০৫. বাৎস্যায়নের চোখে গণিকা

০৫. বাৎস্যায়নের চোখে গণিকা

প্রাচীন যুগে গণিকাদের বিবরণ দিতে চাইব, অথচ বাৎস্যায়নের কামসূত্রম’ উল্লেখ করব না, তাই হয় নাকি? কামসূত্রম আলোচনা করার আগে গ্রন্থের রচয়িতা বাৎস্যায়নকে না-জানলে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মল্লনাগ বাৎস্যায়ন ছিলেন বেদজ্ঞ ভারতীয় দার্শনিক। ধারণা করা হয় তিনি গুপ্তযুগে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী ভারতে বর্তমান ছিলেন। কামসূত্রম ও গৌতমের ন্যায়সূত্র গ্রন্থের টীকা ‘ন্যায়সূত্ৰভাষ্য’-এর রচয়িতা রূপে তাঁর নাম পাওয়া যায়। তবে সম্ভবত, বাৎস্যায়ন নামক কোনো একক ব্যক্তি এই দুই গ্রন্থ রচনা করেননি। তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মল্লিনাগ বা মৃল্লান। বাৎস্যায়ন ছিল তার বংশনাম বা পদবি। নিজ গ্রন্থের শেষে তিনি যে আত্মপরিচয় দান করেছেন তা এরকম–“বাভ্রব্য ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থকারদের রচনা পড়িয়া তদনুসারে এবং তাঁহাদিগের দ্বারা প্রদত্ত অর্থবিধান পর্যালোচনা করিবার পর পবিত্র আদেশানুসারে জগতের কল্যাণার্থে বারাণসীর চতুষ্পঠীর ছাত্র ও দেবসেবক বাৎস্যায়ন কর্তৃক এই সন্দৰ্ভটি রচিত হইয়াছে। ইহা আমাদিগের কামনাবাসনা চরিতার্থ করিবার পুস্তক নহে। যে ব্যক্তি এই বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক অবহিত, যিনি নিজ ধর্ম, অর্থ ও কাম রক্ষা করিয়া এবং লোকাঁচার মানিয়া চলেন, কেবল তিনিই তাঁর ইন্দ্রিয় জয়ে সক্ষম। সংক্ষেপে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তি ধর্ম ও অর্থের অধিকারী হইলে কামেরও অধিকারী হইবেন। তজ্জন্য তাঁহাকে তাঁহার কামনা বাসনার ক্রীতদাসত্ব করিতে হইবে না। তিনি যাহাই করিবেন তাহাতেই সাফল্য পাইবেন।”

বাৎস্যায়নের জীবন বা রচনার সঠিক সময়কাল নির্ধারণ করা অসম্ভব। সম্ভবত খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো একসময়ে তিনি বিদ্যমান ছিলেন। তাঁর রচনায় আছে, কুন্তলরাজ সাতকর্ণী সাতবাহন কামান্ধ হয়ে কর্তারি নামক অস্ত্রের সাহায্যে নিজ পত্নী মাল্যবতাঁকে হত্যা করেন। এই ঘটনা উল্লেখ করে বাৎস্যায়ন সর্বসাধারণকে সতর্ক করে দেখিয়ে দেন যে কামান্ধ হয়ে নারীকে আঘাত করার মতো প্রাচীন প্রথা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। এই কুন্তলরাজ খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে বিদ্যমান ছিলেন। অর্থাৎ, বাৎস্যায়নের সময়কাল প্রথম শতাব্দীর পরে। আবার বরাহমিহির রচিত ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থের অষ্টাদশ অধ্যায়টিও কামকলা সংক্রান্ত। এর বিষয়বস্তু মূলত বাৎস্যায়নের গ্রন্থ থেকে গৃহীত। বরাহমিহিরের সময়কাল খ্রিস্ট্রীয় ষষ্ঠ শতাব্দী। অর্থাৎ, বাৎস্যায়ন যেহেতু বরাহমিহিরের পূর্বে তাঁর গ্রন্থ রচনা করেন, সেইহেতু তিনি প্রথম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে বিদ্যমান ছিলেন।

