কনকদারোগা দিঘা থানার প্রবল প্রতাপান্বিত বড়ো দারোগা। তার অধীনে আরো দুজন সইস্পেক্টর আছে, জন-চারেক অ্যাসিসট্যান্ট সইস্পেক্টর আছে।
কিন্তু এহেন কনকদারোগা থানায় বসে নিজের উপরে কখনো কখনো । বিরক্ত হয়ে ওঠে।
সসম্মানে সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে তার নাহলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, নাহলো কোনো ব্যবহারিক-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চাকরি। টাকার তাগিদে আসতে হলো দাবোগাগিরির বাঁধা সড়কে। বাঁধানো হলেও দুপাশে ফুটপাতের সীমাসরহদ্দ নেই। সামনের দিকে টাইম-স্কেলে মাইনে এগিয়ে যাচ্ছে, এপাশে-ওপাশে কুড়িয়ে-বাড়িয়েও চলা যায়।
লেখাপড়া হলো না বলে যে-খেদটা হয়, সবদিক দিয়ে ভেবে দেখতে গেলে সেটা থাকে । একসময়ে তার বিবেক পীড়া দিত। এখন কর্তব্যকর্মের সঙ্গে তারও একটা সামঞ্জস্য হয়ে গেছে। তার চাকরির গোড়াতেই সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ বাংলাদেশে একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। আর এই থানায় গান্ধীপন্থীরাও নেই যে তাদের উপরে মাঝেমাঝে হুমকি চালাতে হবে। ৪২-এর অত বড়ো সর্বভারতীয় ঘটনাটায় এ অঞ্চল উৎসুক ছিলো না। দু’একদিনমাত্র। থানার চারদিকে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করতে হয়েছিলো, এক-আধবার কস্টেবলদের ফল ইন করানো মাত্র–তা-ও উপরওয়ালার মতে, প্রয়োজনে নয়। আর একটিবারমাত্র যেতে হয়েছিলো সান্যালমশাই-এর বড়ছেলে গ্রামের কাছাকাছি এসে পড়েছে না কি খোঁজ করতে। ভাগ্য তাকে দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা থেকে রক্ষা করেছিলো। অন্তত ভারতবর্ষ যদি স্বাধীন হয় সে বলতে পারবে সরকারের শাসনযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সে কোনো দেশপ্রেমিকের নির্যাতনের নিমিত্তমাত্রও নয়।
কাজেই বেশ দিন যাচ্ছিলো তার। ছোটোখাটো সাধারণ চুরিচামারির ব্যাপারে তদন্ত করা ছাড়া তার একটিমাত্র কাজ ছিলো মাসে দু-দিন করে সান্দারদের হাজিরা নেওয়া। শেষের কাজটাতে সেরীতিমতো আনন্দ পেত। মাঝে মাঝে অপরাধ-বিজ্ঞান চর্চা করার যেসখটা তার হয় তাতে যেন সান্দারদের অস্তিত্ব সাহায্য করে। স্বভাবদুবৃত্ত এরা সরকার থেকে এমনি ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। পুরুষানুক্রমে এরা দুবৃত্তই থেকে যাবে। কৃষিকর্মে এরা যতই মগ্ন হয়ে থাকুক, ছোরা-গুপ্তি এদের লাঙলের আড়ালে লুকোনো না-ই থাক, এদের মনের মধ্যে নাকি সভ্যতাবিরোধী হিংস্রতা ধিকিধিকি জ্বলছে।
কনকদারোগার দৃষ্টিও কাজে কাজেই সান্দারদের প্রতি সজাগ ছিলো। পাক্ষিক হাজিরার দিন আসবার আগেই সে তোড়জোড় করতে এই নৈমিত্তিক কাজটার জন্য। কে এলো, কে এলো না এদিকে তার কড়া নজর। কেউ না এলে লোক পাঠিয়ে খবর নিতে কোনোদিনই তার আলস্য ছিলো না।
কিন্তু আজকাল হাজিরাটা হয় না। সরকার তার নিয়ম শ্লথ করেছে তানয়। গহরজান সান্দার এখনো মাঝে মাঝে আসে। একবুক শাদা দাড়ি নিয়ে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সান্দার সংখ্যা হাজিরায় কমতে কমতে এখন দু-চারজনে দাঁড়িয়েছে।
এক হাজিরায় এসে ওরা বলেছিলো, বুড়ো আলতাপ খসে গেছে। আর কোনোদিনই সে থানায় আসবে না।
কনক ধমকে উঠে বলেছিলো রসিকতা রাখ; কোথায় গেলো তাই বল।
–জে, মরেছে সে।
–কী করে মরলো? মারপিট দাঙ্গার কথাটা নিজেই প্রায় বলে ফেলেছিলো কনক।
ওরা চলে গেলে খটকা লেগেছিলো কনকের। মৃত ও অসুস্থ ছাড়া কোনো সান্দার তার থানার এলাকায় বাস করে থানায় হাজিরা দেবেনা, এ তার কল্পনারও বাইরে। একসময়ে এই অনুপস্থিতি অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিলো। সে ভেবেছিলো অনুপস্থিতির কারণ হিসাবে অনাহারজনিত দুর্বলতা লিখে রাখবে। কিন্তু সেটা লিখতে গিয়েও কলম সরলো না। খবরের কাগজওয়ালারা দুর্ভিক্ষ বলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে আর সরকার এখনো দুর্ভিক্ষকে মেনে নেয়নি, এ সময়ে যদি সে কাগজে-কলমে এতগুলি অনাহারের কথা লিপিবদ্ধ করে রাখে তবে তো সরকারকেই বিপদে ফেলার সামিল হলো।
সে সময় কনকদারোগা একটা ভুল করে ফেলেছিলো, সে সত্যি তদন্তে বার হয়েছিলো। বুধেডাঙা অবধি ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে সে যদি থামত তাহলৈও হতো। বুধেডাঙা ছাড়িয়ে চিকন্দির সীমানায় পৌঁছে সে ব্যাপারটার মুখোমুখি হয়েছিলো।
–ও বাবা, বাবা, সোনা আমার—
ঘোড়া থামিয়েছিলো কনক, তার কানে গেলো–ঐ সোনার মুখে ভাত দিতে পারলাম না রে, বাবা।
থিয়েটারে দেখা সংহত শোক নয়, সিনেমায় শোনা মার্জিত বেদনার হেঁচকি নয়, অসংস্কৃত বেদনার বিকৃত উচ্চারণ।
কনকদারোগার বুকের গোড়াটা উল্টে উল্টে যেতে লাগলো, অগ্রন্থিগুলো ফুলে ফুলে উঠতে লাগলো। চোখের জল পুরোপুরি চাপতে পারলো না সে। ঘোড়ার মুখ ফিরিয়ে কনক পালিয়ে এসেছিলো। । আজ তার মন ভালো ছিলো। অনেক কারণ তার। দুপুর রোদে স্টেশনে ঘোরাফেরা করা
অনেক দিক দিয়ে সার্থক হয়েছে।কর্তব্যরত অবস্থায় উপরওয়ালার চোখে পড়া তার মধ্যে প্রথম। দ্বিতীয়টি তার চাইতেও বড়ো: সান্যালমশাই-এর ছেলে সত্যি আসেনি তার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলতে। তৃতীয় একটিও আছে, তাকে কারণ বলা যায় না, কিন্তু তাহলেও উল্লেখযোগ্য: শিক্ষিত মার্জিত ভদ্রমহিলার সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করার সৌভাগ্য সব পুরুষের ভাগ্যে রোজ ঘটে না। আর পরম কৌতুকের বিষয়-তার উপরে নির্দেশ এসেছিলো সান্যালমশাই-এর ছেলে নৃপনারায়ণকে চোখে চোখে রাখার, যখন সে লোকটি পুলিসের হেপাজতে, হয়তোবা সেন্ট্রাল জেলেই।
