রামায়ণ কী ইতিহাস, নাকি রূপক?
যে অবস্থায় আমরা বাল্মীকির রামায়ণ গ্রন্থখানিকে পেয়েছি, সেই অবস্থায় এ গ্রন্থখানিকে ‘নির্জলা ইতিহাস’ শিরোপা দিলে আমার কিঞ্চিৎ আপত্তি আছে। কেননা রামায়ণ যে নিখাদ ইতিহাস এমন অথেনটিক ইতিহাস তো সমসাময়িক ইতিহাসবিদরা লিখে রেখে যাননি। তা ছাড়া বাল্মীকি বা অন্যান্য কবিরাও কিন্তু তাঁদের রচনাকে ইতিহাস বলে দাবি করেননি। রামায়ণের সত্যতা এবং ঐতিহাসিকতা নিয়ে এ পর্যন্ত বহু আলোচনা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ভারতীয় সাহিত্যে রাম বিষয়ক নানা বিচিত্র কাহিনি পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলিতে একে অপরের সঙ্গে সামঞ্জস্য না-থাকায় বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, সত্যতা বিচার কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকের মতে রামায়ণের কাহিনি সত্য নয়, নিছক রূপকমাত্র। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বাল্মীকি রামকথার ক্ষীণসূত্র ধরেই গোটা রামায়ণটি রচনা করেছেন।দ্বিতীয় মতটি বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ রামকথায় কোনো সত্য ঘটনার বীজ না-থাকলে এত রূপান্তর চোখে পড়ত না। বাল্মীকির রামায়ণের সূচনাতেও এর ইঙ্গিত আছে। রাম না হতে রামায়ণ’ প্রবাদটি নিছক প্রবাদরই, অতিরঞ্জিত। রাম না-জন্মাতেই রামায়ণ রচিত হয়নি। অযোধ্যার সিংহাসনে রামচন্দ্রের অভিষেকের পরেই রামায়ণ রচিত হয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণে সেকথা উল্লেখ আছে–”প্রাপ্তরাজ্যস্য রামস্য বাল্মীকিৰ্ভগবান্ ঋষিঃ।/চকার চরিতং কৃতং বিচিত্রপদমর্থবৎ”। রামায়ণ, মহাভারত যথার্থভাবে জানা না-থাকলে ভারতের ইতিহাস জানা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
বাল্মীকি ‘ইতিহাস’ উল্লেখ করে রামায়ণ রচনা করেননি ঠিকই, তাই বলে ইতিহাস নয় একথাও জোর গলায় বলা যায় না। রামও বাল্মীকির মনোভূমে উদিত হওয়া সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক চরিত্র নয়। রবীন্দ্রনাথ রামায়ণকে কেবল কাব্য বলেই ছেড়ে দেননি, তিনি পাশাপাশি ইতিহাসও বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–“রামায়ণ মহাভারত কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে; ঘটনাবলির ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময় বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে। রামায়ণ মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস।” বস্তুত ভারতীয়রা সে সময় দর্শন, ভূগোল, গণিত, বিজ্ঞান নিয়ে প্রভূত চর্চা করলেও সাল-তারিখ সহ ইতিহাস চর্চা শুরু করেননি। তবে সাল-তারিখ না-থাকলেও বাল্মীকির রামায়ণে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত যেরকমভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভৌগোলিক স্থানের বিবরণ আছে এবং প্রায় সমস্ত ঘটনার তিথি-নক্ষত্রের উল্লেখ আছে, তাতে এ গ্রন্থকে ইতিহাস না-বলে উপায় নেই। রামায়ণে