১৪. জিহাদ

১৪. জিহাদ 

ফরাসিরা জেরুসালেম ত্যাগ করা মাত্র মুসলিমরা নগরীর চারপাশ ঘুরে ক্রুসেডারদের জেরুসালেমের জাঁকজমক দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। অনেক দিক থেকেই এটি ছিল বাড়ি ফেরার মতো। সালাউদ্দিন ক্রুসেডার জেরুসালেমের কেন্দ্রে অবস্থিত হাসপিটালে সিংহাসনে বসে আমির, সুফি ও আলেমদের স্বাগত জানান। তার মুখ তখন ছিল উজ্জ্বল, জানাচ্ছেন ইমাদ-উদ-দিন। কবি ও পবিত্র কোরআনের হাফেজরা তার প্রশংসা করে কবিতা আবৃতি করছিলেন, অন্যরা প্রচণ্ড আনন্দে কাঁদতে শুরু করছিলেন। তবে মুসলিমরা জানত, নগরী জয়ের মাধ্যমেই জেরুসালেমের জন্য জিহাদ শেষ হয়ে যায়নি। জিহাদ শব্দের অর্থ কেবল ‘পবিত্র যুদ্ধ’ নয়। এর মূল অর্থ ‘সংগ্রাম’ এবং পবিত্র কোরআনে প্রধানত এই অর্থেই তা ব্যবহৃত হয়েছে। মুসলিমদেরকে ত্রুটিযুক্ত, বিয়োগান্ত বিশ্বে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রয়াসের জন্য জীবনকে তৈরি করতে ‘আল্লাহর পথে সংগ্রাম’ করতে বলা হয়েছে। যুদ্ধ থেকে ফিরে একটি বিখ্যাত বিখ্যাত হাদিসে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন : ‘আমরা এখন ছোট জিহাদ থেকে আরো বড় জিহাদে ফিরে এসেছি।’ অর্থাৎ নিজের হৃদয়ে নিজের সমাজ ও সততায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আরো গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। সালাউদ্দিন পবিত্র কোরআনের আদর্শ অনুযায়ী জিহাদ পরিচালনা করেছিলেন : ক্রুসেডাররা যখনই চাইত, তিনি সবসময় যুদ্ধবিরতি মঞ্জুর করতেন; বেশির ভাগ সময়ই বন্দিদের সাথে ন্যায়সঙ্গত ও দয়ালু আচরণ করতেন। তিনি বিপুল জয়ের সময়ও মানবিক আচরণ করতেন। বস্তুত অনেক মুসলিম ইতিহাসবিদ বিশ্বাস করেন, তিনি একটি ভুল করে ফেলেছিলেন। তিনি টায়ারে খ্রিস্টানদের জমায়েত হতে সুযোগ দেওয়ায় তারা ফিলিস্তিনে পা রাখার জায়গা ধরে রেখেছিল। ফলে সঙ্ঘাতটি আরো এক শ’ বছর চলতে পেরেছিল। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম রিচার্ড ও ফ্রান্সের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের নেতৃত্বে তৃতীয় ক্রুসেডে জেরুসালেম পুনর্ভয়ে ব্যর্থ হলেও জাফা থেকে বৈরুত পর্যন্ত বিস্তৃত উপকূলীয় এলাকায় একটি সরু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল ফ্রাঙ্করা। তাদের রাজধানী ছিল অ্যাকর। এর শাসকেরা খুবই যত্নের সাথে নিজেদের জেরুসালেমের রাজা হিসেবে অভিহিত করতেন। ক্রুসেডার স্বপ্ন শুকিয়ে যায়নি। ফ্রাঙ্করা যত দিন ফিলিস্তিনে ছিল, মুসলিমরা তত দিন উদ্বিগ্ন ও রক্ষণাত্মক ছিল। 

তবে ১১৮৭ সালে মুসলিম আশা ছিল বিপুল। সালাউদ্দিন জানতেন, জেরুসালেমকে আবারো সত্যিকারের মুসলিম নগরীতে পরিণত করতে হলে তাকে ভিন্ন ধরনের জিহাদে অংশ নিতে হবে। প্রথম দায়িত্ব ছিল হারামকে পরিশুদ্ধ করা। টেম্পলারদের ল্যাট্রিন ও ফার্নিচারগুলো অপসারণ করে আল আকসা মসজিদকে জুমার নামাজের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। কাবাঘরের দিক নির্দেশকারী অংশ তৈরি করতে হবে। টেম্পলারদের তোলা ভেতরের দেয়ালগুলো ভেঙ্গে মেঝকে কার্পেট দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। কয়েক বছর আগে নূরউদ্দিন যে মিম্বার তৈরি করেছিলেন, সেটি দামাস্কাস থেকে এনে স্থাপন করা হলো। ডোম অব দি রকের (কুব্বাতুল সাখরা) ছবি ও মূর্তিগুলো সরানো হলো, কোরআনের খোদাইলিপি প্রকাশিত হলো, রককে ঢেকে রাখা মার্বেল কেসিং সরিয়ে দেওয়া হলো। মুসলিম ইতিহাসলেখকেরা আমাদের জানাচ্ছেন, উমরের মতো সালাউদ্দিনও সারা দিন তার লোকজনের সাথে কাজ করেছিলেন, আঙিনাগুলো ধুয়ে-মুছে সাফ করেন, হারামের পথ চলাচলের স্থানগুলো গোলাপ-পানি দিয়ে পরিষ্কার করেন, গরিবদের সহায়তা করেন। ১০৯৯ সালের পর প্রথমবারের মতো শুক্রবার, ৪ শাবান নামাজিতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল আল আকসা। জেরুসালেমের কাজি মহিউদ্দিন আল কোরেশি যখন নতুন মিম্বারে উঠেন, তখন লোকজন আবেগে কাঁদতে থাকেন। 

ক্রুসেডের আগে মুসলিম জেরুসালেম মোটামুটিভাবে হারাম এলাকা ও আশপাশের ভবনরাজি নিয়ে গঠিত ছিল। কিন্তু সালাউদ্দিনের নতুন ভবন নির্মাণের জিহাদ অনুযায়ী খ্রিস্টান মানচিত্রের ওপর স্থান পেল মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলো I আবারো বিজেতাদের হাতে আদর্শিক অস্ত্রে পরিণত হলো নির্মাণকাজ। গুরুত্বপূর্ণ একটি মুসলিম স্থাপনা-সংবলিত খ্রিস্টান প্রাধান্যপূর্ণ নগরীর বদলে জেরুসালেম নিশ্চিতভাবেই হয়ে ওঠেছিল মুসলিম নগরী। খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি নতুন বৈরিতার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। হলি সেপালচারের পাশে থাকা প্যাট্রিয়াকের বাসভবন বাজেয়াপ্ত করেছিলেন সালাহউদ্দিন, রাষ্ট্রীয় তহবিলে কনভেন্ট ও সেন্ট আনার চার্চ সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি এসব ভবনকে মসজিদে রূপান্তরিত করেননি। শিয়াদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের অংশ হিসেবে নূরউদ্দিন ও সালাহউদ্দিন উভয়েই তাদের দখল করা প্রতিটি নগরীতে সুফি খানকাহ ও উচ্চতর মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন। প্রখ্যাত সাধক ইমাম আল-গাজ্জালির পারিকল্পনায় সংস্কার করা সুন্নায় এগুলোই ছিল প্রধান প্রতিষ্ঠান। তিনি নিজেও প্রথম ক্রুসেডের সামান্য আগে গেট অব মার্সির ওপরে থাকা সুফি খানকায় বাস করতেন। এখন সালাহউদ্দিন সেন্ট আনা চার্চকে মুসজিদে রূপান্তরিত করলেন। আর এর পাশে থাকা কনভেন্টকে করা হয় মাদরাসায়, প্যাট্রিয়ার্কের বাসভবন পরিণত হয় খানকায়। উভয় প্রতিষ্ঠান ওয়াকফ করে দেন সুলতান, তাতে তার নামও অঙ্কিত ছিল। একেবারে শুরুর সময় থেকেই জেরুসালেমে সুফিরা ছিলেন। তবে এখন সালাউদ্দিন জোর দিয়ে বললেন, তার নতুন খানকায় সুফিরা কোনোভাবেই স্থানীয় বাসিন্দা হতে পারবেন না। তা হলে তারা শিয়াদের দিয়ে কলুষিত হয়ে থাকতে পারেন। তাদেরকে সুন্নি মূলভূমি থেকে আসতে হবে। 

সুফি ও বিদ্বজনেরা এসব নতুন প্রতিষ্ঠানে বাস করার জন্য আসতেন। আলেমরা আসতেন হারামে দায়িত্ব পালন করার জন্য। জেরুসালেম জয়ের পর দীর্ঘ সময় শত্রুদের দখলে থাকা নগরীটি দেখার জন্য হাজার হাজার লোক পরিদর্শনে আসে। নগরীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া ও নতুন গভর্নর নিযুক্ত করার আগে পর্যন্ত তিনি মাউন্ট অব অলিভেসে খাটানো ক্যাম্পেই অবস্থান করেন। দুর্গে একটি সেনা ছাউনি স্থাপন করা হয়। তারপর সালাহউদ্দিন দামাস্কাস ফিরে যান তৃতীয় ক্রুসেডের জন্য মুসলিমদের তৈরির কাজে। সৈন্য ও বেসামরিক আমলারা সাবেক প্যাট্রিয়ার্কের কোয়ার্টারে বসতি স্থাপন করে। জয়ের অল্প সময়ের মধ্যেই উত্তর আফ্রিকা থেকে মুসলিমরা আল-কুদসে আসতে শুরু করেছিল। তারা বারবার গোত্রগুলোর হাতে উৎখাত হয়েছিল। এই মাগরেবি মুসলিমরা হারামের উত্তর-পশ্চিম দিকে বসতি স্থাপন করে। তারা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্য বহাল রেখেছিল। তাদেরকে টেম্পলারদের ভোজনকক্ষকে তাদের নিজস্ব মসজিদে রূপান্তরিত করার অনুমতি দেওয়া হয়। আর মাগরেবি কোয়ার্টার পরিণত হয় জেরুসালেমের নতুন বৈশিষ্ট্য। তবে সালাহউদ্দিন খ্রিস্টান ও ইহুদিদের নগরী থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে চাননি : একীকরণ ও সহাবস্থানের পুরনো রীতি বহাল থাকে। কয়েক হাজার সিরিয়ান ও আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান জিম্মি হিসেবে থেকে যাওয়ার অনুমতি চায়। সালাউদ্দিন গ্রিক অর্থোডক্সকে হলি সেপালচার চার্চের অভিভাবক নিযুক্ত করেন। এসব স্থানীয় খ্রিস্টানকে ইউরোপিয়ান ক্রুসেডারদের জন্য দোষারোপ করা যেত না। হলি সেপালচার এখন নতুন নতুন ইসলামি ভবনে ঘিরে থাকল। সালাহউদ্দিন গভর্নরের বাসবভন, একটি হাসপাতাল, একটি মসজিদের জন্য হসপিটালের বিশাল একটি অংশগ্রহণ করেন। এগুলো ওয়াকফ করেন তার ছেলে আফজাল। দুর্গেও একটি নতুন মসজিদ ছিল। এটি দাউদ নবীকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। খ্রিস্টান পবিত্র স্থানটির চার দিকে এখন অনেক মিনার শোভা পাচ্ছিল। প্যাট্রিয়ার্কস কোয়ার্টারের রাস্তাগুলো দিয়ে নামাজের আজান প্রতিধ্বনিত হতো। কয়েকজন আমির চেয়েছিলেন হলি সেপালচারই গুঁড়িয়ে দিতে। কিন্তু সালাহউদ্দিন তাদের অভিমত না শুনে তার অধিকতর বিজ্ঞ অফিসারদের- তাদের মতে এটি চার্চ নয়, বরং খ্রিস্টানদের ঐশী স্থান- সাথে একমত হন। তৃতীয় ক্রুসেডের পর এমনকি ইউরোপের ল্যাতিন তীর্থযাত্রীদেরও জেরুসালেমে তীর্থযাত্রা করার অনুমতি দেওয়া হতো। 

সালাহউদ্দিন ইহুদিদেরও জেরুসালেমে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ক্রুসেডাররা তাদের প্রায় পুরোপুরি উচ্ছেদ করে দিয়েছিল। ইহুদি বিশ্বজুড়ে সালাহউদ্দিনকে নতুন সাইরাস হিসেবে প্রশংসা করা হলো। ক্রুসেড কেবল মুসলিম বিশ্বেই নতুন জিহাদকে উদ্বুদ্ধ করেনি। ক্রুসেডের ফলেই ইউরোপের ও ইসলামি সাম্রাজ্যের ইহুদিদের মধ্যে নতুন ধরনের ইহুদিবাদের বিকাশ ঘটে। এই নতুন ধর্মীয় জায়নবাদের প্রথম প্রবল আবেগ সৃষ্টি হয়েছিল দ্বাদশ শতকের প্রথম দিকে টোলেদান চিকিৎসক জুদা হ্যালেভি মুসলিম স্পেন ও খ্রিস্টান ভূখণ্ডের পুনর্দখলে খ্রিস্টানদের যুদ্ধের ক্রসফায়ারে পড়ে গিয়েছিলেন। স্থানচ্যুতির এই অভিজ্ঞতার ফলে তার মনে ধারণা জন্মে যে ইহুদিদের অবশ্যই তাদের পিতৃপুরুষদের ভূমিতে ফিরে যেতে হবে। বিশ্বে এটিই তাদের সত্যিকারের স্থান। পবিত্র ভূমি বর্তমানে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইরত খ্রিস্টান বা মুসলিমদের নয়। ইহুদিদের অবশ্যই ফিলিস্তিন ও পবিত্র নগরী নিয়ে তাদের দাবি জানাতে হবে। জেরুসালেম হলো পৃথিবীর কেন্দ্রে। এখানে নশ্বর দুনিয়া ঐশী সত্তার কাছে উন্মুক্ত হয়। ডেভিরের স্থানেও ওপরে থাকা গেট অব হেভেন দিয়ে প্রার্থনা উঠে এবং স্বর্গীয় শক্তি এখান দিয়েই ইসরাইলি জনসাধারণের কাছে নেমে আসে, তাদেরকে নবুয়তি শক্তিতে পরিপূর্ণ করে। একমাত্র ফিলিস্তিনেই ইহুদিরা ঐশী দুনিয়ার সাথে নিজেদেরকে সৃষ্টিশীলভাবে সম্পর্কিত করতে পারে, সত্যিকারের ইহুদি হতে পারে। ফিলিস্তিনকে আলিয়ায় পরিণত করার এবং জায়নের জন্য তাদের জীবনের ঝুঁকি গ্রহণ করার কর্তব্য রয়েছে তাদের। তারপর শেখিনা ফিরবেন জেরুসালেমে, ‘ পরিত্রাণ শুরু হবে তখন। 

‘ হ্যালেভি নিজে স্পেন থেকে সমুদ্রপথে যাত্রা শুরু করেন। তবে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তিনি জেরুসালেমে পৌছাতে পারেননি। তিনি সম্ভবত ১৯৪১ সালে মিসরে মারা যান। এই পর্যায়ে খুব কম ইহুদিই তাকে অনুসরণ করার প্রবণতা প্ৰদৰ্শন করতে পেরেছিল। তবে তার কাহিনী কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। লোকজন যখন তাদের আশপাশের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং শারীরিক ও আধ্যাত্মিকভাবে মনে করে যে পৃথিবীতে তাদের কোনো আবাসভূমি নেই, তখন তারা স্বস্তি পাওয়ার জন্য তাদের শিকড়ে ফিরে যাওয়ার টান অনুভব করে। বীর। … … সালাহউদ্দিনের জেরুসালেম জয় ইহুদি জনগোষ্ঠীর জন্য ছিল বিস্ময় ও সেইসাথে গোলযোগপূর্ণও। সুলতান ইহুদিদেরকে দেশে এনে তাদেরকে পবিত্র নগরীতে বিপুল সংখ্যায় বাস করার সুযোগ দিয়েছিলেন। ১১৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে সালাহউদ্দিন অ্যাসক্যালন জয় করেন। তবে পরের মাসে যখন জেরুসালেম বিজয় হয়, তখন মুসলিমরা উভয় নগরী রক্ষা করতে পারেনি। ফলে অ্যাসক্যালন পরিকল্পিভাবে ধ্বংস করা হয়, এর অধিবাসীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়। ১১৯০ সালে অ্যাসক্যালনের ইহুদিরা জেরুসালেমে বসতি স্থাপন করে, তাদেরকে সিনাগগ নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়। তাদের জন্য মাগরিবি কোয়ার্টারের পশ্চিম দিকের জায়গা বরাদ্দ করা হয়। তাদের জন্য বরাদ্দ করা অংশের অপর পাশে ছিল শারাফ কোয়ার্টার। ১১৯৮ সালে উত্তর আফ্রিকা থেকে আরো ইহুদি আসতে শুরু করে। ফ্রান্স থেকে দুটি গ্রুপে ১২১০ সালের দিকে তিন ইহুদি পরিবার আলিয়া করে। এই প্রত্যাবর্তন ছিল উত্তেজনাপূর্ণ, আসন্ন পরিত্রাণের মেসাইনিক আশায় উদ্দীপ্ত। তবে জেরুসালেমের ইসলামিকরণও ছিল চরমভাবে বিতৃষ্ণকর। ইহুদিরা যে নগরীকে তাদের বলে দাবি করছিল, সেটির জন্য খ্রিস্টান ও ইহুদিদের লড়াই করতে দেখাটি ছিল বিভ্রান্তিকর। স্প্যানিশ কবি ইয়েহুদা আল-হারিজি ১২১৭ সালে জেরুসালেমে তার তীর্থযাত্রার সময় হারামের ওপর মুসলিম ভবনগুলো বিপর্যয়কর অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন। 

আমাদের পবিত্র আঙিনাগুলোকে অপরিচিত মন্দিরে রূপান্তর করার দৃশ্য দেখা ছিল পীড়াদায়ক! আমরা চেষ্টা করি, একসময় প্রভিডেন্টস যেখানে বাস করতেন সেখানে দাঁড়ানো বিশাল ও রাজসিক চার্চটি থেকে আমাদের মুখ ফিরিয়ে রাখতে। 

ক্রমাগত বেশি বেশি ইহুদি বুঝতে পেরেছিল যে স্থানটি এর সত্যিকারের অধিবাসীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছে। হ্যালেভি উল্লেখ করেছেন, এর পবিত্রতা থেকে খ্রিস্টান বা মুসলিমদের কেউই উপকৃত হতে পারে না। 

এমনকি সংযত মাইমোনিদেস পর্যন্ত এই উদ্দীপনায় আপ্লুত হন। এই ইহুদি দার্শনিক ছিলেন সালাহউদ্দিনের অন্যতম ব্যক্তিগত চিকিৎসক। তিনি উপলব্ধি করেন, জেরুসামে ইহুদি জনসাধারণের মধ্যাকর্ষণ শক্তির কেন্দ্র হিসেবে বহাল রয়েছে এবং অন্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত ইহুদি রাষ্ট্র বৈধতা পাবে না। ইহুদি রাজ্য ও ইহুদি আইন অবশ্যই হতে হবে টেম্পলভিত্তিক। টেম্পল মাউন্ট হয়তো গোয়িমরা অবমাননা করছে, কিন্তু এটি এখনো পবিত্র স্থান। কারণ সোলায়মান সর্বকালের জন্য এটি পবিত্র করে গিয়েছিলেন। ঐশী উপস্থিতি কখনোই টেম্পল মাউন্ট থেকে সরে যায়নি। একইভাবে হারাম পরিদর্শনের সময় ইহুদিদের এমন আচরণ করতে হবে যাতে মনে হবে যে টেম্পল এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তারা যখন পূর্ব দিকে মুখ করার সময় (একসময় যেখানে দেভির দাঁড়ানো ছিল) কোনোভাবেই নিষিদ্ধ এলাকায় যাওয়ার ঝুঁকি নেবে না বা অপ্রাসঙ্গিক কোনো কাজ করতে পারবে না। টেম্পলটি হারিয়ে গিয়েছিল, তবে স্থানটির পবিত্রতা সর্বকালের জন্য টিকে ছিল। এটি ছিল ঈশ্বরের অব্যাহতভাবে তার জাতিদের পরিচর্যা করার প্রতীক। 

সালাহউদ্দিন ১১৯৪ সালে টায়ফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ইন্তিকাল করেন। তার সাম্রাজ্য টুকরা টুকরা হয়ে যায়। এর বিভিন্ন নগরী আইয়ুব পরিবারের সদস্যরা শাসন করতে থাকে। প্রত্যেকের নিজস্ব সেনাবাহিনী ও প্রশাসন ছিল। তবে যে ঐক্য সালাহউদ্দিন উদ্দীপ্ত করতে পেরেছিলেন, তা তার মৃত্যুর সাথে সাথেই হারিয়ে গিয়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই তার উত্তরসূরিরা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দেয়। এই অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতে দুর্ভোগে পড়ে জেরুসালেম। অবশ্য আল- কুদসের প্রতি উদ্দীপনা ম্লান হয়নি। জেরুসালেম হারানোতে মুসলিমরাও কষ্ট পেয়েছিল। এখন তারা যা ফিরে পেয়েছে তার প্রতি ছিল আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে নিবেদিতপ্রাণ। তারা তাদের জিহাদ-কর্মসূচি অব্যাহত রাখল। ১১৯৩ সালে জেরুসালেমের আমির ইজ্জাদউদ্দিন জারদিক হলি সেপালচারের কাছে একটি মসজিদ আবার উৎসর্গ করলেন। এটি প্রথম ক্রুসেডের আগে উমরের প্রতি উৎসর্গ করা ছিল। এই মসজিদের পাশে একটি হেফজখানাও চালু করা হয়। আল- আফজাল একটি মাদরাসাও উদ্বোধন করেন এর পাশে। আল-আফজাল পুরো মাগরিবি কোয়ার্টারকে ওয়াকফ করে দেন, যাতে সাহায্য ও পরিষেবা উত্তর আফ্রিকার তীর্থযাত্রী ও গরিবদের সহায়তা করা যায়। তিনি সেখানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে উত্তর আফ্রিকান মালিকি মাজহাব পড়ানো হতো। 

এটি ছিল জেরুসালেমে ওয়াকফ দানের অন্যতম প্রাচীন উদাহরণ। এই ব্যবস্থায় কোনো দাতা দোকানের মতো আয়-সৃষ্টিকারী কোনো সম্পত্তির মালিকানা সমর্পণ করতে পারতেন, ভালো কাজে এর মুনাফা (পরিচালনা ব্যয় বাদ দিয়ে) দান করে দিতে পারতেন। ওয়াকফের অর্থ যুদ্ধবন্দিদের মুক্ত করতে, লঙ্গরখানা চালাতে কিংবা মাদরাসা নির্মাণে ব্যয় হতে পারে। এ ধরনের দান-খয়রাত পণ্যের কাজ বিবেচিত হতো, বিশেষ করে আল-কুদসে। এখানে ভালো কাজের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করা হতো। তবে এতে বাস্তব কিছু সুবিধাও ছিল। অনেক দাতা তাদের বংশধরদের জন্যও ওয়াকফকে ব্যবহার করত। এসব বংশধর দান করা ভবনে বাস করতে পারত কিংবা দানকৃত প্রতিষ্ঠান তদারকির দায়িত্ব পালন করে বেতনও পেতে পারত। অনেক সময় মাদরাসা বা খানকায় দাতার জন্য অ্যাপার্টমেন্ট থাকত। তারা শেষ জীবন জেরুসালেমে কাটানোর কথা ভাবতেন। ওয়াকফ ছিল বাস্তব দান : এটি ইসলামি শিক্ষা প্রচার করত, অভাবগ্রস্ত ছাত্রদের বৃত্তি দিত, গরিবদের সহায়তা করত। এই ব্যবস্থা এসবের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করত। এটি পবিত্র কোরআনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা। আর এটি জেরুসালেমের জন্য জিহাদের একটি প্রধান উপপাদ্য বিষয়। ওয়াকফ নগরীর সৌন্দর্য ও আবরণকেই সমৃদ্ধ করেনি, এটি চাকরিও ব্যবস্থা করেছিল। টানাপোড়েনমূলক পরিস্থিতিতে কেউ মাদরাসায় চাকরি নিতে পারত কিংবা সুফি তরিকায় যোগ দিতে পারত। যেকোনো ওয়াকফের যেকোনো পরিমাণের উদ্বৃত্ত অর্থ সবসময় গরিব লোকদের দিয়ে দেওয়া হতো। এর ফলে দানের ওপর নির্ভরশীল লোকজনের জন্য মর্যাদা ও শ্রদ্ধার সাথে আচরণ করার সুযোগ সৃষ্টি করত। একেবারে শুরু থেকে জেরুসালেমের পবিত্রতার মূল বিষয় ছিল ন্যায়বিচার আর সহানুভূতি। ক্রুসেডার জেরুসালেমে এটি তেমন দেখা যায়নি। কিন্তু সালাহউদ্দিনের কাছে বিষয়টির খুবই গুরুত্ব ছিল। ক্রুসেডাররা চলে যাওয়ার পর হারামের বিশুদ্ধকরণের সাথে দান-খয়রাতের কাজও চলেছে। এখন ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে গরিব ও অভাবগ্রস্তদের সহায়তার জন্য। জেরুসালেমের আইয়ুবি ইসলামিকরণে এটি ছিল অপরিহার্য অংশ। 

তবে ক্রুসেডাররা তখনো জেরুসালেমে থেকে যাওয়ায় মুসলিমরা শিথিলতা দেখাতে পারছিল না। বস্তুত, যেসব ফ্রাঙ্ক অ্যাকর রাজ্যে বাস করত, তারা শান্তি বজায় রাখতে উদ্বিগ্ন ছিল। তারা হিত্তিনের যুদ্ধ থেকে অনেক মূল্যবান শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানেরা ছিল অনেক বেশি মারমুখী। তারা জেরুসালেম মুক্ত করার জন্য ক্রুসেডার পাঠানো অব্যাহত রাখে। আল-আদিলের ছেলে আল মোয়াজ্জেম ১২০০ সালে দামাস্কাসের সুলতান হন। তবে তিনি আল- কুদসের প্রতি এতটাই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন যে তিনি সেখানেই নিজের প্রধান বাসভবন নির্মাণ করেন। তিনি দুটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। একটি ছিল তার নামে। এটি হারামের উত্তরে হানাফি মাজহাবের মাদরাসা ছিল। অপরটি গেট অব মার্সিতে আরবি শিক্ষা দিত। আল-মোয়াজ্জেম হারাম সীমান্তের আশপাশের স্তম্ভশ্রেণির মেরামতের কাজ করেন। তবে ১২১৮ সালে পাশ্চাত্য থেকে আরেকটি ক্রুসেড আসে। 

এবার ক্রুসেডাররা সরাসরি ফিলিস্তিনে না গিয়ে মিসর থেকে মুসলিমদের উৎখাত করার চেষ্টা করল। তারা আশা করেছিল, এর মাধ্যমে জেরুসালেম পুনর্দখল করতে তারা একটি ঘাঁটি পাবে। নিকট প্রাচ্যে ক্রুসেডারদের প্রেফ উপস্থিতিই পুরো অঞ্চলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। লোকজন ১০৯৯ সালের গণহত্যার স্মৃতিতে সন্ত্রস্ত্র ছিল, তারা এখন নতুন নৃশংসতার আশঙ্কা করছিল। আল-মোয়াজ্জাম ধরে নিয়েছিলেন, ক্রুসেডাররা জেরুসালেমে ফিরে আসবে, লোকজনকে গলা কেটে হত্যা করবে, পুরো ইসলামিবিশ্বকে শাসন করবে। বস্তুত, প্রাথমিক সাফল্যের পর ক্রুসেড সামান্য অগ্রসরও হয়েছিল। কিন্তু ফ্রাঙ্করা সন্ত্রাসের যে নৃশংস ইতিহাস পেছনে রেখে গিয়েছিল যে মুসলিমদের কাছে পরিস্থিতিকে বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। আল-মোয়াজ্জাম নির্দেশ দিলেন, নগর-প্রাচীরগুলো ভেঙ্গে ফেলতে হবে, যাতে ক্রুসেডাররা সেখানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে। এটি ছিল ভয়াবহ পদক্ষেপ। জেরুসালেমের আমিররা যুক্তি দিয়েছিলেন যে তারা ক্রুসেডার হামলা প্রতিহত করতে পারবেন। কিন্তু আল-মোয়াজ্জাম তাদের আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে জোর দিয়ে বললেন যে তিনি নিজে ধ্বংসের কাজ তদারকি করবেন। নগরীতে সার্বিকভাবে বিপুল মর্মপীড়ার সৃষ্টি হয়। একেবারে শুরু থেকেই যেকোনো নগরীর সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিল এর অধিবাসীদের নিরাপত্তা প্রদান করা। ফলে সুলতানের প্রকৌশলী, ওস্তাগার ও শ্রমিকেরা জেরুসালেমে এসে প্রাচীর ধ্বংস করার কাজ শুরু করলে সেখানে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। নগরীর সবচেয়ে অরক্ষিত লোকজন- নারী, মেয়ে ও বৃদ্ধরা – কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় ছুটে গেল, পোশাক দিয়ে চোখ মুখতে লাগল। তারা প্রথমে হারামে জমায়েত হলো। তারপর দামাস্কাস, কায়রো ও কেরাকে চলে গেল, পেছনে রেখে গেল তাদের পরিবার ও সহায়-সম্পত্তি। শেষ পর্যন্ত নগরীটির সব প্রতিরক্ষা ধ্বংস করে এর সেনা ছাউনিও সরিয়ে নেওয়া হলো। কেবল দাউদ টাওয়ার তার স্থানে দাঁড়িয়ে ছিল। 

আল-কুদস আর টেকসই নগরী রইল না। এখন এর কোনো প্রাচীর নেই, মুসলিমরা সেখানে বাস করতে সাহস পাচ্ছিল না, ফ্রাঙ্করা অ্যাকরের কাছে এসে নগরীর কাছাকাছি থেমে থাকল। নগরীটি তখন একটি গ্রামের চেয়ে বেশি কিছু। মাত্র কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ দরবেশ ও মুফতি অবস্থান করতে লাগলেন। তারা কোনোমতে আইয়ুবি প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রেখেছিলেন, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও অল্প কিছু সৈনিককে সহায়তা দিতে লাগলেন। আল-মোয়াজ্জামের সিদ্ধান্ত পরে অপরিণত বলে প্রমাণিত হয়েছিল। কারণ ১২২১ সালে ক্রুসেডাররা বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। অবশ্য ক্রুসেড ওই অঞ্চলকে এত প্রবলভাবে নগরীকে অস্থিতিশীল করে গিয়েছিল যে মুসলিমদের জন্য পাশ্চাত্যের উপস্থিতিকে কোনো মাত্রায় আস্থায় আনা বা শান্তভাবে গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। জেরুসালেমের জন্য মুসলিম অনুভূতিতে নতুন ধরনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। এটি নগরীর জন্য ধ্বংসকরী হতে পারত। 

মুসলিম শাসকদের জন্য নিরাপত্তাই প্রধান অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়ে পরিণত হলো। ১২২৯ সালে মিসরের সুলতান আল-কামিল নতুন ক্রুসেডার হামলা মোকাবিলা ভয়াবহ আশঙ্কার চেয়ে জেরুসালেম ত্যাগ করার জন্যই তৈরি ছিলেন। এদিকে ইউরোপের হলি রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক পবিত্র ভূমিতে নতুন অভিযানে নেতৃত্ব দিতে পোপের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। স্টুপার মান্ডি, বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে সমসাময়িক লোকদের কাছে পরিচিত ফ্রেডেরিক অব্যাহতভাবে পাশ্চাত্যের প্রত্যাশাগুলোকে বিদ্রুপ করতেন। তিনি কসমোপলিটান সিসিলিতে বেড়ে ওঠেছিলেন। ফলে ইউরোপের সহজাত বৈদেশিকতা-ভীতি তার মধ্যে ছিল না। ইসলামের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ ছিল না। বরং তিনি অনর্গল আরবি বলতে পারতেন, মুসলিম পণ্ডিত ও শাসকদের সাথে কথোপকথন ও পত্র বিনিময় উপভোগ করতেন। তিনি জেরুসালেমের জন্য ক্রুসেডকে সময়ের অপচয় মনে করতেন। তবে জানতেন, গণদাবিকে এড়িয়ে গিয়ে বেশি দিন চলতে পারবেন না। তিনি নৈরাশ্যমূলকভাবে আল-কামিলের কাছে প্রস্তাব দেন তার কাছে জেরুসালেমকে হস্তান্তর করতে। সর্বোপরি নগরীতে কোনো প্রাচীর ছিল না, সুলতান একে অর্থনৈতিক বা কৌশলগত- কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারতেন না। আল- কামিল রাজি হওয়ার জন্য তৈরি ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তার ভাই দামাস্কাসের সুলতান আল-মোয়াজ্জামের সাথে তার মারাত্মক বিবাদ চলছিল। অথচ ঐক্যবদ্ধ বাহিনী ছাড়া ক্রুসেড সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা চিন্তা করা যায় না। আবার অরক্ষিত জেরুসালেমে ফ্রাঙ্কিশ উপস্থিতি কোনো সামরিক হুমকিও সৃষ্টি করবে না। আর নগরীটি ফ্রাঙ্কদের কাছে ফিরিয়ে দিলে পাশ্চাত্য থেকে বিপদ ও প্রশমিত হতে পারে। ফ্রেডেরিক হতে পারেন আল-মোয়াজ্জামের বিরুদ্ধে কার্যকর মিত্র। 

পরিণামে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রাথমিক কিছু ইতস্ততার পর ফ্রেডেরিক ও আল- কামিল ১২২৯ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি জাফায় একটি চুক্তিতে সই করেন। চুক্তিটি করা হয়েছিল ১০ বছরের জন্য। চুক্তি অনুযায়ী খ্রিস্টানেরা জেরুসালেম, বেথলেহেম ও নাজারেথ ১০ বছরের জন্য গ্রহণ করবে। তবে ফ্রেডেরিক জেরুসালেমের প্রাচীর নির্মাণ করতে পারবেন না। ইহুদিদের নগরী ছাড়তে হবে, তবে মুসলিমরা হারাম বহাল রাখতে পারবে। কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই মুসলিমরা সেখানে প্রার্থনা করতে পারবে, মুসলমি পরিচিতি প্রদর্শিত হবে। 

চুক্তির খবরে মুসলিম ও খ্রিস্টান উভয় বিশ্বে ক্রোধের সঞ্চার করেছিল। মুসলিমরা ক্রোধে বাগদাদ, মসুল ও আলেপ্পোকে বিক্ষোভ করল, ইমামেরা তেল আল-আজুলে আল-কামিলের শিবিরে ছুটে গেল। তাদেরকে শক্তি প্রয়োগ করে তাড়াতে হয়েছিল। মৃত্যুশয্যায় থাকা আল-মোয়াজ্জাম এই খবরে এতই কষ্ট পেয়েছিলেন যে জেরুসালেমের অবশিষ্ট জেরুসালেমের অবশিষ্ট প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের কাজ ব্যক্তিগতভাবে তদারকির জন্য বিছানা ছেড়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করতে লাগলেন। দামাস্কাসের গ্রেট মসজিদে জনতা চিৎকার, শোক প্রকাশ করতে লাগল। আল-কামিলকে শেখ সিবত আল-কাউজি ইসলামের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করলেন। আল-কামিল আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেন : : তিনি ইসলামের পবিত্র স্থাপনাগুলো খ্রিস্টানদের কাছে ছেড়ে দেননি, হারাম এখনো মুসলিম অধিকারে রয়েছে। তারা কেবল ‘কিছু চার্চ আর বিধ্বস্ত বাড়িঘর ছেড়ে দিয়েছে, এসবের প্রকৃত কোনো মূল্য নেই। পরের কোনো এক সময় এই নগরী পুনরুদ্ধার করা মুসলিমদের জন্য কঠিন কোনো কাজ হবে না। তবে রক্তপাত ও যুদ্ধের পর জেরুসালেম মুসলিম অখণ্ডতার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। ফলে কোনো ইসলামি শাসকই সহজে পবিত্র নগরী ছেড়ে দিতে পারতেন না। 

খ্রিস্টানেরাও একইরকম কষ্ট পেয়েছিল। বিধর্মীদের সাথে এ ধরনের চুক্তি করা ঈশ্বর অবমাননার সামিল। কোনো খ্রিস্টান নগরীতে হারামকে মুসলিমদের কাছে বহাল রাখতে দেওয়া অসহ্যকর। ফ্রেডেরিক যখন পবিত্র নগরীটি সফর করেছিলেন, তখন ফ্রেডেরিকের আচরণ চরমভাবে কেলেঙ্কারিতে পরিণত হয়েছিল। কারণ সম্প্রতি পোপ তাকে সমাজচ্যুৎ করেছিলেন, কোনো পাদ্রিই তাকে জেরুসালেমের রাজা হিসেবে মুকুট পরায়নি। ফলে সম্রাট নিজেই হলি সেপালচার চার্চের উঁচু বেদিতে নিজের মাথায় মুকুট পরান। তারপর তিনি হেঁটে হারামে যান, আরবিতে পার্শ্বচরদের সাথে কৌতুক করেন, স্থাপত্যের প্রশংসা করেন, বাইবেল হাতে আল-আকসায় প্রবেশে সাহস দেখানোর জন্য এক খ্রিস্টান পাদ্রিকে প্রহার করেন। তিনি যখন শুনলেন যে তার সফরের সময় কাজি আজান দিতে নিষেধ করেছেন, তখন তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ী আজান দিতে বলেন। এটি কোনোভাবেই ক্রুসেডার আচরণ হতে পারে না! টেম্পলাররা ফ্রেডেরিককে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল, তিনি দ্রুততার সাথে দেশটি ত্যাগ করেন। তিনি একেবারে ভোরে দ্রুততার সাথে জাহাজে ওঠেন, অ্যাকরের কসাইরা তার দিকে নাড়িভুঁড়ি ও গোবর ছুঁড়ে মেরেছিল। জেরুসালেম এখন খ্রিস্টান বিশ্বের কাছে এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হলো যে কেউ যদি মুসলিমদের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করে বা পবিত্র নগরী সম্পর্কে হেলাফেলা করে, তার নিহত হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হলো। ফ্রেডেরিকের অনন্য ক্রুসেডের পুরো ঘটনাটি প্রমাণ করে যে ইসলাম ও পাশ্চাত্যের পক্ষে একে অপরকে মেনে নেওয়া অসম্ভব ব্যাপারে পরিণত হয়েছে : কোনো পক্ষই সহাবস্থান ও শান্তির প্রতি কোনো আকাঙ্ক্ষা পোষণ করত না। 

তা সত্ত্বেও চুক্তিটি ১০ বছরই টিকে থাকে, এমনকি যদিও ফ্রেডেরিকের বিদায় নেওয়ার পরপরই হেবরন ও নাবলুসের মুসলিমরা নগরীতে হামলা চালিয়েছিল, উপকূল থেকে জেরুসালেমগামী তীর্থযাত্রীরা পথে হয়রানির স্বীকার হচ্ছিল। তবে জেরুসালেম রক্ষার মতো সম্পদ খ্রিস্টানদের ছিল না। ১২৩৯ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে কেরাকের গভর্নর আল-নাসির দাউদ সামান্য অবরোধের পর ফ্রাঙ্কদের নগরী ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। তবে আইয়ুবিদের মধ্যে তখনো তীব্র বিবাদ চলতে থাকায় মিসরের সুলতানদের বিরুদ্ধে তাদের সহায়তার বিনিময়ে সামান্য পরে খ্রিস্টানদের কাছে নগরীটি হস্তান্তর করেছিলেন। এবার মুসলিমদের কাছে হারামের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তারা আতঙ্কের সাথে শুনল যে আল আকসা মসজিদে খ্রিস্টানেরা বিশাল বিশাল ঘণ্টা বেঁধেছে, মাস উৎসবে ‘রকের ওপর মদের বোতল রেখেছে।’ তবে খ্রিস্টানদের মেয়াদ ছিল খুবই কম। ১২৪৪ সালে খাওয়ারাজমাইনের তুর্কি সেনাবাহিনী, মধ্য এশিয়ায় তাদের ভূমিতে মঙ্গোল হামলা থেকে তারা পালিয়ে গিয়েছিল, ফিলিস্তিনে বিপুলভাবে জমায়েত হয়। মিসরের সুলতান সিরিয়ায় তার যুদ্ধগুলোতে তাকে সহায়তার জন্য তাদেরকে তলব করেন। তারা দামাস্কাস লুণ্ঠন করে, জেরুসালেমে তাণ্ডব চালায়, সেখানকার খ্রিস্টানদের হত্যা করে, হলি সেপালচার চার্চসহ ধর্মীয় স্থানগুলোর অবমাননা করে। নগরী আবার আইয়ুবিদের হাতে ফিরে যায়। তবে এর অনেক বাড়ি ও চার্চ ধোঁয়া সৃষ্টিকারী ধ্বংসস্তূপের চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। এই বিপর্যয়ের পর বেশির ভাগ অধিবাসী তুলনামূলক নিরাপদ উপকূলীয় নগরীগুলোতে পালিয়ে যায়। এখন মাত্র হাজার দুয়েক মুসলিম ও খ্রিস্টান অধিবাসী একসময়ের সমৃদ্ধ মেট্রোপলিসে বাস করছিল। 

ফ্রান্সের রাজা ৯ম লুইয়ের নেতৃত্বে সপ্তম ক্রুসেড জেরুসালেম পুনঃজয় করতে ব্যর্থ হয়। বস্তুত ১২৫০ সালে পুরো সেনাবাহিনীকে মিসরে বন্দি করা হয়। ক্রুসেডাররা যখন বন্দি ছিল, তখনই অসন্তুষ্ট মামলুকদের একটি গ্রুপ মিসরের আইয়ুবিদেরকে পরাজিত করে নিজেদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। মামলুকেরা মূলত ইসলামি সাম্রাজ্যের সীমান্তের বাইরে থাকা ইউরেসিয়ান স্তেপ অঞ্চল থেকে এসেছিল। শৈশবে মুসলিমরা তাদেরকে ক্রীতদাস করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছিল। পরে তাদেরকে মুসলিম সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ রেজিমেন্টে ভর্তি করায়। তাদের বন্দি ও ধর্মান্তরের পর তাদের জীবন নাটকীয়ভাবে উন্নত হওয়ায় তারা নিবেদিতপ্রাণ মুসলিমে পরিণত হয়েছিল। তারা তাদের স্বতন্ত্র জাতিগত পরিচিতি বজায় রেখেছিল, একে অপরের প্রতি প্রবল সংহতি অনুভব করত। এখন বাহারিয়া রেজিমেন্ট মিসর দখল করে নতুন মামলুক রাজ্য সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে তারা নিকট প্রাচ্যের প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। 

মামলুকদের উত্থানে প্রথমে জেরুসালেমের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। সালাউদ্দিনের সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট আইয়ুবিরা তাদের বিরোধিতা করে, জেরুসালেমের অবস্থান অব্যাহতভাবে অস্থিতিশীল থাকে। তবে ১২৬০ সালে মামলুক সুলতান আল জাহির বেইবার্স (১২৬০-৭৬) গ্যালিলির আইন জালুতের যুদ্ধে হানাদার মঙ্গোল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন। এটি ছিল গৌরবময় অর্জন : মঙ্গোলেরা আব্বাসি খিলাফতকে বিধ্বস্ত করেছিল, খোদ বাগদাদসহ মুসলিম নগরীগুলো লুণ্ঠিত ও ধ্বংস করেছিল। এখন বেইবার্স ফোরাত উপকূল থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে ইসলামের বীরে পরিণত হলেন। মঙ্গোলেরা আইয়ুবি সুলতানদেরও পরাজিত করেছিল বলে বেইবার্স এখন সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের শাসকে পরিণত হলেন। তাকে তখনো মাঝে মাঝে মঙ্গোল আক্রমণ মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। এর মধ্যেই তিনি উপকূলীয় রাজ্য থেকে ফ্রাঙ্কদের বিতাড়িত করতে মনস্থ করলেন। কয়েক বছর ধরে ওই অঞ্চলে যে নিরাপত্তাহীনতা ও বিশৃঙ্খলা চলছিল, মামলুকরা শেষ পর্যন্ত এর অবসান ঘটান। 

মামলুকদের কাছে জেরুসালেমের কোনো কৌশলগত গুরুত্ব ছিল না। তারা কখনো প্রাচীর পুনঃনির্মাণ করতে আগ্রহী হয়নি। তবে তারা নগরীর পবিত্রতায় সবচেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছিল। তাদের আমলে এই নগরীর ধর্মীয় মর্যাদা ব্যাপকভাবে বাড়ে। প্রায় সব সুলতান জেরুসালেম সফর করেছেন, সেখানে নতুন নতুন ভবনে সুশোভিত করেছেন। বেইবার্স ১২৬৩ সালে আল-কুদস সফর করেন। তিনি হারামের সংস্কার কাজ ছাড়াও জেরুসালেমের নিরাপত্তা সমস্যার অভিনব সমাধান করেন। ইস্টার ছিল বিশেষভাবে বিপজ্জনক সময়। কারণ তখন নগরীটি খ্রিস্টানদের দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যেত। এ কারণে বেইবার্স দুটি নতুন ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ করেন : একটি জেরিকোর কাছে নবী মুসা (নেবি মুসা) এবং অপরটি রামাল্লায় আরবের নবী সালির সম্মানে। ইস্টারের আগের সপ্তাহে এই দুই নবীর উৎসব হতো। ফলে জেরুসালেমের আশপাশ তখন এই অরক্ষিত সময়ে মুসলিম তীর্থযাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে যেত। নবী মুসা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তীর্থযাত্রীরা জেরুসালেমের চারপাশ ঘুরে হারামে যেত, রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রা বের করত, যেমনটি তারা কয়েক শ’ বছর ধরে খ্রিস্টানদের করতে দেখেছিল। তারা আল-কুদসে তাদের মালিকানা প্রদর্শন করত, ঠিক যেভাবে একসময় খ্রিস্টানেরা করত। নবী মুসায় বিশেষ ব্যানার উড়ানো হতো। সব তীর্থযাত্রী জেরুসালেমে সমবেত হওয়ার পর জনতা পবিত্র স্থানটির উদ্দেশে যাত্রা করত। এর মাধ্যমে তাদের বিপুল সংখ্যার বিষয়টি খ্রিস্টানদের জানানো হতো। নবী মুসায় তারা সপ্তাহ ধরে ইবাদত করত, কোরাআন তিলায়াত করত, সুফি তরিকার বিধিবিধানের চর্চা করত। এছাড়া তারা ওই ধর্মীয় স্থান ও আশপাশের পাহাড়গুলোতে শিবির স্থাপন করে নিজেদের সাহচার্য উপভোগ করত। এদিকে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীরা জেরুসালেমে ইস্টার উদযাপনের সময় জানত যে আল-কুদস রক্ষার জন্য মুসলিমরা তৈরি হয়ে আছে। এটি ছিল কুশলী পরিকল্পনা। তবে নবী উৎসবের পাশাপাশি নতুন নতুন ধর্মীয় স্থানে অন্য যেসব উৎসবের আয়োজন করা হতো, সব মিলে মুসলিম ধর্মানুরাগের নতুন রক্ষাণাত্মক অবস্থা প্রদর্শন করত। 

একটি উগ্র উপাদানও জেরুসালেমে ইহুদি ধর্মানুরাগে অলক্ষ্যে প্রবেশ করেছিল। ১২৬৭ সালে রাব্বি মোসেস বেন ন্যাচম্যান, তিনি ন্যাচম্যানিডেস নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, খ্রিস্টান স্পেন থেকে জেরুসালেমে আলিয়া করেন। তিনি নগরীর দুর্দশা দেখে আঁতকে ওঠেছিলেন। তিনি পৌছে মাত্র দুটি ইহুদি পরিবার দেখেছিলেন। অকুতোভয় ন্যাচম্যানিডেস জিউশ কোয়ার্টারে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে সুন্দর ফটকশোভিত একটি সিনাগগ প্রতিষ্ঠা করেন। রামবান সিনাগগটি (রাব্বি মোসেস বেন ন্যাচমেনের নামে) মামলুক জেরুসালেমে ইহুদি জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তালমুদবাদী হিসেবে ন্যাচম্যানিডেসের বুদ্ধিবৃত্তিক খ্যাতিতে আকৃষ্ট হয়ে ছাত্ররা তার কাছে আসতে থাকে। তারা তার ইয়েশিভার অধ্যায়নের জন্য জেরুসালেমে বসতি স্থাপন করে। শেকড়ের টানহীন নতুন অনুভূতিতে ন্যাচম্যানিডেস জেরুসালেমের সাথে দৈহিক সংযোগ প্রতিষ্ঠা করে স্বস্তি পেয়েছিলেন। তিনি এর পাথরগুলোকে ‘আদর’ ও ‘সোহাগ’ করতে পারতেন, ধ্বংস্তুপের ওপর কান্না করতে পারতেন। ধরে নেওয়া হতো যে বিধ্বস্ত নগরীটি স্পেনে ফেলে তার স্ত্রী ও পরিবারের মতো হয়ে ওঠেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে সব ইহুদির দায়িত্ব হলো ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করা। জেরুসালেম ও আশপাশের এলাকার করুণ দশায়, যা তিন শ’ বছরের সবিরাম যুদ্ধে ভেঙ্গে পড়েছিল, মনে হচ্ছিল যে খ্রিস্টান বা মুসলিমদের অধীনে আর কখনো এই ভূমিটি সমৃদ্ধ হবে না, তবে এর সত্যিকারের মালিকদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছে। ন্যাচম্যানিডেস মনে করেছিলেন, আলিয়া ছিল একটি ইতিবাচক কর্মবিধি’ একটি বাধ্যবাধকতামূলক নির্দেশ, যা ইহুদিদের প্রতিটি প্রজন্মের ওপর বর্তায়। তবে স্পেনে ন্যাচম্যানিডেস যে সেমিটিকবিরোধী নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তাতে তার মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের প্রতি বিতৃষ্ণার জন্ম হয়েছিল। অথচ পূর্ববর্তী শতকগুলোতে ইসলামের অধীনে আন্দালুসিয়ায় ইহুদিরা কয়েক শত বছর ধরে সফলভাবে একসাথে বাস করেছিল। তিনি এখন তার ইহুদি জাতির উদ্দেশে যেসব কথা বলছিলেন, সেগুলো ফিলিস্তিনে তার জাতির রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করছিল: 

আমাদের উচিত হবে ওইসব জাতির ধ্বংস উপভোগ করা যদি তারা আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। তবে যদি তারা শান্তি স্থাপন করতে চায়, আমরা তাদের সাথে শান্তি স্থাপন করব, তাদেরকে কিছু শর্ত পালন করতে দেব। তবে আমরা তাদের হাতে বা অন্য কোনো জাতির হাতে আর কখনোই এই ভূমি ছেড়ে দেব না! 

প্রাচ্যে ক্রুসেড ও ইউরোপে পুনর্জয় তিন ইব্রাহিমি ধর্মের মধ্যে নতুন ও স্থায়ী ভাঙন সৃষ্টি করেছিল। 

ন্যাচম্যানিডেস ছিলেন কাব্বালিপন্থী। এই গ্রুপের লোকজন ১৩ শতকে স্পেনে বিকশিত মরমিবাদের সন্ন্যাস ধরণটি অনুশীলন করত। এমনকি যদিও অল্প কিছু সংখ্যক ইহুদির এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করার সামর্থ্য ছিল। কাব্বালার আধ্যাত্মিক দর্শন ও মিথ পরে ইহুদি ধর্মানুরাগের আদর্শে পরিণত হয়েছিল। বস্তুত কাব্বালারা এই সময়ে ইহুদি ধর্মের অনেক বেশি যৌক্তিক রূপের বিপরীতে পুরানতত্ত্বের বিজয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। নতুন বিতৃষ্ণায় স্প্যানিশ ইহুদিরা তাদের দুর্দশা থেকে দার্শনিক ঈশ্বরকে অনেক দূরে দেখতে পেয়েছিল। তারা সহজাতভাবে পুরনো ঐশী ভূগোলের দিকে নজর দিয়েছিল। এই ভূগোল তখনো আরো বেশি অন্তর্মুখী ও আধ্যাত্মিকসম্পন্ন হয়ে পড়েছিল। দেভিরে অপ্রবেশযোগ্য ঈশ্বরের কাছ থেকে পবিত্রতার ১০ ডিগ্রি বিচ্ছুরণ দেখার বদলে ইহুদিরা এখন ধারণাতীত ও চরমভাবে রহস্যময় ঈশ্বর (যাকে তারা বলত আইন সফ : ‘অনন্ত’) কল্পনা করতে লাগল, যা ১০ সংখ্যায় পৃথিবীর দিকে ছুটতে লাগল, ঈশ্বরের প্রতিটি গোপন বার্তায় পরবর্তী পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করত বা মানবীয় সত্তার সীমিত মনের সাথে খাপ খাইয়ে নিত। এই ১০ সংখ্যা সচেতনতারও প্রতিনিধিত্ব করত, যা মরমি সাধকেরা ঈশ্বরের পথে যেত। আবারো বলা যায়, এটি ছিল ‘ধারণাতীত অন্তরাত্মা’। জেরুসালেম টেম্পলের আধ্যাত্মিকতার পুনঃঘোষণাবিষয়ক কাব্বালার ধারণাটি ঈশ্বর ও মানুষ উভয়ের ভেতরে অংশকে প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তোলে। স্বর্গীয় প্রকৃতি ও মানবতার ধারার মধ্যকার এই পরিচিতির ওপর জোর দিত কাব্বালা। শেষ সৃষ্টি ছিল শেখিনা, যাকে বলা হতো মালখুথ (‘প্রাধান্য’)। এটি একইসাথে ঐশী উপস্থিতি ও ইসরাইলি জনগণকে ঐক্যবদ্ধকারী শক্তিকে ধারণ করত। এখানে নিচে থাকা শেষ সৃষ্টি জায়নের সাথে শনাক্ত হয়। এটি ঐশী মণ্ডলকে এর জাগতিক বাস্তবতা না হারিয়েই ধরে রাখত। ঐশী উপস্থিতি, ইসরাইল, জেরুসালেম অবিভাজ্য থাকার অনুভূতি প্রবল করে। 

কাব্বালা জেরুসালেমে আলিয়া না করেই প্রবাসেই ঈশ্বর যাত্রা সৃষ্টি করতে সক্ষম করে তোলে। তবে এতে জোর দেওয়া হয় যে জায়ন থেকে ইহুদি বিচ্ছিন্নতা ছিল শয়তানি শক্তির জয়।’ এক্সডাসের সময় ইসরাইলিরা আতঙ্কের মরুভূমি’ নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়েছিল, বুনো পরিবেশে তাড়িত হয়ে দানবীয় শক্তির সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছিল তাদেরকে। ইসরাইলিরা স্থানের দখল নিয়ে মাউন্ট জায়নের ওপর প্রার্থনাবিধি উদ্বোধন করার সাথে সাথেই শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সবকিছুই যযথাযথ স্থানে ফিরে এসেছিল। শেখিনা বাস করেছিল দেভিরে, যা ছিল পুরো বিশ্বের আশীর্বাদ, উর্বরতা, শৃঙ্খলার উৎস। এখন সব অস্তিত্বের কেন্দ্রে গভীর ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, যা সংশোধিত হবে যখন ইহুদিরা জায়নের সাথে আবার ঐক্যবদ্ধ হবে, তাদের যথার্থ স্থানটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। এই কিংবদন্তি দেখায়, কিভাবে তাদের ভৌগোলিক স্থানচ্যুতি ইহুদি আত্মাকে আক্রান্ত করেছিল : এটি সত্তার উৎস থেকে আরো বেশি বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করেছিল। এখন ইহুদিদের স্পেন থেকে বের করে দিতে শুরু করেছে খ্রিস্টানেরা। তারা নতুন করে নিঃসঙ্গ অনুভব করতে লাগল। কাব্বালার মিথগুলো ইউরোপের বাকি অংশে ইহুদিদের অবস্থার কথাও প্রকাশ করতে লাগল। ক্রুসেডারদের বারবারের নির্যাতনের পর থেকে তাদের জীবন অসহ্যকর হয়ে পড়েছিল। এই পুরানতত্ত্ব, স্পষ্টভাবে বলা যায় তার ঘরোয়া বিশ্ব, ইহুদি দার্শনিকদের আরো বেশি কল্পনাপ্রসূত মতবাদ আরো গভীরভাবে ধারণ করেছিল। এই পর্যায়ে বেশির ভাগই ছিল প্রতীকি ও জায়নে আধ্যাত্মিকভাবে ফিরে যাওয়া সংক্রান্ত। বস্তুত, ফিলিস্তিনে আলিয়ার মাধ্যমে পরিত্রাণ ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করা তখনো ভুল বিবেচিত হতো। তবে ন্যাচমানিদেসের মতো কোনো কোনো কাব্বালবাদী জেরুসালেমের সাথে দৈহিক যোগাযোগের মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করার অনুপ্রেরণা অনুভব করতেন। 

পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানেরা এই অবস্থার মুখোমুখি পড়তে হয়েছিল যে তারা সম্ভবত আর কখনোই জেরুসালেমে ফিরে গিয়ে এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে না। ১২৯১ সালে মামুলক সুলতান খালিল শেষ পর্যন্ত অ্যাকর রাজ্য ধ্বংস করে ফ্রাঙ্কদেরকে তাদের উপকূলীয় রাজ্য থেকে বহিষ্কার করেন। দুই শত বছরের মধ্যে এই প্ৰথম পুরো ফিলিস্তিন মুসলিমদের হাতে এলো। এই পর্যায় থেকে জেরুসালেমের ভাগ্য বদলাতে থাকে। ফ্রাঙ্করা দৃশ্যপটে আর না থাকায় মুসলিমরা নগরীতে ফিরে আসতে নিরাপদ বোধ করতে থাকে। অবশ্য তখনো নগরীতে যথাযথ দুর্গ ছিল না। তবে খ্রিস্টানেরা হাল ছাড়েনি। কয়েক শ’ বছর পর্যন্ত তারা নতুন ক্রুসেডের পরিকল্পনা করা, পবিত্র নগরী মুক্ত করার স্বপ্ন দেখা অব্যাহত রাখে। জেরুসালেমে পাশ্চাত্যের শক্তি কিছুটা সুরক্ষিত থাকাটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। অ্যাকর পতনের সামান্য পর পোপ চতুর্থ নিকোলাস হলি সেপালচারে কাজ করার জন্য এক দল ল্যাতিন পাদ্রিকে সুযোগ দিতে সুলতানকে অনুরোধ করেন। সুলতান তাতে রাজি হন। পোপ নিজে ফ্রান্সিসক্যান হওয়ায় তিনি জেরুসালেমে একটি ছোট ভিক্ষু দলকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাদের কোনো কনভেন্ট ছিল না, আয় ছিল না। তাদেরকে সাধারণ তীর্থ হোস্টেলে থাকতে হতো। ১৩০০ সালে তাদের দুর্দশার বিষয়টি সিসিলির রাজা রবার্টের নজর কাড়ে। তিনি সুলতানকে উপহার হিসেবে বিপুল অর্থ দিয়ে ফ্রান্সিসকানদেরকে মাউন্ট সায়নে, হলি সেপালচার চার্চে দি মেরি চ্যাপেল, চার্চ ও ন্যাটিভিটি কেভ নির্মাণ করার অনুরোধ করেন। এতেও সুলতান রাজি হন। এই প্রথমবারের মতো পাশ্চাত্যের কোনো শক্তি জেরুসালেমে ল্যাতিনদের স্বার্থ বাড়ানোর জন্য তাদের প্রভাব প্রয়োগ করল। এরপর এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটেছিল। এরপর সায়ন চার্চ ফ্রান্সিসকানদের নতুন সদরদফতরে পরিণত হয়, ফাদার সুপিরিয়র প্রাচ্যের বসবাসরত সব ইউরোপিয়ানের কাস্টস বা অভিভাবকে পরিণত হন। তিনি কার্যত জেরুসালেমে কাউন্সিলের ভূমিকা পালন করছিলেন। ফ্রান্সিসকানরা বিশ্বের অন্যান্য অংশে ইসলামের বিরুদ্ধে জঙ্গিনীতি গ্রহণ করেছিল। ইউরোপে তাদের ধর্মীয় প্রচারণা প্রায়ই সেমিটিকবিরোধী নির্যাতনের কথা বলত। ফলে জেরুসালেমে প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকায় নামা তাদের জন্য হয়ে পড়েছিল কঠিন। 

এখন দেশে শান্তি বিরাজ করছে। মঙ্গোল ও ক্রুসেডার হুমকি কমে যাওয়ায় মামলুকদের আমলে ফিলিস্তিন সমৃদ্ধ হয়। জেরুসালেম কখনো তাদের সাম্রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল না। এটি শাসিত হতো নিম্ন পর্যায়ের আমিরের মাধ্যমে। আনুকূল্যবঞ্চিত কর্মকর্তাদের নির্বাসনে পাঠানোর মতো করে এখানে দায়িত্ব দেওয়া হতো। এই অরক্ষিত শহরে তারা সামান্যই ক্ষতি করতে পারতেন। তবে এসব নির্বাসিতদের অনেকে আল-কুদসের ধর্মীয় জীবনে আকৃষ্ট হতেন। তাদের অনেককে জেরুসালেমের দুটি হারাম ও হেবরনের সুপারিনটেন্ডেন্টের মর্যাদা দেওয়া হতো। অনেকে ওয়াকফ বিভাগে কাজ করতেন। ভবন নির্মাণের পূণ্য কাজ অব্যাহত ছিল। এটিই অনেক সুফি, আলেম, শিক্ষক, ফকিহ, তীর্থযাত্রীকে শহরে নিয়ে আসে। মামলুকেরা জেরুসালেমকে বদলে দিয়েছিল। হারামে কিছু নির্মাণের অধিকার ছিল কেবল সুলতানদেরকেই। এই সুবিধা বেশির ভাগ সুলতানই গ্রহণ করতেন। ১৩১৭ সালে সুলতান আল-নাসির মুহাম্মদ উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তগুলোজুড়ে নতুন স্তম্ভ শ্রেণি নির্মাণ করেন। তিনি আকসার গম্বুজ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, ডোম অব দি রক নতুন করে সোনায় মুড়িয়ে দেন। তিনি পুরনো ক্রুসেডার মার্কেটের স্থানে নতুন একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র নির্মাণ করেন। চতুর্দশ শতকের শুরুর দিকে এটি ছিল জেরুসালেমের নতুন সমৃদ্ধির চিহ্ন। নগরীতে সাবান, সূতা ও লিনেন সামগ্রী তৈরি হতো। হারাম নথিপতে দেখা যায়, প্রাচ্যের বিদেশী ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে বস্ত্র বণিকরা, প্রায়ই নগরীতে উপস্থিত হতেন। অবশ্য আমাদের কাছে বাণিজ্যের প্রকৃত আকার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। সুলতানের নতুন বাজারটিকে বলা হতো সুক আল-কাত্তানিন তথা কটন মার্চেন্ট মার্কেট। তিনি হারাম প্রাচীরের সাথে একে সংযোগ সাধন করতে চেয়েছিলেন। তিনি সেখানে নতুন একটি চমকপ্রদ ফটক নির্মাণ করেন। এর নাম ছিল বাব আল-কাত্তানিন। এখান দিয়ে ২৭টি ধাপ পাড়ি দিয়ে হারাম প্লার্টফমে যেতে হতো। 

পবিত্র স্থানের সাথে সংযোগ স্থাপনের আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি অনেক সময় ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ইহুদি ভক্তিকে ফুটিয়ে তুলত। মামলুক আমলে হারামকে স্পর্শ করার এই আকাঙ্ক্ষা বিশেষভাবে দৃশ্যমান হতো নতুন নতুন মাদারাসা তথা হারামের প্রান্তগুলোজুড়ে নির্মাণে। স্থপতিরা প্রায়ই প্রখর প্রতিভাধর ছিলেন। কারণ স্থান ছিল মহার্ঘ (ডায়াগ্রাম দেখুন)। হারামের কেবল উত্তর ও পশ্চিম প্রান্তগুলোতেই নির্মাণ সম্ভব ছিল। কারণ পূর্ব ও দক্ষিণ দিকগুলোর প্রান্তভাগ ছিল খুবই সরু। তবে সব দাতাই চাইতেন তাদের মাদরাসা থেকে যেন হারাম দেখা যায় বা পবিত্র স্থানের ভূমি স্পর্শ করে। প্রথম দিকে ওয়াকফ করা পশ্চিম দিকের সহায়ক প্রাচীরসহ একটি ভবনকে ওয়াকফ করেছিলেন তানজিক, ১৩২৮ সালে। তিনি ছিলেন সিরিয়ার ভাইসরয়। তিনি ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থানটির এত কাছে ভবন নির্মাণ করতে পেরে গর্বিত ছিলেন। তানজিকিয়া মাদরাসার মসজিদে থাকা একটি খোদাইলিপিতে লেখা ছিল : ‘[আল্লাহ] আকসা মসজিদের পাশে তার মসজিদ নির্মাণ করিয়েছেন, এই ঘনিষ্ঠ নৈকট্য কতই না ভালো।’ ভবনটি ছিল দারুণভাবে সুসজ্জিত। ক্রুশাকার আকারের এই ভবনে চারটি লেকচার হল ও সামাজিক নামাজঘর ছিল। সবগুলোই মাঝখানের আঙিনায় শেষ হয়েছিল। তানজিকিয়া কেবল একটি মক্তবই ছিল না। এতে ১১ জন সুফির জন্য একটি খানকাহ, এতিমদের জন্য একটি স্কুল ছিল। অধ্যায়ন, আধ্যাত্মিক সাধনা, জনহিতৈষী- সবই হতো একই ছাদের নিচে। পরিকল্পনাটি একীকরণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। এটি পবিত্র স্থান সম্পর্কে মুসলিম ধারণার এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এতে আরো দেখা যায়, কেন্দ্রীয় বাস্তব দান আল-কুদসকে কিভাবে ইসলামিকরণ করেছিল। অবশ্য ওই স্থপতি আবিষ্কার করেন যে স্থানটি সব প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্তভাবে ধারণ করার পক্ষে খুবই ছোট। ফলে তার সুফিদের খানকাহ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হয়েছিল সুলতানের হারামের পশ্চিম সীমান্তের ওপর বারান্দার উপরিভাগে। এখন সুফিরা তাদের আধ্যাত্মিক দীক্ষায় তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের মডেল হিসেবে ডোম অব দি রকের দিকে তাকাতেন। 

অন্যান্য দাতা দ্রুততার সাথে তানজিকের উদাহরণ অনুসরণ করেন। আমিনিয়া মাদরাসাটি (১২২৯-৩০) খুবই সংকীর্ণ স্থানে (মাত্র ৯ মিটার, অ্যান্টোনিয়া পাহাড় ও রাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত) ঠাসাঠাসি অবস্থায় ছিল। ফলে নির্মাণকাজ হয়েছে ঊর্ধ্বমুখী। তৃতীয় তলা নির্মাণ হয়েছে উত্তর দিকের ছাদে। মালিকিয়া মাদরাসাও একইভাবে সমস্যাটির সমাধান করে। ফলে শরিয়াহ মাদরাসাটি থেকে হারাম দেখা যেত। মানজাকিয়া মাদরাসা (১৩৬১) পুরোপুরি ছাদে নির্মিত হয়েছিল। এটি নির্মাণ করা হয়েছিল বাব আল-নাসিরের ছাদে। মামলুক আমলে এটি ছিল হারামের ব্যস্ততম প্রবেশপথ। তুলুনিয়া মাদরাসা ও ফারানিয়া মাদরাসাও নির্মিত হয়েছিল উত্তর বারান্দার শীর্ষে। বাব-আল-আসবাতের (গেট অব দি ট্রাইবস) দুই দিকে ছিল এ দুটি স্থাপনা। অন্য কোনো প্রবেশপথ না থাকায় ছাত্রদেরকে মিনারের সংকীর্ণ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হতো। 

হারাম আস-শরিফের সীমান্তগুলোর এই দৃশ্য প্রমাণ করছে, মামলুকদের জন্য পবিত্র স্থানটির প্রান্ত ঘেষে ছাদগুলোর উপরে তাদের মাদরাসা নির্মাণ কিভাবে সম্ভব ছিল। 

ইহুদি ধর্মের মতো এখানে আইন অধ্যায়ন নিরস, প্রাতিষ্ঠানিক ছিল না। বরং এখানে আধ্যাত্মিক উপাসনার ব্যবস্থা ছিল, দেহ-মনে আল্লাহর দিকে পরিচালনার সুযোগ ছিল। মহান ইসলামি আধ্যাত্মিক যাত্রার প্রতীক ডোম অব দি রকের দিকে তাকিয়ে অধ্যায়ন করার আকাঙ্ক্ষায় তা স্পষ্টভাবে দেখা যায়। তবে মঙ্গোল হামলার পর মাদরাসা সম্পূর্ণ নতুন গুরুত্ব লাভ করে। অসংখ্য লাইব্রেরি, পাণ্ডুলিপি ইত্যাদি লুণ্ঠিত ও পুড়িয়ে দেওয়া হওয়ায় মুসলিমরা তাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভের নতুন করে তাগিদ অনুভব করে। যা কিছু হারিয়ে গেছে সেইসব পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে, এবং সম্ভবত অনিবার্যভাবে, এক ধরনের নতুন সংরক্ষণবাদ প্রবেশ করে ইসলামি চিন্তাধারায়। হারামের চারদিকে সুরক্ষামূলকভাবে নির্মিত এসব মাদরাসাকে পবিত্র স্থান ও বৈরী বিশ্বের মধ্যকার নিরাপত্তা বেষ্টনি সৃষ্টির চেষ্টা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। মুসলিমরা জেরুসালেমকে কোন দৃষ্টিতে দেখে তা নতুন রক্ষণাত্মক অবস্থানের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। নগরীজুড়ে নির্মিত সংযমমূলক লঙ্গরখানাগুলোর (রিবাত) মাধ্যমেও বিষয়টি দেখা যেতে পারে। শুরুতে রিবাত ছিল সামরিক দুর্গ। এখন তা দরবেশ, গরিব ও তীর্থযাত্রীদের আশ্রয়ের স্থান হিসেবে দেখা হতে লাগল। 

নতুন রক্ষণশীলতা মোকাবিলা করেছিল সুফি আন্দোলন। মঙ্গোল অভিশাপের পর মুসলিমরা বিপর্যয় ও দুর্ভোগ সম্পর্কে কিছু চূড়ান্ত ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করার প্রেক্ষাপটে এটি বিপুলভাবে বিকশিত হয়েছিল। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে চতুর্দশ শতকে আল-কুদসে সুফিদের জমায়েত অনেক বেশি হয়েছিল। এদের অনেকে হারামের পাশে গড়ে ওঠা নতুন নতুন ভবনে বাস করতে শুরু করেন, অনেকে নগরীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরো ছোট সম্প্রদায়ের মধ্যে স্থান করে নেন। সুফিবাদ অল্প কিছু লোকের গ্রহণ করা কোনো শাস্ত্র ছিল না। এটি জনপ্রিয় আন্দোলনও ছিল। প্রচণ্ড রকমের ব্যক্তিকেন্দ্রিক এই আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে আলেমদের প্রচলিত শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করতে বলত। অবশ্য অনেক সুফি শেখ মাদরাসাগুলোও সুফিবাদের শিক্ষা দিতেন। শেষ পর্যন্ত সুফিবাদ ইসলামি বিশ্বে মুক্ত চিন্তার চেতনা প্রবর্তন করে। সুফিরা বিশাল তরিকা গঠন করতে শুরু করে, তাদের অনেকে এই সময় জেরুসালেম নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে তাদের সদস্যরা খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের মতো দুনিয়া বিমুখ হওয়ার শিক্ষা দিতেন না। অত্যন্ত প্রভাবশালী কাদিরিয়া তরিকা, এর সদরদফতর ছিল পুরনো হসপিটাল কমপ্লেক্সে, শিক্ষা দিত যে সামাজিক ন্যায়বিচার হলো সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তব্য। জিহাদের জন্য আধ্যাত্মিক ও অন্তরাত্মার ইবাদত একসাথে জরুরি। আর এর সাথে থাকতে হবে বাস্তব অনুরাগ। নগরীর উত্তরে বিস্তামিয়ায় প্রতিষ্ঠিত বিস্তামিয়া তরিকা স্বপ্ন ও স্বপ্নবিভাব যে স্তরে থাকে, তাতে আরো গভীরভাবে মিশে যেতে তরিকার সদস্যদের আরো মনোযোগী করতে সহায়তার জন্য যোগ সাধনা শেখাত। এই তরিকায় সুলেহ কুল (সার্বজনীন সমন্বয় সাধন) নামের একটি কর্মসূচিও পরিচালনা করত। এতে বিভিন্ন ধর্মীয় ঐতিহ্য একে অপরকে বোঝা সহজ হতো। কয়েক শ’ বছরের ঘৃণা ও যুদ্ধের পর এটি ছিল পুনঃএকীকরণের একটি প্রচেষ্টা যা আল-কুদসের উত্তপ্ত নগরীতে ছিল খুবই মূল্যবান। 

রক্ষণশীল ও উদ্ভাবনশীলদের মধ্যকার সঙ্ঘাত চতুর্দশ শতকের সংস্কারক তাকিউদ্দিন ইবনে তাইমিয়ার রচনাবলীতেও দেখা যায়। তিনি জেরুসালেমের প্রতি নতুন তীব্র অনুরাগে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। তার মনে হয়েছিল, এটি ইসলামি ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মামলুক আমলে ফাজায়েল-কুদস শ্রেণির অন্তত ৩০টি নতুন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলোতে বারবার নগরীর পবিত্রতা নিয়ে পুরনো ঐতিহ্যগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে মুসলিমদেরকে জেরুসালেম জিয়ারতের আহ্বান জানানো হয়। অতি সঙ্গোপনে হারাম ভক্তির যে ব্যবস্থা প্রচারিত হয়েছিল, তাতে ইমাম তাইমিয়া বিরূপ হয়েছিলেন। আমরা দেখেছি, কিছু সময়ের জন্য মুসলিমরা জেরুসালেমে হজের কিছু শাস্ত্রাচার পালন করত। মক্কা থেকে আল-কুদস যে কিছু পবিত্রতা হাসিল করেছে, এটি ছিল তাদের ওই বিশ্বাস প্রকাশের পন্থা। ইবনে তাইমিয়া তার ছোট কিতাব ‘ইন সাপোর্ট অব পায়াস ভিজিটস টু জেরুসালেম’-এ জোর দিয়ে বলেছেন, মক্কার হজ থেকে আল-কুদস জিয়ারতকে আলাদা রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাবাঘরের মতো ডোম অব দি রকে তাওয়াফ করা ও চুমু খাওয়াও ভুল। ক্র্যাডল অব জেসাসের মতো ধর্মীয় স্থানগুলোর পুরোপুরি বানোয়াট, একমাত্র বোকারাই এসব বিশ্বাস করতে পারে। অবশ্য ইবনে তাইমিয়া তখনো বিশ্বাস করতেন যে জেরুসালেম ইসলামি বিশ্বের তৃতীয় পবিত্রতম নগরী। তবে তিনি পরিষ্কার করে দাবি করতেন যে জিয়ারত হতে পারে কেবল ব্যক্তিগত ভক্তি থেকে, হজের মতো এটি মুসলিমদের জন্য বাধ্যবাধকতাপূর্ণ নয়। ঐতিহ্য রক্ষা ও বিদায়াত (উদ্ভাবন) বন্ধ করতে তার প্রবল আগ্রহ ছিল ওই সময়ের বৈশিষ্ট্য। জেরুসালেম সম্পর্কে তার চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তারা তখনো ফাজায়েল আল-কুদস থেকে উদ্ধৃতি দিত, জেরুসালেমবিষয়ক সব মতবাদকে নির্ভুল মুসলিম ধর্মানুরাগ বিবেচনা করত। 

এই ধর্মানুরাগ সবসময় সহজেই পরিশীলিত করা সম্ভব হয় না। কোনো কোনো ফাজায়েলে জিয়ারতকে সাহসিকতা ও সহিষ্ণুতা প্রয়োজন হয়, এমন ধার্মিক কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়। মুহাম্মদের (সা.) উদ্ধৃতি দিয়ে নতুন একটি হাদিসে বলা হয়, যে ‘জেরুসালেমে বাস করবে, সে মনে করবে সে জিহাদে নিয়োজিত যোদ্ধা। অন্যরা আল-কুদস সফরের ‘অসুবিধা ও বিরূপতা’র কথা বলেন। চতুৰ্দশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ নাগাদ মামলুক ব্যবস্থায় প্রথম ফাটল দেখা যায়। নতুন সুলতানেরা তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে কঠিন অবস্থায় পড়েছিলেন। ক্রুসেডার আমলে জেরুসালেমে হামলা করতে ভয় পেত বেদুইনেরা। এখন তারা আবার ঘন ঘন আক্রমণ চালাতে শুরু করল। ১৩৪৮ সালে সত্যিই তারা নগরীর সব অধিবাসীকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ১৩৫১-৫৩ সময়কালে ‘ব্ল্যাক ডেথে’ জেরুসালেম ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়। তারপর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে গভর্নর নিযুক্ত হতেন একেবারে স্বল্প সময়ের জন্য। তারা আবার স্থানীয় পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞান থাকত না। পঞ্চদশ শতকের শুরুতে বেদুইন হামলা বাড়তে লাগল, খ্রিস্টান জলদস্যূরা ফিলিস্তিনের উপকূলীয় নগরীগুলোতে হানা দিতে লাগল। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ল, কর বেড়ে গেল। এছাড়া নগরীতে প্রায়ই দাঙ্গার সৃষ্টি হতো, এতেও হতাহতের ঘটনা ঘটত। এসব সমস্যা সত্ত্বেও ভবন নির্মাণ জিহাদ অব্যাহত ছিল। সুলতান আন-নাসির হাসান (১৩৪৭-৫১) ও আল-সালিহ সালিহ (১৩৫১-৫৪) আল-আকসা মসজিদের বড় ধরনের সংস্কার সাধন করেন। নগরী ও হারামের আশপাশে নতুন নতুন মাদরাসা ও রিবাত চালু হয়। এসব ফাউন্ডেশনের জন্য জেরুসালেমে অর্থ আসতে থাকে। তবে এসব অর্থ নগরীর অর্থনীতির জন্য সহায়ক হয়নি। কারণ মাদরাসাগুলো কোনো আয় সৃষ্টি করত না। 

অন্যান্য সময়ের মতো মুসলিম জেরুসালেমের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা খ্রিস্টান ও মুসলিমদের শান্তিপূর্ণভাবে একত্রে বসবাস আরো কঠিন করে তুলেছিল। ইহুদিরা ইসলামের প্রতি বৈরিতা অনুভব করত না। চতুর্দশ শতকে ইহুদি সম্প্রদায়কে সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছে সফরকারীরা। তবে এই কঠিন সময়ে নতুন অভিবাসীদের বেশির ভাগই গ্যালিলিতে বসবাস করতে চাইত এখানে অনেক বেশি সুযোগ ছিল। স্থানটি রাব্বানিক পবিত্র স্থানে পরিণত হয়েছিল। তীর্থযাত্রীরা এখন রাব্বি ইয়োহানান বেন জাক্কাই ও রাব্বি আকিভার মতো তালমুদীয় মহান পণ্ডিতদের কবরে প্রার্থনা করতে পছন্দ করত। কাব্বালবাদী ক্লাসিক জোহরের নায়ক রাব্বি সাইমিয়ন বেন ইয়োহইয়ের কাছে সাফেদ আরেকটি পবিত্র নগরীতে পরিণত হয়। বিশেষ করে মরমিবাদের দিকে ঝোঁকবিশিষ্ট ইহুদিরা এই স্থানের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হতো। মুসলিমরাও এসব কবরকে সম্মান জানাত। ইহুদি সফরকারীরা উল্লেখ করেছেন, ফিলিস্তিনে একই ধর্মীয় স্থানে ইহুদি ও ‘সারাসিনেরা’ যেত। স্থানীয় খ্রিস্টান ও আর্মেনিয়ানদের সাথে সুসম্পর্ক উপভোগ করত মুসলিমরাও। আল-কুদসের শান্তি বিঘ্ন ঘটাতে প্রধান সমস্যা সৃষ্টি করত মুসলিম ও পাশ্চাত্যের খ্রিস্টানদের মধ্যকার উত্তেজনা। এটি ছিল ক্রুসেডের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৩৬৫ সালে সাইপ্রাসের ঘাঁটি থেকে হসপিটালাররা আলেক্সান্দ্রিয়ায় আক্রমণ করলে মুসলিমরা পুরো ফ্রান্সিসক্যান সম্প্রদায়কে গ্রেফতার করে, হলি সেপালচার বন্ধ করে দেয়। ফ্রান্সিসক্যানরা কিছু না করেই এ পরিস্থিতির শিকার হয়ে ছিল, এমন নয়। তারা মাঝে মাঝেই আত্মঘাতী হামলা চালাতে শুরু করেছিল। ইসলামি বিশ্বের অন্যান্য অংশে অন্যান্য ফ্রান্সিসক্যান এ ধরনের হামলা শুরু করেছিল। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই তারা জেরুসালেমে মুসলিম এস্টাবলিশমেন্টে হামলা করত। ১৩৯১ সালের ১১ নভেম্বর তাদের একটি গ্রুপ আল-আকসায় গিয়ে কাজির সাথে কথা বলার দাবি জানাতে থাকে। তাদেরকে কাজির কাছে নিয়ে যেতেই তারা চিৎকার করে বলতে থাকে যে মুহাম্মদ ছিলেন ‘কামুক, খুনি, পেটুক, লুণ্ঠনকারী- যিনি মনে করতেন যে মানব- জীবনের উদ্দেশ্য হলো খাওয়া, সম্ভোগ, ও দামি পোশাক পরা। এই মৌখিক আক্রমণের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে ক্রুদ্ধ জনতা কাজির দরজার সামনে জড়ো হয়। নবীকে আক্রমণ করা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ হওয়ায় কাজি তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে তাদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার ধর্মীয় বিকল্প জানান। ফ্রান্সিসকানদের উদ্দেশ্যই ছিল এমনটি। তারা মুসলিমদেরকে বাধ্য করেছিলেন, তাদের যেন শহিদ করা হয়। তারা ‘বিধর্মীদের হাতে মৃত্যু ও নিন্দিত হতে চেয়েছিল।১২ ১৩৯৩ সালে এ ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটে। এ সময় তিন সন্ন্যাসী প্রকাশ্যে আলেমদের সাথে বিতর্কের আমন্ত্রণ জানিয়ে তারপর মুহাম্মদকে ভণ্ড হিসেবে অভিহিত করে কঠোর ভাষায় গালাগাল করতে থাকে। এসব ঘটনায় মুসলিম-খ্রিস্টান সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটায়। মুসলিমরা শোষিত ও অবহেলিত অনুভব করতে থাকে, হামলায় তাদের মনে হতে থাকে, সত্যিকারের সহাবস্থান অসম্ভব। 

এর ফলে উত্তেজনা বাড়তে থাকে, মুসলিমদের নির্মাণ জিহাদ অনেক সময় উদ্দেশ্যমূলক মনে হতে থাকে- এবং নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া হতে থাকে- অন্যান্য পবিত্র স্থানে আক্রমণ চালাতেই তা করা হচ্ছে। চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে রামবান সিনাগগ লাগোয়া এক মসজিদের একটি মিনার পুনর্নির্মাণ করা হয়। এই নির্মাণ পরবর্তীকালে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। ১৪১৭ সালে সালিহিয়া খানকার শেখ একটি মিনার নির্মাণ করেছিলেন। এটি হলি সেপালচারকে উস্কানিমূলকভাবে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। জেরুসালেমের মুসলিমরা বিশ্বাস করত, শেষ বিচারের দিনে এই কাজের জন্য তাকে পুরস্কৃত করা হবে। তবে স্বাভাবিকভাবেই মাউন্ট সায়নে ফ্রান্সিসকানদের সদরদফতরই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ আগ্রাসী সঙ্ঘাতের কেন্দ্ৰ। 

ফ্রান্সিসক্যানেরা ১৩০০ সালে সায়ন চার্চের স্থানটি কিনে নেয়। এর মধ্যে ছির তথাকথিত দাউদের কবর। ক্রুসেড আমলে স্থানটি আলোচনায় এসেছিল। এটি তেমন আকর্ষণীয় স্থান ছিল না। ইহুদি লোককাহিনীর প্রতি ফ্রানসিসক্যানদের দরদ ছিল সামান্যই। তারা যখন তীর্থযাত্রীদেরকে ঘুরিয়ে দেখাত, তখন নিউ টেস্টামেন্টের সাথে এর সম্পৃক্ততার ওপরই জোর দিত। সায়ন চার্চ মূলত ছিল প্রথমদিককার চার্চের স্মৃতি। তীর্থযাত্রীদের আপার রুম, পেন্টেকস্ট শ্রাইন, সেন্ট জন যেখানে ভার্জিন মেরির জন্য মাস করতে অভ্যস্ত ছিলেন বলে উল্লেখিত স্থানটি, পৃথিবীর বুকে জীবনের শেষে যেখানে মেরি ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলেন’ সেই স্থানগুলো দেখানো হতো। দাউদের কবর ও জুদার রাজাদের কবর প্রায়ই মাউন্ট সায়নের তীর্থযাত্রীদের ভাষ্যের শেষের দিকে উল্লেখ থাকত। তবে নগরীর ইহুদিরা হঠাৎ করেই উপলব্ধি করতে পারল যে জেরুসালেমের প্রথম ইহুদি রাজার করবটি খ্রিস্টান যাজকীয় এলাকায় ঢুকে গেছে। তারা বারবার সুলতান বার্সবেকে (১৪২২-৩৭ ) স্থানটি তাদের হাতে স্থানান্তর করতে বলতে লাগল। এটি ছিল ভুল কাজ। বার্সবেকে যখন বলা হলো, কবরটি নবী দাউদের, তখন তার পক্ষে এটিকে ইসলামের শত্রুদের হাতে সমর্পণ করা অসহ্যকর ব্যাপারে পরিণত হলো। তিনি মাউন্ট সায়নে নেমে এসে কবরটি এমনভাবে বন্ধ করে দিলেন যে ফ্রান্সিসক্যানদের পক্ষে তাদের কনভেন্ট থেকে এখানে প্রবেশ করা অসম্ভব হয়ে পড়ল। তিনি তারপর কবরটির সাজসজ্জা গুঁড়িয়ে দিয়ে একে মসজিদে রূপান্তরিত করলেন। সবশেষে তিনি আপার রুম, যা কেন্যাকল চার্চ নামেও পরিচিত ছিল, বন্ধ করে দিলেন। কারণ এটি ছিল সরাসরি দাউদের কবরের উপরে ছিল। নতুন মসজিদের ওপর দিয়ে হাঁটাহাটি করা খ্রিস্টানদের জন্য উপযুক্ত ছিল না।১৩ ল্যাতিন খ্রিস্টানদের সম্পর্কে বলা যায়, সহাবস্থান ও একীভূত করার পুরনো মুসলিম আদর্শ দ্রুত ক্ষয়ে পড়ছিল। 

মাউন্ট সায়নের ওপর তথাকথিত দাউদের কবরটি পঞ্চদশ শতক থেকে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে। বর্তমানে গোঁড়া ইহুদিরা তাদের ছেলেদের প্রথম চুল কাটানোর ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কৌশলে স্থানটির ওপর তাদের দাবি প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। 

সুলতান আল-জাহির জাকমাকের (১৪৩৮-৫৩) মাধ্যমে জিহাদ অব্যাহত থাকে। তিনি আক্ষরিক অর্থে আইনের বিধান প্রয়োগ করে অনুমতি ছাড়া জিম্মিদের উপাসনার স্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিষিদ্ধ করে দেন। তিনি সায়ন চার্চের বাকি অংশ বন্ধ করে দেন, কাছের কবরস্থানে সমাহিত সন্ন্যাসীদের হাড়গোড় তুলে ফেলেন। হলি সেচালচার চার্চে ‘অবৈধভাবে’ তোলা একটি কাঠের ঝুল বারান্দা আল আকসায় নিয়ে যান। বেথলেহেমের নতুন ভবনগুলোও ধ্বংস করা হয়। সিরিয়ার একটি কনভেন্টও বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবে সুলতানের সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল মূলত ল্যাতিনদের প্রতি। তিনি আর্মেনিয়ানদের অনুকূলে বিশেষ ফরমান জারি করে অপ্রয়োজনীয় করারোপ করে তাদের হয়রানি না করতে জেরুসালেমের আমিরকে নির্দেশ দেন। এই নির্দেশটি আর্মেনিয়ান কোয়ার্টারের পশ্চিম প্রবেশপথে একটি ফলকে খোদাই করা ছিল। আর্মেনিয়ানরা ক্রুসেডের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকলেও তারা ইসলামের কঠোর সমালোচক ও প্রবল ঘৃণা প্রদর্শন করত না। তারা ইতোমধ্যেই পক্ষ না নেওয়ার বিষয়টি শিখে ফেলেছিল। ফলে আগের তিন শত বছরের উত্থান-পতনে একমাত্র তাদের সম্প্রদায়ই নিজস্ব মহল্লা অটুট রাখতে পেরেছিল। 

নগরীতে এই উত্তেজনা সত্ত্বেও পাশ্চাত্যের বিপুলসংখ্যক তীর্থযাত্রী জেরুসালেম সফর করা অব্যাহত রাখে। তারা সবসময় স্বস্তিতে থাকতে পারত না। তবে তাদেরকে তারা যা দেখতে আসত, তা দেখতে দেওয়া হতো, তাদের সফর বেশ দক্ষতার সাথে সংগঠিত করা হতো। তারা একটি পুরো রাত হলি সেচালচারে কাটাত, নির্দিষ্ট সূচি অনুযায়ী পুরো নগরী পাহারা দিয়ে তাদেরকে ঘোরানো হতো। মুসলিমরা যাতে ক্ষুব্ধ না হয়, সেজন্য এর সূচনা হতো ভোরে। এটি শুরু হতো হলি সেপালচার চার্চ থেকে। সেখান থেকে তীর্থযাত্রীরা নীরবে নগরীর পূর্ব দিকে (বর্তমান তা লায়ন গেট নামে পরিচিত) অগ্রসর হয়ে কিদরন ভ্যালি দিয়ে গেথসেমানে যেত। তারপর তারা মাউন্ট অলিভেসের অ্যাসেনশন চার্চে যেত। তারা সিলোয়াম পুল দিয়ে নগরীতে ফিরে এসে শেষ পরিদর্শন স্থান হিসেবে মাউন্ট সায়নে যেতে পারত। বেথলেহেম ও রিভার জর্ডানেও তিন দিনের সফর কর্মসূচি ছিল। আগের মতোই তীর্থযাত্রীরা খুব কমই মসজিদ ও মাদরাসার কথা উল্লেখ করত, যদিও ফ্রান্সিসক্যানেরা হারামের বিশেষ খ্রিস্টান তাৎপর্যের ওপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে এর ইসলামিকরণের বিরোধিতা করত। তারা তখনো ডোম অব দি রককে বলত ‘টেম্পল অব দি লর্ড’। তাদের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ ছিল এখানেই শিশু হিসেবে ঈশ্বরের কাছে ভার্জিন মেরিকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। পরে তিনি টেম্পলের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, সেখানেই সেন্ট যোশেফের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। খ্রিস্টানেরা এখন জোর দিয়ে আল-আকসাকে ‘চার্চ অব আওয়ার লেডি’ হিসেবে অভিহিত করত। 

‘প্যাসন অব ক্রাইস্টের’ প্রতি ফ্র্যান্সিসক্যানদের বিশেষ ভক্তি ছিল। তারা যিশুর শেষ যন্ত্রণাদায়ক সময়ের সাথে সম্পর্কিত স্থানগুলোর দিকে নজর দিতে শুরু করেছিল। এখন ল্যাতিনদের সাথে সম্পর্কিত সব স্থান ছিল জেরুসালেমের উত্তর দিকের এলাকা। ক্রুসেড আমল থেকে শুরু হওয়া মাউন্ট সায়ন থেকে স্থানান্তর দৃশ্যত শেষ হয়ে আসছিল। ফলে জেরুসালেম সফরকারী জেমস অব ভেরোনা ১৩৩৫ সালে পুল অব বাথ-হেসদার কাছে অবস্থিত পূর্ব দিকের (লায়ন) গেট দিয়ে নগরীতে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি সেন্ট অ্যানার চার্চ (বর্তমানে সিলিহিয়া মাদরাসা) অতিক্রম করেন, বর্তমানে ভায়া ডোলোরোসা নামে পরিচিত সড়ক দিয়ে এগিয়ে যান। তাকে এই রাস্তায় থাকা আন্নাসের বাড়ি (বর্তমানে মসজিদ) ও হেরডের বাড়ি দেখানো হয়। তিনি পিলেতের বাড়ি’ (হ্যাড্রিয়ানের ফোরামের ‘ইচি হোমো আর্চ’, যিশুকে ক্রুশ বহন করে নিয়ে যেতে দেখে মেরি যেখানে মুর্ছা গিয়েছিলেন এবং যে স্থান দিয়ে যিশু নগরী ত্যাগ করেছিলেন, সেখানকার গেটের ধ্বংসাবশেষ দেখেন। হলি সেচালচার প্রাঙ্গনে প্রবেশ করেই জেমস অন্যান্য ‘কেন্দ্ৰে’ বিরতি নেন। গলগোথায় চড়ার আগে যিশু যেখানে বিশ্রাম নিয়েেিলন, সেখানকার আঙিনায় ফাটল ধরা একটি পাথর ছিল। ক্রুশটি তৈরি হওয়ার সময় চার্চের ভেতরে থাকা একটি গুহায় তাকে বন্দি রাখা হয়েছিল, সেখানেই তার পোশাক খুলে নেওয়া হয়েছিল। তারপর আসে খোদ গলগোথা, আনক্টশনের ব্ল্যাক স্টোন ও সবশেষে কবরটি। এসব স্থানের কিছু বদলে গিয়েছিল। ক্রসের স্টেশনগুলো কোথায়, তা আজ আর জানা যায় না। ফ্রান্সিসক্যানেরা যখন টর্চের আলোতে ভায়া ডোলোরোসা দিয়ে তীর্থযাত্রীদের নিয়ে যেত, তখন তারা বিপরীত দিক থেকে যেত। তবে মাঠ প্রস্তুত করা হয়েছিল। এখন হলি সেচালচারে ল্যাতিন খ্রিস্টানদের তেমন জায়গা ছিল না। তারা বাইরের অন্যান্য স্থানের পরিচর্যা করত। 

বর্তমানে ফ্রানসিসক্যানেরা জেরুসালেমের পবিত্র স্থানগুলোর সরকারি রোমান ক্যাথলিক অভিভাবক হিসেবে ডায়া ডোলোরোসার মালিকানা ভোগ করে। তবে মুসলিম অধিবাসীদের কারণে কিছুটা উদ্বেগে থাকে। 

জার্মান ডোমিনিক্যান ফেলিক্স ফ্যাবরি ১৪৮০ সালের দিকে জেরুসালেম সফর করে তার তীর্থযাত্রা সম্পর্কে প্রাণবন্ত রচনা লিখে গেছেন। তার জাহাজ জাফায় নোঙর করার সময়ই তিনি মুসলিম লোকজন ও ল্যাতিনদের মধ্যে তখন বিরাজমান উত্তেজনা সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন। মুসলিম কর্মকর্তারা প্রতিটি তীর্থযাত্রীকে শক্ত করে ধরে তার নাম ও ঠিকানা জানতে চাইছিলেন। তারপর ফেলিক্সকে ‘একটি বিধ্বস্ত ভল্টের নিচে অন্ধকারময় ও ক্ষয়ে যাওয়া স্থানে এমনভাবে ছুঁড়ে দিলেন যে দুধ দোহনের জন্য ভেড়াকেও এভাবে আস্তাবল থেকে নিক্ষেপ করা হয় না। ১৪ এখানে তার দোভাষী কাম গাইডকে নিয়োগ করেন। এই লোকই তার অবস্থানকালে মুসলিম বিশ্বের সাথে তার যোগসূত্র ছিল। আর ফ্রান্সিসক্যান কর্মচারীরা তীর্থযাত্রীদের কড়া বক্তৃতা দিয়েছিল। দোভাষী ছাড়া তারা কোনোভাবেই ঘোরাফেরা করতে পারবে না। দেয়ালে কিছু খোদাই করা যাবে না, মুসলিম নারীদের দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকানো বা প্রকাশ্যে মদ্যপান (এটি হয়তো মুসলিমদের মধ্যে ভয়াবহ বিদ্বেষ সৃষ্টি করত) নিষিদ্ধ। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মুসলিমদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক একেবারেই ছিল না। উত্তেজনা এখন এত বেশি ছিল যে কর্তৃপক্ষ আর স্থানীয় লোকজনের সহানুভূতিপূর্ণ আচরণের নিশ্চয়তা দিতে পারছিল না। 

এ ধরনের ভয়াবহ আপ্যায়নেও তীর্থযাত্রীর প্রবল আবেগ হ্রাস পায়নি। ফেলিক্স আমাদের বলছেন যে পবিত্র নগরী দেখামাত্র তারা তাদের গাধা থেকে লাফ দিয়েছিলেন, কান্নায় ভেঙে পড়লেন। হলি সেপালচার প্রথম দর্শনে তারা আরো বেশি কেঁদেছিলেন : ‘এ ধরনের হৃদয়ছোঁয়া আর্তনাদ, এ ধরনের মধুর কান্না, এ ধরনের গভীর দীর্ঘশ্বাস, এ ধরনের কষ্ট, এ ধরনের ফোঁপানো আসে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। ১৫ কোনো কোনো তীর্থযাত্রী জম্বির (জ্যান্ত লাশ) মতো ঘুরে বেড়াত, চলার পথে তাদের পশুগুলোকে বেদম প্রহার করত। নারীরা প্রসব যন্ত্রণার মতো করে কাতরাত, তীর্থযাত্রীরা লাশের মতো শুয়ে থাকত। তীর্থযাত্রীরা নিয়মিতভাবেই এত কাহিল হয়ে পড়ত যে তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতো। জেরুসালেমের প্রতি পাশ্চাত্যের ভক্তি উন্মাদনার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এখানে কোনো শৃঙ্খলাপূর্ণ ‘আরোহণপথ’ ছিল না, সত্যিকারের কোনো আধ্যাত্মিকতা ছিল না। এসব তীর্থযাত্রী দৃশ্যত তাদের আত্মকষ্টে ভুগত। 

অবশ্য পাশ্চাত্য ধর্মানুরাগও অন্যান্য পন্থায় বদলে যাচ্ছিল। ফেলিক্স নিজে তার প্রতিক্রিয়া এমন বিশ্লেষণাত্মকভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা আগেকার তীর্থযাত্রাগুলোতে দেখা যায়নি। তিনি দেখেছেন, তীর্থযাত্রা খুবই কঠিন কাজ। প্রচণ্ড রোদে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া, মাটিতে ভর করে চলা, সহজ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, কাজগুলো ঠিকমতো করা যাবে কিনা তা নিয়ে উদ্বেগও ছিল। ‘দৈহিকভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে হাঁটার সময় মানসিক বিমূর্ততায় সংগ্রাম ছিল ভয়াবহ রকমের শ্রমসাধ্য বিষয়। ১৬ ফেলিক্সও কয়েকটি স্থানের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। কিভাবে মূল কবরটি এত কাল অটুট থাকতে পারে? কেন দাউদের কবর আগে কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি?’ একটি নতুন কঠিন চেতনা আত্মপ্রকাশ করায় অনেক পাশ্চাত্য তীর্থযাত্রীর জন্য ঐতিহ্যবাহী তীর্থযাত্রাকে অসম্ভব করে তুলেছিল। 

তবে তীর্থযাত্রার স্বর্ণযুগ সম্ভবত শেষ হয়ে গিয়েছিল। সব প্রধান ধর্মই জোর দিয়ে বলাছিল, সত্যিকারের ধর্মীয় অভিজ্ঞতা অবশ্যই বাস্তব সহানুভূতির মাধ্যমে প্রকাশিত হতে হবে। এটি ছিল নির্ভুল আধ্যাত্মিকতার লিটমাস টেস্ট। অতীতে জেরুসালেম একে অপরের প্রতি বা অন্যান্য ধর্মের সদস্যদের প্রতি পরহিতপরায়ণ হতে খ্রিস্টানদের সহায়তা করেনি। ক্রুসেডারদের ধর্মের উদ্ভট অনুকরণকারী হিসেবে দেখা যেতে পারে : এটি আসলে মূর্তিপূজা, যেখানে পবিত্র স্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণে নেওয়াকেই বিবেচনা করা হয়েছে চূড়ান্ত লক্ষ্য। এখন আধুনিকতার প্রান্তে এসে সমালোচক ফেলিক্স জেরুসালেমের অন্যান্য অধিবাসী সম্পর্কে ভালো কোনো বলার অবকাশই বলতে গেলে পাননি। তিনি বলেন, সারাসেনরা সব ধরনের কপটতা করতে বলতে গেলে বাকি রাখেনি, তারা মূর্তিপূজকের চেয়েও জঘন্য, ইহুদিদের চেয়েও খারাপ;’ গ্রিক চার্চ একসময় জ্ঞানী হলেও এখন ‘সীমাহীন ভুলে নিমজ্জিত;’ সিরিয়ানরা ‘শয়তানের সন্তান;’ এবং আর্মেনিয়ানরা ধর্মভ্রষ্টতায় ডুবে আছে; ইহুদিরা বাকি সবার কাছে যথাযথ কারণেই ঘৃণিত, দুর্দশাগ্রস্ত জীবন ও অবমাননাকর অবস্থার কারণে তাদের বোধশক্তি ভোঁতা হয়ে যায়। জেরুসালেমের সব বাসিন্দার মধ্যে কেবল ফ্রান্সিসক্যানেরাই ধার্মিক জীবন নির্বাহ করে। তাদের ধর্মানুরাগের প্রধান চিহ্ন হলো পবিত্র নগরী জয়ের লক্ষ্যে নতুন ক্রুসেডের জন্য মন- প্রাণ উজাড় করা’ আকাঙ্ক্ষা।’ এই হতাশাজনক তালিকা প্রমাণ করে যে তীর্থযাত্রা ফেলিক্সকে তার মনে গেঁথে থাকা কোনো ধারণা থেকেই মুক্ত করেনি, বরং ঘৃণিত ও আত্ম-সত্যনিষ্ঠতার কানাগলিতে তাকে চালিত করেছে। 

সুলতান আল-আশরাফ কেতবের (১৪৬৮-৯৬) আমলে মামলুক সাম্রাজ্য শেষ অধ্যায়ে প্রবেশ করে। এশিয়া মাইনরের উসমানিয়া তুর্কিদের সেনাবাহিনী তাদের এলাকা দখল করে নিতে থাকে; বেদুইনরা নগরীতে বিপজ্জনক মাত্রায় হামলা চালাতে থাকে : ১৪৬১ সালে জেরুসালেমের প্রাচীরের বাইরে বেদুইন হামলায় ৬০ জন নিহত হয়। পর্তুগিজদের মাধ্যমে মামলুকদের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তবুও সুলতান জেরুসালেমকে অবহেলা করেননি। তিনি হারামের পশ্চিম দিকের প্রাচীরের বাইরে নতুন মাদরাসা চালু করেন। মামলুক ভবনগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে প্রাণবন্ত ছিল আশরাফিয়া মাদরাসা। মুজির উদ্দিন একে হারামের তৃতীয় রত্ন হিসেবে অভিহিত করেছেন। বালাদিয়া মাদরাসা ও হারামের বারান্দার ছাদের ওপর নির্মিত এ মাদরাসাটি হারামের সম্প্রসারণের দিক থেকেও ছিল অনন্য। এমনকি আল কুদসও যখন মামলুকদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল তখনো রকের প্রতি রাজবংশটির শেষ দিকের শাসকদের আকূলতার কারণেই চলে এসব নির্মাণকাজ। আবারো বলা উচিত, আশরাফিয়া মাদরাসা ইসলামের একীকরণকে প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল। এতে চার মাজহাব ও ৬০ সুফি ছিলেন। তবে সুলতান জেরুসালেমের ধর্মীয় উত্তেজনা হ্রাস করার চেষ্টাও করেছিলেন। ফ্রান্সিসক্যানেরা তার যৌবনকালে তার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। জেরুসালেমে নির্বাসিত থাকার বিষয়টি কেইতবে ভোলেননি। তিনি তাদেরকে মাউন্ট সায়ন ফিরিয়ে দেওয়া অনুমোদন করেছিলেন, সেখানে তারা আরো ঘিঞ্জি মহলে বাস করত, বর্বর নজরদারির মধ্যে থাকত তারা। ১৪৮৯ সালে তারা ঘুষ দিয়ে দাউদের সমাধি ও কেন্যাকল চ্যাপেলও ফেরত পেয়ে সেগুলো পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তবে পরের বছর আলেমদের এক সমাবেশে ঘোষণা করা হয় যে স্থানটি একসময় মসজিদ হওয়ায় তা খ্রিস্টানদের হাতে ফেরত দেওয়া অবৈধ। 

জেরুসালেমে মুসলিম ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্পর্কও এই শেষ বছরগুলোতে খারাপের দিকে মোড় নেয়। ১৪৭৩ সালে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে রামবান সিনাগগের অংশবিশেষ ভেঙ্গে পড়ে। এটি পুনঃনির্মাণের জন্য ইহুদিরা আবেদন করলে সংলগ্ন মসজিদের কর্মকর্তারা প্রতিবাদ জানান। তারা জানান, তাদের উচিত সিনাগগের আঙিনা না ডিঙিয়ে সরাসরি রাস্তা থেকে মসজিদে প্রবেশের সুযোগ লাভ করা। ইহুদিরা যথাযথ ঘুষ দিয়ে স্থানটি বহাল রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু এতে তাদের মুসলিম প্রতিবেশীরা ক্ষুব্ধ হয়ে এক রাতে সিনাগগটিই ভেঙ্গে ফেলে। অবশ্য সুলতান কুতসবে ইহুদিদের পছন্দ করতেন। তিনি সিনাগগটি আবার নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। এখন জেরুসালেমে মাত্র ৭০টির মতো ইহুদি পরিবার বাস করত। তাদের বেশির ভাগই ছিল গরিব, থাকত ভাঙ্গাচোরা বাড়িতে। তবে তাতে পুরোপুরি মুসলিমদের দোষ ছিল না। ইতালিয়ান পর্যটক ওবায়দিয়া দা বাতিনেরো উল্লেখ করেছেন, তিনি ১৪৮৭ সালে জেরুসালেম সফর করেছেন। ইহুদিদের প্রধান সমস্যা ছিল জার্মানি থেকে আগত আশকেনাজি ও স্পেন ও ইসলামি বিশ্বের অন্যান্য স্থান থেকে আসা সেফারদি ইহুদিদের মধ্যকার মতভেদ। ইহুদিদের এখন হারামে পা রাখা নিষিদ্ধ বলে ওবাদিয়া আমাদের বলছেন। অনেক সময় হারামের মেরামত কাজের প্রয়োজন হতো। কিন্তু তাদের শাস্ত্রীয় শুদ্ধতার ব্যবস্থা না থাকায় তাদের এসব কাজে নিয়োজিত করা হতো না। এই প্রথমবারের মতো স্ব-আরোপিত বিধিনিষেধের কথা আমরা শুনতে পাই। অনেক ইহুদি এখন পর্যন্ত তা মেনে চলছে। মাইমোনিদেসও একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন। জেরুসালেম সফরের সময় হারামে প্রবেশ করতে তিনি সক্ষম বলে মনে করেননি। এখন টেম্পল মাউন্ট তাদের কাছ থেকে আরো দূরে সরে গেল, ইহুদিদের জন্য নতুন পবিত্র স্থান প্রয়োজন পড়ল। ওবাদিয়া হারামের পশ্চিম দিকের সহায়ক প্রাচীর অতিক্রম করার সময় বিশেষ আবেগ অনুভব করেননি। প্রাচীরটি ছিল ‘বিশাল, ভারী পাথর দিয়ে তৈরি ছিল এ ধরনের পুরনো ভবন রোম বা অন্য কোনো নগরীতে আমি কখনো দেখিনি।১৯ ওয়েস্টার্ন ওয়াল তখনো জেরুসালেমে ইহুদিদের জন্য পবিত্র স্থান ছিল না। তবে এই অবস্থা অল্প সময় পরেই বদলে গিয়েছিল। 

ইতিহাসবিদ মুজিরউদ্দিন ১৪৯৬ সালের রচনায় মামলুকদের শেষ দিনগুলোতে জেরুসালেমের অবস্থা সম্পর্কে আমাদের মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন। মামলুক শতকগুলোতে জেরুসালেমের পবিত্রতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে মুসলিম কল্পনাশক্তিতে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তবে নগরী তখনো ছিল প্রাচীরবিহীন। এমনকি সেখানে কার্যত কোনো সেনাছাউনিও ছিল না। দুর্গের সান্ধ্যকালীন প্যারেড নিয়মিত হতো না, গভর্নর সাধারণ মানুষের মতো বাস করতেন। এমনকি মামলুকেরা হারামের ব্যাপারে ভালোবাসাময় অনেক মনোযোগ দিলেও তারা কখনো নগরীটিকে দুর্গ দিয়ে সুরক্ষিত করার উদ্যোগ নেয়নি। তাদের কাছে এই নগরী ছিল সম্পূর্ণভাবে কৌশলগত গুরুত্বহীন। মামলুকেরা অবশ্য নগরীর জাগতিক জীবনকে অবহেলা করেনি। মুজির আমাদের বলছেন, নগরীর ভবনগুলো দৃঢ়ভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল, মিনারগুলো ছিল বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর। হারামের প্রতি মামলুকদের ভক্তি নগরীর ফোকাস বদলে দিয়েছিল। ফলে নাগরিক জীবনের কেন্দ্র কনস্টানটাইনের আমল থেকে জেরুসালেমকে প্রাধান্য বিস্তারকারী ওয়েস্টার্ন হিল থেকে সরে হারাম এলাকায় নিবদ্ধ হয়েছিল। সালাউদ্দিন যখন প্রথম জেরুসালেম জয় করেন, তখন তিনি ও তার আমিরেরা হলি সেপালচারের পাশে বাস করেছিলেন। মুজিরের আমল নাগাদ গভর্নর বাস করতেন হারামের উত্তর সীমান্তের পাশে। প্রাচ্যের বেশির ভাগ নগরীর মতো জেরুসালেম ছিল নানা মহল্লায় বিভক্ত। জেরুসালেমের অধিবাসীরা তাদের ধর্ম ও জাতিগত উৎসের আলোকে বিভিন্ন মহল্লায় বাস করত। আমেনিয়ান ও মাগরিবিরা একসাথে বাস থাকত। আবার ইরান, আফগানিস্তান ও ভারতবর্ষের মুসলিমরা হারামের উত্তর-পশ্চিম কোণে বাস করত একত্রে। অবশ্য কঠোরভাবে বিভক্তি ছিল না। নগরীর দক্ষিণ দিকের এলাকায ইহুদি ও মুসলিমরা পাশাপাশিও বাস করত। একইভাবে উত্তর-পূর্ব দিকের বাজেথা এলাকায় খ্রিস্টান ও মুসলিমরা পাশাপাশি বাস করত। বিভক্তি তখনো সর্বগ্রাসী হয়নি। সুলতান আল-আশরাফ আকুক আল-গুরির (১৫১৩-১৬) রাজত্বকালে স্পষ্ট হয়ে যায়, মামলুকেরা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত উসমানিয়াদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ১৪৫৩ সালে উসমানিয়ারা কনস্টানটিনোপল দখল করে, পুরনো খ্রিস্টান সাম্রাজ্য বায়জানটিয়াম হজম করে নেয়। একসময় মনে হয়েছিল তারা ইউরোপও জয় করে নেবে। কিন্তু বেলগ্রেডে হাঙ্গেরি সেনাবাহিনী তাদের ঠেকিয়ে দেয়। তারপর ১৫১৫ সালে উসমানিয়া সুলতান প্রথম সেলিম আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেন। তিনি চালদিরান যুদ্ধে ইরানি অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ করেন, আলেপ্পোর উত্তরে মার্জ-দিবিকে মামলুকদের পরাজিত করেন। কায়রোর বাইরে অনুষ্ঠিত যুদ্ধে মামলুক সাম্রাজ্য কার্যত শেষ হয়ে যায়। ১৫১৬ সালের ১ ডিসেম্বর সেলিম জেরুসালেমের বাইরে উপস্থিত হন। কোনো প্রতিরোধ ছিল না। আলেমরা বাইরে এসে সুলতানের সাথে সাক্ষাত করে তার হাতে আল-আকসা ও ডোম অব দি রকের চাবি তুলে দেন। সাথে সাথে সেলিম তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নেমে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন : ‘শুকরিয়া আল্লাহ! আমি প্রথম কিবলার পবিত্র স্থানটির মালিক!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *