১৩. ক্রুসেড

১৩. ক্রুসেড 

বায়েজান্টাইনরা ১০৭১ সালের মানজিকার্ট যুদ্ধের পর সেলজুকদের কাছে প্রায় পুরো এশিয়া মাইনর খুইয়ে ইসলামকে কার্যত তাদের দরজার সামনে দেখতে পেল। কিন্তু তবুও তুর্কোম্যানদের শক্তি ম্লান হয়ে আসছিল, সম্রাট প্রথম আলেক্সিয়াস কমনেনাসের কাছে মনে হলো যে গুটিকতেক ঝটিকা অভিযানই তাদেরকে একেবারে চিরতরে থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। ১০৯৫ সালে তিনি পোপ দ্বিতীয় আরবানের কাছে সামরিক সহায়তা কামনা করলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে আগে তার হয়ে লড়াই করা কয়েকটি নরম্যান ভাড়াটে সৈনিক দল পাঠানো হতে পারে। অবশ্য পোপের আরো বড় উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ছিল। ওই বছরের শেষ দিকে তিনি ক্লেরমতেঁ ইউরোপের পুরোহিত, নাইট ও গরিব মানুষদের উদ্দেশে বক্তৃতা করে মুক্তির পবিত্র যুদ্ধের কথা আহ্বান জানালেন। তিনি নাইটদেরকে ইউরোপকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেওয়া একে অপরের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যহীন সামন্ততান্ত্রিক যুদ্ধ বন্ধ করে এর বদলে ২০ বছর ধরে মুসলিম তুর্কিদের অধীনে থাকা আনাতোলিয়ায় তাদের খ্রিস্টান ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে যেতে কাতর মিনতি করলেন। তারা তাদের ভাইদের পৌত্তলিকদের জোয়াল থেকে মুক্ত করা মাত্র তারা ইসলামের কবল থেকে খ্রিস্টের কবরকে মুক্ত করতে জেরুসালেম রওনা হয়ে যাবে। ইউরোপে ঈশ্বরের শান্তি ও নিকটপ্রাচ্যে ঈশ্বরের যুদ্ধ জারি হবে। আরবান ওই বক্তৃতায় সত্যিই কী কী বলেছিলেন, তার সমসাময়িক কোনো রেকর্ড আমাদের কাছে নেই। পরে এই অভিযান প্রথম ক্রুসেড হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। তবে নিশ্চিতভাবেই মনে হচ্ছে যে তিনি এই অভিযানকে সশস্ত্র তীর্থযাত্রা বিবেচনা করেছিলেন। একাদশ শতকে পবিত্র নগরীতে বিপুলসংখ্যক তীর্থযাত্রী নিয়ে হওয়া আরো যে তিনটি অভিযান হয়েছিল, এটিও তেমন হবে বলে তার মনে হয়েছিল | এরপর তীর্থযাত্রীদের অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এবার পোপ তাদেরকে তরবারি দিলেন। বক্তৃতা শেষ করলে আরবান উচ্ছ্বসিত জয়ধ্বনি পেলেন। বিপুল জনতা এক কণ্ঠে স্লোগান তুলল, ‘ডেনস হক ভল্ট!’ : ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা এটি।’ 

সাড়া ছিল নজিরবিহীন, ব্যাপক ও তাৎক্ষণিক। লোকরঞ্জক প্রচারকেরা তার বক্তব্য ছড়িয়ে দিলো। ১০৯৬ সালের বসন্তে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে গঠিত পাঁচটি সেনাবাহিনী এবং সেইসাথে অযোদ্ধা কৃষকদের দল ও স্ত্রী ও পরিবারসহ তীর্থযাত্রীরা জেরুসালেমের পথে রওনা হলো। তাদের বেশির ভাগই পূর্ব ইউরোপ দিয়ে বিপজ্জনক পথে চলার সময় মারা যায়। শরৎকাল নাগাদ তাদের সাথে যোগ দেয় প্রায় এক লাখ লোক ও পুরোহিতদের একটি দল নিয়ে গঠিত আরো পাঁচটি সেনাবাহিনী। প্রথম দলটি কনস্টানটিনোপলের দিকে চলার সময় প্রিন্সেস আনা কমনেনার কাছে মনে হয়েছিল ‘পুরো পাশ্চাত্য এবং আড্রিয়াটিক সাগর ছাড়িয়ে হেরাক্লিয়াসের স্তম্ভগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগের বেশির ভাগ এলাকা স্থানচ্যুত হয়ে সবকিছু নিয়ে দুর্দান্ত বেগে শক্ত পিণ্ডের মতো এশিয়ায় নেমে আসছে।’ সম্রাট প্রচলিত সামরিক সহায়তা কামনা করেছিলেন, কিন্তু দেখতে পেলেন যে তার উদ্দীপনার ফলে যা ঘটছে, সেটিকে বলা যেতে পারে বর্বর আক্রমণ। অন্ধকার যুগ থেকে পাশ্চাত্য বেরিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে ক্রুসেড ছিল নতুন পাশ্চাত্যের প্রথম সহযোগিতামূলক উদ্যোগ। এতে পুরোহিত ও বিশপ, অভিজাত ও কৃষক- সব শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব ছিল। তারা সবাই জেরুসালেমের আবেগে আচ্ছন্ন ছিল। ক্রুসেডাররা কেবল মাটি আর সম্পদ চেয়েছিল- বিষয়টি এমন নয়। ক্রুসেড ছিল ভয়ানক, ভীতিকর, বিপজ্জনক ও ব্যয়বহুল। বেশির ভাগ ক্রুসেডার তাদের সবকিছু হারিয়ে বাড়ি ফিরেছিল, স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য তাদের সর্বাত্মক আদর্শবাদের প্রয়োজন হয়েছিল। ক্রুসেড আদর্শ সংজ্ঞায়িত করা খুব সহজ নয়। কারণ এসব তীর্থযাত্রী তাদের অভিযান সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পোষণ করত। উচ্চতর পুরোহিতের হয়তো আরবানের পাশ্চাত্য চার্চের শক্তি ও মর্যাদা বাড়ানোর লক্ষ্যে মুক্তির পবিত্র যুদ্ধের আদর্শ ছিল। অনেক নাইট একে তাদের সামন্ত প্রভুর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেভাবে লড়াই করেছিলেন ঠিক সেভাবেই যিশুর পৈত্রিক সম্পত্তি জেরুসালেমের জন্য লড়াই করাকে তাদের কর্তব্য মনে করতেন। অপেক্ষাকৃত গরিব ক্রুসেডারেরা সম্ভবত নতুন জেরুসালেমের মহাপ্রলয়বাদী স্বপ্নে উদ্দীপ্ত হয়েছিল। তবে জেরুসালেম ছিল প্রধান বিষয়। আরবান যদি খ্রিস্টের সমাধির কথা উল্লেখ না করতেন, তবে তার একই ধরনের সাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। 

তবে এই আদর্শবাদের একটি অন্ধকার অন্তর্নিহিত দিক ছিল। অল্প সময়ের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায় যে খ্রিস্টের বিজয় মানে অন্যদের মৃত্যু ও ধ্বংস। ১০৯৬ সালের বসন্তে জার্মান ক্রুসেডারদের একটি দল রাইন নদীর তীরবর্তী স্পেয়ার, ওয়ার্মস ও মেইঞ্জের ইহুদি সম্প্রদায়গুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এটি নিশ্চিতভাবেই পোপের উদ্দেশ্য ছিল না। তবে মুসলিম সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না, তাদের বিরুদ্ধে এসব ক্রুসেডার লড়াই করতে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দেবে, অথচ যারা আসলেই খ্রিস্টকে হত্যা করেছিল (অন্তত ক্রুসেডাররা তাই বিশ্বাস করত) তারা এখনো জীবিত থেকে তাদের একেবারে দোড়গোড়ায় বাস করতে থাকবে তা অদ্ভূতই মনে হতে পারে। এগুলো ছিল ইউরোপের প্রথম পূর্ণ-মাত্রার প্রথম (সঙ্ঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ড)। এরপর থেকে যখনই নতুন ক্রুসেডারের কথা যখনই প্রচারিত হয়েছিল, তখনই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। এতে করে খ্রিস্টান জেরুসালেমের প্রলোভন সেমিটিকবাদবিরোধিতাকে ইউরোপের দুরারোগ্য রোগে পরিণত করেছিল। 

আর ১০৯৬ সালের শরতে রওনা হওয়া ক্রুসেড সেনাবাহিনী ছিল তাদের পূর্বসূরিদের চেয়ে অনেক বেশি সুশৃঙ্খল। তারা মোড় ঘুরে ইহুদিদের দিকে ফেরেনি। বেশির ভাগই সুশৃঙ্খলভাবে কনস্টানটিনোপল পৌছেছিল। সেখানে তারা শপথ গ্রহণ করল যে তারা আগে বায়েজান্টিয়ামের মালিকানায় থাকা সব ভূখণ্ড বিশ্বস্তভাবে ফিরিয়ে দেবে। অবশ্য ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত হয়েছে যে তাদের অনেকের প্রতিশ্রুতি পূরণের কোনো ইচ্ছা ছিল না। সেলজুকদের আক্রমণ করার এটিই ছিল উপযুক্ত সময় : তাদের আগের সংহতি পরিণত হয়েছিল উপদলীয় সঙ্ঘাতে, আমিরেরা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। ক্রুসেডাররা শুভ সূচনা করল। নিক্যাইয়া ও ডোরিলায়ামে তারা বিপুল জয় পেল। তবে তা ছিল দীর্ঘ যাত্রা। খাদ্য ছিল দুর্লভ, তুর্কিরা পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছিল। জেরুসালেমে পৌঁছাতে ক্রুসেডারদের তিনটি অকল্পনীয় কঠিন বছর লেগেছিল। অ্যান্টিয়কে পৌঁছার পর ১০৯৭-৯৮ সালের কঠিন শীতে তারা শক্তিশালী দুর্গে সুরক্ষিত নগরীটি অবরোধ করল। অবরোধের পরিক্রমায় প্রতি সাতজনের একজন ক্ষুধা মারা গিয়েছিল, সেনাবাহিনীর অর্ধেক ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ক্রুসেডাররাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছিল। ১০৯৯ সালে শেষ পর্যন্ত তারা যখন জেরুসালেমের প্রাচীরগুলোর সামনে দাঁড়াল, তারা তখন নিকটপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে ফেলেছে। তারা এশিয়া মাইনরে সেলজুক ঘাঁটি ধ্বংস করে ফেলেছে, পাশ্চাত্যের শাসকদের পরিচালিত দুটি নতুন রাজ্য সৃষ্টি করেছে : একটি ছিল অ্যান্টিয়কে, যা ছিল ট্যারেনটিনোর নরম্যান বোহেমান্ডের অধীনে, অপরটি ছিল আর্মেনিয়ান এডেসা, বলোঙের ব্যান্ডউইন এটি শাসন করতেন। অবশ্য জয়গুলো ছিল কঠিন লড়াইয়ের ফসল। এসব লৌহমুষ্টির যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর দুর্নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। অ্যান্টিয়কে নরমাংস ভোজনের কলুষিত গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। আর ইউরোপের বর্বর খ্রিস্টানরা পরিচিত হয়ে ওঠেছিল চরম নির্মম ও তাদের ধর্মীয় উগ্রতায় উন্মাদ হিসেবে। জেরুসালেমের অনেক গ্রিক অর্থোডক্স ও মনোফাইসিত খ্রিস্টান এসব ভয়ঙ্কর কাহিনীতে সতর্ক হয়ে মিসরে পালিয়ে গিয়েছিল। যারা রয়ে গিয়েছিল এবং সেইসাথে ল্যাতিন খ্রিস্টানদেরকে (তারা যে ক্রুসেডারদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল, তা সন্দেহ করার যৌক্তিক কারণ ছিল) মুসলিম গভর্নরেরা তাদেরকে নগরী থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। নগরী ও আশপাশের এলাকা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অবরোধের সময় ক্রুসেডারদের কাছে চরম মূল্যবান বিবেচিত হয়েছিল। 

ক্রুসেডারা নেতারা প্রাচীরগুলোর চারপাশে তাদের সৈন্যদের মোতায়েন করেছিলেন। রবার্ট দি নরম্যানকে মোতায়েন করা হয়েছিল উত্তরের বিধ্বস্ত সেন্ট স্টিফেন চার্চের কাছে; ফ্ল্যানডার্সের রবার্ট ও সেন্ট পলের হিউকে নগরীর উত্তর- পশ্চিম দিকে; বোলনের গডফ্রে, ট্রানক্রেড ও সেন্ট জিলেসের রেমন্ড তাঁবু গাড়লেন নগরদুর্গের বিপরীতে। আরেকটি সেনাবাহিনী মাউন্ট অলিভসে মোতায়েন করা হয়েছিল পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ শানানোর জন্য। তারপর রেমন্ড তার প্রভেনক্যাল সৈন্যদের নিয়ে মাউন্ট সায়নের ওপর প্রাচীরগুলোর বাইরে থাকা পবিত্র স্থানগুলো রক্ষার জন্য সরিয়ে নিলেন। তারা প্রাচ্যের পাথুরে দুর্গ অবরোধে অভ্যস্ত ছিল না। এসব নগরী ছিল ইউরোপের বেশির ভাগ শহরের চেয়ে অনেক বড়। তাছাড়া অবরোধ ইঞ্জিন বানানোর মতো সামগ্রীর অভাবও ছিল তাদের। তারপর জেনোয়ার একটি বহর জাফায় অবতরণ করল। তারা এর মাস্তুল, দড়ি, হুকগুলো খুলে নিয়ে দুটি টাওয়ার বা ‘বেলফ্রে’ বানাতে সক্ষম হলো। এগুলো চাকায় চালনা করে প্রাচীর পর্যন্ত নেওয়া যেত। এ যন্ত্রটি মুসলিমদের কাছে অপরিচিত ছিল। শেষ পর্যন্ত ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই গডফ্রের সেনাবাহিনীর এক সৈন্য এই দুই টাওয়ারের কোনো একটির মাধ্যমে নগরীতে ঢুকে পড়তে সক্ষম হলো। বাকি ক্রুসেডারেরা তাকে অনুসরণ করতে সক্ষম হলো। নগর রক্ষায় নিয়োজিত মুসলিম ও ইহুদিদেরকে মহাপ্রলয়ের প্রতিশোধপরায়ণ দেবদূতদের মতো করে হত্যা করা হতে লাগল। 

প্রায় তিন দিন ধরে ক্রুসেডাররা সঙ্ঘবদ্ধভাবে জেরুসালেমের প্রায় ৩০ হাজার লোকের ওপর গণহত্যা চালাল। গেস্তা ফ্রানকোরাম সমর্থনসূচকভাবে বলেছেন, ‘তারা চোখের সামনে পড়া সব স্যারাসেন [মুসলিম] ও তুর্কিকে হত্যা করেছিল। নারী বা পুরুষ- সবাইকে তারা হত্যা করেছিল।২ আকসার ছাদে নিরাপদ মনে করে আশ্রয় নেওয়া ১০ হাজার মুসলিমের সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ইহুদিদেরকে তাদের সিনাগগে আটকিয়ে তরবারি চালানো হয়। বলতে গেলে কেউই বেঁচে থাকেনি। একইসময় সেনাবাহিনী চ্যাপলিন চারথ্রেসের ফুলচার বলেন, তারা ঠাণ্ডা মাথায় সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল। ‘কেউ কোনো বাড়িতে প্রবেশ করলে, সেটি ধনী বা গরিব যারই হোক না কেন, অন্য কোনো ফ্রাঙ্ক তাকে চ্যালেঞ্জ করত না। সে কোনো বাড়ি বা প্রাসাদ যাই দখল করুক না কেন, সেটি তার হয়ে যেত।’ রাস্তাগুলো আক্ষরিক অর্থেই রক্তে ভেসে গিয়েছিল। মাথা, হাত আর পায়ের স্তুপ দেখা যাচ্ছিল,’ বলেন প্রভেনক্যাল প্রত্যক্ষদর্শী অ্যাগুইলেসের রেমন্ড। তার মধ্যে লজ্জার কোনো অনুভূতি দেখা যায়নি : গণহত্যা ছিল খ্রিস্টধর্মের মহাবিজয়ের আলামত, বিশেষ করে হারামের ওপর : 

আমি যদি সত্য কথা বলি, তবে তা আপনার বিশ্বাসের শক্তিকে ছাড়িয়ে যাবে। কেবল এটুকুই বলাই যথেষ্ট হবে যে টেম্পলে ও সোলায়মানের বারান্দায় লোকজনের হাঁটু পর্যন্ত ও ঘোড়ার খুরগুলো রক্তে ডুবে গিয়েছিল। বস্তুত, ঈশ্বরের ন্যায়সঙ্গত ও আড়ম্বরপূর্ণ বিচার ছিল যে এ স্থানটি অবিশ্বাসীদের রক্তে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে, কারণ এটি তাদের ঈশ্বর অবমাননায় দীর্ঘ দিন ধরে দুর্ভোগে ছিল।৪ 

মুসলিম ও ইহুদিদেরকে অনিষ্টকর প্রাণির মতো জেরুসালেম থেকে নির্মূল করে দেওয়া হয়। 

শেষ পর্যন্ত হত্যা করার জন্য কাউকে পাওয়া গেল না। ক্রুসেডাররা নিজেদের ধৌত করে অ্যানাস্তাসিসের দিতে অগ্রসর হলো, চোখে-মুখে আনন্দের উল্লাস নিয়ে ভজন গাইছিল। খ্রিস্টের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে তারা ‘অফিস অব দি রিসারেকশন’ গাইল, এর উপাসনা পদ্ধতি নতুন যুগের ভোরের সূচনা করেছে বলে মনে হলো। রেমন্ড এ নিয়ে লিখেছেন : 

আমি বলব, এই দিন ভবিষ্যতের সব যুগের জন্য বিখ্যাত হবে। কারণ এটি আমাদের শ্রম ও বেদনাকে আনন্দ ও উল্লাসে পরিণত করেছে; আমি বলব, এ দিনটি সমগ্র খ্রিস্ট ধর্মের যৌক্তিকতা, পৌত্তলিকতাবাদের বিপর্যয়, বিশ্বাসের নতুন জাগরণের চিহ্ন হয়ে থাকবে। ‘এ দিনটি প্রভু সৃষ্টি করেছেন, এসো আমরা আনন্দ করি, আমরা খুশি হই কারণ এই দিনে ঈশ্বর তার জাতির কাছে প্রকাশ করেছেন তাদের আশীর্বাদপুষ্ট করেছেন।৫

এই দৃষ্টিভঙ্গি অল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপের এস্টাবলিশমেন্ট গ্রহণ করে নিয়েছিল। তারা সম্ভবত প্রথমে গণহত্যার খবরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ক্রুসেড ছিল সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এমন মহাবিজয় যাতে তাদেরকে বিশ্বাস করতে হয়েছিল যে এটি ঈশ্বরের বিশেষ আশীর্বাদধন্য ছিল। ১০ বছরের মধ্যে তিন জ্ঞানী সন্ন্যাসী- নগেন্টের গুইবার্ট, রবার্ট দি মঙ্ক, বরগুইলির ব্যান্ডরিক- প্রথম ক্রুসেডের ইতিহাস রচনা করেন। এতে ক্রুসেডারদের যুধ্যমান ধর্মানুরাগকে পুরোপুরি অনুমোদন করা হয়েছিল। এই সময় থেকে মুসলিমদেরকে তুলনামূলক সহানুভূতিহীনভাবে বিবেচনা করা হতে লাগল। পাশ্চাত্যে তাদেরকে ‘বীভৎস ও ঘৃণ্য জাতি’, ‘ঈশ্বরের কাছে পুরোপুরি অজ্ঞাত’ ও কেবল ‘চিরতরে নির্মূলের উপযোগী হিসেবে দেখা হতে লাগল। ক্রুসেড পরিণত হলো ঈশ্বরের কর্ম হিসেবে, যেভাবে মিসর থেকে ইসরাইলিদের এক্সডোস ছিল। ফ্রাঙ্করা এখন ঈশ্বরের নতুন মনোনীত জাতিতে পরিণত হলো : ইহুদিদের হারানো বৃত্তি গ্রহণ করল।’ রবার্ট দি মঙ্ক অবাক করা দাবি করলেন যে ক্রুসেডারদের জেরুসালেম জয় ক্রুশবিদ্ধকরণের পর বিশ্ব ইতিহাসের সেরা ঘটনা।’৮ অল্প সময়ের মধ্যে খ্রিস্টবিরোধী ধারণা জেরুসালেমে এসে পড়ে, শেষ দিনের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।৯ 

তবে ক্রুসেডাররা আর যাই হোক না কেন, বাস্তবধর্মী ছিল। এসব পরম বিজয় উদযাপনের আগেই নগরীকে পরিষ্কার করতে হয়েছিল তাদের। টায়ারের উইলিয়াম বলছেন, লাশগুলো পরম দক্ষতায় পোড়ানো হয়েছিল, যাতে ক্রুসেডাররা কর্তিত অঙ্গ-প্রতঙ্গে না-মাড়িয়ে আরো বেশি আস্থার সাথে পবিত্র স্থানগুলোতে যেতে পারে। তবে বাস্তবে কাজটি ছিল বিপুল শ্রমসাধ্য। পাঁচ মাস পরও নগরীতে লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। চারত্রেসের ফুলচার ওই বছর ক্রিসমাস উদযাপনের জন্য যখন জেরুসালেমে আসেন, তখন তিনি আতঙ্কিত হয়েছিলেন : 

ওহ, নগরীর ভেতর-বাইরে সব দিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে আছে। নগরী দখলের সময় আমাদের হাতে নিহত স্যারাসেনদের লাশগুলো এখনো পচছে, সেখানে তাদের হত্যা করা হয়েছিল, সেখানেই তাদের লাশ রয়ে গেছে।১১

ক্রুসেডারেরা সমৃদ্ধ ও জনবহুল নগরী জেরুসালেমকে রাতারাতি দুৰ্গন্ধযুক্ত শব দাহ করার শশ্মশানে পরিণত করেছিল। গণহত্যার তিন দিন পর ক্রুসেডাররা যখন বাজার বসিয়েছিল, তখনো রাস্তায় রাস্তায় পচতে থাকা লাশের স্তুপ ছিল। তাদের পায়ের নিচে থাকা তাদের জঘন্য কর্মের প্রমাণ প্রকট থাকা সত্ত্বেও মহা উৎসব আর উল্লাসে তারা তাদের লুটের মালামাল বিক্রি করছিল। পূর্বসূরিদের ঐশী অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো যদি জেরুসালেমের কোনো একেশ্বরবাদী বিজয়ের সততার পরীক্ষা হিসেবে গণ্য হয়, তবে ক্রুসেডাররা অবশ্যই যেকোনো তালিকায় সবার নিচে থাকবে। 

তারা বিজয়-পরবর্তী বিষয় নিয়ে ভাবেনি, নগরীটি কিভাবে পরিচালনা করা হবে সে ব্যাপারেও তাদের কোনো ধারণা ছিল না। ধর্মবেত্তারা বিশ্বাস করতেন, পবিত্র নগরীটি ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী কোনো প্যাট্রিয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া উচিত। নাইটরা চাইতেন, তাদের কেউ শাসন করুক। আবার ক্রুসেডারদের ওপর বেশ প্রভাব বিস্তারকারী গরিব লোকজন শুরু থেকেই নতুন জেরুসালেমের প্রত্যাশা করেছিল। তারা প্রচলিত কোনো ধরনের সরকারই যাতে একেবারে না থাকে, তাই কামনা করত। আপস হতে বেশ সময় নেয়। অবরোধের সময় মুসলিমেরা গ্রিক অর্থোডক্স প্যাট্রিয়ার্ককে বহিষ্কার করায় ক্রুসেডারেরা নরম্যান্ডির রবার্টের চ্যাপলান রোহেসের আরনাফকে ওই পদে নিযুক্ত করে। অর্থাৎ একজন গ্রিকের স্থলাভিষিক্ত হলো একজন ল্যাতিন। তারপর তারা বোলনের গডফ্রেকে তাদের নেতা নিযুক্ত করে। এ তরুণ লোকটির বুদ্ধিমত্তা না থাকলেও ছিলেন ধার্মিক, বিপুল দৈহিক সাহস ধারণ করতেন। গডফ্রে ঘোষণা করলেন যে তিনি সোনার মুকুট পরবেন না, কারণ তার ত্রাণকর্তা কাঁটার মুকুট পরেছিলেন। তিনি পদবি গ্রহণ করলেন ‘অ্যাডভোকেট অব দি হলি সেপালচার। নগরীটি শাসিত হতো প্যাট্রিয়ার্কের মাধ্যমে। তবে গডফ্রে তাকে সামরিক সুরক্ষা (অ্যাডভোকেটিয়া) প্রদান করতেন। কয়েক মাস পর পিসার আর্চবিশপ দাইমবার্ট পোপের সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে জেরুসালেমে আসেন। তিনি সাথে সাথে আরনাফকে বরখাস্ত করে নিজেকে প্যাট্রিয়ার্ক ঘোষণা করে গ্রিক, জ্যাকোবাইট, নেস্টোরিয়ান, জর্জিয়ান ও আর্মেনিয়ানসহ স্থানীয় সব খ্রিস্টানকে অ্যানাস্তাসিস ও জেরুসালেমের অন্য সব চার্চ থেকে বিতাড়িত করেন। পোপ আরবান প্রাচ্যের খ্রিস্টানদের সহায়তা করার ম্যান্ডেট দিয়েছিলেন ক্রুসেডারদের। এখন তারা পবিত্র নগরীতে তাদের পূর্বসূরিদের অসহিষ্ণুতা বাড়িয়ে তাদের একই ধর্মে বিশ্বাসীদের পর্যন্ত সম্প্রসারিত করল। ১১০০ সালের ইস্টার সানডেতে গডফ্রে এই শর্তে প্যাট্রিয়ার্ক দাইমবার্টকে দাউদ টাওয়ার ও জেরুসালেমের অন্য সব কিছুসহ জেরুসালেম নগরী’ প্রদান করলেন যে অ্যাডভোকেট রাজ্যটির জন্য আরো ভূমি জয় করলে তিনি নগরীকে ব্যবহার করতে পারবেন। 

ক্রুসেডারদের জন্য এটি ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। জেরুসালেম জয় করার অর্থ চার্চের জন্য পুরো ফিলিস্তিন মুক্ত করা ছিল না। ফাতেমিরা তখনো উপকূলীয় নগরীগুলোসহ দেশটির অনেক অংশ নিয়ন্ত্রণ করছিল। পিসার নৌবহরের সহায়তায় ফাতেমি ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতে শুরু করলেন গডফ্রে। ১১০০ সালের মার্চ মাস নাগাদ অ্যাসক্যালন, ক্যাসারিয়া, আক্রা ও আরসাফের আমিররা আত্মসমর্পণ করে গডফ্রেকে তাদের প্রভু স্বীকার করে নেন। ট্রান্সডর্জানের শেখরাও তা অনুসরণ করে। এদিকে তানডে গ্যালিলিতে একটি ছোট রাজ্য স্থাপন করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি ছিল অনিশ্চিত। রাজ্যটির এখন রক্ষা করার মতো সীমান্ত থাকলেও পরবর্তী ২৫ বছর তাকে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছিল। কারণ এটি তীব্র বৈরী শত্রুদের পরিবেষ্টিত ছিল। 

ক্রুসেডারদের প্রধান সমস্যা ছিল জনশক্তি। জেরুসালেম জয় হওয়ামাত্র তাদের বেশির ভাগ সৈন্যই দেশে ফিরে গিয়েছিল, পেছনে কেবল একটি কঙ্কাল সেনাবাহিনী রয়ে গিয়েছিল। জেরুসালেম বিশেষভবে জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় এক লাখ লোকের বাস করা নগরীতে এখন ফাঁকা, ভুতুরে পরিবেশে মাত্র কয়েক শ’ লোক থাকে। উইলিয়াম টায়ার বলেছেন, ‘আমাদের দেশের লোকজন সংখ্যায় এত কম ও এত অভাবগ্রস্ত যে রাস্তায় তাদের দেখা পাওয়া দুঃসাধ্য। ৩ নিরাপত্তার জন্য তারা হলি সেপালচারে প্যাট্রিয়ার্কের কোয়ার্টারে গাদাগাদি করে থাকত।১৪ নগরীর বাকি অংশ ছিল জনশূন্য, রাস্তাগুলো অপরাধী আর বেদুইনদের উপস্থিতিতে বিপজ্জনক হয়ে পড়েছিল। এসব লোক খালি বাড়িগুলোতে ঢুকে পড়ত। জেরুসালেম পর্যাপ্তভাবে রক্ষা করা হয়নি : গডফ্রে যখন তার সৈন্যদের নিয়ে কোনো অভিযানে বের হতেন, তখন অল্প কয়েকজন অযোদ্ধা ও তীর্থযাত্রীকে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য রেখে যাওয়া হতো। বৈরিতার অবসান হওয়ামাত্র মুসলিম ও ইহুদিরা বৈরুত, সিডন, টায়ার ও একরের মতো নগরীগুলোতে ফিরে আসতে লাগল। মুসলিম কৃষকেরা গ্রাম এলাকায় রয়ে গিয়েছিল। জেরুসালেম জয়ের পর ক্রুসেডারেরা পবিত্র নগরীতে ইহুদি ও মুসলিমদের নিষিদ্ধ করে; স্থানীয় খ্রিস্টানদেরকেও বহিষ্কার করা হয়। কারণ ক্রুসেডাররা তাদেরকে ইসলামের দুষ্কৃতির সহযোগী বলে সন্দেহ করত। অমার্জিত পাশ্চাত্যের লোকজনের কাছে এসব ফিলিস্তিনি, কপ্টিক ও সিরিয়ান খ্রিস্টানকে আরবদের থেকে ভিন্ন বলে মনে হতো না। নগরীটি যতই পবিত্র হোক না কেন, ফ্রাঙ্কদের খুব কম লোকই জেরুসালেমে বাস করতে চাইত। আগের জেরসালেমের ছায়ায় পরিণত হয়েছিল বর্তমান নগরী। বেশির ভাগই উপকূলীয় নগরীগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। সেখানে জীবন ছিল অনেক সহজ, ব্যবসা-বাণিজ্যের আরো বেশি সুযোগ ছিল। 

জয়ের পরপরই গডফ্রে আকসা মসজিদে সরে গিয়েছিলেন। এটি পরিণত হয়েছিল রাজকীয় বাসভবনে। তিনি ডোম অব দি রককে চার্চে পরিণত করেছিলেন। এর নাম হয় ‘টেম্পল অব দি লর্ড।’ ক্রুসেডারদের কাছে হারামের বিশাল অর্থ ছিল। বায়েজান্টাইনরা জেরুসালেমের এই অংশের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তবে ক্রুসেডাররা বিশ্বাস করছিল যে তারা নতুন মনোনীত জাতি। আর এ কারণে তারা এই ইহুদি পবিত্র স্থানটির উত্তরাধিকারী হওয়া উচিত তাদেরই। শুরু থেকে এটি ক্রুসেডার জেরুসালেমের আধ্যাত্মিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। দাইমবার্ট ‘টেম্পল অব দি লর্ডকে’ তার সরকারি আবাসে পরিণত করেন। ক্রুসেডারদের কাছে হারামের গুরুত্ব বোঝা যায় এই তথ্যে যে প্যাট্রিয়ার্ক ও তার অ্যাডভোকেট এই জনহীন দূরবর্তী এলাকায় বসবাসের জন্য পছন্দ করেছিলেন। ওয়েস্টার্ন হিলের ওপর থাকা প্রধান ক্রুসেডার মহল্লাগুলো থেকে এটি ছিল অনেক দূরে। তাদের সবচেয়ে কাছাকাছি প্রতিবেশী ছিলেন বেনেডিকটাইন সন্ন্যাসীরা। গডফ্রে তাদেরকে কিদরন ভ্যালির ভার্জিন মেরির সমাধিতে স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন। 

গডফ্রের শাসনকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। ১১০০ সালের জুলাই মাসে তিনি টায়ফয়েডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাকে অ্যানাস্তাসিসে সমাহিত করা হয়। ক্রুসেডারেরা একে চার্চ অব দি হলি সেপালচার বলতেই পছন্দ করত। প্যাট্রিয়ার্ক দায়ামবার্ট সেক্যুলারের পাশাপাশি আধ্যাত্মিক নেতৃত্বও গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু গডফ্রের ভাই ব্যান্ডউইনের কৌশলের কাছে পরাজিত হন। ব্যান্ডউইন ছিলেন আর্মেনিয়ার ক্রুসেডার রাজ্য এডেসার কাউন্ট। লরেন থেকে আগত তার দেশী লোকেরা তাকে জেরুসালেমে আসতে তাগিদ দিয়েছিল। তিনি তার ভাইয়ের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান ও বাস্তববাদী ছিলেন। যুব বয়সে পাদ্রির প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী ব্যান্ডউইন বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি শিক্ষিত ছিলেন। তিনি ক্রুসেডার জেরুসালেম রাজ্যকে টিকে থাকার সম্ভাবনাময়ে পরিণত করেছিলেন। ১১০০ সালের ৯ নভেম্বর তিনি পবিত্র নগরীতে পৌঁছালে কেবল ফ্রাঙ্করা নয়, সেইসাথে স্থানীয় খ্রিস্টানেরাও উচ্ছ্বসিতভাবে স্বাগত জানায়। তারা নগরীর বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। ব্যান্ডউইন উপলব্ধি করলেন যে নিকট প্রাচ্যে ফ্রাঙ্কদের টিকে থাকতে হলে তাদের প্রয়োজন বন্ধুর। আর যেহেতু ইহুদি আর মুসলিমদের বিবেচনাই করা যায় না, তাই গ্রিক, সিরিয়ান, আর্মেনিয়ান ও ফিলিস্তিনি খ্রিস্টানেরা হতে পারে সহজাত মিত্র। ব্যান্ডউইনের আর্মেনিয়ান এক স্ত্রী ছিল। ব্যান্ডউইন দাইমবার্টের অবজ্ঞার শিকার প্রাচ্যের খ্রিস্টানদের মন জয় করেছিলেন। 

ব্যান্ডউইন ১১ নভেম্বর রাজা দাউদের নগরী বেথলেহেমের ন্যাটিভিটি চার্চে ‘ল্যাতিনদের রাজা’ হিসেবে মুকুট পরেন। জেরুসালেমে সোনার মুকুট পরতে বা রাজা হিসেবে অভিহিত হতে তার কোনো অস্বস্তি ছিল না। তার নেতৃত্বে ক্রুসেডাররা একটির পর একটি দারুণ জয় পায়। ব্যান্ডউইন ১১১০ সালের মধ্যে ক্যাসারিয়া, হাইফা, জাফা, ত্রিপলি, সিডন ও বৈরুত জয় করে। ক্রুসেডারেরা এখন চতুর্থ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এটি ছিল ত্রিপলি দেশ। বিজিত নগরীগুলোতে লোকজনকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়, মসজিদগুলো ধ্বংস করা হয়। ফিলিস্তিনিরা নিরাপত্তার জন্য ইসলামি ভূখণ্ডে পালিয়ে যায়। এসব গণহত্যা ও বাস্তুচ্যুতির ঘটনা পরবর্তীকালে স্থানীয় লোকজনের সাথে ক্রুসেডারদের স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার কাজটি কঠিন করে ফেলেছিল। ক্রুসেডাররা মনে হচ্ছিল অপ্রতিরোধ্য। অবশ্য সেলজুক আমির ও স্থানীয় রাজবংশগুলো কোনো বড় ধরনের প্রতিরোধ গড়তে পারছিলেন না। তারা তখনো ব্যক্তিগত বিবাদে মত্ত ছিলেন। ফলে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বাগদাদ থেকে প্রত্যাঘাতের কোনো আশা ছিল না। খলিফা এখন আরোগ্য-অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়ায় তার পক্ষে অনেক দূরের ফিলিস্তিনের যুদ্ধকে গুরুত্বপূর্ণভাবে গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। পর্যায়ক্রমে ক্রুসেডাররা নিকট প্রাচ্যে প্রথম উপনিবেশ গড়তে সক্ষম হয়েছিল। 

ব্যাল্ডউইনকে জেরুসালেমের সবচেয়ে সমস্যাটির সমাধান করতে হয়েছিল। নগরীতে তখনো জনসংখ্যা ছিল অতি নগন্য। ফলে বলা যায় নগরীটি প্রায় জনমানবহীনই ছিল। ফ্রাঙ্করা তখনোও উপকূলের আরো সমৃদ্ধ নগরীগুলোর দিকে ছুটে চলছিল। তারা ছিল প্রধানত কৃষক ও সৈনিক। তারা কারিগর বা শিল্পী ছিল না। ফলে স্থানীয় হালকা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল একটি নগরীতে বাস করা তাদের জন্য ছিল কঠিন। ১০৯৯ সালের ‘বিজয়ের আইনের ফলে ক্রুসেডে অংশ নেওয়া লোকজন ভূস্বামী ও বাড়ির মালিকে পরিণত হয়েছিল। তারা এখন ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক ক্রমপরম্পরা থেকে মুক্ত ছিল। আর মুক্ত মানুষ হিসেবে তারা সম্পত্তির মালিক হতে পারত। এসব বারসিজের (পূর্ণস্বশাসিত নগরের অধিবাসী, তারা এভাবেই নিজেদের অভিহিত করত) অনেকে এখন জেরুসালেমে এক বা একাধিক বাড়ি কিংবা আশপাশের এলাকায় এস্টেট বা গ্রামের মালিক। তাদেরকে নগরীতে বাস করানোর লক্ষ্যে ব্যান্ডউইন নতুন একটি আইন করেন। এতে যে লোক এক বছর ও এক দিন কোনো বাড়িতে বাস করলে তাকে ওই বাড়ির মালিকানা দিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে সঙ্কটের সময় লোকজনকে তাদের এস্টেট ত্যাগ করা থেকে বিরত রাখে এই আশায় যে স্বস্তিদায়ক সময়ে তারা ফিরতে পারবে। এসব অধিকার প্রাপ্ত লোকজন ফ্রাঙ্কিশ জেরুসালেমের মেরুদণ্ডে পরিণত হয়। তারা নগরীতে পাচক, কসাই, দোকানদার ও কর্মকার হিসেবে কাজ করে। তবে তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। 

ব্যান্ডউইন স্থানীয় খ্রিস্টানদেরকে জেরুসালেমের চার্চ ও মঠগুলোতে ফিরিয়ে আনার আশা করেছিলেন। ১১০১ সালে তিনি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলেন, মনে হলো স্বর্গ থেকেই এসেছে তা। ইস্টারের আগের রাতে লোকজন পূর্বের মতোই হলি ফায়ারের অলৌকিকত্বের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিছুই ঘটল না : ঐশী আলো (হলি ফায়ার) আবির্ভূত হতে ব্যর্থ হলো। অনুমান করা হতে লাগল যে গ্রিকরা সাথে করে এই গোপন রহস্য নিয়ে গেছে, তারা এর রহস্য ল্যাতিনদের কাছে ফাঁস করতে চায়নি। এই ব্যর্থতা অলুক্ষুণে মনে হলো : ফ্রাঙ্করা কি কোনোভাবে ঈশ্বরকে অসন্তুষ্ট করেছে? বেশ কিছু সময় পর দাইমবার্ট পরামর্শ দিলেন যে ল্যাতিনদের উচিত হবে, তার সাথে টেম্পল অব লর্ডসে যাওয়া। সেখানেই ঈশ্বর সোলায়মানের প্রার্থনার জবাব দিয়েছিলেন। স্থানীয় খ্রিস্টানদেরও প্রার্থনা করতে বলা হলো। পর দিন সকালে ঘোষণা করা হলো যে সমাধির পাশে দুটি আগুনের শিখা আবির্ভূত হয়েছে। স্বর্গ থেকে আসা বার্তার অর্থ স্পষ্ট মনে হলো। আর্মেনিয়ান ইতিহাসবিদ এডেসার ম্যাথু দাবি করলেন যে ‘ফ্রাঙ্কদের মঠগুলো থেকে আর্মেনিয়ান, গ্রিক, সিরিয়ান ও জর্জিয়ানদের বহিষ্কার করার ঘটনায়’ ঈশ্বর ক্রুদ্ধ হয়েছেন এবং প্রাচ্যের খ্রিস্টানেরা অগ্নিশিখা কামনা করায় সেটি পাঠিয়েছেন। সমাধির চাবি আবার গ্রিকদের দেওয়া হলো, পবিত্র নগরীর অন্যান্য সম্প্রদায়কে তাদের উপাসনালয়, ও চার্চগুলোতে ফেরার অনুমতি দেওয়া হলো। 

এই সময় থেকে জেরুসালেমের রাজা স্থানীয় খ্রিস্টানদের রক্ষাকর্তায় পরিণত হলেন। উচ্চতর পুরোহিত ল্যাতিনই থেকে গেলেন। তবে হলি সেপালচার চার্চে গ্রিক নিয়ম বজায় থাকল। ১০৯৯ সালে মিসরে পালিয়ে যাওয়া জ্যাকোবাইতরা ফিরে এলে তাদেরকে মেরি ম্যাগদালিন মঠে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হলো। আর্মেনিয়ানদের বিশেষ আনুকূল্য প্রদর্শন করা হলো। কারণ এখন রাজপরিবারে আর্মেনিয়ান সদস্য রয়েছে। ব্যান্ডউইন আর্মেনিয়ার সাথে বিশেষ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করলেন। ফলে সম্প্রদায়টি ও সেন্ট জেমস কনভেন্ট সমৃদ্ধ হলো। গুরুত্বপূর্ণ আর্মেনিয়ান ব্যক্তিত্ব ও অভিজাতেরা তীর্থযাত্রী হিসেবে জেরুসালেমে আসার সময় মূল্যবান উপহার নিয়ে আসতেন। এসবের মধ্যে ছিল এম্ব্রয়ডরি করা পোশাক, সোনার ক্রুস, পানপাত্র, মূল্যবান পাথরে মোড়া ক্রুশ, কনভেন্ট লাইব্রেরি উজ্জ্বল করার পাণ্ডুলিপি। এসব সামগ্রী এখনো উৎসবের দিনে ব্যবহৃত হয়। হলি সেপালচার চার্চে সেন্ট মেরির চ্যাপেলে আর্মেনিয়ানদেরও অভিভাবক করা হয়। 

ব্যাল্ডউইন ১১১৫ সালে ট্রান্সজর্ডানের সিরিয়ান খ্রিস্টানদের আমদানি করে জেরুসালেমের জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করে ফেললেন। ক্রুসেডারদের নৃশংসতার পর থেকে এসব লোক মুসলিম বিশ্বে অবাঞ্ছিত ঘোষিত হয়েছিল। ব্যান্ডউইন তাদেরকে নগরীতে প্রলুব্ধ করেন বিশেষ সুবিধা প্রদান ও নগরীর উত্তর- পশ্চিম প্রান্তের ফাঁকা বাড়িঘরগুলোতে তাদের বাস করতে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। তাদেরকে তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য চার্চ নির্মাণ ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হলো। তাদের চার্চ গুলো হলো স্টিফেন্স গেটের কাছে সেন্ট আব্রাহামস ও সেন্ট জর্জেস এবং প্যাট্রিয়ার্কস কোয়ার্টারের কাছে সেন্ট ইলিয়াসেস ও সেন্ট জ্যাকবস। 

ব্যাল্ডউইনের নীতি অবশ্যই ফলপ্রসূ হয়েছিল। কারণ, এই পর্যায়ে জেরুসালেমের উন্নতি ঘটেছিল, জনসংখ্যা প্রায় ৩০ হাজারে উন্নীত হয়েছিল। এটি আবারো রাজধানী নগরীতে পরিণত হয়েছিল। তাছাড়া এর ধর্মীয় তাৎপর্য থাকায় এটি হয়েছিল ফ্রাঙ্কিশ রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রধান মেট্রোপলিশ। এটা জেরুসালেমে নতুন জীবন ও আনন্দ বয়ে আনে। অনেক দিক থেকে এটি পাশ্চাত্যের কোনো নগরীর মতোই সংগঠিত হতে থাকে। মুসলিম শরিয়াহ আদালতের স্থলাভিষিক্ত হয় তিনটি ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালত : অভিজাতদের জন্য হাই কোর্ট, বারসিজের জন্য আদালত ও সিরিয়ানদের জন্য আদালত। শেরষাক্ত আদালতটি ছিল স্থানীয় খ্রিস্টানদের জন্য। তারাই এটি পরিচালনা করত। ক্রুসেডারেরা হলি সেপালচারের পাশে পুরনো রোমান ফোরামে ও কার্ডোজুড়ে থাকা বাজারগুলো বহাল রাখে। তারা সম্ভবত স্থানীয় খ্রিস্টানদের কাছ থেকে সুক সংগঠন সম্পর্কে শিখেছিল। কারণ, তারা পল্ট্রি, বস্ত্র, মশল্লা ও খাবারের দোকান আলাদা আলাদা জায়গায় রাখার প্রাচ্যের ব্যবস্থাটি বহাল রেখেছিল। ফ্রাঙ্ক ও সিরিয়ানরা একসাথে ব্যবসা করত, তবে তারা রাস্তার বিপরীত দিকে অবস্থান করত। জেরুসালেম কখনো বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়নি, কারণ এটি ছিল প্রধান রুটগুলো থেকে অনেক দূরে। ইতালির বিভিন্ন নগরী থেকে আসা বণিকেরা উপকূলীয় নানা শহরে নিজস্ব সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা জেরুসালেমের নাগরিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও কখনো সেখানে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাই করেনি। সবসময়ের মতো নগরীটি পর্যটক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল থেকে যায়। জেরুসালেমকে ধর্মীয় নগরী হিসেবে পরিচালনা করার পুরোহিতীয় ধারণাটি ভণ্ডুল করে দিয়েছিল। দাইমবার্টের১৬ কবল থেকে মুক্তি লাভ করা মাত্র তিনি অধীনস্ত ভূমিকায় থাকতে রাজি, এমন প্যাট্রিয়ার্কদের মনোনীত করেন। ১১১২ সাল থেকে পুরনো খ্রিস্টান কোয়ার্টারে প্যাট্রিয়ার্কের পূর্ণ এখতিয়ার ছিল। কিন্তু ব্যান্ডউইন বাকি নগরী শাসন করতেন। সমসাময়িক ইউরোপের যেকোনো নগরীর চেয়ে এই রাজ্য ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে অনেক বেশি স্বাধীন ছিল। 

টেম্পলারদের এ সিলটি, এতে দুই নাইটকে একই ঘোড়ায় চড়তে দেখা যাচ্ছে, ধনী ও শক্তিশালী হওয়ার আগে যিশু খ্রিস্টের গরিব সৈন্যদের প্রাথমিক আদর্শবাদ প্রতিফলিত করছে। 

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, শুরুতে উগ্র ধর্মীয় বিষয় থাকলেও ক্রুসেডার জেরুসালেম অনেক বেশি সেক্যুলার স্থানে পরিণত হয়েছিল। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর ফ্রাঙ্কেরাও একে পাশ্চাত্য নগরীতে পরিণত করার কাজ শুরু করে দেয়। ১১১৫ সালে তারা ডোম অব দি রক নিয়ে কাজ করা শুরু করে। এটি ছিল ফ্রাঙ্কিশ জেরুসালেমে এ স্থানটির গুরুত্ব থাকার আরেকটি নিদর্শন। এই ভবনের ইতিহাস সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা ক্রুসেডারদের ছিল না। তারা বুঝতে পেরেছিল, এটি রাজা সোলায়মানের নির্মাণ করা টেম্পল নয়। তবে তাদের মনে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে কনস্টানটাইন কিংবা হেরাক্লিয়াস পবিত্র টেম্পলের এই স্থানটির প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করেছিলেন একটি ভবন নির্মাণ করে, আর মুসলিমেরা এটি ঈশ্বরের অবমাননা প্রদর্শন করে নিজেদের জন্য ব্যবহার করছিল। ১১১৫ সালে সম্ভবত তারা এর আদি বিশুদ্ধতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে। ডোমের শীর্ষে তারা একটি ক্রুশ সংযোজন করে, একটি বেদী ও কোইয়ারের জন্য মার্বেল দিয়ে ঢেকে দেয়। আর কোরআনের আয়াতগুলোর স্থানে ল্যাতিন বাণী উৎকীর্ণ করা হয়। এটি ছিল মুসলিম উপস্থিতি মুছে ফেলতে বিশেষ ক্রুসেডার উদ্যোগ। তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি কখনো। অবশ্য কারিগরদের দক্ষতা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের। রককে ঘিরে ক্রুসেডারদের নির্মিত গ্রিল ছিল মধ্যযুগের ধাতবশিল্পের টিকে থাকা শ্রেষ্ঠতম নিদর্শনগুলোর অন্যতম। এতে সময়ও লেগেছিল : ‘টেম্পল অব দি লর্ড’ ১১৪২ সালের আগে আনুষ্ঠানিকভাবে পবিত্র করা হয়নি। নতুন চার্চের উত্তরে ক্রুসেডারেরা আগাস্টিয়ানদের জন্য তপস্যা করার জন্য নির্জন স্থান তৈরি করে, ডোম অব দি চেইনকে জেমস ও জাদিককে নিবেদন করা চ্যাপেলে পরিণত করে। জাদিক টেম্পল মাউন্টে শহিদ হয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা হতো। 

শুরুতে আকসা মসজিদ সংস্কারের জন্য অর্থ ছিল না। বিজয়ের সময় এটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছিল। ব্যান্ডউইন ছাদের সীসার আস্তরণ পর্যন্ত বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর ১১১৮ সালে নাইটদের একটি ছোট দল (তারা নিজেদেরকে যিশু খ্রিস্টের ‘গরিব সাথী সৈনিক’ বা পয়ুর ফেলো সোলজার্স নামে অভিহিত করত) রাজার কাছে নিজেদেরকে পেশ করে দাতব্য পরিষেবার প্রস্তাব দেয়। তারা বেদুইন ও অন্যান্য মুসলিম বেপরোয়া দুর্বৃত্তদের থেকে ফিলিস্তিনের রাস্তাগুলো ও নিরস্ত্র তীর্থযাত্রীদের পাহারা দেবে। রাজ্যের তখন এটিই প্রয়োজন ছিল। ব্যান্ডউইন সাথে সাথে সদরদফতরের জন্য তাদেরকে আকসার একটি অংশ দিয়ে দেন। টেম্পল অব দি লর্ডের খুব কাছাকাছি তারা থাকায় গরিব সৈনিকেরা (পুয়র সোল্ডার্স) টেম্পলার্স হিসেবে পরিচিত ছিল।১৭ এই পর্যায় পর্যন্ত সন্ন্যাসীদের জন্য অস্ত্র বহন ও যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু চার্চ যখন টেম্পলারদেরকে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তখন পবিত্র সহিংসতা কিছুটা মাত্রায় হলেও নিয়মে পরিণত হয়ে যায়। এসব সৈনিক সন্ন্যাসী নতুন ইউরোপের দুটি মহা আবেগ তথা যুদ্ধ ও উপাসনাকে একসাথে ধারণ করতেন। তারা অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন নতুন রিক্রুট আকৃষ্ট করেন। তারা রাজ্যের কঠিন জনশক্তি সমস্যার সমাধানে সহায়তা করেন। ১১২০-এর দশকে টেম্পাররা ক্রুসেডরত সেনাবাহিনীতে অভিজাত বাহিনীতে পরিণত হয়। তাদের সৃষ্টি করা হয়েছিল পুরোপুরি রক্ষণাত্মক সামরিক উদ্দেশ্যে। কিন্তু তারা ওই উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়েছিল। 

কাকতালীভাবে গরিব নাইটেরা অল্প সময়ের মধ্যেই ধনী হয়ে যান, চার্চের অন্যতম সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রুপে পরিণত হন। তারা আকসায় তাদের সদরদফতর ঘষেমেজে ঝকঝকে তকতকে করে নেন। এটি পরিণত হয় তাদের সামরিক কম্পাউন্ডে। ভূগর্ভস্থ হেরডিয়ান ভল্টগুলো তাদের আস্তাবলে পরিণত হয়। সোলায়মানের আস্তাবল নামে পরিচিত স্থানটিতে তারা সহিসসহ হাজারের বেশি ঘোড়া রাখত। কক্ষগুলোকে আলাদা করতে মসজিদের ভেতরে তরা অভ্যন্তরীণ প্রাচীর নির্মাণ করে : গুদামঘরগুলো অস্ত্রশস্ত্র, শস্য, গোসলখানা, টয়লেটে পরিপূর্ণ ছিল। ছাদে ছিল বিনোদন উদ্যান, প্যাভিলিয়ন, চৌবাচ্চা নির্মাণ করা হয়েছিল। টেম্পলাররা মসজিদের পশ্চিম দিকে একটি নতুন আশ্রম, একটি ভোজনশালা, একটি মদ্য ভাণ্ডার নির্মাণ করেছিল। তারা জাঁকজমকপূর্ণ একটি নতুন চার্চের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছিল। অবশ্য কারিগরি দক্ষতা ছিল উচ্চমানের। বিশেষ করে ভাস্কর্যে ‘ওয়েট-লিফ’ নক্সা দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল। এতে বায়েজান্টাইন, ইসলামি ও রোমান পদ্ধতির চমৎকার সমন্বয় সাধন করা হয়েছিল। 

অবশ্য টেম্পলাররা ক্রুসেডার জেরুসালেমের প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করছিল। ক্রুসেডে অংশ নেওয়াকে বিবেচনা করা হতে ভালোবাসা প্রকাশের কাজ হিসেবে। পোপ ইউরোপের নাইটদেরকে ইসলামি বিশ্বে তাদের খ্রিস্টান ভাইদের সহায়তার জন্য যেতে বলেছিলেন। পৌত্তলিকদের কবল থেকে খ্রিস্টের পৈত্রিক সম্পত্তি মুক্ত করার চেষ্টায় খ্রিস্টের প্রতি ভালোবাসায় হাজার হাজার ক্রুসেডার মারা গিয়েছিল। ক্রুসেডে অংশ নেওয়াটা সাধারণ মানুষের জন্য এমনকি মঠের আদর্শে বসবাসের মতোই ব্যাপার ছিল।১৮ তবে এই ‘ভালোবাসা’ প্রকাশিত হয়েছিল সহিংসতা ও নৃশংসতায়। টেম্পলারদের ক্যারিয়ারও গরিব ও নির্যাতিতদের প্রতি দয়া প্রদর্শন ও উদ্বিগ্ন হওয়ার ধারণাটি দ্রুত বদলে গিয়ে সামরিক আগ্রাসনে পরিণত হয়। হারামে সব ধরনের সহিংসতা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন আকসা সামরিক ছাউনি আর সামরিক অস্ত্রভাণ্ডারে রূপান্তরিত হলো। অল্প সময়ের মধ্যেই সমগ্র ইউরোপ অ্যানাস্তাসিসের মডেলে নির্মিত গোলাকার টেম্পলার চার্চে ছেয়ে গেল। এর মাধ্যমে খ্রিস্টানদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলো যে পুরো খ্রিস্টান বিশ্ব জেরুসালেম রক্ষায় পবিত্র যুদ্ধের জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছে। 

আমরা একই প্রবণতা দেখি টেম্পলারদের প্রতিদ্বন্দ্বী নাইটস হসপিটালারদের বেলাতেও। তারা প্যাট্রিয়ার্কস কোয়ার্টারের সেন্ট জন দি অ্যালমনারের পুরনো ল্যাতিন হসপিসে ঘাঁটি গেড়েছিল। মঠাধ্যক্ষ গেরার্ড জেরুসালেম অবরোধের সময় ও বিজয়ের পর ক্রুসেডারদের সহায়তা করেছিলেন। গরিব ও অভাবগ্রস্তদের পরিচর্যা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভবকারী একদল নাইট ও তীর্থযাত্রী তার সাথে যোগ দিয়েছিল। এরপর থেকে নাইটেরা আর কখনো পরিচর্যার কায়িক শ্রমের কাজে নিজেদেরকে অসম্মাজনক মনে করার স্বপ্ন দেখেনি। তবে গেরার্ডের অধীনে তারা স্বেচ্ছায় গরিবদের সাধারণ জীবনযাপন করত, নিজেদেরকে দাতব্য কাজে নিবেদিত করত। টেম্পলারদের মতো হসপিটালারাও পবিত্র দারিদ্র্যের আদর্শে উজ্জীবিত ছিল। প্রথম ক্রুসেডে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আবার হসপিটালাররাও ফিলিস্তিন ও ইউরোপে নানা পেশার লোকজনকে আকৃষ্ট করেছিল। ১১১৮ সালে গেরার্ড মারা যান, তার স্থলাভিষিক্ত হন লে পুইয়ের রেমন্ড। তিনি এই গ্রুপকে ইউরোপে ছড়িয়ে দিতে অনেক অবদান রাখেন। তবে টেম্পলারদের মতো হসপিটালরাও ছিল পুরোপুরি জেরুসালেমকেন্দ্রিক। তাদের শাসনে আউট্রেমার (‘বিদেশ’) বলতে বোঝাত ইউরোপ। দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝিতে হসপিটালররাও সৈনিকে পরিণত হয়, তারাও ক্রুসেডরত সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করত, তাদের দাতব্য কাজ অনিবার্যভাবে সামরিকবাদের পথ ধরে। অবশ্য তারা কখনো দাতব্য কাজ পরিত্যাগ করেনি। হলি সেপালচারের দক্ষিণে তাদের জন্য নির্মাণ করা বিশাল ও জাঁকজমকপূর্ণ কম্পাউন্ডে পুরুষ নার্সেরা সারা বছর হাজার হাজার লোকের পরিচর্যা করত, গরিবদেরকে বেশ বড় ধরনের দান-খয়রাত, পোশাক, খাবার দিত। হলি সেপালচারের খুব কাছে থেকেই হসপিটাল ক্রুসেডের আরো বেশি আকর্ষণীয় অবনবের প্রতিনিধিত্ব করত। 

জেরুসালেমের এসব খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীর মতো ক্রুসেডাররাও বিশ্বাস করত যে তারা যিশুর পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। তারা তাদের ক্রুশ (তাদের অভিযানের শুরুতে তাদের পোশাকে লাল ক্রুশ যত্নের সাথে লাগাত) গ্রহণ করেছিল, পবিত্র নগরীর জন্য ও প্রতিরক্ষায় তাদের জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল। তাদের তরবারিই ছিল তাদের স্বপ্নাবিভাবের কেন্দ্রবিন্দু। 

তীর্থযাত্রীরা সবসময়ই হসপিটালদের প্রতিই সবচেয়ে মুগ্ধ হতো। তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন জেরুসালেম আবিষ্কার করতে শুরু করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বায়েজান্টাইনরা টেম্পল মাউন্টে কখনো তীর্থযাত্রীদের চালিত করেনি। তারা স্থানটিকে স্রেফ ইহুদি ধর্মের পরাজয়ের প্রতীক হিসেবে দেখেছিল, তাদের উপাসনাব্যবস্থায় টেম্পল মাউন্টের কোনো স্থান ছিল না। তবে ১১০২ সালের শুরুর দিকে ব্রিটিশ তীর্থযাত্রী সাইউলফ জেরুসালেম সফরের সময় গর্বভরে হারামের উপাসনাগুলো ঘুরে দেখেন। স্থানটি অল্প সময়ের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠেছিল। এখন গেট অব মার্সিকে ভার্জিন মেরির মা-বাবা জোয়াকিম ও আনার প্রথম সাক্ষাতের স্থান হিসেবে দেখা হতে লাগল। হারামের আরেকটি ফটক ছিল ‘বিউটিফুল গেট।’ এখানে সেন্ট পিটার ও সেন্ট জন এক পঙ্গুকে সুস্থ করেছিলেন। ডোম অব দি রক এখন টেম্পল হিসেবে পূজনীয় হয়ে ওঠল। তারা মনে করতে লাগল, এখানে যিশু তার সারা জীবন প্রার্থনা করেছেন। রকে তার পদাঙ্ক দেখা যেত। ক্রুসেডারদের উপাসনাব্যবস্থায় হারাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।১৯ তাদের সব গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ‘টেম্পল অব দি লর্ডে’ শোভাযাত্রা অন্তর্ভুক্ত থাকত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাম সানডে উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ স্থানটিই। নগরীর ধর্মীয় জীবনে আরেকটি পরিবর্তন এসেছিল। তা হলো প্যাসনের অনেক স্থান, যা আগে মাউন্ট সায়নে ছিল, এখন শহরে উত্তরে সরে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে সাইউলফ দেখেছিলেন, যে স্তম্ভের যিশুকে চাবকানো হয়েছিল, সেটি এখন মাউন্ট সায়নের বদলে হলি সেপালচার চার্চে অবস্থিত। তীর্থযাত্রীরা ভাবতে শুরু করেছিল প্রায়েটোরিয়াম (পিলেত যেখানে যিশুকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন) অ্যান্টোনিয়া দুর্গে অবস্থিত। আগে মনে করা হতো, স্থানটি টাইরাপোয়েন ভ্যালিতে অবস্থিত। এই পরিবর্তনে টেম্পলররা উদ্দীপ্ত হয়েছিল। তারা হয়তো চেয়েছিল এ পবিত্র স্থানটি তাদের জেরুসালেম এলাকার মধ্যে থাকুক। 

প্রথম ব্যান্ডউইন মারা যান ১১১৮ সালে। তার উত্তরসূরি হন তার কাজিন এডেসার কাউন্ট লে বার্গের ব্যান্ডউইন। তিনি ধার্মিক, সেইসাথে পরিবারবৎসল লোক ছিলেন। তিনি তার আর্মেনিয়ান স্ত্রী ও চার মেয়ের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। ব্যান্ডউইনই প্রথম রাজা হিসেবে বেথলেহেম ব্যাসিলিকার বদলে হলি সেপালচার চার্চে মুকুট পরেছিলেন। তিনি রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রা বের করেন। এসময় বেলকনি ও ছাদগুলো প্রাচ্যের কম্বলের সাথে ফেস্টুন শোভা পেয়েছিল। জেরুসালেমের প্যাট্রিয়ার্ক, বিশপ ও ল্যাতিন ও স্থানীয় পুরোহিতদের উপস্থিতিতে তিনি খ্রিস্টের সমাধির সামনে চার্চ, পাদ্রি, বিধবা ও এতিমদের রক্ষা করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। তিনি প্যাট্রিয়ার্কের অনুগত থাকার শপথও গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানের পর রাজা টেম্পল অব দি লর্ডের দিকে অগ্রসর হন। সেখানে তিনি তার মুকুটটি বেদীতে রাখেন। তারপর আকসায় নগরীর নাগরিকদের আয়োজিত ভোজসভায় অংশ নেন। ১১২০ সালে ব্যান্ডউইন তার আকসার বাড়ি খালি করে পুরো মসজিদটি টেম্পলারদের দিয়ে দেন। তিনি নগরদুর্গের কাছে নতুন একটি প্রাসাদে ওঠেন। এখানে তিনি ক্রুসেডার জেরুসালেমের আরো কাছাকাছি অবস্থান করতে থাকেন। 

ব্যান্ডউইন ১১২০ সালে নাবলুস কাউন্সিলে যোগ দেন। এটি ছিল অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের অনেকের স্থানীয় সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়া হ্রাস করার চেষ্টা। ক্রুসেড রাজত্বের প্রথম দিকে চারত্রেজের ফুলচার ইউরোপের লোকজনকে উদ্দীপ্তভাবে বলেছিলেন : ‘পাশ্চাত্যবাসীরা, আমরা প্রাচ্যের লোক হয়ে গেছি! গতকাল যারা ইতালিয়ান আর ফরাসি ছিল, আজ তারা বদলে গিয়ে গ্যালিলি আর ফিলিস্তিনি হয়ে গেছি।২০ তার এ মন্তব্য নিশ্চিতভাবেই অতিরঞ্জিত ছিল। তবে সময়ের পরিক্রমায় ফ্রাঙ্করা বদলে গিয়েছিল। একটি পুরো প্রজন্ম প্রাচ্যে জন্মগ্রহণ করেছিল। ইউরোপ নিয়ে তাদের কোনো স্মৃতি ছিল না। তারা নিয়মিত গোসল করত, যা পাশ্চাত্যে প্রায় অশ্রুতই ছিল; তারা কাঠের চালাঘরের বদলে বাড়িতে বাস করত, নরম পোশাক ও কেফিয়ে পরত। তাদের স্ত্রীরা মুসলিম নারীদের মতো বোরকা পরত। দেশ থেকে আসা তীর্থযাত্রীদের এটি কষ্ট দিত : ফিলিস্তিনের ফ্রাঙ্করা মনে হচ্ছে স্থানীয় হয়ে গেছে। স্থানীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করার কারণ হলো, জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে ইউরোপের চেয়ে ইসলামি বিশ্ব অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু রুঢ় প্রকৃতির এসব খ্রিস্টানের কাছে প্রাচ্যের ব্যবস্থা গ্রহণকে অবনতি ও জীর্ণ জীবনধারা মনে হতো। অনেক ফিলিস্তিনি ফ্রাঙ্ক বুঝতে পেরেছিল যে তাদেরকে টিকে থাকতে হলে তাদেরকে খাপ খাইয়ে নিতেই হবে। তাদেরকে মুসললিমদের সাথে বাণিজ্য করতে হবে, স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দ্বিতীয় ব্যান্ডউইন এমনকি জেরুসালেম থেকে ইহুদি ও মুসলিমদেরকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা পর্যন্ত অবলম্বন করেছিলেন। মুসলিমদেরকে এখন খাদ্য এনে নগরীতে বিক্রি করার, সীমিত সময়ের জন্য সেখানে থাকার অনুমতি দেওয়া হতো। ১১৭০ সাল নাগাদ একটি ইহুদি রঞ্জক পরিবার রাজপ্রাসাদের কাছে বসবাসও করছিল। 

কিন্তু এই একীভূত ছিল কৃত্রিম। ১১২০-এর দশকে বৈরী মুসলিমবিশ্বের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে ফ্রাঙ্করা তাদের রাজ্য ঘিরে পুরনো দুর্গগুলো ব্যবহারোপযোগী ও নতুন প্রাসাদের বৃত্ত তৈরি করতে থাকে। মালে আদুমিন, জেরিকো রোডের ওপর, হেবরন, বেথানি, নবি সামউইল, আল-বিরাহ ও রামাল্লায় জেরুসালেমকে ঘিরে সুরক্ষিত চার্চ ও মঠের সারি গড়ে ওঠতে থাকে। পাশ্চাত্য খ্রিস্টান ও ইসলামের মধ্যে বিরাজমান ঘৃণার প্রতিবন্ধকতা ক্রুসেডাররা না ভেঙে বরং তাদের প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে বিশাল বিশাল পাথুরে প্রাচীর নির্মাণ করতে থাকে। তাদের রাজ্যগুলো কৃত্রিম পাশ্চাত্য ছিটমহলে পরিণত হয়ে ওই অঞ্চলে পরদেশী ও অনিষ্টকর হিসেবে বিরাজ করতে থাকে। এগুলো ছিল আগ্রাসীভাবে ও অব্যাহতভাবে আক্রমণ শানাতে প্রস্তুত সামরিক রাজ্য। দ্বাদশ শতক ছিল ইউরোপের বিপুল সৃষ্টিশীলতার সময়। তবে ওই সৃষ্টিশীলতা ক্রুসেডার রাজ্যগুলোতে দেখা যায়নি। তাদের প্রধান উদ্ভাবন ছিল সামরিক গ্রুপ ও সামরিক স্থাপত্য। তাদের প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক আবেগ ছিল পাশ্চাত্যের আইন। ফ্রাঙ্করা কখনো নিকট প্রাচ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির খোঁজ করার সত্যিকারের কোনো চেষ্টা করেনি। ফলে সত্যিকারের কোনো শিকড়ের সন্ধান পায়নি। তাদের কর্মশক্তি কেন্দ্রীভূত ছিল টিকে থাকা নিয়ে এবং তারা যেসব সমাজ সৃষ্টি করেছিল, সেগুলো অনিবার্যভাবে ছিল তাদের আশপাশের অঞ্চলের বিরুদ্ধে কৃত্রিমভাবে সংরক্ষিত। 

অবশ্য ক্রুসেডাররা সৃষ্টিশীল হতে এবং তাদের জয় করা ভিন দেশে তাদের চিহ্ন রেখে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ১১২৫ সালে ফ্রাঙ্করা জেরুসালেমে ব্যাপক নির্মাণ কর্মসূচি শুরু করে। ফিলিস্তিনে তারা যত নির্মাণ করেছে, ততটা এমনকি হেরড ও করেননি। পবিত্র ভূমিতে ইউরোপ নির্মাণ করার মাধ্যমে তারা দেশকে অনুভব করার চেষ্টা করেছে। ফলে তাদের ভবন ও চার্চগুলোতে খুব কমই বায়েজান্টাইন বা মুসলিম চিহ্ন দেখা গেছে। আবার ক্রুসেডাররা ইউরোপের নতুন স্থাপত্য বিকাশ সম্পর্কেও অবগত ছিল না। তারা রোমানেসকিউ সময়ে আটকে থেকে যায়, গোথিকের স্পর্শ পায়নি, তাদের তৈরি ভবনগুলো ক্রুসেড আমলের আগে দেশে যে ধরনের ছিল, সে ধরনের দেখাতে থাকে। প্রথমে তারা বিশালভাবে হলি সেপালচার চার্চ পুনঃনির্মাণ করা শুরু করে। এটি ১১৪৯ সালে নগরী দখল করার পঞ্চাশতম বার্ষিকীর সময় সমাপ্ত হয়। তারপর তারা বাথ-হেসদা পুলের পাশে ভার্জিন মেরির মা সেন্ট আনাকে নিবেদন করে অনিন্দসুন্দর রোনাসেকিউ নির্মাণ করে। খ্রিস্টানেরা ষষ্ট শতক থেকে ভার্জিনের জন্মস্থান হিসেবে শ্রদ্ধা করছিল। এখন এটি বেনেডিকটাইন কনভেন্ট ও চার্চে পরিণত হয়েছে। তাদের নির্দয়তা ও ভীতি সত্ত্বেও ফ্রাঙ্করা তখনো আধ্যাত্মিকতার কিছুটা ধারণ করত। সেন্ট আনা চার্চে চোখটি সরাসরি উচ্চ বেদিতে টানা হয়েছে কেন্দ্র থেকে স্তম্ভের সারির মাধ্যমে; একেবারে সাদামাটার অর্থ হলো কোনো বিচ্যুতি ঘটবে না, তবে বিভিন্ন দিক থেকে চার্চে ফেলা আলো ছায়ার সূক্ষ্ম প্যাটার্ন ও দূরত্বের অনুভূতি সৃষ্টি করবে। 

ফ্রাঙ্করা কিদরন ভ্যালি ও মাউন্ট অলিভেসের গেথসেমেন ও ভার্জিন মেরি সমাধির চার্চাগুলোও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। এসব চার্চে ক্রুসেডাররা মঠ নির্মাণ করে, ফ্রেসকো ও মোজাইক দিয়ে ভূগর্ভস্থ কক্ষ সজ্জিত করে। গোলাকার অ্যাসেনসন চার্চও পুনঃনির্মাণ করা হয়, প্যারিসিয়ান মার্বেল দিকে সাজানো হয়। এ চার্চটিও ক্রুসেডারদের যুদ্ধ মেশিনের অংশে পরিণত হয়, তাদের যুধ্যমান ধর্মানুরাগ প্রতিফলিত করে। তীর্থযাত্রী থিওডোরিচ আমাদের বলছেন যে এটি ছিল ‘পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে ছোট বড় নানা টাওয়ার, প্রাচীর ও গুলিবর্ষণের ছিদ্র, নৈশ টহল-সজ্জিত শক্তিশালীভাবে সুরক্ষিত।২১ ৬১৪ সালে পারসিকরা ইলেয়না ব্যাসিলিকা ধ্বংস করেছিল। এটি আর কখনো পুনঃনির্মিত হয়নি। ক্রুসেডাররা এ স্থানে দুটি চার্চ নির্মাণ করে লর্ডস প্রেয়ারের যিশুর শিক্ষা ও শিষ্যদের প্রতি অ্যাপসলের ক্রিডের স্মরণে। হলি সায়নের ব্যাসিলিকাটি ধ্বংস করেছিলেন আল- হাকিম। এটি আর কখনো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন ক্রুসেডাররা কয়েকটি চার্চকে (চ্যাপেল অব স্টিফেন- ইউদোকিয়ার চার্চে স্থানান্তরের আগে এখানে শহিদের লাশ রাখা হয়েছিল, লাস্ট সাপারে আপার রুম এবং এর ঠিক পাশে থাকা চ্যাপেল অব পেন্টেকস্ট, আত্মার অবতরণের ছবি অঙ্কিত) ঘিরে ‘মাদার অব অল দি চার্চেস’ সংস্কার করে। মেঝের নিচে ছিল ‘গ্যালিলি চ্যাপেল’। এখানে পুনরুত্থানের পর এখানেই যিশু তাঁর শিষ্যদের সামনে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ২২ এ চ্যাপেলটি পুনঃগঠনের সময় ক্রুসেডাররা আবিষ্কার করে যে এখানে কিভাবে কাজ করতে হবে তা তারা জানে না। প্রাচীন প্রাচীরগুলোর একটি ধসে গেলে একটি গুহা বের হয়ে আসে। এতে একটি সোনার মুকুট ও একটি রাজদণ্ড পাওয়া যায়। বর্তমানে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে এটি সম্ভবত প্রাচীন কোনো সিনাগগ ছিল। মিস্ত্রি আতঙ্কে প্যাট্রিয়ার্কের কাছে ছুটে যায়। তিনি বিষয়টি নিয়ে কারাইত সন্ন্যাসীর সাথে পরামর্শ করেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন যে দাউদ ও জুদার রাজাদের সমাধির সন্ধান পাওয়া গেছে। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত লোকজন মাউন্ট সায়নকে ওফেল পাহাড়ে থাকা মূল ইর ডেভিডের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিল। দীর্ঘ দিন ধরে ধারণা করা হচ্ছিল যে পশ্চিম ফটকের পাশে থাকা দুর্গটি দাউদের দুর্গ এবং হেরডের হিপিকাস টাওয়ারটি সাধারণভাবে পরিচিত ছিল দাউদের টাওয়ার হিসেবে। ফলে সম্ভবত অনিবার্য ছিল যে একদিন কেউ মাউন্ট সায়নে তার সমাধিটি ‘আবিষ্কার’ করবে। গুহাটিতে অনুসন্ধান চালাতে চেয়েছিলেন প্যাট্রিয়ার্ক। কিন্তু মিস্ত্রিরা ছিল খুবই ভীত। এ কারণে প্যাট্রিয়ার্ক ‘স্থানটি বন্ধ করে আড়ালে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ইহুদি পর্যটক তুরেদার বেনিয়ামিন। তিনি ১১৭০ সালে জেরুসালেম গিয়েছিলেন। তার মতে, ‘এ কারণে বর্তমান সময়ে দাউদ ও জুদার রাজাদের সমাধির সন্ধান পাওয়া যায় না।২৩ অবশ্য পরে ক্রুসেডাররা দাউদের সমাধির সন্ধান পেয়েছিল। তখন তারা একে হলি সায়নের ব্যাসিলিকার অংশে পরিণত করেছিল। তবে পরে এ নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। 

দ্বিতীয় ব্যান্ডউইন মারা যান ১১৩১ সালে। তার উত্তরসূরী হন তার বড় মেয়ে মেলিসেন্দে ও তার স্বামী আনজুর কাউন্ট ফাল্ক। ফাল্ক ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তিনি মধ্য বয়সে জেরুসালেম রক্ষায় তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। রাজ্যের তখন একজন শক্তিশালী শাসকের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। কারণ প্রথমবারের মতো নিকট প্রাচ্যের ইতিহাসে একজন শক্তিশালী মুসলিম শাসকের আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি হলেন ইমাদ উদ্দিন জাঙ্গি। তিনি ছিলেন মসুল ও আলেপ্পোর তুর্কি কমান্ডার তিনি আমিরদের গৃহবিবাদে অশান্তিতে নিমজ্জিত এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। ধীরে ধীরে ও পরিকল্পিতভাবে জাঙ্গি সিরিয়া ও ইরাকের স্থানীয় গোষ্ঠীপতিদের বশ মানাতে থাকেন। বাগদাদের সমর্থন নিয়ে তিনি একে একে তাদেরকে তার কর্তৃত্বে নিয়ে আসেন। ফ্রাঙ্কদের দখলে থাকা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে জাঙ্গি বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন না। তার হাত তখন অবাধ্য মুসলিম আমিরে ভর্তি। তবে ফ্রাঙ্করা জাঙ্গির ক্রমবর্ধমান সাম্রাজ্যের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিল। ফাল্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরো ভালোভাবে রাজ্যের সীমান্তগুলো সুরক্ষিত করেন, ১১৩৭ সালে বেথ-গিবরিনের সীমান্ত প্রসাদে হসপিটালারদের গ্যারিসন করেন। ওই বছর তিনি দামাস্কাসের প্রিন্স উনারের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। এই নগরী যাতে জাঙ্গির সাম্রাজ্যে হজম হয়ে না যায়, সে ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন উনার। 

ক্রুসেডারদের যুধ্যমান ধর্মানুরাগ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা এমনটি দেখি ফ্রান্সের ক্রেসাকের টেম্পলার চার্চে। এর প্রাচীরগুলো পুরোপুরি এমনসব ফ্রাসকোতে পরিপূর্ণ, যাতে দেখা যাচ্ছে যে নাইটেরা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করতে জেরুসালেম যাচ্ছে। 

এই চুক্তির আলোচনায় অংশ নেওয়া কূটনীতিকদের একজন ছিলেন সিরিয়ার প্রিন্স উসামা ইবনে মুনদিক। চুক্তি সইয়ের পর তাকে ফ্রাঙ্কিশ ফিলিস্তিনে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি আমাদের জন্য তার স্মৃতিকথা রেখে গেছেন। এতে হঠাৎ করে মুসলিম অঞ্চলে এসে পড়া পাশ্চাত্যের লোকজন সম্পর্কে মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। পরিমার্জিত, অমায়িক উসামা ফ্রাঙ্কদের নিয়ে ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি তাদের শারীরিক সাহসের প্রশংসা করলেও তাদের সেকেলে চিকিৎসাব্যবস্থা, নারীদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ, তাদের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দেখে আতঙ্ক বোধ করেন। কোনো এক তীর্থযাত্রী উসামার ছেলেকে পাশ্চাত্যে পড়াশোনার জন্য ইউরোপে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিলেন। ফ্রাঙ্কদের দেশে থাকার চেয়ে তার ছেলে কারাগারেও ভালো থাকবে বলে তার মনে হয়েছিল। অবশ্য তবুও তিনি স্বীকার করেছেন যে প্রাচ্যে জন্মগ্রহণ করা ফ্রাঙ্করা নবাগতদের চেয়ে ভালো। তার মনে হয়েছে, নবাগতরা ইউরোপের আদি বদ্ধ সংস্কারে পরিপূর্ণ। তিনি নির্দেশনামূলক উদাহরণ দিয়ে তার অন্তর্দৃষ্টি তুলে ধরেছেন। তিনি জেরুসালেমের টেম্পলারদের সাথে বন্ধুত্ব গড়েছিলেন। তিনি যখনই আকসায় তাদের কাছে গেছেন, তারা তার নামাজের জন্য ছোট একটু জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। একদিন মক্কার দিকে মুখ করে নামাজ পড়ার সময় এক ফ্রাঙ্ক তার কক্ষে ছুটে এসে উসামাকে শূন্যে তুলে জোর করে তাকে পূর্ব দিকে মুখ করে দেয় : এদিকে মুখ করে প্রার্থনা করতে হয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন। টেম্পলাররা দ্রুত ছুটে এসে লোকটিকে সরিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু ‘তারা সরে যাওয়া মাত্র লোকটি আবারো একই কাজ করে। টেম্পলাররা লজ্জা পেয়ে ব্যাখ্যা করে বলে যে এই লোক বিদেশী; মাত্র আজই তার উত্তরের দেশ থেকে এখানে এসেছে। সে কখনো কাউকে পূর্ব দিক ছাড়া অন্য কোনো দিকে মুখ করে প্রার্থনা করতে দেখেনি। উসামা মর্যাদার সাথে নামাজ শেষ করে বলেন, আমি নামাজ শেষ করলাম। লোকটির মূর্খতায় আমি অবাক হয়ে গেলাম। কাউকে কিবলার দিকে মুখ করে নামাজ পড়তে থেকে সে একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল, কষ্ট পেয়েছিল। 

মা ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহণ করা ও এই কাহিনীতে থাকা টেম্পলারদের মতো যেসব ফ্রাঙ্ক মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করত ও তাদের প্রতিবেশীদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাইত এবং অন্য ধর্মের সাথে সহাবস্থানকে অসম্ভব বিরেচনাকারী ইউরোপ থেকে আসা নবাগতদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জেরুসালেম রাজ্য ক্রমবর্ধমান হারে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল। এই কোন্দল এমন একসময় বাড়ছিল যখন তাদের মুসলিম প্রতিবেশীরা অন্তত তাদের ধ্বংসাত্মক দলাদলি বাদ দিয়ে একজন শক্তিশালী নেতার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল। ১১৪৪ সালে ফ্রাঙ্করা এক আঘাত পায়। তারা যে কতটা অরক্ষিত, সেটিই এই আঘাত দেখিয়ে দেয়। ওই বছরের নভেম্বরে দামাস্কাসের বিরুদ্ধে অভিযানকালে জাঙ্গি ক্রুসেডারদের নগরী এডেসা জয় করে ফ্রাঙ্কিশ রাজ্যটি ধ্বংস করে দেন। মুসলিম বিশ্বে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। মদ্যপায়ী, নির্দয় যোদ্ধা জাঙ্গি হঠাৎ করেই ইসলামের বীর হিসেবে নিজেকে দেখতে পান। দুই বছর পর তিনি নিহত হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন তার ছেলে মাহমুদ। তিনি সাধারণভাবে তার নূর উদ্দিন (বিশ্বাসের আলো) পদবিতেই বেশি পরিচিত। নূর উদ্দিন ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ সুনি। তিনি ফ্রাঙ্ক ও শিল্পা উভয়ের বিরুদ্ধে জিহাদে নিয়োজিত থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি মুহাম্মদের (সা.) মিতব্যয়ী জীবনযাপন করতেন, গরিবদের বিপুল পরিমাণে অর্থ দান করতেন। তিনি জিহাদের জন্য কার্যকর প্রপাগান্ডা অভিযান করেছিলেন। পবিত্র কোরআন সব ধরনের যুদ্ধকে অপছন্দনীয় হিসেবে অভিহিত করে পরিহার করতে বলা হয়েছে, তবে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, দুঃখজনকভাবে, কিছু কিছু সময়ে সুস্থ মূল্যবোধগুলো রক্ষা করতে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রয়োজন পড়ে। যদি মানুষ হত্যা করা হয়, তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়, তাদের উপাসনার স্থান ধ্বংস করা হয়, তবে মুসলিমদের উচিত হবে আত্মরক্ষার্থে ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ করা।’ কোরআনের এই বিধিনিষেধ ক্রুসেডারদের ক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে প্রয়োগযোগ্য। তারা লাখ লাখ মুসলিমকে হত্যা করেছে, তাদেরকে তাদের বাড়িঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের মসজিদ জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারা আল-কুদসের হারামেরও অবমাননা করেছে। নূর উদ্দিন জেরুসালেমের প্রশংসাসূচক রচনা ফাজায়েল আল-কুদস প্রচার করেন, ফ্রাঙ্কদের কবল থেকে জেরুসালেম মুক্ত করার পর আকসা মসজিদে স্থাপনের জন্য একটি সুন্দর মিম্বার তৈরি করেন। 

জিহাদের চর্চা নিকট প্রাচ্যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। পাশ্চাত্য ক্রুসেডারদের নির্দয় আগ্রাসন সেটিকে আবার উদ্দীপ্ত করে। কিন্তু তাদের অনড় বদ্ধসংস্কারের কারণে নূর উদ্দিনের আবেদনে কার্যকর কোনো সাড়া মেলেনি। ১১৪৮ সালে দ্বিতীয় ক্রুসেডের সেনাবাহিনী যখন অবশেষে ফিলিস্তিনে অবতরণ করে, তখন চাপে থাকা ফ্রাঙ্করা স্বস্তি পায়। তবে তারা আলেপ্পোতে নূর উদ্দিনকে হামলা করার বদলে মুসলিমবিশ্বে তাদের একমাত্র মিত্র দামাস্কাসের উনারের বিরুদ্ধে এগিয়ে যায়। এর ফলে, উনারের কাছে নূর উদ্দিনের সহযোগিতা কামনা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প খোলা রইল না। ক্রুসেডাররা এরপর দামাস্কাস অবরোধে চূড়ান্ত ধরনের অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের মূর্খতায় নিমজ্জিত হয়। পরিণতিতে অপমানজক ব্যর্থতা বরণ করতে হয় তাদেরকে। দ্বিতীয় ক্রুসেড প্রমাণ করে যে ইসলামি বিশ্বের প্রতি ফ্রাঙ্কদের বৈরিতা তাদেরকে আত্মঘাতী দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই অঞ্চল থেকে তাদের নিঃসঙ্গতার আরেকটি অর্থ ছিল তারা নিকট প্রাচ্যের বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে পারেনি। 

দ্বিতীয় ক্রুসেডের ব্যর্থতা অবশ্যই ১১৪৯ সালের ১৫ জুলাই নগরী বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকীতে হলি সেপালচারের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত চার্চের উৎসর্গকে তিক্ত করেছিল। অনুষ্ঠানের পর লোকজন শোভাযাত্রা করে টেম্পল অব দি লর্ডে যায়, কিদরন ভ্যালি সফর করে। জেরুসালেম যুদ্ধে নিহত ক্রুসেডারদের এখানেই সমাহিত করা হয়েছিল। তাদের শোভাযাত্রা শেষ হয় উত্তর প্রান্তের প্রাচীরের মোড়ে। এখান দিয়েই ১০৯৯ সালে গডফ্রের সৈন্যরা নগরীতে প্রবেশ করেছিল। সাম্প্রতিক ব্যর্থতার সাথে তুলনা অবশ্যই বেদনাদায়ক হয়েছিল। অবশ্য নতুন চার্চটি হয়েছিল বিরাট কিছু। ক্রুসেডাররা সেখানকার সব ভগ্ন উপাসনালয়কে এক বিশালাকার রোমানেস্ক ভবনের মধ্যে এনেছিল। এসবের মধ্যে ছিল খ্রিস্টের কবর, গলগোথার টিলা ও যে ভূগর্ভস্থ কক্ষে হেলেনা ট্রু ক্রুসটি পেয়েছিলেন বলে ধরা হয় সেটি। (দেখুন ডায়াগ্রাম।) তারা একাদশ শতকে কনস্টানটাইন মোনোমারচুসের বানানো রোতানদাকেও তাদের নতুন চার্চের ভেতরে নিয়ে এসেছিল। পুরনো আঙিনার স্থানে এ স্থাপনাটি একটি উঁচু বড় খিলানের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়েছিল I পাশ্চাত্যের স্থাপত্য যদিও বায়েজান্টাইনের সাথে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করেনি, স্থানীয় স্টাইলের সাথে সমন্বয় সাধনের ক্রুসেডাদের প্রয়াস ছিল এমন এক কৃতিত্ব যা তারা জীবনে অর্জন করতে পারেনি। সমাধির যা অবশিষ্ট ছিল তা একটি মার্বেল স্ল্যাব দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। পরে এতে সোনার একটি আবরণ দেওয়া হয়। মোজাইক ও রঙিন মার্বেলের স্ল্যাবে প্রাচীরগুলো এমনভাবে সাজানো হয় যে তা হয়ে পড়ে দুর্দান্ত ও রাজসিক। বর্তমানের স্বল্পালোকিত ভবনে এর জাঁকজমকতা কল্পনা করা কঠিন। 

নূর উদ্দিন তার অভিযান অব্যাহত রাখেন। তার পরিকল্পনা ছিল জিহাদে নিবেদিত একটি মুসলিম সাম্রাজ্যের মাধ্যমে ফ্রাঙ্কদের ঘিরে ফেলা। তবে জেরুসালেম রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। মনে হতে থাকে ক্রুসেডার রাজ্যগুলোর জীবনের প্রতিটি বিভাগে থাকা আগ্রাসন তাদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে তাড়া করতে থাকে। ১১৫২ সালে তরুণ রাজা তৃতীয় ব্যান্ডউইন তার মা মেলিসিন্দের সাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েন। মেলিসিন্দে তার ছেলের বিরুদ্ধে জেরুসালেমকে সুরক্ষিত করতে থাকেন। গৃহযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠতে থাকায় জেরুসালেমের নাগরিকেরা মেলিসিন্দকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। টেম্পলার ও হসপিটালাররাও সহিংস বিরোধিতায় মত্ত হয়ে ওঠে। তাদের কেউই রাজা ও প্যাট্রিয়ার্কের কাছে আনুগত্য স্বীকার করেনি। হসপিটালাররা তাদের কমপ্লেক্সে একটি টাওয়ার নির্মাণ করে। এটি হলি সেপালচারের চেয়ে উঁচু ছিল। এটি ছিল পরিকল্পিতভাবে একটি অবমাননা ও অবাধ্যতামূলক কাজ। তারা হলি সেপালচারের উপাসনা কার্যক্রমও ভণ্ডুল করে দিচ্ছিল। টায়ারের উইলিয়াম আমাদের বলেন যে প্যাট্রিয়ার্ক বক্তৃতা দিতে উঠামাত্র তারা ‘তাদের বিশাল বিশাল ঘণ্টাগুলো অব্যাহতভাবে প্রচণ্ড শব্দে বাজাতে থাকত যাতে প্যাট্রিয়ার্কের কন্ঠস্বর হট্টগোলে শোনাই না যায়। প্যাট্রিয়ার্ক তাদের কাছে জোরালো প্রতিবাদ জানালে তারা তীব্রবেগে হলি সেপালচারে ছুটে গিয়ে তীরের বন্যা বইয়ে দেয়। ২৬ স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে, পবিত্র নগরীতে বসবাস করা সত্ত্বেও কোনোভাবেই ক্রুসেডারদেরকে ভালোবাসা ও মানবিকতার খ্রিস্টের মূল্যবোধ অনুসরণ করতে উদ্দীপ্ত করেনি।এটা। 

রাজ্যটির প্রাণঘাতী অনৈক্য তিক্ত পরিণতির দিকে যেতে থাকে, খ্রিস্টানেরা তুচ্ছ বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে শক্তি ক্ষয় করতে থাকে। নূর উদ্দিন যাতে ফাতেমি মিসর জয় করতে না পারেন, সেজন্য ফ্রাঙ্করা আগেই সেটি দখল করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু কুর্দি জেনারেল শিরকুহ সেটি জয় করলে ক্রুসেডারদের উদ্যোগ ভণ্ডুল হয়ে যায়। তার ভাইয়ের ছেলে ইউসুফ বিন আইয়ুব ১৯৭০ সালে উজির হিসেবে শিরকুহর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি শিয়া খিলাফত বিলুপ্ত করেন। পাশ্চাত্যের কাছে ইউসুফ পরিচিত হয়েছিলেন তার পদবি সালাহ উদ্দিন (বিশ্বাসের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থেকে আসা সালাদিন নামে। তিনি জিহাদের প্রতি আবেগপূর্ণভাবে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নূর উদ্দিন নয়, তার নিয়তিতেই রয়েছে জেরুসালেম মুক্ত করা। এটিই তার প্রভুর সাথে তাকে সাংঘর্ষিক অবস্থানে এনে দেয়। ১১৭৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নূর উদ্দিন ইন্তিকাল করেন। সালাহউদ্দিন তার সাম্রাজ্যের নেতৃত্ব লাভের জন্য তার ছেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তার ক্যারিশমা, দয়ালুচিত্ত, স্পষ্ট ধার্মিকতা মুসলিমদের সমর্থন এনে দেয় তাকে। ১০ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান মুসলিম নগরীর বেশির ভাগই তার নেতৃত্ব স্বীকার করে নেয়। ক্রুসেডাররা একজন নিবেদিতপ্রাণ ও ক্যারিশমেটিক সুলতানের নেতৃত্বে তাদের রাজ্য ধ্বংস সাধনে আন্তরিক একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সাম্রাজ্যে নিজেদের ঘেরাও অবস্থায় দেখতে পেল। 

এমনকি এই নিশ্চিত হুমকির মুখেও ফ্রাঙ্করা নিজেদের মধ্যে বিবাদ চালাতে থাকল। যখন খুব বেশি প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী নেতৃত্বের, তখন তাদের তরুণ রাজা চতুর্থ ব্যান্ডউইন কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। রাজ্যের ব্যারনরা রাজ- প্রতিভূ ত্রিপলির কাউন্ট রেমন্ডকে সমর্থন করেন। তিনি বুঝতেন যে সালাহউদ্দিনকে শান্ত করার একমাত্র আশা নিহিত রয়েছে তাদের মুসলিম প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে। অবশ্য তাদের বিরোধিতা করতেন একদল নবাগত। তারা রাজপরিবারের আশপাশে নিজেদের জড়ো করে পরিকল্পিতভাবে উস্কানিমূলক নীতি অনুসরণ করে। এসব যুদ্ধবাজের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিলেন চ্যাটিলনের রেনল্ড। তিনি সালাহউদ্দিনের সাথে করা রেমন্ডের প্রতিটি চুক্তি লঙ্ঘন করেছিলেন মুসলিম কাফেলায় হামলা চালিয়ে। তিনি অন্তত দুবার (অসফলভাবে) মক্কা ও ‘মদিনায় হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। রেনল্ডের কাছে ইসলামের প্রতি ঘৃণা ও মুসলিমবিশ্বের প্রতি চরম বিরোধিতাই ছিল একটি ঐশী কর্তব্য ও একমাত্র সত্যিকারের দেশপ্রেম। রাজ্যটির আধ্যাত্মিক নেতৃত্বেরও অভাব ছিল। আরেক নবাগত প্যাট্রিয়ার্ক হেরাক্লিয়াস ছিলেন নিরক্ষর ও স্বাভাবিক কাজ করতে অক্ষম। তিনি আবার তার মিস্ট্রেসের প্রতি প্রকাশ্যে অনুরাগ প্রকাশ করতেন। ১১৮৫ সালের মার্চে ‘কুষ্ঠু রাজার’ মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন তার শিশু ছেলে ৫ম ব্যান্ডউইন। তিনিও এক বছর পর মারা যান। তখন উত্তরাধিকারী নিয়ে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে সালাহউদ্দিন দেশটি আক্রমণ করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। রেনাল্ড আবারো যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেন। অথচ ওই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে রেমন্ড রাজ্যে দম ফেলার অবকাশ সৃষ্টি করেছিলেন। ব্যারনরা কুষ্ঠু রাজার ভগ্নিপতি লুসিগন্যানের গাইকে তাদের রাজা হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ লোকটি তাদের রাজা হিসেবে ছিলেন দুর্বল ও অকার্যকর নবাগত। তবে তারা তখনো তীব্রভাবে বিভক্ত ছিল। ১১৮৭ সালে গ্যালিলিতে সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পুরো সেনাবাহিনী যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনো তাদের মধ্যে বিবাদ ও বিরোধ চলছিল। যুদ্ধবাজ দলটি রাজা গাইকে অনেক শক্তিশালী হিসেবে তুলে ধরে তাকে মুসলিমদের আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে, এমনকি যদিও রেমন্ড তাগিদ দিচ্ছিলেন যে অপেক্ষা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তখন ছিল ফসল তোলার মওসুম। সালাহউদ্দিন তখন তার বিশাল বাহিনীকে আর বেশি দিন বিদেশে মাটিতে রাখতে পারবেন না। কিন্তু গাই এই স্পর্শকাতর উপদেশে কান দিলেন না। তিনি এগিয়ে গিয়ে হামলার নির্দেশ দিলেন। ফলাফল ছিল তাইবেরিয়াসের কাছে হিত্তিনের যুদ্ধে মুসলিমদের বিপুল বিজয়। জেরুসালেমের খ্রিস্টান রাজ্য হেরে গেল। 

হিত্তিনের পর সালাহউদ্দিন ও তা সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনজুড়ে অগ্রসর হতে থাকে, একটির পর একটি শহর তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে থাকে। যেসব খ্রিস্টান বেঁচে গিয়েছিল, তারা টায়ারে আশ্রয় নেয়। তবে পবিত্র নগরী রক্ষার বেপরোয়া চেষ্টায় কিছু লোক জেরুসালেমেও গিয়েছিল। সবশেষে মুসলিম সেনাবাহিনী মাউন্ট অলিভেসের ওপর শিবির স্থাপন করে। সালাহউদ্দিন ওপর থেকে হারামের ওপর থাকা অপবিত্র উপাসনাগাহ আর ডোম অব দি রকের উপরের ক্রশটির দিকে তাকালেন। তিনি তার অফিসারদের উদ্দেশে খুতবা দিলেন, ফাজায়েল আল-কুদসের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন : জেরুসালেম হলো টেম্পলের নগরী, নবীদের নগরী, ইশরা ও মিরাজের নগরী, হাশর ময়দানের নগরী। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, ১০৯৯ সালের গণহত্যার বদলা নেওয়া তার কর্তব্য এবং তিনি অধিবাসীদের প্রতি কোনো করুণা না দেখাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। নগরীর ভেতরে থাকা খ্রিস্টানেরা ভীত হয়ে পড়ল। কার্যকর প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করার মতো কোনো নাইট ছিল না। তখন প্রখ্যাত ব্যারন ইবেলিনের ব্যালিয়ান উপস্থিত হলেন। মনে হলো তাদের প্রার্থনায় সাড়া পাওয়া গেছে। তিনি সালাহউদ্দিনের অনুমতি নিয়ে তার স্ত্রী ও পরিবারকে টায়ারে নিয়ে যেতে সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি মাত্র একটি রাত জেরুসালেমে ব্যয় করার সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু অবরুদ্ধ খ্রিস্টানদের দুর্দশা দেখে তিনি সুলতানের কাছে ফিরে গিয়ে তাকে তার শপথ থেকে মুক্তি দিয়ে অনুরোধ করেন। ব্যালিয়ানকে সম্মান করতেন সালাহউদ্দিন। তিনি সম্মত হলেন, তার পরিবার ও তাদের সব সম্পদ উপকূলে নিরাপদে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি রক্ষী দল পাঠিয়ে দেন। 

ব্যালিয়ান তার সামান্য সম্পদ নিয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার কাজ ছিল হতাশায় ভরা। ১১৮৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সালাহউদ্দিন নগরীর পশ্চিম গেট দিয়ে আক্রমণ শুরু করেন, তার প্রকৌশল বাহিনী সেন্ট স্টিফেন গেটের কাছে উত্তর দিকের প্রাচীরের ভিতে গর্ত খুঁজে ধসিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে। তিন দিন পর ‘গডফ্রেস ক্রস’সহ দেয়ালের একটি পুরো অংশ পরিখায় পড়ে যায়। তবে মুসলিমদেরকে ভেতরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মুখোমুখি হতে হলো এখন। ব্যালিয়ান অবশ্য শান্তির আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রথমে সালাহউদ্দিন করুণা করতে রাজি হননি। তিনি ব্যালিয়ানকে বলেছিলেন, [জেরুসালেম] দখল করার সময় আপনারা লোকজনের সাথে যেমন আচরণ করেছিলেন, আমরা ঠিক তেমনই করব- খুন করে, ক্রীতদাস বানিয়ে ও অন্যান্য বর্বরতার মাধ্যমে। ২৭ তবে ব্যালিয়ান মরিয়া আবেদন করেন। একবার সব আশা শেষ হয়ে গেলে খ্রিস্টানেরা হারাবার আর কিছু পাবে না। তারা তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করবে, তাদের বাড়িঘর ও সম্পত্তি জ্বালিয়ে দেবে, সালাহউদ্দিনের সেনাবাহিনী আসার আগেই ডোম অব দি রক আর আল-আকসা গুঁড়িয়ে দেবে, তাদের প্রত্যেকে মারা যাওয়ার আগে একজন করে মুসলিমকে হত্যা করবে। সালাহউদ্দিন তার আলেমদের সাথে পরামর্শ করে শান্তিপূর্ণভাবে নগরী গ্রহণ করতে রাজি হলেন। তবে ফ্রাঙ্করা কোনোভাবেই নগরীতে অবস্থান করতে পারবে না। তারা তার বন্দি হবে। অবশ্য একেবারে সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে তারা মুক্তি পেতে পারে। 

মুসলিমেরা ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর যখন নবীর মিরাজ ও ইশরা উদযাপন করছিল তখন সালাহউদ্দিন ও তার সৈন্যরা বিজয়ী বেশে জেরুসালেমে প্রবেশ করলেন। সুলতান তার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। একজন খ্রিস্টানকেও হত্যা করা হয়নি। ব্যারনেরা সহজেই তাদের মুক্তিপণ আদায় করেছিল, তবে গরিব মানুষেরা পারেনি। তারা যুদ্ধবন্দি হয়। অবশ্য বিপুলসংখ্যককে মুক্তি দেওয়া হয়। কারণ দাসত্বের কারণে আলাদা হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর দুর্দশা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন সালাহউদ্দিন। সালাহউদ্দিনের ভাই আল-আদিলও এত বিষণ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে তার নিজের ব্যবহারের জন্য রাখা এক হাজার বন্দিকে তিনি সাথে সাথে মুক্ত করে দেন। প্রতিটি মুসলিম কল্পনাতীত কষ্ট পেয়েছিলেন এটি দেখে যে ধনী খ্রিস্টানেরা তাদের স্বদেশী লোকদের মুক্তিপণ দেওয়ার কোনো চেষ্টা না করেই তাদের ধন-সম্পদ নিয়ে পালাচ্ছে। মুসলিম ইতিহাসবিদ ইমাদ উদ্দিন যখন দেখলেন যে প্যাট্রিয়ার্ক হেরাক্লিয়াসের গাড়ির ঘোড়াগুলো তার সম্পদের ভারে গোঙাচ্ছে, তখন তিনি সালাহউদ্দিনের সাথে অনুনয় করেছিলেন ওইসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে বাকি বন্দিদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সালাহউদ্দিন তা করতে অস্বীকার করেন এই যুক্তিতে যে শপথ ও চুক্তি অবশ্যই আক্ষরিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। খ্রিস্টানেরা সব খানে তাদের প্রতি দেখানো দয়ার কথা স্মরণ করবে। ২৮ সালাহউদ্দিন ঠিক কথাই বলেছিলেন। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানেরা অস্বস্তিকরভাবে অবগত ছিলেন যে তাদের নিজস্ব ক্রুসেডারেরা যখন জেরুসালেম জয়ের সময় যা করেছিল এই শাসক তাদের সাথে তার চেয়ে অনেক বেশি ‘খ্রিস্টান’ আচরণ করেছেন। তারা নানা কিংবদন্তি সৃষ্টি করে যা সালাহউদ্দিনকে এক ধরনের সম্মানজনক খ্রিস্টানে পরিণত করে; এসব কাহিনীর কোনো কোনোটিতে এমনকি এমন কথাও জোর দিয়ে বলা হয় যে সালাহউদ্দিন গোপনে ব্যাপ্তাইজ হয়েছিলেন। জেরুসালেমে ক্রুসেড অভিজ্ঞতা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিমেরা সহাবস্থান ও আল-কুদসের একীভূতকরণের পুরনো ব্যবস্থাটি আবার সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ক্রুসেডার শাসনের সহিংস অসন্তোষ ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার সম্পর্ক মৌলিক পর্যায়ে নষ্ট করে দিয়েছিল। পাশ্চাত্য বিশ্বের ব্যাপারে এটি ছিল মুসলিমদের প্রথম অভিজ্ঞতা। আর তা বর্তমান সময়েও বিস্মৃত হওয়া সম্ভব হয়নি। ক্রুসেডারদের হাতে তাদের দুর্ভোগও পবিত্র নগরী সম্পর্কে মুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এরপর থেকে আল-কুদসের প্রতি তাদের ভক্তি আত্মরক্ষামূলক হয়ে পড়ে। ফলে এটি এখন থেকে আরো আগ্রাসী ইসলামি নগরীতে পরিণত হয়ে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *