১০. আলেফ সেখের বাড়িতে

একদিন রামচন্দ্র আলেফ সেখের বাড়িতে যাচ্ছিলো। আলেফ সেখের বাড়ি চরনকাশিতে। আলেফ সেখের তিনজোড়া বলদই নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নতুন একজোড়া সে কিনেছে গত সপ্তাহে অরনকোলার হাট থেকে, তাদের থেকেই রোগটা ছড়াচ্ছে। বুধেডাঙার প্রান্ত পর্যন্ত এসে রামচন্দ্র মাঠের পথ ধরলো। মাঠ পেরিয়ে সে সোজা পাড়ি দেবে চরনকাশির জোলা পর্যন্ত, জোলা পার হলেই আলেফ সেখের বাড়ি।

হঠাৎরামচন্দ্র থেমে দাঁড়ালো। দৃশ্যটা অবিশ্বাস্য। ভরুই পাখি! ধানের সঙ্গে তাদের যাওয়া আসা, ঝাঁক বেঁধে তারা আসে, ধোঁয়ার মতো ধানের শিষগুলির উপরে ভেসে বেড়ায়। তেমনি আসে এদেশে দক্ষিণের চাষীরা। মাথায় টোকা, হাতে ছোট ছোট লাঠি, কাঁধে একটি করে ঝোলা, তাতেই তাদের সর্বস্ব। ধানের দিনে তারা আসতো, তখন তাদের আসাটাই ছিল স্বাভাবিক। তাদের আসা সূচনা করতো ধান, তাদের হাসিতামাশা, কথাবার্তা গ্রামের পথে গ্রামের চাষীদের আত্মতৃপ্তির নিশানা দিয়ে বেড়াতো।

রামচন্দ্র অবাক হয়ে দেখলো ঠিক তাদের মতো চেহারার কয়েকজন তোক দল বেঁধে আসছে। ছিদামের ধান কাটতে এলো নাকি এরা? কথাটা মনে হতেই রামচন্দ্র শূন্য মাঠের মধ্যে একা একা হেসে ফেলো।

কাছাকাছি এসে ওরা বললো চৈতন্য সা-র বাড়ি কোন দিকে যামু?

যাও এই পথেই।

ওরা চলে গেলে রামচন্দ্র পথ চলতে লাগলো আবার। তাহলে এরা চৈতন্য সাহার খোঁজে এসেছে, তার সেই কুখ্যাত হাড়-চালান-দেওয়ার ধানীনৌকার দাঁড়িমাল্লা হবে বোধ হয়। চৈতন্য সাহার জমি হয়েছে, কিন্তু ধান কোথায় যে কাটবে এরা? রামচন্দ্র ঠিক করলো ফিরবার সময়ে বাড়ি যাবার পথে দাঁড়িয়ে শ্রীকৃষ্টকে কৌতুকের খবরটা দিয়ে যাবে।

.

কিন্তু চৈতন্য সাহা নাবালক নয় যে ছিদামের ধান কাটার খবর পাঠিয়ে দাঁড়িমাল্লা ডেকে আনবে। বাঙালরা–এ অঞ্চলে ধান কাটার জন্য যারা দক্ষিণ থেকে আসে তাদের প্রচলিত নাম-কেন এসেছে বোঝা গেলো। রটলোএ বছর চৈতন্য সাহা এ গ্রামের চাষীদের আগাম টাকা দিয়ে চাষ করতে ডাকবে না। যারা প্রাণের দায়ে তার কাছে গিয়েছিলো কথাবার্তা বলতে তারা ফিরে এসেছে। সে তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে–এবার সে অন্য দেশ থেকে চাষী এনে তার খাইখালাসি জমি চাষ করাবে। চাষীরা ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেলো। তারা গত ফসলের সময়ে যে অপমান বোধ করেছিলো ভয়ে তাদের সে-অপমান বোধও আর রইলো না।

কথাটা তার কাছে দু’একজন উত্থাপিত করলে রামচন্দ্র একদিন ভক্ত কামারের কাছে বললো, এমন তো হয়ই, খাইখালাসিতে জমি বাঁধা পড়লে চাষীর তো এই হালই হবি।

কিন্তুক ধরো যে নিজের জমিতে মজুর খাটে গত সনে প্রাণ বাঁচছে, এবার কী হবি? এবার যে মজুর খাটেও দিন চলার উপায় নি। এ সনও না, তার পর সনও না, তারপর জমি ফিরে পাবা। ততদিন কোন ধানে বাঁচবা?

ব্যাপারটা দেখতে দেখতে অন্যতর পরিণতি নিলো।

শ্রীকৃষ্ট সেদিন অসুস্থ, মহাভারত পড়ার শক্তি নেই। রামচন্দ্র তার দাওয়ায় বসে বললো, শুনছেন না, গোসাই?

শ্রীকৃষ্ট সবই শুনেছে, খানিকটা সময় চুপ করে থেকে সে ধীরে ধীরে বললো, আপনাকে নিয়ে আমি একবার সান্যালমশাইয়ের কাছে যাবো। কবো, এখন আমরা মরে গেলে যদি দেশে শান্তি হয়, হউক।

রামচন্দ্র বললো, দেশে আর শাস্তি হবি নে।

গভীর একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো তার।

ঘরের মধ্যে থেকে আর একজনের দীর্ঘনিশ্বাস শোনা গেলো। সে শ্রীকৃষ্টর শেষ বৈষ্ণবী পদ্ম।

শ্রীকৃষ্ট বললো, কেন, পদ্মা, তুমি কী কও?

পদ্ম বললো, আমাদের দেশে লাঙলের পূজা হয়, তাতে শান্তি আসে।

সে কী পূজা?

পদ্ম বললো, দেখছি–নতুন কাঠ দিয়ে এক লাঙল তৈরি করে পাটবাণের পূজার দিনে পূজা হয় তার, তারপর সেই লাঙলে খানিক মাটি ভোলা হয়, গাঙের জল তুলে কাদা করা হয়, সেই কাদায় গড়ায়ে, সারা গায়ে কাদা মাখে আমার দাদারা খেতে নামতো চাষ দিতে।

খেত? না, কন্যে। এদেশে আর খেত নাই। রামচন্দ্র বললো।

আলোচনাটা আর এগোলো না। প্রায় অন্ধকার পথ বেয়ে দশ-পনেরো জন লোক এসে  দাঁড়ালো শ্রীকৃষ্টর ঘরের সম্মুখে।

তুমি এখানে আছেন মোণ্ডল, আমরা খুঁজতেছিলাম। ওদের মধ্যে একজন বললো।

কেন্ ভাই, আমাক কেন্‌?

তারা বললো ভক্ত কামারের দুই ছেলে অনেকদিন থেকে ওপারের মিলে কাজ করে। বড়োছেলে আজ ভক্তকে নিতে এসেছে। তার কাছে শোনা গেছে ওপারের ধানের কলে এখন অনেক মজুর নেবে। ভক্তর কাছে গিয়েছিলো গ্রামের অনেকে, সে বলেছে, রামচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করো, সে বললেই–যাওয়া।

রামচন্দ্র কথা বলার ভঙ্গিতে নড়েচড়ে বসলো, কিন্তু কথা খুঁজে না পেয়ে গোঁফে হাত। রাখলো।

তার বক্তব্য ছিলো–আমি কী বলবো, এমন করে তো আগে তোমরা আমাক কও নাই, আমি কী পরামর্শ দেবো? আমি কি কোনোকালে পরামর্শ দিবের শিখছি?

এদের মধ্যে একটি বোকা বোকা লোক ছিলো, কথা বলতে তার ‘র’ও ন’ দুটিই ‘ল’ হয়ে যেত; সে বললো, মল্‌ডল্‌ বুঝি গাঁ ছাল্‌বা লা? যখন আমলা লা খায়ে মলাম তখন জমিদালও গাঁ ছালে পলাইছিলো।

রামচন্দ্র বললে, কোথায় যাবো?

তার বক্তব্য ছিলো : কোথায় যাবো, সর্বত্রই তো একই পৃথিবী।

প্রশ্নটা সকলেই করতে পারে, উত্তর দেবে এমন কে আছে?

রামচন্দ্র বললো, এবার তার গলাটা আবেগে কেঁপে গেলো, কোথায় যাবো কও, তোমরাই কও। ভক্ত আসে নাই কেন্‌?

তাদের মধ্যে ভক্তর ছেলেও ছিলো, সে বললো, বাবা কলোমুখ দেখাতে লজ্জা করে। আমি কই, না খায়ে মরার চায়েও কি লজ্জা বড়ো?

এখন হয় কি, পুনঃপুনঃ এই নাটক অভিনীত হচ্ছে। যারা মঞ্চে থাকে তারা ঠিক ঠাহর করতে পারে না, কী রকমটা তারা চলবে। তারপর এ ওকে কথা যুগিয়ে দেয়, এর কাজের থেকে ওর কাজের সৃষ্টি হয়। একটা সামান্য কথা, এতটুকু ইঙ্গিতবিভঙ্গ থেকে জনসমুদ্র উদ্বেল হওয়ার গতিবীজ পায়। মেয়েরা যতই উহ্য থাক পুরুষদের আলাপ আলোচনায়, মাঝে মাঝে তাদেরও দু’একটি কথা ছিটকে বাইরে এসে পৌঁছায়। তার গুরুত্ব কম নয়, বরং দেখা যায় পুরুষদের সম্মিলিত যুক্তির আধখানা সৃষ্টি করেছে সেই স্বল্পোচ্চারিত কথা কয়টি।

এতগুলো লোক শ্বশুরকে খুঁজছে কেন এ জানবার আগ্রহে আগন্তুকদের সঙ্গে মুঙ্‌লাও এসেছিলো। ঘরের ভিতর থেকে তাকে ডেকে পদ্ম বললো, বাবাক একটা কথা কবা, আপনেরা যেন যাবেন, মিয়েছেলের কী হবি? তাদের সেখানে আবু থাকে না।

মুঙ্‌লা ফিরে এসে কথাগুলি বললো, সেগুলি অবশ্য ইতিপূর্বেই এদের অনেকে শুনতে পেয়েছে।

তুই কী কস? ওদের একজন প্রশ্ন করলো।

মনে কয়, আমার মাকে নিয়ে আমরা যাবো না।

কয়েকজন প্রায় সমস্বরে বললো, তোমরা শ্বশুর জামাই রোজগার করে সেখানে খাওয়াবের পারবা না? তোমরা থাকতে আব্রুর কী ভয়?

মুঙ্‌লা বললে, অচেনা জায়গায় কী কাম যায়ে, পারি তো এখানেও খাওয়াতে পারবো। কি কও ছিদামসখা?

নেচ্চায়!

যারা চলে যেতে কৃতসংকল্প হয়েছিলো তারা বললো, কিন্তুক চৈতন্য জমির খাজনা দেয় নাই, জমিদার জমি জব্দ করবি। চৈতন্য খাজনা দিবি নে; খাইখালাসি সব খাস হবি, কোনোদিনই আর আমাদের হাতে ফিরবি নে।

মুঙ্‌লা বললে, তা হউক, জমিদার জমি বাক্সে পুরবি নে; খাস করে, বরগা চায়ে নেবা।

বাকি খাজনা না দিলে কোনো জমিদার বরগা দেয় না।

অবিশ্বাসের হাসি হাসলো অনেকে।

একজন বয়স্ক চাষী হাসিটা কথায় প্রকাশ করলো, যেমন ছিদামের বোরো ধান লাগান! বরগা চষা কি গানের পালা বাঁধা নাকি?

অতি দুঃখে কয়েকজন হো হো করে হেসে উঠলো। রামচন্দ্রদাদার সব জমি যে খাইখালাসি হয় নাই তাই এমন কয়- সে হাসির মধ্যে এমন কথাও শোনা গেলো।

হাসি থামলে হরিশ শাঁখারি কথা বললো, রাম রে, আমি কী করি তাই কও।

কেন্ ভাই, হরিশ?

আমার খাইখালাসি যে জমিদারের কাছেই। মিহির সান্যালকে চাপ দিবি কে? মুঙ্‌লা, আমি যে বরগাতেও জমি ফিরে পাবো না।

রামচন্দ্রর মনে হলো এবার সে কেঁদে ফেলবে। বললো, তোমরা যদি থাকো, আমি তোমাদের ছাড়ে যাবো না।

আগন্তুকরা ধীরে ধীরে চলে গেলো। কিন্তু তাদের চলবার কায়দায় মনে হলো রামচন্দ্রর কথায় তারা কিছুমাত্র আশ্বাস পায়নি।

কী করা উচিত রামচন্দ্র কিছুতেই ঠাহর করতে পারছে না। ভাবতে না ভাবতে একদিন সে একটা অনুচিত কাজই করে ফেলো।

ছিদামের বোরো ধান আগুই হয়েছে, এই কৌতুকের খবরটা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। এক সকালে বন্ধু মুঙ্‌লার সাহায্যে ধান কাটার জন্য ছিদাম প্রস্তুত হচ্ছে এমন সময়ে তারা দেখতে পেলো পুকুরটার অন্যদিকে চৈতন্য সাহার পেয়াদারা এসে দাঁড়িয়েছে।

মুঙ্‌লা বললে, কেন্ ভাই, তোমরা আসছো কেন্‌?

ওদের একজন বললে, এ পুকুর কার?

কেন, সান্যালবাবুর প্রজা শ্রীকৃষ্টদাসের।

খাজনা দেও না কয় বছর?

খাজনা দিবার কী আছে কও? মাছ হয় না–জলকর দিবো, ফসল হয় না-খাজনা শোধবো মুঙ্‌লা বললে যুক্তি দিয়ে।

তাইলে খাইখালাসি বন্দোবস্ত করছিলা কেন্ চৈতন সার সাথে?

তা করছি, কিন্তু খাইখালাসির মধ্যে কি এই ধানের কথা ছিলো? এ মুল্লুকে এই ধান কো কালে হয়? যে ফসল এ জমিতে সচরাচর হয় তার উপরই মহাজনের দখল। কিন্তুক যে ফসলে কথা কেউ ভাবে নাই, তার উপর তার দখল হয় কী করে? জমি তো তাক চিরকালের জনি বেচি নাই। সে খাউক না যে ফসল মনে মনে জানা ছিলো কাগজ করার সময়। এ ফসলে। কথা কাগজের সময় তারও মনে ছিলো না, আমারও না। এর পর তার হক্ কী, কও। ছিদা যুক্তি দিলো।

জমি তো তার, তোমার দখল নাই; সে খালাস না দিলে তুমি ইয়েত লাঙল ছোঁয়াবা কে ধান কাটবের আমরা দিমু না। জমিদারের খাজনা দেও, আর চৈতন সার টাকা, তারপর কার ধান।

মুঙ্‌লার মনে হলো এদের সঙ্গে তর্কাতর্কি করা বৃথা। এরা যুক্তির কথা শুনতে আসেনি গায়ের জোর দেখিয়ে এ ধানটুকুও নিয়ে যেতে চায়। সে বললে, ছিদামসখা, ধান তুমি কাটো

কিয়ের ধান কাটবা! ওরা পাঁচ-ছজন একসঙ্গে গর্জে উঠলো।

ছিদাম বললো, ধান কাটাই লাগবি, মেঞাভাইরা, এ ধান আমার সখের ধান। ধান কা বেচবো। বেচে যে টাকা হয় দিব চৈতন্য সা-কে। এক বিশ ধান আর তিন টাকা নিয়ে বন্দোবৎ করছিলাম পুকুরের ডাঙা। এক বিশ ধান আর তিন টাকা আমি তা ফিরায়ে দিব। পুকুরের জ তা দিই নাই, জলের ধান আমার।

লোকগুলির পিছন দিকে একটা ছোটো ঝোঁপের আড়াল থেকে চৈতন্য সাহার মুখ দেখা দিলো, আর সুদ, সুদ দিবি কে?

ছিদাম বললে, সুদ? সুদের কথা তখন কও নাই, মহাজন, মিছা কয়ো না। খাইখালাসির সুদের কথা নাই।

চৈতন্য সাহা ঝোঁপের পিছনে ডুব দিলো।

মুঙ্‌লা বললে, আমাদের যা বলার তা শুনছো, এই ধান আমরা কাটে নিবো। তারপর ও জমি খাক।

মুঙ্‌লা নিচু হয়ে বসে একগোছা ধানের গোড়ায় কাস্তে দিলো। চৈতন্য সাহার পেয়াদাদে একজন এগিয়ে এসে মুঙ্‌লার একখানা হাত চেপে ধরলো।

হাত ছাড়ো, অন্যাই কোরো না। বললো ছিদাম।

মুঙ্‌লা নিজেই হাত ছাড়িয়ে নিলো, কিন্তু ধানের গোছা ছাড়লোনা। পেয়াদাদের আর একজন এগিয়ে এসে মুঙ্‌লার হাতের উপরে তার লাঠিটা দিয়ে একটা গুতো মারলো।

মুঙ্‌লা ধান ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সে এ গ্রামের জামাই। সমবয়সীদের সতে খেলাধুলোর সময়ে চড়চাপড় দেওয়া নেওয়া সে করেছে, কিন্তু, এমন তিরস্কারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে এত বড়ো অপমান তাকে কেউ করেনি। কী একটা তীব্র কথা সে বলতে গেলো, কি তার আগে তার দু চোখ থেকে অশ্রু নেমে এলো।

ছিদাম বললো, সখা,চলো, ধান আমরা কাটবো না, আমার জন্যি তোমার অপমান সয় না।

মুঙ্‌লা বললো, না তুমি থাকো; খেতে দাঁড়ায়ে মরে যাও সখা, ক্ষেত ছাড়বা না। আমি সান্যালমশাইয়ের কাছে যাবো, গাঁয়ের লোকের কাছে যাবো, খাইখালাসি মানে কী তা বোঝাবো। তারপর আমিও মরবো।

ছিদামকে খেতের পাহারায় রেখে মুঙ্‌লাকে বেশিদূর যেতে হলো না। সে তেমাথার মোড়টায় পৌঁছে দেখলো সেখানে একটা জটলা হচ্ছে। রামচন্দ্র বোঝাচ্ছে আর তার চারপাশে দাঁড়িয়ে দশ-পনেরোজন চাষী একসঙ্গে তীব্র কণ্ঠে তর্ক করছে। এমনকী বুধেডাঙার রজবআলি সান্দারও এসে জুটেছে। সে কথা বলছেনা, পাগলের মতো দলটির চারপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তর্কের সমর্থনে।

প্রত্যহ এমন ব্যাপার ঘটে না। ভক্ত কামারের ছেলেরা আজ ভক্তকে নিয়ে গেলো। নদীর ঘাটে তাকে নৌকোয় তুলে দিতে যে দু-একজন গিয়েছিলো তারা লক্ষ্য করেছিলো, শুধু তারা দু’একজন নয়, আরো অনেকে এসেছে ভক্ত কামারের চলে যাওয়া দেখতে। রেল এঞ্জিনের মতো শব্দ করে নয়, ভিজেমাটিতে লগির বাঁশের কিছুমাত্র শব্দ হলো না যখন ভক্ত কামারের নৌকো চিরদিনের জন্য এ গ্রামের মাটি ছেড়ে নদীতে ভেসে গেলো।

স্তব্ধ হয়ে খানিকটা পথ চলার পর কথাটা উঠে পড়েছিলো এর-তার মুখে।

চাষীদের মধ্যে একজন শেষ কথা বলার ভঙ্গিতে বললো, গত সন যা হইছে তা হইছে, এ সন আর নয়। খাইখালাসি দিছি তার দলিল কই?

তোমরা তার কাগজে টিপ দেও নাই? রামচন্দ্র প্রশ্ন করলো।

সই টিপ দিছি, কিন্তুক রেজিস্টারি হয় নাই, সব ভুয়া। লাগে লাগুক মামলা।

রামচন্দ্র বললো, বুকের ভেতর হাতড়ায়ে দেখ তার কাছে টাকা খাইছো কি না খাইছো।

তখন যে না খায়ে মরি, তা দেখে কে? আর-একজন চাষী বললো।

সেই তো বড়ো কথা, তার টাকায় প্রাণ বাঁচছে তখন।

অন্য একজন অল্পবয়সী চাষী তেড়ে উঠে বললো, মানিনা ওসবদলিল। টাকায় নিছিটাকায় দিবো। চিতি সাপ! দলিল সাপের খোলস।

দলিলের দোষ কী ভাই? সব জমিরই কোনো না কোনো দলিল আছে। চৈতন্যর দোষ কী কও, সে খাইখালাসি না করলি আর একজন করতো। নিয়ম আছে তাই সে করছে, না থাকলি সে করতো না। নিয়মেক যদি তাড়াতে পারো তাড়াও!

এমন সময়ে জনতার মধ্যে থেকে রামচন্দ্রর দৃষ্টি পড়লো মুঙ্‌লার মুখের উপরে। তখন মুঙ্‌লা আবেগ ও অবমাননায় আকুঞ্চিত হচ্ছে।

কী হইছে রে?

ও পাড়ার থিকে মার খায়ে আলাম।

মার খায়ে?

রামচন্দ্রর ডান হাতখানা বারবার গোঁফের কাছে উঠে পড়তে লাগলো। ক্রোধে, ক্ষোভে,লজ্জায় সে বিচলিত হয়ে পড়েছে, বুদ্ধিতে কিছু ঠাওর হচ্ছে না; কিন্তু দর্শকদের মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় সে প্রতিবিধিৎসায় মনস্থির করে ফেলেছে।

কার হাতে মার খালে, মুঙ্‌লা?

মুঙ্‌লা ছিদামের ধান কাটার কথা ব্যক্ত করলো।

রামচন্দ্রর চারপাশে যারা দাঁড়িয়েছিলো তাদের একজনের হাতে একটা বড়ো লাঠি ছিলো। হঠাৎ সেটা হাতে নিয়ে রামচন্দ্র হাঁটতে লাগলো; মাঝে মাঝে তার হাত উঠে যেতে লাগলো। গোঁফে। ভারি দেহে দ্রুত হাঁটার ফলে তাকে দেখে মনে হতে লাগলো যেন একটা রাস্তা সমান করার এঞ্জিন ধ্বস্ ধ্বস্ শব্দ করে ছুটছে, যত তাড়াতাড়ি যন্ত্র চলছে ততটা পথ অতিক্রম করছে না। গ্রামবাসীদের ছোটো দলটি রামচন্দ্রর পিছনে পিছনে চলছে।

ছিদামের ধানক্ষেতের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রামচন্দ্র দেখলো দুজন বাঙাল ছিদামের দু-পাশে পাহারায় দাঁড়িয়েছে আর জন তিন-চার বাঙাল বিপরীত দিক থেকে ধান কাটছে। রামচন্দ্রর মনে হলো সে হো হো করে হেসে ফেলবে–এই ধানের এত হাঁকডাক।

কিন্তু হাসিটা ফুটবার আগেই তার মনে পড়লো মুঙ্‌লাকে অপমান করেছে এরা।

রামচন্দ্র বললো, মুঙ্‌লাক মারছে কেন্‌? অন্যাই করে সে, আমাকে ক’লেও হতো।

ছিদাম বললো, অন্যাই কেন্‌? অন্যাই আমার। আমি ধান দিছি খেতে, চিতি সাপের থুথু লাগা খেতে; সেই মহাপাতক।

রামচন্দ্রর রাগটা অকস্মাৎ যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো, লাঠির উপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে প্রচণ্ড স্বরে বললো, তফাৎ।

ওপাশের জঙ্গলটা নড়ে উঠলো, বোধহয় চৈতন্য সাহা স্থান পরিবর্তন করলো। খেতের বাঙালচাষীরা ধানের গোড়া ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

‘ধান কাটো কোন সম্মুন্দি, কোন চিতিসার বাপের ক্ষেত এটা?

একজন বাঙালচাষী বললো, গালমন্দ করেন না, ভাই।

ভাই! শালা আমার চোদ্দপুরুষের।

ক্রুদ্ধ বাঙালরা একসারি হয়ে দাঁড়ালো, কাস্তে মাটিতে ফেলে রেখে তারাও হাতে লাঠি নিলো। ছিদাম আর মুঙ্‌লা রামচন্দ্রকে বাধা দেওয়ার জন্য কী বলতে গেলো; কিন্তু তার আগে রামচন্দ্র খেতের মাঝখানে গিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে দাঁড়িয়েছে, হিংস্রতায় তার দাঁত বেরিয়ে পড়েছে, ক্রোধে তার পিঠ, বুক ও পাশের পেশীগুলি ছিঁড়ে যাবার মতো টানটান।

পিছন থেকে রজব আলি ফিসফিস করে বলে দিলো, রাগ কমান মোল, গা ঢিল দেন; লাঠি চলবি নে না হয়।

ওপাশের জঙ্গলের পিছন থেকে চৈতন্য সাহা কী যেন বললো। একজন বাঙাল কান পেতে শুনলো, তারপর সব বাঙাল পুকুরের পারে উঠে দাঁড়িয়ে সমম্বরে হুলহুলি করে বললো, আমরা ধান কাটার নাইগা আসছি, মারপিট আমরাও জানি, আজ তা কয়ে গেলাম।

বাঙালরা চলে গেলে রামচন্দ্রর দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগলো। সে জলকাদায় মেশানো প্রানের মধ্যে বসে পড়লো। তার বুকপাট তখনো সাপের ফণার মতো বারংবার আকুঞ্চিত ও বিস্ফারিত হচ্ছে।

গ্রামবাসীরা ঘিরে দাঁড়ালো রামচন্দ্রকে, ছিদাম আর মুঙ্‌লা রামচন্দ্রর সম্মুখে কাদার উপরে। বসে পড়লো। একজন স্ত্রীলোকও এসে দাঁড়িয়েছিলো ভিড়ের মধ্যে। খাটো হলদে শাড়ি পরা, আঁটসাট দেহ, চুলগুলো খুব টেনে বাঁধা, বড়ো বড়ো চোখ। চাষীদের যদি ভাষাজ্ঞান থাকতো, বলতো, তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি উপাসনার মতো কতকটা। সে শ্রীকৃষ্টর বৈষ্ণবী পদ্ম।

রজব আলি এতক্ষণ একবার খেতের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, একবার পিছিয়ে যাচ্ছিলো, এবার সে রামচন্দ্রর পাশে বসে দুই হাঁটুর উপর দিয়ে হাত দুটি ধানের দিকে অগ্রসর করে দিয়ে খুঁতখুঁত করে হাসতে লাগলো।

ছিদাম বললো, কেন্ জেঠা, ধান কাটি?

রামচন্দ্রর হয়ে মুঙ্‌লা বললো, এবেলা না হয়, ওবেলা কাটাবো। ভাইসব, তোমরা সকলে আসবা। আমার সখার এই ধানে ভোজ হবি, আকাশে ছিটায়ে ছড়ায়ে দেবো।

কিন্তু রামচন্দ্র মাথা দোলালো। গোঁফে একবার চাড়া দিয়ে মনটাকে স্ববশে এনে সে কথা বললো, ধানে হাত দিবা না, ও ধান তোমার না।

‘তবে?

আগে বিচার করো, রাজার কাছে যাও, তার কথা শোনো। যদি রাজা বলে, ধান তুলবা।

রাজা তো এখন শহরে। উকিল দিয়ে মামলা করে তার কথা শুনতে চারমাস; ততদিনে ধান মাটিতে পড়ে নতুন করে গাছ হবি।-হরিশ বললো কথাটা।

গাঁয়ের রাজা সান্যাল আছে, তাদের কাছে যাও।

তোমার সে রাজা মহাজনের পক্ষ, মিহির সান্যাল খাইখালাসি কারবার করে।

রামচন্দ্র একটু থামলো, তারপর কথাটা বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বললো, যে খাজনা খায় তাকে রাজার কাজও করতে হবি। রাজা মহাজন এদের তো কওয়া হয় নাই আমরা দেনা খাজনার দায়িক হব না। না কয়ে বলে দেনা খাজনা বন্ধ করবের পিরবো না ভাই। যা করবো জানায়ে শুনায়ে।

রামচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো। মুঙ্‌লা ছিদাম ও অন্যান্য সকলকে বিস্মিত করে সে বললো, আমি এই কাদা গায়ে সান্যালমোশাইয়ের কাছে যাতেছি, তিনি মহাজনের বিপক্ষে আয় দেয় কিনা দেখবো।

রামচন্দ্র খেত পার হয়ে সান্যালবাড়ির পথ ধরলো।

পদ্মর মনে হলো, কী ভীরু, কী ভীরু।

কিন্তু সেটা শেষ কথা নয়। আদর্শটা কী করে তৈরি হয় বলা শক্ত। মেয়েদের বেলায় বোধ হয় নিজের বাবাই আদর্শবীজ। বাবার মতো এমন শক্তিশালী কেউ নেই, বাল্যের এই বোধ পুরুষদের আদর্শের মূলে চিরকালের জন্য থেকে যায়। নিজের ভাইরা, নিকট পুরুষ-আত্মীয়রা এই আদর্শের পুষ্টি করে, এবং পরবর্তী জীবনে অপরিচিত যে পুরুষকে মেয়েটি গ্রহণ করে প্রথম ভাবালুতা কেটে যাওয়ার পর সেই পুরুষ তত বেশি নিকটে আসে যতখানি মেয়েটির পূর্ব পরিচিত আত্মীয়পুরুষগুলির সঙ্গে তার চরিত্রগত ঐক্য আছে। পদ্মর কল্পনায় এমন একটি পুরুষ কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে। এটা সে এর আগে কোনোদিন অনুভব করেনি, এখনো তার চিন্তায় এ কথাগুলি ভেসে উঠলো না। এমন কালো তেল-চুঁইয়ে-পড়া রঙ, এমন পেশীবহুলতা, এমন ভারভারিক্কি গোঁফ, এমন পাকাকঁচায় মেশানো একরাশ চুল মাথায়–পদ্মর অনুভবেঅপূর্ব একটি একাত্মবোধ ফুটে উঠলো। নিজের মনের সঙ্গে সে সওয়াল জবাবে নামলোনা, ভীরু নয়, ভীরু নয়। পাঁচ-ছ’জন বাঙাল চাষীর সম্মুখে–তারাও নিরস্ত্র নয়, লাঠি হেঁসো ছিলো–যে হাঁক দিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় সে ভীরু নয়।

.

সংবাদটা গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেলো। খাইখালাসি আর বন্ধকী, বরগাদারী, কিংবা পত্তনি হঠাৎ যেন তার প্রতি দুর্ভিক্ষের আগেকার দিনগুলির মতো মমত্ব বোধ করলো চাষীরা।

সন্ধ্যার পরে চাষীরা শুনলো রামশিঙা বাজছে, খোলে ঘা পড়ছে, ঢোলকে আখর ফুটছে–

চিতিসাপ চাঁদ শাহে লাগলো বিসম্বাদ
শোনো শোনো দেশবাসী তাহার সম্বাদ
–চাঁদ হেন্তাল হাতে নিলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *