১২. অন্য দেশ : প্রাচীন সভ্যতায় গণিকাবৃত্তি
ইহুদি ধর্ম গোত্রের ভিতরে সদস্য-সদস্যাদের কাউকেই গণিকাবৃত্তিতে উৎসাহিত করত না। বরং সেটা তাঁদের নৈতিক আইন অনুসারে জঘন্য অপরাধ বলে বিবেচিত হত। তবুও ইতিহাসে খুব অল্প সময়ের জন্যই তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল। তাই তাঁদের নিজস্ব গোত্রের মধ্যে গণিকাবৃত্তি দমন করতে পারলেও নগর থেকে গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ করতে পারেনি। যত বড়ো নগর তত বেশি গণিকা, তত বেশি ব্যাভিচার। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ‘লিডিয়ান’ ও ‘সাইপ্রিয়ান’ জাতির মেয়েরা দূরবর্তী অঞ্চলে গিয়ে গণিকাবৃত্তি করে অর্থসংগ্রহ করে এনে বিয়ে করত। ভারতেও কয়েকটি প্রদেশে রাজাদের অধীনে ‘নাইক’ নামে একটি সম্প্রদায় ছিল। নাইক মেয়েরাও সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য গণিকাবৃত্তিতে অংশ নিত। পুরোহিতেরাও কখনো-কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে মেয়েদেরকে গণিকাবৃত্তিতে নিযুক্ত করত। যেমন ব্যাবিলোনিয়ায় মেয়েদেরকে ইশতার মন্দিরে যেতে হত। মন্দিরের যে পুরুষ প্রথমে জিভ দিয়ে ওই মেয়েকে রুপোর মুদ্রা নিক্ষেপ করবে, সেই পুরুষ ওই শরীর ভোগের অধিকার পাবে। এ নিয়ম মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিম আফ্রিকাতেও প্রচলন ছিল।
প্রাচীন গ্রিস, রোমে এ ধরনের গণিকাবৃত্তির প্রথম উৎপত্তি। গ্রিক সভ্যতাও একটা পর্যায়ে শুধুমাত্র গণিকাবৃত্তির জন্যই বিখ্যাত ছিল। তাঁদের নগরে যদিও গণিকাদের নাগরিক অধিকার ছিল সামান্য। তবে নগরের অধিকাংশ সম্পদের মালিক ছিল গণিকারা। তাঁরাই নগরের সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের বিলাস ও ব্যাভিচারের অর্থ প্রদান করত। উচ্চাভিলাষী যে-কোনো নারী সে সময়ে স্ব-ইচ্ছায় গণিকাবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করত এবং তাঁরা অর্থে-বিত্তে-সম্মানে কারোর থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে ছিল না। বরং সামনের কাতারেই অবস্থান করত। প্রাচীন গ্রন্থাদি সূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসাবে খ্যাত হেরোডেটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র’ গণিকাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত এবং সেবাশুশ্রষার নমুনা হিসাবে একজন বিদেশির সঙ্গে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হত। একই ধরনের গণিকাবৃত্তির চর্চা হত সাইপ্রাস এবং করিন্থে। এটার বিস্তৃতি পেয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে, যেমন–সিসিলি, ক্ৰটন, রোসানো ভাগলিও সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা যায়, এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নামও। ইসরায়েলে এটি একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল। আগেই বলেছি, প্রাচীন গ্রিকের এথেইনাইয়ের কবি সোলোন (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৯০), যিনি তৎকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসাবে গণ্য হতেন। খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম গণিকালয় স্থাপন করেন। এই গণিকালয়ের উপার্জন দিয়ে আফ্রোদিতিকে নিবেদন করে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমক সম্রাজ্ঞী থেওডেরো প্রথম জীবনে গণিকা ছিল। বোসপোরুসে তিনি ৫০০ গণিকার জন্য একটি নির্দিষ্ট গণিকালয় গড়ে তুলেছিলেন। প্রাচীন হেল্লাস বা গ্রিস দেশের আথেনাই বা এথেন্সে গণিকালয় ছিল। প্রাচীন গ্রিসের লোকেরা স্ত্রী ছাড়াও অন্য মহিলাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতে পারত এবং করত। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ, পরিব্রাজক ও কূটনীতিক মেগাস্থিনিস এক ধরনের পরিদর্শকের কথা বলেছেন, যাঁরা রাজ্যের সকল কার্যক্রমের উপর গণিকাদের সহায়তায় নজর রাখত এবং রাজার কাছে গোপনে রিপোর্ট করত।
রোমান আমলেই পৃথিবীতে প্রথম গণিকাবৃত্তির লাইসেন্স দেওয়া হয় ও কর ধার্য করা হয়। রোমানরা গণিকালয়কে ‘নুপানরিয়া’ (Lupanaria) বলত। তাঁরা ক্রীতদাসীদের সবসময় গণিকা হিসাবে কাজ করাত। যখন এঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকল, তখন এইসব গণিকাদের আলাদা করে রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। অনেক সময় গণিকাদের রূপে মুগ্ধ হয়ে রোমান যুবকরা বিয়ে করতে শুরু করল। সেসময় রক্তের পবিত্রতা ও বংশের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য গণিকালয় তুলে দেওয়ার জন্য বিপ্লব দানা বেঁধে ওঠে। দানা বাঁধলেই হল! সেখানকার সম্রাট গণিকালয় থেকে প্রচুর খাজনা পেত। অতএব আর্থিক দিক দিয়ে চিন্তা করে গণিকালয় ও গণিকাবৃত্তি নিষিদ্ধ করা সম্ভব হল না।
চিনে তাও রাজবংশ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় গণিকাবৃত্তি চালু করে। পরবর্তী সাঙ রাজবংশ (৯৬০ থেকে ১১২৬ সাল) ক্যাফেতে ও অন্যান্য প্রমোদস্থানে যেসব মহিলারা গণিকাবৃত্তি করত, তাঁদের হাংচৌ শহরে সীমাবদ্ধ করে দেয়। ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম ‘পবিত্র’ গণিকার দেখা মেলে।
সূর্যোদয়ের দেশ প্রাচ্যের সুপ্রাচীন সভ্যতার দেশ নিপ্পন তথা জাপানে ঠিক কবে কোন্ অঞ্চল থেকে গণিকাবৃত্তির উদ্ভব হয়েছিল, তা অবশ্যই গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে জাপানের গণিকাবৃত্তির ঐতিহ্য খুবই গভীরে প্রোথিত অনুমান করা যায়। প্রাচীন জাপানে জিশুখ্রিস্টের জন্মের আগের সময়ে জাপানের গণিকাবত্তি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে কমপক্ষে হেইয়ান যুগ (৭৯৪-১১৮৫ খ্রিস্টাব্দ) থেকে কামাকুরা যুগ (১১৮৫-১৩৩৩ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত শরীর ভাড়া ও শরীর বিক্রির তথা যৌনতা বিক্রি পেশা হিসাবে গ্রহণ করার কথা জানা যায়। সে সময়ে ‘ইউজো’ বা ‘আসোবি মে’ নামে গণিকারা কেবল পেশাগতভাবে শরীরসর্বস্বই ছিল না, তাঁরা নাচ-গান-অভিনয় করেও অর্থ রোজগার করত। নারা যুগ (৭১০-৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ) থেকে হেইয়ান যুগ পর্যন্ত ‘মিকো’ বা ‘ফুজো’ নামে মেয়েরা শিন্টোও ধর্মীয় ‘জিনজা’-তে সেবাদাসী হিসাবে কাজ করত। এঁরাই পরবর্তীকালে সেবাদাসীর কাজ ছেড়ে অনেকেই বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত সরাইখানা, মন্দির সংলগ্ন হাট-বাজার, নদী-বন্দর বেছে নিল যৌনকর্মে অংশ নিতে। কামাকুরা যুগ থেকে মুররামাচি যুগ (১৩৯২-১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ‘কোওশোকুকা’ (অশোভন), ‘কেইসেইইয়া’ (রাজকীয়) প্রভৃতি গণিকালয়গুলি ব্যক্তিগতভাবে গড়ে উঠছিল। সেইসময়ে ‘ৎসুজিকো’ নামে এক প্রভাবশালী গণিকা একটি বিশাল গণিকালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল।
আদিম সমাজে গণিকাবৃত্তি আয়ের উৎস হিসাবে যথেষ্ট আদৃত ছিল। ধর্মের দিক থেকে, সমাজের দিক থেকে, পিতা-মাতা ও স্বামীর পক্ষ থেকেও কক্ষনো ঘৃণা করা হত না। তা ছাড়া মেয়ের উপর পিতা বা স্বামীর একচ্ছত্র অধিকার ছিল বলে দুর্দিনে তাঁরা আর্থিক উন্নতির জন্য তাঁদের কর্তৃত্বাধীন মেয়েদের যৌনপেশায় উৎসাহ দিত। ঈশ্বরের পরেই স্বামীর স্থান, তাই স্বামীকে সাহায্য করা মানেই ধর্মীয় কাজ হিসাবে বিবেচিত হত। প্রাচীন যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গণিকাবৃত্তির প্রচলন ছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এও গণিকাদের কথা জানা যায়।