থানার সামনে বড়ো অশ্বত্থ গাছটার পাতাগুলিকে আলোড়িত করে একটা ঝিরঝিরে হাওয়া আসছে। বারান্দার টেবিলটার সম্মুখে বসে অস্ফুট শব্দে শিস দিতে দিতে আঙুলের ডগা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে টেবিলটা ঠুকে কনক উঠে দাঁড়ালো। মুন্সিকে ডেকে বললো, আমি চলোম বিপিন, বাসাতে থাকবো। আজ আর ডাকাডাকি কোরো না।
বাসায় ফিরে স্ত্রী শিপ্রার হাতের খানিকটা সেবা নিয়ে কনক শোবার ঘরের টেবিলের সামনে বসলো। কালো রঙের মাঝারি চেহারার পুরনো ডায়েরিখানা খুলে পাতা উল্টে সেতার গবেষণার প্রচেষ্টা-স্বরূপ লেখাটা বার করে ফেলো। তার মনে হলো স্টেশনে দেখার পর পুরো তার মনের অনেকখানি জুড়ে আছে।
সান্দারদের নিয়ে সে আলোচনা শুরু করেছিলো। উচ্চাভিলাষী কিছু নয়। নিজের জানা কথাগুলির পাশে পাশে নিজের চিন্তাগুলিকে গুছিয়ে রাখা।
সান্দারদের উৎপত্তির ইতিহাসটা কনকের কল্পনাজাত। সেখানে সে লিখে রেখেছে নিজের গন্তব্য। এরা নাকি কোনোকালে বাঙালির নৌ-সৈন্য ছিলো। বাঙালির যেদিন নৌসৈন্য রাখার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো এদের একদল হয়েছিলো জলের ডাকাত আর একদল হলো যাযাবর। কিংবা যখন বাঙালির শানিত ইস্পাতের প্রয়োজন ছিলো তখন এরাই শান্দার ছিলো।
আর যাই হোক, এরা যে যাযাবর সে-বিষয়ে কনক নিঃসন্দেহহয়েছে। নিঃসন্দেহ হতে পারার কারণ বুড়ো আলতাপের সঙ্গে পরিচয়। বুধেডাঙার চরে সান্দারদের সেই নিয়ে আসে। এদিকের সান্দাররা তারই জ্ঞাতিগোত্র।
তারও আগে সান্দাররা দু-তিনটে জেলার ব্যবধানে জাত ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলো। জাত-ব্যবসায়টি যে ঠিক কী তা আন্দাজ করতে হবে। আলতাপের কথা ধরতে গেলে সেটা চুরি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। থানায় দাঁড়িয়ে দারোগার মুখের সামনেও বুড়ো আলতাপ বলতো, ট্রেনে উঠলেই পয়সা। একখান সুটকেস সরাতি পারো পনেরোদিন অ-ভাবনা। বুধেডাঙায় আসবার আগে হয়তো সে-ও ট্রেনে উঠে চুরি করতে যাত্রীদের মালপত্র। অন্তত তাদের ওস্তাদ মেরজান সর্দার করতো। মেরজানের মৃত্যুর ব্যাপারটাই তার প্রমাণ।
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়ির পিছন দিকের জানলা গলিয়ে একটা সুটকেস নিয়ে পালালো মেরজান পুড়াদ’ স্টেশনে। হৈ-হৈ রব উঠলো যাত্রীদের মধ্যে। ইতস্তত করার সময় ছিলো না। পাশে একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো। তখন অন্ধকার নেমে এসেছে, মেরজান চুপ করে একটা মালগাড়ির নিচে গিয়ে বসলো। বসে হয়তো মনে মনে হেসেছিলো সে, কিন্তু হঠাৎ মালগাড়িটাই চলতে আরম্ভ করলো। তখন সেই চলন্ত চাকার ফাঁকে বেরিয়ে আসার জন্যে কত ফিকিরই না সে করেছিলো। প্রাণ নিয়ে যখন টানাটানি তখন মানুষ তার সেরা ওস্তাদি কাজে লাগায়, নাকি সব গুলিয়ে যায় তখন, মাথায় সাধারণ বুদ্ধিও আসে না।
মেরজানের বিবির কাছে খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলো আলতাপ।
–চাচী, আজ তুই ঘরে দুয়ার দে।
–কেন্ রে, সর্দার আসবি নে?
–না, সর্দার, মনে কয়, আজ আসবিনে।
দু-তিন দিনেও যখন মেরজান এলোনা আলতাপ আর গোপন রাখতে পারলোনা। মেরজান বিবি হাহাকার করে উঠেছিলো।
তখন মাথাঘোরা রোগ ছিলো ফুরকুনির, শুধু অনাহারে নয়, সন্তান সম্ভাবনাতেও। একদিন আলতাপকে পথে চলতে দেখে তাকে থামিয়ে ফুরকুনি বললো–আমার কী হবি, কও?
আলতাপ চোখ মেলে দেখলো ফুরকুনিকে।
আলতাপের যাতায়াত এরপরে বেড়ে গিয়েছিলো। আহা, এ সময়ে সাহায্য না পেলে কোনো মেয়েমানুষই বাঁচে না। আর যাই হোক সে মেরজানের বংশধর বহন করছে। একথাও উল্লেখযোগ্য, মেরজান, যার কাছে সান্দারদের যে-কোনো কন্যা সহজলভ্যা ছিলো, তাকে যে বেঁধে রাখে সেই ফুরকুনিবিবি এই।
কিন্তু আলতাপের যে বয়স তাতে তার পক্ষে বিপন্নকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা যত সহজ সেকাজে লেগে থাকা তত নয়। মাঝে-মাঝে ট্রেনে চেপে সে উধাও হয়ে যেতো দীর্ঘদিনের জন্য।
একদিন স্টেশনে বসে জুয়া খেলতে খেলতে রোখ চাপলো মাথায়। রাত যখন মাঝামাঝি তখন আর সকলে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিলো ঘর থেকে। পরাজয়ের বেদনার উপর অপমানের জ্বালা। নিজের গ্রামের পথে ফিরতে ফিরতে তার মনে হলো কার কাছে কত টাকা পায় সে, পায় কিনা কারো কাছে। এরকম গোলমাল মাথায় নিয়ে পথ চলতে চলতে আলতাপের মনে হলো ফুরকুনি তাকে অনেক ঠকিয়েছে। কান্নার সুরে কথা বলে অনেক চাল, অনেক টুকিটাক খরচ আদায় করে নিয়েছে সে। এ কী অন্যায়! তার অভিজ্ঞতা কম বলেই তাকে এরকম ঠকাতে পেরেছে সকলে। চুড়ান্ত আক্রোশের একটা গালিতে চরাচরকে অভিহিত করে সে পণ করলো আজ সে হিংস্রতম প্রতিশোধ নেবে।
কানাকড়ি থাকার দিন ছিলো না ফুরকুনির, তা দিন বারোটাই হোক কিংবা রাত বারোটা কিন্তু নেশার মাথায় আলতাপ স্থির করলো–সব মেয়েরাই, বিশেষ করে সান্দারনীরা চোরাই মালের এটা-ওটা সরিয়ে রাখে। ফুরকুনি মেরজানের সময়ের কিছু কিছু কি আর রাখেনি?
ধাক্কা দিতে ঝাঁপ খুলে গেলো। আলতাপ দেখলো ঘরের একপাশে চটের বিছানায় দু-তিন মাসের শিশুকে পাশে নিয়ে ফুরকুনি ঘুমিয়ে আছে। কুপিটা বোধ হয় নেবাতে ভুলে গেছে, তারইআলো আর ধোঁয়ায় ঘরের ভিতরটা নজরের সামনে নাচছে।
হাত ধরে একটানে ঘুমন্ত লোকটাকে খাড়া করে দিলো আলতাপ। ভালো করে সে চোখ মেলবার আগেই, ভালো করে কিছু বুঝবার আগেই আলতাপ চড় মারলো ফুরকুনির গালের উপরে। চড় খেয়ে ফুরকুনি পড়ে গেলো। ঘুমন্ত গালে পুরুষালি চড়!
–কই দে, কী আছে তোর ট্যাকা পয়সা।
–কনে পাবো? সোনা আমার, মারিস নে আর, তুই খাবের দিছিলি তাই বোঁচে আছি।
মাথায় খুন চাপলে কোনো কথাই কানে ওঠে না মানুষের। ফুরকুনি আরো মার খেলো কিন্তু কিছুতেই যেন আক্রোশ যাবার নয়, গায়ের চামড়া খুলে নিলেও রাগ যেন যায় না। পরিধেয় তার সামান্য পরিবর্ত।
মুশকিল হলো হঠাৎ। রাগের মাথায় সান্দারনীকে সে বিবস্ত্র করে ফেলেছে। রাত্রির ম্লান আলোয় নিরাবরণ নারীদেহ আলতাপের চোখের সম্মুখে। সহসা আলতাপের মন সীমাহীন করুণায় ভরে গেলো। জানু পেতে সে দেহটার পাশে বসে পড়লো।
রাত যখন ভোর হয় আলতাপ ঘুমের মধ্যে শীত শীত বোধ করে সরে এলো; ফুরকুনি জেগে ছিলো; নিজের আঁচলের খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে আলতাপকে ঢাকতে পারলো না যখন নিজেই একটু এগিয়ে গিয়েছিলো আলতাপের দিকে।
আলতাপই তার সমাজের ঐতিহাসিক। ইতিহাস তার কণ্ঠস্থ নয় শুধু, তার প্রকাশভঙ্গিও অনন্য। সন-তারিখে কিছু গোলমাল হয়ে যায় বটে, কিন্তু তাতে যেন ইতিহাসের প্রাচীনত্ব গভীর হয় ওঠে।
বেলাতের যখন বছর পনেরো বয়স, রজব আলি উড়ুউড়ু করছে, তখন ফুরকুনির মৃত্যু হলো। সে এক হাঙ্গামা। পুলিস আলতাপকে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলোগোমুখখু পুলিস! কনক দারোগার সম্মুখেই থুথু ফেলে মুখ বিকৃত করে বলেছিলো আলতাপ। অথচ কত না ভালোবাসা ছিলো দুজনের, এক-আধ দিনের চোখ-ঠারার ব্যাপার নয়, দুটি সন্তানের দুপাশে বসে দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে তাদের মানুষ করে তোলার সাহচর্য। অথচ পুলিসের দারোগা-উকিল বলেছিলো: ফুরকুনির বয়স হয়েছিলো, চুলে পাক ধরেছিলো, আর এদিকে আলতাপের জোয়ান বয়স। আরো লক্ষণীয়, এতদিন পরেও ধর্মের গ্রন্থি পড়েনি এদের জীবনে, এরা এখনো বিবাহিত নয়।
কনক নিজেই প্রশ্নটা করেছিলো–তোমাদের বিয়েসাদিটা কবে হলো।
আলতাপ প্রত্যুত্তরে যা বলেছিলো তার সারমর্ম এই : অসুখ করলে নিজের সন্তানের মতো বুক করে রাখতে পারে আর কোন সান্দারনী ফুরকুনি ছাড়া? আর এটা এত সত্য যে আলতাপ পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন বোধ করেনি। ফুরকুনির মৃত্যুর পর এই দীর্ঘ সময় পৃথিবীর অন্য সব সান্দারনী থেকে সে মুখ ফিরিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। মেরজান-গরবিনী ফুরকুনিকে যে পায় সে কি তাকায় তোমার ফেলানি আর কুড়ানির দিকে।
এই ফুরকুনির তাগিদেই সান্দাররা বুধেডাঙায় এসেছিলো। বোধ করি মেরজানকে হারিয়ে সান্দারদের দুঃসাহসিকতার বৃত্তিকে তার ভয় হয়েছিলো। আলতাপকে পেয়ে তার হারানোর ইচ্ছা ছিলো না। পদ্মার চর তখনো খানিকটা সিকস্তি। বুধবারের দিন গোরুভেড়াগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ে আলতাপের যাযাবর দল এসে দাঁড়িয়েছিলো চরটার উপরে। দুপুরে আহারের পর আলতাপ-ঘরনী ফুরকুনি নিজের বিড়ি থেকে আলতাপের বিড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বলছিলো–আলতাপ!
-ফরমাইয়ে।
–এখানে থাকলি কেমন হয়?
–যেখানে থাকি তোমার কাছেই থাকবো।
–তা লয়, এখানে চাষবাস করে ঘর-দরজা করে ছাওয়াল দু’ডে নিয়ে বসলি হয় না?
–চাষবাসের কাম আমি কী জানি?
সত্যি আলতাপ লাঙল ধরা কোনোদিনই শিখতে পারেনি। শুধু তাই নয়, লাঙল ধরা কাজটাকে সে ঘৃণা করে। সান্দারদের মধ্যে গহরজান কৃষিতে অত্যন্ত সাফল্য লাভ করেছে। মাটির কাজে হাত দিয়ে সান্দাররা মাটি হলো, আলতাপের এ প্রকল্প সে মানতে চায় না। আগেকার দিন হলে আলতাপ সর্দার কী করতে বলা যায় না, এখন সে তার চিরাচরিত প্রথায় থুথু করে ওঠে।
ফুরকুনি তাকে দুটি সন্তান দিয়েছিলো : মেরজানের ছেলে রজব আলি আর তার নিজের ছেলে বেলাত হোসেন। ভাবতে গিয়ে তার অবাক লেগে যায়।রজব আলিকে সে খানিকটা শ্রদ্ধার চোখে দেখে–সে মেরজান সর্দারের ছেলে। লোককে সে বলে–হবি নে কে, সদ্দারের ছাওয়াল, দিল-দেমাক উঁচুই হবি। বেলাত হোসেনের কথায় ফুরকুনি বলেছিলো–এটা তোমার নিজের, তা-ও আদর যত্ন করো না।
কিন্তু পিতার স্নেহ কম পেলেও পিতার প্রবৃত্তিগুলো পেয়েছিলো বেলাত হোসেন। তার নাকি আলতাপের মতো গায়ের রং ছিলো, তেমনি নাকচোখ।শহরের রাস্তায় রাস্তায় ছাতি সারানোর ব্যবসা করে বেড়াতো সে কিন্তু কখনো কখনো এমন সব জিনিস নিয়ে ফিরে আসতো যা নাকি ছাতি-সারানোর মজুরি দিয়ে কেনা যায় না।
অন্য অনেকের জীবনের মতো আলতাপের জীবনে এটাই দুঃখবীজ যে তার আদর্শ ও অন্তরে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়েছিলো। রজব আলিকে সে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। অথচ রজব আলি জমিজমা নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। বেলাত হোসেন তার যাযাবরত্বের আদর্শ মেনে নিয়েছে, কিন্তু সর্দার হবার মতো উদারতা তার নেই। পুলিসের সঙ্গে তার সদ্ভাব।
অনেক জেরার উত্তরে আলতাপ একদিন বলেছিলো–কোনো সান্দার কোনোদিন নিজের সদ্দার ছাড়া আর কাকে সেলাম দিছে? কন দারোগাসাহেব। আর এ কী হলো? জমিদার, তা আমলা, তার পাইক, তার সমনজারি!
কনক বুঝতে পেরেছিলো কৃষক-জীবনে আলতাপের আপত্তিটা কোথায়।
দুর্ভিক্ষের আগে রজবআলির বাড়ির সমুখে একটা মাচায় বসে থাকতো আলতাপ আর বিড়বিড় করতো। ঠাহর করে শুনলে বোঝা যেতো সে বলছে : এতটুকু নতুনত্ব নেই জমিতে যেনতুন কিছু আশা করবে। ঐ তো গহরজান বিশ পটি ধান তুলেছে গোলায়। দুই দু-খান গোরুর গাড়ি তার, পাঁচজোড়া লাঙল বিধে। কালো কোট পরে থানায় হাজিরা দেয় সে, লাল মোল্লাকি টুপি, তফনের চেকনাই চমকে ওঠে বোদ-ভরা মাঠ পার হতে গেলে। সাদি করেছে এ-সনেও একটা। আহাম্মুখ বোঝে না ষাট বছরে ওসব ঘরে আনা শুধু নিজের খাঁচায় পরের জন্য পাখি পোষা। কিন্তু তা যতই করো, দাঁড়াতে হয় না তোমাকে সান্যালদের পেয়াদার সামনে ভেড়া-ভেড়া মুখ করে?
থুথু ফেলে চারপাশ অগম্য করে তুলতে আলতাপ। এর কিছুদিন পরে সে বলতে আরম্ভ করেছিলো–অন্য কোথাও চলো, অন্য কোথাও চলো। এমন ধানও হয়নি কোনো সালে, এমন না-খেয়ে থাকাও আর কোনোদিন হবি নে।
লোকে ভাবতো ওটা বুড়োদের ধরতাই বুলি। প্রতিবারেই তারা বলে এবারের মতো কোনো ঋতু এত প্রবল হয়ে কখনো আসেনি।
কিন্তু আলতাপের শেষ কথা চূড়ান্ত হয়ে সত্য হলো।
কনকদারোগা কলম খুলে নিয়ে কিছু-একটা লিখবার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। সে লিখলো : সারা গায়ে মাটি মেখে ধূলিধুকড়ি হয়ে অকরুণ আকাশের দিকে ধানের বৃষ্টির জন্য চেয়ে থাকবে, সে-জাত এদের নয়। কোনো-একটা মেয়ের প্ররোচনায় এরা মাটিতে হাত দিয়েছিলো, এদের শ্রমে বুধেডাঙা শস্যময়ী হয়ে উঠেছিলো। আজ সুরোকে দেখে এলাম। আলতাপ সান্দারের পৌত্রী, বেলাত হোসেনের কন্যা। চোরাই ব্যবসায়ে লিপ্ত আছে। যাযাবর হয়ে গেলো। মাটির বন্ধনে পড়ে সামাজিক প্রাণী হবার যে-সুযোগ এসেছিলো সেটা চলে গেছে।
কনকের স্ত্রী শিপ্রা ঘরে ঢুকলো। সদ্যস্নাতা একটি সামাজিক প্রাণী।
শিপ্রা বললে–গবেষণা?
সময় কাটাচ্ছি।
শিপ্রা ঝিলিক তুলে বললো–কেউ যদি বলে তোমাদের সকলেরই ঐটি আসল ব্যাপার, ঐ সময় কাটানো? ওদের বাঁচা-মরা তোমাদের নির্লিপ্ত সময় ক্ষেপণের সুযোগ দিয়েছে। এই তোমাদের পলিটিক্স।
তা যদি বলো। কনক খাতা মুড়ে রাখলো–বললে, আলতাপ ফুরকুনির হাসি পাবার লোভে বুধেডাঙায় ঘর বেঁধেছিলো শিপ্রা। আমায় কী করতে হবে বলো।