ভরত : সুচতুর, সাবধানী, দক্ষ রাজনীতিক
রামচন্দ্রের দ্বিতীয় ভাই ভরত, কৈকেয়ীর সন্তান। দশরথের বৃদ্ধ বয়সের বউ কৈকেয়ী। কবি বলেছেন–
“স বৃদ্ধস্তরুণীং ভার্যাং প্রাণেভ্যোহপি গরীয়সীম”।
ভরত রাজা জনকের ভাই কুশধ্বজের কন্যা মাণ্ডবীকে বিবাহ করেন।
কৃত্তিবাস, তুলসীদাস, রঙ্গনাথন প্রমুখ কবিদের রামায়ণে ভরত যেন সাক্ষাৎ ভ্রাতৃভক্তির পরাকাষ্ঠা। তিনি দাদার খড়ম মাথায় করে এনে ভগ্নহৃদয়ে অযোধ্যায় ফিরেছেন! ফিরে তিনি রাজসিংহাসনে উপবিষ্ট হননি, রাজসিংহাসনে দাদার খড়মজোড়া রেখে রাজ্যশাসন করেছেন। নিজে কখনোই সেই রাজসিংহাসনে উপবিষ্ট হননি। ব্যস, এইটুকুতেই বাজিমাত। এইটুকুতেই ভরতের ভাতৃভক্তির চরম নিদর্শন হয়ে গেছে মানবসমাজে। গোটা রামায়ণে আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই ভরতের। একেই বলে সেন্টিমেন্ট, এই সেন্টিমেন্ট বাঙালিকুল সবটাই আত্মস্থ করে নিয়েছে।
বাল্মীকি রামায়ণে কিন্তু ভরতকে এক ভিন্নরূপে পাওয়া যায়। বাল্মীকির রামায়ণে ভরতের কতটুকু ভ্ৰাতৃভক্তি আছে সেটা পাঠকই বিচার করুন। রামচন্দ্রের বিয়ে করার কয়েকদিন পর দশরথ ভরতকে মাতুলালয় কেকয় দেশে পাঠিয়ে দিলেন বায়ো বছরের জন্য। এই দীর্ঘ বারো বছরের একবারের জন্যেও ভরতের মুখদর্শন করেননি দশরথ। এই বারো বছরে অযোধ্যায় তোলপাড় হয়ে গেল, বয়ে গিয়েছে অনেক জল–ভরত কিছুই জানতে পারেনি। মাতা কৈকেয়ী দশরথের কাছ থেকে রামের চোদ্দো বছর বনবাস এবং ভরতের রাজ্যলাভের বর চেয়ে নিলেন। কোনো বরই দশরথ কৈকেয়ীকে না-দিলেও রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা স্বেচ্ছায় চলে গেলেন। দণ্ডকারণ্যে। যেভাবেই হোক, রামের বনবাসের ষষ্ঠদিনে দশরথের মৃত্যু হয়। দশরথ তাঁর জীবদ্দশায় ভরতকে রাজা করার ব্যাপারে কোনোরূপ উদ্যোগ নেননি। কারণ দশরথ কখনোই চাননি ভরত রাজা হোক। তাই কেকয় রাজ্য মাতুলালয় থেকে ভরতকে ফিরিয়ে আনারও কোনো বন্দোবস্ত তিনি করেননি।
দশরথের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ তেলভরতি বড়ো পাত্রে সংরক্ষণের জন্য রাখা হল। কারণ এখনই মৃতদেহ সৎকার সম্ভব নয়। পিতার মৃতদেহ সৎকারের দায়িত্ব যেহেতু পুত্রদের উপর বর্তায়, পুত্ররা যখন কেউই অযোধ্যায় নেই, তখন সংরক্ষণ ছাড়া অন্য উপায় কী! এমতাবস্থায় ঋষি মার্কণ্ডেয়, বামদেব, গৌতম, মৌদগল্য, কাশ্যপ, প্রমুখ ব্রাহ্মণেরা বৈশিষ্ঠকে পৌরহিত্য করে এক জরুরি বৈঠকে বসলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন ভরতকে রাজপদে নিযুক্ত করা হবে। দশরথের অবর্তমানে ভরতকে রাজা করতে দৃঢ়সংকল্প বশিষ্ঠই। বশিষ্ঠের নির্দেশে ভরতকে অযোধ্যায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা হল। ভরত অযোধ্যায় ফিরে এসে অনুভব করে পরিস্থিতি সুবিধার নয়, চারদিক থমথমে ভাব। কেউ তাঁকে সম্ভাষণ জানাচ্ছেন না। কিন্তু কেন এমন মরা-বাড়ি হয়ে আছে। অযোধ্যাপুরী! ভরত কিছুই জানে না, কিছুই জানানো হয়নি তাঁকে। অযোধ্যায় আসার অনেক পর ভরতকে পিতার মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়। তাঁকে রাজা করার বন্দোবস্ত হচ্ছে বুঝতে পেরে বললেন–“আমি রাজ্য কামনা করি না এবং গ্রহণার্থ জননীকেও প্রেরণ করি নাই।”
অতঃপর বশিষ্ঠ ভরতের পিতার প্রেতকৃত্য সাধনে তৎপর হলেন। গোপন করলেন দশরথের মনোবা। দশরথ ভরতকে ত্যজ্যপুত্র করেছেন, কৈকেয়ীকে বলেছেন–“আমার ঔরসজাত পুত্র তোর ভরতকে পরিত্যাগ করিলাম।” কেড়ে নিয়েছেন পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মের অধিকার, বলেছেন–“আমি মরিলে রামই সমস্ত উপকরণ লইয়া আমার অন্ত্যোষ্ঠি ক্রিয়া করবে। এই বিষয়ে ভরত ও তোর কিছুতেই অধিকার থাকবে না।”
না, দশরথের কথা রাখা হয়নি। বশিষ্ঠরাও এই ব্যাপারটায় একেবারেই পাত্তা দেননি। অতএব দশরথের মৃত্যুর ত্রয়োদশ দিবসের মধ্যে দশরথের অগ্নিসংস্কার ও বিভিন্ন পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন হয়ে গেল। বশিষ্ঠের ব্যবস্থাপনাতেই সম্পন্ন হল। করলেনও ভরত, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও।
পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম তো হলই। এবার হাতে রইল অযোধ্যার সিংহাসন। ভরত অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি। হঠকারিতা তাঁর কোষ্ঠীতে লেখা নেই। ভরত বিলক্ষণ জানেন রাজসভার অমাত্যদের মধ্যে বেশিরভাগই রামের অনুরাগী। রামের দণ্ডকারণ্যে নির্বাসনে চলে যাওয়াটা তাঁরা মেনে নিতে পারেননি। সব মিলিয়ে অযোধ্যার রাজসভা থমথম করছে। তাঁদের আগে নিজের দলে টানতে হবে। ধপাস করে সিংহাসনে বসে গেলেই তো হল না! অতএব ফন্দির বিকল্প নেই। যিনি রাজা হতে চলেছেন তাঁর ফন্দি থাকবে না, বিশেষ করে যাঁর রাজা হওয়ার অধিকার নেই! অতএব দশরথের মৃত্যুর চতুর্দশ দিনে ভরত সকলের মুখোমুখি হলেন, যাঁরা বিচক্ষণ। মানুষ এবং ঘোষণা দিলেন–
“আর্য রাম আমাদিগের জ্যেষ্ঠ, অতঃপর তিনিই রাজা হইবেন, আর আমি গিয়া অরণ্যে চতুর্দশ বৎসর অবস্থান করিব; এক্ষণে চতুরঙ্গ সৈন্য সুসজ্জিত করো, আমি স্বয়ং বন হইতে রামকে আনয়ন করিব।”
বর্ণে বর্ণে চাতুরতা, অতএব বাজিমাত। লক্ষ করুন, তিনি বললেন–এক, তিনি স্বয়ং চোদ্দো বছর বনবাস যাপন করবেন এবং দুই, রামকে ফিরিয়ে এনে অযোধ্যার সিংহাসনে বসাবেন। তা রামকে ফিরিয়ে আনতে চতুরঙ্গ সেনাবাহিনীর প্রয়োজন কী? যুদ্ধ নাকি? চতুরঙ্গ সেনাবাহিনী তো যুদ্ধের কাজেই ব্যবহৃত হয়! তাহলে এ যুদ্ধ কার বিরুদ্ধে? ভরতের চোদ্দো বছর বনবাসযাপনই-বা কোন্ কারণে? দুটো প্রস্তাবই অবাস্তব, কিন্তু কার্যকারিতা আছে। রাজসভার বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ তথা প্রজাদের চিত্ত নিজের পক্ষে অনুকূল করে নেওয়া মসৃণ হল।
চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনি নিয়ে অরণ্যপথে যেখান-সেখান দিয়ে তো নিয়ে যাওয়া যায় না! শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। দীর্ঘদিন ব্যয় করে যাত্রাপথ উঁচুস্থান ভেঙে সমতল করে ফেলা হল। যেখানে যত গর্ত খানাখন্দ, সেখানে ভরাট করা হল। তৈরি হল নতুন রাস্তা, নির্মাণ হল সেতু। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে যেখানে যত বাধা সব সরিয়ে ফেলা হল। যখন এসব কর্মকাণ্ড চলছে, তখন বশিষ্ঠও বসেছিলেন না। তিনি বসে থাকার মানুষও নন। সময় বা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে তিনি জানতেন। একদিকে ভরত যখন রামের কাছে পৌঁছোতে পথ তৈরির কাজে ব্যস্ত, অপরদিকে বশিষ্ঠ ভরতের অভিষেক ক্রিয়ার আয়োজন করতে ব্যস্ত। তিনি দূতদের জানালেন–
“দেখো, তোমরা এক্ষণে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, অমাত্য, সেনাপতি ও যোদ্ধাদের সহিত ভরত শত্ৰুগ্ন ও অন্যান্য রাজপুত্র এবং যুধাজিৎ, সুমন্ত্র ও অপরাপর হিতকারী ব্যক্তিকে শীঘ্র আনয়ন করো। বিলম্বে বিঘ্ন ঘটিতে পারে এমন কোনো কার্য উপস্থিত হইয়াছে।”
দশরথ ভরতকে রাজ্য প্রদান করেছে কি না সে ব্যাপারে কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করলেন না বশিষ্ঠ।
তিনি ভরতকে বললেন–
“এক্ষণে তুমি অভিষিক্ত হইয়া পিতা ও ভ্রাতার প্রদত্ত রাজ্য নির্বিঘ্নে উপভোগ করো। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দেশের রাজাগণ ও দ্বীপবাসী ও সামুদ্রিক বণিকেরা তোমায় দিবার নিমিত্ত অসংখ্য ধনরত্ন আনয়ন করুক।”
ভরতের অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে গেল রাম ফেরার আগেই। ভরত রাজা হলেন রামকে ফিরিয়ে আনার আগেই। রাজা হয়ে ভরত চললেন রামের খোঁজে। সঙ্গে চললেন নানাবিধ যুদ্ধাস্ত্রধারী রথী, শস্ত্রধারী বীরপুঙ্গব, মন্ত্রী ও পুরোহিতেরা। চলল অসংখ্য হাতি ও ঘোড়া। যেন মনে হচ্ছে রাজা ভরত কারোর বিরুদ্ধে করতে যাচ্ছেন।
সৈন্যদের কোলাহল, হাতি-ঘোড়ার পদশব্দ আর গর্জনে লক্ষ্মণ সতর্ক হয়ে গেলেন। অন্বেষণে লক্ষ্মণ অনুমান করলেন ভরত সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসেছেন। রাম ও সীতা তখন দগ্ধ মৃগমাংস ভোজনে ব্যস্ত ছিলেন। লক্ষ্মণ তৎক্ষণাৎ রামকে বললেন–
“আর্য, এক্ষণে অগ্নি নির্বাণ করিয়া ফেলুন, জানকী গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হউন। আর আপনি বর্ম ধারণ, কামুকে জ্যা আবোপণ ও শর গ্রহণ করিয়া প্রস্তুত হইয়া থাকুন।… কৈকেয়ীর পুত্র ভরত অভিষিক্ত হইয়া রাজ্য নিষ্কণ্টক করিবার বাসনায় আমাদের নিধন কামনায় উপস্থিত হইয়াছে।..যাহার নিমিত্ত আপনি রাজ্যচ্যুত হইলেন, এক্ষণে সেই শত্ৰু উপস্থিত হইয়াছে। সে আমাদের বধ্য, তাহাকে বধ করিতে আমি কিছুমাত্র দোষ দেখি না।… ভরতকে সসৈন্যে নিহত করিয়া অদ্য শর-কামুকের ঋণ পরিশোধ করিব।”
লক্ষ্মণ ক্রোধী, রাম নয়। প্রথমত সৈন্যবাহিনী ভরতরই কি না তা এখনও জানা যায়নি। দ্বিতীয়ত ভরত না-হয়ে যদি অন্য কেউও হয় এই বিপুল সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুঝা এতটা সহজ নয়। অতএব এমতাবস্থায় রাম লক্ষ্মণকে ক্রোধ থেকে বিরত থাকতে বললেন। ভরত এখন সসৈন্যে চিত্রকুটে। সৈন্যদের দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে রাম লক্ষ্মণের মুখোমুখি। পথে রাজপোশাকে থাকলেও চিত্রকুটে রামের পর্ণকুটিরে প্রবেশের আগে বেশভূষা বদলে চীরবল্কল, কৃষ্ণাজিন পরিহিত জটাভার সংবলিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভরত রামের পায়ের নীচে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। এরপর ভরত পিতা দশরথের মৃত্যুসংবাদ, সেইসঙ্গে নিজেকে ‘দাস’ ঘোষণা করে রামকে রাজ্যভার গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলেন। রাম জানিয়ে দিলেন পিতার প্রতিজ্ঞার কারণে তাঁর ফিরে না-যাওয়ার কথা। পিতৃসত্য পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাম অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনে অসম্মত হলেন এবং বললেন তোমার দাদু কেকয়রাজ অশ্বপতির কাছে পিতা দশরথ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন যে আমাদের মাতা কৈকেয়ীর গর্ভে যে সন্তান। হবে তাঁকেই তিনি রাজ্য সমর্পণ করবেন–
“পুরা ভ্রাতঃ পিতা নঃ স মাতরং তে সমুদবহন।
মাতামহে সমাশ্রৌষীদ রাজ্যশুল্কম্ অনুত্তমম্।”
এমনকি বনবাসযাপন পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর তিনি অযোধ্যায় ফিরবেন না একথাও তিনি জানিয়ে দেন। রামের প্রশংসাপূর্বক ভরত বারবার রামকে অযোধ্যায় ফেরার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন।
ভরত বিলক্ষণ জানতেন রাম ফিরবেন না। ফিরলে বিনাবাক্যব্যয়ে বিনাদ্বন্দ্বে তিনি অযোধ্যা ত্যাগ করতেন না। তবুও ভরত কোনোরূপ ঝুঁকি নেননি। সত্যিই যদি ভরতের অনুরোধে রাম সত্যিই ফিরে আসেন, সেই অপ্রীতিকর সম্ভাবনা নিকেশ করার জন্য চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনীর আয়োজন। রামের সৌভাগ্য যে রামও অযোধ্যায় ফিরতে চাননি, না-হলে ভরত সেদিনই রামকে চিত্রকুটেই খবর করে দিতেন, অযোধ্যায় আর আসতে হত না। অনুরোধ আর অনুরোধ পর্ব শেষ হলে রামের আজ্ঞানুসারে অযোধ্যায় ফিরে যেতে ও রাজ্যশাসনে সম্মত হলেন এবং রামের পাদুকা প্রার্থনা করলেন। বললেন–
“আপনি পদতল হইতে এই কনকখচিত পাদুকাযুগল উন্মুক্ত করুন, অতঃপর ইহাই লোকের যোগক্ষেম বিধান করিবে।”
রামও ভরতের অনুরোধ রেখে পাদুকাযুগল ভরতকে দিলে ভরত রামকে প্রণাম করে পাদুকা গ্রহণ করলেন এবং বললেন–
“আপনার প্রতীক্ষায় চতুর্দশ বৎসর নগরের বহির্দেশে বাস করিব। পঞ্চদশ বৎসরের প্রথম দিবসে যদি আপনার দর্শন না পাই, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমায় হুতাশনে আত্মসমর্পণ করিতে হইবে।”
এরপর রামের পাদুকাদুটি নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে আসেন এবং নির্বিবাদে, নিঃঝঞ্ঝাটে দাবিহীন, নিষ্কণ্টক সিংহাসনে দাদার পাদুকা রেখে দীর্ঘ চোদ্দো বছর রামের নামে রাজত্ব করে গেলেন। তবে দশরথ শাস্তি দিয়েছেন ভরতকে, ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন ভরতকে–“সন্ত্যজামি স্বজঞ্চৈব তব পুত্রং ত্বয়া সহ।” একটাও যুদ্ধটুদ্ধ করতে হয়েছে বলে শুনিনি। দাদার পাদুকা বহন করে রাজত্ব চালানো ছাড়া আর কোনো গুরুত্বই নেই। বিমাতা কৌশল্যাও ভরতকে বিশ্বাস করেননি, সেটা তিনি গোপন রাখেননি–
“জহ্যাদ রাজ্যঞ্চ কোষঞ্চ ভরতো নোপলক্ষ্যতে।… তথাহাত্তমিমং রাজ্যং হৃতসারাং সুরামিবা নাভিমন্তুমলং রামো নষ্টসোমমিধ্বর।”
অর্থাৎ, “রাম যদি বনবাসের পর ফিরে আসেও ভরত তাঁকে রাজ্য, রাজকোশ কিছুই ফেরত দেবে বলে মনে হয় না।… যে মদের সারবস্তু খাওয়া হয়ে গেছে, যে যজ্ঞে সুরা বা মদ (সোমরস) বিনষ্ট হয়ে গেছে, সেইরকম রাজ্য নিয়ে রাম কী করবে? ভরত প্রসঙ্গে সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রামায়ণের সমালোচনা’ নিবন্ধে লিখেছেন–“অসভ্য মূর্খ ভরত। আপন হাতে রাজ্য পাইয়া ভাইকে ফিরাইয়া দিল। ফলতঃ রামায়ণ অকৰ্ম্মা লোকের ইতিহাসেই পূর্ণ। ইহা গ্রন্থকারের একটি উদ্দেশ্য।”
ভরত এখন কেবল রামের ভাই নয়, তিনি এখন রাজা। ভরত ভাই হলেও রাম তাঁকে বিশ্বাস করতে পারেননি। লক্ষ্মণও বিশ্বাস করেন না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিত্রকুট ছেড়ে দণ্ডকারণ্যের গভীর অরণ্যে চলে গেলেন। কারণ রাম ভেবেছিলেন বাকি দিনগুলিতে চিত্রকুটেই থেকে যাবেন। তাই চিত্রকুট পর্বতেই বাসগৃহ নির্মাণ ও বাস্তুশান্তি করেছিলেন। কিন্তু চোদ্দো বছরের মধ্যে একটিবারের জন্যেও রাম, লক্ষ্মণ, সীতার খোঁজ করেননি ভরত। চোদ্দো বছর পর আরও মাস আটেক অতিক্রান্ত হয়েছিল, তখনও কোনো উৎকণ্ঠা দেখা যায়নি ভরতের মধ্যে। শ্বাপদসংকুল রাক্ষস অধ্যুষিত দণ্ডকারণ্যে থেকে কারোর পক্ষেই ফিরে আসা সম্ভব নয়। ভরতও সেটাই মনে করে নিশ্চিন্তেই ছিলেন। তাই খোঁজখবর নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তা ছাড়া গভীর অরণ্যে প্রবেশের পর নানাবিধ বিপদের মধ্যে পড়লেও রাম বা লক্ষ্মণের একবারের জন্যেও ভরতকে মনে পড়েনি, তাঁর সশস্ত্র সাহায্যও তাঁরা কামনা করিনি৷
ভরত স্বপ্নেও কখনো ভাবতে পারেননি যে, রাম কোনোদিন দণ্ডকারণ্য থেকে ফিরবেন বা ফিরতে পারবেন। ভেবেছিলেন রাক্ষসখোস কিংবা হিংস্র জন্তুর পেটে চলে যাবে। তার উপর রাম নিজের মুখেই বলেছেন, তিনি আর কখনোই অযোধ্যায় ফিরবেন না–“ভরত! পিতা স্বর্গারোহণ করিয়াছেন, এক্ষণে আমি অযোধ্যায় গিয়া কী করিব? …এক্ষণে বনবাস অতিক্রান্ত হইলেও আমি আর সেই নিরাশয় বহুনায়ক অযোধ্যায় যাইব না”। রামের এহেন জবাবে ভরত খুশি হলেন। বলপ্রয়োগ নয়, বলপ্রদর্শনেই কাজ হল। এবার সাপ মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। পাদুকা সিংহাসনে রেখে রাজ্যশাসন করলে প্রজারাও ভরতকে ভুল বুঝবেন না, আবার নিজের রাজা হওয়ার স্বপ্নটাও পূরণ হবে। ভরত বিলক্ষণ জানেন, পাদুকা বা খড়ম কখনো রাজ্যশাসন করে না। খড়ম কেবল ভেকমাত্র। আই ওয়াশ! বিচক্ষণ ভরত জানতেন রাজা হয়ে বসে পড়া আর প্রজাদের মনোরঞ্জন করা এক জিনিস নয়। যে রাজ্যের জন্য রামের বনবাস, সেই রাজ্যের দখলি-সত্ত্ব তাঁর নিজের হাতে থাকলে রামভক্ত প্রজাদের মুখের উপর সেই রাজ্য প্রেমানন্দে ভোগ করা মোটেই সম্ভব নয়। তাই এত ফন্দিফিকির!
চোদ্দো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর নানা ঘাতপ্রতিঘাতে উত্তীর্ণ হয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর মতো রামও বদলে গেলেন। লঙ্কাকাণ্ড তথা রাবণ বধেরই শেষে রাম যখন বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে অযোধ্যায় ভরতের মুখোমুখি হন ভুত দেখার মতো ভরত অজ্ঞান হয়ে যান। ভরত ভেবেছিলেন রাম হয়তো এবার তাঁকে হত্যা করে অযোধ্যায় সিংহাসনে বসবেন। ভাবাটাও অমূলক নয়। বেগড়বাই করলে রাম অবশ্যই ভারতকে হত্যা করতেন, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। লঙ্কাযুদ্ধে সবে ব্যাপক হত্যালীলা সাঙ্গ করে এসেছেন। তাঁর হাত দুটো রক্তে লাল হয়েছে। চোখে এখন তাঁর রক্তের নেশা। সিংহাসন ছেড়ে না-দাঁড়ালে ভরত অবশ্যই রামের হাতে হত্যা হয়ে যেতেন। ভরত বিচক্ষণ, দূরদর্শী, পোড়খাওয়া–অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে রামকে রাজ্যভার সব বুঝিয়ে দিলেন। লক্ষ্মণের ছেড়ে দেওয়া যুবরাজের পদটা ভরত পেলেন বটে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অযোধ্যা ছেড়ে চলে যেতে হল রাজা রামের আদেশে। রাম বুঝিয়ে দিয়েছেন আরামের দিন শেষ। এবার খুঁটে খাও। রাজ্য মুফতে পাওয়া যায় না, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাজা হওয়া যায় না। রাজা যদি হতে চাও রক্ত ঝরাও, ঘাম ঝরাও। মরো, না-হয় রাজ্যভোগ করো। গন্ধর্বদেশে গিয়ে গন্ধবদের সঙ্গে তুমূল যুদ্ধ করে ভরত নিজের রাজ্য কায়েম করতে হয়েছিল। একবারের জন্যেও তিনি আর অযোধ্যায় ফিরে আসেননি। তবে উত্তরকাণ্ডের শেষ দিকে ভরতকে দেখা গিয়েছিল রামের সঙ্গে সহমরণে যাত্রার সময়। ভরতের দুই পুত্র–তক্ষ ও পুষ্কল। তক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রাচীন ভারতের শিক্ষার পীঠস্থান তক্ষশিলা, যা ছিল সিন্ধু নদের পূর্বপ্রান্তে। এই তক্ষশিলা দিয়েই ভারতে প্রবেশ করেছিলেন আলেকজান্ডার। পুষ্কল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পুষ্কলাবতী নগর, যা সিন্ধু নদের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। অর্থাৎ ভরতের দুই ছেলে সমগ্র সিন্ধ নগরের সিন্ধু নদের দুই তীরেই নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল। শোনা যায় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক পর্যন্ত এই সাম্রাজ্য টিকে ছিল।