব লোভ হচ্ছে যে।
সে কী! এ সময়ে এমন লোভ তো ভালো নয়। কাউকে পাঠিয়ে দেবো?
মনসা যেন প্রস্তাবটার সবদিকে চিন্তা করলো এমন ভান করে সে বললো, না, ভাই। তারা আবার তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ, এসব বাবোমিশেলি বারোয়ারি ব্যাপার পছন্দ করেন না। তার চাইতে রায়ের জঙ্গলে একটা চড়ুইভাতির ব্যবস্থা করো। আর তা যদি তোমার পছন্দ না হয় বিলমহলে চলো।
একটা শর্ত আছে, আমার ননদাইকে যদি আনিয়ে নাও।
সে ভদ্রলোক শিকারী হিসেবে ভালো বটে, কিন্তু বিনা নিমন্ত্রণে শ্বশুরবাড়ি আসতে পারছেন না।
তুমি একজন লোক ঠিক করে দিয়ো, আমন্ত্রণ নিয়ে যাবে। কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার প্রত্যক্ষ করো। এরা করে মহোৎসব, যার প্রাণ হচ্ছে নামকীর্তন, আর তোমাদের বেলায় প্রাণীহত্যা আর জলক্রীড়া।
কী সর্বনাশ! কপট ত্রাসে বললো মনসা, এই পাদরির রোগ হলো তোমার, এ যে বড়ো ছোঁয়াচে।
সুমিতি গাম্ভীর্য রাখতে পারলো না। সে বললো, তোমার চড়ুইভাতির অনুপ্রেরণা যে মালপোর সুপ্ত লোভ, এ জানতে পারলে কি তোমার শাক্ত পুরুষটি রাজী হবেন?
তা ওঁরা হন। সুরা এবং অন্যান্য কী কী ব্যাপারে নাম পালটে দিলে ওঁদের আপত্তি থাকে না।
খানিকটা হাসাহাসির পরে মনসা বিদায় নিলো।
সে চলে গেলে সুমিতি চৈতন্যের সময়ের আরও কিছু খবর নেবার জন্য সদানন্দর কাছে বই চেয়ে পাঠালো। একসময়ে সে চিন্তা করলো, চৈতন্যের পরেও দেখা গেছে, যে আবহাওয়া শিবাজীকে সৃষ্টি করে, সেটাই আবার রামদাস স্বামীকে উদ্বুদ্ধ করে। রাজা রামমোহন কেন মোহনদাস গান্ধি হলেন না, এটা শুধু কালকে বিশ্লেষণ করলেই কি জানা যাবে?
কিন্তু জীবন্ত মানুষের দাবি ঐতিহাসিক প্রাণীদের চাইতে বলশালী। সুমিতি সেইদিনই অন্য আর-এক সময়ে চিন্তা করলো মনসার কথা। সে এই প্রাসাদের বহু আশ্রিতের ভিড়ে হারিয়ে যায়নি, এখন সে শীর্ষস্থানীয়দের একজন, অনসূয়ার কন্যার অধিক। সান্যালমশাইয়ের পুঁথিঘর এবং সদানন্দ মাস্টারের সঞ্চিত জ্ঞান থেকে মনসা নিজের খেয়ালখুশি মতো যা আহরণ করেছে তার পরিমাণ কমনয়। মনসার এই পরিবর্তনে তার মনীষা কতটা সাহায্য করেছে তা ভেবে দেখার মতো।
বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে, তার জীবনের গতি কোথাও আবর্তসংকুল হয়ে ওঠেনি, যদিও তেমনটি ঘটবার যোগ ছিলো। তার নিজের ভাষায় তার জীবনে একসময়ে উত্তাপের সঞ্চার হয়েছিলো।
কী পেলো মনসা এই জীবনে–পাব্ৰিত্য? তার মতো একটি রমণীর হৃদয়ের একটি কোণ একটি সাধারণ পুরুষের পক্ষে নিখিলভুবন। আত্মত্যাগের মহিমা?দূর করো। ঋণাত্মক কিছু নিয়ে যে নিজেকে ধন্য মনে করে তার চোখ দুটিতে অত বিদ্যুজ্জ্বালা থাকে না।
তখন সুমিতির মনেহলো গড় শ্রীখণ্ডর এই পরিবেশ, যাতে পঞ্চদশ শতক ক্ষণকালের জন্যও স্বপ্রতিষ্ঠ হতে পারে যে-কোনো একটি সাধারণ দিনে, এর সঙ্গে মনসার যেন কোথায় একটি ঐক্য আছে।
কিংবা, সুমিতি ভাবলো, গগ্যার তুলনায় কি মনসার নিজের জীবনও বোঝা যায়। সে মেয়েদের শরীর আর মনের বিপ্লবের কথা বলেছিলো বটে।শহর থেকে দূরে বলে যাকে অন্ধকার মনে হয় তেমন এক গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে কি সে সৃষ্টিশীল কিছু করছে গর্গার মতো! তা হলে তো তার জীবনটাকেই একটা কাব্য বলতে হয়, যে কাব্য দুঃখ, সুখ, ভালোবাসা, অপ্রেমের দ্বন্দ্বে সংঘাতে তারই রচনা।