২০. উত্তরণ: বেশ্যা থেকে যৌনকর্মী
গণিকাপল্লির স্থায়ী বাসিন্দা গণিকাদের ‘যৌনকর্মী’ বা ‘বেশ্যা’ যাই বলা হোক না-কেন, তাঁদের ‘যৌন-ক্রীতদাসী’ বলাটাই সবচেয়ে যুক্তিসংগত। সিটি কলেজের অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্টভাবে বলেছেন–”যাঁদের দেহ বেঁচে খেতে হয়, তাঁদের ‘যৌনকর্মী’ বলে এই কুপ্রথাটিকে এক ধরনের অনুমোদন (স্যাংশান) দেওয়ায় আমার প্রবল আপত্তি আছে। পদ্মলোচন নাম দিলে অন্ধের দৃষ্টি ফেরে না। দেহব্যাবসা শ্রেণিসমাজের বহু কলঙ্কের একটি শ্রেণিপূর্ব সমাজে এমন কোনো কুৎসিত পেশা ছিল না। জীবনধারণের কোনো উপায় না থাকলে তবেই মেয়েদের এই পথ বেছে নিতে হয়–তার কারণ বেছে নেওয়ার মতো আর কোনো বিকল্প তাঁদের থাকে না। এই পেশা বন্ধ করাই হবে শ্রেণিহীন সমাজের দিকে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কাজ। ‘যৌনকর্মী’ নাম দিয়ে, ট্রেড লাইসেন্স চালু করে যাঁরা এই পেশাটাকে টিকিয়ে রাখতে চায়, তাঁরা আসলে শ্রেণিসমাজেরই পক্ষে : আরও বহুরকম শোষণের মতো এই শোষণেও তাঁদের কোনো আপত্তি নেই।” (টপ কোয়ার্ক, ডিসেম্বর, ২০০৪, ৬৯ পৃষ্ঠা)।
রামকৃষ্ণবাবুর সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই হাজার হাজার বছর ধরে যৌনপেশা চলে আসছে। ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করেও নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। ‘অবৈধ’ পেশা দেগে দিয়েও হাজার হাজার বছর ধরে যৌনপেশা চলে আসছে। সারাবিশ্বে রমরমিয়ে যৌনপেশা চলছে নানা বৈচিত্র্যে। পৃথিবীতে এমন কোনো পেশা নেই, যা রাষ্ট্রের কঠোর হস্তক্ষেপে বিলুপ্ত হয়েছে। বিলুপ্ত করতে পারেনি। কারণ চাহিদা থাকলে জোগান থাকবেই। চাহিদা নির্মূল করা কি সম্ভব? আগে চাহিদা নিমূল করুন, তখন দেখবেন স্বাভাবিক নিয়মেই জোগান বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও এটা একটা অবাস্তব চিন্তা। যৌন-চাহিদা এমন এক চাহিদা, যা একটি মৌলিক চাহিদা। আমরা নানাভাবে সেই চাহিদা মেটাই। কেউ বিয়ে করে মেটায়, কেউ যৌনকর্মীর কাছে গিয়ে মেটায়, কেউ পরকীয়ায় মেটায় দুপুর ঠাকুরপো’ হয়ে, কেউ হস্তমৈথুনে মেটায়। আর যে এসব কিছুই করে উঠতে পারে না, সে যৌন-অবদমনে ডুকরে মরে।
শরীর বিক্রির পেশাকে ‘যৌনকর্ম বা পেশায় যুক্ত মেয়েদের যৌনকর্মী’ হিসাবে চিহ্নিত করা বড়ড়াই বিভ্রান্তিকর। কারণ যৌনকর্ম বলার মধ্যে দিয়ে গণিকাবৃত্তিকে কর্ম বা পেশার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। মূলত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে এ ধরনের যৌনাচারের সিস্টেমকে বিশাল পুঁজি বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে যৌনশিল্প বা সেক্স ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করেছে। পৃথিবীর এই সেক্স ইন্ডাস্ট্রিগুলি নারীমাংসের বেচাকেনা করে বিলিয়ান বিলিয়ন ডলার ঘরে তোলে। অর্থগৃধু আর লালসায় নারীও স্বয়ং এবং স্বেচ্ছায় শরীর-ব্যাবসায় নেমে পড়েছে চড়া দর হাঁকিয়ে। সব মিলিয়ে কেবল নারীত্বের আবমাননাই নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় স্বয়ং নারী এবং নারীর চারপাশ তাঁকে ‘পণ্য’ বা ‘মাল’ হিসাবে চিত্রিত করেছেন। তবে আমার মনে হয় যাঁরা যৌনকর্মী শব্দটি জীবিকা হিসাবে বর্ণনা করতে চাইছেন, তাঁরা হয়তো এটাই উদ্ভাবন করতে চাইছেন যে, এই শব্দটি দ্বারা যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত নারীদের নামের সুপ্ত কলঙ্ক খণ্ডন করা যাবে, তাঁদের কর্মী বা শ্রমিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে। যৌনপেশার যুক্ত নর-নারীদের কর্মী বা শ্রমিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়তো করা যাবে একদিন–আজ, না হয় কাল। তাই বলে কলঙ্ক ঘোচানো যাবে কখনো? কখনোই নয়। নামবদলে কলঙ্ক ঘুচবে এটার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
তবে ‘যৌনকর্মী’ শব্দটি ইউনিসেক্স। কারণ শুধু নারীরাই যৌনকর্ম করে না, পুরুষরাও করছে। পুরুষদের গণিকা, পতিতা, বেশ্যা বলা যায় না। কারণ এই শব্দগুলো স্ত্রীবাচক বিশেষণ। অতএব ‘যৌনকর্মী একটি যথার্থ বিশেষণ। সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। এই মুহূর্তে যাঁদের যৌনকর্মী বলা হচ্ছে, তাঁদের আজও বলা হয়, বেশ্যা, পতিতা, গণিকা, বারাঙ্গনা ইত্যাদি। এই শব্দগুলির সবকটাই স্ত্রীলিঙ্গবাচক। কেবল নারীরাই এই পেশা করে, এটাই বোঝাত। কিন্তু এখন সময় বলেছে। এখন কেবল নারীরাই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না। যুক্ত হচ্ছে। পুরুষরাও। পুরুষ যৌনকর্মীদের জন্য কোনো শব্দ সৃষ্টি হয়নি। সেক্ষেত্রে যৌনকর্মী’ শব্দটি নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণির যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের বোঝায়। সম্বিত একজন বেশ্যা বা পতিতা, ব্যাকরণগতভাবে ভুল। সম্বিত একজন যৌনকর্মী, ব্যাকরণগতভাবে সঠিক। তেমনি সুপ্রিয়া একজন যৌনকর্মী, এ কথা বললে একজন নারীই যৌনকর্মী বলে চিহ্নিত করা হয় না। যৌনকর্মী নারী ও পুরুষ উভয়ই। কোনো লিঙ্গের সমস্যা নেই। তবে সাইড এফেক্ট হিসাবে যেটা পাওয়া গেল, তা হল ‘যৌন’। অর্থাৎ পেশায় কর্ম কী, যোনি বা যৌনাঙ্গের ব্যবহার। অর্থাৎ যিনি যৌনাঙ্গের ব্যবহার করে, তিনিই যৌনকর্মী। নামচিহ্নে প্রকট হয়ে উঠল পেশার ধরন। দেহ নয়, কেবলই যৌনাঙ্গ। শরীর নয়, শরীরের একটা অংশ। কিন্তু বাস্তবিক পুরোপুরি তো তা নয়। একজন যৌনকর্মীর কাছে সকলেই যৌনকর্ম (Intercourse) করতে আসে না। সময় কাটাতেও অনেকে আসেন। বহু এমন কর্মী আছে যাঁরা পুরুষদের কাছ থেকে অর্থ নেয় শুধু শরীর মর্দন করেই। আবার অনেক মহিলা আছেন পুরুষ যৌনকর্মীদের অর্থ দেয় শুধুমাত্র শরীর মর্দন করিয়ে, অন্যান্য সঙ্গদানের বিনিময়ে। সবসময়ই যে যৌনকর্মের বিনিময়ে অর্থ আদানপ্রদান হয়, তা তো নয়।
এখন প্রশ্ন হল, যৌনকর্ম কি কোনো কর্ম? আমি বলি অবশ্যই কর্ম। আমরা সবাই শরীরের কোনো না-কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ব্যবহার করে কাজ করি। কেউ হাত, কেউ পা, কেউ চোখ, কেউ মুখ, কেউ কান দিয়ে কাজ করি। যৌনকর্মীরা যৌনাঙ্গ সহ গোটা শরীরকে লাগিয়ে কাজ করে। কাজটা ‘সেক্স করা’ বলে সেটা কর্ম নয়? এ কেমন কথা! সেক্স একটি স্বাভাবিক কর্ম। যৌনকর্মীরাও তো সেক্সই করে। পার্থক্য একটাই, বিবাহ বহির্ভূত সেক্স। যৌনকর্মীদের যৌনকর্ম উচ্ছেদ করলেই কি বিবাহ বহির্ভূত যৌনকর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাবে? কখনোই নয়। এরপর যৌনকর্ম করে অর্থোপার্জনের প্রসঙ্গ। বিবাহ সম্পর্কিত যৌনকর্ম বিনা খরচায় হয়? হয় না। অনেকে মনে করেন, গণিকাবৃত্তিকে ‘কর্ম’ বললে তা আসলে গণিকাবৃত্তিকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। হ্যাঁ, হয়। অবশ্যই হয়। তাতে আপত্তি কীসের? হাজার হাজার বছর ধরে সারাবিশ্বে কর্মের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বলে কি যৌনপেশা বিলুপ্ত হয়ে গেছে! হয়নি, উল্টে বৃদ্ধি পেয়েছে, পাচ্ছে। এই পেশাকে বৈধতা দিন বা অবৈধ বলুন, পেশা কিন্তু চলবেই। বরং আরও আধুনিকীকরণ হবে এবং হচ্ছে।
