রাক্ষস-খোক্ষস : বাস্তবে এবং অবাস্তবে
দণ্ডকারণ্যে এসে সীতা রামকে সতর্ক করে বলছিলেন–“ঋষিরা বললেন, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে বসলে ‘আমি দণ্ডকারণ্যের সমস্ত রাক্ষস বধ করব’, কেন? রাক্ষসেরা তোমার কী ক্ষতি করেছে? বিনা কারণে কেন তাঁদের মারবে?” এখন প্রশ্ন, মহাকবিরা এত রাক্ষস পেলেন কোথায় সে যুগে! মহাভারতে রাক্ষসদের উল্লেখ তেমন একটা পাওয়া যায় না। কিন্তু রামায়ণে রাক্ষস যেন কিলবিল করছে, দণ্ডকারণ্য থেকে লঙ্কা। সেই ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছে পুরাণকারেরাও। বেদের যুগে একটি রাক্ষসদের কথা পাই না। পাই অনার্য তথা দাস বা দস্যুদের। এরাই কি তবে রামায়ণ-মহাভারতের যুগে এসে রাক্ষসে প্রতিপন্ন হয়েছে! যত রাক্ষস সবই যে রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণগুলিতে। বনবাসকালীন রামচন্দ্র প্রায় ১৪,০০০ নিরীহ নিরস্ত্র রাক্ষসদের হত্যা করেছেন কখনো মুনিঋষি তথা ব্রাহ্মণদের রক্ষার্থে, কখনো-বা আত্মরক্ষার তাগিদে, কখনো-বা দাক্ষিণাত্যে আর্য উপনিবেশ ঘটাতে।
মহাভারত মহাকাব্যে আমরা অবশ্য হিড়িম্বা সহ কয়েকজন রাক্ষসের সন্ধান পাই। তিনি হিড়িম্বা, হিড়িম্বক বনের রাক্ষস অধিপতি হিড়িম্বর বোন হিড়িম্বা। হিড়িম্বার আরও একটি পরিচয় আছে–ইনি মধ্যম পাণ্ডব ভীমের স্ত্রী এবং ভীমের ঔরসজাত ঘটোৎকচের মা। কাম্যক বনে ভীমকে দেখে হিড়িম্বা নামে এক রাক্ষুসী মোহিত হয়ে গেলেন। মায়া করে সুন্দর এক যুবতী হয়ে ভীমের কাছে এলেন। আসলে এই রাক্ষসরাও মানুষ, বনবাসী। এঁরা বনে-জঙ্গলে থাকত, তাই সেজেগুজে থাকত না। কিন্তু ভীমকে হিড়িম্বা তাঁর প্রেমে ফেলার জন্য যখন সে সুন্দর করে সাজলেন তখন তো তাঁকে সত্যি সত্যি মানুষের মতোই সুন্দরী ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়নি ভীমের। এই সেজে আসাটাকেই ব্যাসগণ একটু অলংকরণ করে বলেছেন মায়া করেছেন। আর আকাশে উড়ে যাওয়া বিষয়টিও অতিরঞ্জিত করা। ভীমকে বিয়ে করার পরে তাঁকে নিয়ে নির্জন জায়গার দিকে নিয়ে গেলেন যেখানে কোনো মনুষ্যবাস নেই। এই পথটি হিড়িম্বারই জানা ছিল–ভীমের নয়। রচনাকারী এই নির্জন জায়গার দিকে যাওয়াটাকেই আকাশে উড়ে যাওয়া বলে চালিয়ে দিয়েছেন।
ভারতের ধর্ম-সাহিত্যে একেবারে শুরুর কথা বলা যায়। বেদ সাহিত্যে দাস, অনার্যদের কথা জানতে পারি। রামায়ণ-মহাভারতে রাক্ষসদের কথা জানতে পাই। আবার পুরাণগুলোতে অসুর, দৈত্য-দানোদের কথা জানতে পাই। মনুসংহিতায় শূদ্রদের কথা জানতে পাই। এরা কেউ পৃথক নয়। সবাই একই জাতি। এরা সবাই ভারত উপমহাদেশের ভূমিপূত্র তথা আদি বাসিন্দা। বর্তমানে যে জাতি শূদ্র তথা দলিত তথা পিছড়ে বর্গ তথা মূলনিবাসী বলে পরিচিত। এরাই প্রাচীন যুগের রাক্ষস-খোক্ষস, দৈত্য-দানো-অসুর প্রমুখ। প্রাচীন যুগে এই বিশাল ভারত উপমহাদেশে এশিয়া মাইনর হয়ে বহিরাগত আর্যরা প্রবেশ করে। অন্য কোনো ভূখণ্ডের ভিনদেশি জাতি এসে বিনা রক্তপাতে অন্য কোনো ভূখণ্ডে প্রবেশ করবে এবং দখল নেবে, সেটা কি সম্ভব? খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারত উপমহাদেশের মূলনিবাসী তথা ভূমিপুত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে বারবার। এই আর্যরা শক্তিতে, বুদ্ধিতে এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। ফলে তাঁদের সঙ্গে ভারতের ভূমিপুত্ররা সংঘর্ষে পরাস্ত হয়েছে। সেই সংঘর্ষের কাহিনি লিখেছেন আর্যরাই। আর্যদের সেই অতিরঞ্জিত ইতিহাসই সনাতন ধর্ম তথা হিন্দুধর্মগ্রন্থগুলির মূল বিষয়, যা আসলে আর্যবিজয়ের ইতিহাস। আর বিজয়ীরা বিজিতদের ঘৃণ্য ভাষায় সম্বোধন করবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বিদেশি উপনিবেশিকরা যখনই অন্য ভূখণ্ড দখল ও শাসন করত, তখনই ভূমিপুত্র বা মূলনিবাসীদের ঘৃণ্য ভাষায় সম্বাধন করত, অসভ্য বর্বর বলত। ভূমিপুত্রদের অসুর, রাক্ষস, শূদ্র, নিগ্রো এসব বলে নিজেদেরকে কৃষ্টিবান, সংস্কৃতিবান, বুদ্ধিমান, সুশিক্ষিত, সুসভ্য বলে জাহির করত। যেমন আফ্রিকান ভূমিপুত্রদের উপনিবেশিক মাতব্বররা ‘নিগ্রো’ বলে সম্বোধন করত। নিগ্রো একটি অপমানজনক ঘৃণ্য পরিচিত। নিগ্রো আর অসভ্য যেন সমার্থক শব্দ। বর্তমানে কিছু লোকের দ্বারা আপত্তিজনক হিসাবে বিবেচিত’ থেকে ‘সাধারণভাবে অবমাননাকর’ রূপান্তরিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। নিগ্রো শব্দ দ্বারা এখন আর আফ্রিকানদের চিহ্নিত করা যায় না। নিগ্রো শব্দে আফ্রিকানরাও প্রতিবাদ করেন। বহু দেশে এখনও সেই আদিম মানুষরা আছেন নিজেদের মতো করে। নারী-পুরুষ উভয়েরই ঊৰ্ধাঙ্গ অনাবৃত। নিন্মাঙ্গ আংশিক অনাবৃত।
এইসব যাঁরা সম্বোধন করত তাঁরা সকলেই সাদা চামড়ার মানুষ। এই সাদা চামড়ার মানুষগুলোই দেবতার মর্যাদা পেতে থাকল। সাদা রংয়ের কারণে কালো মানুষদের সমীহ আদায় করে নিল আর্যরা। এর সঙ্গে আরও একটা জিনিস হল, সাদা চামড়ার প্রতি কালো মানুষদের মোহ জন্মাতে শুরু করল। সাদা মানেই সুন্দর, কালো মানেই কদাকার–এমন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল উপনিবেশিক ভূখণ্ডগুলিতে। কালো চামড়ার মানুষগুলোও কালো চামড়ার মানুষদের ঘৃণা করা শুরু করল। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে।
রাক্ষস বা নরখাদক বলা হয়েছে রাবণকেও। প্রিয় পাঠকবৃন্দের কাছে একটি প্রশ্ন না-রেখে পারছি না। রাবণের দাদা হচ্ছেন পুলস্ত্য, পিতা বিশ্রবা, ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ, বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুবের এবং পুত্র ইন্দ্রজিৎ–এরা সকলেই ছিলেন সভ্য, ভব্য, সুশিক্ষিত, গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তি। এঁরা কেউই রাক্ষস বা কাঁচামাংসভোজী মানুষ ছিলেন না। রাবণও তার শৈশবকালাবধি মাতা-পিতার রান্না করা খাবারই খেয়েছেন নিশ্চয়। অতঃপর যৌবনে হঠাৎ করে একদিন তিনি খেতে শুরু করলেন জীবের কাঁচামাংস। বিমান বিহার, শক্তিশেল নির্মাণ ও অশোক কানন তৈরি করতে জানলেও তিনি রান্নার পাকপাত্র গড়তে বা রান্না করতে জানেননি। বেশ ভালো। কিন্তু তিনি কোথায় বসে, কোনদিন, কাকে খেয়েছেন–তার একটিরও নামোল্লেখ নেই কেন? রাবণ নরমাংস খেতেন না। এটা বানোয়াট।
মহাকবিদ্বয় বীরদের দিয়ে যেসব রাক্ষসদের হত্যা করিয়েছেন তাঁদের কতিপয় রাক্ষসগণ আবার পূর্বজন্মে হয় দেবতা, নয় গন্ধর্ব বীরদের অস্ত্রে খুন হওয়া যে রাক্ষস, সেই রাক্ষসদের পূর্বজন্ম কী ছিল, আদৌ ছিল কি না তা জানাননি। লক্ষণীর, এইসব বীরেরা এমনকি তথাকথিত রাক্ষসরা পর্যন্ত একটি মানুষ হত্যা করেছেন এমন কাহিনি কিন্তু পাওয়া যায় না। মহাভারতের সময় মানুষের কিছু সন্ধান পাওয়া গেলেও রামায়ণের সময় কিন্তু দণ্ডকারণ্য থেকে লঙ্কা পর্যন্ত শুধুই রাক্ষসদের পাচ্ছি। সেই রাক্ষসদের হত্যা করার জন্য রাম-লক্ষ্মণদের আহারনিদ্রা ছুটে গিয়েছে। একটা মানুষের সঙ্গেও রামচন্দ্রের সাক্ষাৎ হয়নি। মানুষ বলতে শুধুই মুনিঋষি তথা ব্রাহ্মণেরা? এঁরাও তো এক-একজন দেবতা বলেই জেনেছি। আচ্ছা, সাধারণ মানুষরা তখন কী করত! ভগবানরা সব সারাজীবন ধরে রাক্ষস-খোক্ষস মেরে বেরালেন কেন! একটাও মানুষ মারেননি। আসলে ভূমিপুত্র মানুষগুলিই রাক্ষস, অসুর ইত্যাদি। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের বাইরে রাক্ষসরা সব কোথায় গেল। তবে পরবর্তীতে আমরা রাক্ষস-খোক্ষসদের পাই রূপকথার গল্পগুলিতে। লালকমল আর নীলকমলদের রূপকথায় রাক্ষস-খোক্ষসদের সেই ‘হাউমাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাউ’ গোছের।
শ্ৰীযুক্ত যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার তাঁর প্রাচীন-ভারত’ গ্রন্থে বলেছেন–“অন্য এক জাতীয় ব্যক্তিগণ ভ্রমণশীল এবং ইহারা অসিদ্ধ মাংস ভোজন করে। ইহাদের মধ্যে যখন কোনো ব্যক্তি পীড়িত হয়, তখন পীড়িত ব্যক্তি পুরুষ হইলে তাহার আত্মীয়বর্গ তাহাকে হত্যা করে; কারণ, তাহারা মনে করে যে ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি অনেকদিন পীড়িত থাকিলে উহার মাংস নষ্ট হইয়া যায়। যদি পীড়িত ব্যক্তি নিজের ব্যাধির কথা অস্বীকার করে, তবে তাহার আত্মীয়গণ, তাহার সহিত অমত হইয়া শীঘ্র শীঘ্র তাহাকে শমন-সদনে প্রেরণ করে। স্ত্রীলোক পীড়িতা হইলে, তাহার আত্মীয়গণ, পূর্বোক্তপ্রকারে ঐ স্ত্রীলোককে মৃত্যুমুখে প্রেরণ করিয়া তাহার মাংস ভোজন করে। তাহারা বৃদ্ধগণকেও এই প্রকারে ভক্ষণ করে; কিন্তু এই জাতির মধ্যে কাহাকেও অধিক বয়স্ক হইতে দেখা যায় না। কারণ, সামান্য ব্যাধিগ্রস্ত হইলেই তাহার জ্ঞাতিবর্গ তাহাকে শমন-সদনে প্রেরণ করিয়া, মহানন্দে তাহার মাংস ভক্ষণ করে। এরাই কি তবে রামায়ণ-মহাভারতে বর্ণিত রাক্ষস? এরাই তবে ভারতের আদি ও আদিম বাসিন্দা, প্রাচীন অনার্য জাতি। কোনোকালেই আর্যদের মধ্যে মানুষের মাংস ভক্ষণের কথা শোনা যায় না। ভারতের সীমান্তপ্রদেশের বসবাসকারী বন্যজাতি তথা নর্মদা নদীতীরস্থ প্রদেশে পার্বত্য বনচরগণ মানুষের মাংস ভোজন করত বলে মনে হয়।
নিরঞ্জন সিংহ তাঁর “রামায়ণ-মহাভারতের দেব-গন্ধর্বরা কি ভিনগ্রহবাসী” প্রবন্ধে বলেছেন–আর্যদের চোখে মহেঞ্জোদড়োবাসীরা ছিলেন অনার্য। রামায়ণে এদেরকেই বলা হয়েছে গন্ধর্ব। গন্ধর্ব ও রাক্ষসরা ছিল দুটি গোষ্ঠী। একরম যক্ষরাও ছিল আর-একটি গোষ্ঠী। রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশ উত্তরকাণ্ডে বলা হয়েছে–“পুরাকালে ভূমির অপোভাগবর্তী জল সৃষ্টি করিরা তাহাতে সলিল সম্ভব প্রজাপতি জন্মগ্রহণ করেন। পদ্মযোনি–স্বসৃষ্ট প্রাণীপুঞ্জের রক্ষার জন্য কতকগুলি প্রাণীর সৃষ্টি করেন। সেই প্রাণীগণ, ক্ষুধা, পিপাসা এবং ভয়ে প্রপীড়িত হইয়া, আমরা কী করিব? এইরূপ কহিতে কহিতে বিনীতভাবে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছে আসিল। ব্রহ্মা হাসি হাসি মুখে তাহাদিগকে বলিলেন, হে জীবগণ! তোমরা যত্ন সহকারে মানবগণকে রক্ষা করো। তাহাদের মধ্যে কতকগুলি ক্ষুধার্ত জীব রক্ষাম অর্থাৎ রক্ষা করিব এবং কতকগুলি অক্ষুধার্ত জীব রক্ষাম স্থলে যক্ষাম উচ্চারণ করিল। তখন ব্রহ্মা বলিলেন–রক্ষামেতি চ যৈরুক্তং রাক্ষসাস্তে ভবন্তু বঃ।/যক্ষাম ইতি যৈরুক্তং যক্ষা এব ভবন্তু বঃ৷৷ আসলে দেবতা, দানব, রাক্ষস, গন্ধর্ব, নাগ–এরা সবাই একই জায়গার উন্নত সভ্য বিভিন্ন গোষ্ঠী। ভুলে যাবেন না, যক্ষ কুবের ছিলেন রাক্ষস রাবণের বৈমাত্রেয় ভাই। রাক্ষসদের সঙ্গে যক্ষদের বহুবার যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে।
