শেষ পাতে, শেষ কথা
এতক্ষণ রামায়ণ ও রামায়ণ গ্রন্থে বিভিন্ন চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হল। যে আলোচনায় নানা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে রামায়ণ ও রামের অস্তিত্ব নিয়ে। রামায়ণকে নানা পণ্ডিত নানাদিক থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে দেবতার তত্ত্ব। সেই হিসাবে পুরো ঘটনাকেই সত্য বলে মানে সাধারণ মানুষ। সত্যি তো বটেই। এ আমি মোটেই দ্বিমত নই। আমি অতিরঞ্জিত সত্য। অলৌকিক কাণ্ডগুলি বা উপাদানগুলি সরিয়ে পাঠ করলে সত্যের ইতিহাস বিরিয়ে আসব। যেই সত্যকে বলতে পারেন ‘আর্যসত্য’।
সেই আর্যসত্যকে বুঝতে হলে পিছন দিকে ফিরে যেতে হবে। অনেকটা পিছনে। প্রাচীন ভারতকে না চিনলে রামায়ণকে মূল্যায়ন করা যাবে না। সেই প্রাচীন ইতিহাসের আলোর নিচে রামায়ণকে ফেলে যদি পোস্টমর্টেম করতে পারেন, তাহলেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য।
হিমালয় পর্বত থেকে নিঃসৃত তিনটি নদীজলধারা বিধৌত বিশাল অঞ্চল সাধারণভাবে আর্যাবর্ত নামে পরিচিত, যা মুসলিম আগমনে হিন্দুস্তান বলে পরিচিত হয়েছে। এই অঞ্চলের পশ্চিমাংশ সিন্ধু ও তার পাঁচটি শাখা–শতদ্রু, বিপাশা, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা ইরাবতী। মধ্যমাংশ গঙ্গা, যমুনা ও তার উপনদী। পূর্বাংশে ব্ৰহ্মপুত্র প্রবাহিত। আর্যাবর্তের প্রতীচ্য ভাগে একটি অববাহিকার পাশে সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ হয়েছিল। ভারতে আর্যরা নদীর মাহাত্ম্যে মোহিত হয়ে নদীগুলিকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করতেন। তাই ভারতভূমির জলই গঙ্গাদেবতার মর্যাদা পায়। প্রাচীন গ্রন্থগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করলে বেশকিছু তথ্য উঠে আসে, সেগুলি এখানে আলোচনা বা উল্লেখ করলে বিষয়টা একটু স্পষ্ট হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের রাজনৈতিক (পৌরাণিক সহ) ইতিহাসে উত্তর ভারতের গুরুত্ব সর্বাধিক। আর্য সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ এবং প্রথম সাম্রাজ্যের বিস্তার ও প্রকাশ এখান থেকেই হয়েছিল। আর্য কারা? ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা বলেন, আর্যরা প্রথমে পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁরা দলবদ্ধ হয়ে অনেকগুলো পশু সঙ্গে নিয়ে ঘাস আচ্ছাদিত অঞ্চল বা প্রদেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তেন। পরে সে স্থানের ঘাস পশু খাদ্য হিসাবে নিঃশেষিত হলে তাঁরা পুনরায় অন্য অঞ্চল বা প্রদেশে যেতেন। এভাবে তাঁরা প্রতিনিয়ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে আসতেন বলে আর্য (অর্থাৎ গমনশীল) নামে পরিচিত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আর্যরা নিরন্তর এরূপ স্থান পরিবর্তন খুবই কষ্টদায়ক বিবেচনায় এনে এক স্থানে অবস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং এ সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার চেষ্টা চালায়। উপায় হিসাবে কৃষিকাজকেই তাঁরা অধিক গুরুত্ব দিয়ে ফসল উৎপাদনে নিযুক্ত হয়। এজন্যই তাঁরা আর্য (অর্থাৎ কৃষিজীবী) নামে প্রসিদ্ধ হন। শেষোক্ত পক্ষের মতবাদে আর্য শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কৃষিকর্মকারী, কারণ ও ধাতুর কর্ষণার্থও আছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন গ্রন্থগুলির কতগুলোতে উৎকৃষ্ট গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে ‘আর্য’ শব্দে নির্দেশ করা হয়েছে। কোনো কোনো গ্রন্থে হিন্দুধর্মাবলম্বী লোকমাত্রেই অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র–এই চার বর্ণের লোকই ‘আর্য’ বলে লিপিবদ্ধ আছে। আবার, কোনো কোনো গ্রন্থে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য–এ তিন বর্ণকে আর্য এবং চতুর্থ বর্ণকে শূদ্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এতে কেউ কেউ অনুমান করেন যে, শূদ্র গোষ্ঠী আর্যবংশের নয়; আর্যেরা ভারতবর্ষে এসে ভারতের স্থানীয় ভূমিপুত্রদের শূদ্র তথা অনার্য চিহ্নিত করেছেন।
আর্য গোষ্ঠী খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করতে শুরু করে। তৎকালে বাংলা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বা উপরাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক রাষ্ট্র স্বশাসিত নৃগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। পূর্ববর্তী বৈদিক আর্যরা উপনিবেশ গড়ার ক্ষেত্রে নানা কারণে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে আসার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল। কারণ তাঁদের দৃষ্টিতে পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ডে ছিল রাক্ষস, অশুচি ও দস্যু বা বর্বর জনগোষ্ঠীর বাস।
মৎস্য পূরাণের এক বর্ণনায় দেখা যায় যে, এক অন্ধ বৃদ্ধ সাধু ভুলবশত নিম্নগাঙ্গেয় উপত্যকার স্রোতে ভেলা ভাসিয়েছিলেন। বালী নামের এক নিঃসন্তান রাজা বংশ রক্ষা ও রাজ্যের উত্তরাধিকারীর জন্য বৃদ্ধ সাধুকে আশীর্বাদ করার অনুরোধ করেন। সাধুর আশীর্বাদে রাজা তাঁর বৃদ্ধা রানীর গর্ভজাত পাঁচটি পুত্র সন্তানের জনক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। পাঁচ পুত্রের নাম রাখা হয় অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সূক্ষ্ম। রাজার পাঁচ পুত্র সন্তানের নামে বাংলার পাঁচটি ভূখন্ডের নামকরণ হয়। বাংলা ভূখণ্ড আর্যদের নিকট এতোটাই অপবিত্র ছিল যে, তাঁরা সতর্কতার সঙ্গে এতদঞ্চলে প্রবেশ ও স্থায়ী বসবাস গড়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিল। সবচেয়ে কৌতুহোলদ্দীপক হল, আরও পরবর্তী সময়ের বৈদিক সাহিত্যের বিষয়াবলিতেও ভারত তথা বাংলার জনগোষ্ঠীকে দস্যু, দৈত্য-দানো, রাক্ষস-খোক্ষস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মহাভারত এ বাংলার উপকূলবর্তী। অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে ম্লেচ্ছ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। ভগবত পুরাণে ও বাংলার জনগণকে বলা হয়েছে ‘পাপী। ধর্মশাস্ত্রে পুন্ড্র ও বঙ্গীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংস্পর্শে আসার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মৃত্যুর পরবর্তী শেষ কৃত্যানুষ্ঠান আয়োজনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর্যরা আর্যাবর্তের বাইরে বসবাস গড়ে তুললেও স্থানীয় ভূমিপুত্র তথা জনগণের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে তারা নানা ধরণের বিধিনিষেধ বজায় রেখে চলত।
আর্যসমস্যা ইতিহাসের একটি জটিল সমস্যা। একটি মত অনুসারে আর্ব বলতে একটি বিশিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে বোঝায়। অন্য মত অনুযায়ী আ কথাটি জাতি অর্থে ব্যবহার করা উচিত। বর্তমানে প্রথম মতের সমর্থকদের সংখ্যা বেশি হলেও, দ্বিতীয় অভিমতটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত করা হয়নি।
আর্যরা বহিরাগত না ভারতেই আধিবাসী এ প্রশ্নকে কেন্দ্র করেও পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে–(১) গঙ্গানাথ ঝাঁ, ত্রিবেদ, কাল্লা, এ.সি. দাস, পুসলকারের মতো ভারতীয় পণ্ডিতরা মনে করেন ভারতই আর্যদের আদি বাসস্থান, যদিও ভারতের কোন্ অঞ্চলে তারা বসবাস করত তা নিয়েও বিতর্ক আছে। (২) দ্বিতীয় মত অনুসারে (গাইলস, হার্ট ইত্যাদি ইউরোপীয় পণ্ডিত) ইউরোপই আর্যদের আদি বাসস্থান। এ ক্ষেত্রেও ইউরোপের কোন্ অঞ্চলে তাঁরা বসবাস করত, তা নিয়েও মত পার্থক্য আছে। (৩) তৃতীয় একটি মত অনুসারে (ব্রান্ডেনস্টিয়েন) মধ্য এশিয়ায় স্তেপি অঞ্চলেই ছিল আর্যদের আদি নিবাস এবং এখান থেকেই তাঁদের একটি শাখা ইউরোপে ও অপর একটি শাখা পারস্য হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। বর্তমানে তৃতীয় অভিমতই অধিকাংশ পণ্ডিত গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন।
সংস্কৃত ভাষায় লিখিত প্রাচীন শ্লোক অনুসারে “সর্বে গত্যৰ্থাঃ জ্ঞানার্থাঃ প্রাপ্ত্যর্থাশ্চ”–সমূদায় গমনার্থক ধাতু জ্ঞানার্থক ও প্রাপ্ত্যর্থক। সুতরাং, যারা জ্ঞানশীল অথবা যারা (শাস্ত্রসীমায়) গমন করেন কিংবা যারা (শাস্ত্রের পার) প্রাপ্ত হন, তাঁরাই আর্ব। যাস্কাচার্যের মতে “আর্য’ শব্দের নিরুক্তগত অর্থ ‘ঈশ্বরপুত্র’। অর্থাৎ ঈশ্বরের যথার্থ পুত্রকে ‘আর্য’ নামে সম্বোধন করা হয়। মানবমাত্রেই ঈশ্বরের পুত্র, তথাপি সদাচারপরায়ণ পুরুষকেই ঈশ্বরপুত্র অর্থাৎ ‘আর্য’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আর্যরা ভারতবর্ষে বিদেশি অনুপ্রবেশকারী এটি ইংরেজ আমলে প্রচারিত একটি ধারণা বলেও অনেকে মনে করেন।
বাল্মীকি রামায়ণে বলা হয়েছে–
“সর্বদাভিগতঃ সদ্ভিঃ সমুদ্র ইব সিন্ধুভিঃ। আর্যসবসমশ্চৈব সদৈব প্রিয়দর্শন।” (বাল্মীকি রামায়ণ ১/১/১৬)
অর্থাৎ, রামচন্দ্র সদাসর্বদা সৎপুরুষদের সাহচর্যে থাকতেন, যেরূপ সমুদ্র সদা নদীসমূহের সঙ্গে মিশে থাকে তথা তিনি আর্য, সমদর্শী ও সকলের প্রিয় ছিলেন।
বিদুর নীতিতে বলছে–
“আর্য কর্মাণি রজ্যন্ত ভূতি কর্মাণি কুৰ্বতে হিতং চ নাভ্যসূযন্তি পণ্ডিতা ভরতভ।
ন স্বে সুখে বৈ কুরুতে প্রহর্ষ। নান্যস্য দুঃখে ভবতি প্রহৃষ্টঃ।
দত্ত্বা ন পশ্চাৎ কুরুতেহনুতাপং স কথ্যতে সৎপুরুষার্য শীলঃ।” (বিদুর নীতি ১/৩০/১/১৮)
এই শ্লোকে অত্যন্ত ধার্মিককেই ‘আর্য’ বলা হয়েছে। চাণক্যনীতিতে উল্লেখ আছে–“অভ্যাসাদ ধার্যতে বিদ্যা কুলং শীলেন ধার্যতে। গুণেন জ্ঞাযতে আর্যঃ কোপো নেত্রেণ গম্যাতে।” (চাণক্য নীতি ৫/৮) এখানেও গুণীজনকে ‘আর্য’ বলা হয়েছে। মহাভারতের আছে–“স বাল এবামতিপোত্তমঃ।” (মহাভারত আদিপর্ব ৪০/৭) এই শ্লোকে উত্তম রাজকুমারের সাথে ‘আর্যমতি’ বিশেষণ যুক্ত করা হয়েছে যার অর্থ শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে পাচ্ছি–“ব্যবস্থিতামর্যাদাঃ কৃতবর্ণাশ্রমস্থিতঃ।” আর্যগণের মর্যাদাকে যে ব্যবস্থিত করতে সমর্থ সেই রাজ্যাধিকারী, এরূপ বর্ণিত হয়েছে।
মোদ্দা কথা, আর্য হচ্ছে একটি ভাষা গোষ্ঠীর নাম। আর একাধিক মানবগোষ্ঠীই এই ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ভাষাগত দিক দিয়ে ভারতবর্ষে দুটি আর্য জাতির অস্তিত্ব মেলে। আর গোষ্ঠীগত দিক দিয়ে যাদের একটি হল–আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত এবং অন্যটি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত। এই আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা যেমন অসুর, রাক্ষস, শূদ্র নামে পরিচিত, তেমনি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা ছিল ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। অনেক চিন্তাশীল লেখকেরাই ব্যাপারটাকে গুলিয়ে ফেলেন। তাঁরা বলেন, ডঃ আম্বেদকর বলেছেন বৈদিক আর্যরা। বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী নয়। আসলে তাঁরা আম্বেকরের ব্যাখ্যাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি বলে মনে হয়। আসলে ডঃ আম্বেদকর বলেছেন, আলপাইন বা অসুর মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষীরা বহিরাগত নয়। কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ভাষীরা হলেন বহিরাগত। যদিও বর্তমানে আর্য বলতে আমরা কেবল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ব্রাহ্মণদেরই বুঝে থাকি। যারা হলেন ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশকারী বা বহিরাগত। নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী ব্রাহ্মণ এবং অন্যটা আলপাইন মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী অসুর, যা ডঃ আম্বেদকর তাঁর গবেষণা দ্বারাই প্রমাণ করেছেন।
নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা যেহেতু তাঁরা ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত; তাই তাঁরাই মূলনিবাসীদের মধ্যে অত্যন্ত সুকৌশলে বিভেদ সৃষ্টি করে ইন্দো-ইরানি দাস এবং দস্যু সহ দেশীয় আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যদেরও যুদ্ধে পরাজিত করে ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তার করেন। কারণ ইন্দো-ইরানী দাস এবং দস্যু ও দেশীয় আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যরা ছিলেন অযাজকীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যরা ছিলেন যাজকীয় মতবাদে বিশ্বাসী। আর জয়ের পরিকল্পনাটি ঠিক এ কারণেই।
একথার সমর্থনে বলা যায় যে নর্ডিক আর্যরাই দাস এবং দস্যুসহ মূলনিবাসী আলপাইন আর্যদেরও জয় করেছিল। যার প্রমাণ ঋগবেদের উদাহরণ থেকেই পাওয়া যায়। অর্থাৎ ঋগবেদে দেখা যায় দাস এবং দস্যুরা আলপাইন আর্যদের পক্ষ নিয়ে নর্ডিক আর্যদের বিরুদ্ধে সর্বদাই যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। আর নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণেরা যে সত্যিই দাস, দস্যু, রাক্ষস, অসুর এবং আলপাইন আর্যদের জয় করেছিলেন তা অনুপ্রবেশকারী বৈদিক নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণের নিত্যনতুন বৈদিক আইন প্রনয়ণ এবং বৈদিক ধর্মের উপর পরবর্তীকালীন প্রাধান্য থেকেই পরিষ্কার। অতএব ডঃ আম্বেদকরের সদ্ধান্ত থেকে প্রমাণিত নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণেরা বিদেশি ইউরোপিয়ান অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু আলপাইন আর্যরা দেশীয় অসুর জাতি বলেই পরিচিত। যে আলপাইন বা অসুর জাতি নর্ডিক আর্য আগমনের অনেক পূর্বেই নগরকেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন।
প্রাচীন ভারতে হিন্দু বলে কোনো ধর্ম ছিল না। প্রকৃত অর্থে হিন্দুধর্ম বলে কোনো কথার মানেও হয় না। ভারত উপমহাদেশে এরকম কোনো ধর্মের আবির্ভাবও হয়নি। হিন্দুধর্ম বলতে বুঝতে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা রচিত ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন। বলা যায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম। যেহেতু ব্রাহ্মণ্যধর্মের নির্দিষ্ট কোনো মুখ নেই, বহুমুখী–সেই কারণেই হিন্দুধর্মকে সনাতন ধর্ম বলাটাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ, সামগ্রিক।
রামায়ণ ও মহাভারতই ভারতীয় মহাদেশের ভারতত্ব। রামায়ণ ও মহাভারতেই লুকিয়ে আছে হিন্দুজাতির অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব। ভারত উপমহাদেশে বহিরাগত আর্য তথা ব্রাহ্মণরা তাঁদের রচিত শাস্ত্র-সাহিত্য নিয়ে বহু বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এইভাবে ভারতের ভারতীয়তার প্রসারের ফলে এশিয়া ভূখণ্ডের কয়েকটি দেশকে Greater India বা বৃহত্তর ভারত নাম দিয়ে বিশালতর ভারতবর্ষের এক একটি অংশ বলে ধরে নেওয়া হয়। সেই বৃহত্তর ভারতের অংশগুলি হল ব্রহ্ম, শ্যাম, কম্বোজ, কোচিন-চিন বা চম্পা এবং লাওস। মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া অর্থাৎ দ্বীপময় ভারত বা দ্বীপান্তরের দ্বীপ। যেমন–সুমাত্রা, যবদ্বীপ, লম্বক, সুম্বাওয়া, তিমোর, সুলাবেশি, বোর্নিও প্রভৃতি।
ভারতবর্ষ থেকে যেসব দেশে ভারত-ধর্মের ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের প্রচার হয়েছে, সেইসব দেশে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি পৌঁছে গেছে। এর ফলে দক্ষিণ ব্ৰহ্ম, দক্ষিণ শ্যাম, কম্বুজ দেশ (Cambodia), উত্তর ও মধ্য ব্রহ্মের থুল চুক (Thul-Cuk), উত্তর শ্যামের দৈ (Dai) বা থাই (Thai) জাতি, চম্পার চাম (Cham) জাতি, মালয় উপদ্বীপের মালাই জাতি এবং যবদ্বীপের সুন্দা, মাদুরা ও যবদ্বীপীয় জাতি বা বলিদ্বীপের ও লম্বক দ্বীপের অধিবাসীরা সকলেই এককালে ব্রাহ্মণ্য আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্ম ও সমাজ গড়ে তোলে। এই ধর্মপ্রসারে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদিই ছিল একমাত্র অস্ত্র। ব্রাহ্মণ তথা আর্যরা যে কত মহান’ জাতি, তা এই গ্রন্থগুলিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত হয়েছে। পরে অবশ্য ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের বিরোধিতা করে প্রতিস্পর্ধী বৌদ্ধধর্মের উত্থান হলে ব্রাহ্মণধর্ম অনেকটাই খর্ব হয়ে যায়। একদা ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন বা ধর্মে যেসব দেশ সমাজ গড়েছিল, সেইসব দেশ এখন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। সেইসব দেশগুলি হল–চিন, থাইল্যান্ড, জাপান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি। ভারত উপমহাদেশের মানুষ ব্রাহ্মণ্যধর্ম ত্যাগ করে কিঞ্চিৎ বৌদ্ধ এবং অনেকটাই ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করে নিয়েছে।
রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদি যদি যথাযথভাবে সংরক্ষিত করা না যেত, যদি এইসব গ্রন্থে প্রক্ষিপ্তভাবে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রবেশ ঘটানোনা যেত, তাহলে তথাকথিত হিন্দুধর্মের বিলোপ ঘটে যেত। ব্রাহ্মণদের মাহাত্মও প্রচার পেত না। যে রামায়ণ গ্রন্থটি নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করা হল সেই রামায়ণ কি একজন বাল্মীকির রচনা? না, এই বাল্মীকি রামকথাকার আদিকবি নন। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, রাম আমলের প্রচেবংশীয় পুরুষ বলে নিজের পরিচয় দিয়েছে। ভারতীয় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় রামকে সামনে রেখে একটির পর একটি অন্যায় করে গেছেন, আর সেই অন্যায়গুলি যে অন্যায়ই নয় সেটা বোঝানোর জন্য অলৌকিক ঘটনা প্রবেশ ঘটিয়ে মাহাত্ম প্রচার করে গেছেন। তাই রাম হয়েছেন সমস্ত অপবাদ ও অপ্রশংসার লক্ষ্য। তাই রাম সমালোচনার উর্ধ্বে থাকতে পারলেন না কোনোভাবেই।
রাম অসহায় রাজা, বেবশ মানুষ। গোটা রামায়ণ জুড়ে রামের যে কার্যকলাপ রামের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল না। সীতাকে একাকী পঞ্চবটিতে ফেলে গভীর অরণ্যে শিকারে যাওয়া; বালীকে হত্যা করা; সুগ্রীবের সঙ্গে দোস্তি করা; পায়ে পা লাগিয়ে রাবণের যুদ্ধ করে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা; সীতার সতীত্ব যাচাই করার জন্য আগুনে ঠেলে দেওয়া; সীতাকে অপমান করা; সীতাকে জঙ্গলে পরিত্যাগ করা; লক্ষ্মণকে বর্জন করা; লব, কুশ, ভরত ও শত্রুঘ্নকে ভিনরাজ্যে ঠেলে দেওয়া; রামের সদলবলে সরযূ নদীতে আত্মবিসর্জন দেওয়া কোনোকিছুই রামের ইচ্ছামতো হয়নি–রাম ব্রহ্মাবাদী নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণ্য-চক্রান্তে বন্দি। রাম নিজেও এসবের কিছু বোঝেননি, তা কিন্তু নয়। রাম নিজের মুখেই বলেছেন–“দেবগণের সকল কার্যে আমি ব্ৰহ্মার বশবর্তী”। বুঝলেও কিছু করারও ছিল না রামচন্দ্রের। এসব কাজে রামের যে বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না একথা বলা যায় না। কে শোনে তাঁর আপত্তি! আপত্তি শোনার জন্যই কি এত পরিকল্পনা! ব্রাহ্মণ্য-চক্রান্ত যে কত নির্মম আর। নিষ্ঠুর রামকথা তারই জলন্ত প্রমাণ। এই ব্রাহ্মণ নেতাদের হুকুমেই রাম সর্বসমক্ষে সরযূ নদীতে জীবন বিসর্জন বাধ্য হয়েছেন। রামের জীবন সুখে কাটেনি, শেষ জীবন তাঁর বড়োই কঠিন অবস্থা দিয়ে গেছে। মমর্যাতনায় দিনগুলি শেষ হয়েছে তাঁর। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে অবাধে লুণ্ঠনে পরিতৃপ্ত হয়েছেন নেপথ্যের পরিচালকবৃন্দ ব্রাহ্মণগণ। রামচন্দ্র কর্তৃক সমস্ত কর্মকাণ্ডের উপর ব্রাহ্মণদের তীক্ষ্ণ নজর ছিল। ছিল স্পষ্ট নির্দেশ। গোটা রামায়ণে ব্রাহ্মণদের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়েনি। রামের শেষ পরিণতির জন্য ব্রাহ্মণরাই দায়ী। ব্রাহ্মণরাই রামের জীবন থেকে সমস্ত প্রিয়পরিজনদের একে একে সরিয়ে দিয়েছেন। এঁদেরই অঙ্গুলিহেলনে রাম বিধ্বস্ত, রাম একাকী। আর এক ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীরাই নয়, ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ছিল বৃহৎ শক্তির ধারক সম্প্রসারণবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী আর্যদেবতাদের সেনাদল! অথচ নিজেদের গায়ে কোনো কাদাই লাগতে দেননি তাঁরা।
রামায়ণের কেবলমাত্র রামকথাই নয়, রামকথা ধর্মকথাও। অনুশাসনই ধর্মকথা, বাল্মীকি সামাজিক নানা অনুশাসনও উল্লেখ করেছেন, যা অত্যন্ত মূল্যবান। এই কারণেই বোধহয় মহাকাব্য ধর্মগ্রন্থ হয়ে উঠেছে। ধর্মশাস্ত্রের মতোই রামায়ণেও অনুশাসন উচ্চারিত হয়েছে। মহাভারতও সেই কারণেই ধর্মগ্রন্থ। রামায়ণের ছত্রে ছত্রে অনুশাসনের বিবরণ নির্দেশিত হয়েছে–কখনো গল্পের মাধ্যমে, কখনো-বা সরাসরি নির্দেশনা। কোনো প্রতিষ্ঠানকে সুনিয়মে পরিচালিত করতে হলে তার জন্য বিধিবদ্ধ নিয়মের প্রয়োজন হয়। অন্যায়ের পরিহার ও নিয়ম সংরক্ষণই সেই বিধিবিধানের উদ্দেশ্য। স্মৃতিও এই উদ্দেশ্যের জন্যই রচিত হয়েছিল। মনে রাখতে হবে প্রাচীন যুগে রাজনৈতিক, সমাজনৈতিক ইত্যাদি সকল বিষয়ে স্মৃতির অনুশাসন নিয়ন্ত্রণ করত। পাপের পরিহার ও পুণ্যের প্রতিষ্ঠাই সমাজ অনুমোদিত ধর্মশাস্ত্রের উদ্দেশ্য। তবে পক্ষপাতিত্ব যে ছিলই একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্ণভেদে একই অপরাধের শাস্তি ভিন্ন হত। আইন সকলের জন্য সমান–এ অঙ্গীকার প্রাচীন যুগের অনুশাসনে ছিল না। তবে সূর্যাভিমুখে মলমূত্র ত্যাগ করা, সন্তানের মতো পালনকারী রাজার বিরুদ্ধাচরণ বা বিদ্রোহ করা, গুরুর উপদেশ ভুলে যাওয়া, গুরুনিন্দা করা, গুরুকে অবজ্ঞা করা, পা দিয়ে গোরুকে স্পর্শ করা, কাজ করিয়ে ভৃত্যকে বেতন না-দেওয়া, পরনিন্দা করা, পায়েস ও খিচুড়ি ভক্ষণ করা, বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা করা, প্রত্যুপকার না-করা, পুত্রহীন হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া, লাক্ষা-মধু-মাংস-লৌহ-বিষ বিক্রয় করা, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করা, অনুগত ভৃত্যকে পরিত্যাগ করা, মদ-নরী-অক্ষক্রীড়ায় আসক্ত হওয়া, কাম ও ক্রোধে অভিভূত হওয়া, স্বধর্মে অনাসক্তি হওয়া, গৃহ দগ্ধ করা, গুরুপত্নী ভোগ করা, পিতামাতার শুশ্রূষা না-করা, নিজের পত্নীকে পরিত্যাগ করে পরস্ত্রীতে আসক্ত হওয়া ইত্যাদি ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ।
রামায়ণ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক প্রবোধচন্দ্র সেন লিখেছেন–“সব বিবর্তনের ন্যায় এই বিবর্তনের মধ্যেও একটি ঐক্য অপরিবর্তিত রূপে নিত্য বিরাজমান আছে। এই সূক্ষ্ম ঐক্যসূত্রই ভারতবর্ষের অতীতের সঙ্গে তার বর্তমানকে অচ্ছেদ্য রূপে গেঁথে রেখেছে। এই রূপেই রামায়ণ কাব্যখানি ভারতবর্ষের যথার্থ ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। তথ্যগত ইতিহাস নয়, সত্যগত ইতিহাস, নিছক তথ্যগত হলে রামায়ণের প্রভাব কখনো এমন গম্ভীর হতে পারত না। কেননা তথ্য হচ্ছে বাইরের জিনিস, জাতির অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করবার ক্ষমতা তার নেই এবং আপনার কালের সীমাকে অতিক্রম করে নিত্যকালকে সে অধিকার করতে পারে না।” রামায়ণ বা রামকথা ভারতবর্ষের প্রাণস্বরূপ। ভারতের প্রায় সব ভাষায় বাল্মীকির রামায়ণকে নতুন করে লিখেছেন বহু প্রণম্য কবি। রাম পরমপুরুষত্বের কথা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেননি। তিনি সবসময় নিজেকে মানুষ বলেই পরিচয় করেছেন। বাল্মীকিও রামকে দেবতা বা ভগবান বলেননি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–”এই মহাকাব্যে রাম নিজেকে অবতার মনে করেননি, তাই তিনি মর্থ্য নায়ক। এখানে উচ্চ আধ্যাত্মিকতা অনুপস্থিত।”
অনেকে মনে করেন রামায়ণ কেবল কাহিনিমাত্র নয়, রামায়ণ একটি রূপক, প্রতীকী। কৃষি বিস্তার উপলক্ষ্যে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘাত হল রামায়ণ বর্ণিত রাম-রাবণের যুদ্ধের মূলকথা। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা হলেন কৃষি সভ্যতার প্রতিভূ। বিশ্বামিত্র ও জনক হলেন তাঁদের সহায়ক। রাবণ ও তাঁর স্বর্ণলঙ্কা হল শিল্প সভ্যতার প্রতীক। দক্ষিণ ভারত থেকে শিল্প সভ্যতার প্রাধান্য হ্রাস করে কৃষি সভ্যতার বিস্তার করতে গিয়ে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। পরিণামে বিজয়ী আর্যরা দক্ষিণ ভারতে কৃষিনির্ভর নব সভ্যতার প্রসার করে। প্রাবন্ধিক প্রবোধচন্দ্র সেন রামায়ণের রূপকাৰ্থ নির্ণয় করে লিখেছেন–আর্যরা প্রথমে পূর্ব ভারতে ও পরে দক্ষিণ ভারতে অনার্য শক্তিকে প্রতিহত করে কৃষিনির্ভর নব সভ্যতার বিস্তার করেন।
আবার অনেকে মনে করেন–রাম, লক্ষ্মণ, জনক, রাবণ প্রভৃতি চরিত্রগুলি আসলে কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিবিশেষ নয়, সত্তা মাত্র। রামচন্দ্র মানে ক্রীড়াকারী পুঁজি। রাবণ মানে যে শাসক রব করে, অর্থাৎ প্রজাদের জন্য অনেককিছু করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু বাস্তবে করে দেয় না। রামায়ণে সেই শাসক পরাজিত হয় এবং দেশে লক্ষ্মীপুঁজির বিকাশ ঘটে। বৈদিক ভারতের বৌদ্ধ ভারতে উত্তরণের সঙ্গে রামায়ণের কাহিনির মিল রয়েছে। বৌদ্ধযুগেও পুঁজির বিকাশ ঘটে এবং বৈদিক যুগের অবসান ঘটে। পুরোহিত শ্রেষঠ রাবণকে বৈদিক যুগের প্রতিভু বলে বিবেচনা করা যায়। রাম তার শাসনের অবসান ঘটিয়ে রামরাজত্ব গড়ে তুলেন। রামরাজত্ব। বলতে যোড়শ মহাজনপদকে বুঝেছেন। রামায়ণের লঙ্কা আসলে শ্রীলঙ্কা দেশ নয় বরং তা ভারতের শাসনকেন্দ্রের প্রতীক যা জনসমুদ্রের মধ্যে দ্বীপ রূপে প্রতিষ্ঠিত থাকে। রামায়ণের হনুমান আসলে দক্ষ পণ্ডিতদের প্রতীক, যারা বৌদ্ধবিপ্লবে সহায়তা করেছিলেন। তার লেজটিকে সেক্ষেত্রে ডিগ্রির লেজ বলে বুঝে নিতে হবে। আর জনক মানে যিনি জন (কৃষিশ্রমিক) করে পাইকারি হারে কৃষিকার্য শুরু করেছিলেন। প্রসঙ্গত, যৌথ সমাজে একজন মানুষ আর একজন মানুষকে জন করে খাটাবে এমন ব্যাপারটি অকল্পনীয়। সীতা আসলে জনকের কৃষি মজুরদেরই প্রতিভু। ওরা অন্ন উৎপাদন করে বলে ওরাই লক্ষ্মী। রামের সঙ্গে ওদের বিবাহ মানে কাজের চুক্তি বলে বুঝতে হবে।
পণ্ডিত শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র মনে করেন–“রামায়ণের কাহিনি আসলে ভারতের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের কথা। রামায়ণে আছে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা, মৌলবাদী প্রাচীন শাসককে তার ক্ষমতার কেন্দ্র (লঙ্কা) থেকে বের করে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার কাহিনি। এখানে রামরাজত্ব মানে বড়ো রাজত্ব বুঝতে হবে যে রাজত্বে লক্ষ্মীপুঁজির বিকাশ হয়েছিল এবং প্রজারা আরামে ছিল। লঙ্কা মানে শ্রীলঙ্কা দেশ নয় বরং রাক্ষসের রমণস্থান’ (রাক্ষস মানে দুষ্ট শাসক/ যে জনগণের সম্পদ রক্ষা করার নামে ভক্ষণ করে) তথা দেশের তৎকালীন শাসনকেন্দ্র। নিম্নবর্ণের মানুষ যেমন চণ্ডাল, শবর প্রভৃতিরাও রামরাজত্বে সম্মান পেয়েছিল। বাল্মীকিরা ছিলেন এই পরিবর্তনের হোতা। সবাই জানেন কয়েক বছর মাত্র আগে বাঙালি কবি ও বিদ্বজনেরাও শ্লোগান তুলেছিলেন ‘পরিবর্তন চাই’। তারপর আমাদের রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছিল। তেমনিভাবে বাল্মীকিরা রামায়ণ রচনা করার পর এই দেশে রামরাজত্ব এসেছিল বলে ভাবা যায়। কবিরা শুধু বসে বসে কবিতা লেখেন না, তাঁরা যে সমাজপরিবর্তনের কারিগর হতে পারেন সে কথা বলাই বাহুল্য। বাল্মীকিরা রামায়ণ লিখে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের অবসান ঘোষণা করেন। তারপর আসে বৌদ্ধযুগ। বৌদ্ধযুগে বর্ণভেদের তীব্রতা হ্রাস পায়। রামচন্দ্রকে আমরা চণ্ডালের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এবং তার বাড়ি গিয়ে খাবার খেতে দেখি। নিম্নবর্ণের শবর প্রভৃতিদেরও তিনি বন্ধুরূপে চিত্রিত। শম্বুক হত্যা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং কেবলমাত্র তাই দিয়ে রামচন্দ্রের বিচার করা চলে না। হতে পারে এই ঘটনা রামায়ণে প্রক্ষিপ্ত অথবা বেদবাদীদের চাপে এই কাহিনি রামায়ণে ঢুকানো হয়েছিল।”
এক রামায়ণ, অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক অভিমুখ। যদিও খুব কম সংখ্যক মানুষ বাল্মীকির রামায়ণ পাঠ করেছেন। বেশিরভাগ ভাগ মানুষ অতিরঞ্জিত আঞ্চলিক ভাষার রামায়ণ পাঠ করে রাম ও রামায়ণ বিষয়ে জ্ঞানধারণ করেন। তবে একটা বড়ো অংশের মানুষ রামায়ণ পাঠ করা তো দূরের কথা, রামায়ণ ছুঁয়ে দেখারও উৎসাহ বোধ করেননি। এরকম মিশ্র ভারতীয়দের কাছে রাম নানারূপে বর্ণিত হয়ে আছে। আঞ্চলিক রামায়ণগুলিতে যতই অতিরঞ্জিত থাক না-কেন, ভারতবাসীর কাছে রামায়ণ চিরনতুন। কোনোদিন পুরোনো হয়নি, হয় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রামায়ণ’ নিবন্ধে কী লিখেছেন, দেখা যাক–“দেবতার অবতারলীলা লইয়াই যে এ কাব্য রচিত তাহাও নহে। কবি বাল্মীকির কাছে রাম অবতার ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেন–পণ্ডিতেরা ইহার প্রমাণ করিবেন। এই ভূমিকায় পাণ্ডিত্যের অবকাশ নাই; এখানে এইটুকু সংক্ষেপে বলিতেছি যে, কবি যদি রামায়ণে নরচরিত্র বর্ণনা না করিয়া দেবচরিত্র বর্ণনা করিতেন তবে তাহাতে রামায়ণের গৌরব হ্রাস হইত, সুতরাং তাহা কাব্যাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হইত। মানুষ বলিয়াই রামচরিত্র মহিমান্বিত।”
তিনি মানুষ হোক কিংবা দেবতা, অথবা অবতার হোক–আধুনিক ভারতবর্ষে তাঁর রাজত্বকাল ফিরে চায় দেশের একটা অংশ, একটা রাজনৈতিক দল। রাম-রাজত্ব’ শব্দযুগল আমরা প্রথম শুনতে পেয়েছিলাম গান্ধিজির মুখে, বোধ হয়। ব্রিটিশ-মুক্ত ভারতবর্ষে নাকি রাম-রাজত্ব চলবে। কিন্তু কী সেই রাম-রাজত্ব? কেমন সেই রাম-রাজত্ব? রাম-রাজত্বে কী এমন বৈশিষ্ট্য আছে, যা নেতা-নেত্রীরা বারবার স্বপ্ন দেখায়, সাধারণ মানুষ বারবার স্বপ্ন দেখে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যে হিন্দুর ঘরে বাল্মীকির রামায়ণ’ আছে তাঁরা পাতা উলটাতে পারেন। আমিও উলটাচ্ছি আসুন। আমি এখন বালকাণ্ডমের (অনেকের মতে এই কাণ্ডটি বাল্মীকি রচনা করেননি, এই কাণ্ডটি উত্তরকাণ্ডের মতোই প্রক্ষিপ্ত) প্রথম সর্গে আছি। কী উল্লেখ আছে? আসুন মহর্ষি নারদের বয়ানটি বাংলা তর্জমায় পড়ি।
নারদের মুখে রামচন্দ্রের শাসিত রাজ্য অযোধ্যার এক মনোরম সুখসমৃদ্ধির ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। দেবর্ষি নারদ বাল্মীকিকে বলছেন, “রাম-বিরহে এতকাল প্রজারা দুর্বিষহ মনঃকষ্ট ভোগ করেছিল। এখন রাম অযোধ্যার সিংহাসনে বসেছেন। তাঁর আদর্শ সুশাসনে প্রজাদের সুখসমৃদ্ধির সীমা থাকবে না। প্রথম তাদের মনের কষ্ট দূর হওয়ায় প্রজারা আদিমুক্ত হল। শ্রীরামের রাজত্বে আধ্যাত্মিক আধিদৈবিক এবং আধিভৌতিক সন্তাপ থেকে মুক্ত হবে অযোধ্যার নগরবাসী। নীরোগ দেহে তারা রামকে রাজা হতে দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট, আনন্দে, রোমাঞ্চে অত্যুচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ হল। কারণ রাম প্রজাপালনে সদা ব্রতী, সর্বজনরক্ষক। তাঁর সুশাসনে সকল প্রজা ধনসম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে ক্ষোভমুক্ত, আনন্দিত, সন্তুষ্ট। কোনো প্রজাকেই দারিদ্র্যের জ্বালা ভোগ করবে হবে না। রামের সতর্ক দৃষ্টির ফলে প্রজারা সকলে নিজের নিজের কর্মে লিপ্ত থাকবে। তাদের অপুষ্টিজনিত রোগ কোনোদিন থাকবে না। শরীর নীরোগ থাকার সুস্থদেহে তারা সুন্দরভাবে ধর্মাচরণ করতে পারবে। দুর্ভিক্ষের ভয় না-থাকার সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ রাম-রাজত্বে আকালের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। পিতৃহৃদয়ের আকুলতা নিয়ে তিনি প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকবেন। ফলে সকল প্রজা শারীরিক ও মানসিক সর্বপ্রকার ব্যাধিমুক্ত, নীরোগ, সুস্থ জীবনযাপন করবে। চারদিকে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হবে।”
এখানেই শেষ নয়, রাম-রাজত্বে কখনও অকালমৃত্যু ঘটবে না। কোথাও কোনো স্থানে পিতা তাঁর পুত্রের মৃত্যু দেখে দুঃখকষ্ট পাবেন না। অর্থাৎ রামশাসিত রাজ্যে কোথাও কারও পুত্রশোক থাকবে না। কারণ শ্রীরামচন্দ্র হলেন নিষ্পাপ মহাপুণ্যবান রাজা। সব রমণী স্বামীর প্রতি একান্ত অনুরক্ত থাকবেন। পতিই তাঁদের ধ্যান ও জ্ঞান হবে। তাঁরা ব্যভিচারিণী হয়ে কখনও পরপুরুষে আসক্ত হবেন না। তাঁরা কখনও বৈধব্য যন্ত্রণা ভোগ করবে না। সকল নারী রাম-রাজত্বে সতীসাধ্বী পতিব্রতা হয়ে দিনযাপন করবেন। “ন পুত্রমরণং কোচিৎ দ্রক্ষ্যন্তি পুরুষা ক্কচিৎ।/নাশ্চাবিধবা নিত্যং ভবিষ্যন্তি পতিব্রতাঃ তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯১)। রামশাসিত রাজ্য আধিদৈবিক সন্তাপমুক্ত করতে হবে। তাঁর রাজ্য অগ্নি, বায়ু এবং জলে কখনও বিপন্ন হবে না। কোনো প্রাণী বা কোনো ব্যক্তি অগ্ন্যুৎপাত, বন্যার জলোচ্ছাসে অথবা প্রবল ঝঞ্ঝায় কখনও পীড়িত হবে না। “ন চাগ্নিজন ভয়ং কিঞ্চিন্নাসু মজ্জন্তি জন্তবঃ।/ন বাতজং ভয়ং কিঞ্চিন্নাপি জ্বরকৃতং তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯২)। রাজা, দস্যু, তস্কর, হিংস্র প্রাণী প্রভৃতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যের কোথাও কোনো প্রাণী অনাহারে কষ্ট পাবে না। কারও ক্ষুধা-তৃষ্ণার ভয় থাকবে না। দেশ, জনপদ, নগরগুলি ধনধান্যে এমনই সমৃদ্ধ থাকবে যে লোকে চুরি করার প্রয়োজনই বোধ করবে না। ফলে চোর বা তস্কর, ডাকাতের ভয় থাকবে না। “তন চাপি ক্ষুদভয়ং তত্র ন তস্করভয়ং তথা।/নগরাণি রাষ্ট্রাণি ধনধান্যযুতানি চ তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯৩)। ত্রিতাপমুক্ত সর্বসাধারণ পরিশুদ্ধ সত্যযুগের মতোই ত্রেতাযুগেও রাম-রাজত্বে চূড়ান্ত আনন্দে দিনযাপন করবে–“নিতং প্রমুদিতাঃ সর্বে যথা কৃতযুগে তথা”।
নারদের কথন কেবল কথার কথা, অলীক কল্পনা। ভেবে দেখুন, নারদ বলছেন–রামের রাজত্বে কোনো নারী বিধবা হন না, রামের রাজত্বে কোনো শিশুর মৃত্যু হয় না, কোনো মানুষের রোগশোক হয় না, মানুষ এহেন রাজত্বে প্রমসুখে গণ্ডায় গণ্ডায় পুত্র জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। রামরাজত্বে সবাই সহস্ৰজীবী। চোরডাকাত নেই। মানে জরামৃত্যুহীন এক কল্পনার রাজত্ব। আসলে বাস্তবে এমন কিছু ঘটেইনি। ঘটতে পারে না। জন্ম-মৃত্যু জীবনের ধর্ম, নিয়ম। এ নিয়ম কখনোই স্তব্ধ হতে পারে না, হয়ওনি। যৌক্তিকও নয়, প্রলাপমাত্র। মূলত রামরাজত্বে প্রজারা কেমন ছিলেন, সে ব্যাপারে রামায়ণে কোনো যথার্থ চিত্র মেলে না। প্রকৃত ঘটনা, রাম-লক্ষ্মণ-ভরত প্রমুখ সরযূ নদীতে আত্মঘাতী হলে অযোধ্যা জনশূন্য হয়ে পড়েছিল।
এরপর কত যুগ কেটে গেল। রামায়ণের যুগের পর মহাভারতের যুগ, বৌদ্ধযুগ, দীর্ঘ ৮০০ বছরের মুসলিম যুগ, প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ যুগ সবই তো অতীত হয়ে গেল, রাম-রাজত্ব কোথায় গেল! নাকি সবটাই রাম রাজত্বের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি, এখনও সেই রাম-রাজত্বটাই চলছে। রামায়ণের রাজ্যটা ঠিক কেমন তার একটা রূপরেখা তো দেওয়া গেল। রামায়ণে ‘রাজত্ব’ বলতে যা পাই, তা হল–(১) দশরথের রাজত্বের বর্ণনায়, (২) গ্রন্থখানি লেখার আগে নারদ কর্তৃক বাল্মিকীকে রামচন্দ্রের ব্যাপারে যেটুকু রূপরেখা দিয়েছিলেন। বাল্মীকির “রামায়ণম”- এ মহর্ষি নারদ বলছেন–“দশবর্ষসহস্রাণি দশবর্ষশতানি চ।/রামো রাজ্যমুপাসিত্বা ব্রহ্মলোকং গমিষ্যতি তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯৭)। অর্থাৎ, রামচন্দ্র এগারো হাজার বছর ধর্মবোধের সঙ্গে রাজত্ব করে ব্রহ্মলোকে প্রয়াণ করবেন। তাহলে হিসাবমতো রামচন্দ্র এখনও রাজত্ব চালাচ্ছেন। এ কেমন রাম-রাজত্ব চলছে? অবশ্য ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পূর্বেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। এরপর ব্রিটিশমুক্ত স্বাধীন ভারতে এ পর্যন্ত ১৮টি শাসক বা প্রধানমন্ত্রীর আবির্ভাব লক্ষ করেছি। রাম বা রামের মতো কোনো শাসককে পেলুম কী! কেমন হবে রাম-রাজত্বের আধুনিক রূপরেখা?
‘রামরাজ্য’ শব্দটির মধ্যে বর্তমানে অনেকে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পেলেও প্রকৃতপক্ষে শান্তিময় পৃথিবীর সমার্থক হিসাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র এ শব্দটি বাগধারা হিসাবে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। তবে এ শব্দটি সবচেয়ে বেশি শুনতে পাওয়া যায় ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতায় এমন কি নির্বাচনী ইশতেহারেও। তারা অনেকেই একবিংশ শতাব্দীতে ভারতকে রামরাজ্যে পরিণত করতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। দেন না কেবল কেমন হবে রাম-রাজত্ব, তার ধারণা। সনাতন ধর্মবিশ্বাসমতে কলিযুগের শেষে আরেকবার সত্যযুগের আবির্ভাব হওয়ার কথা। অনেক ভারতীয় জ্যোতিষ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, সে সময় অত্যাসন্ন। সে যাই হোক, মোদ্দা কথা হচ্ছে ১০ হাজার বছর পরও রামরাজত্বের মতো একটি শান্তিময় রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের কাছে অতি আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। শান্তিময় রাষ্ট্র’ মানে তো জনশূন্য অযোধ্যা, চলতি কথায় যাকে ‘শ্মশান-শান্তি’। বাল্মীকিও সেই সত্য আড়াল করেননি।
মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, দেশ স্বাধীন হলে ভারতে ‘রামরাজত্ব’ ফিরে আসবে। যখনই তিনি তার স্বপ্নের আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতেন, তিনি রামরাজ্যের কথা বলতেন। রামরাজ্যের শ্লোগানের মাধ্যমে গান্ধীজি বোঝাতে চেয়েছিলেন এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থাকবে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকবে, মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না, কেউ কোনো কাজের কৃতিত্ব দাবি করবে না, সর্বত্র আত্মত্যাগের চর্চা হবে। রামরাজ্যের যেন কোনো অপব্যাখ্যা না-করতে পারে বা একে কেবল হিন্দু সাম্প্রদায়িক শ্লোগান হিসাবে মনে না করা হয়, এজন্য গান্ধীজি নিজেই এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন তার লেখায় এবং বক্তব্যে–বলাই বাহুল্য, সোনার পাথরবাটি। গান্ধীজি এও বলেছিলেন, “কেউ যেন ভুলবশত মনে না-করেন যে রামরাজ্য মানে হিন্দুর শাসন। আমার কাছে রাম হচ্ছে আল্লাহ বা ঈশ্বরের অপর নাম। আমি প্রকৃতপক্ষে চাই খোদার শাসন, যা পৃথিবীর বুকে আল্লাহর রাজত্বেরই সমার্থক।”
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রতিটি জনসভায় রাম মন্দিরের কথা সযত্নে এড়িয়ে গেলেও বারাণসীতে রামরাজ্যের কথা শোনা গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গলায়। উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি ‘রামরাজ্য’ প্রসঙ্গ তোলেন। তাঁর সাফ কথা, মানুষই একদিন এই রাজ্যে ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করবে। তাঁর বক্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল। ‘রামরাজ্য’ বানাতে চান উমা ভারতীও। তুলসীদাসের রামচরিতমানসে রামচন্দ্রের যে ছবি আঁকা হয়েছে, সেই রামচন্দ্রই উত্তরপ্রদেশ ছাড়িয়ে সমগ্র গো-বলয়ে চরম জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তুলসীদাসই তাঁর রামায়ণে রামরাজ্যের মহিমা কীর্তন করে অনেক চৌপদী গেয়েছেন। ধনিক-বণিকদের হিতার্থে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে রামরাজ্য আখ্যা দিয়ে করপাত্রী মহারাজও খুব প্রচার করেছেন। করপাত্রী মহারাজের রামরাজ্য ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত।
রাহুল সাংকৃত্যায়নের রামরাজ্যের ধারণা সামান্য উল্লেখ করি–“সেই ধর্ম অনুসারে যদি কোনো শূদ্র বেদ শুনে ফেলে, তাহলে তার কানে গলন্ত সিসা ঢেলে দিতে হবে। আর কেউ যদি বেদ উচ্চারণ করে, তাহলে সেই বেদ উচ্চারণকারী শূদ্রের জিভ কেটে ফেলতে হবে।” প্রাচীন বস্তুবাদীরা বলতেন–“ভণ্ড, ধূর্ত এবং নিশাচরেরাই কেল তিন বেদের কর্তৃত্ব মেনে চলে। (ত্রয়ো বেদস্য কর্তারো ভণ্ড-ধূর্ত-নিশাচরাঃ)” করপাত্র মহারাজের রামরাজ্য এরকম–“রামরাজ্যবাদী জড় এবং চেতন উভয়কেই আধ্যাত্মিকভাবে সমন্বিত করে। তেমনভাবেই রাজতন্ত্র প্রজাতন্ত্র, ব্যক্তি-সমষ্টি, বিত্ত-বিভেদ এবং শ্রম-বিভেদেরও সমন্বয় সাধন করে। এভাবে অধ্যাত্মবাদের উপরে প্রতিষ্ঠিত, আরম্ভ থেকে অন্ত পর্যন্ত ধর্ম নিয়ন্ত্রিত, ধর্ম সাপেক্ষ, পক্ষপাতহীন শাসনতন্ত্রই সর্বোচ্চ মানব কল্যাণকারী এবং এই ব্যবস্থাই প্রগতির চরমতম সীমা৷”
আবার রাহল সাংকৃত্যায়নের কাছে যাই–“দক্ষিণ ভারত প্রাচীন রামরাজ্যের বড়ো সমর্থক। ছুৎমার্গের বিচারে তারা উত্তর ভারতের লোকের কান কাটে। বড়ো বড়ো বৈদান্তিক, মীমাংসক, বৈদিক প্রভৃতির জন্ম হয়েছে এখানকার ব্রাহ্মণকুলে। আজও এখানে লোকে হাজারে হাজারে ভগিনী-কন্যাকে অর্থাৎ ভাগ্নীকে বিয়ে করে, তাদের গর্ভে সন্তানের জন্ম দেয় এবং ধর্ম, দেশাচার পরম্পরা এই প্রথাকে সমর্থন করে। যদি বিশ্বাস না-হয়, মহারাজ স্বয়ং সেখানে গিয়ে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করে আসতে পারেন।”
কিন্তু সে না-হয় হল একটা রামরাজ্য, কিন্তু রাম ছাড়া রামরাজ্য কীভাবে সম্ভব! রামচন্দ্রকে কোথায় পাওয়া যাবে? আচ্ছা, স্বয়ং রামচন্দ্রই যদি আসেন ভারতের শাসনকার্যের দায়িত্ব নিয়ে, তবে কেমন হবে সেই শাসন? রাহুল সাংকৃত্যায়ন মনে করিয়ে দেন–“আজকাল হাজার নয় লাখো লাখো তথাকথিত শূদ্র তপস্যা করে ব্রাহ্মণের কান কাটছে, বলার কেউ নেই। এক শম্বুকের তপস্যায় ব্রাহ্মণের পুত্রের মৃত্যু হল। রাজা রামের কাছে অভিযোগ গেল। রাজা রাম কিন্তু শম্বুককে তপস্যায় বিরত হতে বললেন না, তিনি শম্বুকের মুণ্ডুটাকেই ধড় থেকে আলাদা করে দিলেন। করপাত্রী মহারাজের আকাঙিক্ষত রামরাজ্যে এরকম রাজারই প্রয়োজন।”
না, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো আমি নৈরাশ্যবাদী নয়। রামরাজত্বকে শুধুমাত্র শূদ্ৰহত্যা দিয়ে বিচার করলেই হবে না–সত্যনিষ্ঠা, পাতিব্রতা, পত্নীপ্রেম, সৌভ্রাত্র, প্রভুভক্তি, আশ্রিতরক্ষা, প্রজানুকূল্য, পিতৃভক্তি, ভরতের ভ্ৰাতৃভক্তি, দাদার প্রতি আনুগত্য, বিমাতা কৈকেয়ীর সপত্নী পুত্রের প্রতি আচরণ, সন্তান স্নেহকাতরা জননী কৌশল্যার মাতৃহৃদয়ের বেদনা, রামের প্রতি দশরথের অন্ধস্নেহ, স্ত্রীর জন্য হাহাকার এসবও নিশ্চয় ভারতের নাগরিকগণ আয়ত্ত করবেন। আর সাম্রাজ্যবাদীর আগ্রাসন তো আমাদের শাসকদের রক্তেই আছে। অবশ্যই সেই ত্রেতা যুগ ফিরে আসবে কী, যে যুগে মূর্তিপুজোর প্রচলন ছিল না? ভারতীয়রা নিশ্চয় আর মূর্তিপুজো করবেন না। মিসাইল, গ্রেনেড, বোফর্স কামান, অ্যাটম বোমা ছেড়ে নিশ্চয়ই তীর-ধনুকে ফিরে যাবেন। বলা, অতিবলা, ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণুচক্র, ইন্দ্রচক্র, ব্রহ্মশির, ঐষিক, ব্রহ্মাস্ত্র (এই নামে অবশ্য আধুনিক ভারতে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হয়েছে।), ধর্মপাশ, কালপাশ, বরুণ পাশ, শুষ্ক অশনি, আর্দ্র অশনি, পৈনাক, নারায়ণ, শিখর, বায়ব্য হয়শির, ক্রৌঞ্জ, কঙ্কাল, মুষল, কপাল, শক্তি, খড়গ, গদা, শূল, বজ্র, কিঙ্কিণী, নন্দন, মোহন, প্রস্বাপন, প্রশমণ, বর্ষণ, শোষণ, সন্তাপন, বিলাপন, মাদন, মানব, তামস, সৌমন, সংবর্ত–এসব অস্ত্র কোথায় পাবেন এযুগের রামচন্দ্র। নিশ্চয় দেবতারাই দেবেন!
অনেকে বলেন সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। কীভাবে ধ্বংস হয়েছে সে ব্যাপারে বহুমত। ধ্বংস হয়েছে, না পরিত্যক্ত হয়েছে? পরিত্যক্ত কেন হল? এমন হতে পারে, সেচব্যবস্থা ধ্বংসের পর কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেতে শুরু করে এবং নদীগুলির গতিপথ পরিবর্তনসহ কিছু নদী ও খালের মৃত্যু এ অঞ্চলে ক্রমাগত মরুকরণ শুরু হয় যা কৃষি উৎপাদনকে চরমভাবে ব্যাহত করে। মনে রাখতে হবে ওই সমসাময়িককালেই সরস্বতী নদী ভ্যানিশ হয়েছিল। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের সিমুর পর্বতে। এখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতে অবতরণ করেছিল। যে প্রস্রবন থেকে এই নদীর উৎপত্তি হয়েছিল তা ছিল প্লক্ষাবৃক্ষের কাছে, তাই একে বলা হত প্লাবতরণ। সে যুগে গঙ্গা-যমুনা ছিল অপ্রধান নদী। সরস্বতীই ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী। সেই নদী মহাভারতের যুগেই রাজপুতনার মরূভূমিতে অদৃশ্য হয়ে গেলেও কয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এই স্রোতধারা চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ও নাগোদ্ভেদ নামে পরিচিত। রাজস্থানের মরূভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের কাছে সরস্বতী শুষ্ক হয়ে হারিয়ে যায়। ভারতের বর্তমান উদয়পুর, মেওয়াড় ও রাজপুতনার পশ্চিম প্রান্তে মরূ অঞ্চলে সিরসা অতিক্রম করে ভুটানের মরূভূমিতে সরস্বতীর বিলোপ স্থানই বিনশন নাম প্রাপ্ত হন।
অতএব নদীমৃত্যুই সভ্যতা পরিত্যাগের কারণ। কারণ নদীঘিরেই মানুষের সভ্যতা। সভ্যতার কারণেই নদীকে কাটিয়ে আনা হয়েছিল উত্তর থেকে দক্ষিণে, যা ভাগিরথী বা গঙ্গা বা হুগলি নদী বলে পরিচিত। নদীকে কেন্দ্র করে নগর গড়ে ওঠে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। উৎপাদন হ্রাসের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যচাহিদা খুব চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এরকম অবস্থায় নগরগুলি পরিত্যাগ করে বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। শুধু সিন্ধুনগরই নয়, নানা কারণে এরকম বহু নগরই পরিত্যক্ত হয়ে আছে, আজও। দু-একটা নমুনা দিই–(১) জাপানের গানাকানজিমা দ্বীপ। এই দ্বীপের আসল নাম হাসিমা দ্বীপ। কিন্তু এই দ্বীপকে গানাকানজিমা নামে ডাকা হয় যার অর্থ হল ‘রণতরী দ্বীপ’। বিশ্বের ৫০৫ টি জনমানবহীন দ্বীপের মধ্য জাপানের গানাকানজিমা দ্বীপ অন্যতম। এটি নাগাসাকি থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৮১০ সালে প্রথম এই দ্বীপে কয়লা পাওয়া যায় এবং পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে গানাকানজিমা দ্বীপ হয়ে উঠে বিশ্বের সব চেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপ। ১৯৫৯ সালে ১৬ একর আয়তনের দ্বীপটির জনসংখ্যা পৌঁছোয় ৫৩০০ জনে। তবে ১৯৭৪ সালের দিকে কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম কমতে থাকে এবং মানুষ ধীরে ধীরে এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে থাকে এবং দ্বীপটি এক সময় জনমানব শূন্য হয়ে পড়ে। দ্বীপটি এখনও পরিত্যক্ত। (২) নামিবিয়ার কোলমানসকোপ ঘোস্ট টাউন। এই শহর দক্ষিণ নামিবিয়ার লুদেরিটজ সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৯০৮ সালে এখানে হিরে পাওয়া যায়। সেই কারণে মাত্র দুই বছরের মধ্যে এই গ্রামীণ এলাকাটি জাঁকজমকপূর্ণ দৃষ্টান্তমূলক জার্মান শহরে রূপান্তরিত হয়। গ্রাম থেকে শহর–অতি দ্রুত এমন একটা শহর, যেখানে ছিল ক্যাসিনো, স্কুল, হাসপাতাল, স্টেডিয়াম, বিলাসবহুল আবাসিক ভবন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সকলে এই হিরের উৎস সম্পর্কে উচ্চ সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু আশা করেছিল। কিন্তু হায়! অতি দ্রুতই হিরের উৎস হ্রাস পেতে থাকে এবং মানুষ এই শহর ত্যাগ করে এদিক-ওদিক চলে যেতে শুরু করে। জল আর বালুঝড়ের সমস্যার জন্যও মানুষ এই শহর পরিত্যাগ করে। ১৯৫৪ সালের মধ্যে শহরটি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। (৩) ইউক্রেনের রাইপিয়াট। রাইপিয়াট হল উত্তর ইউক্রেনের একটি পরিত্যক্ত শহর, যাকে বলা হয় ‘জোন অব এলিয়েন’। পরিত্যক্ত শহরটি চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক প্ল্যান্টের দুর্যোগের পর শহরটি পরিত্যক্ত হয়। এই শহরটিকে দেখলে পারমাণবিক শক্তির ভয়ংকর ক্ষমতার চিত্রই ফুটে ওঠে।
ঋগ্বেদের বহু ঋকেই যে যুদ্ধের বিবরণ পাই সে যুদ্ধ খুব বড়ো ধরনের যুদ্ধ যে নয় তা সহজেই বোঝা যায়। অনেক ঐতিহাসিকগণ এগুলিকে যুদ্ধ না-বলে সংঘর্ষ বলতেই পছন্দ করেন। তথাকথিত ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ পরিত্যক্ত সভ্যতাটিতে তেমন কোনো যুদ্ধাস্ত্র পাওয়া যায়নি। সিন্ধু সভ্যতাটি একটি সাম্যবাদী সভ্যতা ছিল যেখানে যুদ্ধ বিগ্রহবিমুখ একটি সভ্যতাই বিকাশ লাভ করেছিল। পূর্বের ইতিহাসবিদরা অনেকে আবার এই যুদ্ধকে আর্য এবং অনার্যদের যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই যুদ্ধকে বৈদিক ও অবৈদিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধও বলা যেতে পারে। এই যুদ্ধে বৈদিক সম্প্রদায়রা বা আর্যদেবতারাই যে জয়যুক্ত হন, তা বেদ-রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণগুলি পাঠ করলেই অনুধাবন হয়। এর জন্য পণ্ডিত হতে হয় না। যাঁরা চোখ বন্ধ করে থাকতে ভালোবাসেন তাঁরা অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছু দেখবেন এটা আশা করা বিজ্ঞানভিত্তিক হয় না। যাই হোক, সম্ভবত অবৈদিক সম্প্রদায়ের যে অংশ বৈদিক সম্প্রদায়ের ধর্মসংস্কারকে মেনে নিতে পারেনি তাঁরাই দেশত্যাগ করেছিল এবং তাঁদেরই একাংশ ইরানে আবাস গড়ে।
ভারতে উপমহাদেশে দুটি মহাগ্রন্থে দুটি বিশাল মহাযুদ্ধের কথা উল্লেখ হয়েছে। একটি রাম-রাবণের ‘লঙ্কাযুদ্ধ’ বলে খ্যাত, অন্যটি কৌরব-পাণ্ডবের ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ’ বলে খ্যাত। রাম-রাবণের ‘লঙ্কাযুদ্ধ’ তো দুটি যুযুধান গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, মহাভারতের যুদ্ধ রীতিমতো বিশ্বযুদ্ধ–এ যুদ্ধেও ছিল মিত্রপক্ষ এবং শত্রুপক্ষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমরা যেভাবে মিত্রশক্তি এবং অক্ষশক্তিদের পাই। সত্যিই কি রামায়ণেও আমরা রাম-রাবণের যুদ্ধটি বিশাল-বৃহৎ ছিল? এ যুদ্ধ রাম-বিরাধের দণ্ডকারণ্য যুদ্ধ হয়ে কাহিনি থেমে যাওয়ার একটা সুযোগ ছিল, কিন্তু তা হয়নি।
ছোটোখাটো যে-কোনো যুদ্ধই কালে কালে পরিবর্তিত হতে হতে শেষপর্যন্ত রামায়ণ নামক এক বিশাল মহাকাব্যে লিপিবদ্ধ হয়। এরকম কোনো ছোটখাট ঘটনাই মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তিত হতে হতে মিথে রূপান্তরিত হয়। কবিরা সবসময়ই কোনো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে রূপকের আশ্রয় নেন। কেবল প্রাচীনকালেই নয়, সবকালেই। কালের পরিবর্তনে তাঁদের মস্তিষ্কপ্রসূত রূপক আর রূপকথাগুলিই বাস্তবতার দাবি করতে থাকে। কবির কল্পনায় বিকশিত চরিত্র ও রূপকের সঙ্গে মিথের মিশ্রণ এবং আমাদের সমাজের ধর্মান্ধতা এ দুটি গ্রন্থকে আজ দিয়েছে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা। তবুও মিথকে সত্য না-ভেবে একে বাস্তবতার আলোকে ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে বিচার করা উচিত। নিছক গল্পকথা ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে। তবে মেনে নেওয়ার কাজ যতটা আয়েশে করা সম্ভব, মিথ ভেঙে সত্য উঘাটন করার কাজটা তত সহজ কাজ নয়। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ সমুদায় হল রাজা ও রাজত্ব, রাজ্যজয় ও গণহত্যার ইতিবৃত্ত। সেভাবেই পাঠগ্রহণ নিরাপদ। রামায়ণের গর্ভ থেকে রূপকথাগুলিকে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারলেই প্রাচীন ইতিবৃত্ত হাতের মুঠোয় চলে আসবে।
রামায়ণকে অলৌকিক বা বানোয়াট ভেবে দূরে সরিয়ে না-দিয়ে এ কাহিনিকে ভারত উপমহাদেশের ভূমিপুত্রদের বিরুদ্ধে বহিরাগত আর্যজাতির আগ্রাসনের ইতিহাস, অনার্যদের বিরুদ্ধে আর্য কর্তৃক সন্ত্রাসের রক্তাক্ত ইতিহাস হিসাবে দেখলে সব বিতর্কের অবসান ঘটা সম্ভব। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ নয়, এই আগ্রাসনের ইতিহাস সন্ত্রাসের ইতিহাস, যে ইতিহাসে দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। রামায়ণ হল অনার্যদের রক্তে লেখা আর্য তথা ব্রাহ্মণদের ইতিহাস। সেই ইতিহাস ভক্তিরসে উপস্থাপন করলেও ইতিহাসটা মিথ্যা হয়ে যায় না।