০৬. প্রাচীন সাহিত্যে গণিকা
আগেই বলেছি সংস্কৃত সাহিত্যের বিভিন্ন সমাজে দেবতা ও মানুষের সঙ্গে সঙ্গে গণিকাদের সঙ্গেও সহাবস্থানের প্রমাণ মেলে।এই সময়কালে গণিকারা সাধারণের চোখে মোটেই ঘৃণিত ছিলেন না, বরং মর্যাদার সঙ্গে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ ও জীবনযাপন করতেন। প্রাচীন ভারতে ভারতের নাগরিক জীবনে গণিকারা বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। মোটের উপর প্রাচীন ভারতের সামাজিক জীবনে যে গণিকাদের গৌরবময় ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান ছিল তা তৎকালীন সাহিত্যই প্রমাণ দেয়। সেসময়ে গণিকাদের ডাক পড়ত উৎসব-অনুষ্ঠানেও। কারণ সেই সময়ের মানুষ মনে করত গণিকা-দর্শনে দিন ভালো যায়। এঁরা সৈন্যবাহিনীরও অনুচারিণী হত। ভিনদেশীয় কোনো রাজা এলে নগরের বাইরে গিয়ে গণিকারা তাঁদের অভ্যর্থনা করত। সংস্কৃত সাহিত্যের পাতায় পাতায় প্রচুর গণিকাদের বিবরণ পাওয়া গেলেও তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত ছিল। কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে পারি–বসন্তসেনা, বাসবদত্তা, শ্যামা, আম্রপালী প্রমুখ। প্রাচীন সাহিত্যের এইসব গণিকারা সুদীর্ঘকাল অতিক্রম করে একেবারে হাল আমলের সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে। গণিকাদের বিচরণক্ষেত্র একালের মতো সেকালে শুধুমাত্র কামুক পুরুষদের জন্য ছিল না। বরং রাজ-সমীপে বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে বেঁচেবর্তে থাকত।
মহাকবি কালিদাসের মহাকাব্যগুলিতে গণিকাদের উল্লেখ আছে। মেঘদূতে আমরা গণিকাদের কথা জানতে পারি। বিক্রমোঝশীয়ম্ নাটকে মহাকবি যে উর্বশীকে নায়িকা করেছেন তিনি একজন বহুভোগ্যা গণিকারমণী। অবশ্যই উর্বশী ছিলেন তথাকথিত ‘স্বৰ্গবেশ্যা’। “নীচৈরাখ্যং গিরিমধিবসেস্তত্র বিশ্রামহেতোস্তৃৎসম্পকাৎ পুলকিতমিব প্রৌঢ় পুষ্পৈঃ কদম্বৈ/যঃ পণ্য স্ত্রী রতিপরিমলোদগারিভিৰ্মাগরানামুদ্দামানি প্ৰথয়তি শিলাবেশ্মভিযোবনানি (মেঘদূতম্, পূর্বমেঘ, ২৫)। শুধু কালিদাস কেন, বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস গ্রন্থ থেকে জানা যায়–সেকালের গণিকাদের সঙ্গে রাজা ও সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কাহিনি। সেকালের গণিকারা নানা বসনভূষণে অলংকৃত হয়ে রাজপথে কীভাবে শোভাবর্ধন করতেন, তারও উল্লেখ আছে। সপ্তম শতকের লেখক বাণভট্ট তাঁর কাদম্বরী গ্রন্থে লিখেছেন–সেকালে গণিকারা দেশের রাজাদের স্নান করাত। রাজাদের মাথায় আমলকী ঘষে দিত। স্নানের পর রাজাদের সারা শরীরে চন্দন, আতর, কুমকুম ইত্যাদি মাখিয়ে দিত। এমনকি রাজাদের পরনের যাবতীয় পোশাক গণিকারাই পরিয়ে দিতেন। নবম শতকে রচিত ‘কুট্টনীমত’ গ্রন্থে দামোদরগুপ্ত লিখেছেন–সেকালের বারাণসী নগরীতে মালতী নামে গণিকা বাস করত। সেই নারী গণিকা সংক্রান্ত নানা প্রয়োজনীয় উপদেশ নিতে বিকরবালা নামের এক বৃদ্ধা গণিকার কাছে যেতেন। কুট্টনীমত’ গ্রন্থটির উপজীব্যই হল সেই বৃদ্ধা গণিকার বিবৃত যৌনক্রিয়া সংক্রান্ত উপদেশাবলি। শ্রীধরদাস তাঁর ‘সদুক্তিৰ্ণামৃত’ গ্রন্থে তৎকালীন বঙ্গদেশের গণিকাদের বিবরণ দিয়েছেন। এখানে ‘তকালীন’ বলতে দ্বাদশ শতক বুঝতে হবে। শ্রীধরদাস বলেছেন–“বেশঃ কেষাং ন হরতি মনো বঙ্গ বারাঙ্গনানা”। ভবভূতির মালতীমাধব’ গ্রন্থে ব্রাহ্মণ মাধব সিংহলে বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদশালী হন। এরপর কুবলয়াবলি নামের এক সুন্দরী গণিকার প্রেমে পড়ে যান এবং যথারীতি যৌনমিলন কার্ব সম্পন্ন করেন। ব্রাহ্মণের মোহাবিষ্টতার সুযোগ নিয়ে সেই গণিকারমণী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি হরণ করে চম্পট দেয়। পরে অবশ্য কুবলয়াবলিকে পাকড়াও করে এবং তাঁর নাক-কান কর্তন করে ছেড়ে দেন। এটাই মালতীমাধবের বিষয়। চারুদত্ত’ গ্রন্থে লেখক ভাসের কাহিনির উপজীব্য হল চারুদত্ত ও বসন্তসেনার প্রেম। বসন্তসেনা হলেন একজন গণিকা, যাঁর বিয়ে হয় চারুদত্ত নামের জনৈক ব্রাহ্মণ যুবকের সঙ্গে।এছাড়া শর্বিলক নামে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে মদনিকা নামে এক গণিকার বিয়ের কাহিনিও আছে।
জবালা এক বহুচারিণী বা গণিকার নাম। সামবেদীয় ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে জানতে পাই জবালা ও সত্যকামের কাহিনি। সত্যকাম জানতেন না তাঁর পিতৃপরিচয়। পিতৃপরিচয় নেই বলে সত্যকাম কোনো গুরুগৃহে বিদ্যাশিক্ষার জন্য যেতে পারতেন না। বহুচারিণী জবালাও খুব স্বাভাবিকভাবেই জানতেন সত্যকামের প্রকৃত পিতা কে। পরে অবশ্য সত্যকামের বিদ্যাশিক্ষার উপর আগ্রহ অনুভব করে গুরু গৌতম শিক্ষাদান করেছিলেন। বেদের যুগেও আমরা গণিকাদের পাচ্ছি। ঋকবেদে গণিকাদের বলা হত ‘জারিণী” “হপ্তাশ্চ বভ্রবো বাচমত এমদেং নিষ্কৃতং জারিণী” (অর্থাৎ ভ্ৰষ্টা নারী উপপতির নিকট গমন করে)। ঋকবেদে গণিকাদের ‘দিধিষু’ ও ‘সাধারণী’ বলা হয়েছে। অথর্ব বেদে বলা হয়েছে মহানগ্নী’, ‘পুংশ্চলী’। তবে একথা বলতেই হয়, তৎকালীন বৈদিক সাহিত্যে গণিকাদের বিষয়ে সরাসরি কোনো আলোচনা না-হলেও এটা অনুমান করা যায় যে, তৎকালীন সমাজে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য।
বেদের যুগে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি মহত্বপূর্ণ হলেও মনুসংহিতার যুগে এসে নিন্দিত হয়েছে। স্মৃতিকারেরা প্রবঞ্চক, জুয়ারী, তস্করদের সঙ্গে গণিকাদের একাসনে বসিয়ে দিয়েছেন। মনু স্পষ্টভাবে বলেছেন–ব্রাহ্মণ কিংবা গৃহস্থ ব্যক্তির পক্ষে গণিকাদের কাছ থেকে কোনো দান অথবা ভক্ষদ্রব্য গ্রহণ করা দূষণীর। ব্রাহ্মণ কখনোই গণিকাগমন করবে না। যদি যায় তাহলে তাঁকে কৃচ্ছসাধন করে পবিত্র হতে হবে। মনু বলছেন–ষড়দোষে (অধিক মদ্যপান, অসৎ পুরুষ সংসর্গ, স্বামীবিচ্ছেদ, ইতস্তত ভ্রমণ, অসময়ে নিদ্রা এবং পরগৃহে বাস) দুষ্ট রমণী ব্যভিচারিণী হয়ে থাকে (“ষট স্ত্রিয়া ব্যভিচারায়া দোষ জনকানি তস্মাদেতেভ্য এতা রক্ষণীয়াঃ”), এ থেকেই বোঝা যায় সে যুগে ব্যভিচারিণী বা গণিকার উপস্থিতি ছিল। মনু গণিকাদের অশালীন আচরণ করার অপরাধে নানা রকম শাস্তির বিধান দিয়েও গেছেন। মনুর যুগে বিশেষ কোনো গণিকার নাম উল্লেখ না থাকলেও তৎকালীন সমাজে প্রচুর গণিকার উপস্থিতি প্রমাণিত হয় স্মৃতিশাস্ত্রের বিভিন্ন উক্তি থেকে। গণিকাদের মনে করা হত মানুষের চলার পথে কণ্টক স্বরূপ (“প্রকাশলোক বঞ্চকার চাবৈর্জনীয়াৎ”)। সেই কারণেই এঁদের ধরার জন্য রাজার চরেরা ঘুরে বেড়াত। যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতায় গণিকাদের কথা জানা যায়। যাজ্ঞবন্ধ্যে গণিকাদের ‘স্বৈরিণী’ বলা হয়েছে। স্বৈরিণী হল তাঁরাই, যাঁরা স্বীয় স্বামীকে পরিত্যাগ করে ইচ্ছাপূর্বক কোনো পরপুরুষের আশ্রয় করে। যাজ্ঞবল্ক্য গণিকাদের জন্য কিছু নিয়মনীতিও ঠিক করে দিয়েছিলেন। যেমন–(১) কোনো গণিকা যদি খরিদ্দারের কাছ থেকে শুল্ক গ্রহণ করে বা অগ্রিম অর্থ নিয়ে পরে যৌনমিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে গৃহীত অর্থের দ্বিগুণ খরিদ্দার পুরুষটিকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য থাকবে। অন্যথায় গণিকার দেহদানের সমান অর্থ পুরুষটাকে ফিরিয়ে দিতে হবে–“গৃহীত বেতনা বেশ্যা নেচ্চন্তী দ্বিগুণং বহেৎ।/অগৃহীতে সমং দাপ্যঃ পুমাণপ্যেসেব চ”। (২) কোনো পুরুষ যদি গণিকাকে দেহদানের নিমিত্ত অর্থ দিয়েও তাঁর সঙ্গে যৌনসংসর্গ না-করে, তাহলে তাঁর দেয় অর্থ সেই গণিকার কাছ থেকে কোনোমতেই ফেরত পেতে পারে না–“অযৌন গচ্ছতো যেধাং পুরুষং বাপি মোহতঃ।/চতুর্বিংশতিকো দণ্ডস্তথা প্রব্রজিতাগমো”। শুধুমাত্র মনুসংহিতা বা যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতাতেই নয়, পরাপরসংহিতা ও বিষ্ণুসংহিতাতেও গণিকাগমন নিন্দনীয় গণ্য করেছে। বলা হয়েছে, গণিকাগমন হস্তমৈথুনতুল্যের মতো অপরাধ। হিন্দুধর্মে হস্তমৈথুন বা স্বমেহনকে পাপকাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। গৌতমসংহিতায় সর্বসাধারণের ভোগ্যা নারীকে হত্যা করলে হত্যাকারীর কোনো শাস্তি হবে না বলেছে। গণিকার অনুগ্রহণও নিষিদ্ধ, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের।
তা সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই, প্রাচীন ভারতে জীবনের অপরিহার্য অঙ্গই ছিল গণিকারা। কোনো মহৎ উৎসব অনুষ্ঠান গণিকাদের উপস্থিতি ছাড়া হতই না। রামায়ণে আমরা দেখতে পাই গণিকার লোভ দেখিয়ে বিভাণ্ডক মুনির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিকে অযোধ্যার যজ্ঞে আনা হয়েছে। ঋষ্যশৃঙ্গ লোকালয়ের আসা একদম পছন্দ করতেন না। যত জরুরি কাজ থাক না-কেন কখনোই তিনি লোকালয়ে আসতেন না। অতএব রাজা দশরথকে তাঁর অমাত্য সুমন্ত পরামর্শ দিলেন–“মহারাজ, মানুষ সর্বদা যা কামনা করে এবং যাতে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে এমন ইন্দ্রিয়-ভোগ্য জিনিস জড়ো করে ঋষ্যশৃঙ্গকে আকৃষ্ট করে অযোধ্যায় আসা বাঞ্ছনীয়”–“ইন্দ্রিয়ার্থৈবাভমতৈৰ্ণরচিত্ত প্রমাতিথিঃ/পুরমানায়য়িষ্যামঃ ক্ষিপ্রং চাধ্যবসীবতা”। অমাত্য সুমন্ত সহাস্যে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছিলেন–সেই ইন্দ্রিয়ভোগ্য জিনিস হল লাবণ্যময়ী যুবতী গণিকা। রাজা দশরথের নির্দেশে পুরোহিত ও মন্ত্রীরা অবিলম্বে সুন্দরী গণিকাদের ব্যবস্থা করলেন। আদেশানুসারে সেই সুন্দরী গণিকারা ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রমের অভিমুখে যাত্রা করলেন। রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেককালেও প্রচুর গণিকাদের উপস্থিতির কথা জানতে পারি। অধিকৃত ব্যক্তিবর্গকে মুনি বশিষ্ঠ নির্দেশ দিয়েছিলেন–“মন্ত্রীগণ, সর্বত্র পতাকা উড্ডীন করে দাও। রাজপথে জলসিঞ্চন করো, যে পথে গণিকা সকল সুসজ্জিত হয়ে প্রাসাদের দ্বিতীয় কক্ষে অবস্থান করবে।” সুবৃহৎ সংস্কৃত মহাকাব্য মহাভারতেও গণিকাদের কদর ছিল। যৌন কেলেংকারীতে ভীমের হাতে মৃত্যু হয় বিরাটরাজের সেনাপতি কীচকের। সেনাপতির মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে ত্রিগর্তের রাজা সুশর্মা কৌরবদের সাহায্য নিয়ে বিরাটরাজের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিরাটরাজও পাণ্ডবদের সহযোগিতায় ত্রিগর্তের রাজা সুশর্মাকে পরাজিত করেন। সেই যুদ্ধজয়ের আনন্দে বিরাটরাজ এক উৎসবের আয়োজন করেন। সেই রাজকীয় উৎসবের একেবারে পুরোধায় সুন্দরী গণিকাদের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন বিরাটরাজ। গণিকাদেরই রণজয়ের ঘোষণা করতে আদেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং বিরাটরাজ।
সে যুগে গণিকাদের সেনাবাহিনীর সঙ্গেও পাঠানো হত, সেনারা যাতে আমোদ-প্রমোদে সময় অতিবাহিত করতে পারে। রামচন্দ্রের স্বতন্ত্র সেনাবাহিনী, কৌরব ও পাণ্ডবদের সেনাবাহিনীতেও যথেষ্ঠ পরিমাণে গণিকা মজুত রাখা হয়েছিল। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধকালীন সময়ে পাণ্ডব শিবিরে শত শত গণিকাদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল স্বয়ং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের। এমনকি কৌরব-পাণ্ডবদের যুদ্ধের প্রাক্কালে কৃষ্ণ আসছেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দূতরূপে, এই সংবাদ পেয়ে ধৃতরাষ্ট্র দ্রুত নির্দেশ দিলেন–কৃষ্ণের অভ্যর্থনায় যেন কোনো ত্রুটি না হয়। অবিলম্বে হাজার হাজার গণিকাদের উত্তমোত্তর বেশভূষা পরিধান করে যেন কৃষ্ণকে আনতে যায়। অতএব স্বয়ং কৃষ্ণও গণিকাদের পেয়ে বিনোদিত হতেন। কাহিনি বিশ্লেষণে এটাই প্রমাণিত হয় যে, রামায়ণ ও মহাভারতের যুগে গণিকাবৃত্তি বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। মহাভারতের যুগে গণিকাদের রাজকীয় সম্মানে সম্মানিত করা হত। তাঁরা রাজাদের সবসময়ের সঙ্গী। সে সময়ে রাজারা মৃগয়ায় গেলে গণিকাদেরও যেতে হত বিনোদনের জন্যে। সেকালে গণিকাদের যে সম্মান ও মর্যাদা ছিল, সেই সম্মান ও মর্যাদা একেবারে তলানিতে।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে গণিকাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের বর্ণনা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। আমরা এতক্ষণ যেসব গণিকাদের কথা জানলাম তাঁরা রাষ্ট্র-পৃষ্টপোষকতায় হলেও মোটামুটি স্বাধীন। কৌটিল্যের সময়ে এসে দেখতে পাচ্ছি গণিকারা কারোর অধীনে থেকে কাজ করছে। আমরা গণিকাধ্যক্ষের কথা জানতে পারছি, যাঁদের বর্তমান পরিচয় ‘মাসি’ বা ‘মক্ষীরানি’। কৌটিল্যের যুগেও বহু সংখ্যক গণিকা পিছু একজন করে। তত্ত্বাধায়ক বা গণিকাধ্যক্ষ থাকত। তাঁরাই গণিকা সংক্রান্ত নানাবিধ কাজ করত। কারা হতে পারত গণিকাধ্যক্ষ? না, এখনকার মতো বিগতযৌবনা গণিকাদের ‘মাসির মতো গণিকাধ্যক্ষ হতে পারত না। গণিকাধ্যক্ষ একটি রাজকীয় পদ। তাই গণিকাধ্যক্ষদের রীতিমতো রূপবতী, যৌবনবতী ও কলাসম্পন্না রমণী হতে হবে এবং অবশ্যই তাঁকে গণিকা বংশে উৎপন্না অথবা অগণিকা বংশেও হতে হবে। বেতন ছিল ১০০০ পণ। কৌটিল্য গণিকাদের গুণ-রূপ-কাজ অনুযায়ী ভাগও করেছেন। যেমন উত্তম শ্রেণির গণিকা, মধ্যম শ্রেণির গণিকা এবং কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকা। এঁরা সকলেই বেতনভুক্ত শ্রেণি। যেমন উত্তম শ্রেণির গণিকার বেতন ৩০০০ পণ, মধ্যম শ্রেণির গণিকার ২০০০ পণ এবং কনিষ্ঠ শ্রেণির গণিকার ১০০০ পণ। এই বেতন রাজা তথা রাষ্ট্র দিত।
এইসব রূপবতী গণিকাদের যৌবন হারালে কী হত? এখনকার মতোই, অন্যান্য গণিকাদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করতেন সবেতন। বৃত্তিতে থাকতে থাকতে কোনো গণিকার মৃত্যু হলে সেই গণিকার কন্যা বা বোনের গণিকাবৃত্তির অধিকার ছিল। আর গণিকাদের গর্ভে যদি পুত্রসন্তান জন্মত, তাহলে সেই পুত্রসন্তানকে রাজার কাছে দাস হয়ে সারাজীবন কাটাতে হত। কৌটিল্যের যুগে গণিকা এবং খরিদ্দারদের জন্য শাস্তি বা দণ্ডের ব্যবস্থাও ছিল। যেমন–কোনো পুরুষ যদি কোনো গণিকার কুমারীকন্যাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনমিলন ঘটাত, সেই পুরুষের শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। রাজ-আজ্ঞা সত্ত্বেও কোনো গণিকা যদি কোনো বিশেষ পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনে অনিচ্ছা প্রকাশ করত, তাহলে সেই গণিকার বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান ছিল। কোনো গণিকাকে অকারণে কোনো পুরুষ যদি হত্যা করে বা গণিকার ঘরে রাত কাটাতে গিয়ে তাঁর অলংকার চুরি করে, তখন সেই অভিযুক্ত পুরুষকে শাস্তির মুখোমুখি হতেই হত। কোনো পুরুষের কাছ থেকে আগাম পারিশ্রমিক নিয়েও যদি কোনো গণিকা যৌনমিলন না করত, সেক্ষেত্রেও বিশেষ শাস্তি ভোগ করতে হত গণিকাদের।
খ্রিস্ট্রীয় পঞ্চম শতকের মহাকবি কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে দুই প্রকারের গণিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে–একটি নগরনটী, অপরটি দেবদাসী। বিক্রমোর্বশীয়ম, নলোদয়, দ্বাবিংশপুত্তলিকা, ঋতুসংহারে কামুক পুরুষ ও গণিকাদের উল্লেখ আছে। দ্বাবিংশপুত্তলিকা কাব্যে মহাকবি কালিদাস মোট ৩২ জন গণিকার কথা বলেছেন। তাঁরা হলেন–মিশ্রকেশী, সুপ্রভা, ইন্দ্রসেনা, সুদতী, অনঙ্গনয়না, কুরঙ্গনয়না, লাবণ্যবতী, কমলিকা, চণ্ডিকা, বিদ্যাধরী, প্রজ্ঞাবতী, জনমোহিনী, বিদ্যাবতী, নিরুপমা, হরিমধ্যা, মদনসুন্দরী, বিলাসরসিকা, শৃঙ্গারকালিকা, মন্মথসঞ্জীবনী, রতিলীলা, মদনবতী, চিত্রলেখা, সুরতগহ্বরা, প্রিয়দর্শিনী, কামোন্মাদিনী, সুখসাগরা, শশিকলা, চন্দ্ররেখা, হংসগামিনী, কামরসিকা, উন্মাদিনী, প্রভাবতী ইত্যাদি। পাঠক, নামের ধরন দেখে বুঝে নিন এই নারীদের কাজ কী ছিল। মহাকবির লেখনীতে সরাসরি গণিকা না-বললেও নামের অর্থানুসারে অনুমান করাই যায় তাঁরা প্রত্যেকেই বারবিলাসিনী-কামনাময়ী। তবে গণিকাদের বর্ণনায় মহাকবি ছিলেন খুবই উদার। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন–বিলাসিনীরা তাঁদের অর্থবান নাগরদের নানাভাবে গ্রীষ্মের তাপ নিবারণের আয়োজন করছে। এই সময় মেখলা শোভিত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বসনে তাঁদের নিতম্বের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছিল। প্রায় খোলাখুলিভাবে সুউচ্চ স্তনমণ্ডলে তাঁরা নাগরদের দেখিয়ে দেখিয়ে চন্দন মাখছিল এবং চুলে সুগন্ধি দিচ্ছিল (নিতম্ববিম্বৈঃ সদুকুলমেখলৈঃ স্তনৈঃ সহারাভরনৈ সচন্দনৈঃ।/শিরোরুহৈঃ স্নানকষায় বাসিতৈঃ স্ত্রিয়ো নিদাঘাংশময়ন্তি, কামিনা”)। কালিদাসের কাব্যে গণিকাদের গতিবিধি ছিল অবাধ। কথিত আছে, মহাকবি কালিদাস স্বয়ং ব্যক্তিগত জীবনে জনৈকা বিশিষ্ট গণিকার সঙ্গে দিনযাপন করতেন।
গুপ্তসাধনতন্ত্রে বলা হয়েছে গণিকারা শক্তিরূপে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য। তান্ত্রিক সাধনায় এই শক্তির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তন্ত্রসাহিত্যের সৃষ্টি মূলত এক ধর্মীয় গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করেই, সে ধর্মগোষ্ঠী সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য মদ্য, মাংস, মৎস, মুদ্রা ও মৈথুন–এই পঞ্চ ম-কারে বিশেষ প্রাধান্য দিত। এই সাধনা চলত গণিকাদের উপর। আদিরস বা যৌনক্রিয়াকলাপ ছিল তাঁদের প্রধান উপজীব্য। গুপ্তসাধনতন্ত্রে গণিকাদের পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে—(১) রাজগণিকা বা নাগরী, এঁরা শহর বা নগরে বিচরণকারী গণিকা, (২) গুপ্তগণিকা, এঁরা সম্মানিত পরিবারে থেকে গোপনে গণিকাবৃত্তি করে। (৩) দেবগণিকা, এঁরা মন্দির বা দেবালয়ে গণিকাবৃত্তি করে। এঁদের প্রচলিত পরিচয় ‘দেবদাসী’। এঁদের বিষয়ে পরে অন্য অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। (৪) ব্ৰহ্মগণিকা, তীর্থস্থানে ঘুরে ঘুরে গণিকাবৃত্তি করেন।
ধর্মীয় সংস্কার-আচার-প্রথাও পবিত্র পতিতা’-র জন্ম দিয়েছে। লোকজীবনে দেহসাধনায় নামে যে অবাধ যৌনাচার চলে আসছে, তাতে ভণ্ড পির, কামুক সাধু কিংবা বৈরাগী-বৈষ্ণবী আখড়াও বাদ যায় না। নিরুত্তরতন্ত্রে আবার গণিকাদের ছয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন–(১) গুপ্তগণিকা—এঁরা সাধারণত তন্ত্রসাধক বা তান্ত্রিকদের বংশজাতা হয়। এঁরা স্বভাবে নির্লজ্জ এবং অত্যধিক কামাসক্ত হন। এঁরা পশুভাবাপন্ন পুরুষই পছন্দ করেন। (২) মহাগণিকা—এঁরা স্বেচ্ছায় শরীরের পোশাক ত্যাগ করে গোপন অঙ্গ প্রদর্শন পুরুষকে যৌনকর্মে আহ্বান করে (৩) কুলগণিকা–এঁরা স্বামীসন্তান নিয়ে সংসারধর্ম করেন এবং পাশাপাশি গণিকাবৃত্তিও করেন। (৪) রাজগণিকা—এঁরা স্বাধীনভাবে শহরের ভিতর পুরুষের সন্ধানে বিচরণ করে এবং রাজার মতোই আচরণ করে। (৫) ব্ৰহ্মগণিকা এবং (৬) মহোদয়া। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে এইসব গণিকারা এক একটি তীর্থতুল্য। যেমন গুপ্তগণিকাদের বলা হয়েছে অযোধ্যা তীর্থতুল্য, মহাগণিকাদের বলা হয়েছে মথুরা তীর্থতুল্য, কুলগণিকাদের বলা হয়েছে মায়া তীর্থতুল্য, রাজগণিকারা দ্বারকা তীর্থতুল্য ও অবন্তী তীর্থতুল্য, ব্ৰহ্মগণিকারা দ্বারাবতী তীর্থতুল্য এবং মহোদয়া গণিকারা কালিকা তীর্থতুল্য।
নিরুত্তরতন্ত্রেই বলা বলা হয়েছে–“স্ত্রী পুংসো সঙ্গমে সৌখং জায়তে তং পরমং পদ”। অর্থাৎ, স্ত্রী ও পুরুষের যৌনমিলনে বা সঙ্গমে যে আনন্দ, তাই-ই পরমপদ বা ব্রহ্ম। সেই কারণেই তন্ত্রসাধনায় পঞ্চ ম-কারের এত আয়োজন। বলা হয়েছে–“বিনা পীত্বা সুরাং ভুক্কা মৎস্যমাংসং রজস্বলাং/যো জপে দক্ষিণাং কালীং তস্য দুঃখ পদে পদে”। অর্থাৎ, যে বিনা মদ্যপানে, বিনা মাছমাংসে, বিনা যুবতী সম্ভোগে যে দক্ষিণা কালীর আরাধনা করবে, তাঁর পদে পদে দুঃখ হবে।
ষষ্ঠ শতকের লেখক বিষ্ণুশর্মার পষ্ণতন্ত্রে বেশ কিছু কাহিনিতে তৎকালীন সময়ের গণিকাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। আছে দেবদাসীদের কথাও। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় সে সময় গণিকারা প্রভূত ক্ষমতা ভোগ করত এবং প্রচুর সম্পদের অধিকারিণী ছিল। রবিচন্দ্রের অমরুশতকেও গণিকাদের কথা জানা যায়। অমরুশতকের কাহিনি ও চরিত্রের কাঠামো থেকেই অনুমিত হয় সে সময়ের গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অবাধ। সপ্তম শতকে হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে সভাকবি বাণভট্টের কাদম্বরী থেকে জানা যায় স্নানের পর রাজাদের গায়ে চন্দন, আতর, কুমকুম প্রভৃতি মাখিয়ে দিত গণিকারা। রাজাদের পোশাকও পরিয়ে দিতে হত। দ্বাদশ শতকের গ্রন্থ মৃন্ময়সুন্দরীকথাতে দেখি গণিকার আয়ের শতকরা পাঁচশো থেকে ত্রিশ ভাগ ছিল রাষ্ট্রের প্রাপ্য অর্থাৎ রাজস্ব। বৌদ্ধগ্রন্থে গণিকার ‘ভট্টি’ (সংস্কৃত ‘ভূতি’) অর্থাৎ বেতন এবং পরিব্বায়’ (সংস্কৃত পরিব্যয়ম) খরচের উল্লেখ পাই। মথুরার গণিকা বাসবদত্তার পারিশ্রমিকও অত্যন্ত উচ্চহারের ছিল। রাজগৃহের সালাবতী প্রতি রাত্রে একশো কার্যপণ উপার্জন করত।
শাস্ত্রের পাশাপাশি ইতিহাসের সাক্ষ্যও দুর্লভ নয়। বাংলার তাম্রশাসন আমলের লেখমালায় সংগীত ও নৃত্যপটিয়সী রাজনটী ওরফে রাজগণিকাদের পরিচয় মেলে। ধর্মীয় আচারের আড়ালেও আবার কখনো কখনো গণিকা ও গণিকাবৃত্তির জীবনযাপন করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এমন আধুনিক ধর্মগুরু রাম রহিম, রামপাল, স্বামী চিন্ময়ানন্দ, স্বামী নিত্যানন্দ, আশারামের নাম সবাই আজ জেনে গেছেন। কালীঘাটের পটচিত্রে গণিকাসম্ভোগের দৃশ্য আছে, অনেক মন্দিরগাত্রেও উৎকীর্ণ টেরাকোটাতেও এমন দৃশ্য বিরল নয়।
অনেকে মনে করতে পারেন, গণিকারা এমনই সহজলোভ্য পণ্য, যে অর্থ দিলেই হাতের মুঠোয়। এই চিন্তা একালের গণিকাদের প্রযোজ্য হলেও সেকালের গণিকাদের অর্থের হাতছানি করতলগত করা অতটা সহজ ছিল না। এমনই একজন গণিকার নাম হল বসন্তসেনা। হৃদয়বত্তা, ত্যাগ এবং একনিষ্ঠতার সন্ধান যদি করতে হয়, তবে বসন্তসেনাই তার ধারক ও বাহক। বোধহয় এমন মহিমময় গণিকা যুগে যুগে দ্বিতীয়টি সৃষ্টি সম্ভব নয়, যার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে একই সঙ্গে জায়া-জননী-প্রেয়সীর প্রতিরূপ। বসন্তসেনার নাম যখন উঠল, তখন। বৌদ্ধধর্মে উল্লেখিত গণিকাদের একটু খোঁজখবর নিতে পারি। বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থগুলি থেকে আমি নয়জন গণিকার কথা জানতে পাচ্ছি–বসন্তসেনা, আম্রপালী, বাসবদত্তা, শলাবতী, অদ্ধকাশি বা অর্ধকাশি, কাশিসুন্দরী, শ্যামা, সুলসা ও কালি। আলোচনা করব। তবে তার আগে বলি রামায়ণ ও মহাভারতের রাজঃন্তপুরে গণিকাদের উপস্থিতি লক্ষ করি, ঠিক তেমনি বৌদ্ধকাহিনিতে উল্লেখিত রাজঃন্তপুরে গণিকাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বৌদ্ধসাহিত্য বাত্তাক জাতক’ থেকে জানা যায়, গৌতম বুদ্ধের বিবাগি মনকে সংসারী করতে পিতা শুদ্ধোদন সুন্দরী গণিকাদের নিয়োগ করেছিল। এক কার্তিকের উৎসবে শুদ্ধোদন তাঁর পুত্রকে এক সুন্দরী গণিকার ঘরে পাঠিয়ে দেন। সেই গণিকা তাঁর হাজার ছলাকলা কলাকৌশলেও তাঁর ধ্যানভঙ্গ করতে ব্যর্থ হয় এবং তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যায়।
বসন্তসেনা : প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বসন্তসেনা’ কবিতায় লিখছেন–“তুমি নও রত্নাবলী, কিম্বা মালবিকা, রাজোদ্যানে বৃন্তচ্যুত শুভ্র শেফালিকা।/ অনাঘ্রাত পুষ্প নও, আশ্রমবালিকা,/ বিলাসের পণ্য ছিলে, ফুলের মালিকা’রঙ্গালয় নয় তব পুষ্পের বাটিকা, অভিনয় কর নাই প্রণয়-নাটিকা।/ তব আলো ঘিরে ছিল পাপ কুঙ্কুটিকা, ধরণী জেনেছ তুমি মৃৎ-শকটিকা!/নিষ্কণ্টক ফুলশরে হওনি ব্যথিতা।/ বরেছিলে শরশয্যা, ধরায় পতিতা।/কলঙ্কিত দেহে তব সাবিত্রীর মন/সারানিশি জেগেছিল, করিয়ে প্রতীক্ষা/বিশ্বজয়ী প্রণয়ের, প্রাণ যার পণ।/ তারি বলে সহ তুমি অগ্নির পরীক্ষা!”
বসন্তসেনাকে আমরা পাই খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর নাট্যকার শূদ্রকে মৃচ্ছকটিকে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে প্রদ্যোৎ সাম্রাজ্যের পতনকালে উজ্জয়িনী নামে একটি প্রাচীন ভারতীয় নগরের প্রেক্ষাপটে লেখা, যেখানকার রাজা ছিলেন পালক। চারুদত্ত নামের এক সম্ভ্রান্ত অথচ দরিদ্র ব্রাহ্মণ যুবককে কেন্দ্র করে, যিনি বসন্তসেনা নাম্নী এক গণিকা কর্তৃক প্রণয়াসক্ত হন। পারস্পরিক অনুরাগ সত্ত্বেও তাঁদের বাসস্থান ও ভালোবাসা দুই-ই পথে বসে সমস্থানিক নামে এক কামাতুর (বসন্তসেনার প্রতি) রাজসভাসদের চাতুর্যে। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক নাটকে বসন্তসেনা একজন গণিকা। কিন্তু বসন্তসেনার শরীর ও মন দুইয়ের সমন্বয়ে এ নাটকে দেখানো হয়েছে। শ্ৰেষ্ঠী চারুদত্তকে ভালোবাসেন বসন্তসেনা। এই চারুদত্তের সংকটে বসন্তসেনা তাঁর সমস্ত গয়না সমর্পণ করেছেন। এটা শরীরের সম্পর্ক নয়, মনের সম্পর্ক।
আম্রপালী বা অম্বপালী : বৈশালীর রাজোদ্যান নামক স্থানে আমগাছের নিচে এক সদ্য জন্মানো মেয়ে শিশুর কান্নার আওয়াজ ওঠে। নগরের উদ্যান পালক শ্রীনাথ ও তাঁর পত্নী হরিবালা সেই শিশুকে উদ্ধার করে তাঁর ভরণপোষণের ভার গ্রহণ করেন। পালিভাষায় আমকে ‘অম্ব’ বলা হয়। আমগাছের নিচে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বলে এই নামই রাখা হয়েছিল। আদান পালকের কন্যা বলেও তাঁর নাম হয় অম্বপালী বা আম্রপালী। পরিত্যক্ত কন্যাশিশুকে সেই দম্পতি নিজ সন্তানস্নেহে বড়ো করতে থাকেন। কিন্তু সেই বালিকা কৈশোরে পা দিতে না দিতেই নিদারুণ সমস্যায় পড়লেন বাবা ও মা। অসামান্যা সুন্দরী আম্রপালীকে নিয়ে বড় চিন্তায় পড়ে গেলেন তাঁর বাবা ও মা। আম্রপালীর রূপের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে মরে যেতেও সুখ কামুক পুরুষরা। সবারই কাঙ্খিত নারী সে। গ্রামের মহাজন থেকে শুরু করে শহরের বণিক, জনপদের রাজা থেকে শুরু করে নগরের শ্রেষ্ঠী—কে নেই সেই তালিকায়! বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় দেহের ক্রমবর্ধনশীল রূপ-যৌবনে টলটলে আম্রপালী নিয়ে যেন যুদ্ধ বেধে গেল।
বিশ্বের প্রাচীন গণতন্ত্রের মধ্যে বিখ্যাত বৈশালী। সেখানে রাজা নির্বাচিত হতেন নির্বাচনের মাধ্যমে। ছিল না পরিবারতন্ত্র, যোগ্য হলে তবেই নির্বাচিত হয়ে সিংহাসনে বসার সুযোগ মিলত। কথিত আছে, বৈশালীর এক রাজা মনুদেব হত্যা করেছিলেন আম্রপালীর বাল্যপ্রেমিক পুষ্পকুমারকে। সে রাতেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল আম্রপালী ও পুষ্পকুমারের। এরপর শুরু হয় তুমুল দ্বন্দ্ব, জনতার ইচ্ছার সভা বসে বৈশালী সংসদে। গণতন্ত্র বিধান দেয়, আম্রপালী কোনোদিনও বিয়ে করতে পারবেন না। কারণ এত রূপ-যৌবন নিয়ে তিনি কোনো একমাত্র পুরুষের ভোগ্যা হতে পারে না। আজব বিধান বইকি! গণতন্ত্রের শৃঙ্খলায় সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। সুন্দরী হওয়ার অপরাধে আম্রপালী হয়ে গেলেন বৈশালীর গণিকা, বহু পুরুষের ভোগ্যা। আম্রপালী হলেন রাজ্যের সভানর্তকী। তিনি হলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী, অভিজাত আদবকায়দায় রপ্ত এক সুন্দরী। সকল পুরুষ নয়, কেবলমাত্র উচ্চবংশের পুরুষই পেতে পারবে তাঁর কাছ থেকে যৌনসুখ। আম্রপালী নিজেই নিজের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারবেন ভোগের জন্য। জেনে বিস্মৃত হবেন, গণিকা আম্রপালীকে দৃষ্টান্ত রেখে সেই আমলে বৈশালীতে নতুন একটা আইনও তৈরি হয়ে গেল। কী সেই আইন? কোনো অনিন্দ্য সুন্দরী নারী কখনো বিবাহ করতে পারবে না। তাঁকে বহু পুরুষের ভোগ্যা হয়ে যৌনানন্দ বিলিয়ে দেওয়ার জন্য উৎসর্গীকৃত হতেই হবে। তবে রাজগণিকা হওয়ার সুবাদে আম্রপালীর জন্য বরাদ্দ হয়েছিল সুবিশাল উদ্যান, মর্মর অট্টালিকা। ক্রমে আম্রপালী হয়ে উঠলেন প্রভুতা ক্ষমতার অধিকারিণী।
যাই হোক, মগধরাজ বিম্বিসার আম্রপালীর রূপের সংবাদ পেরে সেই রূপের আগুনে একটিবার ঝাঁপ দিতে চাইলেন। কিন্তু কী উপায়ে আম্রপালীকে অঙ্কশায়িনী করা সম্ভব? বৈশালী আর মগধ রাজ্যের মধ্যে তো ছিল পরস্পরের ঘোর শত্রুতা। শত্রুপক্ষের গণিকার কাছে তো আর কামাতুর হয়ে যাওয়া যায় না, আবার শত্রুরাজার কাছে নতজানুও হওয়াও যায় না। অতএব যুদ্ধ। রাজ্য ও রূপবতী গণিকা–দুইয়েরই দখল নেওয়া যাবে। মগধরাজ বিম্বিসার বৈশালী আক্রমণ করলেন ছদ্মবেশে আম্রপালীর প্রাসাদে সোজা ঢুকে গেলেন। ছদ্মবেশী সঙ্গীতজ্ঞ বিম্বিসারের গুণে আম্রপালী যেন ভেসে গেলেন। কিন্তু আম্রপালী যখন জানতে পারল এই ছদ্মবেশী বিম্বিসারই সাজানো বৈশালী তছনছ করে দিয়েছে, আম্রপালী দৃঢ়ভাবে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। শুধু প্রত্যাখ্যান নয়, সেইসঙ্গে বিম্বিসারকে শর্ত দিলেন তাঁকে অঙ্কশায়িনী করতে হলে বৈশালীকে মুক্ত করে দিতে হবে। আম্রপালীর অনমনীয়তায় বিম্বিসার অবশ্যই বৈশালীকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ব্যাপারটা বিম্বিসারের দুর্বলতা বলে ধরে নিয়েছিল শত্ৰুভূমি বৈশালীরাজ। ফলে দুই রাজ্যের দ্বন্দ্ব আটকানো সম্ভব হল না। বিম্বিসার আম্রপালীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন আম্রপালী। তবে বিয়ে না হলেও বিবাহ-বহির্ভূত তাঁদের এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। সেই সম্পর্কের জেরে তাঁদের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। এরপর তিনি ফিরে যান নিজের রাজ্য মগধে।
বিম্বিসারের আর-এক পুত্র অজাতশত্রু পিতা বিম্বিসারকে তখন গৃহবন্দি করে সিংহাসন দখল করেন। অবশেষে গৃহবন্দি অবস্থায় বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে। এরপর অজাতশত্রু আক্রমণ করেছিলেন বৈশালী রাজ্য। উদ্দেশ্য দুটি–একটি হল ধন-সম্পদ লুঠ করা এবং আম্রপালীর দখল নেওয়া। অজাতশত্রু বৈশালী রাজ্যকে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দিলেন। এরপর আম্রপালীর প্রাসাদ দখল করে আম্রপালীকে বিয়ের প্রস্তাব। বাপের ভোগ করা নারী পুত্রেরও ভোগ্যা! না, অজাতশত্রু যখন জানতে পারলেন তাঁরই পিতার সঙ্গে আম্রপালীর সম্পর্ক ছিল এবং তাঁদের এক পুত্র সন্তান আছে, তখন রাগের বশে আম্রপালী ও তাঁর পুত্রকে গৃহবন্দি করে রাখলেন। এরপর তিনি শুরু করে দিলেন আরও লুঠতরাজ, আরও অত্যাচার। আম্রপালীর কারাগার বাদ দিয়ে গোটা বৈশালী পুড়িয়ে ছাই দিয়েছিলেন অজাতশত্রু।
অজাতশত্রু কর্তৃক বৈশালী ধ্বংস হয়ে গেলেও কিছুকাল পর বৈশালী রাজ্য পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়ায়, পুনরায় সম্পদশালী রাজ্য হয়ে ওঠে। এই সময়ে বৈশালীতে গৌতম বুদ্ধ আসেন। সঙ্গে কয়েকশো শ্ৰমণ। আশ্রয় নেন এক নগরের উদ্যানে, নগরবাসীর গৃহে। সে সময় একদিন গৌতম বুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানান আম্রপালী। গণিকা আম্রপালীর উদ্যানে অতিথি হয়ে তাঁর হাতে অনুগ্রহণ করেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। এরপর একদিন আম্রপালী এক তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখতে পেলেন। কিশোরীপ্রেম পুষ্পকুমারের পর ছদ্মবেশী বিম্বিসার, তারপর কারও রূপে মুগ্ধ হল আম্রপালী। ভাবলেন, একেই বশ করবেন। এই তরুণ সন্ন্যাসীও ছিলেন এক বৌদ্ধ শ্ৰমণ। ভিক্ষা ও আশ্রয়প্রার্থী। আম্রপালী নিজে তাঁকে ভিক্ষা দিলেন এবং তাঁর প্রাসাদে সময় অতিবাহিত করতে অনুরোধ করলেন। সন্ন্যাসী বললেন, তথাগতর আদেশ ছাড়া তিনি আশ্রয়গ্রহণ করতে পারবেন না। বুদ্ধদেবের কাছে গিয়ে অনুমতি চাইলেন তরুণ সন্ন্যাস। গৌতম বুদ্ধ অনুমতি দিলেন। এক গণিকার গৃহে থাকবেন বৌদ্ধ শ্রমণ? এই নিয়ে সঙ্ঘের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। গৌতম বুদ্ধও বিচলিত হলেন এহেন গুঞ্জনে। সমালোচকদের বললেন—ওই শ্রমণের চোখে তিনি কোনো কাম দেখেননি। অতএব শ্রমণ সময়মতোই নিষ্কলুষ হয়ে তাঁর কাছে ফিরবেন। কিছুদিন পর সময় অতিবাহিত হল। গণিকার গৃহে দীর্ঘ চারমাস কাটিয়ে সেই তরুণ সন্ন্যাসী ফিরলেন বুদ্ধের কাছে। নিষ্কলুষ শ্ৰমণ। তাঁর পিছন পিছন এলেন অসামান্য সুন্দরী আম্রপালী। আম্রপালী প্রণাম জানালেন গৌতম বুদ্ধকে। জানালেন–“তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিনি, গণিকাবিদ্যার সব জ্ঞান প্রয়োগ করেও তাঁকে টলানো যায়নি। এই প্রথম কোনো পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছি। উল্টে আমাকেই বশ করেছেন সর্বত্যাগী এই তরুণ শ্ৰমণ। আজ সর্বস্ব ত্যাগ করে তথাগত বুদ্ধর চরণে আশ্রয় চায় আম্রপালী।” কিন্তু সুন্দরী নারীর উপস্থিতিতে পাছে ভিক্ষু শ্ৰমণদের মনসংযোগ নষ্ট হয়, সেই আশঙ্কায় বুদ্ধ রাজি ছিলেন না। আম্রপালী তখন তাঁকে প্রশ্ন করেন–“বৌদ্ধ শ্ৰমণদের মনসংযোগ এতই ঠুনকো যে এক নারীর জন্য তা ভেঙে পড়বে?” একথা শুনে বুদ্ধ আম্রপালীকে সঙ্ঘে নিতে রাজি হন। আম্রপালী গৌতম বুদ্ধের ভিক্ষুণী রূপে সঘে যোগ দেন। আম্রপালী নিজের সব ধন-সম্পদ, সম্পত্তি, প্রাসাদ, উদ্যান বৌদ্ধসদ্যে দান করে দিয়েছিলেন। মোহমুক্ত হয়ে বাকি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বৌদ্ধসঙ্ঘে।
বাসবদত্তা : শ্ৰীমান উপগুপ্তের ব্যাবসার উন্নতি ও সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁর বিক্রয়লব্ধ দ্রব্যের গুণাগুণের কথা তথা সুসংত আচরণ, অমায়িক ও ভদ্র ব্যবহার, শীলগুণের কথাও ছড়িয়ে পড়ল। সেইসময় নগরীতে রূপের আলোয় আলোকিত করে অপেক্ষা করছিল বাসবদত্তা নামে এক যুবতী গণিকা।তিনি ছিলেন ধনী, প্রভাবশালী ও উচ্চবংশীয় পুরুষদের ভোগ্যা। গণিকা বাসবদত্তা তাঁর কলাকৌশলে, হাস্যে-লাস্যে, সুমধুর কণ্ঠস্বরে, নৃত্যের হিল্লোলে সকল পুরুষকে বিভোর করে রাখত।
মথুরার গণিকা বাসবদত্তা একদিন সুগন্ধী দ্রব্য কেনার জন্য তপতী নামের জনৈকা দাসীর কাছ থেকে জানতে পারলেন শ্রীমান উপগুপ্তের রূপ ও গুণের কথা। সে কথা শুনে বাসবদত্তা মুগ্ধ হল, উদ্বেলিত হল। মনে জাগল কামনার উদগ্র বাসনা। কামের প্রবল তাড়নায় শ্রীমান উপগুপ্তের প্রতি আকর্ষিত হতে থাকল। এ সময়ে মথুরা নগরে মদন উৎসব নামে একটি উৎসব হত। উৎসবের দিন কাছে এসে যাওয়ায় পথিকদের কর্মচাঞ্চল্যে নগর সর্বদা কোলাহল মুখর হয়ে আছে। উৎসবে যোগদান ও অংশগ্রহণ করতে প্রতি বছর উত্তরাপথের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে বহু বিদেশি (তখনকার সময়ে বিস্তীর্ণ ভারত উপমহাদেশের সব প্রদেশকে একে অপরের কাছে বিদেশি বা ভিনদেশি বলে পরিগণিত হত) মথুরার এসে সমবেত হত।
অভিজাতপল্লির এক সুউচ্চ অট্টালিকার অলিন্দ থেকে সেই জনপ্রবাহ প্রত্যক্ষ করছে বাসবদত্তা। জনতার স্রোতের ভিতর থেকে হঠাৎ এক রূপবান যুবককে দেখতে পেয়ে তিনি শিহরিত হল। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেল বাসবদত্তা। সেই অভিজাত বংশজাত যুবকই হল শ্রীমান উপগুপ্ত। উত্তেজনায় থরথর বাসবদত্তা দাসী তপতীকে চিৎকায় করে ডাক দিল। তপতী হাজির হলে বাসবদত্তা বলল–“দেখেছ রাস্তা দিয়ে চলেছেন এক অসাধারণ রূপবান যুবক। নিশ্চয় ইনিই সেই যুবক যাঁর কথা তুমি বর্ণনা করেছিলে?” তপতী বলল–“তোমার রূপ বড়ই নিষ্ঠুর এই রূপ মুগ্ধ-পুরুষকে বিবশ করে দেয়। কত পুরুষই-না তোমার রূপের আগুনে দগ্ধ হওয়ার জন্য পতঙ্গের মতো ছুটে এসেছে। কত ধনকুবের তোমাকে লাভের আশায় তাঁদের ধনসম্পদ সর্বস্ব লুটিয়ে দিতে চেয়েছে। তুমি তাঁদের অনেককেই প্রত্যাখ্যান করেছ। সেই তুমি আজ কেন এই যুবকের প্রতি প্রলোভিত হচ্ছ? বলো আমায় কী করতে হবে?” বাসবদত্তা বলল–“তাঁকে জানাবে বাসবদত্তা আজ রাতের প্রথম প্রহরে প্রেমমুগ্ধ সতৃষ্ণ অন্তরে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে। তিনি যেন এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। আরও বলবে বাসবদত্তা তাঁর প্রণয়াকাঙ্কিণী, তাঁর কাছ থেকে কোনোরূপ রজতমুদ্রার আশা করে না।”
শ্ৰীমান উপগুপ্তের কাছে এ বার্তা পৌঁছোলে তিনি মনে মনে ভাবলেন—এটা প্রলোভন। এই প্রলোভনে জড়িয়ে পড়া মানে আত্মাহুতি দেওয়া। এই আত্মাহুতি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বৈরীহীন নৈম্যের বিদ্যমানে শত্রুবহুল কামাসক্তিতে কী প্রয়োজন? বাসবদত্তার মতিভ্রম হয়েছে। বাসবদত্তা কামান্ধা। অতএব এহেন পরিস্থিতিতে তাঁকে উপায়-কুশলতা অবলম্বন করতে হবে। শ্রীমান উপগুপ্ত দূতী তপতীকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন–“এখন তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময় নয়। উপযুক্ত সময় হলে আমি নিজেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে নেব।” এই কথা শুনে তপতীকে বিফল মনোরথেই ফিরে যেতে হয়।
মনোবাঞ্ছা পূরণ হল না, এটা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না বাসবদত্তা। মন অশান্ত হয়ে উঠল। রূপবান উপগুপ্তকে যে ভোলা যায় না! ধীরে ধীরে সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায়। কিন্তু বাসবদত্তা যে একজন গণিকা। গণিকামাত্রেই দেহ-ব্যবসায়ী। দেহই তাঁর পুঁজি। উপগুপ্তকে লাভ করা গেল না তাতে কী হয়েছে! সবাই তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবে কেন? বরং সকলে তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবে তাঁর শরীর ভোগ করে। তাই বাসবদত্তার চাই নতুন পুরুষ। উপগুপ্তের জন্য আর অপেক্ষা না করে এক অশ্ব-ব্যবসায়ীর বাহুলগ্না হল। সেই অশ্ব-ব্যবসায়ী অগ্রিম ৫০০ স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে তাঁকে পেতে চাইল। বাসবদত্তা প্রলুব্ধ হয়ে সেই ব্যবসায়ীকে নিজগৃহে ডেকে পাঠায়। ব্যবসায়ী এলেন বটে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু বাসবদত্তার হাতেই হল। ব্যবসায়ীর ধনরত্ন আত্মসাৎ করার লোভে তাঁকে হত্যা করে শৌচাগারে লুকিয়ে রাখে। এ খবর রাজার কানে পৌঁছে যায়। রাজা অপরাধের শাস্তিস্বরূপ বাসবদত্তার হাত-পা-নাক কেটে নগরের বাইরে শ্মশানে ফেলে আসার নির্দেশ দিলেন। মৃত্যুপথযাত্রিনী বাসবদত্তার সঙ্গে উপগুপ্তের শেষ দেখা হয়েছিল।
শলাবতী : বৌদ্ধসাহিত্যে ‘মহাবজ্ঞ’-এর এক জায়গায় শলাবতী নালী এক গণিকার কথা জানা যায়। সে রাজগৃহের প্রধানা গণিকা। যাঁর এক রাতের মূল্য ছিল ৫০০ কার্যপণ। সে একটা সময় গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় শলাবতী খরিদ্দারদের কাছে মিথ্যা কথা বললেন। বললেন–তাঁর শরীর খারাপ। কটাদিন তিনি বিশ্রাম চান। অবশেষে শলাবতীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হল এবং সেই সন্তানকে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষেপ করেন। সেই পতিত সন্তানকে আর-এক গণিকা আম্রপালীর পুর আভয় তাকে কুড়িয়ে নিয়ে লালনপালন করতে থাকে। পরে সেই পতিত সন্তান বড়ো হয়ে জীবক কুমারভৃত্য নাম ধারণ করে বিখ্যাত চিকিৎসক হিসাবে স্বীকৃত পেয়েছিল।
অদ্ধকাশি বা অর্ধকাশি : বৌদ্ধসাহিত্যে আর-এক গণিকা অদ্ধকাশিকেও পাচ্ছি। অদ্ধকাশি এতটাই রূপবতী ছিলেন যে সেই রূপের গর্বে তাঁর কাছে আসা পুরুষদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করত। তাঁর গুণমুগ্ধ পুরুষের সংখ্যা প্রচুর থাকলে ক্রমশ সেই সংখ্যা কমতে থাকল অদ্ধকাশির মাত্রাতিরিক্ত দাবি মেটাতে না পেরে। আয়ও ক্রমশ কমতে কমতে অদ্ধকাশি কপর্দকহীন হয়ে পড়ল। অবশেষে শেষ আশ্রয় হিসাবে বুদ্ধের শরণাপন্ন হল।
কাশিসুন্দরী : বৌদ্ধসাহিত্য ব্ৰতীবদানমালা’-য় গণিকা কাশিসুন্দরীকে পাই। কাশিসুন্দরী প্রথম জীবনে মহারাজ অজাতশত্রুর মন্ত্রী প্রচণ্ডকে প্রত্যাখ্যান করে। প্রচণ্ডের পরিবর্তে তিনি সুবর্ণকে পছন্দ করেন। কিন্তু সুবর্ণ গণিকা কাশিসুন্দরীকে পছন্দ করে না। কাশিসুন্দরীও নাছোড়বান্দা। সুবর্ণ একথা জানতে পেরে কাশিসুন্দরীকে এমন মার মারে যে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। অজ্ঞান কাশিসুন্দরীকে এক বিষধর সাপের কাছে ফেলে দেয়। সেই সাপের দংশনে কাশিসুন্দরীর মৃত্যু হয়। সুবর্ণর অবশ্য সেই অপরাধে রাজার আদেশে মৃত্যুদণ্ড হয়।
শ্যামা : বৌদ্ধসাহিত্যে ‘কানবের জাতক’ ও ‘মহাবস্তু অবদান’ গ্রন্থে শ্যামা নামে এক গণিকার কথা জানতে পারি। শ্যামা ছিল বারাণসীর শ্রেষ্ঠতম গণিকা। বসন্তসেনা ও বাসবদত্তাদের প্রচুর কাব্য-সাহিত্য-নাটক রচিত হলেও শ্যামা প্রায় উপেক্ষিতাই রয়ে গেছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গণিকা শ্যামাকে মনে রেখেছেন তাঁর রচিত নৃত্যনাট্য শ্যামা’ এবং কবিতা পরিশোধ’-এর মধ্য দিয়ে। তক্ষশীলার বজ্রসেন নামে এক ঘোড়া ব্যবসায়ী ঘোড়া বিক্রি করতে আসে বারাণসীতে। কিন্তু কপালমন্দে তাঁকে নগররক্ষীরা চোর সন্দেহে রাজার কাছে ধরে নিয়ে যায়। চুরি করার অভিযোগে রাজা বজ্রসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বজ্রসেনকে বদ্ধভূমিতে নিয়ে যাওয়ার সময় গণিকা শ্যামার নজরে পড়ে যায়। রূপবান বজ্রসেনকে দর্শন করে শ্যামা মুগ্ধ হয়ে যায়। রূপবান বজ্রসেনকে যে শ্যামার চাই! মনে মনে তাঁকে যে প্রেমিক হিসাবে বরণ করে নিয়েছে। বজ্রসেনকে মুক্ত করতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নগররক্ষীদের প্রচুর ধনসম্পদ ঘুষ দিয়ে বজ্রসেনকে মুক্ত করে নিজগৃহের শয্যায় আহ্বান করে আনে। কিন্তু বজ্ৰসেন শ্যামার প্রেমের প্রতিদান দিতে পারেনি। সে যে প্রকৃতই তস্কর। শ্যামার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রচুর মদ্যপান করিয়ে শ্যামার সমস্ত ধনসম্পদ লুঠ করে পালিয়ে যায়। বেহুস শ্যামাকে বারাণসীর ঘাটে ফেলে রেখে যায়। এত কিছুর পরেও বজ্রসেনের প্রতি শ্যামার প্রেমের ঘোর কাটল না। বজ্রসেনকে সে যেনতেনপ্রকারেণ কাছে পেতে চায়, উপভোগ করতে চায়। অতএব শ্যামার ঘনিষ্ঠ এক ভিক্ষুণীকে তক্ষশীলার পাঠিয়ে দেয় বজ্রসেনকে ফিরিয়ে আনতে।
সুলসা : সুলসাও বারাণসীর প্রসিদ্ধ গণিকা। গণিকা সুলসার কথা বৌদ্ধসাহিত্য ‘সুলতাজাতক’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। সে ছিল অত্যন্ত ধনসম্পদশালিনী এবং ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্না। গণিকা সুলসা এক দস্যুর প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু সুলসার প্রেম-বিভোরতার সুযোগ নিয়ে সেই দস্যু তাঁকে এক পাহাড়ের উপর নিয়ে যায়। দস্যুটা ভেবেছিল সুলসাকে পাহাড়ের উপর থেকে ঠেলে ফেলে দেবে এবং তাঁর সমস্ত অলংকার হাতিয়ে নেবে। কিন্তু সুলসা টের পেয়ে যায় দস্যুর অভিপ্রায়। বাঁচার শেষ চেষ্টায় সুলতা দস্যুকে জানাল শেষবারের মতো তাঁর প্রেমিককে বুকে নিতে চায়। দস্যুও সুলসার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে রাজি হয়ে যায়। সুলসা আলিঙ্গনের ভান করে হাত বাড়িয়েই দস্যুকে ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দেয়।
কালি : ‘তরীয় জাতক’-এ আমরা গণিকা কালিকে পাচ্ছি। এ কাহিনি থেকে আমরা জানতে পারি তৎকালীন সমাজে গণিকাদের অন্য এক অবস্থানের কথা। এ সময়ে গণিকার প্রাপ্য যে অর্থ লাভ সে লাভ করবে তার অর্ধেকটা সে নিজে নেবে, বাকি অর্ধেকটা সে খরচ করবে রসসন্ধানী প্রেমিকদের জন্য গন্ধদ্রব্য, পোশাক, ফুলের মালা ইত্যাদির জন্য। সে পুরুষপ্রবর নিজের পোশাক খুলে গণিকার দেওয়া দ্রব্যাদি ব্যবহার করবে এবং অবশ্যই গৃহ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সেইসব পোশাকাদি খুলে রেখে পুনরায় নিজ পোশাকাদি পরে যেতে হবে। গণিকা কালি ধনসম্পদশালী ছিল কি না জানা না-গেলেও তাঁর ভাই তুণ্ডল্ল যে খুবই গরিব ছিল সেটা এক কাহিনি থেকে জানা যায়। তুণ্ডল্লর দারিদ্রতা ঘোচাতে গণিকা কালির দেওয়া মহার্ঘ পোশাকাদি নিয়ম ভেঙে তুণ্ডল্লকে দিয়ে দেয়। এতে গণিকা কালি যারপরনাই অপমানিত বোধ করে। কালি উচিত শিক্ষা দিতে চায় সেই প্রেমিক-পুরুষকে। প্রেমিক-পুরুষটি তুল্লকে পোশাকাদি দান করে এসে যখন নিজের পোশাক কালির কাছে কামনা করে, তখন গণিকা কালি প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর ভৃত্যদের সাহায্যে সেই প্রেমিক-পুরুষকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থাতেই ঘরের বাইরে বের করে দেয়।
আম্রপালী, বসন্তসেনা, শ্যামা, বাসবদত্তা প্রমুখ গণিকারা এমনই চারিত্রিক মহিমায় উদ্ভাসিত যে, তাঁরা একালের কবি-সাহিত্যিকের কাছে অনুপ্রেরণার বিষয়। এককথায়, প্রাচীন সাহিত্যের এই গণিকারা সুদীর্ঘকাল অতিক্রম করে একেবারে একালের আঙিনায় এসে ঠাঁই করে নিয়েছে এবং আগামী দিনেও হয়তো লেখকরা অনুপ্রাণিত হবেন নতুন সাহিত্য সৃষ্টিতে।
মোট কথা, প্রাচীন সাহিত্যে গণিকার উপস্থিতি নেই এমন কোনো সাহিত্যই নেই। যেমন ভোজদেব রচিত শৃঙ্গারমঞ্জরী কথা’, মহেন্দ্র সূরী রচিত ‘নিন্নয় সুন্দরী কথা’, সোমেশ্বর রচিত ‘মানোসসাল্লাস’, দামোদর গুপ্ত রচিত ‘কুট্টিনীমত’, কলহন মিশ্র রচিত ‘রাজতরঙ্গিনী’, দণ্ডি রচিত ‘দশকুমারচরিত’, গুণাঢ্য রচিত ‘বৃহকথা, বাসুদেব হিন্ডি রচিত শ্লোকসংগ্রহ’, কুমার ইলাঙ্গো আদিগল রচিত ‘শিলপ্লাদিকর’ প্রভৃতি গ্রন্থে ভিন্নধর্মী বহু গণিকার কীর্তিকলাপ সুগ্রথিত হয়েছে। এ সময় ব্যাবসা-বাণিজ্য, অর্থ-সম্পদ, বিলাস-ব্যসনে মনুষ্যজীবন সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল। আর কে না জানে জীবনে সার্বিক উন্নয়ন ঘটে গেলেই বিলাসিতার অঙ্গ হিসাবে গণিকা সঙ্গের প্রয়োজন হয়ে পড়ে! কায়ণ অর্থ-সম্পদ-শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্থূল কামনা-বাসনার তো জাগরণও ঘটতে থাকে। সে যুগে তো সর্বস্তরের মানুষের গণিকাপ্রীতি ছিল। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল শিল্প সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। কে নেই, বৌদ্ধভিক্ষু থেকে শুরু করে নগররক্ষী, রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পর্যন্ত সকলেরই গণিকাপ্রীতি বিস্ময়ের উদ্রেগ করে, বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। সে সময় গণিকালয়গুলি এখনকার এঁদো-পুতিগন্ধময় ছিল না, গণিকালয় বা গণিকাগৃহগুলি ছিল সুরভিত, কুসুমাস্তীর্ণ, সুসজ্জিত এবং নান্দনিক–সবসময়। গণিকারাও সামাজিক মর্যাদার অধিকারিণী এবং ধনসম্পদশালী ছিল।