সে যাই হোক, ভারতে আগমনকারী আর্যরাই ছিল সবথেকে অসভ্য। কারণ আর্যজাতীর অন্যান্য শাখাগুলি যেখানেই গিয়েছে সেখানেই সাম্রাজ্য বা সভ্যতা গড়ে তুললেও একমাত্র ভারতে আগমনকারী আর্যরাই কোনো সভ্যতা বা সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারেনি। পারস্যে আগমনকারী আর্যরা একামেনিড সাম্রাজ্য গড়ে তোলে, ইতালিতে আগমনকারী আর্যরা গড়ে তোলে রোমান সাম্রাজ্য, গ্রিসে আগমনকারী আর্যরা গড়ে তোলে হেলেনিক সাম্রাজ্য এবং জার্মানিতে আগমনকারী আর্যরা গড়ে তোলে ফার্সট রাইখ (অটো দ্য গ্রেটের)।
ভারতের এই আর্যরা ছিল ধ্বংসকারী শক্তি, এরা ক্রমশ প্রায় সমগ্র উপমহাদেশে আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু তাঁদের সবথেকে প্রবল বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ৫ টি জনপদ। আর্যরা এগুলি পদানত করতে ব্যর্থ হয়ে শ্লোক রচনা করে–“অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গেযু সৌরাষ্ট্র মগধে চতীর্থ যাত্ৰাং বিনা গচ্ছন পুনঃ সংস্কারঃ হতি শুদ্ধিতরং” (ঐতরেয় আরণ্যক) অর্থাৎ অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সৌরাষ্ট্র ও মগধে তীর্থযাত্রা ভিন্ন গমন করিলে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। এসব জনপদে কোনো আর্য ভুলেও পা রাখলে সে ভ্রষ্ট আর্য বা পতিত আর্য বলে গণ্য হতো, এবং এজন্যে তাঁকে ‘পুনোষ্ঠম’ নামে পুজো করে শুদ্ধ হতে হত। এই জনপদগুলির ভিতরের অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধ আমাদের বৃহৎ বঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর্যরা শ্লোকে উল্লেখিত এই পাঁচটি দেশের অধিবাসীদেরই ‘অসুর’ নামে আখ্যায়িত করত। আর্যরা প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী এসব দেশের অধিবাসীদের সঙ্গে লড়াইতে পেরে না উঠেই এদের অসুর’ বলে চিহ্নিত করে। এই পাঁচটি দেশের দুটি (সৌরাষ্ট্র ও কলিঙ্গ) দেশকে পরাভূত করতে পারলেও বঙ্গদেশের অধিবাসীদের পরাভূত করতে আর্যদের ২,১০০ বছর লেগে যায়! হ্যাঁ, এটাই সত্যি, এদেশের অধিবাসীরা আর্যদের সুদীর্ঘ ২,১০০ বছর ধরে বাঁধা দিয়ে আসছিল। আর আর্যরা ‘রাক্ষস’ বলতে এদেরকেই বোঝাত।
মেগাস্থিনিস তাঁর গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেন–“যে সকল জাতি ককেসাস পর্বতে বাস করে, তারা প্রকাশ্যেই সঙ্গম করেন এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের দেহ ভক্ষণ করেন। সর্বভূক আমিকটারিস জাতি কাঁচা মাংস ভক্ষণ করত। এঁরা স্বল্পজীবী, বৃদ্ধত্ব প্রাপ্ত হওয়ার আগেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এঁদের ওষ্ঠ অধরের নিম্নদেশ পর্যন্ত বিলম্বিত।” এ ইতিহাস, প্রায় ২০০০ বছর আগের। মহাকবি শেক্সপিয়রের সাহিত্যেও একপ্রকার রাক্ষস খোক্ষসদের বর্ণনা পাওয়া যায়।ওথেলোতে এরকম এক ধরনের বর্বর জাতি, নরখাদক (Cannibal) মানুষদের কথা জানা যায়, যাঁদের মাথা ঘাড়ের নীচে।ওথেলো সেইসব গল্প শোনাতেন তাঁর প্রেমিকা ডেসডিমোনাকে। হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছেন–“রামায়ণ প্রভৃতি গ্রন্থে যাদের রাক্ষস, বানর, পক্ষী, যক্ষ, কিন্নর, গন্ধর্ব বলে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃত প্রস্তাবে তারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ। আর্যের সম্প্রদায়ের মানুষদের আর্যরা দাস, বানর, রাক্ষস, পক্ষী ইত্যাদি অবজ্ঞাসূচক নামে অভিহিত করতেন।”
রাক্ষস বলতে যদি আমরা নরখাদকদের বুঝি, তাহলে বলাই যায় সেই নরখাদক রাক্ষস আজও আছে পৃথিবীতে। ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামানের রহস্যঘেরা আদিম দ্বীপ নর্থ সেন্টিনেল। ২৮ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপটিতে বাস করেন নরখাদক আদিম জাতি সেন্টিনেল। সেখানে কেউ গেলে তাঁকে হত্যা করে খেয়ে ফেলে এই সেন্টিনেলরা। কয়েক বছর আগে এক আমেরিকান নাগরিক সেখানে গেলে তাঁকে হত্যা করে সেন্টিনেলরা। এরপর পুলিশ এ ঘঠনায় খুনের মামলা দায়ের করেছে। ওই আমেরিকান নাগরিককে দ্বীপে পৌঁছে দেওয়ার দায়ে সাত জেলেকে গেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে সেই দ্বীপে গিয়ে ঘটনার তদন্ত করার দুঃসাহস দেখায়নি কেউ।
এই অঞ্চলে যাঁরাই গিয়েছেন, হয় সেন্টিনেলদের দেখা পাননি, নয়তো তিরের মুখে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন অথবা প্রাণ দিয়ে খাদ্য হয়েছে। ভাগ্যক্রমে যাঁরা তাঁদের দু-একজনকে দেখেছেন তাঁরা বলেছেন, ওদের গলায়-বুকে-পিঠে হাড় আর খুলির গয়না। কঙ্গোর জঙ্গলের কিগ্যানি বা অস্ট্রেলিয়ার বুশম্যানদের মতো সেন্টিনেলরা বিশ্বের বিরলতম উপজাতিগুলোর একটি। এঁরা গত ৬৫ হাজার বছর ধরে এই দ্বীপের বাসিন্দা। আমেরিকান মিশনারি জন অ্যালেন চাও প্রাণ হারানোর পর বিশ্বের অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম ওই দ্বীপকেই বলছে ‘বিশ্বের ভয়ংকরতম’। ভয়ংকরতম এই দ্বীপের কুখ্যাতি বহুদিনের। দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত রোমান জ্যোতির্বিদ টলেমি লিখেছিলেন বঙ্গোপসাগরের এই নরখাদকদের দ্বীপ নিয়ে। ১২৯০ সালে মার্কো পোলোও বর্ণনা দেন এমন এক দ্বীপের, যেখানে হিংস্র ও বর্বর আদিবাসীরা বসবাস করেন, যাঁরা তথাকথিত সভ্য মানুষ পেলেই খেয়ে ফেলে।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তাঁদের জনসংখ্যা ৫০-এর মধ্যে। তবে বহির্বিশ্ব থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। নিজেদের এলাকায় বাইরে কারও প্রবেশ একেবারেই পছন্দ নয় তাঁদের। কোনো মুদ্রা ব্যবহার করে না সেন্টিনেলরা। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে না সরকারও। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন বা তাদের এলাকায় প্রবেশ বে-আইনি। এমনকি ভিডিও ক্যামেরায় তাদের গতিবিধি রেকর্ড করাও নিষিদ্ধ। গোটা বিশ্ব যখন এঁদের দমন করতে চরমভাবে ব্যর্থ, তখন রামচন্দ্র এঁদের সফলতার সঙ্গে দমন করে ফেলেছিলেন, এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে, তা নিয়ে ভাবার অবকাশ থেকে যাবে
নরমাংস ভক্ষণ মানে হল মানুষের এমন এক ধরনের আচরণ যেখানে একজন মানুষ আর-একজনের মানুষের মাংস ভক্ষণ করে। তবে এর অর্থ আরও বাড়িয়ে প্রাণীতত্ত্বে বলা হয়েছে, এমন কোনো প্রাণীর এমন কোনো আচরণ, যেখানে সে তাঁর নিজের প্রজাতির মাংস ভক্ষণ করে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি তার সহযোগীও হতে পারে। ক্যানিব্যালাইজ শব্দটি ক্যানিবালিজম থেকে এসেছে এর মানে হল সামরিক অংশের পুনোৎপাদন।
ক্যানিবালিজিমের চর্চা হয়েছে লিবিয়া ও কঙ্গোতে বেশ কিছু যুদ্ধে। করোওয়াই হল এমন একটি উপজাতি, যাঁরা এখনও বিশ্বাস করে যে নরমাংস ভক্ষণ সংস্কৃতিরই একটি অংশ। কিছু মিলেনেশিয়ান উপজাতিরা এখনও তাঁদের ধর্মচর্চায় ও যুদ্ধে এই চর্চা করে। এছাড়াও এর একটি বড়ো কারণ হল মানসিক সমস্যা বা সামাজিক আচরণের বিচ্যুতি। নরমাংস ভোজের সামাজিক আচরণে দুই ধরনের নৈতিক পার্থক্য আছে। একটা হচ্ছে একজনকে হত্যা করা ও তাঁর মাংস খাওয়ার জন্য ও আর-একটি হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে মৃত মানুষের মাংস খাওয়া।
সপ্তম শতকে আরবে কোরাইশদের যুদ্ধের সময় এ ধরনের ঘটনার সূত্রপাত ঘটে। ৬২৫ সালে উঁহুদের যুদ্ধের সময় হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব হত্যা হলে তাঁর কলিজা ভক্ষণের চেষ্টা করেন কোরাইশ নেতা আবু। সুফিয়ান ইবনে হার্বের স্ত্রী হিন্দু বিনতে উতবাহ। হাঙ্গেরির মানুষরাও মানুষের মাংস খেত মূর্তিপুজো করার জন্য। পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বলেন যে, তাঁকে এক আফ্রিকান রাজা সতর্ক করে বলেছিলেন সেখানে নরখাদক আছে। জেমস ডব্লিউ ডেভিডসন ১৯০৩ সালে তাঁর লেখা বই ‘The Island of Formosa’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, কীভাবে তাইওয়ানের চিনা অভিবাসীরা তাইওয়ানের আদিবাসীদের মাংস খেয়েছিল ও বিক্রি করেছিল। ১৮০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের মাওরি উপজাতিরা নর্থল্যান্ডে ‘The Boyd’ নামের একটি জাহাজের প্রায় ৬৬ জন যাত্রী ও ক্রুকে হত্যা করে এবং তাঁদের মাংস খেয়ে নেয়। মাওরিরা যুদ্ধের সময় তাঁদের প্রতিপক্ষের মাংসও খেয়ে ফেলে। অনেক সময়ে সাগরযাত্রীরা ও দুর্যোগে আক্রান্ত অভিযাত্রীরাও টিকে থাকার জন্য অন্য সহযাত্রীদের মাংস খেয়েছে এমন ঘটনা জানা যায়। ১৮১৬ সালে ডুবে যাওয়া ফেঞ্চ জাহাজ মেডুসার বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা টানা চার দিন সাগরে ভেলায় ভেসে থাকার পর মৃত যাত্রীদের মাংস খেয়ে বেঁচে থাকেন। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির প্রায় ১,০০,০০০ যুদ্ধবন্দি সেনাকে রাশিয়ার সাইবেরিয়াতে পাঠানোর সময় তাঁরা ক্যানিবালিজমের আশ্রয় নেন। কারণ একদিকে তাঁদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবারের পরিমাণ ছিল খুবই কম, অপরদিকে নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হয়ে সৈন্যরা মারা পড়ছিল। এঁদের মধ্যে মাত্র ৫,০০০ জন বন্দি স্ট্যালিনগ্রাডে পৌঁছতে সক্ষম হয়। ল্যান্স নায়েক হাতেম আলি নামে একজন ভারতীয় যুদ্ধবন্দি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিউ গিনিতে জাপানি সেনাদের মানুষের মাংস খাওয়ার কথা বলেন। তাঁরা জীবন্ত মানুষের শরীর থেকে মাংস কেটে নিত ও এরপর ওই ব্যক্তিকে খালেবিলে ফেলে মেরে ফেলত। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাপানি সেনারা চিচিজিমাতে পাঁচজন আমেরিকান বিমানসেনাকে হত্যা করে তাঁদের মাংস খেয়ে ফেলেন।
আঘোরি নামে উত্তর ভারতের একটি ক্ষুদ্র উপজাতিরা মানুষের মাংস খায়। মাংস খায় তাঁদের ধর্মীয় উপাসনার অংশ হিসাবে ও অমরত্ব অর্জনের জন্য। তাঁরা মনে করে এভাবে অতিপ্রাকৃতিক শক্তিও লাভ করবে। তারপর তাঁরা সেই মানুষের মাথার খুলিতে রেখে অন্য খাবার খায়। বয়স বেড়ে যাওয়া রোধ করতে ও ধর্মীয় পূণ্য অর্জন করতেই মানুষের মাথার খুলিতে খাবার রেখে খায়। ভারতের বারাণসীতে এখনও একটি সম্প্রদায়ের। মধ্যে মানুষ খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। আঘোরি সাধু নামে বিশেষ এক সন্ন্যাসী সম্প্রদায় আছে, যাঁরা মৃত মানুষের মাংস খেয়ে থাকে। যদিও প্রচলিত আছে এই সম্প্রদায় বিশেষ মার্গ সাধনার পদ্ধতি হিসাবে মানুষের মাংস খেয়ে থাকে।
২০১১ সালে পাপুয়া নিউগিনি পুলিশ ২৯ জন মানুষ খেকো আটক করে, যাঁরা ৭ জন ডাক্তার হত্যা ও ভক্ষণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। তাঁরা আদালতে স্বীকার করে যে, এই হত্যার জন্য তাঁরা কোনোভাবে অনুতপ্ত নয়। কারণ এই ডাক্তাররা কালোজাদু করত। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খাবার ও মেয়েদের ছিনিয়ে নিয়ে যেত। আর তাঁরা বিশ্বাস করত কুমারী মেয়েদের কালোবিদ্যা উপাসনায় কাজে লাগালে ভয়ংকর বিপদ নেমে আসে। তাই তাঁরা সেই ডাক্তারদের হত্যা করে তাঁদের মগজ ভক্ষণ করেছে ও পুরুষদের লিঙ্গের স্যুপ করে খেয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করে এই কারণেই ডাক্তারদের সেই কালোবিদ্যা তাঁদের মাঝেও চলে এসেছে এবং এমন এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতার লাভ করেছে যে, তাঁদেরকে আর কোনো রোগ স্পর্শ করতে পারবে না। এমনকি এদের মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিজ সন্তান হত্যা করে খাওয়ার ঘটনাও আছে।
ফিজির সিগাটোকা অঞ্চলে একসময় মানুষখেকোরা থাকলেও এখন তাঁদের দেখা পাওয়া যায় না। সিগাটোকার নাইহেহে গুহায় যেসব নিদর্শন মিলেছে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায় যে মানুষখেকোরা আসলে মিলিয়ে যায়নি। আফ্রিকার মধ্যাঞ্চলীয় দেশটির আদিবাসীদের মাঝে এখনও মানুষ খাওয়ার প্রবণতা কমেনি। প্রকাশ্যে না-হলেও গোপনে মানুষের মাংস খাওয়ার অভ্যাস আছে তাঁদের। ২০০৩ সালের গোড়ার দিকে কঙ্গোর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মানুষ খাওয়ার অভিযোগ তোলে খোদ জাতিসংঘ। দ্বিতীয় কঙ্গো যুদ্ধের পর সরকারের এক প্রতিনিধি তাদের কর্মীদের জীবন্ত ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পর্যন্ত তোলেন। জার্মানিতে মানুষের মাংস খাওয়া কোনো অপরাধ নয়। আর সেজন্যই ২০০১ সালের মার্চে আৰ্মিন মাইভাস নামের এক জার্মান নাগরিক রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষ খেলেও তাঁর বিরুদ্ধে খুনের মামলা ছাড়া কোনো অভিযোগ আনেনি পুলিশ। মানুষ খাওয়ার উদ্দেশে “The Cannibal Cafe’ নামের একটি ওয়েবসাইটে সুঠামদেহী, জবাইযোগ্য এবং আহার হতে চাওয়া মানুষের সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন দেন আর্মিন। অনেকে আগ্রহী হলেও বার্ল্ড জুর্গেন ব্রান্ডিসকে পছন্দ করেন আর্মিন। এরপর জার্মানির ছোট্ট গ্রাম রটেনবার্গে দুজনে মিলিত হন। এক পর্যায়ে ব্রান্ডিসকে হত্যা করে প্রায় ১০ মাস টানা তাঁর মাংস খান আর্মিন মাইভাস। ২০০২ সালে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের ক্রাসনোদার শহরে এক মানুষখেকো। দম্পতি প্রায় ৩০ জনকে হত্যা করেছে বলে স্বীকার করেছে। ৩৫ বছর বয়সি দিমিত্রি বাকশেভ এবং তাঁর স্ত্রী নাতালিয়া যে জায়গায় বসবাস করেন, সেই সামরিক ঘাঁটিতে কাঁটা-ছেঁড়া ও অঙ্গহীন একটি লাশ পাওয়া গেলে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়। রাশিয়ার গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী তাঁদের বাড়ির ভিতরে ও মোবাইল ফোনে পাওয়া ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে এসব হত্যাকাণ্ড প্রায় বিশ বছর আগের। এঁদের মধ্যে একটি ছবি ১৯৯৯ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর মাসে তোলা। যেখানে দেখা যাচ্ছে, একটি বড়ো থালায় বিভিন্ন রকমের ফলের সঙ্গে মানুষের একটি রক্তাক্ত কাটা মাথা পরিবেশন করা হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ৩ এপ্রিল দৈনিক বাংলার একটি বক্স নিউজের ছবিতে দেখা যায় এক যুবক মরা একটি লাশের চেরা বুক থেকে কলিজা খাচ্ছে। সে মরা মানুষের কলজে মাংস খায়!’ জানা যায়, প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর সে মানুষের কলিজা খেত। উত্তর ২৪ পরগনার নিউ ব্যারাকপুরে কেদার নামে এক খুনির কথা জানা যায় তাঁর অনুগামীদের কাছ থেকে। এই কেদার ছিল খুবই নৃশংস ব্যক্তি। বিনা প্ররোচনাতেই যখন-তখন যে কারোকেই খুন করে দিত। খুন করার পর সেই মৃতদেহের বুক চিরে পাকস্থলি, যকৃত, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড বাইরে বের করে এনে কাঁচাই খেতে নিত। পরে এক এনকাউন্টারে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়।
উগান্ডার স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক ইদি আমিনও নাকি নরখাদক ছিলেন। তবে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর নরখাদকের খেতাবটি ফিজির সর্দার রাতু উদ্রের দখলে। প্রত্যেকটি মানুষকে খাওয়ার পর সর্দার রাতু উদ্রে তাঁর শিকারের স্মৃতিতে একটি করে পাথর সাজিয়ে রাখত। তারপর খেয়ালখুশি মতো গুনতে বসত। গুনতে বসত কারণ এ পর্যন্ত তিনি কটা মানুষ খেল সেই হিসাব রাখতে। সে চাইত তাত্র মৃত্যুর পর তাঁকে যেন এই পাথরগুলির পাশে কবর দেওয়া হয়। হয়েছিলও তাই। মৃত্যুর পর উদ্রেকে উত্তর ভিটিলেসুর রাকিরাকি এলাকায় সেই পাথরের স্কুপের মধ্যে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ১৮৪০ সালে মিশনারি রিচার্ড লিথ আসেন ফিজিতে। উদ্রের ছেলে ছিল রাভাতু। সে তাঁর বাবার মতো নরখাদক ছিল না। লিথ সাহেবের কাছে স্বীকার করেছিল তাঁর বাবা সর্দার রাতু উদ্রে সত্যিই নরখাদক ছিল। উদ্রের পেটে যাওয়া সমস্ত হতভাগ্যই ছিল, ফিজির আদিবাসী গোষ্ঠী সংঘর্ষে হেরে যাওয়া যুদ্ধবন্দি। এছাড়া উদ্রের দলে থাকা রাকিরাকির অনান্য আদিবাসী সর্দাররা তাঁদের জীবিত বন্দি ও মৃত শত্রুর দেহ উদ্রের হাতে তুলে দিত। মৃতদেহগুলির সত্যকারের জন্য নয়, স্রেফ খাওয়ার জন্য। লিথকে উদ্রের ছেলে রাভাতু বলেছিল, তাঁর বাবা মানুষের মাংস ছাড়া আর কিছু খেত না এবং তাঁর নরখাদক বাবা হতভাগ্য মানুষদের পুরো শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই আগুনে ঝলসে খেত। একেবারে একটা দেহের সব মাংস খেতে না পারলে অর্ধভুক্ত দেহটি একটা বাক্সে তুলে রাখত। কিন্তু পরে পুরোটা খেয়ে নিত। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর লরেন্স গোল্ডম্যান নরখাদক মানুষদের নিয়ে লিখেছিলেন একটি বই। সেই বইটিতে উদ্রে সম্পর্কে বিশদে লিখেছিলেন গোল্ডম্যান। “The Anthropology of Cannibalism’ নামক বইটির শেষ লাইনে লিখেছেন একটি গা শিউরে ওঠা ভয়ংকর মন্তব্য–“নরখাদক মানুষগুলোকে আমরা সবাই ভয় পাই। কিন্তু আমি একই সঙ্গে তাঁদের প্রশংসা করব। কারণ ওঁরা শক্তির প্রতীক। নিজেদের বীরত্ব ওঁরা এভাবেই প্রমাণ করতে চেয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে।” নরখাদকদের প্রশংসা করা নিয়ে ঝড় উঠেছিল পৃথিবীতে। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’ পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংসতম নরখাদক মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে উদ্রেকে। পিটার ব্রায়ান নামের একজন ব্রিটিশকে ইস্ট লন্ডনে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতার করা হয়, যিনি তাঁর বন্ধুকে খুন করেন ও খেয়ে ফেলেন।