উল্লিখিত বিভিন্ন স্থাপত্য এখনও রক্ষিত আছে। সাল-তারিখ না থাকার কারণে যদি বাল্মীকির রামায়ণকে ইতিহাস বলতে আপত্তি থাকে–তাহলে মেগাস্থিনিস, টলেমি, প্লিনি, সলিনাস, আম্ব্রোসিয়াস, এরিয়ান, স্ট্রাবো প্রমুখের বিবরণগুলিকে ইতিহাস বলা যায় না। এদের যে গ্রন্থগুলি আমাদের ইতিহাসের উপাদান জোগান দেয়, সেখানেও সাল-তারিখ পাওয়া যায় না। বস্তুত খ্রিস্টাব্দ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকেই নির্দিষ্টভাবে সাল-তারিখের উল্লেখ হতে শুরু করে। তার আগের ঘটনাগুলিকে খ্রিস্টপূর্বাব্দ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। রামায়ণ খ্রিস্টাব্দ ব্যবস্থা চালু হওয়ার বহু বহু আগে রচিত। সময়কালটা খেয়াল রাখতে হবে। ভারতীয়রা অনেক অনেক যুগ পরে প্রকৃত ইতিহাস লিখতে করতে শুরু করেন। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস যেটুকু জানতে পারি সেগুলি সবই বিদেশি পরিব্রাজকদের লেখা থেকে। যেমন–মেগাস্থিনিস, টলেমি, প্লিনি, সলিনাস, আস্ত্রোসিয়াস, এরিয়ান, স্ট্রাবো প্রমুখ। প্রাচীন যুগের ভারতে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণে গল্পের মাধ্যমে ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। সেসময় এমনই রীতি ছিল। অতএব রামায়ণকে নিছক এক কবিকল্পনাপ্রসূত কাহিনি ভাবলে মস্ত বড়ো ভুল হয়ে যাবে।
অপরদিকে বাল্মীকির রামায়ণ প্রসঙ্গে শ্রীপ্রবোধচন্দ্র সেন লিখেছেন–“রামায়ণ হচ্ছে প্রত্যক্ষতঃ কবিকল্পনার সৃষ্টি, তৎকাল প্রচলিত কাহিনী ও জনশ্রুতিকে সংকলন করার কোনো প্রত্যক্ষ অভিপ্রায় এই গ্রন্থ রচনার মূলে নেই। বরং কবি সচেতনভাবেই প্রচলিত কাহিনীকে কাব্যসৃষ্টির প্রয়োজনে রূপান্তরিত করে নিয়েছেন। যে কহিনী অবলম্বন করে রামায়ণ কাব্য রচিত সে কাহিনী অবশ্য কবিকল্পনা নয়।” অর্থাৎ ঐতিহাসিক উপন্যাসে যেমন ইতিহাসের যথার্থ অনুসরণ না হলেও তা ইতিহাসের ওপরেই রচিত, রামায়ণও তেমনি অনেকাংশে ঐতিহাসিক কাহিনিকাব্য। তুলনীয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবীচৌধুরানী’, ‘রাজসিংহ’; দ্বৈপায়নের মীরজাফর’, ‘মহারাণা প্রতাপ’, ‘পৃথ্বীরাজ চৌহান’; শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের শাহজাদা দারাশুকো’ ইত্যাদি।
রামায়ণ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের বিরোধের ইতিহাস, রামায়ণ আর্য ও অনার্যের আধিপত্যের ইতিহাস, রামায়ণ শৈবধর্ম ও বৈষ্ণব ধর্মের সংঘাতের ইতিহাস, রামায়ণ উত্তর ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে রাজ্যবিস্তারের ইতিহাস, রামায়ণ অরণ্যচারীদের সঙ্গে কৃষিজীবীদের বিকাশের ইতিহাস–যেভাবেই দেখা হোক না-কেন ইতিহাস নয় কেন? শুধু রামায়ণ কেন–মহাভারত, পুরাণ সবই কাব্যের মোড়কে ইতিহাস তো বটেই। মানুষের সমীহ আদায়ের জন্য, মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য অলৌকিক ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে এবং দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। মানুষ যা পারে না, তাই-ই দেবতারা পারে! তাই মহাভারত-রামায়ণে যখনই অতিশক্তি অলৌকিকতার প্রয়োজন হয়েছে তখনই দেবতার ম্যাজিক উত্থাপন হয়েছে। আসলে এর মাধ্যমে ক্ষত্রিয় আর ব্রাহ্মণদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। ব্রাহ্মণদের ভয় করতে শুরু করেছে বাকিরা। রামায়ণ যতটা না ইতিহাস, তার চেয়ে বেশি অলৌকিক হয়ে উঠেছে। যুক্তিবাদী সত্যসন্ধানীরা রাজহাঁসের মতো দুধ থেকে জল বাদ দিয়ে পান করতে পারলে লাভবান হবেন। ভক্তি থাক বা না-থাক, রামায়ণ ইতিহাসের আকর হয়েই থাকবে।
কবি বা লেখক কেউই সমাজের বাইরের সদস্য নয়, সমাজ বহির্ভূত অলৌকিক কেউ নন। তাই যিনিই লিখুন, যখনই লিখুন তাঁর রচনার সমাজের কিছু চিত্র লিপিবদ্ধ হবে এতে আশ্চর্যের কী আছে! ইতিহাসে অলৌকিক বিষয় লিপিবদ্ধ হয় না, অপরদিকে সাহিত্যে অলৌকিকত্ব লিপিবদ্ধ করার অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে। কোনো সাহিত্যিকের সাহিত্যে বা কাব্যে অলৌকিকত্ব প্রমাণ করার কোনো দায় নেই। কিন্তু ইতিহাস সে দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।
আমাদের যে ইতিহাস জ্ঞান তার সবই বিদেশি ঐতিহাসিকদের থেকে অর্জন করেছি। প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের কোনো ইতিহাস ভারতীয়রা লিখে উঠতে পারেননি। সেই ইতিহাসটা সম্পূর্ণই অন্ধকারে। মুসলমান আক্রমণের আগে ভারতের বহু ইতিহাস পাওয়া যায় না ভারতীয়রা দর্শন, কাব্য, বিজ্ঞান বিষয়ক ভুরি ভুরি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা লিখেছেন, কিন্তু একটিও ইতিহাস লেখেননি। প্রাচীন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ব্রাহ্মণরাই পণ্ডিত ও উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা পরম পিতার ধ্যানেই লিপ্ত থাকতেন। আধ্যাত্মিকতায় বিভোর থাকবেন। এতটাই বিভোর থাকতেন যে, তাঁরা অত্যাবশ্যক ঘটনাগুলি লিপিবদ্ধ করে উঠতে পারেননি। ভারতীয় প্রাচীন ইতিহাস গভীর তমসাচ্ছন্ন ছিল। ম্যাক্রিন্ডল বলেন, গ্রিক ও রোমান গ্রন্থকারের বর্ণনা না-থাকলে তৎকালীন ভারতীয় ইতিহাসের কোনো উপাদানই পাওয়া যেত না। সেলুকাসের দূত মেগাস্থিনিসের ‘ভারতের বিবরণ থেকে আমরা বেশকিছু প্রাচীন তথ্য জানতে পারি। যদিও মেগাস্থিনিসের ইতিহাসে প্রচুর অলৌকিক, উদ্ভট বর্ণনা আছে। সেসব মেগাস্থিনিস কোথায় পেলেন সেটা মেগাস্থিনিসই জানেন। তবে মেগাস্থিনিসের ইতিহাস পাঠ করলেই বোঝা যায়, প্রাচীন যুগে মানুষদের মধ্যে সুপারন্যাচারাল উদ্ভট কাহিনি লেখার সংক্রমণ ছিল। রামায়ণ, মহাভারত, ৩৬টি পুরাণ ইত্যাদি সব কাহিনিই একইভাবে ভয়ানক সংক্রমিত। শুধুমাত্র প্রাচীন যুগেই নয়, মধ্যযুগের অনেকটা সময় পর্যন্ত সুপারন্যাচারাল কাহিনির রমরমা। এমনকি মেগাস্থিনিস, হিউয়েন সাঙ, ফা হিয়েন, ইবনবতুতার গ্রন্থগুলিতে এমনই সব সংখ্য সুপারন্যাচারাল কাহিনি পাওয়া যায়। সেই উর্বর মস্তিষ্কের চাষবাস মানুষ এখনও অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন। মেগাস্থিনিস, হিউয়েন সাঙ, ফা-হিয়েন, ইবান বতুতা, আবুল ফজল, বাণভট্ট, কনুন, বিহুন–এঁরা যাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকতেন, তাঁরা তাঁদের প্রভুদেরই গুণগান লিখে গেছেন অতিরঞ্জিত করে।
যেসব ইতিহাস আর জীবনী নিয়ে আমাদের ইতিহাসজ্ঞান ও ইতিহাসের উপাদান বলে মাথায় করে রেখেছি, সেগুলি মিথ্যাকথন আর অলৌকিকতার সাজানো। প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের শেষদিক পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। হিউয়েন সাঙ তাঁর ভারতভ্রমণ নিয়ে যে গ্রন্থটি লিখেছেন সেখানে কীভাবে অলৌকিকত্ব ও মিথ্যাচার লিপিবদ্ধ হয়েছে, তা একটু দেখে নিতে পারি। হিউয়েন সাঙের ভারত বিবরণ থেকে জানা যায়, হিউয়েন সাঙ ভারতে এলে কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মন তিন-তিনবার নিমন্ত্রণ পাঠালেও হিউয়েন তাঁর রাজ্যে যাননি। হিউয়েন সাঙ যাতে তাঁর রাজ্যে যায়, সেজন্য নালন্দার আচার্য শীলভদ্রের কাছে দু-দুবার দূত মারফত সংবাদ পাঠান ভাস্করবর্মন। কিন্তু খুব শীঘ্রই দেশে ফিরে যাবে এই অজুহাতে হিউয়েন সাঙ না-গেলে, ভাস্করবর্মন ক্ষেপে গিয়ে হুমকি দিয়ে পত্র পাঠিয়ে বলেন, যদি হিউয়েন না-আসেন তবে শশাঙ্ক রাজা যেভাবে বৌদ্ধধর্মের নাশ করেন এবং বোধিবৃক্ষ ধ্বংস করেন তিনিও ওইভাবে সেনা ও হাতি পাঠিয়ে নালন্দা মহাবিহার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন। পাঠক বিশ্বাস করব, নাকি যাচাই করব? আসুন, যাচাই করি–এ ঘটনা ব্রাহ্মণ্যধর্ম বা হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্মের নির্জলা মিথ্যাচার। প্রথমত, একজন বৌদ্ধ শ্রমণের জন্য ভাস্করবর্মণ নালন্দা মহাবিহারই গুঁড়িয়ে দিতে চাইবেন? ভাস্করবর্মন গবেট নাকি? দ্বিতীয়ত, মহাবিহার নিজের রাজ্যে নয়, সম্রাট হর্ষবর্ধনের রাজ্যে। কেউ অন্য রাজ্যে মহাবিহার ভেঙে দিয়ে যাবে, মামদোবাজি নাকি! এছাড়া ধর্মীয় অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী হিউয়েন সাঙ অলৌকিকতার ক্ষেত্রেও কিন্তু কোনোরূপ ত্রুটি রাখেননি তাঁর লেখায়। তিনি যেমন বৌদ্ধ বোধিসত্ব মূর্তি, বুদ্ধমূর্তি, স্তূপ, দেহাবশেষের অলৌকিকত্বের বর্ণনা করেছেন, তেমনই হিন্দু দেবদেবী, বিগ্রহ বা মন্দিরের অলৌকিকত্ব ও মহিমা ব্যক্ত করতে কুণ্ঠিত হননি। তবে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ধর্ম কোন্ অতলে খসে গিয়েছিল, কীরূপ পসরা সাজিয়েছিল, তা এইসব গ্রন্থে অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায়। শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, সব ধর্মগ্রন্থগুলিতেই এইসব চরম অলৌকিকতা সমানভাবে বর্ণিত হয়েছে। ভারতীয় তৎকালীন সমাজ তথাকথিত ধর্মীয় পরিবেশে ধর্মের মহিমা ও মাহাত্ম্য বাড়াতে গিয়ে নানা গালগল্পের আষাঢ়ে গোরুর মতো অতিরঞ্জিত করে ইতিহাসকে বিকৃত করে সত্যকে অতলে তলিয়ে দিতে পিছপা হননি কেউ। পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতও এর বাইরে নয়। মনে রাখতে হবে, প্রাচীন যুগে মানুষ ভারত উপমহাদেশকে ভারত নয়, ‘ব্রাহ্মণের দেশ’ বলেই চিনত।
প্রথম অলৌকিকতামুক্ত ইতিহাস রচিত হয় সম্ভবত ব্রিটিশদের হাত ধরেই। অলৌককতা মুক্ত হলেও মিথ্যাচার অব্যাহতই ছিল। ইংরেজরা ভারতে উপনিবেশ গড়ার পর ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা অলৌকিকতা বর্জন করলেও মিথ্যাচারের পথেই ইতিহাস রচনার ব্রতী হয়েছিলেন। বিশেষ করে উদ্দেশ্যপ্রোণদিতভাবে হিন্দু-মুসলমানের ঘটনা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভুড়িভুড়ি মিথ্যাবর্ণন করে সমাজে বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। তাঁদের শাসনকার্য নিরঙ্কুশ করতেই ‘ভাগ করো, শাসন করো’ (divided and rule policy) প্রয়োগ হল শুরু থেকেই, জাতিকে দুইভাগে ভাগ করে নির্বিঘ্নে ২০০ বছর টিকেছিল এবং জাতিকে দুইভাগ করেই তাঁরা ভারত ছেড়েছেন। যাই হোক, আমরা কিন্তু সেই মিথ্যাচারগুলি বিশ্বাস করি! সেই যে বিদ্বেষের বীজ বপন করে গেছেন তাঁরা, আজ তা বিষবৃক্ষ।
ইতিহাস কাকে বলে? ইতিহাসবিদরা বলেন–ইতিহাস সেটাই, যেখানে বিশেষ রাজবংশ বা ঘটনাবলির নামমালা বা যুদ্ধকৌশলের বর্ণনামাত্র। আমি মনে করি না ইতিহাস বলতে এটুকুই বোঝায়। বরং এই তত্ত্বে বলা যায়, এটা ইতিহাসের সংযোগস্থলমাত্র। কিন্তু ইতিহাসের তো এটুকুই ধর্ম হতে পারে না। হলে তা আংশিক হয়, অর্ধ-ইতিহাস হয়। এই ইতিহাস মানুষের কাজে আসে না, যতক্ষণ-না মানবজীবন বা তৎসমষ্টির উত্থাপন, উন্নতি, অবনতি এবং তার পুনরুদয় ও তৎসহ আনুষঙ্গিক বৃত্তিসমূহ যথার্থ প্রতিকৃতি দ্বারা প্রদর্শিত হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত ইতিহাসও নয়। অনেকে বলে থাকেন, প্রাচীন ভারতের কোনো ইতিহাস নেই। একথা পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান রয়েছে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণগুলিতে। মুনি-ঋষি মহাকবিরা এই কাহিনিগুলিতে গালগপ্পো রচনা করেননি। অলৌকিক ও অ-পার্থিব বর্ণনার সংমিশ্রণে অতিকল্পনার স্বপ্নপূরণে তাঁরা ইতিহাসকেই সংরক্ষণ করে গেছেন। রামায়ণকে কেবল কল্পনা-কাব্য বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আখ্যানময় ইতিহাসের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানময় ইতিহাসে প্রবেশার্থে সচ্ছল পথস্বরূপ। এইসব রচনায় অ-জাগতিক বর্ণনা উপস্থিত থাকলেও ইতিহাস নয় একথা বলা যায় না। সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস নয় ঠিকই। কোন্ প্রাচীন ইতিহাসই-বা সর্বাঙ্গীণ! গ্রিসের প্রাচীন ইতিহাস, মিশরের প্রাচীন ইতিহাস, রোমের প্রাচীন ইতিহাসকে সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস বলা যায়? অতিরঞ্জন ও অতিকথন কি নেই? ইউরোপীয়রা যদি ট্রয়ের যুদ্ধকে ইতিহাস পদবাচ্য করে তৃপ্তিসাধন করতে পারে, তবে আমরা কেন রাম-রাবণের যুদ্ধকে, কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধকে কালনির্ণয়পূর্বক ইতিহাস বলে মেনে নিতে দ্বিধান্বিত হব।
অতিরঞ্জিত, অতিকথন, অতিশোয়াক্তি, দেবতারোপ, অধ্যাত্মবাদ তথা সুপারন্যাচারাল বিষয়গুলি দূরে সরিয়ে রাখলে রামায়ণের ইতিহাস হয়ে উঠতে বাধা কোথায়? একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে–রামায়ণ মূলত শিববিদ্বেষী আর্যদের (শ্রীরামচন্দ্র) সঙ্গে শিবভক্ত অনার্যদের (রাবণ) বিরোধের ইতিহাস। প্রাবন্ধিক হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলছেন–“হরধনুতে জ্যা আরোপণ করতে যে সক্ষম হবে অর্থাৎ শিবভক্ত অনার্যদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম ব্যক্তির হস্তেই তিনি নিজ কন্যা তথা এই কৃষিবিদ্যা সমর্পণ করবেন, এটাই ছিল রাজা জনকের সংকল্প।” দক্ষিণ ভারতে শ্রীরামচন্দ্র কৃষিকার্যের বিস্তার করেছেন এমন কোনো কোনো প্রমাণ বাল্মীকি রামায়ণে নেই। ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের অনেক উপাদান রামায়ণ, মহাভারতে কখনো রূপক হিসাবে কখনো-বা সরাসরিই পাওয়া যায়। প্রাগৈতিহাসিক, অনৈতিহাসিক সমস্ত লুপ্ত ইতিহাস উদ্ধারের জন্য পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণের উপর নির্ভর করতেই হয়। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণগুলিতে ভারতের অনেক লুপ্ত ইতিহাস আলোকিত হয়েছে। শুধু রামই নয়, রাম সহ রামায়ণের অন্যান্য চরিত্রগুলিও সমান ঐতিহাসিক। হ্যাঁ, অতিরঞ্জিত হয়েছে কোথাও কোথাও। হতেই পারে, ইতিহাসে অতিরঞ্জন তো হয়ই। ঐতিহাসিক রচিত্র চন্দ্রগুপ্ত, অশোক, আকবর, ঔরঙ্গজেব, বুদ্ধ, মোহম্মদ, জিশু, শাহজাহানের ইতিহাস কি অতিরঞ্জিত হয়নি! এরা যথার্থ ইতিহাস হলে রাম রাবণ-সীতা নয় কেন? বস্তুত বাল্মীকির রামায়ণ (অন্য কোনো রামায়ণ নয়) আর্য সাম্রাজ্যবাদীদের দাক্ষিণাত্যে ও সাগরপারে দক্ষিণী দ্বীপ লঙ্কাবিজয়ের কাব্যরূপ ইতিকথা। এর সঙ্গে অলৌকিক অপার্থিব দেবদেবতাদের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাচীন যুগে রাজা ও পুরোহিত সম্প্রদায়কে জগৎ-স্রষ্টার সমকক্ষ ভাবা হত, ভাবানো হত। তা ইতিকথা আর নির্জলা ইতিহাস হয়ে যায়। সময়ান্তরে অবয়বে জমতে থাকে রূপকথার শ্যাওলা। সেই রীতি অনুসারে ইতিহাসের সঙ্গে রূপকথার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে রামকথার কথকরা পরবর্তীকালে রাজা রামচন্দ্রকে ঈশ্বরের অবতার এবং কালক্রমে স্বয়ং ঈশ্বররূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাল্মীকি, বেদব্যাসরা তাঁরা তাঁদের মহাকাব্যে কোনো সত্যই গোপন করেননি। গোপন করেছি আমরা, সুবিধাবাদী ধান্ধাবাজেরা। বাল্মীকির রামায়ণকে অবমাননা করে অগ্রাহ্য করে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে চলেছি। সত্য সামনে এসে পড়লেই মারমুখী। বাল্মীকি, বেদব্যাসরা সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছেন, ন্যায়কে ন্যায়, অন্যায়কে অন্যায় বলেছেন। ঘোঁট পাকাচ্ছি আমরা, আমরা মানে ভণ্ড ধার্মিকেরা। বেশি ভক্তিরস দেখাতে গিয়ে ইতিহাসকেই অস্বীকার করে ফেলছি, সত্যকে অস্বীকার করছি। প্রাবন্ধিক হিসাবে আমি বলব–মূল সংস্কৃত ভাষায় লেখা বাল্মীকির রামায়ণ পড়ন। সংস্কৃত ভাষা যাঁরা জানেন না, তাঁরা হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনূদিত বাংলা ভাষায় রামায়ণ পড়ুন। পণ্ডিতপ্রবর হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় তাঁর অনুবাদ গ্রন্থটিতে বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণের মূলানুসারী অনুবাদক্রিয়ায় অসাধারণ কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। একদিকে তিনি যেমন মূল রামায়ণের প্রতিটি তথ্যকে যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন বাংলা প্রতিশব্দের মাধ্যমে, তেমনি অপরদিকে মহাকাব্যকে উপমা অলংকার সংবলিত বিরাট রসৈশ্বর্যটিকেও অবিকৃতভাবে পরিবেশন করেছেন। কোথাও ন্যূনতম সংযোজন ও বর্জন করার ধৃষ্টতা দেখাননি। তাঁর অনূদিত রামায়ণ অনেক চিরাচরিত ভুল ধারণারও নিরসন হয়েছে। আমার গ্রন্থের মূল হাতিয়ারই হল হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের রামায়ণ।
বীরেন্দ্র মিত্র তাঁর ‘রামায়ণে দেবশিবির’ গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেন–“ধর্মাধর্মের সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত রামকথায় প্রতিভাসিত হয়েছে যে আশ্চর্য পুরাবৃত্ত, সেটি যেমন রাবণের তেমনিই আবার রামচন্দ্রেরও করুণ পরিণতির ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আর্য দেববাহিনী এবং ব্রহ্মাবাদী ব্রাহ্মণদের চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও নিষ্ঠুরতা তদানীন্তন ভারতবর্ষে যে ভয়াল এক রাষ্ট্রব্যবস্থার পত্তন করেছিল, উত্তরকাণ্ড সহ বাল্মীকি রামায়ণে তারই পর্বানুক্রমিক চিত্ৰণ অনুসন্ধিৎসু পাঠককে অভিভূত করে। রামায়ণ সম্পর্কিত বিভ্রান্তির মূলে আছে রামস্তুতিমূলক বাজার-চালু রামচরিতগুলি–সাধারণ্যে সেই নবরূপায়িত কল্পিত কাহিনিমালাই রামায়ণ’ নামে প্রচলিত, কিন্তু সেগুলির কোনোটিই প্রকৃত রামকথা নয়, প্রাচীন পুরাবৃত্তের অপব ঘটিয়ে এই স্তবকুসুমাঞ্জলি বিরচিত। ঐ সব গ্রন্থে ইতিহাস অবলুপ্ত হয়েছে উপন্যাসের কথা-আবর্জনার তলায়। রামচন্দ্রের জীবনাবসানের কয়েক সহস্রাব্দ পরে গ্রন্থিত হয় বাল্মীকি রামায়ণ। আবার সেই আদি মহাকাব্য বিরচিত হওয়ারও কয়েক শতক পরে হয়েছিল রামচন্দ্রের অবতারি প্রতিষ্ঠা। তৎপরবর্তী আমলে যথেচ্ছ ভক্তিমূলক প্রক্ষিপ্ত রচনার দ্বারা সম্ভবত মূল রামকথায়ও বিকৃতি ঘটতে শুরু করে। যে আগ্রাসী ব্রাহ্মণরা ক্ষমতা লালসায় অযোধ্যাকে শ্মশান বানিয়ে দীর্ঘকাল রামের পিতৃরাজ্যকে জনশূন্য করে রাখেন, সেই ব্রাহ্মণনেতৃত্বেরই পাহারাদার দুর্বুদ্ধিজীবী মতলবী ব্রাহ্মণ কথকরা পুনরায় রামকে ভগবান বানিয়ে এককালে ব্রাহ্মণ্যশোষণের বনিয়াদটি পাকাঁপোক্ত করে নেন।”
রামায়ণের ভিতরে ঢোকার আগে স্পষ্ট করে বলে নিতে চাই–কৃত্তিবাস, রঙ্গনাথন, তুলসীদাস রচয়িতাদের ভক্তিরসে ভোবানো রামায়ণ বা রামকথা যথার্থ রামায়ণ নয়। সেইসব রামায়ণ নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ বাল্মীকি বিরচিত রামায়ণেই। হতাশ হবেন না, কোথাও কোথাও আঞ্চলিক অন্য কবিদের রূপকথাগুলি উল্লেখ করেছি তুলনামূলক সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য তুলে ধরার জন্য। ইতিহাসের সন্ধানে আমি বাল্মীকির রামায়ণেই থাকব। বাল্মীকির রামায়ণ কি কিংবদন্তি, না মিথ? বাল্মীকির যে রামায়ণটি আমরা পাই, সেটির সম্পূর্ণ অংশ কিংবদন্তি নয়। আবার সম্পূর্ণ অংশ মিথও নয়। আদি বাল্মীকি বিরচিত অযোধ্যাকাণ্ড থেকে যুদ্ধকাণ্ড এই পাঁচটি কাণ্ড কিংবদন্তি। প্রক্ষিপ্ত রচনা বালকাণ্ড বা আদিকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড দুটিকে আংশিক কিংবদন্তি বলাই যায়। কিংবদন্তি হল সেটাই, যা–(১) এই ধরনের কাহিনিতে মানুষের কর্মকাণ্ড ও শক্তির উপর বেশি আরোপ করা হয়। মানুষ হল কিংবদন্তি কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র, এক অসামান্য ব্যক্তিচরিত্র এবং তাঁর কার্যাবলিই কিংবদন্তির বিষয়বস্তু। (২) কিংবদন্তি কাহিনিগুলিতে ঐতিহাসিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ভিত্তি থাকে। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভৌগোলিক বিবরণ থাকে। কোনো একটি বিশেষ অঞ্চলের সংস্কার, সামাজিক রীতিনীতি, লোকাঁচার, লোকবিশ্বাসের উপর করে গড়ে ওঠে। (৩) সম্পূর্ণ যথার্থ না-হলেও বর্তমান সময়ের ভিত্তিতে কিংবদন্তির ঘটনাগুলির একটি আনুমানিক কালপঞ্জি থাকে। (৪) কিংবদন্তির গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে সহায়ক উপাদান হিসাবে বিভিন্ন কাল্পনিক উপাদানকে ব্যবহার করা হয়। অপরদিক মিথ হল সেটাই, যা–(১) এই ধরনের কাহিনিতে ঈশ্বর বা দেব-দেবতাদের কর্মকাণ্ড ও শক্তির উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এই কাহিনিগুলিতে অলৌকিক জগতের ঈশ্বর বা দেব-দেবতারাই নায়িকা। (২) মিথের কাহিনিগুলি মূলত ধর্মভিত্তিক, ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় সংস্কার, ধর্মীয় রীতিনীতি, পুজো-প্রার্থনা, ধর্মোৎসব, উপাচার ইত্যাদির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। (৩) মিথে বর্তমান সময়ের নিরিখে ঘটনাভিত্তিক ধারাবাহিক সময়কালের উল্লেখ বা কালপঞ্জি থাকে না। (৪) মিথে ব্যক্তি বা ঘটনার সঠিক কোনো প্রমাণ বা ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকে না। ভিত্তি থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বল হয়। যেমন–হিন্দু পুরাণোক্ত সৃষ্টির পর পৃথিবী একটি কচ্ছপের মাথার উপর অবস্থান করত। কিংবা ক্ষুধার্ত হনুমানের সূর্যকে ফল ভেবে খাওয়ার জন্য লাফ দেওয়া, বাইবেলে নোয়ার কাহিনি, রোমের রোমুলাসের জীবনকাহিনি ইত্যাদি। (৫) মিথের গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পিছনে সহায়ক উপাচার হিসাবে উপমার ব্যাপক করা হয়। কিংবদন্তিতে বাস্তব চরিত্রে কাল্পনিক রূপ পায়, মিথের সব চরিত্রই কাল্পনিক।
রামায়ণ ও মেঘনাদবধ কাব্যের প্রেক্ষাপট এবং রামায়ন ও মেঘনাদবধ কাব্যের সামাজিক ও ঐতিহাসিক গ্রহনযোগ্যতা টা দিলে উপকৃত হতাম।