১৩. যাত্রা-থিয়েটার-চলচ্চিত্রে গণিকা
যাত্রা-থিয়েটার-চলচ্চিত্রের একেবারে গোড়ার দিকে ছিল নারী-বর্জিত। সে সময়ে নারীরা এসব ক্ষেত্রে আসত না। ফলে বহু বছর পুরুষ অভিনেতারা নারীসজ্জায় সজ্জিত হয়ে নারীচরিত্রে অভিনয় করত। সে সময়ে নারীর অভিনয় করাটাকে মানুষ সুনজরে দেখত না। ১৯২৭-২৮ সালের দিকে ঢাকার নবাব পরিবারের কয়েকজন তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তাঁরা ‘সুকুমারী’ নামে চার রিলের একটি নির্বাক ছবি বানান। ছবিটি পরিচালনা করেন বিশিষ্ট নাট্যকর্মী ও জগন্নাথ কলেজের শরীরশিক্ষার প্রশিক্ষক অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত। এই চলচ্চিত্রে নারী চরিত্র থাকলেও কোনো নারী অভিনয় করেনি। পুরুষরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৈয়দ আবদুস সোবহান। ঢাকাই চলচ্চিত্রে নবাব পরিবারের অবদান থেমে থাকেনি। নবাব পরিবারের উদ্যোগে ঢাকার ইস্টবেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি গঠিত হয়। এর প্রযোজনায় অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত নির্মাণ করে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের নির্বাক চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির নাম ‘দ্য লাস্ট কিস’। তবে এই চলচ্চিত্রে নারীচরিত্রে নারীরাই অভিনয় করেছিল। নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন লোলিটা বা বুড়ি নামের জনৈকা বাইজি। চারুবালা, দেববালা বা দেবী নামের আরও দুজন বাইজিও এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিল। এঁদের তিনজনকেই আনা হয়েছিল গণিকালয় থেকে। চলচ্চিত্রই বলুন, কিংবা যাত্রা-থিয়েটার, সর্বত্রই নারী চরিত্রে প্রথম অভিনয় করতে আসেন বাইজি বা গণিকা মেয়েরা। এঁদের এসব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের কারণে মানুষের মনমন্দিরে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল চলচ্চিত্র-যাত্রা-থিয়েটারে যেসব মেয়েরা অভিনয় করে তাঁরা ‘বেশ্যা’। আজও আমাদের সমাজে অভিনেত্রীদের সুনজরে দেখা হয় না।
গবেষক-অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্ত সরকারি দস্তাবেজ উদ্ধার করে লিখেছেন—“সরকারি মহাফেজখানা থেকে যে রিপোর্ট পেয়েছি তা কৌতূহলোদ্দীপক। দেখা যায় দশ বছরের নিচে বেশ্যাদের বাড়িতে বেশ কিছু মেয়ে রয়েছে। সরকার এদের কথা মাঝে মাঝে ভেবেছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত ব্যাপক যে সরকারের পক্ষে কিছু করে ওঠা কঠিন।” সেই পর্যবেক্ষণ অনুসারে গণিকাপল্লিতে গণিকা-গর্ভজাত কন্যাসন্তানের সংখ্যা ছিল ৪০৮ জন। এইসব গণিকা-কন্যাদের পুনর্বাসন বা সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার ব্যাপারে তখনকার সরকার যেমন কিছু করার চেষ্টামাত্র করেনি। তেমনই সমাজ-সংস্কারকদেরও উদাসীনতা ছিল। গণিকাদের মুক্তির পথ দেখাল থিয়েটার। সেই গণিকা-কন্যাদের মুক্তির জন্য থিয়েটারে অংশগ্রহণের পথ খুলে দিয়েছিলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সৌভাগ্যবশত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি থিয়েটার সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ভালোভাবে থিয়েটার পরিচালনার জন্য বেঙ্গল থিয়েটার একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করেছিল। উপদেষ্টামণ্ডলীতে যেমন ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তেমনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, উমেশচন্দ্র দত্তের মতো ব্যক্তিত্বরা। থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত জরুরি সভায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিরোধিতা করলেন। বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে উমেশচন্দ্র দত্ত ও মধুসূদন দত্তের সমর্থনে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ গণিকালয় থেকে চারজন মেয়েকে অভিনেত্রীকে হিসাবে আনলেন। মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার যাত্রা শুরু করে। মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন। এই পথ ধরেই। থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, এলোকেশী, জগত্তারিণী, শ্যামা, কুসুমকুমারী, নীহারবালা, কৃষ্ণভামিনী, প্রভাদেবীর মতো গণিকারাও। পরবর্তী সত্তর-আশি বছর বাংলা থিয়েটারকে আলোকিত করেছেন এঁরা, সমৃদ্ধ করেছেন অন্ধকার জগৎ থেকে আসা এই মহিলারাই, যাঁদের পোশাকি পরিচয় গণিকা।
থিয়েটারের দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লেদাক্ত অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম শুরু করলেন পিতৃপরিচয়হীনা গণিকা-কন্যারা। সেকালের সংবাদপত্র ও সমাজপতিদের লাগাতার বিরোধিতা ও নিন্দাবাদ সত্ত্বেও সমাজ তাঁদের সঙ্গে ছিল না, একথা বলা যায় না। সেইসব সমাজপতিদের উদ্দেশ্যে নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের প্রশ্ন ছিল—“এইসব মেয়েদের তো আমি অন্তত রাস্তায় দাঁড়িয়ে খরিদ্দার পাকড়াবার চেষ্টা থেকে সরিয়ে, মঞ্চে তুলে দিয়ে রোজগারের একটা পথ দেখিয়েছি, কিন্তু তোমরা এদের জন্য কী করেছ?” একথা অনস্বীকার্য যে, গণিকা-কন্যাদের অনেকেই আমাদের বিনোদন শিল্প তো বটেই, সাহিত্যে ও এবং সামাজিক ইতিহাসেও অপরিমেয় কীর্তি রেখে গেছেন। তাঁদেরকে বাদ দিয়ে চলচ্চিত্র-যাত্রা-থিয়েটারের ইতিহাস লেখা কখনো সম্পূর্ণ হবে না। আমাদের সমাজ এই সব নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি, দিতে চায়নি।
এরকমই এক গণিকা-কন্যা বিনোদিনী দাসী। ঘটনাচক্রে বিনোদিনী রঙ্গালয়ে এসে পড়েন। তিনি চৈতন্যলীলায় নিমাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। পরে শ্রীরামকৃষ্ণের স্পর্শে তাঁর ‘চৈতন্য’ হয় বলে জনশ্রুতি আছে। বর্তমানের ‘স্টার’ থিয়েটারের নামের সঙ্গে বিনোদিনীর নামও বিজড়িত হয়ে আছে। যদিও থিয়েটারের নাম বিনোদিনী দাসীর নামে ‘বিনোদিনী’ হওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল, কিন্তু একটা গণিকার নামে থিয়েটারের নাম হবে! বিনোদিনীই এই থিয়েটারের নামকরণ করল ‘স্টার’। বিনোদিনী বোঝাতে সক্ষম হল–“আপনার ভাববেন স্টার মানে আমি, আর দর্শকরা ভাববে স্টার মানে আমরা সবাই।” বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদা বিনোদিনী কিন্তু পায়নি। গণিকা বলে থিয়েটারের নাম ‘বিনোদিনী’ রাখা যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি তাকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদাও দেওয়া যায়নি। বিনোদিনীর এক শিশুকন্যার জন্ম হয়। এক সম্ভ্রান্ত পুরুষ সেই শিশুকন্যা সহ বিনোদিনীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু গণিকা কন্যা বলে বিনোদিনী তাঁর কন্যা শকুন্তলাকে কোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে পারেননি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে শকুন্তলা মারা যায়। সমাজের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নিয়ে তাঁকে আর বেঁচে থাকতে হয়নি।
রঙ্গালয়ের আর-এক গণিকা অভিনেত্রী হলেন গোলাপসুন্দরী। বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘শরৎ-সরোজিনী’ নাটকে গোলাপসুন্দরী সুকুমারী চরিত্রে এমন প্রাণবন্ত অভিনয় করেছিলেন যে, তিনি গোলাপসুন্দরী থেকে সুকুমারী’ নামেই পরিচিত হয়ে গেলেন। ডিরেক্টর উপেন্দ্রনাথ দাস গোলাপের বিয়ে দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক সুদর্শন অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তের সঙ্গে। তাঁরা এক ভদ্রপল্লিতে বসবাস করতেন। তবে এক কন্যার জন্মের পর গোলাপসুন্দরী স্বামী পরিত্যক্তা হন।
চলচ্চিত্র-যাত্রা-থিয়েটারে গণিকাদের প্রথম পদচারণা শুধু ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীতেই ছিল। এক্ষেত্রে একটা কথা বলা দরকার—গণিকারা যেমন অভিনেত্রী হয়েছেন, তেমনি অভিনেত্রী থেকে গণিকা হয়েছেন এমন উদাহরণও কম নয়। নাম মার্গারেট আলিবার্ত। প্যারিসের মার্গারেট আলিবার্তকে লোকে যাঁকে চেনে ম্যাগি মেলার’ হিসাবে। কিশোরী অবস্থায় সে সন্তানসম্ভবা। সেই সন্তানের পিতা কে সেই প্রশ্নের উত্তরও সে জানে না। এক দুর্ঘটনায় পুত্র-সন্তানের মৃত্যুর দায়ে তাঁর বাবা-মা ম্যাগিকে ত্যাগ করে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিতারণের পর কিছু সন্ন্যাসিনীর আশ্রয়েই জীবন কাটছিল ম্যাগির। কুমারী ম্যাগী এক কন্যা-সন্তান প্রসব করল। এবার সন্ন্যাসিনীরাও তাঁকে ত্যাগ করল। মেয়েকে অন্যত্র রেখে মাত্র ষোলোবর্ষীয় সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত ম্যাগি প্যারিসের পথে পথে ঘুরতে থাকল। অবশেষে জীবিকার জন্য সে নিজের শরীরকেই পণ্য হিসাবেই উপস্থাপন করে নেয়। কিন্তু এত রূপ নিয়ে কি পথগণিকা হিসাবে মানায়? শিয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খাবে যে! সে নজরে পড়ে গেল ম্যাদাম ডেনার্টের।এই ডেনার্টের কাছেই সে সেরার সেরা গণিকা হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। পেতে শুরু করে সেরার সেরা শাঁসালো ক্লায়েন্ট। এই কায়েন্টরা শুধু প্যারসেই নয়, সুদূর আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
শরীর যখন পণ্য, তখন শরীরটাকে ক্লায়েন্টদের পছন্দমতো করে গড়ে তুলতে হবে, এ আর নতুন কথা কী! তাই শরীরচর্চারও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ম্যাগিকে একটা সুন্দর শরীরের মালকিন করে তুলল ম্যাদাম ডেনার্ট। ডেনার্টের দেহব্যাবসা ক্রমশ ম্যাগি তুরুপের তাস হয়ে উঠল। ইউরোপের শরীর-বাজারে ম্যাগি এতটাই জনপ্রিয় উঠেছিল যে, সেই মহাদেশের আনাচে-কানাচে কান পাতলেই ম্যাগির নাম শোনা যায়। ম্যাগির শরীরী-সান্নিধ্য এতটাই সুখকর ও তৃপ্তিদায়ক ছিল যে, তাঁর রূপ-লাবণ্য ছড়িয়ে পড়া রাত অতি তাড়াতাড়ি ভোর হয়ে যেত।
চল্লিশবর্ষীয় অ্যান্ড্রু নামে এক বিবাহিত যুবক সপ্তদশী ম্যাগিকে বিয়ে করে। ম্যাগিও মন দিয়ে ঘর-সংসার করতে থাকল। কিন্তু সুখ সবার সয় না! কয়েক বছরেই মধুচন্দ্রিমার সমাপ্তি ঘটে গেল। ম্যাগিকে ফেলে অ্যান্ড্রু পুনরায় নিজের পুরোনো সংসারে ফিরে গেল। ম্যাগিও আবার আগের জীবনে ফিরে গেল। পুনরায় যৌবনকে ব্যবহার করে উদ্দাম যৌনতার পসার সজিয়ে বসল। আবারও ম্যাগির কাছ থেকে যৌনসুখ কিনতে তৎকালীন ইউরোপের তাবড় তাবড় ব্যক্তিরা ভিড় জমাতে লাগল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ফ্রান্স ভরে গেছে ব্রিটিশ-সেনায়। সেই সেনার অন্যতম কর্তা প্রিন্স অফ ওয়ালেস অষ্টম প্রিন্স এডওয়ার্ড। যৌনসুখের তাগিদে তাঁর এক বন্ধুর সাহায্য নিয়ে একজন রক্ষিতা তথা গণিকাকে ভাড়া করল।কিন্তু সেই মহিলার যথার্থ যৌনজ্ঞান না-থাকায় এডওয়ার্ডকে তৃপ্ত করতে সক্ষম হয়নি। অতএব নতুন খাবারের সন্ধান দিল সেই বন্ধুই। বন্ধুই ম্যাগির সঙ্গে এডওয়ার্ডের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়।শরীরী সঙ্গ দিতে দিতে ম্যাগির সঙ্গে এডওয়ার্ডের প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু সেই প্রেম টেকে মাত্র এক বছর।
ম্যাগি এতদিনে বিলক্ষণ বুঝে গেছে উপঢৌকন আর প্রচুর অর্থের আগমন তাঁর শরীরকে কেন্দ্র করেই। আর এই ভাবনা থেকেই ম্যাগির অর্থ-লালসা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। আরও অর্থ চাই, আরও, আরও অর্থ। এবার ম্যাগির জীবনে বসন্ত নিয়ে আসে চার্লস লরেন্ট নামের এক যুবক। বিয়ে করল এবং ছয় মাসের সংসারও হল। ডিভোর্স হয়ে গেল। আর ডিভোর্সের সেটেলমেন্টে লরেন্টের কাছ পেয়ে গেল প্রচুর অর্থ, বাড়ি, গাড়ি, ঘড়াশাল, চাকর-বাকর ইত্যাদি। গণিকা ম্যাগির আবার বিবাহযোগ। এবার একেবারে প্রাচ্যের এক রাজপরিবারের সঙ্গে সংসার পাতার সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। স্বামী মিশরের রাজপুত্র আলি কামেল ফাহমি বে। এ বিয়ের মূল উদ্দেশ্য রাজপুত্রের অর্থ-প্রতিপত্তি। নাঃ, এ বিয়েও টিকল না। ফাহমির সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেল। ম্যাগি রীতিমতো ছক কষে লন্ডনের এক হোটেলে খুন করল ফাহমিকে। স্বামীকে খুন করে ম্যাগি গ্রেফতার হয়। কিন্তু আদালতে প্রমাণ হল তাঁর উপর স্বামীর উপর্যুপরি অত্যাচারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার তাগিদেই ম্যাগি খুন করতে বাধ্য হয়েছিল। আদালত ম্যাগিকে মুক্তি দেয়। মুক্তি পেয়ে ম্যাগি প্যারিসে ফিরে আসে। ফিরে এসে ম্যাগি প্যারিস চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে শুরু করেন। বেশ কয়েক বছর সে অভিনয় করেছিল। তবে অভিনেত্রী হওয়ার পরও সে গণিকাবৃত্তি চালিয়ে গেছে মোটা অঙ্কের অর্থলোভে। তবে সে আর বিয়ে করেনি। যৌবন-শেষে বার্ধক্য কাটিয়েছে অন্তরালেই। শেষপর্যন্ত কেউ তাঁর কোনো খোঁজ পায়নি।
গণিকাবৃত্তি করতে করতে অভিনয় পেশা আসা মেয়েদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। সেকাল থেকে একাল সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এঁরা। সম্প্রতি ভারতীয় চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণ করেছে পর্ন-গণিকা ভারত বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান সানি লিওনি। টিনা নন্দী, জোয়া রাঠোর, কাজল গুপ্তা, সোনিয়া মহেশ্বরী, আলিশা, কবিতা রাধেশ্যামের মতো গণিকারা তো এখন ওয়েব সিরিজের নামে ক্যামেরার সামনেই গণিকাবৃত্তি করছেন। বাজারও রমরমা। এ তো গেল গণিকা থেকে অভিনেত্রী হওয়ার কথা। অভিনেত্রী থেকে গণিকাবৃত্তিতে আসার ঘটনাও কিছু কম নয়।
কাবুকি, জাপানের একটি বিশেষ নাট্যধারা। সাধারণের রঙ্গালয় হিসাবে এই নাট্যধারার সময়কাল সপ্তদশ শতাব্দী। এই নাট্যধারার স্রষ্টা একজন মহিলা হলেও মহিলা ও তরুণদের জন্য অভিনয় নিষিদ্ধ করেছিলেন। ১৬০৩ সালে ইজুমো নো ওকুমি শুখনো নদীখাতে বিশেষ এক জাতীয় নৃত্যনাট্যের সূচনা করেন। শুরু হল মহিলা কাবুকির যুগ। এই মহিলা কাবুকিদের বলা হত ‘অন্না-কাবুকি’। এই কাবুকি নাট্যধারা যতই জনপ্রিয়তার শিখরে উঠতে থাকল, ততই বিনোদনের পথে পা বাড়িয়ে দিল অধিক অর্থলোভে। কম পরিশ্রমে অধিক রোজগারের হাতছানিতে যৌনপেশায় যুক্ত হতে থাকল অভিনেত্রীরা। কাবুকি নাট্যধারা ক্রমশ গণিকাদের নৃত্যসংগীত হিসাবে পরিচিতি হয়ে গেল। জাপানের সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে এই পরিবর্তিত কাবুকি সংস্কৃতি মিশে গিয়ে সামাজিক অবক্ষয়ের সূচনা হতেই জাপানের তৎকালীন শোগুন শাসন ‘অন্না-কাবুকি নিষিদ্ধ করে দেয়। সালটা ছিল ১৬২৯। তবে ‘অন্না-কাবুকি’-কে অনুসরণ করে একদল উৎসাহী তরুণ ‘ওয়াকাসু-কাবুকি’ নাট্যধারা শুরু করে। কিন্তু এর অভিনেত্রীরাও যৌনকর্মে যুক্ত হলে শোগুন শাসক ‘ওয়াকাসু-কাবুকি’ও নিষিদ্ধ করে দেয়।
সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কাবুকি নাট্যধারা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের হাতে গিয়ে পড়ে। পুরুষ-পরিচালিত এই কাবুকির ডাকনাম ‘ইয়াররা-কাবুকি’। ইয়ারো-কাবুকিদের মধ্যে যাঁরা মহিলা চরিত্রে যেসব পুরুষ অভিনয় করত, তাঁদের বলা হত ‘অন্নাগাতা’। নারী-বর্জিত এই নাট্যধারা বেশ কিছুদিন বেশ চলছিল। সমস্যাও শুরু হয়ে গেল কিছু সময় পর। “অন্নাগাতা’ অভিনেতারা (অভিনেত্রীই বলা উচিত) দীর্ঘদিন ধরে নারীচরিত্রে অভিনয় করতে করতে নিজেদের মধ্যে নারীসুলভ আচরণ লালন করত। এই নারীসুলভ পুরুষরাও যৌনপেশায় যুক্ত হয়ে পড়ে। এঁদের ক্লায়েন্ট নারী-পুরুষ উভয়ই। যথারীতি ইয়ারো-কাবুকি’-ও নিষিদ্ধ হল। পরে অবশ্য (১৬৫২ সালে) এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
জাপান ছেড়ে চলে আসুন ভারতে। ভারতেরও বেশকিছু অভিনেত্রী চলচ্চিত্র ও ধারাবাহিকে অভিনয় করার পাশাপাশি অধিক অর্থ-লালসায় যৌনপেশাও চালিয়ে যায়। গ্ল্যামার দুনিয়ার কত স্বনামধন্য মেয়েরা এসকর্ট গার্ল হিসাবে কাজ করে তার হিসাবে রাখা হয় না বোধহয়। কী টলিউড, কী বলিউড, কী কলিউড, কী হলিউড, কী মলিউড, কী ঢলিউড–সর্বত্র একই চিত্র। ধরা পড়ে গেলে জানতে পারি, না ধরা পড়লে বিন্দাস চলে যৌনকর্ম। প্রবচন হয়েছে–‘ধরা পড়লে ধনঞ্জয়, না পড়লে এনজয়’। কিছুদিন আগেই তো টলিউডের এক প্রথম সারির বিবাহিতা অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে এক চিটফান্ড কোম্পানির কর্ণধারের কয়েক কোটি টাকার বিনিময়ে নিয়মিত শয্যাসঙ্গিনী হতেন। সেই সংবাদ ফলাও করে সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। নিশ্চয় সেই সংবাদ সবাই পড়েছে। এরা কেউ গরিব নন, আর্থিক অনটনে দিন গুজরান করে না। রাতারাতি আরও ধনী হওয়ার লোভ ও যথেচ্ছ যৌনতার হাতছানিতে অত্যন্ত গোপনে এঁরা গণিকাবৃত্তি অব্যাহত রাখে। মুম্বাইয়ের নামজাদা এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর লিজ দেওয়া ফ্ল্যাটে যৌনকর্ম চলত। সংশ্লিষ্ট অভিনেত্রীই যৌনকর্ম পরিচালনা করত কি না, সেটা অবশ্য ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বছর কয়েক আগে হায়দরাবাদের বানজারা হিলসের একটি বিলাসবহুল হোটেলে গণিকাবৃত্তি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেল বলিউডের অভিনেত্রী শ্বেতা প্রসাদ বসু। যে রাতে সে ধরা পড়েছিল সেই রাতের তাঁর রেট ছিল পাঁচ লাখ টাকা। অগ্রিম হিসাবে এক লাখ টাকাও নিয়েছিল। সেলিব্রেটি হওয়ার সুবাদেই তাঁদের শরীর-মূল্যও অনেক চড়া হয়। ধনকুবেররাও শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে সেলিব্রটিদেরই চায়। তাই সেলিব্রেটি অভিনেত্রীদের বাজার ও বাজার-দর আকাশছোঁয়া। গণিকাবৃত্তির সঙ্গে ঐশ আনসারি, ভুবনেশ্বরী, শ্রাবণী, যমুনা, দিব্যাশ্রী প্রমুখ অভিনেত্রীদের নামও উঠে এসেছে সংবাদ শিরোনামে। ২০০৯ সালে গণিকাবৃত্তির অপরাধে অভিনেত্রী ভুবনেশ্বরী গ্রেফতার হয়েছিল। ভুবনেশ্বরী নিজে গণিকাবৃত্তি করতেন, তা নয়। তিনি গ্ল্যামার জগতের তারকাদের নিজের ফ্ল্যাটে এনে যৌনকর্ম করাতেন বলে অভিযোগ ছিল। শোনা যায়, তিনি নীল ছবির অভিনেত্রীও ছিলেন। ২০১৩ সালে যোধপুরের এক হোটেলে যৌনকর্ম করতে গিয়ে অত্যন্ত আপত্তিকর অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে অভিনেত্রী ঐশী আনসারি। এ বছরেই আর এক তামিল অভিনেত্রী সায়রাবানু গ্রেফতার হন গণিকাবৃত্তির অভিযোগে। দক্ষিণী ছবির আরও দুজন অভিনেত্রী শ্রাবণী ও যমুনাকে মধুচক্র চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হয়। শ্রাবণীর ক্লায়েন্টদের মধ্যে বেশিরভাগই অন্ধ্রপ্রদেশের মন্ত্রী। সম্প্রতি মধুচক্রের খবর পেয়ে মুম্বাই পুলিশ হানা দেয় আন্ধেরি এক থ্রি-স্টার হোটেলে হানা দেয়। সেই মধুচক্রের ডেরা থেকে পুলিশের হাতে ধরা পড়ল বলিউডের অভিনেত্রী প্রিয়া শর্মা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৯ বর্ষীয়া এই অভিনেত্রীই ছিল এই মধুচক্রের মূল কাণ্ডারী। প্রিয়া শর্মা দূরদর্শনের জনপ্রিয় একটি ক্রাইম শোতে ইতোমধ্যেই অভিনয় করেছে। প্রিয়া শর্মা ছাড়াও মারাঠি সিরিয়াল ও চলচ্চিত্রের অভিনয় করা আর-এক অভিনেত্রী পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। আর-এক নাবালিকা অভিনেত্রীকেও পাওয়া গিয়েছিল এখান থেকে। সে একটি ওয়েবসিরিজে অভিনয় করেছে।
এই অধ্যায় শেষ করব একটি অন্য ধরনের ঘটনার বিবরণ দিয়ে। তাঁর কথা, যে অভিনেত্রী হয়ে গণিকা নয় বা গণিকা থেকে অভিনেত্রী হওয়ার ঘটনা নয়। সে অভিনেত্রী হতে এসে গণিকা হয়ে গেছে। আসলে অভিনেত্রী হওয়া তাঁর হয়ে ওঠেনি। তাঁর নাম গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাই। মুম্বাইয়ের কামাথিপুরার একজন গণিকা। ভারতের গণিকা নারীদের অধিকার রক্ষা আন্দোলনের নেত্রী, যিনি গণিকালয় রক্ষা করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গেও দেখা করেছেন। গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাই মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতের অভিনেত্রী স্বপ্ন দেখতেন। তখন তাঁর নাম ছিল হরজীবনদাস কাঠিয়াবাদি। গুজরাটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন তিনি। সেই চল্লিশের দশকেও সমাজের কাছে একটা নিদর্শন হয়েছিল তাঁর পরিবার। সেই সময়েও সেই পরিবারের মেয়েরা সিনেমা দেখতেন। হিন্দি সিনেমা দেখেই শুরু হয় গঙ্গার স্বপ্নের জাল বোনা। মুম্বাই আসতে চায়। মুম্বাই তাঁর স্বপ্নের শহর। চোখে শুধু অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন। এমন সময়ে তাঁদের ফার্মে অ্যাকাউন্ট্যান্ট রামলাল নায়েক নামে এক যুবক নিযুক্ত হন। গঙ্গা জানতে পারল এই যুবক কিছুদিন মুম্বাইতে কাজ করেছে। শুরু হল তাঁর কাছে সেই স্বপ্নের শহরের গল্প শোনা। গল্প শুনতে শুনতে তাঁর প্রেমে পড়ে যাওয়া। অতঃপর দুজনে বিয়ে-থা করে মুম্বাই চলে আসে। কিন্তু মুম্বাই এসে গঙ্গার স্বপ্ন ভেঙে ছত্রখান হয়ে গেল। মুম্বাই এসে স্বামী রামলাল মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে কামাথিপুরার গণিকালয়ে গঙ্গাকে বিক্রি করে দেয়। গঙ্গাকে ৫০০ টাকায় কিনে নিল গণিকালয়ের সর্দারনি শীলা মাসি। গঙ্গা বহুবার সেখান থেকে পালানোর চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। গঙ্গার নাম বদলে গেল, হল গাঙ্গুবাই। ক্রমে ক্রমে শিক্ষিত ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ গঙ্গা ‘গাবাই’ গণিকালয়ের সর্বেসর্বা হয়ে উঠল।
ইতোমধ্যে কামাথিপুরা গণিকালয় পাঠান-মাফিয়াদের আস্তানা হয়ে ওঠে। গাঙ্গুবাই মাফিয়া সর্দারের হাতে রাখি পরিয়ে ভাই পাতিয়ে নেয়। এর ফলে গাঙ্গুবাইয়ের ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। কামাথিপুরার গণিকালয়ে গাঙ্গুবাইরাজ প্রতিষ্ঠা হল। বদলাতে থাকল কামাথিপুরা গণিকালয়ের অন্দরমহলের নিয়মকানুন। যেমন–(১) কোনো মেয়েকেই আর জোর করে গণিকালয়ে নিয়ে আসা যেত না। (২) কেউ যদি গোপনে কোনো মেয়েকে গণিকালয়ে বিক্রি করে দিয়ে যায়, যদি সেই মেয়েটি গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করতে না চাইত, তাহলে সেই মেয়েকে গাঙ্গুবাই নিজ দায়িত্বে বাড়ি পৌঁছে দিত।
ভারত ব্রিটিশ মুক্ত হওয়ার পর ব্রিটিশদের মদতে পুষ্ট হয়ে যেসব গণিকালয় গড়ে উঠেছিল, সেগুলি বন্ধ করে দেওয়ার দাবি উঠল। সে সময় গাঙ্গুবাই কামাথিপুরা গণিকালয়ের প্রেসিডেন্ট। গাজুবাই হাজার হাজার গণিকাদের সঙ্গে নিয়ে রাজপথে নামল। গণিকালয় বাঁচাতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর নেহরুর সঙ্গে দেখা করে প্রসিডেন্ট গাঙ্গুবাই। গাঙ্গুবাইয়ের দাবি মেনে নিলেন নেহরু।
কামাথিপুরার গণিকালয়েই গাঙ্গুরামের মৃত্যু হয়। গাঙ্গুবাঈকে আর কেউ মনে রাখেনি। গাঙ্গবাইয়ের সংগ্রামী ইতিহাস চাপা পড়ে যায়। না, কেউ মনে রাখেনি একথা বললে নির্জলা মিথ্যা বলা হবে। গাঙ্গু সিনেমার অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও, অভিনেত্রী হতে না-পারলেও তাঁর জীবন যে সিনেমার মতই বর্ণময় ঘটনাবহুল! তাই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস জেগে উঠল। গাঙ্গুর জীবন নিয়ে মুম্বাইতে তৈরি হল ‘গাঙ্গুবাই কাঠিয়াবাদি’ নামে সিনেমা। শুধু গাঙ্গুবাই নয়, গ্ল্যামারের টানে অভিনেত্রীর স্বপ্ন দেখতে এসে অসংখ্য মেয়েকে শেষপর্যন্ত গণিকা হয়ে যেতে হয়েছে। অভিনেত্রীর হওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে, এই টোপ খেয়ে ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন মানুষদের সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতে করতেই একসময় অনেক মেয়েকেই গণিকাবৃত্তির পথ বেছে নিতে হয়। নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে গণিকা হতে হয় তাঁদেরই, যাঁদের অভিনয় দক্ষতা নেই। তাঁদের ইতিহাস হয়তো কোনোদিনও লেখা হবে না, তাঁদের জীবন-যন্ত্রণা সেলুলয়েড বন্দিও হবে না।
সিরিয়াল, সিনেমার অভিনেত্রী মানেই কি সে চরিত্রহীনা, গণিকা, পতিতা, বেশ্যা? এদেশের অভিনয় শিল্পে নায়িকাদের সম্পর্কে এক শ্রেণির মানুষ এমন চিন্তাভাবনাই পোষণ করে। অনেকে প্রকাশ্যেই সেই মনোভাব ব্যক্ত করে। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, ইন্ডাস্ট্রির ভিতরের মানুষরাও এমন ধারণা ব্যক্ত করে।এই তো বছর কয়েক আগে টলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রী কোয়েল মল্লিক দড়াম্ করে এক বোমা ফাটিয়ে দিলেন। তিনি বললেন–“অভিনয়ের জন্য নগ্নতাকে সামনে আনতে কোনো অসুবিধা নেই। প্রতিদিনই আমাদের নগ্ন হতে হয়।” ইঙ্গিতপূর্ণ এহেন বিবৃতিতে টলিউড তোলপাড় হয়ে ওঠে। ভারতীয় অভিনেত্রী ঊষা যাদব বিবিসি কে এক সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরক বিবৃতি দিলেন, বললেন–“সে ব্যক্তি যেখানেই চেয়েছে আমার শরীরে সেখানেই হাত দিয়েছে। সে যেখানেই চেয়েছে আমার শরীরের সেখানেই চুমু খেয়েছে। সে আমার জামার ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তাকে থামিয়ে দিয়েছিলাম। তখন সে বলল, তোমার মনোভাব যদি এরকম হয়, তাহলে তুমি এখানকার জন্য উপযুক্ত নও।” এহেন বিবৃতি অভিনেত্রীদের সামগ্রিক অবস্থা বিচার করতে খুব বেশি চিন্তা করার প্রয়োজন পড়ে না। উল্টোদিক থেকে যেসব অভিনেত্রী ‘এরকম’ না করে এখানকার মতো করে টিকে গেছে বা টিকে আছে, তাঁরা কি অভিনয়ের বিনিময়ে শরীর বিক্রি করে ফেলেছে? প্রশ্ন উঠছে। ঊষা যাদব এও বলেছেন, সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি তাকে সরাসরি যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছিল। বলেছিল–“তুমি যদি এই রোল বা ভূমিকা পেতে চাও, তাহলে আমার সঙ্গে শুতে হবে। তাহলে কি এটা দাঁড়াল না যে, অভিনেত্রীদের সিনেমায় রোল পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে হয়? অর্থাৎ যতগুলো সিনেমায় রোল পেতে চাইবে ততগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে যৌনক্রিয়া করতে হবে? এই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি’-রা কারা? সে কখনো নামজাদা নায়ক হতে পারে, আবার পরিচালক বা প্রযোজকও হতে পারে। নিট রেজাল্ট, অভিনেত্রী হওয়ার আগে তাঁকে গণিকা হতেই হবে। একথা সব অভিনেত্রীই স্বীকার করার সাহস পায় না। কারণ, ঊষা যাদবের ভাষায়–“অনেকেই ভয় পায়। কারণ এখানে কিছু ব্যক্তি এত ক্ষমতাধর যে তাঁদের সৃষ্টিকর্তার মতো মনে করা হয়।” এঁদের বিরুদ্ধে কেউই মুখ খোলেন না, তা ঠিক নয়। তবে কতিপয় যে কজন মুখ খুলেছে, তাঁদের প্রত্যেরই সিনেমা কেরিয়ার এক লহমায় খতম হয়ে গেছে।
কিছুদিন আগে ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত করে কাস্টিং কাউচের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন তেলগু অভিনেত্রী শ্রী রেডি। একের পর এক নিজেদের সঙ্গে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে এই তেলগু অভিনেত্রী। আর এক তেলগু অভিনেত্রী সন্ধ্যা নাইডু। তিনিও জানালেন–“বয়সের কারণে এখন তাঁর কাছে মা বা মাসির চরিত্রে অভিনয়েরই সিংহভাগ অফার আসে। সকালে শু্যটিংয়ের সময় তাঁকে বলা হয় ‘আম্মা’, আর রাত হলে বলা হয় “শুতে’। সন্ধ্যা নাইডু আরও বলেন–“একদিন একজন জিজ্ঞাসা করল, তিনি ভেতরে কী পরে আছেন? তা স্বচ্ছ কি না।” আমি নিশ্চিত, এই শ্ৰী রেড্ডি, সন্ধ্যা নাইডুরা ইন্ডাস্ট্রিতে থাকতে পারবে না। অভিনয় পেশা থেকে সরে আসতেই হবে। কেউ কাজ দেবে না। যেমনভাবে পপ সংগীতশিল্পী আলিশা চিনাই, তনুশ্রী দত্তদের ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে যেতে হয়েছে। অভিনেত্রী সুনীতা রেডিড নামে আর-এক অভিনেত্রীর কথায়–“জোর করে সকলের সামনে পোশাক পালটাতে বাধ্য করা হয় তাঁদের। অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে সকলের সামনে পোশাক পালটাতেই হয়। এমনকী ন্যাপকিন পালটানো, মলমূত্র ত্যাগের মতো প্রাকৃতিক কাজও মেটাতে হয় পাঁচজনের সামনেই।” মারাঠি সিনেমার অভিনেত্রী শ্রুতি মারাঠে ছবির প্রযোজককে মোক্ষম জবাব দিয়ে তাঁকে স্তম্ভিত ও হতচকিত করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। কেন? ‘হিউম্যানস অফ বম্বে’-এর একটি পোস্টে শ্রুতি মারাঠে তাঁর বক্তব্য শেয়ার করলেন। শ্রুতি লিখলেন–“আমাকে আমার রোলটি নিয়ে আলোচনা করার জন্য প্রযোজক ডেকে পাঠান। প্রথমে পেশাদার ভঙ্গিতেই কাজের কথা আলোচনা করছিলেন। একটু পরেই সুর বদলে যায়। তাঁর সঙ্গে আমাকে রাত কাটানোর অফার দেন।” প্রযোজকের প্রস্তাবের জবাবে শ্রুতি তাঁকে বলেন–“নায়িকার রোল পেতে হলে আমাকে আপনার সঙ্গে শুতে হবে? নায়ককে কার সঙ্গে শুতে বলেছেন?” এরপরেও যেসব অভিনেত্রীরা বলেন ‘অভিনয়ের জন্য, চিত্রনাট্যের চাহিদা মেটাতে আমরা পর্দায় নগ্ন হতে পারি, তাঁদের কিছু বলার নেই।
সিনেমা, টিভির অভিনেত্রীরা নিজেরা যে এসব যৌনবৃত্তির পুরোধা অথবা তাঁদের অনুসরণ করেই শেষপর্যন্ত বিস্তার ঘটে, সিনেমা শিল্পের গোড়া থেকেই মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চ মধ্যবিত্তেরা মন্তব্য করে এসেছিলেন। সাধারণ মানুষের মনে সর্বদাই সিনেমার অভিনেত্রী মানেই আসলে একজন গণিকা এবং সে কথা সংবাদপত্র পত্রপত্রিকায় ব্যক্ত হচ্ছে। মিডিয়াগুলো বলছে–গ্ল্যামার দুনিয়ার মেয়েরা অভিনেত্রী সাইনবোর্ড কাজে লাগিয়ে অধিক অর্থ কামানোর লালসায় অনৈতিক ব্যাবসায় জড়িয়ে পড়ছে। কারণ শরীরলোভী পুরুষরা সিনেমা অভিনেত্রী, মডেল তারকা, টিভি অভিনেত্রীদের বেশি পছন্দ করে। তার জন্য তাঁরা যথেষ্ট মূল্য দিতেও এক পায়ে রাজি থাকে। হাই-ফাই জীবনের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রেই সবকিছু ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। তাঁদের কোনো ভদ্র যুবক বিয়ে করে না। যদিও-বা কোনো ক্লায়েন্ট রূপের মোহে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করে দু-এক বছর সংসার করে চম্পট দেয়। তখন এদের শরীর ছাড়া আর কোনো পুঁজিই থাকে না।
এক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের সিনেমানগরী ঢাকার অনেক অভিনেত্রী আছে, যাঁরা পুরোপুরি গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। এদের অনেকেই যৌবন হারিয়ে মাসির ভূমিকায় ব্যাবসা চালায়। সিনেমা জগতের গডফাদার থেকে শুরু করে বড়ো ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি আমলারা এঁদের ক্লায়েট। এইসব ক্লায়েন্টের মধ্যে অনেকে আবার ভাড়া করা কলগার্ল, নিজের বান্ধবী নিয়ে ওইসব গণিকালয়ে ফুর্তি করতে যায়। অনেক অভিনেত্রী আবার তাঁদের ক্লায়েন্টদের নিয়ে সেক্স ট্রিপে যায় এইসব গণিকালয়ে। বর্তমানে যেসব অভিনেত্রী নিজে এবং কয়েকজন মেয়ে নিয়ে দেহব্যাবসা চালাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতমা একা। পুরোনো ঢাকার বাসিন্দা একা চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী হয়ে যতটুকু নামডাক অর্জন করেছিল, তার চেয়ে বেশি দুর্নাম কুড়িয়েছিল এই যৌনপেশায় এসে। অভিনেত্রীর খাতায় নাম লেখানোর পরপরই অভিনেত্রী একা দেহব্যাবসায় এসেছিলেন। শরীর বিক্রি করে প্রচুর অর্থ কামানোই ছিল তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। একসময় যৌনবাজারে নিজের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাড়িতে কয়েকজন মেয়েকে বোন পরিচয়ে রেখে যৌনব্যাবসা চালাতে লাগল। বর্তমানে ইস্কাটন এলাকায় একা সেক্স সেন্টার চালায়। দেহব্যাবসাকে পেশা হিসাবে নিয়েছিল ঢাকার আর-এক বিতর্কিত অভিনেত্রী কেয়া। শুধু কেয়া একা নয়, তাঁর অপর ছয় বোন বীথি, সাথী, লাকি, তানিয়া, যুঁথি আর ইতিকে নিয়ে এক জমজমাট যৌথ যৌনব্যাবসা চালায় তাঁর গর্ভধারিণী মা সুফিয়া বেগম। যশোরের বহুল আলোচিত মক্ষীরানি সুফিয়া বেগম গুলশান অঞ্চলের ‘শেলফোর্ড নামের বাড়িতে যৌনব্যাবসা পরিচালনা করে, যে বাড়িটির মাসিক ভাড়া বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫৫,০০০ টাকা। বাংলাদেশের অভিনেত্রী সাদিয়া আফরিনকেও গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। একটি বাংলাদেশী এসকর্ট সার্ভিস প্রোভাইডার সাইটে ছবি সহ প্রোফাইল দেখা গেছে ‘নিনা’ ছদ্মনামে। অভিনেত্রী সাদিয়া আফরিন বিনোদন বিচিত্রা সেরা ফোটোসুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ২০১১ সালে মিডিয়ায় পা রাখে। মডেলিংয়ের পাশাপাশি বেশ কিছু সিনেমান আইটেম গানে কাজ করেন। এছাড়া বেশ কিছু সিরিয়াল ও টেলিফ্লিমেও কাজ করেছেন। এই হল অবস্থা! সেই কারণেই বোধহয় জনপ্রিয় মালয়ালাম অভিনেতা-সাংসদ ইনোসেন্ট ভারিদ থেক্কেথালা অবলীলায় বলে ফেলতে পারেন–“ছবিতে চরিত্র পাওয়ার জন্য তাঁদের যৌন-শোষণের মুখোমুখি হতে হয় না। যদি মেয়েটি খারাপ হয়, তবেই সে বিছানায় যায়।”