১৫. রামায়ণে অস্ত্র এবং শস্ত্র

রামায়ণে অস্ত্র এবং শস্ত্র

বশিষ্ঠের ‘ধনুর্বেদসংহিতা’ গ্রন্থের ২০৭ টি শ্লোকে প্রাচীনকালের যুদ্ধ সংক্রান্ত নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে। ‘ধনুর্বেদ’ শব্দটি প্রাথমিকভাবে ধনুর্বিজ্ঞান বোঝালেও ব্যাপক অর্থে সমস্ত আয়ুধবিদ্যাকে বোঝায়। সেখানে বলা হয়েছে, ধনুর্বেদ শিক্ষার ব্যাপারে ব্রাহ্মণই হবেন শিক্ষাগুরু–“ধনুর্বেদগুরুবিঃ “। বশিষ্ঠ বলেছেন–ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যকে এই বিদ্যাকে শিখতে হবে এবং শূদ্র শিকারের জন্য এবং বিপদের সময় রাজ্যরক্ষার্থে শূদ্রও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। প্রাচীন ভারতে অস্ত্রবিদ্যায়ে উন্নত ছিল তার প্রমাণ এই গ্রন্থ। আধুনিক বিচারে বশিষ্ঠের ‘ধনুর্বেদসংহিতা’ তেমন উন্নতমানের না-হলেও, প্রাচীন ভারতে সমরবিদ্যা জানার ক্ষেত্রে এই গ্রন্থের গুরুত্বকে ছোটো করে দেখা যায় না। যাই হোক, সংস্কৃত ভাষায় রচিত এরকম বেশকিছু গ্রন্থে অস্ত্রশস্ত্র এবং অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তবে অস্ত্রশস্ত্র যত-না রাজরাজড়ার কাছে ছিল, তার চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি অস্ত্রশস্ত্র ছিল মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণদের কাছে। এঁদের কাছেই ছিল বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার। রাজরাজড়াদের প্রয়োজন হলে এঁরাই ভয়ানক ভয়ানক সব অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতেন।

রামায়ণে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড এবং যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। এইসব আয়ুধের নাম যেমন অর্থবহ, কার্যক্ষমতাও তেমনই ভয়ংকর। আয়ুধ বা যুদ্ধাস্ত্রগুলি নিয়ে এবার একটু খোঁজখবর নেওয়া যেতে পারে। অস্ত্র এবং শস্ত্র এক জিনিস নয়, সম্পূর্ণ পৃথক। অস্ত্র হল ঐশ্বরিক ক্ষমতা, দৈবিক শক্তির বলে যা প্রাপ্ত হত, যা কোনও দেবদেবী কৃপায় বরপ্রাপ্ত হত। এইসব হাতিয়ারের ক্ষমতা ছিল অসীম, শুধু বিপক্ষের মানুষজন কেন, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেও গুঁড়িয়ে দেওয়া যেত বলে গল্পেসল্প পড়েছি। দেবতাদের কৃপায়’ রামও অনেক অস্ত্রলাভ করেছিলেন। কিন্তু সমস্ত অস্ত্রই যে রাম তপস্যাবলে পেয়েছেন, এমন তথ্য কোথাও পাই না। অস্ত্রের জন্য বা অমরত্বের জন্য রামকে তপস্যা-টপস্যা করতে হয়নি। এমনিই সবাই অস্ত্রশস্ত্র গুছিয়ে দিয়েছেন, যেহেতু রাম ক্ষত্রিয়। প্রভাব যাঁর বেশি, তাবেদারদের সংখ্যাও তাঁদের বেশি। অতএব নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দান করেছেন মুনিঋষি, দেবদেবতারা। কিন্তু রাক্ষস-খোক্ষস, দৈত্যদানোদের দৈব অস্ত্রশস্ত্র কেউ এমনি এমনি দান করেননি, দিতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই সেইসব অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী হয়েছিলেন তাঁরা। যদিও অস্ত্রের প্রয়োজন এবং ব্যবহার রামকেই বেশি করতে হয়েছিল। কারণ সেই বিরাধ রাক্ষস থেকে রাবণ হত্যা পর্যন্ত প্রচুর হত্যা তাঁকে করতে হয়েছে। তা ছাড়া রামের প্রতিপক্ষরা ছিলেন অসমসাহসী, প্রবল শক্তিমান এবং যথার্থ বীর। এই দুই বীরকে পরাস্ত করতে গিয়ে অনেক সময়ই রাম এবং লক্ষ্মণ উভয়ই পরাস্ত ও বিপর্যস্ত হয়েছেন একাধিকবার। রামের এত ভয়ানক অস্ত্রশস্ত্র থাকা সত্ত্বেও বীরত্ব দ্বারা নয়, অবশেষে চালাকির দ্বারা প্রতিপক্ষ পরাস্ত করা সম্ভব হয়েছে। তদুপরি যুদ্ধক্ষেত্রে বহিঃশক্তি তথা আর্যদেবতাদের কৃপা তো রয়েছেই। শক্তি এবং দৈব অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও রামচন্দ্র কিছুতেই রাবণকে কবজা করতে পারেনি, তিনদিন তুমূল যুদ্ধের পরেই রাবণকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

অস্ত্র কেমন? রামের এরকমই একটা অস্ত্রের ব্যবহারের কথা বলি–একদিন রাম তপোবনে সীতার সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপে ব্যস্ত ছিলেন। কিছুক্ষণ পর রাম নিদ্রামগ্ন হলে সীতা রামের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসে থাকলেন। এক কাক, যা কিনা ছদ্মবেশী রাক্ষস! সীতার মাথা বারবার ঠুকরে দিচ্ছে। সীতার শরীরে আঘাত লাগলেও পাছে রামের ঘুম ভেঙে যায়, সেই কারণে তিনি আঘাত সহ্য করছেন। এরকম দাসী-বউই বোধহয় বেশিরভাগ পুরুষ পছন্দ করেন! যাই হোক, হঠাৎ সীতার মাথা থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং সেই রক্ত গড়িয়ে পড়ে রামের শরীরে। উষ্ণ রক্তের স্পর্শে রামের ঘুম ভেঙে গেল। রাম একমুঠো দূর্বা ঘাস ছিঁড়ে তাঁকে মন্ত্রপূত করে উপরের কাকটির দিকে ছুঁড়ে দিলেন। কাকটির মৃত্যু হল সেই দূর্বার প্রয়োগে, এটাও অস্ত্র বটে। এই অস্ত্র দেবতার কাছ থেকে বর হিসাবে পেয়েছিলেন, যা কিনা অ্যুৎ এবং অকিঞ্চিৎকর রাক্ষসকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই অস্ত্রের প্রয়োগ করতে হল! অবশ্য এ ইতিহস বাল্মীকি লেখেননি।

এবার শস্ত্রের কথায় আসি। শস্ত্র হল লোহা, কাঠ ইত্যাদি পদার্থ জাতীয়। যেমন গদা, ধনুক, তলোয়ার ইত্যাদি, যা দিয়ে সরাসরি আঘাত করা যায় বা হত্যা করা যায় অন্য একজন বা একাধিক ব্যক্তিকে। আধুনিক যুগের যেমন গাদার রাইফেল, একে-৪৭, কালাশনিকভ অ্যাসল্ট, রিভলভার, গ্রেনেড ইত্যাদি সবই শস্ত্র। কিন্তু প্রশ্ন হল, সে যুগের দৈবাস্ত্র কি এখনও কেউ পান তপস্যাবলে? দেবতারা কি বর দেন? পাওয়া যায় অভীষ্ট সিদ্ধির অস্ত্র? পাওয়া যায় বইকি। পুরাণ যুগে সবচেয়ে বেশি দৈবাস্ত্র ও অমরত্বের বর প্রদান করেছেন স্বয়ং অনার্য ‘দেবতা’ শিব। এরপর সেই তালিকায় আছেন যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র।

এ সময়ের শিবের ভূমিকা পালন করছেন আমেরিকা এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা। তাঁরা তাঁবেদার দেশগুলিকে ভয়ংকর ভয়ংকর সব অস্ত্রশস্ত্র প্রদান করছেন, সেইসব অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান হয়ে বিভিন্ন শক্তিশালী দেশ তুলনামূলক দুর্বল দেশের উপর আক্রমণ করছে এবং হত্যালীলা সম্পন্ন করছে। এইসব অস্ত্রশস্ত্র দেবতাদের অস্ত্রের চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি ধ্বংসকারী। এক লিটল বয়’ নামে নিউক্লীয় বোমার আঘাতেই হিরোসিমায় মৃত্যু হয়েছে ২ লাখ ৩৭ হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষ। নাগাসাকিতে মৃত্যু হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার নিরীহ সাধারণ মানুষ, অস্ত্রের নাম ‘ফ্যাট ম্যান’। এমন বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা দেবতাদেরও হয়নি। অতএব আজকের এই মানুষগুলো দেবতাদের চেয়েও ভয়ংকর এবং শক্তিশালী। দেবতারা অত্যাচারী শাসকদের হত্যা করত, মানুষ অসামরিক মানুষদের হত্যা করে। শুধু আমেরিকাই নয়–যুদ্ধাস্ত্র প্রদান করেন ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইটালি, জার্মান–এমনকি ভারতও। অস্ত্র প্রদানের বাজার তৈরি করার সাধনায় ব্রতী থাকেন এরা, সারা বছর। দেশে দেশে শত্রুতা আর যুদ্ধ জিইয়ে রাখেন তাঁরা। এদের ভয়ে সারা বিশ্ব থরথর করে কাঁপছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায়। যেমন পুরাণে ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ভয়ে সবাই থরথর করে কাঁপত। এখন আর অস্ত্র ও শস্ত্রের মধ্যে কোনো তফাত নেই।

অস্ত্রধারণ করেন যিনি তাঁকে বলা হয় অস্ত্রধারী। রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণকাহিনিতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার হতে দেখা যায়। এইসব অস্ত্রের নাম, ব্যবহারের রীতিনীতি, ফলাফল সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়। বিশ্বামিত্র রামের প্রতি তুষ্ট হয়ে যে অস্ত্রগুলি দিয়েছিলেন সেগুলি হল–বলা, অতিবলা, ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণুচক্র, ইন্দ্রচক্র, ব্রহ্মশির, ঐষিক, ব্রহ্মাস্ত্র, ধর্মপাশ, কালপাশ, বরুণ পাশ, শুষ্ক অশনি, আর্দ্র অশনি, পৈনাক, নারায়ণ, শিখর, বায়ব্য হয়শির, ক্রৌঞ্জ, কঙ্কাল, মুষল, কপাল, শক্তি, খড়গ, গদা, শূল, বজ্র, কিঙ্কিণী, নন্দন, মোহন, প্রস্বাপন, প্রশমণ, বক্ষণ, শোষণ, সন্তাপন, বিলাপন, মাদন, মানব, তামস, সৌমন, সংবর্ত। আরও অনেক নাম-না-জানা অস্ত্র! বিশ্বামিত্রের কি অস্ত্রের কারখানা ছিল আমেরিকার মতো? শুধু বিশ্বামিত্রই নন, অস্ত্র দিয়েছেন অগস্ত্যও। এঁরা তথাকথিত মুনিঋষি হলেও প্রত্যেকেই এক একজন বিপুল অস্ত্রভাণ্ডারের মালিক।

অনার্যদেবতা শিবের পৃষ্ঠপোষকতায় রাবণ ছিলেন অপ্রতিরোধ্য, অপরাজেয় শক্তিমান। তিনি ছিলেন শিবের ও ব্রহ্মা পদাধিকারীদের একনিষ্ঠ ভক্ত। পুরাণে আছে, অমরত্ব লাভের জন্য শিবের কাছে তপস্যা তথা দরবার করেছেন। শিব যতবারই তাঁকে পরীক্ষা করছেন, রাবণ নিজ মস্তক তরবারির আঘাতে কেটে গুরুর পায়ের কাছে ফেলে দিচ্ছেন। প্রতিবারই শিবের কৃপায় রাবণের মস্তক আবার যথাস্থানে ফিরে যাচ্ছে। এইভাবেই রাবণ দশ মস্তকের অধিকারী হলেন। নাম হলো দশানন। আসল কথা হল, দশানন বা দশ মস্তকের অধিকারী কথাটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাবণের শক্তি, সামর্থ্যের কথা। জৈন মতে রাবণের ছিল দশমুখ। বাল্মীকির রামায়ণে রাবণের একটাই মাথা, দুটি হাত, দুটি পা।

রাবণের মৃত্যু হয়েছিল রাম নয়, ইন্দ্রের হাতে। এ ইঙ্গিত রাবণের মৃত্যুর পর মন্দোদরীই দিয়েছেন। পুরাণ বলছে, পরবর্তী জীবনে রাবণ তীর্থঙ্কর হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্মীকির রাবণ শিবের কাছে তপস্যার পর শিব। সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে রাবণ অমরত্ব চাইলেন। শিব অমরত্ব দিলেন না। রাবণের নাভির নিচে লুক্কায়িত। রইল অমৃত, যার উপস্থিতিতে রাবণ হলেন অপরাজেয়। অমৃত বিনষ্ট না-করে রাবণকে বধ করা যাবে না। লাভ করলেন অনন্ত শক্তি, যাতে মানুষ ছাড়া দেবকুল, অসুরকুল ইত্যাদি যত কুল আছে, সকলেই তাঁর কাছে পরাজিত হবেন। অবধ্য, অপরাজেয় হবেন রাবণ। আর দিলেন চন্দ্রহাস তরবারি। কিন্তু অকারণে এই শস্ত্রের প্রয়োগে তা কার্যকরী হবে না, পুনরায় ফিরে যাবে দেবতার কাছে। এছাড়াও শিব ও ব্রহ্মা অনেক অস্ত্র দিয়েছিলেন তাঁকে, যা দিয়ে তিনি লাভ করবেন সসাগরা পৃথিবীর আধিপত্য। এই সব অস্ত্রই ব্যবহৃত হয়েছিল লঙ্কার যুদ্ধে। সাধারণের মানুষের প্রতি তাঁর কোনো ভয় ছিল না। মানুষকে তিনি শত্রু বলেই মনে করেন না। তাঁর প্রধান শত্রু ছিলেন দেবকুল এবং অসুরকুল। তাই তিনি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কথা ভেবে শিবকে তুষ্ট করতেন। বিভীষণ রাবণের মৃত্যু কীভাবে সম্ভব একথা রামকে জানালে রামচন্দ্র প্রসাভপন অস্ত্র দিয়ে রাবণের অমৃতকে বায়বীয় পদার্থরূপে হাওয়ায় উড়িয়ে দেন।

ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ ইন্দ্রলোক জয় করেছিলেন। ইন্দ্রলোক, দেবলোক জয় করা তো সামান্য বীরের কাজ নয়! এহেন মেঘনাদকে পরাজিত এবং হত্যা করার আগে লক্ষ্মণ ও রাম পরাস্তই হয়েছিলেন তাঁর কাছে। একবার নয়, দু-দুইবার। বহিঃশক্তি আর্যদেবতাদের সহায়তা এবং কৌশল অবলম্বন না-করলে সেই যুদ্ধে মেঘনাদকে পরাস্ত করা সহজসাধ্য ছিল না।

আবার রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণকাহিনিতে এমন কিছু মন্ত্রও আছে, যা নকি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে হাজির হয় শস্ত্র হিসাবে। কখনও-বা সেই শস্ত্রের আঘাতে বিপক্ষের জীবনহানিও হয়ে যায় নিমেষে। আবার কখনও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সেই সকল অস্ত্রের দ্বারা অহেতুক ক্ষতিসাধনও হয়ে থাকে। আর-একটি প্রসিদ্ধ অস্ত্রের কথাও আমরা জানি, তা হল ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। এই অস্ত্রের ব্যবহার ছিল একেবারে শেষ পর্যায়ে। আধুনিক যুগে পরমাণু বোমার মতো। যুদ্ধের শেষ অস্ত্র। এই অস্ত্র ব্যবহারের কিছু বিধিনিষেধও ছিল। বিপক্ষকে কোনওভাবেই পরাস্ত করতে না-পারলে, বিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যু আসন্ন হলে এবং সমগ্র বাহিনী পরাজয়ের সম্মুখীন হলে তবেই এই অস্ত্র ব্যবহার করা হত। তবে কি এই অস্ত্র ছিল একালের নিউক্লিয়ার বোমা বা পরমাণু অস্ত্র, যার প্রয়োগ সম্বন্ধে আছে অনেক বিধিনিষেধ! হঠকারিতা যে হয় না, তা নয়–সেযুগেও হয়েছে, এযুগে হয়। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোসিমা ও নাগাসাকির বিরুদ্ধে ব্ৰহ্মাস্ত্র (নিউক্লীয় বোমা) প্রয়োগ করে এমনই হঠকারিতা করেছিল আমেরিকা।

এছাড়া ছিল ‘যমাস্ত্র’। নাম শুনেই মনে হয় একেবারে ইহলীলা সাঙ্গ করার জন্যই এর ব্যবহার। যম মানেই যে মৃত্যু, শমন। এই অস্ত্রটি মেঘনাদ বিভীষণের প্রতি ব্যবহৃত হয়েছিল। বিভীষণ রাম-লক্ষ্মণদের জানিয়ে দিয়েছেন মেঘনাদকে তাঁদের শক্তি দিয়ে হত্যা করা সহজ কাজ নয়। মেঘনাদ এখন যজ্ঞে বসেছেন এবং যজ্ঞ সম্পন্ন হলে তিনি অমরত্ব লাভ করবেন–কেউ আর তাঁকে পরাস্ত করতে পারবেন না। এদিকে রাম-লক্ষ্মণ মেঘনাদের অস্ত্রপ্রয়োগে যারপরনাই বিপর্যস্ত। লক্ষ্মণকে দু-বার এবং রামচন্দ্রকেও একবার পরাস্ত করেছেন ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ। কোনোপ্রকারে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এসেছেন রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই। অতএব মেঘনাদের যজ্ঞ পণ্ড করে মেঘনাদকে হত্যা করা যদি আসান হয়, সেই সুযোগ আর হাতছাড়া করা কেন! যজ্ঞ পণ্ড করলেই যদি তিনি আর অমরত্ব লাভ করতে না-পারেন, তাহলে আর দেরি কেন–অতএব শুভস্য শীঘ্রম। লক্ষ্মণ ও বিভীষণ সদলবলে মেঘনাদের যজ্ঞক্ষেত্রে হানা দিলেন। তখনই বিভীষণের বিরুদ্ধে যমাস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলেন মেঘনাদ।

‘নাগপাশ’ আর-এক ভয়ংকর অস্ত্র। মেঘনাদের কাছে রাম এবং লক্ষ্মণ বারেবারেই পরাস্ত হচ্ছিলেন। মেঘনাদ নাগপাশ অস্ত্রের প্রভাবে রাম এবং লক্ষ্মণকে সর্পবন্ধনে বেঁধে ফেলেছিলেন। পরে গরুড়ের সাহায্যে তাঁরা মুক্ত হন। গরুড় (বিষ্ণুর বাহন বলা হয়) না-থাকলে সেদিন রাম-লক্ষ্মণ মুক্তি অসম্ভব ছিল। বহিঃশক্তি দেবতাদের পক্ষপাতিত্ব না-থাকলে রাম-লক্ষ্মণরা বড়োই অসহায়। আর-একটি ভয়ংকর অস্ত্র হল ‘শক্তি অস্ত্র বা ‘শক্তিশেল। এই অস্ত্র মেঘনাদ প্রয়োগ করেছিলেন লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে। একপ্রকার মৃত বলেই ঘোষিত হয়েছিলেন লক্ষ্মণ। হনুমান সঞ্জীবনী’ এনে না-দিলে সেবারেই ‘খবর’ হয়ে যেতেন তাঁরা। এছাড়া সূর্যাস্ত্র, বরুণাস্ত্র, ইন্দ্রাস্ত্র ইত্যাদি অস্ত্র একা মেঘনাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছিল। এক এক দেবতার এক একরকমের অস্ত্র, তার পাল্লা এবং বীভৎসতাও এক একরকম।

ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ এবং রামচন্দ্র ‘ব্ৰহ্মাস্ত্র’, ‘পাশুপত অস্ত্র’, ‘বৈষ্ণবাস্ত্র’ এই তিনটি অস্ত্রের অস্ত্রধারী বীর ছিলেন। এছাড়াও ছিল ‘গান্ধর্বাস্ত্র’, যা বহু সৈন্যকে একসঙ্গে হত্যা করার মতন ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র ছিল। রাম এবং রাবণ এই দুজন শক্তিধর ব্যক্তি ছাড়া আর কোনও বীরেরই এই অস্ত্রচালনা করার ক্ষমতা ছিল না।

শুধু রামায়ণ নয়, মহাভারতেও আমরা ভয়ানক সব সামরিক পরিচয় পাই। যে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র তাঁদের কাছে ছিল, সে ধরনের অস্ত্রশস্ত্রের মারণক্ষমতা ছিল প্রলয়ংকর। মহাভারতের আদি পর্বে অগ্নিদেব বাসুদেবকে ‘সুদর্শন চক্র’ দিয়ে বলছেন–‘এই অস্ত্র শত্রু নিপাত করবে এবং কাজ শেষ হলে তাঁরই হাতে ফিরে আসবে’। সেই বাসুদেব শিশুপালের হাতে যখন প্রায় নিগৃহীত, তখন তিনি সেই সুদর্শন চক্র ব্যবহার করেছিলেন এবং সেই ‘চক্র তাঁহার দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন করিয়া বাসুদেবের হস্তে ফিরিয়া আসিল’। দুর্দান্ত ক্ষুরধার ব্যুমেরাং! এত বছর আগে ব্যুমেরাং!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *