রামায়ণে বিমানের ব্যবহার
রামায়ণের যুগে কি বিমানের ব্যবহার ছিল? বাল্মীকির রামায়ণের কিন্তু বহু জায়গায় বিমানের উল্লেখ আছে। ২৪,০০০ শ্লোকে লেখা রামায়ণ দেবতাদের মহাকাশ পরিক্রমা বিবরণে সমৃদ্ধ। রামায়ণে এমন একটি আশ্চর্যজনক রথের উল্লেখ আছে, তা পাঠ করে মনে হয় রথ এক মহাকাশযান। সেই রথ আকাশে বিচরণ। করছে একসঙ্গে অনেকগুলো লোক নিয়ে। সেই যানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ‘উড়ন্ত পিরামিড’ বলে, যা উল্লম্বভাবে আকাশে উঠত। নিঃসন্দেহে মাটি ছেড়ে আকাশে ওঠার সময় সেই যান বিকট শব্দ করত। বাল্মীকি রামায়ণের বর্ণনায়–“প্রভাত উদয়ে রামচন্দ্র সেই স্বর্গীয় বিমানে আরোহণ করিলেন। যানের অসীম শক্তি। বিমানটি দ্বিতল, তাহাতে বহু বিভাগ এবং অসংখ্য গবাক্ষ ছিল। … বিমানটি সুশোভিত এবং শক্তিশালী ছিল। … তাহা যখন আকাশমার্গে গমন করিল, তখন তাহা হইতে স্বর্গীয় শব্দ প্রকাশিত হইতে লাগিল।” সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘সমরাঙ্গনসূত্রধার’ নামে এই প্রাচীন গ্রন্থটি বিমান নিয়ে লিখেছে–“দেহটি যেন বেশ শক্তসামর্থ্য, টেকসই এবং যথেষ্ট স্বল্পভার বস্তু দিয়ে গঠিত হয়। … পারদে যে শক্তি সুপ্ত রয়েছে, তাকে জাগিয়েই মানুষ দূর-দূরান্তের আকাশ পাড়ি দিতে পারে। পারদই বিমানের চালিকাশক্তি। চেষ্টা করলে দেবমন্দিরের মতো বিশাল বিমানও গঠন করা সম্ভব। বিমানের মধ্যে পারদের চারটি আধার থাকবে। তারপর লৌহের আধার থেকে নিয়ন্ত্রিত অগ্নিসংযোগে পারদ থেকে বিদ্যুৎশক্তি লাভ করে বিমান যখন ঊধ্বাকাশে উঠে যাবে, তখন তাকে দেখলে মনে হবে যেন একটি উজ্জ্বল মুক্তাবিন্দু।”
রামায়ণে কোথাও উড্ডীন যন্ত্র, কোথাও স্বর্গীয় যান বা কোথাও দেবযান বলে উল্লেখ আছে। অরণ্যকাণ্ডে বলা হয়েছে, দুবৃত্ত রাবণ ঠিক কেমন করে সূর্য সদৃশ বিমানে মনোরমা সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই বিমান উড়ল উপত্যকা, বন-উপবন, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে। বানররাজ হনুমান ছিলেন ব্যোমযান চালক হিসাবে অসমসাহসী। বাল্মীকির বয়ানে রামায়ণ বলছে–“তিনি যখন পর্বত শীর্ষ হইতে ব্যোমযান চালনা করেন, তখন পর্বতশীর্ষ ভাঙিয়া পড়ে, তাহার ভিত্তি কম্পিত হইতে থাকে, সুবিশাল তরুশ্রেণি শাখাপ্রশাখাহীন হইয়া ভাঙিয়া পড়ে, শাখা-প্রশাখা-কাণ্ড-পত্রের বৃষ্টি ঝরিতে থাকে, পর্বতের পক্ষিকুল এবং জীবজন্তু তাহাদের গুপ্ত আশ্রয়ে পলাইয়া যায়।”
আর্য, অনার্য, রাক্ষস, বানর, হনুমান সকলেই বিমানের ব্যবহার করেছেন বলে জানা যাচ্ছে বাল্মীকির রামায়ণে। বাল্মীকির রামায়ণে কুম্ভকর্ণ, রাবণ, ইন্দ্রজিৎ প্রমুখরা বিমানে চড়ে যুদ্ধ করেছেন বলে জানা যায়। ইন্দ্রজিতের সঙ্গে লক্ষ্মণের যুদ্ধ উভয় উভয়ের বিমান থেকেই হয়েছে। ইন্দ্রজিতের অন্য নাম মেঘনাদ। তার কারণ তিনি মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতে পারতেন। মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করা সম্ভব একমাত্র বিমানে চড়লেই–বিমান কখনো মেঘের নীচে, কখনো মেঘের নীচে, এ তো হয়েই থাকে। রাবণও রামের (মতান্তরে ইন্দ্রের সঙ্গে) সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন বিমানে চড়েই। হনুমান লঙ্কায় অশোকবনে সীতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অপদস্থ হয়ে ফেরার সময় বিমানে চড়ে রামশিবিরে ফেরেন বলে জানা যায়। বাল্মীকির রামায়ণ থেকে আরও জানা যায়, তাড়কার সঙ্গে যুদ্ধের সময় আর্যদেবতারা তাঁদের ‘উড়ন্ত রথে চেপে সমরাঙ্গনের উপর চক্কর দিচ্ছিলেন। আকাশপথ থেকে তাঁরাও তাড়কাসৈন্যদের হত্যা করেছেন। দণ্ডকারণ্যে অগ্নিদাহনের সময়ও উড়ন্ত অবস্থায় ইন্দ্র নাগকুল নিকেষ করেছিলেন। মরু ও গন্ধর্বরাও আকাশপথ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করতেন। মরুরা তো জলে-স্থলে-আকাশে বিচরণশালী দুর্ধর্ষ যোদ্ধারূপেই প্রাচীন যুগে প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিষ্ণুরও আকাশযান বা বিমান ছিল, তাঁর বিমানচালক গরুড়। বাল্মীকির রামায়ণে বিরাধ-যানেরও উল্লেখ আছে, যে যানের চালক গন্ধর্বজাতি তুম্বুরু। ‘উড়ন্ত যান’ পরশুরামেরও ছিল, যে যান ‘প্রচুর হাওয়া ছুটিয়ে গাছের ডালপালা ভেঙে মেঘগর্জনের গম্ভীর শব্দ তুলে’ অবতরণ করেছিল।
ভোজরাজ রচিত ‘সমরাঙ্গনসূত্ৰধার’ গ্রন্থের যন্ত্রবিধান অধ্যায়ে ‘ব্যোমচারী বিহঙ্গযন্ত্র’, ‘আকাশগামী দারুময় বিমানযন্ত্র’-এর উল্লেখ আছে। তবে রামায়ণে পুষ্পক রথ ও মহাভারতে অপূর্ব নানা যন্ত্রের বর্ণনা থাকলেও তাতে ততটা বাস্তবসম্মত বর্ণনা নেই, যা এখানে আছে। এখানে পারদ ব্যবহার করে বিমান চালানোর কথা বলা হয়েছে। এই গ্রন্থে আকাশযানের বিবরণে শূন্যমার্গে যন্ত্রচালনার সমস্যা, শূন্যে অবস্থান এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তখনকার দিনে শিক্ষাদান পদ্ধতি হাতেকলমে হত বোঝা যায়। ভরদ্বাজ ঋষির বিমানশাস্ত্রের উপর একটি পুরো গ্রন্থই রচনা করে রেখেছেন। গ্রন্থটির নাম ‘বৈমানিকশাস্ত্রম্’। এই গ্রন্থটি থেকে বেশ কিছু পৌরাণিক বিমানের কারিগরি সংবাদ পাওয়া যায়। বিমানের সংজ্ঞা দিয়ে ভরদ্বাজ বলেছেন–
“পৃথিব্যপস্বন্তরীক্ষে খগবদ্বেগত স্বয়ম্।
যসসমর্থো ভবদ্বম্ভং স বিমান ইতি মৃতঃ।”
অর্থাৎ যা আপন শক্তিতে পাখির মতো জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বিচরণ করতে পারে তারই নাম বিমান। বিমানকে শূন্যপথে একই জায়গায় স্থির করে রাখার কৌশলের নাম–“বিমানস্তম্ভনক্রিয়ারহস্যম”। এরকম বেশ কিছু সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থ পাওয়া যায়, যেখানে বিমান বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে।
রামায়ণের যেরূপ যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়, তা স্থলযুদ্ধ ছাড়াও বৈমানিক যুদ্ধেরও পরিচয় পাওয়া যায়। রামায়ণে উল্লেখ আছে–“ওই সময় দেবতা, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও চারণগণ তথায় বিমানে আরোহণপূর্বক অবস্থান করিতেছিলেন।” আর্যদেবতারা তাঁদের বিমান থেকে কী ধরনের অস্ত্র নিক্ষেপ করে খরের সেনাবাহিনী ধ্বংস করেছিলেন, সেকথা স্পষ্টতই রামায়ণে উল্লেখ আছে। খরের কাছেও বিমানযুদ্ধ মোকাবিলা করার মতো অস্ত্র যে ছিল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। খর অবিচলিতভাবে আকাশপথের আর্যদেবতাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে পঞ্চবটিতে প্রবেশ করেছেন এবং শেষপর্যন্ত রামশিবির আক্রমণ করতে সমর্থ হয়েছেন। যদিও শেষরক্ষা তিনি করতে পারেননি। সীতা অপহরণের সময় জটায়ুও রাবণের সঙ্গে বিমানে চেপে যুদ্ধ করেছিলেন। জটায়ুর ভগ্ন আকাশযানটি রাবণের সঙ্গে আকাশযুদ্ধের সাক্ষ্যস্বরূপ তখনও পড়ে ছিল। উল্লেখ্য, জটায়ু কোনো পাখিবিশেষ নয়। জটায়ু সম্পূর্ণভাবে মানুষ। তিনি আর্যদেবতা অরুণের ঔরসে স্যেনী বা মহাশ্বেতা নামক নারীর গর্ভজাত। জটায়ুর বড় ভাই সম্পাতি, ইনিও দক্ষ বিমানচালক ছিলেন। প্রসঙ্গত। উল্লেখ্য, জটায়ু অযোধ্যার রাজা দশরথের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন।
রামায়ণের বিমানের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে নানাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। বিমানের কম্পন এবং শব্দ বা গর্জনের কথা উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে–“ওই প্রদীপ্ত পাবকতূল্য মহাবল ঘনঘন কম্পিত হইতেছেন এবং সর্বাঙ্গের নোম স্পন্দন পূর্বক জলদগম্ভীর রবে গর্জন করিতেছেন।” ‘জলদগম্ভীর’ বলতে মেঘগর্জনই বোঝায়। বিমানের ইঞ্জিন চালু হলে মেঘগর্জনের মতোই শোনায়। রামায়ণকার হনুমানের বিমানের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন–“উহার কক্ষ্যান্তরাগত বায়ু জলবৎ গম্ভীর রবে গর্জন করিতেছে।” একজন বিমানযাত্রী যেভাবে উড়তে উড়তে অপসৃয়মাণ নীচের দৃশ্যাবলি দেখেন, ঠিক সেইভাবেই হনুমান লঙ্কা দেখছিলেন। হনুমানের লংকা দেখার বিবরণ ঠিক সেইভাবেই দেওয়া হয়েছে। হনুমানের ক্ষুদ্র থেকে বৃহদাকার এবং বৃহদাকার থেকে ক্ষুদ্র হয়ে যাওয়াটি বিমানের ভিতর প্রবেশ ও প্রস্থানের চিত্রটিই প্রকট হয়। সীতার অন্বেষণ করে ফেরার পথে হনুমান বিমানে চড়েছেন কথা বর্ণনাতেই আছে। গমনে আর আগমনে এরকম বর্ণনা বিমানে চেপে সমুদ্র লঙ্ঘন করেছিলেন এটাই প্রমাণ হয়। সেই বিমানের শব্দ শুনে অঙ্গদবাহিনী কী বলছে কবির লেখনীতে জানা যাক–“দূর হইতে বায়ু ক্ষুভিত মেঘের গভীর নির্ঘোষের ন্যায় উহার … সিংহনাদ শুনিতে পাইল। এই শব্দ শুনিবামাত্র সকলেই উহাকে দেখিবার নিমিত্ত ব্যগ্র হইয়া উঠিল।”
কুম্ভকর্ণও ‘কুম্ভকর্ণ’ নামক বিমানে চড়েই হনুমানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এমন বর্ণনাই আছে। প্রাচীনকালে যিনি বিমানের মালিক বা চালক তাঁর নামেই বিমানের নাম হত। যেমন কুম্ভকর্ণ-বিমান, ইন্দ্রজিৎ-বিমান, হনুমান বিমান, গরুড়-বিমান, ইন্দ্র-বিমান ইত্যাদি। ইন্দ্রজিৎও বিমানে চড়ে যুদ্ধ করেছিলেন এবং বিমানেই ‘ড্যামি’ সীতাকে এনেছিলেন রণক্ষেত্রে এবং বিমানেই তাঁকে খাঘাত করে হত্যা করেছেন। লক্ষ্মণ হনুমান-বিমানে চড়ে বিমানারূঢ় ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। বাল্মীকি বলেছেন–“উঁহারা অন্তরীক্ষগত দুইটি গ্রহের … ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।” রাবণও বিমানে চড়েই যুদ্ধ করেছেন। সে সময় ইন্দ্র-বিমানে চড়ে ইন্দ্র উপস্থিত হলে ইন্দ্রের চালক মাতলি রামকে বিমানে তুলে নিয়েছিলেন। রামকে ঘিরে “বিমানচারী দেব, দানব, গন্ধর্ব, উরগ, ঋষি”-রাও রণস্থলের উপর অবস্থান করছিলেন। লঙ্কাযুদ্ধের পর সীতাকে নিয়ে রাম বিমানেই। অযোধ্যায় ফিরেছিলেন। শুধু রাম-সীতাই নয়, অন্য বিমানে চড়ে হনুমান-লক্ষ্মণ-সুগ্রীব-জাম্ববান-বিভীষণ সকলেই রামের সঙ্গে এসেছিলেন। এ বিষয়ে বাল্মীকির রামায়ণে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে।
রাম-সীতা অযোধ্যায় ফেরার পথে যে যে দৃশ্য দেখে সীতাকে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তা উপর থেকে দেখেই বলা সম্ভব, নীচ থেকে কোনোভাবেই নয়। সামান্য নমুনা দিই। রাম বলছেন–“পুষ্পকরথ মহানাদে গমনমার্গে উত্থিত হইল। তখন রাম চতুর্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্বক চন্দ্রাননা জানকীকে কহিলেন, প্রিয়ে ঐ দেখ … ত্রিকূটশিখরে বিশ্বকর্মানির্মিত লঙ্কাপুরী। ঐ দেখ … যুদ্ধভূমি।” ইত্যাদি ইত্যাদি। আর-একটু পড়ুন–“ঐ যে সমুদ্রে একটি অবতরণ পথ দেখিতেছ, আমরা সমুদ্র পার হইয়া ঐ স্থানে রাত্রিবাস করিয়াছিলাম। ঐ দেখ … লবণ সমুদ্রে সেতুবন্ধন করিয়াছি, ইহা নল নির্মিত ও অন্যের অসাধ্য। এই দেখ … মহাসমুদ্র … ঐ স্বর্ণবর্ণ গিরিবর মৈনাক। এই দেখ সমুদ্রের উত্তর তীরবর্তী সেনানিবেশ।” এরপর কিষ্কিন্ধ্যা নগরী, রাম দেখালেন কোথায় বালীকে হত্যা করেছিলেন। দেখা গেল ঋষ্যমূক পর্বত, যেখানে তিনি সুগ্রীবের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। এরপর দৃশ্যমান হল পম্পা নদী, সীতাকে এখানে শবরী ও কবন্ধের কথা বললেন। এরপর দৃশ্যমান হল তাঁদের আশ্রমশিবির, যা এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। একে একে গোদবরী, অগস্ত্যের আশ্রম, শরভঙ্গের ডেরা, চিত্রকূট পর্বত, যমুনা নদী, ভরদ্বাজের আশ্রম, পুণ্যসলিলা গঙ্গা, শৃঙ্গবের পুর, অবশেষে গন্তব্য অযোধ্যা।
বিমান যত সামনে এগিয়েছে, দৃশ্য তেমনই পালটে পালটে গেছে। বিমান বিষয়ে বিস্তারিত জানতে অবশ্যই বাল্মীকির রামায়ণটি পাঠ করতে হবে। বিকল্পে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনূদিত বাংলা রামায়ণ পড়া যেতে পারে। এর সঙ্গে যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক ও রামায়ণ গবেষক বীরেন্দ্র মিত্রের রামায়ণে দেবশিবির’-ও পড়ে নিন। এরপর যদি কেউ বলেন রামায়ণের যুগে বিমান তো দূরের কথা, বিমানের জ্বণও ছিল না–তাহলে মেনে নিতে হয় রামায়ণ প্রাচীন যুগে হয়নি, এটি রচিত হয়েছে ১৯০৩ সালের পর। কারণ ১৯০৩ সালের পরই বর্তমানে যে বিমান দেখি সেই বিমান আবিষ্কার করেছেন রাইট ভ্রাতৃদ্বয়।
দানিকেন বলেন–“প্রাচীন ভারতের পুঁথিপত্রে যে বিমানের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেই বর্ণনাকে যাঁরা নেহাত বুজরুকি মনে কতটা ভাবতে জানে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। প্রাচীন পুঁথিপত্রে যেসব ‘উদ্ভট বস্তুর দেখা মেলে, অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গে যাদের খাপ খাওয়ানো যায় না, তা থেকে আর-একটি তত্ত্বের হদিস মিললে তাকে বাজে বলে বাতিল করা হয়ে থাকে। নতুন সেই তত্ত্ব মতে মানবকদের ‘মানুষ’ করেছিল বহির্জাগতিকেরা, তাদের মস্তিষ্ককে। কিন্তু সুদীর্ঘ মানবেতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সে উন্নতি ঘটেছিল, বলতে গেলে, একেবারেই হঠাৎ।”
রামায়ণের যুগে যদি বাস্তবিক বিমানের অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে সে সময়কার মানুষ কীভাবে স্বর্গীয় যানের বর্ণনা করতে পারল এত নিখুঁতভাবে? আকাশে অর্থাৎ শূন্যে বিমানের মতো যান ওড়াতে কী কী বস্তুর প্রয়োজন, সেটাই-বা জানল কীভাবে? বিমান চালানোর যন্ত্রপাতিই-বা আসত কোথাও থেকে? যেসব ব্যোমযান স্বর্গকেও চমকে দিত, সে সব তো ছেলেখেলার বিষয় ছিল না। প্রাচীন পুঁথিগুলোতে যে স্বর্গীয় ব্যোমযানের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেগুলি ছিল বহুতলবিশিষ্ট, সেই যানের ভিতরটা ছিল মন্দিরের মতো বিশাল। এসব তো ঘরে নিত্য ব্যবহৃত হাতা-খুন্তি-সাঁড়াশি দিয়ে বানানো সম্ভব নয়! দানিকেন বলেছেন–“নির্মাণকৌশলের দিক থেকে বিচার করলে আধুনিক স্পেস শাটলের চেয়ে ভারতীয় পুঁথিপত্রে বর্ণিত বিমানের ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। পৃথিবীর চারদিকে তাঁরা ঘুরে বেড়াতে পারত, আকাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত, মিশে যেতে পারত তারাদের সঙ্গে এবং এমন তীব্র আলো ফেলতে পারত যে, মনে হত আকাশে দুটো সূর্য রয়েছে।” আক্ষেপের বিষয় এটাই যে, সেইসব প্রাচীন প্রযুক্তিবিদরা তাঁদের প্রযুক্তির নির্মাণ-কৌশলের বিবরণ কোথাও রেখে যাননি।
মানুষ সেই সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যেসব স্বপ্ন দেখে আসছে তার মধ্যে আকাশে ডানা মেলার স্বপ্নই সবচেয়ে বেশি প্রাচীন। সভ্যতার শুরুতে অনেক জীবনযাপন পশুপাখির কাছ থেকে শিখেছে। মানুষের অনেক আগে পশুপাখিরা পৃথিবীতে এসেছে। মানুষই সর্বশেষ প্রাণী, যাঁরা পৃথিবীতে এসেছেন। যাই হোক, পাখিকে আকাশে উড়তে দেখে মানুষেরও সাধ হয়েছে পাখির মতোই তাঁরাও আকাশে অবাধে উড়ে বেড়াবে। তারপর দীর্ঘদিন অনেক মানুষের অনেক কষ্ট, পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে আজ মানুষ আকাশে চড়ে বেড়াচ্ছে। মহাশূন্য, চাঁদ জয় করে চলেছে। তবুও তার সেই প্রাচীনতম আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু হয়নি। সে চায় আরও দৃপ্ত, আরও নিরাপদ, আরও সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে আকাশে ডানা মেলে বেড়াতে। আর এজন্য যথারীতি চলছে বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা কীভাবে আকাশ আরও নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও দ্রুত করা যায় তার জন্য। আর বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টায় প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সাফল্য এসে ধরা দিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বিশালাকার, দ্রুতগতির ও আরামদায়ক বিমানের।
ভেবে দেখুন, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ উড়ার জন্য যে কতটা ব্যাকুল ছিল তা বোঝা যায় বিভিন্ন প্রাচীন উপকথার দিকে তাকালেই। সেখানেও বিভিন্নভাবে এসেছে মানুষের আকাশে ভ্রমণের কথা। গ্রিক পুরাণের একটি গল্প শোনাই–প্রাচীন যুগে ডিডালুস ও তার ছেলে ইকারাস পাখির পালক দিয়ে ডানাসদৃশ বস্তু তৈরি করে তা মোম দিয়ে পরস্পরকে দিয়ে আকাশে উড়তে সক্ষম হয়েছিল। এইভাবে একসময় ইকারাস বেশি উপরে উঠে গেলে সূর্যের উত্তাপে তার ডানার মোম গলে গেলে তা থেকে থেকে পালক খসে পড়ে গেলে সে নদীতে পড়ে যায়।
গ্রিকরা যে শুধু রূপকথা নিয়েই পড়ে ছিল তা কিন্তু নয়। এই রূপককে বাস্তবে রূপ দিতেও তাঁদের দেশে সেই সময়ে অনেকেই কাজ করে গেছেন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালে আর্কিটাস, যিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, গণিতবিদ, জ্যোতিষী। তিনি প্রথম উড়ুক্কু মানের ডিজাইন ও মডেল নির্মাণ করেছিলেন এবং এটি নাকি ২০০ মিটার পর্যন্ত উড়তে সক্ষম হয়েছিলে। তিনি এই যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন পিজিয়ন।
উন্নত উড্ডয়ন যন্ত্রের চিত্র অংকন করেছিলেন শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। প্রাজ্ঞজন বলেন, তিনিই সর্বপ্রথম আকাশে উড়ার একটি তাত্ত্বিক ধারণা দেন। তাঁর ডিজাইন করা গস্নাইডারে ডানার ভিতরের অংশ ছিল মূল কাঠামোর সঙ্গে শক্তভাবে লাগানো। আর ডানার নড়তে সক্ষম অংশগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল আলাদা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এর নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ওরনিথপ্টার। ১৪৯৬ সালে তিনি এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। কেননা এ যন্ত্রের সাহায্যে আকাশে পাখির মতো মুক্তভাবে উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করা সম্ভব ছিল না সেই সময়। অনেকে অবশ্য বাহুবলেই এই যন্ত্রের সাহায্যে উড়তে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই চেষ্টায় কেউ সফল হয়েছে বলে শোনা যায়নি কখনো। কেননা মানুষের বুকের ও কাঁধের পেশিগুলি এই কাজ করার মতো যথেষ্ঠ শক্তিশালী নয়। ভিঞ্চির মৃত্যুর পর অনেকদিন আর আকাশে ডানা মেলার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৬৩০ সালের দিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ৬২.৫৯ মিটার উঁচু গালাতা টাওয়ার থেকে হিজাফেন আহমেদ সালাবি নামক এক ব্যক্তি নিজের তৈরি উড়ুক্কু এক যানে করে ৩ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬৩৩ সালে তার আর-এক ভাই হাসান সালাবি সাতটি ডানার এক রকেটে করে আকাশ উড্ডয়ন করেছিলেন। এর উপরের অংশ ছিল গান পাউডারে পূর্ণ। এটিই মানুষের বানানো প্রথম রকেট বলে মনে করা হয়। তিনি গান পাউডার শেষ হওয়ার পর ডানাগুলিকে প্যারাসুটের মতো ব্যবহার করে নিরাপদেই অবতরণ করেছিলেন। তিনি আকাশে ছিলেন প্রায় ২০ সেকেন্ড আর ৩০০ মিটার মতো উঁচুতে উঠেছিলেন বলে জানা যায়।
বাতাসের চেয়ে ভারি কোনো উড়ুক্কু যান সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭১৬ সালে, ‘স্কেচ অফ এ মেশিন ফর ইন দা এয়ার’। লিখেছিলেন ইমানুয়েল সুইডেনবর্গ। তিনি এই বইয়ে তাঁর ফ্লাইং মেশিনের বর্ণনায় বলেছিলেন এটি হাল্কা কাঠামোর শক্ত ক্যানভাসে ঢাকা একটি যন্ত্র যার দুটি বড়ো ডানা ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন যে, এই কাঠামো আকাশে উড়ার মতো প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দেওয়ার মতো ব্যবস্থা এতে ছিল না। ১৯০১ ও ১৯০৩ সালে দুটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইড পরিচালনা করলেও এগুলির ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা তেমন আশানুরূপ ছিল না। পরে তিনি ৫২ হর্সপাওয়ারের দুটি শক্তিশালী ইঞ্জিন ব্যবহার করে পরীক্ষা চালালেও তার এই মডেল এইক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখেনি। ইনিই প্রথম উড়ুক্কু যান নিয়ে আকাশে উড়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
অবশেষে অরভিল রাইট আর উইলবার রাইট ভ্রাতৃদ্বয় নতুন যুগে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার কিল ডেভিল হিলসে ১৯০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারা ফ্লায়ার ওয়ানের সফল উডডয়ন করান। প্রথম ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন অরভিল রাইট। তিনি প্রথম ফ্লাইটে ১২ সেকেন্ড ৩৭ মিটার পথ পাড়ি দেন। একই দিনের চতুর্থ ফ্লাইটে উইলবার রাইট ৫৯ সেকেন্ডের ফ্লাইটে ২৬০ মিটার পথ পাড়ি দেওয়ার কৃতিত্ব দেখান। চারটি ফ্লাইটই মাটির ১০ ফুট উপর দিয়ে পরিচালনা করা হয়। প্রথম উড্ডয়নে আকাশযানের সামনের রাডার বহনকারী কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মূল কাঠামোটি সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল। ১৯০৫ সালের ৫ অক্টোবর উইলবার রাইট ৩৯ মিনিট ২৩ সেকেন্ডে ২৪ মাইল পথ পাড়ি দেবার গৌরব অর্জন করেন।
শুধু রামায়ণেই তো নয়, মহাভারত ও বাইবেল পুরাণাদিতেও বারবার বিমান বিষয়ে উল্লেখ আছে। পৌরাণিক বিবরণসমৃদ্ধ বাইবেল গ্রন্থেও আকাশপথ থেকে মিশ্ৰীয় সেনাবাহিনীর উপর বিশ্বপ্রভুর আক্রমণের বর্ণনা আছে, যা আকাশযুদ্ধেরই বর্ণনা। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, বাইবেলে যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিমানের উল্লেখ আছে, সেটা বিমান বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না-থাকলে কখনোই বর্ণনা করা সম্ভব হত না। পৌরাণিক যুগে ভয়ংকর ভয়ংকর যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার হয়ে গেল, বিমান আবিষ্কারটাও কিন্তু দুঃসাধ্য হতে পারে না।
তাহলে এমন তো নয় পৌরাণিক যুগের পর বিমান নিয়ে কোনো গবেষণা বা প্রচেষ্টা হয়নি! মাঝের সময়গুলি কি বিজ্ঞান গবেষণায় অন্ধকারময় যুগ ছিল? তাই কি আরও অনেক সময় লেগে গেল আধুনিক বিমানে পৌঁছোতে! দানিকেন এক সংগত প্রশ্ন তুলেছেন–ক্রমবিকাশের ধারায় সেই যানগুলো আরও উন্নত হল না কেন? পারে পায়ে তাহলে তো কয়েক হাজার বছর আগেই আমরা চাঁদে যেতে পারতাম। বস্তুত ইতিহাস বলে প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও প্রাচ্যের মানুষরা ছিলেন খুবই বিজ্ঞানমনস্ক। তাঁরা বহু আবিষ্কারের হোতা হলেও তা তাঁরা সংরক্ষণ করে রাখতে পারেননি। ফলে পাশ্চাত্যের মানুষেরা যেভাবেই সেসব জ্ঞান চুরি করে নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়েছে। ক্রুসেডের সময় খ্রিস্টান ও ইহুদি যোদ্ধারা প্রচুর তথ্য, জ্ঞান, পুঁথিপুস্তক নিয়ে চলে এসেছিল মুসলিম পণ্ডিতদের হত্যা করে। একটা বড়ো অংশের মানুষ প্রাচীন পুঁথির মূল পাঠ করতে পারেনি দুর্বোধ্য ভাষায় কারণে। আক্রমণকারীরা সেসব পুঁথি ভাবানুবাদ করেছিল নিজেদের সুবিধামতো বর্জন সংযোজন করে। বিশেষ করে প্রাচীন প্রযুক্তগত জ্ঞান নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। আমরা যে অনুবাদ পাঠ করি, তা মূল গ্রন্থের হুবহু নয়। এমনকি আমাদের দেশীয় অনুবাদরা মূল গ্রন্থকে হুবহু অনুবাদ না করে নিজেদের মতো রচনা করেছেন। যে কারণে আমরা বহু মূল্যবান জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। বিদেশি অনুবাদকরাও ‘উদ্ভট’ বলে বহু তথ্য সরিয়ে ফেলেছে। রামায়ণের একটা জার্মান অনুবাদ আছে। সেই অনুবাদ আক্ষরিক মোটেই নয়। অনুবাদটি পরিচ্ছেদেও বিভক্ত নয় কোনো পংক্তিরও ছাড় নেই তাতে। অনুবাদকে নাম হেরমান জ্যাকোবি। কোথাও কোনো জটিল দুর্বোধ্য অংশ দেখলেই সেই অংশ বাতিল করেছেন। যেমন–কোনো উডডীন যন্ত্রের কথা দেখতে পেলেই তিনি ভেবেছেন সেগুলো অর্থহীন। বাতিল তো করেছেই, উপরন্তু উদ্ধতভাবে বলেছেন–“ওসব অর্থহীন কচকচি’, না হয় বলেছেন ‘এ জায়গাটাকে অনায়াসে বাদ দেওয়া যেতে পারে, এখানে যত উদ্ভট কথা ছাড়া আর কিছু নেই।” পৌরাণিক যুগে আবিষ্কৃত বিমান যদি গবেষণার মধ্য দিয়ে ভারতীয়রা যেত, তাহলে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের অনেক অনেক আগেই ভারতীয়রাই বিমান আবিষ্কারের কৃতিত্ব অর্জন করত। পাশ্চাত্য আবিষ্কারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রাচ্যকে অস্বীকার করা তো অনেক পুরোনো অসুখ। পাশ্চাত্য অ্যালোপ্যাথিককে যেমন প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদকে সুচারুভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রে চরক ও সুশ্রুতের আয়ুর্বেদ প্রাচীন ভারতীয়দেরই কৃতিত্ব, সেটা অস্বীকার করা যাবে কি?