১৮. জায়ন?

১৮. জায়

যে হলুকাস্ট নিয়ে ১৯৬৭ সালে বিপুলসংখ্যক ইসরাইলি আতঙ্কে ছিল, তা সন্দেহাতীতভাবে কখনো তাদের সামনে আসেনি। ৫ জুন ইসরাইলি বাহিনী সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আগাম হামলা চালায়, মিসরীয় বিমান বাহিনীর প্রায় পুরোটা মাটিতেই ধ্বংস করে দেয়। জেরুসালেমের সুরক্ষা অপর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও এই ঘটনার অনিবার্যভাবে জর্দানকে যুদ্ধে টেনে নেয়। মাত্র কয়েক হাজার সৈন্য ছিল সেখানে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। হলি সিটি রক্ষার জন্য দুই শ’ লোক জীবন দেয়। কিন্তু ৭ জুন বুধবার ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী পুরনো নগরী ঘিরে ফেলে, লায়ন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। তখনো বেশির ভাগ বেসামরিক ইসরাইলি নাগরিক বিমান হামলা থেকে রক্ষা পেতে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিল। তবে মুখে মুখে আরব জেরুসালেম দখলের খবর ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোক ম্যান্ডেলবাম গেটের সামনে জড়ো হয়। 

এদিকে ইসরাইলি সৈন্য ও অফিসারদের লক্ষ্য ছিল একটি : যত দ্রুত সম্ভব ওয়েস্টার্ন ওয়ালে যাওয়া। সৈন্যরা সরু রাস্তাগুলো দিয়ে দৌড়ে হারাম প্লাটফর্মে ছুটে যায়, আড়চোখে একনজরে মুসলিম উপাসনা স্থানগুলো দেখে নেয়। অল্প কিছু সময় আগেও প্রায় ২০ বছর ধরে ইহুদিদের জন্য বন্ধ হয়ে থাকা ছোট্ট স্থানটিতে সাত শ’ সৈন্য ক্যামোফ্লাজ মুখে রক্তভেজা পোশাকে গাদাগাদি করে অবস্থান করছিল। বেলা প্রায় ১১টার দিকে জেনারেলরা পৌঁছাতে শুরু করে, আইডিএফের প্রধান রাব্বি জেনারেল শলোমো গোরেনকে আনা হয়। ১৯২৯ সালের পর প্রথমবারের মতো শোফার ফোঁকার সম্মান তাকেই দেওয়া হয়। প্রাচীরে রাব্বি ভি ইয়েহুদা কুককে নিয়ে আসার জন্য জনৈক প্লাটুন কমান্ডার একটি জিপও পাঠান। এসব লোকের ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, প্রাচীরের সামনে আসা ছিল বিপুল ধর্মীয় অভিজ্ঞতা, এমনকি মর্মভেদী বিষয়ও। মাত্র কয়েক দিন আগে তারা নিশ্চিহ্ন হওয়ার শঙ্কায় পড়েছিল। এখন তারা আবারো অপ্রত্যাশিতভাবে ইহুদি বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত এলাকার সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে। সেক্যুলার তরুণ ছত্রীসেনারা পাথরগুলো আঁকড়ে ধরল, কেঁদে ফেলল : অন্যরা ছিল প্রচণ্ড রকমের হতবিহ্বল, এমনকি তাদের পক্ষে নড়াচড়া করাও অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল। রাব্বি গোরেন যখন শোফার ফুঁকলেন, সুর করে সাম পাঠ করতে লাগলেন, নাস্তিক অফিসারেরা তখন একে অপরজে জড়িয়ে ধরলেন। এক তরুণ সৈনিক স্মৃতিচারণ করেছেন যে তার মাথা ঝিমঝিম করছিল, তার পুরো দেহ জ্বলে গিয়েছিল। এটি ছিল নাটকীয় ও অপ্রত্যাশিত প্রত্যাবর্তন যা পুরনো ইহুদি কল্পকথনের প্রায় বিস্ময়কর পুনরাবৃত্তি। আবারো ইহুদি জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মুখে পড়েছিল, কিন্তু আবারো তারা ঘরে ফিরতে পেরেছে। এই ঘটনা ঐশী স্থানটির স্বাভাবিক সব অভিজ্ঞতা উস্কে দিলো। প্রাচীরটি স্রেফ কোনো ঐতিহাসিক স্থান ছিল না, বরং তা ছিল একটি প্রতীক যা দ্বিধাহীনভাবে প্রতিটি সৈনিকের ইহুদি পরিচিতির মূলে পৌঁছে গিয়েছিল। এটি ছিল উভয় অন্যটি- ‘এমন কিছু যা বড় ও ভয়ঙ্কর এবং অন্য বিশ্ব থেকে আগত’- এবং প্রবলভাবে পরিচিত- ‘এক পুরনো বন্ধু, ভুল করা অসম্ভব। এটি ভয়ঙ্কর তবে মুগ্ধকারী; পবিত্র, এবং একইসাথে ইহুদি সত্তার প্রতিফলিত ছবি। এটি দাঁড়িয়ে আছে টিকে থাকার জন্য, ধারাবাহিকতার জন্য, মানবজাতির আকাঙ্ক্ষা করা চূড়ান্ত সমন্বয় সাধনের প্রতিশ্রুতির জন্য। পাথরগুলোতে চুমু খাওয়ার সময় আব্রাহাম দাভদেভানির মনে হলো একইসাথে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত তার সামনে উপস্থিত হয়েছে : ‘আর কোনো ধ্বংসের প্রয়োজন নেই, প্রাচীরটি আর কখনো নিঃসঙ্গ হবে না।’ এটি সহিংসতার, ধ্বংসের ও বিচ্ছিন্নতার সমাপ্তির পূর্বাভাস দিচ্ছে। এটি এমন এক বিষয় যা অন্যান্য প্রজন্ম হয়তো স্বর্গে প্রত্যাবর্তন বলে অভিহিত করেছে। 

‘বিজয়ী প্রজন্মকে দেখতে এমনই মনে হয়। ১৯৬৭ সালে পুরনো নগরী জয়ের পর উল্লসিত ইহুদি সৈন্যরা ডোম অব দি রকের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিল। 

ধার্মিক ইহুদিরা, বিশেষ করে রাব্বি কুক দি ইয়ংগারের শিষ্যদের স্থির বিশ্বাস ছিল যে পরিত্রাণ শুরু হয়ে গেছে। তারা মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগের রাব্বির কথাগুলো স্মরণ করে স্থির বিশ্বাসে পৌছাল যে ঈশ্বর তাকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। বিজয়ের দিনে প্রাচীরটির সামনে দাঁড়িয়ে রাব্বি কুক ঘোষণা করলেন যে ‘স্বর্গীয় আদেশে’ ইহুদি জনগোষ্ঠী ‘এই মাত্র পবিত্রতা ও আমাদের নিজস্ব পবিত্র নগরীর বাড়িতে ফিরেছে।’ তার ছাত্র ইসরাইল ‘অ্যারিয়াল’ স্টিটিগলিজ প্রাচীর ত্যাগ করে হারাম প্লাটফর্মে হেঁটে ছিলেন। এসময় পাক-সাফের বিধান ও নিষিদ্ধ এলাকাটি নিয়ে তার মধ্যে কোনো পরোয়া ছিল না, রক্তের ছাপ ও নোংরার ব্যাপারেও তার কোনো খেয়াল ছিল না। পরে তিনি স্মৃতিচারণ করেছিলেন : ‘আমি এমন এক স্থানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানে উচ্চ পুরোহিত বছরে একবার প্রবেশ করতেন খালি পায়ে, মিকভায় পাঁচবার অবগাহন করে। তবে আমি ছিলাম জুতা পরা, সশস্ত্র অবস্থায় ও হেলমেট পরিহিত। আমি নিজেকেই বলেছিলাম, বিজয়ী প্রজন্মকে দেখতে এমনই মনে হয়।o শেষ যুদ্ধে লড়া হয়ে গিয়েছিল, ইসরাইল এখন পুরোহিতদের জাতিতে পরিণত হয়েছে। এখন সব ইহুদি হলি অব হলিজে প্রবেশ করতে পারে। রাব্বি কুক বারবার বলছিলেন যে পুরো ইসরাইলি সেনাবাহিনী ছিল ‘পবিত্র’ এবং এর সৈন্যরা দৃঢ় পদক্ষেপে ঈশ্বরের উপস্থিতির দিকে এগিয়ে যাবে। 

নাৎসি হলুকাস্টের ব্যাপারে আর কখনো নয়!’ পরিভাষাটি এখন সাথে সাথে ইহুদিদের ঠোঁটে ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ছিল। এ মর্মান্তিক ঘটনাটি নতুন রাষ্ট্রের পরিচিতির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে যায়। অনেক ইহুদি ইসরাইল রাষ্ট্রটিকে অন্ধকারের মুখে নতুন জীবন সৃষ্টির প্রয়াস হিসেবে বিবেচনা করে। নাসেরের ঘৃণামিশ্রিত বাগাড়ম্বরতার কারণে হলুকাস্টের স্মৃতি ‘ছয় দিনের যুদ্ধের’ আগের সপ্তাহগুলোতে অনিবার্যভাবেই ভাসছিল। এখন তারা ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ফিরে ‘আর কখনো নয়!’ পরিভাষা এই নতুন প্রেক্ষাপটেই শোনা গিয়েছিল। বিজয়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাব্বি কুক ঘোষণা করলেন ‘আমরা আর কখনো এখান থেকে নড়ব না।’ জেনারেল মোশে দায়ান ছিলেন ঘোষিত নাস্তিক। তিনি প্রাচীরের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন যে বিভক্ত জেরুসালেম নগরী ‘পুনঃএকত্রিকরণের’ কাজ করছে আইডিএফ। ‘আমরা আমাদের সবচেয়ে পবিত্র স্থানে ফিরে এসেছি; আমরা ফিরে এসেছি এবং আমরা আর কখনো এগুলো ফিরিয়ে দেব না।’ তিনি নগরীর সব গেট খুলে দিতে, কাঁটাতারের বেড়াগুলো সরিয়ে ফেলতে এবং নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা সব মাইন অপসারণের নির্দেশ দেন। পেছনে ফেরার আর কোনো প্রশ্নই নয়। 

নগরীর প্রতি ইসরাইলের দাবি ছিল সংশয়পূর্ণ। ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল কেবল জেরুসালেম নয়, পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমিও (মানচিত্র দেখুন) দখল করে। ১৯০৭ সালের হেগ রেগুলেশন্স বা ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন- কোথাও ইসরাইলি দাবির প্রতি সমর্থন ছিল না। আন্তর্জাতিক আইনে কোথাও সামরিকভাবে জয় করা ভূমি স্থায়ীভাবে নিজের করে নেওয়ার অনুমোদন ছিল না। প্রধানমন্ত্রী লেভি ইশকলসহ অনেক ইসরাইলি আরব বিশ্বের সাথে শান্তি স্থাপনের বিনিময়ে সিরিয়া, মিসর ও জর্দানকে এসব অধিকৃত এলাকা ফিরিয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু জেরুসালেমের পুরনো নগরী আরবদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো প্রশ্ন ১৯৬৭ সালে ছিল না। ওয়েস্টার্ন ওয়াল বিজয়ের মাধ্যমে একসময়ের প্রবল সেক্যুলার জায়নবাদী ধারায় অতিপ্রাকৃত উপাদান প্রবেশ করে। এমনকি সবচেয়ে কট্টর নাস্তিকও তাদের হলি সিটিকে ‘পবিত্র’ হিসেবে অভিহিত করে। জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ইসরাইলি প্রতিনিধি আবা ইবান বিষয়টি বলেছেন এভাবে, জেরুসালেম নিহিত রয়েছে ‘নিচে ও ওপরে, আগে ও পরে, সব রাজনৈতিক ও সেক্যুলার বিবেচনায়।’ ইসরাইলিদের কাছে বিষয়টিকে বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখা ছিল অসম্ভব। কারণ তাদের সামনে থাকা প্রাচীরটি ছিল ইহুদি আত্মা। 

বিজয়ের সন্ধ্যায় লেভি ইশকল ঘোষণা করেন যে জেরুসালেম হলো ‘ইসরাইলের চিরন্তন রাজধানী। ১০ নগরী বিজয় এত বিপুল অভিজ্ঞতা ছিল যে, অনেক ইহুদি লোকজনের কাছে, তা অনিবার্যভাবে ‘সঠিক’ মনে হতে থাকে : এটি ছিল নির্বাসনে থাকার সময় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইহুদিদের মধ্যে লালিত কল্পকথন ও কিংবদন্তিগুলোর চমকপ্রদ স্মৃতিচারণ। কাব্বালবাদীদের কাছে মনে হলো, জায়নে ফিরে এসেছে ইসরাইল, বিশ্বের সবকিছু ও পুরো মহাবিশ্ব এর যথার্থ স্থানে ফিরেছে। অবশ্য জেরুসালেমের আরবেরা এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কোনোভাবেই একমত হতে পারছিল না। ইসরাইলি বিজয় নগরীর ‘পুনএকীকরণ’ ছিল না, বরং এটি ছিল এক বৈরী শক্তির দখলদারিত্ব। আরব বাহিনীর প্রায় দুই শত সৈন্যের লাশ রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে ছিল; আরব বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করা হয়। ইসরাইলি রিজার্ভ ইউনিটগুলো অস্ত্রের সন্ধানে বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালায়, ওয়ান্টেড তালিকায় থাকা শত শত ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার করা লোকজন তাদের পরিবারগুলো ছেড়ে যায়, তাদের মনে হচ্ছিল, তারা যাচ্ছে মৃত্যুর পথে। সন্ধ্যায় যখন তাদের ফিরতে দেওয়া হয়, তখন তারা কান্নায় স্বাগত জানায়, মনে করতে থাকে আজরাইলের কবল থেকে তারা ফিরে এসেছে। সৈন্যদের পেছনে পেছনে আসছিল লুটেরা বাহিনী। কয়েকটি মসজিদে লুটপাট চালানো হয়, ফিলিস্তিন আর্কিওলজি মিউজিয়াম থেকে ডেড সি স্কুল সরিয়ে নেওয়া হয়। পুরনো নগরী ও পূর্ব জেরুসালেমের ফিলিস্তিনি বাসিন্দারা ভয়ে তাদের বাড়িতে দরজা বন্ধ করে থাকে। এই অবস্থা কাটে মেয়র রুহি আল-খাতিবের উদ্যেগে। তিনি এক ইসরাইলি অফিসারকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে ঘর থেকে বের হয়ে এসে দোকানপাট খুলতে বলেন তাদেরকে, যাতে লোকজন খাবার কিনতে পারে। ৯ জুন শুক্রবার আরব মিউনিসিপ্যালের অর্ধেক কর্মী কাজে যোগ দেয়। মেয়র ও তার সহকারীর নির্দেশে তারা মৃতদের দাফন করতে থাকে, পানিব্যবস্থা মেরামত করতে থাকে। পরে তাদের সাথে পূর্ব জেরুসালেমের ইসরাইলি মিউনিসিপ্যাল শ্রমিকরা যোগ দেয়। 

তবে এই সহযোগিতা স্থায়ী হয়নি। টেডি কোলেক একেবারে বিজয়ের দিনেই দায়ানের কাছে গিয়ে প্রতিশ্রুত দেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নো ম্যান্স ল্যান্ডের অপসারণ কাজ তদারকি করবেন। কাজটিতে মারাত্মক বিপদ ও জটিলতা ছিল। দায়ানের মতো তিনিও ‘সৃষ্ট বাস্তবতার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন, যা হলি সিটিতে স্থায়ী ইহুদি উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করবে, যাতে করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষে এটি খালি করার কোনো প্রশ্নই না আসে। শনিবার রাতে, ২ জুন, অস্ত্র বিরতি সই হওয়ার পর, মাগরিবি কোয়ার্টারের ৬১৯ জন অধিবাসীকে তিন ঘণ্টা সময় দেওয়া হয় তাদের বাড়িঘর খালি করার জন্য। তারপর বুলডোজার দিয়ে এ ঐতিহাসিক এলাকাটি (জেরুসালেম ওয়াকফ) গুঁড়িয়ে দিয়ে এর আয়তন হ্রাস করা হয়। জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘনমূলক এ কাজটি তদারকি করেন কোলেক। তিনি চেয়েছিলেন ওয়েস্টার্ন ওয়ালে সম্ভাব্য হাজার হাজার তীর্থযাত্রীর স্থান সঙ্কুলানের মতো যথেষ্ট বড় একটি প্লাজা সৃষ্টি করতে। এটি ছিল নগর পুনরুদ্ধারের’ দীর্ঘ ও অব্যাহত প্রক্রিয়ার শুরু মাত্র। আর এই পুনরুদ্ধারের মূলে ছিল ঐতিহাসিক আরব জেরুসালেম ধ্বংস করা। আর তা নগরীর অবয়ব ও বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি বদলে দেয়। 

ইসরাইলি নেসেট ২৮ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে পুরনো নগরী ও পূর্ব জেরুসালেমকে যুক্ত করে একে ইসরাইল রাষ্ট্রের অংশ বলে ঘোষণা করে। এটি ছিল হেগ কনভেনশনের সরাসরি পরিপন্থী। ইতোমধ্যেই আরব দেশগুলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট ব্লক অধিকৃত আরব জেরুসালেম থেকে প্রত্যাহার করার জন্য ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল। নগরীকে স্থায়ীভাবে জয় করা বিবেচনা না করার জন্য ইসরাইলিদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছিল ব্রিটেন। এমনকি ইসরাইলের প্রতি সবসময় প্রসন্ন থাকা যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত নগরীর মর্যাদা পরিবর্তন করার কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক আইন প্রণয়ন না করার জন্য হুঁশিয়ার করে দেয়। কারণ আন্তর্জাতিক আইনে এর কোনো অবকাশ নেই। নেসেটের নতুন আইন ও ২৮ জুনের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অর্ডিন্যান্সে সতর্কভাবে ‘স্থায়ীকরণ’ শব্দটি পরিহার করা হয়েছিল। ইসরাইলিরা এর বদলে আরো ইতিবাচক পরিভাষা ‘একত্রীকরণ ব্যবহার করে। একইসাথে জেরুসালেম মিউনিসিপ্যালের সীমানাও সম্প্রসারণ করে নেসেট, যাতে নগরী এখন আরো বিস্তৃত এলাকা নিয়ে গঠিত হয়। নতুন সীমানাগুলো এমন কৌশলে আঁকাবাঁকা করে করা হয় যাতে বিশাল আরব লোকজন বাইরে থাকে এবং নতুন নতুন ইসরাইলি বসতি স্থাপনের জন্য প্রচুর ফাঁকা জায়গা পাওয়া যায়। (মানচিত্র দেখুন) এটি নিশ্চিত করে যে নগরীর ভোটদাতা লোকজন প্রধানত ইহুদি থাকবে। দখলের পর শেষ পর্যন্ত মেয়র আল-খাতিব ও তার পরিষদকে অপমানজনক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বরখাস্ত করা হয়। সামরিক পুলিশ তাদেরকে তাদের বাড়ি থেকে মিউনিসিপ্যাল ভবনের কাছাকাছি থাকা গ্লোরিয়া হোটেলে নিয়ে যায়। সেখানে উপ সামরিক গভর্নর ইয়াকব সালমান আগে থেকে তৈরি একটি বিবৃতি ভাষণের মতো করে পাঠ করে জানান যে মেয়র ও তার পরিষদের সেবার আর প্রয়োজন নেই। আল-খাতিব লিখিত বিবৃতির অনুরোধ করলে সালমানের সহকারী ডেভিড ফারহি হোটেলের পেপার ন্যাপকিনে ক্ষিপ্র হাতে লিখে তা আরবিতে অনুবাদ করে দেন।১২ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল মেয়রকে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানাতে এবং তার ব্যক্তিগত উপস্থিতিতে তার কাছে জেরুসালেমের নতুন আইনগত মর্যাদা ব্যাখ্যা করার জন্য। কিন্তু তা করা হয়নি। সাবেক মেয়র ও তার পরিষদ সদস্যরা তাদেরকে বরখাস্ত করার কারণে কষ্ট পাননি। তারা মনে করতেন, তাদের বরখাস্ত করা অনিবার্য। যা তাদের অপমানিত করেছে তা হলো অপদস্থ ও অমর্যাদার অনুষ্ঠান। এমন অনুষ্ঠান ওই ঘটনার জন্য মানানসই ছিল না। ইসরাইলি সরকারের কিছু কিছু সদস্য মনে করেছিলেন যে আরব মিউনিসিপ্যালটি পশ্চিম জেরুসালেমের মিউনিসিপ্যালটির সাথে বা অধীনে পাশাপাশি থেকে কিছু ধরনের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। টেডি কোলেক এতে সম্মত হননি। তিনি বলেছিলেন, আরবেরা আমার কাজে সমস্যার সৃষ্টি করবে। তিনি সংবাদপত্রকে বলেন, ‘জেরুসালেম এক নগরী। কাজেই এতে একটি মিউনিসিপ্যালটি থাকবে। ৩ 

নগরীকে বিভক্তকারী প্রতিবন্ধকতাগুলো অপসারণ করা হয় ২৯ জুন দুপুরে, আরব ও ইসরাইলিরা নো ম্যান্স ল্যান্ড অতিক্রিম করে ‘অন্য দিকে’ যায়। বিজয়ী ইসরাইলিরা উচ্ছ্বসিতভাবে পুরনো নগরীতে ছুটে যায়, সুকে দেখতে পাওয়া সবকিছু কিনতে থাকে। তারা কষ্টের সাথে দেখে যে আরবেরা বিলাসবহুল খাবার, আমদানি করা বিদেশী পণ্য উপভোগ করছিল, যা পশ্চিম জেরুসালেমে পাওয়া যায় না। আরবরা ছিল বেশি ইতস্তত। তাদের অনেকে কাতামন ও বাকায় তাদের পুরনো বাড়ির চাবিগুলো সাথে নিয়েছিল। ওইসব স্থানেই তারা ১৯৪৮ সাল থেকে বাস করছিল, তারা তাদের সাবেক বাড়িঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তাকায়। আরবেরা যখন দরজায় নক করে তাদের পারিবারিক বাড়িগুলোর ভেতরটা দেখার জন্য বিনীতভাবে অনুমতি চাইছিল, তখন কিছু ইহুদি অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। অবশ্য কোনো সহিংসতা ঘটেনি। দিন শেষে ইসরাইলিদের মনে সাধারণভাবে বিশ্বাস সৃষ্টি হয় যে আরবরা নগরীর ‘একীকরণকে মেনে নিতে শুরু করেছে। পরের ঘটনাবলীতে প্রমাণিত হয়েছিল যে, তারা স্রেফ হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতিকে মেনে নেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। আল-কুদস আরবদের কাছেও পবিত্র স্থান ছিল। ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৮ সালে তাদের স্বকীয়তা বিলীন হওয়ার কষ্ট সহ্য করেছিল। এখন তারা জেরুসালেম থেকেও নিশ্চিহ্ন হতে শুরু করেছিল। তাদের সাবেক মেয়র হুহি আল-খাতিব হিসাব কষেছিলেন যে ইসরাইলি যুদ্ধের কারণে ১৯৬৭ সালে প্রায় ১০৬,০০০ আরব জেরুসালেমবাসী প্রবাসী হয়েছিল।১৪ এখন সুবিধামতো সীমানা টানার কারণে নগরীর মোট জনসংখ্যার মাত্র প্রায় ২৫ ভাগে পরিণত হয়েছে আরবেরা। গৃহহীনতা, বিচ্ছিন্নতার কারণে প্রবাসে ফিলিস্তিনিরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছিল। তারা কাব্বালবাদীদের স্বপ্নে অংশীদার হতে পারছিল না : তাদের ক্ষেত্রে সবকিছুই ভুল স্থানে ছিল। স্থানচ্যুতি ও হারানোর এই অভিজ্ঞতা আরবদের কাছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জেরুসালেমকে বেশি মূল্যবান করে তোলে। 

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ইসরাইলের জেরুসালেম যুক্ত করার বিষয়টি গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিল না। ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে জাতিসঙ্ঘ এই ‘একীকরণ’ বাতিল করার জন্য এবং জেরুসালেমের মর্যাদা পরিবর্তন করে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে দুটি প্রস্তাব পাস করে। যুদ্ধ ও এর পরিণাম অবশেষে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের দুর্দশার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখন আরো হাজার হাজার লোক ইসরাইল অধিকৃত এলাকা থেকে পালিয়ে আরব দেশগুলোর আশপাশের শিবিরগুলোতে ভিড় করতে থাকে। সবশেষে ১৯৬৭ সালের ২২ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ২৪২ নম্বর প্রস্তাব পাস করে : ছয় দিনের যুদ্ধের সময় ইসরাইল যেসব ভূখণ্ড দখল করেছে, সেখান থেকে তাকে অবশ্যই প্রত্যাহার করতে হবে। এই অঞ্চলের সব রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে। 

কিন্তু বেশির ভাগ ইসরাইলি ও প্রবাসে থাকা অনেক ইহুদি ঐশী স্থানের প্রতি তাদের নতুন আবেগে বাঁধা পড়েছিল তারা। তারা এসব প্রস্তাবের বৈধতা মেনে নিতে পারছিল না। টেম্পল ধ্বংসের পর ইহুদিরা ধীরে ধীরে বাস্তবভাবে জেরুসালেম দখল করার ধারণা ত্যাগ করেছিল। ঐশী ভূগোল অন্তর্মুখী হয়ে পড়েছিল, অনেক অর্থোডক্স তখনো ইসরাইল রাষ্ট্রকে অপবিত্র মানব সৃষ্ট বিবেচনা করছিল। তবে ৭ জুনের নাটকীয় ঘটনাগুলো এই ধারণা বদলাতে শুরু করে। পরিস্থিতি কনস্টানটাইন আমলের জেরুসালেম নিয়ে খ্রিস্টান ধারণায় পরিবর্তনের চেয়ে অমিল ছিল না। ইহুদিদের মতো খ্রিস্টানেরাও মনে করত যে তারা ঐশী স্থানগুলোতে ভক্তিতে সীমিত থাকার অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। কিন্তু খ্রিস্টের সমাধির সাথে অপ্রত্যাশিত পুনঃএকীকরণের সাথে সাথে ঐশী প্রতীক হিসেবে জেরুসালেম নিয়ে নতুন প্রশংসার পথ সৃষ্টি করে। ইহুদিদের মতো চতুর্থ শতকের খ্রিস্টানেরাও নৃশংস নির্যাতনের আমল থেকে বের হয়ে এসেছিল। ইহুদিদের মতো তারা আবারো বিশ্বের সম্পূর্ণ ‘নতুন রাজনৈতিক অবস্থান করায়ত্ত করেছিল সদ্য। নাৎসি বিপর্যয় এমন গভীর একটি আঘাত চাপিয়ে দিয়েছিল যা যৌক্তিক সান্ত্বনায় আরোগ্য লাভ করার মতো ছিল না। পুরনো কল্পকথন- প্রাচীন ধরনের মনোস্তত্ত্ব – আত্মার অপেক্ষাকৃত কম যৌক্তিকভাবে বোধগম্য অংশের আরো গভীরে পৌঁছাতে পারে। জেরুসালেমের পবিত্রতার এই নতুন ইহুদি আবেগ স্রেফ জাতিসঙ্ঘের নির্দেশনা বা তর্কসাপেক্ষ যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা যায় না। এটি আইনসম্মত বা যৌক্তিক- এজন্য শক্তিশালী ছিল না, বরং এটি কল্পকথন বলেই যথাযথ হয়েছিল। 

কনস্টানটাইনের সময়ে খ্রিস্টের সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছিল ইতিহাসের অন্যতম প্রথম লিপিবদ্ধ করা প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে। সমাহিত ও তখন পর্যন্ত অগম্য পবিত্রতায় যাওয়ার জন্য মাটির নিচে খনন করার এ প্রক্রিয়াটি নিজে থেকেই ছিল মনোস্তাত্ত্বিক উপশম লাভের অনুসন্ধানের একটি শক্তিশালী প্রতীক। চতুর্থ শতকে খ্রিস্টানেরা আর নির্যাতিত, অসহায় সংখ্যালঘু না হওয়ায় তাদের ধর্মকে নতুন করে মূল্যায়ন করছিল, নতুন খ্রিস্টান পরিচিতি নির্মাণের লক্ষ্যে সংগ্রাম করে (প্রায়ই বেদনার সাথে) শক্তির উৎস খুঁজছিল। ফ্রয়েড প্রত্নতত্ত্ব ও মনোস্তত্ত্বের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় তাড়াহুড়া করেছেন। ইসরাইলেও, যেমনটা ইসরাইলি লেখক অ্যামোস অ্যালন প্রবলভাবে অনুভব করেছেন, প্রত্নতত্ত্ব আধা-ধর্মীয় আবেগপূর্ণ বিষয় হয়ে পড়েছিল। কৃষিকাজের মতো এটি ছিল ভূমির সাথে অভিবাসীদের একে নিজের করে নেওয়ার উপলক্ষ। তারা যখন পূর্ববর্তী সময়ের ফিলিস্তিনের ইহুদি জীবনের জমিনে অবয়বগত প্রমাণ পেল, তখন তারা দেশটির প্রতি তাদের অধিকারে নতুন বিশ্বাস লাভ করল। এটি তাদের ফিলিস্তিনি পূর্বসূরিদের ব্যাপারে থাকা তাদের সন্দেহ প্রশমিত করতে সহায়তা করে। ইসরাইলের সবচেয়ে বিখ্যাত সৌখিন প্রত্নতত্ত্ববিদ মোশে দায়ন এ ব্যাপারে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন যে প্রত্নতত্ত্বে ইসরাইলিরা তাদের ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ আবিষ্কার করেছির। তারা জানতে পেরেছিল যে তাদের পূর্বপুরুষেরা তিন হাজার বছর আগে এই দেশে ছিল। এটি ছিল মূল্যবোধ… এর মাধ্যমে তারা লড়াই করেছিল, এ নিয়েই তারা বেঁচেছিল।১৫ অ্যালন যুক্তি দিয়েছেন, দেশপ্রেমমূলক প্রত্নতত্ত্ব অনুসন্ধানের এই কাজে ‘বিশ্বাস বা ফ্রয়েডিয়ান বিশ্লেষণ হিসেবে এটি লক্ষ করা সম্ভব ছিল যে উপশমের একটি ধরন অর্জন; মানুষ তাদের সন্দেহ ও ভয় থেকে উত্তানো এবং সত্যিকারের বা কল্পিত ভয় থেকে উদ্ধার পেয়ে লুকানো মূলের দিকে যায় সবসময়। ১৬ 

ছয় দিনের যুদ্ধে জয় করা ‘ডেড সি স্ক্রলগুলো রাখার জন্য নির্মিত প্রদর্শন হল দেখাচ্ছে, ইসরাইলিরা কিভাবে তাদের নিজস্ব প্রয়োজনের আলোকে ঐশী ভূগোলের পুরনো প্রতীকের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। এর শ্বেত গম্বুজটি ইহুদি জেরুসালেমের সবচেয়ে বিখ্যাত স্মারকে পরিণত হয়। নেসেটের দিকে মুখ করা এ গম্বুজটি হলি সিটির প্রতি দাবি করে খ্রিস্টান ও মুসলিম গম্বুজগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে। অ্যালন উল্লেখ করেছেন, ইসরাইলিরা এই বিরোধপূর্ণ দেশে মালিকানার দলিল হিসেবে ক্রলগুলোকে বিবেচনা করে। ১৯৪৭ সালে এগুলোর আবিষ্কারের সময়ই কাকতালীয়বাবে ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ফলে ফিলিস্তিনে ইসরাইলের পূর্ববর্তী অস্তিত্ব একেবারে যথাযথ সময়ে প্রমাণিত হয়। ‘শ্রাইন অব দি বুক’ নামে পরিচিত ভবনের নামটিই এর ঐশী তাৎপর্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। উপাসনালয়টির গর্ভাশয়-ধরনের অভ্যন্তরভাগে প্রবেশ করতে হয় একটি কৃষ্ণ, সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ দিয়ে। এটি আসলে আদি শান্তি ও সম্প্রীতিতে ফিরে যাওয়ার গ্রাফিক প্রতীক। আর তা বিশ শতকের সেক্যুলার সমাজের জন্মপূর্ব অভিজ্ঞতার সাথে সম্পৃক্ত। উপাসনালয়টির কেন্দ্রে থাকা শিষ্ণু, মুগুর-সদৃশ ভাষ্কর্যটি টিকে থাকার জাতীয় ইচ্ছাটিই প্রদর্শন করে। তবে এটি হারানো স্বর্গে নারী ও পুরুষের একসাথে থাকার জীবনকেও ফুটিয়ে তোলে। পবিত্র স্থানটি অনেক সময়ই উর্বরতার উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো। ইলোন বলেছেন, উপাসনালয়ের ‘প্রত্নতাত্ত্বিক ও জাতীয়তাবাদ প্রাচীন ও পুনর্জীবিত উর্বরতার শাস্ত্রাচারের ঐক্যবদ্ধ রূপ। শ 

কামরানের তীব্র ধর্মতত্ত্বের মতো উপশম ও জাতীয় পরিচিতির এই অনুসন্ধানের একটি আগ্রাসী দিকও রয়েছে। প্রথম থেকেই মোশে দায়ান পরিষ্কার করে দেন যে ইসরাইল খ্রিস্টান ও মুসলিমদেরকে তাদের নিজস্ব উপাসনালয়গুলো পরিচালনার অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। ইসরাইলিরা গর্বভরে জর্দানিদের আচরণের (তারা ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ইহুদিদের প্রবেশাধিকার দিতে অস্বীকার করেছিল) সাথে তাদের আচরণের তুলনা করে। বিজয়ের পর ওই দিনই পশ্চিম তীরের সামরিক গভর্নর একটি সভা করে জেরুসালেমের সব খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে আশ্বাস দেন। আর ১৭ জুন দায়ান মুসলিমদেরকে বলেন যে তারা হারামের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখতে পারবে। রাব্বি গোরেনের স্থাপিত আর্কটি তাকে দিয়ে অপসারণ করিয়ে সেটিকে প্লাটফর্মের দক্ষিণ প্রান্তে স্থাপন করতে বলেন দায়ান। হারামে প্রার্থনা করা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করা ইহুদিদের জন্য নিষিদ্ধ করে ইসরাইলি সরকার। কারণ এটি এখন মুসলিম পবিত্র স্থান। ইসরাইলি সরকার কখনো এই নীতি থেকে সরে আসেনি। এতে প্রমাণিত হয় যে জায়নবাদী বিজয়ীরা জেরুসালেমে তাদের পূর্বসূরীদের পবিত্র অধিকারের প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধাহীন ছিল না। তবে দায়ানের সিদ্ধান্তটি সাথে সাথে কিছু ইসরাইলির মধ্যে ক্রোধের সৃষ্টি করে। জেরুসালেমে একটি গ্রুপ টেম্পল মাউন্ট ফেইথফুল নাম দিয়ে সংগঠিত হয়। তারা বিশেষভাবে ধার্মিক ছিল না। তাদের অন্যতম নেতা গারশোম সোলোমন ছিলেন বেগিনের ডানপন্থী হেরুত পার্টির সদস্য। তার ধর্মীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার চেয়ে অনেক বেশি ছিল জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা। তিনি যুক্তি দেন যে টেম্পল মাউন্টের ওপর ইহুদিদের প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ করার কোনো অধিকার নেই দায়ানের। কারণ হলি প্লেসেস বিল সব উপাসনাকারীকে স্বাধীন প্রবেশাধিকার দিয়েছে। অন্য দিকে টেম্পল মাউন্ট যেহেতু প্রাচীন ইসরাইলের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র, তাই নেসেট, প্রেসিডেন্টের বাসভবন ও সরকারি অফিসগুলো হারামে সরিয়ে নেওয়া উচিত।’ গুরুত্বপূর্ণ ইহুদি উৎসবগুলোতে টেম্পল মাউন্ট ফেইথফুল হারামে প্রার্থনা করা অব্যাহত রাখে, নিয়মিতভাবে পুলিশ তাদেরকে বের করে দেয়। মাগরেবি কোয়ার্টার ধ্বংস করার ক্ষেত্রেও একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল : ইসরাইলি উগ্রপন্থীদের দৃষ্টিতে পবিত্র স্থানটিতে ইহুদিদের প্রত্যাবর্তনের সাথে সেখানে মুসলিম উপস্থিতির ধ্বংসের বিষয়টি সম্পৃক্ত। 

বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় ১৯৬৭ সালের আগস্টে। ওই সময় রাব্বি গোরেন ও কয়েকজন ইয়েশিভা ছাত্র অ্যাভের নবম দিবসে মুসলিম রক্ষী ও ইসরাইলি পুলিশের সাথে দস্তাদস্তির পর হারামে এগিয়ে যান। তারা উপাসনায় অংশ নেন। এটি শেষ হয় রাব্বি গোরেনের শোফার ফোঁকার মাধ্যমে। ইসলামের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধের অস্ত্রে পরিণত হয় প্রার্থনা। দায়ান মুসলিমদেরকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন। তিনি একটি মামলুক মাদরাসায় গোরেনের প্রতিষ্ঠিত রাব্বানেত অফিস বন্ধ করে দেন। অবশ্য উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ামাত্র ধর্মমন্ত্রী জেরাহ ওয়ারফতিগ একটি সাক্ষাতকার প্রকাশ করে দাবি করেন যে আরুনাহ দি জেবুসাইতের কাছ থেকে দাউদের স্থানটি কেনার পর থেকেই টেম্পল মাউন্ট ইসরাইলের মালিকানাধীন রয়েছে।১৯ তিনি বলেন, এর ফলে ডোম অব দি রক ও আকসা মসজিদ ধ্বংস করার আইনগত অধিকার আছে ইসরাইলের। অবশ্য মন্ত্রী আসলে কর্মপন্থা হিসেবে এই সুপারিশ করেননি। কারণ ইহুদি বিধানে বলা হয়েছে, কেবল মেসাইয়াকেই তৃতীয় টেম্পল নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে। (স্মরণ করা যায় যে এমনকি এ ধরনের উপাসনালয় কার্যত চতুর্থ ইহুদি মন্দির হলেও হেরডের নির্মাণকাজের সময় উপাসনার ধারাবাহিকতায় কোনো বিরতি পড়েনি। ফলে এটি দ্বিতীয় টেম্পল হিসেবেও পরিচিত হয়।) 

বিজয়ের দিন, ওয়েস্টার্ন ওয়ালে চুমু খাওয়ার জন্য জমায়েত হওয়া সৈন্যদের মনে হয়েছিল যে শান্তি ও সম্প্রীতির নতুন যুগের সূচনা ঘটেছে। তবে বাস্তবে শান্তির নগরী জায়নে আবারো ঘৃণা আর অনৈক্যের দৃশ্য দেখা যেতে থাকে। পবিত্ৰ স্থানগুলো ইহুদিদের কাছে ফিরিয়ে দিলে তা কেবল ইসলামের সাথেই নতুন করে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করত না, সেইসাথে ইসরাইলি সমাজের মধ্যেও গভীর সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করত। মাগরিবি কোয়ার্টারকে ধ্বংস করে প্রায় সাথে সাথে নতুন প্লাজা সৃষ্টির ঘটনাটি ইহুদিদের মধ্যে বিবাদের নতুন উৎসে পরিণত হয়। কোলেকের ত্বরিত পদক্ষেপ দৃশ্যত কেবল অমানবিকই ছিল না, বরং সেইসাথে নন্দনগতভাবেও ছিল ভুল। পুরনো সংকীর্ণ বদ্ধ এলাকাটি যতটুকু ছিল, তার চেয়ে বড় দেখাত। এখন এটি তানজিকিয়া মাদরাসা বা সোলায়মানের নগর প্রাচীরের লাগোয়া প্রাচীরগুলোর চেয়ে উঁচু দেখাতে লাগল। এসব প্রাচীর এখন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হলো। উদ্বোধনের দিনে এক সফরকারী হতাশার সাথে বলেছিলেন, ‘এর বিশাল বিশাল পাথর ছোট মনে হয়, এগুলোর আকার বিলীন হয়ে গেছে।’ প্রথম নজরে প্রাচীরটি ‘বাম দিকে বাড়িগুলোর পাথরের সাথে মিশে গিয়েছে।’ সংকীর্ণ এলাকার ঘনিষ্ঠতা বিদায় নিয়ে গেছে। নতুন প্লাজাটি আর মনোস্তাত্ত্বিক ঘনিষ্ঠতার সুযোগ দেয় না, যে-ই আসবে, সে-ই আগের মতোই তার স্রষ্টার সাথে একক হয়ে যাওয়ার অনুভূতি লাভ করে না। ২০ 

অল্প সময়ের মধ্যে স্থানটির ব্যবস্থাপনা ও করণীয় নিয়ে ধার্মিক ও সেক্যুলার ইহুদিদের মধ্যে সবচেয়ে অপবিত্র বিরোধ বিস্ফোরিত হয়। প্রাচীরটি এখন পর্যটক আকর্ষণের স্থান, লোকজন আর কেবল প্রার্থনার জন্য সেখানে যেত না। ফলে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রাচীরের একেবারে সামনে বেড়া দিয়ে নতুন প্রার্থনা স্থান নির্মাণ করতে চাইল। এতে সেক্যুলার ইসরাইলিরা ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ল : মন্ত্রণালয় কিভাবে অন্য ইহুদিদের প্রাচীরে যেতে না দেওয়ার সাহস দেখায়? তারা তো জর্দানিদের মতোই খারাপ লোক! শিগগিরই রাব্বিরাও এই পবিত্র স্থানের সত্যিকারের প্রেক্ষাপট নিয়ে তিক্ত সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ যুক্তি দিলো যে প্রাচীরের সামনে থাকা অংশসহ পুরো ওয়েস্টার্ন ওয়াল পবিত্র। তারা তানজিকিয়া মাদরাসার বেসমেন্ট খুঁড়ে ভূগর্ভস্থ কক্ষগুলোর একটিতে সিনাগগ প্রতিষ্ঠা করে ঘোষণা করল, প্রতিটি কক্ষ বা ভল্টকে তারা পবিত্র স্থানের মর্যাদা দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমেরা শঙ্কিত হলো যে এই ধর্মীয় প্রত্নতত্ত্ব চরমভাবে ও আক্ষরিকভাবে তাদের নিজস্ব পবিত্র স্থানটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবে রাব্বিরা ইহুদি সেক্যুলারপন্থীদেরকেও জেরুসালেম থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছিল। তারা মিউনিসিপ্যাল এলাকার ঈশ্বরহীন স্থানে পবিত্রতার সীমান্ত ঠেলে দিচ্ছিল। এই সংগ্রাম আরো তীব্র হয়েছিল ইসরাইলি প্রত্নতত্ত্ববিদ বেনিয়ামিন মাজার হারামের দক্ষিণ প্রান্তে খননকাজ শুরু করায়। এটি আবারো মুসলিমদের আতঙ্কিত করে। 

তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে এতে আকসা মসজিদের ভিত্তিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পবিত্র স্থানগুলোতে এই অপবিত্র অনুপ্রবেশে ধার্মিক ইহুদিরাও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। বিশেষ করে মাজারের ওয়েস্টার্ন হিলের পাদদেশে তার তৎপরতা চালালে ও রবিনসন্সের আর্চ পর্যন্ত এগুতে থাকলে তারা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। নগরীর ‘একীকরণের’ কয়েক মাসের মধ্যে ওয়েস্টার্ন ওয়ালে একটি নতুন ‘বিভাজন’ সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ প্রান্ত এখন নতুন ঐতিহাসিক, ‘সেক্যুলার’ জোন; পুরনো প্রার্থনা এলাকাটি ছিল ধর্মীয় প্রাধান্যবিশিষ্ট; এবং এই দুয়ের মাঝামাঝি ছিল একটি নিরপেক্ষ এলাকা বা নতুন নো ম্যান্স ল্যান্ড। এখানে অবশিষ্ট কয়েকটি আরব বাড়ি ছিল। এগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া মাত্র প্রতিটি পক্ষ অন্য পক্ষের এলাকার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। ১৯৬৯ সালের গ্রীষ্মকালের দুটি ঘটনায় উপাসনাকারীরা আক্ষরিক অর্থেই ঈশ্বরের জন্য এই নিরপেক্ষ এলাকাটি মুক্ত করতে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আক্রমণ করেছিল। 

ইসরাইলি সরকার পবিত্র স্থানগুলোতে শান্তি বজায় রাখার উদ্যোগ নিলেও তখন জেরুসালেমের দখল নিয়ে নিজস্ব যুদ্ধে নিয়োজিত ছিল, ভবনের সময়োত্তীর্ণ অস্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিল।২২ প্রায় সাথে সাথেই পূর্ব জেরুসালেমের চারপাশে সুউচ্চ অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের নিরাপত্তা জোন নির্মাণের মাধ্যমে জেরুসালেম আরো ইহুদি আনার নতুন ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে। এগুলো নির্মাণ করা হয় ফ্রেঞ্চ হিল, রামাত এশকল, রামত, ইস্ট তালপিত, নেভে ইয়াকুক ও গিরোতে। ( মানচিত্র দেখুন) আরো কয়েক মাইল পূর্ব দিকে জর্দান উপত্যকার পাহাড়গুলোর কাছে মালুত আদুমিনে বাইরের একটি নিরাপত্তা বেষ্টনি নির্মাণ করা হয়। নির্মাণকাজ চলে ক্ষিপ্রগতিতে, বেশির ভাগই আরব ভূমি দখল করে। কৌশলগত রাস্তাগুলো একটি বসতি থেকে অপরটিকে সংযুক্ত করে। এটি কেবল নান্দনিক বিপর্যয়ই জেরুসালেমের স্কাইলাইন এসব কুৎসিত ব্লকে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল) ছিল না, সেইসাথে দীর্ঘ দিন ধরে থাকা আরব এলাকাগুলো কার্যত ধ্বংস করা হয়েছিল। দখলের ১০ বছরের সময়কালে ইসরাইলি সরকার আরবদের কাছ থেকে প্রায় ৩৭,০৬৫ একর জমি দখল করে। এটি ছিল জয় ও ধ্বংসের কাজ। বর্তমানে পূর্ব জেরুসালেমের মাত্র ১৩.৫ ভাগ আছে আরবদের হাতে। ২৩ নগরীটি বাস্তবিকই ‘ঐক্যবদ্ধ’ হয়েছে। কারণ, ইহুদি ও আরব জেরুসালেমের মধ্যে সুস্পষ্ট কোনো পার্থক্য নেই। তবে নবীরা যে ঐক্যবদ্ধ জায়নের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন, এটি তেমন ছিল না। ইসরাইলি ভূগোলবিদ মাইকেল রোমান ও আলেক্স ওয়াইড পরিকল্পনাকারীদের যুধ্যংদেহী পরিভাষা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন যে তারা যখন ‘আচ্ছন্ন করা, ‘লঙ্ঘন করা, ‘অনুপ্রবেশ করা,’ ‘ভূখণ্ডগত আধিপত্য,’ ও ‘নিয়ন্ত্রণ’- এর কথা বলে, তাতে নগরীর আরব জনসাধারনের প্রতি তাদের আগ্রাসী উদ্দেশ্যই প্রকট হয়। ২৪ 

তারা আল-কুদস থেকে নিংড়ে বের করে দেওয়া হবে এমন আশঙ্কায় আরবরা নিজস্ব কায়দায় প্রতিরোধে নামে, যদিও এই ভবন আক্রমণ প্রতিরোধে তাদের কিছুই করার ছিল না। তারা সরকারের কাছ থেকে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ছাড় আদায় করতে সমর্থ্য হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৬৭ সালের জুলাই মাসে তারা কাজি আইন গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল। এটি ইসরাইলের মূল ভূখণ্ডে মুসলিম কর্মকর্তাদের ওপর আরোপ করা হয়েছিল। জেরুসালেমের কাজি আইন বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, ওয়াকফ ও নারীদের মর্যাদার মতো বিষয়াদিতে পরিবর্তন এনে ইসরাইলি আইনের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই আলেমেরা ঘোষণা করেন, তারা সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল পুনর্জীবন করতে যাচ্ছেন। কারণ মুসলিম ধর্মীয় বিষয়াদি অবিশ্বাসীদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়াটা ইসলামি বিধানের পরিপন্থী। সরকার অধিকতর মুসলিম বিরোধীদের কয়েকজনকে বহিষ্কার করে এর জবাব দিলেও শেষ পর্যন্ত কৌশলে হলেও সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিলের অস্তিত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়। আরবেরাও জেরুসালেমে ইসরাইলি শিক্ষাব্যবস্থা আরোপ করার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রচারকাজ চালায়। কারণ, এটি তাদের নিজস্ব জাতীয় আকাঙ্ক্ষা, ভাষা ও ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাইবেল, মিসনাহ ও হাগাদার জন্য যেখানে বরাদ্দ ছিল ১৫৬ ঘণ্টা, সেখানে কোরআনের জন্য ছিল মাত্র ৩০ ঘণ্টা। এসব স্কুল থেকে শিক্ষা লাভকারী ছাত্রদের আরব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করার জন্য যোগ্য বিবেচিত হতো না। শেষ পর্যন্ত সরকারকে আপস করতে হয়, নগরীতে জর্দানি কারিকুলাম সমান্তরালভাবে চালু করার অনুমতি দেওয়া হয়। 

ইসরাইলিরা আবিষ্কার করতে থাকে যে জেরুসালেমের আরবরা ইসরাইলি মূল ভূখণ্ডের আরবদের মতো ততটা মানানসই নয়। আগস্টে তারা আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয় : ১৯৬৭ সালের ৭ আগস্ট সব দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও রেস্তোরাঁ সারা দিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটিয়ে ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহর চরমপন্থী সদস্যরা নগরীর ভেতরে সেল প্রতিষ্ঠা করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে। এসব সেলের তিনটি একযোগে ৮ অক্টোবর জায়ন সিনেমা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৬৮ সালেল ২২ নভেম্বর জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব ২২-এর বার্ষিকীতে মাহানে ইয়েহুদা মার্কেটে এক গাড়ি বোমায় ১২ জন নিহত হয়, ৫৪ জন আহত হয়। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে আরো কয়েকটি গাড়ি বোমা হয় : একটি হয় হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়ায়। এতে ২৬ জন নিহত হয়। এই হামলায় বেশ ক্ষতি হয়। ইসরাইলের অন্য যেকোনো নগরীর চেয়ে পশ্চিম জেরুসালেমেই সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী হামলা হয়, আর স্বাভাবিকভাবেই এর প্রতিশোধ নেয় ইহুদিরা। ১৯৬৮ সালের ১৮ আগস্ট নগরীর কয়েকটি স্থানে বিস্ফোরণ ঘটার পর কয়েক শত তরুণ ইহুদি আরব এলাকাগুলোতে চড়াও হয়ে দোকানপাটে ভাংচুর চালায়, রাস্তায যে আরবকেই দেখেছে, তাকে প্রহার করে। 

এই আরববিরোধী নিধনযজ্ঞে ইসরাইলি লোকজন কষ্ট পায়। তারাও ১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট ছড়িয়ে পড়া আরব ঘৃণা ও সন্দেহের গভীরতা দেখে আতঙ্কিত হয়। ওই সময় আকসা মসজিদে আগুন লেগে নূরউদ্দিনের বিখ্যাত মিম্বারটি ধ্বংস হয়ে যায়, সিলিংকে ঠেস দেওয়া কাঠের বিমগুলো পুড়িয়ে দেয়। শত শত মুসলিম মসজিদে ছুটে যায়, কাঁদতে কাঁদতে জ্বলতে থাকা ভবনে ঢুকে পড়ে। তারা ইসরাইলি দমকল বাহিনীর সদস্যদের প্রতি চিৎকার করে গালিগালাজ করে, আগুনে গ্যাসোলিন ছিটানোর জন্য তাদেরকে অভিযুক্ত করে। নগরজুড়ে আরবেরা বিক্ষোভ করে, পুলিশের সাথে সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত হয়। হারামে কিছু ইসরাইলির উত্তেজক আচরণের বিষয়টি বিবেচনা করা হলে মুসলিমদের জন্য এটি বিবেচনা করা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে অগ্নিসংযোগকারী ছিল জায়নবাদী। অবশ্য বাস্তবে অগ্নিসংযোগকারী ছিল অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত ডেডিভ রোহান নামের এক তরুণ খ্রিস্টান পর্যটক। খ্রিস্টের দ্বিতীয় আগমন ত্বরান্বিত করার আশায় তিনি মসজিদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। রোহান ইহুদি এজেন্ট নয়, তিনি সত্যিই খ্রিস্টান এবং হারামের উপাসনালয়গুলো ধ্বংস করার কোনো পরিকল্পনা ইহুদিদের নেই- এই তথ্য বিশ্বাস করিয়ে মুসলিমদের ভয় দূর করতে ইসরাইল সরকারের কয়েক মাস সময় লেগেছিল।

নতুন ইহুদি বসতিগুলো ১৯৭৪ সাল নাগাদ জেরুসালেমের স্কাইলাইনে প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলে, পুরনো ক্রুসেডার ক্যাসলগুলোর মতো নগরীকে ঘিরে ফেলে। আবারো জেরুসালেম পরিণত হয় দুর্গ নগরী, বৈরী প্রতিবেশীদের কোণঠাসা করে। 

পরের চার বছরে জেরুসালেমে চাপা ক্ষোভ নেমে আসে। অবশ্য এমন লক্ষণও দেখা যেতে থাকে যে ইসরাইলি ও আরবরা একে অপরের সাথে বসবাস করা রপ্ত করতে শুরু করেছে। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে নাসেরের মৃত্যুর পর ইসরাইল রাষ্ট্রের এই শত্রুর জন্য শোক শোভাযাত্রা আয়োজন করতে জেরুসালেমের আরবদের অনুমতি দেয় সরকার। বৃহস্পতিবার, ১ অক্টোবর, নগরীর পুরো আরব জনগোষ্ঠী নীরবে সমবেত হয়, নিখুঁত শৃঙ্খলায় শোভাযাত্রা করে হারামে যায়। সমঝোতা অনুযায়ী কোনো ইসরাইলি পুলিশ রাস্তায় ছিল না, আবার কোনো ইসরাইলবিরোধী প্লাকার্ডও দেখা যায়নি। অবশ্য এই শান্তির সময়ও অনেক ইসরাইলি আশা করলেও ফিলিস্তিনিরা তাদের দাবি ত্যাগ করেনি। তারা সুমাদ (‘অবিচলতা’) নীতি গ্রহণ করে। তারা বুঝতে পেরেছিল যে নগরীতে তাদের প্রকাশ্য উপস্থিতিই তাদের প্রধান অস্ত্র। ইসরাইল তাদেরকে যেসব কল্যাণমুখী ও অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে আগ্রহী সেগুলো গ্রহণ করতে হবে, তদেরকে জেরুসালেমে অব্যাহতভাবে বাস করতে হবে, সন্তান জন্ম দিতে হবে। এক ফিলিস্তিনি নেতা বলেছিলেন, ‘আমরা আমাদেরকে ছুঁড়ে ফেলার অজুহাত তোমাদেরকে দেব না। আমরা কেবল সেখানে উপস্থিত থেকেই প্রতিদিন তোমাদের মনে করিয়ে দেব যে জেরুসালেম সমস্যাটির সমাধান করতে হবে। ২৫ 

যম কিপুরে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে ইসরাইলের ওপর আকস্মিকভাবে হামলা চালায় মিসর ও সিরিয়া। এটি দুই পক্ষের মধ্যকার মনোভাব বদলে দেয়। এবার আরবরা অনেক ভালো করে। ঘোর কাটিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালাতে আইডিএফের কয়েক দিন সময় লাগে। জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিদের মনোবল চাঙ্গা হয়, তারা আশা করতে থাকে যে আল-কুদসে ইসরাইলি দখলদারিত্ব কেবল সাময়িক ব্যাপার হবে। আত্মতৃপ্তি কেটে যায় ইসরাইলের। নিকট প্রাচ্যে ইসরাইল তাদের নিঃসঙ্গতার বিষয়টি নতুন করে বুঝতে পারে। এই ভয় ইসরাইলের নতুন অপরিবর্তনীয় মনোভাবের সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে ধর্মীয় গ্রুপগুলোর মধ্যে। যুদ্ধের অল্প সময় পর রাব্বি কুকের শিষ্যরা গুশ ইমুনিম (ব্লক অব দি ফেইথফুল) প্রতিষ্ঠা করে।২৬ ইসরাইলি এস্টাবলিশমেন্টের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা কেটে গিয়েছিল : ঈশ্বর ১৯৬৭ সালে ইসরাইলকে দারুণ একটি সুযোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু অধিকৃত ভূখণ্ডে উপনিবেশ গড়া ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অগ্রাহ্য করার বদলে সরকার স্রেফ গয়িমকে তুষ্ট করার চেষ্টা করে গেছে। যম কিপুর যুদ্ধ হলো ঈশ্বরের শাস্তি এবং এর মাধ্যমে কল্যাণকরভাবে আসল দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেক্যুলার জায়নবাদের মৃত্যু ঘটেছিল : এর বদলে পরিত্রাণ ও তাওরাতের জায়নবাদের প্রস্তাব করে গাশ। যুদ্ধের পর এর সদস্যরা অধিকৃত ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন শুরু করে। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিল যে এই পবিত্র উপনিবেশকরণের ফলে মেসাইয়ার আগমন ত্বরান্বিত হবে। গাস তৎপরতার প্রধান লক্ষ্য জেরুসালেম নয়, ছিল হেবরন। এখানে এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রাব্বি মোশে লেভিঙ্গার হেবরনের পাশে কিরিয়াত আরবায় নতুন শহর প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরাইলি সরকারকে রাজি করাতে দক্ষ লবি জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানে বসতি স্থাপনকারীরা প্যাট্রিয়ার্ক কেভে আরো বেশি প্রার্থনার সময়ের দাবিতে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করল। ওই সময় পর্যন্ত ইহুদিদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই কেবল প্রার্থনা করার অনুমতি দেওয়া হতো। কিন্তু লেভিঙ্গার হেবরন নগরীতে ইহুদিদের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করতে এবং ১৯২৯ সালের দাঙ্গার সময় ইহুদিদের গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই যেখানে মানবীয় অবয়বে ইব্রাহিম তার ঈশ্বরের চাক্ষুষ সাক্ষাত পেয়েছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে, ওই স্থানটি ইসরাইলের সবচেয়ে সহিংস ও ঘৃণা-তাড়িত নগরীতে পরিণত হলো। 

তারপর ১৯৭৭ সালে লেবার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে মেনাহেম বেগিনের নতুন লিকুদ পার্টি ক্ষমতায় এলে ডানদের আশা তুঙ্গে ওঠে, বিশেষ করে যখন পশ্চিম তীর প্রশ্নে ব্যাপক বসতি স্থাপনের জন্য নতুন সরকার আহ্বান জানায়। তবে তখন বেগিন আরববিশ্বের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করলে তার জনগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ২০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত তার ঐতিহাসিক জেরুসালেম সফর করেন। পরের বছর তিনি ও বেগিন ক্যাম্প ডেভিড চুক্তিতে সই করেন। ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় মিসর, এর বিনিময়ে সিনাই উপদ্বীপ থেকে প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দেন বেগিন। এটি ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে তীব্র সঙ্ঘাতের সৃষ্টি করে। তারা সিনাইয়ে ইহুদি নগরী ইয়ামিত নির্মাণ করেছিল। তারা এই নগরী গুঁড়িয়ে দেওয়া ঠেকাতে শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়াই করে যায়। নতুন ডানপন্থী গ্রুপগুলো চুক্তির বিরোধিতা করে জোট গঠন করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যায়। 

টেম্পল মাউন্টই ক্রমবর্ধমান হারে জেরুসালেমে নতুন উগ্রপন্থীদের তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। রাব্বি শলোমো অভিনার ১৯৭৮ সালে রাব্বি কুকের মারকেজ হারাভের সম্প্রসারণ হিসেবে ইয়েশিভাত অ্যাটেরেট হা-খুহানিম (‘ক্রাউন অব দি প্রিস্টস ইয়েশিবা’) প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৭ সালের জয়ের পর সরকার পুরনো ইহুদি কোয়ার্টার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। জর্দানি আমলে তা উদ্বাস্তু শিবিরে পরিণত হয়েছিল। ভাঙ্গা সিনাগগগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়, পুরনো বিধ্বস্ত বাড়িগুলো গুঁড়িয়ে নতুন নতুন বাড়িঘর, দোকানপাট ও গ্যালারি নির্মাণ করা হয়। আতেরেত হা- কোহানিমের চোখে এগুলো পর্যাপ্ত ছিল না। প্রধানত আমেরিকান ইহুদিদের তহবিলে মুসলিম কোয়ার্টারের আরব সম্পত্তি কিনতে শুরু করে ইয়েশিভা। ১০ বছরের মধ্যে তারা ৭০টির বেশি ভবনের মালিক হয়ে যায়।২৭ 

অবশ্য, নতুন ইয়েশিভার প্রধান কাজ ছিল টেম্পলের ধর্মীয় অর্থ নিয়ে গবেষণা করা।২৮ রাব্বি অ্যাভিনার নিজেও বিশ্বাস করতেন না যে ইহুদিদের তৃতীয় টেম্পল নির্মাণ করা উচিত। তার মতে, এই দায়িত্ব মেসাইয়ার জন্য সংরক্ষিত। তবে তার সহকারী রাব্বি মেনাচেম ফ্রুম্যান চাইতেন তার শিষ্যরা যেন টেম্পলে উপাসনাসহ সামগ্রিক কাজের জন্য প্রস্তুত থাকে, যাতে মেসাইয়া আসামাত্র তারা তাকে সহায়তা করতে পারে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, নিকট ভবিষ্যতেই মেসাইয়ার আগমন ঘটবে। তিনি বলির বিধিবিধান ও পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, এই লোকবিদ্যা সম্পর্কে তার ছাত্রদের নির্দেশিকা প্রদান করেন। রাব্বি ডেভিড এলবোইম তাওরাতের নির্দেশনা পুঙ্গানুপুঙ্খভাবে (এবং তা প্রায়ই অস্পষ্ট) পুরোহিদের পোশাক বুনতে শুরু করেন। 

অন্যরা বিশ্বাস করত যে আরো সুস্পষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন। সাদাতের জেরুসালেম সফরের সামান্য পরই গাসের দুই সদস্য ইয়েহুদা ইজায়ন ও মেনাচেম লিভনি জেরুসালেমের কাব্বালপন্থী ইয়েহোশুয়া বেন-শোশানের সাথে গোপন বৈঠক করেন। ধীরে ধীরে একটি গোপন আন্দোলন গঠিত হয়। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল ডোম অব দি রক উড়িয়ে দেওয়া। এটি নিশ্চিতভাবেই শান্তি-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেবে, ইহুদিদের ধর্মীয় দায়দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বজুড়ে ইহুদিদের মধ্যে প্রবল ধাক্কার সৃষ্টি হবে। তবে তারা বিশ্বাস করত, আধ্যাত্মিক বিপ্লবের ফলে মেসাইয়াকে পাঠাতে ও চূড়ান্ত পরিত্রাণে বাধ্য হবেন ঈশ্বর। লিভনি ছিলেন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। তিনি হিসাব করে দেখলেন যে আশপাশের এলাকার ক্ষতি সাধন না করেই ডোম অব দি রক গুঁড়িয়ে দিতে ২৮ কেজি নিখুঁত বোমার প্রয়োজন। তারা গোলান মালভূমির একটি সামরিক শিবির থেকে বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক সংগ্রহ করেন। তবে ১৯৮২ সালের হামলার মুহূর্তটিতে তাদের উদ্যোগকে আশীর্বাদ দিতে তারা কোনো রাব্বিকে পেলেন না। গ্রুপটির মধ্যে কেবল ইতজিয়ন ও বেন-শোশানই কোনো রাব্বির অনুমোদন ছাড়া মিশন অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলেন। ফলে পরিকল্পনাটি স্থগিত হয়ে গেল। 

ইসরাইলে একটি ধর্মীয় উদ্দীপনার আবির্ভাব ঘটেছিল। এটি সহমর্মিতাবোধ নয়, বরং খুনে ঘৃণা বাড়িয়ে তুলছিল। ১৯৮০ সালে এনজিয়নের গ্রুপটি হেবরনে ছয় ইয়েশিবা ছাত্রকে হত্যার বদলা নিতে পশ্চিম তীরে পাঁচ আরব মেয়রকে বিকলাঙ্গ করার ষড়যন্ত্র করে। ষড়যন্ত্রটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তবে দুই মেয়রকে নৃশংসভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। ঘৃণার এই নতুন ইহুদিবাদের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ মূর্তরূপ ছিলেন রাব্বি মেইর কাহানি। তিনি নিউ ইয়র্কে তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। সেখানেই তিনি ইহুদিদের ওপর কৃষ্ণাঙ্গ যুবকদের হামলার প্রতিশোধ নিতে জিউশ ডিফেন্স লিগ গঠন করেছিলেন। ইসরাইলে এসে কাহানে খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে জেরুসালেমের রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ আয়োজন করতে লাগলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তার কার্যক্রম পবিত্র ভূমিতে গোয়িমের উপস্থিতি বিষয়ে নির্দিষ্ট রাব্বানীয় ঘোষণায় অনুমোদিত। অবশেষে ১৯৭৫ সালে কাহানে কিরয়ারত আরবায় চলে গিয়ে তার সংগঠনের নাম রাখেন ক্যাচ (‘শক্তিবলে’)। এখন তার প্রধান লক্ষ্য হলো ইসরাইল রাষ্ট্র থেকে আরবদের তাড়িয়ে দেওয়া। ১৯৮০ সালে দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ডোম অব দি রক ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের জন্য সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কারারুদ্ধ হন। 

এসব উগ্র গ্রুপে যোগদানকারী লোকজন সেকেলে বা অশিক্ষিত ছিল না। আকসা মসজিদে বোমা পোঁতার জন্য ১৯৮২ সালে কারারুদ্ধ ইয়েল লার্নার ছিলেন ম্যাসাচুটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গ্রাজুয়েট ও ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক। মুক্তির পর লার্নার টেম্পল মাউন্টে স্যানহেদ্রিন প্রতিষ্ঠার প্রচারণা শুরু করেন। এসব কার্যক্রমের সামষ্টিকভাবে বিপজ্জনক প্রভাব ছিল। ক্রমাগত বেশি বেশি লোক অনিষ্টকর কাজে জড়িয়ে পড়ছিল, এমনকি তাদের অনেকে সরকারি পদেও ছিল। ১৯৮৩ সালের মার্চে হারামে যাওয়ার পথে ৩৮ জন ইয়েশিভা ছাত্রসহ গ্রেফতার হন রাব্বি ইসরাইল ‘অ্যারিয়াল’। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের মাধ্যমে হেরডিয়ান প্লাটফর্মের নিচে থাকা প্রথম টেম্পলের অবশিষ্টাংশে পৌঁছে সেখানে পাসওভার উদযাপন করা এবং সম্ভবত সেইসাথে সেখানে একটি ভূগর্ভস্থ বসতি প্রতিষ্ঠা করা। তাদের লক্ষ্য ছিল হারামে একটি সিনাগগ নির্মাণ করতে ইহুদিদের অনুমতি দিতে মুসলিমদের বাধ্য করা। ওয়েস্টার্ন ওয়ালের দায়িত্বে থাকা রাব্বি মেইর ইহুদা গেটজও গোপনে হারাম ভল্টে অনুসন্ধান চালিয়েছিলেন, তিনিও প্লাটফর্মে একটি সিনাগগ প্রতিষ্ঠার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৮৪ সালে এতজিয়নের ডোম অব দি রক উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার আগে পর্যন্ত তৃতীয় টেম্পল ছিল টাবু। ঈশ্বরের নামের মতো টেম্পল পুনঃনির্মাণের কথা মুখে বলাও বিপজ্জনক বিবেচিত হতো। কিন্তু এখন ওই টাবু উড়ে গেল, লোকজন সম্ভাব্য প্রকল্প হিসেবে এই ধারণার সাথে পরিচিত হয়ে গেল। তৃতীয় টেম্পল নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনার জন্য ১৯৮৪ সালে ‘অ্যারিয়াল’ প্রতিষ্ঠা করেন জফিয়া (সামনের দিকে তাকানো) নামের একটি সাময়িক পত্র। ১৯৮৬ সালে তিনি পুরনো নগরীতে টেম্পল জাদুঘর উদ্বোধন করেন। এখানে ইতোমধ্যে তৈরি নৌকা, বাদ্যযন্ত্র ও পুরোহিতের পোশাক প্রদর্শন করা হয়। অনেকে এই বিশ্বাসে উপনীত হয় যে ইহুদিরা এখন পুরোপুরি তৈরি। হারামের মুসলিম উপাসনালয়গুলো কোনোভাবেই হোক না কেন, ধ্বংস করে দেওয়া মাত্র তারা মাউন্ট জায়নে প্রবেশ করতে প্রস্তুত হবে, পূর্ণাঙ্গ আনুষ্ঠানিক উপাসনা শুরু করে দেবে। এর প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়-জাগানিয়া। আমেরিকান কৌশলবিদেরা হিসাব করে দেখেন যে স্নায়ুযুদ্ধের পরিস্থিতিতে আরবদের সমর্থন করছে রাশিয়া, ইসরাইলিদের সমর্থন করছে আমেরিকা। ফলে ইতজায়ন যদি ডোম অব দি রক উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা সফল হন, তবে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে দিতে পারে। 

অ্যালেনবাইয়ের জেরুসালেম জয়ের ঠিক ৫০ বছর পর ১৯৮৭ সালের ৯ ডিসেম্বর গাজায় ইন্তিফাদা নামে পরিচিত ফিলিস্তিন গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এর কয়েক দিনের মধ্যে কট্টরপন্থী জেনারেল অ্যারিয়াল শ্যারন পুরনো নগরীর মুসলিম কোয়ার্টারে তার নতুন অ্যাপার্টমেন্টে ওঠেন। এটি ছিল আরব জেরুসালেমে থাকার ইসরাইলি ডানপন্থীদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অবস্থানের প্রতীকী প্রকাশ। তবে মধ্য জানুয়ারি নাগাদ পূর্ব জেরুসালেমে ইন্তিফাদা ছড়িয়ে পড়ে : বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য ইসরাইলি সৈন্যরা হারামে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় জেরুসালেমে ইন্তিফাদার তীব্রতা কম থাকলেও নগরীতে গোলযোগ ও ধর্মঘট ছিল। ইসরাইলিরা এই বাস্তবতা মেনে নিলো যে জেরুসালেম দখল করার ২০ বছর পরও আল-কুদসের ফিলিস্তিনি অধিবাসীরা অন্যান্য এলাকার বিদ্রোহীদের সাথেই পূর্ণভাবে একাত্ম। ইন্তিফাদার একটি বাস্তব পরিণতি ছিল এই যে জেরুসালেম আবারো দুটি নগরীতে পরিণত হলো। অবশ্য এবার পূর্ব ও পশ্চিম জেরুসালেমের মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না, নো ম্যান্স ল্যান্ডে কোনো মাইন ছিল না। তবে আরব জেরুসালেম এমন এক স্থানে পরিণত হয়েছিল, যেখানে প্রবেশ করলে আঘাত সহ্য ছাড়া বের হতে পারবে না বলে মনে করতে থাকল ইসরাইলিরা। তারা অদৃশ্যমান রেখাটি অতিক্রম করার সময় এখন এমন আশঙ্কা ছিল যে তারা বা তাদের গাড়িতে ফিলিস্তিনি তরুণরা পাথর নিক্ষেপ করবে, কোনো না কোনো ঘটনা ঘটবেই। পূর্ব জেরুসালেম পরিণত হলো শত্রু ভূখণ্ডে। 

ইন্তিফাদা আন্তর্জাতিকভাবে অবাক করা ফলাফল অর্জন করল। সারা বিশ্বে সাধারণ মানুষ অধিকৃত জেরুসালেম ও ভূখণ্ডে ইসরাইলি আগ্রাসী প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন করে অবগত হলো, পাথর-নিক্ষেপকারীদের ইসরাইলি সৈন্যদের ধাওয়া ও গুলি করে হত্যা করা বা তাদের হাতের হাড় ভেঙ্গে দেওয়ার দৃশ্য দেখে। গণ- আন্দোলনের পরিকল্পনাকারী ছিল ফিলিস্তিনের তরুণ প্রজন্ম। তারা ইসরাইলি দখলদারিত্বে বেড়ে ওঠেছিল, কোনো সাফল্য পেতে ব্যর্থ পিএলও’র নীতিতে তাদের কোনো বিশ্বাস ছিল না। আরব বিশ্বকেও মুগ্ধ করে ইন্তিফাদা। ১৯৮৮ সালের ৩১ জুলাই বাদশাহ হোসেন নাটকীয়ভাবে ঘোষণা দিয়ে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেমের ওপর থেকে জর্দানি দাবি প্রত্যাহার করে নিলেন। অর্থাৎ এর মাধ্যমে এই ভূখণ্ডের মালিক যে ফিলিস্তিনি জনগণ, তা তিনি স্বীকার করে নিলেন। এতে যে ক্ষমতার শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা পিএলও গ্রহণ করে। ইন্তিফাদার নেতারা পুরনো অবাস্তববাদী নীতি পরিত্যাগ করার জন্য পিএলওর প্রতি আহ্বান জানান : ফিলিস্তিনিরা পছন্দ করুক বা না করুক, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রই ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের প্রধান নির্ধারক। পিএলওকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যানবাদী অবস্থান ত্যাগ করে জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাব ২৪২ গ্রহণ করতে হবে, ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে, সন্ত্রাসবাদ ত্যাগ করতে হবে। ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর পিএলও এই পথ অবলম্বন করে, ইসরাইলের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার অধিকার স্বীকার করে। এটি ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার ঘোষণাও ইস্যু করে। ইসরাইলের পাশে পশ্চিম তীরে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হবে জেরুসালেম [আল-কুদস আল-শরিফ]। 

ইন্তিফাদা ইসরাইলি শান্তি আন্দোলনের হাতকেও শক্তিশালী করে। এটা জাতীয় স্বাধীনতা ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন প্রশ্নে ফিলিস্তিনিদের নিরঙ্কুশ প্রতিরোধ এতই জোরালো করেছিল যে তা অস্বীকার করা ইসরাইলিদের জন্য ক্রমবর্ধমান হারে কঠিন করে তোলে। আরো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় সম্ভবত এই যে এই আন্দোলন অনেক বেশি আপসহীন কারো কারো চিন্তায় প্রভাব বিস্তার করে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী আইজ্যাক রবিন সবসময়ই ফিলিস্তিন প্রশ্নে কঠোর নীতি অনুসরণ করতেন। কিন্তু ইন্তিফাদা অবশেষে তার মধ্যে এই বিশ্বাস সৃষ্টি করে যে মানবতাবোধ না হারিয়ে ইসরাইলের পক্ষে অধিকৃত ভূখণ্ড ধরে রাখা সম্ভব নয়। ইন্তিফাদায় অংশগ্রহণকারী মা ও সন্তানদের নতি স্বীকার করাতে অনির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে না ইসরাইল সেনাবাহিনীর শক্তিকে। ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি পিএলওর সাথে শান্তি আলোচনা করার প্রস্তুতি নেন। পরে বছর ইসরাইল ও পিএলও ওসলো চুক্তিতে সই করে। এর ফলে গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরের অংশবিশেষ (মূলত জেরিকোর আশপাশের এলাকাগুলো) নিয়ে ফিলিস্তিন প্রশাসন গঠিত হয়। আরাফাত ও রবিন ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউসের লনে হাত মেলান। 

ওসলো চুক্তি তীব্র বিরোধিতার সৃষ্টি করে। উভয় পক্ষের লোকজনই মনে করতে থাকে যে তাদের নেতারা অনেক বেশি ছাড় দিয়ে ফেলেছেন। ফলে জেরুসালেমের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা ১৯৯৬ সালের মে পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেওয়া হলো যে এটি হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ। এটি যে কত কঠিন তা দেখা যায় ১৯৯৬ সালের জেরুসালেম মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে। এতে রক্ষণশীল লিকুদ প্রার্থী ইহুদ ওলমার্টের কাছে হেরে যান মেয়র টেডি কোলেক। ১৯৬৭ সালে মাগরেবি কোয়ার্টার ও আরব মিউনিসিপ্যাল ভেঙ্গে দেওয়ায় ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও কোলেককে বিবেচনা করা হতো উদার হিসেবে। তিনি আরব জেরুসালেমে অনেক সময় দিতেন, তাদের সাথে একাত্ম হতেন। তিনি জোর দিয়ে বলতেন যে জেরুসালেমে আরব জীবনব্যবস্থা সংরক্ষণ করার জন্য সবকিছু অবশ্যই করতে হবে। অবশ্য তিনি তখনো নগরীর ‘পুনঃএকীকরণের’ প্রতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। বিশ্বজুড়ে তিনি তার ঐক্যবদ্ধ নগরীর দর্শন নিয়ে শ্রোতাদের উদ্দীপ্ত করতেন, ‘বিভক্তি’ ও কাঁটাতারের বেড়া-সংবলিত সীমানার ভয় তাড়া করে ফিরতেন অবশ্য কোলেকের জেরুসালেমের ঐক্যের অর্থ সাম্য ছিল না। সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৬৭ সাল থেকে ৬৪,৮৮০টি হাউসিং ইউনিট নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮.৮০০ ইউনিট ছিল ফিলিস্তিনিদের জন্য। নগরীর ৯০০ স্যানিটেশন কর্মীর মধ্যে মাত্র ১৪ জন ছিল পূর্ব জেরুসালেমের জন্য বরাদ্দ। অপেক্ষাকৃত পুরনো আরব এলাকাগুলোর সাথে সংযুক্ত করার জন্য নতুন কোনো রাস্তা নির্মাণ করা হয়নি। ২৯ স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, এমনকি একজন ইসরাইলি ‘উদার ও তার বদান্যতা প্রদর্শনে বৈষম্য করেছেন। অধিকন্তু, ইসরাইলি সরকারের গৃহীত আইনগত পরিকল্পনা প্রক্রিয়ার ফলে পূর্ব জেরুসালেমের ৮৬ ভাগ ভূমি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। মিউনিসিপ্যালটির এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এর ফলে ২১ হাজার ফিলিস্তিনি পরিবার বর্তমানে গৃহহীন রয়েছে বা অনেক ছোট বাড়িতে বাস করছে। বাড়ি করার জন্য আইনগত এলাকা না থাকা পূর্ব জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নির্মাণের অনুমোদন পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কোনো পরিবার যদি অনুমতি না নিয়ে বাড়ি বানায়, তবে সেটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালের চিত্রে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ১৯৮৭ সালের মধ্য ভাগ থেকে পূর্ব জেরুসালেমে ২২২টি ফিলিস্তিনি বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর মিউনিসিপ্যালিটির বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে ইহুদি অধিবাসীদের জন্য উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব জেরুসালেমে আরো ৩১,৪১৩টি নতুন বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের ধীরে ধীরে আল-কুদস থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। টেডি কোলেকের বিপরীতে নতুন মেয়র ইহুদ ওলমার্ট উদার কথাবার্তা বলার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি পশ্চিমে নয়, পূর্ব দিকে জেরুসালেম সম্প্রসারিত করব। চিরদিনের জন্য নগরীটি যাতে ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণে ঐক্যবদ্ধ থাকে, সেজন্য আমি বাস্তব সব কাজ করব। এই ধরনের মনোভাবে শান্তির অস্তিত্ব থাকে না। 

ইসরাইলি উদারপন্থীদের কাছে টানার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন না ওলমার্ট। তিনি জেরুসালেমের উগ্র-অর্থোডক্সের সাথে জোট বেঁধে ক্ষমতায় এসেছিলেন। আর এই উগ্রপন্থীরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রুত বেড়েছে। তারা আর মিয়া শেরিমের ঘৌটোতে আবদ্ধ নয়, তারা নগরীর উত্তর অংশের বেশির ভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। ১৯৯৪ সালে ১০ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের ৫২ ভাগ ছিল উগ্র-অর্থোডক্স পরিবারের। আরবদের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। তাদের চিন্তা ছিল জেরুসালেমকে আরো ধর্মনিষ্ঠ নগরীতে পরিণত করা, সেক্যুলারদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। তারা সাবাতে আরো কম অ-কোশার রেস্তোরাঁ, আরো কম থিয়েটার ও বিনোদন স্পট খোলা দেখতে চায়। ওলমার্টের সমর্থকেরা ফিলিস্তিনিদের সাথে সার্বভৌমত্বের কোনো ধরনের ভাগাভাগিতে বিশ্বাস করে না। উগ্র-অর্থোডক্স ও সেইসাথে উগ্র ডানপন্থী গ্রুপগুলোর জন্য ভাগাভাগি করা মানে ভাগ করা, আর বিভক্ত জেরুসালেম হলো মৃত জেরুসালেম। 

ইসরাইলি সরকারগুলো বারবার জোর দিয়ে বলে আসছে যে জেরুসালেম হলো ইহুদি রাষ্ট্রের শ্বাশত অবিভাজ্য রাজধানী, এর সার্বভৌমত্ব ভাগাভাগি করার প্রশ্নই ওঠতে পারে না। আল-কুদসই হবে ফিলিস্তিনের রাজধানী- ফিলিস্তিনিদের এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য সরকার অব্যাহত চেষ্টা চালাতে থাকে। অবশ্য বলার ধরন পাল্টে গিয়েছিল। ইন্তিফাদার পর থেকে জেরুসালেম কার্যত বদলে গিয়েছিল : নগরীতে এমন স্থান খুবই কম আছে যেখানে আরব ও ইহুদিরা স্বাভাবিক পরিবেশে সাক্ষাত করতে পারে। পশ্চিম জেরুসালেমের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকটি প্রায় পুরোপুরি ইহুদিদের, পুরনো নগরী প্রায় পুরোপুরি আরব। একমাত্র সংযোগস্থল হলো পূর্ব জেরুসালেমে ইসরাইলি বসতিগুলোর আগ্রাসীভাবে স্থাপন করা রিংটি। ক্রমবর্ধমানভাবে ইসরাইলিরা একে জীবনের বাস্তব সত্য হিসেবে গ্রহণ করে নিচ্ছে। অনেকে জানতে চায়, যে এলাকায় তুমি সশস্ত্র প্রহরী ছাড়া প্রবেশ করতে পারো না, সেই স্থান দখল করার মানে কী? ১৯৯৫ সালের মে মাসে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফোরমেশন পরিচালিত এক জনমত জরিপে বিস্ময়কর তথ্য দেখা যায়। এতে প্রকাশ পায় যে ২৮ শতাংশ ইসাইলি ইহুদি প্রাপ্তবয়স্ক লোক ইহুদি এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার শর্তে হলি সিটির সার্বভৌমত্বে বিভক্তি মেনে নিতে প্রস্তুত। 

জেরুসালেমে ১৯৯৫ সালের ১৩ মে পিএলও প্রতিনিধি ফয়সাল হোসাইনি আরব ভূমি বাজেয়াপ্তকরণের বিরুদ্ধে আয়োজিত বিক্ষোভে বক্তৃতা করেন। একসময় নো ম্যান্স ল্যান্ড হিসেবে বিরাজ করা পুরনো নগরীর প্রাচীরগুলোর নিচে দাঁড়িয়ে হোসাইনি বলেন, ‘আমি ওই দিনের স্বপ্ন দেখছি যখন কোনো ফিলিস্তিনি বলবে ‘আমাদের জেরুসালেম’ এবং এর মানে হবে ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলিরা এবং কোনো ইসরাইলি বলবে ‘আমাদের জেরুসালেম’ এবং এর অর্থ দাঁড়াবে ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিরা।৩২ এর প্রতিক্রিয়ায় লেখক, সমালোচক, শিল্পী ও সাবেক সিনেট সদস্যসহ সাত শ’ প্রখ্যাত ইসরাইলি এই যৌথ বিবৃতিটি প্রদান করেন : 

জেরুসালেম আমাদের, ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের- মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের। 

আমাদের জেরুসালেম হলো একবারে প্রথম দিন থেকে- কেনানি ও জেবুসিত ও ইসরাইলি, ইহুদি ও হেলেনিস, রোমান ও বায়েজান্টাইন, খ্রিস্টান ও মুসলিম, আরব ও মামলুক, উসমানিয়া ও ব্রিটন, ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি- নগরীকে সমৃদ্ধ করা সব সংস্কৃতি, সব ধর্ম, সব আমলের জন্য একটি ছবি। তারা এবং সেইসাথে যারাই নগরীতে অবদান রেখেছে তাদের সবারই জেরুসালেমের আধ্যাত্মিক ও ভৌগোলিক দৃশ্যপটে স্থান রয়েছে। 

তবে জেরুসালেম অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ, সবার জন্য উন্মুক্ত, এর সব অধিবাসীর মালিকানায় থাকতে হবে। আর সেখানে থাকতে পারবে না কোনো সীমানা, কাঁটাতারের বেড়া। 

আমাদের জেরুসালেম অবশ্যই দুটি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে, তারা এই দেশে পাশাপাশি বাস করবে- পশ্চিম জেরুসালেম হবে ইসরাইল রাষ্ট্রের রাজধানী, পূর্ব জেরুসালেম হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী। 

আমাদের জেরুসালেম অবশ্যই হতে হবে শান্তির রাজধানী। ৩৩ 

জায়ন যদি সত্যিই যুদ্ধ আর ঘৃণার নগরীর বদলে শান্তির নগরী হয়ে থাকে, তবে কোনো না কোনো ধরনের যৌথ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। সমাধানের অনেক ধরনের প্রস্তাব রয়েছে। জেরুসালেম কি আন্তর্জাতিকভাবে শাসিত এলাকা হিসেবে থাকা উচিত? ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য বিশেষ সুবিধা- সংবলিত ইসরাইলি সার্বভৌমত্ব থাকা উচিত সেখানে? কিংবা অবিভক্ত নগরীতে যৌথ ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি প্রশাসন থাকবে, যেখানে দুটি আলাদা মিউনিসিপ্যালটি (পরিচালনা সংস্থা হতে পারে একটি বা দুটি)? এ নিয়ে প্রচণ্ড বিতর্ক হয়। কিন্তু মূলনীতি সুস্পষ্ট না হলে এসব সমাধান কল্পকাহিনী হিসেবেই থেকে যাবে। 

এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জেরুসালেমের ইতিহাস আমাদেরকে কী শিক্ষা দেয়? ১৯৯৫ সালের শরতে রাজা দাউদের নগরী জয়ের তিন হাজারতম বার্ষিকী উদযাপনের জন্য বছরব্যাপী উৎসবের সূচনা করে ইসরাইলিরা। ফিলিস্তিনিরা এতে আপত্তি জানায়। তারা এই উদযাপনকে পুরোপুরি ইহুদি জেরুসালেমের প্রপাগান্ডা বিবেচনা করে। তবে দাউদের জয়ের কাহিনী ছিল ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের প্রতি রক্ষণশীল ইসরাইলিদের কল্পনার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তারকারী। আমরা দেখেছি, সব একেশ্বরবাদী বিজয়ীই এই সত্যের মুখোমুখি হয়েছেন যে জেরুসালেম তাদের আগেও অন্য জাতির কাছে পবিত্র নগরী ছিল। তিন ধর্মের সবাই ব্যক্তির নিরঙ্কুশ ও ঐশী অধিকারের ওপর জোর দেয় বলে পবিত্র নগরীতে পূর্বসূরীদের প্রতি বিজয়ীদের আচরণই হবে তাদের আদর্শের প্রতি তাদের আন্তরিকতার পরীক্ষা। আমাদের হাতে থাকা অপূর্ণাঙ্গ তথ্যের আলোকে আমরা বলতে পারি যে রাজা দাউদ এই পরীক্ষায় উৎরে গেছেন ভালোভাবেই। তিনি জেরুসালেম থেকে জেবুসিত অধিবাসীদের তাড়িয়ে দেওয়ার কোনো চেষ্টা চালাননি, জেবুসিত প্রশাসন বহাল থাকে এবং ঐশী স্থানগুলো কেড়ে নেওয়া হয়নি। দাউদের অধীনে জেরুসালেম অনেকটাই জেবুসিত নগরীই থেকে যায়। ইসরাইল রাষ্ট্রকে এই মানদণ্ডে পরিমাপ করা যায় না। ১৯৪৮ সালে পশ্চিম জেরুসালেমে ৩০ হাজার ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর হারায়। আর ১৯৬৭ সাল থেকে আরব ভূমি জবরদখল অব্যাহত রয়েছে, ক্রমবর্ধমান ও বিপজ্জনক হারে হারাম আল-শরিফের ওপর হামলা হচ্ছে। ইসরাইলিরা জেরুসালেমের সবচেয়ে খারাপ বিজয়ী নয় : তারা তাদের পূর্বসূরীদের নির্বিচারে হত্যা করেনি, যেভাবে ক্রুসেডাররা করেছিল, তাদেরকে তারা স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেনি, যেভাবে নগরীতে বায়েজন্টাইনরা করেছিল ইহুদিদের। অন্য দিকে, তারা তারা খলিফা উমরের মতো উঁচু মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি। বর্তমান অসুখী পরিস্থিতিতে আমরা যা দেখছি, তাতে কষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে অতীতে দু’বার জেরুসালেমে ইসলামি বিজয়ের পর ইহুদিদের তাদের পবিত্র নগরীতে ফিরে আসা সম্ভব হয়েছিল। উমর ও সালাহউদ্দিন উভয়েই জেরুসালেমে ইহুদিদের (খ্রিস্টান শাসকদের তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন) বসতি স্থাপন করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। 

কিংবদন্তিপ্রতীম ঘটনা ছিল ১৯৬৭ সালের বিজয়। এর প্রতীকী বিষয়টি ছিল সর্বগ্রাসী। ইহুদিরা অবশেষে সত্যিই জায়নে ফিরে গিয়েছিল। অবশ্য প্রথম থেকেই জায়ন কেবল একটি ভৌগোলিক সত্তা ছিল না। এটি ছিল একটি আদর্শও। জেবুসিত আমল থেকে জায়ন শান্তির নগরী হিসেবে, সম্প্রীতি ও একীকরণের দুনিয়াবি স্বর্গ হিসেবে শ্রদ্ধা পেয়ে আসছিল। ইসরাইলি সাম্যবাদী নেতা ও নবীরাও এই স্বপ্নাবিভাব বিকশিত করেছেন। কিন্তু জায়নবাদী জেরুসালেম দুঃখজনকভাবে ওই আদর্শ থেকে অনেক নিচু স্থানে রয়েছে। ক্রুসেডের পর থেকে তিন ইব্রাহিমি ধর্মের মধ্যকার সম্পর্ক স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জেরুসালেম নার্ভাস, রক্ষণাত্মক নগরী হয়ে পড়েছে। এটি ক্রমবর্ধমানহারে বিরোধপূর্ণ স্থানেও পরিণত হয়ে আছে। কেবল ইহুদিরা নয়, খ্রিস্টান ও মুসলিমরাও লড়াই করেছে, একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করেছে। কিন্তু সহিংস সাম্প্রদায়িক বিভেদ তিনটি প্রধান সম্প্রদায়কে ভেতর থেকে তিক্তভাবে বিভক্ত দলে পরিণত করেছে। উনিশ শতকের প্রায় প্রতিটি ঘটনায় জেরুসালেম সাম্প্রদায়িক বিরোধে উস্কানি দিয়েছে বা বাড়িয়ে তুলেছে। বর্তমানে খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলো এখনো খ্রিস্টের সমাধিতে একে অপরের বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ লড়াইয়ে নিয়োজিত। আর ছয় দিনের যুদ্ধে নগরীর আবেগগত বিজয়ের পর পরই ধর্মীয় ও সেক্যুলার ইসরাইলিরা ওয়েস্টার্ন ওয়ালে একে অপরের বিরুদ্ধে তীব্র দ্বন্দ্বে নিয়োজিত রয়েছে। রাজা দাউদ নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে যে জায়ন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এটি তেমন স্থানে পরিণত হয়নি। 

ইসরাইল অব্যাহতভাবে জাতীয় নিরাপত্তার স্থায়ী গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনিরা চায় মুক্তি, আর ইসরাইলিরা চায় সীমান্ত নিশ্চিত করতে। ইহুদি ইতিহাসে ক্ষতের মতো থাকা নৃশংসতার বিষয়টি বিবেচনা করলে এটি বিস্ময়কর মনে হবে না। নগরী থেকে লোকজন প্রথম যে জিনিসটি চায়, তা হলো নিরাপত্তা। প্রাচীন বিশ্বের রাজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল জনগণের আকাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা দিতে শক্তিশালী দুর্গব্যবস্থা সৃষ্টি। একেবারে শুরুর দিন থেকে জায়ন মানে ছিল শান্তির এক সুরক্ষিত স্থান। আর আবদি-হেপার আমল থেকে এটি ভেতর ও বাইরের শত্রুদের হুমকির মুখেও ছিল। বর্তমানে জেরুসালেম আবারো দুর্গ দিয়ে ঘেরাও নগরীতে পরিণত হয়েছে। পূর্ব দিকে এর সীমান্ত বিশাল বিশাল নতুন বসতি দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। এটি পুরনো ক্রুসেডার দুর্গায়নের মতো করে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে আছে। তবে প্রাচীরগুলো কোনোই কাজে আসবে না, যদি ভেতরেই ভয়াবহ গোলযোগ শুরু হয়ে যায়। হতাশাবাদী পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, কিছুটা সাম্যপূর্ণ সমাধান পাওয়া না গেলে জেরুসালেমও হেবরনের মতো সব অধিবাসীকে নিয়ে সহিংস ও বিপজ্জনক স্থানে পরিণত হবে। 

একেবারে শুরু থেকে জায়নের ঐশী সত্তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শ। কোনো প্রাচীন শাসক তার নগরীতে ঐশীব্যবস্থা আরোপ করতে পেরেছেন এবং নগরীটি ঈশ্বরদের শান্তি ও নিরাপত্তা উপভোগ করতে পারছে বলে নিশ্চিত হয়েছেন তখনই যখন তিনি বিশ্বাস করতে পেরেছেন যে আরো কিছুর মতো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার সামর্থ্যও তার রয়েছে। জেবুসিত জেরুসালেমের বাল ধর্মমতে সামাজিক ন্যায়বিচার ছিল আদর্শ। সামবাদী ও নবীরা জোর দিয়ে বলতেন যে জায়ন অবশ্যই হতে হবে গরিবদের আশ্রয়স্থল : বিশেষ করে নবীরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন যে ঐশী স্থানের প্রতি ভক্তি পুরোপুরি মূল্যহীন যদি ইসরাইলিরা তাদের সমাজের দুর্বল লোকদের পরিচর্যাকে অবহেলা করে। পি’র হলিনেস কোডে ‘আগন্তুকদের জন্য উদ্বেগ ও ভালোবাসার কথা রয়েছে। ইসরাইলিদেরকে এসব লোককে অবশ্যই স্বাগত জানাতে হবে বলে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। সামাজিক ন্যায়বিচার পবিত্র কোরআনি বার্তার মূলেও রয়েছে। আর আইয়ুবি ও মামলুক আমলে বাস্তব সহানুভূতি ছিল জেরুসালেমের ইসলামিকরণের অনিবার্য আনুষাঙ্গিক বিষয়। বর্ষীয়ান উদ্যোক্তাদের সামাজিক জায়নবাদের মূলেও ছিল এটি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজকে জায়নে এমনকি মেয়র টেডি কোলেকের সময়ও ফিলিস্তিনিদের স্বাগত জানানো হয় না। ইসরাইলিরা প্রায়ই জবাবে বলে যে আরব রাষ্ট্রগুলোতে ফিলিস্তিনিরা যে ধরনের আচরণ পেয়ে থাকে, তারা জেরুসালেমের ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার চেয়ে ভালো আচরণ করা হয়ে থাকে। কথাটি হয়তো সত্য, কিন্তু ফিলিস্তিনিরাতো নিজেদেরকে অন্য আরবদের সাথে নয় বরং তাদের ইহুদি নাগরিকদের সাথে তুলনীয় করতে চায়। ন্যায়বিচার ছাড়াই কোনো নগরী ‘পবিত্র’ বলে জোরালো দাবি করার অর্থ হলো জেরুসালেমের পবিত্রতার হস্তান্তর- অযোগ্য অংশকে বিপজ্জনক ধারায় চালিত করা। 

আগেকার কয়েকটি আমলের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারি এটি কত বিপজ্জনক। ওই সব সময়ে নগরীর অগ্রগতির ওপর জোর দেওয়া হলেও সহানুভূতির কর্তব্যকে অবহেলা করা হয়েছিল। হাসমোনিয়ান জেরুসালেমে বদান্যতা ছিল সামান্যই : ইহুদি জেরুসালেমের অখণ্ডতা রক্ষার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রামের পর হাসমোনিয়ানরা রাজ্যের প্রভু বনে যায়। কিন্তু দেখা যায়, যে স্বৈরতন্ত্রকে পরাজিত করে তারা ক্ষমতায় এসেছিল, তাদের নৃশংসতা থেকে তারা আসলে খুব বেশি ভিন্ন ছিল না। তাদের আচরণের কারণে তারা ফারাসিদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। ফারাসিরা বদান্যতা ও ভালোবাসা-জাগানিয়ার দয়ার ওপরই জোর দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ফারাসিরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইহুদি রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার জন্য রোমানদের অনুরোধ করে : এসব খারাপ ইহুদি শাসনের চেয়ে বিদেশী শাসন অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। 

অন্যদের অধিকারের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও নিরঙ্কুশ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনকে হিসাবের বাইরে রাখার ফলে যে বিপদ আসতে পারে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো খ্রিস্টান জেরুসালেম। নিউ টেস্টামেন্টে স্পষ্ট যে বদান্যতা ছাড়া বিশ্বাসের কোনো মূল্যই নেই। অবশ্য এই আদর্শ কখনো জেরুসালেমের খ্রিস্টান ধর্মমতে একীভূত করা হয়নি। এর কারণ হয়তো এই যে নগরীটির প্রতি তাদের ভক্তি এসেছে অনেক পরে এবং তা খ্রিস্টানদের কাছে প্রায় বিস্ময় ঠেকেছে। বায়জান্টাইন জেরুসালেম খ্রিস্টানদেরকে ঐশী সত্তার প্রবল সান্নিধ্য দিতে সক্ষম ছিল, তবে এটি ছিল সবচেয়ে বদান্যতাহীন নগরী। খ্রিস্টানেরা কেবল একে অপরের বিরুদ্ধে তীব্র দ্বন্দ্বেই অবতীর্ণই হয়নি, সেইসাথে তাদের নতুন জেরুসালেমের পবিত্রতা ও অখণ্ডতার জন্য অপরিহার্য বিষয় হিসেবে পৌত্তলিকতা ও ইহুদিধর্মকে গুঁড়িয়ে দেওয়া ও বহিষ্কার করাও অনিবার্য ভেবেছে। খ্রিস্টানদের জয়ের অর্থ ছিল ইহুদির ভাগ্যের পতন; পবিত্র নগরীর কাছাকাছি জুদার মরুভূমিতে বসবাসকারী কৃচ্ছ্র সন্ন্যাসীদের বেশির ভাগই ছিল ভয়ঙ্কর রকমের সেমিটিকবিরোধী। শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টান সম্রাটদের অসহিষ্ণু নীতি ইহুদি ও ‘ধর্মত্যাগীদেরকে’ এতটাই দূরে সরিয়ে দিয়েছিল যে তারা পুরোপুরি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনে পারসিক ও মুসলিম হামলকারীদের উৎসাহভরে স্বাগত জানিয়েছিল ইহুদিরা, তাদেরকে কার্যকর সহায়তাও করেছিল। 

ক্রুসেডার জেরুসালেম নিশ্চিতভাবেই ছিল আরো বেশি নির্মম নগরী। এটি গণহত্যা ও উচ্ছেদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমান ইসরাইলের মতো ক্রুসেডারেরাও এমন একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল যা ছিল নিকট প্রাচ্যে বিদেশী ছিটমহল। বৈরী রাষ্ট্রগুলোতে পরিবেষ্টিত অবস্থায় তারা বিদেশী সহায়তায় ওপর নির্ভরশীল ছিল। ক্রুসেডার রাজ্যের পুরো ইতিহাস ছিল টিকে থাকার সংগ্রাম। আমরা দেখেছি যে ক্রুসেডাররা যৌক্তিক কারণেই নিরাপত্তা নিয়ে ইসরাইলের মতোই এক ধরনের আবেগ অনুভব করত। ফলে ক্রুসেডার জেরুসালেমে সত্যিকারের সৃষ্টিশীলতা ছিল সামান্যই। কারণ, শিল্পকলা ও সাহিত্য এ ধরনের যুদ্ধবিক্ষত পরিবেশে সত্যিকার অর্থে বিকশিত হতে পারে না। বর্তমানের অনেক ইসরাইলির মতো জেরুসালেমের ফ্রাঙ্করাও বুঝতে পেরেছিল যে নিকট প্রাচ্যে পাশ্চাত্য ঘৌটো হিসেবে তাদের রাজ্য টিকে থাকতে পারে না। তাদেরকে অবশ্যই আশপাশের মুসলিমবিশ্বের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু ক্রুসেডারদের ঘৃণার ধর্ম খুবই বদ্ধমূল ছিল। একবার তারা ইসলামিবিশ্বে তাদের একমাত্র মিত্রের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল, একে অন্যের প্রতিও ভয়ঙ্করভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঘৃণার ধর্ম কাজ করেনি, এটি সহজেই আত্ম-বিধ্বংসী হয়ে পড়েছিল। ক্রুসেডাররা তাদের রাষ্ট্র হারিয়েছিল। বদান্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যটি অবহেলাজনিত ধর্মানুরাগের প্রচণ্ড অভাবের কারণে একটি পবিত্র স্থান হারানোর ঘটনা এখন সবচেযে বেশি দেখা যায় হলি সেপালচারের খ্রিস্টান উপদলগুলোর তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয়ে অন্তহীন বিবাদে। 

একেশ্বরবাদী পরিভাষায় কোনো উপাসনালয় বা কোনো নগরীকে ধর্মটির চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করাটা পৌত্তলিকতা। আমরা আদ্যেপান্ত দেখেছি যে এগুলো এমন প্রতীক যা একটি বৃহত্তর বাস্তবতার দিকে নিয়ে যায়। জেরুসালেম ও এর ঐশী স্থানগুলো ভয় ও ভক্তির উদ্রেকের অভিজ্ঞতা দেয়। এগুলো কোটি কোটি ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমকে ঐশী সত্তার সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়। একইসাথে আমরা দেখেছি, অনেক একেশ্বরবাদীর কাছে এগুলোকে ঈশ্বরের ধারণার সাথে অবিভাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

আর ঐশী সত্তা স্রেফ অতিপ্রাকৃতিক বাস্তবতার ‘চরম অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং অহংয়ের গভীরতার মধ্যেই তা অনুভূত হওয়ায় কারণে আমরা লোকজনের অন্তরাত্মার জগতের অংশ হিসেবেও বিবেচনা করতে দেখি পবিত্র স্থানগুলোকে। অনেক সময় কোনো উপাসনালয় নিয়ে বিরোধের সময় ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমেরা আকস্মিক চমক অনুভব করে, নিজেদেরই মুখোমুখি হয়ে পড়ে। এটি জেরুসালেম ও এর সমস্যাবলীকে বস্তুনিষ্ঠভাবে বিবেচনা করা তাদের জন্য কঠিন করে তোলে। ধর্মকে যখন পরিচিতি অনুসন্ধানের প্রধান বিষয় হিসেবে দেখা হয়, তখন অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়। বিশ্বাসের একটি কাজ হলো অহংয়ের অনুভূতি জোরদার করা : আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং আমাদের ঐতিহ্য কেন স্বতন্ত্র্য ও বিশেষ তা ব্যাখ্যা করা। কিন্তু এটিই ধর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। সব প্রধান বিশ্বধর্মই জোর দিয়ে নিজের নিরাপত্তার আকাঙ্ক্ষায় অন্যদের প্রায়ই কলঙ্কিত করে এমন ঠুনকো ও সর্বগ্রাসী অহংকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়। অহংকে পেছনে রাখা কেবল আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যই নয়, এটি সহানুভূতির শৃঙ্খলার জন্যও প্রয়োজনীয়। এটি আমাদের স্বার্থেন্বেষী আকাঙ্ক্ষাগুলোর সামনে অন্যদের অধিকারকে রাখার দাবি জানায়। 

জেরুসালেম ইতিহাসের এড়ানো অযোগ্য একটি বার্তা হলো এই যে রোমান্টিক মিথগুলো যাই বলুক না কেন, সত্ত্বেও দুর্ভোগ আমাদেরকে কোনোভাবেই আরো উন্নত, আরো মহৎ লোকে পরিণত করে না। বরং প্রায়ই যা করে, তা মিথ-কথনের বিপরীত। বেবিলনে নির্বাসনের পর জেরুসালেম প্রথমে একটি বর্জনশীল নগরীতে পরিণত হয়। ওই সময় নতুন ইহুদি ধর্ম প্রাধান্যপূর্ণ পৌত্তলিক বিশ্বের স্বতন্ত্র পরিচিতি প্রতিষ্ঠায় ইহুদিদের সহায়তা করেছিল। দ্বিতীয় ইসাইয়া ঘোষণা করেছিলেন যে জায়নে প্রত্যাবর্তন শান্তির নতুন যুগের সূচনা ঘটাবে। কিন্তু আম হা- আরেতজকে বহিষ্কার করা হলে গোলাহ (ইহুদিদের পরবাসে থাকা) জেরুসালেমকে স্রেফ বিরোধের বিষয়ে পরিণত করে। রোমের হাতে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা খ্রিস্টানদেরকে অন্যদের দুর্ভোগের প্রতি আরো বেশি সহানুভূতিসম্পন্ন করেনি, ক্রুসেডারদের হাতে মুসলিমদের দুর্ভোগ পোহানোর পর আল-কুদস আরো বেশি আগ্রাসী ইসলামি নগরীতে পরিণত হয়েছিল। ফলে হলোকাস্টের বিপর্যয়ের সামান্য পরে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইল রাষ্ট্রের সবসময় মধুরতা ও আলোকময় নীতিমালা বাস্তবায়ন না করাটা বিস্ময়কর নয়। আমরা দেখেছি যে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হওয়ার ভীতিই প্রাচীন কালের লোকজনকে পবিত্র নগরী ও মন্দির নির্মাণ করার অনুপ্রেরণা সৃষ্টিতে উদ্দীপ্ত করেছিল। প্রাচীন ইসরাইলি পুরানতত্ত্বে প্রতিশ্রুত ভূমির স্বর্গে পৌঁছার জন্য ঊষর প্রান্তরের (যেখানে কোনো মানুষই ছিল না, কিছুই ছিল না) ভুতুরে রাজ্যে তাদের সফরের কাহিনী বলা হয়েছে। ইহুদি জনগোষ্ঠী মৃত্যু শিবিরগুলোতে নজিরবিহীন মাত্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে পড়েছিল। ছয় দিনের যুদ্ধের সময় জায়নে তাদের প্রত্যাবর্তন তাদের মূলকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এর ফলে তাদের অনেকে বিশ্বাস করেছিল যে এটি একটি নতুন সৃষ্টি, নতুন সূচনা। এই বিশ্বাস বিস্ময়কর কিছু নয়। 

কিন্তু আজ ক্রমবর্ধমান হারে ইসরাইল পবিত্র নগরী ভাগাভাগি করে নেওয়ার বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছে। অবশ্য দুঃখজনকভাবে শান্তির জন্য যেসব লোক কাজ করছে, তাদের বেশির ভাগই সেক্যুলার। সঙ্ঘাতের উভয় পক্ষেই ধর্ম ক্রমবর্ধমান হারে বৈরী ও আগ্রাসী হয়ে ওঠছে। চরমপন্থীদের (তারা আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়, অপর গোষ্ঠীর উপাসনালগুলো উড়িয়ে দেয়, তাদেরকে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করার কথা বলে থাকে) প্রলয়বাদী আধ্যাত্মিকতা অনুসরণ করছে খুবই ছোট্ট গ্রুপের লোকজন। তারা সংখ্যায় কম হলেও তারা অনেক বড় মাত্রায় ঘৃণা ছড়াচ্ছে। নৃশংসতার পর উভয় পক্ষের মনোভাব আরো কঠোর হয়ে পড়েছে, শান্তি আরো সুদূর পরাহত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ৬৬ সালে জিলটরাই (গোঁড়া) পিস পার্টির (শান্তিবাদী পক্ষ) বিরোধিতা করেছিল। প্রধানত তারাই জেরুসালেম ও এর টেম্পল ধ্বংসের জন্য দায়ী। আর চ্যালিটনের রেনাল্ড মনে করেছিলেন যে পৌত্তলিকদের সাথে কোনো ধরনের শান্তিচুক্তি পাপকাজ। তিনিই ক্রুসেডার রাজ্যের পতন ডেকে আনেন। ঘৃণার ধর্মটির এমন প্রতিক্রিয়া থাকে যা এর সাথে জড়িত লোকজনের সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। বর্তমানে সঙ্ঘাতের উভয় পক্ষের ধর্মীয় চরমপন্থীরাই ‘ঈশ্বরের’ নামে নৃশংসতা চালানোর জন্য দায়ী। ১৯৯৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হেবরনের প্যাট্রিয়ার্কস কেভে অন্তত ৪৮ ফিলিস্তিনি মুসল্লিকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন বারুচ গোল্ডস্টেইন। অথচ এখন উগ্র ডানপন্থীরা তাকে ইসরাইলের শহিদ হিসেবে সম্মান করে। আরেকজন হলেন শহিদ হওয়া ইসলামি গ্রুপ হামাসের তরুণ সদস্য। ১৯৯৫ সালের ২৫ আগস্ট জেরুসালেমের একটি বাসে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে তিনি পাঁচজনকে হত্যা ও ১০৭ জনকে আহত করেছিলেন। এসব কাজ ধর্মের বিকৃত রূপের প্রতিনিধিত্ব করলেও জেরুসালেমের ইতিহাসে অনেকবারই ঘটেছে। কোনো ভূমি বা নগরীর দখলে আসামাত্র খুন থেকে বিরত থাকার কোনো কারণ থাকে না। সাথে সাথেই অন্য মানুষদের শ্রদ্ধা করার ঐশী বার্তা বিস্মৃত হয়ে যায়, ‘ঈশ্বর’ আমাদের নিজস্ব বদ্ধমূল ধারণা ও আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করার চূড়ান্ত ঐশী অনুমোদন দিয়ে দেন। ধর্ম তখন সহিংসতা ও নৃশংসতার প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। 

প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ১৯৯৫ সালের ৪ নভেম্বর তেল আবিবে এক শান্তি সমাবেশে বক্তৃতার পর নিহত হন। ইসরাইলিরা আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এই খবর শুনে যে হত্যাকারী ছিল আরেকজন ইহুদি। প্রাণঘাতী গুলিটি ছুড়েছিল তরুণ ছাত্র আইগ্যাল আমির। হত্যাকারী ঘোষণা করেন যে ঈশ্বরের নির্দেশনায় তিনি কাজটি করেছেন। আর ইসরাইলের পবিত্র ভূমি শত্রুর হাতে তুলে দেয়ার জন্য যে ব্যক্তি প্রস্তুতি নেয়, তাকে হত্যা করা অনুমোদনযোগ্য। ঘৃণার ধর্মের তার নিজস্ব গতিশীলতা আছে বলে মনে হচ্ছে। ভয়ঙ্কর একগুঁয়ে নীতি এমন এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে এটি কেবল শত্রুর বিরুদ্ধই পরিচালিত হচ্ছে না, একই ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ক্রুসেডার জেরুসালেম নিজেরাই তিক্তভাবে বিভক্ত ছিল। সালাহউদ্দিন যখন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন ফ্রাঙ্করা আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধে নিয়োজিত ছিল। তাদের একে অপরের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও তাদের কঠিন অন্তঃকলহ ছিল হাত্তিনের যুদ্ধে সালাহউদ্দিনের হাতে পরাজয়ের একটি কারণ। 

রবিনের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ছিল অনেক ইসরাইলির কাছে তাদের নিজস্ব সমাজের গভীর বিভাজনের কষ্টকর বহিঃপ্রকাশ। ওই সময় পর্যন্ত এই বিভক্তির বিষয়টি তারা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। জায়নবাদীদের এমন এক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠা করতে ফিলিস্তিনে আসতে হয়েছিল, যেখানে প্রাণঘাতী গোয়িম থেকে তারা নিরাপদ থাকবে। এখন ওই ভূমির জন্যই একে অপরকে হত্যা করতে শুরু করল। বিশ্বজুড়ে ইহুদিরা এই বেদনাদায়ক উপলব্ধির সাথে লড়াই করে যে তারা কেবল শিকারই নয়, বরং তারাও ক্ষতি করতে পারে ও স্থায়ী নৃশংসতা চালাতে পারে। রবিনের মৃত্যু ধর্মের অপব্যবহারের বিষয়টিও তীব্রভাবে সামনে নিয়ে আসে। ইব্রাহিমের সময় থেকে ইসরাইলের ধর্মের সবচেয়ে মানবিক ঐতিহ্য এই ধারণা দেয় যে অন্য মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ ঐশী সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারে। ফলে পবিত্রতা হলো মানবিকতা যা কখনো অন্য মানুষের জীবনকে উৎসর্গ করার অধিকার দেয় না। আইগাল আমির অবশ্য যশুয়া গ্রন্থের আরো সহিংস নৈতিকতা অনুসরণ করেন। তিনি পবিত্র ভূমিতে কেবল ঐশী সত্তাকেই দেখেছেন। এ ধরনের পৌত্তলিকতার বিপদকে ভীতিকরভাবে প্রদর্শন করাই ছিল তার অপরাধ। 

কাব্বালবাদী মিথ শিক্ষা দেয় যে ইহুদিদের জায়নে ফেরার সময় বিশ্বের সবকিছুই যথাযথ স্থান ফিরে পেয়েছিল। রবিনের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে যে ইসরাইলে ইহুদিদের প্রত্যাবর্তনের মানে বিশ্বের সবকিছু ঠিক স্থানে থাকা নয়। অবশ্য এই পুরানতত্ত্ব কখনো আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করার কথা বলে না। ১৯৪৮ সাল থেকে জায়নে ইহুদি জনগোষ্ঠীর ধীরে ধীরে প্রত্যাবর্তনের ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনির তাদের আবাসভূমি ও সেইসাথে জেরুসালেম থেকে বাস্তুচ্যুতি ঘটে। আমরা জেরুসালেমের ইতিহাস থেকে জানি যে প্রবাস জীবন ছিল বিশ্বের সমাপ্তি, অঙ্গহানি ও আধ্যাত্মিক বিচ্যুতির অভিজ্ঞতা। একটি নির্দিষ্ট অবস্থান ও দেশমুখিতা ছাড়া সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ে। অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হলে মরুভূমি হয়ে পড়ে বর্তমান, ভবিষ্যত হয় কল্পনা-অযোগ্য। নিশ্চিতভাবেই ইহুদিরা প্রবাস জীবনকে দানবীয় ও ধ্বংসকরী হিসেবে দেখেছিল। উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন, মর্মান্তিকভাবে দুর্ভোগের এই বোঝা এখন ইসরাইল রাষ্ট্র চাপিয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের ওপর। বিস্ময়কর নয় যে ফিলিস্তিনিরা সবসময় টিকে থাকার জন্য তাদের নিজস্ব সংগ্রামে সবসময় দৃষ্টান্তমূলক আচরণ করেনি। তবে আবারো বলতে হয় যে এমন ফিলিস্তিনিও আছে যারা স্বীকার করে যে তাদের আবাসভূমির অন্তত কিছু অংশ ফেরত পেতে হলে আপস করাও প্রয়োজনীয় হতে পারে। অসলো চুক্তি নিয়ে তারা তাদের নিজস্ব কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছে : একসময় যে ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদান করা ছিল অসম্ভব স্বপ্ন, তারা সেটাকেও আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিয়েছে। প্রবাসে জায়ন পরিণত হয়েছিল ইহুদিদের জন্য পরিত্রাণ ও সমন্বয় সাধনের প্রতিকৃতিতে। বিস্ময়কর নয় যে আল-কুদসও ফিলিস্তিনিদের প্রবাসে তাদের জন্য আরো বেশি মূল্যবান বস্তুতে পরিণত হয়েছে। দুই জাতিই বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে এখন একই পবিত্র নগরীতে আবার সুস্থ হয়ে ওঠতে চায়। 

পরিত্রাণের- সেক্যুলার বা ধর্মীয়- অর্থ অবশ্যই হতে হবে নগরীর স্রেফ মালিকানা না হয়ে আরো বড় কিছু। ভেতরের প্রবৃদ্ধি ও মুক্তির ব্যবস্থা থাকতেই হবে। জেরুসালেমের ইতিহাস একটি জিনিস শেখায় আমাদের তা হলো, কোনো কিছুই পরিবর্তন-অযোগ্য নয়। এর অধিবাসীরা কেবল তাদের নগরীকে বারবার ধ্বংসই হতে দেখেনি, তারা দৃশ্যত অপছন্দনীয় নানা পন্থাতে এটি নির্মিত হতেও দেখেছে। ইহুদিরা যখন তাদের পবিত্র নগরীর পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার কথা শুনেছে, প্রথমে হ্যাড্রিয়ানের ঠিকাদারদের হাতে এবং তার পর কনস্টানটাইনের হাতে, তাদের তখন নিশ্চিতভাবে মনে হয়েছিল, তারা আর কখনো তাদের নগরীতে ফিরতে পারবে না। মুসলিমরাও ক্রুসেডারদের হাতে তাদের প্রিয় হারামকে অপবিত্র হতে দেখেছে। ওই সময় ক্রুসেডারদেরকে অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছিল। এসব ভবনের সবই তথ্য তুলে ধরার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। তবে চূড়ান্তভাবে ইট আর সুড়কিই শেষ নয়। মুসলিমদের নগরীটি ফিরে পাওয়ার কারণ হলো ক্রুসেডাররা ঘৃণা আর অসহিষ্ণুতার স্বপ্নে আটকা পড়ে গিয়েছিল। আমাদের নিজেদের আমলেই সকল প্রতিকূলতার বিপরীতে ইহুদিরা জায়নে ফিরে এসে জেরুসালেমকে ঘিরে তাদের নিজস্ব বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে। তবে জেরুসালেমের দীর্ঘ, মর্মান্তিক ইতিহাস যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, নিশ্চিত নয়। 

বর্তমানের যুধ্যমান ধর্মের একটি উদাহরণ হলো হামাস সদস্যরা। এই উগ্র ইসলামি গ্রুপের সদস্যরা তীব্রভাবে ওসলো চুক্তির বিরোধিতা করেছে, লাঠি ও শেকল ঘুরিয়ে গাজার রাস্তায় মিছিল করেছে। 

এক ফিলিস্তিনি অত্যাধুনিক একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের নিচে নামাজ পড়ছেন। উত্তর জেরুসালেমের এই ব্লকে বাস করে উগ্র অর্থোডক্স ইহুদিরা। অব্যাহত নির্মাণ কি বর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকবে নাকি জেরুসালেম সত্যিই জায়ন বা এমন শান্তির নগরীতে পরিণত হবে যেখানে ইহুদি ও মুসলিমরা একসাথে ঐশী সত্তার মুখোমুখি হতে পারবে? 

এ বইটির প্রথম সংস্করণ ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে ছাপাখানায় যাওয়ার পর থেকে জেরুসালেম বিষয়াদির অস্থায়িত্ব ও দ্রুত পরিবর্তনশীলতা প্রতি বছরই নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। তখনো শান্তির আশা বেশ উচ্চ মাত্রায় ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ওইসব আশা ভেঙে খান খান হয়ে যায় হেবরন গণহত্যার দ্বিতীয় বার্ষিকীতে। জেরুসালেম, অ্যাশকেলন ও তেল আবিবে একের পর এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৫৭ ইসরাইলি নিহত হয়। লেবাননের ইসরাইলি নিরাপত্তা জোনে ইসলামি গ্রুপ হিজবুল্লাহর হাতে ছয় ইসরাইলি সৈন্য নিহত হওয়ার পর ১১ এপ্রিল ইসরাইল বড় ধরনের পাল্টা আক্রমণ চালায়। ‘অপারেশন গ্রাপস অব রেখ নামের এই অভিযানে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করা হয়, ১৫ শ’ বার বিমান হামলা চালানো হয়। এর ফলে ১৬০ জন লেবাননি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। 

এই গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলে নতুন দফার বৈরিতা আবারো শান্তির ভঙ্গুরতা প্রদর্শন করে। সহিংসতা আরো বেশি সহিংসতার সৃষ্টি করে। অতীতের মতো এবারো ধর্মীয় চরমপন্থীরা শান্তির সব আশা ধ্বংস করে দেয়। ইসলামি জঙ্গিবাদে অবরুদ্ধ অনুভব করে অনেক ইসরাইলি শান্তি-প্রক্রিয়ার ওপর থেকে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। ১৯৯৬ সালের ২৯ মে সাধারণ নির্বাচনে লিকুদ দলের যুধ্যমান নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সামান্য ব্যবধানে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হন। নেতানিয়াহু যৌক্তিকতার আলোকে অসলো চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি অনেক দিন ধরেই শান্তির বিনিময়ে আরবদের সাথে ভূমি বিনিময় করার লেবার পার্টির ইচ্ছার তীব্র সমালোচনা করে আসছিলেন। নতুন শাসনের অধীনে পশ্চিম তীর থেকে ইসরাইলি প্রত্যাহার বন্ধ হয়ে যায়, গাজা ও পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সেখানে নতুন আটটি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। এর ফলে ২০০০ সাল নাগাদ এসব ভূখণ্ডে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা এক লাখ ৩০ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ লাখ। নেতানিয়াহু স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে জেরুসালেমের ব্যাপারে কোনো আপস করা হবে না। পবিত্র নগরী চির দিনের জন্য ইসরাইলি রাজধানী থাকবে, এর সার্বভৌমত্ব ভাগাভাগি করা হবে না, ইসরাইল জেরুসালেমের কোনো এলাকার কোনো অংশ বা রাস্তা ত্যাগ করবে না। 

নেতানিয়াহু খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের একটি সুড়ঙ্গ চালু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে ২৩ সেপ্টেম্বর জেরুসালেমের পবিত্র স্থানটি নতুন ধরনের মর্মান্তিক সহিংসতায় উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। সুড়ঙ্গটি ওয়েস্টার্ন ওয়াল ও হারাম আল-শরিফ ঘেষে ভায়া দোলোরোসা পর্যন্ত গেছে। এটি পুরনো নগরীর মুসলিম কোয়ার্টারের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। শান্তি-প্রক্রিয়ায় স্থবিরতা ও আত্মঘাতী বোমা হামলার পর অধিকৃত ভূখণ্ডে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে কঠিন অবস্থায় থাকা ফিলিস্তিনিদের কাছে এটি ছিল খুব বেশি মাত্রায় লঙ্ঘন। সাথে সাথেই গাজা ও পশ্চিম তীরে ১৯৬৭ সালে এসব ভূখণ্ড জয় করার পর থেকে যে ভয়াবহ ধরনের সহিংসতা চলছিল, তা হঠাৎ করে ছড়িয়ে পড়ে। ২৭ সেপ্টেম্বর আল-আকসা মসজিদে জুমার নামাজের সময় হারামে ইসরাইলি পুলিশের সাথে সংঘর্ষে তিন ফিলিস্তিনি নিহত ও ১২০ জন আহত হয়, ওয়েস্টার্ন ওয়ালে ফিলিস্তিনিদের প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে ইহুদি উপাসনাকারীরা। সবশেষে সহিংসতা প্রশমিত হয়। তবে ততক্ষণে ৭৫ জন নিহত ও ১৫ শ’ লোক আহত হয়ে গেছে। 

অনেক হতভম্ব পর্যবেক্ষকের কাছে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান চালুর ফলে এ ধরনের রক্তপাতের ঘটনা তাদের কাছে আশ্চর্য মনে হয়েছে। তবে যারা জেরুসালেমের মর্মান্তিক ইতিহাস অবগত রয়েছেন, তাদের কাছে এটি ছিল দুঃখজনকভাবে পরিচিত ঘটনা। জেরুসালেমে প্রত্নতত্ত্ব কখনোই পুরোপুরি স্বাভাবিক কার্যক্রম হিসেবে বিরাজ করেনি। ৩২৫ সালে কনস্টানটাইনের বিশপ মাকারিয়সকে খ্রিস্টের সমাধি (আফ্রোদিতির পৌত্তলিক মন্দির ধ্বংস করে) খনন করার অনুমতি দেওয়ার পর থেকে প্রত্নতত্ত্ব প্রায়ই নগরীর পবিত্র ভূখণ্ডে দাবি উত্থাপনে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি মালিকানা দাবি ও মালিকানা খারিজ করার সাথে সম্পৃক্ত একটি বিভাগ। আলোচিত সুড়ঙ্গটি খনন করেছিল ১৯৬৮ সালে ইসরাইলের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেটি ছিল সদ্য জয় করা নগরীতে তাদের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের অংশবিশেষ। ভায়া ডোলোরোসায় সুড়ঙ্গটির আরেকটি দরজা খোলা নিয়ে আগের আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে প্রকল্পটি খুবই স্পর্শকাতর। ফলে এটি বাস্তবায়ন করার মানে হবে খুবই বাধা সৃষ্টিকারী। অবশ্য নেতানিয়াহু তার নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের হুঁশিয়ারি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তার সরকারের জেরুসালেম প্রশ্নে কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিষয়টি প্রকাশ করার জন্য। 

এটিও সত্য যে সুড়ঙ্গতে কিছু করার মানে খোদ হারামে অনুপ্রবেশ নয়। তবে রাজনৈতিক উত্তেজনার সময়, বিশেষ করে তারা তাদের পবিত্র স্থানগুলোর প্রতি হুমকি অনুভব করলে জেরুসালেমের লোকজন সবসময় যৌক্তিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। খ্রিস্টপূর্ব ১৭০ সালে অ্যান্টিচুস ইপিফানিসের তাদের টেম্পলকে অবমাননা করার পর থেকে ইহুদি লোকজন নিশ্চিতভাবেই এই অবস্থার মধ্যে পড়েছে। পরে বেশির ভাগ ইহুদি রোমের শাসন মেনে নিয়েছিল, তবে টেম্পলের পবিত্রতার প্রতি হুমকি যদি না থাকে তবেই। পন্টিয়াস পিলেত বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন যখন তিনি উস্কানিমূলকভাবে অ্যান্টোনিয়া ফর্টেসে দণ্ড হাতে রোমান সম্রাটের আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। জোসেফাস আমাদের বলেন, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ইহুদিদের তাদের টেম্পলের পবিত্র রক্ষায় দৃশ্যত আত্মঘাতী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব প্রদর্শন করলে কঠোর রোমান গভর্নর দুঃখ ও কষ্ট পেয়েছিলেন। 

এই গ্রন্থজুড়ে আমরা দেখেছি যে জেরুসালেম ও এর উপাসনালয়গুলো কেবল ঐশী সত্তার শক্তিশালী প্রতীকই নয়, সেইসাথে এগুলো উপাসনাকারীদেরকে তাদের গভীর সত্তার মুখোমুখি হওয়ার ব্যবস্থাও করে দেয়। অ্যান্টিচুস ইপিফানেস যখন দেভিরের ভেতরের পবিত্র স্থানে (ইহুদি বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র ও সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থান) ঢুকে পড়েছিলেন, তখন তা ভয়াবহ ধরনের ঘটনা তথা ইহুদি জাতিকে ধর্ষণ করার সামিল বলে মনে হয়েছিল। ১৯৬৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনিরা ক্রমবর্ধমান হারে ইহুদি চরমপন্থীদের ঘন ঘন হুমকিকে অবরুদ্ধ জাতীয় পরিচিতির প্রতীক হিসেবে দেখছে। সুড়ঙ্গটি উদ্বোধনের মাত্র দুই মাস আগে ইসরাইলি হাইকোর্ট ২৬ জুলাই আকসা মসজিদের পশ্চিম প্লাজায় প্রার্থনা আয়োজন করতে টেম্পল মাউন্ট ফেইথফুলের প্রায় এক শ সদস্যকে অনুমতি দেয়। ফেইথফুলের নেতা গারশোম সলোমন দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন যে ‘‘অ-ইহুদি’ উপস্থিতি অপসারণ ও ইহুদি টেম্পলের আবারো মাথা উঁচু না করা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’৩৪ শত শত ফিলিস্তিনিও ওই প্রার্থনার দিনে আকসার দিকে মিছিল করে যায়। ইসরাইলি পুলিশের কারণেই কেবল ওই দিন সঙ্ঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া গিয়েছিল। তারা হারাম থেকে ইহুদি বিক্ষোভকারীদের সরে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। হারাম আল-শরিফকেন্দ্রিক এই তীব্রতর উত্তেজনাকর পরিবেশে ফিলিস্তিনিরা এই পবিত্র স্থানে আরেকটি হামলা হিসেবে ধরে নিয়ে সহজাত ক্ষোভ ও কষ্ট নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে, ঠিক যেভাবে দুই শ’ বছর আগে ইহুদিরাও তাদের ঐশী স্থানের (তাদের এবং সেইসাথে ইহুদি আত্মার) ওপর বিদেশী শাসকদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত আশঙ্কায় প্রদর্শন করেছিল। 

মধ্যপ্রাচ্য শান্তি-প্রক্রিয়ার ভবিষ্যত বা পবিত্র নগরীর ভবিষ্যত- কোনোটির ব্যাপারেই আশাবাদী হওয়া কঠিন। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যভাগে আমি এটি যখন লিখছি, তখন পশ্চিম তীরের বেথ-ইল বসতিতে দুই ইহুদি অধিবাসীকে হত্যা করে ফিলিস্তিনি চরমপন্থীরা। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জবাবে অধিকৃত ভূখণ্ডে বসতি স্থাপন বাড়ানোর হুমকি দিয়েছেন, সেখানে বাড়ি তৈরি ও বসবাস করতে আগ্রহীদের আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। বসতি স্থাপনকারীদের খুনের ঘটনায় প্রচণ্ড নিন্দা জ্ঞাপন করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাকে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর হামলার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা ও অসলো চুক্তির সুস্পষ্ট বরখেলাপ বলে অভিহিত করে। হামাস পুরো ফিলিস্তিন মুক্ত করার লক্ষ্যে আরো হত্যাকাণ্ড চালানোর হুমকি দিয়ে নতুন ইসরাইলি পদক্ষেপের জবাব দেয়। উভয় পক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা শাস্তি না জয় চায়। অসলোতে মনে হচ্ছিল যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলিরা গ্রহণ করে নিয়েছিল যে স্থায়ী শান্তি অর্জন করতে হলে উভয় পক্ষকে আপস করতেই হবে। বর্তমানে মনে হচ্ছে, উভয় পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ লোক একতরফা বিজয়ের জন্য সহিংস পন্থার দিকে ঝুঁকেছে। 

দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের জন্য মহাপ্রয়লিক আশাবাদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছে জেরুসালেম। নবী ও স্বপ্নাবিভাবকারীরা হিন্নম উপত্যকায় এমন সহিংস যুদ্ধের কল্পনা করেছিলেন, যেখানে ঈশ্বরের লোকজন জয়ী হবে, তার শত্রুরা হয় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে কিংবা দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে। এসব মহাপ্রলয়িক কল্পনাবিলাসে জেরুসালেমকে সামগ্রিক বিজয় এনে দেওয়া পবিত্র যুদ্ধের নগরী, সঙ্ঘাতের স্থান হিসেবে দেখা হয়েছে। অথচ গোলযোগপূর্ণ বিশ শতকের ধারায় আমাদের কাছে এটিকে অবাস্তব বলে মনে হয়। তবে নবী ইসাইয়ার সহস্রাব্দ জেরুসালেম নিয়ে ভিন্ন স্বপ্নাবিভাব ছিল। তিনি এমন এক সময়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন যখন নেকড়ে ও ছাগলছানা, সিংহ ও মেষশাবক- আগে যারা একে অপরের প্রতি ভয়াবহ রকমের সহিংসছিল- ঈশ্বরের পবিত্র পর্বতে শান্তিতে একসাথে বাস করবে। কয়েক দশকের রক্তাক্ত বিরোধের পর ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিরা যদি তাদের পবিত্র নগরীতে এ ধরনের সহাবস্থান অর্জন করতে পারে, তবে জায়ন সত্যিই সমগ্র বিশ্বের জন্য আশার বাতিঘর, তথা জাতিগুলোর দৃষ্টিশক্তিতে পরিণত হবে। এ বইটি লেখার সময় শান্তির সম্ভাবনা বিবর্ণ মনে হয়েছে। তবে জেরুসালেমের ইতিহাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে বিস্ময়কর বিপরীত ঘটনা সবসময়ই সম্ভব এবং এমনকি সর্বোচ্চ মাত্রার ঘৃণাসহ কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। অনেক ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি, অনেক আরব ও ইহুদি হয়তো এখনো শান্তির আকাঙ্ক্ষা করে, শান্তি অর্জনের জন্য কোরবানি দিতে প্রস্তুত। এ কথা এখনো সত্য যে জেরুসালেমের দীর্ঘ ইতিহাসের দিকে পেছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাবো যে ওই সমাজগুলোই পবিত্র নগরীতে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে ছিল, যারা সাধারণভাবে কোনো না কোনো ধরনের সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের জন্য প্রস্তুত ছিল। সার্বভৌমত্ব ও পূর্ণ বিজয়ের জন্য নিষ্ফল ও প্রাণঘাতী সংগ্রাম নয়, বরং সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানই হতে হবে বর্তমানে জেরুসালেমের পবিত্রতা উদযাপনের একমাত্র পথ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *