২০. প্ল্যাটফর্মে কাঠের বাক্সে

প্ল্যাটফর্মে কাঠের বাক্সে রোজই সে বসে থাকে, সব সময়ে তোকজনের সঙ্গ তার ভালো লাগে না। সেদিন তেমনি বসে ছিলো মাধাই। সুরতুন ধীরে ধীরে এলো। তার মনে হয়েছিলো কিছু একটা বলা উচিত কিন্তু কথা জোগালো না। ট্রেনকে ঝাণ্ডা দেখাতে গিয়ে আবার সে দেখতে পেলো সুরতুনকে।

যেদিন রাত্রিতে সুরতুন নিখোঁজ হয়েছিলো সে রাত্রির সব কথা আবার মনে পড়লো তার।

প্রথমে সে অত্যন্ত লজ্জিত ও সংকুচিত বোধ করেছিলো। তারপর সেই সংকোচ থেকে আত্মাণ করতে গিয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলো।

কিন্তু সে-ক্রোধ পরে একটা আশঙ্কায় রূপান্তরিত হলো। তখন সে একটা রেলের লণ্ঠন নিয়ে সুরতুনকে খুঁজতে শুরু করেছিলো। বাজার স্টেশন ইত্যাদি জায়গায় অনির্দিষ্টভাবে খুঁজে, প্রায় ভোর রাত পর্যন্ত হেঁটে, কখনো বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার হেঁটে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে সে স্থির করেছিলো–কেউ যদি লুকিয়ে থাকতে চায় তবে বন্দর দিঘার মতো অত বড়ো জায়গায় একক চেষ্টায় তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে সে বাসায় ফিরেছিলো এবং ব্যর্থ খোঁজাখুঁজির চেষ্টায় নিজের উপরেই বিরক্ত হয়ে উঠলো। মনের এরকম অবস্থায় জাগরণক্লান্ত মস্তিষ্কে সে ভাবলো : যে সাজায়-গোছায় সে কী চায় তা বোঝো না? পরক্ষণেই তার মনে পড়লো, সাজানো-গোছানোর পিছনে সত্যি তার কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না। থাকলে বোধহয় সাজানো-গোছানোর ব্যাপারে এগিয়ে যাওয়ার আগে উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা ও চিন্তা করতে পারতো। এ যুক্তি যখন টিকলো না তখন অধিকতর ক্রুদ্ধ হয়ে সে স্বগতোক্তি করলো–মেয়েমানুষের সেই দুর্গতির দিনে যে আশ্রয় দিয়েছিলো তোমাদের, তার কি কিছুমাত্র দাবি নেই? রক্ষক যে ভক্ষক সে এই প্রবাদটা সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়লো। এ যুক্তিটাও বানচাল হয়ে গেলো। হাতের পিঠে একটা জ্বালা করছে, চিবুকেও। এতক্ষণে যেন সে লক্ষ্য করার সময় পেলো। অনেকটা জায়গা কেটে গেছে হাতের পিঠে, আরসিটা তুলে নিয়ে দেখলো চিবুকেও বিন্দু বিন্দু রক্ত জমে আছে। মাধাইয়ের ক্রোধটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলল, শালী বনবিলাই। আয়ডিন লাগাতে হবে।

এসব কিছুতেই সান্ত্বনা পায়নি সে। তার ঘরের বাইরে শুকনো পাতা খচমচ করে উঠতেই সে বলেছিলো, সুরো আসলি? আয়, নির্ভাবনায় আয়। এমনকী উঠে গিয়ে সে বাইরে দাঁড়িয়েছিলো।

পরদিন মাধাই কাজে যায়নি। সুরতুন এসে যদি তাকে না পায় এই আশঙ্কায় সারাদিন সে ঘরেই ছিলো। দিনের বেশিরভাগ সময়ে চিন্তা করেছিলো–ভয় পেয়েছে ও।

আজ সুরতুনকে দেখতে পেয়ে তার মনে একটি অনির্বচনীয় ভাব জমে উঠতে লাগলো। ইতিমধ্যে তার জীবনে অন্য একটি স্ত্রীলোক এসেছে। তার প্রতি যে কোনো মোহ জন্মেছে তা নয়, তবু যেন কিছুটা কৃতজ্ঞতাবোধ, সামান্য কিছু করুণা তার জন্য অনুভব করলো সে। সুরতুনকে গ্রহণ করা কিংবা তার সম্পর্কে উদাসীন হওয়া যেন এ ঘটনা থেকেই জটিল একটা ব্যাপার হয়ে উঠলো।

যে অনুতপ্ত তার অনুশোচনাকে মূল্য না দিলে অনেক ক্ষেত্রে সে-অনুতাপ চিরস্থায়ী বিদ্বেষেও পরিণত হতে পারে। সুরতুন চলে যাওয়ার কয়েকদিন পরে বিদ্বেষ যখন তার সব চিন্তার মূল রস, তখন একদিন তার মনে পড়লো রমণী হিসাবে টেপি সুরতুনের তুলনায় কিছু কম তো নয়ই বরং অনেক দিক দিয়ে অনেক বেশি কাম্য। টেপিরও এক ধরনের রূপ আছে, অধিকন্তু সে রুচিসম্মত বেশভূষা ব্যবহার করতে জানে, সব চাইতে বড়ো কথা–সে কথা বলতে জানে, রসিকা সে। সাত-পাঁচ মাথামুণ্ডু ভাবতে ভাবতে মাধাই টেপিদের পল্লীতে গিয়ে পৌঁছেছিলো। তখনো সন্ধ্যা হতে কিছু দেরি আছে। মাধাই লক্ষ্য করলো সবগুলি বাড়ির দরজা খোলা, খোলা দরজার পাশে সজ্জিতা স্ত্রীলোক, কোথাও বা একাধিক। হঠাৎ যেন মাধাইয়ের ভয় ভয় করে উঠলো। সে কোনোদিকে না চেয়ে রাস্তাটা ধরে মুখ নিচু করে দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলো।

টেপি ফিরছিলো সওদা করে। সে মাধাইকে এ পথে দেখে অবাক হলো। এ অবস্থায় মাধাইয়ের সঙ্গে কথা বলা উচিত হবে কিনা ভাবতে ভাবতে সে থেমে দাঁড়িয়েছিলো।

মাধাই বললো–তোমার কাছে আসছিলাম।

–আমার কাছে, কেন্‌?

ডুবন্ত মানুষ যেমন করে তুচ্ছকে অবলম্বন বলে আঁকড়ে ধরে তেমনি করে মাধাই টেপির মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

টেপি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলো, তারপরে বললো–তুমি আসো আমার সঙ্গে।

মাধাই টেপির দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখের চশমা থেকে পায়ের চটি পর্যন্ত সর্বত্র সুরুচির চিহ্ন। হাসি হাসি মুখে টেপি দাঁড়িয়ে আছে। টেপির ঠোঁট দুটিও লাল টুকটুক করছে রঙে।

যে-ভয়ে পালাচ্ছিলো মাধাই সেটা যেন দূর হলো। এমন সঙ্গিনী পেলে কোথাও ভয় থাকে না।

টেপির ঘরে এসে মাধাই হকচকিয়ে গেলো। ঘরটি খুব পরিচ্ছন্ন নয়। দেয়ালের চুনবালির আস্তর এখানে-সেখানে খসে পড়েছে। কিন্তু ঘরের সস্তা আসবাবপত্র ও শয্যা-উপকরণগুলি পরিচ্ছন্ন ও নতুন এবং সেজন্য মাধাইয়ের চোখে অপূর্ব সুন্দর বলে বোধ হলো।

মাধাইকে একটা চেয়ারে বসিয়ে টেপি বললো–চা করি?

–করো।

টেপি নিজে চা করতে গেলো না। হরিদাসী বলে একজন কাকে ডেকে জল ফুটিয়ে দিতে বললো। এরকম অবস্থায় চট করে কথা পাওয়া শক্ত। পথে দাঁড়িয়ে টেপির রূপে মনে যে ঔদার্য এবং সাহসএসেছিলো সেটা এই ঘরের সংকীর্ণ পরিসরের মধ্যে ক্রমশ ম্লান হয়ে যেতে লাগলো, সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তরে এ পল্লীর উদ্দেশ্যটা কালো হয়ে উঠতে লাগলো।

টেপির মনে হলো যদি দিনের কোনো কাজ হতো এতক্ষণে মাধাই বলে ফেলতো। মাধাই তা বলেনি।

হরিদাসী একটা কেটলি করে চায়ের জল দিয়ে গেলো। মাধাইয়ের সম্মুখে চা-বিস্কুট ধরে দিয়ে টেপি বললোচা খায়ে নেও, তারপর তোমার কথা শুনবো।

খানিকটা সাধাসাধির পর চায়ে হাত দিলো মাধাই।

কিন্তু মুখ নিচু করে চা খেয়ে মাধাই যখন চোখ তুলো ততক্ষণে টেপির সাজ-পোশাকের পরিবর্তন হয়ে গেছে। চোখে চশমা নেই, গলায় সেই ঝুটা মুক্তার মালা নেই। এ যেন খানিকটা নাগালের মধ্যে একজন।

মাধই বলল–টেপি, মানুষ আসার সময় হলো?

–না। বোসো। আজ মানুষ আসেনা। আমাক তোমার মনের কথা কও। এমন হলো কেন্‌? কী হইছে?

–এখানে আসছো কেন্‌?

মাধাই হাসবার একটা করুণ চেষ্টা করলো।

তখন টেপি বললো–তোমার কষ্ট সওয়া যায় না। দাদা, তুমি শুধু সুরতুন আর ফতেমাকে বাঁচাও নাই। তুমি জানো না, কতবার কত জায়গায় ধরা পড়ে আমি কইছি মাধাইয়ের বুন হই আমি।

হঠাৎ মাধাইয়ের মন ভাষা পেলো–কেন রে, দুনিয়ার সব মিয়েমানুষ কি আমার বুন হবি?

সে যেন একটা পরম কৌতুকবোধে হো হো করে হেসে উঠলো।

মাধাই উঠে দাঁড়ালো। টেপির মনে হলো এমন অদ্ভুত কথা কেউ কোনোদিন বলেনি।

সে বললো–তুমি তো জানোই আমাক ঘরে নিয়ে সুখী হওয়ার পথ আর নাই।

একটু তিক্ত হেসে মাধাই বললো–বুন হবা বলো, বুনই ভালো।

কিন্তু টেপির পল্লীর বাইরে পৃথিবী বহুবিস্তৃত। পাঁচ-সাতদিন ঊর্ধ্বশ্বাসে জীবন নিয়ে ছুটোছুটি করে মাধাই রেল কলোনীর একান্তে চাঁদমালাকে আবিষ্কার করলো।

এমন সময়ে আবার দেখা দিলো সুরতুন। দু-তিন মাসের ব্যবধানেই সুরতুন তার ধূলিমলিন স্বাভাবিক রূপে ফিরে গেছে। তার কথা ভাবতে ভাবতে মাধাইয়ের মন উদাস হয়ে গেলো। দু-চারদিন আগে এক গোঁসাইয়ের মুখে সে একটা গান শুনেছে : শাদা-শাদা পায়রা তোমার উঠোন থেকে মটর খেয়ে যায়। যদি তুমি চাও যে সে পায়রা থাকবে তবে ধরতে যেয়ো না। এই জীবনের কথা, ভাই মানুষ, শোনন, এই অবসরে বলা হলো। সুখকে ফাঁদ পেতে ধরা যায় না।

পায়রা উড়ে গেছে, সুখের পায়রা, তাই সুখও গেছে। ধরতে গিয়েই তো এই বিড়ম্বনা।

.

স্কুলের সেই মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে আজকাল নিয়মিত সপ্তাহে একদিন দেখা হয়। বাঁধা রুটিনে মাধাই রেলশ্রমিক সংঘের অবৈতনিক সহ-সংগঠন-সম্পাদক হিসেবে সভাপতি মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি যায়। রিপোর্ট দেয়। এবং রুটিন রিপোর্টের দস্তুরমতো তাতে আজকাল যথেষ্ট মিথ্যাও থাকে।

কিন্তু গোঁসাইয়ের গানের পরিসীমায় নিজের মনকে আবদ্ধ করে রাখতে পারলোনা মাধাই। সামান্য একটা ঘটনাকে অবলম্বন করে সে একটা আকস্মিক ধর্মঘট আহ্বান করে বসলো। খবর পেয়ে তার সংঘের অন্যান্য মন্ত্রী ও সভাপতি ছুটে এলো। ব্যাপার কী, মাধাই? কিছুই নয়। ব্যাপারটা একটা বড়ো রকমের ঘটনায় পর্যবসিত হতে পারতো, কিন্তু হয়নি;কারণ তার আগেই মাস্টারমশাই ও স্টেশনমাস্টারের মধ্যে আলাপ আলোচনা হলো, একটা সমাধানের সূত্র আবিষ্কার করা গেলো। ঘণ্টাতিনেক বিলম্ব করে গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। মাস্টারমশাই জনান্তিকে মাধাইকে মৃদু তিরস্কার করে বললেন, শক্তির অকারণ খরচ করলে, মাধাই।

কিন্তু মাধাইয়ের কাছে এ সবই মূল্যহীন। স্টেশনের সব কর্মচারী যখন ইউনুস ফিটারের অপমানের কথা, যা ধর্মঘটের মূল কারণ, এবং তার প্রবল শক্তিশালী কিন্তু অনির্দিষ্ট বন্ধুকে নিয়ে আলোচনা করছে, তখন সেই বন্ধু মাধাই বাসায় ফিরে ভাবলো : ইস্টিমবোঝাই এঞ্জিন, মনে কয়, দুনিয়া বাঁধে দ্যাও ল্যাজে,দুনিয়া নিয়ে ছুটবি, ক্যানিস্তার-টিন-বাঁধা কুকুর যেমন পাগল হয়ে ছোটে। কিন্তুক আজ দিলাম বন্ধ করে। ল্যাও, গলায় দড়ি বাঁধা কুকর, কত ছুট ছোটো।

মেয়েটির নাম চাঁদমালা, কিন্তু আশ্চর্য এই যে সে নিজেও জানে না তার নাম এটা। সে বলে চঁদমালা তার নাম নয়, আসলে সে চন্দ্রাবলী। মাধাই বললো, চন্দ্রাবলী, একপদ গান করো।

আপনে বড়ো বাজে কথা কন্‌।

কী আর বাজে কথা কলাম। আজ যা করছি শুনলে তুমি বুঝবা আমি কে। রেলগাড়ি দেখছো? ফোটিন ডাউন? কলকেতা শহরে যায় মাছ আর ঘি, দই আর ছানা নিয়ে। কলাম–যাবিনে আজ গাড়ি। গেলো না।

চাঁদমালা তার বোকা বোকা কাজল-আঁকা চোখে তাকিয়ে রইলো। ঘরের এক কোণে চাঁদমালার নীলের বড়োনাদাটা, তার পাশে একটা নেবানো উনুনের উপরে ইস্ত্রি দুটি। তার পাশে মাধাইয়ের আনা লাইন-দেখা আলো জ্বলছে। চাঁদমালা অত্যন্ত কালো, কিন্তু পালোয়ানি স্বাস্থ্য তার দেহে। দূর থেকে এই স্বাস্থ্যই আকর্ষণ করে। একটু পরিচিত হতেই মাধাই লক্ষ্য করেছে চাঁদমালা কল্পনাতীত বোকা।কাপড়-জামা হিসেব করে ফেরত দিতে পারে বটে, পয়সা আদায়টা ঠিক ঠিক করতে পারেনা। পশ্চিমা সেই ধোবাটির মৃত্যুর পর থেকে চাঁদমালা মাধাইয়ের মতোই নিঃসঙ্গ।

কিন্তু চন্দ্রাবলী, গান না হয় না করো, নাচো একটু।

কী জ্বালা!

চন্দ্রাবলী, মদ খাবা?

রোজই তো কন্ একদিনও খাওয়ান না।

আচ্ছা, শনিবার আবার আসবো, সেদিন আনবো। সিগ্রেট খাবা?

মাধাই একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েকটা টান দিয়ে চাঁদমালার হাতে দিলো। চন্দ্রাবলী ভঙ্গি ভরে বিছানায় বসে সিগারেট নিলো।

আচ্ছা, চাঁদমালা, আগে তোমার ঘরে সোডার সোঁদা-সোঁদা গন্ধ থাকতো, আজ যে নাই। কাম ছাড়ে দিলা, দিন চলবে কেমন করে?

দুই সপ্তাহ হলো কাপড় আনি নাই। লোকেক কইছি কোমরীবাত।

খালে কী? তোমার মাংস খাওয়ার খরচই তো দিন একটাকা।

মাংস খাওয়া ছাড়ে দিছি। আপনে সেইদিন দুই টাকা দিয়ে গিছিলেন, তাতেই এ কয়দিন চালালাম কষ্টেসেষ্টে।

মাধাই কিছুক্ষণ চিন্তা করলো। তারপর বললো, চন্দ্রাবলী, আফিং খাবা?

সে খায়ে তো মানুষ মরে।

তোমারও বাঁচে কী সুখ?

চাঁদমালা এক নিমেষে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, গাল পাড়েন আপনে, আপনে আর আসবেন না।

কেন্‌, তোমার আগের লোক নাকি আফিং খাতো।

আগেও লোক থাকার কথা যদি বিশ্বাস করেন তাইলে আপনে আর আসবেন না।

কিন্তুক আফিং-এ নিশাও হয়। খাবা একদিন?

তা দিয়েন।

তা দিবো। কোকিয়ান খাবা, চন্দ্রাবলী?

সে কি?

বড়ো নিশা।

আপনে কিছুই দেন না। খালি কন্।

মাধাই হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালো।

সে কী, চলে যান?

এই নেও, টাকাটা ধরো। আফিং আনতি যাই।

আর একটা সিগ্রেট দিবেন। আর আমার একখানা কাপড়ের দরকার। কিনে দিবেন?

তা-ও দিবো। বলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা ছুঁড়ে দিলো মাধাই।

মাধাই সোজা স্টেশনে গিয়ে উপস্থিত হলো। একটা চায়ের দোকানে বসে সে বললো, ডবল ডিমের মামলেট দ্যাও, আর দুই পি রুটি। চা যে করবা ষাঁড়ের রক্ত হওয়া চাই।

চা-রুটিতে নৈশ আহার শেষ করে মাধাই দেয়ালঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো রাত এগারোটা পার হচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে চলতে চলতে সে দেখতে পেলো জয়হরি ডিউটিতে আসছে।

কী ভাই, ডিপটিতে আসলা?

আসলাম, কী করি কও? জয়হরি মুখ গম্ভীর করে বললো।

তোমার বড়ো ছাওয়ালডার তাড়াসে জ্বর শুনলাম।

এখানে বলা দরকার জয়হরির র‍্যাশান-কার্ডে একাধিক ছেলের হদিশ পাওয়া গেলেও তার সন্তান বলতে একটিমাত্র মেয়ে, এবং এ-খবর মাধাইয়ের জানা ছিলো।

না। অবাক হলো জয়হরি।

তবে?

বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হলো। জয়হরি মাধাইকে বুঝতে না পেরে সত্যি কথাটা বলে ফেলো।

মন কেমন করতেছে?

না। তেমন আর কী।

এরপর জয়হরিকে অবাক করে দিয়ে মাধাই প্রস্তাব করলো, তুমি বাড়ি যাও ভাই, বউয়ের পায়ে হাত রাখে মাপ চায়ে নিবা। আমি তোমার ডিপটি করে দিতেছি। জয়হরি ভেবেছিলো এটাও পরিহাস। কিন্তু ততক্ষণে মাধাই দক্ষিণের কেবিনের দিকে জয়হরির ডিউটি দিতে রওনা হয়ে গেছে।

বলা বাহুল্য, ডিউটি দিতে দিতে চাঁদমালার কথা মনে পড়লো না। মাধাই নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করলো–এটা ধরো বদূলির ব্যাপারের মতো। যার সঙ্গে খুব আলাপ হলো, রানিংরুমে বসে একসঙ্গে গালগল্প হাসিঠাট্টা করলাম সে বলি হয়ে গেলো একদিন। সম্বন্ধ পাতানো হয়েছিলো, মিটে গেলো। এই হচ্ছে সুরতুন।

কিন্তু মাধাই তখনো বুঝতে পারেনি যে যার সঙ্গে সম্বন্ধ নেই এটা বুঝতে চিন্তা করা দরকার, তাকে বিস্মৃত হওয়া যায় না।

তারপর সেই ঘটনাটা ঘটলো–সুরতুনের সঙ্গে তার দেখা হলো মিলিটারি ক্যান্টিনের সরু গলিতে। সজ্জিতানয় সুরতুন। একটু ক্লান্ত দেখালো তাকে, যেমন তাকে সাধারণত দেখায়। কিন্তু তার মুখের দিকে মুখ নামিয়ে অনেকটা সময় নীরবে চেয়ে ছিলো মাধাই। এত ঘনিষ্ঠ সে-দেখা যে সুরতুনের চোখের সূক্ষ্ম লাল শিরাগুলি তার চোখে পড়ছিলো, নিশ্বাসে নিশ্বাসে তার বুকের কাছে যে অস্পষ্ট নীল শিরাটা থরথর করে কাঁপছিলো সেটিও।

ঘরে ফিরে তার মনে পড়লো :সুরতুন তিরস্কারের এমন সুযোগ পেয়েও ছোটো একটি ভীত মেয়ের মতো নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। যেন নিজের কোনো অপরাধের জন্য দুঃখপ্রকাশ করবে।

সে তখন ভাবলো–আচ্ছা বোকা আমি। তখন-তখনই সুরতুনকে ডেকে আনার জন্য সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো; কিন্তু এগিয়ে যেতে পারলো না, খানিকটা সময় তার কোয়ার্টারের সম্মুখে অস্থিরভাবে পদচারণ করে বেড়াতে লাগলো।

মাধাই একদিন মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে গেলো।

কে, মাধব? এসো, এসো। এমন অসময়ে যে?

কথাটা পাড়া সহজসাধ্য নয়; সূত্র হিসাবে যতগুলি কথা মাধাই মনে মনে স্থির করলো কোনটিই তার পছন্দ হলো না। শেষ পর্যন্ত সে বলে ফেলো, আন জাতের মেয়ে বিয়ে করার নিয়ম কী?

মাস্টারমশাইয়ের কৌতুক বোধ হলো। সেটা দমন করে সে বললো, তুমি করবে নাকি?

যদি করি মন্তর পড়ার কী হবি, পূজার কী হবি?

ওসব করতেই হবে এমন কী কথা আছে?

ওছাড়া অন্য মিয়েমানুষ আর বউয়ে কি তফাৎ থাকে?

তারা যদি হিন্দু হয় তবে মন্ত্রপড়ার ব্যবস্থা করা যায়।

আর যদি হিন্দু না হয়?

মাধাই, বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে বিবাহসম্পর্ক স্থাপনের জন্যে সরকারি আইন আছে।

সেরকম বউ কি লোকে গণ্যমান্য করে?

তা করে বৈকি।

মাধাই মুখ নিচু করে বসে রইলো, তারপর হঠাৎ অভিমানের সুরে বললো, যুদ্ধের হুড় হাঙ্গামায় আমি যেন বুঝতে পারি নাই আমি কী চাই। আপনেরা ভদ্দরলোক হয়েও কেন ধরবের পারলেন না আমার কী দরকার। সংঘের কাজ-কামে তারপরেই লাগায়ে দিতে পারতেন।

বক্তব্যটিকে বিশদ হওয়ার সুযোগ না দিয়ে মাধাই উঠে পড়লো। সমগ্র দিনটি সে মাস্টারমশাই-এর কথাটা একটি মূল্যবান আহরণের মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। একসময়ে সে স্থির করলো কিন্তু তারও আগে নিজে পরিষ্কার হতে হবে। চাঁদমালার মলিন শয্যা পরিহার নয় শুধু, নিজের এতদিনের ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ, শয্যা, সবই যেন পরিহার্য।

রাত্রিতে বিছানায় শুয়ে চাঁদমালার কথা মনে হলো। তার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতা, তার বোকামির জন্য একটা সহানুভূতি অনুভব করতে লাগলো সে। তাহলে এটাই কি পাপ? কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে প্রতিভাস্ফুরণের মতো একটা কথা তার মনে হলো গঙ্গাস্নান করে পরিষ্কার হওয়া যায়। একদিনে হবি নে। দিন দশ-পনেরো গঙ্গার ধারে থাকে রোজ স্নান করা লাগবি।

কথা শুধু কথাই নয়। জয়হরিকে বললো মাধাই, সে কাশী যাবে, অন্য কাউকে বললো মাসির বাড়িতে যাচ্ছে। তীর্থযাত্রার কথা পূর্বাহে প্রকাশ করলে ফলশূন্য হয় পরিক্রমা, এরকম একটা কথা সে কখনো কারো কাছে শুনে থাকবে, তাই এত ছলনা। প্রকৃতপক্ষে সে মনিহারিঘাটে যাওয়াই স্থির করলো। গ্রামে থাকতে সে শুনেছিলো পিতৃপুরুষের অস্থি বিসর্জনের পক্ষে মনিহারিঘাটই প্রশস্ত। তা যদি হয় তবে তার চাইতে পবিত্র কে?

মাধাই সত্যি ছুটি নিলো, সত্যিই একদিন ট্রেনে চেপে বসলো। সে-সময়ে সুরতুনকে একবার দেখার লোভ হলো তার।

.

সুরতুন লক্ষ্য করে দেখলো, সেজীবনের একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। যতদিন মোকামের দর আর এখানকার দরের পার্থক্য লাভজনক থাকবে ততদিন গোঁসাইয়ের এই কুটিরেই সে বাস করবে। অত্যন্ত পরিশ্রমসাপেক্ষ, তবু দুবেলা আহারের নিশ্চিত সুযোগ। স্বাবলম্বনের তৃপ্তিটাও যেন উপভোগ করা যাচ্ছে।

একদিন বন্দরের দোকানগুলির সম্মুখ দিয়ে চলতে চলতে সে হাসি হাসি মুখে থেমে দাঁড়ালো। একটা বিড়ি কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ব্যাপার। একজন বয়স্ক লোক মাথায় লালপাগড়ি বেঁধে, গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে আর পায়ে ঘুঙুর বেঁধে গান করছে, নাচের ভঙ্গিতে পা ঠুকে ঠুকে ঘুঙুর বাজাচ্ছে। আর দুটি ছেলে রাধাকৃষ্ণ কিংবা রাজারানী সেজে দাঁড়িয়ে আছে।

তখন বেলা হয়েছে। গান বাজনা বেশিক্ষণ আর চললো না। মূল গায়ক গলা থেকে। হারমোনিয়াম খুলে কাছের একটা চায়ের দোকানে বসলো। রানীও তার কাছে রইলো, কিন্তু রাজা চঞ্চল চোখে এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে সুরতুন যেখানে বসে চাল বিক্রি করছিলো তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

আমাক চিনছো?

হয়, চিনলাম। রানী কি তবে জয়নুল? কবে আসছিস?

পেরায় চারদিন।

ইয়াজ কনে?

তা কী জানি।

সোভান তাদের মাস দু-একের ইতিহাস গলগল করে বলে গেলো। তার সারমর্ম এই : কিছুদিন ভিক্ষা করার পর তারা অবশেষে মোকামের দিকে এক শহরে এক বিড়ির কারখানায় চাকরি নিয়েছে। বিড়ি বাঁধতে পারে না, দিনে দশ-বারো ঘণ্টা একটা টিনের পাতের মাপে বিড়ির পাতা কাটাই তাদের কাজ। দু’বেলা হোটেলে খায়, রাত্রিতে সেখানকার স্টেশনে শোয়। এখন তারা সফরে বেরিয়েছে, ফিরে গিয়ে সেই কাজই করবে আবার।

যাবার সময় সোভান বললো, যাওয়ার আগে তোমার হাতের রান্না খায়ে যাবো।

চার-পাঁচ দিন পরে এক সন্ধ্যায় টেপির মায়ের ঘরের কাছাকাছি এসে সুরতুন জয়নুল, সোভান আর তাদের সঙ্গীহারমোনিয়ামওয়ালাকে আবিষ্কার করলো। কি রে, তোরা আসছিস?

আলাম, রাঁধে খাওয়াও। এনাকেও ধরে আনছি। কিন্তু অপরিচিত বয়স্ক একজন লোককে সে কী করে সমাদর করবে? সুরতুন একটু ইতস্তত করে বললো, তোদের দুইজনেক না হয় রাধে দিলাম, কিন্তুক ওনাক কী রাঁধে দিবো? রাঁধে দিলেও কি খান?

লোকটি এই প্রথম কথা বললো, বাবরি চুল দুলিয়ে সে বললো, বেহুলা যদি রাঁধে, খায় না কে? যদি কও, সুন্দরি, হাটবাজার করে আনি।

সোভান লোকটির ভুল ধরিয়ে দিলো, ওর নাম সুরেরা, সুন্দরি না। এখন না হয় আমরা মাসি কবো।

লোকটি বললো, তা ধরো যে সুরৎ আর সুন্দর একই হলো।

সুরতুনের নীরবতায় সম্মতি পেয়ে যেন লোকটা বাজারে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।

সুরতুন বললো, তাইলে কলাপাতা, আনাজ, তেল আর ঝাল মসলা আনবেন।

সে রাতটি শুক্লপক্ষের ছিলো, কাজেই পরিচ্ছন্ন উঠোনটা চাঁদের আলোয় ধৰ্ধকরছিলো। জয়নুল সারাদিনের ক্লান্তিতে উঠোনে গামছা পেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো, সোভান বয়স্কদের ভঙ্গিতে বসে বিড়ি টানছে। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে সুরতুন দেখতে পেলোলোকটি হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে আছে।

সুরতুন তাকে বললো, যেমন করে গ্রামের মেয়েরা ফকিরবাউলকে বলে, আর একটা গান করেন।

লোকটি কিছু বললো না। কিন্তু সুরতুন রান্না করতে করতে শুনতে পেলো, একটা গান ধরেছে। লোকটি।

গোঁসাই গান করে। তখন তার হাসি হাসি মুখের দিকে চাইলে সুরের চাইতে কথা, এবং কথার চাইতে গায়ককে বেশি ভালো লাগে। কিন্তু এ লোকটির গানের তুলনায় গোঁসাইয়ের গানকে নিষ্প্রভ মনে হয়।বহুদিন সে যাত্রার দলে সখী সেজে গান করেছে, এবং এখন যে গানটি করছে সেটা পানোন্মত্ত কোনো রাজার নৃত্যশালার দৃশ্য থেকে আহরণ করা। সুরতুন না জেনে ভালো করেছিলো।

এদের রাত্রির ট্রেন ধরে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু আহারাদির পর প্রথমে জয়নুল এবং পরে সোভান বিশ্রাম করতে চাইলো। লোকটিও রাজী হতে পেরে খুশি হয়ে বললো, কাল সকালের ট্রেনে গেলিও যাওয়াই হবি!

জয়নুল ঘরের হদিশ জানতো। সে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সোেভান নিজের বয়সের মর্যাদা দেখানোর জন্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে জয়নুলকে অনুসরণ করলো। সারাদিনের রোদ লেগেছে গায়ে, নেচে নেচে পথ চলেছে তারা–এমন নিশ্চিন্ত মায়ের কোলের মতো আশ্রয় পায়নি তাকে দিন। সোভান আর জয়নুল দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লো।

রান্নাঘরের কাজ শেষ করে এসে সুরতুন এইবার চরম বিব্রত হয়ে পড়লো। ঘরে ঢুকে দেখলো জয়নুল ও সোভান দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবরিওয়ালা লোকটি উঠোনে তার হারমোনিয়ামের পাশে বসে আছে। এখন সে কী বলবে, কী করবে, এই হলো সুরতুনের চিন্তা।

ছাওয়ালরা ঘুমালো?

তা ঘুমালো।

তারপরই আবার দুজনেই থেমে গেলো।

লোকটি একটা বিড়ি ধরিয়ে চিন্তা করার মতো মুখ করে বসে থেকে থেকে অবশেষে বললো, এ বাড়ি গ্লোমার? এই জমি-জিরাতও তোমার?

না।

তবে পরের বিষয় পাহারা দেও?

তাও না।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ করে থেকে লোকটি বললো, তাইলে এক কাম করা যাক। হারমনি আর ঝোলা ঝক্কর ঘরে থাক। ইস্টিশনে যাই, কাল পরভাতে আসবো।

লোকটি বিদায় নিলে সুরতুন শুতে যাবে এমন সময়ে মনে পড়লো তার শাড়িটার দু-এক জায়গায় সেলাই করা দরকার। কুপিটার পলতে বাড়িয়ে দিয়ে সূচ-সুতো নিয়ে বসলো সে। কয়েক মুহূর্ত পরে পায়ের শব্দে সে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো। সে তত গোঁসাই নয় যে বলবে-দরজা খোলা আছে, মানুষ হও এসো।

জাগে আছো? পথ চিনে ইস্টিশনে যাবো এমন ভরসা পালাম না। চাঁদের আলোয় পথঘাট সব সমান দেখাতিছে।

হারমোনিয়ামওয়ালা ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে বললো, ভাবলাম কপালে যা আছে, ফিরে যাওয়াই লাগবি।

কাছাকাছি দাঁড়িয়ে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে সুরতুনের মনে হলো, ঝাকড়া চুল আর মুখের লাবণ্যহীনতায় লোকটিকে যত বয়স্কই মনে হোক এই হাল্কা-পলকা লোকটি প্রকৃতপক্ষে ইয়াজদের বয়সীহবে, অন্তত সে সুরতুনের নিজের চাইতে বয়সে ছোটো হবে এতে আর সন্দেহ নেই। লোকটি যেন ভয়ে হাঁপাচ্ছে।

ভয় পাইছো?

না, ভয় আর কী? নতুন জায়গা, গা ছমছম করে।

এখন আর কোন কাজই বা আছে, বসে বসে গান করো।

লোকটি গান ধরলো কিন্তু গাইতে পারলো না, তার গলা কেঁপে কেঁপে যেতে লাগলো। থেমে গেলো সে।

কী হলো?

হয় না।

কেন্‌? এখনো ভয়?

জান্‌নে।

অনেকদিন যাত্রা করেছে লোকটি। নিজের কথা না বলে, কিংবা নিজের কথা কী করে বলা যায় তা বুঝতে না পেরে, সে নায়িকা সেজে দাঁড়ালে তাকে লক্ষ্য করে অন্য কেউ হয়তো যা বলেছে, সে কথা কয়টি সে বলে ফেলো, প্রাণ পুড়ে যায়, পাদপদ্ম বিনে শীতল হয় না।

এও যেন আর একটি গান, তেমনি ভাষা। সুরতুন বললো, পাদপদ্ম কী?

সে বললো, কন্যে, তোমার বিহনে আহারে আমার রুচি নাই।

সুরতুন খিলখিল করে হেসে উঠলো।

এরকম অনুভব সুরতুনের জীবনু কখনো হয়নি। হারমোনিয়ামওয়ালার অবাস্তব ভাষা, অবাস্তব ভঙ্গি, তার ভয়, তার রোগা-পল্ক চেহারা, তার বয়স সম্বন্ধে সুরতুনের নিজের ধারণা সুরতুনকে এক ধরনের সাহস যুগিয়ে দিলোগোঁসাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে টেপির মা যেমন টিপে টিপে হাসে তেমন অকুতোভয়তাতার ছেঅবিশ্বাস্য বোধহতো। কিন্তু তার নিজের মধ্যে কোথাও লুকনো ছিলো এমনি যেন তার এই সাহস সত্তার সাময়িক প্রকাশ। তার ইচ্ছা হলো সে টেপির মাকে অনুকরণ করবে। সে বললো, পেরাণের পোড়ানি কমছে?

হারমোনিয়ামওয়ালা কথাটায় প্রশ্রয় পেয়ে এগিয়ে এসে সুরতুনের একখানা হাত নিজের হাতে নিলো।

কালো রোগা রোগা হাতের উপর নিজের পুষ্ট হাতখানা লক্ষ্য করলো সুরতুন। সে বললো, আমার আঙুলগুলি কী হবি?

সুরতুন, কও, তুমি আমাক দয়া করবা?

সুরতুন খিলখিল করে হাসতে হাসতে বাইরে এসে দাঁড়ালো। চাঁদের আলোয় চরাচর আচ্ছন্ন। সে নিজের অভূতপূর্ব অনুভবটাকে নির্ণয় করার চেষ্টা করতে লাগলো। একেই কি সাহস বলে! তার সঙ্গীরা কি এর অভাবকেই তার মধ্যে আবিষ্কার করে আলোচনা করতো। এর অভাবেই কি সে মাধাইয়ের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছে?

আমি আসবো?

আসো না কেন, কে আটকায়। সুরতুন হাসলো।

কাছে এসে লোকটি বললো, সুন্দরি, আজকের এই চান্দের আলোয়—

সুরতুন বললো, একটুক জল খাবো, গরম লাগতিছে। পুকুরের থিকে জল আনে দেও।

 হারমোনিয়ামওয়ালা বললো, কলস নিয়ে যাতে পারি যদি পথ দেখাও।

তা দেখাবো।

দুপুররাত্রিতে পুকুর থেকে জল আনতে যাচ্ছে লোকটি, সুরতুন আগে আগে যাচ্ছে। পথে খানা-খন্দ ঝোঁপঝাড়। লোকটি একবার হোঁচট খেয়ে বললো, বাবা, ই কী পথ!

পথের যে জায়গাটায় সবচাইতে বেশি জঙ্গল সেখানে হঠাৎ সুরতুন অদৃশ্য হয়ে গেলো। হারমোনিয়ামওয়ালা দেখলো, সে যে-জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছে তার চারদিকেই আশশেওড়ার ঝোঁপ, আর সেগুলির মধ্যে মধ্যে সরু সরু পথ। ঝোঁপগুলি যেমন প্রত্যেকটি অন্যটির মতো দেখতে, তেমনি সেই সরু পথগুলি।

কোথায় গেলা, সুরতুন? পুকুরের পথ কোন দিকে?

সাড়া না পেয়ে লোকটি ভাবলো সুরতুন এগিয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি খানিকটা ছুটে গিয়ে দেখলো.যে পথ ধরে সে চলেছে সেটার প্রান্ত একটা বড়ো ঝোঁপড়া জঙ্গলে গিয়ে শেষ হয়েছে।

থমকে দাঁড়িয়ে হারমোনিয়ামওয়ালা ডাকলো, সুরৎ!

কে যেন খিলখিল করে হেসে উঠলো।

সে ভাবলো, পাশের ছোটো ঝোঁপটা ডিঙিয়ে যেতে পারলে সুরতুনের কাছে পৌঁছনো যাবে। বলপ্রয়োগ করে ঝোঁপ সরিয়ে চলতে গিয়ে পাঁচ-ছটা কিংবা তারও বেশি কাঁটা তার হাতেপায়ে বিধে গেলো। ইস্ উস্ করে ঝোঁপটা থেকে বেরিয়ে এসে সে বললো, তুমি হাসো, সুরতুন,

আমার পরাণ যায়।

কেন, কী হলো?

স্বরটা যেন তার বাঁ দিক থেকে এলো। সে দিকটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার। অনেকটা দূর ঘাসে ঢাকা মাঠ দেখা যাচ্ছে। হারমোনিয়ামওয়ালা দৌড়ে খোলা জায়গাটা পার হতে হতে বললো, এইবার তোমাক ধরছি।

অনেক দূরে বড়ো জঙ্গলটার মাথায় মাথায় কয়েকটা পাখি কবা কবাক্ করে উঠলো।

পিছনে ফিরে সে দেখবার চেষ্টা করলো কুঁড়েঘরগুলি কোথায়। ঘরগুলি অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে, সেগুলি সহজেই চোখে পড়লো। হারমোনিয়ামওয়ালা কলসি মাটিতে রেখে কর্তব্য চিন্তা করলো। সে শুনেছে এর আগে এমন নির্জন মাঠে এমনি ঘটনা ঘটেছে। দিশেহারা মানুষ সারারাত পথে-বিপথে ছুটে সকালের দিকে কোনো মজাপুকুরে কিংবা দ’য়ে ডুবে প্রাণ হারায়। ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাকে সে দেখেছিলো সে হয়তো সুরতুন নয়। হয়তোবা সুরতুন ঘরে ফিরে এতক্ষণ ঘুমোচ্ছে। ঘরের দিকে ছুটতে ছুটতে তার মনে হলো–তা না হলে এমন রূপ, এমন হাসি!

পিছন থেকে কে যেন খিলখিল করে হাসলো, মিঠিয়ে মিঠিয়ে বললো, পালাও কেন?

তাকে থমকে দাঁড়াতে হলো। পথের মাঝখানে সুরতুন দাঁড়িয়ে।

হারমোনিয়ামওয়ালা বললো, ঘরে চলো, জল আনবের আমি পারবো না।

আমার কলস কোথায়?

হারাইছে।

ঘরে ফিরে এসে হারমোনিয়ামওয়ালা সোভান-জয়নুলকে ডেকে তুলো, রাত ভোর হয়, ট্রেন ধরবের হবি নে?

ঘুমন্ত ছেলে দুটিকে ঠেলতে ঠেলতে খানিকটা দূর অত্যন্ত দ্রুত হেঁটে একসময়ে সাহসের ভাব নিয়ে হারমোনিয়ামওয়ালা পথের উপরে দাঁড়ালো। ইতস্তত করে জয়নুলকে সে বললো, আচ্ছা, তোরা কস, এখানে তোরা আগেও আসছিস।কখনো রাত করে পুকুর থিকে জল আনতে কেউ কইছে?

না। তা কবি কে?

হারমোনিয়ামওয়ালা কী ভাবলো, তারপর মাথা দুলিয়ে বললো, সেবয়স তোদের হয় নাই।

পানীয় জলের খোঁজে সুরতুন রান্নাঘরে গেলো। ততক্ষণে কুপির তেল নিঃশেষে পুড়ে গেছে। হাতড়িয়ে টেপির মায়ের কলসটি সে বার করলো। চাঁদের আলোয় নিয়ে দেখলো কলসের তলায় জল চকচক করছে। পোকামাকড় থাকতে পারে এই ভেবে নিজের পরনের শাড়ির আঁচলটায় কলসের মুখ ঢেকে সেই কাপড়ে মুখ রেখে চুষে চুষে অনেকক্ষণ ধরে জলটা খেলো সুরতুন।

শরীরটা কিছু স্নিগ্ধ হয়েছিলো। সে ভাবলো, এখুনি ঘুম এসে যাবে।

সকালে ঘুম ভাঙলেও অনেকটা বেলা পর্যন্ত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে গড়িয়ে গড়িয়ে একসময়ে সে উঠে বসলো। স্বগতোক্তি করলো রাত-বিরেতে এমন ছুটোছুটি করলে গায়ে ব্যথা হয়। সে মোকামে গেলো না। তখন কেউ যদি সুরতুনের মুখ দেখতো তবে তার মনে হতে পারতো তার চাহনির পরিবর্তন হয়েছে, চোখের কোণ দুটি চঞ্চল হয়েছে।

.

একদিন ট্রেনে উঠতে গিয়ে সুরতুন নিঃশব্দে সরে এলো। গাড়ির কামরার সামনে মাধাই। দাঁড়িয়ে।

সে ট্রেনেই উঠলো না সুরতুন।

মাধাইকে আজ অন্যরকম দেখিয়েছে। রেলের বোতাম বসানো শাদা একটা কোট পরেছে মাধাই বাবুদের মতো। খাকির পোশাকে নেই বলেই কি এমন দেখিয়েছে? তাকে বলশালী বলে বোধ হলো না।

নিজের হাসি সবসময়ে দেখা যায় না, কিন্তু সুরতুন আজ মাধাইয়ের কথা ভাবতে মিঠিয়ে মিঠিয়ে হাসলো একবার।

এক দুপুরে বসে বসে সে নিজের টাকার হিসেব নিলো। গেজে ও আঁচলে ভাগ করে রাখা টাকা-পয়সা নোট গুনে-গেঁথে দেখলো, তেরো টাকায় পরিণত হয়েছে তার মূলধন।

টাকাপয়সা সব আঁচলে বেঁধে সে বেরিয়ে পড়লো।

দিঘা বন্দরের দোকানের পথ এখন তার অপরিচিত নয়।

বাজারের ঠিক মাঝখানে একটা কাপড়ের দোকানের সম্মুখে গিয়ে সুরতুন দাঁড়ালো।

কী চাই?

শাড়ি।

দোকানদার তাকে দু-একখানা শাদা শাড়ি দেখালো।

সুরতুন বললো, রঙিন নাই?

দেখেশুনে একটি শাড়ি সে পছন্দ করলো, কালো জমিতে লাল চওড়া দাঁত-দেওয়া পাড়। কিন্তু দাম দিতে গিয়ে সে বিপন্ন বোধ করলো। দশ টাকায় একখানা কাপড়! কিন্তু শেষ পর্যন্ত শাড়িটা কিনলো সে।

শেষ সম্বল অবশিষ্ট তিনটি টাকা শক্ত করে আঁচলে বেঁধে বাজারের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালো সে।

হঠাৎ তার চোখে লাগলো, তিনজোড়া রেশমি চুড়ি কিনলো সে।

বাজার থেকে বেরুনোর পথে তার চোখ পড়লো একটা ইরানীর দোকানে।

ইরানী বললো, সুর্মা লেবে?

কতকে?

দো-আনা শিশি।

দেও একটা। ওটা কী, সাপান?

দো-আনা।

দেও একটা।

এই সময়ে দোকানের এক অংশে সুরতুনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। লাল মোটা কাঁচের বড়ো বড়ো পুঁতির তৈরি একটা মটরমালা। মটরের মধ্যে মধ্যে আবার কাঠি পরানো। সুরতুন মালাটা চেয়ে নিয়ে হাতে করে ওজন দেখলো। সুতোয় গাঁথা নয়, পেতলের তারে বসানো, লক্ষ্য করলো। তারপর সে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছিলো, তখন ইরানী নিজে উঠে এসে মালাটা তাকে পরিয়ে দিলো। ঠাণ্ডা কাঁচ গায়ে লেগে সুরতুনের গা হিম হয়ে গেলো।

অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, কতকে?

ইরানী বললো, তিন রুপেয়া।

সুরতুন হারটিকে খুলবার জন্য আঁকুপাঁকু করতে লাগলো। সে বললো, তিন টাকা নাই।

কত আছে?

দুই টাকা। তা আমার খাতে আট আনা লাগবি।

ইরানী ভঙ্গি করলো, মিথ্যা বললো, অবশেষে বললো, খানেমে চার আনা রাখো।

সুরতুন চার আনা পয়সা রেখে আর সব দোকানদারের হাতে তুলে দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো।

সুরতুন প্রথমে স্থির করলো বাঁধের ডোবায় স্নান করতে যাবে। তেমনি করে বিসর্জন দেবে পুরনো কাপড় যেমন একবার দিয়েছিলো। মাথা ঘষবে, হাতেপায়ে সাবান দেবে। আয়না? মানে যাওয়ার পথে অবশিষ্ট সম্বল সিকিটা দিয়ে একটা চিরুনি, একটা খুব ছোটো আয়না হয় কিনা দেখতে হবে।

কিন্তু কোথা থেকে এক লজ্জা এসে বাধা দিতে লাগলো। বাঁধে যাওয়া হলো না। বিকেলের আলো যখন পড়ে এসেছে পুকুর থেকে সে স্নান করে এলো। মাথা ঘষা হলো না কিন্তু শুধু জল দিয়ে চুলের ময়লা যতদূর সম্ভব উঠিয়ে দিলো।

সন্ধ্যার অন্ধকারে নতুন শাড়ি পরে সুরতুন দিঘার পথ ধরলো।

মাধাইয়ের কোয়ার্টার্সের অনতিদূরে তাকে একবার থামতে হলো। ঘরের ভিতরে যেন মানুষ চলার শব্দ হচ্ছে, আর সে শব্দ তার নিজের বুকের মধ্যে গিয়ে ঘা দিচ্ছে। বুকের নিচে তার অন্তরদেশ থরথর করে কেঁপে কেঁপে উঠছে। বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়ে সে একটা খুঁটি চেপে ধরলো। পা টাল খাচ্ছে, সেটা সামলাতে হবে, পালানোর প্রবল ইচ্ছাটাকেও বাধা দিতে হবে।

খোলা জানলায় চোখ পড়তে সে বিস্মিত হলো, বিস্ময়ের টানে এগিয়ে গেলো। মাধাই ঘরে নেই, এমনকী তার শয্যা-উপকরণ, জামাকাপড় কিছু নেই। সে কি ঘর ভুল করেছে? বারান্দা থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে ঘরখানিকে চিনবার চেষ্টা করলো।

তখন তার মনে হলো, এখনই সে স্টেশনে ছুটে যাবে। রেল কোম্পানির যত লোক আছে সকলকে সে জিজ্ঞাসা করবে মাধাই কোথায় গেলো।

কিন্তু দুর্নিবার একটা অভিমানও হলো তার–কেন, চলেই যদি যাবা আমাকে কলেই হতো সেদিন? ঝরঝর করে জল নামলো চোখ থেকে। অন্ধের মতো কিন্তু দ্রুতপায়ে টেপির মায়ের বাড়ির দিকে সে হেঁটে যেতে লাগলো।

কখনো সে নিজেকে দুষলোবেশ হইছে! মাধাই কি হারমোনিওয়ালা!

দুদিন সুরতুন ঘর থেকে বার হলো না। তৃতীয় দিনে টেপির মা ফিরলো।

একা যে?

গোঁসাই ঘর ভোলার জায়গা দ্যাখে।

সে কী! কেন্‌?

তা শোনো নাই? এদিকে ইটের ভাটা হবি। তার জন্যি না, গোঁসাই কয় সে-জায়গা এর চায়ে ভালো।

ও কী?

আসতে আসতে দেখলাম পথে পড়ে আছে বনবিলাই। নিবি?

কী করবো?

পোষ না কেন।

আহারাদি করে, গোঁসাইয়ের জন্য ভাত নিয়ে টেপির মা চলে গেলো। দুপুরটা সুরতুন স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। বনবিড়ালটার সামনের একটা পা ভেঙে গেছে। সেটা ঘরের এক কোণে বসে সুরতুনের দিকে প্যাটপ্যাট করে চেয়ে রইলো। টেপির মায়ের কথা মনে এলো। কোথায় এর চাইতে ভালো জায়গা পেলো কে জানে। এ ঘরগুলির জন্য এতটুকু মোহ আছে বলে মনে হয় না, যদিও হয়তো এর কিছু কিছু অংশ এখান থেকে নিয়ে যেতে পারে তারা। কিংবা যদি সুরতুনের প্রয়োজন হয় এখানে ঘর এমনই থাকবে।

উদাস কথাটা সুরতুন জানে না কিন্তু একটা ঔদাস্যে তার মন ভরে উঠলো। দুপুরের পর একসময়ে চাল আনার ঝোলাটায় তার সামান্য যা সম্বল তা পুরে নিয়ে সুরতুন ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। কোনদিকে যাবে তার কোনো স্থিরতা নেই। _ চলতে শুরু করে তার মনে হলো বনবিড়ালটার কথা। বিস্মৃতপ্রায় অতীতে তার যে বনবিড়াল পুষবার সখ ছিলো তা মনে হলো।

বনবিড়ালটাকে কোলে তুলে নিয়ে সুরতুন বললো, মাদী! তা মিয়েমানুষ হয়ে পরাক্রোম দেখাবের যাওয়া কে?

প্রাণীটি হিংস্র। সেটার আহত পাটাকে বাইকে রেখে অন্য থাবাগুলি চটের থলি দিয়ে ঢেকে নিলো সুরতুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *