অন্দরের আঙিনায় সকালের পায়চারি ও আলাপচারিতা শেষ করে সান্যালমশাই কাছারিবাড়িতে এসে বসেছেন। আমলারা আসেনি, কাছারিবাড়ির বুড়ো চাকরটি সান্যালমশাইয়ের ফুর্সির জল বদলে অন্যান্য হুঁকোগুলোর দিকে মন দিয়েছে।
সান্যালমশাই বসতেই সে নিবেদনের ভঙ্গিতে বললো, তামাক দি, কর্তা?
তামাক? না, থাক।
সান্যালমশাই তামাকটা খুব বেশি খান। অনেকের চোখে তিনি ও তার তামাক অবিচ্ছেদ্য। ভৃত্যটি হুঁকোয় জল বদলাতে বদলাতে তার মুখের ভাবটি পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। অসুখ বিসুখ করলে কিংবা খুব ক্রুদ্ধ হলে তামাকে তার মন থাকে না। এটা এদের সকলেরই জানা। কিন্তু এ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করা কাছারিবাড়ির প্রথা নয়। অন্দরের কোনো ভৃত্য হলে হয়তো সাহস করে প্রশ্ন করতে পারতো।
ভৃত্য চলে গেলে সান্যালমশাই ভাবলেন, দ্যাখো অভ্যাসটা কী! তামাকের নাম শুনে তিনি প্রায় হাত বাড়িয়েছিলেন। অথচ কাল রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে তিনি চিন্তা করে স্থির করেছেন তামাক খাওয়া কমিয়ে দেবেন। স্বাস্থ্য? না। সংযম? দূর করো। এ বয়সে সংযম-অসংযমের প্রশ্ন আর ওঠে না। পঞ্চাশ পার হলো। শুধুমাত্র স্নায়ুগুলিকে আর-একটু থিতিয়ে দেওয়া, যাতে সেগুলি সহজেই উত্তেজিত না হয়ে পড়ে। আর এ কথাগুলি চিন্তা করতে গিয়ে তিনি তার আর এক সহগামীকে আবিষ্কার করেছেন এক মুহূর্তের জন্য যে কতগুলি অভ্যাসলব্ধ মুদ্রাদোষের সমুষ্টি, কতগুলি বাঁধিবুলির রেকর্ড। এবং এই সহগামীর নাম খুঁজে না পেয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘পশ্চাতের আমি’ কথাটাই তার সম্বন্ধে প্রয়োগ করেছে। তখন সেই ‘পশ্চাতের আমি’র হাত থেকে আহোদ্ধার করার ইচ্ছাও তাঁর হয়েছিলো।
মামলাটা শেষ হবার আগে থেকেই এ সন্দেহটা হচ্ছিলো তাঁর, এটা না করলেও চলতো। কিন্তু সেটা যত সময় নিচ্ছিলো ততই স্নায়ু উত্তেজিত হচ্ছিলো আর ততই জেদের ফন্দি ফিকিরগুলো আসছিলো মাথায়।
যাক, হবার যা হয়ে গেছে।
কাল, রাত্রি তখন বারোটা, আইন-সেরেস্তার আমলা ব্রজকান্ত এসে খবর দিলো, মিটেছে। খবর দেওয়ার কথা ছিলো, সেজন্য সে নিজের বাড়িতে না গিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে অত রাত্রিতে খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলো।
দোতলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে সান্যালমশাই নীরবে খবরটা উপভোগ করলেন, তারপর বললেন–তুমি তাহলে এবার বিশ্রাম নাও, দারোয়ানদের কাউকে বরং নিয়ে যাও, এগিয়ে দেবে।
সে চলে গেলে তামাক নিয়ে বসেছিলেন তিনি, ভেবেছিলেন, আর নয়। মিহিরকে ডেকে একবার বলবেন ব্যাপারটাকে বরং তুমি ভবিতব্য বলে মেনে নিও। তাহলে আর জ্বালা থাকবে না।
দিনের আলোয় এখন তিনি অনুভব করছেন, রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে এটা সম্ভব বলে বোধ হলেও, এ কথাগুলির দৈনন্দিন অর্থ সান্ত্বনাপ্রদ নয়। বরং মিহিরের মনে হতে পারে, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়াই তার উদ্দেশ্য। সময় তার কাজ করুক।
কিন্তু মোকদ্দমার সংবাদ প্রত্যুষেই ছড়িয়ে পড়েছিলো। রামচন্দ্র এলো, সঙ্গে আট-দশজন লোক।
রামচন্দ্রের হাতে একটা লাঠি, মাথায় গামছা বাঁধা। সে এসেই লাঠিসমেত সান্যালমশাইয়ের পায়ের কাছে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলো। লাঠিটা রইলো তার পায়ের তলায়।
সান্যালমশাই বললেন–সকালেই খবর পেয়েছো বুঝি? কিন্তু একটা কথা তোমাদের বলে রাখি, এ নিয়ে কোনো হৈচৈ আমোদ-আহ্লাদের ব্যবস্থা কোরো না।
আজ্ঞা না কর্তা, তা হবে না।
তিনি বললেন, তোমাদের জেদ বজায় রইলো, কিন্তু আর টানাটানি কোরো না। এখন বরং মিহিরের কাছে যাও। আমি একটু কাজ করি।
রামচন্দ্র উঠবার ভঙ্গি করলো। বারান্দা থেকে সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপরে সঙ্গের লোকগুলোকে বললো, রাজার কাছে কথা, তোমরাই বলো না কেন কী কথা আছে তোমাদের।
আর কেউ কথা বললো না, রামচন্দ্রকেই বলতে হলো।
আজ্ঞা, মামলার সাথে সামিল।
সান্যালমশাই একটু উত্তেজিত স্বরে বললেন–না-না। আর বোলো না।
মামলাটার সূত্রপাত করেছিলো রামচন্দ্ররাই এমনি করে সাধারণ কথাবার্তা থেকে।
মিহিরও সান্যালবংশের ছেলে। শৈশবে তার পিতার মৃত্যু হয়। তার মা অনেক কষ্টে ও গ্রামের চোখে সান্যালদের মর্যাদাবোধ ক্ষুণ্ণ হয় এমন অনেক কাজ করে তবে মানুষ করতে পেরেছিলো তাকে। এখন সে নিজের ভার নিজে নিয়েছে, কিছু কিছু সম্পত্তি বাড়িয়েছেও। উদ্যমশীল সে। কোনোনা-কোনো পরিকল্পনায় সে সবসময়েই লেগে আছে। ইতিমধ্যে সে নিজের বাড়ির চারিদিকে পড়ে যাওয়া প্রাচীরের জায়গায় নতুন প্রাচীর তুলেছে।
কিন্তু মিহির নির্দয়।
তার বাড়ির প্রাচীরের নিচে দিয়ে পশ্চিমমুখী একটা রাস্তা ছিলো। সরকারি রাস্তা নয়। তবু বহুদিন থেকে সাধারণের ব্যবহার্য বেশ চওড়া একটা পথ। চিকন্দি ও সানিকদিয়ারের সংযোগকারী সরকারি সড়কের বড়ো বৃত্তাংশটির দুই প্রান্ত যুক্ত করতে। সান্যালদের জমির উপর দিয়ে রাস্তা। মিহির একদিন বাঁশ আর কুলকাটা দিয়ে রাস্তার অনেকটা নিজের জমির সামিল করে ঘিরে নিলো।
রামচন্দ্ররা এসে এরই প্রতিবিধান চেয়ে নালিশ করেছিলো।
সান্যালমশাই একদিন মিহিরকে বলেছিলেন–পথটা বন্ধ করে দিলে? লোকের অসুবিধা হবে।
–জমিটা তো লোকের নয়, আমার।
তিনি হেসে বলেছিলেন–সব জমিই তো কারো না কারো। সব পথই তো কোনোনা-কোনো সান্যালের জমির উপর দিয়ে।
মিহির অগত্যা বলেছিলোলোক চলে কোথায় ও-পথ দিয়ে?
কিন্তু পথ সে খুলে দেবে না এটা বোঝা গিয়েছিলো তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে।
এই দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই মামলা লাগলো। সান্যালমশাই থমথমে মুখ নিয়ে কাছারির দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন–নায়েবমশাই, মিহিরের বাড়ির নিচের রাস্তাটা আমার চাই। পুরনো কাগজ ঘেঁটে দ্যাখো একবার।
পুরনো কাগজ ঘাঁটা চললো। সারা গ্রামের কোথায় কতটুকু কোন সান্যালের, এর মোটামুটি হিসাব যত সহজ, সূক্ষ্ম হিসাব তত কঠিন। মোটা হিসাব নিয়ে রোজকার কাজ চলে,টাকা আদায় হয়, লাট দেওয়া চলে। সূক্ষ্ম হিসাব মামলা করে পেতে হয়, মামলা করে রাখতে হয়। সূক্ষ্ম হিসাবের মোট কথা এই সব জমির হিসাব জট পাকিয়ে সব সান্যালের বলে বোধ হয়। পরচা, দানপত্র, কটকোবলায় দুরূহ দর্শনের পাণ্ডুলিপি।
মামলা মানে টাকা নিয়ে খেলা। নিচের কোর্টেই কাগজপত্রের সীমাহীন ফর্দ নিয়ে যখন দাঁড়ালো সান্যালমশাইয়ের নায়েব, তখন মিহির হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। টাকার অভাবে ঠিক নয়, টাকা আঁকড়ে থাকার সহজ প্রবৃত্তিতেই বরং। সহজ বুদ্ধির অঙ্কে সে হিসাব করে দেখলো মামলার শেষ পরিণতি হাইকোর্ট। একতরফা ডিক্রি পেলেন সান্যালমশাই।
মামলাটা তার ভালো লাগেনি। জমিদারিবৃত্তিটাই মামলাসংকুল। মামলার ভয় না থাকলে এক পয়সা খাজনা আদায় হয় না। কিন্তু সেসব মামলার প্রবক্তা নায়েবমশাই, সেগুলিতে এমন করে রক্ত গরম হয়ে ওঠে না, এমন করে পুড়ে পুড়ে ক্ষয় হয় না স্নায়ু। শুধু সম্মান রাখার এই মামলায় মিহিরকে নত করাই সার্থকতা। এ-সব আর ভালো লাগে না। যেন অন্য কেউ তাঁকে নিয়োগ করেছিলো এ ব্যাপারে।
সান্যালমশাই বললেন আবার–মিহিরের কাছেই বরং যাও একবার। সে-ই খুলে দেবে পথ।
তা নয়, আজ্ঞা। মিহিরবাবু সকাল থেকেই পথ খুলে দেওয়ার জন্য লোক লাগিয়েছেন।
তবে আর কী থাকতে পারে?
রামচন্দ্র সঙ্গীদের নির্দেশ করে বললো–কর্তা, এরা যে মরে। মরার বাড়া গাল নাই। তাই হইছে এদের। মিহিরবাবু এদের ভিটাছাড়া করবেন।
ব্যাপারটা এই : মিহিরের বাড়ির অনতিদূরে শাঁখারিদের পাড়া। একসময়ে খুব বাড়বাড়ন্ত ছিলো এ পাড়ার। এমনকী দালানকোঠা তোলার মতো সচ্ছলতাও হয়েছিলো ওদের কারো কারো। এখন যারা আছে তারা শাঁখা তৈরি করা ভুলে গেছে। যারা পেরেছে শহরে পালিয়েছে, যারা পালায়নি তাদের একাংশ উঞ্ছবৃত্তি অবলম্বন করে ধুকছে, অবশিষ্ট চাষী হচ্ছে। পাড়াটার সবটাই মিহিরকে খাজনা দেয়। যেসব ভিটায় অধিবাসী নেই সেগুলি সে বাকি খাজনার দায়ে খাস করে নিচ্ছে। খাস করে নেওয়াটার ভালোও আছে। জঙ্গলের বদলে সেগুলি মিলিয়ে মিলিয়ে মিহিরের বাগান হয়েছে। স্বাস্থ্যের পক্ষে এ-পরিবর্তনটা বোধ হয় ভালো। কিন্তু খাস করতে শুরু করে সে থামতে পারছে না, বাকি খাজনার দায়ে অনবরত এর-ওর নামে ডিক্রি আনছে। শাঁখারিদের মাতব্বরস্থানীয় হরিশচন্দ্র একদিন মিহিরের স্নেহ পেয়েছে। কিন্তু এই মামলাটায় সান্যালমশাই-এর নায়েবের চক্রান্তে মিহিরের বিপক্ষে সে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে। তাই মিহিরের লোক গেছে সদরে তার নামে মামলা করতে আজকেই রাত থাকতে উঠে।
কথাটা শুনে ভাবলেন সান্যালমশাই।
কিন্তু নীরবতায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার লোক নয় রামচন্দ্র। একটু পরে সান্যালমশাই বললেন–এতে আমার আর কী করার আছে রামচন্দ্র, তোমরা যা বোঝে করো গে।
রামচন্দ্র তার গোঁফটিকে সূক্ষ্ম দু-ভাগে ভাগ করে নিলো। তারপরে বললো–রাজা যদি প্রজাকে রক্ষা না করেন, সে তো অরাজক, আজ্ঞা!
জুতসই কথা বলার সুখে রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে লাগলো। সান্যালমশাই-এর বলতে ইচ্ছা হলো–আদালতে যাও তবে, রাজ্য চালানোর ভার আমার উপরে নেই। কিন্তু থামলেন তিনি। রামচন্দ্রর অবক্তব্য কিছু নেই। আদালতের কথায় হয়তো সে বলে বসবে–এই আদালত, ফিস দিব, আজ্ঞা করেন। লোকটি হামেশা আসে না কাছারিতে। খাজনা বাকি ফেলার দলে নয় সে যে তলব তাগাদায় হাজিরা দেবে।বরং তার উল্টো। খাজনা দেওয়ার সময় এমন ভাব দেখায়, যেন আরো বেশি খাজনা দিতে পারলেই সুখী হবে। তার কথাবার্তায় চালচলনে একটা নাটকীয়তা আছে। তার সরলতাকে কৃত্রিম বলে বোধ হয়।
রামচন্দ্র বললো, কর্তা, এ গাঁ গড়-চিকন্দি। রায়রা জমিদারি করেছে, সান্যালরাও। কিন্তুক কোনোদিন কোনো সান্যালকর্তা অত্যাচার করে নাই প্রজার উপর। লোকে কয়, কাছারি তো সান্যাল-কাছারি, যাও, বিচার পাবাই। দোষ করো, পায়ের কাছে লাঠি রাখে দণ্ডবৎ হও, সাতখুন মাপ। কর্তা, সেই সান্যালের দুয়ারে আসছি আমরা।
মামলাটার বিষয় নিয়ে যখন রামচন্দ্র এসেছিলো, সে দীর্ঘতর প্রশস্তি দিয়ে তার আবেদন শুরু করেছিলো। সেদিন সান্যালমশাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, এমনকী উভয় বংশের পুরনো কথা ভাবতে একসময়ে তার মনে পড়েছিলো সেকালের অত্যাচারী পুরুষদের কথা। তখন তার মনে হয়েছিলো, সেকালের সেই মহাবাহু বীর্যবান পুরুষদের যেন অত্যাচার-প্রবৃত্তি মানাতো, যেমন কোনো মহৎ শিল্পীর সুরাপান। তখনি তার মনে হয়েছিলো, মিহির তো সে সব পুরুষের মতো নয়, ডান হাতে তরোয়াল ধরে রাজার অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এমন সামন্ত নয় সে। সান্যালমশাই স্থির করেছিলেন পারুষ্য মিহিরকে মানায় না।
কিন্তু তখন ছিলো মনের অভিমান মত্ত অবস্থা। বাস্তবের আলোয় বিষয়টিকে হাস্যকর বোধ হয়। হাসিমুখে সান্যালমশাই ভাবলেন, কাকে মানায় না বা মানায়–এ প্রশ্নই নয়।কলকাতা থেকে দূরে থাকার ফলে কিছুদিন আগেও মধ্যযুগীয় সে সব প্রথার কিছু কিছু এ অঞ্চলে বেঁচে ছিলো, ক্রমশ সে সবও গত হচ্ছে। এখন অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভগবানের কাছে নালিশ হয় না, হয় আদালতে।
আর তাছাড়া এ ব্যাপারে অত্যাচারটা কোথায়? সান্যালমশাই ভাবলেন, সেকালে জমিদাররা অত্যাচার করতো, ভালোবাসতো। এখন দুটির কোনোটিই নয়। বাইরের শাসনের চাপে দুই-ই এক হয়ে গেছে প্রজা ও জমিদার। উপরে যে সরকার সে কি ভালোবেসে লাটটা কম করে নেয় কেউ অশক্ত হলে? আগাগোড়া হক বুঝে নেওয়ার ব্যাপার। যদি খাসমহলের প্রজা। হতো হরিশচন্দ্র, আদালতি পরোয়ানা ফিরতো যুক্তহস্তের মিনতিতে? কালেক্টর দয়া করতে না।
সান্যালমশাই বললেন–শোনো রামচন্দ্র, আজকাল তো প্রজারা আকচার নালিশ করছে জমিদারের নামে আদালতে। প্রয়োজন হলে তোমরাও তাই করো। খাজনা আদায় করা আমার কাছে অন্যায় নয়।
এদিকে রামচন্দ্রও দমবার নয়, সে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো, আজ্ঞা ন্যায়ের উপরেও ন্যায় আছে। আমরা অন্যায় করে স্বীকার কবুল করতেছি। আদালতে তাতে মাপ নাই, কিন্তুক বাপ। আর ভগোমান মাপ করে, আজ্ঞা।
রামচন্দ্রের বসার ভঙ্গিতে এটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে উঠলো কিছু একটা প্রতিকারের আশ্বাস–নিয়ে সে উঠবে না। কথায় কথাই বেড়ে যাবে। সান্যালমশাই বললেন–আচ্ছা তোমরা এখন যাও। আমি মিহিরের কাছে সব ব্যাপারটা আগে জেনে নিই।
রামচন্দ্ররা চলে গেলেনায়েব এলো সুমার বই নিয়ে। এটা প্রাত্যহিক কর্ম। গতদিনের সুমারের অঙ্কগুলিতে একবার চোখ বুলিয়ে তলায় একটা সই করে দেন সান্যালমশাই।
নায়েবের কাছ থেকে সুমার বই নিয়ে সান্যালমশাই বললেন–আবার কী গোলমাল লাগালো এরা, একবার দেখো তো। খাজনা দেবে না অথচ মিহিরকে অনুরোধ করতে হবে যাতে উচ্ছেদ না করে। মিহিরই বা শুনবে কেন?
আজ্ঞে, ধানটা উঠলে ওরা খাজনা শোধ করে দেবে হয়তো।
বলেছিলো নাকি? ধান উঠবার কত দেরি?
আর দু’একটা মাস যো-সো করে চালাতে পারলে আউস
তবে তোমার মহালগুলোতেও এখন বাকি খাজনার চাপ পড়বে না বলো?
আজ্ঞে। মাথা চুলকালো নায়েব।
তবে?
লোকের বসতবাটি কিনা। চাষের জমিগুলো গেলে তবু সহ্য হয়, বাসের কুঁড়ে গেলে বুকে বড়ো লাগে।
সুমার বই সই হয়ে গিয়েছিলো, নায়েব আর দাঁড়ালো না। নায়েবমশাই তার মামার কাছে উত্তরাধিকার সূত্রে চাকরিটা পেয়েছিলো, তেমনি পেয়েছিলো দুটি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। তার প্রথমটা হচ্ছে : এ বংশের নায়েবি করে সম্মান ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, মনিবের পরিবারের প্রায় একজন হয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু বাজে টাকার লোভ রাখতে নেই। একদিন হয়তো সুমার বইয়ের অঙ্কের নিচে কলম বাধিয়ে তাকান এঁরা, ভয়ংকর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে : জিজ্ঞাসিত না-হলে কোনো প্রস্তাব করতে নেই।
কিন্তু আজ সান্যালমশাই নিজেই ডাকলেন নায়েবকে।
তামাক দিতে বলবো, হুজুর।
আচ্ছা, তা দিতে বলল।
তামাক এলো। আজ সকালে এই প্রথম তামাক। খানিকটা সময় সেটা নিয়ে ব্যস্ত রইলেন সান্যালমশাই, তারপরে বললেন–ধান ওরা বুনেছে, কিন্তু চৈতন্য সাহার হাত এড়িয়ে তা ঘরে তুলতে পারবে?
কিছু হয়তো পারবে।
সে-কিছুটা কতটুকু? তাতে খাজনা শোধ হয়?
আজ্ঞে! নায়েব থতমত খায়।
বাসের কুঁড়ের কথা বলছিলে। বুধেডাঙায় তুমি কী করছো? সেখানেও তো সান্দারদের বাসের কুঁড়ে।
এমন জেরায় পড়তে হবে জানলে নায়েব ওদের হয়ে কথা বলতো না। সে বিব্রতমুখে উত্তরের জন্য কাছারির দরজা আঙিনা ইত্যাদি অন্বেষণ করতে লাগলো।
আজ্ঞে, তাহলে কিন্তু আমরা সান্দাররা ফিরলে জমি ফিরিয়ে দেবো। আমরা না ধরলে চৈতন্য সা সব বেদখল করে নিতো।
ধোঁয়া ছেড়ে সান্যালমশাই হেসে বললেন–মামলাটার ঝোঁক তোমার এখনো কাটেনি। মিহিরের সঙ্গে আমার মামলা মিটে গেছে তুমি ভুলে গিয়েছিলে। আসলে মিহিরকে কিছু বলার কোনো যুক্তিই আমার নেই।
নায়েবের বলতে ইচ্ছা হলো-হরিশচন্দ্র মিহিরবাবুর বিপক্ষে সাক্ষ্য দেওয়াতেই এই বিপদ তার।
সান্যালমশাই বললেন–মিহিরের কাছে একবার যেও, অনুরোধ কোরো, যদি একমাস সে মাপ করতে পারে।
নায়েব চলে গেলো।
সান্যালমশাই-এর মনে হলো, মিহির তার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠবে এমন সম্ভাবনা দেখেই কি তিনি তাকে বিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন? তার সেই দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে যে-স্বাতন্ত্র ছিলো সেটা কি তার মনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছায়াপাত করেছিলো? নিজের মনের স্বরূপ দেখে যেন তিনি বিস্মিত ও লজ্জিত হলেন। এরকম কেন হয়? পরে যা খারাপ বলে বুঝতে পারেন আগেই কেন তা অনুমান করতে পারেন না। এই অনুশোচনা হলো তার।
কাছারির সম্মুখে বিদেশী লাইম গাছটার পুরনো ডালে কালকের ঘুঘু জোড়া এসে বসেছে। বোধ হয় বাসা বাঁধবে। একটু পরেই দ্বিপ্রহরে স্তব্ধ বিশ্রামের নিকেতন হবে। তখন চঞ্চুচুম্বনের অবসরে ওরা দীর্ঘ টানা সুরে এক-এক বার ডেকে উঠবে।
ওদের কি মন আছে? চিন্তা করার মতো, স্মৃতি থেকে বিচারে পৌঁছবার মতো মন ওদের হয়তো নেই। সামান্যতম মস্তিষ্কও যখন আছে তখন স্মৃতি না-থাকার কী যুক্তি আছে বলো।
লাইম গাছটার পাতা নড়ে উঠতেই গাছটার গোড়ার কাছে রোদের সীমা এসে পৌঁছলো। বেলা তাহলে অনেকই হলো।
কাছারির সদর দরজার বাঁ-দিকে দুটি কাঠের খুঁটিতে একটি কাঠ আড় করে শোয়ানো, সেই শোয়ানো কাঠ থেকে ঝুলেছে পেতলের ঘড়ি। কিছুদিন আগেকার ব্যাপার, সান্যালমশাই দিনের বেলায় ঘড়ি পেটা বারণ করে দিয়েছেন। নতুবা সান্যালগিন্নি অনসূয়ার কাজের হাত থামতে চায় না। দুপুরের বিশ্রাম কুঁড়ে তিনি বলে বসেন–যাই, সময় হলো। আজ আবার ছানাটাও ওরা ভালো করে কাটতে পারেনি। পেটা ঘড়ি বন্ধ হওয়াতে প্রথম যেদিন সান্যালগিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, সেই দুপুরের কথাটা মনে হওয়াতে কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সান্যালের দৃষ্টি। মামলার কয়েকটি দিন এসব তেমন নজরে পড়েনি। কী অন্যায়!
স্নানের সময় হয়েছে। এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে চাকরকে দেখতে না পেয়ে সান্যালমশাই ডাকে-আসা খবরের কাগজ আর চশমার খাপটি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চাকরও এলো।
দুপুরের ঘুম শেষ হয়েছে। শোবার ঘরের সবচাইতে ছায়া-গাঢ় কোণে গভীর একটা সোফায় ডুবে বসে আছেন সান্যালমশাই, চোখের সামনে বিলেতি পত্রিকা। তামাকের মৃদু-মৃদু শব্দ হচ্ছে।
রূপনারায়ণ মায়ের পাশে বসে ছবি আঁকছে। সান্যালগিন্নি অনসূয়া কী একটা সেলাই করছেন।
রূপনারায়ণ বললো, আজ সকালে রামচন্দ্ররা এসেছিলো কেন, বাবা?
পত্রিকার পৃষ্ঠা উলটিয়ে সান্যালমশাই বললেন–তুমি রামচন্দ্রকেও চেনো?
হ্যাঁ, লোকটি একটা কীর্তনের দল খুলেছে। ওরা বলে নাম কীর্তন করে বেড়ালে দেশের আধিব্যাধি দূর হবে। আমাদের বাড়িতে করতে চায় একদিন।
এতসব খবর তুমি কোথায় পেলে? সান্যালমশাই মৃদু-মৃদু হাসলেন।
একদিন ব্ৰজকান্তবাবুর কাছে বলছিলো ওদের একজন, শুনলাম। তোমার কাছে বলতে সাহস পায়নি।
সান্যালমশাই বই মুড়ে রেখে বললেন–ছোটোবাবু, তুমি চাঁদ কাজির গল্প শুনেছো? চার পাঁচশো বছর আগে একদল বাঙালি কীর্তন দিয়ে দেশের আধিব্যাধি দূর করতে চেষ্টা করেছিলো। তখন এ দেশের রাজা ছিলো কীর্তন শুনতে যাদের ঘোরতর আপত্তি। সেসব কীর্তনিয়া কিন্তু ভয় পায়নি।
তাহলে ওদের আসতে নিষেধ নেই তো?
ওরা তো কীর্তনের কথা আমাকে কিছু বললে না।
তাহলে তোমার আপত্তি নেই। আমি বলে আসি।
রূপনারায়ণ নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেলো।
সান্যালমশাই ছেলের উৎসাহের দিকে চেয়ে চেয়ে হাসতে লাগলেন।
অনসূয়া বললেন–হাসছো যে?
সান্যালমশাই বললেন, ওদের কথায় একদিন রূপু বলেছিলো, ভালুকে চাষী। সেটা ঘৃণা করে বলেনি, ওদের শক্তির যে রূপটা চোখে পড়েছিলো তারই বর্ণনা করেছিলো ভালুকের সঙ্গে উপমা দিয়ে। তারা মৃদঙ্গ নিয়ে বৈষ্ণব হয়ে গেলে কেমন হয়, তাই কল্পনা করছিলাম।
ওদের মধ্যেও ধর্মভাব আছে। ওরা তো মাঝে মাঝে বারোয়ারি কালীপুজো করে। অসুখ বিসুখ খুব লেগে উঠলেই ওরা একটা না একটা পুজো করে।
সেসব পুজো ওদের মানায়।
কীর্তন ওদের মানায় না এ তুমি কী করে বলো? সেটা তো এখানকারই জিনিস।
গড়গড়ার নলটা দোলাতে দোলাতে সান্যালমশাই বললেন, এমন এক দুর্ভিক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রের মহেন্দ্ররা কামান তৈরি করেছিলো, সত্যানন্দরা কীর্তনের বাড়বাগি জ্বেলেছিলো; এবার তোমার স্বামী পালিয়েছিলো শহরে। রাজপুরুষ শ্যালক ছিলো বলেই, নতুবা কী হতো বলা যায় না।
তোমার সব তাতেই হাসিঠাট্টা, ধর্ম নিয়েও তাই।
কে বলছে, কে বলছে? তোমার সঙ্গে হাসিমস্করা? সান্যালমশাই মৃদুমন্দ হাসতে লাগলেন, আমি ওদের আজই খবর দেবো। কীর্তন শুনতে আমিও ভালোবাসি। ব্রজকান্ত এবার যেদিন শহরে যাবে রামগোঁসাই-এর দলকে নিয়ে ফিরবে।
আসলে তুমি বিশ্বাস করো না ওদের কোনোকালে ধর্মে মতি হতে পারে।
সান্যালমশাই গম্ভীরমুখে বললেন–ধর্মে মতি হওয়া খুবই বাঞ্ছনীয় বোধ হয়।
অনসূয়া স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে গাম্ভীর্যটার কতটুকু কপট ঠাহর করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
কিন্তু ধর্ম ও কীর্তন নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হলো না। কাছারিতে ঢুকবার আগেই রূপনারায়ণকে যেমন, দোতলার এ ঘরখানাতে সান্যালমশাইদেরও তেমনি বিস্মিত হতে হলো। বিষয়টা কৌতুকেরও বটে। পাল্কিতে চড়ে এমন হুম-হাম শব্দের মধ্যে অনেকদিন কেউ কাছারিবাড়ির সীমানা পার হয়ে অন্দরবাড়ির দরজায় এসে থামেনি।
পুলিসের লোকেরা আসে। শহরের রাজপুরুষরা বছরে এক-আধবার আসে; আত্মীয়স্বজনরাও আসে। পুলিসের ঘোড়া ও সাইকেল। রাজপুরুষরা আসে সান্যালমশাই-এর ফিটনে। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে আজকাল যারা আসে তারা প্রায়ই গোরুগাড়ি করে আসে। অন্যসব যানবাহন থাকে কাছারির ফটকের বাইরে। কদাচিৎ অনসূয়া যাওয়া-আসা করেন। তার পাল্কি অবশ্য অন্দরেই চলে আসে আট বেয়ারার কাঁধে। আর একজন আসে, সে মনসা। অপরিচিতি হালকা পাল্কির এমন সোরগোল!
হু হুম না, হু হুম না।
অনসূয়া কৌতূহলভরে সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নেমে এলেন। সান্যালমশাই জানলার কাছে উঠে দাঁড়ালেন। রূপনারায়ণ কাছারি আর অন্দরের দরজার পাশে পাকিটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো।
পাল্কি থেকে নিজের ছোটো হাতব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে সুমিতি নামলো।রূপনারায়ণের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরলো। তুমি বড়োবাবুর ছোটোভাই, ছোটোবাবু রূপু?
মহিলার সম্মুখে দাঁড়ানোর অভ্যাস রূপনারায়ণের একেবারেই নেই, তার উপরে যে এমন সপ্রতিভ তাকে কী উত্তর দেবে লাজুক রূপনারায়ণ।
সুমিতি রূপনারায়ণের হাত ধরে বললো–চলো ভাই, বাবা-মায়ের কাছে।