০৪. গণিকাবৃত্তির এক করুণ রূপ বিষকন্যা
মহাভারতের যুগে ‘বিষকন্যা’ নামক এক শ্রেণির সুন্দরী গণিকাদের কথা জানা যায়। এঁরা খুনে গুপ্তচর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তাঁদের কাজ ছিল যৌনসম্ভোগকালে ওষ্ঠ-চুম্বনে অথবা দন্তদংশনে এরা হত্যার জন্য প্রেরিত ব্যক্তির শরীরে বিষ ঢেলে দিত। সেই ব্যক্তি জ্ঞান হারালে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করত এবং তাঁর পুরুষাঙ্গটিও কেটে ফেলা হত। মহাভারতের চতুর্দশ অধ্যায়ের বিষয়ই বিষকন্যা পাঠিয়ে গুপ্তহত্যা। শ্রীসুখময় ভট্টাচার্য তাঁর ‘মহাভারতের সমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন–“অনেক সময় শত্রুপক্ষ সুন্দর যুবতীকে উপঢৌকন স্বরূপ পাঠাইয়া থাকেন। পরিমিত মাত্রায় বিষ হজম করাইয়া সেই সকল কন্যাকে এমনভাবে তৈয়ারি করা হয় যে, তাহাদের স্পর্শমাত্রই অপর প্রাণী মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া থাকে। সেই সকল কন্যাকে ‘বিষকন্যা’ বলে। গুপ্তচরের মুখে সমস্ত বার্তা অবগত হইয়া অতিশয় সাবধানে বাস করিবে। এই সকল প্রলোভন হইতে নিজেকে রক্ষা করিতে না পারিলে বিনাশ সুনিশ্চিত।”
শৈশবকাল থেকেই সুন্দরী কন্যাসন্তানদের শরীরে অল্প অল্প করে বিষ প্রয়োগ করে তাঁদের শরীরকে বিষ সহনীয় করে তোলা হত। এই প্রক্রিয়াকালে অনেক কন্যাসন্তান বিষের প্রভাবে মারাও যেত। যাঁরা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যেত, তাঁদের শরীর জুড়ে বিষের প্রবাহ। এইসব মেয়েরা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে উঠলে শত্রু কবজা করতে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এঁরা শরীরী-ছলনায় কামুক পুরুষদের দখল নিত। যে পুরুষ যৌনকামকে জয় করতে পারত, তাঁকে কবজা করা জটিল হয়ে পড়ত।যে জয় করতে পারত না, তাঁর মৃত্যু অনিবার্য।
মোট কথা, ক্ষমতাবান শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য বিষকন্যা পাঠানোর রেওয়াজ ছিলই। মৌযযুগেও এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। নন্দরাজার এক মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে বিষকন্যা পাঠিয়েছিল। চাণক্যের কুট-বিচক্ষণতায় সেই বিষকন্যাকে পর্বতক নামে এক ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পর্বতক বিষকন্যায় শরীরী ছলনায় আত্মসমর্পণ করলে তাঁর মৃত্যু হয়। ভারতবর্ষে ‘বিষকন্যা’ গণিকাদের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়েই। বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকের প্রথম ও দ্বিতীয়াংশে বিষকন্যাদের উল্লেখ আছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও বিষকন্যার হদিস পাওয়া যায়। কল্কিপুরাণে সুলোচনা (সুলোচনা ছিলেন গন্ধর্ব চিত্রগ্রীবের স্ত্রী) নামে এক বিষকন্যার কথা জানা যায়। এইসব বিষকন্যার নজরে কোনো পুরুষ পড়লেই পুরুষটি মারা যায়।
তৎকালীন রাজারাও বিষকন্যাদের নিয়োগ করতেন শক্রনিধনের স্বার্থে। এহেন বিষকন্যারা একদিকে যেমন বহুপুরুষগামী, অপরদিকে হত্যাকারী। জিশুর জন্মের ৩২৭ বছর আগে আটাশ বর্ষীয় এক শক্তিশালী গ্রিক রাজার কথা জানতে পাই। তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল পশ্চিম ইউরোপ থেকে পারস্য পর্যন্ত। এই রাজা পারস্যরাজ দরায়ুসকে পরাজিত করে পৌঁছোলেন ভারত ভূখণ্ডে এবং ভারত জয় করে নিলেন। পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টক, অশ্বক জাতির রাজারা একে একে তাঁর কাছে পরাজিত হলেন। তক্ষশীলার রাজাও আত্মসমর্পণ করলেন। অর্ধেক পৃথিবীর ‘রাজা’ তৃতীয় আলেকজান্ডারের শিবিরে বহুমূল্যের উপঢৌকন পাঠালেন ভারতীয় রাজ্যের রাজা সিকান্দার। সঙ্গে পাঠালেন পাঁচ অপরূপ সুন্দরী লাস্যময়ী নারী। সেই ক্ষীণকটির রূপবৈভবে মুগ্ধ হয়ে গেলেন গ্রিক শিবির। নারীর প্রতি যে আলেকজান্ডারের আসক্তি ছিল, সে কথা ততদিনে ভারতে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই আসক্তিকেই সুচারুভাবে কাজে লাগালেন ভারতীয় রাজা। আলেকজান্ডারও ঘুণাক্ষরে টের পেলেন না ভারতীয় রাজার কৌশল। লুব্ধ দৃষ্টিতে মোহিত হয়ে লাস্যময়ী নারীর দিকে এগোতে থাকলেন আলেকজান্ডার। ভারতীয় রাজা এই সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আত্মসমর্পণের বদলা নিতেই রাজা লাস্যময়ীদের পাঠিয়েছিলেন। গ্রিকশিবিরের আলেকজান্ডারের সঙ্গে ছিলেন অ্যারিস্টটল। আলেকজান্ডারের গুরু। লাস্যময়ীর নৃত্যে আলেকজান্ডার মোহিত হয়ে গেলেও অ্যারিস্টটল সতর্ক ছিলেন। তিনি আলেকজান্ডারকে সতর্ক করে বললেন–“আর এগিয়ো না বৎস। এই লাস্যময়ী বিষকন্যা”। আলেকজান্ডার বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না গুরুকে।গুরু অ্যারাস্টটলের দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকাতেই গুরু বললেন–“অপেক্ষা করো বেটা। আমি প্রমাণ দিচ্ছি”। অ্যারিস্টটল ঈশারায় দুজন দাসকে কাছে ডাকলেন এবং আদেশ দিয়ে বললেন–“ওই নারীর ওষ্ঠে চুম্বন করো”।
চুম্বন করবে কী! তাঁরা সেই লাস্যময়ী নারী শরীর স্পর্শ করামাত্রই দুজন দাসই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এখানেই শেষ নয় পরীক্ষার। তিনি সেই নারীকে আলেকজান্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ঘোড়াকে স্পর্শ করতে বললেন। নারীর স্পর্শে নিমেষে তেজি ঘোড়া নিস্তেজ হয়ে গেল। এবার আলেকজান্ডারের মোহ ভাঙল এবং তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দিল এই গুপ্তঘাতিনী লাস্যময়ী নারীকে। তারপর বিষকন্যাকে পুড়িয়ে দেওয়া হল। এ কাহিনি পাওয়া যায় কবি গুইলাম ডি চেরভেরা রচিত ‘রোমানিয়া গ্রন্থ থেকে। এ কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছিল ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি পর্যন্ত। এছাড়া আলেকজান্ডারের যেসব উপদেশ অ্যারিস্টটল দিয়েছিলেন, তার একটা সংকলন প্রকাশিত হয়। সংকলনটির নাম ‘সিক্রেটা সিক্রেটোরাম’। সিক্রেট সিক্রেটোরামে অ্যারিস্টটল ভারতের বিষকন্যাদের থেকে শত হস্তে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আলেকজান্ডারকে। অ্যারিস্টটল এটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, অতীতে বহু রাজা খতম হয়েছেন এই বিষকন্যাদের সংসর্গে। ভারতের মতোই আকর্ষণীয় ভারতের বিষকন্যাদের কাহিনি। এই বিষকন্যারা গণিকা হিসাবে পরিচিত হলেও তাঁর সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে উঠত পারত না শিকার। কারণ তাঁদের সামান্য স্পর্শেই শিকারের মৃত্যু অনিবার্য। সেই কারণেই বিনা যুদ্ধে শত্রুবিনাশে এই অপ্সরা-সুন্দরীদের ব্যবহার করত রাজা, মহারাজা, সম্রাটরা।
যে পদ্ধতিতে বিষকন্যাদের বিষসহনে অভ্যস্ত করা হত তার নাম মিথ্রিডেটিজম। গ্রিসের পন্টাসের রাজা ষষ্ঠ মিথ্রিডেটস নিজের শক্তিশালী শত্রুদের দমন করার জন্য প্রথম বিষকন্যাদের বিষময় করে তোলার পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তিনি ভীত ছিলেন এই ভেবে যে, তাঁর মা তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করবে। সেই ভয়ে তিনি জঙ্গলে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে বনচরদের কাছ থেকে শিখে নেন কীভাবে অল্প পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করিয়ে বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করা যায়। বিষকন্যারা তাঁদের রূপের জালে রাজা বা রাজপুরুষ বা বণিকদের ফাঁসিয়ে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করত প্রতিপক্ষ। শক্তিশালী শত্রু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মানবঘাতক বিষকন্যাদের ব্যবহার করার সবথেকে বড়ো সুবিধা হল, তাঁদের বিষকন্যা হিসাবে চেনা অত সহজ ছিল না। ভোগলালসা নারীসঙ্গে ডুবে থাকা রাজারা খুব সহজেই গণিকা বিষকন্যাদের সৌন্দর্য ও লাস্যের ফাঁদে পড়ে মৃত্যুর দেশে পৌঁছে যেত নিমেষের মধ্যেই। বিষকন্যাদের যে চেন যেত না, তা কিন্তু নয়। অভিজ্ঞরা অবশ্যই চিনতে পারতেন।
প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত তিন চিকিৎসক হলেন–চরক, সুশ্রুত ও ভাগবত। এঁরা তাঁদের রচিত গ্রন্থে বিষকন্যাদের কথা লিখে গেছেন। সেখানে বলা হয়েছে বিষকন্যাদের চেনার সহজ উপায়–(১) অকারণ হাসি, (২) চুলে আঙুল চালানো, (৩) সন্দেহজনক আচরণ, (৪) অতিরিক্ত কথা বলা, (৫) মাটি আঁচড়ানো, (৬) ঘনঘন পিছন ফিরে দরজা দেখা, (৭) কোনো প্রশ্ন করলে নীরব থাকা ইত্যাদি।
বিষকন্যার বিষের সঙ্গে কীভাবে রক্ষা পেতে হবে, সেই উপায়ও বাতলে দিয়েছেন চিকিৎসক সুশ্রুত। কীভাবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে সে কথাও বলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মেয়েদের অন্ন, দাঁত মাজার সামগ্রী, চুলের তেল, জামাকাপড়, স্নানের জল, চোখের পথ্য, অলংকার, প্রসাধনী দ্রব্য ইত্যাদিতে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রাচীন যুগে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই বিষকন্যাদের ব্যবহার ছিল। বোহেমিয়ার রাজা দ্বিতীয় ওয়েনচেসলাউসের মৃত্যু হয় বিষকন্যাদের সংসর্গেই। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতের রাজনীতিতে বিষকন্যাদের দাপট ছিল ব্যাপক। অঙ্গ, কোশল, কাঞ্চী, অবন্তী সহ একাধিক রাজাদের পরাজিত করে মগধের উত্থান হয়েছিল এই বিষকন্যাদের সংসর্গে। মুদ্রারাক্ষস, অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে সেইসব রোমহর্ষক কাহিনি পাওয়া যায়। নন্দবংশের শাসনামলে বিষকন্যা কর্তৃক রাজা ও রাজপুরুষদের গুপ্তহত্যা প্রবলভাবে বেড়ে যায়। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা একবার মরতে মরতে বেঁচে যান চাণক্যের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে। মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে মগধসম্রাট ধননন্দের সঙ্গে বিরোধ ছিল। দাম্ভিক, প্ৰজাবিদ্বেষী রাজা ধননন্দের ভয়ে চন্দ্রগুপ্ত জঙ্গলে আত্মগোপন আছেন। প্রজ্ঞা ও চতুর কৌশলে চাণক্য আভাস পাচ্ছিলেন চারপাশে চন্দ্রগুপ্তকে হত্যার চক্রান্ত চলছে, তার মধ্যে বিষকন্যা কর্তৃক বিষের আক্রমণের সম্ভাবনাই ছিল প্রবল। তাই চন্দ্রগুপ্তের খাবারে তিনি গোপনে প্রতিদিন বিষ মিশিয়ে দিতেন। বিষের স্পর্শ থেকে বাঁচাতে চাণক্য এইভাবেই চন্দ্রগুপ্তের শরীরকে তৈরি করতে থাকলেন। যুদ্ধে ধননন্দের মৃত্যু হলেও ধননন্দের রাক্ষস নামক মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্তের কাছে এক লাস্যময়ী বিষকন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন। মৌর্যসম্রাটের ছায়াসঙ্গী চাণক্য সেই বিষকন্যাকে দ্রুত চিনে ফেললেন। তিনি সেই বিষকন্যাকে চন্দ্রগুপ্তের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দিলেন না। বিষকন্যাকে পাঠিয়ে দিলেন পর্বতকের কাছে। পর্বতক ধননন্দের পুত্র। পর্তক চন্দ্রগুপ্তের প্রতিদ্বন্দ্বী। চন্দ্রগুপ্তের পথের কাঁটা হয়ে তিনিও গোপনে ষড়যন্ত্র রচনা করছিলেন। চন্দ্রগুপ্তকে পাঠানো বিষকন্যার ছোবলেই পর্বতকের মৃত্যু হয়।
তবে এমন শোনা যায় যে, বিষকন্যারা একবার কারোর মৃত্যুর কারণ হলে তাঁর শরীর থেকে বিষ শেষ হয়ে যেত। তাই একই সঙ্গে দুজনের মৃত্যু ঘটানো সম্ভব হত না, যতক্ষণ-না নতুন করে তাঁদেরকে বিষের জোগান দেওয়া হত। বিষ হজম করে বড় হতে থাকা মেয়েদের উপর চলত বিশেষ প্রশিক্ষণ। রাজ্যের বিশিষ্ট গণিকা, নর্তকীদের তত্ত্বাবধানে চলত এঁদের শিক্ষাদীক্ষা। শরীরের প্রতিটি অঙ্গের ব্যবহার কীভাবে সুচারুভাবে করতে হয়, তার শিক্ষা নিতে হত। শিখতে হত মোহময় বাক্যজাল বিস্তার। পুরুষকে আকর্ষণ করার সমস্ত ছলাকলাই শিখতে হত। এর সঙ্গে শিখতে হত ছদ্মবেশ ধারণ করা ও কামকলা। তাঁদের চলনে, বলনে, শরীরী কটাক্ষে ঝরে পড়তে হবে উত্তেজক যৌনতা। সেই যৌনতায় খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে তাবড় রাজা-মহারাজা বীরপুরুষরা।
এইসব বিষকন্যাদের মতো হত্যাকারিণীদের কি কোনো শাস্তির বিধান ছিল? না, এমন কোনো বিধান বা নির্দেশ ছিল না। তবে কোনো মেয়েকে বিষকন্যা বলে টের পেলে তাঁর শরীর তলোয়ার দিয়ে টুকরো টুকরো কেটে ফেলা হত। তারপর মাটিতে পুঁতে দেওয়া কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হত। আমি আগেই উল্লেখ করেছি আলেকজান্ডারও তলোয়ার দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করেছিল গুপ্তঘাতিনী লাস্যময়ী বিষকন্যাকে। তারপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেটে দু-টুকরো করে দেওয়াই হোক বা মাটিতে পুঁতে ফেলাই হোক, আগুনে পুড়িয়ে দেওয়াই হোক–কী যায় আসে! এই অভাগাদের জীবন কি জীবন! মৃত্যুতেই এই অভাগা নারীদের মুক্তি। সেই শৈশবকাল থেকেই তাঁদের নিয়মিত বিষপান করতে হত রাজাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায়। নিজের শরীরে বিষ প্রতিরোধ করার সক্ষমতা এলে মানুষ মারার উপযুক্ত হয়ে উঠলে সেই মেয়েদের পাঠানো হত বিভিন্ন রাজার দরবারে। সব মেয়েই বিষ প্রতিরোধ করতে পারত না। অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন। হত অকালমৃত্যু। ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকলে কোনো রাজার বিশ্বাসভাজন হয়ে থাকতে হত শরীরে বিষের জ্বালা নিয়ে। সেই রাজা যখন মনে করত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপক্ষ রাজাকে হত্যা করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, তখন এইসব মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হত সংশ্লিষ্ট রাজার বিলাসভবনে।এঁদের প্রথম কাজ ছিল রাজার খাবারে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো। তবে রাজাকে সন্দেহমুক্ত করার জন্য নিজেকেও সেই বিষ মেশানো খাবার খেতে হত। এরপর রাজা সেই বিষ-খাবার খেয়ে মারা যেত, কিন্তু বিষকন্যাদের কিছু হত না। রাজাদের সাম্রাজ্যগ্রাসের কুটিল রাজনীতিতে বিষই হয়ে উঠেছিল বিষকন্যাদের জীবনের একমাত্র পরিচয়, যাকে ইচ্ছামতো ব্যবহার করত সেকালের ধুরন্ধর রাষ্ট্রনেতা, সমরবিদরা।
পৃথিবী জুড়ে আজও এঁরা আছে। কেবল পদ্ধতি পালটে গেছে। অন্য রূপে। অন্য ভাবে। যেমন ধরুন হাতের কাছে হানি ট্র্যাপ। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল হানি ট্র্যাপের কাছে ঘায়েল হওয়ার। এরা সেইসব নারী, যাঁদের আন্তরিক আহ্বান, সহজ-সরল চোখদুটিকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা খুব কম পুরুষেরই আছে। এঁরা পুরুষদের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে গোপন তথ্য বের করে আনে। ১৯১০ সালে বার্লিন থেকে প্যারিস সারা ইউরোপ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াত মাতা হারি নামে এক গণিকা গুপ্তচর। পামেলা বোর্দেও ছিল এমনই এক গণিকা গুপ্তচর। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের চর ডামিনি ম্যাকনট নামে এক লাস্যময়ী নারীর ফাঁদে পা দেন বিমান বাহিনীর ওই অফিসার। তিনি নাকি বাহিনীর রণকৌশল পাচার করেছিলেন। সিআইএ, মোসাদ, র, হামাস, কেজিবি, আইএসআই সব গোয়েন্দা সংস্থার তূণে আছে এই গণিকা গুপ্তচর। ‘হানি ট্র্যাপ’ মানেই যে ‘মধুর ফাঁদ’। এই মধুর ফাঁদে শত শত রাঘব বোয়াল ধরা দেবেন এ আর নতুন কথা কী।