যৌনকর্মীরা কি শ্রমিক? এমন প্রশ্নে উচ্চ আদালতের আইনজীবী অশোক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেছেন–“চরম দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে যে সমস্ত মেয়েগুলোকে ধরে এনে দেহব্যাবসা করানো হচ্ছে, তাঁদের পুনর্বাসন না-করে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে আরও জাঁকিয়ে ব্যাবসা করার দাবি জানানো হচ্ছে। এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? যৌনকর্মীরা চাইছে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, ভাবা যায়! আরে বাবা, ব্যাবসা হল সাধারণত দু-রকম। এক, সুস্থ ও আইনি ব্যাবসা। দুই, অসুস্থ ও বেআইনি ব্যাবসা। এখন যে ব্যাবসাটা আপদমস্তক অসুস্থ ও বেআইনি, তার আবার ট্রেড ইউনিয়ন কীসের, আমার মাথায় তো কিস্যু ঢুকছে না। আর এই দাবির পিছনে যুক্তিটা কী, না আইনের অধিকার পেলে যৌনকর্মীদের ব্যাবসা করতে আরও সুবিধা হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই ব্যাবসা চালাতে আজও কি আইন তাঁদের স্বীকৃতি দিয়েছে? দেয়নি। সুতরাং যে পেশা বা ব্যাবসার কোনো আইনি ভিত্তিই নেই, সে ব্যাবসার আবার পরবর্তী সুযোগসুবিধা নিয়ে ভেবে লাভ কী? আজ যৌনকর্মীরা তাঁদের শ্রমিক বলে দাবি করছে। তাঁদের গতর খাটানোর সঙ্গে শ্রমিকের গতর খাটানোর তুলনা করছে। খুব নিষ্ঠুর অর্থে তাঁদের এবং শ্রমিকের গতর খাটানোর এই তুলনাটা মেনে নিলেও জানতে ইচ্ছে করে একজন যৌনকর্মীর পক্ষে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি একজন শ্রমিকের মতো উৎপাদন করা সম্ভব? সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, সমাজের প্রতি একজন শ্রমিকের দায়বদ্ধতা, একজন যৌনকর্মীরও কি সেই সমান দায়বদ্ধতা আছে! নিশ্চয় নয়। যদিও তাঁদের বক্তব্য, যৌনকর্মী না-থাকলে আজ ঘরে ঘরে এই ব্যাবসা হত, যে ব্যাবসা বন্ধ করেই নাকি সোনাগাছি, প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট, কালীঘাটের মতো যৌনপল্লির প্রয়োজন। এটা একেবারেই অযৌক্তিক কথা। যেমন অযৌক্তিক তাঁদের দাবি। আরে বাবা, আইনের স্বীকৃতি পেলেই কি মানুষের মানসিকতা, সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ পালটে যাবে?” (টপ কোয়ার্ক, ডিসেম্বর ২০০৪, ৭০ পৃষ্ঠা)
অশোকবাবুর জন্য আমার একটাই প্রশ্ন–অন্ধ হয়ে থাকলে কি প্রলয় থাকে? আইনজীবী অশোকবাবুর সঙ্গে আমার কয়েকটা পয়েন্টে দ্বিমত আছে। অশোকবাবু প্রশ্ন করেছেন—(১) একজন যৌনকর্মীর পক্ষে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কি একজন শ্রমিকের মতো উৎপাদন করা সম্ভব? অশোকবাবু, শ্রমিক মাত্রই কি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত? তাহলে যাঁরা উৎপাদন করে না তাঁরা শ্রমিক নন? যাঁরা পরিসেবা দেন তাঁরা শ্রমিক নন? শ্রম দান করেন যিনি তিনিই তো শ্রমিক। তাই না? শ্রম দান করে যে রোজগার করে, তাঁর রোজগারকেই তো পারিশ্রমিক বলে। সেই শ্রমদান শুয়ে শুয়ে, বসে বসে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, দৌড়ে দৌড়ে যে-কোনোভাবেই হতে পারে। বড়ো মুখ করে আজ যাঁদের শ্রমিক বলি, তাঁদেরও একদা শ্রমিক ও শ্রমের মর্যাদা দিতে চায়নি রাষ্ট্রগুলো। তখনও আপনাদের মতো মানুষেরাই শ্রমিকের দাবির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অনেক রক্তের বিনিময়ে আজ তাঁরা শ্রমিকের মর্যাদা পেয়েছেন। সেও তো প্রায় ১৩৫ বছর হয়ে গেল। এককথায় বলতে গেলে যিনি শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক, তবে আইনের ভাষায় হওয়া উচিৎ—যিনি মজুরি বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক। শ্রমিকের সংজ্ঞা হবে–শ্রমের বিনিময়ে যিনি মজুরি গ্রহণ করেন তিনিই শ্রমিক অথবা মজুরির বিনিময়ে যিনি শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে কৃষকরা তাঁদের মজুরি বৃদ্ধি এবং কাজের উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ার জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা জন বল তার এক বিখ্যাত বক্তৃতায় বলেন, “জন্মের সময় সব মানুষই সমান। যখন আদম ও হাওয়া পৃথিবীতে এসেছিল, তখন কি তারা ভদ্রলোক ছিল?” শ্রমিকরা প্রায়ই তাঁদের পূর্বতন অধিকারের জন্য আপিল করত। উদাহরণস্বরূপ, ইংরেজ কৃষকরা যখন আন্দোলন শুরু করে, তখন তাঁদের বেশিরভাগ আন্দোলনই ছিল ঐতিহ্যগতভাবে পাওয়া সাম্প্রদায়িক জমিগুলো নিয়ে। ইংল্যান্ডে ১৮৩৩ সালে একটি আইন পাস করেছিল। যেখানে বলা ছিল যে, ৯ বছরের কম বয়সি কোনো শিশু কাজ করতে পারবে না, শিশুদের বয়স ৯-১৩ এর মধ্যে হলে দৈনিক মাত্র ৮ ঘণ্টা এবং বয়স ১৪-১৮ এর মধ্যে হলে দৈনিক মাত্র ১২ ঘণ্টা কাজ করতে পারবে।
১৯১৯ সালে শ্রমিক অধিকার রক্ষার জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা গঠন করা হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা পরবর্তীতে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ওঠে। জাতিসংঘ নিজেই তাঁদের মানবাধিকার সনদের ২টি আর্টিকেলে শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারে সমর্থন দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার (নিবন্ধ ৬-৮) চুক্তিতে বলা হয়েছে–(১) প্রত্যেকেরই কাজ করার, স্বাধীনভাবে কর্মসংস্থান পদ্ধতি বাছাই করে নেওয়ার, পছন্দের কাজের ক্ষেত্রে ন্যায্য ও অনুকূল শর্ত এবং বেকারত্ব থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার অধিকার আছে। (২) প্রত্যেকেরই কোনোরূপ বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের জন্য সমান বেতন পাওয়ার অধিকার রয়েছে। (৩) যারা কাজ করে তাদের প্রত্যেকেরই ন্যায্য ও অনুকূল পারিশ্রমিক পাবার এবং তাদের পরিবারের সকল সদস্যদের সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার এবং অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। (৪) সবারই তাঁদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার জন্য ট্রেড ইউনিয়নে যোগদানের অধিকার আছে।
শ্রমের অধিকার ও শ্রমিকের মর্যাদা আদায়ের লড়াই নতুন কিছু নয়। শ্রমিকদের প্রতি শোষণ ও বঞ্চনা তো অনস্বীকার্য। শ্রমিকদের দিয়ে উদয়াস্ত খাঁটিয়ে নেওয়ার অভ্যাস ছিল মালিকদের। শ্রমিকরা ছিল পশুর মতো। যথাযথ পারিশ্রমিক পর্যন্ত দেওয়া হত না। শ্রমিক যেন ক্রীতদাস। শ্রমিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক আটঘন্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা জমায়েত হয়েছিল। তাঁদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। এরপর ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে, ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক আটঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে “শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না-খাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন পয়লা মে তারিখে যে-কোনো আয়োজন হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সে জন্য ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দেই তিনি নাইটের সমর্থিত শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।
অতএব শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকারের লড়াই সেদিনও করতে হয়েছিল, আজও করতে হয়। আজ না হয় কাল, গণিকারা শ্রমিকের মর্যাদা পাবেই। কোনো জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতাই এটা আটকাতে পারবে না। শ্রমদান কে শুয়ে করবে কে বসে করবে, সেটা বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য সেটাই হবে কোনো ব্যক্তি সত্যিই শ্রমদান করছে কি না। অনেকের মনে হতে পারে, সেক্স করাটা একটা আরামের বিষয়, সুখের বিষয়। শ্ৰম কীসের? এটা সাধারণ যৌন-সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও পেশাদার যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। প্রতিদিন অসংখ্য ক্লায়েন্টের সঙ্গে যৌনসঙ্গম নিশ্চয় আরামের হতে পারে না। কোনো ছুটি নেই। কোনো ডিউটি আওয়ারস নেই। ২৪ X ৭ X ৩৬৫ দিন একটানা যৌনসঙ্গমে কতটা যৌনসুখ পাওয়া যায়? শরীরটা তখন শরীরের সেই বিরল সুখ দিতে পারে না, যন্ত্র হয়ে যাওয়া শরীর তখন যন্ত্রের যন্ত্রণা দেয় এবং তা হাসিমুখে হজম করতে হয়।
যৌনপল্লিতে কোনো পুরুষই পয়সা খরচা করে কোনো যৌনকর্মীকেই যৌনসুখ দিতে আসে না, যৌনসুখ বুঝে নিতে আসে। তাই যৌনকর্মীদেরও সর্বদা শরীর-মন সুস্থ-সবল-চাঙা রাখতে হয়। ইচ্ছা-অনিচ্ছার স্বাধীনতা সব যৌনকর্মীর থাকে না, বিশেষ করে যখন বাড়িওয়ালি কিনে কোনো মেয়েকে যৌনপেশায় নিযুক্ত করেছে। সে সব মেয়েরা একপ্রকার ক্রীতদাসীই। এইসব মেয়েদেরকে দিনে প্রচুর খরিদ্দারদের সঙ্গে শুতে হয় রোজগার বাড়ানোর জন্যে। তা না-হলে বাড়িওয়ালির ভাগের পয়সা মেটানো যাবে না। ফলে খরিদ্দারের সঙ্গে দ্রুত কাজ সেরে, পরের খরিদ্দারের সঙ্গে শোওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হয়। এইভাবে প্রতিদিন চলে। এঁদের শরীর বলতে একটি ফুটো’ ছাড়া আর কিছু নয়। শীঘ্রপতনের খরিদ্দার পেয়ে গেলে একটু রেহাই পায় বইকি। অনেক খরিদ্দার মনে করেন দীর্ঘক্ষণ সঙ্গম করলে বোধহয় পৌরুষত্ব দেখানো যায়। সেক্ষেত্রে এইসব যৌনকর্মীরা সময় হয়ে গেলে ঘর থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেয় কাস্টমারকে। তবে অবসন্ন ও দুর্বল শরীর দিক বা না দিক, বাবু’ এলে ‘বসতেই হবে। একটু দরিদ্র শীর্ণকায় যৌনকর্মীদের কখনো-সখনো শরীরের জেল্লা বাড়াতে গর্ভধারণও করতে হয়। গর্ভধারণ করলে বুক-দুটো ভারী হয়ে ওঠে, শরীরটাও গোলপানা হয়। পোয়াতি মেয়ের ভরা বুক ভরা শরীর অনেক খরিদ্দারকে তাতিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু সন্তান যতক্ষণ ধারণ করা সম্ভব ততক্ষণ ধারণ করে। তারপর গর্ভপাত। পেট খসাতে’ হাতুড়ে ডাকতে হয়। অনেকক্ষেত্রে ব্যাপারটা খুব বিপজ্জনক হয়ে যায়। জীবন সংকটে পড়ে যায়।
(২) সমাজের প্রতি একজন শ্রমিকের দায়বদ্ধতা, একজন যৌনকর্মীরও কি সেই সমান দায়বদ্ধতা আছে? শ্রমিকের সামাজিক দায়বদ্ধতা? একজন শ্রমিক কি সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে শ্রম দান করে নাকি? মোটেই না। একজন শ্রমিক তাঁর, তাঁর পরিবার এবং নিয়োগকর্তার কাছে দায়বদ্ধ। তা ছাড়া সে আর কারোর কাছে তাঁরা দায়বদ্ধ নয়। একজন যৌনকর্মীও কোনোরূপ সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে পারে না। একজন যৌনকর্মী আর পাঁচজন শ্রমিকের মতো তাঁর ও পরিবারের কাছে দায়বদ্ধ। অতিরিক্ত যে কাজটি একজন যৌনকর্মী তাঁর অজান্তেই করে ফেলে, তা হল মানুষের যৌন অবদমন থেকে সমাজকে মুক্তি দেয়। এটা সামাজিক দায় বইকি। প্রতি সুস্থ মানুষের যৌন তাড়না (লিবিডো) থাকবেই। সেই যৌন তাড়না থেকে মুক্তির পথ খুঁজে নেবে প্রতিটি সুস্থ মানুষ। এটা তাঁর মৌলিক চাহিদা ও অধিকার। আর যদি মুক্তির পথ খুঁজে না-পায়, তখন তা জোর করে অবদমন করতে হয়। এই যৌন অবদমনের ফলে মানুষ বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মস্তিষ্ক বিকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়। যে ব্যক্তি সারাজীবন যৌনতার সুযোগ পায় না, সে অপরিণতমনস্ক হয়। অকারণে ক্রোধী হয়। জীবনে অবসাদ নেমে আসে। সেই অবসাদ থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। যৌন অবদমন মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে।
যৌন তাড়না বা যৌন প্রবৃত্তি হল এমন চাহিদা যা সবাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। যৌন তাড়না কোনো ব্যক্তির সার্বিক যৌন প্রবৃত্তি বা যৌনকামনা। যৌন প্রবৃত্তি জৈবিক, মানসিক ও সামাজিক বিষয় কর্তৃক প্রভাবিত হয়। জৈবিকভাবে, যৌন হরমোনসমূহ ও সহযোগী নিউরোট্রান্সমিটারসমূহ যেগুলো নিউক্লিয়াস অ্যাকিউম্বেন্সের উপর ক্রিয়া করে (প্রাথমিকভাবে টেস্টোস্টেরন ও ডোপামিন), এগুলো মানবদেহে যৌন প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। কাজ ও পরিবারের মতো সামাজিক বিষয় এবং ব্যক্তিত্ব ও মনোদৈহিক চাপের মতো অভ্যন্তরীণ মনস্তাত্ত্বিক উপাদান বা বিষয়গুলোও যৌন প্রবৃত্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। পাশাপাশি শারীরিক অবস্থা, ওষুধপত্র, জীবনযাপন-প্রণালী, সম্পর্কের বিষয়াবলি ও বয়স (যেমন বয়ঃসন্ধি) দ্বারাও যৌন প্রবৃত্তি প্রভাবিত হতে পারে। কোনো ব্যক্তির যদি চরমভাবে বারংবার বা হঠাৎ করে যৌন তাড়না বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা থাকে তবে তাঁর হাইপারসেক্সয়ালিটি হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে, আর এর বিপরীত অবস্থাকে বলা হয় হাইপোসেজুয়ালিটি।
কোনো ব্যক্তির হয়তো যৌন আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের কোনো সুযোগ নেই, অথবা ব্যক্তিগত, নৈতিক বা ধর্মীয় কারণে সে উক্ত চাহিদা অনুযায়ী আচরণ করা থেকে বিরত থাকে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, কোনো ব্যক্তির চাহিদাকে অবদমন সসম্মানে গ্রহণ করা হতে পারে। অপরদিকে, কোনো প্রকৃত বাসনা ছাড়াও কোনো একজন ব্যক্তি যৌনাচরণে অংশ নিতে পারে। বিভিন্ন উপাদান মানব যৌন প্রবৃত্তিকে প্রভাবিত করতে পারে, যেমন শারীরিক ও মানসিক চাপ, অসুস্থতা ইত্যাদি। মানব সমাজে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরিতে ও তা বজায় রাখতে যৌন আকাঙ্ক্ষাসমূহ প্রায়শই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করে। যৌন আকাঙ্ক্ষার অভাব বা শূন্যতা উক্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। কোনো যৌন-সম্পর্কে যে কোনো সঙ্গীর যৌন আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন যদি বহাল থাকে বা সমাধান না-করা হয়, তবে তা সম্পর্কে সমস্যা তৈরি করতে পারে। কোনো সঙ্গীর অবিশ্বস্ততা এই ইঙ্গিতের আভাস বহন করতে পারে যে, কোনো সঙ্গীর পরিবর্তনশীল/পরিবর্তিত যৌন আকাঙ্ক্ষাবর্তমান সম্পর্কের মাধ্যমে আর তৃপ্ত হতে পারবে না। সঙ্গীদের মধ্যে যৌন আকাঙ্ক্ষার অসমতা বা যৌন আকাঙ্ক্ষাসম্পন্ন ও যৌনতাপ্রিয় সঙ্গীদের মাঝে নগণ্য যোগাযোগের ফলে সমস্যার উত্থান হতে পারে।
যৌন অবদমন থেকে যৌন বিকৃতি চরম মাত্রা পায়। মূলত যৌনতার মতো মানুষের শক্তিশালী জৈবিক প্রবৃত্তির মাত্রাতিরিক্ত দমনের ফলে তা বিকৃত যৌনাচারের দিকে যায়। ধর্ষণের মতো সামাজিক অপরাধ ঘটার এবং উত্তরোত্তর এর বিপজ্জনক প্রাদুর্ভাবের পিছনে বিভিন্ন কারণ কাজ করে। লৈঙ্গিক বৈষম্য, ক্ষমতা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিচারহীনতা, নারীর দুর্বল সামাজিক অবস্থান, নৈতিক অবক্ষয়, প্রজন্মের পর্নাসক্তি ইত্যাদি। কিন্তু এইসব কারণগুলোকে নেতৃত্ব দেয় অস্বাভাবিক যৌন অবদমন। মাত্রাতিরিক্ত যৌন অবদমন মানুষের অবচেতনে স্তরে স্তরে জমা হয়ে এক ধরনের বিকৃত মনস্তত্ব তৈরি করে। মানুষের মাঝে যৌন হিংসা এবং ধর্ষকামী মনোভাব আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। স্বাভাবিক যৌনতা থেকে বঞ্চিত হয়ে সমাজের সদস্যরা অবচেতনে ধর্ষকামী মনোভাব লালন করে থাকে। এমন না যে, প্রত্যেক অসচেতন ধর্ষকামীই পরবর্তীতে ধর্ষণ করে। বরং এর একটা বড়ো অংশ স্বাভাবিক সামাজিক জীবনযাপন করে যায় তাঁর ধর্ষকামী মনোভাবকে মনের অবচেতনে জমা রেখেও। মনের মধ্য ধর্ষকাম পোষণ করা মানুষেরাই পরবর্তীতে নৈতিক পুলিশের ভূমিকা পালন করে। সমাজের কোনো সদস্যের যে-কোনো রকমের চরিত্র বিচ্যুতির ঘটনায় এঁরা উৎফুল্ল হয়ে উক্ত ঘটনার রসালো আলাপ বাজারে চালু রাখে এবং এভাবেই তাঁদের ধর্ষকামকে তাঁরা প্রশমিত করতে চায়।
ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মন প্রচণ্ডভাবে গতিশীল এবং এই মন’ নামক মানবিক উপাদানটি সহজাত প্রবৃত্তি, তাড়না, বিরোধ, গূঢ়ৈষা, অবদমন ইত্যাদির মতো কিছু ইচ্ছামূলক ক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমরা আমাদের সমাজব্যবস্থায় অবস্থান করি বিভিন্ন বিরোধ আর বাধাকে গ্রাহ্য করে এবং এর ফলে আমরা কখনোই সম্পূর্ণ। স্বাধীন নই। আমাদের চিন্তারও নেই কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রবাহ। যে কামনা, বাসনা আর যৌন তাড়না একটি মানুষ বিভিন্ন সামাজিক নিয়মকানুনের জন্য তৃপ্ত করতে পারে না, সেই অতৃপ্তি-জাত ইচ্ছেগুলোকেই অবদমিত হয়ে স্থান করে নেয় মানুষের মনের অচেতন স্তরে। এই অচেতন স্তরেই অবদমনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় এক ধরনের বিপরীতমুখী বিরোধ ও বাধার, যা লজ্জা, ভয়, দুঃখ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন মানসিক বা মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে থাকে। মানুষের যে ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি, যার জন্য সে অতৃপ্ত, সেই অবদমিত অতৃপ্তি ও ইচ্ছাগুলোই অচেতন স্তর থেকে স্বপ্ন হয়ে বেরিয়ে আসে বা বাস্তবে তার প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ে যায়। ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনুযায়ী মনের চেতনও অবচেতন স্তরের সমন্বয়ে তৈরি হয় একজন ব্যক্তিমানুষের অহং। সামাজিক অহং সবসময় বাস্তবতায় নিয়মকানুন মেনে চলে এবং অচেতনে বন্দি কামজ ইচ্ছা বা বাসনাকে সমাজ-বাস্তবতায় আসতে দেয় না। ফ্রয়েডের সংশোধিত মতবাদে অহং আংশিক চেতন ও আংশিক অচেতন রূপকে গ্রাহ্য করা হয়েছে।
ফ্রয়েড কথিত আংশিক চেতন অহংকে আমরা শুধু অহং হিসাবেই চিহ্নিত করব এবং অচেতন অহংকে বলব অদ। অদ সবসময় সুখসূত্র মেনে চলে—জৈবিক সুখ, কামনা, বাসনা ইত্যাদির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন চায় অদ। অদের জৈবিক কামনা, বাসনা ও তাড়না যেহেতু সবসময় সমাজের নিয়মকানুন মানে না, সেহেতু অহং, অদের সব ইচ্ছে পূরণ হতে দেয় না বাস্তবতার সূত্র গ্রাহ্য করে। অদের যে কামনা, বাসনা বা ইচ্ছা সমাজের নৈতিক আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, তা অপূর্ণ থেকেই অবদমিত হয়ে অচেতন মনে জমা হতে থাকে। যে অহং বাস্তবতার সূত্র মানে, তাকে ফ্রয়েড অতি-অহং বা অধিসত্তা হিসাবেও চিহ্নিত করেছেন।
ফ্রয়েড তাঁর মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বে মানুষের যৌন-আকাক্ষা, অবদমন এবং শৈশবকালীন যৌনতার বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, মানুষের আত্মরক্ষামূলক কাজ হল অহং প্রবৃত্তি। কামপ্রবৃত্তির উপাদান হিসাবে আমরা সব ধরনের প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুপ্রীতি, আদর, সোহাগ ইত্যাদিকে চিহ্নিত করতে পারি। কামপ্রবৃত্তির উপস্থিতি হল একজন মানুষের জৈবিক সংগঠনের মৌলিক উপাদান এবং এর ফলে একটি শিশুর জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আত্মকামী সত্তা হিসাবে যৌন অনুভূতিকেন্দ্রিক কামপ্রবৃত্তির দিকে এগিয়ে যায়। একটি শিশু জন্মের পর নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বাধীন সত্তা হিসাবে গ্রাহ্য করে না, এ অবস্থায় সে হয়ে ওঠে এক আত্মকামী ‘নার্সিসাস’। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি কিশোর যখন তার সমবয়স্ক অন্য কোনো কিশোরের ভালবাসা কামনা করে, তখন মনস্তাত্ত্বিক কারণেই এক ধরনের কামপ্রবৃত্তির সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা বলি সমকাম (এরকম যৌনচতনা যদি প্রাপ্তবয়স্ক স্তর পর্যন্ত চেতনায় থাকে তবে তা সমকামী বিষয় হিসাবে গণ্য হয়)। একটি শিশুর সমলিঙ্গ প্রেম সাধারণত বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় এবং একসময় তা নারী-পুরুষকেন্দ্রিক যৌন কামনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। কামপ্রবৃত্তির উপাদান হিসাবে আরও কিছু বিষয় নিয়ে তাত্ত্বিক ধারণা দিয়েছেন ফ্রয়েড, যার মাঝে ইদিপাস এষণা, ইলেক্ট্রা এষণা, মর্ষকাম, ধর্ষকাম, জীবনবৃত্তি এবং মরণপ্রবৃত্তি উল্লেখযোগ্য। একটি পুরুষ শিশু তার আত্মকামকে গ্রাহ্য করে বিপরীত লিঙ্গের মায়ের প্রতি যে যৌন-আকর্ষণ অনুভব করে এবং একই সঙ্গে সমলিঙ্গের পিতাকে ভালোবাসার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে চিহ্নিত করে যে ঈর্ষা ও ঘৃণা দেখায়, তাকে ফ্রয়েড ইদিপাস এষণা হিসাবে চিহ্নিত করেন। ইদিপাস এষণার বিপরীত মনস্তাত্ত্বিক উপাদান হল স্ত্রী-শিশুর পিতার প্রতি যৌন-আকর্ষণ এবং মাকে ঘৃণা ঈর্ষা করা, যাকে ফ্রয়েড বলেন, ইলেক্ট্রা এষণা, মর্ষকাম হচ্ছে ভালোবাসার পাত্র বা পাত্রী দ্বারা নিগৃহীত হয়ে যৌনসুখ নেওয়া, আর ধর্ষকাম হল ভালোবাসার মানুষকে নিপীড়ন করে যৌনতৃপ্তি পাওয়া। ফ্রয়েডের তত্ত্বের একটা বড়ো অংশজুড়ে রয়েছে যৌনতা বা অবদমিত কামনা। ফ্রয়েডের তত্ত্বে যেভাবে অবদমিত কামনা বা লিবিডোের ধারণা এসেছে ঘুরেফিরে, তাতে করে অনেকেই কানে তুলো খুঁজেছিলেন তঙ্কালীন সময়ে। কানাঘুসো করছিলেন–ছিঃ, আমরা কামসর্বস্ব! ফ্রয়েড কিন্তু বলছেন—ঠিক তাই, আর এটাই হল নিদারুণ বাস্তব। এমনকি মানবশিশুর বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে ধাপেধাপে ভেঙে তিনি দেখিয়েছেন, সেখানেও কেমনভাবে যৌনতার ভূমিকা আছে।
বিশ্বের যে-কোনো সাহিত্যে আমরা যৌন অবদমনের প্রসঙ্গ পেয়েছি। দুনিয়া কাঁপানো লেখা লিখছেন সাদাত হোসেন মান্টোর মতো লেখকরা। এমনকি বাংলা সাহিত্যেও পেয়েছি। শুরু হয়েছে রবীন্দ্র-পরবর্তী প্রথা-ভাঙা সাহিত্যচর্চা। সাহিত্যে তখন উত্তাল কল্লোল যুগ। বুদ্ধদেব বসুর কলমে তখন বজ্রনিঘোষ। সময়ের ডাকে বাংলা সাহিত্যে হু-হু ঢুকে পড়ছে যৌনতা। আর ঠিক এই সময়ে দেখা যাচ্ছে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দাসাহিত্যেও ফ্রয়েডের ‘অবদমিত কামনা’ চলে আসছে। অবদমিত যৌনতা সাহিত্যেও এড়ানো যায়নি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছুরি’ বলে একটা গল্পের বিষয় হল—এক যুবক একটি বন্ধকি কারবারের দোকান চালায়। যুদ্ধের বাজারে গোরা সৈনিকরা জিনিসপত্র বাঁধা দিয়ে টাকা ধার নেয় সেখান থেকে। এমনই একজন লোক একদিন একটা ছুরি বাঁধা দিতে আসে সেই যুবকের দোকানে। ছুরিটা খুব সামলে রাখতে বলা হল। এদিকে বাড়িতে তাঁর রুগ্ন বিগতযৌবনা স্ত্রী। তাই সে অর্থে যুবকের যৌনজীবন বলে কিছুই নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, তার জন্য আক্ষেপও নেই তাঁর সচেতন মনে। কিন্তু ছুরিটা হাতে পাওয়ার পর থেকেই সব যেন কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। ওই ছুরি যেন যুবকের অবদমিত কামনার প্রতীক হয়ে দাঁড়াল। সে প্রথমে ওই ছুরিটা তাঁর দোকানের নরম গদির উপর বিধিয়ে দিল। সে কী অপার্থিব অনুভূতি! তারপর একদিন মাঝরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তার এক কুকুরকে ওই ছুরি চালিয়ে মারল। তারপর সেদিন এসে গেল, ওই ছুরিটা চালিয়ে দিল তাঁর স্ত্রীর শরীরে। শরীর এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে দিল যুবকটি। একবার নয়, বারবার বিধিয়ে দিয়ে যেন এক অপার্থিব সুখ পেল। বলাই বাহুল্য, বন্ধকি কারবারি ওই যুবক যে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে যৌনভাবে অতৃপ্ত ছিল, তা কিন্তু সরাসরি কোথাও বলা হয়নি গল্পে। শুধু তাঁর হালকা আভাস দিয়েছিলেন লেখক। ওই ছুরিটা হল যুবকের অবদমিত যৌনতার প্রতীকমাত্র। ওটা হাতে পেয়েই যুবকের অবদমিত কামনা জেগে উঠেছিল। আর ওই ছুরি সে নরম গদি থেকে শুরু নরম শরীরে বিধিয়ে বিঁধিয়ে নিজের সাপ্রেসড সেক্সকে পরিপূর্ণ করল। ছুরি যেন লিঙ্গের প্রতীক হয়ে গেল।
হ্যাঁ, যৌনকর্মীদের যতই হেলাফেলা করি না-কেন, যতই অবজ্ঞার চোখে দেখি না কেন, তাঁরা অজান্তেই সমাজের সেফটি ভালভ, যাঁরা যৌন অবদমনের ভয়ংকরতা থেকে সমাজকে মুক্তি দেয়। এটা নিদারুণভাবে উপলব্ধি করতে পারব সেদিন, যেদিন ‘অলৌকিকভাবে গোটা পৃথিবী থেকে যৌনকর্মীরা উধাও হয়ে যাবে। অতএব চোখ বন্ধ করে রাখলে প্রলয় থামানো যাবে না।
আইনজীবীকে অনেকে রক্ষণশীল বলতেই পারেন। তাঁর সঙ্গে কেউ একমত হতেও পারেন, আবার না-ও হতে পারেন। তবে আমি বলব–প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সারা পৃথিবীতে যে বিপুল পরিমাণ নারী বা পুরুষ এই পেশার যুক্ত হয়েছেন বা হতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরা যেভাবেই হোেক তাঁদের শ্রমই বিক্রি করছেন। একদিনের বা এক মাসের নোটিসে এদের এই পেশা থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। একটি বড়ো শহরের সবকটি বড়ো বড়ো শিল্পপ্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে শহরে যেরকম দুর্যোগ বাড়বে, শ্রমিকদের যে করুণ পরিণতি হবে, এটিকেও সেভাবেই দেখতে হবে।
১৮৫৩ সালে তৈরি এক পুলিশ রিপোর্ট কলকাতার তৎকালীন চিফ ম্যাজিস্ট্রেট এলিয়ট গোটা কলকাতা শহরে ৪০৪৯ টি গণিকাদের ঘর আছে বলে স্বীকার করেন, যাতে বাস করত মোট ১২,৪১৯ জন গণিকা বা যৌনকর্মী। অর্থাৎ ঘরপ্রতি যৌনকর্মীর সংখ্যা ছিল ৩ জনেরও বেশি। ১৮৬৭ সালে কলকাতার হেস্থ অফিসার ফেভার টোনার যৌনকর্মীর সংখ্যা ৩০,০০০ জন সনাক্ত করেন। ১৯১১ সালের আদমসুমারিতে উল্লিখিত এ সংখ্যা ১৪,২৭১ জন। ১৯২১ এবং ১৯৩১ সালে আদমসুমারিতে সংখ্যাটি কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১০,৮১৪ এবং ৭,৯৭০ জনে। কিন্তু ১৯৩২ সালে বেঙ্গল উইমেনস ইউনিয়নের সভানেত্রী দাবি করেন যে, পুলিশের হিসাবে কলকাতার যৌনকর্মীর সংখ্যা ২০,০০০ জন। ১৯৩২ সালের পর অনেক জল গড়িয়ে গেছে গঙ্গা দিয়ে। এর মধ্যে গোটা ভারত উপমহাদেশে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিকের পটভূমি ব্যাপক উলটপালট হয়ে গেছে। গোটা বিশ্বজুড়ে বিশ্বযুদ্ধ সমস্ত মূল্যবোধের খলনলচে বদলে গেছে। এই বাংলায় একের পর এক মন্বন্তর। সবচেয়ে ভয়ানক ছিল পঞ্চাশের (ইংরেজি ১৯৪৩) মন্বন্তর। এই বাংলাতেই না খেতে পেয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছিল ৩০ লক্ষ মানুষ। যাঁরা মরেননি, তাঁরাও আর্থিকভাবে ব্যাপক প্রভাবিত হয়েছিল। অভাবের করাল থাবায় এবং বিশ্বায়নের কুফল হিসাবে দিকে দিকে দরিদ্রতা হু হু করে বেড়েছে, তার তালে তালে বেড়েছে নারী পাচার। অসংখ্য মেয়েরা পেটের জ্বালা নিরসনে যৌনপেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। কলকাতা সহ গোটা রাজ্যে হু হু করে বেড়েছে যৌনকর্মীর সংখ্যা, গজিয়ে উঠছিল অসংখ্য যৌনপল্লি।
দেবাশিস বসুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৩ সালে ‘অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেঙ্খ’ বিভাগের মহামারিতত্ত্ব বিভাগ যে জরিপ চালায়, তাতে কলকাতা ও হাওড়া শহরে মোট ১৯টি যৌনপল্লি চিহ্নিত হয়। প্রতিটি পল্লিতে যদি গড়ে ২০০ করেও ঘর ধরা হয়, তাহলে মোট ঘরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮০০টি এবং ঘরপ্রতি ৩ জন ধরলে যৌনকর্মীর সংখ্যা হয় ১১,৪০০ জন। ভাসমান যৌনকর্মীর সংখ্যা যদি ৮,৬০০ জন ধরা হয়, তবে এই সংখ্যাটি হবে ২০,০০০ জন। দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির হিসাবটা ঠিক এরকমই। তাঁদের মতে, কলকাতার মোট যৌনকর্মীর মধ্যে পাড়া-নির্ভর ১২,০০০ জন এবং ভাসমান ৮,০০০ জন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, এই সংখ্যায় আবাসিক হোটেল, সাধারণ গৃহকোণ এবং ফ্ল্যাটবাড়িভিত্তিক যৌন পরিসেবাকারীদের চিত্রটি নেই। নেই তাঁদের কথাও, যাঁরা গোপনে আড়ালে-আবডালে যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত, অথচ নিজেকে ‘যৌনকর্মী পরিচয় দেয় না। সে হতে পারে স্কুল-কলেজের ছাত্রী বা সাধারণ গৃহবধূ। এই ভাগে আরও ২০,০০০ জন থাকাও বিচিত্র নয়। এটি ধরা হলে কলকাতা শহরে মোট যৌন পরিসেবাকারীদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪০,০০০ জন।
তথাকথিত ‘নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনও গণিকাবৃত্তিকে বৈধতা দেওয়ার বিরুদ্ধে। তিনি এক লেখায় বলছেন–“পতিতাপ্রথাকে বৈধ করা মানে নারী নির্যাতনকে বৈধ করা। যে রাষ্ট্রে পতিতাপ্রথা বৈধ সেই রাষ্ট্র সত্যিকার কোনো সভ্যতা বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। গণতন্ত্র মানবাধিকার নিশ্চিত করে, নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করে। কোনো গণতন্ত্র মানুষের উপর নির্যাতনকে ছল-ছুতোয় মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে না। করতে পারে না। যদি করে, সেই গণতন্ত্রের নাম নিতান্তই পুরুষতন্ত্র, আর সেই সভ্যতার নাম বর্বরতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।” তসলিমা নাসরিন একটু মোটা দাগের নারীবাদী। মোটা দাগের বিবৃতি দিতেই বেশি পছন্দ করেন। তাই উনিই বলতে পারেন, “পুরুষরা যেমন খালি গায়ে ঘুরে বেড়ায় নারীরাও তেমনি খালি গায়ে ঘুরে বেড়বে।” যাই হোক তসলিমার বিবৃতি প্রসঙ্গে বলব, প্রতিটি দেশের সংবিধানে প্রতিটি ব্যক্তির পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছে। কে কোন্ পেশা স্বাধীনভাবে বেছে নেবে সেটাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রই নিজের পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেয়। কারোকে কোনো পেশায় বাধ্য করানো যায় না। বাধ্য করানোটাই অগণতান্ত্রিক।
তা ছাড়া পৃথিবীতে এমন হাজার হাজার পেশা আছে, যেগুলো মানুষের ইচ্ছা না-থাকলেও করতে বাধ্য হয়। সবার ভাগ্যে পছন্দের পেশাটি করে উঠতে পারে না। আমরা বেশিরভাগই অমলকান্তির মতো, যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে উল্লেখ করে আর-একটু বলতে চাই–“আমাদের মধ্যে যে এখন মাস্টারি করে,/অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,/যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল, উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।/অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।/অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।” কারণ অমলকান্তি অন্ধকার ছাপাখানায় কাজ করে। এরকম অনেককেই এমন পেশা বেছে নিতে হয়, যা তাঁর পছন্দের নয়, ভালোবাসার নয়, ভালোলাগার নয়। তবুও করতে হয় সারাজীবন। সবার ক্ষেত্রেই যে এমনটা হয়, তেমনটাও নিশ্চয়ই নয়। আবার বিকল্প পেলে পেশা পরিবর্তনও করতে পারে। যৌনপেশাও ঠিক তেমনি।
শুধু মেয়েরা নয়, পুরুষরাও এই পেশায় আসছে। বিকল্প নেই বলেই আসছে। কারণ সকলের জন্য বিকল্প থাকে না। স্কিল্ড বা দক্ষ হতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথেষ্ট পুঁজিও লাগে। দক্ষতা ও পুঁজি সবার থাকে না। অগত্যা যৌনপেশা বেছে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে নারী-পুরুষের মধ্যে। এই পেশাকে অবৈধ করে রেখে নির্মূল করার চিন্তা বাতুলতা মাত্র। বরং আমি মনে করি যৌনপেশাকে কেউ যদি স্বেচ্ছায় বেছে নেয়, তাহলে সেক্ষেত্রে এই পেশাকে ঘিরে অপরাধ প্রবণতা কমবে। একই সঙ্গে আমি এটাও বলব, এক্ষেত্রে কেউ যদি কোনো নারী বা পুরষকে যৌনপেশা করতে বাধ্য করে সেক্ষেত্রে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করুক রাষ্ট্র। যেমন পাচার, বিক্রি, জোর করে যৌনপেশায় বাধ্য করানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কঠোর নজরদারি থাক। এমনকি যাঁরা নারী বা পুরুষের যৌনপেশার পয়সায় (পরিবার ছাড়া) জীবনধারণ করে বা সেক্স ইন্ডাস্ট্রি পরিচালনা করে বা যৌনকর্মের জন্য বাড়ি ভাড়া দেয় তাঁদের কঠোরতম শাস্তি দিক রাষ্ট্র। যৌনকর্মীদের জন্য ন্যূনতম শাস্তি থাকা উচিত নয়। উল্টে যৌনকর্মীরা যাতে নির্বিবাদে তাঁর পেশা চালিয়ে যেতে পারে, তারজন্য সুরক্ষাকবচ দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে যেহেতু যথেচ্ছ যৌনসঙ্গম ভয়ংকর যৌনরোগের কারণ, সেহেতু যৌনকর্মে কন্ডোমের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোনো অজুহাতেই যৌনকর্মীরা কন্ডোম ছাড়া যৌনমিলন করতে পারবে না। করলেই মোটা অঙ্কের জরিমানা বা জেল বা উভয়ই ধার্য হোক। তাহলেই মানুষের প্রতি সুবিচার হয়। তার মানে এই যে, যৌনপেশাকে বৈধ করে দিলে সকলেই দলে দলে গণিকাবৃত্তিতে নাম লেখাবে, এটা ভাবা অমূলক—কষ্টকল্পনা। পৃথিবী এমন কোনো পেশা নেই যেখানে মানুষ দলে দলে নাম লিখিয়েছে। এই পেশাকে বৈধতা দিতে তাঁদেরই আপত্তি, যাঁদের কাছে এই পেশা অবৈধ থাকলেই সুবিধা বেশি বলে মনে করে।
‘Sex Worker’ (যৌনকর্মী) শব্দটি নতুন। এই শব্দটি নির্বাচনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দুনিয়া কর্মের বৈধতা দিল। অর্থাৎ যৌনপেশার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা নিজেদেরকে কর্মী’ ভাববে। অর্থাৎ গণিকারাও কর্মীর স্বীকৃতি পেল। গণিকারাও এখন নিজেদেরকে ‘যৌনকর্মী’ বলতেই পছন্দ করে। পতিতা বা গণিকা শব্দের ব্যবহার অল্পবেশি ব্যবহার থাকলেও ‘বেশ্যা’ শব্দটিই আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। আমাদের সমাজে ‘বেশ্যা’ শব্দটি যেমন যৌনকর্মীদের বিশেষিত হলেও সাধারণ মহিলাদের মধ্যেও ‘বেশ্যা’ সম্বোধন করে অপমান করা হয়। অর্থাৎ ‘বেশ্যা’ শব্দটি অপমানসূচক হিসাবেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বেশ্যা’ ও ‘বেশ্যাবৃত্তি’ শব্দের সঙ্গে সামাজিক ঘৃণা যুক্ত হয়েছে। অতএব ‘বেশ্যা’ শব্দটি কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। যদিও অনেকে বলছেন যৌনকর্মীর বিশেষণের মধ্যে সামাজিক মর্যাদা বা পেশাকে সম্মান দেওয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। আমি অবশ্য তা মনে করি না। এটাও যথেষ্ট অসম্মানজনক বিশেষণ। কারণ বেশ্যা ও যৌনকর্মী শব্দটির মধ্যে মর্যাদাগতভাবে কোনো পার্থক্য নেই। দীর্ঘদিন ধরে ‘বেশ্যা’ শব্দটি ব্যবহারে যেমন অশ্লীল হয়ে গেছে, তেমনি ‘যৌনকর্মী’ শব্দটিও অশ্লীল হবে। দুটো শব্দই সমান ঘৃণার। অবশ্য পৃথিবীতে এরকম অনেক পেশা আছে। যেগুলো ঘৃণার চোখেই দেখা হয় এবং সেই পেশার সঙ্গে জড়িত মানুষদেরও ঘৃণার চোখেই দেখা হয়। এটা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ। নাম পালটে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করা যাবে না। যাহাই লাউ তাহাই কদু।
তসলিমার সুরে সুর মিলিয়ে বলাই যায়–“নিজেদের যতই শ্রমিক বলে দাবি করুক, সমাজ জানে এঁরা বেশ্যার কাজই করছে। তকমা বদলালেই কি জীবন বদলাবে? মেথরের কাজকে জাতিভেদাশ্রিত সমাজ শ্রদ্ধার চোখে না-দেখলেও সেটা শ্রমিকের কাজ। কিন্তু বেশ্যাবৃত্তির কখনও এরকম ব্যাখ্যা হতে পারে না।” আসলে একটা শ্রেণির নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যেই ‘যৌনকর্মী’ শব্দটির উদ্ভব। সেটি হল কর্মের অধিকারে আইনি স্বীকৃতি। অর্থাৎ পেশার বৈধতা। বিপন্ন’ যৌনকর্মীদের সুরক্ষিত রাখতেই আইনি বৈধতার প্রয়োজন আছে বইকি। আইনি স্বীকৃতি দিলেই যে সব মহিলারা দলে দলে এই পেশায় অংশগ্রহণ করবেন, এটা যেমন ঠিক ভাবনা নয়–ঠিক তেমনি এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মহিলারা বুক চিতিয়ে ‘গতর খাঁটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই’ বলবে এটাও অনেকে মেনে নিতে পারছে না। যৌনপেশাকে যাঁরা শ্রমের মর্যাদা দিতে নারাজ, তাঁদের বক্তব্য–যে পথেই হোক, যৌনপেশাকে নিয়ে কখনোই আহ্লাদিত হওয়ার নয়। কারণ কোনো অপরাধই আইনগ্রাহ্য হতে পারে না। তাঁরা আরও বলছেন–“খাইতে পারিলে কে চুরি করে বললে কারোর চুরি করার অধিকার জন্মায় না। চৌর্যবৃত্তিও বৈধতা পায় না। তাহলে তো কোনো অপরাধীকেই শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। মানুষ তো পেটের জ্বালা মেটাতেই চুরি ডাকাতি রাহাজানি করে। শখ করে তো কেউ চুরি ডাকাতি রাহাজানি করে না।” চুরি ডাকাতি রাহাজানি আর যৌনপেশা কি এক জিনিস? চুরি ডাকাতি রাহাজানি কবে থেকে পেশা হল? চুরি ডাকাতি রাহাজানি অন্যের কষ্টার্জিত সম্পদ হরণ করে। অন্যের সম্পদ হরণ করা নিশ্চয় বৈধ হতে পারে না। সাধারণত অন্যের ক্ষতি করে এমন কোনো কাজই অপরাধ, বেআইনি। যৌনপেশায় যৌনকর্মীরা তো কারোর কোনো সম্পদ হরণ করে না, কারোর কোনো ক্ষতিসাধনও করে না। যাঁদের ইচ্ছে হবে তাঁদের কাছে যাবে, যাঁদের ইচ্ছে হবে না তাঁরা তাঁদের কাছে যাবে না। যৌনকর্মীরা তো কারোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না। বরং আমি সমর্থন করি–এই। পেশার সঙ্গে জড়িত আড়কাঠি, দালাল, মেয়ে পাচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। এঁদের বিরুদ্ধে এমন আইন তৈরি হোক যে আইনে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দেওয়া সম্ভব।
বিশ্বজুড়ে বহু যুগ (বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে) ধরে যে বিতর্ক চলছে, তা হল–গণিকাবৃত্তিকে কি আইনি বৈধতা দেওয়া উচিত? সেমিনারের পর সেমিনার হচ্ছে। নারীবাদীদের সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিকরাও নেমেছেন আসরে। কিন্তু বিতর্কের কোনো অবসান হচ্ছে না। আইনি বৈধতা নয়, এর সপক্ষে মোটামুটি দশটি যুক্তি পাওয়া যায়। যেমন–(১) গণিকাবৃত্তির আইনি স্বীকৃতি আসলে আড়কাঠি, দালাল, শরীর-ব্যবসায়ী বাড়িওয়ালিদের কাছে এক উপহারস্বরূপ। এই ছাড়পত্রের সুবাদে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠবে গণিকালয়, সেক্স ক্লাব, ম্যাসাজ পার্লার, মধুচক্র, যৌনঠেক ইত্যাদি। (২) গণিকাবৃত্তির বৈধতাদান বা নিরপরাধীকরণের অর্থ নারী পাঁচরকে উৎসাহিত করা। (৩) যৌনপেশার আইনি বৈধতা বা নিরপরাধীকরণ গণিকাবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং তাকে বাড়িয়ে দেয়। (৪) গণিকাবৃত্তি আইনি বৈধতা পেলে গোপনকর্ম আর গোপনে থাকবে না। প্রকাশ্যেই শরীর কেনাবেচার হাট বসে যেতে পারে। (৫) গণিকাবৃত্তির স্বীকৃতিদান ও নিরপরাধীকরণ যৌনপেশায় নাবালিকাদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে দেবে। (৬) গণিকাবৃত্তির আইনি স্বীকৃতি সাধারণ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না। (৭) যৌনব্যাবসা চাহিদা আরও বাড়িয়ে দেবে। আইনি প্রশ্রয় পেয়ে পুরুষকে নারীদেহের প্রতি আরও আকৃষ্ট করবে। (৮) আইনি বৈধতার যৌনপেশায় যুক্ত মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয় না। (৯) বৈধতা বলবৎ হলেও যৌনপেশায় যুক্ত মেয়েদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য বৃদ্ধি পাবে না। (১০) তদুপরি যৌনপল্লির স্থায়ী বাসিন্দারাই চায় না বৈধতা।
গণিকাবৃত্তিকে অবৈধ করলে গণিকারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যা তাদের প্রতি সহিংসতা, দারিদ্রতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো বিষয়ে দুর্বল অবস্থানে দাঁড় করায়। একজন সাধারণ নারীর তুলনায় একজন গণিকার ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামুলকভাবে অনেক বেশি। এমনকি গণিকাদের খুন হওয়ার সম্ভাবনাও সাধারণ নারীর তুলনায় বেশি। ২০১৫ সালের ৩০ জুন, বিবিসির একটি লেখায় ব্রেন্ডা মায়েরস পাওয়েল (Brenda Myers-Powell) নামের প্রাক্তন এক গণিকার ২৫ বছর উপস্থাপিত হয়েছে। তার ভাষায়–“I’ve been shot five times, stabbed 13 times–I don’t know why those men attacked me, all I know is that society made it comfortable for them to do so.” (আমাকে পাঁচবার গুলি করা হয়েছে, ছুরির আঘাত করা হয়েছে ১৩ বার। এসব মানুষগুলো আমাকে আক্রমণ করেছিল কেন তা আমি জানি না। আমি শুধু জানি, সমাজ তাঁদেরকে এসব কাজের জন্য একটি তৃপ্তিদায়ক অনুভুতি দেয়।)।
গণিকাবৃত্তি বৈধ হলে গণিকাদের উপর অমানবিক আচরণ এবং সহিংসতার জন্য তাঁদের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দারস্থ হওয়ার পথ খোলা থাকে, যা কিছুটা হলেও এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সহায়ক হবে। ব্রেন্ডা মায়েরস পাওয়েলের একজন প্রাক্তন গণিকা, যে কিশোরী মেয়েদের তাঁর মতো পথ থেকে দুরে রাখতে কাজ করছে। তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই তাঁকে একাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। অনেক প্রামাণিক লেখা থেকে জানা যায়, যেখানে গণিকারাই দাবি করছে গণিকাবৃত্তি তাঁদেরকে সক্ষমতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। নারীকে আর্থিক সক্ষমতার শক্তিশালী করে তুলেছে। অনেকক্ষেত্রে যৌন স্বাধীনতা না-থাকলেও অন্যান্য স্বাধীনতাগুলি ভোগ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। গণিকাদের অনেক লেখা ও সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে, গণিকাবৃত্তিকে নিজেদের মুক্তির কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ‘Quartz’ নামের অনলাইল সাইট তাঁদের ফেসবুক পেজে যৌনকর্মীদের লেনদেন নিয়ে এই ভিডিও প্রকাশ করে, যেখানে একজন গণিকা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবার কারণ হিসেবে গণিকাবৃত্তিকে সামনে নিয়ে আসে। স্বয়ং গণিকাদের এমন সাবলীল স্বীকারোক্তি গণিকাবৃত্তিকে অবৈধ করার রাখার পিছনে যুক্তি কি, আবার খতিয়ে দেখতে উৎসাহিত বস্তুত অবৈধ গণিকাবৃত্তি জোরপূর্বক শিশু গণিকাবৃত্তি, মানব পাচারের মত অপরাধগুলো বাড়িয়ে তোলে। অবৈধ গণিকালয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি না-থাকার কারণে গণিকাবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে এর পারিপার্শ্বিক অপরাধগুলোও সংগঠিত হতে থাকে, যা ধীরে ধীরে শুধুমাত্র ওই দেশ বা সমাজ না, পার্শ্ববর্তী দেশ, এমনকি পৃথিবীর অন্য প্রান্তেও সম্পৃক্ত অপরাধ বাড়িয়ে তুলতে পারে। গণিকাবৃত্তির বৈধতা গণিকালয় সম্পর্কিত অপরাধের উপর নজরদারি নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা তৈরি করে।
প্রকৃতপক্ষে গণিকাবৃত্তি যৌন-সম্পর্ক পরস্পরের প্রতি অন্তরঙ্গতা প্রকাশের এক অদ্বিতীয় উপায়, গণিকাবৃত্তি একে চুক্তিভিত্তিক লেনদেনের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসে। এই সেবাগ্রহীতার অনেকের কাছেই যৌন-সম্পর্ক তখন শুধুমাত্র অর্থ প্রদানের মাধ্যমে উদ্দেশ্যসাধনের উপায় হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। এরকম মনোভাব মানুষকে গণিকাদের দিয়ে এমন যৌনাচারের হাতিয়ার হিসাবে সামনে আনতে পারে যা সাধারণ নারী যাতে অনিচ্ছুক এবং এই প্রেক্ষাপটও মূল সমস্যার খুবই ক্ষুদ্র অংশকে উপস্থাপন করে। ২০১০ সালের ১৫ জানুয়ারিতে গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ৭০০ জন যৌন পরিসেবা গ্রহণকারীদের উপর গবেষণার উপর একটি প্রতিবেদন অ্যালেক্স নামের এক ভদ্রলোক যৌনতা ক্রয় সম্পর্কে তার মনোভাব তুলে ধরেছেন এভাবে–“গণিকারা তাঁকে পছন্দ করুক সে তাই চায়, আবার একই সঙ্গে সে এই বিভ্রমে থাকতে চায় না যে তাঁরা প্রকৃতপক্ষেই একটি সম্পর্কের মধ্যে আছে।” গণিকাদের প্রতি এরকম মানসিকতা একেবারেই সাধারণ ঘটনা।
গণিকাবৃত্তি বৈধতা পেলে কিছু মানুষ তা নিয়ে বৈধ উপায়ে উপার্জনের পথ দেখাবে। কিছু মানুষ গণিকাদের নিয়ে ব্যাবসা খুলে বসবে। গণিকালয়গুলো চলে যাবে ক্ষমতাবান এবং বিত্তশালী কিছু মানুষের হাতে, যাঁরা আসলে মূল ব্যাবসাটা করবে যেখানে পুঁজি থাকবে গণিকারাই। পশ্চিমে গণিকালয়ে যারা ইম্প (যাঁরা যৌন সম্পর্কের জন্য গণিকা সরবরাহ করে থাকে) এবং এখানে মাসি বা পিসি নামে পরিচিত, তাঁরাই মূল ব্যাবসার সুযোগ পাবে। গণিকারা তাঁদের হাতের অদৃশ্য সুতোয় বন্দি থাকবে। বর্তমানে রাজমিস্ত্রী, কাঠমিস্ত্রী প্রভৃতি শ্রমিকরাও এরকম সিন্ডিকেটতন্ত্রে আবদ্ধ হয়ে গেছে। কোনো শ্রমিক পেতে হলে সেই সিন্ডিকেটের সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলতে হয়। শ্রমিকদের পারিশ্রমিকের একটা অংশ সুপারভাইজাররাই ভোগ করে। এটা কি আমরা আটকাতে পেয়েছি? না আটকানোর কোনো চেষ্টা করেছি? গণিকাদের ক্ষেত্রে এমন হলে আটকাবো কেন?
বৈধতা প্রদানের ভালো কিছু উদাহরণও আমাদের সামনে আছে। ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে নেদারল্যান্ড গণিকাবৃত্তিকে বৈধ পেশার স্বীকৃতি দেয়। এমনকি এই পেশায় উপার্জনের উপর করও আরোপিত হয়। গণিকাবৃত্তি দু-ভাবেই চর্চা হয়—ইচ্ছাকৃত এবং জোরপূর্বকভাবে। ১৯৮০ সালের পর এই দুই চর্চার মাঝে সীমারেখা টানা এবং তা নজরদারি সহজ হয়েছে। ১৯৯৬ সালের দিকে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং ১৯৯৯ থেকে উপার্জনের উপর কর আরোপিত হয়, যা ধীরে ধীরে সমাজের চোখে একটি সাধারণ পেশা হিসাবে গণিকাবৃত্তিকে প্রতষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। ভারতের যৌনকর্মীদের সংগঠন জাল নোট সনাক্ত করতে গণিকাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে, যা তাঁদেরকে অর্থনৈতিক ঝুঁকি থেকে কিছুটা হলেও সুরক্ষা দেয়। অবৈধতা এরকম সুরক্ষার ক্ষেত্র প্রস্তত করত বলে আমার মনে হয় না।
২০০০ সালে বাংলাদেশে গণিকাবৃত্তি বৈধতা পায় উচ্চ আদালতের রায়ে। যদিও বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী- “State shall endeavor to prevent gambling and prostitution”। ২০০০ সালে গণিকালয় থেকে আটককৃত শতাধিক গণিকার আটকাদেশ নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় ছিল এটি। ভারতেও গণিকাবৃত্তি বৈধ, তবে একটু অন্যভাবে। কারণ ভারতে গণিকাবৃত্তি বৈধ, কিন্তু গণিকালয় নয়। বিবাহ, বধু এবং প্রেমিকার মতো গণিকাও এক বাস্তবতা। অবৈধ করে এটিকে থামানো সম্ভব না। ইউএসএ-এর নেভাদার অবৈধ গণিকাবৃত্তির আকার অন্য প্রদেশের বৈধ গণিকাবৃত্তির চার গুণেরও বেশি বড়ো। বৈধতা এবং অবৈধতা দুটি ধারার সমস্যা নিয়ে আমাদের সামনে আসে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বৈধতা দিয়ে যথাযথ নজরদারির মাধ্যমে এই সম্পৰ্কত অপরাধ নিয়ন্ত্রণের রাখা সম্ভব এবং এটাই যৌক্তিক উপায়।
জুয়াও বেআইনি। জুয়া খেলতে খেলতে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়, আত্মহত্যাও করে থাকে। সে জুয়া যখন সরকারের স্বীকৃতি পায় সেটা তখন আইনি। তেমনই এক জুয়ার নাম লটারি। এই লটারির টিকিট কেনা ও বেচা কোনোটাই অপরাধ নয়। আছে মোটা অঙ্কের প্রাইজ মানি। এই প্রাইজ মানির লোভে কত মানুষ সর্বস্বান্ত হয় তার কোনো খবর কেউ রাখে না। কিন্তু কেউ এর বাইরে অন্য কোনো জুয়া খেললে তা গ্রেফতারযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। যেমন সাট্টা ইত্যাদি। পাড়ায় বসে তাস খেলছেন? সেই খেলায় টাকা লেনদেন করছেন? তাহলে তা অবশ্যই গ্রেফতারযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। ক্রিকেট বা কোনো খেলায় বেটিং করছেন? তাহলে সেটাও গ্রেফতারযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। আপনি চোলাই মদ বানাচ্ছেন বা বিক্রি করছেন? এটাও গ্রেফতারযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। তার কারণ আপনি এসব করেন সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে। সীমান্তে ‘চোরা কারবার’ গ্রেফতারযোগ্য অপরাধ এবং দণ্ডনীয়। কেন? তাঁরা কি চোরাই পণ্য এ-দেশ ও-দেশ করে? মোটেই না। তাঁরা গাঁটের কড়ি খরচা করে পণ্য কিনে অন্য দেশে বিক্রি করে। তাঁদের অপরাধ হল তাঁরা সরকারকে রফতানি শুল্ক দেয় না, ফাঁকি দেয়। অর্থাৎ যে পেশায় রাজস্ব দেওয়া হয় না, সেই পেশাই অবৈধ। যদি যৌনকর্মীরাও সরকারকে রাজস্ব প্রদান করে, তাহলে যৌনপেশাও বৈধ হয়ে যাবে। যৌনকর্মীদের ট্রেড লাইলেন্স ও রোজগারের বার্ষিক রিটার্ন জমা দিলে পেশাটি বৈধতা পাবে। অর্থাৎ এই পেশায় যাঁরা আসবে তাঁদের সরকার দ্বারা রেজিস্টার্ড হতে হবে। এটা আর পাঁচটা পরিসেবা বা পেশার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিসেবা। আপনার প্রাত্যহিক প্রয়োজনে অর্থের বিনিময়ে বাজার থেকে চাল ডাল কিনে খেতে যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে অর্থের বিনিময়ে যৌনতা কেনাবেচার আপত্তি থাকবে কেন? তাহলে কি বিনামূল্যে শরীর ও যৌনসুখ পেলে সব অপরাধ ঘুচে যাবে? পৃথিবী থেকে বাজারের ধারণা যেদিন বিলুপ্ত হবে সেদিন থেকে আর পাঁচটা পেশার মতো যৌনপেশাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাজার থাকলেই পণ্য থাকবে, পণ্য থাকলে বাজারও সৃষ্টি হবে।