বাৎস্যায়ন ছিলেন কোনো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্তান। কেউ কেউ মনে করেন তাঁর বাল্যকাল কেটেছিল এক গণিকালয়ে, যেখানে তাঁর প্রিয় মাসি কাজ করতেন। এখান থেকেই তিনি কামকলা সংক্রান্ত প্রথম জ্ঞান লাভ করেছিলেন। বাৎস্যায়নের কামসূত্রম পাঠ করলে বোঝা যায়, ওইরূপ কামবিলাসসম্পন্ন পুরুষ ও নারীদের যুগে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। কোথায় এবং কোন্ দেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত বিশেষ পাওয়া যায় না। তবে মনে হয়, তিনি গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই গুপ্ত সম্রাটদের সময়েই মহাকবি কালিদাস, জ্যোতির্বিদ বরাহ মিহির ইত্যাদি মনীষা সম্পন্ন ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাৎস্যায়নের সাহিত্যের মতো তাঁদের সাহিত্যে ও অনেক অধুনা সমাজ বিরুদ্ধ ও তথা কথিত বর্তমান ‘অশ্লীল’ আখ্যা বিশিষ্ট কবিতা ও লেখা দেখতে পাওয়া যায়। নাট্যলেখক শূদ্রক রাজা ও ওই সময়ে তাঁর ‘মৃচ্ছকটিক’ নামে সংস্কৃত নাটক লেখেন। তবে অনেকে বলেন বাৎস্যায়ন খ্রিস্টপূর্ব যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন খ্রিস্টজন্মের পরবর্তী যুগে তিনি জন্মগ্রহণ করেন দাক্ষিণাত্য দেশে। এ বিষয়ে অনেক মতানৈক্য আছে। তবে আমরা একথা অনেকটা বিশ্বাস করি যে, মহর্ষি বাৎস্যায়ন গুপ্তরাজাদের সময়কালেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বহুদেশ বিদেশ ঘুরে যৌনক্রিয়ার বিভিন্ন প্রচলন দেখে জ্ঞান লাভ করে কামসূত্রম’ নামে গ্রন্থটি রচনা করেন।

পুরাণ মতে, মহাদেবের অনুচর নন্দী হর-পার্বতীর কথোপকথন শুনে রচনা করেন রতিশাস্ত্র। মহর্ষি উদ্দালকের পুত্র শ্বেতকেতু তা থেকে একটি সুন্দর গ্রন্থ রচনা করেন। তারপর বাভ্রব্য নামে উত্তর ভারতের একজন ঋষি তাঁকে সুন্দর ভাবে ১৫০ টি পরিচ্ছেদে ভাগ করে তা বিশ্লেষণ করেন। বাব্যের এই পুস্তক সারা বিশ্বের পণ্ডিত ও লেখক সমাজে বিশেষ প্রশংসা লাভ করে। গ্রন্থটির বিভিন্ন অধ্যায়কে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে ভারতের ঋষিরা বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন—(১) চারায়ণ লেখেন সাধারণ কাম বিচার’। (২) সুবর্ণাভ লেখেন ‘যৌন কাম বিচার”। (৩) ঘোটক মুখ লেখেন যুবতী নারীর বিচার’। (৪) গোমার্দীয় লেখেন “স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধের বিচার’। (৫) গণিকা পুত্র লেখেন ‘পরস্ত্রী গমন বিচার’! (৬) দত্তক লেখেন ‘পতিতাদের কাম বিচার’। (৭) কুচুমার লেখেন ‘দেহ সৌন্দর্য ও যৌনিক বৃদ্ধির উপায় বিচার’। কিন্তু এইসব গ্রন্থ প্রত্যেকটি উৎকৃষ্ট হলেও পরস্পর বিচ্ছিন্ন ছিল বলে মানুষের মনকে তা আকর্ষণ করতে পারেনি। তাই ঋষি বাৎস্যায়ন এই শাস্ত্র একত্রিত করে তার “কামসূত্রম’ নামক গ্রন্থটি রচনা করলেন। এই গ্রন্থে তিনি বিভিন্ন ভাগে সব রকম কাম উদ্রেকের তত্ত্ব বিষয়ে সুন্দর ভাষায় ও স্পষ্ট করে আলোচনা করেছেন।

বাৎস্যায়নের মতে কামের পথে প্রকৃতই অগ্রসর হতে হলে নারী বা পুরুষ উভয়ের কতকগুলি কলাবিদ্যা শিক্ষা করা উচিত। মোট চৌষট্টি কলা বাৎস্যায়ন দেখিয়ে গেছেন। এইসব কলায় একজন মানুষ হয়তো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না, তবে কয়েকটি কলায় সে ব্যুৎপত্তি লাভ করতে পারে। আর কলা ছাড়া জীবন ও কাম কিছুই। মধুময় হতে পারে না।

কোনো কোনো ভারতীয় দার্শনিক ‘পুরুষার্থ’ নামক জীবনের চার উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন—(১) ধর্ম : ধার্মিক জীবন, (২) অর্থ : আর্থিক সমৃদ্ধি, (৩) কাম : নান্দনিক ও যৌন আনন্দ লাভ ও (৪) মোক্ষ : আধ্যাত্মিক মুক্তি। ধর্ম, অর্থ ও কাম দৈনন্দিন জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু মোক্ষ জন্ম ও পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তিলাভ। কামসূত্রম গ্রন্থে লিখেছেন–“ধর্ম অর্থ অপেক্ষা শ্রেয়, অর্থ কাম অপেক্ষা শ্রেয়। কিন্তু অর্থই রাজার জীবনে প্রথম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কারণ কেবল ইহা হতেই প্রজাগণ জীবনধারণ করিবেন। পুনরপি, কাম বেশ্যাদিগের উপার্জনপথ এবং তাঁহারা অন্য দুই অপেক্ষা ইহাকেই বাছিয়া লয়। ইহা সাধারণ নিয়মের ব্যতয়।” এই গ্রন্থের একটি অংশের উপজীব্য বিষয় হল যৌনতা সংক্রান্ত ব্যাবহারিক উপদেশ। গ্রন্থটি মূলত গদ্যে লিখিত। তবে অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত অনেক পদ্যাংশ এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। ‘কাম’ শব্দের অর্থ ইন্দ্রিয়সুখ বা যৌন আনন্দ। অপরদিকে ‘সূত্র’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ সুতো বা যা একাধিক বস্তুকে সূত্রবদ্ধ রাখে। কামসূত্র’ শব্দটির অর্থ তাই পুস্তকের আকারে এই জাতীয় উপদেশমালার গ্রন্থনা। এতে রমণীদের জন্য প্রযোজ্য চৌষট্টি কলা বিবৃত হয়েছে।

মল্লনাগ বাৎস্যায়ন রচিত কামসূত্র গ্রন্থে ৭ ভাগে বিভক্ত ৩৬টি অধ্যায়ে মোট ১২৫০টি শ্লোক রয়েছে—১. সাধারণম্ (ভূমিকা) শাস্ত্রসংগ্রহ (গ্রন্থের উপাদান সংক্রান্ত অধ্যায়সমূহ), ত্রিবর্গপ্রতিপত্তি (জীবনের তিন লক্ষ্য), বিদ্যাসমুদ্দেশ (জ্ঞান লাভ), নাগরকবৃত্তম (সুনাগরিকের আচরণ), নায়কসহায়দূতীকর্মবিমর্শ (নায়কের সহায়তায় দৌত্যকর্ম সংক্রান্ত অধ্যায়) ২. কন্যাসযুক্তকম (পত্নীলাভ) বর্ণসম্বিধানম সম্বন্ধনিশ্চয় চ (বিবাহের ধরন), কন্যাবিস্ৰম্ভণম (পত্নীকে শান্ত করণ), বালায়াম উপক্ৰমা ইঙ্গিতাকারসূচনম চ (পত্নীলাভ), একপুরুষাভিয়োগা (একক ব্যবস্থাপন), বিবাহ দ্বারা সম্মিলন ৩. ভার্যাধিকারিকম (পত্নী সম্পর্কে) একচারিণীবৃত্তম প্রবাসচার্য চ (এক পত্নী সংক্রান্ত), প্রধানা পত্নী ও অন্যান্য পত্নী সংক্রান্ত ৪. বৈশিকম (গণিকা) সহায়গম্যাগম্যচিন্তা গমনকারণং গম্যোপাবর্তনম (প্রণয়ী নির্বাচন সংক্রান্ত উপদেশ), কান্তানুবৃত্তম (স্থায়ী প্রণয়িনীর অনুসন্ধান), অর্থাগমোপায়া বিরক্তলিঙ্গানি বিরক্তপ্রতিপত্তির নিষ্কাসনক্রম (অর্থোপার্জন), বিশীর্ণপ্রতিসন্ধানম (পুরাতন প্রণয়ীর সহিত পুনরায় বন্ধুত্বকরণ), লাভবিশেষা (লাভ বিশেষ), অর্থানর্থবন্ধসংশয়বিচারা বেশ্যাবিশেষশ্চ (লাভ ও ক্ষতি) ৫. পারদারিকম (অন্যান্য পত্নী সংক্রান্ত) স্ত্রীপুরুষশীলবষ্ঠাপনম ব্যবৰ্তনকারণাণি স্ত্রী সিদ্ধা পুরুষা অযত্নসাধ্য যোষিত (স্ত্রী ও পুরুষের আচরণ), পরিচয়কারণায় অভিযোগ (পরিচিত হওয়া), ভাবপরীক্ষা (ভাবপরীক্ষা করণ), দূতীকর্মাণি (দৌত্য), ঈশ্বরকামিতম (রাজসুখ), অন্তঃপুরিকং দাররক্ষিতকম (অন্দরমহল) ৬. সংপ্রয়োগিকম (যৌন মিলন) প্রমাণকালভবেভয়ো রত অবস্থাপনম (কামনা উদ্দীপ্তকরণ), আলিঙ্গনবিকারা (আলিঙ্গন), চুম্বনবিকল্পাস (চুম্বন), আদর, দশনচ্ছেদ্যবিহায়ো (দংশন), সম্বেশনপ্রকারাশ্চিতররতানি (স্ত্রীপুরুষের দৈহিক মিলন), প্রহণনপ্রয়োগাস তক্তাশ শীৎকৃতক্রম (শীৎকারাদি), পুরুষোপসৃপতানি পুরুষায়িতম (নারীর পুরুষোচিত আচরণ), ঔপরিষ্ঠকম (মৌখিক যৌনাচার), রত অরম্ভ অবসানিকম রত বিশেষ প্রণয়কলহশ্চ (কামকেলির বিবরণী) (১০ অধ্যায়) ৭. ঔপনিষদিকম (বশীকরণ) সুভগংকারণম বশীকরণম বৃষ্যাশ্চ যোগা (শারীরিক আকর্ষণের উন্নতি করণ), নষ্টরাগপ্রত্যানয়নম বৃদ্ধিবিধায়শ্চরিতাশ্চ যোগা (হ্রাসপ্রাপ্ত যৌনক্ষমতা পুনরায় বৃদ্ধিকরণ)

কামসূত্ৰমের ‘বৈশিক’ নামে একটি বিস্তৃত অধিকরণে প্রাচীনকালে ভারতীয় গণিকাদের জীবনযাত্রার একটি সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ থেকেই সাধারণের মনে গণিকাদের সম্পর্কে যে অবজ্ঞা, ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধার বিরূপ ধারণা আছে বাৎস্যায়নের উল্লিখিত গণিকাদের জীবনযাত্রার বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করলেই সেই বদ্ধমূল ধারণার বদল হতে পারে।

বাৎস্যায়ন গণিকাদের পরিচয় দিতে গিয়ে কামসূত্ৰমের চতুর্থ অধিকরণের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে বলেছেন–“বেশ্যানাং পুরুষাধিগমে রতির্বৃত্তিশ্চ সৰ্গাৎ”। অর্থাৎ “গণিকাদের পুরুষ-ধরা বিদ্যা এবং অর্থ উপার্জন সেই সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে”। দ্বিতীয় শ্লোকে বলেছেন–“রতিতঃ প্রবর্তনং স্বাভাবিকং কৃত্রিমমর্থার্থম্‌”। অর্থাৎ রুচি হল রতির প্রতিশব্দ। রুচি থেকে যে পুরুষ গ্রহণে প্রবৃত্তি সেটা স্বাভাবিক, আর তা থেকে গণিকাদের যে অর্থোপার্জন প্রবৃত্তি সেটা কৃত্রিম”। এবার গণিকাদের উদ্দেশে তৃতীয় শ্লোকটি পড়ুন–“তদপি স্বাভাবিকবপরেৎ কামপরাসু হি পুংসাং বিশ্বাসযোগাৎ”। অর্থাৎ “তুমি যে পুরুষের কাছে ছল করছ, সেটা যেন বুঝতে না পারে। এমন ভাব দেখাবে যে তুমি তাকে ভালোবাসো, তাঁর অনুরাগিণী–এরকম হলে পুরুষ তোমার হাতের মুঠোয় এসে যাবে”। ষষ্ঠ শ্লোকে বলা হয়েছে–“ন চানুপায়েনার্থান সাধয়েদায়তিসংরক্ষণার্থ”। অর্থাৎ, “পুরুষের কাছে অর্থ উপার্জন করবে, কিন্তু খুব কৌশলে”।

এই পরামর্শই বুঝিয়ে দেয় গণিকাবৃত্তির বৈধতা ছিল, নিন্দনীয় নয়। বাৎস্যায়ন পইপই করে বলে দিয়েছেন কোন্ ধরনের পুরুষ একজন গণিকার কাছে চরম কাম্য হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ সাদা বাংলায় গণিকারা কোন্ ধরনের পুরুষদের সঙ্গ দিলে মোটা টাকা মিলবে। তৎকালীন সময়ে গণিকারা প্রভাবশালী ও ধনীদেরই শয্যাসঙ্গিনী হতেন। এখনও এমন এক গণিকাশ্রেণি আছেন, যাঁরা কেবলমাত্র প্রভাবশালী ও ধনীদের বিলাসবহুল কক্ষে শয্যাসঙ্গিনী হন মোটা অর্থের বিনিময়ে। তবে তা খুব সংগোপনে।

যাই হোক, দেখা যাক বাৎস্যায়ন গণিকাদের কেমন শয্যাসঙ্গী পছন্দ করতে বলেছেন। যেমন–(১) ধনী তো হতেই হবে, সেইসঙ্গে পুরুষটিকে স্বাধীন হতে হবে। অর্থাৎ পিছুটান নেই এমন পুরুষ। (২) যে ব্যক্তি প্রজাদের কাছ থেকে শুল্কাদি আদায় করে। (৩) ধনীক শ্রেণির যৌন-বিকৃত বৃদ্ধ। (৪) সংঘর্ষবন, অর্থাৎ এক গণিকাকে নিয়ে দুজন ধনীর প্রতিদ্বন্দ্বীর কে কত টাকা দিয়ে তাঁকে নিতে পারে। (৫) সবসময় যাদের হাতে টাকা আসে। যেমন–সুদখোর, কুসীদজীবী ইত্যাদি (৬) যে পুরুষ দেখতে কালো কুৎসিত, অথচ নিজেকে সে রূপবান এবং রমণীরঞ্জন মনে করে।(৭) আত্মশ্লাঘার বড়াই করে এমন ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা আদায় করা খুব সহজ। (৮) ধনী, অথচ ধ্বজভঙ্গ বা নপুংসক পুরুষ বিবেচ্য। (৯) বাপ-মায়ের অনাদরের ছেলেকে আদরে ভরিয়ে দিলে প্রচুর অর্থ সমাগমের সম্ভাবনা। (১০) সঙ্গদোষে দুষ্ট বখে যাওয়া যুবক। ইত্যাদি।

কোন পুরুষের সঙ্গে গণিকারা যৌনমিলন করবে না, সে বিষয়েও পরামর্শ দিতে ভোলেননি বাৎস্যায়ন।যেমন–(১) যক্ষ্মারোগ (টিউবারকুলাইসিস) হয়েছে এমন পুরুষ। (২) কুষ্ঠরোগাক্রান্ত (লেপ্রসি) পুরুষ। (৩) যে ব্যক্তির বীর্যের সঙ্গে ক্রিমি জাতীয় একপ্রকার ক্ষুদ্র কীট (বোঝাই যাচ্ছে এখানে বিশেষ কোনো যৌনরোগের কথাই বলা হয়েছে) থাকে, যা নারীর যোনির ভিতর দিয়ে জরায়ুতে পৌঁছে নারীকে জরাগ্রস্ত করবে। (৪) কঠোর ও কর্কশভাষী। (৫) কঞ্জুষ বা কিপটে। (৬) নির্মূণ। (৭) গুরুজনের পরিত্যক্ত পুরুষ। (৮) চোর। (৯) বিশ্বাসঘাতক। (১০) যে পুরুষের মুখে দুর্গন্ধ। (১১) যে পুরুষ বশীকরণ জানে। (১২) বঞ্চক ইত্যাদি।

সব ঠিক থাকলে তবেই একজন গণিকা “বর্তমানং নিষ্পীড়িতার্থমুৎস্যজন্তী বিশীর্ণেন সহ সন্ধ্যাৎ”–একজন পুরুষের অর্থ নিঃশেষ করে ছিবড়ে করে তারপর আর-একজন অর্থবান পুরুষকে পাকড়াও করবে। (কামসূত্রম্ ৪/৩/১) বাৎস্যায়ন মনে করেন, একজন গণিকাকে বিভিন্ন রুচির যুবক এবং প্রৌঢ় ব্যক্তির সঙ্গ দিতে হবে। যদি ধনবান হয়, প্রয়োজনে বৃদ্ধের সঙ্গেও শুতে হবে অর্থলাভের তাগিদে। এমনকি গণিকাদের কামশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করতে হলে সবার আগে ৬৪ কলায় নিপুণতা লাভ করতে হবে। একটু জেনে নেওয়া যাক ৬৪ কলাগুলো কী কী–(১) কণ্ঠসংগীত। (২) যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শিতা।(৩) নৃত্যকলা (৪) চিত্রাঙ্কন। (৫) কেশ সজ্জা।(৬) পুষ্পশয্যা নির্মাণ। (৭) নানাবিধ বর্ণে গৃহ সুসজ্জিতকরণ। (৮) নিজ পোশাক-পরিচ্ছদ, কেশ, নখ, দন্ত, প্রত্যক্ষ বর্ণের দ্বারা সুসজ্জিতকরণ। (৯) বর্ণাঢ্য প্রস্তর এবং ধাতব পদার্থে ঘর ও শয্যা সুশোভিত করা।(১০) ভিন্ন ভিন্ন উৎসবে বা আনন্দে শয্যা নানাভাবে আস্তরণ দেওয়া। (১১) সাঁতার ও জলকেলি। (১২) প্রিয় লোককে আকর্ষণ করার জন্য মন্ত্র-তন্ত্র অনুশীলন।(১৩) ফুল নিয়ে মালা গাঁথা ও অঙ্গাদি সুশোভিত করা। (১৪) ফুল নিয়ে মালার মুকুট ও বেষ্টন।(১৫) নিজের শোভন বেশভুষা করা—উৎসবে একপ্রকার, অন্য উৎসবে অন্য প্রকার। (১৬) চিত্তহারী প্রথায় কানের দুল পরিধান করা (১৭) সুগন্ধি দ্রব্য তৈরি করা। তৈজসপত্রাদি তৈরি সম্পর্কে শিক্ষা করা। (১৮) নতুন ভূষণ তৈরি বা পুরানো বিভিন্ন ধরনের অলংকার নতুন করে গড়া (১৯) অতিথিচর‍্যা (২০) পরিচ্ছদ রচনার সুচারুতা। (২১) হাতের কাজ।(২২) রন্ধনকলা। (২৩) পানীয় দ্রব্য, বিবিধ মিষ্টান্ন, আচার, চাটনি, ইত্যাদি তৈরিতে পারদর্শিতা। (২৪) সেলাই ও দেহের বস্ত্রাবরণ করতে সুদক্ষতা। (২৫) বস্ত্রখণ্ড ও সুতো দিয়ে পাখি, পাতা, ফুল ইত্যাদি তৈরি করা। (২৬) বীণা ও ডমরুর শব্দ অনুকরণ। (২৭) নানাবিধ হেঁয়ালিপূর্ণ আচরণ।(২৮) তাৎক্ষণিক কাব্যরচনা ও আবৃত্তি। (২৯) কঠিন অর্থপূর্ণ দুরূহ শব্দের অর্থ নিরূপণ করা। (৩০) সুমধুর কণ্ঠে শাস্ত্রীয় শ্লোক আবৃত্তি। (৩১) নাটক, অভিনয়, দর্শন ও নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের প্রকৃত সমালোচনা। (৩২) কোনো কবিতার হারানো পঙক্তির পুনরুদ্ধার করা বা তা পুনরায় নতুন করে লেখা। (৩৩) বেত বা তৃণ থেকে নানাবিধ নতুন নতুন আসবাবপত্র রচনা বা বোনা। (৩৪) কাঠ থেকে কুঁদে ছবি বা দৃশ্য রচনা। (৩৫) কাঠমিস্ত্রির কাজ, এবং বাড়িঘর নির্মাণ। (৩৬) সোনা, রূপা ও দামি পাথর বসিয়ে নানা কাজ করা। (৩৭) রসায়ন বা ধাতব শাস্ত্র অধ্যয়ন। (৩৮) উজ্জ্বল পাথর ও দামি ধাতুর বস্তু রচনা। (৩৯) কানন রচনা ও পুষ্পবিন্যাস। (৪০) ভেড়া, মোরগ এবং পায়রাদের নিয়ে কৌতুকপূর্ণ খেলা করার উৎসাহ দান। (৪১) শুক, ময়না প্রভৃতি পাখিকে কথা শেখানো ও তাদের দিয়ে মজাদার কাজ করানো। (৪২) গাত্র মর্দন করতে শেখা, বেশভূষা রচনা করা, কাজের শিল্প শিক্ষা করা। (৪৩) সংবাদ প্রাপ্তির নমুনাস্বরূপ আঙ্গুলের দাগ বোঝা।(৪৪) গুপ্ত সংকেত শেখা ও ব্যবহার। (৪৫) বিভিন্ন দেশের লিখিত ভাষা ও কথাবার্তা বোঝ। (৪৬) ঘোড়া, হাতি ও যানবাহন সুসজ্জিত করা। (৪৭) সংকেত চিহ্ন বা গুপ্ত বার্তা বোঝা (৪৮) নানা ধরনের যন্ত্রে জ্ঞানলাভ করা। (৪৯) স্মৃতিশক্তি বা স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করার অভ্যাস। (৫০) নানাবিধ পুস্তক পাঠ। (৫১) নানাবিধ পুস্তক রচনা। (৫২) অভিধান ও বিশ্বকোশ সংগ্রহ।(৫৩) ছন্দের নিয়ম এবং বক্তৃতা শিল্প শিক্ষা। (৫৪) লুকানোর শিল্প, তুলো রচিত দ্রব্যকে পশমরূপে রূপদান, সাধারণ দ্রব্যকে চিত্তাকর্ষক করে তোলা। নানা বস্ত্র পরিধান করা। (৫৫) দাবা খেলা ও পাশা খেলায় দক্ষতা (৫৬) বস্ত্র পরিচ্ছদ পরিধান করে নিজেকে অন্যের চোখে আকর্ষণীয় করে তোলা। (৫৭) শিশুদের মতো পুতুল ও গোলাকার সব বস্তু নিয়ে খেলা করা।(৫৮) নানা প্রকার শারীরিক ব্যায়াম ও কলাকৌশল শিক্ষা করা।(৫৯) রাজনীতি শিক্ষা করা।(৬০) সামরিক রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞান (৬১) মুখ দেখে মানুষের চরিত্র আন্দাজকরণ।(৬২) কৃত্রিম পুষ্প তৈরি ৷(৬৩) কাদা বা নরম মাটি দিয়ে পুতুল, মূর্তি নির্মাণ (৬৪) গণিত বিষয়ে জ্ঞান লাভ।

বাৎস্যায়ন চৌষট্টি বা চতুঃষষ্টি কলায় সুশিক্ষিত গণিকাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন–“আভিরভূচ্ছিতা বেশ্যা শীলরূপগুণান্বিতা।/লভতে গণিকাশব্দং স্থানঞ্চ জনসংসদি৷৷” বাৎস্যায়নের সময় গণিকাদের বিয়ের মধ্যে এক অভিনব ব্যাপার ছিল। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতো তাঁরাও বিয়ে-থা, সন্তান জন্মদান, ঘর-সংসার করতে পারত। তবে কোনো গণিকাকেই বিয়ের পর পুরোনো গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করত না। অবশ্য বিয়ের পর প্রথম একটা বছর স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করা নিষিদ্ধ ছিল। বিয়ের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর গণিকাবৃত্তিতে আর কোনো বাধা ছিল না। তবে সেক্ষেত্রে শর্ত একটাই–এক বছর পর স্বামী যে রাতে তাঁকে যৌনমিলনের তাগিদে বিছানায় আহ্বান করবে সেই মুহূর্তে শত খরিদ্দার ত্যাগ করেও সেই রাতে তাঁকে স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হতে হবে (কামসূত্রম্ ৭/১/২২)। বাৎস্যায়ন শেষ করব গণিকাদের একটি বিপজ্জনক অপকর্ম দিয়ে। এইসব গণিকারা চতুরতার সাহায্যে মাঝমধ্যেই শাঁসালো ধনীর ছেলে খুঁজে তাঁর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করত। কীসের ক্ষতিপূরণ? গণিকারা তাঁর কোনো সখি বা দাসীর সাহায্যে তাঁর অক্ষতযোনি কন্যার যোনিদেশে সীসা-লৌহাদি নির্মিত কৃত্রিম লিঙ্গ প্রবেশ করিয়ে সতীচ্ছদ ছিন্ন করে ক্ষতের সৃষ্টি করত। এরপর ওই যযানি-বিধ্বস্ত মেয়েকে পাখি-পড়া পড়িয়ে মুখিয়ার দরবারে কিংবা বিচারালয়ে পূর্বে নির্দিষ্ট যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করত এবং বেশ মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিত (কামসূত্রম্ ৭/১/২০)।

বাৎস্যায়নের সময়ে সমাজের বিদ্বান ব্যক্তিরা দলে দলে গণিকালয়ে আড্ডা জমাতেন। শুধু মুখে আচ্ছা নিশ্চয় হত না। নারী থাকবে, অথচ সুরা থাকবে না তা কি কখনো হয়! অতএব ঢালাও মদের ব্যবস্থাও ছিল সেই আড্ডায়। কত ধরনের মদের সমাবেশ ঘটানো হত, তার তালিকাও বাৎস্যায়ন উল্লেখ করেছেন। বাৎস্যায়ন এটাও প্রমাণ করে দিয়েছেন, অন্য বৃত্তিধারী বা পেশাদার মানুষরা যেমন বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে, ঠিক তেমনই গণিকারাও নিজের বৃত্তি বা পেশায় টিকে থাকার জন্য নানারকম কৌশল অবলম্বন করে থাকত। আর পাঁচটা বিক্রেতাদের খরিদ্দার ধরে রাখার মতো গণিকারাও পুরুষ ধরে রাখার চেষ্টা করতেন, ধরে রাখার বিদ্যাটাও অতি যত্নে আয়ত্ব করতে হত। বলতে দ্বিধা নেই, বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামশাস্ত্রম’ রচনা করেছিলেন মূলত গণিকাদের জন্যেই। গণিকারা যাতে উৎকৃষ্ট ও সুখদায়ক কামকলা প্রদর্শন করতে পারে সেই শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই কামসূত্র। গণিকাদের যৌনক্রিয়ার পারদর্শিনী করে তুলতেই এই আকর গ্রন্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *