বানর এবং হনুমান : মানুষ না ভগবান, নাকি মানবেতর প্রাণীমাত্র?
রামায়ণের বানর কখনোই আমাদের গাছে-গাছে লাফিয়ে বেড়ানো বাঁদর বা শাখামৃগ নয়। যে হনুমানকে দেখে আমরা বলি এই হনুমান কলা খাবি?’–এ হনুমান রামায়ণের হনুমান নয়। রাগ করবেন না, ব্যাখ্যায় আসছি। রামায়ণের উল্লখযোগ্য বানর-চরিত্র বালী ও সুগ্রীব। পৌরাণিক মতে বিশ্বকর্মাকেও বানর জাতীয় বলা হয়েছে। বিশ্বকর্মার আর-এক পুত্র ছিলেন, তিনি বানর যুথপতি নল। এই নল রাম-রাবণের যুদ্ধের প্রাক্কালে সেতুবন্ধনের কাজে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিলেন। এঁদেরকে রামায়ণে ‘বানর’ বলেই পরিচয় দেওয়া হয়েছে, বাঁদর নয়। এই বানর কি শাখামৃগ? আমরা সিনেমা-টিনেমাতে দেখেছি এঁদের মুখটা বাঁদর বা হনুমানের মতো, সারাক্ষণ চোখ পিটপিট করে। অনেকটা সুকুমার রায়ের হাঁসজারু কিংবা বকচ্ছপের মতো কিছু একটা–আধা বানর, আধা মানুষ। অর্থাৎ পুরোপুরি মানুষও নয়, আবার পুরোপুরি বাঁদরও নয়। মুখটা বাঁদর বা হনুমানের মতো হলেও বাকি শরীর মানুষের মতো–আবার দীর্ঘ লেজও আছে। এই বানরেরা মানুষের মতো কথা বলে বটে, কিন্তু বাঁদরের মতো লাফায়–এমনকি সমুদ্র-টমুদ্রও পার করে ফেলে! অনেকে এই বানরদের একপ্রকার মনুষ্য প্রজাতি’ মনে করেন। তবে এটা তো ঠিক, একদা ভারতে নানা জাতি প্রজাতির মানুষ বসবাস করতেন, এখনও বসবাস করেন। তাঁদের দেখতেও আলাদা, আকৃতিও আলাদা। প্রাচীন যুগে বহু জাতি থাকলেও আজ হয়তো কিছু জাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পুরাণশাস্ত্রাদি ঘেঁটে জানা যায়, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের ফর্সা-ফর্সা অপ্সরা এবং দাক্ষিণাত্যের কালা-কালা সুন্দরীদের সঙ্গে দেবসম্প্রদায়ের পুরুষদের অবাধ যৌনমিলনের ফলেই দেব-ঔরসজাত বানর জাতীয়রা জন্ম হতে থাকে। এর ফলে আর্য-অনার্য সংমিশ্রণে এইসব বানরপ্রজাতিরা বিভিন্ন দেহবর্ণ লাভ করে। বস্তুত সুগ্রীব ও অন্যান্য বানরদের গায়ের রং ছিল হেমপিঙ্গল। অবশ্য জিনগত কারণে কিছু বানর কৃষ্ণবর্ণও ছিল। দেবমন্ত্রী ব্রহ্মা এঁদেরকে নিয়েই কিষ্কিন্ধ্যায় একটি সেনাদলও তৈরি করে রাখলেন, যাতে প্রয়োজনে রামকে সাহায্য করতে পারে।
বাল্মীকি তাঁর রচিত রামায়ণে ১০৮০ বার ‘বানর’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। ৪২০ বার বানরদের ‘কপি’ সম্বোধন করেছেন। বানরদের ‘হরি’ সম্বোধন করা হয়েছে ৫৪০ বার। ছদ্মবেশ ধারণে পটু হওয়ায় বানরদের ‘কামরূপীন’ও বলা হয়েছে। হেমপিঙ্গল ও কৃষ্ণকায় দুই রঙেরই বানর ছিল। কৃষ্ণকায় বানরদের বলা হয়েছে ‘গোলাঙ্গুলা’। বলা হয়, আর্যদেবতাদের আনুকূল্যেই আর্য-অনার্য মিশ্রণে বানরদের জন্ম হয়েছে। বলা হয়েছে, রাবণের সঙ্গে রামচন্দ্রের যুদ্ধের কাজে লাগে, সেই কারণে দেবমন্ত্রী ব্রহ্মা বানরদের নিয়ে সহায়ক বাহিনী তৈরি করেছেন। রামায়ণে উল্লেখিত বানররা শাখামৃগ নয়। আসলে এরা টোটেমীয় বানর সম্প্রদায়। কোনো দেবদেবতা বা দেবদেবতাদের ঔরসজাত হতেই পারে।
মনুসংহিতায় এই ধরনের বিজাতীয় যৌনসম্পর্কের ফলে সন্তান জন্মের উল্লেখ আছে। যেমন–চণ্ডাল পুরুষের সঙ্গে নিষাদ স্ত্রীর যৌনমিলনের সন্তানকে বলা হত ‘অন্ত্যাবসায়ী’, বৈদেহক ও কারাবরের মিলনজাত সন্তান ‘অন্ধ্র’, ব্রাহ্মণ পুরুষ ও বৈশ্য স্ত্রীলোকের মিলনজাত সন্তান ‘অন্বষ্ঠ’, ব্রাহ্মণ পুরুষ ও অম্বষ্ঠ স্ত্রীর মিলনজাত সন্তান ‘আভীর’, শূদ্র ও বৈশ্যার সন্তান ‘আয়োগব’, ব্রাত্য ব্রাহ্মণ ও সবর্ণা স্ত্রীর সন্তান আবষ্য’, ব্রাহ্মণ পুরুষ ও উগ্র স্ত্রীর সন্তান আবৃত’, ক্ষত্রিয় পুরুষ ও শূদ্রার সন্তান ‘উগ্র’, শূদ্র পুরুষ ও ক্ষত্রিয় স্ত্রীর সন্তান ‘ক্ষত্তা’, চুচুক পুরুষ ও ব্রাহ্মণ স্ত্রীর সন্তান ‘তক্ষক’ ইত্যাদি। অনুরূপ আর্য পুরুষ ও অনার্য স্ত্রীর অথবা অনার্য পুরুষ ও আর্য স্ত্রীর মিলনজাত সন্তান ‘বানর’ হলে অবাক হব কেন? অতএব এঁরা কিলকিলা রকারী প্রজাতি শাখামৃগ মোটেই নয়। অবাঙালিরা যেমন বাঙালিদের ‘কিচিরমিচির’ রবকারী প্রজাতি বলত, পাখি বলত। আর্যদেবতারা তো কেউ বানর ছিলেন না–তাহলে ঔরসজাত সন্তানরা বানর হবে কেন? ‘বানর’ আর্যদেবতাদেরই দেওয়া নামকরণ। প্রখ্যাত স্থপতি বিশ্বকর্মা বানর জাতির কৃতিপুরুষ। কেউ কেউ বলেন অনার্যদের স্থপতি ময়দানব বিশ্বকর্মারই পুত্র। বিশ্বকর্মার দুই পুত্র–ময়দানব ও নল। বানর-স্থপতি নলই লঙ্কা পৌঁছোনোর জন্য সমুদ্রের সেতুনির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। ময়দানব ও নল দুজনেই পিতার মতো স্বনামধন্য স্থপতি। অনার্য বানর প্রজাতির বিশ্বকর্মা পরে আর্যদের কুক্ষিগত হয়। ঠিক যেমনভাবে অনার্য পশুপতি আর্যদের কৈলাশপতি হয়ে যান।
রামায়ণে উল্লিখিত বানরজাতির বাসস্থানের নিখুঁত বর্ণনা বাল্মীকি দিয়েছেন–“অন্যে ঋক্ষবতঃ প্রস্থানুপতস্তুঃ সহস্রশঃ।/অন্যে নানাবিধাচ্ছৈলান্ কাননানি চ ভেজিরে।” অর্থাৎ বহু সহস্র বানর ঋক্ষবা পর্বতের উপত্যকায় বসবাস শুরু করলেন, বাকি নানা পর্বতে ও কাননে আশ্রয় নিলেন। ঋক্ষবান পর্বতের অবস্থান মনুষ্য-কল্পিত স্বর্গ আকাশে নয়, ঋক্ষবান পর্বত এই ধরাধামেই বিন্ধ্য পর্বতমালার পশ্চিমাংশ। এই পর্বত তুঙ্গভদ্রার তীরে অবস্থিত। এই বানরজাতির স্বতন্ত্র গোষ্ঠী ও গোষ্ঠীপতিদের পরিচয় পাওয়া যায়–“সূর্যপুত্রং চ সুগ্রীবং শত্রুপক্ষং চ বালিনম্।/ভ্রাতরাবুপতস্তুস্তে সর্বে চ হরিযুথপাঃ।/নলং নীলং হনুমন্তমন্যাংচ হরিযুথপান্।”
রামায়ণে গল্পে বানরের সেতুবন্ধনের ব্যাপারটি বেশ জনপ্রিয়। এ গল্পে আছে সমুদ্রকে দু-দিকে সরিয়ে দেওয়া, শিলা যাতে জলে ভাসে সেজন্য প্রতিটি শিলায় শ্রীরাম’ লিখে দেওয়া, কাঠবিড়ালির শিলা বহন করা ইত্যাদি। এখন প্রশ্ন তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই সমুদ্র দু-দিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাহলে ‘শ্রীরাম’ লিখে দেওয়া শিলা কোথায় ভাসল? সমুদ্র দু-দিকে সরিয়ে দেওয়া কি আদৌ সম্ভব? যদি সম্ভব হয় এমন কোনো জলযান নির্মাণ করা গেল না, যাতে চড়ে লংকায় পৌঁছোনো সম্ভব। রামায়ণে প্রচুর আকাশযান বা বিমানের কথা উল্লেখ আছে। যে বিমান রাবণ ব্যবহার করেছেন, হনুমান ব্যবহার করেছেন, রাম ব্যবহার করেছেন, আর্যদেবতারা ব্যবহার করেছেন। আকাশযানের ব্যবহার যাঁরা জানেন, তাঁদের জলযান ছিল না! খামোকা সমুদ্র ফাঁক করে, শ্রম নষ্ট করে, সময় নষ্ট করে এ কর্মযজ্ঞের প্রয়োনীয়তা কী? হাজার হাজার বানরসেনা থাকতে সেতুবন্ধনের জন্য কাঠবিড়ালির ভূমিকা কতটকু? কাঠবিড়ালির পক্ষে কি সম্ভব শিলা বহন করা? সেতুবন্ধনের কাজে কাঠবিড়ালিকে আমদানি করেছেন কৃত্তিবাস, বাল্মীকি নয়। আর রামের কোমল স্পর্শে কাঠবিড়ালির পিঠের উপর লম্বা লম্বা দাগগুলি, যা রামচন্দ্রের নখের আঁচড় বল হয়, এটি আমদানি করেন রঙ্গনাথ, বাল্মীকি নয়। তাছাড়া কালাপানি বা সমুদ্র পার করা তো নিষিদ্ধই ছিল, তাহলে কেন সমুদ্র অতিক্রম করার প্রসঙ্গ?
বানররা সত্যিই সমুদ্র বন্ধন করেছিল? রামবাহিনী কি সমুদ্র পেরিয়ে লঙ্কায় পৌঁছেছিলেন? রামায়ণে উল্লিখিত রাবণের লঙ্কা কি বর্তমানের শ্রীলঙ্কা। যদি শ্রীলঙ্কা হয়, তাহলে নিশ্চয় সমুদ্রবন্ধনের মতো দূরহ কাজ করার প্রয়োজন আছে। এখানেও প্রশ্ন, লঙ্কা লক্ষ করে শত্রুপক্ষ সেতুবন্ধনের মতো কর্মজ্ঞ হয়ে গেল, আর রাবণ ঘৃণাক্ষরেও জানতে পারলেন না? না, সমুদ্রবন্ধনের মতো কোনো কর্মকাণ্ডই ঘটেনি। দুস্তর সমুদ্রও কারোকে অতিক্রম করতে হয়নি, লঙ্কা পৌঁছোতে যদি দুস্তর সমুদ্র পেরতে হত, তাহলে সেই সমুদ্র অতিক্রম করে দাক্ষিণাত্য জুড়ে রাক্ষসদের অবাধ বিচরণ থাকত না, এত আসা-যাওয়া থাকত না।
রামায়ণে উল্লিখিত লঙ্কা বর্তমানের শ্রীলঙ্কা নয়। তাই সমুদ্রবন্ধনের অতিরঞ্জিত গল্পটিও ধোঁপে টেকে না। কোনো ইতিহাসবিদ কিন্তু কখনোই এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে না। কারণ শ্রীলঙ্কা বা ‘লঙ্কা’ নামটি আধুনিক, ১৯৩৫ সালে সিংহলের নামকরণ করা হয় শ্রীলঙ্কা। এর আগে শ্রীলঙ্কার নাম ছিল ‘সিংহল’, আর সিংহল নামটি এসেছে বঙ্গদেশের রাঢ়ের নির্বাসিত রাজপুত্র বিজয় সিংহের নামানুসারে। এই রাজপুত্র নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে খ্রিস্টজন্মের ৫৪৩ বছর আগে এই দেশ জয় করেন ও নিজনামে এর নামকরণ করেন, ‘সিংহল’। এর আগে অর্থাৎ ৫৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহলের নাম ছিল ‘তাম্রপর্ণী’। রামের লঙ্কাজয়ের কাহিনি আমরা বাল্মীকি রচিত মহাকাব্য রামায়ণ থেকে জানতে পারি, আর রামায়ণের রচনাকাল Buckner B.Trawick–এর মতে খ্রিস্টজন্মের ২০০-ঊর্ধ্বে ৫০০ বছর আগে। তার মানে রামায়ণ রচনাকালে শ্রীলঙ্কা বলে কোনো দেশ ছিল না, ছিল ‘সিংহল। রামের লঙ্কা জয়ের কয়েক শত বছর পর রামায়ণ লেখা হয়েছে ধরে নিলেও বলতে হয় তখন এর নাম ছিল “তাম্রপর্ণী’ নিশ্চিত। আর আধুনিক শ্রীলঙ্কাই যে রামায়ণে বর্ণিত লঙ্কা নয়, তার সবথেকে শক্ত প্রমাণ দক্ষিণ ভারতের এত দূর পর্যন্ত কস্মিনকালেও আর্য অধিকারভুক্ত ছিল না। দক্ষিণ ভারতের একমাত্র আর্য জনপদ হচ্ছে অস্মক। মালায়লাম, কানাড়ি, তামিল, তেলেগু এসব দক্ষিণ ভারতীয়দের গায়ের রং ও শারীরিক আকার নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে এদের শরীরে বিন্দুমাত্রও আর্যরক্ত নেই। নৃবিজ্ঞান মতেও এরা অবিমিশ্র অনার্য দ্রাবিড় জাতি, আর্যরা যদি সত্যিই শ্রীলঙ্কা জয় করত তাহলে তার আগে তাঁদের নিশ্চিতভাবে দক্ষিণ ভারতের বিশাল ভূখণ্ড জয় করতে হত।
বস্তুত লঙ্কা একটি লম্ব বা ত্রিকূট পর্বতে অবস্থিত ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্য, যার চতুর্দিক বিস্তীর্ণ পরিখা দিয়ে ঘেরা। লঙ্কা সম্ভবত কোনো বিশেষ দেশের নাম ছিল না, সোনায় মোড়া লঙ্কা ছিল প্রাসাদের নাম। যাই হোক, প্রাচীন যুগে রাজারা নিজের রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে এবং শত্রুরা যাতে অতর্কিতে আক্রমণ করতে না-পারে সেজন্যই রাজ্যের চারদিকে গভীরভাবে পরিখার সৃষ্টি করে রাখতেন সেই রাজ্যের রাজারা, রাবণ হয়তো সেই পরিখা সমুদ্র কেটে রাজ্যের চারদিক ঘিরেছিলেন। রামবাহিনী যথাসম্ভব সেই পরিখাই অতিক্রম করেছেন সেতু নির্মাণ করে। বাল্মীকির যুদ্ধকাণ্ডে বলা হয়েছে, মহাবল বানরগণ সমুদ্রবন্ধনের জন্য হস্তীতূল্য বৃহৎ পাথর উৎপাটিত করেছেন। না, কাঁধে তুলে নয়। যন্ত্রযোগেই সেই কাজ সমাধা হয়েছিল–
“হস্তিমাত্রান মহাকায়াঃ পাষাণাংশ্চ মহাবলাঃ/পর্বতাংশ্চ সমুৎপাট্য যন্ত্রৈঃ পরিবহন্তি চ।”
পার্শ্ববর্তী জঙ্গল থেকে ভারি ভারি গাছের গুঁড়ি কেটে আনা হয়, আনা হয় বড়ো বড়ো পাথর। নলের নেতৃত্বে শুরু হল সেতু তৈরি কাজ–“পাষাণ ও পর্বত বেগে যেমন প্রক্ষিপ্ত হইতেছে সমুদ্রের জল অমনি উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছে এবং ঊর্ধ্ব হইতে আবার তৎক্ষণাৎ নিম্নদিকে নামিতেছে।” অবিশ্রান্ত কর্মতৎপরতার পর পাঁচদিনে সেতুনির্মাণ করে দিলেন বানরসেনাপতি নল। ভাবুন, টানা পাঁচদিন ধরে তুমূল কলরবে সেতু তৈরি হয়ে গেল, অথচ রাবণ জানতে পারল না, দ্বাররক্ষীরা জানতে পারল না। সবাই পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলেন নাকি? গুপ্তচরেরা কী করছিলেন?
রামায়ণের লঙ্কাকে একটি দ্বীপ বলা হয়েছে। আর এই দ্বীপে যাওয়ার জন্য রাম বানরসেনাদের দ্বারা নির্মিত সেতুর উপর দিয়েই সাগর পার হয়েছিলেন। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মাঝে অবস্থিত আদমসেতু (Adam’s Bridge)-কে ‘রামসেতু’ নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। রামায়ণ মতে, “রাম বানরের সেতুর সাহায্যে সাগর পেরিয়ে লঙ্কায় পৌঁছান”। অথচ রামেশ্বরমের মন্দিরের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৪৮০ সালেও এই রামসেতুর সাহায্যে পায়ে হেঁটে শ্রীলঙ্কা যাওয়া যেত। তাদের কথাটা কি সাংঘর্ষিক নয়? পায়ে হেঁটেই যদি যাওয়া যেত ১৪৮০ সাল পর্যন্ত তাহলে তো ১ কোটি ২০ লাখ বছর আগেও রাম তাঁর সেনাদল ও বানরসেনাদের নিয়ে পায়ে হেঁটেই শ্রীলঙ্কা যেতে পারতেন, তাহলে আর বানরদের এত কষ্ট করে সেতু বানানোর কী প্রয়োজন ছিল? কিছু বিশেষজ্ঞ নামধারী ব্যক্তি সম্প্রতি দাবি করেছে যে আদম সেতুই বানরদের তৈরি করা সেই সেতু।
বাংলাদেশের ইতিহাসবেত্তারা বলেন, বাংলাদেশের কুমিল্লাই রামায়ণের লঙ্কা। এই কুমিল্লা’ শব্দটি এসেছে। ‘কমলঙ্কা’ শব্দ থেকে। শ্রী শ্রী ভঙ্গাল মৃগাঙ্কস্য পট্টিকেরা রণবঙ্কমল্ল দেবের তাম্রশাসনে এটিকে ‘কমলঙ্কা’ নামেই আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু এই কমলঙ্কা আধুনিক কুমিল্লা শহর ছিল না। বরং এর অবস্থান লালমাই ময়নামতি পাহাড়ের অদূরেই এর দুর্গপ্রাচীরের ধ্বংসাবশেষের দৈর্ঘ্যই ১ মাইল। নলীনকান্ত ভট্টশালী ও আয়েশা বেগমের মতে এটিই প্রাচীন কমলঙ্কা, আর রাবণের রাজধানী লঙ্কাই বিবর্তনের মাধ্যমে কমলঙ্কায় রূপান্তরিত হয়। সম্প্রতি মেহেরকুল দুর্গের ধ্বংসাবশেষে বড়ো দাঁত ও চোখের গর্তের চারিপাশের লাল রঙের চিহ্নবিশিষ্ট ‘রাক্ষস মুখোস’ এই কথাকেই সমর্থন দেয়। সে যুগে প্রত্যেক দুর্গের চারিপাশে গভীর ও চওড়া পরিখা খনন করা হত, পরিখাগুলি এত গভীর করে খনন করা হত যে ১২ মাস তাতে জল থাকত। আর সেকারণেই এগুলিকে দ্বীপ বলেই মনে হত। কমলঙ্কা দুর্গনগরীর তিনদিকে পরিখার চিহ্ন আজও দেখা যায়। আর-এক দিকে বয়ে যেত ক্ষিরোদা নদী, যার খাত আজও দেখা যায়। লঙ্কা যদি শ্রীলঙ্কাই হত তাহলে ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার পথে ছিল পক প্রণালী ও আদমসেতু। একটা প্রণালীর উপর দিকে কি আদৌ সেতু তৈরি করা। সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন ও মধ্যযুগে পরিখা, নদী পেরুবার জন্য কাটারি ও মানিকী এই দুই ধরনের নৌকার সাহায্যে সেতু নির্মাণ করা হত। এধরনের নৌকার সেতু বাংলাদেশে এখনও দেখা যায়।
বর্তমান কুমিল্লার আগের নাম রওশানাবাদ। নাওয়াব শুজা-উদ-দাওলাহ ত্রিপুরা অধিকার করে এর নাম রাখেন আলোরনগরী বা রওশানাবাদ। ত্রিপুরা ব্রিটিশ যুগেও দুই ভাগে বিভক্ত ছিল–(১) ত্রিপুরা (বৃহত্তর কুমিল্লা) এবং (২) পার্বত্য ত্রিপুরা (বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য)। এরও আগে এর নাম ছিল এই কুমিল্লাই।
এ তো গেল বানরের কথা, এবার আসি হনুমানের প্রসঙ্গে। হনুমান নামটি এসেছে হনু (চোয়াল’) এবং মান (বিশিষ্ট’ বা ‘কদাকার’) শব্দদ্বয় থেকে। অর্থাৎ হনুমান’ শব্দার্থ ‘কদাকার চোয়ালবিশিষ্ট। অপর একটি সূত্র বলে ‘হনুমান’ নামটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘হন’ (হত্যা) এবং মানা’ (গ) থেকে। অর্থাৎ হনুমান অর্থ যাঁর গর্ব হত হয়েছে।
রামায়ণে উল্লেখিত রামের সহযোদ্ধারা সকলেই বানর। তবে একজন ভাল্লুক জাম্ববান এবং হনুমানের কথাও জানতে পারি। বীর হনুমান, বজরংবলি। ইনি সর্বশাস্ত্রবিদ, রাজনীতিজ্ঞ, রণনিপুণ। ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক এফ. ই. পাজ্জিটার ১৯১১ সালে হনুমানের পরিচয় খুঁজতে ব্যস্ত হয়েছিলেন। তিনি হনুমানের পরিচয় রহস্য প্রকাশ করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, ঋগ্বেদের বৃষাকপি ও রামায়ণের হনুমন্ত (হনুমান) উভয়েই গোদাবরী নদীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হনুমান যে দাক্ষিণাত্যের মানুষ তা সুস্বীকৃত এবং বৃষাকপিও যে সেই দেশের ব্যক্তি, তা সুসংগতভাবে অনুমতি এবং এই দুইজনের মধ্যে কোনো একটা সংশ্রব আছে। গোদাবরী তীরে বৃষাকপি তীর্থ আছে আর হনুমানের কৃপাতেই তীর্থরূপে গণ্য হয়েছে।
বৃষাকপি একটি নামবাচক হলেও বৃষ ও কপি এই শব্দযোগেই উৎপত্তি। কেবল শব্দার্থ ধরে নিলে এর অর্থ পুরুষ বানর বোঝায়। এখন বৃষাকপিকে দাক্ষিণাত্যবাসী বলা যায়, তবে এই যৌগিক শব্দটি কোনো দুটি দ্রাবিড়ীয় শব্দের সংস্কৃতানুবাদ হবে হনুমান। যখন নিশ্চয়ই দাক্ষিণাত্যবাসী তখন এই সংস্কৃত নামটিও কোনো দ্রাবিড়ীয় নামের সংস্কৃতানুবাদ হবে। সংস্কৃত ‘হনুমান’ শব্দের অর্থ হনু-বিশিষ্ট। এমন অর্থ দিয়ে শব্দটিকে আসলে সংস্কৃত শব্দ বোঝা যায় না। কিন্তু কাহিনি অনুসারে মূলত কোনো দ্রাবিড়ীয় শব্দের সংস্কৃতরূপ হতে পারে, এরকম অনুমান করা যায়।
রামায়ণে হনুমান ও বানরদের দেশ কিষ্কিন্ধ্যা বলা হয়েছে। এটি গোদাবরীর দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছুটা দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্থানটি কর্ণাটি ভাষার দেশের দক্ষিণে এবং তামিল ভাষার দেশের উত্তরে অবস্থিত। অতএব ওই দুই ভাষা থেকে এই নামের উৎপত্তির মূল যদি কিছু থাকে তা পাওয়া যাবে।
‘বৃষা’-পুরুষ, দ্রাবিড়ীয় ভাষায় সাধারণত ‘আণ’ শব্দের সঙ্গে মিলতে পারে। কর্ণাটী, তামিল ও মালয় ভাষায় ওই শব্দটি আছে। তেলগু ভাষায় এই শব্দটির পরিবর্তে ‘মগ’ শব্দ আছে। আণ’ শব্দ অন্য শব্দের পূর্বে বসে তার পুংস্তু নির্দেশ করে। কর্ণাটী, তামিল, তেলগু ও মালয় এই চারটি ভাষায় ‘কপি’ বাচক দুটি শব্দ দেখা যায়–কুরঙ্গু ও মণ্ডি। কেবল তামিল ভাষায় কুরুঙ্গু’ শব্দে কপি বোঝায়। অন্য তিন ভাষায় এর অর্থ কেবল হরিণ। মালয় ভাষায় কুরঙ্গ’ শব্দে হরিণ ও ‘কুরম্ন’ শব্দে বানর বোঝায়। মণ্ডি’ শব্দে তামিল ভাষায় বানর, বিশেষত বানরী বোঝায়। মালয় ভাষায় কৃষ্ণমুখ বানর বোঝাতে ‘মণ্ডি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। কর্ণাটীতে মানুষ বা ব্যক্তি বোঝাতে ‘মণ্ডি’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। তেলগুতে অন্য শব্দযোগে ‘মণ্ডি’ শব্দে ব্যক্তি বোঝায়। কর্ণাটী ও তেলগুতে ‘কোটি’ ও ‘তিস্মা’ শব্দে বানর বোঝায়। কিন্তু তামিল ও মালয় ভাষায় এর সমশব্দ নেই। অতএব দ্রাবিড়ীয় ভাষায় বানরার্থ ‘মণ্ডি’ শব্দ সবচেয়ে প্রাচীন শব্দ। এই সমস্ত সাদৃশ্য উপস্থাপন করে পুরাতাত্ত্বিক পাজ্জিটার বলছেন–যদি এইসব কথা গ্রহণীর হয়, তবে ‘আণ মণ্ডি’ শব্দ বৃষাকপি শব্দবোধক হতে পারে। আণমণ্ডির শব্দার্থ করে সংস্কৃতানুবাদ বৃষাকপি হতে পারে। তারপর ‘আণ মণ্ডি’-কে সংস্কৃত করে নিতে হলে সহজেই “হনুমান’ হয়ে যায়। কারণ আর্যরা যেখানে দ্রাবিড়ীয় শব্দকে সংস্কৃত করে নিয়েছেন, সেইখানেই অনেক ক্ষেত্রে ‘হ’ মিশিয়ে দিয়েছেন। এইভাবে আণমণ্ডি > অনমন্ত > হনুমন্ত হয়েছে। অতঃপর পাজ্জিটার বলেছেন–বৃষাকপি > আণমণ্ডি > হনুমন্ত যদি ঠিক হয়, তবে বলতে হয় ঋগ্বেদের আগেই দাক্ষিণাত্যে এর বিস্তৃতি হয়েছিল। বানরপুজো দাক্ষিণাত্যের সম্পত্তি এবং ঋগ্বেদ সংগ্রহের আগেই বানর স্তুতিমন্ত্র সমস্ত দেশে রচিত হয়েছিল। (ভারতবর্ষ/প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)
বিভিন্ন পুরাণ ও বিভিন্ন রামায়ণে এই হনুমানকে নিয়েই প্রচুর অলৌকিক ও সুপারন্যাচারাল কাহিনি প্রচলিত আছে। কয়েকটা কাহিনি এ আলোচনায় উল্লেখ করা যায় বিনোদনের জন্য। শাস্ত্রপুরাণাদি ঘেঁটেঘুঁটে হনুমানের জন্ম নিয়ে চারটি ভিন্ন স্বাদের গল্প পাওয়া যায়। কোনো গল্পে হনুমান পবন বা বায়ুর ঔরসজাত, কোনো গল্পে তিনি শিবের ঔরসজাত। শিবের দাঁড়িপাল্লাই ভারী। হনুমান কি বানর? বানর হলে ভীম তবে কে? হনুমানের মতো ভীম পবনপুত্র হয়েও ভীম ‘বানর’ এমন কথা তো কোথাও পাইনি! তবে হনুমানের জন্মকাহিনিতে যতই ভিন্নতা থাক–পিতা পৃথক পৃথক হলেও মাতা একই। মাতার নাম অঞ্জনা, অঞ্জনা কেশরীর স্ত্রী। কিন্তু হনুমানকে অনেকক্ষেত্রে ‘কেশরীনন্দন’ বলা হলেও, তিনি কেশরীর ঔরসজাত নন।
এক নম্বর গল্প : অঞ্জনা একাকিনী পাহাড়াঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। একে সুন্দরী নারী, তার উপর পরস্ত্রী–পরস্ত্রী বড়োই উপাদেয় বোধহয়! অঞ্জনাকে একাকিনী পেয়ে পবনদেবতা ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর উপর। বলাৎকারে বিবস্ত্র হয়ে গেলেন অঞ্জনা। পরস্ত্রী অঞ্জনার সঙ্গে মিলিত হলেন ‘দেবতা’ পবন। এই বলাৎকারের ফল হল হনুমানের জন্ম। অতএব অঞ্জনাও বানরী নয়, পবনও বানর নয়। এটি একটি বানোয়াট গল্প।
দুই নম্বর গল্প : নানা গল্পে বিষ্ণুকে মোহিনী রূপে দেখা গেছে। অর্থাৎ পুরুষশরীরে নারীর সাজসজ্জা–রূপান্তরকামীরা যেমন সাজেন! এবার মোহিনী বেশধারী বিষ্ণু এতটাই মোহময়ী হয়ে উঠছিলেন যে, তাঁকে দেখে শিবের বীর্যপাত হয়ে যায়। শিবে তেজোময় বীর্যপাত হলে তা কোথায় স্থাপন করবেন, তা নিয়ে শিব বহুবার বিব্রত বোধ করেছেন। এবারও শিবের একই অবস্থা। তবে শিবের এই পতিত বীর্য পরস্ত্রী অঞ্জনার গর্ভে স্থাপন করে দিলেন। অঞ্জনা গর্ভবতী হলেন, গর্ভের সেই সন্তানই হনুমান। প্রাচীন ভারতে বাইরে থেকে বীর্য নিয়ে নারীর গর্ভে স্থাপন করে নারীকে গর্ভবতী করানো যেত। এ তথ্যের সত্যতা নিয়ে কোনো গ্রন্থ মুনিঋষিরা লিখে যাননি।
তিন নম্বর গল্প : অঞ্জনার স্বামী কেশরীর গর্ভে শিব তাঁর তেজ’ প্রবেশ করালেন। এরপর কেশরী ও পবন উপর্যুপরি অঞ্জনার সঙ্গে মিলিত হলেন। এই সঙ্গমের ফলও হনুমানের জন্ম।
চার নম্বর গল্প : বিভিন্ন পুরাণের নানা ঘটনায় হর-পার্বতীর যৌনমিলনের কাহিনি পাওয়া যায়। সেসব কাহিনি বড়োই রসালো। এখানেও হর-পার্বতীর যৌনমিলনের যে গর্ভসঞ্চার হয়, শিব সেই গর্ভ পবনদেবকে দান করেন। পবন সেই গর্ভ বহন করে অঞ্জনার গর্ভে চালান করে দেন। এই গর্ভই হনুমানের জন্ম দেয়।
উপরে উল্লিখিত গল্পগুলি কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? বিজ্ঞানসম্মত? হনুমানের জন্মদানে শিব কমন (Common)। কে এই শিব? একই ব্যক্তি, নাকি পৃথক কেউ? অনার্য পশুপতি শিব? নাকি কৈলাশপতি শিব? পশুপতি শিব আর কৈলাশপতি শিব কি এক ব্যক্তি? এসব অস্তিত্ব প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্র বলেছেন–“শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবপ্রধানদের পদবিমাত্র ছিল। এক দেবতার উত্তরাধিকারী গদিপ্রাপ্ত পরবর্তী দেবতাও ওই পদবি দ্বারা পরিচিত হতেন। শিবকে শাসন করতে হত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল এবং হিমালয়ের বেশিতম প্রদেশগুলি। কোনো মানুষের পক্ষেই এত বড়ো সাম্রাজ্য একা শাসন করা সম্ভব ছিল না। শিবের প্রতিনিধি শাসক বা দেবতা থাকতেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং তাঁরাও ‘শিব’ উপাধি দ্বারাই পরিচিত ছিলেন।”
সে জন্ম যেই-ই দিক, জন্ম তো হয়েছেই। গোবলয়ের মানুষ হনুমানকে ‘বজরংবলি’ বলে থাকেন। বজরংবলি বলতে বোঝানো হয় একক শক্তিশালী, যার শরীরের রং বজ্রের মতে, অথবা যার বজ্রের মতো পা আছে।
হনুমান হলেন গোবলয়ের হিন্দুধর্মের একজন দেবতা হিসাবে পূজ্য। বাল্মীকির রামায়ণের না-হলেও কৃত্তিবাস রঙ্গনাথন-তুলসীদাসের রামায়ণে তিনি রামের একনিষ্ঠ ভক্ত, কতটা ভক্ত সেটা বোঝাতে তিনি তাঁর বুকের ছাতি ফাটিয়ে রাম-সীতাকে দেখিয়েছেন স্বয়ং রামকেই। তাই বুক চিরে রাম-সীতাকে দেখানো হাঁটু মুড়ে বসা হনুমানের মূর্তি পুজো করতে দেখা যায়। পুরাণাদিতে হনুমানকে বিশেষ স্থান দেওয়া হয়েছে। রামায়ণ বর্ণিত হনুমান পবননন্দন হিসাবে হিন্দুদের কাছে পূজনীয়। রামায়ণের মূল চরিত্র রাম, যাকে হিন্দুরা ভগবান বিষ্ণুর ‘অবতার’ হিসাবে দাবি করে, তাঁর অনুগত চরিত্র হিসাবে পাওয়া যায় এই হনুমানকে। তবে অবশ্য বাল্মীকির রামায়ণে নয়, প্রাদেশিক কবিদের রামায়ণে হনুমান রামভক্ত। সেই সূত্রে হিন্দুদের কাছে হনুমান ‘রামভক্ত’ হিসাবেই পরিচিত।
অন্য একটা গল্পে জানা যাচ্ছে–মহাদেব বানরকুলে জন্ম নিয়েছিলেন। কেন জন্ম নিলেন? এর একটা কারণও উল্লেখ আছে। একবার রাবণ জোর করে কৈলাশে প্রবেশ করতে গেলেন। দ্বার পাহারায় ছিলেন নন্দী মহারাজ। এক প্রস্থ হাতাহাতিও হয়ে গেল। রাবণ নন্দীকে দেখে পশু, মানুষ বলে উপহাস করাতে নন্দী রেগে রাবণকে অভিশাপ দিলেন–নরবানরের হাতেই তোর ধ্বংস’। তাই বানরকুলে মহাদেব ছাড়া অন্যান্য দেবতারাও জন্ম নিলেন বানর রূপে। কার্তিক মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে অঞ্জনা এক গুহার মধ্যে হনুমানকে প্রসব করেন। একে বলা হয় অনকচতুর্দশী। এই উপলক্ষেই কাশীতে প্রতি বছর এই তিথিতে মেলাও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
রামায়ণের কাহিনি অনুসারে হনুমান সীতাকে উদ্ধারের জন্য লঙ্কায় অভিযান চালান। লঙ্কায় পৌঁছে অশোকবনে উপবিষ্ট সীতার সঙ্গে দেখা করেন, কিছু শলাপরামর্শও করেন। এরপর সামান্য গাছপালা এটাওটা ভাঙচুর করেন, কয়েকজন লঙ্কার নাগরিকদের সঙ্গে মারপিটও করেন। তাঁর বিরুদ্ধে যে অক্ষ নামে একজন এবং একাধিক সেনাপতি হত্যা করার যে কাহিনি আছে তা সত্য নয়, বনোয়াট। না, তিনি হত্যাটত্যা কিছু তিনি করেননি। যাই হোক, বিদেশি হনুমান নামক দূত লংকায় প্রবেশ করে উৎপাত করছেন, এ সংবাদ রাবণের কানে পৌঁছেলে তাঁকে বিচারের জন্য ধরে আনতে দুইজন লোক পাঠালেন। হনুমান ওই দুজনকে খুব করে মনের সুখে পিটিয়ে দিলেন। এরপর ইন্দ্রজিৎ কয়েকজন সহচর হনুমানের কাছে এলেন এবং শণের দড়ি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললেন। বেঁধে সোজা রাবণের বিচারসভায়। রাবণ হনুমানকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। কিন্তু বিভীষণের মধ্যস্থতায় সেই মৃত্যুদণ্ড রদ হয়ে গেল। বিভীষণ রাবণকে বললেন–“দূত অবধ্য, তাঁকে হত্যা করলে আপনার মতো বীরের অপযশ হবে।” রাবণ বিভীষণের পরামর্শে খুশি হলেন এবং রায় পরিবর্তন করে বললেন, এই দূত বানরজাতি। এঁদের প্রিয় ভূষণ লেজ। এই লেজেই আগুন ধরিয়ে রাজ্যের বাইরে ছেড়ে দাও। ক্ষমার পূজারি রাক্ষস রাবণ, যার মূল্য ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে চোকাতে হয়েছে তাঁকে। গুপ্তচর বা দূতের সঙ্গে শলাপরামর্শ করার অভিযোগে সীতাকেও কোনো শাস্তির নিদান দিলেন না। তবে এটা স্বীকার করতেই হয় যে, সেদিন বিভীষণ সভায় উপস্থিত না-থাকলে হনুমান ধড়-মাথায় দু-টুকরো হয়ে যেতেন।
রাক্ষসরাজ রাবণের রায়ে হনুমানের লেজে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল এবং রাজপথে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁকে নিয়ে বিস্তর মজাও করা হল। লঙ্কার নাগরিকেরা ভিড় করে দেখতে থাকলেন গুপ্তচরের অপমানজনক সাজা। তারপর একাকী পরিত্যক্ত অপমানিত লঙ্কা অতিক্রম করে রামশিবিরে চলে আসেন।
না, হনুমান তাঁর লেজের আগুন দিয়ে লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করেননি। অন্তত বাল্মীকি এমন অবাস্তব কাজ হনুমানকে দিয়ে করাননি। সত্যিই যদি তাই হত, তাহলে রামের যুদ্ধ করার জন্য কেউই বেঁচে থাকতেন না। লঙ্কা পুড়ে ছারখার হলে রাবণ সহ লঙ্কার অন্যান্য বীরপুরুষরাও মরে ভূত হয়ে যেত। এই অগ্নিকাণ্ডে সীতা যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকেন, তাহলে নিরঙ্কুর প্রতিদ্বন্দ্বীহীন লঙ্কা থেকে সীতাকে হনুমান কাঁধে তুলে রামশিবিরে নিয়ে আসতেন। যুদ্ধের আর অবকাশ কোথায় থাকত? লঙ্কায় কি পুলিশ, সামরিকবাহিনী, প্রতিরোধবাহিনী রক্ষীরা ছিলেন না, যাতে হনুমান অবরুদ্ধ হতে পারে? লঙ্কা যদি পুড়ে ছাই হয়ে যেত, তাহলে রাবণ পরবর্তীতে রাজত্ব করলেন কীভাবে? যে বিভীষণের প্ররোচনায় পড়ে রাবণ হনুমানে জীবন্ত মুক্তি দিলেন, আর সেই হনুমান লঙ্কায় ভস্ম করে দিলে, বিভীষণকে জবাবদিহি না-করেই রাবণ ছেড়ে দেবেন? কই, জবাবদিহি তো করেননি! যাঁর বুদ্ধিতে হনুমান লঙ্কায় হাজার হাজার নর-নারী-শিশু দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন, তা সত্ত্বেও লঙ্কেশ্বর নিস্তরঙ্গ নিরুদ্বেগ থাকলেন কীভাবে? এটা বাস্তব? তা উপর কোনো কোনো কবি বলেছেন হনুমানের লেজের আগুন নাকি নিভছিলই না। উপায়ান্তর না-পেয়ে সীতার পরামর্শ নিতে গেলেন, সীতাও পরামর্শ দিলেন লেজটি ঘুরিয়ে মুখে ধরতে। মুখে লেজ ঘুরিয়ে লাগাতেই সেই আগুন নিভেছিল। নিভেছিল বটে, হনুমানের মুখটা পুড়ে কালো হয়ে গেল। মুখ কালো হয়ে গেলে হনুমান খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। সেই পথও বাতলে দিলেন সীতা। বললেন–কালো মুখের জন্য লজ্জার কিছু নেই। শুধু তোমারই মুখ কালো থাকবে না, পৃথিবীর সব হনুমানের মুখ কালো হয়ে যাবে! সেই থেকেই পৃথিবীর সব হনুমানের মুখ নাকি কালো। আষাঢ়ে গপ্পো আর কাকে বলে! তবে হ্যাঁ, লঙ্কা অবশ্যই পোড়ানো হয়েছিল, তাও স্বয়ং রামেরই হুকুমে। ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে রামশিবিরের সকলেই যখন ধরাশায়ী, মৃতপ্রায়–হনুমানের তৎপরতায় যখন সকলেই সুস্থ হয়ে উঠলেন, তখন রামচন্দ্র ক্রোধে মাঝরাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত লঙ্কানগরী চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে আবালবৃদ্ধবনিতাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন। বানরসেনারা সেই হুকুমমতোই পুড়িয়েছিলেন নিরীহ লঙ্কাবাসীদের। কীভাবে পারলেন? নগরদ্বারগুলি কে খুলে দিল? লঙ্কারাজ্যে কোন্ বিশ্বাসঘাতক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই অগ্নিদাহন প্রত্যক্ষ করলেন? রামই-বা কেন মাঝরাতে, তার উপর ঘুমন্ত নিরীহ মানুষদের পুড়িয়ে মারলেন? এত বীরের কাপুরুষতা!
বিনোদনের জন্য আর-একটা আজগুবি গল্প শোনাই–হনুমান প্রসবের পর অঞ্জনা ক্ষুধার্ত হয়ে বনে ফল আনতে গেল। হনুমান ভোরের সূর্যকে (জানি না হনুমান কোথা থেকে সূর্যের দিকে লাফ মারে। যদি পৃথিবী থেকে লাফ মারে তাহলে বিষয়টা ভাবতেই হয়। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব আনুমানিক ১৪.৯৬ কোটি কিলোমিটার এবং সূর্যের কেন্দ্রভাগে তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি ৩৬ লক্ষ কেলভিন। সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্র ৫৮০০ ডিগ্রি কেলভিন) ফল মনে করে খাবারের জন্য লাফ দিয়ে বহু শত যোজন অতিক্রম করল। এইসময় পবনদেবতা বাতাসকে শীতল করে দেন, যাতে সূর্য তেজহীন তাপহীন হয়ে যায়। সূর্য তাঁকে দগ্ধ করল না, কারণ হনুমান তো শিশু! ঘটনাচক্রে সেইদিনই সূর্যকে গ্রাস করার জন্য রাহু অগ্রসর হলে হনুমান সূর্যকে গ্রাস না-করে রাহুকে গ্রাস করতে ছুটলেন। রাহু তো ভীষণ ভয় পেয়ে গেল, অগত্যা তিনি ইন্দ্রের আশ্রয় নিলেন। এরপর ইন্দ্র রাহুকে সঙ্গে নিয়ে সূর্যের কাছে উপস্থিত হয়ে মধ্যস্থতা শুরু করেন, সঙ্গে ইন্দ্রের ঐরাবতও ছিল। সেই ঐরাবতকে হনুমান গ্রাস করতে ছুটে আসার চেষ্টা করলে ইন্দ্র তাঁর বজ্র দিয়ে হনুমানকে আঘাত করেন। বজ্রের আঘাতে হনুমানের হাড় ভেঙে যায় এবং ইনি পর্বত শিখরে উঠে নীচে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। পুত্রের এহেন পরিণতি দেখে পিতা পবন পর্বতগুহায় প্রবেশ করে পুত্রের জন্য বিলাপ করতে করতে স্থবির হয়ে যান। বায়ু বা বাতাস থমকে যাওয়ায় সমগ্র চরাচরে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। তখন সমস্ত দেবতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে ব্রহ্মা পবনের কাছে উপস্থিত হন এবং হনুমানকে পুনরুজ্জীবিত করেন। পবন খুশি হন এবং পুনরায় বাতাস প্রবাহিত করেন। এই শিশু হনুর হাড় বজ্রের আঘাতে ভেঙেছিল বলেই এর নাম রাখা হয় হনুমান। এরপর বিভিন্ন দেবতা হনুমানকে বিবিধ প্রকার বর প্রদান করেন। ইন্দ্র বর দেন যে বজ্রের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হবে না এবং ইচ্ছামৃত্যু হবে। সূর্য তাঁর শতাংশ তেজ দান করেন। ব্রহ্মা বলেন, হনুমান ব্ৰহ্মজ্ঞ ও চিরজীবী হবেন এবং সকল ব্ৰহ্মশাপের অবধ্য হবেন। মহাদেব ও বিশ্বকর্মা বলেন, ইনি সকল অস্ত্রের অবধ্য। একসময় এমন এল যে, শিশু হনুমান বিভিন্ন ঋষিদের আশ্রমে উপদ্রব করতে শুরু করেন। অতঃপর ঋষিদের অভিশাপে ইনি দীর্ঘদিন তাঁর নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে থাকেন।
হনুমান কর্তৃক সাগর লঙ্ঘনের পূর্বে ভল্লুকরাজ জাম্ববান হনুমানকে তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। এরপর থেকে ইনি তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে আর বিস্মৃত হননি। রাবণ সীতাকে অপহরণ করলে, সীতার খোঁজে রাম-লক্ষ্মণ কিষ্কিন্ধ্যায় উপস্থিত হন। এই সময় সুগ্রীব তাঁদের পরিচয় জানার জন্য হনুমানকে পাঠান। হনুমান এঁদের পরিচয় লাভ করার পর, এঁদেরকে পিঠে চড়িয়ে সুগ্রীবের কাছে এনেছিলেন। এরপর রাবণ ও সীতার অনুসন্ধানে সুগ্রীব বিভিন্ন দিকে চর পাঠান। হনুমানও দক্ষিণ দিকে চলে যান। এই অনুসন্ধানকালে সম্পাতির কাছে সীতার অবস্থান জানতে পেরে ইনি সাগর টপকে লঙ্কায় পৌঁছে যান। পথের মাঝে দেবতা, গন্ধর্ব ও ঋষি প্রমুখ হনুমানের শক্তি পরীক্ষার জন্য নাগমাতা সুরসাকে পাঠান। পরীক্ষায় জয়লাভ করে হনুমান পৌঁছে গেলেন সোজা লঙ্কায়। অঅন্য রামায়ণের যে অলৌকিক গল্প মানুষ বিশ্বাস করে, সেটা এখানে উল্লেখ খেই রাখার জন্য। সুরসা রাক্ষস রূপে হনুমানের পথ অপরুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে বলেন যে, দেবতারা তাঁকে তাঁর খাদ্যরূপে নির্দিষ্ট করেছেন। উত্তরে হনুমান বললেন যে, তিনি সীতাকে উদ্ধার করতে লঙ্কায় রামের দূত হয়ে যাচ্ছেন। সীতার সংবাদ রামকে দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করেই তিনি সুরাসার মুখে খাদ্যের জন্য প্রবেশ করবেন। এরপর সুরসা বলেন যে, দেবতার বরে কেউই আমাকে অতিক্রম করে যেতে পারবে না। কার্যসিদ্ধির পর হনুমানকে মুখে প্রবেশ করা কথা বলেন সুরসা এবং তার মুখ প্রসারিত করেন। হনুমান তাঁর দেহকে ১০ যোজন বিস্তৃত করেন, সুরসাও মুখ ১০ যোজন বিস্তৃত করলেন। সুরসা ২০ যোজন মুখ বিস্তৃত করলে হনুমানও ৩০ যোজন বিস্তৃত করেন। এইভাবে দুইজনের আয়তন ক্রমশ বিস্তৃত হতে থাকেন। এরপর হনুমান অকস্মাৎ নিজেকে আঙ্গুলের আকারে ধারণ করলেন। পরে সুরসার মুখে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে এলেন। এরপর সুরসা নিজমূর্তি ধারণ করে হনুমানকে আশীর্বাদ করেন। এরপর পথে সিংহিকা নামক এক রাক্ষসীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। এই রাক্ষসী জীবের ছায়া আকর্ষণ করে আহার করতেন। অতএব হনুমানেরও ছায়া আকর্ষণ করে তাঁকে আহার করার চেষ্টা করলে হনুমান প্রথমে তাঁর শরীর বৃদ্ধি করেন। সেই কারণে সিংহিকাকেও মুখ বিস্তার করতে হয়। পরে হনুমান হঠাৎ করে তাঁর শরীর সংকুচিত করে সিংহিকার শরীরে প্রবেশ করেন এবং হৃদপিণ্ড ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে হত্যা করেন। লঙ্কায় প্রবেশ করে ইনি তাঁর দেহ বিড়ালের মতো ছেটো করে সীতাকে খুঁজতে শুরু করেন। শেষপর্যন্ত অশোকবনে সীতাকে দেখতে পান। হনুমান সীতাকে রামের আংটি দেখালে সীতা আশ্বস্ত করেন। প্রতিদানে সীতা তাঁকে চূড়ামণি দান করেন এবং রামের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য সীতা তাঁকে তাঁর মাথার মণি প্রদান করেন। ফেরার সময় হনুমান অশোকবনটাও ধ্বংস করে আসেন। তাঁকে ধরার জন্য রাবণ তাঁর পাঁচ সেনাপতি ও পুত্র অক্ষয়কুমারের অধীনে এক বিশাল সেনাবাহিনী পাঠান। হনুমানের সঙ্গে যুদ্ধে অক্ষয়কুমার সহ সমস্ত সেনাদেরই মৃত্যু হয়। রাবণের নাতি জঘুমালীও নিহত হন। বুঝি, হনুমান-পরাক্রম বোঝাতেই এরকম অ্যাতো অ্যাত অতিরঞ্জিত গল্প।
আরও একটি আষাঢ়ে গল্প। হনুমান বিশাল সমুদ্র লাফিয়ে পার হয়ে লঙ্কায় পৌঁছোন, এমনটাই বিশ্বাস রাখেন ভক্ত মানুষরা। সত্যিই কি হনুমান সমুদ্র লাফিয়ে পার হয়ে লঙ্কায় পৌঁছেছিলেন? শত যোজন, অর্থাৎ চারশো ক্রোশ পরিমাণ বিস্তৃত মহাসাগর অতিক্রম করা কি সম্ভব? কবি বলেছেন–“সাগর স্যোম্মিজালানামুরসা শৈলবর্মনা অভিঘুংস্তু মহাবেগঃ পুপুরে স মহাকপিঃ।” কাহিনিটি এমন–সীতাকে উদ্ধারের জন্য সুগ্রীবের সহায়তায় বানরসৈন্য নিয়ে হনুমান লঙ্কার দিকে অগ্রসর হলেন। যাত্রাপথে সামনে সমুদ্র থাকায় তাঁদের গতি রুদ্ধ হল। তখন জাম্ববানের উপদেশে অঞ্জনার গর্ভজাত সন্তান হনুমান সমুদ্র টপকে লঙ্কায় যেতে রাজি হলেন। এরপর হনুমানের শরীর বিকট ও বিশালাকার ধারণ করলেন এবং জানালেন–“লাফানোর জন্য উদ্যত হলে ইহলোকে কেউ তাঁর গতি রুদ্ধ করতে পারবে না। একমাত্র মহেন্দ্র পর্বতই তাঁর গতি রোধ করতে সক্ষম হবে।” হনুমানের শরীরের এত বেগ যে, সমুদ্রের যে অঞ্চল দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই সেই অঞ্চল পাগলের মতো উত্তাল হচ্ছিল। সমুদ্রতরঙ্গমালা এতটাই উত্থিত হচ্ছিল যে, আকাশপথে যাওয়ার সময় সমুদ্রতরঙ্গ হনুমানের বুক পর্যন্ত স্পর্শ করছিল। মনে রাখতে হবে, ভারতের সর্বশেষ দক্ষিণ সীমান্ত রামেশ্বরম দ্বীপ থেকে লঙ্কার সর্বশেষ উত্তর সীমান্তের মান্নার উপসাগর বর্তমান দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার (৩০ মাইল)। মাঝে অনেকটা অংশ ফাঁকা (ধনুষ্কোটি থেকে তালাইমান্নার), যা আদম ব্রিজ দিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। ৩০ মাইল সমুদ্র অতিক্রম করে লঙ্কায় সীতার কাছে পৌঁছতে বীর হনুমান কি সত্যিই লম্ফন করেছিলেন? যদিও এর আগে হনুমানের ব্যাপক এক রেকর্ড আছে–তিনি পৃথিবী থেকে সূর্যের দিকে (আনুমানিক দূরত্ব ১৪.৯৬ কোটি কিলোমিটার) লাফ দিয়েছিলেন, যেখানকার তাপমাত্রা ৫৮০০ ডিগ্রি কেলভিন–৫০ কিলোমিটার দূরত্ব তো সেখানে নস্যি! পরিব্রাজক মেগাস্থিনিস লিখেছেন–
“অকাইপোদিস জাতি এত দ্রুতগামী যে অশ্বও তাঁদের সঙ্গে দৌড়তে পারে না, ইন্টোকোটাইদের কান তাঁদের পায়ের নীচ পর্যন্ত বিলম্বিত হত এবং সেইজন্য তাঁরা কানের উপর শুয়ে পড়তে পারত এবং এঁরা এমন বলবান যে, বৃক্ষোৎপাটন ও স্নায়ুনির্মিত ধনুগুণ ছিন্ন করতে পারত। এঁদের পায়ের গোড়ালির সম্মুখভাগে এবং পদাঙ্গুলি পিছনদিকে অবস্থিত।”
তবে কি মেগাস্থিনিস বর্ণিত এই জাতিগণই রামায়ণ-মহাভারতের বানর-হনুমান? মেগাস্থিনিস অবশ্য তাঁর গ্রন্থে। অবশ্য প্রচুর উদ্ভট উদ্ভট জাতির কথা উল্লেখ করেছেন। এমনই আর-একটি জাতির কথা মনে পড়ছে, যা মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেছেন–‘মনোমোটাই’ তেমনই এক জাতি, যাঁরা একচক্ষুবিশিষ্ট এবং যাঁদের কুকুরের মতো কান। এঁদের একটি চোখ নাকি কপালের মাঝখানে অবস্থিত। এঁরা ঊর্ধকেশী এবং বক্ষস্থল রোমশ। ভারতবর্ষ এক অসভ্য ও বর্বরজাতির দেশ, এমন সাব্যস্ত করতেই বোধহয় এহেন উদ্ভট বিবরণ। মেগাস্থিনিসরা এসব তথ্য কোথায় পেলেন সেই সূত্র তিনি দিয়ে যাননি। তবুও এসব বর্ণনায় ভক্ত-মানুষের কী প্রশ্নহীন এবং অগাধ আস্থা, বিশ্বাস!
মেগাস্থেনিস লিখেছেন–“ভারতে পঞ্চবিঘস্ত দীর্ঘ মানুষ আছে, তাহাদিগের মধ্যে কাহারও নাক নাই, কেবল মুখের উপরে দুইটি রন্ধ্র আছে, তাহার দ্বারা নিশ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করে। ত্রিবিঘস্ত জাতির সহিত সারসেরা যুদ্ধ করে, তিতির পক্ষীও যুদ্ধ করে, এগুলি রাজহংসের ন্যায় বৃহৎ।… বনমানুষগুলিকে চন্দ্রগুপ্তের নিকট আনা পারা যায় নাই। ইহাদের পায়ের গোড়ালি সম্মুখের দিকে, পাতা ও আঙ্গুলগুলি পশ্চাদ্দিকে। ভারতীয় মহাকাব্যে এরা ‘পশ্চাদলয়ঃ’ নামে পরিচিত। কয়েকটা মুখবিহীন মানুষ আনীত হইয়াছিল, তাহারা শান্ত ছিল।” আর-একটি যে জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়, এরা হল ‘okupodas’। এই জাতির একটিমাত্র পা এবং ঘোড়ার চেয়েও দ্রুতগামী। রামায়ণ ও হরিবংশেও একপদ জাতির উল্লেখ আছে। একচরণ’ নামও পাওয়া যায়। Enoctokoital বা কর্ণবরণগণ জাতির কথা জানা যায়, তাদের শারীরিক বর্ণনা এরকম–এদের কান পা পর্যন্ত লম্বা, বিলম্বিত কানের উপরই তারা ঘুমোয়। এরা এতটাই বলবান যে, তারা বিশাল বিশাল বৃক্ষ উৎপাটন করতে পারে, ধনুগুণ ছিন্ন করতে পারে। মহাভারতে কর্ণপ্রাবরণ কথা জানা যায়–“বশে চক্রে মহাতেজা দণ্ডকাশ্চ মহাবলঃ।/সাগরদ্বীপবাসাংস্ট নৃপতি ম্লেচ্ছযযানিজান।/নিষাদা পুরুষাদাশ্চ কর্ণপ্রাবরণানপি।/যে চ কালমুখো নাম নররাক্ষসযোনয়ঃ।”(সভাপর্ব/৩১ অধ্যায়/৬৬-৬৭ শ্লোক) ক্টিসিয়সও বলেন–“বামনজাতি ভারতবাসী। এই বামনেরা কিরাতজাতি। কিরাত বলতে বামনই বুঝায়। প্রবাদ এই যে, তাহারা গৃধ্র ও গরুড়ের (ঈগলের) সহিত যুদ্ধ করে, সেজন্য বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের একটি নাম, কিরাতগণ মঙ্গোলীয় জাতি। এজন্য ভারতবর্ষীয়েরা ইহাদিগকে মঙ্গোলীয় জাতির ন্যায় বর্ণনা করিয়া যাইয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কদর্যতা তুলিয়াছে। মুখবিহীন’ প্রভৃতি অভিধানের ইহাই মূল।” এ ধরনের বর্ণনা থেকে এটাই প্রমাণ করে যে, আর্যরা প্রবেশের আগে ভারত উপমহাদেশ জুড়ে এরকম শারীরিক বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষের বসবাস ছিল। আর্যরা প্রবেশের পর তাঁদের রচনায় এঁদেরই বিচিত্র শারীরিক গড়নের বর্ণনা পাওয়া যায়, যাঁদের তাঁরা রাক্ষস-খোক্কস, অসুর, দৈত্য দানো, দাস-দস্যু হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। আর্যদেবতাদের মধ্যে সেইরকম শারীরিক গড়নের প্রভাব পড়েছিল। তাই বোধহয় আর্য দেবদেবীদের মধ্যে চার মাথা, তিন চোখ, একাধিক হাতের রূপ পাওয়া যায়। আমরা গ্রিক ও রোমের দেবদেবীদেরও এরকম বিচিত্র রূপে দেখতে পাই।
অবশ্য স্ট্রাবো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছেন–“ডিমখস ও মেগাস্থেনিস একেবারেই বিশ্বাসের অযোগ্য। ইঁহারা নানা। অলৌকিক জাতির উপাখ্যান রচনা করিয়াছেন। কোনো জাতির কর্ণ বৃহৎ যে তাহাতে শয়ন করা যায়, কোনোটির মুখ নাই, কোনোটির নাসাবর্জিত, কোনোটির পদ ঊর্ণনাভের পদের ন্যায়, কোনোটির আঙ্গুল পশ্চাদ্দিকে। বামন সারসের যুদ্ধ সম্বন্ধে হোমরের যে আখ্যায়িকা আছে, ইহারা পুনরক্তি করিয়াছেন, ইঁহারা বলেন যে, এই বামনেরা ত্রিবিঘস্ত দীর্ঘ ছিল। স্বর্ণখননকারী পিপীলিকা, কীলকাকার মস্তকবিশিষ্ট নরপশু (Pans), সশৃঙ্গ গো ও হরিণ উদরসাৎ করে, এই প্রকার অজগর ইত্যাদি অনেক উপাখ্যান হঁহারা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।” এরাটস্থেনীয় বক্তব্য স্মতব্য–“ইঁহারা এই সকল বিষয়ে একে অন্যকে মিথ্যাবাদী বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।”
উত্তর খুঁজতে আমরা সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘টলেমির প্রাচীন ভারত’ গ্রন্থটি অনুসরণ করতে পারি। টলেমি ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ ভৌগোলিক এবং জ্যোতির্বিদ। টলেমির মতে লঙ্কা পেরোবার জন্য কোনো দুস্তর সাগর পারাপারের প্রশ্নই ছিল না। লঙ্কা আর ভারতের ভূখণ্ড সংযোগ ছিলই। হেঁটে অনায়াসেই লঙ্কায় চলে যাওয়া সম্ভব। ভূগোলবিদ স্ট্রাবো ও প্লিনির ১০০ বছর পরে টলেমি তাঁর পূর্ববর্তী ভৌগোলিকদের গ্রন্থাবলি অনুশীলন এবং অন্যান্য উপায় অবলম্বন করে পুরাবৃত্ত বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করেন। টলেমির ‘ভূগোল’ নামক গ্রন্থটি অতি মূল্যবান। টলেমি লিখেছেন–তিনেভেলির প্রধান নদী তাম্রপর্ণী। এই নদী কখইয়ের দক্ষিণে সমুদ্রে এসে মিশত, যার বর্তমান পরিচয় মান্নার উপসাগর। তামিল কাব্যে এটাই আবার পরুনী, পালি ভাষায় তম্বপন্নি বা তপ্রবেন নামে পরিচিত। প্রাচীন যুগে মান্নান উপসাগরের অদূরে অর্গালিক উপসাগর ছিল, এটা রামেশ্বর দ্বীপ দ্বারা বিছিন্ন ছিল এবং ভারতবর্ষের সঙ্গে ছোটো ছোটো দ্বীপমালা দিয়ে সিংহল তথা লঙ্কা প্রায় যুক্ত ছিল। ভৌগোলিক প্লিনি সিংহলের অতি কাছে ভারতীয় সূচ্যগ্র ভূখণ্ড একটি ক্ষীণ প্রবাল (চুনাপাথর?) সাগর দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল। তবেন দ্বীপ ক্রমশই তার নাম পালটেছে। রামায়ণে এবং অন্যান্য সংস্কৃত গ্রন্থে এই দ্বীপকেই ‘লঙ্কা’ বলা হয়েছে। আলেকজান্ডারের সময়ে ‘ট্যাপ্ৰেবন’ বলা হত, আলেকজান্ডারের আগে গ্রিকরাই বলত ‘অ্যান্টিচথোনাস’। মেগাস্থিনিসই এই দ্বীপকে ‘ট্যাপ্ৰেবন’ বলেছেন, বলেছেন এই ট্যাপ্ৰেবন একটি নদী দিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। অতএব ভারতবর্ষ ও লঙ্কার মধ্যস্থিত সমুদ্রকে যেরকম দুষ্কর ও দুস্তর বলে রামায়ণে বর্ণনা করা হয়েছে, বিষয়টি তেমন কিছু নয়–এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত হওয়াই যায়। অতএব বলাই বাহুল্য, লঙ্কেশ্বর রাবণ এবং তাঁর অনুগামীরা অনায়াসেই ভারতবর্ষে যথা-তথা ইচ্ছা বিচরণ করত। তাঁর প্রমাণ তথাকথিত রাক্ষসরাজ সহ শূর্পণখা, মারীচ, বিরাধরা দণ্ডকারণ্যে এসে সারাক্ষণ ঋষিদের বিরক্ত করত কীভাবে? রাবণ না-হয় বিমানে চেপে সীতাকে অপহরণ করেছেন, কিন্তু রাবণের বাকি অনুগামীরা কীভাবে ভারত ভূখণ্ডে বিচরণ করত? বিভীষণ কীভাবে লঙ্কা থেকে এসে রামের পক্ষে যোগ দিলেন? হনুমানের মতো সমুদ্রলঙ্ঘন করে নিশ্চয় নয়? অতএব এ থেকে প্রমাণ হয় লঙ্কা থেকে ভারতে অবাধেই যাতায়াত করা যেত, লম্ফঝম্ফ-উলম্ফনের কোনো প্রয়োজন ছিল না। হনুমানের সমুদ্রলঙ্ঘনের গল্পটি অতিরঞ্জিত, অতিকল্পিত।
২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কা পর্যটনের উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রিন্স রামের কিংবদন্তি উদযাপন ভারতে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের থেকে ধর্মীয় পর্যটন প্রচার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে অনেক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ জানায়। ২০০২ সালে নাসা উপগ্রহ চিত্রের একটি গবেষণা উপর ভিত্তি করে জানিয়েছে, এটা একটি প্রাকৃতিক গঠন, মানুষের তৈরি কাঠামো ছিল না। নাসা বলছে যে, ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই sandbanks প্রাকৃতিকভাবে শৃঙ্খল ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারত সরকার, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি হলফনামায় বলেন, রামের দ্বারা সেতু নির্মিত হয়েছে এর কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ থেকে জানা যায়, এটা মানুষের বানানো হয়েছে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০০৮ সালে ভারত সরকারের জন্য একজন মুখপাত্র বলেন, এটি মনুষ্যসৃষ্ট গঠন ছিল না। এটা একটি অতিমানব বানানো কাঠামো হতে পারে, কিন্তু একই অতিমানবই এটা ধ্বংস করেছে। তাই কি ধনুষ্কোটি থেকে তালাইমান্নার পর্যন্ত ফাঁকা, ভূখণ্ডহীন সমুদ্র! তবে অতিমানব নয়, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন এ অংশটি ভারত-শ্রীলঙ্কার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয় সাইক্লোন বা সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে। এই চুনাপাথর প্রাচীর প্লেট টেকটোনিক্স তত্ত্বের ফলেও বিচ্ছিন্ন হতে পারে বলে আমার মনে হয়। বস্তুত প্যানথালাসা ও প্যানজিয়ার যুগে ভারত ও শ্রীলঙ্কা ভূখণ্ড দুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
যাই হোক, কাব্যের খাতিরে কবি লঙ্কা যুদ্ধের সময় হনুমানকে দিয়ে এককভাবে অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করিয়েছেন। তাঁর হাতে–ধুম্রাক্ষ, অকম্পন, দেবান্তক, ত্রিশিরা, নিকুম্ভ নামক রাক্ষস সেনাপতি নিহত হয়। ইন্দ্রজিৎ হত্যার সময় ইনি লক্ষ্মণকে বহন করেছিলেন। রাবণের নিক্ষিপ্ত শক্তিশেলের আঘাতে লক্ষ্মণ মৃতপ্রায় হলে বিশেষজ্ঞ জাম্বুবানের (মহাভারতে কবিরাজ সুষেণ) পরামর্শে বিশল্যকরণী’ নামক ঔষধি আনার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে যান। বিবিধ গাছপালার মধ্যে ইনি এই গাছটি খুঁজে না-পেরে গোটা পর্বতটাই তুলে আনেন বলে বর্ণিত হয়েছে। সত্যিই কি বীর হনুমান গোটা গন্ধমাদন পর্বতটাই তুলে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন? তা কি সত্যিই সম্ভব? তুলতে না-পারার কী আছে! হনুমান তো এলিতেলি কেউ নন, দেবতা–দেবতার পুত্র দেবতা।
উদ্ভিদ থেকে নির্গত গন্ধ সমস্ত অঞ্চলকে সুবাসিত করে রাখে যে ঔষধি পর্বত, তাকেই গন্ধমাদন পর্বত বলা হয়। গন্ধ + মাদন, যা গন্ধে মাদয়িত (মত্ত) করে। মহাকবি বাল্মীকি এই পর্বতকে ঔষধি পর্বত বলেছেন। এই পর্বতাঞ্চলে যে যে ঔষধি বৃক্ষলতা পাওয়া যেত, তা হল–
(১) মৃতসঞ্জীবনী (যা মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে পুনর্জীবন দান করে),
(২) বিশল্যকরণী (যা শরীর থেকে ক্লেদ, কালিমা, টক্সিন দূর করে),
(৩) সুবর্ণকরণী (যা দেহকে স্বাস্থ্যজ্জ্বল ও লাবণ্যময় করে) এবং
(৪) সন্ধানকরণী (যা ভগ্ন অস্থিকে সংযুক্ত করে)।
এ সমস্ত ভেষজ আজও পাওয়া যায়, কাল্পনিক নয়। এইসব ঔষধি বৃক্ষ ভারত উপমহাদেশের মহান সম্পদ। অভিধান মতে ‘গন্ধমাদন’ শব্দের অর্থ গন্ধক (Sulpher) এবং পর্বত শব্দের অপর একটি অর্থ একপ্রকার শাক বা উদ্ভিদ। ওই সময়ে বিশল্যকরণী, গন্ধক এবং শাকবিশেষের সংমিশ্রণে যে ওষুধ তৈরি হত, তা ক্ষতরোগের মহৌষধি বলে খ্যাত ছিল। এটি হিমালয় সন্নিহিত আলপাইন সদৃশ অরণ্য এবং কৈলাস ও স্বর্ণাভ ঋষভ পর্বতের প্রায় ১০০ যোজন বা আট মাইল জুড়ে বিস্তৃত। কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন গন্ধমাদন হল যমকোটিপত্তন থেকে নীল ও নিষধ পর্বত পর্যন্ত মাল্যবান পর্বত। রোমকপত্তন থেকে নীল ও নিষধ পর্বত পর্যন্ত। আবার কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন, এই পর্বত ইলাবৃত বর্ষ ও ভদ্রাশ্ব বর্ষের সীমাপর্বত এবং মেরুর পূর্বে অবস্থিত। প্রাবন্ধিক শ্ৰীমনোনীত সেন বলেন, রামায়ণে উল্লিখিত গন্ধমাদন পর্বতই কারাকোরাম পর্বত। প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্র বলেছেন–“গন্ধমাদন পর্বত গাড়োয়াল হিমালয়ের একটি বৃহদংশের নাম। রুদ্র হিমালয় এবং কৈলাস পর্বতমালার অংশীভূত। এই পর্বতে মন্দাকিনী প্রবাহিত। মন্দাকিনী নেমেছে কেদার অঞ্চল ছুঁয়ে।” তা হনুমান যখন গন্ধমাদন পর্বতটাই উৎপাটন করে লংকায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন মন্দাকিনী নদীটি কোথায় রেখে গিয়েছিলেন?
রাম-রাবণের যুদ্ধকালে হনুমান একবারই (দু-বার নয়) এই ঔষধি পর্বত উৎপাটন করে এনেছিলেন। প্রথমবার ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে রাম ও লক্ষ্মণ যখন মৃতপ্রায় হয়। রাম কিছুক্ষণ পর সুস্থ হয়ে উঠলেও লক্ষ্মণ অচৈতন্য। রামশিবিরে যখন কবিরাজ সুষেণের সঙ্গে বিশল্যকরণী আনানোর জন্য পরামর্শ চলছে, ঠিক তখনই গড়র ওষুধপত্র নিয়ে অকুস্থলে হাজির হয়ে যান। রাম ও লক্ষ্মণ উভয়ই ওষুধ সেবনে চাঙা হয়ে উঠলেন। এক্ষেত্রে বিশল্যকরণী গরুড়ই এনেছিলেন, হনুমান নয়। দ্বিতীয়বার ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধে আবার রাম, লক্ষ্মণ, হনুমান, জাম্ববান মৃতপ্রায় হলেন ও অন্যান্য প্রচুর বানরসেনারা লাশ হয়ে গেলেন। রণক্ষেত্র শ্মশানে পরিণত হল। শবপ থেকে হনুমান জ্ঞান ফিরে পান। জ্ঞান ফিরলেই অন্ধকারে খুঁজতে খুঁজতে বিভীষণকে পেয়ে গেলেন। হনুমান ও বিভীষণ আবিষ্কার করলেন জাম্ববানকে। জাম্ববান হনুমানকে নির্দেশ দিলেন ঋষভগিরি কৈলাসের মাঝে গন্ধমাদনের বিশল্যকরণী, সুবর্ণকরণী ও সন্ধানী ও ঔষধি আনতে। হনুমান এই চারপ্রকার ওষুধও এনে দিলেন।
ঔষধির গন্ধে রাম, লক্ষ্মণ শল্যমুক্ত হন এবং বানরেরা (লঙ্কার যুদ্ধে ইন্দ্রজিৎ মন্ত্রপূত শাণিত প্রাস, শূল এবং অন্যান্য বাণ দ্বারা হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, গন্ধমাদন, জাম্ববান, সুষেণ, বেগদর্শী, মৈন্দ, দ্বিবিদ, নীল, গবাক্ষ, গবন্ধু, কেশরী, হরিলোম, বিদ্যুদ্দংষ্ট্র, সূর্যানন, জ্যোতিমুখ, দধিমুখ, পাবকাক্ষ, নল ও কুমুদ প্রভৃতি হরিশাদূলগণকে বিদ্ধ করে মৃতপ্রায় করে দিয়েছিল।) সুস্থ হয়। ঔষধি চিনতে না-পেরে গোটা পর্বতটাই তুলে আনেন! শুধু গাছগাছালিই নয়, অসংখ্য জন্তুজানোয়ারও নিশ্চয় উঠে আসে। হনুমানে এত ক্ষমতা, অথচ কটা গাছ চিনতে পারলেন না। হনুমান চেনেন বলেই তো জাম্ববান তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। যাঁর উপর বিষ্ণুর অংশ রামের জীবন ফিরে পাওয়ার সম্পর্ক এবং যুদ্ধে পরজয়ের গ্লানি সরিয়ে পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রাবণকে বিনাশ করতে হবে, সেখানে এই অনাবশ্যক শক্তি ক্ষয় করে গোটা পর্বতটাই উপড়ে উড়িয়ে আনতে গেলেন কোন যুক্তিতে! সত্যিই কি পর্বতটি উপড়ে আকাশপথে (যুদ্ধক্ষেত্র তথা দক্ষিণের ত্রিকূট পর্বত থেকে উত্তরের গন্ধমাদন পর্বতের দূরত্ব প্রায় ৩২১৪ কিলোমিটার বা ১৯৯৭ মাইল) উড়িয়ে এনেছিলেন? যদি তর্কের খাতিরে মেনেই নিই গন্ধমাদন পর্বত তুলে এনে যুদ্ধক্ষেত্রে এনেছিলেন, তবে বলব কাজ মিটে গেলে পর্বতটি কে যথাস্থানে রেখে গিয়েছিল? সেই গল্পটি কোনো রামায়ণে পাইনি। এমন পর্বত তুলে আনার গপ্পোই তো বাল্মীকি বলেননি।
সমগ্র ঘটনাটি ঘটেছিল রাতেই। ঔষধিগুলি সরাসরি শরীরে প্রয়োগ করা হয়নি, গন্ধ আঘ্রান করেই সবাই চাঙা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। রাম-রাবণের এই যুদ্ধে শুধু রাম-লক্ষ্মণ-বানরাই মৃত বা মৃতপ্রায় হননি, রাবণের প্রচুর অনুগামীরাও মৃত বা মৃতপ্রায় হয়েছিলেন–তাহলে কি তাঁরাও চাঙা হয়ে উঠেছিল? উঁহু, তা হওয়ার জো নেই! মহাকবি বলেছেন–যখন থেকে বানর-রাক্ষসদের যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, সেই সময় থেকেই রাবণের আদেশে মৃত সৈন্যদের পরিমাণ বিষয়ে হিসাব রাখার জন্য রণমধ্যে বানরের হাতে মৃত ও আহত নিশাচরেরা সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। মৃত রাক্ষসদেহ সেখানে ছিলই না, ঔষধির আঘ্রাণ তাঁরা নিতে পারেনি, অতএব জীবিত হওয়ারও সুযোগ ছিল না। শ্ৰীমনোনীত সেন বলেছেন–“আষাঢ়ে গল্প”। গন্ধমাদন তুলে আনার গপ্পোটি আষাঢ়ে, তা আমরা না-মানলেও মহাভারতকার এই আষাঢ়ে গপ্পোটিকে এক্কেবারেই পাত্তা দেননি। তাই মহাভারতে মার্কণ্ডেয় মুনির বর্ণিত রামোপাখ্যানে গন্ধমাদন পর্বতের কথা ভুলেও উচ্চারণ করেননি। বনপর্বের ২৮৮ নম্বর অধ্যায়ে শুধুমাত্র বলেছেন–“বানররাজ সুষেণ দিব্য মন্ত্রপ্রযুক্ত মহৌষধি বিশল্যা দ্বারা অতি সত্বরে তাঁহাদিগকে শল্যনিমুক্ত করিয়ে দিলেন। মহারথ রাম-লক্ষ্মণ লব্ধসংজ্ঞ ও শল্যনিমুক্ত গাত্রোত্থানপূর্বক ক্ষণকাল মধ্যেই গতক্রম হইলেন।”
হনুমানকে এভাবে বোকা বানানোর অর্থ কী? ধরে আনার কাজ যদি কেউ বেঁধে আনে, তাঁকে তো সবাই বোকাই বলে গাছ চিনতে পারেনি বলে তাই পর্বতটাই তুলে এনেছে–এটা হেঁদো যুক্তি নয়? জাম্ববান বিচক্ষণ ব্যক্তি, সামান্য সুস্থ হওয়ার পর তিনি হনুমানকেই খুঁজেছিলেন, “ভগবান রামকে বা অন্য কাউকে নয়। কারণ তিনি জানতেন হনুমানই চিনতেন এইসব ওষুধিগুলি। কাজেই এইসব গপ্লোগাছা দৃষ্টিহীন’-রাই বিশ্বাস করেন, ‘চক্ষুষ্মন’-রা নয়। এমন গপ্পোগাছা বিশ্বাস করতে হলে হনুমান আর জাম্ববানকে “বোকার হদ্দ” প্রতিপন্ন করতে হয়। সেটা কি সমীচীন হবে? হনুমান নিঃসন্দেহে মহাশক্তিমান, বীর। এহেন মহাশক্তিমান অমাত্য মন্ত্রীসভায় থাকতে সুগ্রীব কেন যে তাঁর দ্বারা বালীকে হত্যা করে কিষ্কিন্ধ্যা দখল করতে পারল না, সেটাই ভাবাচ্ছে।
যুদ্ধশেষে ইনি সীতার কাছে রাবণবধের সংবাদ দেন এবং সীতাকে রামের কাছে পৌঁছে দেন। অযোধ্যায় রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা ফিরে আসার সময় রাম হনুমানকে নন্দীগ্রামে ভরতের মনোভাব জানার জন্য পাঠিয়েছিলেন। অযোধ্যা থেকে ফেরার সময় রাম তাঁর শরীরের সমস্ত অলংকার হনুমানকে প্রদান করেন। সেই সঙ্গে রাম হনুমানকে বর দেন যে, যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন হনুমানও জীবিত থাকবেন। বাবাল্মীকির রামায়ণে লংকাযুদ্ধের সময় হনুমান কিছু রাক্ষস মেরেছিলেন বটে, সেই সঙ্গে গুটিকয়েক মহারথী মহাবীরও হত্যা করেছিলেন। যেমন–অকম্পন, ত্রিশিরা।
এ তো গেল রামায়ণের হনুমান। এই হনুমানকে মহাভারতেও পাওয়া যাচ্ছে। রামায়ণের রাম ও হনুমান ত্রেতাযুগের, ত্রেতাযুগের সময়কাল ১২,৯৬,০০০ বছর। মহাভারত ও মহাভারতের হনুমান দ্বাপরযুগের, দ্বাপরযুগের সময়কাল ৮,৬৪,০০০ বছর। পাঠকগণ দুই যুগের ব্যবধানটা আপনারা নিজেরাই হিসাব করে নিন। আমি বলি দ্বাপরযুগের হনুমানের কথা–তো দ্বাপর যুগে ভীম যখন দ্রৌপদীর অনুরোধে পদ্ম সংগ্রহের জন্য ভুল করে মানুষের অগম্য স্বর্গপথে রওনা দেন, তখন হনুমান তাঁর পথরোধ করে বসেছিলেন। উল্লেখ্য হনুমান এবং ভীম দুজনেই পবনপুত্র। সেদিক থেকে দেখলে, তাঁরা একে অপরের ভাই। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময়ে হনুমান এক অসুস্থ এবং বৃদ্ধ বানরের বেশে ভীমকে দেখা দেন। ভীম ছিলেন অসম্ভব আত্মগর্বী। তাঁকে শিক্ষা দেওয়াই ছিল হনুমানের উদ্দেশ্য। ভীমের পথ রুদ্ধ করে অসুস্থ বৃদ্ধের ছদ্মবেশে হনুমান শুয়ে ছিলেন। ভীম তাঁকে অতিক্রম করতে চাইলে তিনি ভীমকে বলেন তাঁর লেজটি সরিয়ে চলে যেতে। ভীম বহু চেষ্টাতেও সেই লেজ সরাতে পারেননি। শেষে তিনি অনুভব করেন, এই ব্যক্তি কোনও সাধারণ বানর নন। তিনি হনুমানের শরণ নেন। এরপর ভীম তাঁর অগ্রজের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং সমুদ্র লঙ্ঘনের পূর্বে হনুমানের রূপ কেমন ছিল তা দেখার জন্য আবেদন জানান। হনুমান তাঁকে বিন্ধ্যাপর্বতের মতো বিশাল রূপ দেখান। এরপর হনুমান পদ্মবনের প্রকৃত পথ দেখান। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ইনি আড়ালে থেকে ভীমকে সাহায্য করেছিলেন। এছাড়াও প্রসঙ্গত বলতে ইচ্ছে করছে, হনুমান যখন জানতে পারেন যে রামের দীর্ঘায়ু কামনায় সীতা সিঁথিতে সিঁদুর পরেন তখন তিনি সারা গায়ে ‘কুমকুম’ বা সিঁদুর মেখে ফেলেন। মেটে সিঁদুরের রঙে তাঁর গায়ের রং হয়ে ওঠে কমলা। এজন্যই হনুমানের আর এক নাম বজরংবলি, কারণ ‘বজরং’ কথার অর্থ কমলালেবু। নারদ মুনির প্ররোচনায় একবার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে হনুমানকে বধ করতে গিয়েছিলেন রাম। তখনই হনুমান একমনে রামনাম জপ করতে থাকেন। আর সেই নামজপেই অকেজো হয়ে যায় রামের সবচেয়ে শক্তিশালী এই দৈব অস্ত্র।
হনুমানের সঙ্গে অর্জুনেরও দ্বৈরথ ঘটেছিল। সেতুবন্ধ রামেশ্বরমে অবস্থানকালে অর্জুন এক ক্ষুদ্র বানরের সম্মুখীন হন। অর্জুন সেই বানরের সামনে গর্ব ভরে বলেন, বানরদের সাহায্য না-নিয়ে রামচন্দ্র একাই সেই সমুদ্র-সেতু নির্মাণ করতে পারতেন। তির যোজনা করেই তো সেটা করা সম্ভব ছিল। ক্ষুদ্র বানর অর্জুনকে চ্যালেঞ্জ জানায় ওই কাজ করে দেখাতে। অর্জুন ব্যর্থ হলে ক্ষুদ্র বানরের ছদ্মবেশ ত্যাগ করে হনুমান প্রকট হন। অর্জুন তাঁর শরণ নিলে, তিনি অর্জুনের রথশীর্ষে অধিষ্ঠান করবেন বলে বর দেন। অর্জুনের রথের উপরে তাই ‘কপিধ্বজ’ শোভা পায়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হলে অর্জুন রথ থেকে নেমে আসেন। কৃষ্ণ হনুমানকে ধন্যবাদ জানান রথশীর্ষে অবস্থান করার জন্য। হনুমানও ধ্বজা-রূপ ত্যাগ করে স্বমূর্তি ধারণ করেন। তিনি বিদায় নিলে রথটি ভস্মে পরিণত হয়। হতবাক অর্জুনকে কৃষ্ণ জানান, ভয়ানক সব অস্ত্র এই রথের উপরে বর্ষিত হয়েছে। হনুমান রক্ষা না-করলে রথটি অনেক আগেই ভস্মীভূত হত। মাত্র চারজন ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে ভগবদগীতা শুনেছিলেন এবং বিশ্বরূপ দর্শন করেছিলেন। এঁরা হলেন–অর্জুন, সঞ্জয়, বরিক এবং ঘটোৎকচ। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে, ধ্বজ হিসাবে রথশীর্ষে অবস্থানের কারণে হনুমানও ছিলেন সেই তালিকায়।
একটি আশ্চর্য রামায়ণের সন্ধান পাওয়া যায়, যার রচয়িতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয় স্বয়ং হনুমানকেই। ‘হনুমদ রামায়ণ’ নামে পরিচিত এই গ্রন্থ সম্পর্কে যে কিংবদন্তিটি চলিত রয়েছে, তা সত্যিই কৌতূহলোদ্দীপক। এই মিথ অনুসারে, রাবণবধের পরে হনুমান আধ্যাত্মজীবন যাপনের উদ্দেশ্যে হিমালয় গমন করেন। সেখানে তিনি পর্বতগাত্রে নখের আঁচড় কেটে লিখতে শুরু করেন তাঁর নিজস্ব রামায়ণ। এই রামায়ণে তিনি রামের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রাখেন। হনুমান চেয়েছিলেন, বাল্মীকি তাঁর রামায়ণ সম্পর্কে মন্তব্য করুন। মহর্ষি বাল্মীকিকে তিনি আমন্ত্রণ জানান। বাল্মীকি হনুমানের রামায়ণ পড়ে বেশ ভেঙে পড়েন। হনুমান তাঁর বিষাদের কারণ জানতে চাইলে মহর্ষি জানান, তিনিও রামকথা লিখছেন। কিন্তু হনুমানের রচনা এত প্রাণবন্ত যে, তাঁর কীর্তি এর কাছে ম্লান হয়ে যাবে। উদারচেতা মহাবলি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রচনাকে বাতিল করেন। তাঁর দ্বারা খোদিত প্রস্তরখণ্ডগুলিকে তিনি একে একে নদীতে নিক্ষেপ করেন। বাল্মীকিও হনুমানের উদারতায় প্রসন্ন হয়ে তাঁর আশ্রমে ফিরে আসেন। গল্প কিন্তু এখানে শেষ নয়। বহুকাল পরে মহাকবি কালিদাস নাকি ‘হনুমদ রামায়ণ’-এর একটি প্রস্তর খুঁজে পান। তিনি উজ্জয়িনী নগরের এক প্রকাশ্য স্থানে এই প্রস্তরলিপিটা ঝুলিয়ে দেন। হনুমান যে লিপিতে এই রামকথা লিখেছিলেন, সেটি একটি অতি প্রাচীন এবং অবলুপ্ত লিপি। কালিদাস চেয়েছিলেন, তাঁর সহনাগরিক পণ্ডিতরা এই লিপির পাঠোদ্ধার করুন। কিন্তু তা কেউ করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। এই লিপিই কি কালিদাসকে ‘রঘুবংশম’ লিখতে প্রাণীত করেছিল? ইতিহাস কিন্তু মিথের ব্যাপারে সায় দেয় না।
এই হল আমাদের সবার প্রিয় বানর বা বাঁদর বা হনুমান। ভগবান বা দেবতাও। ইতিহাস কি? পাঠককুল কি এই কাহিনিগুলির মধ্যে ইতিহাসের কোনো উপকরণ বা উপাদান পেলেন?
“ধৰ্মার্থকামমোক্ষানামুপদেশসমন্বিতম্।/পূৰ্ব্ববৃত্তকথাযুক্তমিতিহাস প্রচক্ষতে।”
অর্থাৎ যে গ্রন্থে ধর্ম-অর্থ-কাম ও মোক্ষ প্রাপ্তির উপদেশ সহ (রাজাদের) পূর্ব-বৃত্তান্ত বিবৃত হয়, ইতিহাস বলে। রামায়ণ এই সংজ্ঞা অনুসারে ইতিহাসশ্রেণিভুক্ত হওয়ার অধিকারী নয়। কারণ ধর্ম-অর্থ-কাম ও মোক্ষের উপদেশ থাকলেও যে রাজাদের কথা এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, তাতে তাঁদের পূর্বপুরুষের কোনোরূপ বিবরণ নেই। বস্তুত রাজা দশরথের পিতৃ-পিতামহের তথা ইক্ষ্বাকুবংশের প্রাচীন কথা না-থাকাতেই ঋষিদের মতে রামায়ণ ইতিহাসের শিরোপা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কবি নিজেই বলেছেন–“মহদুৎপন্নমাখ্যানং রামায়ণমিতি তম।” তবে আখ্যানের ইতিহাস হতে তো বাধা নেই। আখ্যানেও দেশ-কাল-পাত্রের প্রভাব থাকবেই। প্রায় সব সাহিত্যেই ইতিহাস নথিভুক্ত হয়ে যায়, অজান্তেই। সমসাময়িক চিত্রপট আঁকা হয়ে যায় সাহিত্যে। ধরা পড়ে সামাজিক ও সমাজজীবনের বর্ণনা। রামায়ণ ভারতে বসেই রচিত হয়েছে, তাই ভারতের স্থান-কাল-পাত্র ঘটনা নথিভুক্ত থাকবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে রামায়ণে যতটা-না ইতিহাস আশ্রয় পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি আশ্রয় পেয়েছে যুক্তিহীন অলৌকিকতা। অলৌকিকতা ছাড়া কোনো ঘটনাই সম্পন্ন হয়নি। রামায়ণে (মহাভারতেও) এমন বিষয়, ঘটনা ও চিত্রনাট্য আছে যা অসম্ভব, অপ্রাকৃতিক, অপ্রার্থিব ও অনৈতিহাসিক। সকল অলীক, অস্বাভাবিক ও অনৈতিহাসিক বর্ণনা থাকলে ইতিহাসের আলোচনা থেকে ত্যাগ করতেই হবে। তবেই লিবির রোমের ইতিহাস, হিরোডোটাসের গ্রিস ও মিশরের ইতিহাসের মতো রামায়ণও কিঞ্চিৎ ইতিহাস হতেই পারে। কবির কাব্য ইতিহাস নয় বটে, কিন্তু কাব্যের উপাদানে ঐতিহাসিকদের ভাববার অবকাশ আছে।
রামায়ণ বা মহাভারতের উল্লিখিত বানর বা হনুমান সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত কিংবা প্রাইমেট অন্তর্গত কোনো জাতি নয়। প্রাইমেট অন্তর্গত কোনো প্রাণী হলে এই ধরনের কর্মকাণ্ড করে ফেলা সম্পূর্ণতই অবাস্তব। রামায়ণের বানর-হনুমানেরা একপ্রকার প্রজাতির মানুষ। দাক্ষিণাত্যে বানর, রাক্ষস, নাগ ইত্যাদি প্রজাতি মানুষের আধিপত্য ছিল। এরা খুব হিংস্র ও শক্তিশালী ছিল। আর্যাবর্তের অনেক আর্যরা বিন্ধ্যপর্বতকে পিছনে রেখে দাক্ষিণাত্য অতিক্রম করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। এমনই এ অসফল ব্যক্তি হলেন অগস্ত্য। অগস্ত্য দাক্ষিণাত্যে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু আর ফিরে আসতে পারেননি। একেই বলে অগস্ত্য যাত্রা! রামের পক্ষেই কেবল দাক্ষিণাত্যে পৌঁছোনো সম্ভব হয়েছিল। তার কারণ রামের বিচক্ষণতা, প্রাজ্ঞতা, আস্থাভাজন এবং বীরতা।
পরবর্তীতে এইসব বানর, রাক্ষস-খোক্ষস, দানো-দৈত্য, নাগজাতিরা হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে কোনো কারণে, অথবা আজও আছে অন্য রূপে। প্রাচীন ভারতে এরকম অনেক প্রজাতির জীব ছিল, যাঁরা আজ লুপ্ত। প্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতে, সভ্য মানুষের অসভ্য আচরণ আর নৃশংস মনোভাব, তদুপরি পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে ৫০০-রও বেশি প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও পাখি লুপ্ত হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ৯০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির আরও ১২ শতাংশ প্রাণী লুপ্ত হয়ে যাবে। আজও এরকম অনেক প্রজাতির মানবগোষ্ঠী আছেন এ ভারতে, যারা বিলুপ্তির পথে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, তাঁরা নিজেদের মতো করে বেঁচে আছে, তাঁরা বিপন্ন। কালের নিয়মে একদিন পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। সভ্য মানুষের আগ্রাসনে দাক্ষিণাত্যের বহু আদিম প্রজাতির মানবগোষ্ঠী লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায়। এই মুহূর্তে জাবোয়া ও আওয়া উপজাতিরা বিলুপ্তির পথে অপেক্ষারত।
বানর নিয়ে আর-একটি পৌরাণিক কাহিনি পাওয়া যায়। যেখানে ভগবান শিব একজন মাদারি (বাঁদর খেলা যে দেখায় তাকে মাদারি বলে) সেজে আর হনুমানকে এক বাঁদর সাজিয়ে অযোধ্যাতে গেল। রামের ইষ্ট শিব, আবার শিবের ইষ্ট রাম। অযোধ্যা নগরীতে নেমে ডুগডুগি বাজিয়ে শিব বাঁদর খেলা দেখাতে লাগল। রাজবাড়িতে বাঁদর নাচানো দেখাতে গেলেন স্বয়ং পশুপতি। চার ভ্রাতা সেই খেলা দেখে আনন্দিত হলেন। শিশু রাম, দশরথকে অনুরোধ জানালেন তাঁকে ওই বাঁদরটি দিতে। দশরথ রাজা মাদারিকে বললেন–“কত মূল্যে তুমি বাঁদরটি দেবে?” মাদারি রূপধারী হর জানালেন–“মহারাজ, এর কোনো মূল্য লাগবে না। খালি একটি প্রতিজ্ঞা করতে হবে, যেন সারাজীবন আপনার পুত্র এই বাঁদরটিকে তাঁর সেবক রূপে রাখেন।” রামচন্দ্র কথা দিলেন। মাদারিরূপী শিব সেখানে বাঁদরটি দিয়ে চলে গেলেন। চার ভাই যখন খেলা করতেন, তখন বানররূপী হনুমান তাঁদের সঙ্গে খেলা করতেন। রাম খুবই স্নেহ করতেন হনুমানকে। আর হনুমান সর্বদা রামচন্দ্রের ছায়াসঙ্গী হয়ে ঘুরতেন। রামচন্দ্রের খেলনাসামগ্রী যেমন কন্দু, ঘুড়ির লাটাই, তির ইত্যাদি এনে এনে দিতেন। গাছে উঠে সুগন্ধি ফুল বা মিষ্টি ফল পেড়ে দিতেন।
উত্তরকাণ্ডের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, একই কারণে দেবতাদের বানর হয়ে জন্মগ্রহণ করতে হয়, রামকে রাবণবধে সাহায্য করার জন্যে। বালকাণ্ডে সেইসব বীভৎস কাহিনি আছে যেখানে ভগবানের আদেশে দেবতারা নাকি গন্ধর্বী, যক্ষী, অপ্সরা, বিদ্যাধরী ও বানরীদের গর্ভে স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই অসংখ্য বানর সৃষ্টি করলেন। কিন্ত রাবণকে ব্রহ্মার এই বর দেওয়ার কাহিনি শুধুমাত্র উত্তরাকাণ্ডেই আছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে নিঃসন্দেহে প্রক্ষিপ্ত।
“অপ্সরঃসু চ মুখ্যাসুগন্ধবীণাং তনুষু চ। যক্ষপন্নকন্যাসু ঋক্ষবিদ্যাধরীষু চ। কিন্নরীণাং চ গাত্রে বানরীণাং তনুষু চ। সৃজধ্বং হরিরূপেণ পুত্ৰাংস্তুল্য পরাক্রমান্।”–পৌরাণিক সমর্থনে বিষ্ণুকে যে কারণে রাবণবধের জন্য মানুষ হয়ে জন্মাতে হল, তা হচ্ছে ব্রহ্মা কর্তৃক অতীতে রাবণকে দেওয়া বর, যার ফলে নর আর বানর ছাড়া আর কারও পক্ষেই রাবণকে বধ করা সম্ভব নয়। অতএব রাবণের সঙ্গে এঁটে উঠতে হলে রামচন্দ্রকে বানরসেনাদের সাহায্য নিতে হবে এটা দেবমন্ত্রী ব্রহ্মার পূর্ব-পরিকল্পিত। এ থেকেই বোঝা যায় রাবণের শক্তির কাছে রামের একক শক্তি এতটাই ক্ষুদ্র ছিল যে, সশস্ত্র আর্যদেবতাদের প্রত্যক্ষ সাহায্য দ্বারাও রাবণ ও দাক্ষিণাত্যে কবজা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই কৃজ্ঞতায় আবদ্ধ করে দাক্ষিণাত্যের অন্যতম শক্তিশালী কিষ্কিন্ধ্যার রাজা সুগ্রীবকে দলে টানতে হল অন্যায়ভাবে। উপরি হিসাবে শূর্পণখার পরে বিশ্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বাসঘাতক বিভীষণকেও পাওয়া গেল। ফলে আর্যদেবতাদের দাক্ষিণাত্য জয় জলবৎ তরলং হয়ে গেল।
বস্তুত ‘বন’ শব্দের সঙ্গে ইক প্রত্যয় যগে ‘বান’ শব্দ হয়, যেমন বানপ্রস্থ শব্দে। তারপর ‘বান’ শব্দের সঙ্গে ‘নর’ শব্দের সন্ধি করলে, বনে বসবাসকারী মানুষ অর্থে বানর হতে পারে। লঙ্কার বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে তথাকথিত রাক্ষসেরা প্রকৃতপক্ষে সুসভ্য এবং নগরবাসী অনার্য ছিল। অর্থাৎ উত্তর ভারতীয় জনপদগুলি থেকে আর্যরা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকলে প্রথমে বনাঞ্চলের আদিবাসী এবং পরে আরও দক্ষিণে সুসভ্য নগরবাসী অনার্যদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। নারদ বিবৃত রামকথায় হনুমান-বানরদের কোনো উল্লেখ ছিল না। মহাকবি বাল্মীকি তাঁর মহাকাব্যে এই চরিত্রগুলি কল্পনা করেছেন যুদ্ধের প্রয়োজনে। যেহেতু রাম-লক্ষ্মণ রাজা নন, তাই তাঁদের সেনাবাহিনীও নেই। সসৈন্য রাবণের সঙ্গে সৈনহীন রামের যুদ্ধ সম্পন্ন কীভাবে হবে? অতএব বানরদের মতো কাল্পনিক ভাড়াটে সৈন্যদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, কাহিনির প্রয়োজনে। যেহেতু বানরদের যুদ্ধ করতে পারার কথা নয়, তাই বানরদের প্রায় সব ক্রিয়াকর্মই অলৌকিক পথেই করাতে হয়েছে। পরবর্তী কবিরা এবং পুরাণগুলিতে এই অলৌকিকতাগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য বানরদের উপর ‘দেবত্ব’ আরোপ করেছেন। কারণ দেবতারা সব পারেন, অলৌকিকতাকেও ইতিহাস করে দেওয়া যায়। লক্ষ করা যায় রামায়ণ ও রামের যুগে যুদ্ধাস্ত্র বলতে একমাত্র সম্বল তীর-ধনুক। রাম-রাবণ উভয়ই তীর-ধনুকের সাহায্যে যুদ্ধ করেছেন। একমাত্র বানরসেনারাই যুদ্ধে গদা ব্যবহার করেছেন, এটাই বোধহয় স্বাতন্ত্রতা। ১৯০০ সালের ৩১ তে জানুয়ারির উল্লিখিত ভাষণে স্বামী বিবেকানন্দ রামায়ণ ও মহাভারতের কল্পকাহিনিকে পরিষ্কারভাবেই বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে যুক্ত করেন এবং বানরদের বনবাসী আদিমজাতি বলে চিহ্নিত করেন, যাদের সঙ্গে বহিরাগত আর্যদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। তিনি এও বলেন যে এই বনবাসী আদিমজাতির মধ্যে যেসব মানুষ খুব বলশালী ছিল, তাঁদেরই আর্যেরা রাক্ষস বলতেন। বানরসেনা প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ এটাও বলেন–
“The Aryans did not know who were the inhabitants of these wild forests. In those days the foresttribes they called ‘Monkey’ and some of the so called “Monkey’, if unusually strong and powerful were called ‘demons’.”
হনুমান প্রসঙ্গে যা উল্লেখ না করলে নয়, তা হল–মুণ্ডা উপজাতিরা দুটি দাবি করে। (১) তাঁরা হনুমানের বংশধর। রামায়ণে উল্লেখিত বানর বা হনুমানের যে লেজ সেটা বায়োলজিক্যাল লেজ নয়, এটা ধুতি বা নেংটির বাড়তি খুঁট (লক্ষ করে দেখবেন মুণ্ডারা ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে আজও তাঁদের উৎসব-অনুষ্ঠানে লেজ বের করে ধুতি পরেন)।(২) তাঁরা হলেন রাবণের বংশধর। তাঁদের এ দাবি মেনে নিলে রাবণ ও হনুমান একই গোত্রের জাতি। অতএব রোমিলা থাপার, অতুল সুর প্রমুখের হিসাবমতে এঁরা সেই বিন্ধ্যপর্বত অঞ্চলেরই মানুষ। যাঁদের একদল বাস করত বলে বন-নর (বানর), আর-এক দল গর্জনশীল ঝর্ণা বা সরব নদী মোহনার কাছে বা কিংবা দ্বীপে বাস করত বলে রাবণ। তবে শুধুমাত্র দাক্ষিণাত্যের বানর প্রজাতিদের মধ্যেই লেজপ্রীতি ছিল, তা নয়। শিক্ষিত মিশরীয়গণ ছাড়াও লেজ সজ্জা’ হিসাবে আকৃষ্ট ছিল প্রাচীনকালের বেশকিছু আদিম জনগোষ্ঠী। বিশাখাপত্তনমের বাসিন্দাদের মধ্যে সবরজাতি পোশাকের সঙ্গে লেজও ব্যবহার করত। প্রাচীনযুগে বেশকিছু অরণ্যবাসী আদিমজাতিদের মধ্যেও লেজপ্রীতি ছিল। অরণ্যবাসীদের এই লেজপ্রীতির কারণ বোধহয় অরণ্যে বসবাসকারী অন্যান্য প্রাণীদের লেজ দেখেই তাঁরাও আসল না-থাকায় নকল লেজ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কোনো কোনো গবেষক বলেন, অভিষেককালে কোনো কোনো ভারতীয় রাজপরিবারে লেজকে ভূষণধারণের প্রথা হিসাবে অবশ্যপালনীয় ছিল। আন্দামানের একটি আদিমগোষ্ঠীদের মধ্যেও পিছনে লেজ লাগানোর অভ্যেস ছিল।
তবে রামায়ণ যে সময় রচিত হয়েছে, সে সময় বা তার আশেপাশে সময়ে কোনো বানর-মানুষ থাকার সম্ভাবনা নেই। দেখে নেওয়া যেতে পারে নৃতাত্ত্বিক রিপোর্ট–জিঞ্জিই হল বানর-মানুষ। জিঞ্জি, মানে জিঞ্জানথ্রোপাস (পূর্ব আফ্রিকার মানুষ)। ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ Dr. Louis Leakey ও তাঁর স্ত্রী Mary পূর্ব আফ্রিকার একটি হ্রদের বুক থেকে একটি খুলির জীবাশ্ম আবিষ্কার করলেন। নাম দিলেন জিঞ্জানথ্রোপাস। এই প্রজাতি ২০,০০,০০০ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত। জিঞ্জানথ্রোপাসের সমসাময়িক অস্ট্রেলোপিথিকাস, এ প্রজাতি দক্ষিণ আফ্রিকার বানর-মানুষ। এরপর কেটে যায় কুয়াশাচ্ছন্ন ১০,০০,০০০ বছর। এই লক্ষ বছরের মধ্যে আমরা আর কোনো বানর-মানুষ পাচ্ছি না। এরপর যাদের সন্ধান পাওয়া গেল, তাঁরা সিনানথ্রোপাস বা পিকিং মানুষ। এরপর পাই হোমোনিয়ানডার্থাল মানবগোষ্ঠী। প্রায় ৫,০০,০০০ বছর আগে এঁদের ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকায় আবির্ভূত হয়েছিল। এরা কিন্তু বানর-মানুষ নয়। অর্থাৎ অনেককাল আগেই বানর-মানুষের ইতি হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫,০০০ বছর আগেই এই নিয়ানডারথাল মানুষরা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এর পরবর্তীকালের নিয়ানডারথাল মানুষদের কোনো কঙ্কাল আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অপরদিকে ১০,০০,০০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বুকে কেটে গেছে চার-চারটি তুষার যুগ, শেষ হয় খ্রিস্টজন্মের ১৩,০০০ বছর আগে। নিয়ানডারথাল মানুষদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সময় এ পৃথিবীতে আবির্ভাব হয় ক্রোম্যাগনন মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ক্রোম্যাগনন মানুষই নাকি আমাদের আমাদের পূর্বপুরুষ। হিন্দু শাস্ত্রকারেরা বলেন রাম জন্মেছিলেন ৫০০০ বছর বছর আগে। অতএব রামায়ণে উল্লিখিত যে বানরজাতির কথা বর্ণিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ কল্পকথা। বানর-মানুষের অস্তিত্ব ২০,০০,০০০ আগেই খতম হয়ে যায়। ৫০০০ বছর আগে তা কল্পনাই করা যায়, বাস্তবিক নয়।
বানর বা হনুমান প্রসঙ্গে বাল্মীকি তাঁর রামায়ণে কীভাবে উপস্থাপন করেছেন তা দেখে নিতে পারি পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর ভাষ্যে–“এরা মোটেই আমাদের দৃষ্ট-ত বানরদের মতো ছিল না। তাদের বুদ্ধি, হৃদয় ক্ষমতা এবং চেহারার যে পরিচয় খোদ রামায়ণ থেকেই মেলে তাতে বোঝা যায়, এরা মানুষই ছিল, তবে অবশ্যই অনার্য সম্প্রদায়ভুক্ত। প্রথম কথা, প্রাচীন সংস্কৃতে ‘বা’ শব্দটি উপমার্থে ব্যবহৃত হত এবং ভাষাগত দিক দিয়ে বানর মানে দাঁড়ায় নরের মতে, মানুষের মতো৷…দেবতাদের ঔরসে এইসব বানরদের জন্ম দিয়ে বাল্মীকি নিজের জন্য অদ্ভুত এক বৈজ্ঞানিক ফাঁপর তৈরি করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় এঁরা আক্ষরিক অর্থে বানর ছিলেন না। যদি লেজের কথা বলেন, তা হলে প্রথমে মনে রাখতে হবে–বালীর বৌ তারা, সুগ্রীবের বৌ রুমা কিংবা অন্য কোনো বানরীর লেজের কথা ভুলেও উচ্চারণ করেননি। তবে হ্যাঁ, বালী, সুগ্রীব, হনুমান অথবা কাপড়চোপড়-পরা রামায়ণের সব বানরেরাই একটা করে লেজ নিজের দেহে লাগিয়ে নিতেন। সুন্দরকাণ্ডে হনুমান যখন সমুদ্র পার হওয়ার জন্য বিরাট এক লম্ফ দিলেন, তখন তাঁর পশ্চাৎদেশে লাগানো লেজটি গোরুড়ের মুখে লটকানো সাপের মতো লাগছিল–তস্য লাঙ্গুলম্ আবিদ্ধ অতিবেগস্য পৃষ্ঠতঃ দদৃশে গরুড়েনের হ্রিয়মানো মহোরগঃ। ‘আবিদ্ধ’, ‘সমাবিদ্ধ’–এইসব শব্দগুলি তো ‘আটকানো’, ‘লাগানো’ অর্থেই সংস্কৃতে ব্যবহৃত হয়। যদি-বা পণ্ডিতেরা শব্দের নানার্থ ভাবনায় ‘আবিদ্ধ’ শব্দের অন্য মনে করেন, তা হলে বলি বাল্মীকি রাবণের মুখ দিয়েই পরিষ্কার জানিয়েছেন যে রামায়ণী বানরদের লেজটা হল সম্মানের এবং সৌন্দর্যের প্রতীক।” অতএব এই লেজ বানর-হনুমানদের শরীরের অঙ্গও নয়, প্রত্যঙ্গও নয়৷ ওইসব বানর-হনুমানদের লেজ যে সম্মানের এবং সৌন্দর্যের প্রতীক, তা সহজেই অনুমেয় হয় যখন লঙ্কায় হনুমান রাক্ষসসৈন্যদের হাতে ধরা তাঁর লেজটিতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়–“তদস্য দীপ্যতাং শীঘ্রং তেন দগ্ধেন গচ্ছতু”। পুড়িয়ে দেওয়ার অর্থ হনুমানের সম্মান হানি করা, তার উপর তিনি আবার প্রতিপক্ষ রামচন্দ্রের প্রতিনিধি। আমরা ভারতের কোনো জাতির মধ্যে দেখব গোঁফ বা পাগড়ি সম্মানের প্রতীক। এঁদের প্রতিপক্ষ কেউ গোঁফ কেটে নিলে বা পাগড়ি খুলে নিলে তাঁদের সম্মান মান-মর্যাদা ধুলোর সঙ্গে মিশে যায়। বানর-হনুমানদের লাগানো লেজ মর্যাদারই প্রতীক ছিল।
প্রাবন্ধিক বীরেন্দ্র মিত্রও প্রায় একই বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেছেন–“বাল্মীকি রামায়ণে চতুস্পদ এবং সহজাত লাঙ্গুলধারী বানর-বানরীর উল্লেখ নেই। বরং বানরজাতি কর্তৃক লাঙ্গুল শোভা ধারণের অর্থাৎ লাঙ্গুল সজ্জা গ্রহণের স্বীকৃতিই চোখে পড়ে। মানুষের বানরত্ব ঘটেছে মুনিদের বানানো প্রক্ষিপ্ত কল্পকাহিনির মধ্যে। মহাকাব্যে যদিও স্পষ্টতই বলা হয়েছে, ‘দেবগণ ভগবান স্বয়ম্ভর আদেশ শিরোধার্য করিরা বানররূপী পুত্র সকল উৎপাদন করিতে লাগিলেন’।–কথকঠাকুররা কায়দা করে সেই ‘বানররূপী’ বা ‘বানর রূপসজ্জাধারী’ দেবপুত্রদের ‘কিলকিলা’ রবকারী বৃক্ষশাখাবাসী বানরে সরাসরি রূপান্তরিত করে গেলেন। একটি সুশিক্ষিত মানবজাতিকে অবমাননা এমন নজির বিস্ময়কর।.. যাত্রাপালাগানে এবং নব নব রামায়ণকথায় বেদজ্ঞ, রাজনীতিপ্রাজ্ঞ, প্রখর বুদ্ধিবিদ্যাসম্পন্ন এক দক্ষিণী মহাবীর একটি অতিপ্রাকৃত হনুমার রূপেই চিত্রিত হয়ে আছেন।”
বাল্মীকির রামায়ণে বানর, হনুমান প্রজাতি ছাড়াও আর-একটি প্রজাতি কথাও জানা যায়, তাঁরা হলেন ভাল্লুক। আগের শ্লোকে আমরা ‘ঋক্ষ’ শব্দটা পেয়েছি। ঋক্ষ ও ভাল্লুক সম্প্রদায় সম্ভবত একই গোত্রীয়। রামায়ণে সুগ্রীবের বানরসেনাদের মধ্যে জ্ঞানবৃদ্ধ জাম্ববানকে পেয়েছি। ভাল্লুক সম্প্রদায়ের রাজা জাম্ববান ছিলেন ঋক্ষরাজ। মহাভারতের জাম্ববান-কন্যা জাম্ববতাঁকে বিয়ে করেন কৃষ্ণ। জাম্ববতীর প্রথম পুত্র শাম্ব। রামায়ণে জাম্ববান রাম-সহায়ক বানররাজ সুগ্রীবের মন্ত্রী ও সেনাপতি ছিলেন। এই জাম্ববান ভাল্লুক সম্প্রদায়গণের আদি নিবাস হিমালয়। পরে দেবমন্ত্রী ব্রহ্মার আদেশে দাক্ষিণাত্যে বসবাস শুরু করেন।
প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন টোটেমি জাতি ছিল। শুধু ভারতে কেন, সারা পৃথিবীতেই টোটেমী অস্তিত্ব ছিল। সাধারণত জন্তু-জানোয়ারের নামেই টোটেমী-পরিচিত হত। সেই টোটেম নামেই হত গোষ্ঠীর নাম, পরম্পরায়। ভারতে সর্প টোটেম (নাগ), ঋক্ষ টোটেম (ভাল্লুক), কপি টোটেম (বানর), সারমেয় টোটেম (কুকুর), মহিষ টোটেম, শৃগাল টোটেম ইত্যাদি। স্যার হারবার্ট রিসলের ‘এথনোগ্রাফিক সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে সাঁওতাল, হোম, মুণ্ডা, ভিল প্রভৃতি জাতির মধ্যেই টোটেমি প্রথার প্রাধান্য ছিল। ফ্রয়েড জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়ায় টোটেম হচ্ছে ক্যাঙারু, এমু। মেলানেশিয়া, পলিনেশিয়া, আফ্রিকার নিগ্রোদের মধ্যেও অনুরূপ টোটেমী ছিল। স্কটল্যান্ডবাসী জে ফারগুসন ম্যাকলেন্নান মাউদের প্রাচীন ইতিহাসে টোটেম প্রথার বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করেছিলেন। অস্ট্রিলিয়ার বাইরে উত্তর আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের মধ্যে, পলিনেশীয় দ্বীপের বিভিন্ন জাতির মধ্যে, পূর্ব ভারতে, আফ্রিকার নানা জায়গায় টোটেমীয় প্রথা ছিল। আদিম আর্যদের মধ্যেও এবং ইউেরোপের সেমিটিক জাতিদের মধ্যেও টোটেম ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ওল্ডেনবার্গ লক্ষ করেছেন মাছ ও কুকুর টোটেমও আর্যসম্প্রদায় বিশেষে মান্য ছিল ঋগ্বেদীয় আমলে। প্রাচীন ভারতে ‘ভালুকি’ নামে এক রসায়নশাস্ত্রবিদের কথা যায়। অষ্টম শতকের আর এক রসায়নবিদ ‘কাকচণ্ডেশ্বর’-এর পরিচয়ও আমরা জানতে পারি। জানতে পারি ‘শাদূল’ নামের এক নৃত্যচার্যের কথা। বহু গবেষক মনে করেন, টোটেম ব্যবস্থা মানবীয় বিকাশের একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় স্তর, যা প্রত্যেক জাতিই তার ক্রমবিকাশের পথে অতিক্রম করেছে। আর্য পুরাণকাররা টোটেমী অনার্য জাতিগোষ্ঠীকে তাঁদের টোটেম দ্বারাই অভিহিত করে মানুষের উপর জান্তব প্রাণীর অবয়ব নির্মাণ করেছেন। আর্য বা আর্যদেবতারা তো বাঙালি প্রজাতিতে পাখি বলত, বাঙালিদের ভাষা পাখির ভাষায় মতো। আর্যরা ভারত উপমহাদেশের মানুষদের নিয়ে তাদের ঘৃণা ও নিন্দার কোনো শেষ ছিল না। তাঁরা এদের অভিহিত করেছে দাস, দস্যু, অসুর, রাক্ষস ইত্যাদি নামে। আবার কোথাও বলেছে মাছখেকো, বয়াংসি বলে। বাঙালি ‘বয়াংসি’ অর্থাৎ পাখির জাত, কারণ আর্যদের মতে এঁরা পাখির মতো কিচির-মিচির ভাষায় কথা বলে। মোদ্দা কথা, সীতা উদ্ধার তথা দাক্ষিণাত্যে আর্য-উপনিবেশের জন্য রামচন্দ্রকে এক ফোঁটাও আর্যরক্ত খরচ হয়নি সবই হয়েছে বানরদের উপর দিয়ে। হাজার হাজার বানর প্রাণ দিয়েছেন সুগ্রীবের স্বপ্নপূরণের মূল্য হিসাবে।