ক্রৌঞ্চবিরহী মহাকবি বাল্মীকি তাঁর রামচরিতে প্রকৃতি থেকে শুরু করে ভৌগোলিক স্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ যেমন দিয়েছেন, ঠিক তেমনই নারীর শরীরসৌন্দর্য থেকে ভোজনদ্রব্যের বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। কোথাও তিনি ফাঁকি দেননি। রাম, রাবণ, রাক্ষস, বানররা কী ধরনের খাদ্য ভোজন করতেন তারও উল্লেখ আছে। এই প্রবন্ধে সেই খাদ্যাদি উল্লেখ করলে প্রাচীন যুগের ভারতীয়দের খাদ্যাভাসের খানিকটা আভাস পাওয়া যাবে।
বাল্মীকির রামায়ণে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা নিরামিষভোজী ছিলেন না। তাঁরা কেবলই ফলমূল খেয়েই জীবন ধারণ করত না। না, মহামুনিরা সে কথা বলছেন না। যা সত্য তাইই বলেছেন। তাঁরা যে সত্যদ্রষ্টা। রামচন্দ্র নিজেই। আমিষ খাবার পছন্দ করতেন। ভরত যেদিন রামকে ফিরিয়ে আনতে চিত্রকূটে পর্বতে এলেন, সেদিন রাম দগ্ধ মৃগমাংসের সাহায্যে সীতা বিনোদন করছিলেন। অর্থাৎ রাম-সীতা উভয়ই হরিণের মাংস ভক্ষণ করছিলেন। লক্ষ্মণ তখন খাচ্ছিলেন না। কারণ তখন তিনি প্রহরায় ব্যস্ত ছিলেন। প্রহরায় ব্যস্ত থাকলেও এই মৃগমাংস খাদ্যাদির ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন। কাঠ সংগ্রহ করা, আগুন জ্বালানো, পশুপাখি মারা, খাবার বানানো, ঘর বানানো এসব কাজ লক্ষ্মণই করতেন। শুধু মাংস নয়, রামচন্দ্র মাছ খেতেও খুব পছন্দ করতেন। বাল্মীকি বলেছেন–“ঘৃতপিণ্ডেপমান্ স্থূলাংস্তান্ দ্বিজান্ ভক্ষয়িষ্যথ।/রোহিতাংশ্চক্ৰতুণ্ডাংশ্চ নলমীনাংশ্চ৷৷” অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে–চক্রতুণ্ড, নলমীন এবং রোহিত বা রুই এই তিন রকমের মাছ তিনি খেয়েছেন। পম্পা সরোবরের কাছে মাতঙ্গ ঋষির আশ্রম, কাছেই ঋষ্যমূক পর্বত, যে পর্বতে কিষ্কিন্ধ্যা থেকে বহিষ্কৃত সুগ্রীব অবস্থান করছিলেন। এই পম্পা সোবর থেকে বর্শা বা ওই ধরনের কোনো তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে রাম ও লক্ষ্মণ মাছ শিকার করেছেন, একথা বাল্মীকি রামায়ণে উল্লেখ আছে–
“পম্পায়ামিমুভিমৎস্যাংস্তত্র রাম বরা হতা।
নিকপক্ষানয়স্তপান্ কৃশানৈক কণ্টকা।”
রান্নাবান্না করতেন লক্ষ্মণ। খাদ্যতালিকায় ভাত যেমন থাকত, তেমনি জ্বলন্ত কাঠের উপর দই ও লবণ দিয়ে ম্যারিনেট করা ঝলসানো মাছও ছিল–
“তব ভক্ত্যা সমযুক্তো লক্ষ্মণঃ সম্প্রদাস্যতি।
ভৃশংতা খাদতো মৎস্যান পম্পায়া পুষ্পসঞ্চয়ে।
…স্থানং প্রপচতাং তত্র দৃষ্টা, নীবারতণ্ডুলা।
পিপ্পলী লবণাভ্যাং চ মৎস্যান সম্পাদপিষ্যথঃ।”
পঞ্চবটি বটে সীতা রাবণকে বলেছেন যে, আমার স্বামী এখনই অনেক বনজাত খাদ্যদ্রব্য, অনেক রুরু মৃগ, গোসাপ, শুয়োর সব মেরে মাংস নিয়ে আসবেন–
“আগমিষ্যতি মে ভর্তা বন্যমাদায় পুষ্কল।
রুরূ বরাহাংশু হত্বাদায়ামিষং বহু।”
এ প্রসঙ্গে বাল্মীকি বলেছেন–
“নিহত্য পৃষতঞ্চান্যং মাংসমাদায় রাঘবঃ।
ত্বরমাণে জনস্থানং সসারাভিমুখং তদা।”
অর্থাৎ রাম হরিণ হত্যা করে সেই মাংস কাঁধে নিয়ে ঘরের দিকে ছুটলেন।
রামায়ণের চরিত্ররা কি গো-মাংস ভক্ষণ করত? অনেকে দাবি করেন স্বয়ং রামচন্দ্রই নাকি গো-মাংস ভক্ষণ করতেন। আসুন দেখি রামায়ণ কি বলে। রামায়ণে সীতা গঙ্গা নদী পার হওয়ার সময় গঙ্গাকে গোরু নিবেদন করার কথা বলেন। বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ড (৫২ সর্গ)-এ বলা হয়েছে–“জানকি গঙ্গার মধ্যস্থলে গিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “গঙ্গে! এই রাজকুমার তোমার কৃপায় নির্বিঘ্নে এই নির্দেশ পূর্ণ করুন। ইনি চতুর্দশ বৎসর অরণ্যে বাস করিয়া পুনরায় আমাদের সহিত প্রত্যাগমন করিবেন। আমি নিরাপদে আসিয়া মনের সাধে তোমার পূজা করিব। তুমি সমুদ্রের ভার্যা, স্বয়ং ব্রহ্মলোক ব্যাপিয়া আছ। দেবী! আমি তোমাকে প্রণাম করি। রাম ভালোয় ভালোয় পৌঁছিলে এবং রাজ্য পাইলে আমি ব্রাহ্মণগণকে দিয়া তোমারই প্রীতির উদ্দেশ্যে তোমাকে অসংখ্য গো ও অশ্ব দান করিব, সহস্র কলস সুরা ও পলান্ন দিব। তোমার তীরে যেসকল দেবতা রহিয়াছেন, তাহাদিগকে এবং তীর্থস্থান ও দেবালয় অর্চনা করিব।” (বাল্মীকি রামায়ণ/অযোধ্যা কাণ্ড/২৫০ সর্গ; অনুবাদক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)। না, এই সংলাপে গো-মাংস ভক্ষণের কোনো আভাস পর্যন্ত নেই। গো-দানের উল্লেখই পাচ্ছি।
যমুনা নদী অতিক্রম করার সময় সীতা যমুনাকেও গোরু নিবেদন করার কথা বলেন–“এই বলিয়া রাম সীতাকে অগ্রে লইয়া লক্ষ্মণের সহিত যমুনাভিমুখে চলিলেন এবং ওই বেগবতী নদীর সন্নিহিত হইয়া উহা কি প্রকারে পার হইবেন ভাবিতে লাগিলেন। অনন্তর তাহারা বন হইতে শুষ্ক কাষ্ঠ আহরণ এবং উশীর দ্বারা তাহা বেষ্টন করিয়া ভেলা নির্মাণ করিলেন। মহাবল লক্ষ্মণ জম্বু ও বেতসের শাখা ছেদন পূর্বক জানকীর উপবেশনার্থ আসন প্রস্তুত করিয়া দিলেন। তখন রাম সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর ন্যায় অচিন্ত্যপ্রভাবা ঈষৎ লজ্জিতা প্রিয় দয়িতাকে অগ্রে ভেলায় তুলিলেন এবং তাহার পার্শ্বে বসন ভূষণ, খন্ত্রি এবং ছাগচর্ম সংবৃত পেটক রাখিয়া লক্ষ্মণের সহিত স্বয়ং উত্থিত হইলেন এবং সেই ভেলা অবলম্বন করিয়া প্রীতমনে সাবধানে পার হইতে লাগিলেন। জানকি যমুনার মধ্যস্থলে আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিয়া কহিলেন, “দেবী আমি তোমায় অতিক্রম করিয়া যাইতেছি, এক্ষণে যদি আমার স্বামী সুমঙ্গলে ব্রত পালন করিয়া অযোধ্যায় প্রত্যাগমন করিতে পারেন, তাহা হইলে সহস্র গো ও শত কলস সুরা দিয়া তোমার পূজা করিব। সীতা কৃতাঞ্জলিপুটে এইরূপ প্রার্থনা করত তরঙ্গবহুলা কালিন্দীর দক্ষিণ তীরে উত্তীর্ণ হইলেন।” (বাল্মীকি রামায়ণ/অযোধ্যা কাণ্ড/৪৯ সর্গ; অনুবাদক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য) পঞ্চানন তর্করত্নের অনুবাদ করেছেন এভাবে, বলা হয়েছে–“অনন্তর সম্যক জ্ঞানবতী সীতা দেবী সেই যমুনা নদীর। অধ্যদেশে যাইয়া তাহাকে বন্দনা করিলেন। “দেবী! আমি আপনার উপর দিয়া পরপারে যাইতেছি; আপনি আমার মঙ্গল কামনা করুন,–আমার পাতিব্রাত্য ব্রতের রক্ষাকারী হউন। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজগণ পালিতা অযোধ্যা নগরীতে রাম মঙ্গলে মঙ্গলে ফিরিয়া আসিলে, আমি আপনাকে সহস্র গো ও একশত সুরাপূর্ণ কলসদ্বারা পূজা করিব।” এই বলিয়া তিনি কৃতাঞ্জলিপুটে প্রার্থনা করত দক্ষিণতীরে গিয়া উপস্থিত হইলেন।” (বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যাকণ্ড/ ৫৫ সর্গ; অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন)।
এছাড়া রাম যখন ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হন তখন ভরদ্বাজ তাঁকে গোরু দ্বারা আপ্যায়ণ করেছিলেন—
“তস্য তদ্বচনং শ্রুত্বা রাজপুত্রস্য ধীমতঃ।
উপিনয়ত ধর্মাত্মা গামৰ্ঘমুদকং ততঃ। ১৭
নানাবিধাননুরসান বন্যমূলফলায়ান। ভেভ্যো দদৌ তপ্ততপা বাসঞ্চৈবাভ্যকল্পয়ৎ। ১৮
মৃগপক্ষিভিরাসীনো মুনিভিশ্চ সমন্ততঃ।
রামমাগতমভ্যচ্চ স্বাগতেনাগতৎ মুনিঃ। ১৯
প্রতিগৃহ্য তু তামর্জাপুবিষ্টং স রাঘবম্।
ভরদ্বাজোহব্ৰবীদ্বাক্যং ধৰ্ম্মযুক্তমিদং তদা। ২০
চিরস্য খলু কাকুৎস্থ পশ্যাম্যহমুপাগতম্।
তং তব ময়া চৈব বিবাসনমকারণম্। ২১”
– অর্থাৎ “মুনি, পক্ষী ও মৃগগণে চতুর্দিকে পরিবৃত হইয়া সমাসীন সেই সতত-তপোনুষ্ঠায়ী ধর্মাত্মা ভরদ্বাজ ঋষি সম্যক পরিজ্ঞাত ধীমান রাজনন্দন রামের কথা শুনিয়া তাহাকে “তুমি তো সুখে আসিয়াছ?” বলিয়া অর্চনা করত অর্ঘ্য উদক ও গো উপঢৌকন দিলেন। পরে তিনি তাহাদিগকে ফলমূলসস্তৃত নানাবিধ ভোজ্য প্রদান করিয়া তাহাদিগের বাসস্থান নিরূপণ করিলেন। পরে রঘুনন্দন রাম সেই সকল দ্রব্য প্রতিগ্রহ করিয়া উপবিষ্ট হইলে, ভরদ্বাজ ঋষি তাহাকে এই ধর্মযুক্ত কথা বলিলেন–“ কাকুৎস! তোমাকে সমাগত দেখিয়া, আমার বহু কালের ইচ্ছা পূর্ণ হইল! তুমি যে অকারণে বিবাসিত হইয়াছ, তাহাও আমি শুনিয়াছি… (বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যা কাণ্ড/ ৫৪ সর্গ; অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন)। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুবাদে আছে–“মহর্ষি ভরদ্বাজ রামের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাকে স্বাগতপ্রশ্ন পূর্বক অর্ঘ্য, বৃষ, নানাপ্রকার বন্য ফলমূল ও জল প্রদান করিলেন এবং তাহার অবস্থিতির নিমিত্ত স্থান নিরূপণ করিয়া অন্যান্য মুনিগণের সহিত তাহাকে বেষ্টনপূর্বক উপবিষ্ট হইলেন।” রাজশেখর বসু এই অংশের অনুবাদে লিখেছেন–“কিছুদূর যাওয়ার পর তাঁরা ভরদ্বাজ ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। শিষ্য পরিবৃত ভরদ্বাজকে প্রণাম করে রাম নিজের পরিচয় দিলেন। ভরদ্বাজ তাঁদের স্বাগত জানিয়ে অর্ঘ্য, বৃষ, জল ও বন্য ফলমূল প্রভৃতি আহার্য দিয়ে বললেন–কাকুৎস, বহুদিন পরে তোমাকে এখানে দেখছি। তোমার নির্বাসনের কারণ আমি শুনেছি। দুই মহানদীর এই সঙ্গমস্থান অতি নির্জন, পবিত্র ও রমণীয় তুমি এখানে সুখে বাস কর।”
রাজশেখর বসুর এই অনুবাদে আমরা বৃষকে (ষাঁড়) আহার্য হিসাবে পাচ্ছি, যা রামচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গীদের ভক্ষণের জন্য প্রদান করছেন ভরদ্বাজ ঋষি। তবে প্রাচীন যুগে গোরুকে মূল্যবান সম্পদ হিসাবে দেখা হত, বলা হত ‘গো-ধন’। যাঁর গোরু যত সংখ্যক, সে তত ধনবান বলে মনে করা হত। গোরু চুরি এবং গোরু চুরিকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ পর্যন্ত বেধে যেত। সম্পদ হিসাবে গো-দানকে শ্রেষ্ঠ দান বলে মনে করা হত। তাই কোনো শুভ কাজে ব্রাহ্মণদের রাজারা প্রচুর গো-দান করত আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজকে পুণ্যকাজ বলে মনে করা হত। কিছুদিন আগে পর্যন্ত শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের স্ববৎস গো-দানের রীতি প্রচলন ছিল।
প্রাচীন যুগে গো-দানের মতো গো-মাংস ভক্ষণেরও রীতি ছিল। বেদের যুগ থেকে গো-মাংস ভক্ষণের সূত্র পাওয়া যায়। বেদ-পরবর্তী রামায়ণ যুগে গো-মাংস নিষিদ্ধ হয়েছিল, এমন কোনো সূত্র পাওয়া যায় না। রামায়ণ-পরবর্তী মহাভারত যুগে মহাভারতের নানাস্থানেই গো-হত্যা ও গো-মাংস ভক্ষণের কথা পাওয়া যায়। রন্তিদেবের ভোজনশালায় রন্তিদেব নামে এক ধার্মিক রাজার কথা বারবার মহাভারতে উল্লেখ আছে। তিনি প্রচুর পশু হত্যা করে মানুষদের খাওয়াতেন। আশ্চর্যজনকভাবে সেই পশুগুলোর মধ্যে প্রচুর গোরুও ছিল। আর সেই গো-মাংস খাওয়ার জন্য মানুষের লাইন পড়ে যেত। পাঁচকেরা তখন বাধ্য হয়ে বলতেন বেশি করে ঝোল নিতে, কারণ খুব বেশি মাংস নেই।
কালিপ্রসন্নের মহাভারতের বনপর্বের ২০৭ তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে–“পূর্বে মহারাজ রন্তিদেবের মহানসে প্রত্যহ দুই সহস্র পশু হত্যা করিয়া প্রতিদিন অতিথি ও অন্যান্য জনগণকে সমাংস অন্নদানপূর্বক লোকে অতুল কীর্তি লাভ করিয়াছেন।” কালিপ্রসন্নের মহাভারতের দ্রোণ পর্বের ৬৭ তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে–“নারদ কহিলেন, হে সৃঞ্জয়! সংস্কৃতিনন্দন মহাত্মা রন্তিদেবকেও শমনসদনে গমন করিতে হইয়াছে। ঐ মাহাত্মার ভবনে দুইলক্ষ পাঁচক সমাগত অতিথি ব্রাহ্মণগণকে দিবারাত্র পক্ক ও অপক্ক খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করিত। মহাত্মা রন্তিদেব ন্যায়োপার্জিত অপৰ্য্যাপ্ত ধন ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করিয়াছিলেন। তিনি বেদাধ্যয়ণ করিয়া ধর্মানুসারে শত্রুগণকে বশীভূত করেন। ঐ মহাত্মার যজ্ঞসময়ে পশুগণ স্বর্গলাভেচ্ছায় স্বয়ং যজ্ঞস্থলে আগমন করিত। তাহার অগ্নিহোত্র যজ্ঞে এত পশু বিনষ্ট হইয়াছিল যে, তাহাদের চর্মরস মহানস হইতে বিনির্গত হইয়া এক মহানদী প্রস্তুত হইল। ঐ নদী চর্মনবতী নামে অদ্যপি বিখ্যাত রহিয়াছে।” এরপরে বলা হয়েছে–“সংস্কৃতিনন্দনের ভবনে (রন্তিদেবের) এত অধিক অতিথি সমাগত হইত যে মণিকুণ্ডলধারী সুদগণ একবিংশতিসহস্র বলীর্দের মাংস পাক করিয়াও অতিথিগণকে কহিত, অদ্য তোমরা অধিক পরিমাণে সুপ ভক্ষণ করো, আজি অন্যদিনের ন্যায় অপর্যাপ্ত মাংস নাই।” (দ্রোণপর্ব/৬৭) মহাভারতের অনেক জায়গাতে গো-মেধ যজ্ঞের কথা বলা আছে–(১) “এই পৃথিবীতে যে সমস্ত তীর্থ আছে, নৈমিষেও সেই সকল তীর্থ বিদ্যমান রহিয়াছে। তথায় সংযত ও নিয়তাসন হইয়া স্নান করিলে গো-মেধ যজ্ঞের ফলপ্রাপ্তি ও সপ্তম কুল পর্যন্ত পবিত্র হয়।” (বনপর্ব/৮৪) (২) “মনুষ্যের বহুপুত্র কামনা করা কর্তব্য; কারণ তাহাঁদিগের মধ্যে কেহ যদি গয়ায় গমন, অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান অথবা নীলকায় বৃষ উৎসর্গ করে, তাহা হইলে বাঞ্ছিত ফল লাভ হয়।” (বনপর্ব/ ৮৪) (৩) “তৎপরে তত্রস্থ শ্রান্তিশোক বিনাশন মহর্ষি মতঙ্গের আশ্রমে প্রবেশ করিলে গো-মেধযজ্ঞের ফল লাভ হয়।” [বন/৮৪]।
মহাভারতে শ্রাদ্ধেও গো-মাংস দেওয়ার কথা বলা আছে–“শ্রাদ্ধকালে যে সমস্ত ভোজ্য প্রদান করা যায়, তন্মধ্যে তিলই সর্বপ্রধান। শ্রদ্ধে মৎস্য প্রদান করিলে পিতৃগণের দুই মাস, মেষমাংস প্রদান করিলে তিন মাস, ও শশ মাংস প্রদান করিলে চারি মাস, অজমাংস প্রদান করিলে পাঁচ মাস, বরাহ মাংস প্রদান করিলে ছয় মাস, পক্ষীর মাংস প্রদান করিলে সাত মাস, পৃষৎ নামক মৃগের মাংস প্রদান করিলে আট মাস, রুরু মৃগের মাংস প্রদান করিলে নয় মাস, গবয়ের মাংস প্রদান করিলে দশমাস, মহিষ মাংস প্রদান করিলে একাদশ মাস এবং গো-মাংস প্রদান করিলে এক বৎসর তৃপ্তি লাভ হইয়া থাকে। ঘৃত পায়স গো-মাংসের ন্যায় পিতৃগণের প্রীতিকর; অতএব শ্রাদ্ধে ঘৃতপায়েস প্রদান করা অবশ্য কর্তব্য। …” (অনুশাসন/ ৮৮)
রাজশেখর বসুর মহাভারতের সারানুবাদেও গো-মাংসের উল্লেখ মেলে। রাজশেখরের সারানুবাদে (সভাপর্ব/২) আছে, দেবর্ষি নারদ পারিজাত, রৈবত, সুমুখ ও সৌম্য এই চারজন ঋষির সাথে পাণ্ডবদের সভায় উপস্থিত হলে যুধিষ্ঠির তাদের গো-মধুপর্ক দিয়ে আপ্যায়ণ করেন–“একদিন দেবর্ষি নারদ পারিজাত, রৈবত, সুমুখ ও সৌম্য এই চারজন ঋষির সাথে পাণ্ডবদের সভায় উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির যথাবিধি অর্ঘ্য, গো-মধুপর্ক ও রত্নাদি দিয়ে সংবর্ধনা করলে নারদ প্রশ্নচ্ছলে ধর্ম, কাম ও অর্থ বিষয়ক এই প্রকার বহু উপদেশ দিলেন–মহারাজ, তুমি অর্থচিন্তার সাথে ধর্মচিন্তাও কর তো? কাল বিভাগ করে সমভাবে ধর্ম, অর্থ ও কামের সেবা করো তো?”
বিষ্ণুপুরাণের তৃতীয় অংশের ১৬ তম অধ্যায়ে আছে—
“ঔৰ্ব্ব উবাচ। “হবিষ্যমৎস্যমাংসৈস্তু শশস্য শকুনস্য চ।
শৌকরচ্ছাগলৈরৈণৈ-রৌরবৈর্গবয়েন চ।১
ঔরভ্রগব্যৈশ্চ তথা মাংসবৃদ্ধ্যা পিতামহাঃ।/প্রয়ন্তিতৃপ্তিং মাংসৈস্তু নিত্যং বার্ধণসামিষৈঃ।২
খামাংসমতিবাত্র কালশাকং তথা মধু।/শস্তানি কৰ্ম্মণ্যত্যন্ততৃপ্তিদানি নরেশ্বর। ৩”
অর্থাৎ, ঔৰ্ব্ব কহিলেন, শ্রাদ্ধের সময় ব্রাহ্মণদিগকে হবিষ্য করাইলে পিতৃগণ একমাস পরিতৃপ্ত থাকেন, মৎস্য দিলে দুইমাস, শশমাংস দিলে তিনমাস, পক্ষী মাংস দিলে চারি মাস, শূকর মাংস দিলে পাঁচ মাস, ছাগমাংস দিলে ছয়মাস, এণ নামক হরিণ মাংস দিলে সাত মাস, রুরুমৃগমাংস দিলে আট মাস, গবয় মাংস দিলে নয় মাস, মেষ মাংস দিলে দশ মাস, গোমাংস দিলে এগারো মাস পিতৃগণ পরিতৃপ্ত থাকেন। পরন্তু যদি বার্ধীণস মাংস দেওয়া যায়, তাহা হইলে পিতৃলোকের তৃপ্তির আর শেষ নাই। রাজন! গণ্ডারের মাংস, কৃষ্ণশাক ও মধু এই সমস্ত দ্রব্য শ্রাদ্ধ কর্মে অত্যন্ত প্রশস্ত ও যারপরনাই তৃপ্তিদায়ক। ( শ্রীবরদাপ্রসাদ বসাক কর্তৃক প্রকাশিত) এই অংশের টীকায় যা বলেছেন অনুবাদক, তা বেশ আগ্রহোদ্দীপক–“গব্য শব্দ থাকাতে কেহ কেহ গো-মাংস না-বলিয়া পায়স অর্থ করেন। এ অর্থ অযৌক্তিক, কারণ পায়স বা দুগ্ধ কখনো মাংস মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। বিশেষত যখন গবয় মাংস, শূকর মাংস ভক্ষণ করিয়া পরিতৃপ্ত হইতেছেন, তখন গোমাংস ভক্ষণে বাঁধা কী? ফলত কলির পূর্বে গো-মাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিল। মহাভারতে ষোড়শ রাজিক স্থলে কথিত আছে, রন্তিদেব প্রতিদিন দুই সহস্র গো হত্যা করিয়া তাহার মাংস ব্রাহ্মণদিগকে ভোজন করাইতেন। বশিষ্ঠ বাল্মীকির আশ্রমে গমন করিলে তাঁহাকে একটি বৎসতরী ভোজনার্থ দেওয়া হয়। জনমেজয়ও বেদব্যাসকে একটি বৎস ভোজনার্থ দিয়াছিলেন, বেদব্যাস দয়া করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। এরূপ গোমাংস ভক্ষণের অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়।” পণ্ডিতপ্রবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত বিষ্ণুপুরাণের অনুবাদ করে লিখেছে–“ ঔৰ্ব্ব কহিলেন, শ্রাদ্ধের দিনে ব্রাহ্মণদিগকে হবিষ্য করাইলে, পিতৃগণ একমাস পর্যন্ত পরিতৃপ্ত থাকেন, মৎস্য প্রদানে দুইমাস, শশক মাংস প্রদানে তিন মাস, পক্ষী মাংস প্রদানে চারিমা, শূকর মাংস প্রদানে পাঁচ মাস, ছাগ মাংস প্রদানে ছয় মাস, এণ মাংস দিলে সাত মাস, রুরুমৃগমাংস প্রদান করিলে আট মাস, গবয় মাংস প্রদানে নয় মাস, মেষমাংস প্রদানে দশ মাস, গো-মাংস প্রদান করিলে এগার মাস পর্যন্ত পিতৃগণ পরিতৃপ্ত থাকেন। পরন্তু যদি বাণস মাংস দেওয়া যায়, তাহা হইলে পিতৃলোক চিরদিন তৃপ্ত থাকেন। হে রাজন! গণ্ডারের মাংস, কৃষ্ণশাক ও মধু এই সমুদায় দ্রব্য শ্রাদ্ধকর্মে অত্যন্ত প্রশস্ত ও অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক।” (শ্রীনটবর চক্রবর্তী দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত) শ্রী রাম সেবক বিদ্যারত্ন বিষ্ণু পুরাণের আলোচ্য অংশের অনুবাদে লিখেছেন–“হে মহারাজ! যে যে মাংস দ্বারা পিতৃগণের তৃপ্তি লাভ হয়, তাহা আপনার নিকট কীর্তন করিতেছি শ্রবণ করুন। শশক, শকুল, বন্য শূকর, ছাগ, হরিণ, রুরু নামক মৃগ, গবয়, মেষ, গো, বার্ধণস ও গণ্ডারদিগের মাংস পিতৃগণের অতিশয় প্রীতিকর।”
রাজশেখর বসুর মহাভারতের সারানুবাদে (উদ্যোগ পর্ব/৮) আছে প্রহ্লাদ সুধম্বাকে গো-মাংস দিয়ে সংবর্ধনা করতে চেয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়েছে–“… দুজনে প্রহ্লাদের কাছে উপস্থিত হলেন। প্রহ্লাদ বললেন তোমরা পূর্বে কখনো একসঙ্গে চলতে না, এখন কি তোমাদের সখ্য হয়েছে? বিরোচন বললেন, পিতা সখ্য হয়নি, আমরা জীবন পণ রেখে তর্কের মীমাংসার জন্য আপনার কাছে এসেছি। সুধম্বার সংবর্ধনার জন্য প্রহ্লাদ পাদ্য জল, মধুপর্ক ও দুই স্কুল শ্বেত বৃষ আনতে বললেন। সুধম্বা বললেন, ওসব থাকুক, আপনি আমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিন–ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ না বিরোচন শ্রেষ্ঠ? “
মহাভারত অনুসারে, যোগবলে যাঁরা বিশুদ্ধচিত্ত লাভ করেছেন তাঁরা গো-হত্যা করলে কোনো পাপ হয় না–“যাহারা যোগবলে এইরূপ বিশুদ্ধচিত্ত হইয়াছেন, তাহারা যোগবলে গো-হত্যা করিলেও করিতে পারেন। কারণ তাহাদিগকে গো-বধজনিত পাপে লিপ্ত হইতে হয় না।” (শান্তিপর্ব/২৬৩) নহুষের গো-বধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–“রাজপুরোহিত, স্নাতক ব্রাহ্মণ, গুরু ও শ্বশুর এক বৎসর গৃহে বাস করিলেও মধুপর্ক দ্বারা তাহাদিগের পূজা করা কর্তব্য”। (অনুশাসন/৯৭) প্রাচীনকালে অতিথিদের মধুপর্ক দ্বারা আপ্যায়ণ করার বিধান ছিল। মধুপর্কে গো-মাংসের প্রয়োজন হত। মহাভারতে মধুপর্কের জন্য নহুষের গো-বধ করার কথা পাওয়া যায়। তবে নহুষের সময়ের ঋষিরা নহুষের এই কর্মের বিরোধিতাও করেন–“পূর্বে মহারাজ নহুষ মধুপর্ক দান সময়ে গো-বধ করাতে মহাত্মা তত্ত্বদর্শী ঋষিগণ তাহারে কহিয়াছিলেন, মহারাজ তুমি মাতৃতুল্য গাভী ও প্রজাপতিতুল্য বৃষকে নষ্ট করিয়া যাহার পর নাই গর্হিত কার্যের অনুষ্ঠান করিয়াছ; অতএব তোমার যজ্ঞে হোম করিতে আমাদের প্রবৃত্তি নাই, তোমার নিমিত্ত আমরা অতিশয় ব্যথিত হইলাম।” (শান্তিপর্ব/২৬২)
শান্তিপর্বের ২৬৮ তম অধ্যায়েও নহুষের গোবধের কথা পাওয়া যায়। এখানে নহুষ গোহত্যা করতে গেলে কপিল ঋষি তাঁর বিরোধ করেন। তা নিয়ে স্মরশ্মি ঋষি ও কপিল ঋষির মধ্যে এক দীর্ঘ তর্কের সূচনা হয়–“একদা মহর্ষি তৃষ্টা নরপতি নহুষের গৃহে আতিথ্য স্বীকার করিলে তিনি শাশ্বত বেদ বিধানানুসারে তাহারে মধুপর্ক প্রদানার্থ গো-বধ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, এমন সময়ে জ্ঞানবান সংযমী মহাত্মা কপিল যদৃচ্ছাক্রমে তথায় সমাগত হইয়া নহুষকে গো-বধে উদ্যত দেখিয়া স্বীয় শুভকরি নৈষ্ঠিক বুদ্ধিপ্রভাবে, “হা বেদ!” এই শব্দ উচ্চারণ করিলেন। ঐ সময় স্মরশ্মি নামে এক মহর্ষি স্বীয় যোগবলে সেই গো-দেহে প্রবিষ্ট হইয়া কপিলকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, “মহর্ষে! আপনি বেদবিহিত হিংসা অবলোকন করিয়া বেদে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিলেন, কিন্তু আপনি যে হিংসাশূন্য ধর্ম অবলম্বন করিয়া রহিয়াছেন, উহা কি বেদবিহিত নহে? ধৈর্যশালী বিজ্ঞানসম্পন্ন তপস্বীরা সমুদায় বেদকেই পরমেশ্বরের বাক্য বলিয়া কীর্তন করিয়াছেন। পরমেশ্বরের কোনো বিষয়েই অনুরাগ, বিরাগ বা স্পৃহা নাই। সুতরাং কী কর্মকাণ্ড, কী জ্ঞানকাণ্ড তাহার নিকট উভয়ই তুল্য। অতএব কোনো বেদই অপ্রমাণ হইতে পারে না।” স্মরশ্মির কথার প্রত্যুত্তরে কপিল বলেন–“আমি বেদের নিন্দা করিতেছি না এবং কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড এই উভয়বিধ বেদের তারতম্য নির্দেশ করাও আমার অভিপ্রেত নহে। কী সন্ন্যাস, কী বানপ্রস্থ, কী গার্হস্থ, কী ব্রহ্মচর্য লোকে যে ধর্ম অনুসারে কার্য করুন না-কেন, পরিণামে অবশ্যই তাহার গতিলাভ হইয়া থাকে। সন্ন্যাসাদি চারিপ্রকার আশ্রমবাসীদিগের চারি প্রকার গতি নির্দিষ্ট আছে। তন্মধ্যে সন্ন্যাসী মোক্ষ, বানপ্রস্থ ব্ৰহ্মলোক, গৃহস্থ স্বর্গলোক এবং ব্রহ্মচারী ঋষিলোক লাভ করিয়া থাকেন। বেদেকার্য আরম্ভ করা ও না-করা উভয়েরই বিধি আছে। ঐ বিধি দ্বারা কার্যের আরম্ভ ও অনারম্ভ উভয়ই দোষাবহ বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে। সুতরাং বেদানুসারে কার্যের বলাবল নির্ণয় করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। অতএব যদি তুমি বেদশাস্ত্র ভিন্ন যুক্তি বা অনুমান দ্বারা অহিংসা অপেক্ষা কোনো উৎকৃষ্ট ধর্ম স্থির করিয়া থাক, তাহা কীর্তন করো।”
তবে ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীরা একটা সময় গো-মাংস খাওয়া ত্যাগ করেছিল, সেটারও উল্লেখ পাই মহাভারতে।
উল্লেখ আছে–“পূর্বকালে মহাত্মা রন্তিদেব স্বীয় যজ্ঞে গোসমুদায়কে পশু রূপে কল্পিত করিয়া ছেদন করাতে উহাদিগের চর্মরসে চর্মণবতী নদী প্রবর্তিত হইয়াছে। এক্ষণে উহারা আর যজ্ঞীয় পশুত্বে কল্পিত হয় না। উহারা এক্ষণে দানের বিষয় হইয়াছে।” (অনুশাসন/৬৬)।
রামায়ণের মুনিঋষিরাও ব্যাপক মাংস পছন্দ করতেন এবং ভক্ষণ করতেন। মৃত্যুশয্যায় কিষ্কিন্ধ্যার রাজা বালী রামকে বলেছেন–আমাকে মেরে তোমার কী লাভ হল? আমার মাংস তোমার খাওয়া চলবে না। কারণ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা একযোগে যে পাঁচনখওয়ালা প্রাণীর মাংসগুলি খায়–তা হল শজারু, গোসাপ, খরগোস আর কচ্ছপের মাংস (“পঞ্চ পঞ্চখা ভক্ষ্যা ব্ৰহ্মক্ষত্রেণ রাঘব।/শল্যকঃ শ্বাবিধো গোধা শশঃ কূর্মশ্চ পঞ্চম্।”)। বনবাসের তৃতীয় দিনে সারথি সুমন্ত্র ও বন্ধু গুহককে বিদায় দিয়ে অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করে হরিণ, শুয়োর মেরে নিলেন–
“তৌ তত্র হত্বা চতুরো মহামৃগান্ বরাহমৃষ্যং পৃষং মহাররুম।”
রাম মদও খেতেন। বাল্মীকি তাই-ই বলছেন। লঙ্কার অশোকবনে সীতাকে রামের খবর দিয়ে হনুমান বলছেন–
“ন মাংসং রাঘববা ভুঙক্তে ন চৈবং মধু সেবতে।”
সীতা নেই মদ খাওয়াও নেই। অর্থাৎ সীতা যখন কাছে ছিলেন তখন মদ-মাংস দুইই চলত। রামই শুধু নয়–সীতা, কৌশল্যা, কৈকেয়ী সকলেরই মদ্যপানের অভ্যেস ছিল। রামায়ণে বাল্মীকি অন্যান্য সম্প্রদায়ের খাদ্যাভাস কী ছিল, সেটাও বর্ণনা করেছেন।
রাক্ষসদের খাদ্য (লঙ্কার বাসিন্দা) : গন্ডারের মাংস, গিরগিটি, হরিণের মাংস, ময়ূরের মাংস, কুকুটের মাংস, ছাগলের মাংস, শুয়োরের মাংস, খরগোশ, মাছ, মহিষের মাংস, মদ, ভাত, রক্ত ইত্যাদি। পাঠক লক্ষ করুন, রাক্ষসদের খাদ্যতালিকায় যেসব খাদ্য রামায়ণের কবি উল্লেখ করেছেন, তা তো মানুষেরই খাদ্য। মানুষ তো সাপ, ব্যাঙ, আরশোলা, মুরগি তিমি, হাঙর, কচ্ছপ, শুয়োর সব খায়। তাহলে রাক্ষস কী অপরাধ করল! রাক্ষসরা তো মানুষই।
আর্যসমাজের খাদ্য : তণ্ডুল সিদ্ধ বা ভাত, সঙ্গে নানাবিধ ব্যঞ্জন, যব, গম, মিষ্টি, হরিণ, ময়ূর, শর্করা, আখের রস, মধু, মদ, দই, দুধ, ডাল, চণক বা ছোলা, কুলখ বা কলাই, কৃশর বা খিচুড়ি, পিষ্টক বা পিঠা, ভোজ্যতেল, সুগন্ধি তেল, সৌরের মদ, সৌরীক মদ, সুরা ইত্যাদি। রাম-লক্ষ্মণরা মৃগয়া থেকে প্রাপ্ত শুয়োর, ঋষ্য বা কৃষ্ণসার হরিণ, পৃষৎ, গন্ডার, শল্যকী বা শজারু, গোধা বা গোসাপ, খরগোশ, কচ্ছপ, মহারুরু ও পাখির মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল।”পঞ্চ পঞ্চক্ষা ভক্ষ্যা ব্ৰহ্মক্ষত্রেণ রাঘবা/শল্যকঃ শ্বাবিধো গোধা শশ কূৰ্মশ্চ পঞ্চম৷”–এই পাঁচটি ছাড়া অন্য পঞ্চনখ বিশিষ্ট প্রাণী অভক্ষ্য ছিল। ছাগলের মাংস, পায়েস, খিচুড়ি যজ্ঞ ছাড়া নিষিদ্ধ, অভক্ষ্য–“পায়সং কৃশরং ছাগং বৃথা সোহশ্নাতু নির্ঘণঃ।” হুইলার প্রমুখ সাহেবরা রামায়ণের যুগে যে গো-মাংস ভক্ষণের ব্যবস্থা ছিল, একথা উল্লেখ করতে দ্বিধা করেননি।
বানরদের খাদ্য : মধু, ফলমূল, নিবার ধানের কাঞ্জিক, মদ, পশুপক্ষীর মাংস ইত্যাদি।
মুনিঋষিদের খাদ্য : বিশ্ব বা বেল, কপিঙ্খ বা কয়েতবেল, পনস বা কাঁঠাল, বীজপুরক, আমলকী, আম, কন্দমূল, মেষ, হবিষ্যান্ন, মাংস ইত্যাদি।
ভুল তথ্য লিখে, মানুষের মনে ভুল ধারণা জন্মায় , ভুল তথ্য গুলি মুছে ফালুন .
নিজে সংস্কৃতের পন্ডিত হয়ে তার পর নিজে পরে তবে লিখুন .
লেখাটিতে ভুল তথ্য দেয়া , আসা করি ভুল গুলি ঠিক করে দেবেন , অন্যের অনুবাদ না লেখে নিজ অনুবাদ করে তবে লিখুন
কোথায় কোথায় ভুল তথ্য আছে?
কোথাও ভুল নেই । পুরোটাই সঠিক তথ্য।